সত্যের সাক্ষ্য
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
বইটির অডিও শুনুন
সত্যের সাক্ষ্য
[এটি মাওলানা মওদূদীর (রঃ) একটি ভাষণ। ১৯৪৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর লাহোর জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলনে তিনি এ ভাষণ দেন। শিয়ালকোট সংলগ্ন মুরাদপুরে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।]
সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার, যিনি নিখিল বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, মালিক এবং শাসক। যিনি অসীম জ্ঞান, অনুগ্রহ ও ক্ষমতা বলে এই বিশ্বজাহান পরিচলনা করছেন। যিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাকে দান করেছেন জ্ঞান ও বিবেক- বুদ্ধির ন্যায় অমূল্য শক্তি আর সমাসীন করেছেন দুনিয়ায় তাঁর খিলাফাতের মর্যাদায়। যিনি মানুষের পথ প্রদর্শনের নিমিত্ত যুগে যুগে নবীদের মারফতে নাযিল করেছেন কিতাবসমূহ।
আল্লাহর করুণারাশি বর্ষিত হোক তাঁর সে সব সম্মানিত ও নেক বান্দাদের উপর যাঁরা দুনিয়ায় এসেছিলেন মানুষকে প্রকৃত মানুষ্যত্ব শেখাতে, যারা মানুষকে তার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করে গেছেন, আর বাতলে দিয়েছেন তার জীবন যাপনের সঠিক পদ্ধতি। আজ দুনিয়ায় যা কিছু হিদায়াতের আলো, নৈতিক পবিত্রতা, পুণ্য ও পরহিযগারীর নিদর্শন দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে আল্লাহর এ নেক বান্দাদেরই পথ-নির্দেশের ফল। দুনিয়ার মানুষ কখনো তাঁদের এ অনুগ্রহের কথা ভুলতে পারবে না।
প্রিয় বন্ধুগণ, আমরা আমাদের সম্মেলনগুলোকে দু’টো অংশে ভাগ করে থাকি। একাংশে আমরা পরস্পর বসে আপন কাজ কর্ম যাচাই-পর্যালোচনা করি এবং তাকে আরো সামনে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ করে থাকি। আর দ্বিতীয়াংশে আমরা সম্মেলন স্থানের সাধারণ অধিবাসীদের কাছে দাওয়াত পেশ করে থাকি। আজকের এ সম্মেলন শেষোক্ত উদ্দেশ্যেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা কোন বস্তুর দিকে লোকদের আহবান জানিয়ে থাকি অথবা আমাদের দাওয়াত কি, এ কথাটুকু বলার জন্যেই আমরা আপনাদেরকে এখন কষ্ট দিচ্ছি।
আমাদের দাওয়াত
আমাদের দাওয়াত হচ্ছে যারা প্রথমত: বংশগত মুসলমান এবং দ্বিতীয়ত: মুসলমান নয় এমন সব মানবগোষ্ঠীর প্রতি। এদের প্রত্যেকের জন্যই আমাদের কাছে বিশেষ পয়গাম রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এখানে শেষোক্ত দলের লোকদেরকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের অতীতের ভুল ও বর্তমান অবস্থার ফলেই মানব জাতির এক বিরাট অংশ আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে। এমতাবস্থায় তাদের ও আমাদের মহান প্রভু আমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য নবীদের মারফত যে পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, তাকে তাদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ আমরা খুব কমই পেয়ে থাকি। যা হোক, তারা এখানে উপস্থিত নেই বলে মুসলমানদের জন্যে দাওয়াতের নির্দিষ্ট অংশকেই আমি এখানে পেশ করবো। মুসলমানদের প্রতি আমাদের আহবান হচ্ছে এই যে, মুসলমান হিসেবে তাঁদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যস্ত হয়, তা তারা পুরোপুরি অনুধাবন ও পালন করুন।
আমরা মুসলিম, আমরা আল্লাহ ও তার দীনকে মেনে নিয়েছি, কেবল এটুকু কথা বলেই আপনারা দায়িত্বমুক্ত হতে পরেন না। বরং আপনাদের এ চেতনাও থাকতে হবে যে, যে মুহূর্তে আপনারা আল্লাহকে আপন প্রভু এবং তাঁর দীনকে নিজেদের জীবন বিধান বলে মেনে নিয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে আপনাদের উপর এক বিরাট দায়িত্বও এসে পড়েছে। পরন্তু সে দায়িত্ব পালনের পন্থা কি, সে সম্পর্কে আমাদেরকে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। কারণ, এতে আপনারা ব্যর্থকাম হলে আপনাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এর মন্দ পরিণতি থেকে আপনারা কোথাও রেহাই পাবেন না।
মুসলমানের দায়িত্ব
সে দায়িত্বটা কি? তা শুধু আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতা, তার কিতাব, তার রাসূল ও পরকালের প্রতি আপনাদের ঈমান আনা নয় অথবা তা শুধু আপনাদের নামায পড়া, রোযা রাখা, যাকাত দেয়া এবং হজ্জ করার ব্যাপারেও নয়, কিংবা তা বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে কিছুটা ইসলামী বিধান মেনে নেয়াও নয়, বরং এ সবের উর্ধ্বে এক বিরাট দায়িত্ব আপনাদের উপর ন্যস্ত হয়ে থাকে। তা হচ্ছে এই যে, যে মহান সত্যের উপর আপনারা ঈমান এনেছেন, তার সাক্ষীরূপে সারা দুনিয়ার সামনে আপনাদেরকে দাঁড়াতে হবে।
কুরআন মজীদে ‘মুসলমান’ নামে আপনাদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতির মর্যাদা দেয়া হয়েছে।এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, আপনারা সমস্ত মানুষের সামনে পুরোপুরি সত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবেন।
وكذلك جعلناكم امة وسطا لتكونوا شهداء على الناس ويكون الرسول عليكم شهيدًا .
“আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থী জাতি বানিয়েছি যাতে করে তোমরা লোকদের জন্যে সাক্ষী হও আর রাসূলও যেন তোমাদের জন্যে সাক্ষী হন।” (সূরাআল বাকারাহ-১৪৩)
জাতি হিসেবে এ হচ্ছে আপনাদের আবির্ভাবের একমাত্র উদ্দেশ্য।।এ উদ্দেশ্য পর্ণ করতে না পারলে আপনাদের জীবন বৃথাই শেষ হয়েছে বলতে হবে। এ দায়িত্ব বস্তুত আল্লাহর পক্ষ থেকেই আপনাদের উপর অর্পিত হয়েছে।
আল্লাহর হুকুম হচ্ছে-
يايها الذين امنوا كونوا قومين بالقسط شهداءلله
হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর জন্যে সত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও।” (সুরা আন নিসা-১৩৫)
এ নিছক নীতিকথা নয়, বরং এ হচ্ছে কড়া নির্দেশ। আল্লাহ বলেন-
ومن اظلم ممن كتم شهادة عنده من الله .
“যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে, সে যদি তা গোপন রাখে, তবে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? (সুরা বাকারা-১৪০)
অতঃপর এ দায়িত্ব পালন না করার ভীষণ পরিণতির কথাও আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আপনাদের পূর্বে ইহুদী জাতিকে এ সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু তারা সত্যের কিছুটা গোপন আর কিছুটা তার বিপরীত সাক্ষ্যদান করেছিল। এমনিভাবে তারা সামগ্রিকভাবে সত্যের পরিবর্তে বাতিলের সাক্ষীতে পরিণত হয়ে গেল।
ফলে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এক প্রচন্ড আঘাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন এবং তাদের অবস্থা এ দাঁড়ালো যে,
وضربت عليهم الذلة والمسكنة وباءو بغضب من الله.
“লাঞ্ছনা- গঞ্জনা, অপমান, অধঃপতন ও দুরবস্থা তাদের উপর চেপে বসলো এবং তারা আল্লাহর গযবে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লো।” (সুরা আল-বাকারা-৬১)
সত্যের সাক্ষ্য
আপনাদের উপর এই যে সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আপনাদের কাছে যে সত্য এসেছে, যে সত্য আপনাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়েছে, তার সত্যতা ও যথার্থতা সম্পর্কে এবং তার সরল-সোজা পথ হওয়া সম্বন্ধে আপনারা দুনিয়ার সামনে সাক্ষ্য দান করবেন। এমনি সাক্ষ্য দিবেন যেন সত্যতা যথার্থরূপেই প্রতিপন্ন হয় এবং দুনিয়ার মানুষের সামনে আল্লাহর দীনের চুড়ান্ত প্রমাণও প্রকাশ হয়ে পড়ে। বস্তুত সত্যের এমনি সাক্ষ্য দানের জন্যেই যুগে যুগে নবীগণের আবির্ভাব হয়েছিল। আর এ দায়িত্ব পালন করা ছিল তাঁদের অপরিহার্য কর্তব্য। নবীদের অবর্তমানে এ দায়িত্ব এসে পড়েছে সম্মিলিতভাবে সমগ্র মুসলিমজাতির উপর।
সাক্ষ্য দানের গুরুত্ব
এ সাক্ষ্যদানের গুরুত্ব আপনারা এথেকে অনুধাবন করতে পারেন যে, এর ভিত্তিতেই আল্লাহ তাআলা মানুষের হিসাব – নিকাশ এবং পুরস্কার বা শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ তাআলা মহাজ্ঞানী, মেহেরবান এবং ইনসাফের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর অগাধ জ্ঞান, অসীম অনুগ্রহ ও ন্যায় বিচারের কাছ থেকে এটা আশা করা যেতে পারে না যে, মানুষ তার ধর্মীয় কথা জানতে পারবে না অথচ তার বিপরীত পথে চলার অপরাধে তিনি তাকে পাকড়াও করবেন। মানুষ সরল- সোজা পথের কথা জানবে না অথচ সে পথে না চলার দরুন তাকে ধরে তিনি শাস্তি দেবেন। বস্তুত কোন বস্তুটি সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে, তা মানুষের অজ্ঞাত থাকবে আর তার কাছ থেকে সে সম্পর্কেই জবাব চাওয়া হবে, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা প্রথম মানুষকেই একজন নবীরূপে সৃষ্টি করেন। অতঃপর মানুষকে তাঁর মরযী ও দুনিয়ার জীবন যাপনের নির্ভুল পদ্ধতি শেখানোর জন্যে যুগে যুগে আরো অসংখ্য নবী পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষকে এ শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, দেখো, এ পথে তোমরা প্রকৃত মালিকের সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবে। আর এগুলো হচ্ছে বর্জনীয় এবং এসব জিনিস সম্পর্কে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে, ইত্যাদি।
চূড়ান্ত প্রচেষ্টা
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীদের দ্বারা এসব সাক্ষ্যই দান করান। পবিত্র কুরআনে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-
رسلا مبشرين ومنذرين لئلا يكون للناس على الله حجة بعد الرسل ط وكان الله عزيزا حكيما .
অর্থাৎ “আল্লাহ তাআলা নবীদেরকে সুসংবাদ প্রদানকারী এবং পরিণতির ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তাঁর কাছে এরূপ বিতর্ক তোলার সুযোগ না পায় যে, আমরা তো বে-খবর ছিলাম। আর আল্লাহ সর্বাবস্থায়ই প্রবল পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন নিসাঃ ১৬৫)
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সতর্ককরণের দায়িত্ব নবীগণের উপর অর্পন করেন এবং তাঁরা এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের কাজে নিয়োজিত হন। আর তারা যথার্থরূপে সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব পালন করলে লোকেরা নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্যে নিজেরাই দায়ী হতে পারে। আর যদি তাদের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দানের দায়িত্ব পালনে ক্রটি হয়, তবে সাধারণ মানুষের গোমরাহীর জন্যে তাদেরকে পাকড়াও করা যেতে পারে। অন্য কথায় বলা যায়, নবীদের উপর অতি বিরাট ও সংকটপূর্ণ দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছিল। আর তা ছিল এই যে, হয় তাঁদেরকে যথার্থরূপে সত্যের সাক্ষ্য দান করে মানুষের কাছে সত্যকে চূড়ান্তরূপে প্রকাশ করতে হতো অথবা তাদেরকে সাধারণ মানুষের এ অভিযোগের সম্মুখীন হতে হতো যে, আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে যে তত্ত্বজ্ঞান দান করেছিলেন আপনারা তা আমাদের কাছে সরবরাহ করেননি। জীবন যাপনের যে সঠিক পদ্ধতি তিনি আপনাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদেরকে তা শিখিয়ে দেননি। এ কারণেই নবীগণ এ দায়িত্বের গুরুত্ব তীব্রভাবে অনুভব করতেন। আর এ কারণেই তাঁরা সত্যের সাক্ষ্য দানের দায়িত্ব পালনে এবং মানুষের কাছে সত্যকে চুড়ান্তরূপে প্রমাণ করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন।
জবাবদিহি
অতঃপর নবীদের মাধ্যমে যারা জ্ঞান ও হিদায়াতের পথ পেয়েছেন, তারাই একটি উম্মত বা জাতিতে পরিণত হয়েছে। নবীদের উপর সত্যের সাক্ষ্যদানের যে দায়েত্ব অর্পিত ছিল, তাঁদের অবর্তমানে তা উম্মতের উপর এসে পড়লো। তারাই এখন নবীদের উত্তরাধিকারীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হলো। এখন যদি তারা সত্যের সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব যথাযথরূপে পালন করা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ সত্যপন্থী না হয়, তবুও তারা পুরস্কৃত হবে এবং সাধারণ মানুষ আল্লাহর দরবারে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। কিন্তু তারা যদি সত্যের সাক্ষ্যদানের কোনরূপ অবহেলা প্রদর্শন করে অথবা সত্যের পরিবর্তে অসত্যের বা বাতিলের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়, তবে লোকদের আগে তারাই ধরা পড়েবে। তারা নিজেদের কার্যাবলী সম্পর্কে তো জিজ্ঞাসিত হবেই তদুপরি সাক্ষ্যদানে তাদের অবহেলার অথবা মিথ্যা সাক্ষ্যদান করার দরুন যারা গোমারাহী, বিপর্যয় ও ভ্রান্তির পথে চলেছে, তাদের কার্যাবলী সম্পর্কেও তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
সাক্ষ্য দানের পদ্ধতি
ভদ্র মহোদয়গণ! সত্যের সাক্ষ্যদানের এ সংকটজনক দায়িত্বই আমর, আপনার ও যারা মুসলিম জাতি বলে পরিচয় দেয় এবং যাদের কাছে আল্লাহর কিতাব ও নবীদের হিদায়াত বর্তমান রয়েছে, তাদের উপরও ন্যস্ত হয়ে আছে। এখন এ সাক্ষ্য দানের পন্থা কি তা ভেবে দেখুন।সাক্ষ্য দু’রকমের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে মৌখিক সাক্ষ্য, আর একটি বাস্তব সাক্ষ্য।
মৌখিক সাক্ষ্যদান
মৌখিক সাক্ষ্য বলতে বুঝায় নবীর মাধ্যমে আমাদের কাছে যে সত্য এসে পৌছেছে বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে তাকে তুলে ধরা। মানুষকে বুঝাবার ও তাদের মর্মে প্রবেশ করানোর সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করে দাওয়াত ও তাবলীগ এবং প্রচার-প্রোপাগান্ডার সম্ভাব্য সকল উপায় উপকরণ ব্যবহার করে ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান উদ্ভাবিত সমস্ত মাল-মসলাকে আয়ত্তে এনে আল্লাহর মনোনীত দীনের সাথে দুনিয়ার মানুষের পরিচয় করিয়ে দেয়া। পরন্তু মানুষের চিন্তায়, বিশ্বাসে, নৈতিকতায়, তাহযীব-তামাদ্দুনে, সামাজিক রীতি- নীতিতে, রুজি-রোজগারে, লেনদেন ও আইন- আদালতে, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এবং মানবীয় বিষয়াদি অন্যান্য সকল দিক ও বিভাগের জন্যে এ পেশকৃত শিক্ষাকে অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে বিবৃত করা, যুক্তি- প্রমাণের দ্বারা তার সত্যতার প্রমাণ করা এবং এর বিপরীত যত মতাদর্শ বর্তমান রয়েছে যুক্তিপূর্ণ সমালোচনার মাধ্যমে তার দোষ -ক্রটি নির্দেশ করা। কিন্তু যে পর্যন্ত না গোটা মুসলিম জাতি মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখানোর জন্য নবীদের ন্যায় চিন্তা ভাবনা করবে, সে পর্যন্ত এ মৌখিক সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় হতে পারে না। কর্তব্য পালন করতে হলে এ কাজটিকে আমাদের সামগ্রিক চেষ্টা, সাধনা ও জাতীয় কর্ম- চাঞ্চল্যের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যে পরিণত করতে হবে এবং সকল কাজেই এ উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। পরন্তু আমাদের মধ্য থেকে সত্যের বিপরীত সাক্ষ্য দানকারী কোন আওয়াজকেই বরদাশত না করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বাস্তব সাক্ষ্যদান
বাস্তব সাক্ষ্যদানের অর্থ হচ্ছে এই যে,আমরা যেসব নিয়ম নীতিকে সত্য বলে প্রচার করি আমাদের বাস্তব জীবনেও সেগুলোকে প্রতিফলিত করতে হবে। দুনিয়ার মানুষ যেন আমাদের কাছ থেকে ঐ নীতিগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে কেবল মৌখিক চর্চাই শুনতে না পায়, বরং তারা যেন স্বচক্ষে আমাদের জীবনে ঐ সবের সৌন্দর্য ও কল্যাণকারিতা প্রত্যক্ষ করতে পারে। ঈমানের কল্যাণে মানুষ নৈতিক চরিত্র ও আচার ব্যবহারের মাধ্যমে তার রসাস্বাদন করতে পারে। এ দীনের পথ –নির্দেশে কেমন আদর্শ মানুষ তৈরি হয়, কিরূপ ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠিত হয়, কেমন সৎ সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়, কত স্বচ্ছ ও পবিত্র তামাদ্দুন গড়ে ওঠে, কিরূপ সঠিক ধারায় জ্ঞান- বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ঘটে, কি রকম সুবিচার ও সহানুভতিপূর্ণ এবং আর্থিক সহযোগিতার সূচনা হয় আর ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ কেমন পরিশুদ্ধ, সুবিন্যস্ত ও কল্যাণের সম্পদে ভরপুর হয়ে ওঠে, তা যেন তারা স্বচক্ষে দেখতে পারে। বস্তত আমরা যদি ব্যক্তিগত ও জাতিগতভাবে নিজেরা দীনের মূর্তিমান সাক্ষ্যে পরিণত হতে পারি, আমাদের ব্যক্তি চরিত্র সত্যতার প্রমাণ পেশ করে, আমাদের ঘর-বাড়ী সৌরভে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ তারাই আলোকে আলোকিত হয়ে ওঠে; আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা তারাই সৌন্দর্য চর্চায় নিয়োজিত হয় এবং আমাদের জাতীয় নীতি ও সম্মিলিত চেষ্টা-সাধনা তার সত্যতার উজ্জ্বল নিদর্শনে পরিণত হয়, তাহলে এ সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব যথার্থরূপে পালিত হতে পারে।
মোদ্দা-কথা, যে-কোন স্থানে, যে-কোন ব্যক্তি বা জাতির সাথেই আমাদের সাক্ষাৎ হোক না কেন, আমরা যে নীতিগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে থাকি এবং যার বদৌলতে মানুষের জীবন বাস্তবিকই সুন্দর ও উন্নত হতে পারে, তারা যেন আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রে সে সব নীতির সত্যতার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
সাক্ষ্যদানের পূর্ণতা
প্রসংগত এ কথাও বলে রাথতে চাই যে, এসব মূলনীতির ভিত্তিতে যখন আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা আল্লাহর দীনকে পুরোপুরি গ্রহণ করে তার বিচার, ইনসাফ, সংস্কারমূলক কার্যসূচি ও সুশৃংখল ব্যবস্থাদি, শান্তি-প্রিয়তা ও জনগণের কল্যাণ সাধন, শাসক শ্রেণীর সচ্চরিত্র, সুষ্ঠু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ইনসাফ ভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতি, ভদ্রতাপূর্ণ যুদ্ধ এবং আনুগত্যমূলক সন্ধির মাধ্যমে এ কথাই সাক্ষ্য দেবে যে, যে দীন বা জীবন ব্যবস্থা এ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে তা সত্যিই মানব কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধানে সক্ষম এবং এরূপ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জাতির সার্বিক কল্যান, কেবল তখনই এ সাক্ষ্যদান পূর্ণাঙ্গ হতে পারে। আর এমনি সাক্ষ্য মৌখিক সাক্ষ্যের সাথে মিলিত হলেই মুসলিম জাতি পুরোপুরি এর দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে, আর তখনই মানব জাতির সামনে সত্য চূড়ান্তরূপে প্রকাশ পেতে পারে আর আখিরাতের আদালতে দাঁড়িয়ে রসূলল্লাহ (স.)-এর পর আমাদের জাতি এ সাক্ষ্য দেয়ার অধিকারী হতে পারবে যে, হযরত (স.) আমাদের কাছে যা কিছু পৌছিয়েছিলেন আমরা তা দুনিয়ার মানুষের কাছে যথার্থরূপেই পৌছিয়ে দিয়েছি। এতদসত্ত্বেও যারা সত্য পথে আসেনি, তারা নিজেরাই তাদের দুর্গতির জন্য দায়ী।
ভদ্র মহোদয়গণ, মুসলিম জাতি হিসেবে আমাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে এমনি সাক্ষ্যদান করাই ছিল কর্তব্য। কিন্তু আজ ভেবে দেখুন, বাস্তবে আমরা কেমন সাক্ষ্য দান করে চলেছি।
মৌখিক সাক্ষ্য বিশ্লেষণ
মৌখিক সাক্ষ্যের কথাই প্রথমে ধরা যাক। আজ ব্যক্তিগত ও সামগ্রিকভাবে বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে ইসলামের জন্য সাক্ষ্যদানের কাজে ব্যাপৃত রয়েছে এমন খুব কম লোকই আমাদের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। তাদের মধ্যেও আবার যথার্থরূপে এ কাজ করে যাচ্ছেন এমন লোকও খুব নগণ্য। যা হোক, এ নগণ্য সংখ্যক যদি বাদ দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, মুসলিম জাতির সাধারণ সাক্ষ্য ইসলামের অনুকূলে নয়, বরং তারা প্রতিকূলেই চলে যাচ্ছে। আমাদের ভূ- স্বামীগন ইসলামের উত্তরাধিকার আইনের পরিবর্তে জাহেলী রীতিকে যথার্থ বলে সাক্ষ্য দান করেছেন। আমাদের উকিল, মোক্তার ও জজ-ম্যাজিস্ট্রেটগণ ইসলামের যাবতীয় আইন-কানুনকে শুধু ভুল নয়, বরং ইসলামের মৌলিক আইন শাসনকে গ্রহণের অযোগ্য এবং মানব রচিত আইনকে নির্ভুল বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। আমাদের শিক্ষক, অধ্যাপক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্র, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, অথর্নীতি ও রাজনীতি এবং আইন শাস্ত্র ও নৈতিক বিধি-বিধান সম্পর্কে ধর্মবিমুখ পাশ্চাত্য মতবাদকে সত্য এবং ইসলামী মতবাদকে ভ্রুক্ষেপ করার ও অনুপযোগী বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
অনুরূপভাবে আমাদের সাহিত্যিকগণ সাক্ষ্য দান করছেন যে, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স ও রাশিয়ার ধর্মবিমুখ নাস্তিক সাহিত্যিকদের যা আদর্শ তাদের আদর্শের তাই এবং মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে তাদের সাহিত্যের কোন স্বতন্ত্র মর্মবাণী নেই।
আমাদের পত্র-পত্রিকা ও প্রচার যন্ত্রগুলো এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, অমুসলিমদের কাছে যে সব নীতি এবং প্রচার- পোপাগান্ডার পদ্ধতি রয়েছে তাদেরও নীতি এবং প্রচার পদ্ধতি ঠিক তাই। এখানকার ব্যবসায়ী ও মালিকগন সাক্ষ্য দান করছে যে, লেন-দেন সম্পর্কীয় ইসলামী পদ্ধতি অনুসরণের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শুধু অমুসলিমদের অনুসৃত পন্থায়ই কাজ-কারবার চলতে পারে। আমাদের নেতৃবৃন্দ সাক্ষ্যদান করে চলেছেন যে, অমুসলিমদের কাছে জাতীয়তা ও স্বদেশিকতার যে যিকির, জাতীয় দাবী-দাওয়া, জাতীয় সমস্যাবলী সমাধান করার যে পন্থা এবং রাজনীতি ও শাসনতন্ত্রের যে মূলনীতি বিদ্যামান রয়েছে। তাদের কাছেও ঠিক তাই রয়েছে।এসব ব্যাপারে যেন ইসলাম তাদেরকে কোন পথের সন্ধান দেয়নি। আমাদের জনগণ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তাদের মুখে দুনিয়াবী কাজ-কারবারের চর্চাব্যতীত অন্যকোন আলোচ্য বিষয় নেই। তারা এমন কোন ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয় যার আলোচ্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারে। আজ শুধু ভারতের (উপমহাদেশে) নয়, বরং সমষ্টিগতভাবে সারা দুনিয়ার মুসলমান যে মৌখিক সাক্ষ্য দান করছে, এ হচ্ছে তার নমুনা।
বাস্তব সাক্ষ্য বিশ্লেষণ
এবার বাস্তব সাক্ষ্যের কিছু নমুনা দেখুন। মৌখিক সাক্ষ্যের তুলনায় এ অবস্থা আরো শোচনীয়। অবশ্য কোন কোন স্থানে এমন কিছু সৎ ব্যক্তিও রয়েছেন, যারা নিজেদের জীবনে ইসলামকে প্রতিফলিত করে চলেছেন। কিন্তু বেশীর ভাগ লোকের অবস্থা কি? ব্যক্তিগত জীবনে মুসলিম জনসাধারণ ইসলামের যে প্রতিনিধিত্ব করছে, তা হচ্ছে এই যে, ইসলামী পরিবেশে লালিত পালিত ব্যক্তিগণ কোন দিক দিয়েই কুফরী পরিবেশে লালিত পালিত লোকদের তুলনায় উন্নত অথবা স্বতন্ত্র নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা ওদের চেয়েও নিকৃষ্ট। তারা মিথ্যা বলতে পারে, খিয়ানত করতে পারে, অত্যাচার চালাতে পারে , ধোঁকা দিতে পারে, ও ওয়াদা খেলাপ করতে পারে, চুরি-ডাকাতি করতে পারে, দাংগা-ফাসাদ করতে পারে, তারা নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার যাবতীয় কাজই করতে পারে। নৈতিকতা বিরোধী এসব আচরনে তারা গড়পড়তা হিসেবে কোন কাফির জাতির তুলনায় কম নয়। পরন্তু আমাদের সামাজিক রীতি-নীতি, চাল চলন, উঠা বসা, রসম- রেওয়াজ, উৎসব-আনন্দ, মেলা-উরস, সভা, শোভাযত্রা, মোদ্দা কথা সমাজ জীবনে কোন একটি দিক ও বিভাগেও আমরা ইসলামের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করছি না। আমাদের এসব আচারণ এ কথারই বাস্তব সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ইসলামপন্থীগণ নিজেদের জন্যে ইসলামের পরিবর্তে জাহিলিয়াতকেই বেশী অনুকরণযোগ্য মনে করছে।
আমরা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তাতে শিক্ষা, শিক্ষা-পদ্ধতি ও শিক্ষার দর্শন সব কিছুই অমুসলিমদের কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকি। কোন সম্মতি কায়েম করলে তার উদ্দেশ্য, গঠন-পদ্ধতি কর্মনীতি সব কিছুই অমুসলিমদের সমিতি থেকে নিয়ে থাকি। আমাদের জাতি কোন সামগ্রিক চেষ্টা সাধনায় আত্মনিয়োগ করলে তার দাবী-দাওয়া, তার তদবীরের পন্থা, দলের গঠনতন্ত্র, নিয়ম-পদ্ধতি, তার প্রস্তাববলী, বক্তৃতা-বিবৃতি সব কিছুই অবিকল অমুসলিম জাতির অনুরূপ হয়ে থাকে। এমন কি যেখানে আমাদের স্বাধীন অথবা আধা-স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সরকার বর্তমান রয়েছে, সেখানেও আমরা রাষ্ট্রের ভিত্তি, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং যাবতীয় আইন-কানুন অমুসলিমদের কাছ থেকেই ধার করে নিয়েছি। কোন কোন মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী আইন শুধু পার্সনাল ল’ হিসাবেই রয়ে গেছে। আর কোন কোন রাষ্ট্রে তো তাকেও পরিবর্তন না করে ছাড়েনি অধুনা লরেন্স ব্রাউন (lawrence brown) নামক জনৈক ইংরেজ লেখক “দি প্রসপেক্টস অব ইসলাম” (The Prospects of Islam) নামক গ্রন্থে বিদ্রুপ করে বলেছেন :
“ আমরা যখন ভারতে ইসলামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনকে সেকেলে ও অকেজো মনে করে রহিত করে দিয়ে কেবল মুসলমানদের পার্সোনাল ল’ হিসেবে রেখে দিয়ে ছিলাম, তখন মুসলমানদের কাছে তা বড় অপছন্দনীয় বলে মনে হচ্ছিল। কারণ এর ফলে তাদের অবস্থা এককালীন ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম যিম্মীদের অনুরূপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আমাদের নীতি শুধু ভারতীয় মুসলমানদেরই মনঃপূত হয়নি, বরং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও আজ আমাদের অনুসৃত নীতিরই অনুসরণ করছে। তুরস্ক ও আলবেনিয়া তো বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার আইন পর্যন্ত আমাদের মানদন্ড অনুযায়ী সংশোধন করে নিয়েছে। এথেকে এ কথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, ‘আইনের উৎস হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা মাত্র’-মুসলমানদের এ ধারণাটি নিছক একটি পবিত্র কাহিনী (pious fiction) ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”
আজ সারা দুনিয়ার মুসলমান সম্মিলিতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে যে বাস্তব স্বাক্ষ্য দান করে চলেছে, এ তো হচ্ছে তার নমুনা। আমরা মুখে যাই বলি না কেন, আমাদের সামগ্রিক কার্যকলাপ এ কথার সাক্ষ্য বহন করছে যে, এ দীন ইসলামে কোন নিয়ম-নীতিই আমাদের মনঃপূত নয় এবং এর প্রবর্তিত কানুনের মধ্যেও আমদের কোন কল্যাণ ও মুক্তি নেই।
সত্য গোপনের শাস্তি
এমনি সত্য গোপন ও মিথ্যা সাক্ষ্য দানের মধ্যেই আজ আমরা লিপ্ত হয়ে আছি। আর আল্লাহ তায়ালা এমনি গুরুতর অপরাধের জন্য যে ভীষণ পরিণাম নির্ধারিত করে রেখেছেন, আমাদেরকে ঠিক সেই পরিণতিরই সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
যখন কোন জাতি আল্লাহর কোন নিয়ামতের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শণ করে আপন সৃষ্টিকর্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন আল্লাহ তাকে ইহকাল ও পরকালে সর্বত্রই শাস্তি দিয়ে থাকেন। ইহুদী জাতির বেলায় আল্লাহ তায়ালার এই শাশ্বত বিধান পুরোপুরি কার্যকরী হয়েছে। আর আজ আমরা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। ইহুদীদের সংগে আল্লাহ তায়ালার কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল না, যে তিনি শুধু তাদেরকেই অপরাধের শাস্তি দান করবেন। আর আমাদের সংগে তাঁর এমন কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই যে, অপরাধে লিপ্ত থেকেও আমরা তার শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবো। বস্তুত আমরা সত্যের সাক্ষ্যদানে যতটুকু ত্রুটি করে আসছি আর বাতিলের সাক্ষ্যদানে যতখানি তৎপরতার পরিচয় দিচ্ছি, ঠিক ততটাই আমরা অধঃপাতের দিকে নেমে যাচ্ছি। গত এক শতাব্দীর মধেই মরক্কো থেকে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (ইন্দোনেশিয়া, মালয়, সিংগাপুর ইত্যাদি) পর্যন্ত একের পর এক দেশ আমাদের হস্তচ্যুত হয়ে গেছে। মুসলিম জাতিগুলো একে একে পরাজিত ও পরাধীন হয়ে পড়েছে। মুসলিম নাম আর গৌরব ও সম্মানের প্রতীকরূপে নয়-অপমান, দারিদ্র ও অবনতির প্রতীক স্বরূপ রয়ে গেল। দুনিয়ায় মান সম্মান বলতে আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। কোথাও আমাদের কে পাইকারী ভাবে হত্যা করা হলো, আর কোথাও আমাদেরকে ঘর বাড়ী থেকে বিতাড়িত করা হলো, আর কোথাও শুধু চাকরি-বাকরি ও খেদমতের কাজে ব্যবহার করার জন্যে জীবিত রাখা হলো। যেখানে মুসলমানদের নিজস্ব সরকার ছিল, সেখানেও তারা ক্রমাগতভাবে পরাজিত হতে লাগলো। আজ তাদের অবস্থা এই যে, বিদেশী শক্তির ভয়ে তারা সদা ভীত ও সন্ত্রস্ত, অথচ তারা যদি ইসলামের মৌখিক এবং বাস্তব সাক্ষ্য দান করতো, তাহলে কুফরের ধারক ও বাহকরাই তাদের ভয়ে কম্পমান থাকতো।
এ কথাটা বুঝতে খুব বেশী দূরে যেতে হবে না। এই উপমহাদেশে নিজেদের অবস্থাটাই একটু পর্যবেক্ষণ করে দেখুন। আপনারা সত্যের সাক্ষ্যদানে যে ত্রুটি করেছেন এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে সত্যের বিপরীত যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারই ফলে একের পর এক রাজ্য আপনাদের হস্তচ্যুত হয়ে গেল। প্রথমে আপনারা মারাঠা ও শিখদের হাতে নাজেহাল হলেন। তারপর ইংরেজদের গোলামী আপনাদের ভাগ্যে জুটলো। আর এখন পূর্বের পরাজয়ের চেয়ে অধিকতর শোচনীয় পরাজয় আপনাদের সামনে আসছে। আজ আপনাদের সামনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সংখ্যালঘিষ্ঠতার প্রশ্নই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আপনারা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের অধীন হয়ে পড়ায় এবং এককালীন নমশূদ্র জাতির মতো পরিণতির সম্মখীন হওয়ার আতংকে সদা কম্পমান রয়েছেন। কিন্তু আপনারা আল্লাহর ওয়াস্তে আমায় বলুন তো, আপনারা যদি ইসলামের যথার্থ সাক্ষী হতেন, তাহলে কি এখানকার কোন সংখ্যাগুরু জাতি আপনাদের ভয়ের কারণ হতে পারতো? আর আজো যদি আপনারা কথা ও কাজের মাধ্যমে ইসলামের যথার্থ সাক্ষ্যদানকারী হন, তাহলে কি কয়েক বছরের মধ্যেই সংক্যালঘিষ্ঠতার প্রশ্নে মীমাংসা হয়ে যায় না? আরবের মাত্র প্রতি লাখে একজন সংখ্যালঘুকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সিদ্ধান্ত করেছিল এক বিদ্বেষ পরায়ণ ও চরম অত্যাচারী সংখ্যাগুরু জাতি। কিন্তু ইসলামের সত্যতার সাক্ষীগণ মাত্র দশ বছরের মধ্যেই সেই সংখ্যালঘুদেরকে শতকরা একশত জনের সংখ্যাগরিষ্ঠাতায় রূপান্তারিত করেছিল। অতঃপর ইসলামের সাক্ষ্য দানকারী এই জাতিটি যখন আরব থেকে বের হলো, তখন মাত্র ২৫ বছরের মধ্যেই তুর্কীস্তান থেকে মরক্কো পর্যন্ত একের পর এক জাতি তঁদের সাক্ষ্যদানের উপর ঈমান আনতে লাগলো। যেসব এলাকায় শতকরা একশতজন অগ্নিপূজক ও খ্রিষ্টান বাস করতো, সেখানে শতকরা একশতজনই মুসলমান বাস করতে লাগলো। কোন প্রকার হঠকারিতা, জাতি-বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতাই সত্যের এই বাস্তব ও জীবন্ত সাক্ষ্যের সামনে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ানোর মতো মযবুত বলে প্রমাণিত হয়নি। কাজেই আজ যদি আপনারা অন্য জাতির পদানত হয়ে গিয়ে থাকেন এবং অধিকতর শোচনীয়রূপে পদানত হওয়ার আশংকায় শংকিত হয়ে পড়েন, তাহলে তা সত্য গোপন ও মিথ্যা সাক্ষ্য দানের অনিবার্য শাস্তি ছাড়া আর কি হতে পারে?
পরকালের শাস্তি
এইতো হচ্ছে এ অপরাধের জন্য দুনিয়ার জীবনে প্রাপ্য শাস্তির নমুনা। আর পরকালে এর চেয়েও কঠিনতর শাস্তির আশংকা রয়েছে। যতক্ষণ আপনারা সত্যের সাক্ষীরূপে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার যত গোমরাহী বিস্তার লাভ করবে, যত যুলুম পীড়ন, ফিতনা-ফাসাদ নাফরমানীমূলক ব্যাপার ঘটবে, যত অনৈতিকতা ও অসচ্চরিত্রতার প্রচলন হবে, নিজ দায়িত্ব থেকে আপনারা কিছুতেই নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবেন না। কারণ ঐ সকল অনাচার সৃষ্টির দায়িত্ব যদি আপনাদের নয়, কিন্তু ঐগুলো সৃষ্টি হওয়ার কারণ জিইয়ে রাখার এবং এগুলোর বিকাশ লাভের সুযোগ দেয়ার জন্য আপনারা অবশ্যই দায়ী।
মুসলমানদের সমস্যা ও তার সমাধান
ভদ্র মহোদয়গন! এ পর্যন্ত আমি যা কিছু আরয করলাম, তা থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন যে, মুসলমান হিসেবে আমাদের কি কর্তব্য ছিল আর কি করছি এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের কি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিক থেকে যদি আপনারা প্রকৃত বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য করেন, তাহলে স্বাভাবতই আপনাদের কাছে এ সত্যটি উদঘাটিত হবে যে, মুসলমানরা আজ ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেসব সমস্যাকে তাদের জাতীয় জীবনের আসল সমস্যা বলে মনে করে নিয়েছে এবং যেগুলোর সমাধানের জন্য কিছুটা পরিকল্পিত আর বেশির ভাগই অন্যের কাছ থেকে ধার করে আনা পন্থায় সর্বশক্তি নিয়োগ করছে, প্রকৃত পক্ষে সেগুলোর কোনটিই সমস্যা নয়। আর সেগুলো সমাধানের জন্যে সময়,শক্তি শ্রম ও অর্থ ব্যয় নিছক পন্ডশ্রম বৈ কিছুই নয়।
একটি সংখ্যালঘু জাতি আর একটি সংখ্যাগুরু জাতির মাঝখান থেকে নিজেদের স্বার্থ, অস্তিত্ব ও অধিকার কি করে রক্ষা করবে, কোন সংখ্যালঘু জাতি নিজ নিজ সীমার ভেতরে সংখ্যাগুরুর ন্যায় অধিকার কেমন করে আদায় করবে, কোন পরাধীন জাতি একটি পরাক্রমশালী জাতির অধীনতা থেকে কেমন করে মুক্ত হবে, একটি দুর্বল জাতি একটি শক্তিশালী জাতির অন্যায় ও যুলুম থেকে কেমন করে আত্মরক্ষা করবে, একটি অনুন্নত জাতি কেমন করে একটি শক্তিশালী জাতির ন্যায় উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শক্তি অর্জন করবে, এ ধরনের সমস্যা অমুসলিমদের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানতম সমস্যা বিবেচিত হতে পারে এবং এগুলোর প্রতিই তাদের যাবতীয় চেষ্টা- সাধনা ও মনোযোগ কেন্দ্রীভুত হতে পারে। কিন্তু আমাদের মুসলমানদের পক্ষে এগুলো কোন স্বতন্ত্র ও স্থায়ী সমস্যাই নয়, বরং এ হচ্ছে আমাদের আসল কাজের প্রতি বিমুখতারই অনিবার্য পরিণতি। আমরা যদি সে কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করতাম, তাহলে আজ আর এত জটিল ও উদ্বেগজনক সমস্যার স্তুপ জমতে পারত না। এখনো যদি আমরা ঐ আবর্জনা পরিস্কার করার পরিবর্তে আমাদের যাবতীয় মনোযোগ ও শক্তি- সমর্থকে সেই আসল কর্তব্য পালনে নিয়োজিত করি, তাহলে অনতিকালের মধ্যেই শুধু আমাদের নয়, সারা দুনিয়ার পক্ষে উদ্বেগজনক সমস্যার আবর্জনা স্বাভাবিকভাবেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ, দুনিয়াকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ রাখার দায়িত্ব আমাদের উপরই ন্যাস্ত ছিল। সে দায়িত্ব পালনে গাফলতির ফলেই আজ দুনিয়াটা সমস্যার আবর্জনায় ভরে গেছে। আর দুনিয়ার সর্বাধিক জঞ্জালময় অবস্থাটা আমাদের ভাগেই পড়েছে।
পরিতাপের বিষয় যে, মুসলমাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়টি বুঝবার জন্যে আদৌ চেষ্টা করছেন না। মুসলিম জনসাধারণকে আজ সর্বত্রই এ কথা বুঝানো হচ্ছে যে, সংখ্যাগুরুর প্রশ্ন, স্বদেশের স্বাধীনতা, জাতীয় স্বার্থরক্ষা, বৈষয়িক উন্নতি ইত্যাদিই হচ্ছে তোমাদের আসল সমস্যা। পরন্তু এই ভদ্রলোকেরা এসব সমস্যার সমাধানের যে পন্থা অমুসলিমদের কাছ থেকে শিখেছেন, তাই মুসলমানদের কাছে পেশ করছেন। কিন্তু আমি আল্লাহর অস্তিত্বের উপর যতটা বিশ্বাসী ঠিক ততখানি দৃঢ়তার সাথেই বলতে পারি যে, এদ্বারা আপনাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। আর এ পথে চলে আপনারা কখনো কল্যাণময় লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না।
আসল সমস্যা
তাই আপনাদের জীবনে প্রকৃত সমস্যা কি, এ কথা অকপটে ও পরিস্কার ভাষায় বিবৃত না করলে আপনাদের চরম অহিতাকাংখী বলেই প্রমাণিত হবে। আমার জানা মতে আপনাদের বর্তমান, ভবিষ্যত একটি বিশেষ প্রশ্নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে আপনাদের কাছে যে হিদায়াত পাঠিয়েছেন, যার কল্যাণে আপনারা মুসলিম নামে অভিহিত হচ্ছেন এবং যার সাথে সম্পর্কে থাকার দরুন ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায় আপনারা দুনিয়ায় ইসলামের প্রতিনিধি সাব্যস্ত হয়েছেন, তার সংগে আপনারা কিরূপ আচরণ করছেন? আপনারা যদি সত্যিকারভাবে ইসলামের আনুগত্য করেন এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে তার সত্যতার সাক্ষ্য দেন আর আপনাদের জাতীয় পরিচয় ইসলামকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করেন, তাহলে আপনাদের দুনিয়ার উন্নতি ও সমৃদ্ধি এবং পরকালে সাফল্য ও কল্যাণের অধিকারী হবেন। আপনাদের উপর ভয়-ভীতি, অপমান-লাঞ্ছনা এবং পরাজয় ও পরাধীনতার যে মেঘ আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। সত্যের প্রতি আপনাদের আহবান ও সচ্চারিত্রিক মাধুর্য লোকদের মস্তিস্ক প্রভাবিত করবে। দুনিয়াজোড়া আপনাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কায়েম হবে আপনাদের কাছ থেকেই ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা করা হবে। আপনাদের আমনতদারী ও বিশ্বস্ততার উপরই লোকেরা ভরসা করবে। আপনাদের মুখনিঃসৃত বাণীই সকল মহলে প্রবল বলে স্বীকৃতি লাভ করবে। আপনারাই হবেন যাবতীয় কল্যাণের উৎস। আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কুফরী নেতৃত্বের কোন প্রভাব-প্রতিপত্তিই আর অবশিষ্ট থাকবে না। আপনাদের সততা ন্যায়পরায়ণতার ফলে তাদের সমুদয় দর্শন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদগুলো মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। তাদের শিবিরে আজ যেসব শক্তির সমাবেশ দেখা যাচ্ছে, তা ছিন্ন হয়ে ইসলামের শিবিরে এসে পড়বে।
এভাবে এমন এক দিন আসবে যখন কম্যুনিজম মস্কোতে থেকেই আত্মরক্ষার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে। পুঁজিবাদপুষ্ট গণতন্ত্র ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক থেকেই আত্মরক্ষার চিন্তায় কম্পমান হবে। লন্ডন ও প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জড়বাদপুষ্ট ও নাস্তিক্যবাদের জায়গা খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। বংশপূজা ও জাতীয়তাবাদ স্বয়ং ব্রাহ্মণ ও জার্মানদের মাঝেও ভক্ত খুঁজে পাবে না। আর বর্তমান যুগটি এমন একটি শিক্ষামূলক কাহিনীরূপে ইতিহাসে স্থান পাবে যে, ইসলামের ন্যায় বিশ্বগ্রাসী শক্তির ধারকগণও কোনকালে এমনি বেকুব বনে গিয়েছিল যে, হযরত মুসা (আ.) এর যষ্টি বগল তলে চেপে রেখেও লাঠি ও রশি দেখে সাপের ভয়ে কাঁপছিল।
বস্তুত ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ও সত্যিকারের সাক্ষ্যদানকারী হলেই আমাদের ভবিষ্যত এমনি উজ্জ্বল হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত আপনারা যদি আল্লাহর প্রেরিত হিদায়াতের উপর জেঁকে বসে থাকেন তা থেকে না আপনারা নিজেরা উপকৃত হন, আর না অন্যকে উপকৃত হতে দেন। আপনারা নিজেদের মুসলান বলে দাবী করে ইসলামের প্রতিনিধি সেজে বসেন আর নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে শিরক, জাহিলিয়াত, দুনিয়াপূজা এবং নৈতিক উচ্ছৃংখতার পথেই বেশীর ভাগ সাক্ষ্য দান করেন। আল্লাহর কিতাব তাকের উপর রেখে পথ নির্র্দেশের জন্য ধাবিত হন কুফরের ধ্বজাধারী ও গোমরাহীর উৎসের দিকে। আল্লাহর বন্দেগীর দাবী করে প্রকৃত শয়তানী ও আল্লাদ্রোহী শক্তিগুলোর দাসত্ব করেন, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা শুধু প্রবৃত্তির লালসার জন্যেই করেন, আর উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামকে দূরে সরিয়া রাখেন আর এভাবে নিজেদের জীবনকেও ইসলামের কল্যাণ থেকে দূরে রাখেন এবং দুনিয়াবাসীকেও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার পরিবর্তে উল্টো আরো দুরে ঠেলে দেন,তবে এমতবস্তায় আপনাদের দুনিয়া ও আখিরাত কোনটাই কল্যাণময় হতে পারে না। বরং আজ আপনারা যা কিছু দেখতে পাচ্ছেন, তা হচ্ছে আল্লাহর চিরাচরিত নিয়মানুসারে এরূপ কর্মনীতির পরিণতি। আর অদূর ভবিষ্যতে এর চেয়েও মন্দ পরিণতির সম্মুখীন হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
ইসলামের লেবেলটা খুলে দিয়ে প্রকাশ্যে কুফরকে গ্রহণ করলে হয় তো পারসীয়ান, আমেরিকান ও বৃটেনের মতো আপনাদের দুনিয়াবী যিন্দেগীটা চাকচিক্যময় হতে পারতো কিন্তু মুসলমান হয়ে অমুসলমানদের মতো জীবন যাপন করা এবং আল্লাহর দীনের ভূয়া প্রতিনিধিত্ব করে দুনিয়ার মানুষের জন্যে হিদায়াতের দ্বার রূদ্ধ করে দেয়ার এই গুরুতর অপরাধ আপনাদের দুনিয়াবী যিন্দেগীকেও সমৃদ্ধিশালী হতে দেবে না। এ অপরাধের যে শাস্তির কথা কুরআনে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং যার জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে আপনাদের সামনে ইহুদী জাতি বর্তমান রয়েছে, তা কিছুতেই নড়চড় হতে পারে না। আপনারা এক জাতিত্বের লঘুতর বিপদকে (اهون البليتين) গ্রহণ করুন কিংবা মুসলিম জাতীয়তার নামে নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার স্বীকৃতি আদায় করে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেন, এ থেকে কোন মতেই আপনারা রেহাই পেতে পারেন না। কারণ এ শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবার একমাত্র পথই হচ্ছে ঐ অপরাধ থেকে বিরত থাকা।