চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
নঈম সিদ্দিকী
বইটির অডিও শুনুন
চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
মানুষের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, যত অধিক গুরুত্ব অর্জন করে, সেখানে শয়তানের হস্তক্ষেপও ততই ব্যাপকতর হতে থাকে। এদিক দিয়ে বর্তমান যুগ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ যুগে একদিকে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপূজারী সভ্যতা আমাদের জাতির নৈতিক পতনকে চরম পর্যায়ে উপনীত করেছে, অন্যদিকে চলছে সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা। এ হামলা আমাদের জাতির মৌলিক ঈমান-আকীদার মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ইসলামের সাথে জাতির গভীর প্রেম-প্রীতিময় সম্পর্কের ভিত্তি নড়ে উঠেছে। বিপর্যয় ও অনিষ্টকারিতার ‘সিপাহসালার’ শয়তান যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল হুবহু তারই চিত্র যেন আজ ফুটে উঠেছে।
শয়তান বলেছিলঃ
“আমি (হামলা করার জন্য) এদের (মানব জাতির) সামনে থেকে আসবো, পিছন থেকে আসবো, ডান দিক থেকে আসবো, বাম দিক থেকে আসবো।“ (সূরা আরাফঃ ১৭)
এ অবস্থায় আমাদের অনেক কল্যাণকামী বন্ধু দুনিয়ার ঝামেলা থেকে সরে এসে সংসারের একান্তে বসে কেবল নিজের মুসলমানিত্বটুকু বজায় রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালাবার উপদেশ দান করে থাকেন। অবশ্য এ অবস্থার মধ্যে অবস্থান করা মামুলী ব্যাপার নয়। সাধারণ অবস্থায় প্রত্যেক সৎ ব্যক্তি নৈতিকতার আদর্শকে কায়েম রাখে। কিন্তু নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলার প্রবল বাত্যা পরিবেষ্টিত হয়ে উন্নত নৈতিক বৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে দূরে অবস্থান করে নিজেদের স্বাস্থ্যোন্নতির কাজে ব্যাপৃত থাকে এবং নিশ্চিন্তে মহামারিকে নৈতিক মৃত্যুর বিভীষিকা চালিয়ে যাবার ব্যাপক অনুমতি দান করে, তাহলে আমাদের মতে এর চাইতে বড় স্বার্থপরতা আর হতে পারে না। মাজারের নিকট যে সমস্ত মূল্যবান প্রদীপ ও স্বর্ণনির্মিত বাতিদান অযথা আলোক বিচ্ছুরণ করে, অথচ তাদের সন্নিকটে বনে-জঙ্গলে মানুষের কাফেলা পথভ্রষ্ট হয়ে দস্যুহস্তে লুন্ঠিত হয়, সেই প্রদীপ ও বাতিদানের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব যেমন সমান মূল্যহীন, ঠিক তেমনি যে ঈমান, ইসলাম ও তাকওয়া চতুষ্পার্শের পরিবেশকে আলোকিত করার জন্য কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে বিরোধী শক্তির ভয়ে মসজিদে আশ্রয় খুঁজে ফেরে, তাও হৃদয়-মনের জন্য নিছক স্বর্ণালংকার বৈ আর কিছুই নয়। চরিত্রের যে ‘মূলধন’কে ক্ষতির আশঙ্কায় হামেশা সিন্দুকের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় এবং যা হামেশা অনুৎপাদক (Unproductive) অবস্থায় বিরাজিত থাকে, সমাজ জীবনের জন্যে তার থাকা না থাকা সমান। মুসলমান নারী-পুরুষ এবং মুসলিম দলের নিকট চরিত্র ও ঈমানের কিছু ‘মূলধন’ থাকলে তাকে বাজারে আবর্তন (Circulation) করার জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারপর মূলধন নিয়োগকারীদের মধ্যে যোগ্যতা থাকলে সে মূলধন লাভসহ ফিরে আসবে, আর অযোগ্য হলে লাভ তো দূরের কথা আসল পুঁজিও মারা পড়বে। কিন্তু বাজারে আবর্তিত হতে থাকার মধ্যেই পুঁজির স্বার্থকতা। অন্যথায় যত অধিক পরিমাণ পুঁজিই জমা করা হোক না কেন তা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে বাধ্য।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ যখন তাদের চরিত্র ও ঈমানের ন্যূনতম পুঁজি এ পথে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তখন একে কেবল ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই নয়, বরং দেশ ও জাতির এবং আমাদের নিজেদেরকেও এ থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জনের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একজন স্বল্প পুঁজিদার ব্যবসায়ীর ন্যায় আমাদের রক্ত পানি করা উপার্জনকে ব্যবসায়ে খাটাবার ব্যাপারে পূর্ণ সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত। এর পরিচালনা এবং দেখা-শুনার জন্য যাবতীয় উপায়ও অবলম্বন করা কর্তব্য। মহামারী আক্রান্ত এলাকায় জনগণের সেবা করার জন্য আমাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনই হচ্ছে এ কঠিন পরীক্ষাক্ষেত্রে আমাদের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন। এ সম্পর্ক তার প্রত্যাশিত সর্বনিম্নমানের নীচে নেমে আসলে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ও তৎপরতা দুনিয়াদারীর রঙে রঙিন হয়ে উঠবে এবং শয়তানের জন্য আমাদের হৃদয়-মনের সমস্ত দুয়ার খুলে যেতে পারে। অতঃপর গোনাহের সৈন্যদের বিবেকের দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশের পথে আর কোন বাঁধা থাকে না। আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং তাকে ভবিষ্যত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রয়োজন অনুযায়ী তরক্কী দেবার জন্য কমপক্ষে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের প্রতি অধিক দৃষ্টিদান অপরিহার্যঃ
১. আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে আমাদের আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত কোন কর্মী মৌলিক ইবাদতসমূহ পরিত্যাগ করেনি। কিন্তু কেবল ইবাদত অনুষ্ঠানই যথেষ্ঠ নয় বরং এ ব্যাপারে পূর্ণ নিয়মানুবর্তিতা এবং এই সঙ্গে আল্লাহর ভয়ে ভীত হবার ও তার সম্মুখে নত ও বিনম্র হবার গুণাবলীও সৃষ্টি হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আমরা এখন কাঙ্ক্ষিত মানের সবচাইতে নীচে অবস্থান করছি। এটা এমন একটি দুর্বলতা যে, এর উপস্থিতিতে যদি আমরা বড় বড় সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি (বলাবাহুল্য যে জীবন সংগ্রাম থেকে আমরা আলাদা থাকতে পারিনা) তাহলে আমাদেরকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত অনুষ্ঠানের জন্য যে সকল বিধি-বিধান দান করেছেন এবং এগুলোর মাধ্যমে যে সকল অবস্থা সৃষ্টির প্রত্যাশা করেন; কুরআন ও হাদীসের সাহায্যে আমাদের সহযোগীদের সেগুলো অবগত হওয়া, অতঃপর সে সব যথাযথভাবে সম্পাদনের ব্যবস্থা করা উচিত। বিশেষ করে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে সময়ের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ের লোভ যদি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি না হয় তাহলে নামাজে আল্লাহভীতি, নতি ও বিনম্র ভাব সৃষ্টি হওয়া কঠিন। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, ইবাদতের সাথে সাথে আত্মবিচারে অভ্যস্ত না হলে ইবাদতের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার সম্ভব নয়। আত্মবিচারের অনুপস্থিতিতে ইবাদতের বাইরের কাঠামো যতই পূর্ণাঙ্গ হোক না কেন তা অন্তঃসারশূণ্যই থেকে যায়।
২. আল্লাহর সাথে সম্পর্কের বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধনের জন্য কুরআন ও হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন করা উচিত। কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ ও তার রাসূল বর্ণিত শিক্ষার উপর যে দলের সমগ্র প্রচেষ্টা-তৎপরতা নির্ভরশীল, সে দলের কর্মীগণ যদি প্রত্যহ ঈমান ও জ্ঞানের ঐ ঊৎসদ্বয়ে অবগাহন করার চেষ্টা না করেন, তাহলে যে কোন মুহুর্তে তাদের বিপথে পরিচালিত হবার সম্ভাবনা আছে। আধুনিক যুগের জনপ্রিয় জাহিলিয়াতসমূহের যে সকল অন্ধকার গলিপথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে এবং সাহিত্য-শিল্প জ্ঞানের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিপদসংকুল বনপথে যে সকল দস্যু দলের ব্যুহভেদ করে আমাদের অগ্রসর হতে হবে তার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্বীনি শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রদীপ হাতে না নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে এক ফার্লং পথও অতিক্রম করা সম্ভবপর নয়।
যে আদর্শ ও মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা প্রচেষ্টারত তার তাৎপর্য ও দাবীসমূহ সরাসরি তার আসল উৎস থেকে জানবার জন্য আমাদেরকে কিছু সময় অন্তত এক-আধ ঘন্টা বা পনের-বিশ মিনিট ব্যয় করা উচিত। খুব বেশী সম্ভব না হলেও প্রত্যহ মাত্র একটি আয়াত ও একটি হাদীস পাঠ করি, তার অর্থ পুরোপুরি অনুধাবন করে বাস্তব জীবনে তাকে কার্যকরী করতে প্রয়াস পাই; তাহলে ইনশাল্লাহ হকের এ ঔষধগুলো পরিমানের স্বল্পতা সত্ত্বেও তাদের ধারাবাহিকতার কারণে আমাদেরকে আদর্শবিরোধী পরিবেশের বিষবাষ্প থেকে রক্ষা করবে।
যে সকল বই-পত্র কুরআন-হাদীস বুঝার ব্যাপারে সাহায্য করে, বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের বই-পত্রগুলো নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। অনেক কর্মী কিছু কিছু বই-পত্র অধ্যয়ন করে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেছেন এবং আর বেশী অধ্যয়ন করার তাগিদ অনুভব করছেন না। তারা মনে করেছেন যে, তারা আন্দোলন ও সংগঠনকে পুরোপুরি বুঝে নিয়েছেন। অথচ এটা তাদের নেহায়েত ভুল ধারণা বৈ আর কিছু নয়। কিছু কর্মী এমনও আছেন যারা কয়েক বছর আগে একবার যে বইগুলো পড়ে নিয়েছেন, সেগুলো পুণর্বার পড়ে নতুনভাবে প্রেরণা সৃষ্টি করার প্রয়োজনবোধ করেন না অথচ সমস্ত বই-পত্র পড়া এবং বার বার পড়া অত্যন্ত জরুরী।
৩. আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে নফল ইবাদতের উপর যথাসম্ভব গুরুত্বারোপ করা প্রতি যুগের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য অপরিহার্য বিবেচিত হয়ে এসেছে। নফল ইবাদত নিয়মিতভাবে করা এবং এ ব্যাপারে বিশেষ করে গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রয়োজন। নফল ইবাদতের মধ্যে নফল নামাজ, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাজের স্থান অতি উচ্চে। তাহাজ্জুদ নামাজ ইসলামী আন্দোলনের সৈন্যদের জন্য কঠিন পর্যায় অতিক্রমে সর্বোত্তম সহায়কে পরিণত হয়।
নফল ইবাদতের মধ্যে দ্বিতীয় হচ্ছে নফল রোজার। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য এটি উত্তম উপায়। মাসে তিনদিন রোজা রাখা সুন্নত, বরং এক যুগ রোজা রাখার সমান। এছাড়াও হাদীসে বিশেষ বিশেষ দিবসে রোজা রাখাকে পছন্দনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে এ ব্যাপারে নরম নীতি অবলম্বিত হয়েছে। প্রতি দশ দিনে বা প্রতিমাসে একদিন নফল রোজা রাখা যেতে পারে।
নফল ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর পথে ব্যয় করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের উপার্জন তথা অর্থের একটি অংশ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োগ করার জন্য পৃথক করে রাখতে অভ্যস্ত হতে হবে। এছাড়া আমাদের আন্দোলনের মূলে পানি সিঞ্চন করার দ্বিতীয় কোন পথ নেই। বরং এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমানে কাজের এমন সব পর্যায় দেখা দিচ্ছে যেখানে হয়ত নিজেদের সৌন্দর্যোপকরণসমূহ বিক্রি করে আমাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য রসদ যোগাতে হবে। আমরা জানি আমাদের বন্ধুদের অধিকাংশই গরীব, মুষ্টিমেয় কয়েকজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং পার্থিব স্বার্থ থেকে দূরে অবস্থানকারী। এ আন্দোলনের পিছনে ধনিক শ্রেনীর কোন সমর্থন নেই। এ অবস্থায় আমাদের সদস্য ও সমর্থকগণ যে পর্যায়ের আর্থিক কুরবানী করে বায়তুলমালকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, কোন পার্থিব স্বার্থভোগী দল তার নজীর পেশ করতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ জানেন, নবীর (স) সাহাবাগণ আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার যে নজির উপস্থাপন করেছেন আমাদের এ আর্থিক কুরবানী তার তুলনায় এখনও অনেক নিম্নমানের। চিন্তা করুন! বর্তমানে আমরা যে নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, সেখানে যদি বায়তুলমালে প্রয়োজনীয় পরিমান খাদ্য সরবরাহ না হওয়ার কারণে আন্দোলনের শিরা-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালিত হতে না পারে এবং নিছক এতটুকুন কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহর নিকট আমরা কি জবাব দেব। তাই আমাদের আল্লাহর পথে অর্থব্যয় করার প্রেরণাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
৪. আল্লাহর সাথে সম্পর্কের জন্য সার্বক্ষণিক যিকির ও দোয়া হচ্ছে একটি মৌলিক প্রয়োজন। আল্লাহর নবী (স) সংসার ত্যাগের ধারণা মিশ্রিত যিকিরের পরিবর্তে তার উম্মতকে দিবা-রাত্রের প্রত্যেকটি কাজের জন্য অসংখ্য দোয়া ও যিকির শিখিয়েছেন। এগুলো যেন শয়নে, জাগরণে, চলাফেরায়, ওঠা-বসায় তথা প্রত্যেকটি কাজে জারী থাকে।
ঘুম থেকে ওঠার জন্য, ঘর থেকে বের হবার জন্য, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য, কোন আনন্দ মুহুর্তে, কোন দুঃখ-কষ্টের সময়, কোন ত্রুটি সাধিত হলে, কোন কাজ শুরু করার জন্য, আজান শুনে, ওজু করার সময়, হাঁচি দিলে, মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত হলে, পানি পান করার সময় – অর্থাৎ ছোট-বড় প্রত্যেকটি কাজে রাসূলুল্লাহ (স) আল্লাহর যিকির ও তার নিকট দোয়ার জন্য বহু ছোট ছোট সুন্দর কথা শিখিয়েছেন। সজ্ঞানে ও সচেতন মনে এ কথাগুলি উচ্চারণ করার সময় মুসলমান নিজেকে তার প্রভু ও মালিক আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত রাখে। আল্লাহকে ভুলে দুনিয়ার কর্মব্যস্ততার মধ্যে সে কখনও নিজেকে হারিয়ে ফেলে না। যিকির ও দোয়ায় তার জীবন ভরপুর হয়ে ওঠে।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে কখনো সুবহানাল্লাহ (আল্লাহ সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি, ক্ষতি, স্বল্পতামুক্ত পাক পবিত্র), কখনো আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য), কখনও আস্তাগফিরুল্লাহ (আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি), কখনো লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তি সহায় নেই), কখনো সাদাকাল্লাহু ওয়া রাসূলুহু (আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন), কখনো রাব্বিগফির ওয়ারহাম (হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার প্রতি রহম করো), কখনো আনতা অলীয়্যী ফিদ্ দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ (হে আল্লাহ! দুনিয়া ও আখিরতে তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু), কখনো হাসবিয়াল্লাহু রাব্বি (আমার মালিক আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট), কখনো নেয়মাল মাওলা ওয়া নেয়মাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমার সর্বোত্তম বন্ধু ও শ্রেষ্ঠ সহায়) বলতে থাকে এবং তা আন্তরিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলতে থাকে। * এভাবে নিজের সর্বশক্তিমান মালিক ও প্রভুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সে প্রতি পদে পদে সেই মহান সর্বশক্তিধর, সত্ত্বার নিকট সৎকর্ম করার জন্য শক্তি সময় সুযোগ কামনা করে। তাঁর নিকট থেকে পথের সন্ধান লাভ করে, কল্যাণ কামনা করে, শয়তানের তৎপরতার মুকাবিলায় তাঁর নিকট আশ্রয় চায়, নিজের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এমনিভাবে তার সমগ্র জীবন যিকির, কল্যাণ ও ন্যায় নিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
*যিকির ও দোয়াগুলোর আরবীরূপঃ
(১) سـُبحَـا نَ الله
(২) الحمد لله
(৩) اسـتـغـفـر الله
(৪) لا حـولا ولا قـوة الا بـالله
(৫) صدق الله و رسـولـه
(৬) رب اغـفـر وارحـم
(৭) انـت ولـي فـى الـدنـيـا والا خـرة
(৮) حـسـبـى الله ربـى
(৯) نـعـم الـمـولـى ونـعـم الـوكـيـل-
আমাদের প্রত্যেক কর্মীর জন্য এ ধরণের সচেতন মনে সার্বক্ষণিক যিকিরে অভ্যস্ত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। উপরন্তু প্রতিমুহূর্তে নিজের ঈমান, চরিত্র, ছবর, তাওয়াক্কুল, সংযম ও নিয়মানুবর্তিতার দৃঢ়তা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য দোয়া করা উচিত। এ শক্তি যে কোন সংগ্রামে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রমাণিত হতে পারে।
বলাবাহুল্য, যে যিকির ও দোয়া সচেতন মনের অভিব্যক্তি নয়, যার সাথে মানসিক অবস্থার যোগ নেই, যা আল্লাহর উপস্থিতির অনুভূতিহীন, যা প্রদর্শনেচ্ছার কলুষযুক্ত এবং নিছক স্নায়ুবিক ব্যায়ামের পর্যায়ভুক্ত, তা থেকে আকাঙ্খিত ফল লাভ সম্ভব নয়। কাজেই যিকির-দোয়া, চিন্তা ও চেতনার সাথে হওয়া উচিত এবং সাথে সাথে প্রদর্শনেচ্ছা থেকেও মুক্ত হওয়া উচিত।