আরববাসীদের উপর কোরআনের আশ্চর্য প্রভাব
কোরায়েশদের শত বাধা সত্ত্বেও দিন-দিন ইসলামের প্রভাব আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলছিল। এর মূলে ছিল পবিত্র কোরানের অলৌকিক প্রভাব। নিম্নের ঘটনা কয়টিই বাস্তবতা প্রমানের জন্য যথেষ্ট।
প্রথম দিকে প্রায় তিন বছর কাল হুজুর (সঃ) ইসলামের দাওয়াত গোপনে দিতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ্র নির্দেশে তিনি প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনা করেন, আর এই সময়ই শুরু কোরায়েশদের সাথে সংঘাত। এ সময় কোরায়েশ সর্দাররা একদিকে মুহাম্মাদের (সঃ) দরিদ্র ও দুর্বল সাথীদের উপরে নানারূপ শারিরীক নির্যাতন শুরু করে এবং স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদকে (সঃ) নানারূপ প্রলোভন দ্বারা সত্য পথ হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে।
নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে কোরায়েশ নেতাদের প্রস্তাবক্রমে তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উতবা বিন রাবিয়াকে হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) নিকট একটি আপোষ প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হয়। উতবা হুজুরের খেদ্মতে হাজির হয়ে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করেন যে, হে মুহাম্মাদ (সঃ) তুমি এ নতুন মতবাদ পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমাকে আমাদের নেতা করে নেব। যদি তুমি ধনের আকাঙ্ক্ষা করো, তাহলে আমরা তোমাকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী করে দেব। আর যদি তুমি সুন্দরী মহিলার লোভ রাখ, তাহলেও আমরা তোমার সেই বাসনা পুর্ন করে দেব”। হুজুর বললেন, নেতৃত্ব, ধন আর নারী কেন, তোমরা যদি আমার এক হাতে আকাশের সূর্য ও অন্য হাতে চন্দ্রও এনে দাও তবুও আমি এ মতবাদ ত্যাগ করতে পারব না। অতঃপর হুজুর সূরায়ে হামিমের কয়েকটি আয়াত তাঁর সামনে তিলাওয়াত করলেন।
উতবা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উহা শ্রবণ করল। তাঁর বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল এবং ভিতর হতে সে তাঁর সমস্ত শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলল। অতঃপর সে সেখানে ফিরে গেল, যেখানে কোরায়েশ দলপতিরা তাঁর পথ চেয়েছিল এবং মনে মনে একটি শুভ সংবাদের আশা করছিল।
উতবা কোরায়েশ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “দেখ তোমরা মুহাম্মাদকে বাধা দিও না। অতঃপর যখন তাঁর দাওয়াত কোরায়েশদের এলাকার বাইরে চলে যাবে, তখন অকুরায়েশদের সাথে মুহাম্মাদের সংঘর্ষ হবে। সে সংঘর্ষে যদি মুহাম্মাদ পর্যুদস্ত হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ। কেননা তোমাদের শত্রু ধ্বংস হল, অথচ তোমাদেরকে সংঘাতে লিপ্ত হতে হল না। আর যদি মুহাম্মাদ জয়ী হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কেননা তোমাদের কোরায়েশ বংশেরই একটি লোক আরবদের নেতা হবে”।
এহেন প্রস্তাবে উপস্থিত নেতারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এবং অনুসন্ধান করে জানতে পারল যে, মুহাম্মাদের (সঃ) মুখ নিঃসৃত কোরআনের বাণী শুনেই উতবা অভিভূত হয়ে পড়েছে, ফলে মুহাম্মাদের সম্পর্কে সে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেছে।
অনুরূপ আর একটি ঘটনা ঘটে আবিসিনিয়ায়। তখন নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। কোরায়েশদের উৎপীড়নে জর্জরিত হয়ে হুজুর (সঃ) প্রথমে ষোলজন এবং পরে তিরাশিজন মুসলমান নর নারীর দুটি দলকে আবিসিনিয়ায় প্রেরন করেন। আবিসিনিয়ায় ইসায়ী শাসক নাজাশী ছিলেন অত্যন্ত সুবিচারক এবং প্রজাবৎসল। তিনি মুসলমানদেরকে তাঁর দেশে বসবাসের আদেশ দিয়েছিলেন। এদিকে কোরায়েশ সর্দারগন এটা জানতে পেরে একটি যোগ্য প্রতিনিধি দলকে প্রচুর উপঢৌকনসহ নাজাশীর দরবারে পাঠাল। তাঁরা নাজাশীর খেদমতে হাজির হয়ে উপঢৌকন পেশ করে বলল, মহারাজ, কিছু যুবক- যুবতী কিছু গোলাম আমাদের নেতাদের অবাধ্য হয়ে তাদের অনুমতি (ছাড়পত্র) ছাড়াই আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে ফেরত নেয়ার জন্যই আমাদেরকে আপনার খেদমতে পাঠানো হয়েছে। দয়া করে আপনি তাদেরকে আমাদের হাতে সমর্পন করবেন”। দরবারকারীরাও পলাতকদের ফেরত দেয়ার পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু বাদশাহ বললেন, তাদের বক্তব্য না শুনে আমি তাদেরকে ফেরত দিতে পারি না। অতঃপর তাদেরকে ডাকা হল এবং কেন তাঁরা দেশ ত্যাগ করে এসেছে তা বলতে বলা হল।
মুসলিম দলের নেতা হযরত আলীর ভ্রাতা হযরত জাফর দাঁড়িয়া বললেন, “জাহাঁপনা, আমরা ইতিপুর্বে মুর্তিপুজাসহ নানারূপ কুসংস্কারে লিপ্ত ছিলাম। মারামারি, খুন-খারাবী, রাহাজানি ও লুটতরাজ ছিল আমাদের নিত্য- নৈমিত্তিক কাজ। ইতিমধ্যে আল্লাহ্ মেহেরবানী করে আমাদের ভিতরে একজন নবী পাঠালেন। তিনি আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্র দাসত্ব গ্রহণ করতে, সত্য কথা বলতে। আত্নীয়- স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে, গরীব- মিসকিনদের প্রতি সদয় হতে এবং খুন- খারাবী ও লুটতরাজ পরিত্যাগ করে পবিত্র জীবন- যাপন করতে আহবান জানালেন। আমরা তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর দ্বীন গ্রহণ করি। ফলে আমাদের গোত্র নেতারা আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে আমাদের পয়গাম্বরের আদেশে আপনার দেশে হিজরত করে এসেছি। এখন যদি আপনি আমাদেরকে এই কোরায়েশ দূতদের হাতে অর্পণ করেন তাহলে আমাদের আর কোন উপায় নেই”।
বাদশাহ্ হযরত জাফরের এই তেজস্বীনি ও হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য শুনে খুবই প্রীত হলেন এবং বললেন, তোমাদের পয়গাম্বরের উপরে যে কালাম অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর কিছু আমাকে শুনাতে পার? হযরত জাফর , হযরত ঈসা ও হযরত মরিয়ম সম্পর্কীয় সূরায়ে মরিয়মের কয়েকটি আয়াত সুললিত কন্ঠে
**************
পাঠ করে তাঁকে শোনালেন। নাজাশীর দুচোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগলো। তিনি অন্তরে এক স্বর্গীয়- শান্তি অনুভিব করলেন এবং বললেন, সৃষ্টিকর্তার শপথ ইঞ্জিল আর যে কালাম এখন আমাকে শুনান হ উভয়ই একই মূল হতে এসেছে। অতঃপর তিনি কোরায়েশ দূতগণকে লক্ষ্য করে বললেন, ফিরে যাও, আমি এ নিরাপরাধ লোকগুলিকে তোমাদের হাতে অর্পন করতে পারব না”
এদিকে কোরায়েশরা অধীর আগ্রহে দূতদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল। তারা ভেবে ছিল পলাতক লোকগুলিকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে দূতগণ মক্কায় ফিরবে। কিন্তু দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে দূতগণ যখন খালি হাতে ফিরে এল, তখন তারা আশ্চর্য হয়ে কারণ জানতে চাইল। দূতগণ বলল, জাফরের মুখে কোরআন শুনেই বাদশাহ বিগড়ে গেলেন। নতুবা আমরা তাদেরকে ফেরত আনতে পারতাম।
কোরায়েশরা আরেকবার অনুভব করল যে, কোরআনের অলৌকিক প্রভাবই তাদের সর্বনাশের মূল কারণ।
কোরআন শুনে কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে অভিভূত হয়ে নবূয়তের প্রথম দিকে যারা ঈমান এনেছিলেন, তাদের ভিতরে দক্ষিণ আরবস্থ ইয়ামানী কবি তোফায়েল ইবনে দোসীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরবে তখন কবিদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হত। ফলে তোফায়েল ইবনে দোসীর ইসলাম গ্রহণে আরব দেশে এক তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দোসী গোত্রের সমস্ত লোকই তার প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করে।
বনি সলিম গোত্রের বিজ্ঞ ব্যক্তি কায়েস ইবনে নাসিরাও হুজুরের মুখনিঃসৃত কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। পরে তিনি বাড়ী ফিরে গিয়ে তার গোত্রে লোকদের একত্র করে বললেন, দেখ, রোম ও পারস্যের সেরা কবি সাহিত্যিকদের কথাবার্তা ও রচনাদি শুনার ভাগ্য আমার হয়েছে, হামিরের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের কথাবার্তা আমি ঢের শুনেছি। কিন্তু মুহম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআনের বাণীর সমতুল্য আমি কারো কাছেই কিছু শুনি নাই। পরবর্তী সময় তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর গোত্রের প্রায় এক হাজার লোক ইসলাম কবুল করেছিলনে।
আজাদ গোত্রের সর্দার জামাদ ইবনে ছায়ালাবাও নবীর মুখে কোরআন শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নেতৃস্থানীয় কোরায়েশ যুবকের ভিতরে হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণও ছিল কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপঃ
নবুয়তের তখন নবম বর্ষ। আবু জাহেল দ্বারে-নোদয়ায়ে কোরায়েশ নেতাদের এক সম্মেলন ডাকল। অতঃপর সকলকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী ভাষায় মুহম্মদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে একটি নাতি-দীর্ঘ বক্তৃতা করল। আর কোরায়েশ যুবকদের এই বলে উসকাল,” এই একটি মাত্র লোক আমাদের জাতিধর্ম ইত্যাদি সবকিছু উলট পালট করে দিল। অথচ কেউ এ শত্রুকে নিপাত করতে পারল না। আমি আজ জনসমক্ষে ঘোষণা করছি, যে বীর যুবক মুহম্মদের (সঃ) ছিন্ন মস্তক আমাদের কাছে হাজির করতে পারবে। আমি তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং একশত উট পুরস্কার দিব।”
ঘোষণার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতার ভিতর হতে বলিষ্ঠ দেহ, বিশাল বক্ষ, যুবক উমর নাংগা তলোয়ার হাতে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল,
“এই আমিই যাই, মুহম্মদের ছিন্ন মস্তক না নিয়ে আর ফিরব না।” জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল, আর মহাবীর উমর তলোয়ার নিয়ে রওয়ানা হলো।
পথিমধ্যে বন্ধু নঈমের সাথে তার সাক্ষাৎ হল। নঈমের এই ক্রোধাবস্থা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল এ অসময় উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তুমি কার সর্বনাশ করতে বের হয়েছ? বলল, ”মুহম্মদের (সঃ) মুন্ডপাত করতে। সে আমাদের সবকিছুই ওলট-পালট করে দিয়েছে।”
নঈম যে গোপনে ইসলাম কবুল করেছিলেন, উমর তা জানত না। নঈম রসূলকে (সঃ) উমরের আক্রোশ হতে বাঁচাবার জন্যে বললেন, “ আরে মুহম্মদের মাথা তো নিবে, কিন্তু বাড়ীর খবর রাখো তো? তোমার ভগ্নি ফাতেমা ও ভগ্নিপতি সাঈদও যে ইসলাম কবুল করেছে।” উমর আঁতকে উঠে বলল: “ হায় সর্বনাশ! আমারই ঘরে? আমি এক্ষণেই ঠিক করে দেব,” এই বলে সে বোনের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো।
তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ। সাঈদ ও ফাতেমা কোরআনের লিখিত কিছু অংশ পাঠ করছিলেন। হঠাৎ উমরের আগমনধ্বনি শুনে তারা উহা লুকিয়ে ফেললেন। উমর জিজ্ঞেস করল, এই মাত্র কি পাঠ করছিলে। ফাতেমা বললেন, কই তুমি কি শুনেছ? উমর ক্রোধভরে সাঈদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে প্রহার করা শুরু করল। আর বলল, মুহম্মদের দ্বীন কবুল করেছ, এবার মজা দেখে নাও। ফাতেমা ঠেকাতে গিয়ে আহত হল। তার জখম হতে রক্ত ঝরছিল। উমর রক্ত দেখে থমকে দাঁড়াল এবং বলল, হতভাগিনী মুহম্মদের (সঃ) দ্বীন কবুল করেছিস? ফাতেমাও ছিল মহাবীর খাত্তাবের মেয়ে। জখম হয়ে নির্ভীক কন্ঠে উত্তর দিলেন, “তুমি যত পার মার। মুহম্মদের(সঃ) দ্বীন কবুল করেছি, তা পরিত্যাগ করব না।” বোনের এই কঠোর ও নির্ভীক উক্তিতে উমর সচকিত হল এবং বলল, তোমরা যা পাঠ করছিলে তা আমাকে দাও। ফাতেমা উত্তর দিলেন আগে তুমি অজু করে পবিত্র হও তারপরে দেব। উমর পবিত্র হওয়ার পর তাকে তা দেয়া হল। এতে সূরায়ে তোয়াহার অংশ বিশেষ লেখা ছিল। উমর মনোনিবেশ সহকারে তা পাঠ করল। অতঃপর কোরআনের ভাষা ও অন্তর্নিহিত ভাব উমরকে একেবারেই অতিভূত করে ফেলল। সে একান্তভাবে অনুভব করল যে, এ কালাম কিছুতেই মানব রচিত নয়। কম্পিত কন্ঠে উমর ঘোষণা করলেন,
أَشْهَدُ أنْ لا إلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
”আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহম্মদ (সঃ) তাঁর রাসূল।”
অতঃপর তিনি বললেন,
“ কোথায় নূর নবী, আমাকে তাঁর পদপ্রান্তে নিয়ে চল” ফাতেমা আর সাঈদের তখন আনন্দের আর সীমা থাকলো না। তারা হযরত উমরকে নিয়ে হুজুর (সঃ) যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে হাজির হলেন। হুজুরের (সঃ) সঙ্গীরা উমরকে আসতে দেখে দারুন বিচলিত হলেন। কিন্তু হুজুর (সঃ) বললেন উমরকে আসতে দাও।
উমর ভিতরে প্রবেশ করেই তলোয়ার হুজুরের (সঃ) পদপ্রান্তে রেখে দিয়ে ঘোষণা করলেন,
أَشْهَدُ أنْ لا إلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
”আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহম্মদ (স) আল্লাহর রাসূল।”
হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের খবর বিদ্যুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে দ্বারে নোদওয়ায়ে মুহম্মদের ছিন্ন মস্তক হস্তে মহাবীর উমরের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় যারা ছিল, তাদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। তারা বুঝতেই পারাল না যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন কি ঘটনা ঘটল, যার ফলে মাথা নিতে গিয়ে মাথা দিয়ে আসলো।
অনুসন্ধান করে জানলো। বোনের বাড়িতে কোরআন পাঠ করেই তাঁর এ দুর্দশা। কোরায়েশরা আর একবার চরমভাবে অনুভব করল যে, কোরআনই তাদের সব অঘটনের মূল।
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত জোবায়ের ইবনে মোতেমও কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। এসব ঘটনা দৃষ্টে কাফের ও মুশরেক নেতাদের আর বুঝতে বাকী থাকল না যে, কোরআনের কারণেই তাদের এ বিপর্যয়। মুহম্মদ (স) তো কোরআন নাযিলের আগেও তাদের ভিতরে ছিল। কিন্তু কই, তখন তো সে তাদের জাতি বা সমাজের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। কোরআন অবতীর্ণের পর হতেই তো তাদের এ বিপর্যয়। কোরআন শুনে ওৎবার মত প্রখর বুদ্ধিমান লোকটি বু্দ্ধি হারিয়ে ফেলল। আবার এই কোরআনের আকর্ষনেই নাজাশী কোরায়েশ দূতদেরকে খালি হাতে ফেরত দিল, উমরের মত পাষাণ হৃদয় কোরআনের যাদু স্পর্শে মাথা নিতে দিয়ে মাথা নিয়ে আসল। প্রসিদ্ধ কবি তোফায়েল বিন দোসী, জামাদ, জোবায়ের, প্রভৃতি গোত্র সর্দারগণ কোরআনের বাণীতে মুগ্ধ হয়েই কোলে আশ্রয় নিল।
[কোরআনের এই অলৌকিক প্রভাবের কথা স্বীকার করে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন,
”এই পুস্তকখানার সাহায্যেই আরবরা আলেকজন্ডার ও রোম অপেক্ষাও বৃহত্তর ভূ-ভাগ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। রোমের যত শত বছর লেগেছিল তাদের বিজয় সম্পূর্ণ করতে আরবদের লেগেছিল তত দশক। এরই (কোরআনের) সাহায্যে সমস্ত সেমিটিক জাতির মধ্যে কেবল আরবরাই এসেছিল ইউরোপের রাজারূপে। নতুবা ফিনিসীয়রা এসেছিল বণিকরূপে। আর ইহুদীরা পলাতক কিংবা বন্দীরূপে।”]
সুতরাং কাফের সর্দারগণ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তারা নিজেরাও কোরআন শুনবে না এবং কোরআনের আওয়াজ যাতে কোন লোকের কাছে না পৌঁছে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আল্লাহ তাদের এ সিদ্ধান্তে কথা নিম্নলিখিত আয়াত দ্বারা রাসূলকে জানিয়ে দিলেন
﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ﴾
﴿فَلَنُذِيقَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا عَذَابًا شَدِيدًا وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
”আর কাফেররা বলে, কেহই কোরআন শুননা এবং কোরআন তেলাওয়াতের সময় শোরগোল কর, তাহলেই তোমাদের পরিকল্পনা কার্যকরী হবে। আমি এসব কাফেরদেরকে কঠোর শাস্তির স্বাদর গ্রহণ করাব এবং তাদেরকে এ অপকর্মের উপযুক্ত প্রতিফল দেব।” (সুরা হামিম সিজদা, আয়াত-২৬-২৭)