উত্তোলিত তলোয়ার কোষবদ্ধ হলো
যুদ্ধের এক ময়দান। মুসলমানদের সাথে কাফিরদের ভীষণ যুদ্ধ চলছে। হযরত আলী (রা) জনৈক বিপুল বলশালী শত্রুর সাথেঞ যুদ্ধে মত্ত রয়েছেন। বহুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর তাকে কাবু করে ভূপাপিত করলেন এবং তাকে আঘাত হানার জন্য তাঁর জুলফিকার উর্ধে উত্তোলন করলেন। কিন্তু আঘাত হানার আগেই ভুপাতিত শত্রুটি তাঁর চেহারা মুবারকে থুথু নিক্ষেপ করলো। ক্রোধে হযরত আলীর চেহারা রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো। মনে হলো, এই বুঝি তাঁর তরবারি শতগুণ বেশী শক্তি নিয়ে শত্রুকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলে। কিন্তু তা হলো না। যে তরবারিটি আঘাত হানার জন্য উর্ধে উত্তোলিত হয়েছিল এবং যা বিদ্যুৎ গতিতে শত্রুর দেহ লক্ষ্যে ছুটে যাচ্ছিল, তা থেমে গেল। শুধু থেমে গেল নয়, ধীরে ধীরে তা নীচে নেমে এল। পানি যেমন আগুনকে শীতল করে দেয়, তেমনিভাবে আলীর ক্রোধে লাল হয়ে যাওয়া মুখমন্ডলও শান্ত হয়ে পড়ল।
হযরত আলীর এই আচরণে শত্রুটি বিস্ময় বিমূঢ়। যে তরবারি এসে তার দেহকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলার কথা, তা আবার কোষবদ্ধ হলো কোন কারণে? বিস্ময়ের ঘোরে শত্রুর মুখ থেকে কিছুক্ষণ কথা সরল না। এমন ঘটনা সে দেখেনি, শোনেওনি কোনদিন। ধীরে ধীরে শত্রুটি মুখি খুলল। বলল, “আমার মতো মহাশত্রুকে তরবারির নীচে পেয়েও তরবারি কোষবদ্ধ করলেন কেন?”
হযরত আলী বললেন, “আমরা নিজের জন্য কিংবা নিজের কোন খেয়াল খুশীঅ চরিতার্থের জন্য যুদ্ধ করিনা। আমরা আল্লাহর পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যুদ্ধ করি। কিন্তু আপনি যখন আমার মুখে থুথু নিক্ষেপ করলেন তখন প্রতিশোধ গ্রহণের ক্রোধ আমার কাছে বড় হয়ে উঠল। এ অবস্থায় আপনাকে হত্যা করলে সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হতোনা। বরং তা আমার প্রতিশোধ গ্রহণ হতো। আমি আমার জন্য হত্যা করতে চাইনি বলেই উত্তোলিত তরবারি ফিরিয়ে নিয়েছি। ব্যক্তিস্বার্থ এসে আমারকে জিহাদের পুণ্য থেকে বঞ্চিত করুক, তা আমি চাইনা।”
শত্রু বলল, “আমিদূর থেকে এতদিন আপনাদের উদারতা, মহানুভবতা ও সত্যনিষ্ঠার কথা শুনেছি, আজ তা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করলাম।”
শত্রুটি ভূমি শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সংগে সংগে তাওবা করে ইসলাম কবুল করল। এমন অদম্য অতুল্য বীরের ক্ষুদ্ধ হৃদয়েও এত বেশী ক্ষমা এবং স্বস্তি গুণ বিদ্যমান থাকে, এত বড় যোদ্ধা চরম মুহূর্তেও এমন ভীষণ শত্রুকে এতটুকু কর্তব্য বোধে ছেড়ে দিতে পারেন, এত বাড় জিতেন্দ্রীয় এত বড় ক্ষমাশীলের ইতিহাস আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি-একথা শত্রু অকুণ্ঠ চিত্তেই স্বীকার করে নিল।
‘ধন্য সেই বিধান যা খলীফা পর্যন্ত খাতির করেনা’
৬৫৮ সাল। হযরত আলী (রা) খলীফার আসনে। তাঁর ঢাল চুরি গেল। চুরি করল একজন ইহুদী। খলীফা আলী কাযীর বিচার প্রার্থী হলেন।কাযী আহবান করলেন দু’পক্ষকেই। ইহুদি খলিফার অভিযোগ অস্বীকার করল। কাযী খলীফার কাছে সাক্ষী চাইলেন। খলিফা হাজির করলেন তাঁর এক ছেলেকে এবং চাকরকে। কিন্তু আইনের চোখে এ ধরণের সাক্ষী অচল। কাযী খলিফার অভিযোগ নাকচ করে দিলেন।
মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও কোন বিশেষ বিবেচনা তিনি পেলেন না।ইসলামী আইনের চোখে শত্রুমিত্র সব সমান।
ইহুদি বিচার দেখে অবাক হল। অবাক বিস্ময়ে সে বলে উঠল, “অপূর্ব এই বিচার,ধন্য সেই বিধান যা খলীফাকে পর্যন্ত খাতির করে না,আর ধন্য সেই নবী যার প্ররণায় এরূপ মহৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে। হে খলিফাতুল মুসলিমিন, ঢালটি সত্যিই আপনার,আমিই তাচুরি করেছিলাম। এই নিন আপনার ঢাল। শুধু ঢাল নয়, তার সাথে আমার জান-মাল,আমার সবকিছু ইসলামের খেদমতে পেশ করলাম”।
সত্য তার আপন মহিমায় এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে।
অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা ও এক হাজার দিনার
হযরত উসমানের (রা) শাসন কাল। নীল ভূমধ্যসাগর তীরের তারাবেলাস নগরী। পরাক্রমশালী রাজা জার্জিসের প্রধান নগরী এটা। এই পরাক্রমশালী রাজা ১লক্ষ ২৯ হাজার সৈন্য নিয়ে ‘আবদুল্লাহ ইবন সাদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। স্বয়ং রাজা জার্জিস তাঁর বাহিনীর পরিচালনা করছেন। পাশে রয়েছে তাঁর মেয়ে। অপরূপ সুন্দরী তাঁর সে মেয়ে।
যুদ্ধ শুরু হল। জার্জিস মনে করেছিলেন তাঁর দুর্ধষ্য বাহিনী এবার মুসলিম বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দেবে। কিন্তু তা হল না। মুসলিম বাহিনীর পাল্টা আঘাতে জার্জিস বাহিনীর ব্যুহ ভেংগে পড়ল। উপায়ান্তর না দেখে তিনি সেনা ও সেনানীদের উৎসাহিত করার জন্য ঘোষণা করলেন, “যে বীর পুরুষ মুসলিম সেনাপতি আবদুল্লাহর ছিন্ন শির এনে দিতে পারবে, আমার কুমারী কন্যাকে তার হাতে সমর্পন করবো।”
জার্জিসের এই ঘোষণা তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যে উৎসাহের এক তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি করল। তাদের আক্রমণ ও সমাবেশে নতুন উদ্যোগ ও নতুন প্রাণাবেগ পরিলক্ষিত হলো। জার্জিসের সুন্দরী কন্যা লাভের উদগ্র কামনায় তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠল। তাদের উন্মাদ আক্রমণে মুসলিম রক্ষা ব্যুহে ফাটল দিল। মহানবীর শ্রেষ্ঠ সাহাবা হযরত যুবাইরও সে যুদ্ধে শরীক ছিলেন। তিনি সেনাপতি সাদকে পরামর্শ দিলেন, “আপনিও ঘোষণা করুন, যে তারা বেলাসের শাসনকর্তা জার্জিসের ছিন্নমুন্ড এনে দিতে পারবে, তাকে সুন্দরী জার্জিস দুহিতাসহ এক হাজার দিনার বখশিশ দেব।” যুবাইরের পরামর্শ অনুসারে সেনাপতি সা‘দ এই কথাই ঘোষণা করে দিলেন।
তারাবেলাসের প্রান্তরে ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হলো। যুদ্ধে জার্জিস পরাজিত হলেন। তাঁর কর্তিত শিরহস জার্জিস কন্যাকে বন্দী করে মুসলিম শিবিরে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু এই অসীম সাহসিকতার কাজ কে করল? এই বীরত্বের কাজ কার দ্বারা সাধিত হলো? যুদ্ধের পর মুসলিম শিবিরে সভা আহূত হলো। হাজির করা হলো জার্জিস-দুহিতাকে। সেনাপতি সা‘দ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের মধ্যে যিনি জার্জিসকে নিহত করেছেন, তিনি আসুন। আমার প্রতিশ্রুত উপহার তাঁর হাতে তুলে দিচ্ছি।”
কিন্তু গোটা মুসলিম বাহিনী নীরব নিস্তব্ধ। কেউ কথা বলল না, কেউ দাবী নিয়ে এগুলোনা। সেনাপতি সা‘দ বার বার আহবান জানিয়েও ব্যর্থ হলেন। এই অভূতপূর্ব ব্যাপার দেখে বিস্ময়ে হতবাক হলেন জার্জিস দুহিতা। তিন দেখতে পাচ্ছেন তাঁর পিতৃহন্তাকে। কিন্তু তিনি দাবী নিয়ে আসছেন না কেন? টাকার লোভ, সুন্দরী কুমারীর মোহা তিনি উপেক্ষা করছেন? এতি বড় স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারে জগতের ইতিহাসে এমন জিতেন্দ্রীয় যোদ্ধা-জাতির নাম তো কখনও শুনেননি তিনি। পিতৃহত্যার প্রতি তাঁর যে ক্রোধ ও ঘৃণা ছিল, তা যেন মুহূর্তে কোথায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। অপরিচিত এক অনুরাগ এসে সেখানে স্থান করে নিল।
অবশেষে সেনাপতির আদেশে জার্জিস দুহিতাই যুবাইরকে দেখিয়ে দিলেন। বললেন, “ইনিই আমার পিতৃহন্ত, ইনিই আপনার জিজ্ঞাসিত মহান বীর পুরুষ।” সেনাপতি সা’দ যুবাইরকে অনুরোধ করলেন তাঁর ঘোষিত উপহার গ্রহণ করার জন্য।
যুবাইর উঠে দাঁড়িয়ে অবনত মস্তকে বললেন, “জাগতিক কোন লাভের আশায় আমি যুদ্ধ করিনি। যদি কোন পুরস্কার আমার প্রাপ্য হয় তাহলে আমাকে পুরস্কৃত করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।”
মূর্তির নাকের বদলে মানুষের নাক
একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ চৈ পড়ে গেল। কে একজন গত রাত্রে যীশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলেছে। খ্রীষ্টানরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ধরে নিল তারা যে, এটা একজন মুসলমানেরই কাজ। খ্রীষ্টান নেতারা মুসলিম সেনাপতি আমরের কাছে এলো বিচার ও অন্যায় কাজের প্রতিশোধ দাবী করতে। আমর সব শুনলেন। শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। ক্ষতিপূরণ স্বরুপ তিনি প্রতিমূর্তিটি সম্পূর্ণ নুতন করে তৈরী
করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রীষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ নেবার বাসনা ছিল অন্যরুপ। তাদের সংকল্প প্রকাশ করে একজন খ্রীষ্টান বলল, “যীশুখৃষ্টকে আমরা আল্লাহর পুত্র মনে করি। তাঁর প্রতিমূর্তির এরুপ অপমান হওয়াতে আমরা অত্যন্ত আঘাত পেয়েছি। অর্থ এর যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ নয়। আমরা চাই আপনাদের নাবী মুহাম্মদের প্রতিমূর্তি তৈরী
করে ঠিক অমনি ভাবে তাঁর অসম্মান করি।” একথা শুনে বারুদের মত জ্বলে উঠলেন আমর। ভীষন ক্রোধে মুখমন্ডল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষন নীরব থেকে নিজেকে সংযত করে নিয়ে তিনি খৃষ্টান বিশপকে লক্ষ্য করে বললেন,”আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি তাতে রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত,যার নাক আপনারা চান।” খৃষ্টান নেতারাও সকলে একমত হয়ে এ প্রস্তাব গ্রহন করলো। পরদিন খৃষ্টান ও মুসলমানরা বিরাট এক ময়দানে হাজির হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন,”এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার।
যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসন দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহন করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।”
এই কথা বলেই তিনি বিশপকে একখানা তীক্ষ্মধার তরবারি হাতে দিলেন। জনতা স্তব্দ হয়ে দাড়িয়েছে, খৃষ্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে
ভাব।সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সহসা সেই নীরবতা ভংগ করে একজন মুসলিম সৈন্য এলো। চিৎকার করে বলল, “আমিই দোষী—সিপাহসালারের কোন অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাসিকা কর্তন করেছি, এই তা আমার হাতেই আছে।” সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিল।
স্তম্ভিত বিশপ। নির্বাক সকলে। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তরবারি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিশপ বললেন,”ধন্য সেনাপতি, ধন্য এ বীর সৈনিক,আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ,যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মত মহৎ,উদার,নির্ভিক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যীশু খৃষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা অন্যায় হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতেও
অন্যায় হবে যদি আজ আমি এই সুন্দর ও জীবন্ত দেহের অঙ্গহানী করি। সেই মহান ও আদর্শ নাবীকেও আমার ছালাম জানাই।”
শত্রুকে নিজের তরবারি দান
চতুর্থ খলীফা বীরবর আলী। বিস্ময়কর তার শক্তি, সাহস ও ওউদার্য।
এক যুদ্ধের ময়দানে বিপুল বিক্রমে তিনি যুদ্ধ করছেন।
একজন বলিষ্ঠ ও সাহসী সৈন্য তার দিকে অগ্রসর হয়ে প্রচন্ড বেগে তাকে আক্রমণ করল। তুমুল যুদ্ধ চললো। অকস্মাত আলীর আঘাতে শত্রুর তরবারি ভেঙ্গে গেল। শত্রুকে অসহায় দেখে আলী তরবারি কোষ বন্ধ করলেন। শত্রু মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। আলীকে ক্ষান্ত হতে দেখে সে বিস্মিত হলো। সে আলীর কাছে আর একখানি তরবারি চাইতেই আলী ততক্ষণাত দ্বিধাহীন চিত্তে নিজের তরবারি খানি তাকে দিয়ে দিলেন। শত্রু অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে ব-ইলো . এভাবে নিজেকে অরক্ষিত করে যে বীর অন্যের প্রার্থনা পুর্ণ করে, তার সঙ্গে তো যুদ্ধ অসম্ভব। শত্রু জিজ্ঞাসা করলো, “হে বীর শ্রেষ্ঠ আলী, আপনি কেন এভাবে নিজেকে বিপদের মুখে টেলে দিয়ে নিজের তরবারি দান করলেন?” আলী উত্তর দিলেন, “কিন্তু আমি যে কারও প্রার্থনা অপুর্ণ রাখিনে।” শত্রু অম্লান বদনে আলীর এই মহত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। সত্যের কাছে অসত্য এমনিভাবে পরাজয় স্বীকার করেছে – যুগে যুগে। সত্যের মহিমা মিত্যার গর্বকে জয় করেছে।
সত্য-ন্যায়ের শক্তি পশুত্বকে জয় করেছে, অস্রের চাকচিক্য, মৃত্যুর ভ্রুকুটিকে ম্লান করেছে-উপেক্ষা করেছে।
উবাদা ইবনে সামিতের শপথ রক্ষা
খলীফা উমার (লা) শাসনকাল। মুয়াবিয়া তখন সিরিয়অর শাসনকর্তা। মদীনার খাযরাজ গোত্রের হযরত উবাদা ইবন সামিত গেলেন সিরিয়ায়। বাইয়াতে রিদওয়ানে শরীক আনসার উবাদা ইবন সামিত সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে দুনিয়ার কোন মানুষকেই ভয় করেন না। সিরিয়ায় ব্যবসা ও শাসনকার্যে কতকগুলো অনিয়ম দেখে তিনি ক্রোধে জ্বলে উঠলেন।
দামেশকের মসজিদ। সিরিয়ার গভর্ণর মুয়াবিয়াও উপস্থিত মসজিদে। নামাযের জামাত শেষে হযরত উবাদা ইবন সামিত উঠে দাঁড়িয়ে মহানবীর (রা) একটি হাদীস উদ্ধৃত করে তীব্র ভাষায় অভিযুক্ত করলেন হযরত মুয়াবিয়াকে। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। মুয়াবিয়ার পক্ষে তাঁর মুখ বন্ধ করা সম্ভব হলো না। একা উবাদা ইবনে সামিত গোটা সিরিয়াকে যেন নাড়া দিলেন। ইতোমধ্যে হযরত উমার (রা) ইন্তিকাল করেছেন। অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে হযরত মুয়াবিয়া তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানকে (লা) লিখলেন, “হয় আপনি উবাদাকে মদীনায় ডেকে নিন, নতুবা আমিই সিরিয়া ত্যাগ করব। গোটা সিরিয়াকে উবাদা বিদ্রোহী করে তুলেছে।”
উবাদাকে মদীনায় ফিরিয়ে আনা হলো। মদীনায় এসে হযরত উবাদা সোজা গিয়ে হযরত উসমানের (রা) বাড়ীতে উঠলেন। হযরত উসমান (রা) ঘরে বসে, ঘরের বাইরে প্রচুর লোক। তিনি ঘরে ঢুকে ঘরের এক কোণে বসে পড়লেন। হযরত উসমান (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, “কি খবর।” হযরত উসমানের কথার উত্তরে উবাদা উঠে দাঁড়ালেন। স্পষ্টবাদী, নির্ভীক উবাদা বললেন, “স্বয়ং মহানবীর উক্তি পরবর্তী কালের শাসকরা অসত্যকে সত্যে এবং সত্যকে অসত্যে পরিণত করবে। কিন্তু পাপের অনুকরণ বৈধ নয়, তোমরা কখনও অন্যায় করো না।”
হযরত আবু হুরাইরা (রা) কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হযরত উবাদা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যখন আমরা মহানবীর (সা) হাতে বাইয়াত করি, তখন তোমরা ছিলে না, কাজেই তোমরা অনর্থক কথার মাঝখানে বাধা দাও কেন? আমরা সেদিন মহানবীর (সা) হাতে বাইয়াত করি, তখন তোমরা ছিলে না, কাজেই তোমরা অনর্থক কথার মাঝখানে বাধা দাও কেন? আমরা সেদিন মহানবীর (রা) কাছে শপথ করেছিঃ সুস্থতা ও অসুস্থতা সব অবস্থায়ই আপনাকে মেনে চলব, প্রাচুর্য় ও অর্থ সংকট সব অবস্থায়ই আপনাকে অর্থ সাহায্য করব, ভাল কথা অন্যের কাছে পৌঁছাব, অন্যায় থেকে সবাইকে বারণ করব। সত্য কথা বলতে কাকেও ভয় করবো না।”
হযরত উবাদা এসব শপথের প্রতিটি অক্ষর পালন করে গেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত। তাঁকে কিচু অসিয়ত করতে বলা হলে তিনি বললেন, “যত হাদীস প্রয়োজনীয় ছিল, তোমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছি, আর একটি হাদীষ ছিল, বলছি শুন।” হাদীস বর্ণানা শেষ হবার সাথে সাথেই হযরত উবাদা ইবন সামিত ইন্তিকাল করলেন।
ইয়ারমুকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল যারা
ইয়ারমুক প্রান্তরে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এটা এক মরণ পণ সংগ্রাম। রোম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নিপুণ সেনাপতি ম্যানোয়েল বা মাহান দুই লক্ষেরও অধিক সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ৪০ হাজার সৈন্যের এক ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর উপর। একদিন নয় দুদিন নয়, ৫ দিন যুদ্ধ চলছে। রোমক ন্যৈদের পায়ে শৃঙ্খল লাগানো হয়েছে যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে না পারেন। অর্থাৎ জিততে না পারলে আত্মবলি দেবে এই দুর্জয় পণ নিয়েই রোমকরা যুদ্ধে নেমেছে। একদিন যুদ্ধ করতে করতে ইয়ারমুক বিজয়ের সুলস্তম্ভ মহাবীর খালিদ ইবন ওয়ালিদের হাত অবিরাম তরবারী চলনায় প্রায় অবশ হয়ে পড়ল।
এটা দেখে হারেস ইবনে হিশাম প্রধান সেনাপতি আবু উবাইদাকে বললেন, ‘খালিদের তলোয়ারের হক যতখানি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী খালিদ করে দেখিয়েছেন। তাঁকে এবার আরাম দেয়া দরকার। হযরত আবু উবাইদা তাঁর কথায় সায় দিয়ে খালিদের সমীপবর্তী হয়ে তাঁকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বললেন। খালিদ তার উত্তরে বললেন, “আমি সব রকমে সবদিকে চেষ্টা করে শাহাদাত লাভের আশা করি, আমার নিয়ত আল্লাহ তায়ালাই জানেন।” বলে তিনি শত্রু ব্যুহে ঢুকে পড়লেন। দু‘লক্ষাধিক রোমক সৈন্যের বিরুদ্ধে ৪০ হাজার মুসলিম সৈন্যের প্রত্যেকে এ ভাবেই লড়ে যাচ্ছে।
একদিকে যখন এই অবস্থা আহতদের কাতারে আর এক দৃশ্য। আবু জাহিম ইবনে হুজাইফা আহত নিহতদের সারিতে তাঁর চাচাতো ভাইকে খুঁজে ফিরছিলেন। তাঁর কাঁধের মশকে পানি। খুঁজতে খুঁজতে তিনি তাঁর ভাইকে পেয়ে গেরেন। সে তখন মুমূর্ষ। যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে। ইশারায় সে পানি চাইল। হুজাইফার ভাই পানি পান না করে পাশের হিশাম ইবন আবিল আসের কাছে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে যেতে বললেন। হুজাইফা যখন হিশামের কাছে পৌঁছলেন, তখন পাশের আর একজন মুমূর্ষ সাহাবী পানি পান করতে চাইলো। হিশাম ইংগিতে প্রথমে তাকেই পানি দিতে বললেন। হুজাইফা যখন পানি নিয়ে পাশের সাহাবীর কাছে পৌঁছলেন, তখন তাঁর রূহ ইহজগত ছেড়ে চলে গেছে। হুজাইফা ফিরে এলেন হিশামের কাছে। কিন্তু হিশামও ততক্ষণে জান্নাতহবাসী হয়েছেন। হুজাইফা ফিরে গিয়ে তার চাচাতো ভাইকেও আর পেলেন না। ততক্ষণে শাহাদাত বরণ করেছেন তিনিও।
অদ্ভুত এ ত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব আর মমত্ববোধ। তাঁরা পরস্পরে মিলে এমন সিসার প্রাচীর গড়ে তুলতে পেরেছিলেন বলেই সেদিন মাত্র চল্লিশ হাজার ন্যৈ ইয়ারমুক প্রান্তরে সমগ্র এশিয়ার সম্মিলিত খৃষ্টান শক্তির বিজয়ের প্রাণান্ত প্রচেষ্টাকে শোচনীয় পরাজয়েল অতল পঙ্কিলে ডুবিয়ে দিতে পেরেছিল।
রোমান সেনাপতি মাহানের তাঁবুতে খালিদ বিন ওয়ালিদ
ইয়ারমুকের যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। সম্রাট হেরাক্লিয়াসের প্রধান সেনাপতি মাহানের অধীনে কয়েক লক্ষ সৈন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। এমন সময় ময়দানের অপর প্রান্তে মুসলিম শিবিরে খবর এল, রোমক সেনাপতি মাহান মুসলিম দূতের সাথে দেখা করতে চান। এই আহবান অনুসারে মুসলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি আবু উবাইদার নির্দেশে খালিদ ১০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে মাহানের শিবিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। কয়েক লক্ষের বিশাল বাহিনীর মধ্য দিয়ে বীরদর্পে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ১০০ জন সাথী সহ মাহানের দরবারে গিয়ে পৌঁছলেন।
রোমক সেনাপতি মাহান চাইলেন রোমক সৈন্যের শান শওকত ও রোমক দরবারে ঐশ্বর্য দেখিয়ে মুসলমানদেরকে দুর্বল করে দিতে। কিন্তু হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত ও কিংখাব খচিত চেয়ারগুলো সরিয়ে রেখে মেঝেতে নিঃসংকোচে আসন গ্রহণ করলেন, তখন যে মাহান মুসলমানদেরকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল সে নিজেই মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ল। তারপর মাহানের সাথে খালিদের অনেক বিষয়ে তর্ক বিতর্ক হল। মাহান এক সময় বললেন,মুসলিম সৈন্যের প্রত্যেককে একশত দিনার, আবু উবাইদাকে তিনশত দিনার এবং খলীফাকে দশ হাজার দিনার আমি দান করছি, বিনিময়ে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে হবে। খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু পাল্টা দাবী উত্থাপন করলেন, হয় জিযিয়া দিন, নয়তো ইসলাম গ্রহণ করুন। মাহান খালিদের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে বলেন, ঠিক আছে তলোয়ারের সব ফায়সালা করে দেবে।উত্তরে খালিদ বললেন,যুদ্ধের বাসনা আপনাদের চেয়ে আমাদেরই বেশি এবং আমরা অবশ্যই আপনাদেরকে পরাজিত করব।বন্দী করে খলীফার দরবারে হাজির করব।
মাহান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল, দেখ, চেয়ে দেখ তোমরা, এখনই তোমাদের সামনে তোমাদের পাঁচজন বন্দী বীরকে হত্যা করছি। সঙ্গে সঙ্গে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, তুমি আমাদেরকে মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছ অথচ মৃত্যুই আমাদের কাম্য। মুসলমানদের জীবন তো মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয়। কিন্তু জেনে রাখ, কোন বন্দীর গায়ে যদি হাত তোল তাহলে এখনই তোমাকে আমরা সদল বলে হত্যা করব। তোমাদের সংখ্যাধিক্যের পরোয়া আমরা করি না।
লক্ষ লক্ষ রোমক সৈন্য পরিবেষ্টিত শিবিরে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই বীরত্বপূর্ণ কথা মাহানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিল। সে খাপ থেকে তলোয়ার বের করার জন্য তলোয়ারের বাঁটে হাত দিল। শিবিরে উপস্থিত কয়েকশ রোমক সৈন্যও প্রস্তুত হয়ে দণ্ডায়মান। কিন্তু তলোয়ার বের করার সুযোগ সে পেলনা। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক লাফে তার সমীপবর্তী হয়ে তার বুকে তলোয়ারের অগ্রভাগ ঠেকিয়ে নির্দেশ দিলেন,সব প্রহরীদের অস্ত্র ফেলে দিতে বল, এবং কেউ যাতে কোন বাধা দিতে এগিয়ে না আসে, সে নির্দেশ ঘোষণা কর। ভীত ও বিস্ময় বিস্ফোরিত মাহান সে নির্দেশ পালন করল।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার সাথীগণ সহ বিশাল সৈন্যসারির মধ্য দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে স্বীয় তাঁবুতে এসে পৌঁছলেন।
সেনাপতি হলেন সাধারণ সৈনিক
সিরিয়ার রণক্ষেত্র। সিরিয়ায় মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক খালিদ সৈন্য পরিচালনা করছেন। মদীনা থেকে খলিফা হযরত উমারের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দূত শাদ্দাদ ইবনে আউস খালিদের পদচ্যুতি এবং সেনাপতি আবু উবাইদার প্রধান সেনাপতি মনোনয়নের চিঠি নিয়ে এলেন সিরিয়ায়। সিরিয়ার সেনাশিবির। সকল সৈনিক ও সেনাধ্যক্ষরা উপস্থিত। খলীফার দূত শাদ্দাদ সকলের সামনে সর্বাধিনায়ক খালিদের পদাবনতি এবং আবু উবাইদার প্রধান সেনাপতি পদে মনোনয়নের কথা ঘোষণা করলেন। সেনা ও সেনাধ্যক্ষদের পিনপতন নীরবতা। নীরবভাবে খালিদও খলীফার নির্দেশনামা পাঠ শুনলেন। তারপর নীরবে নতমুখে তিনি সেনাপতির থেকে পিছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। শূন্যস্থান পূরণ করলেন গিয়ে আবু উবাইদা।
সর্বাধিনায়ক খালিদ সাধারণ সৈন্যের সারিতে মিশে গেলেন। এই পদাবনতিতে খালিদের চোখ কি ক্রোধে জ্বলে উঠেছিল? কিংবা অপমানে তাঁর মুখ কি লাল হয়ে উঠেছিল? অথবা তাঁর গণ্ডদ্বয় বেয়ে কি দুঃখের অশ্রু নেমে এসেছিল? না, এগুলোর কিছুই হয়নি তাঁর। সিরিয়া মরু দেশের প্রান্তর থেকে প্রান্তরে ঘোরা খালিদের রোদপোড়া লাল মুখটিতে তাঁর আগের সেই উজ্জ্বল হাসি-সেই শান্ত স্বর্গীয় নুরানী দীপ্তি তখনও। তাঁর শির মুহুর্তের জন্য আনত হয়েছিল খলীফার নির্দেশ মাথা পেতে নেবার জন্য। তারপর তাঁর শির আগের মতই উন্নত। সে শিরে লজ্জা অপমান কোন স্থান পেলনা, দুঃখের কালিমাও তাঁকে স্পর্শ করতে পারলো না। তিনি পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে বললেন, “হযরত উমার (রা) কোন হাবশী গোলামকেও যদি আমার নেতা মনোনীত করতেন, তবু তাঁর আদেশ সানন্দে মেনে আমি জিহাদ চালিয় যেতাম। আর হযরত আবু উবাইদা তো কত উঁচু দরের লোক।”
পদাবনতির ফলে কোন স্বাভাবিক নিরুৎসাহও কি হযরত খালিদকে ঘিরে ধরেছিল? তিনি উৎসাহ উদ্দীপনা-গতিবেগ হারিয়ে ফেলেছিলেন? না। কোনটিই নয়। পদচ্যুত হবার পর মুহুর্তেই সেনাপতি আবু উবাইদার নির্দেশে তিনি আব্দুল্লাহ ইবন জাফরের সাহয্যে এক রণক্ষেত্রে ছুটে যান, প্রাণপণ যুদ্ধ করেন, জয়ীও হন সেখানে।
এই আনুগত্য, এই আন্তরিকতা এই নিবেদিতপ্রাণ চিত্ততার কোন নজির ইতিহাসে নেই। একজন প্রধান সেনাপতি দেশের পর দেশ জয় করলেন, যিনি পেলেন সৈন্য ও সেনাধ্যক্ষদের অকুন্ঠ ভালবাসা ও আনুগত্য, তিনি বিনাবাক্য ব্যয়ে পদাবনতি মেনে নিয়ে অধীনস্ত সেনাধক্ষ্যদের অধীনে সাধারণ সৈনিকের মত পূর্বের ন্যায় একই আন্তরিকতা নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, নেতৃত্ব ও সামরিক শৃংখলার প্রতি এমন সম্মান প্রদর্শন অপরূপ-বিস্ময়কর। বিস্ময়কর নয় শুধু ইসলামের ইতিহাসে-মুসলমানদের জন্য, যারা যুদ্ধ করে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য; ধন মান পদের লোভে নয়।
উহুদের হিন্দা ইয়ারমুকে
যেই হিন্দা উহুদ যুদ্ধে শহীত হামজার কলিজা চিবিয়েছিলেন, সেই হিন্দা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় লাভের পর নতুন এক জীবনে বিমূর্ত হয়ে উঠলেন। যে রূপে আমরা তাঁকে উহুদ প্রান্তরে দেখেছিলাম তার বিপরীত রূপে আমরা তাঁকে দেখি ইয়ারমুক রণক্ষেত্রে।
ইসলামের বিস্ময়কর আবির্ভাব ও অব্যুত্থানে পূর্বরোম সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা বিচলিত হয়ে পড়েন। রোম সাম্রাজ্যের পাশেই ইকটি শক্তিশারী রাষ্ট্রের অভ্যুদয় তাঁর অস্তিত্বের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর। তাই মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংস করার জন্য রোমান শাসনকর্তা বিরাট বাহিনী সমাবেশ করলেন ইয়ারমুক প্রান্তরে। মুসলিম বাহিনীও এসে তাদের মুখোমুখি দাঁড়াল। হিন্দা তখন বেঁচে আছেন। তুষার শুভ্র কেশ। জীর্ণ দেহ। বেশ কিচু সংখ্যক মহিলার সংগে তিনি ইয়ারমুযক রণাংগনে আসেন।
কাতারে কাতারে মুসলিম সৈন্য অগ্রসর হয়ে চলেছে। যুদ্ধ আরম্ভ হলো। বিপুল রক্তক্ষয়ী সে সংগ্রাম। অপূর্ব সাহস ও বীরত্বের সাথে মুসলিম সৈন্য যুদ্ধ করতে লাগলো। কিন্তু বিপুল শত্রুসৈন্যের সম্মুখে তারা অধিকক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না। পেছনে হটতে লাগলো। মুসলিম সৈন্যের পরাজয় আসন্ন হয়ে দেখা দিল। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা তাঁবুর দিকে ছুটতে লাগলো। হঠাৎ রণক্ষেত্রে হিন্দা তাঁর সাথীদের নিয়ে উপস্থিত হলেন। চীৎকর করে তিনি মুসলিম সৈন্যদের সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, “কাপুরুষ, কোন মুখে তোমরা পরাজয় বরণ করে ফিরে আসছো, তোমাদের লজ্জা করেনা? হচে যদি আসতে চাও, তবে এই নাও আমাদের অলংকার, আমাদের মুখাবরণ, তাঁবুতে প্রবেশ কর। আমরা নরীরা তোমাদের অশ্বে আরোহণ করে যুদ্ধ করবো। জয়লাভ করবো।” হিন্দার এই তেজোদীপ্ত উক্তিতে মুহূর্তে যুদ্ধের গতি ফিরে গেল। নবীন উৎসাহে পূর্ণ তেজে মুসলিম সৈন্য ফিরে দাঁড়ালো। অমিতবিক্রমে রোমান সৈন্যদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করল। সেই আক্রমণের বেগ তারা সহ্য করতে পারলো না। শোচনীয় পরাজয় বরণ করল রোমান বাহিনী।
ইকরামা ইবন আবু জাহলের শাহাদাত
ইসলামের মখর শত্রু ইকরামা ইবন আবু জাহল ইসলামের সশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ইসলাম গ্রহণের আগে একদিন যে কট্টর শত্রু ছিল, ইসলাম গ্রহণের পর সে হয়ে উঠল একজন জানবাজ মুজাহিদ। তাঁর প্রাণে জ্বলে উঠল ঈমানের আগুন-শহীদের রক্তবীজ সঞ্চারিত হলো তাঁর প্রাণমূলে। অন্ধকার থেকে আলোয় এসেছেন তিনি। আলেঅর স্পর্শ তাঁকে পাগল করে তুলেছে। সংগ্রামের প্রাণশক্তি তাঁর প্রাণ জগত থেকে উপছে উঠছে। কিন্তু এ প্রাণশক্তি তিনি রাখবেন কোথায়? শীঘ্রই সুযোগ এল। এল যুদ্ধের ডাক। ইকরা সাড়া দিলেন সে ডাকে। যুদ্ধে শামিল হলেন ইকরামা ইবন আবু জাহল।
ভীষণ যুদ্ধ চলছে ইয়ারমুকে। সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য প্রাণের আবেগে ইকরামা প্রাণপণ সংগ্রামে নিরত। বাতিলের রক্তে স্নান করে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে- শহীদের রক্ত শয্যায়। পাশেই কিচু দূরে ছিলেন মহান সেনানায়ক খালিদ ইবন ওয়ালিদ। তিনি দেখতে পেলেন ভূমি শয্যায় শায়িত ইকরামা ইবন আবু জাহলকে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। ইকরামার কাছে এসে তিনি ঘোড়া থেকে দ্রুত নামলেন। ইকরামার জীবনী শক্তি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে আসছিল। খালিদ তাঁর মাথা তুলে নিলেন কোলেণ। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে ইকরামা বললেন, “খলীফা উমার আমার শাহাদাত লাভেল শক্তিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। আজ আমার আনন্দ যে, আমার জীবন্ত বিশ্বাসের প্রমাণস্বরূপ আমি শহীদ হতে চলেছি।” শাহাদাতে আকুল পিয়াসা ইকরামাকে পাগল করে তুলেছিল। সেই পিয়াসা নিয়ে ইকরামা শাহাদাত বরণ করলেন।
যুদ্ধশেষে পা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন হারারা ইবনে কায়েস
ইয়ারমুকের প্রান্তর। মুসলিম ও রোমক বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ২লক্ষ ৪০ হাজার রোমক সৈন্যের নেতৃত্ব করছেন রোম সমপ্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র স্বয়ং। মুসলিম বাহিনীর অধিনায়কত্ব সরছেন সেনাপতি আবু উবাইদাহ এবং তাঁর অধীনে রয়েছেন খালিদ ইবন ওয়ালিদ। ২লক্ষ ৪০হাজার রোমক সৈন্যের মুকাবিলা করার জন্য খালিদ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীকে এক অপূর্ব কৌশলে ৩৬টি দলে বিভক্ত করলেন। তারপর মুসলিম বাহিনী তার ঐতিহ্য অনুযায়ী রোমক শিবিরে সত্যেল দিকে আহবান জানিয়ে শান্তির বার্তা প্রেরণ করল। রোমকরা এর জবাব দিল অস্ত্রের মাধ্যমে।
পুনঃপুনঃ পরাজয়ের গ্লানিতে রোমক বাহিনী ক্ষিপ্ত জানোয়ারের মত আপতিত হলো ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর উপর। কিন্তু আঘাতের পর আঘাত খেয়ে রোমক বাহিনীই অবশেষে পিছু হটল, মুসলিম বাহিনীকে হটাকে পারল না এক ইঞ্চিও।
পরুদিন আবার আক্রমন শুরু হল। রোমক বাহিনীই আবার আক্রমণ করল। কিন্তু সেদিন মুসলিম বাহিনী শুধু আত্মরক্ষা নয়, পাল্টা আক্রমণ চালাল। রোমকরা সেদিন জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ইঠেছে, আর মুসলনামরা তো হয় জয় নয় শাহাদাতের আকাংখা নিয়েই যুদ্ধে নেমেছেন। সুতরাং সেদিন ইয়ারমুক প্রান্তরে যে যুদ্ধ শুরু হল তার বর্ণনা অসম্ভব। শত্রুনিধন ছাড়া কারো কোন বাহ্যিক জ্ঞান পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। অদ্ভুত সে দৃশ্য। ২লক্ষ ৪০ হাজার রোমক সৈন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বলীয়ান, আর ৪০ হাজার মুসলিম সৈন্যের একমাত্র শক্তিই হলো তাদের ঈমান-সত্যের জন্য জীবন দেয়ার অদম্য আকাংখা। এক এক মুসলিম সৈন্য সেদিন একশ’ জনে পরিণত হয়েছিল। অবশেষে রোমক শক্তি নেতিয়ে পড়ল, পরাজিত হলো। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শত্রু হননে তখন মত্ত তারা। সেনাপতি সৈনিকদের মত্ততা দূর করার জন্য যুদ্ধবিরতির বাদ্য ধ্বনি করতে আদেশ দিলেন। সৈনিকদের সম্বিত ফিরে এলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে তারা যখন চারদিকে চাইলেন, দেখলেন, চারদিকে রোমক সৈন্যের লাশ ছাড়া আর কিছু নেই। মুসলিম সৈন্যের মত্ততা সম্পর্কে জনৈক ঐতিহাসিক লিখেছেন, “ইয়ারমুক যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যরা শত্রু নিধনে এমনি একাগ্র ছিল যে, হারারা ইবন কায়েসের একটি পা যে কখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সে টেরই পায়নি। যুদ্ধ শেষে সপ্তোদিতের মত হাসতে হাসতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি পা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।”
এই ভয়াবহ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর তিন হাজার মুজাহিদ শহীদ হয়েছিল, আর রোমক পক্ষে মারা গিয়েছিল ১লক্ষ ১৪ হাজার ন্যৈ।
এই শোচনীয় পরাজয় বার্তা শ্রবণ করে রোম সম্রাট এশীয় ভুখন্ড ছেড়ে কনষ্ট্র্যান্টিনোপলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাবার সময় যুগ যুগ ধরে ভোগ করা সিরিয়ার নয়নাভিরাম দৃশ্যের দিকে চেয়ে বলেছিলেন, “বিদায় হে সিরিয়া, শত্রুদের জন্য তুমি কি সুন্দর দেশ!”
চার শহীদের মা
কাদেসিয়া প্রান্তর। পারস্য সম্রাটের সাথে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। তদানীন্তন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠা মহিলা কবি খানসা তাঁর চার ছেলে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে এসেছেন। যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই খানসা তাঁর ছেলেদের কাছে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, “তোমাদের আমি বহুকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছি, বহু দুঃখ বিপদের ভেতর দিয়ে মানুষ করে তুলেছি, এখন আমার কথা শোন, সত্যের জন্য যুদ্ধ করার মহত্বের কথা স্মরণ কর আর স্মরণ কর কুরআনের নির্দেশ – দুঃখ বিপদের মধ্যে ধৈর্য ধারণে বজ্রসার আদেশ। কাল প্রভাতে সুস্থ মনে শয্যা ত্যাগ করে শংকাহীন চিত্তে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করবে- সর্বাপেক্ষা সাহসী যোদ্ধার সম্মুখীন হবে এবং প্রয়োজন হলে নির্ভীক চিত্তে শহীদ হবে।”
পরদিন খানসার চার ছেলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং একে একে চার জনই শহীদ হলেন। সংবাদ বীর মাতার কাছে পৌঁছলে তিনি দু’হাত উপরে তুলে বললেন, “আল্লাহ, আমাকে আপনি শহীদের মাতা হবার সৌভাগ্য দান করেছেন, আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ।” কোন শোকচ্ছাস নেই। দুঃখের আবিলতা নেই – এক পরম তৃপ্তিতে মায়ের বুক ভরে গেছে – পুত্ররা তাঁর সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছে। এর চাইতে গৌরবজনক মৃত্যু আর কি হতে পারে !