ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
বইটির অডিও শুনুন
[পুস্তিকাটি মূলত মাওলানা মওদূদীর একটি ভাষণ। ১৯৪৫ সালের ২১ এপ্রিল পূর্ব পাঞ্জাবস্থ পাঠান কোর্টের ‘দারুল ইসলামে’ নিখিল ভারত জামায়াতে ইসলামীর যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সে সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে মাওলানা এ ভাষণটি প্রদান করেন।]
আপনারা জানেন, আমাদের ইসলামী আন্দোলনের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন। এই দুনিয়াতে আমরা যে লক্ষ্যে উপনীত হতে চাই, তা এই যে, মানব জীবনের সর্বক্ষেত্র হতে ফাসেক, আল্লাহদ্রোহী ও পাপীষ্ঠ লোকদের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য নির্মূল করে দিয়ে তদস্থলে আমরা সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করবো। এই উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম করাকে আমরা ইহকাল ও পরকাল সর্বত্রই আল্লাহর সন্তোষলাভের একমাত্র উপায় বলে বিশ্বাস করি।
কিন্তু আমরা যে জিনিসকে নিজেদের চরম উদ্দেশ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করে নিয়েছি, বর্তমান মুসলিম অমুসলিম কেউই এর গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্ণরূপে সচেতন ও অবহিত নয়। মুসলমানগণ একে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মাত্র বলে মনে করে। দ্বীন ইসলামে এর গুরুত্ব যে কতোখানি, তা তারা মাত্র অনুধাবন করতে সমর্থ হয় না। অমুসলিমগণ কিছুটা হিংসার বশবর্তী এবং অনেকটা অজ্ঞতাবশত মানব সমাজের মূলগত সমস্যা সম্পর্কে একেবারেই অচেতন হয়ে আছে। এই দুনিয়ায় মানব সমাজের সকল দুঃখ-দুর্দশা ও বিপদ-মুসিবতের মুলীভূত কারণ হচ্ছে মানুষের উপর ফাসেক আল্লাহদ্রোহী পাপী ও অসৎলোকদের নেতৃত্ব। পৃথিবীর সর্বাধিক কাজ-কর্মের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কেবলমাত্র সৎ ও আল্লাহর অনুগত লোকদের হাতে ন্যস্ত হওয়ার উপরই মানবতার কল্যাণ একান্তভাবে নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ এই কথা মাত্রই হৃদয়ংগম করতে পারছে না। আজ বিশ্বের মানব সমাজে যে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, অত্যাচার-জুলুম ও নির্যাতন-নিষ্পেষণের স্বপ্লাবী সয়লাব বয়ে চলছে, মানব চরিত্রে যে সর্বাত্মক ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, মানবীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রতি রন্দ্রে রন্দ্রে যে বিষ সংক্রমিত হয়েছে, পৃথিবীর যাবতীয় উপায়-উপাদান এবং মানব বুদ্ধির আবিস্কৃত সমগ্র শক্তি ও যন্ত্র যেভাবে মানুষের কল্যাণ ও উন্নতি বিধানের পরিবর্তে ধ্বংস সাধনের কাজে নিয়োজিত হচ্ছে এসবের জন্য মানব সমাজের বর্তমান নেতৃত্বই যে একমাত্র দায়ী, তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। দুনিয়াতে সৎ ও সত্য প্রিয় লোকদের কোনো অভাব নেই একথা ঠিক, কিন্তু দুনিয়ার যাবতীয় কাজ-কর্মের কর্তৃত্ব এবং সমাজযন্ত্রের কোনো চাবিকাঠি তাদের হাতে নয়, এই স্বতঃসিদ্ধ। বরং বর্তমান দুনিয়ার সর্বত্রই কর্তৃত্ব রয়েছে আল্লাহদ্রোহী, আল্লাহবিমুখ, জড়বাদী ও নৈতিক চরিত্রহীন লোকদের মুষ্ঠিতে। এমতাবস্থায় যদি কেউ দুনিয়ার সংস্কার-সংশোধন করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয় এবং বিপর্যয়, উচ্ছৃংখলা, অশান্তি, অসচ্চরিত্রতা এবং অন্যায়কে পরিবর্তিত করে শান্তি-শৃংখলা এবং সুসংবদ্ধতা-সচ্চরিত্রতা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টানুবর্তী হয়, তবে পুণ্য ও সওয়াবের ওয়াজ আল্লাহর বন্দেগী করার সদুপদেশ, সচ্চরিত্রতা, নির্মল নৈতিকতা গ্রহণের মৌখিক উৎসাহ দেয়াই কখনো উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যথেষ্ট হতে পারে না। বরং মনুষ্য জাতির মধ্যে সত্য প্রিয়তা ও ন্যায়পন্থী যতো লোকই পাওয়া যাবে, তাদের একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করে সমষ্টিগত শক্তি অর্জন করা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ফাসেক ও আল্লাহদ্রোহী লোকদের হাত হতে কেড়ে সত্যপন্থী ও আদর্শবাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকরী পন্থা অবলম্বন করাই সংস্কারবাদী প্রত্যেকটি মানুষের পক্ষে অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে পড়ে।
নেতৃত্বের গুরুত্ব
মানব জীবনের জটিল সমস্যাবলী সম্পর্কে সামান্য মাত্র জ্ঞানও যার আছে, এই নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে সে ভালো করেই অবহিত হবে যে, মানব সমাজের যাবতীয় ব্যাপারের কর্তৃত্ব ও চাবিকাঠি কার হাতে নিবদ্ধ এই প্রশ্নের উপরই মানব জীবনের শান্তি, স্বস্তি নিরাপত্তা এবং ভাঙন-বিপর্যয় ও অধপতন একান্তভাবে নির্ভর করে। গাড়ি যেমন সবসময়ই সেই দিকেই দৌড়িয়ে থাকে যেদিকে তার পরিচালক ড্রাইভার চালিয়ে নেয় এবং তার আরোহীগণ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক সেই দিকেই ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়; অনুরূপভাবে মানব সমাজের গাড়িও ঠিক সেই দিকেই অগ্রসর হয়ে থাকে যেদিকে তার নেতৃবৃন্দ ও কর্তৃত্বশীল লোকেরা নিয়ে যায়। পৃথিবীর সমগ্র উপায় উপাদান যাদের করায়ত্ব হয়ে থাকবে; শক্তি, ক্ষমতা, ইখতিয়ারের সব চাবিকাঠি যাদের মুঠির মধ্যে থাকবে, সাধারণ জনগণের জীবন যাদের হাতে নিবদ্ধ হবে, চিন্তাধারা, মতবাদ ও আদর্শের রূপায়ণ বাস্তবায়নের জন্যে অপরিহার্য উপায় উপাদান যাদের অর্জিত হবে, ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র পুনর্গঠন, সমষ্টিগত নীতি ব্যবস্থার বাস্তবায়ন এবং নৈতিক মূল্য (valu) নির্ধারণের ক্ষমতা যাদের রয়েছে, তাদের অধীন জীবনযাপনকারী লোকগণ সমষ্টিগতভাবে তার বিপরীত দিকে কিছুতেই চলতে পারে না। এই নেতৃবৃন্দ ও কর্তৃত্বশীল লোকগণ যদি আল্লাহর অনুগামী, সৎ ও সত্যাশ্রয়ী হয়, তবে সেই সমাজের লোকদের জীবনের সমগ্র গন্থী ও ব্যবস্থাই আল্লাহভীতি, সার্বিক কল্যাণ ও ব্যাপক সত্যের উপর গড়ে উঠবে। অসৎ ও পাপী লোকও সেখানে সৎ ও পুণ্যবান হতে বাধ্য হবে। কল্যাণ ও সৎ ব্যবস্থা এবং মঙ্গলকর রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, উৎকর্ষ ও বিকাশ লাভ করবে। অন্যায় এবং পাপ নিঃশেষে মিটে না গেলেও অন্তত তা উন্নতিশীল এবং বিকশিত হতে পারবে না। কিন্তু নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি আল্লাহদ্রোহী, ফাসেক, পাপী ও পাপলিপ্সু লোকদের করায়ত্ত হয়, তবে গোটা জীবনব্যবস্থায়ই স্বতস্ফূর্তভাবে আল্লাহ দ্রোহিতা জুলুম, অন্যায়, অনাচার ও অসচ্চরিত্রতার পথে চলতে শুরু করবে। চিন্তাধারা আদর্শ ও মতবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্প ও রাজনীতি, অর্থনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান, নৈতিক চরিত্র ও পারস্পরিক কাজকর্ম বিচার ও আইন সমষ্টিগতভাবে এ সবকিছুই বিপর্যস্ত হবে। অন্যায় ও পাপ ফুলে-ফলে সুশোভিত হবে। কল্যাণ, ন্যায় ও সত্য পৃথিবীর কোথাও একবিন্দু খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবী ন্যায় ও সত্যকে স্থান দিতে, বায়ু ও পানি তার লালন-পালন করতে অস্বীকার করবে। আল্লাহর এই পৃথিবী অত্যাচার জুলুম, শোষণ ও নিপীড়ন-নিষ্পেষণের সয়লাব স্রোতে কানায় কানায় ভরে যাবে। এরূপ পরিবেশে অন্যায়ের পথে চলা সকলের পক্ষেই সহজ হবে ন্যায় ও সত্যের পথে চলাচল নয় শুধু দাঁড়িয়ে থাকাও হবে অত্যন্ত কঠিন। একটি জনাকীর্ণ মিছিলের সমগ্র জনতা যেদিকে চলে সেদিকে চলার জন্য উক্ত মিছিলের অন্তর্ভুক্ত কোনো ব্যক্তির পক্ষে বিশেষ শক্তি ব্যয় করতে হয় না, ভিড়ের চাপেই সে স্বতই সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, কিন্তু তার বিপরীত দিকে চলার জন্য প্রবল শক্তি ব্যয় করে এক কদম পরিমাণ স্থান অগ্রসর হওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় বিপরীত দিকে সামান্য চললেও ভিড়ের প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য চাপে দশ কদম পশ্চাতে সরে পড়তে বাধ্য হয় এটা এক স্বতসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত সত্য। মানুষের সমষ্টিগত জীবনের ধারা যখন অসৎ ও পাপাশ্রয়ী লোকদের নেতৃত্ব কুফরী ও ফাসেকী পথে অগ্রসর হতে থাকে, তখন (উপরোক্ত উদাহরণের ন্যায়) স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্তিদের পক্ষে অন্যায়ের পথে চলা তো খুবই সহজ এতোই সহজ হয় যে, সেদিকে চলার জন্য নিজের কোনো শক্তি ব্যয় করতেই হয় না কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলতে চাইলে নিজের দেহ-মনের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করেও তার পক্ষে ন্যায় পথে দৃঢ় হয়ে থাকতে পারলেও সমষ্টিগতভাবে তার জীবন মানব সমষ্টির অনিবার্য চাপে পাপ ও অন্যায়ের পথেই চলতে বাধ্য হয়।
এখানে আমি যা বলছি তা এমন কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, যার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য কোনো যুক্তিতর্কের আবশ্যক হতে পারে। বাস্তব ঘটনা প্রবাহই একে অনস্বীকার্য সত্যে পরিণত করেছে। কোনো সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিই এর সত্যতা স্বীকার না করে পারে না। এই বইয়ের প্রত্যেক পাঠকই আমার উক্ত কথার সত্যতা যাচাই করতে পারেন। বিগত এক শতাব্দীকালের মধ্যে আমাদের এই দেশের লোকদের মতবাদ, চিন্তাধারা, দৃষ্টিভংগী, রুচি ও স্বভাব-প্রকৃতি, চিন্তা-পদ্ধতি ও দৃষ্টিকোণ গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সভ্যতা ও চরিত্রের মানদণ্ড এবং মূল্য ও গুরুত্বের মাপকাঠি বদলে গেছে। আমাদের একটি জিনিসও অপরিবর্তিত থাকতে পারেনি। এই বিরাট পরিবর্তন আমাদের এই দেশে আমাদেরই দৃষ্টির সম্মুখে সাধিত হলো। মূলত এর কি কারণ হতে পারে, তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, এর একটি মাত্র কারণ রয়েছে আর আপনিও যতোই চিন্তা করেন, এছাড়া অন্য কোনো কারণ নির্ধারণ করা আপনার পক্ষেও সম্ভব হবে না। সে কারণ শুধু এটাই যে, যেসব লোকের হাতে এদেশের সর্বময় কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব নিবদ্ধ ছিলো সমাজ পরিচালন ও দেশ শাসনের ক্ষমতা ইখতিয়ার যাদের করায়ত্ত ছিলো, তারাই সমগ্র দেশের নৈতিক চরিত্র, মনোবৃত্তি, মনস্তত্ব, কাজকর্ম ও পারস্পরিক লেন-দেন ও আদান-প্রদান এবং সমাজ-সংস্থা ও ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে নিজেদের ইচ্ছা ও রুচি অনুসারেই ঢেলে গঠন করেছিলো। এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করার জন্য যেসব শক্তি মস্তক উত্তোলন করেছিল, তারা কতোখানি সাফল্য লাভ করতে পেরেছে, আর ব্যর্থতা তাদেরকে কতোখানি অভিনন্দিত করেছে, তাও একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন। একথা কি সত্য নয় যে, পরিবর্তন বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দান করেছেন, তাঁদেরই সন্তান অধস্তন পুরুষ শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন স্রোতের গড্ডালিকা প্রবাহে তৃণখণ্ডের ন্যায় ভেসে গেছে? বহির্বিশ্বের যাবতীয় বিবর্তিত রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও ধরণ-পদ্ধতি সবকিছুই তাদের ঘরবাড়ি নিমজ্জিত করে দিয়েছে? এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে যে, অসংখ্য সম্মানিত ধর্ম নেতার বংশে আজ এমনসব লোকের জন্ম হচ্ছে, যারা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং অহী ও নবুয়াতের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভবনা সম্পর্কে প্রবল সন্দেহ পোষণ করছে? জাতীয় জীবনের এই বিরাট বিপর্যয় এই বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার পরও কি একথা অস্বীকার করা যায় যে, মানব জীবনের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে নেতৃত্বের সমস্যাই হচ্ছে সবচেয়ে জটিল এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর সত্য কথা এই যে, এই জিনিসটির এহেন গুরুত্ব কেবল বর্তমানেই তীব্র হয়ে দেখা দেয়নি, এটা এক চিরন্তন সত্য ও চিরকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
الناس على دين ملوكهم “জনগণ নেতৃবৃন্দেরই আদর্শানুসারী হয়ে থাকে” কথাটি বহু পুরাতন। হাদিস শরীফে জাতীয় উত্থান-পতন, গঠন ও ভাঙনের জন্য দায়ী করা হয়েছে জাতিসমূহের আলেম, পণ্ডিত, শিক্ষিত লোক এবং নেতৃবৃন্দকে। কারণ, সমাজের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের গুরুদায়িত্ব চিরদিনই এদের উপর অর্পিত হয়ে থাকে।
সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বীন ইসলামের মূল লক্ষ্য
সৎ ও আদর্শ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দ্বীন ইসলামে যে কতোবেশী গুরুত্বপূর্ণ, তা উপরোক্ত বিশ্লেষণ হতে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারা যায়। আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের সর্বপ্রথম নির্দেশ এই যে, দুনিয়ার সকল মানুষ নিরংকুশভাবে একমাত্র আল্লাহর দাস হয়ে জীবনযাপন করবে এবং তাদের গলায় আল্লাহর দাসত্ব ছাড়া অন্য কারো দাসত্বের শৃঙ্খল থাকবে না। সেই সঙ্গেই এর আর একটি দাবি এই যে, আল্লাহর দেয়া আইনকেই মানুষের জীবনের একমাত্র আইন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এর তৃতীয় দাবী এই যে, পৃথিবীর বুক হতে সকল অশান্তি ও বিপর্যয় নির্মূল করতে হবে, পাপ ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করতে হবে। যেহেতু দুনিয়ার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হওয়ার এটাই একমাত্র কারণ।
অতএব এসব দূরীভুত করে তদস্থলে ন্যায়, সত্য, কল্যাণ ও মংগলকর ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও উৎকর্ষ সাধন করতে হবে, কারণ আল্লাহ তায়ালা এটাই পছন্দ করেন এবং ভালবাসেন। কিন্তু সকলেই বুঝতে পারেন যে, মনুষ্য জাতির নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং যাবতীয় সামাজিক কার্যাবলীর মূল চাবিকাঠি যতোদিন কাফের ও ভ্রষ্ট নেতৃবৃন্দের মুষ্টিবদ্ধ হয়ে থাকবে; আর একমাত্র সত্য ব্যবস্থা ইসলামের অনুসারী যতোদিন তাদের অধীন, তাদেরই প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগে লিপ্ত হয়ে ঘরের কোণে বসে আল্লাহর ‘জিক্র’ করার কাজে নিমগ্ন হয়ে থাকবে ততোদিন উপরোল্লিখিত উদ্দেশ্য কখনই সফল হতে পারে না। এই লক্ষ্য স্বতই নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন দাবি করে এবং সকল ন্যায়নিষ্ঠ, ন্যায়পন্থী, আল্লাহর সন্তোষকামী লোকদেরকে পরস্পর মিলিত হয়ে সামগ্রিক শক্তি অর্জন করতে এবং সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করে আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র সত্য বিধান ইসলামকে কায়েম করতে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়। এই সত্য বিধান কায়েম করতে হলে নেতৃত্বের পদ ও কর্তৃত্বের সকল চাবিকাঠি সমাজের সর্বাপেক্ষা অধিক ঈমানদার, সৎ ও আদর্শবাদী লোকের হাতে অর্পণ করতে হবে। এরূপ রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন ছাড়া দ্বীন ইসলামের মূল লক্ষ্য এবং দাবি কখনই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এ জন্যই সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা দীন ইসলামের সত্য বিধান বাস্তবায়নে আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়েছে। এমনকি এই বিরাট কর্তব্য বিস্মৃত হওয়ার পর এমন কোনো কাজই থাকতে পারে না, যা করে আল্লাহর কিছুমাত্র সন্তোষলাভ করা সম্ভব হতে পারে। কুরআন মজীদে জামায়াতবদ্ধ হওয়া ও নেতার আদেশ শ্রবণ ও পালনের উপর এতোবেশি গুরুত্ব কেন আরোপ করা হয়েছে, তা বাস্তবিকই প্রণিধানযোগ্য। উপরন্তু কুরআনের বিধান মতো জামায়াত হতে স্বেচ্ছায় বহিষ্কৃত ব্যক্তি হত্যার যোগ্য তাওহীদের কালেমায়ে তার বিশ্বাস থাকলেও এবং নামায-রোযা পালনকারী হলেও এই দণ্ড হতে সে কোনোক্রমেই রক্ষা পেতে পারে না। এরই বা কারণ কি? এর মূলীভূত ও একমাত্র কারণ কি এই নয় যে, সৎ নেতৃত্ব ও সত্যের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও স্থিতি সাধন দ্বীন ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলেই এরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে? আর এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সমষ্টিগত ও সংঘবদ্ধ শক্তি অর্জন করা একান্তই অপরিহার্য। কাজেই যে ব্যক্তিই সামগ্রিক শক্তি ও সামাজিক শৃংখলা চূর্ণ করবে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তার অপরাধ এতোবড় ও এতো মারাত্মক যে হাজার তাওহীদ স্বীকার এবং হাজার নামায-রোযা দ্বারা এর ক্ষতিপূরণ কিছুতেই হতে পারে না।
পরন্তু, ইসলামে জিহাদের উপর এতো অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কেন, তাও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। জিহাদ হতে বিরত থাকলে কুরআন মজিদ তাকে ‘মুনাফিক’ বলে কেন অভিহিত করে? কারণ এই যে, জিহাদ ইসলামের সত্য বিধান প্রতিষ্ঠারই নামান্তর মাত্র, কুরআন শরীফে মুসলমানের ঈমান পরীক্ষার জন্য এই জিহাদকেই চূড়ান্ত মাপকাঠি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য কথায় কুরআনের বিধান অনুযায়ী ঈমানদার ব্যক্তি বাতিল ও কাফেরী শাসন ব্যবস্থার প্রাধান্যে কখনই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। আর দ্বীন ইসলামের সত্য ও আদর্শ জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা-সাধনা না করা এবং জান-মালের কুরবানী না দেয়া তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আর এই কাজে এই ব্যাপারে কারো কুণ্ঠা ও ইতস্ততভাব প্রকাশিত হলে তার ঈমান সংশয়ের মধ্যে পড়ে যায়। ফলে অন্য হাজার ‘সওয়াবের’ কাজও তাকে কোনো কল্যাণদান করতে সমর্থ হয় না।
এই বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করার স্থান এটা নয়, এখানে তার অবকাশও নেই; কিন্তু উপরে যা কিছু বলেছি তা হতে খুব সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা একটি কেন্দ্রীয় ও মৌলিক উদ্দেশ্য বিশেষ এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এই ইসলামের প্রতি যার ঈমান আছে একমাত্র নিজের ব্যক্তিগত জীবনকেই যথাসম্ভব ইসলামী আদর্শের অনুসারী করলে তার সকল কর্তব্য সম্পন্ন হয় না তার সকল দায়িত্ব পালন হয় না। মানব সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকার কাফের ও ফাসেকদের নিকট হতে কেড়ে নিয়ে সর্বাপেক্ষা সৎ, সত্যাশ্রয়ী ও আদর্শবাদী লোকদের হাতে উহা তুলে দেয়ার জন্য সকল শক্তি নিযুক্ত করাও তার মূল ঈমানের ঐকান্তিক ও অনস্বীকার্য দাবি। কারণ, আল্লাহর মর্জি অনুযায়ী পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা ও সমাজ পরিচালনা এরূপ এক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ভিন্ন আদৌ সম্ভব নয়। পরন্তু, এই উদ্দেশ্য যেহেতু উচ্চতর সামগ্রিক প্রচেষ্টা ছাড়া হাসিল হতে পারে না, এজন্যই এমন একটি সৎ ও আদর্শ জামায়াত গঠন করাও অপরিহার্য যা সবসময়েই ইসলামের সত্য নীতি অনুসরণ করে চলবে এবং ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করা, স্থায়ী রাখা এবং তাকে ঠিকভাবে পরিচালিত করে যাওয়া ভিন্ন তার আর কোনই উদ্দেশ্য হবে না। সারা পৃথিবীতে একটি মাত্র লোক যদি ঈমানদার হয়, তবুও সে একাকী বলে এবং নিজেকে নিঃসম্বল মনে করে বাতিল শাসনব্যবস্থার প্রভাব সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করা কিংবা هون البليتين ‘দু’টি বিপদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজতম বিপদকে গ্রহণ করার, অবাঞ্ছিত কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কুফরী ও ফাসেকী ব্যবস্থার অধীন নামেমাত্র ধর্মীয় জীবনযাপন করার সুবিধা ভোগ করা তার পক্ষে আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়। বরং সেই একাকী ও নিঃসংগ ঈমানদার ব্যক্তিরও কর্তব্য হচ্ছে বিশ্বমানবকে আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান গ্রহণ করার আহবান জানান। তার এই আহবানের প্রতি কেউ ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করলেও সমগ্র জীবন ভর ইসলামের সত্য ও দৃঢ় পথে দাঁড়িয়ে থাকা এবং লোকদেরকে আহবান জানান ও আহবান জানাতে জানাতেই মৃত্যু মুখে ঢলে পড়া তার কর্তব্য। নিজ মুখে সত্যভ্রষ্ট দুনিয়ার পছন্দসই কোনো আমন্ত্রণ প্রচার করা এবং কাফেরদের নেতৃত্বের অধীন দুনিয়া যে পথে ছুটে চলেছে, সেই দিকে অগ্রসর হওয়া অপেক্ষা সত্য পথে সত্যের বাণী প্রচার করতে করতে মৃত্যুবরণ করাও তার পক্ষে শ্রেয়। আর তার আমন্ত্রণে কিছু সংখ্যক লোক যদি একত্রিত হয়, তাদের নিয়ে একটি বিশেষ সংঘ গঠন করা এবং উল্লেখিত আদর্শের জন্য সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা-সাধনা ও আন্দোলন করাই তার একান্ত কর্তব্য।
দীন ইসলাম সম্পর্কে আমার যতোটুকু জ্ঞান আছে এবং কুরআন ও হাদিস নিগূঢ়ভাবে অধ্যয়নের ফলে যতোটুকু বুদ্ধি ও স্বচ্ছ দৃষ্টি আমি লাভ করতে পেরেছি, তার ভিত্তিতে আমি এটাকেই দীন ইসলামের মৌলিক দাবি বলে জানতে পেরেছি। আল্লাহর কিতাব কুরআন মজীদ এটাই আমাদের নিকট দাবি করে বলে বুঝতে পেরেছি, আর আল্লাহর প্রেরিত সকল নবীর এটাই যে সুন্নাত ছিলো তা আমি নিঃসন্দেহে জানতে পেরেছি। আমি আমার এ মত ত্যাগ করতে মাত্রই রাজি নই যতোক্ষণ পর্যন্ত না কেউ কুরআন ও সুন্নাহর দলিল হতেই আমার ভুল প্রমাণ করে দিবে।
নেতৃত্বের ব্যাপারে আল্লাহর নিয়ম
আমাদের এই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্য বুঝে নেয়ার পর এই ব্যাপারে বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব নিয়ম-নীতি কি তাও জেনে নেয়া আবশ্যক। কারণ, আমাদের কোনো উদ্দেশ্য লাভ করতে হলে তা আল্লাহর নিয়ম অনুসারেই লাভ করা সম্ভব, তার বিপরীত নয়। আমরা যে বিশ্ব প্রকৃতির বুকে বসবাস করি, আল্লাহ তার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ীই এটা সৃষ্টি করেছেন। এখানকার প্রত্যেকটি দ্রব্য ও বস্তুই সেই স্থায়ী ও অটল নিয়ম বিধানের অনুসারী। কেবল সদিচ্ছা ও নেক বাসনার দরুনই এখানে চেষ্টা সাফল্য লাভ করতে পারে না। মহান পবিত্র আত্মাদের (?) বরকতেই এখানে কোনো বাসনা বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে না। এই প্রাকৃতিক দুনিয়ায় মানুষের চেষ্টা-সাধনা ফলপ্রসু হওয়ার জন্য আল্লাহ নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে চলা অপরিহার্য। একজন কৃষক সে যতোবড় বুজুর্গ হোক, মহৎ গুণের আধার এবং তসবীহ পাঠে যতোই আত্মহারা হোক না কেন যতোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে পরিপূর্ণ শ্রম সহকারে কৃষিকাজ সম্পন্ন না করবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তার একটি বীজও অংকুরিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে নেতৃত্ব বিপ্লবের সেই চরম উদ্দেশ্যও কখনো কেবল দোয়া, তাবীজ, সদিচ্ছা ও নেক বাসনার সাহায্যে লাভ করা যাবে না। রাষ্ট্র বিপ্লবের জন্য আল্লাহর নিয়ম অনুধাবন করা একান্ত আবশ্যক। কারণ, দুনিয়ার নেতৃত্ব কায়েম হওয়ার এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। এরই অধীন একজন লোক নেতৃত্ব লাভ করে এবং এ নিয়ম অনুযায়ীই এক-একজন লোক নেতৃত্ব হারায় বা নেতৃত্ব হতে বঞ্চিত হয়। এই সম্পর্কে আমার অন্যান্য রচনাবলীতেও আমি আলোচনা করেছি বটে; কিন্তু তা ছিলো সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আজ এখানে যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করা দরকার বলে মনে করি। কারণ, এই বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পরিষ্কার ধারণা না হলে আমাদের কর্মপন্থা এবং চলার পথ আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হবে না।
মানুষের গোটা সত্তার বিশ্লেষণ করে দেখলে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায় যে, এর মধ্যে দু’টি দিক পরস্পর বিরোধী হয়েও পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের একটি দিক এই যে, তার একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ও পাশবিক সত্তা রয়েছে। তার এই সত্তার উপর ঠিক সেইসব নিয়ম ও আইন জারি হয়ে আছে, যা সমগ্র বস্তুগত ও জন্তু-জানোয়ারের উপর বর্তমান। দুনিয়ার অন্যান্য সমগ্র জড় পদার্থ ও জান্তব সত্তার কার্যকারিতা ও কর্মক্ষমতা যেসব যন্ত্রপাতি ও বৈষয়িক উপায়-উপাদান এবং জড় অবস্থার উপর একান্ত নির্ভরশীল, মানুষের এই দিকটির কার্যকারিতা ও কর্মক্ষমতা ও অনুরূপভাবে সেই সবেরই উপর নির্ভরশীল। মানুষের এই স্বাভাবিক (Physical) সত্তা তার যাবতীয় কর্মক্ষমতাকে একমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন যন্ত্রপাতি ও উপায়-উপাদানের সাহায্যে এবং স্বাভাবিক জড় অবস্থায় থেকেই ব্যবহার করতে পারে। এজন্যই তার সকল কাজের উপরই বাস্তব ও কার্যকারণ পরম্পরা জগতের সমগ্র শক্তিই বিপরীত কিংবা অনুকূল প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
মানুষের মধ্যে আর একটি দিক রয়েছে খুবই উজ্জ্বল এবং গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে তার মানবিক দিক তার মানুষ হওয়ার দিক অন্য কথায় বলা যায়, মানুষের একটি নৈতিক দিক রয়েছে, যা কোনদিক দিয়েই প্রাকৃতিক সত্তার অধীন ও অনুসারী নয়। এই নৈতিক দিক নৈতিক সত্তাই মানুষের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক দিকের উপর এক হিসেবে প্রভুত্ব বিস্তার করে। স্বাভাবিক ও জান্তব সত্তাকেও এটা অস্ত্র ও উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বের কার্যকারণসমূহকেও নিজের অধীন করতে এবং নিজের উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে যেসব নৈতিক ও চারিত্রিক গুণপণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তাই হচ্ছে এর কর্মচারী বা কার্যসম্পন্নকারী শক্তি। তার উপর প্রাকৃতিক নিয়মের কোনো প্রভুত্বই চলে না, চলে নৈতিক নিয়ম বিধানের প্রভুত্ব।
মানুষের উত্থান-পতন নৈতিক চরিত্রের উপর নির্ভরশীল
উল্লেখিত দু’টি দিক মানুষের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত রয়েছে। সমষ্টিগতভাবে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং তার উত্থান ও পতন বৈষয়িক বা বস্তুনিষ্ঠ ও নৈতিক এই উভয়বিধ শক্তির উপর একান্তভাবে নির্ভর করে। মানুষ না বস্তুনিষ্ঠ শক্তি নিরপেক্ষ হতে পারে, আর না নৈতিক শক্তির মুখাপেক্ষীহীন হয়ে কিছু সময় বাঁচতে পারে। তার উন্নতি লাভ হলে উভয় শক্তির ভিত্তিতেই হবে, আর পতন হলেও ঠিক তখনি হবে, যখন এই উভয়বিধ শক্তি হতেই সে বঞ্চিত হয়ে যাবে। অথবা এটা অন্যান্যের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে। কিন্তু একটু গভীর ও সুক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করলে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যাবে যে, মানব জীবনের মূল সিদ্ধান্তকারী গুরুত্ব রয়েছে নৈতিক শক্তির বৈষয়িক বা বস্তুনিষ্ঠ শক্তির নয়। বৈষয়িক বস্তুনিষ্ঠ উপায়-উপাদান লাভ, স্বাভাবিক পন্থাসমূহের ব্যবহার এবং বাহ্যিক কার্যকারণ পরম্পরাসমূহের আনুকূল্য সাফল্যলাভের জন্য অপরিহার্য শর্ত এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাজেই মানুষ যতোদিন এই কার্যকারণ পরম্পরা জগতে বসবাস করবে, এই শর্ত কোনোরূপেই উপেক্ষিত হতে পারে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যে মূল জিনিসটি মানুষের পতন ঘটায়, উত্থান দান করে এবং তার ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে যে জিনিসটির সর্বাপেক্ষা অধিক প্রভাব রয়েছে, তা একমাত্র নৈতিক শক্তি ভিন্ন আর কিছুই নয়। এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষকে এর দেহসত্তা বা এর পাশবিক দিকটার জন্য কখনও মানুষ বলে অভিহিত করা হয় না, বরং মানুষকে মানুষ বলা হয় এর নৈতিক গুণ-গরিমার কারণে। মানুষের একটি দেহ আছে, স্বতন্ত্র একটি সত্তা আছে, তা কতোখানি স্থান দখল করে থাকে, সে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে, কিংবা বংশ বৃদ্ধি করে; কিন্তু শুধু এই কারণে মানুষ দুনিয়ার অন্যান্য বস্তু ও জন্তু হতে স্বতন্ত্র মর্যাদালাভের অধিকারী হতে পারে না। মানুষ নৈতিক গুণসম্পন্ন জীব, তার নৈতিক স্বাধীনতা ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। ঠিক এই জন্যই মানুষকে দুনিয়ার সমগ্র জীব-জন্তু ও বস্তুর উপর বিশিষ্ট মর্যাদা দান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষকে ‘দুনিয়ার বুকে আল্লাহর খলিফা’ হওয়ার মহান মর্যাদায়ও অভিষিক্ত করা হয়েছে। অতএব মানবতার মূল প্রাণবস্তু সর্বাপেক্ষা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন মানুষের নৈতিকতা, তখন মানুষের জীবনে গঠন-ভাঙ্গন ও উন্নতি-অবনতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী গুরুত্বও যে সেই নৈতিক চরিত্রেই রয়েছে তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। বস্তুত মানুষের উত্থান-পতনের উপর তার নৈতিক নিয়ম-বিধানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান।
এই নিগূঢ় তত্ত্ব অনুধাবন করার পর আমরা যখন নৈতিক চরিত্রের গভীরতর বিশ্লেষণ করি, তখন নীতিগতভাবে এর দু’টি প্রধান দিক আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় একটি হচ্ছে মৌলিক মানবীয় চরিত্র, অপরটি হচ্ছে ইসলামী নৈতিক চরিত্র।
মৌলিক মানবীয় চরিত্রের বিশ্লেষণ
মৌলিক মানবীয় চরিত্র বলতে বুঝায় সেসব গুণবৈশিষ্ট্য যার উপর মানুষের নৈতিক সত্তার ভিত্তি স্থাপিত হয়। দুনিয়ার মানুষের সাফল্যলাভের জন্য অপরিহার্য যাবতীয় গুণ-গরিমাই এর অন্তর্ভুক্ত। মানুষ কোনো সৎ উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করুক, কি ভুল ও অসৎ উদ্দেশ্যে সকল অবস্থায় তা একান্তই অপরিহার্য। মানুষ আল্লাহ, অহী, রসূল এবং পরকাল বিশ্বাস করে কি করে না, তার হৃদয় কলুষমুক্ত কিনা, নিয়ত ও লক্ষ্য কল্যাণময় কিনা, সে নিজে সৎ গুণ ও সৎকাজে ভূষিত কিনা, সদুদ্দেশ্যে কাজ করে, অসদুদ্দেশ্যে উল্লেখিত চরিত্রের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। কারো মধ্যে ঈমান থাকুক কি না থাকুক, তাদের জীবন পবিত্র হোক কি অপবিত্র, তার চেষ্টা-সাধনার উদ্দেশ্য সৎ হোক কি অসৎ এসব প্রশ্নের ঊর্ধে থেকে পার্থিব জগতে সাফল্যলাভের জন্য অপরিহার্য গুণগুলো কেউ আয়ত্ত করলেই সে নিশ্চিন্তরূপে সাফল্যমণ্ডিত হবে এবং ঐসব গুণের দিক দিয়ে যারা পশ্চাদপদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা প্রথম ব্যক্তির পশ্চাতে পড়ে থাকবে।
ঈমানদার, কাফের, নেককার, বদকার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিপর্যয়কারী প্রভৃতি যে যাই হোক না কেন, তার মধ্যে যদি ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তি, প্রবল বাসনা, উচ্চাশা ও নির্ভীক সাহস, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তা তিতিক্ষা ও কৃচ্ছ্রসাধনা, বীরত্ব ও বীর্যবত্তা, সহনশীলতা ও পরিশ্রম প্রিয়তা, উদ্দেশ্যের আকর্ষণ এবং সে জন্য সবকিছুরই উৎসর্গ করার প্রবণতা, সতর্কতা, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি বোধশক্তি ও বিচার ক্ষমতা, পরিস্থিতি যাচাই করা এবং তদুনুযায়ী নিজেকে ঢেলে গঠন করা ও অনুকূল কর্মনীতি গ্রহণ করার যোগ্যতা নিজের হৃদয়াবেগ, ইচ্ছা বাসনা, স্বপ্ন সাধ ও উত্তেজনার সংযমশক্তি এবং অন্যান্য মানুষকে আকৃষ্ট করা, তাদের হৃদয়মনে প্রভাব বিস্তার করা ও তাদেরকে কাজে নিযুক্ত করার দুর্বার বিচক্ষণতা যদি কারো মধ্যে পুরোপুরিভাবে বর্তমান থাকে, তবে এই দুনিয়ায় তার জয় সুনিশ্চিত।
সেই সঙ্গে এমন গুণও কিছু না কিছু থাকা অপরিহার্য, যা মনুষ্যত্বের মূল যাকে সৌজন্য ও ভদ্রতামূলক স্বভাব-প্রকৃতি বলা যায় এরই দৌলতে এক-একজন লোকের সম্মান-মর্যাদা, মানব সমাজে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। আত্মসম্মান জ্ঞান, বদান্যতা, দয়া-অনুগ্রহ, সহানুভূতি, সুবিচার, নিরপেক্ষতা, ঔদার্য ও হৃদয়মনের প্রসারতা, বিশালতা, দৃষ্টির উদারতা, সত্যবাদিতা ও সত্যপ্রিয়তা, বিশ্বাসপরায়ণতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, ওয়াদাপূর্ণ করা, বুদ্ধিমত্তা, সভ্যতা, ভব্যতা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা এবং মন ও আত্মার সংযম শক্তি প্রভৃতি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কোনো জাতির বা মানব গোষ্ঠীর অধিকাংশ লোকের মধ্যে যদি উল্লেখিত গুণাবলীর সমাবেশ হয়, তবে মানবতার প্রকৃত মূলধনই তার অর্জিত হয়েছে বলে মনে করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সমাজ সংস্থা গঠন করা তার পক্ষে অতীব সহজসাধ্য হবে। কিন্তু এই মূলধন সমাবিষ্ট হয়ে কার্যত একটি সুদৃঢ় ও ক্ষমতাসম্পন্ন সামাজিক রূপলাভ করতে পারে না যতোক্ষণ পর্যন্ত না তার সাথে আরো কিছু নৈতিক গুণ এসে মিলিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সমাজের সমগ্র কিংবা অধিকাংশ মানুষই একটি সামগ্রিক লক্ষ্যকে নিজেদের চরম লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করবে। সেই লক্ষ্যকে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ এমনকি, নিজের ধন-প্রাণ ও সম্পদ-সন্তান হতেও অধিক ভালবাসবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম ভালবাসা ও সহানুভূতির মনোভাব প্রবল হবে, তাদের মধ্যে পরস্পর মিলেমিশে কাজ করার মনোভাব থাকবে। সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনার জন্য যতোখানি আত্মদান অপরিহার্য, তা করতে তারা প্রতিনিয়ত প্রস্তুত থাকবে। ভাল ও মন্দ নেতার মধ্যে পার্থক্য করার মতো বুদ্ধি-বিবেচনা তাদের থাকতে হবে যেন যোগ্যতম ব্যক্তি তাদের নেতা নিযুক্ত হতে পারে। তাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অপরিসীম দূরদৃষ্টি ও গভীর ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং এছাড়া নেতৃত্বের জন্য অপরিহার্য অন্যান্য গুণাবলীও বর্তমান থাকা দরকার। সমাজের সকল লোককে নিজেদের নেতৃবৃন্দের আদেশ পালন ও অনুগমনে অভ্যস্থ হতে হবে। তাদের উপর জনগণের বিপুল আস্থা থাকতে হবে এবং নেতৃবৃন্দের নির্দেশে নিজেদের সমগ্র হৃদয়, মন, দেহের শক্তি এবং যাবতীয় বৈষয়িক উপায়-উপাদান লক্ষ্যস্থলে উপনীত হওয়ার জন্য যে কোনো কাজে জনমত প্রয়োগ করতে প্রস্তুত থাকবে শুধু তাই নয়, গোটা জাতির সামগ্রিক জনমত এতো সজাগ-সচেতন ও তীব্র হতে হবে যে সামগ্রিক কল্যাণের বিপরীত ক্ষতিকারক কোনো জিনিসকেই নিজেদের মধ্যে এক মুহূর্তের তরেও টিকতে দেবে না।
বস্তুত এগুলোই হচ্ছে মৌলিক মানবীয় চরিত্র। এগুলোকে আমি “মৌলিক মানবীয় চরিত্র” বলে এজন্য অভিহিত করেছি যে, মূলত এ নৈতিক গুণগুলোই হচ্ছে মানুষের নৈতিক শক্তি ও প্রতিভার মূল উৎস। মানুষের মধ্যে এই গুণাবলীর তীব্র প্রভাব বিদ্যমান না থাকলে কোনো উদ্দেশ্যের জন্যই কোনো সার্থক সাধনা করা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব হয় না। এই গুণগুলোকে ইস্পাতের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ইস্পাতের মধ্যে দৃঢ়তা, অক্ষয়তা ও তীব্রতা রয়েছে, এরই সাহায্যে একটি হাতিয়ার অধিকতর শাণিত ও কার্যকরী হতে পারে। অতপর তা ন্যায় কাজে ব্যবহৃত হবে কি অন্যায় কাজে সে প্রশ্ন অপ্রাসংগিক। যার সৎ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সে জন্য কাজ করতে চাহে, ইস্পাত নির্মিত অস্ত্রই তার জন্য বিশেষ উপকারী হতে পারে, পচা কাঠ নির্মিত অস্ত্র নয়। কারণ, আঘাত সহ্য করার মতো কোনো ক্ষমতাই তাতে নেই। ঠিক এই কথাটি নবী করীম (সা) হাদিস শরীফে এরশাদ করেছেনঃ
خياركم فى الجاهلية خياركم فى الاسلام
“তোমাদের মধ্যে ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগের উত্তম লোকগণ ইসলামী যুগেও উত্তম ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।”
অর্থাৎ জাহেলি যুগে যাদের মধ্যে যোগ্যতা ও বলিষ্ঠ কর্মক্ষমতা এবং প্রতিভা বর্তমান ছিলো ইসলামের মধ্যে এসে তারাই যোগ্যতম কর্মী প্রতিপন্ন হয়েছিল। তাদের কর্মক্ষমতা উপযুক্ত ক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্ত হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতোটুকু যে, পূর্বে তাদের প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা ভুল পথে ব্যবহার হতো, এখন ইসলাম তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছে। কিন্তু অকর্মণ্য ও হীনবীর্য লোক না জাহিলিয়াতের যুগে কোনো কার্যসম্পাদন করতে পেরেছে না ইসলামের কোনো বৃহত্তম খেদমত আঞ্জাম দিতে সমর্থ হয়েছে। আরব দেশে নবী করীমের (সা) যে বিরাট অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ হয়েছিল এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর সর্বগ্রাসী প্রভাব সিন্ধু নদ হতে শুরু করে আটলান্টিক মহাসাগরের বেলাভুমি পর্যন্ত দুনিয়ার একটি বিরাট অংশের উপর বিস্তারিত হয়েছিল তার মূল কারণ এটাই ছিলো যে, আরব দেশের সর্বাপেক্ষা উত্তম ও প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ তাঁর আদর্শানুগামী হয়েছিল। তাদের মধ্যে উক্ত রূপ চরিত্রের বিরাট শক্তি নিহিত ছিলো। মনে করা যেতে পারে, আরবের অকর্মণ্য, অপদার্থ, বীর্যহীন, ইচ্ছাশক্তি বিবর্জিত, বিশ্বাস-অযোগ্য লোকদের একটি বিরাট ভিড় যদি নবী করীমের (সা) চারপাশে জমায়েত হতো, তবে অনুরূপ ফল কখনোই লাভ করা সম্ভব হতো না। একথা একেবারেই স্বতসিদ্ধ।
ইসলামী নৈতিকতা
নৈতিক চরিত্রের দ্বিতীয় প্রকার যাকে আমি “ইসলামী নৈতিকতা” বলে অভিহিত করেছি এ সম্পর্কেও আলোচনা করতে হবে। মুলত এটা মৌলিক মানবীয় চরিত্র হতে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর কোনো জিনিস নয়, বরং তার বিশুদ্ধকারী ও পরিপূরক মাত্র।
ইসলাম সর্বপ্রথম মানুষের মৌলিক মানবীয় চরিত্রকে সঠিক ও নির্ভুল কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করে দেয়। অতপর এটা সম্পূর্ণরূপে কল্যাণকর ও মঙ্গলময়ে পরিণত হয়। মৌলিক মানবীয় চরিত্র একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় বস্তুনিরপেক্ষ নিছক একটি শক্তি মাত্র। এই অবস্থায় তা ভালও হতে পারে, মন্দও হতে পারে, কল্যাণকরও হতে পারে, অকল্যাণের হাতিয়ারও হতে পারে। যেমন, একখানী তরবারি একটি তীর শাণিত অস্ত্র মাত্র। এটা একটি দস্যুর মুষ্টিবদ্ধ হলে যুলুম পীড়নের একটি মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হবে। আর আল্লাহর পথে জিহাদকারীর হাতে পড়ে এটা হতে পারে সকল কল্যাণ ও মঙ্গলের নিয়ামক। অনুরূপভাবে “মৌলিক মানবীয় চরিত্র” কারো মধ্যে শুধু বর্তমান থাকাই তার কল্যাণকর হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং নৈতিক শক্তি সঠিক পথে নিয়োজিত হওয়ার উপরই তা একান্তভাবে নির্ভর করে। ইসলাম একে সঠিক পথে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে মাত্র। ইসলামের তাওহীদী দাওয়াতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করা। এই দাওয়াত গ্রহণকারী লোকদের পার্থিব জীবনের সমগ্র চেষ্টা-সাধনা ও শ্রম মেহনতকে আল্লাহর সন্তোষলাভের জন্যই নিয়োজিত হতে হবে। واليك نسعى ونحفد “হে আল্লাহ! আমাদের সকল চেষ্টা-সাধনা এবং সকল দুঃখ ও শ্রম স্বীকারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তোমার সন্তোষ লাভে।” ইসলামের দাওয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির চিন্তা ও কর্মের সকল তৎপরতা আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে আবদ্ধ হবে। اياك نعبدولك نصلى ونسجد “হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব করি এবং তোমার জন্য আমরা নামায ও সিজদায় ভুলুণ্ঠিত হই।”
ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবন ও অন্তর্নিহিত শক্তি নিচয়ক এভাবেই নিয়ন্ত্রিত ও সংশোধিত করে। এই মৌলিক সংশোধনের ফলে উপরোল্লিখিত সকল বুনিয়াদী মানবীয় চরিত্রই সঠিক পথে নিযুক্ত ও পরিচালিত হয় এবং তা ব্যক্তিস্বার্থ, বংশ পরিবার কিংবা জাতি ও দেশের শ্রেষ্ঠত্ব বিধানের জন্য অযথা ব্যয়িত না হয়ে একান্তভাবেই সত্যের বিজয় সম্পাদনের জন্যই সংগতরূপে ব্যয় হতে থাকে। এর ফলেই তা একটি নিছক শক্তি মাত্র হতে উন্নীত হয়ে সমগ্র পৃথিবীর জন্য একটি কল্যাণ ও রহমাতের বিরাট উৎসে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়ত, ইসলাম মৌলিক মানবীয় চরিত্রকে সুদৃঢ় করে দেয় এবং চরম প্রান্তসীমা পর্যন্ত এর ক্ষেত্র ও পরিধি সম্প্রসারিত করে। উদাহরণ স্বরূপ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার উল্লেখ করা যেতে পারে। সর্বাপেক্ষা অধিক ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তির মধ্যেও যে ধৈর্য ক্ষমতা দেখতে পাওয়া যায়, তা যদি নিছক বৈষয়িক স্বার্থের জন্য হয় এবং শিরক ও বস্তুবাদী চিন্তার মূল হতে ‘রস’ গ্রহণ করে, তবে তার একটি সীমা আছে, যে পর্যন্ত পৌছিয়ে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। অতপর উহা কেঁপে উঠে, নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ধৈর্য ও তিতিক্ষা তাওহীদের উৎসমূল হতে ‘রস’ গ্রহণ করে এবং যা পার্থিব স্বার্থলাভের জন্য নয় একান্তভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত তা ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও তিতিক্ষার এক অতল স্পর্শ মহাসাগরে পরিণত হবে। দুনিয়ার সমগ্র দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত মিলিত হয়েও তাকে শূন্য ও শুষ্ক করতে সমর্থ হয় না।
এজন্যই ‘অমুসলিম’দের ধৈর্য খুবই সংকীর্ণ ও নগণ্য হয়ে থাকে। যুদ্ধের মাঠে তারা হয়ত গোলাগুলির প্রবল আক্রমণের সামনে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছে। কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করার সুযোগ আসা মাত্রই কামাতুর বৃত্তির সামান্য উত্তেজনার আঘাতে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতাকে জীবনের বিশাল ক্ষেত্রে বিস্তারিত করে দেয় এবং সামান্য ও নির্দিষ্ট কয়েকটি দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত প্রতিরোধের ব্যাপারেই নয়, সকল প্রকার লোভ-লালসা, ভয়, আতঙ্ক ও আশংকা এবং প্রত্যেকটি পাশবিক বৃত্তির মোকাবিলায় স্থিতিলাভের জন্য এটা একটি বিরাট শক্তির কাজ করে। বস্তুত ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবনকে একটি অচল-অটল ধৈর্যপূর্ণ পর্বত প্রায় সহিষ্ণু জীবনে পরিণত করে। জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সঠিক পন্থা অবলম্বন করাই হয় এহেন ইসলামী জীবনের মূলনীতি তাতে সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা, বিপদ-মুসিবত, ক্ষতি-লোকসান বরদাশত করতে হলেও এই জীবনে এর কোনো ‘সুফল’ পাওয়া না গেলেও জীবনের গতি ধারায় একবিন্দু পরিমাণ বক্রতা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে এই জীবন কোনরূপ স্খলন বরদাশত করতে পারে না। অভাবিত পূর্ব সুযোগ-সুবিধা লাভ, উন্নতি এবং আশা-ভরসার শ্যামল-সবুজ বাগিচা দেখতে পেলেও নয়। পরকালের নিশ্চিত সুফলের সন্দেহাতীত আশায় দুনিয়ার সমগ্র জীবনে অন্যায় ও পাপ হতে বিরত থাকা এবং পুণ্য,মঙ্গল ও কল্যাণের পথে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হওয়ারই নাম হচ্ছে ইসলামী সহিষ্ণুতা ইসলামী সবর। পরন্তু, কাফেরদের জীবনের খুব সংকীর্ণতম পরিবেশের মধ্যে ততোধিক সংকীর্ণ ধারণা অনুযায়ী সহিষ্ণুতার যে রূপ দেখতে পাওয়া যায়, মুসলমানদের জীবনে তাও অনিবার্যরূপে পরিলক্ষিত হবে। এই উদাহরণের ভিত্তিতে অন্যান্য সমগ্র মৌলিক মানবীয় চরিত্র সম্পর্কেও ধারণা করা যেতে পারে এবং বিশুদ্ধ ও নির্ভুল চিন্তা ও আদর্শ ভিত্তিক না হওয়ার দরুন কাফেরদের জীবন কত দুর্বল এবং সংকীর্ণ হয়ে থাকে তাও নিঃসন্দেহে অনুধাবন করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলাম সেইসবকে বিশুদ্ধ ও সুষ্ঠু ভিত্তিতে স্থাপিত করে অধিকতর মজবুত এবং বিস্তৃত ও বিশাল অর্থদান করে।
তৃতীয়ত, ইসলাম মৌলিক মানবীয় চরিত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের উপর মহান উন্নত নৈতিকতার একটি অতি জাঁকজমকপূর্ণ পর্যায় রচনা করে দেয়। এর ফলে মানুষ সৌজন্য ও মাহাত্ম্যের এক চূড়ান্ত ও উচ্চ পর্যায়ে আরোহন করে থাকে। ইসলাম মানুষের হৃদয়মনকে স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, অত্যাচার, নির্লজ্জতা ও অসংলগ্নতা, উশৃঙ্খলতা হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করে দেয় এবং তাতে আল্লাহর ভয়, তাকওয়া, আত্মশুদ্ধি, সত্যবাদিতা ও সত্যপ্রিয়তা জাগিয়ে তোলে। তার মধ্যে নৈতিক দায়িত্ববোধ অত্যন্ত তীব্র ও সচেতন করে তোলে। আত্মসংযমে তাকে সর্বতোভাবে অভ্যস্ত নিখিল সৃষ্টি জগতের প্রতি তাকে দয়াবান, সৌজন্যশীল, অনুগ্রহ সম্পন্ন, সহানুভূতিপূর্ণ, বিশ্বাসভাজন, স্বার্থহীন, সদিচ্ছাপূর্ণ, নিষ্কলুষ নির্মল ও নিরপেক্ষ, সুবিচারক এবং সর্বক্ষণের জন্য সত্যবাদী ও সত্যপ্রিয় করে দেয়। তার মধ্যে এমন এক উচ্চ পবিত্র প্রকৃতি লালিত-পালিত হতে থাকে, যার নিকট সবসময় মঙ্গলেরই আশা করা যেতে পারে অন্যায় এবং পাপের কোনো আশংকা তার দিক হতে থাকতে পারে না। উপরন্তু, ইসলাম মানুষকে কেবল ব্যক্তিগতভাবে সৎ বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় না। তা যথেষ্টও মনে করে না। রসূলের বাণী অনুযায়ী তাকেঃ مفتاح للخير ومفلاق لشر কল্যাণের দ্বার উৎঘাটন এবং অকল্যাণের পথ রোধকারীও বানিয়ে দেয়। অন্য কথায় গঠনমূলক দৃষ্টিতে ইসলাম তার উপর ন্যায়ের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ ও মূলোৎপাটনের বিরাট কর্তব্য পালনের দায়িত্ব অর্পন করে। এরূপ স্বভাব-প্রকৃতি লাভ করতে পারলে এবং কার্যত ইসলামের বিরাট মহান মিশনের জন্য সাধনা করলে এর সর্বাত্মক বিজয়াভিযানের মোকাবিলা করা কোনো পার্থিব শক্তিরই সাধ্যায়ত্ত হবে না।
নেতৃত্ব সম্পর্কে আল্লাহর নীতির সারকথা
দুনিয়ার নেতৃত্ব কর্তৃত্ব দানের ব্যাপারে সৃষ্টির প্রথম প্রভাত হতেই আল্লাহ তায়ালার একটি স্থায়ী নিয়ম ও রীতি চলে এসেছে এবং মানব জাতি বর্তমান প্রকৃতির উপর যতোদিন জীবিত থাকবে ততোদিন তা একই ধারায় জারী থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। এখানে প্রসংগত সেই নিয়মের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।
পৃথিবীর বুকে ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় চরিত্রে ভূষিত এবং জাগতিক কার্যকারণ ও জড় উপায়-উপাদান প্রয়োগকারী কোনো সুসংগঠিত দল যখন বর্তমান থাকে, তখন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কতৃত্বের চাবিকাঠি এমন একটি দলের হাতে ন্যস্ত করেন যে দল অন্তত মৌলিক মানবীয় চরিত্রে ভূষিত এবং জাগতিক উপায়-উপাদানসমূহ ব্যবহার করার দিক দিয়ে অন্যান্যের তুলনায় অধিকতর অগ্রসর। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই পৃথিবীর শৃংখলাবিধান করতে দৃঢ় সংকল্প। এই শৃংখলাবিধানের দায়িত্ব ঠিক সেই মানব গোষ্টীকেই দান করেন, যারা সমসাময়িক দলসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম প্রমাণিত হবে। বস্তুত দুনিয়ার নেতৃত্বদান সম্পর্কে এটাই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার স্থায়ী নীতি।
কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোনো সুসংগঠিত দল যদি বাস্তবিকই বর্তমান থাকে, যা ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় চরিত্র উভয় দিক দিয়েই অবশিষ্ট সকল মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও বিশিষ্ট প্রমাণিত হবে এবং জাগতিক উপায়-উপাদান ও জড় শক্তি প্রয়োগেও কিছুমাত্র পশ্চাৎপদ হবে না, তবে তখন পৃথিবীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি অন্য কোনো দলের হাতে অর্পিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। শুধু অসম্ভবই নয় তা অস্বাভাবিকও বটে, তা মানুষের জন্য নির্ধারিত আল্লাহর স্থায়ী নিয়ম-নীতিরও সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহ তায়ালা সত্যপন্থী ও নিষ্ঠাবান ঈমানদার লোকদের জন্য তাঁর কিতাবে যে প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করেছেন, এটা তারও খেলাফ হয়ে পড়ে। দুনিয়ার বুকে সৎ, সত্যাশ্রয়ী ও ন্যায়পন্থী, আল্লাহর মর্জী অনুযায়ী বিশ্বপরিচালনায় যোগ্যতাসম্পন্ন একটি একনিষ্ঠ মানব দল বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তিনি দুনিয়ার কর্তৃত্ব তার হাতে অর্পণ না করে কাফের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও আল্লাহদ্রোহী লোকদের হাতে ন্যস্ত করবেন একথা কিরূপে ধারণা করা যেতে পারে?
কিন্তু বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, এরূপ অনিবার্য পরিণাম ঠিক তখনি লাভ করা যেতে পারে যখন উল্লেখিত গুণাবলী সমন্বিত একটি দল বাস্তবিকই দুনিয়াতে বর্তমান থাকবে। এক ব্যক্তির সৎ হওয়া এবং বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য সৎ ব্যক্তির বর্তমান থাকায় দুনিয়ার নেতৃত্বলাভের আল্লাহর নীতিতে বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম সৃষ্টি হতে পারে না সেই ব্যক্তিগণ যতোবড় অলী আল্লাহ পয়গম্বরই হোক না কেন। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার নেতৃত্বদানের যে ওয়াদা করেছেন, তা বিক্ষিপ্ত ও অসংঘবদ্ধ কয়েকজন ব্যক্তি সম্পর্কে নয়; এমন একটি দলকে এটা দান করার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন যা কার্যত ও বাস্তব ক্ষেত্রে নিজেকে خيرامة “সর্বোত্তম জাতি” ও امة وسطا “মধ্যম পন্থানুসারী জাতি” বলে প্রমাণ করতে পারবে।
একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, উক্তরূপ গুণে ভূষিত একটি দলের শুধু বর্তমান থাকাই নেতৃত্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটার জন্য যথেষ্ট নয়, তা এমন নয় যে, এদিকে এরূপ একটি দল অস্তিত্ব লাভ করবে, আর ওদিকে সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ হতে কিছু সংখ্যক ফেরেশতা অবতরণ করে ফাসেক-কাফেরদেরকে নেতৃত্ব কর্তৃত্বের গদি হতে বিচ্যুত করে দিবে এবং এই দলকে তদস্থলে আসীন করবে। এরূপ অস্বাভাবিক নিয়মে মানব সমাজে কখনই কোনো পরিবর্তন সূচিত হতে পারে না। নেতৃত্বের ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি করতে হলে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে ও বিভাগে, প্রত্যেক কদমে পদক্ষেপে কাফের ও ফাসেকী শক্তির সাথে দ্বন্দ্ব ও প্রত্যক্ষ মোকাবিলা করতে হবে এবং সত্য প্রতিষ্ঠার বন্ধুর পথে সকল প্রকার কুরবানী দিয়ে নিজের সত্যপ্রীতির ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং নিজের অপ্রতিভ যোগ্যতাও প্রমাণ করতে হবে। বস্তুত এটা এমন একটি অনিবার্য শর্ত যা নবীদের উপরও প্রযোজ্য হয়েছে। অন্য কারো এই শর্ত পূরণ না করে সমাজ নেতৃত্বে কোনরূপ পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারার তো কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।