জাহেলী সমাজের কিছু খন্ড চিত্র
জাযিরাতুল আরবের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করার পর এবার সেখানকার সামগ্রিক অর্থনৈতিক এবং চারিত্রিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরা হচ্ছে।
সামগ্রিক অবস্থা
আরবের জনগণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো। প্রতিটি শ্রেণীর অবস্থা ছিল অন্য শ্রেণীর চেয়ে আলাদা। অভিজাত শ্রেণীতে নারী পুরুষের সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট উন্নত। এ শ্রেণীর মহিলাদের স্বাধীনতা ছিল অনেক। এদের কথার মূল্য দেয়া হতো। তাদের এতোটা সম্মান করা হতো এবং নিরাপত্তা দেয়া হতো যে, এরা পথে বেরোলে এদের রক্ষের জন্য তলোয়ার বেরিয়ে পড়তো এবং রক্তপাত হতো। কেউ যখন নিজের দানশীলতা এবং বীরত্ব প্রসঙ্গ নিজের প্রশংসা করতো তখন সাধারণত মহিলাদের সম্বোধন করতো। মহিলা ইচ্ছে করলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ এবং রক্তপাতের আগুন জ্বালিয়ে দিতো। এসব কিছু সত্ত্বেও পুরুষদেরই মনে করা হতো পরিবারের প্রধান এবং তাদের কথা গুরুত্বের সাথে মান্য করা হতো। এ শ্রেণীর মধ্যে নারী পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্ক বিয়ের মাধ্যমে নির্ণীত হতো এবং মহিলাদের অভিভাবকদের মাধ্যমে এ বিয়ে সম্পন্ন হতো। অভিভাবক ছাড়া নিজের বিয়ে করার মতো কোন অধিকার নারীদের ছিল না।
অভিজাত শ্রেণীর অবস্থা এরকম হলেও অন্যদিকে অন্যান্য শ্রেণীর অবস্থা ছিল ভিন্নরূপ। সে সব শ্রেণীর মধ্যে নারী পুরুষের যে সম্পর্ক ছিল সেটাকে পাপাচার, নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং ব্যভিচার ছাড়া কিছু বলা যায় না। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, আইয়ামে জাহিলিয়াতে বিয়ে ছিল চার প্রকার।
প্রথমটা ছিল বর্তমান কালের অনুরূপ। যেমন একজন মানুষ অন্য একজনকে অধীনস্থ মেয়ের বিয়ের জন্য পয়গাম পাঠাতো। সে পয়গাম মঞ্জুর হওয়ার পর মোহরানা আদায়ের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হতো।
দ্বিতীয়টা ছিল এমন, বিবাহিত মহিলা রজস্রাব থেকে পাক সাফ হওয়ার পর তার স্বামী তাকে বলতো, অমুক লোকের কাছে পয়গাম পাঠিয়ে তার নিকট থেকে তার লজ্জাস্থান অধিকার করো। অর্থাৎ তার সাথে ব্যভিচার করো, এসময় স্বামী নিজ স্ত্রীর নিকট থেকে দুরে থাকতো, স্ত্রীর কাছে যেতোনা । যে লোকটাকে দিয়ে ব্যভিচার করানো হচ্ছির তার দ্বারা নিজ স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর কাছে যেতো না। গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর স্বামী ইচ্ছে করলে স্ত্রীর কাছে যেতো। এরূপ করার কারণ ছিল যাতে সন্তান অভিজাত এবং পরিপূর্ণ হতে পারে। এ ধরণের বিয়েকে বলাহয় ‘এসতেবজা’ বিবাহ। ভারতেও এ বিয়ে প্রচলিত আছে।
তৃতীয়ত, দশজন মানুষের চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ কোন এক জায়গায় একজন মহিলার সাথে ব্যভিচার করতো। সেই মহিলা গর্ভবতী হওয়ার পর সেই মহিলা সে সব পুরুষকে কাছে ডেকে আনতো। এ সময় কারো অনুপস্থিত থাকার উপায় ছিল না। সকলে উপস্থিত হলে সেই মহিলা বলতো, তোমার যা করেছো সে তো তোমার জান, এখন আমার গর্ভে থেকে এ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। হে অমুক, এ সন্তান তোমার। সেই মহিলা ইচ্ছেমতো যে কারো নাম নিতে পারতো এবং যান নম নেয়া হতো নবজাত শিশুকে তান সন্তান হিসাবে সবাই মেনে নিতো।
চতুর্থত, বহুলোক একত্রিত হয়ে একজন মহিলার কাছে যেতো। সেই মহিলা কোন ইচ্ছুক পুরুষকেই বিমুখ করতো না বা ফিরিয়ে দিতো না। এরা ছিল পতিতা। এরা নিজেদের ঘরের সামনে একটা পতাকা স্থাপন করে রাখতো। এর ফলে ইচ্ছে মতো যে বিনা বাধায় তাদের কাছে যেতে পারতো। এ ধরনের মহিলা গর্ভবতী হলে এবং সন্তান প্রসব করলে যারা তার সাথে মিলিত হয়েছিল তারা সবাই হাযির হতো এবং একজন বিশেষজ্ঞকে ডাকা হতো। সেই বিশেষজ্ঞ তার অভিমত অনুযায়ী সন্তানটিকে কারো নামে ঘোষণা করতো। পরবর্তী সময়ে সেই শিশু ঘোষিত ব্যক্তির সন্তান হিসাবে বড় হতো এবং কখনো সে ব্যক্তি সন্তানটিকে অস্বীকার করত পারতো না। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর আল্লাহ পাক জাহেলি সমাজের সকল প্রকার বিবাহ প্রথা বাতিল করে দিলেন এবং বর্তমানে প্রচলিত ইসলামী বিবাহ প্রথা প্রচলন করলেন। (সহীহ বুখারী, কেতাবুন নেকাহ, ২খন্ড, পৃ৭৬৯, আবু দাউদ, বাবে ওজনু নেকাহ বিস্তারিত বিবরণের জন্য তাফসীর তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন ১৪ নং খন্ড দেখুন)
আরবে নারী পুরুষের সম্পর্ক অনেক সময় তলোয়ার ধারের মাধ্যমে নির্ণীত হতো। গোত্রীয় যুদ্ধে বিজয়ীরা পরাজিত গোত্রের মহিলাদের বন্দী করে নিয়ে নিজেদের হারেমের অন্তরীন করে রাখতো। এ ধরনের বন্দিনী নারীর গর্ভজাত সন্তানেরা সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। তারা সব সময় আত্মপরিচয় দিতে লজ্জা অনুভব করতো।
জাহেলি যুগে একাধিক স্ত্রী রাখা কোন দোষণীয় ব্যাপার ছিল না। সহোদর দুই বোনকেও অনেকে একইসময়ে স্ত্রী হিসাবে ঘরে রাখতো। পিতার তালাক দেয়া স্ত্রী অথবা পিতার মৃত্যুর পর সন্তান তার সৎ মায়ের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। তালাকের অধিকার ছিল শুধু পুরুষের এখতিয়ার। তালাকের কোন সংখ্যা নিদিষ্ট ছিল না। (আবু দাউদ, তাফসীর গ্রন্থাবলী, আত তালাক মাররাতান, দ্রষ্টব্য)
ব্যভিচার সমাজের সর্বস্তরে প্রচলিত ছিল। কোন শ্রেণীর নারী পুরুষেই ব্যভিচার কদর্যতা পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত ছিল না। অবশ্য কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষ এমন ছিল যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকার কারণে এ নোংরামি থেকে নিজেদের বিরত রাখতো। এছাড়া স্বাধীন মহিলাদের অবস্থা তুলনামুলকভাবে দাসীদের চেয়ে ভালো ছিল। দাসীদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। জাহেলি যুগের অধিকাংশ পুরুষ দাসীদের সাথে মেলামেশায় দোষ এবং লজ্জা মনে করতো না। সুনানে আবু দাউদে উল্লেখ রয়েছে যে, একদা একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসুল, অমুক আমার পুত্র সন্তান। জাহেলি যুগে আমি তার মায়ের সাথে মিলিত হয়েছিলাম। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলামে এ ধরনের দাবীর কোন সুযোগ নেই। এখন তো সন্তান সেই ব্যক্তির মালিকানাধীন, যার স্ত্রী বা স্বামী হিসাবে সেই মহিলা পরিচিতা আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুর শাস্তি। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু আনহু এবং আবদ ইবনে জাময়ার মধ্যে জাময়ার দাসীর পুত্র আব্দুর রহমান ইবনে জাময়ার বিষয়ে যে ঝগড়া হয়েছিল সেটা তো সর্বজনবিদিত (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৯৯৯, ১০৬৫)। জাহেলি যুগে পিতা পুত্রের সম্পর্কও ছিল বিভিন্ন রকমের। কিছু লোক এমন যারা বলতো, আমাদের সন্তান আমাদের সন্তান আমাদের কলিজার মতো যারা মাটিতে চলাফেরা।
অন্যদিকে কিছু লোক এমন ছিল যারা অপমান এবং দারিদ্রের ভয়ে সন্তানকে জীবিত মাটিতে প্রোথিত করতো। শিশু সন্তানদের প্রোথিত করতো। শিশু সন্তানদের শৈশবেই মেরে ফেলতো।
পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে (সূরা আনআম, আয়াত ১০১, সুরা নাহল আয়াত ৫৮-৫৯. সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১, ৮১, সুরা আনফাল)। এ অবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল কিনা তা বলা মুশকিল। কেননা আরবের লোকেরা শত্রুদের মোকাবেলা এবং আত্মরক্ষার জন্য অন্যান্য জাতির চেয়ে বেশিসংখ্যাক জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতো। এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সচেতন ছিল বলা যায়।
সহোদর ভাইয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক, চাচাতো ভাইয়ের সাথে এবং গোত্রের অন্যান্য লোকদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত ছিল। কেননা আরবের লোকেরা গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং গোত্রীয় অহমিকার জোরেই বাঁচতো এবং মরতো। গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। গোত্রীয় সম্পর্কের ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত ছিল।
তারা এ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতো যে, ভাইয়ের সাহায্য করো, সে অত্যাচারী বা অত্যাচারিত যা কিছুই হোক। পরবর্তীকালে ইসলাম অত্যাচারীকে তার অত্যাচার থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রভুত্ব ও সর্দারির চেষ্টায় কোন গোত্রের একজন লোকের সমর্থনে গোত্রের অন্য সব লোক যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়তো। উদাহরণস্বরূপ আওস খাযরাজ আবস-জুবয়ান, বকর-তাগলাব প্রভৃতি গোত্রর ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্কের এতো অবনতি হয়েছিল যে, গোত্রসমুহের সমস্ত শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয়িত হতো। দ্বীনি শিক্ষার কিছুটা প্রভাব এবং সামাজিক রুসম-রেওয়াজের কারণে অনেক সময় যুদ্ধের সময় যুদ্ধের বিভীষিকা ও ভয়াবহতা কম হতো। অনেক সময় সমাজে প্রচলিত কিছু নিয়ম কানুনের অধীনে বিভিন্ন গোত্র মৈত্রী বন্ধনেও আবদ্ধ হতো। এছাড়া নিষিদ্ধ মাসসমুহে পৌত্তলিকদের জীবনে শান্তি স্থাপনে এবং তাদের জীবিকা অর্জনে বিশেষ সহায়ক প্রমাণিত হতো।
মোটকথা সামগ্রিক অবস্থা ছিল চরম অবনতিশীল। মূর্খতা ছিল সর্বব্যাপী। নোংরামী, পাপাচার ছিল চরমে। মানুষ পশুর মতো জীবন যাপন করতা। মহিলাদের বেচাকেনার নিয়ম প্রচলিত ছিল। মহিলাদের সাথে অনেক সময় এমন আচরণ করা হতো যেন তারা মাটি অথবা পাথর। পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল দুর্বল এবং ভঙ্গুর। সরকার বা প্রশাসন নামে যা কিছু ছিল তা প্রজাদের নিকট থেকে অর্থ সম্পদ সংগ্রহ করে কোষাগার পূর্ণ করার কাজে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশের কাজে নিয়োজিত থাকতো।
অর্থনৈতিক অবস্থা
অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার অধীন। আরবদের জীবিকার উৎসের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ব্যবসা বাণিজ্যেই ছিল তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। বাণিজ্যিক আদান প্রদান সম্ভব ছিল না। জাযিরাতুল আরবের অবস্থা এমন ছিল যে, নিষিদ্ধ মাসসমুহে ছাড়া শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ অন্য কোন সময় বিদ্যমান ছিল না। এ কাননেই জানা যায় যে, নিষিদ্ধ মাসসমুহেই আরবের বিখ্যাত বাজার ওকায, যিল মায়ায, মাযনা প্রভৃতি মেলাগুলো বসতো।
শিল্পক্ষেত্রে আরবরা ছিল বিশ্বের অন্য সকল দেশের পেছনে। কাপড় বুনন, চামড়া পাকা করা ইত্যাদি যেসব শিল্পের খবর জানা যায় তার অধিকাংশই হতো প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে। সিরিয়া, হীরা বা ইরাকে। আরবের খেত খামার এবং ফসল উৎপাদনের কাজ চলতো। সমগ্র আরবে মহিলারা সুতা কাটার কাজ করতো। কিন্তু মুশকিল ছিল এই যে, সুতা কাটার উপকরণ থাকতো যুদ্ধের বিভীষিকায় দুর্লভ। দরিদ্রতা ছিল একটি সাধারণ সমস্যা। প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্য এবং পোশাক থেকে মানুষ পায়ই বঞ্চিত থাকতো।
চারিত্রিক অবস্থা
এটা স্বীকৃত সত্য যে আরবের লোকদের মধ্যে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় অভ্যসসমুহ পাওয়া যেতো এবং এমন সব কাজ তারা করতো যা বিবেক বুদ্ধি মোটেই অনুমোদন করত না। তবে তাদের মধ্যে এমন কিছু চারিত্রিক গুণও ছিল যা রীতিমত বিস্ময়কর। নীচে গুণাবলীর কিছু বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।
এক) দয়া ও দানশীলতা। এটা ছিল আরবদের একটা বিশেষ গুণ। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব লক্ষ্য করা যতো। এ গুণের ওপর তারা এতো গর্ব করতো যে, আরবের অর্ধেক মানুষই কবি হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে কেউ নিজের প্রশংসা করতো, কেউ অন্য কারো প্রশংসা করতো। কখনো এমন হতো যে, প্রচন্ড শীতে এবং অভাবের সময়েও হতো কারো বাড়িতে মেহমান এলো। সেই সময় গৃহস্বামীর কাছে একটা মাত্র উটই ছিল সম্বল। গৃহস্বামী আতিথেয়তা করার জন্য সেই পশুই জবাই করে দিতো। দয়া এবং উদারতার কারণেই তারা মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ করে নিতো এবং সে ক্ষতিপূরণ যথারীতি আদা করতো। এমনিভাবে মানুষকে ধ্বংস এবং রক্তপাত থেকে রক্ষা করে অন্যান্য ধনী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে গর্ব করতো।
এ ধরনের দানশীলতার কারণেই দেখা যেতো যে, তারা মদ পান করায় গর্ব অনুভব করতো। মদ পান প্রকৃতপক্ষে কোন ভাল কাজ ছিল না, কিন্তু মদ পানের ফলে তারা উদার হতে পারতো এবং দান-খয়রাত করা তাদের জন্য সহজ হতো। কেননা নেশার ঘোরে অর্থ সম্পদ ব্যয় করা মানুষের জন্য কষ্টকর হয় না। এ কারণে আরবের লোকেরা মদ তৈরির উপকরণ আঙ্গুরের গাছকে করম এবং মদকে বিনতুল করম বলে অভিহিত করতো। জাহেলি যুগের কবিদের কবিতার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারা গর্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল।
আনতারা ইবনে শাদ্দাস আবসী তার রচিত মোয়াল্লাকায় লিখেছেন, দুপুরের প্রখর রোদ কমে যাওয়ার পর আমি একটি কারুকার্য খচিত পীত রঙের পাত্র থেকে মদ পান করলাম। যখন আমি মদ পান করি তখন আমার অর্থ সম্পদ দান করে ফেলি। কিন্তু এ সময়ও আমি নিজর ইজ্জত আব্রু সম্পর্কে সচেতন থাকি। ওতে কোন দাগ রাখতে দেই না। জ্ঞান ফিরে আসার পরও আমি দানশীলতার ক্ষেত্রে কোন কার্পণ্য করি না। আমার চারিত্রিক সৌন্দর্য এবং দয়া সম্পর্কে তোমাদের কি আর বলবো, সেটাতো তোমাদের অজানা নয়।
দয়াশীলতার কারণেই আরবরে লোকেরা ঢালাওভাবে জুয়া খেলতো। তারা মনে করতো যে, এটা দানশীলতার একটা পথ। কেননা জুয়া খেলার পর জুয়াড়িরা যা লাভ করতো অথবা লাভ থেকে খরচের পর যা বেঁচে যেতো সেসব তারা গরীব দুঃখীদের মধ্যে দান করে দিতো। একারণেই পবিত্র কোরআনে মদ এবং জুয়ার উপকারের কথা অস্বীকার করা হয়নি বরং বলা হয়েছে যে, এ দুটোর উপকারের চেয়ে অপকার বেশি। আল্লাহ পাক বলেন, লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বল, উভয়ের মধ্যে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও আছে কিন্তু এদের পাপ উপকারের চাইতে বেশী। (২১৯, ৬)
দুই) অঙ্গীকার পালন। আরবের লোকেরা অঙ্গীকার পালনকে ধমের অংশ বলে মনে করতো। অঙ্গীকার পালন বা কথা র রাখতে গিয়ে তারা জানমালের ক্ষতিকেও তুচ্ছ মনে করতো। এটা বোঝার জন্য হানি ইবনে মাসুদ শায়বানী সামোয়াল ইবনে আদীয়া এবং হাজের ইবনে জারারার ঘটনাগুলোই যথেষ্ট।
তিন) আত্মমর্যাদা সচেতনতা। যুলুম অত্যাচার সহ্য করেও নিজের মর্যাদা বজায় রাখা ছিল জাহিলি যুগের পরিচিতি একটি চারিত্রিক গুণ। এর ফলে বীরত্ব বাহাদুরি প্রকাশ করতো। তাদের ক্রোধ ছিল অসামান্য হঠাৎ করেই তারা ক্ষেপে যেতো। অবমাননার সামান্য লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া গেলেও তারা অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়তো এবং রক্তপাত ঘটাতো। এব্যাপারে তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতো।
চার) জাহেলী যুগের লোকদের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এইযে, কোন কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করলে সে কাজ থেকে তারা কিছুতেই দুরে থাকতো না। কোন বাধাই তারা মানত না। জীবন বিপন্ন হলেও সে কাজ তারা সম্পাদন করতো।
পাঁচ) সহিষ্ঞুতা এবং দুরদর্শীতামুলক প্রজ্ঞা। এটাও আরবের লোকদের একটা মহৎ গুণ। কিন্তু বীরত্ব এবং যুদ্ধের জন্য সব সময় তৈরি থাকার কারণে গুন তাদের মধ্যে ছিল দুর্লভ।
ছয়) বেদুইন সুলভ সরলতা। তারা সভ্যতার উপকরণ থেকে দুরে অবস্থান করতো এবং এক্ষেত্রে তাদের অনীহা ছিল। এই ধরনের সাদাসিধে সহজ সরল জীবন যাপনের কারণে তাদের মধ্যে সত্যবাদিতা এবং আমানতদারী পাওয়া যেতো। প্রতারণা, অঙ্গীকার ভঙ্গ এসবকে তারা ঘৃণা করতো।
আমরা মনে করি যে জাযিরাতুল আরবের সাথে সমগ্র বিশ্বের যে ধরনের ভৌগলিক অবস্থান ছিল সেটা ছাড়া উল্লেখিত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণেই তাদেরকে মানব জাতির নেতৃত্ব এবং নবুয়তের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। এ সব গুণাবলীর কারণে হঠাৎ করে যদিও তারা ভয়ংকর হয়ে উঠতো এবং অঘটন ঘটাতো তবুও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এসব গুণাবলী ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় প্রকৃত মানবিক গুণ। সামান্য সংশোধনের পর এ সব গুণ মানুষের জন্য মহাকল্যাণকর প্রমাণিত হতে পারে। ইসলাম সেই কাজ সম্পাদন করেছে।
সম্ভবত উল্লেখিত চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে অঙ্গীকার পালনের পর আত্মমর্যাদাবোধ এবং প্রতিজ্ঞা পালন ছিল সবচেয়ে মূল্যবান এবং প্রশংসনীয়। এইসব গুণাবলী এবং চারিত্রিক শুক্তি ছাড়া বিশৃঙ্খলা অশান্তি ও অকল্যাণ দুর করে ন্যায়নীতি ও সুবিচারমুলক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
জাহেলী যুগে আরবের লোকদের মধ্যে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক গুণ ছিল কিন্তু এখানে সবগুলো আলোচনা করার প্রয়োজন নেই।
তিনিই সেই মহান সত্বা, যিনি তাদের সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে তাদেরই একজনকে রসুল করে পাঠিয়েছেন। সে তাদের আল্লাহর আয়াতসমুহ পড়ে শোনাবে, তাদের জীবনকে (জাহেলিয়াত থেকে) পবিত্র করবে, সর্বোপরি তাদের (দ্বীনের) কৌশল শিক্ষা দেবে, অথচ এই লোকগুলোই (সে আসার) আগে (পর্যন্ত) এক সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিলো। (সুরা জুমুয়া ২)