সাংগঠনিক ত্র“টি দূরকরণের পন্থা
জামায়াতের সংগঠনকে ত্র“টিমুক্ত র্রাকার জন্য আমরা সমষ্টিগত মোহাসাবা অর্থাৎ সমালোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা রেখেছি। এতে খোলাখুলিভাবে ভুল ধরা হয়, সদস্য হোক কিংবা কর্মকর্তা, সকলেরই বেপরোয়া সমালোচনা চলে। সম্মেলনে আমি সর্বপ্রথম সংশোধনের চেষ্টা করা হয়। জামায়াত সদস্যদের সম্মেলনে আমি সর্বপ্রথম নিজেকে সমালোচনার জন্য পেশ করেছি। আমি আমার কর্মীদেরকে প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছি আমার ওপর যে আপত্তি থাকে, যে অভিযোগ থাকে বলুন, আমি সকলের সামনে তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো। কোন সময় আমার ওপর সম্মেলন ও বৈঠকাদিতে এত কঠোর সমালোচনা হয়েছে যে নতুন সদস্যরা তা দেখে আতঁকে উঠেছে যে, একি ব্যাপার। এত লোকের সধ্যে জামায়াতে প্রধানকে এমন নির্মমভাবে পাকড়াও করা হচ্ছে। কিন্তু আমি তাদেরকে এ বলে বুঝিয়েছি যে, ভাই, এ পন্থায় তো আমরা আমাদের দলকে সুপথে রাখতে পারি। আপনারা এতে ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আমি যদি আমার দলের লোকদের কে সন্তষ্ট করতে না পারি তাহলে এ দল পরিচালনার আমি যোগ্য নেই। আমার সমালোচনা করা তাদের অধিকার আর তাদেরকে সন্তষ্ট করা আমার দায়িত্ব। তাদের যদি কোন ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে তাহলে আমি তাদেরকে বুঝিয়ে সন্তষ্ট করবো আর যদি তাদের অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে তাহলে আমি ত্র“টি স্বীকার করে নিজেকে সংশোধন করবো। এ পন্থায় আমরা এ যাবত আমাদের দলকে ত্র“টিমুক্ত রাখার চেষ্টা করছি।
আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি
এবার জামায়াতের পরামর্শ গ্রহণের পদ্ধতি সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলবো। জামায়াতের সমস্ত ইতিহাসে মাত্র দুবারই অধিকাংশের ভোট নিয়ে ফায়সালা করতে হয়েছে। নচেৎ এযাবত আমরা সর্বসম্মতভাবেই সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। মজলিসে শুরার মাত্র একজন সদস্য আমাদের সকলের মতামতে সন্তষ্ট হতে পারেননি বলে আমি অনেক সময় কয়েকদিন পর্যন্ত একই ব্যাপারে আলোচনা অব্যহত রেখেছি। এমন বহুবার হয়েছে যে, মজলিসে শুরার সদস্যরা আলোচনার দীর্ঘ সূত্রিতায় অতিষ্ঠ হয়ে দাবী করে বসতেন যে, ভোট গ্রহণ করে অধিকাংশের মতানুসারে ফায়সালা করা হোক। কিন্তু আমি তাদরকে বুঝিয়েছি যে, আমরা যে কাজ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, তার জন্য সমগ্র জামায়াতের পূর্ণঐকমত্য সহকারে চলা প্রয়োজন। এ জন্য মজলিসে শুরার কোন এক ব্যক্তির মনেও যদি কোন সংশয় থেকে থাকে তবে তা দূর করার জন্য শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করুন। আর কেবলমাত্র অনন্যোপায় অবস্থায়ই ভোট নিয়ে ফায়সালা করুন। এ জন্য আমাদের মজলিসে শুরায় যখন যে ফায়সালা হয়েছে সমগ্র জামায়াত পূর্ণ আত্মতৃপ্তির সাথে তা বাস্তবয়িত করেছে।
জামায়াতে ইসলমীর মজলিসে শুরাকে জামায়াত সদস্যরা তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন করে। এতে তকোন এক ব্যক্তি মনোনীত হন না। বর্তমান মজলিসে শুরার পূর্ব পাকিস্তান থেকে আলেমের সংখ্যা ৫জন, বি এ ৩জন, এম এ ২জন এবং ইঞ্জিনিয়ার ১জন। পশ্চিম পাকিস্তান
থেকে আলেম ১৭জন, বি এ ৫জন, বি এ বি এড ১জনদ, এল এল বি ২জন, এম এ ১জন এবং বি এস সি এগ্রি ১জন। এ পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মজলিসে শূরায় আলেম ও আধুনিক শিক্ষিতদের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে এবং তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াত পূর্ণরূপে সমর্থ
এমনিভাবে জামায়াত জাতীয় পরিষদের জন্য যেসব প্রার্থী মনোনীত করেছে তাদের মধ্যে কি ধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন লোক রয়েছে তাও আমি আপনাদের সামনে ব্যক্ত করছি। অনেক বলে বেড়াচ্ছেন যে, এ মৌলবীরা কি করে দেশ চালাবে? এবার এ মৌলবীগুলোর তালিকা দেখুন এবং এবং চিন্তা করুন যে এরা দেশে চালাতে পারে কিনা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে ১৭জনআলেম, ১৬জন বি এ, ১ জন ইঞ্জিনিয়ার, ১জন ব্যরিষ্টার, ৩১জন এল এল বি এবং ২১জন এম, এ।
আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৩জন আলেম, ১২জন এল এল, বি, ১৭জন এম এ, এম, এস সি, ও এম কম, ১২জন বি এ ও বি, এস সি, ২জন ইঞ্জিনিয়ার ও ২জন এম, বি বি এস,১জন অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল, ১জন অবসর প্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ও ৩জন অবসর প্রাপ্ত মেজর রয়েছেন। এরা বর্তমান যুগের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চাইতে বিদ্যাগত যোগ্যতার দিকদিয়ে কোন অংশে কম নন। অন্তত অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সমান দক্ষতার সাথেই এরা দেশ পরিচালনা করতে পারবেন। তবে পার্থক্য হচ্ছে আমাদের এ টীমের মধ্যে ওলামাও রয়েছেন, যারা তাদেরকে প্রত্যেক পদে পদে ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে উপদেশ দিতে পারবেন। এ আলেম ও আধুনিক শিক্ষিত প্রার্থী দলের মধ্যে পরস্পর এত ঘনিষ্ট সহযোগিতা বিদ্যমান যে, তারা পাকিস্তানকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি আধুনিকতম রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে পূর্ণরূপে সমর্থ। এ ছাড়া আর বিসয়ের দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো, তা হচ্ছে আমাদের জাপমাঢাতের সংগঠন সারা দেশে পরিব্যাপ্ত। দোশের কোন অংশ এমন নেই যেখানকার লোক জামায়াতে শামিল হয়নি। বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, পাঠান, বেলুচী, সিন্ধী, ব্রোহী মোটকথা পাকিস্তানের জনসংখ্যার সকল উপাদান এর মধ্যে শামিল রয়েছে। দেশের কোন অংশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কোন ফায়সাালা করা এর পক্ষে সম্ভব নয়। এটা কোন সীমিত বা অঞ্চল ভিত্তিক দল নয় এবং কোন বিশেষ এলাকার ভাবাবেগকে জাগিয়ে তুলে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসছে না। যেমন দল বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছে এবং নিজ নিজ এলাকার ভাবাবেগকে জাগ্রত করে আসছে, পরিষদে পৌছলে তারা দেশকে ছিন্ন ভিন্ন করার সিদ্ধান্ত সহজেই গ্রহণ করতে পারবে। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলমী এমন একটি দল, যার সংগঠন সারা দেশে বিস্তৃত এবং দেশের প্রত্যেক অংশের জনগন এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
একথাও বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয় যে, জামায়াতে ইসলামী ঊনত্রিশ বছর আগে তার যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, আজও সেটাই তার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য। জামায়াত এ ঊনত্রিশ বছরের মধ্যে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে, একথা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। সুতরাং যে ক্ষমতায় এলে এ দেশে ইসলমী ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কিছু কায়েম করবে এটা কল্পনাও করা যায় না।
অপপ্রচারকারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ
এবার আমি জামায়াতের ইতিহাস একটু বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করবো। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, (১৯৪১ সালের আগষ্ট মাসে)৭৫জন সদস্য এবং ৭৪টাকা ১৪আনা তহবিল নিয়ে জামায়াতের কাজ শুরু হয়(আর ২আনা হলেই টাকা ও সদস্য সংখ্যা সমান হয়ে যেত)। জামায়াতে প্রতিষ্ঠিত হবার দশ মাস পর আমরা কেন্দ্রীয় অফিস লাহোর থেকে বাইরে স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহল করি। ১৯৪২ সালের জুন মাসে আমরা পাঠানকোট থেকে ৪মাইল দুরবর্তী গ্রাম দারুল ইসলাম স্থানান্তরিত হই।
যেহেতু এ সময় দেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য এক দুর্বার আন্দোলন চলছিল। তাই শহরে বসে আমরা কাজ চালাই আর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এ আন্দোলনের সাথে একটা দ্বন্দ্ব বেধে যাক তা আমাদের মকাম্য ছিলনা, একজন্য আমরা শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
পাকিস্তান আন্দোলনের কোন প্রকার বিরোধিতা করার কথা জামায়াতে ইসলামী কখনো কল্পনা ও করেন। আজ যে কোন ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে যা খুশী অপবাদ রটাক কিন্তু জামায়াতের কোন প্রস্তাব, কোন সম্মেলনের কার্য বিবরণী এবং কোন বিবৃতি থেকেই একথা প্রমাণিত হয়না যে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল। আমরা শুধু চেয়েছিলাম কোন নির্জন গ্রামে গিয়ে নিরিবিলিতে আমাদের সদস্য ও মুত্তাফিকদের ট্রেনিং দিতে ও সংগঠন মজবুত করতে। আমরা নিজেদেরকে পাকিস্তান আন্দোলনের সাফল্যের পর ভারত প্রস্তুত করছিলাম। আর পাকিস্তান সাফল্যের পর ভারত মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার এবং পাকিস্তানে ইসলামের প্রতি যে ঔদাসীন্য প্রদর্শনের আশংকা ছিল, তা প্রতিহত করার জন্যও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাই আমরা নিজেদের ট্রেনিং ও সংগঠনের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলাম, যা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি যতই ভয়বহ হোকনা কেন আমাদের সংগঠনকে যেন বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে না পারে এবং সংগঠন যেন যথারীতি কায়েম থাকে। আমরা অনুমান করতে পেরেছিলাম ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশংকা রয়েছে, তা উদ্ভব হবার পর এ ধরনের সংগঠন মজবুত করার কাজে ব্যয় করি। এ সাথে আমরা পরবর্তী পরিস্থিতির জন্যও ধর্মবির্বিশেষে বিভিন্ন অংশে অনুষ্ঠান করা এবং প্রত্যেক সম্মেলনের শেষে জাতি ধর্মনির্বিশেষে সর্বসাধারণের জন্য একটি জনসাভার আয়োজন করা ছিল এ কর্মপন্থার একটি বিশেষ দিক। আমরা এ সব জনসভায় হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান মোটকথা প্রত্যেক জাতির লোককে ডেকে আনতাম এবং তাদের সামনে ইসলামের খালেস দাওয়াত পেশ করতাম। ইসলম কি, তার মূলনীতি কি এবং সিসব মূলনীতি দ্বারা মানব জাতির কল্যাণ সাধন কিভাবে সম্ভব, এ সব কথাই তােিদকে আমরা ব্যাখ্যা করে বুঝাতাম।
অত্যন্ত ভয়াবহ সময়ে যাখন হিন্দু ও মুসলমান এবং শিখ ও মুসলমানদের মধ্যে মারাত্মক দাংগা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখানো আমরা এ কাজ অব্যহত রাখি। সে সময় জামায়াতে ইসলামীই একমাত্র দল ছিল যা ভারতের বিভিন্ন অংশে পরস্পরে দাংগায় লিপ্ত জাতিসমূহকে এক সভায় মিলিতকরতে পারতো এবং তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতো। আমরা এমন পন্থায় ইসলামের দাওয়াত পেশ করাতাম যে হিন্দু শিখ এবং ইসলামের কঠোর দুশমনও তা শুনতো।
১৯৪৭সালে যখন দাংগা পরিস্থিতি চরম আাকার ধারণ করলো এবং সারা দেশে সাংঘাতিক রকমের হানাহানি বলতে লাগলো, তখন আমি শেষবারের মত ভারত সফর করি এবং বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেই। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে মাদ্রাজের একটি জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে আমি ভারতে মুসলানদের অনাগত ভবিষ্যতের বিপদ ও কর্তব্য অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করি। আমার সে ভাষণ জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী পঞ্চম খণ্ডে রয়েছে। আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ভারতের মুসলামনদের হুশিয়ার করে দেই যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এযাবত দু পায়ে খাড়া ছিল। তার এক পা হচ্ছে ইংরেজের মোকাবিলার স্বাধীনতার সংগ্রাম আর দ্বিতীয়টি হলো মাসলমানদের বিরুদ্ধে শত্র“তা। দেশ বিভাগের পর এর একটা আপনা আপনি খসে পড়ব্ েকেননা ইংরেজ জাতির মোকাবেলায় অযাদী সংগ্রামের আর প্রাযোজন থাকবে না। এরপর এ জাতীয়তাবাদ তার এ পাটা বহাল রাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। এ জন্য সে মুসলমানদের উপর সব রকমের যুলুম অত্যাচার চালাবে এবং এ সব দীর্ঘকাল পর্যন্ত মুসলানদের বরদাশত করতে হবে। কিন্তু এরপর আপনারা জেনে রাখুন, তিন্দুজাতের মধ্যে যে অভ্যন্ত রীণ স্ববিরোধিতা বর্তমান রয়েছে, শেষ পর্যন্ত তা বেরিয়ে পড়বে এবং এ সব সময় পর্যন্ত আপনাদের ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। এ সময়ের মধ্যে আপনাদের উচিত ভারতের সমস্ত বগড় বড় ভাষায় যথা হিন্দী, মারাঠী, গুজরাটী, তামিল, তেলেগু মালয়ালম, বাংলা প্রভৃতিতে যথাসম্ভাব বেশী করে ইসলামী পুস্তক প্রকাশ করেন, তাহলে আপনাদের ভবিষ্যৎ বংশধর যেমন ইসরাম সম্পর্কে জ্ঞাত থাকবে তেমনি হিন্দুদের মধ্যে ইসলামের প্রাসার ঘটবে।
১৯৪৭সালের মে মাসে পাঠানকোটের নিকটবর্তী দারুল ইসলামী গ্রামেও আমরা একটি জনসভা অনুষ্ঠিত করি এবঙ হিন্দু শিখ ও মুসলমান সবাইকে এতে যোগদান করার দাওয়াত জানাই। এ সময় পূর্ব পাঞ্জাবে এক ভয়াবহ দাংগা চলছিল, তা সকলেরই জানা। এহেন পরিস্থিতিতে এ তিন জাতি একই সভায় মিলিত হবে, এ কেউ কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু খোদার রহমতে আমরা তাদেরকে সমবেত করেছি এবং এ সভায় আমি যে ভাষণ দেই তা ভাংগা গড়া নামে একটি পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আজ ও যে কোন ব্যক্তি সে ভাষণ পড়লে বুঝতে পারবেন যে আমি সে সাংঘাতিক পরিস্থিতিকে ও উক্ত জনসমাবেশে কিভাবে সত্য কথা বিবৃত করেছি।
দেশ বিভাগের পর জামায়াতের কর্মসূচী
১৯৪৭ সালের মে মাসে দারুল ইসলামে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও মুত্তাফিকদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমি দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানে কিভাবে কাজ করতে হবে তা সবিস্তারে বিশ্লেষণ করেছিলাম। আমার এ বক্তৃতা জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত নামে প্রকাশিত হয়েছে। এটি পড়ে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের আগস্টের শেষের দিকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র দারুল ইসলাম থেকে লাহোরে স্থানান্তরিত হয়।
এ সময় জামায়াতের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৬২৫ জন। তন্মধ্যে ২৪০ জন ভারত ও অধিকৃত কশ্মীর রয়ে গেছেন আর পাকিস্তানে যে’ সব সদস্য আগে থেকে ছিলেন এবং যারা হিজরত করে এেেলন তাদরে নিয়ে মোট ৩৮৫জন হলো। এভাবে পাকিস্তানে ৩৮৫ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতের কাজ শুরু হয়। আমরা প্রথমে দিনই ভারতীয় জামায়াত ইসলামী ও পাকিস্তান জামায়াত ইসলামীর সংগঠন আলাদা করে ফেলি। কেননা এ দুটোর মধ্যে যোগাযোগের কোন সম্ভবনা ছিল না (পরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, অধিকৃত কাশ্মীরের সংগঠনও ভারতীয় জামায়াত থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে)।
দেশ বিভাগের পর মাত্র কয়েক মাস অতিবাহিত না হতেই দেখা গেল, দেশবিভাগের আগে আমরা যে সব আশাংকা প্রকাশ করেছিলাম তা সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
যে ধরনের পরস্পর বিরোধী চরিত্রের অধিকারী লোকেরা একত্র হয়ে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তা দেখে আমরা পাকিস্তান হবার পরবর্তী অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। বস্তবেও দেখা গেল তাই হচ্ছে। আজ ২৩বছর পর আমরা পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, দেশ বিভাগের কয়েক বছর আগে আমরা যাবলেছিলম তার প্রত্যেকটি এক এক করে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এখন করুন সাধ্য নেই আমাদের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। দেশ বিভগের পর আমরা পাকিস্তানে এসে সর্বপ্রথম মুহজিরদের সেবায় আত্মনিয়োগ করি। আমি অত্যন্ত দুঃখেল সাথে বলছি যে, তখন আজ যারা নিজেদেরকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বলে দাবী করেন তাদের একটি উল্লোখযোগ্য অংশ হিন্দুদের পরিত্যক্ত জায়গা জমি দখলের চেষ্টায় ছির আর তাদের মধ্যে কতেক মুহজিরদের ক্যাম্পে তাদের সেসব সুন্দরী মেয়ে খুজে বেড়াচ্ছি যারা হিন্দু ও শিখদের হাত থেকে কোনোক্রমে বেছে এসেছিল। এসময়ে মুহজিরদের মধ্যে রেশন বন্টন করার জন্য খোদ সরকারী অফিসারদেরও জামায়াত কর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল যে, তাদের মাধ্যমেই রেশন মুহাজিরদের কাছে ঠিক ঠিক মত পৌছাবে (দেশ বিভাগের পর থেকেই যে এ ধরনের পরিস্থিত দেখা দিতে শুরু করেছিল, তার চাক্ষুস সাক্ষী এখনো রয়েছে) এরপর আমরা স্পষ্টত অনুভাব করলাম যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাদের এখন আর পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ইচ্ছে নেই।
আমি জিজ্ঞেস করি এবং প্রত্যেকেরই চিন্তা করে দেখা উচিত যে, বাস্তবিকই যদি পাকিস্তাকে ইসলামী রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা ইচ্ছে থাকতো তাহলে প্রথম সুযোগেই গণপরিষদে আদর্শ প্রস্তাব পাশ করা উচিত ছিল না? যে প্রস্তাবকে দেড় দুবছরের চেষ্টার পর পাশ করা হলো তা তো প্রথম দিনেই পাশ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা বিস্মিত হয়ে দেখি বড় বড় নেতারা তাদের বক্তৃতায় বলছিলেন যে, এখানে যদি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয় তাহলে শতকরা ৯৫ জন লোকের হাত কাটা যাবে অর্থাৎ কিনা তাদের মতে পাকিস্তানের শতকরা ৯৫জনই চোর এমন কি দুনিয়ার সামনে মুখ দেখাব কি করে? এরূপ লজ্জাকর যুক্তিও দেয়া হলো যে, পাকিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র কয়েম হলে ভারতে হিন্দু হয়ে যাবে। এরূপ আরো কত বাহানা যে সে সময় তোলা হয়েছিল তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ইসলামী রাষ্ট্রের চারটি মূলীতি
এ পরিস্থিতি যখন দেখা দিল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের দাবী উপেক্ষা করার প্রয়াস চললো তখন আমি ১৯৪৮সালের ফেব্র“য়ারী মাসে লাহোর ল কলেজে এক বক্তৃতা দেই। এতে আমি ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলমী আইন কানুন সম্পর্কে সব ভুল ধারণা অপনোদন করি। আমি স্বীয় বক্তৃতায় প্রথমে পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করি এবং তার পরে চারটা মূলনীতি বর্ণনা করি যা স্বীকার না করলে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারেনা। ১) আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে হবে। ২) সরকারকে অংগীকারে আবদ্ধ হতে হবে যে আল্লাহর নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থেকে কাজ করবে। ৩) বৃটিশ শাসনআমলের উত্তররাধিকার ইসলাম বিরোধী আইনগুলো সংশোধন করতে হবে। ৪) ভবিষ্যতের যাবতীয় আইন কানুন ইসলাম অনুযায়ী রচিত হবে। আমি প্রস্তাব পেশ করি যে আমাদের গণপরিষদের কর্তব্য প্রথমে আইনের ভাষায় এ মূলনীতিগুলো মঞ্জুর করা। এর পরেই এ সরকার ইসলামী সরকার বলে গণ্য হবে। এছাড়া এখানে ইসালামী রাষ্ট্র কায়েম হবেনা। যেমন কোনো ব্যক্তি কালেমায়ে তাইয়েবা মুখে উচ্চারণ না করে মুসলমান হতে পারে না ,তেমনি কোনো রাষ্ট্র সে পর্যন্ত মুসলমান হতে পারে না যে পর্যন্ত সে স্বীকার না করে যে তার বাদশাহ হচ্ছেন আল্লহ। যতক্ষণ সে স্বীকার না করবে যে দুনিয়াবী যারা এসরকার পরিচালানা করে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবেই তা করে, যতক্ষণ সে স্বীকার না করবে যে তার আইন কানুনের উৎস কোরআন ও সুন্ন্হ, যে পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত না করবে যে তার চতুসীমার মধ্যে অনৈসলামী আইন জারী হতে পারবে না, ততক্ষণ তা আনুষ্ঠানিক একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে না।
একটি জঘন্য মিথ্যা ও নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারী
এ দাবি উত্থাপন করার পর যখন আমরা তার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা শুরু করলাম, অমনি ক্ষমতাসীনরা কি করে আমাদের মুখ বন্ধ করা যায় সে চেষ্টায় মেতে উঠলেন। প্রকাশ্যে তো আর ইসলামী রাষ্ট্রা কায়েম করতে রাজী নয় এমন কথা ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না। এজন্য যাতে আমাকে আমার সঙ্গী সাথীদের কে অন্য কোন অভিযোগের ফাদে আটকানো যায় সে জন্য একটি ষড়যন্ত্র তৈরী হলো। ষড়যন্ত্র হচ্ছে ১৯৪৮সালের মে সাসে পেশোয়ার থেকে জনৈক ভদ্রলোক আমার কাছে এলেন। ইনি আজাদ কাশ্মীরের পাবলিসিটি অফিসার ছিলেন। তিনি আমার সাথে গোপন আলাপ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করলে আমি তাকে নির্জন কক্ষে ডেকে আনলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাশ্মীরের জেহাদে অংশ গ্রহণ করছেন না কেন?
আমি বললাম এর একটি করণ রয়েছে যা আমি ব্যক্ত করতে চাই না।
তিনি বললেন,অন্তত পক্ষে আমাকে তো বলুন। আমি শুধু ব্যক্তি গতভাবে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আামি বললাম, যে জাতির সাথে পাকিস্তানের সরকার যুদ্ধ করে না, তার সাথে পাকিস্তানের নাগরিকরা কি করে যুদ্ধ করতে পারে? আমি এটা বুঝতে পারি না। কিন্তু আমি এব্যাপারে নীরবই থাকতে চাই, আমার মতামত ব্যক্ত করতে চাই না। পরের দিনই তিনি সংবাদপত্রে বিবৃতি জারী করে দেন যে, মাওলানা মওদূদী কাশ্মীরের জেহাদেকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন এবং একথাও বলেছেন যে, এযুদ্ধে যারা নিহত হচ্ছে তাদের হামার মৃত্যু। এর পর এ মিথ্যা কে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলো। শ্রীনগর রেডিও তৎক্ষণাৎ তাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলো এবং কাশ্মীরে যুদ্ধরত মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে প্রচার করতে লাগলো যে, পাকিস্তানের অমুক আলেম বলেছেন যে তোমরা যুদ্ধ করে মরলে তোমাদের হারাম মৃত্যু হবে।
আমি রেডিও পাকিস্তানকে লিখলাম যে, অধিকৃত কাশ্মীর রেডিও আমার নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচারণঅ চালাচ্ছে। আমাকে এর প্রতিবাদ করার এবং এটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচারণা, তা জনগণের সামনে বলার অনুমতি দেয়া হোক। কিন্তু আমাকে অনুমতি দিতে সরাসরি অস্বীকার করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তানে ইসলামী শাসনের দাবী নস্যাৎ করা আমাদের ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিতে কাশ্মীর সমস্যার চেয়েও জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার নাম নিয়ে কাশ্মীরের মুজাহিদদের উৎসাহ ভংগ করা হচ্ছিল। অথচ তাদের সে ব্যাপারে পরোয়াই ছিল না। তাদের কেবল চিন্তা ছিল ইসলামী শাসনের আন্দোলনকে কিভাবে পর্যুদস্ত করা য়ায়। আজ পর্যন্ত সে মিথ্যা অপবাদের পুনারাবৃত্তি করা হচ্ছে। যখনি আমি পাকিস্তানের সংস্ককরের জন্য কোনো চেষ্টা চালাই অমনি এ মিথ্যার ফানুস ওড়ানো শুরু হয়। অথচ আমি একাধিকবার এর প্রতিবাদ করেছি। এ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করার পর ১৯৪৮সালের অক্টোবর মাসে আমাকে এবং মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী ও মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদকে গ্রেফতার করা হয়। একাধিক্রমে ২০মাস আমাদেরকে আটক করে রাখা হয়। তারা মনে করেছিল যে এতিনজন মানুষকে আটক করলেই জামায়াতে ইসলামী খতম হয়ে যাবে। কিন্তু জামায়াত যে তাসের ঘর নয় বরং গবেষণার পর তৈরী করা একটি মজবুত সংগঠন, একথা তারা ভুলে গিয়েছিল। আমাদের গ্রেফতারীর পরেও ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১৯৪৯সালের মার্চ মাসে আদর্শ প্রস্তাব পাশ করা হয়। অথচ এটি আমাদের গণপরিষদে প্রথম দিনেই পাশ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এপ্রস্তাব পাশের আগে বা পরে এমন কোনো নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়নি, যাতে করে বুঝা যেতে পারে যে এখন বাস্তবিকই আমাদের দেশে ইসলামী শাসন কায়েম কারর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রকৃত স্বরূপ আমি মুক্তি লাভের পর এক বক্তৃতায় এরূপভাবে ব্যক্ত করেছিলাম যে, এ একটি আজব বৃষ্টিপাত। এর আগে কোনো মেঘ করেনি, পরেও মাটিতে কোনো জীবনী শক্তির সঞ্চর হয়নি। শুধু একটি প্রস্তাবই পাশ করা হয়েছে মাত্র।
প্রশ্ন হলো, সরকার যদি সত্যি সত্যি আমাদের দাবী মনেপ্রাণে গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তার পরেও আমাদের দীর্ঘদিন পর্যন্ত আটক রাখার কি বৈধতা থাকতে পারে? এরপরেও তো সরকারের বলা উচিত ছিল যে, এখন জামায়াত ও মুসলিম লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আসুন, এবার আমরা সম্মিলিত উদ্দেশ্যের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।
কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বুঝা গেল যে, ঐ প্রস্তাব শুধুমত্র আমাদের জব্দ করা জন্য পাশ করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য নয়। এর পরেও আমাদের আটকাদেশ প্রত্যেক ছয় মাস পরপর সম্প্রসারিত করা হতে থাকে। এসময় অন্য একটি আদালাত কোনো মামলার রায় দেয় যে, একজন মানুষের আটকাদেশ তিন বারের বেশি মেয়াদ বৃদ্ধি করা চলে না। এরায়ের ফলে নেহয়েৎ ঘটনাক্রমে আমরা মুক্তি পেয়ে গেলাম। নচেৎ আদর্শ প্রস্তাব পাশকারীদের এরূপ ইচ্ছে ছিল না যে সারজীবনেও কোনোদিন আমাদের জেল থেকে বের হতে দেবে।
খতমে নবুয়্যতের আন্দোলান ইসলামী শাসনাতন্ত্র বানচালের ষড়যন্ত্র
জেল থেকে মুক্তি লাভের পর আমরা পুনরায় দাবি তুলি যে, এখন আদর্শ প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে। খাজা নাজিমুদ্দীন মরহুমের আমলে শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরুও হয়েছিল। কিন্তু তার গতিরোধ করার জন্য আবার এক চক্রান্ত করা হয় এবং ১৯৫৩সালে জামায়াতে ইসলামীর ওপর তৃতীয় হামলা চালানো হয়। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি ধামাচাপা দেয়ার জন্য খতমে নবুয়্যতের আন্দোলন পাকিয়ে তোলা হয়েছিল। (মুনীর রিপোর্ট থেকে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং আমি এসম্পর্কিত সমস্ত তথ্য আমার গ্রন্থ কাদিয়ানী সমস্যার বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছি) এসময় খতমে নবুয়্যত আন্দোলনের নেতৃবৃন্দেকে বহু বুঝানো হয় যে আল্লার ওয়াস্তে একবার শাসনতন্ত্রটা পাশ হতে দিন এবং এরপরে আপনারা এসমস্যা তুলবেন। খাজা নাজিমুদ্দীন রিপোর্ট তৈরী হয়ে গিয়েছিল। শাসনন্ত্র পাশ হতে আর বেশী বিলম্ব ছিল না শুধুমাত্র গণপরিষদে মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট পেশ হতে এবং শাসনতন্ত্র মঞ্জর হতে যা দেরী ছিল। কিন্তু ঠিক এমুহূর্তে দাংগা হাংগামা শুরু হয়ে গেল। খাজা নাজিমুদ্দীন রিপোর্ট যেমন ছিল তেমনই বয়ে গেল। লাহোরে সামরিক আইন জারী হলো। খাজা নাজীমুদ্দীন ওজারিত গেল আর সে সাথে আমলাতন্ত্রের রাজত্ব এমন মজবুত ভাবে শিকড় গেড়ে বসলো যে, আজো পর্যন্ত তা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়নি।
১৯৪৯সাল থেকে একটি সরকারী অথবা আধা সরকারী প্রচার সেল জামায়াতে ইসলামীল বিরুদ্ধে অবিরাম কুৎসা অভিযান চালিয়ে আসছে। এটি ১৯৬৮সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। রীতিমত বেতনভুক্ত অথবা মজুরীর ভিত্তিতে নিযুক্ত লোকেরা জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা রকমের অপবাদ রটনা এবং ইসলাম সম্পর্কে লোকদের মনে যতদূর সম্ভব সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত থাকে। সরকারী তহবিল থেকে এ জন্য লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়। বহু পত্র পত্রিকা এই কাজ করতে থাকে, বহু বই পুস্তক আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ করা হয় এবং সরকারীভবে প্রত্যেক মহলে তা বিলি করা হয়। জামায়াতে ইসলামীর দুর্নাম রটানোর জন্য কোনো সুযোগ বাকী রাখা হয়নি। আর সে সাথে প্রত্যেক সম্ভাব্য উপায়ে জনগণের মনে বিভ্রান্তি ও সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়,যেন লোকে অনন্যোপায় হয়ে ভাবতে শুরু করে যে ইসলামের নিকট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও নেই আর বর্তমান যুগে আইনও নেই।
১৯৫৫সাল থেকে আলেমদের একটা গোষ্ঠিও আমাকে ও জামায়াতে ইসলামীকে গালিগালাজ করা ও আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রচনায় লেগে রয়েছে। আমি জেলে থাকা অবস্থায়ই এ কাজ শুরু করা হয়। আর আজ ১৫বছর হয়ে যাচ্ছে গালাগালি এ অভিযান জোরদার ও তীব্রতর হয়ে চলেছে।
স্বৈরাচারী আইয়ুবের কবলে জামায়াতে ইসলামী
এরপরে আসে ১৯৬৩সালের ষড়যন্ত্রের কতা। তখন জামায়াতকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য মারাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। এ লাহোর শহরে আমরা জামায়াতের সম্মেলন করছিলাম। প্রথমে লাউড স্পীকারের অনুমতি দেয়া হল না, তার পরে তার জন্য অত্যন্ত সংকীর্ণ স্থান দেয়া হল এবং সেখানে সুসজ্জিত গুন্ডা বানিী প্রেরণ করা হয়। এই গুন্ডাবাহিনী কে প্রেরণ করেছিল? তা আজ আর কারো অজানা নেই। পরিল্পনা ছিল গুন্ডারা এসে হট্রগোল বাধাবে আর জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা যদি কোনো গুন্ডার ওপর হাত তোলে তাহলে তৎক্ষাণাৎ] পুলিশ ব্যাপক হামলা চালাবে এবং জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গুলি বর্ষণ শুরু করবে। যারা এ পরিকল্পনা তৈরী করেছিল তারা পরিস্কার বলেছিল যে, মিশরে ইখওয়ানের যে দশা হয়েছে আমরা এখানে জামায়াতের সে দশা করবো। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে জামায়াত নিজকে এতটা সুশিক্ষিত ও সুসংগঠিত করে নিয়েছিল যে শত্র“দের এই সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল। জামায়াতের একজন কর্মীও কোন দুস্কৃতিকারীর ওপর হাত তোলেনি। দুস্কৃতিকারীরা এক প্রান্তে থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত লাফালাফি করে বেড়ালো। শামিয়ানার দড়ি কেটে দিল। সমগ্র সভাস্থলে তার হৈ চৈ করে বেড়াল। কিন্তু তারা যখন দেখলো যে এখানে তাদেরকে কেউ কিছু বলেইনা, তখন অগত্যা মুখ পাংশু করে চলে গেল। জামায়াতের জনসভা পূর্ণ শান্তি শৃংখালার সাথে অব্যাহত থাকলো। তারা ভেবেছিল যে সম্মেলনে যখন আমার দিকে পিস্তল দিয়ে গুলি চালানো হবে তখন আমি কোনো চোকির নীচে গিয়ে পালাবো। কিন্তু তারা যখন দেখলো যে মানুষটা একদম দাড়িয়ে রয়েছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাড়িয়েই থাকলো এবং এক মুহূর্তের জন্যও বসলোনা তখন তারা হতোদ্যম হয়ে পড়লো এবংবুঝতে পারলো যে, যেমন তেমন লোকের পাল্লায় তারা পড়েনি।
(সম্মেলনের প্যান্ডেলের পেছনে এক হাজারেরও বেশী মহিলা উপস্থিত ছিলেন। দুস্কৃতিকারীরা তাদের শিবিরেও বোতল ইত্যাদি নিক্ষেপ করে। অথচ তাদের মধ্যে কোন বিব্রতবোধ পরিদৃষ্ট হয়নি। এ হাংগামার মধ্যে আমাদের জনৈক কর্মী আল্লাহর বখশকে শহীদ করে দেয়া হয়। তার স্ত্রী ও মেয়ে মহিলাদের শিবিরে উপস্থিত ছিলেন। তারা যখন আপন পিতা ও স্বামীর শাহাদাদের খবর জানতে পারেন তখন তারা কোনো আহাজারী পর্যন্ত করেননি। বরংপূর্ণ ধৈর্যের সাথে বিছানা পত্র বেধে শহীদের লাশ নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমি সে সময় আমার বক্তৃতায় বলেছিলাম যে, আমরা দুনিয়ার কোন আদালতে এ খুনের বিচার চাইব না। এ খুনের মামলা অন্য এক জায়গায় দায়ের হয়ে গেছে এবং এর ফায়সালা ইনশাআল্লাহ সেখানে থেকেই হবে। শেষ পর্যন্ত সেই অদৃশ্য আদালত থেকে মামলার এমন আদর্শ বিচার হলো যে খুব কম যালেমই তার যুলুমের এমন সাংঘাতিক পরিণতি দেখেছে।)
জামায়াতকে বেআইনী ঘোষণা
এচক্রান্ত যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো তখন অবশেষে ১৯৬৪সালে জাময়াতে ইসলামীকে হঠাৎ বেআইনী ঘোষণা করা হলো। জামায়াতে ইসলামী ১৯৬২সালের শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়াতা বিধানের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী একটি দুর্বার স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযানের ফলে মৌলিক অধিকারের দাবি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আইনের খসড়া বিল পরিষদে গৃহীত হওয়া সত্ত্বে ও প্রেসিডেন্ট ইচ্ছাপূর্বক তাতে স্বাক্ষর দিতে বিলম্ব করেন। ১৯৬৪সালের ৬ই জানুয়ারী জামায়াত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ও আমাদেরকে গ্রেফতার করার কাজ সম্পূর্ণ হলে তারপর ১০ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট উক্ত বিলে স্বাক্ষর দান করেন। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তার এ পদক্ষেপও জামায়াতকে খতম করতে সক্ষম হয়নি। হাইকোর্ট আমাদের গ্রেফতারী এবং সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিষিদ্ধকরণের নিদের্শকে বাতিল ঘোষণা করে। যখন আদালাত এ রায় ঘোষণা করে তারপর ২৪ঘন্টা অতিবাহিত না হতেই জামায়াতে ইসলামী সে জায়গায় এসে দাড়ালো যেখানে আইয়ুব খানের হামলার আগে দাড়িয়ে ছিল। ১৯৫৮সালের সামরিক আইনে অন্যান্য দলের সাথে জামায়াতও ৪৫মাস নিষিদ্ধ থাকলো,তখনও এরূপ হয়েছিল। আমি তখনও স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলাম যে, আপনারা এসব চক্রান্ত দ্বারা জামায়তকে খতম করতে পারবেন না। যখনই সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে, জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন তখনই মাত্র ২৪ঘন্টার মধ্যে পুনরায় বহাল হবে।
যে ইতহাস আমি বর্ণনা করলাম, তাথেকে আপনার সহজেই অনুমান করতে পারেন যে দেশ বিভাগের আগেই জামায়াতের সংগঠনকে যদি ৬বছর ধরে মজবুত ভিত্তির ওপর দাড় করানো না হতো তাহলে পরবর্তী যুগে একে ধ্বংস করারজন্য অবিশ্রান্তভাবে যে সব চেষ্টা তদবীর করা হয়েছে তার ধাক্কা সামলাতে না পেরে জাময়াত বহু আগেই খতম হয়েযেত । গত ২৩বছরে ক্ষমতাসীন সরকারসমূুুহ আমলাতন্ত্র,জায়গীর দার ও পুজিপতি,ধর্মহীনতা ও সমাজতন্ত্রের ধারক বাহক দলগুলো, বিভিন্ন রকমের বিভ্রান্তির প্রসারকারী লোকেরা, নানা ধরনের বিরোধী রাজনৈতিক এবং আলেমদের বিভিন্ন গোষ্ঠি এ দলকে খতম করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এমনকি এমন এক সময় ও অতিবহিত হয়েছে যখন সমস্ত সংবাদপত্র জগত জাময়াতের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছ এবং কোনো একটিও জামায়াতের পক্ষ সমর্থন করেনি। তা সত্ত্বে জাময়াত শুধু বেচেই থাকেনি এবং কদম সামনে এগিয়ে চলেছে এবং কোনো শক্তি তার গতি স্তব্ধ করতে পারেনি। এটা সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের ফল। যার জন্য শোকর আদায় করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
জাতীয় কল্যাণে জামায়াতের অবদান
এবার জাময়াত গত ২৯বছরে জাতির কল্যাণেল জন্য কিকি কাজ করেছে আমি তার একটা বিবরণ পেশ করতে চাই।
জাময়াতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি হলো, সে এক বিশাল ও ব্যাপক সাহিত্য জগত সৃষ্টি করেছে। ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে হাজার হাজার বই পুস্তক প্রকাশ করেছে। জামায়াতের এসব বই পুস্তক ইসলামের সভ্যাতা ন্যায়ানুগত্য ও তার কার্যোপযোগিতা সম্পর্কে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীকে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করতে এবংপাশ্চত্য শিক্ষা ও সভ্যাতা তাদের মন মগজে যে সব সন্দেহ, সংশয় ও বিভ্রান্তির জাল বুনেছে তার সবই অতি সুন্দর ভাবে অপনোদন, করতে সক্ষম। জামায়াতে ইসলামী শুধু বক্তৃতার খই ফুটিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন নয়। বক্তৃতা তো বাতাসে উড়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী এক মজবুত সাহিত্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে যে সাহিত্য ইনশআল্লাহ এ দেশে বহু শতাব্দি পর্যন্ত কায়েম থাকবে। গত ২৯বছরে এ সাহিত্য লাখ লাখ পরিবারে গিয়ে পৌছেছে, লাখ লাখ মানুষ তা পড়েছে এবং ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও পড়বে। এ সাহিত্য যেখানেই গেছে, সেখানে মানুষের মন মগজের মধ্যে এত গভীরভাবে শিকড় বিস্তার করেছে যে, খোদার অনুগ্রহে এখন আর কারোর সাধ্য নেই তা কারোর মনমগজের মধ্য থেকে টেনে বের করে। শিক্ষিত জনগণের একটি বিরাট অংশ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি আধুনিকতম রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্পূর্ণ সম্ভব। অধিকন্তু এমন সুন্দর ভাবে পরিচালানা করা সম্ভব যে, দুনিয়ার অন্যান্য জাতি ও রাষ্ট্র এথেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। এখন যদি কেউ এমন কথা বলার দুঃসাহস দেখায় যে ইসালম একটা প্রাচীন ব্যবস্থা যা বর্তমান যুগে চলার যোগ্য নয়, তাহলে হাজার হাজার মুখ তাকে দাতভাংগা জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত আছে, এটা জামায়াতে ইসলামীর একটি অসাধারণ কীর্তি, যা সে আল্লাহর অনুগ্রহে আঞ্জাম দিয়েছে এবং দিচ্ছে
নিষ্ঠাবান কর্মীবাহনী সংগঠনে জামায়াত
জামায়াত নিষ্ঠাবান ও নির্ভর যোগ্য চরিত্রের অধিকারী কর্মীদের একটি সুসংগঠিত বাহিনীও তৈরী করেছে। এটা তার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন কীর্তি। এ বাহীনি অক্লান্ত সাধনা ও পরিশ্রম দ্বারা লাখ লাখ মানুষকে জামায়াতের সমর্থক বনিয়েছে। দেশের মধ্যে নিজের সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য প্রচুর সুনাম ও আস্থা অর্জন করেছে। এ কর্মীবাহিনী যখনই স্বদেশে অথবা বিদেশে মুসলামানদের ওপর কোনো বিপদ মুসিবত আপতিত হয়েছে, সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তাদের সম্ভাব্য সব রকমের সেবা ও সাহায্য করেছে আর দেশের প্রত্যেক অংশ অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন স্থানীয় নেতৃত্ব সরবরাহ করেছে। দেশের জনগণের নিকট জামায়াত ও তার কর্মীদের কতখানি সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে তা পরীক্ষার মুহূর্তেই প্রকাশ পায়। উদাহরণ স্বরূপ বকরা ঈদে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা জনসেবার জন্য চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। প্রত্যেক বছর বকরা ঈদ সমাগত হওয়া মাত্রই (মহল বিশেষ কর্তৃক) পোষ্টার দিয়ে প্রাচীর গাত্র ছেয়ে ফেলা হয়। এসব পোষ্টারে লেখা হয় যে জামায়াতে ইসলামী কে চমড়া দেয়া হারাম। সব রকমের অপবাদ জাময়াতের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়। লোকেরা যাতে তাকে চামড়া না দেয়, সে জন্য চেষ্টার ত্র“টি করা হয় না। কিন্তু তারা সবাই মিলে যত চামড়া সংগ্রহ করে তার চাইতে অনেক বেশী চামড়া শুধু জমায়াতকে দেয়া হয়। জমায়াতের বিরোধীরা পর্যন্ত নিজেদের কোরবানীর চামড়া জামায়াতের হাতে অর্পণ করেছে। আইয়ুব খান সাহেবের চরম স্বৈরাচারী শাসনমলেও যখন জাময়াতের সংস্পর্শে যাওয়াও বিপদের কারণ ছিল, বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ সরকারী অফিসার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোরবানীর চামড়া জামায়াতে ইসলামীকে পাঠিয়ে দিতেন।
এর কারণ হচ্ছে, জাতির মধ্যে সাধারণভাবে একটি আস্থা জন্মে গেছে যে এ দলের কর্মীদেরকে যা কিছু দেয় হবে তা উপযুক্ত ব্যয়ের খাতেই ব্যয়িত হবে। এরা এক কাজের নামে চাদা বাগিয়ে অন্য কাজে ব্যয় করার লোক নয়। ১৯৬৫সালের যুদ্ধেও জামায়াত জনগণের নিকট কত জনপ্রিয় ও আস্থাভাজন, তা সপ্রমাণ হয়েছে। সে সময় সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাব যত চাদা যুদ্ধ উপদ্রুত লোকদের সাহায্যের জন্য সংগ্রহ করেছে তার চাইতে কয়েকগুণ বেশী চাদা জাময়াত একাই সংগ্রহ করেছে। যুদ্ধের সময় বহুবার এমন হয়েছে যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা বহু মূল্যবান সামগ্রী যুদ্ধ উপদ্রুতদের সাহায্যার্থে নিয়ে এসেছে এবং জামায়াত কর্মীদের বলেছে যে এগুলো যদি আপনারা স্বয়ং বণ্টন করেন তাহলে আপনাদের হাতে সমপর্ণ করে দেই। আর যদি অন্য কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানকে দিতে চান তাহলে ফেরত নিয়ে যাই। এধরনের বহু পরীক্ষা মাঝে মাঝে হয়ে থাকে যা দ্বারা দেশে জামায়াত কর্মীদের কত সুনাম, তা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি।
(এ ছাড়া গত ২৩বছরে ও বন্যা উপদ্রুতদের জন্য, ১৯৬৫সালের যুদ্ধ উপদ্রুতদের জন্য, কাশ্মীর জেহদ তহবিল, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা তহবিল, ফিলিস্তিন জেহাদ তহবিল এবং ইরিত্রিয়ার মুজাহিদদের সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের জনগণ নগদ টাকা ও দ্রব্য সামগীর আকারে সর্বমোট ৭৮লক্ষ জামায়াতকে দিয়েছে এবং তার পূর্ণ হিসাব জামায়াতের কাছে রয়েছে। সম্ভবত দেশের অন্য কোনো দলের প্রতি জাতি এত বেশী আস্থা স্থাপন করেনি।)
গলিগালাজের ঝড় যথারীতি বয়ে চলেছে। মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসার ধারও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু যখনই আমরা জনগণের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে গিয়েছে, তখন বুঝতে পেরেছি যে তারা জামায়াতের উপর যতখানি বিশ্বাস ও আস্থা রাখে ততখানি আর কারোর ওপর রাখে না।
ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় জাময়াত
যেসব দল ও প্রতিষ্ঠান এদেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় অথবা যেসব আন্দোলন দেশকে ছিন্ন ভিন্ন করতে ইচ্ছুক, জামায়াতে ইসলামী প্রত্যেক ময়দানে তাদের মোকাবেলা করেছে এটা জামায়াতের তৃতীয় বৃহৎ কীর্তি। এসব আন্দোলন আসলে দেশের স্নায়ু কেন্দ্র দখল করে এবং তারপরে দেশের নাগরিক জীবনকে পংগু করে দিয়ে ঈস্পিত বিপ্লব আনবার চেষ্টা করে। তারা ছাত্র,শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক ও অধ্যাপকের করায়ত্ত করে ও তাদেরকে কাজে লাগায়। মোটকথা তারা এমন সব পথ অবলম্বন করে, যা করায়ত্ত করতে পারলে তাদের ঈপ্সিত বিপ্লবের পথে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। জামায়াতে ইসলামী এ সমস্ত ক্ষেত্রেই তাদের মোকাবেলা করে যাবে। জাতির স্নায়ু কেন্দ্রগুলোতে এসব ধ্বংসাত্মক শক্তির আগমন প্রতিরোধ করছে এমন দল জাময়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনোটা নয়। আপনাদের বিশ্বাস রাখা উচিত সে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অথবা দেশকে ছিন্ন ভিন্ন করার কোনো বিপ্লব হোক তা কখনো জনগণের সমর্থন নিয়ে আসবে না এবং তাকে শুধু জনসভা ও বক্তৃতা করে করে প্রতিরোধও করা যাবে না। এ স্নায়ুকেন্দ্র গুলোকে করায়ত্ত করেই এসব বিপ্লব এসে থাকে। শ্রমিকদেরকে করায়ত্ত করে দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ, রেলওয়ে,টেলিফোন, ও তার ব্যবস্থা পংগু করে দিয়ে এ বিপ্লব আসে। ছাত্রদেরকে উস্কিয়ে দিয়ে মাঠে নামানো হয় এবং তাদের মস্তিস্ক বিগড়ে দেয়া হয়। এবং তাদের মধ্যে বেহায়াপনা ও ধর্মবিরোধী ভাবাগেব জাগিয়ে তোলা হয়। এভাবে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরী করা হয়। এসব ক্ষেত্রে এধ্বংসাত্মক শক্তির মোকাবেলায় জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য কোনো দল যদি লিপ্ত থেকে থাকে তাহলে সে দলের নাম প্রকাশ করা উচিত। জামায়াতে ইসলামী জনসামাবেশ অনুষ্ঠিত করেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে আর সে সাথে এসব স্নায়ুকেন্দ্র গুলোকেও তাদের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। এমনকি মাত্র এব বছরে সে এ সব ধ্বংসাত্মক শক্তিতে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।
উপসংহার
এ হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও তার তৎপরতার সংক্ষিপ্ত ইতহাস। এ বিবরণ দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামীল সদস্য কর্মী ও মুত্তাফিকরা যেন জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন কর্ম পদ্ধতি ও সংগঠন ভালোভাবে উপলদ্ধি করেন আর অন্যান্য যারা জামায়াত সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে চান তারাও যেন বুঝতে পারেন যে জামায়াতে ইসলামী জিনিসটা কি? আমিতাদের কাছে এ অনুরোধ করবোনা যে এসব জানা ও শোনা পর আপনারা জামায়াতের কদর করা শুরু করুন। জামায়াতের কাজের প্রকৃত মূল্য ও কদর আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ রয়েছে। আমি শুধু এটুকু কামনা করি, যে ব্যক্তি জামায়াতের আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, তিনি যেন এর কাজকে সত্য সঠিক মনে করে নিশ্চিত মনে তা করেন। আর যারা এর সাথে মিলিত হয়ে কাজ করা পসন্দ করেন না, তারা যেন অন্তত কোনো প্রকার ভ্রান্ত ধারাণায় লিপ্ত না থাকেন। বস্তুত কেউ যদি আমাদের কাজের বিরোধিতা না করবেন তবে এটাও তার পক্ষ থেকে আমাদের ওপর একটি বিরাট অনুগ্রহ বলে গণ্য হবে।
— সমাপ্ত—