আখেরাত
মৃত্যুর পরে জীবন আছে কি? যদি থাকে তবে তা কোন্ ধরনের জীবন? এ প্রশ্নের উত্তর প্রকৃতপক্ষে আমাদের জ্ঞান সীমার বহির্ভূত। কেননা মৃত্যুর সীমারেখার পরপারে কি আছে এবং কি নেই, তা উঁকি মেরে দেখার মতো চক্ষু আমাদের নেই। ওপারের কোনো আওয়ায শোনার মতো কান আমাদের নেই এবং এমন কোনো উপকরণও আমাদের কাছে নেই, যার দ্বারা সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তা জানা যেতে পারে। বিজ্ঞানের যতোটুকু ক্ষেত্র, এ প্রশ্ন তার সম্পূর্ণ বহির্ভূত। যে ব্যক্তি বিজ্ঞানের নামে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে অস্বীকার করে, সে নিশ্চিতরূপে অবৈজ্ঞানিক কথা বলে। মৃত্যুর পরে কোনো জীবন আছে- বিজ্ঞানের সহায়তায় একথা যেমন বলা যায় না ; তেমনি তা নেই বলে ঘোষণা করা চলে না, যে পর্যন্ত না এতদসম্পর্কিত জ্ঞান লাভের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র আবিষ্কৃত হয়। অন্ততঃপক্ষে তদ্বিধ নির্ভুল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি একমাত্র এটাই হতে পারে যে, আমরা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করবো না।
কিন্তু বাস্তব জীবনে এ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কি কার্যকরী? মোটেই নয়। বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে কোনো একটা জিনিস সন্বন্ধে অবগত হওয়ার যাবতীয় উপকরণ হস্তগত না হওয়া পর্যন্ত ‘না’ অথবা ‘হাঁ’ সূচক কোনো সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কোনো জিনিসের সাথে যখন আমাদের কার্যপদ্ধতি স্থির করা ছাড়া কোনোই উপায় থাকে না, তখন তা অবশ্যই করতে হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কোনো এক ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কিছুই অবগত নন এবং তার সাথে আপনার কোনো কাজ-কারবার করারও ইতিপূর্বে প্রয়োজন হয়নি। এমতাবস্থায় এ ব্যক্তি বিশ্বস্ত হওয়া না হওয়া সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু উক্ত ব্যক্তির সাথে যদি আপনার কোনো কাজ-কারবার করতেই হয়, তাহলে তাকে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য কিংবা বিশ্বাস-অযোগ্য মনে করে নিতে আপনি বাধ্য হন। আপনি নিশ্চয়ই বলতে পারেন যে, বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী বলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমি তার সাথে সন্দিগ্ধ অবস্থায় কারবার করবো। কিন্তু বিশ্বাসী হওয়ার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ মনে আপনি যে কারবার তার সাথে করবেন, বাস্তব ক্ষেত্রে তার ধরন অবিশ্বাস্য ব্যক্তির মতোই হবে। অতএব প্রকৃতপক্ষে স্বীকার ও অস্বীকার ও মধ্যবর্তী সন্দিগ্ধ অবস্থায় স্থিরিকৃত হতে পারে না। এর জন্য তো সুস্পষ্ট স্বীকার কিংবা চূড়ান্ত অস্বীকারই অপরিহার্য।
সামান্য মনোনিবেশ ও গবেষণা দ্বারাই এটা আপনার বোধগম্য হবে যে, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কীত প্রশ্নটি মাত্র একটি দার্শনিক প্রশ্নই নয়, বরং আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যদি আমার এ ধারণা থাকে যে, জীবনের সবকিছু এ পার্থিব জীবন পর্যন্তই শেষ এবং এরপর অপর কোনো জীবন নেই, তাহলে আমার নৈতিক ব্যবহার এক ধরনের হবে। আর যদি আমার ধারণা থাকে যে, এরপর আরও একটি জীবন আছে যাতে আমার বর্তমান জীবনের হিসাব প্রদান করতে হবে এবং আমার এ জীবনের কার্যকলাপের ভিত্তিতেই সেখানে ভালো কিংবা মন্দ ফল গ্রহণ করতে হবে ; তাহলে নিশ্চয়ই আমার নৈতিক কার্যপদ্ধতি পূর্বোক্ত ধরনের জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। এর উদাহরণ এভাবে বুঝুনঃ যেমন এ ব্যক্তি এ ধারণা নিয়ে ভ্রমণ করছে যে, তাকে এখান থেকে করাচি পর্যন্ত যেতে হবে এবং করাচি পৌঁছার পর এ ভ্রমনের শুধু চির সমাপ্তিই ঘটবে না, বরং সে সেখানে পুলিশ আদালত এবং সওয়াল-জওয়াব করার অধিকারী সকল শক্তির নাগালের বাইরে চলে যাবে।
পক্ষান্তরে অপর এক ব্যক্তি এ ধারণা রাখে যে, এখান থেকে করাচি পর্যন্ত তার সফরের প্রথম মনজিল। এরপর তাকে সমুদ্রের পরপারে এমন এক দেশে যেতে হবে, যে দেশের বাদশাহই এই দেশের বাদশাহ এবং তাঁর অফিসে এ ব্যক্তি এ দেশে যা করেছে তৎসম্পর্কিত সম্পূর্ণ গুপ্ত রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। তার কৃতকর্ম অনুসারে কোন্ ধরনের ব্যবহার তার সাথে করা যেতে পারে, তা উক্ত রেকর্ড পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এ দুই ব্যক্তির কার্যপদ্ধতিতে কি পরিমাণ পার্থক্য থাকবে, তা আপনি সহজেই অনুমান করতে পারেন। প্রথম ব্যক্তি এখান থেকে করাচি পর্যন্ত সফরের উপযোগী পাথেয় সংগৃহিত করবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ব্যক্তির পাথেয় সংগৃহিত হবে পরবর্তী দীর্ঘ সফরের জন্যও। প্রথম ব্যক্তি মনে করবে- লাভ-লোকসান যা কিছু হবার তা পৌঁছা পর্যন্তই, এরপর আর কিছুই নেই। দ্বিতীয় ব্যক্তি মনে করবে যে, প্রকৃত লাভ-লোকসান সফরের প্রথম মনজিলে নয় বরং সর্বশেষ মনজিলেই দেখা দিবে।
প্রথম ব্যক্তি নিজের কার্যকলাপের সেই সমস্ত ফলাফলের প্রতিই নজর রাখবে যা করাচি পৌঁছা পর্যন্ত প্রকাশিত হতে পারে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তির মনোযোগ সেই সমস্ত ফলাফলের প্রতি থাকবে, যা সমুদ্রের অপর পার্শ্বস্থ দেশে পৌঁছার পর প্রকাশিত হতে পারে। এ দুই ব্যক্তির কার্যপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য ভ্রমণ সম্পর্কে তাদের ধারণা পার্থক্যেরই যে ফল তা সুস্পষ্ট। ঠিক এভাবেই মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কিত ধারণা আমাদের বাস্তব জীবনের ধারা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে থাকে। বাস্তব কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করতে হলেই উক্ত পদক্ষেপের প্রকৃতি নিরূপণ এ প্রশ্নেরই উপর নির্ভরশীল যে, এ জীবনকেই প্রথম ও শেষ জীবন মনে করে কাজ করা হচ্ছে, অথবা পরবর্তী কোনো জীবন ও তার ফলাফলের প্রতিও আস্থা আছে। প্রথমোক্ত অবস্থায় আমাদের পদক্ষেপ এক প্রকৃতির হবে এবং শেষোক্ত অবস্থায় তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হবে।
এ আলোচনা থেকে জানা গেলো যে, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কিত প্রশ্নটা নিছক খেয়ালী দার্শনিক প্রশ্ন নয় ; বরং বাস্তব জীবনেরই প্রশ্ন। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সন্দিগ্ধ ও দোদুল্যমান মনোভাব গ্রহণ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। সন্দিগ্ধ অবস্থায় জীবন যাপনের যে পদ্ধতিই আমরা অবলম্বন করবো, তা অস্বীকারকারীর জীবন পদ্ধতির মতোই হবে। ফল কথা মৃত্যুর পরে অন্য কোনো জীবন আছে কিনা, এ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য। বিজ্ঞান যদি আমাদেরকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে অক্ষম হয়, তবে আমাদেরকে বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।
এখন বুদ্ধির সাহায্যে বিচার করার জন্য আমাদের কাছে কি উপকরণ আছে তাই আমরা সর্বপ্রথম যাচাই করে দেখবো।
আমাদের সামনে প্রথম উপকরণ হচ্ছে স্বয়ং মানুষ এবং দ্বিতীয় উপকরণ হচ্ছে বিশ্বপ্রকৃতি। আমরা মানুষকে এ বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যস্থলে রেখে বিচার করে দেখবো যে, মানুষ হিসেবে তার সমস্ত দাবি-দাওয়া সৃষ্টির বর্তমান পরিচালনা ব্যবস্থায় মিটে যাচ্ছে, না কোনো দাবি অর্পূণ থাকছে বলে তার জন্য একটি ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজন হতে পারে। মানুষের দেহটিই বিচার করে দেখুন তা বহু খনিজ পদার্থ লবন, পানি এবং গ্যাসের সমষ্টি। এর সাথে সমান্তরালভাবে সৃষ্টি জগতে মাটি, পাথর, ধাতু, লবণ, গ্যাস এবং অনুরূপ অন্যান্য জিনিস বিদ্যমান। এ সমস্ত জিনিসের স্ব স্ব কাজ করার জন্য বিধানের প্রয়োজন। উক্ত বিধান সৃষ্টি জগতের সর্বত্রই সক্রিয় এবং তা বাইরের পরিবেশে পাহাড়, নদী ও বায়ূকে যেমন স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের পূর্ণ সুবিধা দিয়ে থাকে, তেমনি মানুষের দেহও ঐ বিধানের অধীন কাজ করার অধিকার পায়।
দ্বিতীয়ত, মানুষের দেহ চতুষ্পাশ্বস্থ দ্রব্যসমূহ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বর্ধিত ও প্রতিপালিত হয়। এ ধরনেরই বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, ঘাস ইত্যাদি সমষ্টিসমূহের মধ্যেও বর্ধনশীল দেহধারীদের প্রয়োজনীয় বিধানের অস্তিত্ব দেখা যায়।
তৃতীয়ত, মানুষের দেহ জীবন্ত ও স্বেচ্ছায় নড়া-চড়া করে, নিজের খাদ্য নিজেই সংগ্রহ করে, নিজের রক্ষণাবেক্ষণ নিজেই করে থাকে এবং নিজের বংশ বিস্তারেরও ব্যবস্থা করে থাকে। সৃষ্টিজগতে এ ধরনেরও বিভিন্ন জীবন বিদ্যমান রয়েছে। জল, স্থল ও বায়ূমণ্ডলে এমন অসংখ্য জীব-জন্তুর সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের সামগ্রিক জীবনের উপর পরিব্যাপ্ত থাকার উপযোগী বিধানও ঐ সমস্ত জীবন্ত অস্তিত্বের উপর পূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল।
এসবের উর্ধ্বে অন্য ধরনের আরও একটি সত্ত্বা মানুষের আছে, যাকে আমরা নৈতিক জীবন বলে অভিহিত করি। তার মধ্যে ভালো ও মন্দ কাজ করার অনুভূতি আছে। ভালো মন্দের পার্থক্যবোধ আছে, ভালো কিংবা মন্দ কাজ অনুসন্ধান করার শক্তি আছে এবং কৃতকর্মের ভালো কিংবা মন্দ ফল প্রকাশ্যভাবে লাভ করার একটি প্রকৃতিগত বাসনাও তার মধ্যে বিরাজ করছে। যুলুম, ইনসাফ, সত্যবাদিতা ও মিথ্যা, হক ও না হক, দয়াশীলতা ও নির্মমতা, কৃতজ্ঞতা ও কৃতঘ্নতা, দানশীলতা-কার্পণ্য ও বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি শ্রেণীর নৈতিক গুনাগুণসমূহের মধ্যেও মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই পাথর্ক্য করে থাকে। এসব গুণ কাল্পনিক নয়, বরং মানুষের বাস্তব জীবনে এটা ক্রিয়াশীলরূপে পরিদৃষ্ট হয় এবং কার্যত এদের প্রভাব মানুষের তামাদ্দুনিক জীবনে প্রকাশিত হয়। অতএব মানুষ জাতি স্বভাবতই দৈহিক কাজের ফলাফলের ন্যায় নৈতিক কাজের ফলাফল লাভ করার প্রয়োজনীয়তাও তীব্রভাবে অনুভব করে।
কিন্তু সৃষ্টিজগতের পরিচালনা ব্যবস্থার প্রতি সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখুন, মানুষের নৈতিক কার্যকলাপের ফলাফল পূর্ণরূপে এখানে প্রকাশিত হতে পারেনি? আমি আপনাদেরকে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে জ্ঞাপন করছি যে, এখানে তার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কেননা আমাদের জানা মতে নৈতিক জীবনের অধিকারী অপর কোনো সৃষ্টির সন্ধান পাওয়া যায় না। সারাটি বিশ্ব প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে। নৈতিক বিধান এর কোনো অংশেই কার্যকারীরূপে দৃষ্ট হচ্ছে না। এখানে টাকার ওজন এবং মূল্য দুই-ই আছে, কিন্তু সত্যকে ওজন করা যায় না। তার মূল্যও নির্ধারণ করা চলে না। এখানে আমের বীজ থেকে সর্বদা আম বৃক্ষ অংকুরিত হয়। কিন্তু সত্যের বীজ বপনকারীদের প্রতি কখনও পুস্প বৃষ্টি, আর কখনও জুতা বর্ষণ হয়ে থাকে। এখানে দৈহিক অস্তিত্বসম্পন্নদের জন্য নির্দিষ্ট বিধান আছে এবং সেই বিধানানুযায়ী সর্বদা ফলাফল প্রকাশিত হয়। কিন্তু নৈতিক কার্যসমূহের জন্য এমন কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই যাতে ফলাফল সর্বদা একই ধরনের হতে পারে। প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলার দরুন নৈতিক ফলাফল কখনও পাওয়া যাবে,যতটুকু প্রাকৃতিক বিধানের অধীন সম্ভব। কখনও এরূপ হয়ে থাকে যে, কোনো একটি নৈতিক কাজ এর স্বাভাবিক পরিণতি স্বরূপ একটি বিশেষ ফলের সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও প্রাকৃতিক বিধানের সংমিশ্রণে এর ফল সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হয়ে যায়। মানুষ নিজেই তাদের তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপসমূহের এক বাঁধা-ধরা ফল প্রাপ্তির যৎসামান্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ চেষ্টা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং বিরাট ত্রুটিপূর্ণ। একদিকে প্রাকৃতিক বিধান এ চেষ্টাকে সীমাবদ্ধ এবং ত্রুটিপূর্ণ করে রেখেছে এবং অপরদিকে মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতাসমূহ এ ত্রুটিকে আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছে।
আমি আমার বক্তব্য কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে পরিষ্কার করতে চাই। এক ব্যক্তি যদি অন্য এক ব্যক্তির শত্রুতা করে এবং তার ঘরে অগ্নিসংযোগ করে, তবে তার ঘর জ্বলে যাবে, এটা এ কাজের প্রাকৃতিক পরিণতি। এর নৈতিক ফল স্বরূপ অগ্নি সংযোগকারীর সেই পরিমাণ শাস্তি পাওয়া উচিত, যে পরিমাণ ক্ষতি উক্ত পরিবারটির হয়েছে। কিন্তু এ ফল প্রকাশিত হওয়া কয়েকটি শর্তের উপর নির্ভরশীল। যথা অগ্নি সংযোগকারীর সন্ধান পাওয়া, তাকে গ্রেফতার করতে পুলিশের সক্ষম হওয়া, তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া, আদালতের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও তাদের পরবর্তী বংশধরদের ক্ষতির সঠিক হিসাব নির্ধারণ সম্ভব হওয়া এবং ন্যায়পরায়ণতার সাথে তাকে ঠিক পরিমাণ মতো দণ্ড দান করা। এ সমস্ত শর্তের কোনো একটিও পূরণ না হলে হয় নৈতিক ফল আদৌ প্রকাশিত হবে না ; আর না হয় তা খুবই সামান্য প্রকাশিত হবে। এমনও হবার সম্ভবনা আছে যে, নিজের শত্রুকে সমূলে ধ্বংস করে সেই ব্যক্তি দুনিয়াতে পরম সুখে বর্ধিত ও প্রতিপালিত হতে থাকবে।
এটা থেকেও একটি বড় ধরনের উদাহরণ নেয়া যাক। মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক নিজেদের জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করে বসে এবং সমগ্র জাতি তাদের নির্দেশানুসারে চলতে থাকে। এ অবস্থার সুবিধা গ্রহণ করে তারা জনমনে উৎকট জাতিপূজার রোগ ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র আকাঙ্খা জাগ্রত করে এবং চতুষ্পার্শ্বস্থ জাতিসমূহের সাথে যুদ্ধ বাঁধায় ফলে লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হয়। সমগ্র দেশ ধ্বংসের কবলে পতিত হয় এবং এর প্রভাব পরবর্তী কয়েক পুরুষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ মুষ্টিমেয় লোক যে বিরাট অপরাধে অপরাধী তার যথাযোগ্য ও ন্যায়সংগত শাস্তি এ পার্থিব জীবনে তার পাবে বলে মনে করা যায় কি? যদি তাদের দেহের গোশতসমূহ বেঁচে ফেলা যায় কিংবা জীবন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা যায়। অথবা মানুষের সাধ্যানুযায়ী অন্য কোনো কঠিনতম শাস্তিও দেয়া হয়, তথাপি কোটি কোটি মানুষ এবং তাদের বংশধরদের যে অনিষ্ট সাধন তারা করেছে তার তুলনায় প্রদত্ত শাস্তি অতি নগণ্যই হবে। বস্তুত বর্তমান জগত যে প্রাকৃতিক বিধানের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এতে উপরোক্ত অপরাধের যোগ্য শাস্তিদানের কোনোই উপায় নেই।
পক্ষান্তরে ঐ সমস্ত লোকের কথাও চিন্তা করুন, যারা মানব গোষ্ঠীকে সত্য এবং ন্যায়ের শিক্ষাদান করেছেন, জীবন যাপনের উজ্জ্বল পথপ্রদর্শন করেছেন, যাদের দানে অসংখ্য মানুষ পুরুষানুক্রমে কল্যাণ লাভ করে আসছে এবং আরও পরবর্তী কতো শতাব্দী পর্যন্ত লাভ করবে তার ইয়ত্তা নেই। এ মহৎ ব্যক্তিগণ তাদের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল কি এ পার্থিব জীবনে লাভ করতে পারবে? আপনি কি ধারণা করতে পারেন যে, বর্তমান প্রাকৃতিক বিধানের অধীন এক ব্যক্তি তার এমন সমস্ত কাজের পূর্ণ প্রতিফল লাভ করতে পারে- যার প্রতিক্রিয়া তার মৃত্যুর পরও শত সহস্র বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকে এবং অসংখ্য মানুষকে পরিব্যাপ্ত করে নেয়। উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, প্রথমত বিশ্বের বর্তমান ব্যবস্থা যে বিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাতে মানুষের নৈতিক কার্যকলাপের পূর্ণ ফল লাভ করবার কোনোই অবকাশ নেই। দ্বিতীয়ত এখানকার স্বল্পকালীন জীবনে মানুষ যে সমস্ত কাজ করে থাকে তার প্রতিফল এতো সুদূর প্রসারী এবং দীর্ঘস্থায়ী যে, তা সঠিকভাবে ভোগ করবার জন্য তার হাজার হাজার বরং লক্ষ লক্ষ বছর দীর্ঘায়ুর প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান প্রাকৃতিক বিধানের অধীন মানুষের এতো দীর্ঘায়ূ হওয়াও সম্ভব নয়। এ আলোচনা থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, মানব সত্তার মৃত্ত্বিক আংগিক ও জৈবিক উপাদানসমূহের জন্য বর্তমান প্রাকৃতিক বিশ্বের স্বাভাবিক বিধানসমূহই যথেষ্ট ; কিন্তু নৈতিক দিকের জন্য এ দুনিয়ার জীবন মোটেই যথেষ্ট নয়। এর জন্য এমন একটি বিশ্বজনীন ব্যবস্থার প্রয়োজন, যেখানে নৈতিক বিধানই হবে প্রভাবশীল ও ভিত্তিগত বিধান এবং প্রাকৃতিক বিধান এর অধীনে থেকে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।
সেখানে জীবন সীমাবদ্ধ না হয়ে অসীম হবে এবং এখানে অপ্রকাশিত বা বিপরীত রূপে প্রকাশিত যাবতীয় নৈতিক ফলাফল সেখানে ঠিকভাবে প্রকাশিত হবে। সেখানে সোনা ও রূপার স্থলে সততা ও সত্যবাদিতার মূল্য ওজন হবে। সেখানে অগ্নি শুধু তাকেই দগ্ধ করবে, নৈতিক কারণে যার দগ্ধ হওয়া উচিত।
সেই স্থান সৎলোকদের জন্য সুখময় এবং অসৎলোকদের জন্য দুঃখময় হবে। বুদ্ধিমত্তা ও প্রকৃতি নিঃসন্দেহে এ ধরনের একটি জগত ব্যবস্থার দাবি করে।
বুদ্ধিমত্তা আমাদেরকে ‘হওয়া উচিত’ পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়েই তার কর্তব্য শেষ করে। এখন প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কোনো জগত আছে কিনা সেই সম্পর্কে আমাদের বুদ্ধি ও বিদ্যা উভয়ই কোনো চূড়ান্ত রায় প্রদান করতে সমর্থ নয়। এ ব্যাপারে একমাত্র পবিত্র কুরআনই আমাদের সাহায্য করে। তার ঘোষণা এই যে, তোমাদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রকৃতি যে জিনিসের দাবি করে, প্রকৃতপক্ষে হবেও তাই। বর্তমান প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা পরিচালিত জগত একদিন শেষ হয়ে যাবে এবং এক ভিন্ন ধরনের জগত ব্যবস্থা স্থাপিত হবে যার অধীন আসমান-যমীন এবং সকল জিনিসই ভিন্নরূপ ধারণ করবে।
অতপর সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত যতো মানুষ দুনিয়াতে জন্ম লাভ করেছে তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে এবং একই সময় সকলকে আল্লাহ তাআলার সামনে হাজির করা হবে। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক জীব এবং সমগ্র মানব গোষ্ঠীর পূর্ণ কার্যকলাপের রেকর্ড ভুল-ত্রুটি বিহীন অবস্থায় পেশ করা হবে।
প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিটি কাজে যা এবং যতোটুকু প্রতিক্রিয়া এ দুনিয়াতে দেখা দিয়েছে তার পূর্ণ বিবরণী মওজুদ থাকবে। এসব কার্যকলাপের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহল-ই সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হবে। মানুষের কথা এবং কাজ দ্বারা যাদের উপর সামান্যতম আঁচড়ও লেগেছে, তারাও স্ব স্ব তালিকা পেশ করবে। মানুষ তার নিজের হাত, পা, চোখ ও অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগকে কোন্ ধরনের কাজে ব্যবহার করেছিলো এরা তার সাক্ষ্য দান করবে। অতঃপর সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক এই কার্যবিবরণীর প্রতি পূর্ণ ন্যায়পরায়ণ দৃষ্টি রেখে তাঁর রায় দান করবেন। তাতে কে কি পরিমাণ পুরষ্কার বা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তার ঘোষণা করবেন। এ পুরষ্কার বা শাস্তির ব্যপ্তি এতো বিশাল হবে যে, বর্তমান সীমাবদ্ধ দুনিয়ার মাপকাঠি অনুসারে তার অনুমান করা অসম্ভব। সেখানে সময় ও স্থানের মাপকাঠি ভিন্ন ধরনের এবং প্রাকৃতিক বিধানও অন্য প্রকারের হবে। এখানে যাদের কৃত সৎকর্মসমূহ থেকে অন্যান্য মানুষ হাজার হাজার বছর পর্যন্ত কল্যাণ লাভ করেছে, সেখানে তারা তার পূর্ণ ফল ভোগ করার সুযোগ পাবে, মৃত্যূ, রোগ এবং বার্ধক্য তাদের সুখ হরণ করতে পারবে না। অনুরূপভাবে যাদের দুষ্কর্মের দরুন এ দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ শত-সহস্র বছর যাবত যন্ত্রণা ভোগ করেছে, তারাও সেখাকে কৃত অপরাদের শাস্তি পূর্ণমাত্রায় ভোগ করবে। মৃত্যু কিংবা সংজ্ঞাহীনতা তাদেরকে শাস্তি ভোগ করা থেকে বাঁচাতে পারবে না।
এমন এক জীবন ও জগতের সম্ভবনা যারা অস্বীকার করে তাদের চিন্তাশক্তির সংর্কীণতার জন্য আমার দুঃখ হয়। যদি আমাদের বর্তমান বিশ্বের পক্ষে বর্তমান প্রাকৃতিক বিধান সহকারে আমাদের সামনে মওজুদ থাকা সম্ভব হয়ে থাকে, তবে এরপরে অপর একটি জগত অন্য ধরনের বিধান সহকারে অস্তিত্বশীল হওয়া অসম্ভব হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে? অবশ্য এ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দানের জন্য কোনো বাস্তব প্রমাণ পেশ করা সম্ভব নয়। তার জন্য গায়েবের (অদৃশ্য) প্রতি বিশ্বাস থাকা একান্ত আবশ্যক।
— সমাপ্ত —