যাকাতের হাকীকত
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
বইটির অডিও শুনুন
যাকাতের গুরুত্ব
নামাযের পর ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। সাধারণত নামাযের পরই রোযা উল্লেখ করা হয় বলে অনেকের মনে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, নামাযের পরই বুঝি রোযার স্থান। কিন্তু কালামে পাক থেকে জানা যায় যে, নামাযের পর যাকাতই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ দুটি ইসলামের প্রধান স্তম্ভ-এটা বিধ্বস্ত হয়ে গেলে ইসলামের প্রাসাদও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
‘যাকাত’ অর্থ পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা। নিজের ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বন্টন করাকে ‘যাকাত’ বলা হয়। কারণ এর ফলে সমগ্র ধন-সম্পত্তি এবং সেই সাথে তার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ তাঁর বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করে না, তার সমস্ত ধন অপবিত্র এবং সেই সাথে তার নিজের মন ও আত্মা পংকিল হতে বাধ্য। কারণ, তার হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার নাম মাত্র বর্তমান নেই। তার দিল এতদূর সংকীর্ণ, এতদূর স্বার্থপর, এবং এতদূর অর্থ পিশাচ যে, যে আল্লাহ অনুগ্রত পূর্বক তাকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেও তার মন কুন্ঠিত হয়। এমন ব্যক্তি দুনিয়ায় খালেছভাবে আল্লাহর জন্য কোনো কাজ করতে পারবে, তার দীন ও ঈমান রক্ষার্থে কোনোরূপ আত্মত্যাগ ও কুরবানী করতে প্রস্তুত হতে পারবে বলে মনে করা যেতে পারে কি? কাজেই একথা বলা যেতে পারে যে, যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না তার দিল নাপাক, আর সেই সাথে তার সঞ্চিত ধন-মালও অপবিত্র, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
‘যাকাত’ ফরয করে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছানুক্রমেই প্রয়োজনতিরিক্ত ধন-মাল হতে আল্লাহর নির্দিষ্ট হিস্যা আদায় করে এবং আল্লাহর বান্দাহদের যথাসাধ্য সাহায্য করে, বস্তুত সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাজ করার উপযুক্ত, ঈমানদার লোকদের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা তারই রয়েছে। পক্ষান্তরে যার দিল এতদূর সংকীর্ণ যে, আল্লাহর জন্য এতটুকু কুরবানী করতে প্রস্তুত হয় না, তার দ্বারা আল্লাহর কোনো কাজই সাধিত হতে পারে না-সে ইসলামী জামায়াতে গণ্য হবার যোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে তাকে মানব দেহের একটি পঁচা অংগ মনে করা যেতে পারে, আর পঁচা অংগকে যত শীঘ্র কেটে বিচ্ছিন্ন করা যায় শরীরের অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগের পক্ষে ততই মংগল। অন্যথায় সমগ্র দেহেই পচন শুরু হবে। এ জন্যই হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের পর যখন আরবের কোনো এক গোত্রের লোক যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করেছিল, তখন (প্রথম খলীফা) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে-কাফেরদের বিরুদ্ধে যেমন করতে হয় ঠিক তেমনি-যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। অথচ তারা নামায পড়তো, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের ঈমানও বর্তমান ছিল। এত নিসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত আদায় না করলে নামায-রোযা ইত্যাদি তার কোনো কাজই আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে না, আর এরূপ ব্যক্তির ঈমানদার হওয়ার দাবী করার আদৌ কোনো মূল্য নেই।
কুরআন মজীদ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায়, প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক নবীর উম্মাতের প্রতিই সমানভাবে নামায ও যাকাত আদায় করার কঠোর আদেশ করা হয়েছিল-দীন ইসলামের কোনো অধ্যায়েই কোনো নবীর সময়ে কোনো মুসলমানকেই নামায ও যাকাত থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর বংশের নবীদের কথা আলোচনা করার পর কুরআন পাকে বলা হয়েছে:
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ ۖ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ
আমরা তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমাদেরই বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে-পথপ্রদর্শন করে। আমরা ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করেছি, তারা খাঁটিভাবে আমরা ইবাদাত করতো-হুকুম পালন করতো। সূরা আল আম্বিয়া : ৭৩
হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে:
وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ ص وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا
“তিনি তাঁর লোকদেরকে নামায এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করতেন এবং আল্লাহর দরবারে তিনি বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন।” সূরা মরিয়ম : ৫৫
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর নিজের সম্পর্কে দোয়া করেছিলেন- “হে আল্লাহ! এ দুনিয়ায় আমার মঙ্গল দাও, পরকালেও কল্যাণ দান কর।” এর উত্তরে আল্লাহ সূরা আল আরাফের ১৫৬ আয়াতে বলেছিলেন:
عَذَابِي أُصِيبُ بِهِ مَنْ أَشَاءُ ۖ وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ ۚ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُم بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ
“যাকে ইচ্ছা হবে, তাকে আমার আযাবে নিক্ষেপ করবো। যদিও আমার রহমত সকল জিনিসের ওপরই পরিব্যাপ্ত আছে; কিন্তু তা কেবল সেই লোকদের জন্যই নির্দিষ্ট করবো যারা আমাকে ভয় করবে এবং যাকাত আদায় করবে, আর যারা আমার বাণীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।” সূরা আরাফ : ১৫৬
হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জাতির লোকদের দিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল। ধন-সম্পদ লাভের জন্য প্রাণ দিতেও তারা কুণ্ঠিত হতো না। বর্তমানকালের ইয়াহুদীরাই তার বাস্তব উদাহরণ। এজন্য আল্লাহ তাআলা এ মহান সম্মানিত পয়গম্বরের প্রার্থনা উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন যে, তোমার উম্মাত যথারীতি যাকাত আদায় করলে আমার রহমত পেতে পারবে অন্যথায় পরিষ্কার জেনে রাখ, তারা আমার রহমত হতে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হবে এবং আমার আযাব তাদেরকে পরিবেষ্টন করে নেবে। হযরত মূসা (আ) এর পরেও বনী ইসরাঈলগণকে বার বার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বার বার তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে: আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগেী করবে না এবং রীতিমত নামায ও যাকাত আদায় করবে। (সূরা আল বাকারা, রুকূ : ১০)। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সুস্পষ্ট নোটিশ দেয়া হয়েছে এই বলে :
وَقَالَ اللهُ اِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصًّلوةَ وَاتَيْتُمْ الزَّكوةَ وَامْنْتُمْ بِرُسُلِىِ وَعَزَّرتُمُوْهُمْ وَاَقْرَضْتُمْ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا لاَّكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيَّاتِكُمْ ـ المائِدة : ١٢
আল্লাহ বললেন, “হে নবী ইসরাঈল! তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করতে থাক, আমার রাসূলদের ওপর ঈমান আন; তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে করযে হাসানা দাও, তাহলে আমি তোমাদের সাথী এবং তোমাদের দোষ-ত্রুটিগুলো দূর করে দেব (অন্যথায় রহমত লাভের কোনো আশাই তোমরা করতে পার না)।” সূরা মায়েদা : ১২
হযরত রাসূলে করীম (সা) এর পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামই সর্বশেষ নবী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকেও একই সাথে নামায এবং যাকাতের হুকুম দিয়েছেন। সূরা মারিয়ামে বলা হয়েছে:
وَّجَعَلّنِى مُبرَكًا اَيْنَا مَاكُنْتُ وَاَوْضنِى بَالصَّلوةِ وَالزَّكوْةِ مَادُمْتُ حَيًا ـ مريم : ٣١
“আল্লাহ আমাকে মহান করেছেন-যেখানেই আমি থাকি এবং যতদিন আমি জীবিত থাকবো ততদিন নামায পড়া ও যাকাত আদায় করার জন্য আমাকে নির্দেশ করেছেন।” সূরা মরিয়াম : ৩১
এ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায় যে, দীন ইসলাম প্রত্যেক নবীর সময়ই নামায ও যাকাত এ দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছিল। আল্লায় বিশ্বাসী কোনো জাতিকেই এ দুটি কর্তব্য থেকে কখনও নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) এর উপস্থাপিত শরীয়াতে এ দুটি ফরযকে কিভাবে পরস্পর যুক্ত ও অবিচ্ছেদ্য করে দেয়া হয়েছে, তা অনুধাবন যোগ্য। কুরআন পাকের প্রথমেই যে আয়াতটি উল্লেখিত রয়েছে, তা এই :
ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤِْنُوْنَ بِالْغِيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة :
٢ -٣
“এ কুরআন আল্লাহর কিতাব-এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা পরহেযগার, আল্লাহভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার জীবনের সঠিক ও সোজা পথপ্রদর্শন করে। পরহেযগার তারাই যারা অদৃশ্যকে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।” সূরা আল বাকারা: ২-৩
অতপর বলা হয়েছেঃ
أُوْلَـٰٓٮِٕكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِهِمْ وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ البقرة : ٥
“বস্তুত এরাই রব প্রদত্ত হেদায়াত লাভ করেছে এবং এরাই সফলকাম।” সূরা আল বাকারা : ৫
অর্থাৎ যাদের ঈমান নেই এবং নামায ও যাকাত আদায় করে না তারা শুধু আল্লাহর হেদায়াত থেকেই বঞ্চিত নয়, কল্যাণ ও সাফল্য তাদের ভাগ্যে জুটবে না। তারপর এ সূরা আল বাকারা পড়তে পড়তে সামনে এগিয়ে যান, কয়েক পৃষ্ঠা পরই আদেশ হয়েছে:
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ـ البقرة : ٤٣
“নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূ’কারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রুকূ কর (জামায়াতের সাথে নামায আদায় কর) । সূরা আল বাকারা : ৪৩
অতপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এ সূরায় বলা হয়েছে:
لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوْلُّوْا وَجُوْهَكُمْ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلكِنَّ البِرَّ مَنْ امَنَ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ وَالْمَلئِكَةِ وَالْكِتبِ وَالنَّبِيْنَ وَاَتَى الْمَالَ عَلى حُبِّه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَّسْكِيْنَ وَاَبْنَ السَّآئِلِيْنَ وَفِى ارِّقَابِ وَاَقامَ الصَّلوةَ وَاَتَى الزَّكوةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا الرِّقَابِ وَاَقَامَ الصَّلوَةَ وَاَتَى الزَّكوَةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا وَالصَّبِرِيْنَ فِى الْبَاسَآءِ وَالضَّرَّاءِ وَحَيْنَ الْبَاسِ اُوْلئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَاُوْلئِكَ هُمْ الْمُتَّقُوْنَ ـ البقرة : ٧ ١٧
“পূর্ব কিংবা পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়ালেই কোনো পূণ্য লাভ হয় না বরং যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব এবং পয়গাম্বরদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহর প্রেমে তার অভাবী আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে নিজেদেরকে ধন-সম্পদ দান করে, অন্য লোকদেরকে তাদের ঋণ, দাসত্ব কিংবা কয়েদ থেকে মুক্তি লাভের ব্যাপারে সাহায্য করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, বস্তুত একমাত্র তারাই পূণ্য লাভ করতে পারে। আর যারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, বিপদ, ক্ষতি-লোকসান এবং যুদ্ধের সময় যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর সত্য পথে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে, তারাই পূণ্যবান। তারাই খাঁটি মুসলমান, মুত্তাকী ও পরহেযগার।” সূরা আল বাকারা : ১৭৭
এরপর সূরা আল মায়েদায় এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাও প্রণিধানযোগ্য :
اِنَّمَا وَلَيُّكُمُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَهُمْ رِكِعُوْنَ ـ وَمَنْ يَّتَوَلَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا فِانَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْغلِبُوْنَ ـ المائِدَة : ٥٥-٥٦
“মুসলমান! তোমাদের প্রকৃত বন্ধু সাহায্যকারী হচ্ছে শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ মাত্র। ঈমানদার লোক বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা নামায কায়েম কবে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহর সামনে মাথা নত করে। অতএব যারা আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদারদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তারা আল্লাহর দল বলে বিবেচিত হবে এবং আল্লাহর দলই নিশ্চিতরূপে বিজয়ী হবে।”- সূরা মায়েদা : ৫৫-৫৬
এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতমত, এ আয়াত থেকে জানা গিয়েছে যে, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে তারাই মুসলমান। ইসলামের এ দুটি রুকন যে ব্যক্তি যথাযথরূপে আদায় করে না, তার ঈমানদার হওযার দাবী মূলত মিথ্যা। দ্বিতীয়ত, এ আয়াত থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ একটি দলভুক্ত। অতএব ঈমানদার ব্যক্তিগণের অন্যান্য সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে এ পার্টিতে শামিল হতে হবে। এ দলের বাইরের কোনো ব্যক্তিকে সে পিতা হোক, ভাই হোক, পুত্র হোক, প্রতিবেশী, স্বদেশবাসী কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন- কোনো মুসলমান যদি তাকে নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং তার সাথে ভালোবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে আল্লাহ তাআলা যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, এমন আশা কিছুতেই করা যেতে পারে না। সর্বশেষে এ আয়াত থেকে একথাও জানা গেল যে, ঈমানদার লোকগণ দুনিয়ায় কেবল তখনই জয়ী হতে পারে যখন তারা একনিষ্ঠ হয়ে শুধু আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকদেরকেই নিজেদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধু, সাহায্যকারী এবং সাথী হিসেবে গ্রহণ করবে।
আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে তাওবায় আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ক্রমাগত কয়েক রুকূ পর্যন্ত এ যুদ্ধ সম্পর্কে হেদায়াত দিয়েছেন। এ প্রসংগে বলা হয়েছে:
فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاتَوُا الزَّكوةَ فَاِخْوَانَكُمْ فِىْ الدِّيْنِ ـ
“তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে ‘তাওবা’ করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দীনি ভাইয়ে পরিণত হবে।”- সূরা আত তাওবা : ১১
অর্থাৎ শুধু কুফর ও শিরক থেকে ‘তাওবা’ করা এবং ঈমান আনার কথা প্রকাশ করাই যথেষ্ঠ নয়, সে যে কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষেই ঈমান এনেছে, তার প্রমাণের জন্য যথারীতি নামায আদায় করা এবং যাকাত দেয়াও অপরিহার্য। অতএব, তারা যদি তাদের এরূপ বাস্তব কাজ দ্বারা একথার প্রকাশ পেশ করে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা তোমাদের দীনি ‘ভাই’, অন্যথায় তাদেরকে ভাই মনে করা তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও বন্ধ করা যাবে না। এ সূরায় আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে:
وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيْآَءُ بَعْضٍ يَامُوْرُونَ بِامُرُوْنَ بَالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ اُوْلئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ ـ التوبية : ٧١
“ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন।” সূরা আত তাওবা : ৭১
অন্য কথায় কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান এনে কার্যত নামায ও যাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ সে মুসলমানদের দীনি ভাই রূপে পরিগণিত হতে পারবে না। বস্তুত ঈমান, নামায ও যাকাত এই তিনটি জিনিসের সমন্বয়েই ঈমানদার লোকদের জামায়াত গঠিত হয়। যারা এ কাজ যথারীতি করে, তারা এ পাক জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত এবং তাদেরই পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব, ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপিত হবে। আর যারা এ তিনটি কাজ করে না, তারা এ জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। তাদের নাম মুসলমানদের ন্যায় হলেও ইসলামী জামায়াতের মধ্যে শামিল হতে পারে না। এখন তাদের সাথে বন্ধুত্ব, প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করলে আল্লাহর আইন ভংগ করা এবং তাতে আল্লাহর পার্টির শৃংখলা নষ্ট করা হবে। তাহলে এসব লোক দুনিয়ায় জয়ী হয়ে থাকার আশা কি করে করতে পারে?
আরও সামনে অগ্রসর হলে সূরা হজ্জ-এ দেখা যায়, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَّنْصُرُهُ اِنَّ اللهَ لَقَوِي عَزِيْزٌ ـ اَلَّذِيْنَ اِنْ مَّكَّنّهُمْ فِى الاَرْضِ اَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاَتَوُا الزَّكوةَ وَاَمَرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِۗ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الاُمُوْرِ ـ الحج ـ ٤٠-٤١
“যে আল্লাহর সাহায্য করবে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার সাহায্য করবেন। আল্লাহ তাআলা বড়ই শক্তিশালী এবং সর্বজয়ী। (আল্লাহর সাহায্য তারাই করতে পারে) যাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করলে তারা নামায আদায়ের (সামাজিক) ব্যবস্থা কায়েম করবে এবং সামগ্রিকভাবে যাকাত আদায় করবে, লোককে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সকল জিনিসের পরিণাম আল্লাহর ওপরই নির্ভর করে।”- সূরা আল হজ্জ : ৪০-৪১
বনী ইসরাঈলদের ইতিপূর্বে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এ আয়াতে মুসলমানদেরকেও ঠিক সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলদেরকে বলা হয়েছিল যে, তারা যতদিন নামায কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে এবং নবীদের কাজে সাহায্য করতে থাকবে অর্থাৎ আল্লাহর আইন জারি করবে, ততদিন আল্লাহ তাদের সাথী ও সাহায্যকারী থাকবেন। আর যখন এ কাজ ত্যাগ করবে, তখনই আল্লাহ তাদের প্রতি সকল সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। ঠিক একথাই এ আয়াতে মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, দুনিয়ার শক্তি লাভ করে যদি তারা নামায আদায়ের সামাজিক ব্যবস্থা এবং যাকাত আদায়ের সামগ্রিক পন্থা প্রতিষ্ঠা করে আর ভালো কাজের প্রচার ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ করে, তাহলে আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী হবেন। বস্তুত, আল্লাহ অপেক্ষা শক্তিমান সাহায্যকারী আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু মুসলমান যদি নামায ও যাকাত আদায় করা পরিত্যাগ এবং দুনিয়ার শক্তি লাভ করে সৎকাজের পরিবর্তে অসৎকাজের প্রচার করে, অন্যায়কে নির্মূল না করে সৎকাজের পথ বন্ধ করতে থাকে, আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করার পরিবর্তে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করতে শুরু করে আর কর আদায় করে নিজেদের জন্য দুনিয়ার বুকে স্বর্গ রচনা করাকে রাজত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে, তাহলে আল্লাহর সাহায্য তাদের ভাগ্যে কখনো জুটবে না। তারপর শয়তানই হবে তাদের সাহায্যকারী। ভাবতে অবাক লাগে, এটা কত বড় শিক্ষার কাজ! বনী ইসরাঈল আল্লাহ প্রদত্ত এ বাণীকে অমূলক ও মৌখিক মাত্র মনে করেছিল। ফলে তার বিপরীত কাজ করতে তাদেরকে দুনিয়ার দিকে দিকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে ঘুরে মরতে হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কোথাও তারা স্থায়ীভাবে আশ্রয় লাভ করতে পারছে না। এরা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী সম্প্রদায়, কোটি কোটি টাকা তাদের ভান্ডারে স্তুপীকৃত হয়ে আছে, কিন্তু এ টাকা তাদের কোনো কাজেই লাগছে না। নামাযের পরিবর্তে অসৎকাজ এবং যাকাতের বদলে সুদখোরীর অভিশপ্ত পন্থাকেই অবলম্বন করে তারা একদিকে নিজেরা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হচ্ছে, অপর দিকে তারা প্লেগের ইঁদুরের ন্যায় দুনিয়ার দিকে দিকে এ অভিশাপ সংক্রমিত করে ফিরছে। মুসলমানদেরকেও এ হুকুমই দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলমানগণ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নামায আদায় ও যাকাতদানের ক্ষেত্রে উদাসীন হয়েছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি প্রয়োগ করে সত্য প্রচার এবং মিথ্যা ও অন্যায় প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করা ভুলে বসেছে। আর এর তিক্ত ফলও তারা নানাভাবে ভোগ করেছে। (দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ও মহাশক্তিধর) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমগ্র দুনিয়ায় তারা সকল যালেম শক্তির নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা দুর্বল ও পরাভূত। নামায ও যাকাত ত্যাগ করার কুফল তো দেখলেন। এখন এদের (বনী ইসরাঈলদের মধ্যে) এমন একটি দল সৃষ্টি হয়েছে যারা মুসলমানদের মধ্যে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা, পর্দাহীনতা এবং কুৎসিত কাজের প্রবর্তন করতে বদ্ধপরিকর। তারা মুসলমানদেরকে বলছে, “তোমাদের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে হলে ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানী খুলে পেট ভরে সুদ খাও।” কিন্তু সত্য কথা এই যে, মুসলমানগণও যদি এতেই লিপ্ত হয়ে থাকে, তবে তাদেরকেও ইয়াহুদীদের ন্যায় চরম লাঞ্ছনার এক কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করা হবে এবং চিরন্তন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে।
যাকাত কি জিনিস এতে আল্লাহ তাআলা কত বড় শক্তি নিহিত রেখেছেন, যদিও মুসলমানগণ এটাকে একটি অতি সাধারণ জিনিস বলে মনে করছে, অথচ তাতে যে কত বিরাট লাভের সম্ভবনা রয়েছে এসব বিষয়ে পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো, এ প্রবন্ধটিতে আমি শুধু একথাই বলতে চাচ্ছি যে, নামায ও যাকাত ইসলামের একান্ত বুনিয়াদী জিনিস। ইসলামে এ দুটির গুরুত্ব এত অধিক যে, এটা যেখানে নেই সেখানে আর যাই থাক, ইসলাম যে নেই তা সন্দেহতীত। অথচ অনেক মুসলমান আজ নামায কায়েম না করে এবং যাকাত আদায় না করেও মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে চায় এবং তাদের তথাকথিত কিছু ধর্মগুরুও এ বিষয়ে তাদেরকে নিশ্চয়তা দান করেছে। কিন্তু কুরআন তাদের দাবীর তীব্র প্রতিবাদ করে। মানুষ যদি কালেমায় তাইয়্যেবা পড়ে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য নামায এবং যাকাত আদায় না করে, তাহলে কুরআনের দৃষ্টিতে তার এ কলেমা পড়া একেবারেই অর্থহীন। এজন্যই হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত দিতে অস্বীকারকারী ব্যক্তিদের কাফের মনে করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যারা আল্লাহ ও রাসূলকে মানে এবং নামাযও পড়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয কিনা সাহাবায়ে কেরামের মনে তখন এ সন্দেহ জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু যখন হযত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকে আল্লাহ তাআলা নবুয়াতের কাছাকাছি সম্মান দান করেছিলেন-সুদূঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন : আল্লাহর শপথ, রাসূলে কারীম (সা) এর জীবন যারা যাকাত দিত, আজ যদি কেউ তার উট বাঁধার একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে, তবে তার বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধারণ করবো। শেষ পর্যন্ত সকল সাহাবীই একথার যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সকলে একমত হয়ে ঘোষণা করলেন যে, যারা যাকাত দিবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অপরিহার্য। কুরআন শরীফ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, যাকাত না দেয়া কেবল পরকালে অবিশ্বাসী মুশরিকদেরেই কাজ:
وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِيْنَ ـ الًّذِيْنَ لاَيُؤْتُوْنَ الزَّكوَةَ وَهُمْ بِالاخِرَةِ هُمْ كفِرُوْنَ ـ
“যেসব মুশরিক যাকাত দেয় না, যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।”- সূরা হা-মীম-আস-সাজদা : ৬-৭
যাকাতের মর্মকথা
পূর্বে বলা হয়েছে, নামাযের পর ইসলামের সর্বপ্রধান রুকন হচ্ছে যাকাত। আর তার গুরুত্ব এতবেশী যে, নামাযকে অস্বীকার করলে যেমন কাফের হতে হয়, অনুরূপভাবে যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তাকে শুধু কাফেরই হতে হয় না, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম একমত হয়ে তার রিরুদ্ধে জিহাদও করেছেন।
এখানে আমি যাকাতের প্রকৃত রূপ এবং এর অর্ন্তনিহিত তত্ত্ব আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। যাকাত মূলত কি জিনিস এবং ইসলাম এর এতবেশী গুরুত্ব দেয় কেন তা আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে।
আমাদের মধ্যে অনেক লোকই যার তার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। অথচ কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করার সময়ে সে বাস্তবিকই বন্ধুত্বের ব্যাপারে তারা প্রায়ই প্রতারিত হয়ে থাকে। পরে তাদের বড় দু:খ এবং অনুতাপ করতে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা বুদ্ধিমান তারা যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদেরকে খুব ভালো করে যাচাই ও পরীক্ষা করে নেয় এবং পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাদেরকে তারা খুব ভালো লোক, নির্ভরযোগ্য, নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাসভাজন বলে মনে করে, কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে, আর অন্যান্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ও সর্বাভিজ্ঞ। তিনি যাকে তাকে নিজের বন্ধু বানাবেন, নিজের দলভুক্ত করে নিবেন এবং তাঁর দরবারে সম্মান ও নৈকট্যের মর্যাদা দান করবেন তা কি করে আশা করা যেতে পারে? সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ যখন পরীক্ষা ও যাচাই না করে কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে রাযী হয় না, তখন সকল জ্ঞান ও বুদ্ধির একচ্ছত্র অধিকারী আল্লাহ তাআলা খুব ভালভাবে যাচাই ও পরীক্ষা না করে কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারেন না। দুনিয়ায় এই যে কোটি কোটি মানুষ ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে, যাদের মধ্যে ভাল-মন্দ সকল প্রকার মানুষই রয়েছে, নির্বিচারে ও নির্বিশেষে এদের সকলকেই আল্লাহর দলে শামিল করে নেয়া সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তাআলা যাদেরকে দুনিয়ায় তাঁর খলীফা বানাতে এবং আখেরাতে তাঁর নৈকট্য দান করতে চান, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট মানদন্ডে বিশেষ পরিস্থিতি ও পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাচাই করে নিতে চান। যাঁরাই সেই পরীক্ষায় যথাযথাভাবে উত্তীর্ণ হবেন, তাঁরাই আল্লাহর দলে গণ্য হতে পারবেন, আর যারা তা পারবে না তারা নিজেরাই তা থেকে দূরে সরে যাবে এবং তারা পরিষ্কাররূপে জানতে পারবে যে, তারা আল্লাহর দলে শামিল হবার যোগ্যতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়নি। মানুষের পরীক্ষা করার সেই কষ্টি পাথরটি কি? আল্লাহ নিজে যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তাই তিনি সর্বপ্রথম মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞানকেই পরীক্ষা করতে চান। মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিছু আছে কিনা, না নিরেট নির্বোধ তা তিনি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে থাকেন। কারণ নির্বোধ লোকেরা কখনও বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের বন্ধু হতে পারে না। (আর মূর্খ ও নির্বোধ লোকেরা তো কিছুতেই এবং কখনই আল্লাহর বন্ধু হতে পারে না।) আল্লাহর অস্তিত্বের নিশানা দেখে যে বুঝতে পারে যে, তিনিই আমার মালিক ও সৃষ্টিকর্তা, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ কোনো পরোয়ারদিগার, দোয়া শ্রবণকারী এবং সাহায্যকারী আর কেউ নেই। আল্লাহর কালাম দেখ যে তাকে আল্লাহর কালাম বলেই চিনতে পারে এবং তা অন্য কারো কালাম হতে পারে না বলে দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করে, সত্য নবী এবং মিথ্যা নবীদের জীবন চরিত, কাজ-কর্ম ও শিক্ষা-দীক্ষার মৌলিক পার্থক্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং নবী হওয়ার দাবীদারগণের মধ্যে প্রকৃত নবীকে আল্লাহর প্রেরিত নবী এবং সত্যের পথ নির্দেশকারী নবী বলে চিনতে পারে, আর মিথ্যা নবীকে দাজ্জাল ও প্রতারক বলে চিহ্নিত করতে পারে সেই ব্যক্তিরই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাকে লক্ষ কোটি লোকের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে নিজের দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে গণ্য করেন। অবশিষ্ট যারা প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় তাদেরকে তিনি পরিত্যাগ করেন।
এ প্রথম পরীক্ষায় যে সকল প্রার্থী উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে অতপর দ্বিতীয় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। দ্বিতীয়বারে মানুষের বুদ্ধির সাথে সাথে তার নৈতিক চরিত্র বলেরও যাচাই করা হয়। সত্য এবং পূণ্য কাজের পরিচয় লাভ করে তা গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী কাজ করা এবং অন্যায় ও পাপ কাজের পরিচয় লাভ করার পর তা পরিত্যাগ করার যোগ্যতা ও শক্তি তার আছে কিনা তা জেনে নেয়া এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য। যাচাই করে দেখা হয় যে, এ ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির দাস, বাপ-দাদার অন্ধ অনুসারী এবং পারিবারিক প্রথা এ দুনিয়ার সাধারণ রীতিনীতির গোলাম তো নয়? একটি কাজকে আল্লাহর বিধানের বিপরীত জেনে এবং তাকে খারাপ মনে করেও তার মধ্যে লিপ্ত থাকার মত দুর্বলতা তার মধ্যে নেই তো? পক্ষান্তরে একটি জিনিসকে আল্লাহর মনোনীত এবং সত্য জেনে তা গ্রহণ করার মনোবল আছে কিনা তাও যাচাই করা হয়। এ পরীক্ষায়ও যারা বিফল হয় তাদেরকে আল্লাহর দলভুক্ত করা হয় না। আল্লাহর দলভুক্ত কেবল তারাই হতে পারে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
فَمَنْ يَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرُوةِ الْوُثقى لاَ اَنْفِصَامَ لَهَا ـ
অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের বিরোধী বিধান ও পথ এবং বিধানদাতাকে যারা সাহসের সাথে পরিত্যাগ করে-সেই ব্যাপারে কারো পরোয়া করে না এবং নির্ভীকভাবে কেবল আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারেই জীবন যাপন করতে প্রস্তুত হয়-তাতে কেউ খুশী হোক আর নারায হোক সেই দিকে মাত্রই ভ্রুক্ষেপ করে না, তারা একটি মজবুত জিঞ্জির দৃঢ়তার সাথে ধারণ করে নিয়েছে যা কখনো ছিড়বে না।
এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে তৃতীয় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। একবার পরীক্ষা হয় আল্লাহর অনুসরণ ও আনুগত্য স্বীকারের প্রবণতার। এই সময়ে হুকুম দেয়া হয় যে, আমার তরফ থেকে যখনই কোনো নির্দেশ দেয়া হবে, তখনই তোমরা নিদ্রা ত্যাগ করে আমার সামনে হাজির হবে; কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে, নিজের স্বার্থ ও মন:পুত কাজ ছেড়ে, আনন্দ আর খুশী ত্যাগ করে আসবে এবং নির্দিষ্ট কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে, গ্রীষ্ম হোক, শীতহোক-যাই হোক না কেন, সকল সময়েই ডাক শোনা মাত্র হাজির হবে-সকল দু:খ-কষ্ট সহ্য করে আমার দরবারে উপস্থিত হবে এবং কর্তব্য পালন করবে। আবার যখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার না করতে বলবো এবং নফসের খাহেশ পূরণ করতে নিষেধ করবো, তখন তোমাকে এ হুকুম পুরোপুরি পালন করতে হবে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যত দু:সহ কষ্টই হোক না কেন; আর যত সুমিষ্ট পানীয়, স্বুস্বাদু খাদ্য তোমার সামনে স্তুপীকৃত হোক না কেন। এই পরীক্ষায় যারা অনুত্তীর্ণ হয় তাদেরকেও বলে দেয়া হয়, তোমাদের দ্বারা আমার কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। আর তৃতীয় পরীক্ষায়ও যারা উত্তীর্ণ হয় কেবল তাদেরকেই নির্বাচন করা হয়। কারণ এদের সম্পর্কেই এ আশা করা যেতে পারে যে, আল্লাহর তরফ থেকে যে বিধান নাযিল করা হবে তাই তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে স্বার্থ এবং লাভ, সুখ ও দু:খ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই যথাযথরূপে পালন করতে পারবে।
অতপর চতুর্থ পরীক্ষা নেয়া হয় মানুষের ধন-সম্পদ কুরবানী করার। তৃতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লোকগণও আল্লাহর কর্মচারী পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য প্রমাণিত হতে পারেনি। কেননা তাদের দিল ছোট, সংকীর্ণ, হীন সাহস ও বীর্যহীন এবং নীচ কিনা-মুখে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার বড় বড় দাবী করার লোক তো অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধুর ও ভালবাসার বড় বড় দাবী করার লোক তো অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধুর খাতিরে পকেটের পয়সা খরচ করতে প্রস্তুত কিনা, তার পরীক্ষা নেয়া এখনও বাকী রয়েছে। তারা তো সেই সকল লোকদের মত নয় যারা মুখে মুখে মা মা করে ভক্তিতে গদগদ এবং সেই মায়ের জন্য দাংগা করতেও পিছপা নয়, কিন্তু সেই মা যখন জন্তুর বেশে শস্যক্ষেত্র প্রবেশ করে তখন লাঠি নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়-পিটিয়ে ছাল উঠিয়ে দেয়। এমন স্বার্থপর, অর্থপূজারী সংকীর্ণমনা ব্যক্তিকে কোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও নিজের বন্ধু বলে গ্রহণ করতে পারে না। আর বড় উদার আত্মা বিশিষ্ট লোকও এমন ব্যক্তিকে নিজের কাচে কোনোরূপ মর্যাদা দিতেও প্রস্তুত হবে না। তাহলে যে মহান আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আল্লাহরই পথে খরচ করতে প্রস্তুত করতে পারেন, যে আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আল্লাহরই পথে খরচ করতে প্রস্তুত নয়? আর যে আল্লাহ এতবড় বুদ্ধিমান এবং বিজ্ঞ তিনি কেমন করে এমন ব্যক্তিকে নিজের দলভুক্ত করতে পারেন, যার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা মৌখিক জমা-খরচ মাত্র এবং যার ওপর কোনো কাজেই বিন্দুমাত্র ভরসা করা যায় না? কাজেই এ চতুর্থ পরীক্ষায় যারা ব্যর্থ হয় তাদেরকেও পরিষ্কার বলে দেয়া হয় যে, আল্লাহর দলে তোমাদের কোনো স্থান নেই, তোমরাও অকর্মণ্য-আল্লাহর খলীফার ওপর যে বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তা পালন করার যোগ্যতা তোমাদের নেই। এ দলে কেবল তাদেরকেই শামিল করা যেতে পারে যারা আল্লাহর ভালোবাসায় জীবন-প্রাণ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, বংশ-পরিবার, দেশ-সবকিছুর ভালবাসাকে অকুন্ঠিত চিত্তে কুরবান করতে পারে:
لَنْ تَنَالُوْا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ ـ ال عمران : ٩٢
“তোমরা নিজ নিজ প্রিয় জিনিসগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর উদ্দেশ্যে ব্যয় না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পুণ্য ও মহত্বের উচ্চতম মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।”- সূরা আলে ইমরান : ৯২
আল্লাহর এ দলে সংকীর্ণমনা লোকদের কোনোই স্থান নেই, কেবল উদার উন্নত হৃদয়বান ব্যক্তিরাই এই দলে শামিল হতে পারে।
وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ التغابن : ١٦
“মনের সংকীর্ণতা এবং কৃপণতাকে যারা অতিক্রম করতে পেরেছে কেবল তারাই সর্বাঙ্গীন কল্যাণ লাভ করতে পারে।”- সূরা আত তাগাবুন: ১৬
আল্লাহর দলে কেবল এমন লোকদের ভর্তি করা যেতে পারে, যারা কেউ তাদের শত্রুতা করলেও, তাদেরকে দু:খ দিলেও, তাদের ক্ষতিসাধন করলেও এবং তাদের কলিজাকে টুকরো কুকরো করলেও-কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই তারা পেটের খাদ্য এবং পরণের কাপড় দিতে অস্বীকার করবে না এবং বিপদের সময় তার সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হবে না:
وَلاَ يَاتَلِ اُوْلُوْا الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ اَنْ يُّؤْتُوْا اُوْْلِى الْقُرْبى وَالْمَسكِيْنَ وَالْمُهجِرِيْنَ فِى سَبِيْلِ اللهِ وَلْيَعْفُوا وَاْيَصْفَحُوْا اَلاَ تَحِبُّوْنَ اَنْ يَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ـ النور : ٢٢
“তোমাদের মধ্যে যারা বড় এবং সংগতি সম্পন্ন লোক তারা যেন নিজেদের প্রিয়জনদের, নিকটাত্মীয়দের, গরীব-দু:খীদের এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের (কোনো অপরাধের জন্য বিরক্ত হয়ে তাদেরকে) সাহায্য দান বন্ধ না করে। বরং তাদেরকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দেন তা কি তোমরা দাও না? অথচ আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড় ক্ষমাশীল এবং দয়াবান।”১- সূরা আন নূর : ২২
এ দলে এমন লোকদের আবশ্যক, যারা আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ থেকে বেছে বেছে ভাল ভাল জিনিস আল্লাহর জন্যই খরচ করে:
يَآ يُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَاكَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنْ الاَرْضِ وَلاَ تَيْمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ ـ الرقرة : ٢٦٧
“হে ঈমানদারগন! তোমরা নিজেরা যে ধন-সম্পত্তি উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য যমীন থেকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ভাল ভাল সামগ্রী (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। খারাপ দ্রব্য থেকে কিছু সেই পথে খরচ করো না।”- (সূরা আল বাকারা : ২৬৭)
১. হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জনৈক প্রিয় লোক যখন তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার চরিত্র সম্পর্কে অপবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছিল এবং হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার প্রতি অসন্তষ্ট হয়ে তার আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন এই আয়াতটি নাযিল হয়। আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তিনি কম্পিত ও ভীত হয়ে বললেন : আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাই এবং তখনই তিনি সেই লোকটির আর্থিক সাহায্য পুনরায় জারি করলেন।
এখানে এমন বড় আত্মার লোকদের আবশ্যক, যারা নিজেদের অভাব-অনটন, দারিদ্র ও রিক্ততার দু:সহ অবস্থায় নিজেদের অপরিহার্য প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করাকে তারা নিষ্ফল মনে করবে না। বরং তারা একান্তভাবে বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করা যায়, দুনিয়া এবং আখেরাত তিনি তার উত্তম ফল দান করবেন। এজন্য তারা কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই খরচ করে। তাদের এ দানশীলতার কথা দুনিয়ার প্রচার হোক না হোক কিংবা কেউ তার দানের শুকরিয়া আদায় করুক বা না করুক সে দিকে কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না:
وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ فَلاَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُوْنَ اِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ يُّوْفَّ اِلَيْكُمْ وَاَنْتُمْ لاَتُظْلَمُوْنَ ـ البقرة : ٢٧٢
“তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করবে তা তোমাদেরই কল্যাণ সাধন করবে- অবশ্য যদি তোমরা সেই খরচের ব্যাপার আল্লাহ ছাড়া আর কারো সন্তুষ্টি পেতে না চাও। এভাবে তোমরা ভাল কাজে যা কিছু দান করবে তার পূর্ণ ফল তোমরা লাভ করবে। সে দিক দিয়ে তোমাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।”- সূরা আল বাকারা : ২৭২
ধনী হয়ে সুখের মধ্যে ডুবে থেকেও যারা আল্লাহকে ভুলে যায় না, আল্লাহর দলে এ ধরনের ধীর প্রকৃতির লোকদেরই দরকার। তারা বড় বড় প্রাসাদে সুখ ও সম্ভোগের ভিতরে থেকেও আল্লাহকে ভুলে যাবে না:
يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَتُلْهِكُمْ وَلاَ اَوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلِ ذلِكَ فَاوُلئِكَ هُمُ الْخسِرِوْنَ المنفقون : ٩
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের সম্পদ আর সন্তান যেন তোমাদেরকে কখনও আল্লাহর যিকর থেকে বিরত না রাখে। এসবের জন্য যারা আল্লাহকে ভুলে যাবে তারা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”- সূরা মুনাফিকূন: ৯
ওপরে বর্ণিত গুণাবলী আল্লাহ তাআলার দলের লোকদের মধ্যে বর্তমান থাকা অপরিহার্য। এছাড়া কোনো ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধুদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের শুধু নৈতিক চরিত্রেরই নয়, তার ঈমানেরও বড় কঠিন এবং তিক্ত পরীক্ষা। আল্লাহর পথে খরচ করতে যে ব্যক্তি কুণ্ঠিত হবে, এরূপ খরচকে যে নিজের ওপরে জরিমানা বলে মনে করবে, কৌশল ও শঠতা করে তা থেকে যে আত্মরক্ষা করতে চায়, আর কিছু খরচ করলেও সে জন্য লোকের প্রতি নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে মনের জাল মিটাতে চায় কিংবা নিজের বদান্যতার কথা দুনিয়ায় প্রচার করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এমন লোকদের আদৌ ঈমান থাকতে পারে না। সে মনে করে, আল্লাহর জন্য সে যা কিছু করেছে, তা একেবারে নিষ্ফল হয়েছে। তার নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, নিজের স্বার্থ ও খ্যাতিকেই সে আল্লাহ এবং তাঁর সন্তষ্টি অপেক্ষাও বেশী প্রিয় বলে মনে করে। তার মতে এ দুনিয়াটাই সবকিছু। টাকা-পয়সা খরচ করলেও এ দুনিয়ায়ই সে জন্য সুনাম ও খ্যাতি লাভ হওয়া আবশ্যক। কারণ তাহলে সে টাকার বিনিময় এখানেই পাওয়া যেতে পারে। নতুবা টাকাও খরচ করলো আর কেউ জানতেও পারলো না যে, অমুক ব্যক্তি ভাল কাজে এতগুলো টাকা দিয়ে দিয়েছে, তবে তা সবই অর্থহীন হয়ে যায়। কুরআন মজীদে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের মানুষ আল্লাহর কোনো কাজেই আসতে পারে না। সে যদি নিজেকে ঈমানদার বলে প্রচার করে তথাপি সে ঈমানদার তো নয়ই বরং সে প্রকাশ্য মুনাফিক নিম্নের আয়াতগুলো তার প্রমাণ:
يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا صَدْقتِكُمْ بَالْمَنَ وَالاَذي كَالَّذِى يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَآ ءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ ـ البقرة : ٢٦٤
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দানকে অন্যের ওপরে নিজের অনুগ্রহ প্রচার করে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে তার মতো নিষ্ফল করে দিও না, যে ব্যক্তি শুধু অন্যকে দেখাবার জন্য কিংবা সুনাম কিনার জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস রাখে না।”
وَاَلَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَيُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فِبَشّرِهُمْ بِعَذَابِ اَلِيْمٍ ـ التوبة : ٣٤
“যারা স্বর্ণ এবং রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও।”- সূরা তাওবা : ৩৪।
لاَيَسْتَاْذِنُكَ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ اَنْ يُّجَاهِدُوْنا يَاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفٌسِهِمْ وَاللهُ عَلَيْمٌ بِالْمُتَّقِيْنَ ـ اِنَّمَا يَسْتَاذِنُكَ الَّذِيْنَ لاَيُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُبُهُمْ فَهُمْ فِىْ رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُوْنَ ـ
“হে নবী! যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের জান-মালসহ জিহাদে যোগদান করার কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকার জন্য কখনও অনুমতি চাইবে না। আল্লাহ তাআলা প্রকৃত মুত্তাকী বান্দাহগণকে খুব ভাল করেই জানেন। অবশ্য সেসব লোক ওজর আপত্তি করতে পারে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যাদের আদৌ বিশ্বাস নেই-যাদের মনের মধ্যে সন্দেহ জমাট বেঁধে রয়েছে এবং নিজেদের সন্দেহের মধ্যে নিমজ্জিত থেকেই ইতস্তত করে।”- সূরা আত তাওবা : ৪৪-৪৫
وَمَا مَنَعَهَمْ اَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقّهُمْ اِلاَّ اَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِه وَلاَ يَاتُوْنَ الصَّلوةَ اِلاَّ وُهُمْ كُسَالى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ اِلاَّ وَهُمْ كرِهُوْنَ ـ
“আল্লাহর পথে তাদের দান শুধু এজন্যই কবুল করা যায় না যে, মূলত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান নেই; নামাযের জন্য তারা আসে বটে; কিন্তু মনক্ষুণ্ন হয়ে; আর টাকা-পয়সাও তারা দান করে, কিন্তু বড়ই বিরক্তি সহকারে ।”- সূরা আত তাওবা : ৫৪
اَلْمُنفِقُوْنَ وَالْمُنفِقّتُ بَعْضُهُمْ مِّنْ بَعْضٍ يَامُرُوْنَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَيقْبِضُوْنَ اَيْدِيْهِمْ نَسُوْا اللهَ فَنَسِيْهُمْ اِنَّ الْمُنفِقِيْنَ هُمْ الْفسِقُوْنَ ـ التوبة : ٦٧
“মুনাফিক পুরুষ আর মুনাফিক স্ত্রী সব একই দলের লোক-একে অন্যের সাহায্যকারী। এরা সকলেই মিলে অন্যায়ের আদেশ করে, ন্যায় ও সত্যকে নির্মূল রাখে। এরা সকলেই আল্লাহকে ভুলে গেছে। তাই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেছেন। এসব মুনাফিক যে ফাসেক (আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘনকারী) তাতে সন্দেহ নেই।”- সূরা আত তাওবা : ৬৭
وَمَنْ الاَعْرَابِ مَنْ يَّتَّخِذُ مَايُنْفِقُ نَغْرَمًا ـ التوْبة : ٩٨
“এ আরাব (মুনাফিকদের) অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করলেও তা করে একান্তভাবে ঠেকে-যেন জরিমানা আদায় করছে।”
هآَ نْتُمْ هؤْلاَءٍ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فِمِنْكُمْ مَّنْ يَّبْخَلُ وَمَنْ يَّبْخَلْ فَانِّمَا يَبْخَلُ عَنْ نَّفْسِه وَاللهُ الْغَنِىُّ وَاَنْتُمْ الفُقَرَآءُ وَاِنْ تَتَوْلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ تُمَّ لاَيَكَوْنُوْا اَمْثَالَكُمْ ـ محمد : ٣٨
“জেনে রাখ, তোমাদের অবস্থা এতদূর খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, তোমাদের আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করতে বললে তোমরা সেজন্য মোটেই প্রস্তুত হও না বরং তোমাদের অনেকেই তখন কৃপণতা করতে থাকে। অথচ যে ব্যক্তি এসব কাজে কৃপণতা করে সেই কৃপণতায় তার নিজেরই ক্ষতি হয়। মূলত আল্লাহ একমাত্র ধনশালী আর তোমরা সকলেই দরিদ্র-তাঁরই মুখাপেক্ষী। আল্লাহর রাস্তায় যদি তোমার আদৌ অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত না হও তবে এ অপরাধের অনিবার্য ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্থানে এক ভিন্ন জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তারা নিশ্চয়ই তোমাদের মত (কৃপণ) হবে না।”- সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮
মোটকথা, যাকাত ইসলামের একটি স্তম্ভ এবং এটাই তার মূল কথা। একে প্রচলিত সরকারী ট্যাক্সের মত মনে মারাত্মক ভুল। কারণ আসলে এটা ইসলামের প্রাণ, ইসলামের জীবনী শক্তি। যাকাত ফরয করার মূলে ঈমানের পরীক্ষা করাই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রী লাভ করে, অনুরূপভাবে আল্লাহও মানুষের ঈমান যাচাই করার জন্য কতগুলো পরীক্ষা নির্দিষ্ট করে দেন; প্রত্যেক মানুষকেই এ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মানুষ যখন এরূপ পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ পরীক্ষা-অর্থাৎ অর্থদানের পরীক্ষায়ও সাফল্য লাভ করে, তখনই সে খাঁটি মুসলমান হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এটা নিশ্চয়ই সর্বশেষ পরীক্ষা নয়।
এরপরে আসে প্রাণের পরীক্ষা। সেই সম্পর্কেও আমি পরে আলোচনা করবো। কিন্তু ইসলামের সীমার মধ্যে আসার জন্য-অন্য কথায় আল্লাহর দলভুক্ত হবার যে কয়টি প্রবেশিকা পরীক্ষা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে, তার মধ্যে যাকাত হচ্ছে সর্বশেষ পরীক্ষা। বর্তমানে অনেকেই বলে বেড়াচ্ছে যে, টাকা-পয়সা খরচ বা দান করার অনেক ওয়াজই মুসলমানকে শুনান হয়েছে, বর্তমানে এ অভাব ও দারিদ্রের কঠিন মুহূর্তে তাদেরকে খানিকটা উপার্জন ও সঞ্চয় করার ওয়াজ শুনানো উচিত; কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে, যে জিনিসটির প্রতি তারা নাক ছিটকাচ্ছে তা হচ্ছে ইসলামের এ প্রাণ বস্তুটি। আর এ জিনিসটির অভাবই মুসলমানকে নৈতিক ও আর্থিক অধ:পতনের চরম সীমায় নিয়ে পৌঁছিয়েছে। এ প্রাণ বস্তুটি তাদেরকে অধপতিত করেনি। তাদের সর্বব্যাপী পতন হয়েছে শুধু এজন্য যে, এ প্রাণ বস্তুটিই তাদের দেহ থেকে নির্গত হয়ে গেছে।