৮
বিতির নামায
তিনি বিতির তাহাজ্জুদের সাথে পড়তেন
রসূলুল্লাহ সা. –এর বিতির নামায তাঁর কিয়ামুযল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে শামিল ছিলো। তিনি তাহাজ্জুদের সাথেই বিতির নামায পড়তেন। ফলে তাঁর বিতির নামাযকে তাঁর তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে মিলিয়েই আলোচনা করতে হবে।
তিনি তাহাজ্জুদের সাথে বিতির কিভাবে পড়তেন এবং কতো রাকাত পড়তেন?- হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে তার কয়েকটি ধরণ জানা যায়। সেগুলো নিম্নরূপ:
এক. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত ধরণ: ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একবার আমি আমার খালার বাসায় রাত্রি যাপন করলাম। দেখলাম রসূলুল্লাহ সা. রাতের শেষ তৃতীয়াংশে উঠলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘ইন্না ফী খালফিস সামাওয়াতি …..’ পড়লেন। তারপর অযু করলেন। এবং নামাযে দাঁড়ালেন। আমিও অযু করে তাঁর বাম পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন তিনি আমার কান ধরে ঘুরিয়ে আমাকে তাঁর ডানপাশে নিয়ে গেলেন। আমি তাঁর সাথে নামায পড়লাম, দেখলাম, তিন (বিতিরসহ) মোট তের রাকাত নামায পড়লেন।
ইবনে আব্বাস রা. থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি রসূল সা. –কে দেখেছেন, তিনি দুই রাকাত দুই রাকা করে আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়েছেন, তিন রাকাত বিতির পড়েছেন আর দুই রাকাত ফজরের সুন্নত পড়েছেন। এসব বর্ণনা বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে।
দুই. আয়েশা রা. বর্ণিত ধরণ: আয়েশা রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. রাতের নামাযের জন্যে উঠে প্রথমে হালকা (সংক্ষিপ্ত) দুই রাকাত দিয়ে শুরু করতেন এবং এগার রাকাত শেষ করতন। প্রত্যেক দুই রাকাতে সালাম ফিরাতেন এবং শেষবারে এক রাকাত যোগ করে বিতির (বিজোড়) করতেন।
তিন. দ্বিতীয প্রকারের মতো তের রাকাত পড়তেন।
চার. দুই রাকাত দুই রাকাত করে আট রাকাত পড়তেন। অতপর মাঝখানে না বসে এক সালামে পাঁচ রাকাত পড়তেন। (বুখারি ও মুসলিম: আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত)
পাঁচ: একত্রে নয় রাকাত পড়তেন। ক্রমাগত আট রাকাত পড়ে অষ্টম রাকাতে বসতেন এবং সেই বসায় আল্লাহর যিকর ও হামদ করতেন এবং দু‘আ করতেন। তারপর দাঁড়িযে নবম রাকাত (বিতির) পড়ে সালাম ফিরাতেন। তারপর বসে বসে দুই রাকাত পড়তেন। (সহীহ মুসলিম আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত)
ছয়. উপরে উল্লেখিথ নয় রাকাতের অনুরূপ সাত রাকাত পড়তেন। তারপর বসে বসে দুই রাকাত পড়তেন।
সাত. দুই রাকাত দুই রাকাত করে তাহাজ্জুদ পড়ে শেষ করতেন। তাপর মাঝখানে না বসে একাধারে তিন রাকাত বিতির পড়তেন। ইমাম আহমদ আয়েশরা রা. থেকে একথা বর্ণনা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন: তিনি তিন রাকাত বিতির অবিচ্ছিন্নভাবে পড়েছেন।’
ইমাম নাসায়ীও আয়েশা রা. থেকে এ ধরনের একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাতে আয়েশরা রা. বলেন: দ্বিতীয় রাকাতে সালাম না ফিরিয়ে রসূল সা. অবিচ্ছিন্নভাবে তিন রাকাত বিতির পড়েছেন।” –অবশ্যি বিতির নামাযের এই প্রকারিটি সম্পর্কে ভেবে দেখার দরকার আছে। কারণ এই প্রকারটি অধিকাংশ বর্ণনার সাথে মিলেনা।
আবু হাতিম ও ইবনে হিব্বান তাদের সহীহ হাদিস সংকলনে আবু হুরাইরা রা. থেকে হাদিস বর্ণননা করেছেন। তাতে আবু হুরাইরা রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমরা বিতির নামাযকে মাগরিবের অনুরূপ করোনা, তিন রাকাত পড়োনা। বরং পাঁচ অথবা সাত রাকাত পড়ো।’
ইমাম দারু কুতনি বলেছেন, বিতির নামায পাঁচ এবং সাত রাকাত পড়া সংক্রান্ত যে বর্ণনা এসেছে, এ বর্ণনার সকল রাবিই নির্ভরযোগ্য। তিনি বলেন, আমি আবু আবদুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি বিতির নামাযে দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফিরান কিনা? জবাবে তিনি বলেন: হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফিরান? জবাবে তিনি বলেন: দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফিরানো সংক্রান্ত হাদিসের সংখ্যা অনেক এবং হাদিসগুলো মজবুত। কারণ এ সংক্রান্ত হাদিস ইমাম যুহরি উরওয়া ইবনে যুবায়ের রা. থেকে এবং তিনি আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনার এই সূত্রটি অত্যন্ত মজবুত ও সোনালি সূত্র।
হারিস রহ. বলেছৈন, ইমাম আহমদকে বিতির নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দেন: দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফিরাতে হবে। অবশ্য সালাম না ফিরালেও আমি আশা করি নামাযের কোনো ক্ষতি হবেনা। তবে সালাম ফিরানোর ব্যাপারটি নবী করীম সা. থেকে প্রমাণিত।
আবু তালিব বলেন, আমি আবু আবদুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বিতিরের ব্যাপারে আপনি কোন হাদিসকে অগ্রাধিকার দেন? জবাবে তিনি বলেন মাঝখানে না বসে একাধারে পাঁচ রাকাত পড়ে শেষ রাকাতে সালাম ফিরানোর হাসিও ঠিক, একাধারে সাত রাকাত পড়ে শেষ রাকাতে সালাম ফিরানোর হাদিসও ঠিক। আবার যিরারা আয়েশরা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূল সা. নয় রাকাত পড়তেন এবং একাধারে আট রাকাত পড়ে বসতেন- এ হাদিসও সঠিক। তবে এক রাকাত দিয়ে বিতির পড়ার হাদিসগুলোই বেশি শক্তিশালী, তাই আমি সেটাই করি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইবনে মাসউদ রা. যে তিন রাকাতের কথা বলেছেন? জবাবে তিনি বলেন, হঁ্যা ইবনে মাসউদ রা. যে তিন রাকাতের কথা বলেছেন এবং সা’আদও জবাবে তাঁকে কিছু কথা বলেছৈন এবং তাঁর তিনস রাকাতের বিষয়টি খন্ডণ করেছন।
আট. নাসায়ী ও আবু দাউদে বর্ণিত হযরত হুযাইফার বক্তব্য এতে হুযাইফা রা. দীর্ঘ তাসবীহ ও দু’আ সম্বলিত মাত্র চার রাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। [আসলে হুযাইফা রা. –এর এই বর্ণনায় বিতির নামাযের কথা উল্লেখ করা হয়নি।]
এই বিতির নামাযের বিভিনন প্রকার, যা রসূলুল্লাহ সা. পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়অ যায়। [বিতির নামায রসূল সা. রাতের নামাযের সাতে একত্রে পড়েছেন বিধায়, এই নামাযের রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে সাহাবীগণ যে যা দেখেছেন, তিনি তাই বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া তাঁরা আমলও করেছেন নিজস্ব দেখা অনুযায়ী। তাই সহীহ হাদিস সমূহে বর্ণিত যে কোনো প্রকারের উপর আমল করলেই চলবে। কারণ রসূল সা. বিভিন্ন রকম করেছেন।]
কখন কিভাবে পড়তেন?
বিভিন্ন হাদিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, রসূলুল্লাহ সা. বিতির নামায –
-রাতের প্রথম ভাগেও পড়েছেন এবং সাহাবীগণকেও পড়তে বলেছৈন।
-রাতের মধ্য ভাগেও পড়েছেন।
-রাতের শেষ ভাগেও পড়েছেন।
রসূলুল্লাহ সা. রাতের নামায সাধারণত তিনভাবে পড়েছেন:
এক. অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
দুই. কখনো কখনো (বিশেষ করে শেষ বয়েসে) বসে বসে পড়েছেন এবং রুকূও বসে বসে করেছেন।
তিন: কখনো কখনো বসেই সূরা কিরাত পড়েছেন। তবে রুকূ করার সময় দাঁড়িয়ে রুকূ করেছেন। তারপর সাজদায় গিয়েছেন।
-এই তিন প্রকারই সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
বিতিরে দু’আ কুনুত
রসূলুল্লাহ সা. বিতির নামাযে কুনূত পড়েছেন বলে ইবনে মাজাহতে বর্ণিত একটি হাদিস ছাড়া অন্য কোথাও থেকে জানা যায়নি। হাদিসটির সূত্র নিম্নরূপ ইবনে মাজাহ> আলী ইবনে মাইমুন আপর রকী> মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযীদ> সুফয়অন> যায়েদ ইবনে ইয়ামী> সায়ীদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবযী> আবদুর রহমান ইবনে আবযী> উবাই ইবনে কা’আব রা.। উবাই ইবনে কা’আব বর্ণিত হাদিসটি হলো: রসূলুল্লাহ সা. বিতির পড়তেন এবং রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন।”
ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সা. মূলত রুকূর পরে কুনাত পড়তেন, পূর্বে নয়।
আসলে কুনূতের ব্যাপারে হাদিস যতো হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তাহলো রসূল সা. ফজর নামাযে রুকূ থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কুনূত পড়েছেন। ইবনে মাজাহর এই হাদিস থেকে জানা যায়, বিতিরে রুকূর পূর্বে কুনুত পড়েছেন।
মুসনাদে আহমদ ও সুনান গ্রন্থাবলীতে হাসান ইবনে আলী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন রসূলুল্লাহ সা. আমাকে বিতিরে পড়ার জন্যে যে কথাগুলো শিক্ষা দিয়েছেন, সেগুলো হলো:
(আরবী********************)
অর্থ হে আল্লাহ, তমি যাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছো, আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো! যাদেরকে তুমি ক্ষমা ও সুস্থতা দান করেছা, আমাকেও ক্ষমা ও সুস্থতা দান করে তাদের অন্তর্বুক্ত করো! তুমি যাদের অভিভাবক হয়েছো, আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করো! তুমি যা কিছু প্রদান করেছা, আমার জন্যে তাতে বরকত (প্রাচুর্য) দান করো। তোমার মন্দ ফায়সালা থেকে আমাকে রক্ষা করো। তুমিই প্রকৃত ফায়সালাকারী আর তোমার উপর কারো ফায়সালা চলেনা। তুমি যার অভিভাকত্ব গ্রহণ করেছো, তাকে কেউ অপদস্থ করতে পারে না। যে তোমার শত্রু হয়েছে, তাকে ইযযত দান করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের প্রভু, বিরাট প্রাচুর্যশীল তুমি, অতিশয় মহান তুমি।”
নাসায়ীর বর্ণনায় একথাও আছে যে, হাসান রা. এই দু’আ পড়ার পর রসূলুল্লাহ সা. –এর প্রতি দরূদ পড়তেন।
হাকাম তার মুসতদরক গ্রন্থে হাসান রা. থেকে একথাও উল্লেখ করেছেন যে: রসূলুল্লাহ সা. বিতর নামাযে রুকূ থেকে দাঁড়ানোর পর যখন সাজদা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকবেনা, তখন এই কথাগুলো (উপরোক্ত দু’আটি পড়ার জন্যে আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
ইমাম তিরমিযি বলেছৈন, হাসানের এই হাদিসটি ‘হাসান’ (উত্তম) হাদিস। বিতরের কুনুত সম্পর্কে এর চাইতে উত্তম আর কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়না।
তবে[এর বাকি অংশটুকু সম্পাদক কর্তৃক সংযোজিত] মুহাদ্দিস তাবারানি প্রমুখ বিতির নামাযে আরেকটি কুনূতের কথা বর্ণনা করেছন। যদিও হাসান রা. বর্ণিত উপরোক্ত কুনূতটিকেউ মুহাদ্দিসগণ বিতিরের সর্বোত্তম কুনূত বলে অভিহিত করেছন, কিন্তু ইমাম আবু হানীফা ও ইমা মলিক প্রমুখ নিম্নোক্ত কুনূতটিকেও উত্তম বলেছেন:
(আরবী******************)
অর্থ: আয় আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য চাই, তোমারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তোমারই প্রতি ঈমান রাখি, তোমার উপরই ভরসা করি এবং সর্বপ্রকার মহোত্তম গুণাবলী তোমারই প্রতি আরোপ করি। আমরা তোমার কৃতজ্ঞ হয়ে জীবন যাপন করি, তোমার অকৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বন করিনা। আমরা তোমার অবাধ্য লোকদের ত্যাগ করি এবং তাদের সাথে সম্পর্ক রাখিনা। ওগো আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব করি, তোমারই জন্যে নামায পড়ি এবং তোমাকেই সাজদা করি। আমরা তোমারই পথে দৌড়াই, তোমারই পথে এগিযে চলি। তোমার রহমতের আমরা আকাংখী, তোমার আযাবকে আমরা ভয় করি, আর তোমার আযাব তো কেবল কাফিরদের প্রতিই বর্তাবে।”
বিতিরের পরে দুই রাকাত
সহীহ মুসিলম ও মুসনাদে আহমদে আয়েশা রা. উম্মে সালামা রা. এবং আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সা. কখনো কখনো বিতিরের পরে বসে বসে দুই রাকাত নামায পড়ছেন।
এই দুই রাকাতের শুদ্ধতা নিয়ে আলিমদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে। কারো কারো মতে এই দুই রাকাত ‘বিতিরকে রাতের শেষ নামায বানাও’ রসূল সা.- এর এই বাণীর খেলাফ। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিতিরের পরে নামায পড়ার বৈধতা দেখাবার জন্যেই রসূল সা. এই দুই রাকাত পড়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এই দুই রাকাত বিতিরের পরিপূরক নামায।