হজ্জের হাকীকত
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
বইটির অডিও শুনুন
মাওলানা মওদূদী রচিত এই বইয়ে হজ্জের পেছনে অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা রয়েছে।
হজ্জের গোড়ার কথা
আরবী ভাষায় ‘হজ্জ’ অর্থ যিয়ারতের সংকল্প করা। যেহেতু খানায়ে কা’বা যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা পৃথিবীর চারদিক থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে চলে আসে, তাই এর নাম রাখা হয়েছে ‘হজ্জ’। কখন কিভাবে হজ্জের সূচনা হয়েছিল, সেই ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং শিক্ষাপ্রদ। গভীর মনোযোগের সাথে সেই ইতিহাস অধ্যয়ন করলে হজ্জের কল্যাণকারিতা হৃদয়ঙ্গম করা পাঠকের জন্য সহজ হবে।
কি মুসলমান, কি খৃস্টান- হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নাম কারো অজানা নয়। দুনিয়ার তিন ভাগের দু’ভাগেরও বেশী লোক তাঁকে ‘নেতা’ বলে স্বীকার করে। হয়রত মূসা আলাইহিস সালাম, হয়রত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এ তিনজন শ্রেষ্ঠ নবীই তাঁর বংশজাত, তাঁর প্রজ্জলিত আলোকবর্তিকা থেকে সমগ্র দুনিয়ার সত্যের জ্যোতি বিস্তার করেছে। চার হাজার বছরেরও বেশীকাল পূর্বে তিনি ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন সমগ্র দুনিয়ার মানুষ আল্লাহকে ভুলে বসেছিল। পৃথিবীর একজন মানুষও তার প্রকৃত মালিক ও প্রভুকে জানতো না এবং তাঁর সামনে বন্দেগী ও আনুগত্যের ভাবধারায় মস্তক অবনত করতো না। যে জাতির মধ্যে তাঁর জন্ম হয়েছিল সে জাতির লোকেরা যদিও তদানীন্তন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতি ছিল; কিন্তু পথভ্রষ্ট হওয়ার দিক দিয়েও তারাই ছিল অগ্রনেতা।সৃষ্ট জীব কখনও মা’বুদ বা উপাস্য হতে পারে না। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্প-ভাস্কর্যে চরম উন্নতি লাভ করা সত্ত্বেও এ সহজ কথাটি তারা বুঝতে পারতো না। তাই তারা আকাশের তারকা এবং (মাটি বা পাথর নির্মিত) মূর্তি পূজা করতো। জ্যোতিষ শাস্ত্র, ভালো-মন্দ জানার জন্য ‘ফাল’ গ্রহণ, অজ্ঞাত কথা বলা, যাদু বিদ্যা প্রয়োগ এবং দোয়া তাবীয ও ঝাড়-ফুঁকের খুবই প্রচলন ছিল। বর্তমানকালের হিন্দু পন্ডিত ও ব্রাহ্মণগণের মতো তখনকার সমাজে ঠাকুর-পুরোহিতেরও একটি শ্রেনী ছিল। তারা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করতো, অপর লোকের পক্ষ থেকে পূজা করে দিত, বিপদে- আপদে বা আনন্দে- খুশিতে তারা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করতো এবং অজ্ঞাত কথা বলে লোকদেরকে প্রতারিত করতো। সাধারণ লোকেরা এদেরকেই ভাগ্য নির্ধারক বলে মনে করতো। তারা এদেরই অংগুলি নির্দেশে ওঠা-বসা করতো এবং চুপচাপ থেকে নিতান্ত অন্ধের ন্যায় তাদের মনের লালসা পূর্ণ করে যেতো। কারণ তারা মনে করতো যে, দেবতাদের ওপরে এসব পূজারীর কর্তৃত্ব রয়েছে। এরা খুশি হলে আমাদের প্রতি দেবতাদের অনুগ্রহ বর্ষিত হবে। অন্যথায় আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। এ পূজারী দলের সাথে তৎকালীন রাজা-বাদশাহদের গোপন যোগাযোগ ছিল। জনসাধারণকে দাসানুদাস বানিয়ে রাখার ব্যাপারে রাজা-বাদশা ও পূজারীগণ পরস্পর সাহায্য করতো। একদিকে সরকার পূজারীদের পৃষ্ঠপোকতা করতো এবং অন্যদিকে পূজারীগণ জনগণের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিত যে, রাজা-বাদশাহরাও ‘আল্লাহর’ মধ্যে গণ্য; তারা দেশ ও প্রজাদের একচ্ছত্র মালিক, তাদের মুখের কথাই আইন এবং প্রজাদের জান-মালের ওপর তাদের যা ইচ্ছা করার অধিকার আছে। শুধু এতটুকুই নয়, রাজা -বাদশাহের সামনে (সিজদায় মাথা নত করা সহ) তাদের বন্দেগীর যাবতীয় অনুষ্ঠানই পালন করা হতো -যেন প্রজাদের মন-মগযের ওপর তাদের প্রভুত্বের ছাপ স্থায়ীভাবে অংকিত হয়ে যায়।
এহেন পরিবেশের মধ্যে এবং এ জাতির কোনো এক বংশে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের জন্ম। আরও মজার ব্যাপার এই যে, যে বংশে তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই বংশটাই ছিল পেশাদার ও বংশানুক্রমিক পূজারী। তাঁর বাপ-দাদা ছিলেন আপন বংশের পন্ডিত-পুরোহিত ব্রাহ্মণ।কাজেই একজন ব্রাক্ষণ সন্তানের পক্ষে যেরূপ শিক্ষা -দীক্ষা লাভ করা সম্ভব, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামও ঠিক তাই লাভ করলেন। সেই ধরনের কথা-বার্তা শৈশবকাল হতেই তাঁর কানে প্রবেশ করতো। তিনি তার ভাই -ভগ্নীদের মধ্যে পীর ও পীরজাদাদের মতো আড়ম্বর এবং বড়লোকী চাল-চলন দেখতে পেতেন। স্থানীয় মন্দিরের পৌরহিত্যের মহাসম্মানিত গদি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই গদিতে বসলে তিনি অনায়াসেই ‘জাতির নেতা’ হয়ে বসতে পারতেন। তাঁর গোটা পরিবারের জন্য চারদিকে থেকে যেসব ভেট-বেগাড় আর নযর -নিয়াজ জড়ো হতো, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্যও তা বর্তমান ছিল। দেশের লোক নিজেদের চিরকালীন অভ্যাস অনুসারে তাঁর সামনে এসে হাত জোড় করে বসার এবং ভক্তি -শ্রদ্ধা ভরে মাথানত করার জন্য প্রস্তুত ছিল। দেবতার সাথে সম্পর্ক পেতে অজ্ঞাত কথা বলার ভান করে তিনি সাধারণ কৃষক থেকে তদানীন্তন বাদশাহ পর্যন্ত সকলকে আজ্ঞানুবর্তী গোলাম বানিয়ে নিতে পারতেন। এ অন্ধকারে যেখানে সত্য জ্ঞানসম্পন্ন সত্যের অনুসারী একজন মানুষ কোথাও ছিল না সেখানে একদিকে তাঁর পক্ষে সত্যের আলো লাভ করা যেমন সম্ভবপর ছিল না তেমনি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক উভয় দিক দিয়েই এ বিরাট স্বার্থের ওপর পদাঘাত করে নিছক সত্যের জন্য দুনিয়া জোড়া বিপদের গর্ভে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হওয়াও কোনো সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কিন্তু হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না।তাঁকে ‘স্বতন্ত্র মাটি’ দ্বারাই সৃষ্টি করা হয়েছিল। জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথেই তিনি ভাবতে শুরু করলেন চন্দ্র, সূর্য, তারকা নিতান্ত গোলামের মতই উদয়-অস্তের নিয়ম অনুসরণ করছে, মূর্তি তো মানুষের নিজের হাতে পাথর দিয়ে গড়া, দেশের বাদশাহ আমাদের ন্যায় একজন সাধারণ মানুষ, এরা রব হতে পারে কেমন করে? যেসব জিনিস নিজের ইচ্ছায় এতটুও নড়তে পারে না, নিজের সাহায্য করার ক্ষমতাও যেসবের মধ্যে নেই, জীবন ও মৃত্যুর ওপর যাদের বিন্দুমাত্র হাত নেই, তাদের সামনে মানুষ কেন মাথা নত করবে? মানুষ কেন তাদের দাসত্ব ও পূজা -উপাসনা করবে? প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য তাদের গোলামীই বা কেন করবে? আকাশ ও পৃথিবীতে যত কিছুই আমরা দেখতে পাই, যেসব জিনিস সম্পর্কে কোন না কোন ভাবে আমরা ওয়াকিফহাল, তার মধ্যে একটি জিনিসও স্বাধীন নয়, নিরপেক্ষ নয়, অক্ষয়- চিরস্থায়ীও নয়। এদের প্রত্যেকটিরই অবস্থা যখন এরূপ তখন এরা মানুষের ‘রব বা প্রভু’ কিরূপে হতে পারে? এদের কেউই যখন আমাকে সৃষ্টি করেনি, আমার জীবন-মৃত্যু ও লাভ-ক্ষতির এখতিয়ার যখন এদের কারো হাতে নেই,আমার রিযিক ও জীবিকার চাবিকাঠি যখন এদের কারো হাতে নয়, তখন এদের কাউকেও আমি ‘রব’ বলে স্বীকার করবো কেন? এবং তার সামনে মাথা নত করে দাসত্ব ও উপসনাই বা কেন করবো? বস্তুত আমার ‘রব’ কেবল তিনিই হতে পারেন যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন, সকলেই যার মুখাপেক্ষী এবং যার হাতে সকলেরই জীবন -মৃত্যু ও লাভ -ক্ষতির উৎস নিহিত রয়েছে। এসব কথা ভেবে হযরত ইরাহীম (আ) জাতির উপাস্য মূর্তিগুলোকে পূজা না করে বরং পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত করলেন এবং এ সিদ্ধান্তে পৌছেই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেনঃ
إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ
‘‘তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক বলে মনে কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।” – সূরা আল আন’আমঃ ৭৮
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
‘‘আমি সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশেষভাবে কেবল সেই মহান সত্ত্বাকেই ইবাদাত – বন্দেগীর জন্য নির্দিষ্ট করলাম যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নই।’’ – সূরা আল আন’আমঃ ৭৯
এ বিপ্লবাত্মক ঘোষণার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ওপর বিপদ – মুসিবতের পাহাড় ভেংগে পড়লো। পিতা বললেন, আমি তোমাকে পরিত্যাগ করবো, বাড়ী হতে তাড়িয়ে দেব। সমগ্র জাতি বলে ওঠলো আমরা কেউ তোমাকে আশ্রয় দেব না। স্থানীয় সরকার ও তার বিরুদ্ধে লেগে গেল, বাদশাহর সামনে মামলা দায়ের করা হলো, কিন্তু হযরত ইবরাহীম আলাহীস সালাম একাকী এবং নিঃসংগ হয়েও সত্যের জন্য সকলের সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন। পিতাকে বিশেষ সম্মানের সাথে বললেন: ‘‘আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি। আপনি তা আদৌ জানেন না। কাজেই আমি আপনাদের কথা শুনবো না, তার পরিবর্তে আমার কথা আপনাদের সকলের শোনা উচিত।”
জাতির লোকদের হুমকির উত্তরে নিজ হাতে সবগুলো মূর্তি ভেংগে ফেলে তিনি প্রমাণ করলেন যে, তোমরা যাদের পূজা করো, তাদের কোন ক্ষমতা নেই। বাদশাহর প্রকাশ্য দরবারে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেনঃ “তুমি আমার ‘রব’ নও, আমার ‘রব’ তিনিই যাঁর মুষ্ঠিতে তোমার আমার সকলেরই জীবন ও মৃত্যু নিহিত রয়েছে এবং যাঁর নিয়মের কঠিন বাঁধনে চন্দ্র, সূর্য সবই বন্দী হয়ে আছে।” রাজ দরবার থেকে শেষ পর্যন্ত ফয়সালা হলো, ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে জীবন্ত জ্বালিয়ে ভষ্ম করা হবে। কিন্তু ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দিল ছিল পর্বত অপেক্ষা অধিকতর শক্ত – একমাত্র আল্লাহর ওপরেই ছিল তাঁর ভরসা। তাই এ ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতেও তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে প্রস্তুত হলেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা যখন তাঁকে কাফেরদের অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি দিয়েছিলেন তখন তিনি জন্মভূমি, জাতি, আত্মীয়-বান্ধব সবকিছু পরিত্যাগ করে শুধু নিজের স্ত্রী ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে সাথে নিয়ে পথে পথে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। যার জন্য ঘরে পৌরোহিত্যের গদি অপেক্ষা করছিলো, সেই গদিতে বসে যিনি গোটা জাতির পীর হয়ে যেতে পারতেন এবং সেই গদিকে যিনি বংশানুক্রমিকভাবে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিতে পারতেন, তিনি নিজের ও নিজের সন্তান সন্ততির জন্য নির্বাসন, সহায়-সম্বল হীনতার নিদারুণ দুঃখ- মসিবতকেই শ্রেয় মনে করে গ্রহণ করলেন। কারণ দুনিয়াবাসীকে অসংখ্য ‘মিথ্যা রবের’ দাসত্ব নিগড়ে বন্দী করে সুখের জীবন যাপন করা তিনি মাত্রই বরদাশত করতে পারলেন না। বরং তার পরিবর্তে তিনি একমাত্র প্রকৃত রবের দাসত্ব কবুল করে সমগ্র দুনিয়াকে সেই দিকে আহ্বান জানাতে লাগলেন এবং এ ‘অপরাধে’ (?) তিনি কোথাও একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারলেন না।
জন্মভূমি থেকে বের হয়ে হযরত ইবরাহীম (আ) সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর এবং আরব দেশসমূহে ঘুরতে -ফিরতে লাগলেন। এই ভ্রমণ ব্যাপদেশ তাঁর ওপর অসংখ্য বিপদ এসেছে, ধন-সম্পদ বা টাকা-পয়সা তার সাথে কিছু ছিল না। বিদেশে গিয়েও তিনি রুজি-রোজগার করার জন্য একটু চিন্তা-ভাবনা করেন নি। রাত দিন তিনি কেবল একটি চিন্তা করতেন, দুনিয়ার মানুষকে অসংখ্য রবের গোলামীর নাগপাশ থেকে মুক্ত করে কিরূপে একমাত্র আল্লাহর বান্দায় পরিণত করা যেতে পারে। এ খেয়াল ও চিন্তা -ভারাক্রান্ত মানুষটিকে যখন তাঁর পিতা এবং নিজ জাতি মোটেই সহ্য করলো না, তখন তাঁকে আর কে বরদাশত করতে পারে? কোন্ দেশের লোক তাঁকে আদর -অভ্যর্থনা জানাবে? সকল স্থানে সেই একই ধরনের মন্দিরের পুরোহিত আর খোদায়ীর দাবীদার রাজা- বাদশাহরাই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল এবং সর্বত্র একই ধরনের অজ্ঞ- মূর্খ জনসাধারণ বাস করতো, যারা এ ‘মিথ্যা খোদাদের’ গোলামীর জালে বন্দী হয়ে ছিল। এদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কি করে শান্তিতে দিন কাটাতে পারে, যিনি নিজের রব ছাড়া অন্য কারো গোলামী করতে প্রস্তুত ছিলেন না। যিনি অন্য লোকদেরও বলে বেড়াতেন যে, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কেউ মালিক, মনিব ও প্রভু নেই, সকলের প্রভুত্ব ও খোদায়ীর আসন চূর্ণ করে কেবলমাত্র আল্লাহর বান্দারূপে জীবনযাপন কর। ঠিক এ কারণেই হযরত ইবরহীম আলাইহিস সালাম কোথাও শান্তিতে বসবাস করতে পারেননি। বছরের পর বছর ধরে তিনি উদভ্রান্ত পথিকের ন্যায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও কেনানের জনপদে, কখনও মিসরে এবং কখনও আরবের মরুভুমিতে গিয়ে পৌঁছেছেন। এভাবেই তাঁর গোটা যৌবনকাল অতিবাহিত হয়ে গেল, কালো চুল সাদা হয়ে গেল।
জীবনের শেষ ভাগে নব্বই বছর পূর্ণ হতে যখন মাত্র চারটি বছর বাকী ছিল এবং সন্তান লাভের কোনো আশাই যখন ছিল না তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সন্তান দান করলেন। কিন্তু তখনও এ আল্লাহর বান্দা এতটুকু চিন্তিত হয়ে পাড়েননি যে, নিজের জীবনটা তো আশ্রয়হীনভাবে কেটে গেছে, এখন অন্তত ছেলে পেলেদেরকে একটু রুজি-রোজগারের যোগ্য করে তুলি। না, এসব চিন্তা তাঁর মনে উদয় হয়নি। বরং এ বৃদ্ধ পিতার মনে একটি মাত্র চিন্তাই জেগেছিল, তা এই যে, যে কর্তব্য সাধনে তিনি নিজের জীবন অতিবিহিত করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর সেই কর্তব্য পালন করার এবং তাঁর দাওয়াত চারদিকে প্রচার করার মতো লোকের বিশেষ অভাব রয়েছে। ঠিক এ জন্য তিনি আল্লাহর কাছে সন্তান কামনা করেছিলেন এবং আল্লাহ যখন তাঁকে সন্তান দান করলেন, তখন তিনি তাকে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কাজ চালিয়ে যাবার উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করলেন। এ পূর্ণ মানুষটির জীবন একজন সত্যিকার মুসলমানের আদর্শ জীবন ছিল। যৌবনের সূচনাতেই – বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন তিনি তাঁর রবকে চিনতে পারলেন তখন আল্লাহ তাকে বলেছিলেনঃ أَسْلِمْ – ইসলাম গ্রহণ কর – স্বেচ্ছায় আমার কাছে আত্মসমর্পণ কর, আমার দাসত্ব স্বীকার করো। তিনি তখন উত্তরে পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেনঃ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ – আমি ইসলাম কবুল করলাম। আমি সারাজাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করলাম, নিজেকে তার কাছে সোপর্দ করলাম। সমগ্র জীবন ভরে একথা ও এ ওয়াদাকে এই সাচ্চা মানুষটি সবদিক দিয়ে পূর্ণ করে দেখিয়েছেন। তিনি রাব্বুল আলামিনের জন্য শত শত বছরের পৈত্রিক ধর্ম এবং তার যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান ও আকীদা – বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছেন। পৌরহিত্যের গদিতে বসলে তিনি যেসব সুযোগ – সুবিধা লাভ করতে পারতেন তা সবই তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের বংশ – পরিবার, নিজের জাতি ও মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন। নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে আগুনের বুকে ঝাঁপ দিয়েছেন। দেশত্যাগ ও নির্বাসনের দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন, দেশের পর দেশ পরিভ্রমণ করেছেন, নিজের জীবনের এক একটি মূহুর্তকে রাব্বুল আলামীনের দাসত্ব অনুগত্যের কাজে এবং তাঁর দ্বীন ইসলামের প্রচারে কাটিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে যখন সন্তান লাভ হলো তখন তাঁর জন্যও এ ধর্ম এবং এ কর্তব্যই নির্ধারিত করলেন। কিন্তু এসব কঠিন পরীক্ষার পর আর একটি শেষ ও কঠিন পরীক্ষা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। যে পরীক্ষায় উত্তির্ণ না হওয়া পর্যন্ত হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সব কিছু অপেক্ষা রাব্বুল আলামীনকেই বেশী ভালবাসেন কিনা, তার ফয়সালা হতে পারতো না। সেই কঠিন এবং কঠোর পরীক্ষার সামনে এসে পড়লো। বৃদ্ধ বয়সে একেবারে নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর যে সন্তান লাভ হয়ে ছিল, সেই একমাত্র সন্তানকেও আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে পারেন কিনা, তারই পরীক্ষা নেয়া হলো। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এ পরীক্ষায়ও উর্ত্তীণ হলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ লাভ করার সাথে সাথে যখন তিনি নিজের পুত্রকে নিজের হাতে যবেহ করতে প্রস্তুত হলেন, তখন চূড়ান্তরূপে ঘোষণা করা হলো যে, এখন তুমি প্রকৃত মুসলিম হওয়ার দাবীকে সত্য বলে প্রমাণ করেছো। আল্লাহর কাছেও তাঁর এ কুরবানী কবুল হলো এবং তাকে বলে দেয়া হলো যে, এখন তোমাকে সারা দুনিয়ার ইমাম বা নেতা বানিয়ে দেয়া যেতে পারে – এখন তুমি সেই জন্য সম্পূর্ণরূপে যোগ্য হয়েছো। কুরআন শরীফের নিম্নলিখিত আয়াতে একথাই বলা হয়েছেঃ
وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ
“এবং যখন ইবরাহীমকে তার ‘রব’ কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সে সেই পরীক্ষায় ঠিকভাবে উত্তীর্ণ হলো তখন তাকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের ইমাম (অগ্রবর্তী নেতা) নিযুক্ত করেছি। তিনি বললেন, আমার বংশধরদের প্রতিও কি এ হুকুম? আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ যালেমদের জন্য আমার ওয়াদা প্রযোজ্য নয়।” – সূরা আল বাকারাঃ ১২৪
এভাবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে দুনিয়ার নেতৃত্ব দান করা হলো এবং তাঁকে ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের ‘নেতা’ নিযুক্ত করা হলো। এখন এ আন্দোলনকে অধিকতর সম্প্রসারিত করার জন্য এবং বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার জন্য তাঁর কয়েকজন সহকর্মী একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়লো। এ ব্যাপারে তিন ব্যক্তি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ‘দক্ষিণ হাত’ স্বরূপ কাজ করেছেন। একজন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত লূত আলাইহিস সালাম, দ্বিতীয় তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম যিনি – আল্লাহ তাঁর জীবন চান জানতে পেরে অত্যন্ত খুশী ও আগ্রহের সাথে – যবেহ হবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং তৃতীয় হচ্ছেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম।
ভ্রাতুষ্পুত্রকে তিনি ‘সাদুম’ (ট্রান্স জর্দান) এলাকায় বসালেন। এখানে সেকালের সর্বাপেক্ষা ইতর – লম্পট জাতি বাস করতো। সেখানে একদিকে সেই জাতির নৈতিকতার সংস্কার সাধন এবং সেই সাথে দূরবর্তী এলাকাসমূহেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোই ছিল তাঁর কাজ। ইরান, ইরাক এবং মিসরের ব্যবসায়ী দল এ এলাকা দিয়েই যাতায়াত করতো। কাজেই এখানে বসে উভয় দিকেই ইসলাম প্রচারের কাজ সুষ্ঠু রূপে সম্পন্ন করা তাঁর পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক হয়েছিল।
কনিষ্ঠ পুত্র হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামকে তিনি কেনান বা ফিলিস্তিন এলাকায় রাখলেন। এটা সিরিয়া ও মিসরের মধ্যবর্তী স্থান, তদুপরি এটা সমূদ্র – উপকূলবর্তী এলাকা বলে এখান থেকেই অন্যান্য দেশ পর্যন্ত ইসলামের আওয়াজ পৌঁছানো সহজ ছিল। এ স্থান থেকেই হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের পুত্র হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম যার নাম ছিল ইসরাঈল এবং পৌত্র হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের মারফতে ইসলামী আন্দোলন মিসর পর্যন্ত পোঁছেছিল।
জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে হিজাযের মক্কা নগরীতে বসালেন এবং দীর্ঘকাল যাবত নিজেই তাঁর সাথে থেকে আরবের কোণে কোণে ইসলামের শিক্ষা বিস্তার করেছিলেন। তারপর এখানেই পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে ইসলামী আন্দোলনের বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্র খানায়ে কা’বা প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এ কেন্দ্র নির্দিষ্ট করেছিলেন, নিজেই এটা গড়ে তোলার স্থান ঠিক করেছিলেন। খানায়ে কা’বা সাধারণ মসজিদের ন্যায় নিছক ইবাদাতের স্থান নয়, প্রথম দিন থেকেই এটা দীন ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রচার কেন্দ্ররূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ কা’বা ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী সকল মানুষ এখানে এসে মিলিত হবে এবং সংঘবদ্ধ ভাবে এক আল্লাহর ইবাদাত করবে, আবার এখান থেকেই ইসলামের বিপ্লবী পয়গাম নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবে। বিশ্ব মুসলিমের এ সম্মেলনেরই নাম হলো ‘হজ্জ’। এ ইবাদাত কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা কি করে হলো, কোন সব পূত ভাবধারা এবং দোআ প্রার্থনা সহকারে পিতা-পুত্র মিলে এ ইমারত তৈরী করেছিলেন আর ‘হজ্জ’ কিভাবে শুরু হলো তার বিস্তারিত বিবরণ কুরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছেঃ
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ – فِيهِ آَيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ آَمِنًا
“মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তা মক্কার ঘর তাতে সন্দেহ নেই। এটা অত্যন্ত পবিত্র, বরকতপূর্ণ এবং সারা দুনিয়ার জন্য হেদায়াতের কেন্দ্রস্থল। এতে আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ বর্তমান রয়েছে, ‘মাকামে ইবরাহীম’ রয়েছে এবং যে-ই এখানে প্রবেশ করবে সেই নিরাপদে থাকবে।” – সূরা আলে ইমরানঃ ৯৬-৯৭
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَمًا آَمِنًا وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ
“আমরা মানুষের জন্য কিরূপে বিপদশূন্য ও শান্তিপূর্ণ হেরেম তৈরী করেছি তা কি তারা দেখতে পায়নি? অথচ তার চারপাশে লোক লুণ্ঠিত ও ছিনতাই হয়ে যেতো।”- সূরা আল আনকাবুতঃ ৬৭
অর্থাৎ আরবের চারদিকে যখন লুঠ-তরাজ, মার-পিট এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি অশান্তির সয়লাব বয়ে যেত তখনও এ হেরেমে সর্বদা শান্তি বিরাজ করতো। এমন কি দুর্ধর্ষ মরু বেদুঈন যদি এর সীমার মধ্যে তার পিতৃহন্তাকে দেখতে পেত, তবুও এর মধ্যে বসে তাকে স্পর্শমাত্র করতে সাহস পেত না।
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ – وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا بَلَدًا آَمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آَمَنَ مِنْهُمْ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ
“এবং স্মরণ কর, যখন আমরা এ ঘরকে লোকদের কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয় স্থল বানিয়েছিলাম এবং ইবরাহীমের ইবাদাতের স্থানকে ‘মুসাল্লা’ (জায়নামায) বানাবার নির্দেশ দিয়েছিলাম আর তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী এবং নামাযীদের জন্য আমার ঘরকে পাক ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। পরে যখন ইবরাহীম দোয়া করলো, হে পালনকর্তা আপনি এ শহরকে শান্তিপূর্ণ জনপদে পরিণত করুন এবং এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদের জন্য ফল-মূল দ্বারা জীবিকার সংস্থান করে দিন।” – সূরা আল বাকারাঃ ১২৫-১২৬
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ – رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ – رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“এবং স্মরণ কর, ইবরাহীম ও ইসমাঈল যখন এ ঘরের ভিত্তি স্থাপনকালে দোয়া করছিলঃ পরওয়ারদিগার! আমাদের এ চেষ্টা কবুল কর, তুমি সবকিছু জান ও শুনতে পাও। পরওয়ারদিগার! তুমি আমাদের দু’জনকেই মুসলিম- অর্থাৎ তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশাবলী থেকে এমন একটি জাতি তৈরী কর যারা একান্তভাবে, তোমারই অনুগত হবে। আমাদেরকে তোমার ইবাদাত করার পন্থা বলে দাও, আমাদের প্রতি ক্ষমার দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরওয়ারদিগার! তুমি সে জাতির প্রতি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল পাঠাও যিনি তাদেরকে তোমার বাণী পড়ে শুনাবে, তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞানের শিক্ষা দেবে এবং তাদের চরিত্র সংশোধন করবে। নিশ্চয় তুমি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বিজ্ঞ।” – সূরা আল বাকারাঃ ১২৭-১২৯
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا الْبَلَدَ آَمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ – رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ – رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ
“এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম দোয়া করেছিলঃ হে আল্লাহ! এ শহরকে শান্তিপূর্ণ বানিয়ে দাও, আমাকে এবং আমার সন্তানকে মূর্তিপূজার শির্ক থেকে বাচাও। হে আল্লাহ! এ মূর্তিগুলো অসংখ্য লোককে গোমরাহ করেছে। অতএব, যে আমার পন্থা অনুসরণ করবে সে আমার, আর যে আমার পন্থার বিপরীত চলবে -তখন তুমি নিশ্চয়ই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরাওয়ারদিগার! আমি আমার বংশধরদের একটি অংশ তোমার এ মহান ঘরের নিকট, এ ধূসর মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেছি- এ উদ্দেশ্যে যে, তারা নামাযের ব্যবস্থা কায়েম করবে। অতএব, হে আল্লাহ! তুমি লোকদের মনে এতদূর উৎসাহ দাও যেন তারা এদের জীবিকার ব্যবস্থা করে। হয়ত এরা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবে।”-সূরা ইবরাহীমঃ ৩৫-৩৭
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ – وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ – لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ
“এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমের জন্য এ ঘরের স্থান ঠিক করেছিলাম -একথা বলে যে, এখানে কোনো প্রকার শিরক করো না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও নামাযীদের জন্য পাক-সাফ করে রাখ। আর লোকদেরকে হজ্জ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহবান জানাও – তারা যেন তোমার কাছে আসে, পায়ে হেঁটে আসুক কিংবা দূরবর্তী স্থান থেকে কৃশ উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন -দুনিয়ার কল্যাণের কত সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেয়া জন্তুগুলোকে আল্লাহর নামে কুরবানী করবে, তা থেকে নিজেরাও খাবে এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরও খেতে দেবে।” – সূরা আল হজ্জঃ ২৬-২৮
‘হজ্জ’ শুরু হওয়ার এটাই গোড়ার ইতিহাস। এটাকে ইসলামের পঞ্চম রোকন (স্তম্ভ) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ থেকে জানা গেলে যে, দুনিয়ায় যে নবী বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন, মক্কা-ই ছিল তাঁর প্রধান কার্যালয়।পবিত্র কা’বাই ছিল এর প্রধান কেন্দ্র – যেখানে থেকে ইসলাম দুনিয়ায় দূরবর্তী অঞ্চলে প্রচারিত হতো।আর দুনিয়ায় যারাই এক আল্লাহর বন্দেগী করতে চাবে এবং বাস্তব কর্মজীবনে তার আনুগত্য করে চলবে, তাঁরা যে জাতি আর যে দেশেরই অধিবাসী হোক না কেন, সকলেই একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে প্রতি বছর এসে সমবেত হবে, এজন্য ‘হজ্জ’ করার পন্থা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া যাবে যে, চাকা যেমন নিজ অক্ষের চতুর্দিকে ঘোরে, মুসলমানদের জীবনও তেমনি আপন কেন্দ্রেরই চতুর্দিকে আবর্তিত হয়- এ গূঢ় রহস্যেরই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে হজ্জ।
হজ্জের ইতিহাস
কিভাবে এবং কোন উদ্দেশ্যে হজ্জ শুরু হয়েছিল সে কথা পূর্বের প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মক্কায় ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে এখানে বসিয়ে ছিলেন, যেন তার পরে তিনি এ আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন, একথাও পূর্বের প্রবন্ধে বলা হয়েছে। হযরত ইসমাইল আলাইহীস সালামের পর তার বংশধরগণ কতকাল দীন ইসলামের পথে চলেছে তা আল্লাহ তাআলাই অবগত আছেন। কিন্তু পরবর্তী কয়েক শতাদ্বীর মধ্যেই তারা যে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদের শিক্ষা ও প্রদর্শিত পথ ভুলে গিয়েছিল এবং অন্যান্য ‘জাহেল’ জাতির ন্যায় সর্বপ্রকার গোমরাহী ও পাপ- প্রথার প্রচলন করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।যে কা’বা ঘরকে কেন্দ্র করে এককালে এক আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত ও প্রচার শুরু হয়েছিল, সেই কাবা ঘরে শত শত মূর্তি স্থাপন করা হলো। এমনকি, মূর্তি পূজা বন্ধ করার সাধনা ও আন্দোলনে যে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সারাটি জীবন অতিবাহিত হয়েছিল তাদের মূর্তি নির্মাণ করেও কাবা ঘরে স্থাপন করা হয়েছিল। চন্দ্র, বুধ, শুক্র, শনি ইত্যাদি গ্রহ – নক্ষত্রের পূজাও করতো। ভূত- প্রেত, ফেরেশতা এবং মৃত পূর্বপুরুষদের ‘আত্মা’র পূজাও করতো। তাদের মূর্খতা এতদূর প্রচণ্ড রূপ ধারন করেছিল যে, ঘর থেকে বের হবার সময় নিজেদের বংশের মূর্তি না পেলে পথ চলার সময় যে কোনো রঙীন পাথর দেখতে পেতো তারা তারই পূজা শুরু করতো। পাথর না পেলে পানি ও মাটির সংমিশ্রণে একটি প্রতিমূর্তি বানিয়ে তার ওপর ছাগ দুগ্ধ ছিটি‘য়ে দিলেই তাদের মতে সেই নিস্প্রাণ পিণ্ডটি খোদা হয়ে যেত এবং এরই পূজা করতো। যে পৌরোহিত্য ও ঠাকুরবাদের বিরুদ্ধে তাদের ‘পিতা’ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সমগ্র ইরাকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তা-ই আবার তাদের ঘরে প্রবেশ করেছিল, কা’বাকে তারা মূর্তিপূজার আড্ডাখানা বানিয়ে নিজেরাই সেখানকার পুরোহিত সেজেছিল। হজ্জকে তারা ‘তীর্থযাত্রা’র অনুরূপ বানিয়ে তাওহীদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল কা’বা ঘর থেকে মূর্তিপূজার প্রচার শুরু করেছিল এবং পূজারীদের সর্বপ্রকার কলা -কৌশল অবলম্বন করে আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকদের কাছ থেকে ‘নযর- নিয়ায ও ভেট – বেগাড়’ আদায় করতো এভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন, তা সবই বিনষ্ট হয়ে গেল।
এ ঘোর জাহেলী যুগে হজ্জের যে চরম দুর্গতি হয়েছিল একটি ব্যাপার থেকে তা ষ্পষ্টরূপে অনুমান করা যায়। মক্কায় একটি বার্ষিক মেলা বসতো, আরবের বড় বড় বংশ ও গোত্রের কবি কিংবা ‘কথক’ নিজ নিজ গোত্রের খ্যাতি, বীরত্ব, শক্তি, সম্মান ও বদান্যতার প্রশংসায় আকাশ- বাতাস মুখরিত করে তুলতো এবং পারষ্পরিক গৌরব ও অহংকার প্রকাশের ব্যাপারে রীতিমত প্রতিযোগিতা করতো। এমন কি অপরের নিন্দার পর্যায়ও এসে যেত। সৌজন্য ও বদান্যতার ব্যপারেও পাল্লা দেয়া হতো। প্রত্যেক গোত্র -প্রধান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ডেগ চড়াতো এবং একে অন্যকে হেয় করার উদ্দেশ্যে উটের পর উট যবেহ করতো। এ অপচয় ও অপব্যয়ের মূলে তাদের একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল; তা এই যে, এ সময় কোনো বদান্যতা করলে মেলায় আগত লোকদের মাধ্যমে আরবের সর্বত্র তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে এবং কোন গোত্রপতি কতটি উট যবেহ করেছিল এবং কত লোককে খাইয়েছিল ঘরে ঘরে তার চর্চা শুরু হবে। এসব সম্মেলনে নাচ -গান, মদ পান, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার নির্লজ্জ কাজ – কর্মের অনুষ্ঠান বিশেষ জাক- জমকের সাথে সম্পন্ন হতো। এ উৎসবের সময় এক আল্লাহর দাসত্ব করার কথা কারো মনে জাগ্রত হতো কিনা সন্দেহ। কা’বা ঘরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করা হতো। কিন্তু তার পদ্ধতি বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নারী – পুরুষ সকলেই উলংগ হয়ে একত্রে ঘুরতো আর বলতো আমরা আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় যাব, যেমন অবস্থায় আমাদের মা আমাদেরকে প্রসব করেছে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ‘ইবাদাত’ করা হতো একথা ঠিক; কিন্তু কিভাবে? খুব জোরে হাততালি দেয়া হতো, বাঁশি বাজান হতো, শিংগায় ফুঁ ৎকার দেয়া হতো। আল্লাহর নামও যে সেখানে নেয়া হতো না, এমন নয়। কিন্তু কিরূপে? তারা বলতো:
لَبَّيْكَ اللّٰهُمَّ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيْكاً هُوَ لَكَ تَمْلِيْكُهُ وَمَا مَلَكَ
“আমি এসেছি হে আমার আল্লাহ! আমি এসেছি, তোমার কেউ শরীক নেই ; কিন্তু যে তোমর আপন,সে তোমার অংশীদার। তুমি তারও মালিক এবং তার মালিকানারও মালিক।”
আল্লাহর নামে সেখানে কুরবানীও দেয়া হতো। কিন্তু তার পন্থা ছিল কত নিকৃষ্ট ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কুরবানীর রক্ত কা’বা ঘরের দেয়ালে লেপে দিত এবং এর গোশত কা’বার দুয়ারে ফেলে রাখতো। কারণ, তাদের ধারণা মতে আল্লাহ এসব রক্ত ও গোশত তাদের কাছ থেকে কবুল করছেন (নাউযুবিল্লাহ)। হযরত ইবরাহীম আলাহিস সালামের সময়ই হজ্জের চার মাসে রক্তপাত হারাম করে দেয়া হয়েছিল এবং এ সময় সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তী – কালের লোকেরা এ নিষেধ অনেকটা মেনে চলেছে বটে ; কিন্তু যুদ্ধ করতে যখন ইচ্ছা হতো, তখন তারা এক বছরের নিষিদ্ধ মাসগুলোকে ‘হালাল’ গণ্য করতো এবং পরের বছর তারা ‘কাযা’ আদায় করতো।
এছাড়া অন্যান্য যেসব লোক নিজ ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিল তারাও নিতান্ত মূর্খতার কারণে আশ্চর্য রকমের বহু রীতিনীতির প্রচলন করেছিল। একদল লোক কোনো সম্বল না নিয়ে হজ্জ যাত্রা করতো এবং পথে ভিক্ষা মেগে দিন অতিবাহিত করতো। তাদের মতে এটা খুবই পুণ্যের কাজ ছিল। মুখে তারা বলতো -“আমরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছি, আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার জন্য যাচ্ছি- দুনিয়ার সম্বল নেয়ার প্রয়োজন কি?” হজ্জে গমনকালে ব্যবসা করা কিংবা কামাই – রোযগারের জন্য শ্রম করাকে সাধারণত নাজায়েয বলেই ধারণা করা হতো। অনেক লোক আবার হজ্জের সময় পানাহার পর্যন্ত বন্ধ করে দিত এবং এরূপ করাকেও তারা ইবাদত বলে মনে করতো। কোনো কোনো লোক হজ্জে যাত্রা করলে কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ করে দিত। এর নাম ছিল ‘হজ্জে মুছমিত’ বা ‘বোবা হজ্জ’। এভাবে আরও যে কত প্রকার ভ্রান্ত ও কুপ্রথার প্রচলন হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ লিখে সময় নষ্ট করতে চাই না।
এরূপ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা কম- বেশী দু’ হাজার বছর পর্যন্ত ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে আরব দেশে কোন নবীর আবির্ভাব হয়নি, আর কোনো নবীর প্রকৃত শিক্ষাও সেই দেশে পৌঁছেনি। অবশেষে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোয়া পূর্ণ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলো। তিনি কা’ বা ঘর প্রতিষ্ঠার সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেনঃ “হে আল্লাহ!এ দেশে একজন নবী এ জাতির মধ্য থেকেই প্রেরণ কর, যে এসে তাদেরকে তোমার বাণী শুনাবে ; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবে এবং তাদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করবে।” এ দোয়া আল্লাহর কাছে মঞ্জুর হয়েছিল, তাই তাঁরই অধস্তন পুরুষে একজন কামেল ইনসান’ আবির্ভূত হলেন, যাঁর পাক নাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম ইবনে আবদুল্লাহ।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেরূপ পূজারী ও পুরোহিতের বংশে জন্মলাভ করেছিলেন, এ ‘কামেল ইনসান’ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অনুরূপ এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন- শতাব্দীকাল ধরে যারা কা’বা ঘরের পৌরোহিত্য করে আসছিল। একচ্ছত্রভাবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেরূপ আপন বংশের পৌরোহিত্যবাদের ওপর আঘাত হেনেছিলেন, শেষ নবী হযরাত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঠিক তেমনি প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিলেন নিজ বংশীয় পৌরোহিত্য ও পণ্ডিতগিরির ওপর। শুধু তাই নয়, তাঁর আঘাতে তা একেবারে মূলোৎপাটিত হয়েছিল। হযরত ইবারাহীম আলাইহিস সালাম যেমন বাতিল মতবাদ ও সমগ্র মিথ্যা খোদায়ী ধ্বংস করা এবং এক আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম করার উদ্দেশ্যে চেষ্টা করেছিলেন, শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাই করেছিলেন। তিনি হযরত ইবারাহীম আলাইহিস সালামের প্রচারিত প্রকৃত ও নির্মল দ্বীন ইসলামকে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। একুশ বছরের চেষ্টায় তার এসব কাজ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন আল্লাহ তায়ালার হুকুমে কা’বা ঘরকেই তিনি সমগ্র দুনিয়ায় এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীদের কেন্দ্ররূপে স্থাপনের কথা ঘোষণা করলেন এবং দুনিয়ার সকল দিক থেকেই হজ্জ করার জন্য কা’বা ঘরে এসে জমায়েত হওয়ার আহবান জানালেনঃ
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
“মানুষের ওপর আল্লাহর হক এই যে, এ কা’বা ঘর পর্যন্ত আসার সামর্থ যাদের আছে তারা হজ্জ করার জন্য এখানে আসবে। যারা কুফুরী করবে (অর্থাৎ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করতে আসবে না), তারা জেনে রাখুক যে, আল্লাহ সৃষ্টিজগতের মুখাপেক্ষী নন।”- সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭
এভাবে নব পর্যায়ে হজ্জ প্রবর্তন করার সাথে সাথে জাহেলী যুগে দু’ হাজার বছর যাবত প্রচলিত যাবতীয় কুসংস্কার একেবারে বন্ধ করা হলো। কা’বা গৃহের মূর্তিগুলো ভেংগে ফেলা হলো। আল্লাহ ছাড়া মূর্তির যে পূজা সেখানে হতো তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হলো। মেলা এবং সকল প্রকার তামাশা ও উৎসব নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো। আল্লাহর ইবাদাত করার সঠিক এবং স্বাভাবিক পদ্ধতি প্রচলন করা হলো, আল্লাহর আদেশ হলোঃ
وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِنْ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّينَ
“(আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদাত করার,) যে পন্থা আল্লাহ তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক তদনুযায়ী আল্লাহর স্মরণ (ও ইবাদাত) কর যদিও এর পূর্বে তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে (অর্থাৎ স্মরণ ও ইবাদাত করার সঠিক পন্থা জানতে না)” – সূরা আল বাকারাঃ ১৯৮
সকল অন্যায় ও বাজে কর্মতৎপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলোঃ
فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ
– (সূরা আল-বাকারাঃ ১৯7)
“হজ্জ উপলক্ষে কোনরূপ ব্যাভিচার, অশ্লীলতা, আল্লাহদ্রোহিতা, ফাসেকী কাজ এবং ঝগড়া -বিবাদ বা যুদ্ধ -বিগ্রহ করা যাবে না।”
কাব্য আর কবিত্বের প্রতিযোগিতা, পূর্বপুরুষদের কাজ -কর্মের কথা নিয়ে গৌরব -অহংকার এবং পরের দোষ -ক্রটি প্রচার করা বা গালাগাল দেয়া বন্ধ করা হলোঃ
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آَبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا
“হজ্জের অনুষ্ঠানগুলো যখন সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণ যেভাবে বাপ -দাদার স্মরণ করতো ঠিক অনুরূপ কিংবা তদপেক্ষা বেশী করে তোমরা আল্লাহর স্মরণ কর।” সূরা আল বাকারাঃ২০০
শুধু লোকদের দেখাবার জন্য বা খ্যাতি অর্জন করার যেসব বদান্যতা ও দানশীলতার গৌরব করা হতো তা সবই বন্ধ হলো এবং তদস্থলে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আমলের পশু যবেহ করার রীতি প্রচলিত হলো। কারণ এর ফলে গরীব হাজীদেরও কুরবানীর গোশত খাওয়ার সুযোগ মিলত।
كُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“খাও, পান কর, কিন্তু অপচয় করো না; কারণ আল্লাহ তাআলা অপচয়কারীদেরকে ভালবাসেন না।”-সুরা আল আরাফঃ ৩১
فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ فَإِذَا وَجَبَتْ
جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ
“খালেছ আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এবং তারই নামে এ জন্তুগুলোকে যবেহ কর। যবেহ করার পর যখন প্রাণ একেবারে বের হয়ে যাবে, তখন নিজেরাও তা খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্ত প্রার্থীকেও খেতে দাও।”- সুরা আল হাজ্জঃ ৩৬
কুরবানীর পশুর রক্ত খানায়ে কা’বার দেয়ালে মর্দন করা এবং গোশত নিক্ষেপ করার কুপ্রথা বন্ধ হলো। পরিস্কার বলে দেয়া হলোঃ
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ
التَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ
“এসব পশুর রক্ত বা গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, তোমাদের তাকওয়া এবং পরহেযগারীই আল্লাহর কাছে পৌঁছতে পারে।” সুরা আল হাজ্জঃ ৩৭
উলংগ হয়ে তাওয়াফ করা একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেল এবং বলা হলোঃ
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ
“হে নবী! আপনি তাদেরকে বলে দিন যে, আল্লাহ তার বান্দাহদের জন্য যেসব সৌন্দর্যবর্ধক জিনিস (অর্থ্যাৎ পোশাক পরিচ্ছদ) মনোনীত করেছেন, তা কে হারাম করলো? ”- সূরা আল আরাফঃ ৩২
قُلْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ
“হে নবী! আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ কখনও নির্লজ্জতার হুকুম দেন না।”- সূরা আল আরাফঃ ২৮
يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ
“হে আদম সন্তান! সকল ইবাদাতের সময় তোমাদের সৌন্দর্য গ্রহণ (পোশাক পরিধান) কর।” সূরা আল আরাফঃ ৩১
হজ্জের নির্দিষ্ট মাসগুলোকে উল্টিয়ে দেয়া এবং নিষিদ্ধ মাসকে যুদ্ধের জন্য ‘হালাল’ মনে করাকে বিশেষ কড়াকড়ির সাথে বন্ধ করা হলোঃ
إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ ۖ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِّيُوَاطِئُواعِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا مَا حَرَّمَ اللَّهُ ۚ
“নাসী কুফরীকে অধিকতর বাড়িয়ে দেয় (কুফরীর সাথে স্পর্ধাকে যোগ করে)। কাফেরগন এভাবে আরও অধিক গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়। এক বছর এক মাসকে হালাল মনে করে আবার দ্বিতীয় বছর তার বদলে আর একটি মাসকে হারাম বেঁধে নেয় -যেন আল্লাহর নিষিদ্ধ মাসগুলোর সংখ্যা সমান থাকে। কিন্তু এরূপ কাজ করলে আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিসকেই হালাল করা হয়।” সুরা আত তওবাঃ ৩৭
সম্বল না নিয়ে হজ্জযাত্রা করা নিষিদ্ধ হলো এবং পরিস্কার বলে দেয়া হলোঃ
وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ ۚ
“হজ্জ গমনকালে সম্বল অবশ্যই নেবে। কারণ, (দুনিয়ার সফরের সম্বল না নেয়া আখেরাতের সম্বল নয়) আখেরাতের উত্তম সম্বল তো হচ্ছে তাকওয়া।” সুরা আল বাকারাঃ ১৯৭
হজ্জের সময় ব্যবসা করা বা অন্য কোনো উপায়ে রুজি -রোযগার করা নিতান্ত অপরাধের কাজ, আর এসব না করাকেই বড় পুণ্যের কাজ মনে করা হতো। আল্লাহ তাআলা এ ভুল ধারণার প্রতিবাদ করে নাযিল করলেনঃ
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَبْتَغُوا فَضْلًا مِّن رَّبِّكُمْ ۚ
“(হজ্জে গমনকালে) ব্যবসা করে আল্লাহর অনুগ্রহ স্বরূপ কিছু কামাই রোযগার করলে তাতে কোন অপরাধ নেই।” -সুরা আল বাকারা ১৯৮
‘বোবা’ হজ্জ এবং ‘ক্ষুধার্ত -পিপাসার্ত’ হজ্জ হতেও মানুষকে বিরত রাখা হলো। শুধু তাই নয়, এছাড়া জাহেলী যুগের আরও অসংখ্য কুসংস্কার নির্মূল করে দিয়ে তাকওয়া, আল্লাহর ভয়, পবিত্রতা এবং অনাড়ম্বরতাকে মানবতার পূর্ণাংগ আদেশ বলে ঘোষনা করা হলো, হজ্জযাত্রীদেরকে নির্দেশ দেয়া হলো যে, তারা যেন ঘর থেকে বের হবার সময় নিজেদেরকে সকল প্রকার পার্থিব সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে নেয়, নফসের খাহেশ ও লালসা যেন ত্যাগ করে, হজ্জ গমন পথে স্ত্রী-সহবাসও যেন না করে, গালাগাল, কুৎসা রটানো, অশ্লীল উক্তি প্রভৃতি জঘন্য আচরণ থেকে যেন দূরে সরে থাকে। কা’বায় পৌঁছার যত পথ আছে, প্রত্যেক পথেই একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সেই স্থান অতিক্রম করে কা’বার দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এহরাম বেঁধে গরীবানা পোশাক পরিধান করে নেবে। এতে আমীর গরীব সকলেই সমান হবে, পৃথক কওম, গোত্র প্রভৃতির পার্থক্য ঘুচে যাবে এবং সকলেই এক বেশে- নিতান্ত দরিদ্রের বেশে এক আল্লাহর সামনে বিনয় ও নম্রতার সাথে উপস্থিত হবে। এহরাম বাঁধার পর মানুষের রক্তপাত করা তো দুরের কথা, পশু শিকার করাও নিষিদ্ধ। মানুষের মধ্য থেকে যেন কোনো যুদ্ধ -বিগ্রহ না হয়, এজন্য এ চারটি মাসকে ‘হারাম’ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে কা’বা গমনের সমস্ত পথ নিরাপদ হবে ; হজ্জ যাত্রীদের পথে কোনোরূপ বিপদের আশংকা থাকবে না। এরূপ পবিত্র ভাবধারা সহকারে তারা ‘হেরেম শরীফে’ প্রবেশ করবে- কোনো রূপ রং- তামাশা, নাচ – গান এবং মেলা আর খেলা দেখার উদ্দেশ্যে নয়। এখানে প্রতি পদে পদে আল্লাহর স্মরণ – আল্লাহর নামের যিকর, নামায, ইবাদাত ও কুরবানী এবং কাবা ঘর প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করতে হয়। আর এখানে একটি মাত্র আওয়াযই মুখরিত হয়ে উঠে, ‘হেরেম শরীফের ’ প্রাচীর আর পাহাড়ের চড়াই উৎরাইয়ের প্রতিটি পথে উচ্চারিত হয়ঃ
“তোমার ডাকেই হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি এসেছি, তোমার কোন শরীক নেই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। সকল তা’ রীফ প্রশংসা একমাত্র তোমারই জন্য। সব নেয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি একক- কেউ তোমার শরীক নেই।”
এরূপ পূত -পবিত্র এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ হজ্জ সম্পর্কে বিশ্বনবী ইরশাদ করেছেনঃ
“যে ব্যক্তি খাঁটিভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করে এবং এ ব্যাপারে সকল প্রকার লালসা এবং ফাসেকী থেকে দূরে থাকে, সে সদ্যজাত শিশুর মতই (নিষ্পাপ হয়ে) ফিরে আসে।”
অতপর হজ্জের কল্যাণ ও কার্যকারিতা বর্ণনা করার পূর্বে হজ্জ কি রকমের ফরয, তা বলা আবশ্যক। আল্লাহ কালামে পাকে বলেনঃ
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
“আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার মতো সামর্থ যার আছে, হজ্জ করা তার ওপর আল্লাহর একটি অনিবার্য নির্দিষ্ট ‘হক’। এতদসত্ত্বেও যে তা অমান্য করবে সে কাফের এবং আল্লাহ দুনিয়া জাহানের মুখাপেক্ষী নন।”- সূরা আল ইমরানঃ ৯৭
এ আয়াতেই হজ্জ করার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ না করাকে পরিষ্কার কুফরী বলা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তার মধ্যে দু’টি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছেঃ
مَنْ مَلَكَ زَادًا وَرَاحِلَةً تُبَلِّغُهُ إِلَى بَيْتِ اللَّهِ وَلَمْ يَحُجَّ فَلَا عَلَيْهِ أَنْ يَمُوتَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا
“আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য পথের সম্বল এবং বাহন যার আছে সে যদি হজ্জ না করে, তবে এ অবস্থায় তার মৃত্যু ইহুদী ও নাসারার মৃত্যুর সমান বিবেচিত হবে।” [তিরমিযী]
مَنْ لَمْ يَمْنَعْهُ مِنَ الْحَجِّ حَاجَةٌ ظَاهِرَةٌ أَوْ سُلْطَانٌ جَائِرٌ أَوْ مَرَضٌ حَابِسٌ فَمَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ فَلْيَمُتْ إِنْ شَاءَ يَهُودِيًّا وَإِنْ شَاءَ نَصْرَانِيًّا
“যার কোনো প্রকাশ্য অসুবিধা নেই, কোন যালেম বাদশাও যার পথ রোধ করেনি এবং যাকে কোন রোগ অসমর্থ করে রাখেনি – এতদসত্ত্বেও সে যদি হজ্জ না করেই মরে যায়, তবে সে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মরতে পারে।” [দারেমী]
হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বাখ্যা করে বলেছেনঃ
“সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা হজ্জ করেনা,তাদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করতে হয়; কারণ তারা মুসলমান নয়,মুসলমান নয়।”
আল্লাহ তায়ালার উল্লিখিত ইরশাদ এবং রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তারঁ খলিফার এ ব্যাখ্যা দ্বারা প্রত্যেকেই বুঝতে পারেন যে, হজ্জ করা সামান্য ফরয নয়। তা আদায় করা না করা মুসলমানদের ইচ্ছাধীন করে দেওয়া হয়নি। বস্তুত যে সব মুসলমানদের কা’বা পর্যন্ত যাওয়া আসার আর্থিক সামর্থ আছে,শারীরিক দিক দিয়েও যারা অক্ষম নয় তাদের পক্ষে জীবনের মধ্যে একবার হজ্জ করা অবশ্য কর্তব্য। তা না করে কিছুতেই মুক্তি নেই। দুনিয়ার যে কোণেই বাস করুক না কেন এবং যার ওপর ছেলে-মেয়ে ও কারবার কিংবা চাকরি-বাকরির যত বড় দায়িত্বই অর্পিত হোকনা কেন, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও একজন মুসলমান যদি হজ্জকে এড়াতে চায় এবং অসংখ্য ব্যস্ততার অজুহাতে বছরের পর বছর তাকে ক্রমাগত পিছিয়ে দেয়-সময় থাকতে আদায় না করে,তবে তার ঈমান আছে কিনা সন্দেহ। আর যাদের সমগ্র জীবনও হজ্জ আদায় করার কর্তব্য পালনের কথা মনে জাগে না, দুনিয়ার দিকে দিকে, দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়- ইউরোপ-আমেরিকা যাতায়াতকালে হেজাযের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে -কা’বা ঘর যেখান থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ, তবুও হজ্জ আদায় করার খেয়ালও তাদের মনে জাগ্রত হয়না -তারা কিছুতেই মুসলমান নয়; মুসলমান বলে দাবী করার কোনোই অধিকার তাদের নেই, দাবী করলেও সেই দাবী হবে মিথ্যা। আর যারা তাদেরকে মুসলমান মনে করে,তারা কুরআন শরীফের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ, জাহেল।এসব লোকের মনে যদি মুসলিম জাতির জন্যে দরদ থাকে তবে থাকতে পারে ; কিন্তু তার কোনোই সার্থকতা নেই। কারণ তাদের হৃদয়-মনে আল্লাহর আনুগত্য ও তার বিধানের প্রতি ঈমানের কোনো অস্তিত্ব নেই, একথা স্বতঃসিদ্ধ।