ঈমানের বিবরণ
আগের অধ্যায়সমূহে যা বলা হয়েছে আরো সম্মুখে অগ্রসর হবার আগে একবার খতিয়ে দেখা প্রয়োজনঃ
একঃ ইসলাম বলতে যদিও বুঝায় আল্লাহর আনুগত্য ও তার আদেশের অনুবর্তিতা, তথাপি আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী তার ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবন যাপনের পদ্ধতি এবং আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান কেবল মাত্র আল্লাহর পয়গাম্বরের মাধ্যমেই লাভ করা যেতে পারে। তাই ইসলামের নির্ভুল সংজ্ঞা অনুসারে পয়গাম্বরের শিক্ষার উপর ঈমান আনা এবং তাঁর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করাই হচ্ছে ইসলাম। যে ব্যক্তি পয়গাম্বরের পথ বর্জন করে সোজা-সোজি আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর হুকুমের অনুবর্তিতা করার দাবী করে, সে মুসলিম নয়।
দুইঃ পূর্বে আলাদা আলাদা কওমের জন্য আলাদা আলাদা পয়গাম্বর এবং একই কওমের মধ্যে ক্রমাগত একের পর এক পয়গাম্বরের আবির্ভাব হয়েছে। তখনকার দিনে প্রত্যেক কওমের জন্য, “ইসলাম” বলতে বুঝাত সেই র্ধম যা বিশেষ করে সেই কওমের পয়গাম্বর বা পয়গাম্বরগণ শিক্ষা দিয়েছিলেন। যদিও ইসলামের প্রকৃতি প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক যুগে একই ছিল তথাপি শরীয়াত অর্থাৎ আইন ও ইবাদাতের পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন। এ কারণে এক কওমের জন্য অপর কোন কওমের পয়গাম্বরের অনুসরণ অপরিহার্য ছিল না, যদিও সকল পয়গাম্বরের প্রতি ঈমান পোষণ ছিল অপরিহার্য।
তিনঃ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) যখন দুনিয়ায় পয়গাম্বর হিসেবে প্রেরিত হলেন, তখন তার মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা সুস্পন্ন করে দেয়া হল এবং তামাম দুনিয়ার জন্য একই শরীয়াত প্রেরণ করা, তার আনীত শরীয়াত সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য হল। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সকল পয়গাম্বরের প্রবর্তিত শরীয়াত প্রত্যাহৃত হল এবং এরপর কিয়ামত পর্যন্ত যেমন কোন নবী আসবে না, তেমনি আসবে না কোন নতুন শরীয়াত আল্লাহ তা’য়ালার তরফ থেকে। সুতরাং বর্তমানে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর আনুগত্যের নামই হচ্ছে ইসলাম। তাঁর নবুয়াতের স্বীকৃতি, তাঁর প্রতি প্রত্যয়ের ভিত্তিতে তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা মেনে চলা এবং তার সকল হুকুমকে আল্লাহর হুকুম মনে করে তার আনুগত্য করাই হচ্ছে ইসলাম। আর এমন কোন ব্যক্তি আল্লাহর তরফ থেকে আসবেন না যাঁকে মেনে চলা মুসলমান হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত থাকবে এবং যাকে না মানলে মানুষ কাফের হয়ে যাবে।
হযরত মুহাম্মাদ (সা) কোন কোন জিনিসের উপর ঈমান পোষণ করার শিক্ষা দিয়েছেন এবং তা মেনে নিলে মানুষ কিরূপ উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে;তা-ই আমি এখন বলব।
আল্লাহর প্রতি ঈমান
হযরত মুহাম্মাদ (সা-এর সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছেঃ
اللّهُ اِلّا اِلَهَ لآ
“আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই।”
এ কালেমা-ই হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ-যা দিয়ে এক কাফের এক মুশরিক ও এক নাস্তিক থেকে মুসলিমের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। এ কালেমার স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি দ্বারা এক মানুষ ও অপর মানুষের মধ্যে বিপুল পার্থক্য রচিত হয়। এ কালেমার অনুসারীরা পরিণত হয় এক জাতিতে এবং অমান্যকারীরা হয় তাদের থেকে স্বতন্ত্র জাতি। এর অনুসারীরা দুনিয়া থেকে শুরু করে আখেরাতে পর্যন্ত উন্নতি, সাফল্য ও সম্মানের অধিকারী হয় এবং অমান্যকারীদের পরিণাম হচ্ছে ব্যর্থতা অপমান ও পতন।
এ ছোটখাট কথাটি কেবল মুখে উচ্চারণ করার ফলেই মানুষে মানুষে এ বিপুল পার্থক্য রচিত হতে পারে না; মুখে দশ লক্ষ্য বার ‘কুইনিন’ ‘কুইনিন’ বললে এবং তা সেবন না করলে যেমন ম্যালেরিয়া কখনো ছাড়তে পারেনা, তেমনি মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উচ্চরণ করলে, অথচ কি তার অর্থ, এ ক’টি শব্দ উচ্চরণ করে কত বড় জিনিসের স্বীকৃতি দান করা হল এবং এ স্বীকৃতির ফলে নিজের উপর কত বড় দায়িত্ব গ্রহণ করা হল তা যদি বুঝতে না পারা যায় তা হলে না বুঝে এমনি উচ্চারণ করার ফলে কারো কোন কল্যাণই সাধিত হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে প্রার্থক্য কেবল তখনই আসতে পারে, যখন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-র তাৎপর্য অন্তরে প্রতিভাত হবে, তার অর্থের উপর পূর্ণ প্রত্যয় জন্মাবে এবং তাঁর বিরোধী যত রকম বিশ্বাস আছে, তা থেকে মন সম্পূর্ণরূপে মুক্তি লাভ করবে এবং আগুনের দাহিকা শক্তি ও বিষের মুত্যু ঘটাবার মতার প্রতি বিশ্বাস যতটুকু প্রভাব বিস্তার করে এ কালেমার প্রতি বিশ্বাস ও মন-মস্তিষ্কের উপর কমপক্ষে ততটা প্রভাব বিস্তার করবে। যেমন করে আগুনের প্রকৃতি সম্পর্কে ঈমান মানুষকে আগুনের স্পর্শ থেকে দূরে রাখে এবং বিষের প্রকৃতির উপর ঈমান বিষ পান থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি করে বিশ্বাস ও কর্মের সকল ক্ষেত্রে এ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার উপর ঈমান শিরক, কুফর, নাস্তিকতা প্রভৃতি দুষ্কুতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রূপ থেকে মানুষ কে বিরত করে রাখবে।
‘লা -ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- র অর্থ
‘ইলাহ’ বলতে কি বুঝায়, সবার আগে তা-ই বুঝে নিতে হবে। আরবী ভাষায় ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ইবাদাতের যোগ্যঃ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব ও মহত্বের যে সত্তা উপাসনার যোগ্য এবং বন্দেগী ইবাদাতে যাঁর সামনে মস্তক অবনমিত করা যায়। ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থে এ তাৎপর্য ও শামিল রয়েছে যে, তিনি হবেন অনন্ত শক্তির অধিকারী যে শক্তির উপলব্ধি মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির সীমানা অতিক্রম করে যায়। ‘ইলাহ’ শব্দের তাৎপর্যের মধ্যে এও রয়েছে যে, তিনি নিজে কারুর মুখাপেক্ষী হবেন না, অথচ আর সবাই জীবনের সকল ব্যাপারে তাঁর মুখাপেক্ষী হবে এবং তাঁর কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতে বাধ্য হবে। ‘ইলাহ’ শব্দের মধ্যে রহস্যময়তার অর্থও নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ ‘ইলাহ’ তাকেই বলা যায়, যাঁর শক্তির উপর থাকবে রহস্যের আবরণ। ফারসী ভাষায় ‘খোদা’, হিন্দী ভাষায়, দেবতা, ইংরেজী ভাষায় ‘গড’ শব্দও এর কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার হয় এবং দুনিয়ার অন্যান্য ভাষায় একই অর্থে বিশেষ বিশেষ শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
‘আল্লাহ’ শব্দটি হচ্ছে একক -লা শরীক আল্লাহর ‘ইসমে জাত’ বা মৌলিক নাম, মূল সত্তার পরিচায়ক নাম। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটির শব্দগত তরজমা হচ্ছে কোন ইলাহ নেই সেই বিশেষ সত্তা ব্যতীত যাঁর নাম আল্লাহ। এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, সমগ্র সৃষ্টিতে আল্লাহ ব্যতীত এমন আর কোন সত্তার অস্তিত্ব নেই, যে উপাসনা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে। তিনি ব্যতীত এমন যোগ্যতাসম্পন্ন আর কেউ নেই, ইবাদাত বন্দেগী ও আনুগত্যে যার সামনে মস্তক অবনমিত করা হয়। তিনিই একমাত্র সত্তা, যিনি তামাম জাহানের মালিক ও বিধানকর্তা, সবকিছুই তাঁর মুখাপেক্ষী, সবাই একমাত্র তাঁর কাছ থেকেই সাহায্য কামনা করতে বাধ্য। তিনি মানুষের উপলব্ধির বাইরে লুক্কায়িত এবং তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করতে গিয়ে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র প্রকৃত তাৎপর্য
উপরে তা কেবল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটির শাব্দিক অর্থ বিশ্লেষণ করা গেল। এখন তার সঠিক তাৎপর্য পর্যালোচনা করব।
মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম যুগের যেসব তথ্য আমাদের হাতে এসেছে এবং প্রাচীনতম জাতিসমূহের যে সব ধ্বংসাবশেষ সন্ধান আমরা পেয়েছি, তা থেকে বুঝা যায়, প্রত্যেক যুগের মানুষ কোন না কোন খোদাকে মেনে নিয়েছে এবং কোন না কোন ধরনের ইবাদাত করেছে। আজো দুনিয়ার যত জাতি রয়েছে-তারা নিতান্ত আদিম প্রকৃতির হোক অথবা সুসভ্য হোক, তাদের সবারই মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই যে, তারা কোন বিশেষ সত্তাকে খোদা বলে মানছে, তার ইবাদাত করেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, খোদার ধারণা মানুষের প্রকৃতির শামিল হয়ে আছে। তার ভিতরে এমন কোন জিনিস রয়েছে যা তাকে বাধ্য করেছে কাউকে খোদা মানতে ও তার ইবাদাত করতে।
এরপর প্রশ্ন ওঠে মানুষের মধ্যে সেই বিশেষ জিনিসটি কি? প্রত্যেকটি লোক তার নিজের অস্তিত্বের প্রতি ও সকল মানুষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আপনা থেকেই এর জবাব উপলব্ধি করতে পারবে।
প্রকৃতপক্ষে, মানুষ বান্দা হয়েই পয়দা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সে পরমুখাপেক্ষী, দুর্বল ও দুঃস্থ। তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যে অসংখ্য জিনিসের প্রয়োজন, তা তার শক্তির আধিপত্যের অধীন নয়। কখনো আপনা থেকেই তা তার হাতে আসে, আবার কখনো বা সে তা থেকে বঞ্চিত হয়।
এমন অনেক জিনিসই তো রয়েছে, যা তার পক্ষে কল্যাণকর। সে তা অর্জন করতে চায়;কিন্তু সেই সব জিনিস কখনো তার হাতে আসে, কখনো বা আসেনা; কারণ সেই সব জিনিস অর্জন করার স্বাধীন ক্ষমতা আদৌ তার নেই।
আবার এমন অনেক জিনিস আছে, যা তার অনিষ্ট সাধন করে, তার সারা জীবনের পরিশ্রম মুহুর্তে বিনষ্ট করে দেয়, তার সকল আশা-আকাংখাকে ধূলি-লুন্ঠিত করে দেয় তাকে ব্যাধী ও মৃত্যুর কবলগ্রস্ত করে দেয়। সে চায় সেই সব অনিষ্টকর জিনিসকে ধ্বংস করে দিতে;কখনো তা ধ্বংস হয়, কখনো হয়না। তার ফলে সে উপলব্ধি করে যে, সেই সব জিনিসের আসা না আসা, দূর হওয়া না হওয়ার উপর তার কোন কর্তৃত্ব নেই।
এমন অনেক কিছুই রয়েছে, যার শান-শওকত ও বৃহত্ব দেখে মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। পাহাড়, নদী ও ভয়াবহ হিংস্র জানোয়ারের রূপ তার চোখের সামনে আসে। ঝড়ঝঞ্জা, প্লাবন ও ভুমিকম্পের নগ্নরূপ সে দেখতে পায়। মেঘের গর্জন, অন্ধকার ঘনঘটা, বজ্রের হুংকার বিজলীর চমক ও মুষলধারা-বৃষ্টির দৃশ্য একের পর এক তার চোখের সামনে আসতে থাকে। সে দেখে যে, এসব জিনিস কত বড়, কত শক্তিশালী, কত মহিমাময় আর তার তুলনায় সে নিজে কত দুর্বল কত নগণ্য।
এসব বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য ও তার নিজের দীনতার বিভিন্ন প্রমাণ চোখের সামনে দেখে মানুষের অন্তরে স্বতঃই নিজের দাসত্ব (বন্দেগী), পরমুখাপেক্ষিতা ও দুর্বলতার অনুভুতি জাগ্রত হয় এবং সেই অনুভূতির সাথে সাথেই জন্মে আল্লাহর ধারণা। যে হাতের ইংগিত চালিত হয় এসব মহাশক্তি, তাঁর ধারণা তার মনে জাগ্রত হয়। তাঁর শক্তির অনুভূতি মানুষকে বিনয়-নম্র করে, তারই কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতে বাধ্য করে। তাঁর কল্যাণদায়ক শক্তির অনুভূতি মানুষকে বাধ্য করে বিপদ মুক্তির জন্য তাঁরই সামনে হস্ত প্রসারিত করতে। তার অনিষ্টকর শক্তির অনুভূতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর ভীতি অন্তরে পোষণ করতে এবং তাঁর গযব থেকে বাঁচার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে।
অজ্ঞতার সর্বনিম্ন স্তর তাকেই বলা যায়, যখন মানুষে এসব ঐশ্বর্য ও শক্তিতে প্রত্যক্ষ করেও তাদের কল্যাণকর বা অনিষ্টকর রূপ দেখে মনে করে যে, এরাই খোদা, তারা পূজা করতে থাকে জানোয়ার, পাহাড় ও নদীকে। তারা পূজা করে যমীন, আগুন, বৃষ্টি, হাওয়া, চন্দ্র, সূর্য ও আরো কত শক্তির।
যখন এ অজ্ঞতার মাত্রা কিছুটা কম থাকে এবং জ্ঞানের আলোক কিছুটা পাওয়া যায়, তখন বুঝা যায় যে, এসব জিনিস মানুষেরই মত পরমুখাপেক্ষী কত বড় জানোয়ার তুচ্ছ মশা-মাছির মত মরে যায়;প্রকান্ড প্রকান্ড নদীর পানি ওঠে, নামে, শুকিয়ে যায়, মানুষ নিজেই কেটে ফেলে পাহাড়। যমীনের ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ হওয়া তার নিজর ইচ্ছাধীন নয়, পানি যখন তাকে সাহায্য করেনা, তখনই যমীন হয় শুষ্ক অনুর্বর। পানিও নিজের খুশী মত চলতে পারে না, তাকেও হতে হয় হাওয়ার মুখাপেক্ষি। হাওয়াও নিজের ক্ষমতার অধীন নয়, তার কল্যাণ অকল্যাণ নির্ভর করে অন্যবিধ কল্যাণের উপর। চন্দ্র, সূর্য, তারকার কোন বিশেষ বিধানের আনুগত্য করে চলে। এ বিধানের বাইরে তারা কখনো তাদের গতির বিন্দুমাত্র রদবদল করতে পারে না। এসব দেখে শুনে মানুষের মন কোন অদৃশ্য রহস্যাবৃত মুক্তির দিকে ফিরে যায় তখন সে ভাবতে থাকে যে, এসব দৃশ্যমান বস্তুসমূহের অন্তরালে রয়েছে এমন রহস্যাবৃত শক্তিপুঞ্জ, যারা পরিচালিত করছে তাদেরকে এবং সবকিছুই হচ্ছে এ শক্তিপুঞ্জের অধীন। এখান থেকেই বহু খোদা ও বহু দেবতার ধারণার উদ্ভব হয়েছে। এ অবস্থাতেই মানুষ মেনে নিয়েছে আলো, হাওয়া, পানি ব্যাধি, স্বাস্থ্য ও আরো বহু জিনিসের আলাদা আলাদা খোদার অস্তিত্ব। তাদের কাল্পনিক মূর্তি তৈরী করে তারা করে চলেছে তাদের পূজা।
এরপর যখন আরো বেশী করে জ্ঞানের আলো আসতে থাকে, তখন মানুষ দেখতে পায় যে, দুনিয়ার ব্যস্থাপনা চলছে এক শক্তিশালী আইন ও এক বড় রকমের বিধানের অনুসরণ করে। হাওয়ার গতি, বৃষ্টির আগমন, গ্রহ উপগ্রহের আবর্তন, ঋতুসমূহের পরিবর্তনের মধ্যে কি নিয়ম শৃঙখলা বিরাজমান; কিভাবে অগণিত শক্তি মিলে- মিশে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বজগতের এ সামঞ্জস্য লক্ষ্য করে একজন মুশরিককেও মেনে নিতে হচ্ছে যে, সব ছোট ছোট খোদার উপর রয়েছে সবার বড় এক খোদার সার্বভৌম আধিপত্য; নইলে এসব ভিন্ন ভিন্ন খোদা অনন্য নির্ভশীল ও স্বতন্ত্র হলে এবং সর্বত্র তাদের স্বেচ্ছাতন্ত্র চালিযে গেলে বিশ্বের এ বিপুল বিরাট কারখানা বির্পযস্ত হয়ে যেত এই বড় খোদার নাম দিয়েছে সে ‘আল্লাহ’ ‘পরমেশ্বর’ ‘খোদায়ে খোদাগান’ -আরো কত কিছু। উপাসনার ক্ষেত্রে ছোট খোদাকেও শরীক করেন তাঁর সাথে। তার ধারণা আল্লাহর কর্তৃত্ব চলছে পার্থিব রাজা-বাদশাহর রাজত্বেরই মত। যেমন দুনিয়ার এক বাদশাহ রাজত্ব করেন তাঁর থাকে বহু মন্ত্রী, বিশ্বস্ত অনুচর, শাসনকর্তা ও দায়িত্বশীল কর্মচারী, তেমনি করে এ সৃষ্টির উপর রয়েছেন এক বড় খোদা; আর বহু ছোট ছোট খোদা রয়েছে তাঁর অধীনে। যতক্ষণ না এসব ছোট ছোট খোদা কে খুশী করা যাবে, ততক্ষণ বড় খোদার কাছে যাওয়া যাবে না। সুতরাং তাদেরও উপাসনা কর তাদের কাছে হাত পাত, তাদের অসন্তোষের ভয় কর, তাদেরকে বড় খোদার কাছে পৌঁছাবার মাধ্যমে পরিণত কর এবং নযর- নিয়ায দিয়ে তাদেরকে খুশী রাখ।
আবার যখন জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরো উন্নত হতে থাকে খোদার সংখ্যা তখন আরো কমতে থাকে। অজ্ঞ মানুষেরা যত খোদা তৈরী করে রেখেছে, তার মধ্যে এক একটির চিন্তা করলে মানুষ বুঝতে পারে যে, সে খোদা-ই নয়। সে আমাদেরই মত এক বান্দাহ, এবং আমাদের চেয়েও বেশী অসহায় সে। এমনি করে একে একে এসব কাল্পনিক খোদা পরিত্যক্ত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত কেবল এক খোদাই অবশিষ্ট থাকেন। কিন্তু এ এক খোদা সম্পর্কে ও মানুষের ধারণার অনেকখানি অজ্ঞাতার পরিচয় পাওয়া যায়। কেউ ধারণা করে যে, খোদা আমাদের মত রক্ত মাংসের দেহের অধিকারী এবং তিনি এক নির্দিষ্ট স্থানে বসে তাঁর খোদায়ী চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ মনে করে খোদা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে মানুষের মত বাস করেন এবং মানুষের মত তাঁর সন্তান-সন্তুতির ধারা চলে আসছে। কেউ আবার অনুমান করে যে খোদা দুনিয়ার মানুষের আকৃতি ধারণ করে অবতরণ করে দুনিয়ায়। কেউ বলে খোদা এ দুনিয়ার কারখানা চালু করে দিয়ে নির্বিকভাবে বসে আছেন এবং কোথাও আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। কারুর ধারণা, খোদার কাছে বুযর্গ লোকদের আত্মা সমূহের সুপারিশ অপরিহার্য এবং তাদের মাধ্যমে ব্যতীত সেখানে কোন কাজ চলতে পারে না। কেউ তার ধারণায় আল্লাহর এক বিশেষ রূপ পরিকল্পনা করে নেয় এবং উপাসনার জন্য সেইরূপ সম্মুখে স্থাপন করার অপরিহার্য প্রয়োজন অনুভব করে। তাওহীদ বিশ্বাস পোষণ করা সত্ত্বেও এ ধরনের বহুবিধ ভুল ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে থাকে, যার ফলে মানুষ শিরক অথবা কুফরে নিমজ্জিত হয়। এর সব কিছুই হচ্ছে অজ্ঞতার পরিণতি।
সবার উপরে রয়েছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটির স্থান। এ হচ্ছে সেই জ্ঞান যা খোদ আল্লাহ তা’য়ালাই প্রত্যেক যুগে তার নবীদের মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন। এ জ্ঞান সবার আগে তিনি হযরত আদম (আ) কে দিয়ে তাঁকে দুনিয়ায় অবতীর্ণ করেছিলেন। আদম (আ) এর পরে এ জ্ঞান লাভ করেছিলেন হযরত নূহ (আ), হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত মূসা (আ) ও অন্যান্য সকল পয়গাম্বর। আবার এ জ্ঞান নিয়েই সবার শেষে দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছিলেন হযরত মুহম্মাদ (সা)। এ নির্ভুল জ্ঞানের মধ্যে কোন অজ্ঞতার স্পর্শ নেই। উপরে শিরক বুতপরস্তি ও কুফরের যত রূপ আমি বর্ণনা করেছি, মানুষ পয়গাম্বরদের শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজস্ব উপলব্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করেছে বলেই তাতে জড়িত হয়েছে। এবার এ ছোট খাট কথাটির অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করব।
একঃ সবার আগে বিবেচ্য প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর ধারণা। এই সীমাহীন বিশ্ব-প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এর আদি ব্যবস্তাপনা ও অন্ত সর্ম্পকে ভাবতে গিয়ে আমাদের মন বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। এক অজানা যুগ থেকে শুরু হয়েছে এর গতি এবং অজানা যুগের দিকে চলছে এগিয়ে। এর ভিতরে পয়দা হয়েছে সীমাসংখ্যাহীন অনন্ত সৃষ্টি এবং আরো পয়দা হয়ে চলছে। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এমন বিস্ময়কর যে, তা উপলব্ধি করতে গিয়ে মনুষ্য জ্ঞান বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। এ বিপুল সৃষ্টির খোদায়ী কেবল তাঁরই পক্ষে সম্ভব, যিনি নিজে সীমাবন্ধনহীন, অনন্তকাল ধরে যিনি জীবন্ত, যিনি কারুর মুখাপেক্ষি নন, যিনি স্বাধীন, সর্বশক্তিমান, সার্বভৌম শক্তির অধিকারী ও সর্বজ্ঞ, সকল বস্তুর জ্ঞান যিনি রাখেন, কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন থাকতে পারেনা। সবার উপর যিনি বিজয়ী এবং যাঁর হুকুম অমান্য করতে কেউ পারে না, যিনি অনন্ত শক্তির মালিক এবং আপনা থেকে যাঁর কাছ থেকে সৃষ্টির সকল জীবের কাছে পৌঁছে জীবন ও জীবিকার সামগ্রী, যিনি সকল অভাব ত্রুটি ও দুর্বলতা দোষ থেকে মুক্তি এবং যাঁর কার্যে অপর কারুর হস্তক্ষেপ চলতে পারে না।
দুইঃ আল্লাহর কর্তৃত্বের এসব গুণ কেবল একটি মাত্র সত্তার ভিতরে সীমাবদ্ধ হওয়াই অপরিহার্য। একাধিক সত্তার মধ্যে এ সবগুণের অস্তিত্ব সমভাবে থাকা অসম্ভব, কারণ সবার উপর বিজয়ী ও সার্বভৌম শক্তির অধিকারী মাত্র একজনই হতে পারেন। এসব গুণরাজী ভাগাভাগী করে বহু খোদার মধ্যে বন্টন করে নেয়া ও তেমনি অসম্ভব। কেননা এক খোদা যদি হন সার্বভৌম শক্তির অধিকারী, অপর এক খোদা সর্বজ্ঞ, অপর একজন হন জীবন দানকারী তা হলে প্রত্যেক খোদাকে হতে হয় অপরের মুখাপেক্ষী এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা না থাকলে মুহুর্তে এ সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। এও সম্ভব হতে পারে না যে, এসব গুনরাজী এক থেকে অপরের কাছে ন্যস্ত হবে অর্থাৎ এর কোন গুণ কখনো থাকবে এক খোদার মধ্যে; আবার কখনো থাকবে অপর খোদার মধ্যে; কেননা যে খোদা নিজেকে জীবন্ত রাখার মতো ক্ষমতার অধিকারী নয়, সারা সৃষ্টিকে জীবন দান করা তার পক্ষে অসম্ভব এবং যে খোদা নিজের খোদায়ী সংরক্ষণ করতে পারে না, এত বড় বিরাট সৃষ্টির উপর কর্তৃত্ব চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়; সুতরাং যত বেশী করে জ্ঞানের দীপ্তি লাভ করা যাবে মনে তত বেশী প্রত্যয় জন্মাবে যে, কেবলমাত্র একই সত্তার মধ্যে আল্লাহর গুণরাজীর সমাবেশ হওয়া অপরিহার্য।
তিনঃ আল্লাহর কর্তৃত্বের পরিপূর্ণ ও নির্ভুল ধারণাকে দৃষ্টির সামনে রেখে সকল সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করা যেতে পারে। যতসব জিনিস দৃষ্টি পথে আসে, যা কিছু জ্ঞানের পরিধির মধ্যে আসে, তার কোন কিছুর মধ্যেই এসব গুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যাবে না। বিশ্ব-প্রকৃতির সবকিছু অপরের মুখাপেক্ষী ও অপর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত; তারা জন্মে, পরিবর্তিত হয়, মরে ও বাঁচে। কোনকিছুই অপরিবর্তিত অবস্থায় স্থায়ী হয়ে থাকতে পারে না। কারুরই নিজের খেয়াল খুশী অনুযায়ী কিছু করার মতা নেই। সর্বোপরি যে আইন বলবৎ রয়েছে তার চুল পরিমাণ অতিক্রম করার ক্ষমতা কারুর নেই। তাদের মধ্যে আল্লাহর সামান্যতম দ্যুতিও দেখা যায় না। আল্লাহর কার্যকলাপের মধ্যে তাদের কারুর বিন্দুমাত্র দখল নেই। লা-ইলাহা-র মানে হচ্ছে এই।
চারঃ বিশ্ব-জগতের সকল পদার্থের আল্লাহর কর্তৃত্ব অস্বীকার করার পর একথা অংগীকার করতেই হবে যে সর্বোপরি রয়েছেন আর এক স্বতন্ত্র সত্তা। একমাত্র তিনিই হচ্ছেন সকল কর্তৃত্বের গুণরাজীর অধিকারী এবং তিনি ব্যতীত আর কোন আল্লাহ নেই। ইল্লাল্লাহ-র মানে হচ্ছে এই।
সকল জ্ঞানের সেরা জ্ঞান হচ্ছে এই। যতই অনুসন্ধান ও গবেষণা চালানো যাবে, ততই বুঝতে পারা যাবে যে, জ্ঞানের শুরু এখানেই এবং শেষ সীমানাও এতেই সীমাবদ্ধ। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতিষ, ভূতত্ব, জীবতত্ত্ব, মানবীয় তত্ত্ব-এক কথায় বিশ্ব জগতের রহস্য অনুসন্ধানের যে কোন পথই অবলম্বন করা হবে, সেখানে গবেষণা চালিয়ে অগ্রসর হতে হতে লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ-র সত্যতা ক্রমাগত উদঘাটিত হতে থাকবে এবং তার প্রতি প্রত্যয় ক্রমাগত বেড়ে যাবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতি পদে অনুভূত হবে যে, সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এ সত্যকে অস্বীকার করার পর সৃষ্টির যে কোন জিনিস নিরর্থক হয়ে যায়।
মানব জীবনে তাওহীদ বিশ্বাসের প্রভাব
‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ-’র স্বীকৃতি ঘোষণা করলে তার ফলে মানব জীবনে কি প্রভাব পড়ে এবং এ কালেমা অমান্যকারী দুনিয়া ও আখেরাতে কেন ব্যর্থ হয়, তার বর্ণনা এখানে পেশ করছি।
একঃ এ কালেমায় বিশ্বাসী ব্যক্তি কখনো সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী সম্পন্ন হতে পারে না। সে এমন এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী যিনি যমীন ও আসমানের স্রষ্টা, মাশরিক ও মাগরিবের মালিক, তামাম জাহানের পালনকর্তা। এ ঈমানের পর সারা সৃষ্টির কোন বস্তুই তার দৃষ্টিতে নিজের থেকে আলাদা মনে হতে পারে না। আপন সত্তার মতই সে এর সবকিছুকে এই মালিকের আধিপত্যের ও একই বাদশাহর প্রভুত্বের অধীন মনে করে। তার সহানুভূতি, প্রেম ও খেদমত কোন বিশেষ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। আল্লাহর বাদশাহী যেমন অনন্ত অসীম, তার দৃষ্টিভংগী ও তেমনি সীমা বন্ধনহীন হয়ে যায়। এ ধরনের দৃষ্টিভংগি এমন কোন লোকের মধ্যে থাকতে পারে না, যে ছোট ছোট খোদার বহু অস্তিত্ব স্বীকার করে অথচ যার খোদার মধ্যে মানুষেরই মত সীমাবদ্ধও ত্রুটি-বিচ্যুতিপূর্ণ গুণের সমাবেশ হয়, অথবা যে ব্যক্তি গোড়া থেকেই খোদার অস্তিত্বই স্বীকার করে না।
দুইঃ এ কালেমা মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মমর্যাদার অনুভুতি জাগিয়ে তোলে। এর উপর বিশ্বাস পোষনকারী জানে যে, এক আল্লাহ-ই সকল শক্তির মালিক। তিনি ব্যতীত আর কেহ মানুষের কল্যাণ বা অকল্যাণ দান করতে পারে না, কেউ তাকে জীবন দিতে পারে না, মারতে পারে না, এ জ্ঞানও প্রত্যয় তাকে আল্লাহ ব্যতীত অপর যে কোন শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত, আত্মনির্ভরশীল ও নির্ভীক করে তোলে। তার শির কোন সৃষ্টির সামনে অবনমিত হয়না; তার হাত কারুর সামনে প্রসারিত হয় না। তার অন্তরে কারুর শ্রেষ্ঠত্বের আধিপত্য স্থান লাভ করে না। তাওহীদ বিশ্বাস ব্যতীত কোন অন্যবিধ বিশ্বাস থেকে গুণের এ জন্ম হয় না। শিরক কুফর ও নাস্তিকতার অপরিহার্য প্রকৃতি হচ্ছে এইযে, মানুষ তার প্রভাবে সৃষ্টির সামনে অবনমিত হয়। তাকেই কল্যাণ অকল্যাণের মালিক মনে করে, তারই ভয় সে অন্তরে পোষণ করে এবং তার কাছে কোন কিছু প্রত্যাশা করে।
তিনঃ আত্মসম্মানবোধের সাথে সাথে এ কালেমা মানুষের মধ্যে বিনয়ও সৃস্টি করে। এ কালেমার স্বীকৃতিদানকারী কখনো গর্বস্ফীত ও উদ্ধত হতে পারে না। শক্তির গর্ব, সম্পদের গর্ব ও যোগ্যতার গর্ব কখনো তার মনে স্থান লাভ করে না, কারণ সে জানে তার যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর দান এবং তিনি যেমন সবকিছু দেয়ার শক্তি রাখেন, তেমনি সবকিছু নেয়ার শক্তিও তাঁর রয়েছে। এর মুকাবিলায় এমন লোকও রয়েছে যে কোনরূপ পার্থিব কৃতিত্ব অর্জন করে গর্বস্ফীত হয়ে ওঠে। কারণ সে মনে করে যে, তার সে কৃতিত্ব তার যোগ্যতার ফল। এমনি করে শিরক ও কুফরের সাথে অহংকাররের উদ্ভব অপরিহার্য, কেননা মুশরিক ও কাফের ব্যক্তি এ ধারণা পোষণ করে যে তাদের উপাস্য বহু খোদা ও দেবতার সাথে তাদের একটা বিশেষ সম্পর্ক, যা অপরের ভাগ্যে জোটেনা।
চারঃ এ কালেমায় বিশ্বাস পোষণকারী বেশ ভাল করেই জানে, আত্মার শুদ্ধি ও সৎকর্ম ব্যতীত তার মুক্তি ও সাফল্যের আর কোনপথ নেই। কারণ সে এমন এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস পোষণ করে যিনি আত্মনির্ভরশীল, কারুর সাথে যাঁর কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই, যিনি পূর্ণ ন্যায় বিচারক, যাঁর কর্তৃত্বতে আর কারুর হস্তক্ষেপ বা প্রভাব চলতে পারে না। পাক্ষান্তরে যারা মুশরিক ও কাফের তাদের সর্বক্ষণ মিথ্যা আশার উপর নির্ভর করে জীবন যাপন করতে হয়। তাদের মধ্যে কেউ মনে করে যে, খোদ খোদার পুত্র তার পাপের প্রায়শ্চিত করবেন। কেউ মনে করে সে খোদার অনুগৃহীত সুতরাং তার কোন শাস্তি হতে পারে না। কারুর ধারণা তাদের বুযর্গেরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন। কেউ আবার দেবতাকে নযর-নিয়ায দিয়ে ভাবছে, দুনিয়ার বুকে সবকিছু করার স্বাধীনতা সে পেয়েছে। এ ধরনের মিথ্যা বিশ্বাস তাকে সর্বক্ষণ পাপ ও দুস্কৃতির চক্রে টেনে নিয়ে যায় এবং সেই মিথ্যা বিশ্বাসের উপর ভরসা করে আত্মশুদ্ধি ও সৎকর্ম থেকে গাফেল হয়ে থাকে। নাস্তিক ব্যাক্তির ব্যাপারে বলা যায়, সে তো শুরু থেকেই এমন কোন শক্তিমান সত্তায় বিশ্বাস করে না ভাল মন্দ কাজের জন্য যার কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই সে দুনিয়ায় নিজেকে মনে করে যে কোন কাজ করার স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী। এ ধরনের লোকের অন্তরের আকাংখাই হয় তাদের খোদা এবং তারা হয় ইন্দ্রীয়পরতার দাস।
পাঁচঃ এ কালেমার স্বীকৃতিদানকারী কোন অবস্থায়ই হতাশ ও ভগ্ন হৃদয় হয়না। সে এমন এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, যিনি আসমান যমীনের সকল ধনভান্ডারের মালিক, যার মহিমা ও অনুগ্রহ সীমাহীন এবং যাঁর শক্তি অনন্ত। ঈমান তাকে দেয় অসাধারণ শান্তি ও নিশ্চিন্ততা এবং তার অন্তরকে আশায় পরিপূর্ণ করে। দুনিয়ার সকল দুয়ার থেকে সে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরতে পারে, কোন কিছুই তার কাছে না আসতে পারে এবং সকল উপায় ও পন্থা সে একে একে হারাতে পারে, তথাপি এক আল্লাহর উপর নির্ভর-প্রবণতা সে কোন অবস্থায়ই হারায় না এবং তারই বলে সে নতুন আশা বুকে নিয়ে নতুন প্রচেষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে। এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস ব্যতীত অপর কোন বিশ্বাস থেকেই অন্তরের এ নিশ্চিন্ততা লাভ করা যেতে পারে না। মুশরিক, কাফের ও নাস্তিক যারা তাদের অন্তর ছোট হয়ে থাকে, তাদের নির্ভর করতে হয় সীমাবদ্ধ শক্তির উপর। তাই সংকটের পথে, দ্রুত তাদের ঘিরে ফেলে হতাশা এবং অনেক সময়ে এমনি অবস্থায় তাদের আত্মহত্যার পথ ধরতে হয়।
ছয়ঃ এ কালেমার উপর বিশ্বাস মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে দৃঢ় সংকল্প, উচ্চাকাঙ্খা, অধ্যবসায় ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের বিপুল শক্তি। আল্লাহর সন্তোষ বিধানের জন্য যখন সে কোন মহৎ কাজ করার পথে এগিয়ে যায় তখন অন্তরে প্রত্যয় পোষণ করে যে, যমীন ও আসমানের বাদশাহর শক্তি রয়েছে তার পশ্চাতে। এ ধারণা তার ভিতরে পর্বতের দৃঢ়তা সৃষ্টি করে দেয় এবং দুনিয়ার সকল সংকট, বিপদ বিরোধী শক্তি সমূহ মিলিত হলেও তাকে তার সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। শিরক কুফর ও নাস্তিকতায় শক্তি কোথায় পাওয়া যাবে?
সাতঃ এ কালমা মানুষকে বীর্যবান করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে মানুষকে কাপুরুষ করে তোলে দুটো জিনিসঃ এক দিকে ধন-প্রাণ ও সন্তান-সন্তুতির প্রেম, অপরদিকে এ ধারণা যে আল্লাহ ব্যতীত মানুষের মৃত্যু ঘটাবার মত অপর কোন শক্তি রয়েছে এবং মানুষ চেষ্টা করে মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র প্রতি বিশ্বাস এ দুটো জিনিস অন্তর থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। প্রথমটি দূরিভূত হওয়ার কারণ, এ কালেমায় স্বীকৃতিদানকারী নিজের ধন-প্রাণ ও সবকিছুর মালিক বলে জানে একমাত্র আল্লাহকেই এবং সে আল্লাহর সন্তোষের জন্য সবকিছু কুরবান করতে তৈরী থাকে। তারপর দ্বিতীয় ধারণাটি ও তার অন্তরে অবশিষ্ট থাকে না, কারণ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও কালেমার স্বীকৃতিদানকারীর দৃষ্টিতে প্রাণ হরণের ক্ষমতা মানুষ, পশু, তোপ, তলোয়ার, লাঠি, পাথর কোন কিছুরই নেই এ মতের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ এবং তিনি মৃত্যুর যে সময় নির্দেশ করে রেখেছেন, তার আগে দুনিয়ার সকল শক্তি মিলিত হয়েও কারুর প্রাণ হরণ করতে পারে না। এ কারণেই আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণকারীর চেয়ে বেশী বীর্যবান ও সাহসী দুনিয়ার আর কেউ হতে পারেনা। নাংগা তলোয়ারের চমক, কামানের অগ্নিবর্ষণ, বোমাবৃষ্টি ও দুর্দান্ত সেনাবাহিনীর আক্রমণ সবকিছুই তার কাছে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। আল্লাহর পথে যখন সে লড়াই করতে এগিয়ে যায় তখন তার চেয়ে দশগুণ শক্তিশালী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। মুশরিক কাফের ও নাস্তিক এ শক্তি পাবে কোত্থেকে? তাদের কাছে প্রাণই সবচেয়ে প্রিয় বস্তু এবং তারা মনে করে, দুশমনই নিয়ে আসে মৃত্যু; আর দুশমনকে সরিয়ে দিতে পারলেই মৃত্যুকেও সরিয়ে দেয়া যায়।
আটঃ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র প্রতি বিশ্বাস মানুষের মনে সন্তোষ, পরিতুষ্টি ও অনন্যনির্ভরতার গৌরবময় মনোভাব সৃষ্টি করে এবং লোভ লালসা হিংসা ও বিদ্বেষের অবাঞ্চিত মনোভাব তার অন্তর থেকে দূরীভূত করে দেয়। সাফল্য অর্জনের অবৈধ ও ঘৃণ্য ধারণা তার মনে অনুপ্রবেশের অবকাশই পায় না। সে মনে করে যে, রুযী- রোযাগার আল্লাহরই হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছা বেশী করে দেন, যাকে ইচ্ছা কম করে দেন। সম্মান, শক্তি, খ্যাতি ও আধিপত্য আল্লাহর ইখতিয়ারের অন্তগত; তিনি আপন বিবেচনা অনুযায়ী যাকে যেমন ইচ্ছা কম করে দেন। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে নিজ নিজ সীমানার মধ্যে বৈধ উপায়ে চেষ্টা করে যাওয়া। সাফল্য ও ব্যর্থতা আল্লাহর অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। তিনি দিতে চাইলে দুনিয়ার কোন শক্তি তাঁকে বাধা দিতে পারে না আর তিনি দিতে না চাইলে কোন শক্তিই তাঁকে বাধ্য করতে পারে না। পাক্ষান্তরে মুশরিক, কাফের ও নাস্তিকেরা নিজস্ব সাফল্য ও ব্যর্থতাকে নিজস্ব প্রচেষ্টা ও পার্থিব শক্তিসমূহের সাহায্য অথবা বিরোধিতার উপর নির্ভরশীল মনে করে এবং সেই কারনেই তারা থাকে প্রলোভন ও হিংসাবৃত্তির দাস হয়ে। তাই সাফল্য লাভের জন্য ঘুস, খোশামোদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বপ্রকার নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করতে তাদের কোন ভয় নেই। অপরের সাফল্যে তারা পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসায় জ্বলে মরে এবং তাকে-তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ব্যাপরে কোন রকম চেষ্টার ত্রুটি করে না।
নয়ঃ সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র প্রতি বিশ্বাস মানুষকে আল্লাহর আইনের অনুসারী করে তোলে। কালেমার প্রতি ঈমান পোষণকারী বিশ্বাস করে যে আল্লাহ প্রকাশ্য ও গোপন বস্তু সম্পর্কে অবগত আছেন, তিনি আমাদের শাহ্রগ অপেক্ষা অধিকতর নিকটবর্তী। রাতের অন্ধকারে অথচ নিঃসংগ নির্জনতায় যদি আমরা কোন পাপের কাজ করি, তা তিনি জানতে পান। আমাদের অন্তরের গভীরে যদি কোন অসদাকাঙক্ষা জন্ম নেয়, তার খবরও অল্লাহ্র কাছে পৌঁছে যায়। আর সবার কাছে আমরা যা গোপন করতে পারি, আল্লাহর কাছে তা আমরা গোপন করতে পারি না। সবার কাছ থেকে আমরা পালিয়ে বাঁচতে পারলেও আল্লাহর রাজ্যের বাইরে আত্মগোপণ করার সাধ্য আমাদের নেই। সবার কাছ থেকে বাঁচতে পারলেও আল্লাহর হাত থেকে আমরা বাঁচতে পারি না। এ প্রত্যয় যতবেশী শক্তিশালী হবে, মানুষ তত বেশী আল্লাহর আদেশ-নিষেধের অনুগত হবে। যা কিছু আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করে দিয়েছেন, তা তার কাছে ঘেষতে পারবে না। আর যা কিছু করার হুকুম করে দিয়েছেন সে নিঃসংগতা ও অন্ধকারের মধ্যে ও তা পালন করবে। কেননা সে জানে, এমন এক পুলিশ তার পেছনে যে, কখনো কোন অবস্থায়ই তাকে একা ছেড়ে দেবে না এবং এমন এক আদালতের ভীতি তার রয়েছে যার ওয়ারেন্ট এড়িয়ে সে কোথাও পালাতে পারেনা। এ কারণেই মুসলিম হওয়ার সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে জরুরী শর্ত হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাহ ও উপর ঈমান আনা। আগেই যেমন বলা হয়েছে যে, মুসলিম মানে হচ্ছে আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হওয়া, তেমনি আল্লাহর অনুগত হওয়া ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ না মানুষ এ প্রত্যয় পোষণ করে যে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই।
হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বুনিয়াদি জিনিস হচ্ছে আল্লাহর উপর ঈমান। এ হচ্ছে ইসলামের কেন্দ্র ও মূল এবং তার শক্তির উৎস। এ ছাড়া ইসলামের যেসব বিশ্বাস, আদেশ বিধান রয়েছে সবকিছুই দাঁড়িয়ে আছে এরই উপর নির্ভর করে এবং সব কিছুকেই শক্তি সংগ্রহ করতে হয় এ একই কেন্দ্র থেকে। এ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস কে বাদ দিলে এ ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।
আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান
আল্লাহর প্রতি ঈমানের পর নবী করীম (সা) আমাদেরকে ফেরেশতাদের অস্তিত্বের প্রতি ঈমান পোষণের নির্দেশ দিয়েছে। তাঁর এ শিক্ষার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ হচ্ছে এই যে, এর ফলে তাওহীদের বিশ্বাস শিরকের যাবতীয় বিপদ সম্ভাবনা থেকে মুক্ত থাকে।
উপরে বলা হয়েছে যে, মুশিকরা খোদায়ীতে দু’রকমের সৃষ্টিকে শরীক করে নিয়েছে। এ দ্বিবিধ সৃষ্টির মধ্যে একটি হচ্ছে বাস্তব অস্তিত্বশীল ও দৃশ্যমান, যেমনঃ চন্দ্র, সূর্য, তারকা, অগ্নি, পানি বিশেষ বিশেষ মহাপুরুষ প্রভৃতি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সেই ধরনের সৃষ্টি, যাদের কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই, যারা অদৃশ্য এবং পিছনে থেকে সৃষ্টির যাবতীয় শক্তিকে পরিচালিত করে, বিশ্বাস করা হয়ঃ যেমন, একজন হাওয়া পরিচালনা করে, একজন বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থা করে অপর একজন দান করে আলো। এর ভিতরে প্রথমোক্ত ধরনের সৃষ্টি তো মানুষের চোখের সামনেই রয়েছে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বাণীই প্রমাণ করে দেয় যে, আল্লাহর কর্তৃত্বে তাদের কোন অংশই নেই। দ্বিতীয় ধরনের সৃষ্টি হচ্ছে মানব চক্ষুর অন্তরালে রহস্যাবৃত এবং মুশরিকদের এদের উপর বিশ্বাস পোষণের প্রবণতা বেশী দেখা যায়। তারা এসব জিনিসকে মনে করে দেবতা, খোদাও খোদার সন্তান-সন্ততি। এদের কল্পিত মূর্তি করে তারা তাদের সামনে হাযির করে কত নযর-নিয়ায। সুতরাং আল্লাহর একত্বের ধারণাকে এ দ্বিতীয় ধরনের শিরক থেকে মুক্ত রাখার জন্য বিশ্বাসের একটি স্বতন্ত্র ধারা বর্ণনা করা হয়েছে।
হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) আমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে, যেসব রহস্যাবৃত জ্যোর্তিময় সত্তাকে মানুষ দেবতা, খোদা ও খোদার সন্তান-সন্ততি বলে থাকে প্রকৃতপক্ষ তারা হচ্ছে আল্লাহর ফেরেশতা। আল্লাহর কর্তৃত্বে তাদের কোন দখল নেই। তারা সবাই আল্লাহর ফরমানের অনুগত এবং তারা এতটা বাধ্য যে, আল্লাহর হুকুমের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম তারা করতে পারে না। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে নিজের রাজ্য পরিচালনা করেন এবং তারা ঠিক আল্লাহর হুকুম মুতাবিক কাজ করে যায়। নিজের ইচ্ছা ও স্বাধীন ক্ষমতা বলে কিছুই করার ক্ষমতা তাদের নেই। তারা আপন ক্ষমতা বলে আল্লাহর নিকট কোন পরিকল্পনা পেশ করতে পারে না। আল্লাহর দরবারে কারুর জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা ও তাদের নেই। তাদের পূজা ও তাদের সাহায্য ভিক্ষা করা মানুষের পক্ষে অপমানকর; কেননা ‘রোযে আযল’বা সৃষ্টির দিনে আল্লাহর তা’য়ালা তাদেরকে বাধ্য করেছিলেন হযরত আদম (আ) কে সিজদা করতে; আদম (আ) কে তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞান দান করেছিলেন। মানুষকে যে ফেরেশতাকুল সিজদা করেছিল তাদেরকে সিজদা করার ও তাদেরই কাছে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে বড় অপমানকর ব্যাপার মানুষের পক্ষে আর কি হতে পারে?
হযরত মুহাম্মাদ (সা) একদিকে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন ফেরেশতাদেরকে পূজা করতে ও তাদেরকে আল্লাহর শরীক মনে করতে। তিনি আমাদেরকে আরো বলেছেন যে, ফেরেশতা আল্লাহ তা’য়ালা মনোনীত সৃষ্টি। তাঁরা সর্বপ্রকার গোনাহ থেকে মুক্ত। তাঁদের প্রকৃতি এমন যে তাঁরা আল্লাহর আদেশ সমূহ অমান্য করতে পারে না। তাঁরা সর্বক্ষণ আল্লাহর ও বন্দেগী ইবাদাতে মশগুল থাকেন। তাদের মধ্যে একজন মনোনীত ফেরেশতার মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা তার পয়গাম্বরদের কাছে ওহী প্রেরণ করেন, তাঁর নাম হচ্ছে জিবরাঈল (আ)। হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) কাছে কুরআন আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছিল জিবরাইল (আ) এর মাধ্যমে। এ ফেরেশতাদের মধ্যে এক শ্রেণী সর্বদা আমাদের সাথে লেগে আছেন প্রতি মুহুর্তে। ভাল মন্দ গতিবিধি পরীক্ষা করছেন; আমাদের ভালমন্দ প্রত্যকটি মানুষের জীবনের রেকর্ড সংরক্ষিত হচ্ছে। মৃত্যুর পর যখন আমরা আল্লাহর কাছে হাযির হব, তখন তারা আমাদের আমলনামা পেশ করবে এবং আমরা দেখতে পাব যে, জীবনভর গোপনে ও প্রকাশ্যে যা কিছু সৎকর্ম ও দুষ্কর্ম করেছি তার সবকিছুই সংরক্ষিত রয়েছে।
ফেরেশতাদের স্বরূপ আমাদের জানান হয়নি। কেবলমাত্র তাঁদের গুণরাজী আমাদেরকে বলা হয়েছে। তাঁদের অস্তিত্বের উপর প্রত্যয় পোষণের আদেশ হয়েছে। তাঁরা কেমন ও কেমন নয়, তা জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে নেই। সুতরাং নিজস্ব বুদ্ধিতে তাদের সত্তা সম্পর্কে কোন মনগড়া কথা তৈরী করে নেয়া মূর্খতা মাত্র! আবার তাঁদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে কুফরী। কেননা অস্বীকার করার মত কোন দলীল কারুর কাছে নেই এবং অস্বীকৃতির মানে হচ্ছে হযরত মুহাম্মাদ (সা) কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। আমরা তাঁদের অস্তিত্বের উপর ঈমান পোষণ করি কেবলমাত্র এ কারণে যে, আল্লাহ তা’য়ালার সত্যিকার রাসূল আমাদেরকে দিয়েছেন তাদের অস্তিত্বের খবর।
আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান
হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর মাধ্যমে আমাদেরকে তৃতীয় যে জিনিসটির প্রতি ঈমান পোষণের শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাসমূহ যা তিনি নাযিল করেছেন তাঁর নবীদের উপর।
আল্লাহ তা’য়ালা যেমন হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর উপর কুরআন নাযিল করেছেন, তেমনি করে তাঁর আগে যেসব রাসূল অতীত হয়ে গেছেন, তাঁদের কাছেও তিনি তার কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছিলেন। তার মধ্যে কোন কোন কিতাবের নাম আমাদেরকে বলা হয়েছে, যেমন হযরত ইবরাহীম (আ) এর কাছে প্রেরিত ছুহুফে ইবরাহীম (ইবরাহীমের গ্রন্থরাজি ), হযরত মূসা (আ) এর কাছে প্রেরিত তাওরাত, হযরত দাউদ (আ) এর কাছে অবতীর্ণ যবুর এবং হযরত ঈসা (আ) এর কাছে প্রেরিত ইঞ্জিল। এ ছাড়াও অন্যান্য কিতাব বিভিন্ন নবীর কাছে এসেছে, কিন্তু তার নাম আমাদেরকে বলে দেয়া হয়নি। এ কারণে অপর কোন ধর্মীয় কিতাব সম্পর্কে আমরা প্রত্যয় সহকারে বলতে পারি না যে, তা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে তেমনি আবার এথাও বলতে পারি না যে তা আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। অবশ্য আমরা ঈমান পোষণ করি যে, যে কিতাবই আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে, তার সবই পূর্ণ সত্যাশ্রিত ছিল।
যেসব কিতাবের কথা আমাদেরকে বলা হয়েছে, তার মধ্যে ছুহুফে ইবরাহীমের অস্তিত্বই দুনিয়ায় নেই। তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিল ইয়াহুদী ও ঈসায়ীদের নিকট অবশ্য রয়েছে কিন্তু কুরআন শরীফে আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, এসব কিতাবে মানুষ আল্লাহর বাণীকে পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং নিজেদের তরফ থেকে অনেক কথাই তার মধ্যে মিশিয়ে ফেলেছে। ঈসায়ী ও ইয়াহুদীরা নিজেরাই স্বীকার করে যে আসল কিতাবগুলো কাছে নেই, রয়েছে কেবল তার তরজমা এবং তাতেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এসব কিতাব পড়লে পরিস্কার বুঝা যাবে যে, তার মধ্যে এমন বহু কথা রয়েছে যা আল্লাহর তরফ থেকে কখনো আসতে পারেনা। এ কারণে যেসব কিতাব বর্তমান রয়েছে তা ঠিক আল্লাহর কিতাব নয়; তার মধ্যে আল্লাহর কালাম ও মানুষের কালাম মিলে মিশে গেছে এবং কোনটি আল্লাহর কালাম ও কোনটি মানুষের কালাম তা বুঝবারও কোন উপায় নেই। সুতরাং অতীতের কিতাবসমূহের উপর ঈমান পোষণের যে হুকুম আমাদেরকে দেয়া হয়েছে, তার ধরন হচ্ছে কেবল এই যে, আল্লহ তা’য়ালা কুরআন মজীদের আগেও দুনিয়ার প্রত্যেক জাতির কাছে তাঁর আদেশসমূহ আপন নবীদের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন এবং যে আল্লাহর কাছে থেকে কুরআন এসেছে, সেই একই আল্লাহর কাছে থেকেই সেই সব কিতাবও তাঁর হুকুমসমূহ নিয়ে এসেছিল কুরআন কোন নতুন ও অভিনব কিতাব নয়, বরং অতীতের সেই শিক্ষাকে জীবন্ত করার জন্যই তা প্রেরিত হয়েছে, যে শিক্ষা অতীত যুগের লোকেরা পেয়ে বিনষ্ট করে ফেলেছে অথবা পরিবর্তন করেছে অথবা মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত কথার সাথে মিশিয়ে ফেলেছে।
কুরআন শরীফ আল্লাহ তা’য়ালার আখেরী কিতাব। কতকগুলি দিকে দিয়ে তার অতীতের কিতাবসমূহের মধ্যে পার্থক্য রয়েছেঃ
একঃ পূর্বে যেসব কিতাব অবতীর্ন হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশের আসল লিপি দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, রয়ে গেছে কেবলমাত্র সেগুলোর অনুবাদ। কিন্তু কুরআন যেসব শব্দ সম্বলিত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল তা এখনো পুরোপুরি অক্ষুন্ন রয়েছে, তার একটি মাত্রও বর্ণ এমন কি একটি বিন্দু পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি।
দুইঃ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে মানুষ কালামে ইলাহীর সাথে নিজস্ব কালাম মিশ্রিত করে ফেলেছে। একই কিতাবে আল্লাহর কালাম রয়েছে, জাতীয় ইতিহাস রয়েছে, বুযর্গদের অবস্থার বর্ণনা রয়েছে, ব্যাখ্য রয়েছে, বিধান কর্তাদের উদ্ভাবিত বিধান সংক্রান্ত সমস্যার আলোচনা রয়েছে, এবং এর সবকিছুর এমনভাবে সংমিশ্রিত হয়ে আছে যে আল্লাহর কালাম তার ভিতর থেকে আলাদা বাছাই করে নেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কুরআন আমরা পাই নিছক আল্লাহর কালাম এবং তার মধ্যে অপর কারুর কথার বিন্দুমাত্র সংমিশ্রণ ঘটেনি। তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, সিরাতে রাসূল, সীরাতে সাহাবা, ইতিহাস–ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানগণ যা কিছু লিখেছেন, তা সবই কুরআন থেকে আলাদা বিভিন্ন গ্রন্থারাজিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআন মজীদে তার এটি শব্দও মিশ্রিত হতে পারেনি।
তিনঃ দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির কাছে যেসব কিতাব রয়েছে তার মধ্যে একখানি কিতাব সম্পর্কে ঐতিহাসিক দলীল দ্বারা প্রমাণ করা চলে না, তা যে নবীর প্রতি আরোপ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তাঁরই মাধ্যমে তা নাযিল হয়েছিল। বরং বিভিন্ন ধর্মীয় কিতাব এমনও রয়েছে, যার সম্পর্কে গোড়া থেকে বুঝা যায়নি কোন যামানায় কোন নবীর উপর তা অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু কুরআন সম্পর্কে এমন বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে যে, কোন ব্যক্তিই হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে তার যোগাযোগ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে না। এমনকি তার আয়াত সমূহে সম্পর্কে কোন আয়াত কখন কোথায় নাযিল হয়েছিল তাও সঠিকভাবে জানা যায়।
চারঃ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ যেসব ভাষায় নাযিল হয়েছিল, বহুকাল ধরে তা মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে। আজকের দুনিয়ায় কোথাও সে ভাষায় কথা বলবার লোক অবশিষ্ট নেই এবং তা বুঝবার লোকও খুব কমই পাওয়া যায়। এ ধরনের কিতাব যদি অবিকৃত ও নির্ভুল অবস্থায় ও পাওয়া যেত তথাপি তার বিধান সমূহ সঠিকভাবে বুঝা ও তার অনুসরণ করা সম্ভব হত না। অথচ কুরআন যে ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে তা হচ্ছে একটি জীবন্ত ভাষা। দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ আজো এ ভাষায় কথা বলছে, কোটি কোটি মানুষ এ ভাষা জানে ও বুঝে। এর শিক্ষার ধারা দুনিয়ার সর্বত্র জারী রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি এ ভাষা শিখতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি এ ভাষা শিখবার অবকাশ না পায়, প্রত্যেক জায়াগয় সে এমন সব লোকের সন্ধান পেতে পারে, যাঁরা তাকে কুরআন শরীফের অর্থ বুঝিয়ে দেবার যোগ্যতা রাখেন।
পাঁচঃ দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির কাছে যেসব ধর্মীয় কিতাব রয়েছে, তার প্রত্যেক কিতাবে সন্নিবেশিত আদেশসমূহ দেখে বুঝা যায় যে, কেবলমাত্র এক বিশেষ যুগের অবস্থা বিবেচনায় তখনকার প্রয়োজন মিটাবার জন্যই তা প্রেরিত হয়েছিল, কিন্তু এখন তার প্রয়োজনই নেই অথবা তার অনুসরণ করে কাজ করা যায় না। এদ্বারা একটা সত্যই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এসব কিতাব ভিন্ন ভিন্ন জাতির জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এর কোন কিতাবই তামাম দুনিয়ার জন্য আসেনি। আবার যে জাতির জন্য সেই কিতাব এসেছিল তাদের জন্য ও তা সর্বকালে প্রযোজ্য হয়ে আসেনি, বরং তা এসেছিল একটি বিশেষ যামানার জন্য। এবার কুরআনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে এ কিতাবের সর্বত্র সাধারণভাবে মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে। এর কোন একটি ধারা দেখেও এমন সন্দেহ হবেনা যে, তা কোন বিশেষ জাতির উদ্দেশ্যে এসেছে। অনুরূপভাবে এ কিতাবে যেসব বিধান রয়েছে, তা সর্বকালে সর্বত্র কার্যকরী করা যেতে পারে। এদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন সারা দুনিয়ায় সর্বকালে প্রয়োজন।
ছয়ঃ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রত্যেকটিতেই সৎকর্ম ও ন্যায় নীতির কথা বর্ণনা করা হয়েছিল এবং চরিত্র, নৈতিকতা, সততা ও সত্যনিষ্ঠার নীতিসমূহ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। প্রত্যেকটি কিতাবেই আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবন যাপন করার নির্দেশ করা হয়েছিল, একথা সত্যিই, কিন্তু কোন কিতাবই এমন ছিল না, যাতে কোন কিছু বাদ না দিয়ে সকল গুণের সমাবেশ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে আলাদা আলাদা করে যেসব গুণের বর্ণনা দেয়া হয়েছিল, একমাত্র কুরআনেই তার সকল কিছুর সমাবেশ হয়েছে এবং পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যেসব কথা বাদ পড়ে গিয়েছিল তাও এ কিতাবে সন্নিবেশিত হয়েছে।
সকল ধর্মীয় কিতাবে মানুষের কৃত হস্তক্ষেপ ও বিকৃতির দরুন এমন সব কথা মিশ্রিত হয়ে গেছে, যা বাস্তব সত্যের বিপরীত ও যুক্তি বিরোধী এবং যুলুম ও অত্যাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের বিশ্বাস ও কার্যকলাপে তার ফলে বিকৃতিদুষ্ট হয়ে যায়। এমন কি, অনেক কিতাবে অশ্লীলতা ও নৈতিকতা বিরোধী কথাও দেখা যায়। কুরআন এসব বিকৃতি থেকে মুক্ত। তার মধ্যে এমন কোন কথা নেই, যা যুক্তি বিরোধী এবং যা প্রামাণ্য দলীল ও পরীক্ষা দ্বারা ভুল প্রমান করা যেতে পারে। এর কোন হুকুম অবিচারের সংস্পর্শ নেই, এর কোন কথাই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে না এবং এর ভিতর অশ্লীলতা ও নৈতিকতা বিরোধী কথার নাম নিশানা নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারা কুরআন শরীফ উচ্চাংগের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি, ন্যায় বিচারের শিক্ষা, সঠিক পথের নির্দেশ এবং সর্বোত্তম বিধান ও আইন পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের দরুন তামাম দুনিয়ার জাতিসমূহকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন কুরআনের প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং অপর সকল কিতাবকে ছেড়ে একমাত্র এ কিতাবেরই অনুসরণ করে। কেননা আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্য মানুষের যেরূপ পথ নির্দেশের প্রয়োজন তার সবকিছুই এর মধ্যে পরিপূর্ণ ও নির্ভুল ভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার পর আর কোন কিতাবের প্রয়োজন নেই।
কুরআন ও অন্যান্য কিতাবের মধ্যে তফাত কি তা যখন জানা হয়ে গেল তখন প্রত্যেকেই বুঝতে পারে যে কুরআন ব্যতীত অন্যান্য আল্লাহর কিতাবের উপর ঈমানের ক্ষেত্রে কতটা পার্থক্য থাকা প্রয়োজন। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান কেবল তার সত্যতা স্বীকারের সীমানা পর্যন্ত—থাকবে, অর্থাৎ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে সেই সব কিতাবও আল্লাহর তরফ থেকে এসেছিল, সত্যাশ্রিত ছিল এবং যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কুরআন নাযিল হয়েছে সেই একই উদ্দেশ্যে সেই সব কিতাব এসেছে। কুরআনের উপর ঈমান এ ধরনের হবে যে, এ হচ্ছে আল্লহর বিশুদ্ধ কালাম, পরিপূর্ণ সত্যের বাহন এর প্রতিটি শব্দ সুরক্ষিত, এর প্রতিটি উক্তি সত্য এর প্রতিটি আদেশের অনুসরণ করা ফরয। কুরআন বিরোধী যে কোন জিনিসই অগ্রাহ্য করতে হবে।
আল্লাহর রাসূলদের প্রতি ঈমান
কিতাবসমূহের পর আল্লাহর সকল রাসূলের উপর ঈমান পোষণ করার নির্দেশ ও আমাদেরকে দেয়া হয়েছে।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার সকল কওমের মধ্যে আল্লাহর রাসূল এসেছিলেন এবং সর্বশেষ হযরত মুহাম্মাদ (সা) ইসলামের যে শিক্ষা দেয়ার জন্য দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছিলেন, তাঁরাও সেই এক শিক্ষাই দিয়েছিলেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে আল্লাহর সকল রাসুলই একই শ্রেণীর অর্ন্তভুক্ত ছিলেন। কোন ব্যক্তি তাঁদের মধ্যে কোন একজন বিশেষ রাসূলকে মিথ্যা বলে ঘোষণা করলে তার ফলে সকলকেই মিথ্যা ঘোষণা করা হল। এবং অনুরূপভাবে কোন একজন রাসূলের সত্যতা স্বীকার করলে তার পক্ষে সকলেরই সত্যতা স্বীকার করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মনে করা যেতে পারে, দশজন লোক একই কথা বলছেন। তাদের মধ্যে একজনকে সত্যভাষী বলে স্বীকার করে নিলে আপনা থেকেই বাকী নয়জনকে সত্যভাষী বলে স্বীকার করা হয়ে যায়। যদি একজনকে মিথ্যবাদী বলা হয়, তাহলে তার মানে হচ্ছে তাদের কথিত উক্তিকেই মিথ্যা ঘোষণা করা হচ্ছে। তার ফলে তাদের দশজনকেই মিথ্যাবাদী বলা হল। এ কারণেই ইসলামে সকল রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি কোন রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ না করবে সে কাফের হয়ে যাবে, এমনি করে অন্যান্য রাসূলের উপর ঈমান আনলেও এর কোন ব্যতিক্রম হবে না।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে দুনিয়ার বিভিন্ন কওমের কাছে যেসব নবী প্রেরিত হয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল এক লাখ চব্বিশ হাজার। কতকাল ধরে এ দুনিয়ায় মানুষের বসতি হয়েছে আর কত কওম দুনিয়া থেকে অতীত হয়ে গেছে, একথা ভেবে দেখলেই বুঝা যায়, এ সংখ্যাটা খুববেশী নয়। এ সোয়া লাখ নবীর মধ্যে থেকে যাদের নাম কুরআনে আমাদের কাছে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি সুস্পষ্ট ঈমান পোষণ করা অপরিহার্য। বাকী যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবারই সম্পর্কে কেবলমাত্র এ ধারণা পোষণের শিক্ষা আমাদের দেয়া হয়েছে যে, যে লোককেই আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর বান্দাহদের হেদায়াত করার জন্য পাঠানো হয়েছে তাঁরা খাঁটি ছিলেন, সত্যবাদী ছিলেন। হিন্দুস্তান, চীন, ইরান, মিসর, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং দুনিয়ার অন্যান্য দেশে যেসব নবী এসে থাকবেন, আমরা তাঁদের সবারই প্রতি ঈমান পোষণ করি; কিন্তু আমরা কোন বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে যেমন বলতে পারি না যে, তিনি নবী ছিলেন, তেমনি একথাও বলতে পারি না যে, তিনি নবী ছিলেনা। কারণ তাঁর সম্পর্কে আমাদেরকে কিছুই বলা হয়নি। অবশ্যি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা যেসব লোককে তাদের পথপ্রর্দশক বলে মেনে নেয়, তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু বলা আমাদের পক্ষে বৈধ নয়। খুব সম্ভব হতে পারে যে তাঁদের মধ্যে কেউ সত্যিকার নবী ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁদের অনুসারীরা তাদের প্রচারিত ধর্মকে বিকৃত করে ফেলেছে, যেমন করে বিকৃত করেছে হযরত মূসা (আ) ও হযরত ঈসা (আ) এর অনুগামীরা। সুতরাং আমরা যে মত প্রকাশ করব তা তার ধর্ম ও তাঁর রীতিনীতি সম্পর্কেই করব; কিন্তু পথপ্রদর্শকদের সম্পর্কে আমরা নিরবতা অবলম্বন করব, যেন না জেনেশুনে কোন রাসূল সম্পর্কে অসংগত উক্তি করে আমরা অপরাধী না হই।
হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর মত অন্যান্য নবীরাও ছিলেন আল্লহর সত্যিকার পয়াগাম্বর; তাঁরাও ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত, ইসলামের সহজ সরল পথ তারাও দেখিয়েছিলেন এবং তাঁদের সকলের উপর ঈমান পোষণের নির্দেশ আমাদের দেয়া হয়েছে, এদিক দিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁদের মধ্যে কোন তফাত নেই, কিন্তু এমনি সকল দিক দিয়ে সমপর্যায় ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও অন্যান্য পয়গাম্বরদের মধ্যে তিনটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমত, পূর্ববর্তী নবীরা বিশেষ কওম, বিশেষ যামানার জন্য এসেছিলেন এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা) কে প্রেরণ করা হয়েছিল তামাম দুনিয়ার জন্য ও সর্বকালের জন্য নবী হিসেবে। আগের অধ্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
দ্বিতীয়, পূর্ববর্তী নবীদের শিক্ষা হয় দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, অথবা কোনরূপ অবশিষ্ট থাকলেও নিজস্ব স্বরূপ সহ তা রক্ষিত হয়নি। এমনি করে তাঁদের সঠিক জীবন কাহিনী আজ দুনিয়ার কোথাও খুজে পাওয়া যায় না বরং তার সাথে মিলিত হয়ে গেছে সংখ্যাহীন গল্প-কাহিনী। এ কারণেই কেউ তাঁদের পথ অনুসরণ করতে চাইলেও তাঁর পক্ষে তা সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে, হযরত মুহাম্মাদ (সা)–এর শিক্ষা তাঁর পবিত্র জীবন –কথা তাঁর মৌখিক উপদেশ, তাঁর অনুসৃত পন্থা, তাঁর নৈতিক জীবন, স্বভাব ও সৎকর্মসমূহ–এক কথায় তাঁর জীবনের প্রতিটি জিনিস দুনিয়ার বুকে পূর্ণ সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে। এ কারণেই প্রকৃতপক্ষে সকল পয়গাম্বরের মধ্যে কেবল হযরত (সা)-ই একমাত্র জীবন্ত পয়গাম্বর এবং একমাত্র তাঁরই অনুসরণ করা সম্ভব হতে পারে।
তৃতীয়, পূর্ববর্তী নবীগণের মাধ্যমে ইসলমের যে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল তা সুসম্পূর্ণ ছিল না। প্রত্যক নবীর পরে অপর কোন নবী এসে তাঁর আদেশ, আইন ও হেদায়াত সমূহ সংশোধন ও সংযোজন করেছেন এবং সংশোধন ও উন্নতির ধারা বরাবর জারী রয়েছে। এ জন্য এসব নবীর যামানা অতীত হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের শিক্ষাকে আল্লাহ তা’য়ালা সংরক্ষিত করে রাখেননি; কেননা প্রত্যেকটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পর তার পূর্ববর্তী অসম্পূর্ণ শিক্ষার আর প্রয়োজন থাকেনি। অবশেষে হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর মাধ্যমে ইসলামের এমন শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা প্রত্যেক দিকে দিয়ে সুসম্পূর্ণ। তার পূর্বে সকল নবীর শরীয়াত আপনা থেকেই বাতিল হয়ে গেছে, কেননা সম্পূর্ণ জিনিসকে পরিত্যাগ করে অসম্পূর্ণ জিনিসের অনুসরণ করা বুদ্ধি বৃত্তি বিরোধী। যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ (সা) -এর আনুগত্য করবে সে প্রকৃতপক্ষে সকল নবীরই আনুগত্য করবে। তার কারণ হচ্ছে এই যে, সকল নবীর শিক্ষায় যা কিছু কল্যাণকর ছিল তার সবকিছুই মওজুদ রয়েছে হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর শিক্ষায়। আবার যে ব্যক্তি তার আনুগত্য ছেড়ে পূর্ববর্তী কোন নবীর আনুগত্য স্বীকার করবে, সে বহুবিধ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, কেননা যেসব কল্যাণকর নির্দেশ পরবর্তীকালে এসেছে, আগেকার শিক্ষায় তা ছিল না।
উপরিউক্ত কারণে তামাম দুনিয়ার মানুষের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (সা)- এর আনুগত্য করা। মুসলমান হওয়ার জন্য হযরত মুহাম্মাদ (সা)- এর উপর ঈমান আনা তিনটি দিক দিয়ে মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
প্রথমত, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর সত্যিকার পয়গাম্বর।
দ্বিতীয়, তাঁর হেদায়াত সর্বতোভাবে সুসম্পূর্ণ। তার মধ্যে কোন অসম্পূর্ণতা নেই এবং তা সর্বপ্রকার ত্রুটি- বিচ্যুতি থেকে মুক্ত।
তৃতীয়, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর আখেরী পয়গাম্বর। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত কোন কওমের মধ্যে কোন নবী আসবেন না। অতপর এমন কোন ব্যক্তির আবির্ভাব কখনো হবেনা, মুসলমান হওয়ার জন্য যার উপর ঈমান আনা শর্ত হিসেবে গণ্য হবে অথবা যাকে না মানলে কোন ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে।
আখেরাতের উপর ঈমান
পঞ্চম যে জিনিসটির উপর হযরত মুহাম্মাদ (সা) আমাদেরকে ঈমান পোষণের নির্দেশ দিয়েছেন তা হচ্ছে আখেরাত। আখেরাত সংক্রান্ত যে জিনিসের উপর ঈমান পোষণ করা জরুরী তা হচ্ছেঃ
একঃ একদিন আল্লাহ তা’য়ালা সমগ্র বিশ্বজগত ও তার ভিতরকার সৃষ্টিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। এ দিনটির নাম হচ্ছে ‘কিয়ামত’।
দুইঃ আবার তাদের সবাইকে দেয়া হবে নতুন জীবন এবং তারা সবাই এসে হাযির হবে আল্লাহর সামনে। একে বলা হয় ‘হাশর’।
তিনঃ সকল মানুষ তাদের পার্থিব জীবনে যা কিছু করেছে তার আমলনামা আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে।
চারঃ আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির ভাল-মন্দ কাজের পরিমাপ করবেন। আল্লাহর মানদন্ডে যার সৎকর্মের পরিমাণ অসৎ কর্ম অপেক্ষা বেশী হবে, তিনি তাকে মাপ করবেন এবং যার অসৎকর্মের পাল্লাভারী থাকবে, তিনি তার উপযুক্ত শাস্তি বিধান করবেন।
পাঁচঃ আল্লাহর কাছ থেকে যারা মার্জনা লাভ করবে, তারা জান্নাতে চলে যাবে এবং যাদের শাস্তি বিধান করা হবে, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
আখেরাতের বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা
আখেরাতের ধারণা যেভাবে মুহাম্মাদ (সা) পেশ করে গেছেন, তার আগেকার নবীরা ও ঠিক তেমনি করে তা পেশ করে এসেছিলেন এবং প্রত্যেক যামানায় মুসলমান হওয়ার জন্য এটা ছিল অপরিহার্য শর্ত। যে ব্যক্তি আখেরাতকে অস্বীকার করেছে অথবা সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, সকল নবীই তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন, কেননা এ ধারণা ব্যতীত আল্লাহকে তার প্রেরিত কিতাব ও রাসূলদেরকে মেনে নেয়া সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে যায় এবং মানুষের সমগ্র জীবনই হয় বিকৃত। বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখলে সহজেই কথাটি হৃদয়ংগম করতে পারা যাবে। কাউকে যখন কোন কাজের কথা বলা হয়, তখন সবার আগে তার মনে প্রশ্নজাগেঃ একাজ করলে কি লাভ হবে, আর না করলেই বা কি ক্ষতি হবে? এ প্রশ্ন কেন জাগে? যে কাজে কোন লাভ নেই মানুষ তাকে মনে করে অর্থহীন ও ব্যর্থ। যে কাজ সম্পর্কে মানুষের অন্তরে প্রত্যয় রয়েছে যে তাতে কোন ফায়দা হবে না, তা করার জন্য মানুষ কখনো তৈরী হবেনা। তেমনি এমন কোন কাজ থেকে কেউ বিরত হয়ে থাকতে রাযী হবে না, যাতে কোন ক্ষতি হবে না বলে প্রত্যয় রয়েছে। সন্দেহের ক্ষেত্রেও এ একই অবস্থা। যে কাজের লাভ সম্পর্কে কারো সন্দেহ রয়েছে তাতে সে কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারবে না। কোন কাজ ক্ষতিকর কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে তা থেকে বেঁচে থাকবার জন্য সে কোন বিশেষ চেষ্টা করবে না। শিশুদের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে। শিশুরা আগুনে হাত দেয় কেন? তার কারণ হচ্ছেঃ তাদেও মনে প্রত্যয় নেই যে, আগুন পুড়িয়ে দেয়। আবার পড়াশুনা থেকে তারা কেন দূরে থাকতে চায়? তার কারণ হচ্ছেঃ তাদের গুরুজনরা এ থেকে যেসব কল্যাণ প্রাপ্তির কথা তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করেছেন তা তাদের মনে লাগছেনা। অনুরূপ কারণেই যে লোক আখেরাতে বিশ্বাসী নয় সে আল্লাহকে মানা ও তার ইচ্ছাঅনুযায়ী চলাকে মনে করে নিষ্ফল। তার কাছে আল্লাহর আনুগত্য যেমন কোন লাভ নেই, তেমনি তার না-ফরমানীতে ও কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূল ও কিতাবের মাধ্যমে যেসব আদেশ দিয়েছেন, তার আনুগত্য করা তার পক্ষে কি করে সম্ভব হবে? যদি ধরে নেয়া যায় যে সে আল্লাহকে মেনে নিয়েছে তা হলেও তার সে মানা সম্পূর্ণ নিরর্থক, কেননা সে আল্লাহর প্রদত্ত আইনের আনুগত্য করবেনা এবং তার ইচ্ছা অনুসারে চলবে না।
এখানেই ব্যাপারটি শেষ নয়। আরো ভাল করে চিন্তা করলে বুঝতে পারা যায় যে, আখেরাতের স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি মানুষের জীবনে চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। আগেই বলেছি, মানুষের স্বভাবই হচ্ছে এমনি যে, সে যে কোন কাজ করার বা না করার সিদ্ধান্ত করে লাভ ক্ষতির দিক বিবেচনা করে। এখন এক ব্যক্তির নযর কেবল দুনিয়ার লাভ-ক্ষতির উপর নিবদ্ধ। এমন কোন সৎকাজের প্রবনতা তার মধ্যে কখনো দেখা যাবে না, যার কোন লাভ এ দুনিয়ায় প্রাপ্তির আশা নেই; আবার এমন কোন কাজ থেকে সংযত হয়ে থাকবে না, যা থেকে এ দুনিয়ার বুকেই কোন ক্ষতি হওয়ার মতো বিপদ সম্ভাবনা না থাকবে। অপরদিকে আর এক ব্যক্তি রয়েছে, যার নযর রয়েছে কাজের শেষ পরিণামের উপর। দুনিয়ার লাভ -ক্ষতিকে সে মনে করে ক্ষণস্থায়ী। সে আখেরাতের স্থায়ী লাভ -ক্ষতি বিবেচনা করেই সৎকর্মের পথ অবলম্বন করবে আর অসৎকর্মের পথ বর্জন করে চলবে, তাতে সৎকর্ম থেকে তার যত বড় ক্ষতিই আসুক আর অসৎকর্ম থেকে যত বেশী লাভের সম্ভাবনাই থাকুক। চিন্তা করা দরকার এদের দু’জনের মধ্যে কত বড় প্রভেদ। একজনের কাছে সৎকাজ হচ্ছে তাই যা সে পাবে পাবে এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে; যেমন কিছু টাকা তার মিলবে, কিছু যমীন তার অধিকারে আসবে, হয়ত কোন পদ সুনাম সুখ্যাতি ও মানুষের বাহবা মিলবে, হয়ত কোন লালসা চরিতার্থ হবে, কিছুটা আকাংখা তার পূর্ণ হবে; হয়ত কিছুটা ভোগের পরিতৃপ্তি সে পাবে? তার ধারণা অনুযায়ী অসৎকাজ হচ্ছে তাই যাতে এ জীবনে কোন খারাপ পরিণাম আসে অথবা আসার ভয় থাকে; যেমন ধন-প্রাণের ক্ষতি, স্বাস্থ্যহানি, সরকার তরফের শাস্তি, কোন রকম দুঃখ কষ্ট অথবা অবাঞ্ছিত অবস্থা। পক্ষান্তরে, অপর ব্যক্তির কাছে সৎকাজ তাই যাতে আল্লাহ খুশী হন, আর অসৎকাজ হচ্ছে তাই যাতে আল্লাহ নারায হন। সৎকাজের ফলে দুনিয়ায় যদি তার কোন লাভ না হয় বরং কোন ক্ষতি হয়, তবুও সে তাকে সৎকাজই মনে করে এবং প্রত্যয় পোষণ করে যে, শেষ পর্যন্ত তার সৎকাজের জন্য চিরদিনের প্রাপ্য লাভ সে আল্লহর কাছে পাবে। অসৎকর্ম থেকে যদি তার কোন ক্ষতি নাও হয়, কোন ক্ষতির ভয় না থাকে বরং তার ফলে কাছে কেবল সুযোগ সুবিধা ই আসতে থাকে, তবুও সে তাকে অসৎকর্মই বলে মনে করে এবং প্রত্যয় পোষণ করে যে, যদি দুনিয়ায় এ সংক্ষিপ্ত জীবনে শাস্তি থেকে বেঁচে যায় এবং কিছু দিন মজা লুটবার সুযোগ পায়; তবু শেষ পর্যন্ত আযাব থেকে তার রেহাই নেই।
এ দু’টি বিভিন্ন ধারণার প্রভাবে মানুষ দু’টি বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে। যে ব্যক্তি আখেরাতের উপর প্রত্যয় পোষণ করে না, তার পক্ষে ইসলামের পথে এক পাও অগ্রসর হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। ইসলাম বলেঃ ‘আল্লাহর পথে গরীবকে যাকাত দাও’। জবাবে সে বলে যাকাত দিতে গেলে আমার সম্পত্তি কমে যাবে। আমার অর্থের উপর আমি সুদ নেব এবং সুদের ডিক্রিতে তাদের ঘরের শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত ক্রোক করে নেব। ইসলাম বলেঃ ‘হামেশা সত্যিকথা বল, আর মিথ্যা থেকে সংযত হয়ে থাক, সত্যভাষণ তোমার যতই ক্ষতি হোক আর মিথ্যা ভাষণে যতই লাভ হোক।’ জবাবে সে বলেঃ এমন সত্যকে গ্রহণ করে আমি কি করব, যাতে আমার কেবল ক্ষতিই হবে, কোন লাভ হবে না? আর এমন মিথ্যা থেকে আমি সংযত হয়ে থাকবো কেন যা আমার জন্য লাভজনক হবে এবং যাতে কোন দুর্নামের ভয় পর্যন্ত নেই? এক নিঃসংগ পথ অতিক্রম করতে করতে তার নযর পড়ছে একটি বহু মূল্যবান বস্তু, অমনি ইসলাম তাকে বলে, ‘এ তোমার সম্পত্তি নয়, কিছুতেই তুমি এ জিনিস গ্রহণ করতে পার না, সে তার জবাব দেয়ঃ আপনা আপনি যে জিনিস আসে তা কেন ছেড়ে দেব। এখানে তো এমন কেউ নেই যে দেখে পুলিশকে খবর দেবে। অথবা আদালতে সাক্ষ্য দেবে অথবা লোকের কাছে আমার বদনাম করবে। এরপর কেন আমি কুড়িয়ে পাওয়া অর্থ থেকে লাভবান হব না? একটি লোক গোপনে তার কাছে কিছু জিনিস আমানত রেখে মারা যায়? ইসলাম তখন তাকে বলেঃ আমানত বিনষ্ট কর না; যার ধন তার সন্তান-সন্তুতি কাছে পৌঁছে দাও। সে বলে উঠেঃ কেন? মৃত ব্যক্তির ধন যে আমার কাছে রয়েছে তার তো কোন সাক্ষী নেই তার সন্তান-সন্তুতি ও এ খবর জানেনা। সহজেই আমি যখন কোন আইনের ভয় না করে কোন বদনামীর আশংকা না করে আত্মসাৎ করতে পারি, তখন কেন তা করব না? সোজা কথায় জীবনের পথে প্রত্যেক পদক্ষেপে ইসলাম তাকে এক বিশেষ পথে চলার নির্দেশ দেবে, আর সে তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথ অনুসরণ করে চলবে। কেননা ইসলামে প্রত্যকটি জিনিসের কদর ও মূল্যমান নির্ধারিত হয় আখেরাতের স্থায়ী ফলাফল বিবেচনায়; কিন্তু সে ব্যক্তি প্রত্যেক ব্যাপারে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এ দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে পাওয়ার মত ফলাফলের উপর। আখেরাতের উপর ঈমান পোষণ ব্যতীত মানুষ যে কেন মুসলমান হতে পারে না, তা এখন সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়। মুসলমান হওয়া তো দূরের কথা প্রকৃতপক্ষে আখেরাতকে অস্বীকার করে মানুষ মুনষ্যত্ব থেকে নেমে গিয়ে পশুত্ব অপেক্ষা নিম্নতর স্তরে চলে যায়।
আখেরাত বিশ্বাসের সত্যতা
আখেরাতে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা ও কল্যাণকারিতা আলোচনা করার পর এখন সংক্ষেপে বলতে চাই যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা) আখেরাত বিশ্বাস-সম্পর্কে আমাদেরকে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা যুক্তির দিক দিয়েও সত্য বলে আপনাদের বোধ্যগম্য হয়। যদিও নিছক যুক্তিভিত্তিক না হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থার উপরই আমাদের এ বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, তবুও আমরা যখন বিশেষভাবে চিন্তা করি, তখন আখেরাত সম্পর্কিত সকল বিশ্বাসের মধ্যে এ বিশ্বাসকেই সবচেয়ে যুক্তিভিত্তিক মনে হয়।
আখেরাত সম্পর্কে দুনিয়ায় তিন রকমের বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছেঃ
এক দলের ধারণা মরার পর মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর আর কোন জীবন নেই। এ হচ্ছে নাস্তিকের বিশ্বাস যারা নিজেদেরকে বিজ্ঞানী বলে দাবী করে।
দ্বিতীয় দল বলে, মানুষ নিজস্ব কর্মফল ভোগ করার জন্য বারবার এ দুনিয়ায় দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অসৎ কাজ করলে পরজন্মে তারা কুকুর বিড়ালের মত কোন জানোয়ার হয়ে আসবে, অথবা কোন গাছ হয়ে জন্মাবে, অথবা কোন নিকৃষ্ট স্তরের মানুষের আকৃতি ধারণ করবে। আর যদি ভাল কাজ করে তাহলে আরো উঁচু স্তরের জীবনে পৌঁছবে। কোন কোন জড়ত্ব প্রাপ্ত ধর্মে এ ধরনের ধারণা প্রচলিত রয়েছে।
তৃতীয় দল কিয়ামত, পুনর্জীবন লাভ, আল্লাহর আদালতে উপস্থিতি এবং কৃতকর্মের প্রতিদান ও প্রতিফলের উপর ঈমান পোষণ করে। এ হচ্ছে সকল নবীর সাধারণ বিশ্বাস।
এবার প্রথম বিশ্বাস সম্পর্কে চিন্তা করা যাক। তাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ ‘মরার পর কাউকে জীবিত হতে আমরা দেখিনি। আমরা বরং দেখি মানুষ মরার পর মাটিতে মিশে যায়। সুতরাং মৃত্যুর পর আর কোন জীবন নেই। কিন্তু চিন্তা করে দেখলে বুঝা যায় যে, এ কথার মধ্যে কোন যুক্তি নেই। মরার পর কাউকে জীবিত হতে দেখা যায়নি, এ জন্য বড় জোর বলা যায়ঃ মরার পর কি হবে আমরা জানিনা’ এর চেয়ে এগিয়ে গিয়ে যে দাবী করা হয়, মরার পর কিছুই হবে না, আমরা জানি এর স্বপক্ষে কি প্রমান পেশ করা যেতে পারে? যে পল্লিবাসী কখনো উড়োজাহাজ দেখেনি, সে বলতে পারেঃ উড়োজাহাজ কি জিনিস, আমার জানা নেই। কিন্তু সে যখন বলেঃ ‘আমি জানি উড়ো জাহাজ বলতে কোন জিনিসই নেই।’ তখন বুদ্ধিমান লোকেরা তাকে নির্বোধ বলবেন। কারণ কোন বিশেষ জিনিস না দেখবার অর্থ এ হতে পারে না যে, তা কোন জিনিসই নয়। একটি মানুষ কেন, বরং সারা দুনিয়ার মানুষ ও যদি একটা বিশেষ জিনিস না দেখে থাকে, তবুও এ দাবী করা চলে না যে সে জিনিসটির অস্তিত্ব নেই অথবা তা থাকতেই পারে না।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বাস সম্পর্কে বিবেচনা করা যাক। এ বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যক্তি বিশেষ যখন মানুষ হিসেবে বর্তমান জীবন যাপন করেছে, তখন তার কারণ হচ্ছে, বিগত জীবনে সে জানোয়ার থাকা অবস্থায় সৎকার্য করেছিল আর যে জানোয়ার বর্তমান জীবন জানোয়ার হিসেবে অতিবাহন করছে, অতীত জীবনে মানুষ হিসেবে বসবাস করে সে অসৎকার্য করেছিল। অন্য কথায় মানুষ জানোয়ার অথবা বৃক্ষ হওয়া প্রকৃতপক্ষে অতীত জীবনের কর্মফল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছেঃ প্রথমে কি জিনিস ছিল? যদি বলা হয় যে সবার আগে ছিল মানুষ তাহলে মেনে নিতে হবে যে, তারও আগে ছিল জানোয়ার অথবা বৃক্ষ নইলে প্রশ্ন উঠবেঃ মানুষের আকৃতি কোন সৎকর্মের বদলায় পাওয়া গিয়েছিল? যদি বলা হয় সবার আগে পশু অথবা বৃক্ষ ছিল; তাহলে মেনে নিতে হবে যে তারও আগে ছিল মানুষ নইলে প্রশ্ন উঠেঃ বৃক্ষ অথবা পশুর আকৃতি কোন অসৎকর্মের শাস্তি স্বরূপ পাওয়া গিয়েছিল? সোজা কথা এ বিশ্বাসের অনুসারীরা সৃষ্টির প্রারম্ভিক রূপ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেনা, কেননা যে কোন রূপের আগে অপর এক রূপ পরিকল্পনা তাদের পক্ষে অপরিহার্য, যাতে পরবর্তী রূপকে পূর্ববর্তী রূপসম্পন্ন সৃষ্টির কর্মফল বলে ধরে নেয়া যায়। এ বিশ্বাস সোজাসুজি যুক্তি বিরোধী।
এবার তৃতীয় বিশ্বাস সম্পর্কে বিবেচনা করা যাক। এতে সবার আগে বলা হয়েছেঃ একদিন কিয়ামত আসবে এবং আল্লাহ নিজেই তার এ কারখানাকে ভেঙ্গে চুরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তার জায়গায় গড়ে তুলবেন আর এক উচ্চতর পর্যায়ের উৎকৃষ্টতর কারখানা। এ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যার সত্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ ও অবকাশ নেই। দুনিয়ার এ কারখানা নিয়ে যত চিন্তা করা যায়, তত বেশী করে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এটা একটি স্থায়ী কারখানা নয়, কারণ যেসব শক্তি এর ভিতরে কাজ করে যাচ্ছে, তারা সবাই সীমাবদ্ধ ও একদিন তাদের সমাপ্তি নিশ্চিত। এ কারণে সকল বিজ্ঞানী এ সম্পর্কে এক মত যে, একদিন সূর্য শীতল ও জ্যোতিহীন হয়ে যাবে, গ্রহ উপগ্রহসমূহের পরস্পরের মধ্যে ঘটবে সংঘাত এবং দুনিয়া হয়ে যাবে ধ্বংস।
দ্বিতীয় কথাটি বলা হয়েছেঃ ‘মানুষকে দ্বিতীয়বার জীবন দান করা হবে।’ এও কি সম্ভব? যদি অসম্ভব হয়, তা হলে মানুষ বর্তমানে যে জীবন উপভোগ করছে, তা কি করে সম্ভব হল? স্পষ্টত যে আল্লাহ এ দুনিয়ায় মানুষকে পয়দা করেছেন, অপর কোন দুনিয়ায়ও তিনি মানুষকে আবার নতুন করে পয়দা করতে পারেন।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছেঃ ‘মানুষ এ দুনিয়ার জীবনে যা কিছু কাজ করেছে, সবকিছুর রেকর্ড সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে এবং হাশরের দিন তা পেশ করা হবে। এ দুনিয়ায়ও এর প্রমাণ আজ আমরা পাচ্ছি। আগেকার দিনের চলতি ধারণা ছিল যে, যে আওয়ায মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, হাওয়ার উপর তা কিছুটা তরঙ্গ সৃষ্টি করে মিলিয়ে যায়। কিন্তু আজকের দিনে আমরা জানতে পারছি যে, প্রত্যেক আওয়ায় তার গতি পথে বিভিন্ন জিনিসের উপর দাগ রেখে যায়। সে আওয়ায আবার নতুন করে সৃষ্টি করা যায়। অবশ্যি এ নীতির উপরই উদ্ভাবন করা হয়েছে গ্রামোফন রেকর্ড।
তা থেকেই বুঝা যায় যে, যেসব জিনিস আমাদের গতি পথে আসছে, তার সব কিছুতেই আমাদের গতিবিধির চিহ্ন অংকিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সম্পূর্ণ আমলনামা যে সংরক্ষত হয়ে আছে এবং তা যে পুনরায় হাযির করা যেতে পারে তা এ অবস্থা থেকে প্রত্যয় সহকারে উপলব্ধি করা যেতে পারে।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছেঃ ‘আল্লাহ হাশরের দিনে আদালত বসাবেন, ন্যায়নীতি অনুযায়ী আমাদের ভাল মন্দ কাজের পুরস্কার ও শাস্তি বিধান করবেন। একে কে অসম্ভব বলতে পারে? এর মধ্যে কোন কথাটি যুক্তি বিরোধী? যুক্তির দাবীই হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাঁর ন্যায়ের আদালতে ন্যায়নীতি অনুযায়ী সবকিছুর সিদ্ধান্ত করবেন। আমরা দেখতে পাই, এক ব্যক্তি ভাল কাজ করে, অথচ দুনিয়ায় তার কোন লাভ সে পায় না। আবার এক ব্যক্তি খারাপ কাজ করে যায়, অথচ তার কোন ক্ষতি সে ভোগ করে না। শুধূ তাই নয়, বরং আমরা এমনি হাজার হাজার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, ব্যক্তি বিশেষ ভাল কাজ করে যাচ্ছে অথচ উল্টা তার ক্ষতি হচ্ছে। পাক্ষন্তরে; অপর ব্যক্তি খারাপ কাজ করেও বেশ মজা লুটছে। এ ধরনের সব ঘটনা লক্ষ্য করে যু্ক্তি দাবী করে যে, কোন না কোন জয়গায় সৎকর্মশীল ব্যক্তির সৎকার্যের ও দুস্কৃতি পরায়ণ ব্যক্তির দুস্কৃতির প্রতিফলন পাওয়া প্রয়োজন।
সর্বশেষ জিনিস হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নাম। তার অস্তিত্ব অসম্ভব নয়। যে আল্লাহ চন্দ্র, সূর্য, মঙ্গল গ্রহ ও যমীন সৃষ্টি করতে পারলেন, শেষ পর্যন্ত—তিনি কেন জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করতে পারবেন না? তিনি যখন আদালত বসিয়ে মানুষের ভাল মন্দের পুরস্কার ও শাস্তি বিধান করবেন, তখন পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য লোকদের কোন বিশেষ সম্মান, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের এবং শাস্তি পাওয়ার যোগ্য লোকদের জন্য অপমান দুঃখ বেদনা ভোগের জন্য স্থান নির্দিষ্ট থাকাও প্রয়োজন।
এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে যুক্তি আপনিই বলে উঠবে যে, দুনিয়ার মানুষের পরিণাম সম্পর্কে যত ধারণা রয়েছে, তার মধ্যে এ ধারণাই হচ্ছে সবচেয়ে যুক্তিসংগত এবং এর ভিতরে অযৌক্তিক অথবা অসম্ভব কিছুই নেই।
আল্লাহর সাচ্চা নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) যখন একে সত্য বলে বর্ণনা করে গেছেন এবং এর সবকিছুই আমাদের জন্য কল্যাণকর, তখন বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে এর উপর প্রত্যয় পোষণ করা এবং বিনা যুক্তিতে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ না করা।
কালেমা তাইয়েবা
ইসলামের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পূর্ব বর্ণিত এ পাঁচটি বিশ্বাসের উপর। এ পাঁচটি বিশ্বাসের সারবস্তু রয়েছে কেবলমাত্র এক কালেমারই মধ্যেঃ (…………………)
একজন মানুষ যখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে তখন সে সকল মিথ্যা উপাস্যকে বর্জন করে কেবল এক আল্লাহর দাসত্বের প্রতিশ্রুতি দান করে। আবার যখন ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলে তখন সে এ কথাটির সত্যতা স্বীকার করে যে হযরত মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহরই রাসূল। রিসালাতের সত্যতা স্বীকারের সাথে সাথে অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে পড়ে যে, আল্লাহর সত্তা ও গুণরাজি, ফেরেশতামন্ডলী, আসমানী কিতাসমুহ, পয়গাম্বরগণ ও আখেরাত সম্পর্কে যা কিছু ও যেমন কিছুরই শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ (সা) দিয়ে গেছেন, তার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্যের যে পথ তিনি নির্দেশ করেছেন তার অনুসরণ করতে হবে।