বাংলায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের খতিয়ান: এপ্রিল ১৮৭১
ইউরোপিয়ান হিন্দু মুসলমান মোট
চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস (মহামান্য রাণী কর্তৃক ইংলন্ড থেকে নিয়োগপত্র প্রদত্ত) ২৬০ ২৬০
রেগুলেশন বহিভূত জেলাসমুহে (এরা এবং এর পরবর্তী গ্রেডের কর্মচারীরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত) বিচার বিভাগিয় অফিসার ৪৭ ৪৭
এক্সাট্রা এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ২৬ ৭ ৩৩
ডেপুটি ম্যাজিষেটট্রট ও ডেপুটি কালেক্টর ৫৩ ১১৩ ৩০ ১৯৬
ইনকামট্যাক্স এসেসর ১১ ৪৩ ৬ ৬০
রেজিষ্ট্রেশন ডিপাটমেন্ট ৩৩ ২৫ ২ ৬০
স্মল জজ কোর্টের জজ এবং সাব অর্ডিনেট জজ ১৪ ২৫ ২ ৬০
মুন্সেফ ১৭৮ ৩৮ ২১৬
পুলিশ বিভাগ, সকল গ্রেডের গেজেটেড অফিসার ১০৬ ৩ ০ ১০৯
গণপূর্তবিভাগ, ইঞ্জিনিয়ারিং এস্টাবলিশমেন্ট ১৫৪ ১৯ ০ ১৭৩
গণপূর্তবিভাগ,সাব অর্ডিনেট এস্টাবলিশমেন্ট ৭২ ১২৫ ৪ ২০১
গণপূর্তবিভাগ, একাউন্ট এস্টাবলিশমেন্ট ২২ ৫৪ ০ ৭৬
মেডিক্যাল ডিপাটমেন্ট মেডিক্যঅল কলেজে, জেলাখানায়, দাতব্য চিকিৎসালয়ে, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও রোগ প্রতিষেধক বিভাগে নিযুক্ত কর্মচারী এবং জেলা মেডিকেল অফিসার ইত্যাদি, ৮৯ ৬৫ ৪ ১৫৮
জনশিক্ষা বিভাগ ৩৮ ১৪ ১ ৫৩
শুল্ক, নৌ চলাচল, জরিপ, আফিম নিয়ন্ত্রন (উর্ধ্বতন অফিসারদের ধরা হয়নি। আফিম বিভাগের কিছু সংখ্যক অফিসার গেজেটেড নয়) ইত্যাকারের বিভিন্ন বিভাগ ৪১২ ১০ ৪২২
মোট ১৩৩৮ ৬৮১ ৯২ ২১১১
একশ বছর পূর্বে রাষ্ট্রীয় চাকরির সকল পদ মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকারে ছিল। শাসনশক্তি কদাচিৎ কখনও অনুগ্রহ বিতরণ করলে হিন্দুরা তাই গ্রহন করে কৃতার্থ হত এবং সামান্য দুএকটা জায়গায় কিংবা দুচারটে কেরানী পদে ইউরোপিয়ানদের মুখ দেখা যেত। কিন্তু উপরের হিসেবে দেখানো হয়েছে যে, পরবর্তী সময়ে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের আনুপাতিক হারে দাঁড়িয়েছে এক সপ্তমাংশেরও কম। ইউরোপিয়ানদের তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অর্ধেকেরও বেশী। ইউরোপিয়ানদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক পঞ্চমাংশের কম। এক শতাব্দী পূর্বে সরকার প্রশাসনে যে জাতির একচেটিয়া অধিকার কায়েম ছিল, বর্তমানে তাদের আনুপাতিক হার মোট সংখ্যার তেইশ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। এটাও আবার শুধুমাত্র গেজেটের চাকরির বেলায় প্রযোজ্য যেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। প্রেসিডেন্সী শহরের অপেক্ষাকৃত সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিয়োগ প্রায় সম্পূর্ণ রহিত হয়ে গিয়েছে। কদিন গে দেখা যায় যে, কোন একটা বিভাগে এমন একজনও কর্মচারী নেই যে মুসলমানদের ভাষা পড়তে জানে; এবং বস্তুত কলকাতায় এখন কদাচিৎ এমন একটা সরকারী অফিস চোখে পড়বে যেখানে চাপরাশী ও পিয়ন শ্রেণীর উপরিস্থরে একজনও মুসলমান কর্মচারী বহাল আছে। এ রকম হওয়ার কারণ কি এই যে, মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুরা অধিকতর যোগ্য এবং তারাই শুধু সুবিচার পাবার দাবী রাখে? অথবা ব্যাপারটা কি এই যে, বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে মুসলমানদের এত বেশী সুযোগ রয়েছে যে, সরকারী চাকরি গ্রহণের তারা অনিচ্ছুক এবং তাই চাকরির জায়গাটা তারা হিন্দুদের এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়েছে? হিন্দুরা নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট মেধার অধিকারী কিন্তু সরকারী কর্মক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করার জন্য যে রকমের সার্বজনীন ও অনন্য মেধা থাকা দরকার বর্তামানে তা তাদের নেই এবং তাদের অতীত ইতিহাসও একথার পরিপন্থী। বাস্তব সত্য হলো এই যে, এদেশের শাসন কর্তৃত্ব যখন আমাদের হাতে আসে তখন মুসলমানরাই ছিল উচ্চতর জাতি; এবং শুধুমাত্র মনোবল ও বাহুবলের বেলাতেই উচ্চতর নয়, এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় দক্ষতা এবং সরকার পরিচালনায় বাস্তব জ্ঞানের দিক থেকেও তারা ছিল উন্নততর জাতি। এ সত্ত্বেও মুসলমানদের জন্য এখন সরকারী চাকরি এবং বেসরকারি কর্মক্ষেত্র এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
মর্যাদাবান মুসলমানদের জন্য বর্তমানে যে একটিমাত্র লৌকিক কর্মক্ষেত্রে খোলা আছে তা হল আইন আদালত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন রকমের পেশা এবং সে সম্বন্ধে আমি পরে আলোচনা করব। এমনকি আইনের জায়গাতেও মুসলমানদের প্রবেশের সুযোগ বর্তমান সরকারী চাকরির চেয়ে অধিকতর কঠোরতার সাথে বন্ধ হয়ে পড়েছে। বঙ্গীয় হাইকোর্ট মহামান্য রাণী কর্তৃক নিযুক্ত বিচারকদের মধ্যে এখন দুজন হিন্দু (এরা সরকারী চাকরির প্রথম গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত। এদের বেতন বছরে ৫০০০ পাউন্ড) রয়েছেন। কিন্তু মুসলমান একজনও নিই। একদা যে জাতির লোকেরা গোটা বিচার বিভাগের ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভোগ করেছে তাদের মধ্যে থেকে হাইকোর্টে একজনও বিচারক নিয়োগের প্রশ্ন বর্তমানে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও হিন্দুদের জন্য সমান অকল্পনীয়। ১৮৬৯ সালে আমি যখন ভারতীয় চাকরিসমূহের সর্বশেষ পরিসংখ্যান প্রণয়ন করি তখন বিচার বিভাগের অবস্থা ছিল নিম্নরূপ:
মহামান্য রাণীর নিযুক্ত মোট ছয়জন আইন অফিসারের মধ্যে চারজন ইংরেজ ও দুইজন হিন্দু ছিল। কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না; হাইকোর্টের উচ্চতর গেজেটেড পদে মোট একুশজন অফিসারের মধ্যে সাতজন ছিল হিন্দু কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না। ব্যারিস্টারদের মধ্যে তিনজন ছিল হিন্দু (এই সংখ্যা বর্তমানে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমার ধারণা), কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না।
কিন্তু হাইকোর্টে উকিলের পদে (নিম্নতর ব্যারিস্টারি ধরনের পেশা) নিযুক্ত ব্যক্তিদের সর্বাধিক করুণ ইতিহাসের পরিচায়ক। বর্তমানে যারা জীবিত তাদের সকলেরই মনে আছে যে, আইনের এই পেশাটা সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদেরই করায়ত্ত ছিল। বর্তমান তালিকাটা ১৮৩৪ সালের অবস্থা অনুসারে তৈরী হয় এবং ঐ সময়কার উকিলদের মধ্যে যারা ১৮৬৯ সালে জীবিত ছিল তাদের মধ্যে ইংরেজ একজন হিন্দু একজন এবং মুসলমান দুজন ছিল। ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা ইংরেজ ও হিন্দুর সম্মিলিত সংখ্যার প্রায় সমান ছিল। আনুপাতিক হিসেবে ইংরেজ ও হিন্দু সাত আর মুসলমান ছয়জন। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে উকিল হিসেবে সনদ প্রাপ্তদের মধ্যে যারা ১৮৬৯ সালে জীবিত ছিল তাদের সবাই মুসলমান। এমনকি ১৮৫১ সালেও যারা সনদ পেয়েছে তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ইংরেজ ও হিন্দুর সম্মিলিত সংখ্যার সমান। এরপর থেকেই এ পেশায় নতুন ধরনের লোকদের সমাগম ঘটতে থাকে। ভিন্নতর দৃষ্টি কোন থেকে যোগ্যতা যাচাই শুরু হয়ে যায় এবং তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে, ১৮৫২ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত মোট সনদ প্রাপ্ত দুইশত চল্লিশজন ভারতীয়দের মধ্যে দুইশত উনচল্লিশ জনই হিন্দু, আর মুসলমান মাত্র একজন।
আইন ব্যবসায়ের পরবর্তী গ্রেডে, অর্থাৎ হাইকোর্টের এটর্নি প্রোক্টর ও সলিসিটর (অরিজিনাল সাইডের আওতায়) ১৮৬৯ সালে হিন্দু সংখ্যা চিল সাতাশ কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না। শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত উদীয়মান আইনজীবীদের মধ্যেও হিন্দুর সংখ্যা ছিল ছাব্বিশ, কিন্তু মুসলমান সেই শূন্যের কোঠায়। এই পেশার যেকোনো বিভাগের দিকেই দৃষ্টি ফেরাই না কেন, সবখানেই একই অবস্থা পরিদৃষ্ট হচ্ছে। হাইকোর্টের রেজিষ্ট্রার অফিসে ১৮৬৯ সালে গেজেটেড পদমর্যাদাসম্পন্ন মোট ১৭জন কর্মচারীর মধ্যে ৬জন ছিল ইংরেজ অথবা ইষ্ট ইন্ডিয়ান, আর হিন্দু ছিল ১১জন কিন্তু একজনও মুসলমান ছিল না। রিসিভার অফিসে মোট ৪জনের মধ্যে দুইজন ইংরেজ ও দুইজন হিন্দু ছিল, কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না। আইনের সকল শাখাপ্রশাখায় একাউন্ট অফিসে শেরিফের অফিসে, করোনারের অফিসে এবং দোভাষীদের অফিসে মোট ২০ জনের মধ্যে ইংরেজ ৮জন এবং হিন্দু ১১জন, আর মুসলমান মাত্র ১জন ছিল। তালিকার এই একটিমাত্র মুসলমানই গোটা মুসলমান জাতির একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বিরাজমান; তিনি হচ্ছেন একজন দুর্দশাগ্রস্ত মওলা (আইন অফিসার) যার বেতন সপ্তাহে মাত্র ছয় শিলিং।
এরপর থাকছে চিকিৎসা পেশার কথা। কিন্তু এটা দুঃখজনক যে, ভারতীয় ডাক্তাররা যে ধরনের চিকিৎসায় অভ্যস্ত তা উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে কদাচিৎ পেশা হিসেবে পরিগণিত হতে পেরেছে। মুসলমান ভদ্রলোকদের জন্য দুজন করে চিকিৎসক প্রয়োজন হয়। একজন হচ্ছেন সত্যিকার চিকিৎসক, তার উপাধি তিব্বি; ইংরেজ লেখকরা যাদেরকে হাকিম বলে উল্লেখ করে থাকেন। এরা রোগীর কাছ থেকে উত্তম পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। অপরটির নাম জাররাহ সহজ ইংরেজিতে যার মানে ক্ষৌরকার। ক্ষৌরকর্ম থেকে শুরু করে অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ পর্যন্ত যাবতীয় অস্ত্রোপচারের কাজ এরাই করে থাকে। আবার ঔষধের চিকিৎসক এবং অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকের মাঝে ব্যবধানটা এত তীব্র যে, একজন যশস্বী তিব্বি কারো ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাধতেও অস্বীকার করবে। এটা অস্ত্রোপচারকারী ক্ষৌরকারের একচেটিয়া অধিকারভুক্ত বিষয়। চিকিৎসার প্রায় সমগ্র ক্ষেত্রটাই কার্যত এদের এখতিয়ারভূক্ত হয়ে পড়েছে এবং প্রকৃত মুসলমান চিকিৎসকরা বর্তমানে একটা ক্ষয়িষ্ণু শ্রেণীতে পর্যবসিত হয়েছে। উত্তর ভারতের বড় বড় শহরে তাদেরকে হয়ত এখনও দেখা যাবে। কিন্তু বাংলার জেলাগুলোতে এদের কোন নাম নিশানাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিকিৎসা পেশা এখন সম্পূর্ণভাবে অশিক্ষিত মুসলমান ক্ষৌরকার এবং হিন্দু ডাক্তারদের (হিন্দু ডাক্তারদের মধ্যেও দুটো শ্রেণী আছে: কবিরাজ, যারা প্রাচীন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে এবং যাদেরকে হাতুড়ে বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজদের কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক) একচেটিয়া অধিকার চলে গেছে।
এতদসত্ত্বেও উত্তর ভারতের যেখানেই টিকে থাক না কেন, মুসলমান চিকিৎসকদের পাণ্ডিত্য ও সাধু স্বভাব বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সক্রিয় চিকিৎসকদের জীবনের চেয়ে এরা বরং নিঃসঙ্গ জীবনযাপনই বেশী পছন্দ করে। এরা ফার্সী ও আরবী কিতাব থেকে চিকিৎসাবিদ্যা রপ্ত করেছে এবং আমাদের ইংরেজি চিকিৎসাবিদ্যাকে ক্ষৌরকার অস্ত্রোপচারকারীর সমপর্যায়ে বলে গণ্য করে। ফলে বাংলায় কোন ভদ্রবংশজাত মুসলমান কদাচিৎ চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে চাইবে যদিও সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র অত্যন্ত প্রশংসনীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। সেখানে গরীব মুসলমান ছেলেরা বড় জোর কম্পাউন্ডারি করার জন্য যতটুকু চিকিৎসা জ্ঞান থাকা দরকার তার বেশী শিখতে চাইবে না। এক কথায় বলা যায় যে, তারা ঠিক পরবর্তী ক্ষৌরকার অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকদের মতই;উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের কাছে তাদের কোনই মর্যাদা নেই এবং মুষ্টিমেয় যে কয়জন মুসলমান চিকিৎসক এখনও টিকে আছে তারা এদেরকে আদৌ স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়।যাদের কাছ থেকে এরা চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছে তাদের প্রতিও তারা অকৃতজ্ঞ এবং খুব একটা বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। কিন্তু বহু সংখ্যক হিন্দু ডাক্তারের সাথে আমি ঘনিষ্ঠভাবে মিশে দেখেছি যে, নিষ্ঠা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে তারা এই মহৎ পেশার উপযুক্ত বলে নিজেদেরকে গণ্য করতে পেরেছে। কিন্তু অনুরূপ একজনও মুসলমান ডাক্তার আমার চোখে পড়েনি। হয়ত উত্তর ভারতে তারা থাকতে পারে, কিন্তু বাংলায় এমন একজনও মুসলমান ডাক্তার নেই যে নাকি চিকিৎসা বিদ্যায় স্বীকৃত কোন একটা শ্রেণীর গণ্ডিতে পড়তে পারে। ১৮৬৯ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েট উপাধিপ্রাপ্ত মোট চারজন ডাক্তারের মধ্যে তিনজন হিন্দু ও একজন ইংরেজ, কিন্তু মুসলমান একজনও নেই। মেডিসিনে ব্যাচেলর ডিগ্রীপ্রাপ্ত মোট ১১ জনের মধ্যে হিন্দু ১০ জন আর ইংরেজ একজন। এল এম এফ উপাধিধারী মোট ১০৪ জনের মধ্যে ইংরেজ ৫ জন, হিন্দু ৯৮ জন এবং মুসলমান মাত্র একজন। সম্প্রতি সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট দুইজন ভারতীয় চিকিৎসককে বাহাদুর উপাধি দান করেছেন। রাজনৈতিক প্রশ্ন বিবেচনা করে ঠিক করা হয় যে, উপাধি দুটির একটি একজন হিন্দুকে এবং অপরটি একজন মুসলমানকে দেওয়া উচিত, এবং এটা সুবিদিত যে, এ ধরনের উপাধিকে মুসলমানরা কত মূল্যবান মনে করে। এ সত্ত্বেও আমি জানতে পেরেছি যে, উক্ত উপাধি প্রদানের জন যে মুসলমান ভদ্রলোককে বাছাই করা হয় তিনি অত্যন্ত মর্যাদাবান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও উক্ত উপাধি তাকে তার নিজ দেশবাসীর মধ্যে যথোপযুক্ত সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তব সত্য এই যে, আমাদের মেডিকেল স্কুলে যে চিকিৎসাবিদ্যা শিখানো হয় মুসলমানরা তাকে ভদ্রলোকের পেশা বলে গ্রহণ করতে পারেনি। তাছাড়া সামাজিক কুসংস্কারের দরুন এই পেশার দরজা অন্যান্য পেশার মতই মুসলমান পরিবারের ছেলেদের জন্য রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে এবং উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুদের আধিক্য ও প্রাধান্যের জন্য সরকারী চাকরীর দরজাও তাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলার মুসলমানদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধাদির অধিকতর করুণ কোন বিবরণ আমি কদাচিৎ পড়েছি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ফার্সী পত্রিকা (দূরবীন জুলাই ১৮৬৯) সম্প্রতি লিখেছে: উচ্চস্তরের বা নিম্নস্তরের সকল চাকরি ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সরকার সকল শ্রেণীর প্রজাকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য; তথাপি এমন সময় এসেছে যখন মুসলমানদের নাম আর সরকারী চাকুরিয়াদের তালিকায় প্রকাশিত হচ্ছে না; কেবল তারাই চাকরির জায়গায় অপাংক্তেয় সাব্যস্ত হয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবন কমিশনারের অফিসে কতিপয় চাকরিতে লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কিন্তু অফিসারটি সরকারী গেজেটে কর্মখালীর যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় যে, এই শূন্য পদগুলোতে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে। (ফার্সী পত্রিকাটিতে প্রকাশিত আলোচ্য সংবাদের সত্যতা সরকারীভাবেই যাচাই করার মত কোন উপায় এখন আমার হাতে নেই; কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি যে, এ পর্যন্ত এই সংবাদটির প্রতিবাদ কেউ করেনি)মোট কথা হল, মুসলমানদের এখন কতটা নিচে ঠেলে দেয়া হয়েছে যে, সরকারী চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও সরকারী বিজ্ঞপ্তি মারফত এটা জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তাদের জন্য কোন চাকরি খালি নেই। তাদের অসহায় অবস্থার প্রতি কারো দৃষ্টি নেই এবং এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতেও রাজি নয়।
উড়িষ্যার মুসলমানদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি কমিশনারের (মিঃ ই. ডবলিউ, মলোনী, সি এস যার কাছ থেকে একটা কপি পাওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ) কাছে পেশকৃত একটি আবেদনপত্রের কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করেছি। এতে তাদের ব্যবহৃত ভাষার রুঢ়তা হয় তা হাসির উদ্রেক করতে পারে, কিন্তু এই প্রদেশের এককালীন বিজেতারা যে এখন পেটের দায়ে অশুদ্ধ ইংরেজিতে দয়া ভিক্ষা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা সত্যিই তাদের দুঃখজনক নীরবতা পরিচায়ক: মহামান্য দয়াবতী রাণীর অনুগত প্রজা হিসেবে দেশের সরকারী চাকরিতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার আমাদেরও আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, উড়িষ্যার মুসলমানদের ক্রমাগত নিচে চেপে রাখা হচ্ছে এবং তাদের মাথা তুলতে দাঁড়াবার আর কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণকারী এসব মুসলমান বর্তমানে চাকরির অভাবে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের অবস্থাটা ঠিক ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত করুণ হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের এই করুণ অবস্থার কথা আপনার সামনে এই আশায় তুলে ধরছি যে, উড়িষ্যা বিভাগে মহামান্য রাণীর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে আপনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রজার প্রতি সুবিচার করবেন। সরকারী চাকরি থেকে বঞ্চিত হবার কারণেই আমরা আজ কপর্দকহীন হয়ে পড়েছি। আমাদের অবস্থা আজ এতই শোচনীয়, যে আমরা দুনিয়ার যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে রাজী আছি তা সে হিমালয়ের বরফাচ্ছাদিত চূড়াই হোক কিংবা সাইবেরিয়ার জনমানবহীন প্রান্তরই হোক যদি জানতে পারি যে, অনুরূপ ভ্রমণের ফলে সপ্তাহে মাত্র দশ শিলিং বেতনের কোন চাকরিতে আমাদের নিয়োগ করা হবে।
এটা কি করে সম্ভব যে, সরকারী চাকরি এবং স্বকৃত সকল পেশার দরজা মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল? বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তির অভাব নেই, এবং দারিদ্র্যের চাপে তারা সব সময়ই ভাগ্যোন্নতির জন্য একটা কিছু করার চেষ্টায় আছে। সরকার বাংলায় অনেক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর অনেক জেলাই মুসলমান অধ্যুষিত। তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রতিযোগিতায় কৃতকার্য হতে পারে এবং যেকোনো পেশায় ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে এমন কৃতি মুসলমান ছাত্র তৈরি করতে ঐ সব সরকারী স্কুল ব্যর্থ হয়েছে। অথচ প্রতি বছর ঐ সব স্কুল থেকে দলে দলে এমন সব সুশিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী ও মেধাবী হিন্দু যুবক বেরিয়ে আসছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের যোগ্যতা অর্জন করেছে এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করে অর্থ রোজগার ও ভদ্র জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্র অধিকার করে বসেছে।
আসল সত্য এই যে, আমাদের প্রবর্তিত জনশিক্ষা ব্যবস্থা হিন্দুদেরকে শতাব্দীর নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে তাদের নিষ্ক্রিয় জনসাধারণকে মহৎ জাতিগত প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তুলতে পারলেও তা মুসলমানদের ঐতিহ্যের পরিপন্থী, তাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং তাদের ধর্মের কাছে ঘৃণার্হ আমাদের শাসনে যেমন মুসলমানদের শাসনামলেও ঠিক তেমনিভাবে হিন্দুরা নিজেদের ভাগ্যকে বরণ করে নিয়েছিল। বর্তমানে ইংরেজি জানা লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এবং হিন্দুরা ইংরেজি শিখছে। ইতিপূর্বে ফার্সী জানা লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হত এবং তখন হিন্দুরা ফার্সী শিখত সুদূর অতীতে, ১৫০০ সালেও তারা ফার্সী ভাষায় বই পুস্তক রচনা করেছে। সেকালের একজন হিন্দু লেখকের ফার্সী কাব্যগ্রন্থ আজও টিকে আছে। পৌত্তলিক হওয়া সত্ত্বেও তাকে মুসলমান যুবকদের শিক্ষকতা করার জন্য সরকারী লেকচারার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আকবরের সময় দিল্লীর দরবারে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরাও সমাদৃত হতেন। এবং একজন বিশিষ্ট ফার্সী কবি সেখানে বিশেষ সম্মানজনক আসন লাভ করেন। তবে ফার্সী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন লাভজনক হওয়ার পরই শুধু সাধারণ হিন্দুরা ফার্সী শিখতে এগিয়ে এসেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পাদে ভারত সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী যিনি নিজেেই একজন হিন্দু এই মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, অতঃপর সরকারী হিসেব সংরক্ষণের যাবতীয় কাজ ফার্সী ভাষায় সম্পাদিত হবে এবং রাজস্ব বিভাগের অধস্তন হিন্দু অফিসাররা তাড়াতাড়ি ফার্সী ভাষা শিখে নেয়।
সুতরাং আমরা যখন সরকারী কাজে ইংরেজি চালু করলাম, নমনীয় হিন্দুরা তখনই ইংরেজি শিখে নিয়েছে, কারণ তারা উপলব্ধি করে যে, ইংরেজি না জানলে জীবনে কৃতকার্য হওয়া যাবে না। মুসলমান আমলের সরকারী ভাষা এবং আমাদের আমলের সরকারী ভাষা ইভয়ই হিন্দুদের কাছে বিদেশী ভাষা। তাদের কাছে উভয় ভাষাই সমান অনাদৃত কিন্তু জীবনের সাফল্য লাভের জন্যই তারা তা শিখেছে। তবে আমাদের সরকারী স্কুলসমূহে ইংরেজি শিক্ষার ব্যয় পূর্ববর্তী আমলের তুলনায় অর্ধেক হওয়ায় হিন্দুরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অত্যন্ত সমাদরের সাথে গ্রহণ করেছে।
কিন্তু মুসলমানদের বেলায় ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এ দেশ আমাদের হাতে আসার আগে তারা শুধুমাত্র ভারতের রাজনৈতিক কর্তাই ছিল না, বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রটাও তাদের অধিকারে ছিল। তাদেরকে ভাল করে জানেন এমন একজন ভারতীয় রাষ্ট্রনীতিবিদের (মিঃ ই. সি বেইলী, সিএস আই) ভাষায় বলতে হয়: তারা এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত যা আমাদের প্রবর্তিত ব্যবস্থার তুলনায় নিকৃষ্ট হলেও মোটেই অবজ্ঞার বিষয় নয় এবং উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তি ও আদব কায়দা প্রশিক্ষণের জন্য সে ব্যবস্থাটা যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল। প্রাচীন ভাবধারায় চালিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা যে নীতির দ্বারা চালিত হত তা সম্পূর্ণ দোষযুক্ত ছিল না এবং তৎকালীন ভারতে প্রচলিত অন্যান্য শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় তাদেরটা ছিল নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্টতর। সে ব্যবস্থার গুণেই বুদ্ধিবৃত্তি ও অর্থ সম্পদের ক্ষেত্রে তারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে এবং সরকারী ক্ষমতার সামান্য যা কিছু অংশ হিন্দুরা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে তাও ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা রপ্ত করার বদৌলতে।
আমাদের শাসনের প্রথম পঁচাত্তর বছর প্রশাসন কার্য পরিচালনার যোগ্য অফিসার সৃষ্টির জন্য আমরা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই কাজে লাগিয়েছি। কিন্তু ইত্যবসরে জনশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করি। এবং নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্ত বহুলোক সৃষ্টি হওয়ার পর মুসলমানদের পুরনো ব্যবস্থাটা আমরা বর্জন করেছি। ফলে মুসলমান যুবকদের সামনে রাষ্ট্রীয় কর্মের প্রতিটি রাস্তা রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বুদ্ধিমান হলে মুসলমানরা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে তদনুসারে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলত। কিন্তু একটা প্রাচীন বিজেতা জাতির পক্ষে তাদের স্বর্ণযুগের ঐতিহ্য রাতারাতি বিসর্জন দেয়া সম্ভবপর নয়। বাংলার মুসলমানরা যে জাতির ওপর এতকাল শাসন কর্তৃত্ব চালিয়ে এসেছে, যাদেরকে তারা মূর্তিপূজক হিসেবে ঘৃণা এবং নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ হিসেবে অবজ্ঞা করে এসেছে, সেই জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে না এমন একটা ব্যবস্থা মেনে নিতে তারা অঙ্গীকার করেছে। নয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সৃষ্ট জনমতের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস সহায়ক হয়েছে। এবং কোন মুসলিম বালক নিজের আত্মার অধঃপতন না ঘটিয়ে আমাদের সরকারী স্কুলে ভর্তি হতে পারে নিকা সে সম্বন্ধে দীর্ঘকাল যাবত সংশয় বিরাজমান ছিল আমরা যদি ইংরেজ শিক্ষকদের মাধ্যমে আমাদের ব্যবস্থা চালু করতাম, অথবা রাষ্ট্রীয় কাজে এদেশের ভাষা সম্পূর্ণ বর্জন করে শুধু যদি ইংরেজি চালু করতাম, তাহলে হয়ত ধর্মীয় কারণে তাদের অসুবিধাগুলো বহুলাংশে লাঘব হয়ে যেত। কেননা মুসলমানরা এটা স্বীকার করেযে, তাতের পয়গম্বর কর্তৃক প্রবর্তিত পূর্ণ সত্যের কাছে খ্রিষ্ট ধর্ম অসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেটা মানবজাতির কাছে নাজিলকৃত অন্যতম আসমানী ধর্ম। কিন্তু তাদের কাছে হিন্দু ধর্ম হচ্ছে একটা আদিম অন্ধবিশ্বাস এবং ভূতপ্রেত ও মূর্তিপূজার এমন একটা আজগুবি মতবাদ, একেশ্বরবাদের ধারণার স্পর্শ মাত্রই যা অবলুপ্ত হয়ে যাবে না। (বলা বাহুল্য যে, এই মতের আমি সম্পূর্ণ বিরোধী; যদিও কিছু সংখ্যক নিরপেক্ষ খ্রিষ্টান এখনও এই মতের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। বিজিত জাতির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানার পরিণাম অজ্ঞ মুসলমানরা ইতিমধ্যেই ভোগ করেছে) দক্ষিণ বঙ্গে আমাদের স্কুলসমুহে যে ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয় সেটা হিন্দুদের ভাষা এবং শিক্ষকরাও হিন্দু মুসলমানরা সর্বসম্মতভাবে পৌত্তলিক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পৌত্তলিক ভাষায় প্রদত্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই বিরূপ মানসিকতা যুগের চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন ভাবধারার সৃষ্টি করেছে। আমাদের স্কুলগুলোকে অপছন্দ করার পক্ষে সৃষ্ট সাধারণ জনমত প্রথম দিকে ধর্ম কর্তৃক সমর্থিত হয়, কিন্তু পরে ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। বর্তমান যুগের সর্বাধিক বিজ্ঞ আইন বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্ত, যা এই বইতে ইতিমধ্যেই একাধিকবার উদ্ধৃত করেছি, ইংরেজি শিক্ষার সপক্ষে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই প্রখ্যাত অধ্যাপকটি ইতিমধ্যেই ইংরেজদের অধীনে চাকরি গ্রহণের সমর্থনে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কতিপয় সরকারী চাকরি প্রয়োজনীয় কতিপয় অবাঞ্ছিত আবার কতিপয় চাকরি পাপাত্মক। ইংরেজরা যদি মুসলমানদের প্রশংসনীয় পদে নিয়োগ করে যেমন ইসলামী বিধিবিধান মোতাবেক আইন অফিসারের পদে, রাস্তা তদারককারী ওভারসীয়ার, গরীবের ভ্রমণকারীদের পান্থনিবাস তদারকের কাজে, সম্পত্তির অছি, অথবা চোর ডাকাত দমনের কাজে তাহলে সেসব চাকরি গ্রহণ করা ভাল। কারণ একইভাবে পয়গম্বর যোসেফ মিসরের নাস্তিক রাজার কোষাধ্যক্ষ ও পুলিশ প্রধানের পদ গ্রহণ করেছিলেন। এবং মূসাকে দুধ পান করাবার উদ্দেশ্যে মহামান্য মুন্সী ফেরাউনের অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু কোন সরকারী পদ যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধর্মহীন করে তোলে তবে সে পদ গ্রহণকারী মুসলমান গোনাহগার হয়ে যাবে।
একই ভাবে যখন শিষ্যরা প্রশ্ন করেন যে, যুক্তিশাস্ত্র অথবা ইংরেজি শিখা শাস্ত্রসম্মত কিনা, তখন অধ্যাপক জওয়াব দেন, বেছে থাকার জন্য যুক্তিশাস্ত্র অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয় নয়, কিন্তু একটা ভাষা শিখার জন্য ব্যাকরণ যেমন সাহায্য করে, বেচে থাকার জন্যও তেমনি যুক্তিশাস্ত্র সহায়তা করে। যদি কেউ ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এটা শিখে তবে সে গোনাহগার প্রতিপন্ন হবে। কিন্তু শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য শিখলে তাতে দোষের কিছু নেই। বই পড়া, চিঠিপত্র লেখা এবং শব্দ অন্তর্নিহিত অর্থ আয়ত্ব করার জন্য ইংরেজি শিখলে তা সমর্থন করতে আপত্তি নেই। জাইদ ইবনে সাবিত পয়গম্বরের নির্দেশে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ভাষা ও শব্দকোষ শিখেছিলেন, কারণ ইহুদী ও খ্রিস্টানরা পয়গম্বরের কাছে যে সকল চিঠিপত্র পাঠাত তার জওয়াব দেয়ার জন্য তাদের ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু কেউ যদি ইংরেজদের সাথে মেলামেশা করার জন্য কিংবা নিছক সখ করে ইংরেজি শিখে তবে সে ব্যক্তি ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে। এমনকি লোহার তৈরি অস্ত্র সম্পর্কেও বলা যায়, কেউ যদি চোর যাকাত তাড়ানো কিংবা তাদেরকে পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র নির্মাণ করে তবে সেটা হবে পুণ্যের কাজ; কিন্তু চোর ডাকাতের পক্ষে লড়ার জন্য যদি কেউ অস্ত্র নির্মাণ করে তবে সেটা নিঃসন্দেহে পাপকার্য বলেই বিবেচিত হবে।
অবশ্য, অধিকতর বিদ্বেষপরায়ণ মুসলমানরা আমাদের সরকারী স্কুলসমূহে প্রদত্ত শিক্ষাকে আইনানুগ বলে মেনে নিতে পারেনি। পার্থিব মনোভাবাপন্ন মুসলমানরা যখন এই ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়েছে, ধর্মান্ধরা তখন এই ব্যবস্থা থেকে আরও দূরে সরে গেছে। গত চল্লিশ বছরে পোশাক পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা ও অন্যান্য বাহ্যিক আচার ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিন্দুদের সাথে তাদের ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পেয়েছে; ঠিক মুসলমানি শাসনামলের মত তারা এখনও হিন্দুদের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সচেষ্ট। এমনকি ১৮৬০-৬২ সালেও আমাদের স্কুলসমূহে প্রতি দশজন হিন্দু ছাত্রের মধ্যে মাত্র একজন মুসলমান ছাত্র ছিল এবং তারপর থেকে মুসলমান ছাত্রের হার কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও সেটা সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি স্কুলের বেলায়ই প্রযোজ্য। সরকারী জেলা স্কুলগুলোতে অবস্থা আগের মতই রয়ে গিয়েছে। ইংরেজি স্কুলগুলোতে তাদের ছাত্র সংখ্যা বাড়েনি। ওয়াহাবী মামলায় সরকার পক্ষের যে ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি তথ্যের ভিত্তিতে আমি এসব কথা লিখছি এবং পূর্ব বাংলার সাথে যার ঘনিষ্ঠ পরিচয় রয়েছে তিনি জানিয়েছেন, মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা এত কম যে, মুসলমান জনসংখ্যার তুলনায় তা অতি নগণ্য।
প্রকৃত সত্যে এই যে, আমাদের জনশিক্ষা ব্যবস্থা তিনটি কারণে মুসলমানদের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়নি। প্রথমত, এই ব্যবস্থায় বাংলাভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়, যাকে শিক্ষিত মুসলমানরা বিজাতীয় ভাষা বলে মনে করে; এবং হিন্দু শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষা দান, যে হিন্দুকে গোটা মুসলমান সম্প্রদায় ঘৃণার চোখে দেখে। বাঙ্গালী শিক্ষক নিজের মাতৃভাষায় এবং বিকৃত উর্দুতে শিক্ষাদান করে। আমাদের মত তার কাছেও উর্দু বিদেশী ভাষা। অধিকন্তু শান্ত ও নম্র মেজাজের জন্য তার পক্ষে মুসলমান ছেলের ওপর শৃঙ্খলা আরোপ করা সম্ভব নয়। জনৈক মুসলমান কৃষক সম্প্রতি একজন ইংরেজ অফিসারের কাছে বলেছে, পৃথিবীর কোন প্রলোভনই আমার ছেলেকে কোন বাঙ্গালী শিক্ষকের কাছে পাঠাতে আমাকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, জীবনের সম্মানজনক স্থান অধিকার করা এবং স্বীয় ধর্মীয় কর্তব্য পালনের জন্য যে ভাষা শিক্ষা করা দরকার, আমাদের স্কুলগুলোতে তা শিখার সুযোগ মুসলমান ছাত্ররা কদাচিৎ পেয়ে থাকে। প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত মুসলমানেরই কিছুটা ফার্সি জানা চাই কিন্তু আমাদের উচ্চশ্রেণীর জেলা স্কুলগুলোতেও ফার্সী শেখার কোন সুযোগ নেই। ফার্সী (বাঙ্গালী মুসলমানদের কাছে ফার্সি প্রায় ধর্মীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। কারণ এই ভাষাতেই ইসলামী বিধি-বিধান ও শাস্ত্রীয় শিক্ষা তারা লাভ করেছে। ) ও আরবী হচ্ছে মুসলমানদের পবিত্র ভাষা এবং কৃষক থেকে রাজবংশজাত যেকোনো মুসলমানের নামায আদায় করার জন্য এই দুই ভাষার যেকোনো একটি জানা প্রয়োজন; কিন্তু এই দুটো ভাষা আমাদের স্কুলগুলোতে স্বীকৃতি পায়নি। অতি সম্প্রতি এ বিষয়টা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয় যে, মুসলমান যদি নির্ধারিত ভাষায় নামায না পড়ে তবে তা আল্লাহর কাছে প্রহনীয় হয়না। তৃতীয়ত, আমাদের সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় মুসলমান ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ নেই। এই বাস্তব অবস্থাটা খতিয়ে দেখা হয়নি যে, স্মরণাতীতকাল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য একটা বিশেষ যাজক শ্রেণী আছে, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে অনুরূপ কোন পৃথক যাজক শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটির ধর্মীয় শিক্ষায় পারদর্শী হতে হয় এবং তিনিই হচ্ছেন তার পরিবারের ধর্মীয় যাজক। অবশ্য, সামাজিক ধর্মানুষ্ঠানসমূহ মসজিদে হয়ে থাকে কিন্তু ইসলামের মহত্ব এই যে, তার প্রার্থনার জায়গা মানুষের তৈরি না হলেও চলে আল্লাহর আদমের যেকোনো স্থানে কিংবা আল্লাহর আসমানের নিচে যেকোনো জায়গায় মুসলমানরা প্রার্থনা করতে পারে। খাটি লৌকিক শিক্ষা খুব কম জাতির কাছেই গ্রহণীয় হয়ে থাকে। অনেক চিন্তাশীল লোকের মতে, এই ব্যবস্থা আয়ারল্যান্ডে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুসলিম বাংলার অশিক্ষিত ও ধর্মান্ধ কৃষকদের কাছেও তা গ্রহণ যোগ্য হবে না।
সুতরাং বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন এমন একজন রাষ্ট্রনীতিবিদের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলতে হয়: মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি কোনরূপ অনুগ্রহ দেখায়নি কিংবা তাদের অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিক্ষাদানের কোন ব্যবস্থা নেই এবং তাদের স্বার্থ ও সামাজিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী একটি ব্যবস্থা থেকে মুসলমানরা সরে দাঁড়িয়েছে এতে বিস্মিত হবার কি আছে?
প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা যে শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ অফিসারদের মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারছে, মুসলমানরা এই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করায় তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এটাই হল এ সমস্যার দুটি বিপরীত দিক। হিন্দুদের মন বিদ্বেষযুক্ত হওয়া স্বত্বেও মুসলমানরা তাদেরকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করবে তা আমরা বুঝতে অক্ষম। কিন্তু আসল যে সত্যটি তাদেরকে আলাদা করে রেখেছে যা আমাদের চোখে ধরা পড়েনি, সেটা হল, ধর্মীয় অনুভূতির মতই পুরনো একেশ্বরবাদ ও বহু দেবতাবাদের সেই প্রশ্নটি যা যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতিকে পৃথক করে রেখেছে। বহু দেবতাবাদ তার অনুসারীদের বিচিত্র উপাসনা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসকেও বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিভক্ত করেছে। একদা গিবন গ্রীকদের সম্পর্কে যে চমৎকার কথাটি বলেছিলেন তা বর্তমানকালের হিন্দুদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য: সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের মন জুড়ে রয়েছে যে অবিভাজ্য নিয়মিত পদ্ধতি, তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এক সহস্র অবিন্যস্ত ও পরিবর্তনশীল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গ্রীক উপাখ্যান গড়ে উঠেছে, এবং এখানে দেবতাদের ভক্তরাই তাদের ধর্ম বিশ্বাসের ধরন ও মাত্রা ঠিক করে নিতে পারে। (রোমান এম্পায়ার, দ্বিতীয় খন্ড; পৃঃ ৩৬০, ১৭৮৬ সালের কোয়ার্টো সংস্করণ) একরম স্বাধীনতা মুসলমানদের নেই। শাস্ত্র তাদের কাছে সম্পূর্ণ প্রাণবন্ত, এবং এমনকি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দাবী করে। সেই জন্য কোন জনশিক্ষা ব্যবস্থায় যদি ধর্মীয় নীতির প্রতিফলন না ঘটে তবে ইসলামের গোঁড়া ভক্তরা তাতে আদৌ সন্তুষ্ট হবে না।
খ্রিস্টান সরকার হিসেবে আমাদের নীতি বিসর্জন না দিয়ে এ ব্যাপারে মুসলমানদের প্রতি আমরা কতটা ন্যায়বিচার করতে পারব সে বিষয়ে পরে আলোচনা করব। ইত্যবসরে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আমরা সকল শ্রেণীর কাছ থেকে নির্বিচারে যে কর আদায় করি, তা বাংলায় কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্য প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যয় করা হচ্ছে বলে মুসলমানরা যে অভিযোগ তুলেছে তা একেবারে ভিত্তিহীন নয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ এটা নয়। আমাদের প্রবর্তিত জনশিক্ষা ব্যবস্থা যেমন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি আবার তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যে আর্থিক সাহায্য এতকাল তারা পেয়ে আসছিল সেটাও আমরা বিনষ্ট করেছি। বাংলার প্রত্যেকটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এমন একটা পৃথক তহবিলের ব্যবস্থা ছিল যার ফলে ঐ পরিবারের ছেলেরা ছাড়াও আশেপাশের গরীব ঘরের ছেলেরাও বিনা খরচায় লেখাপড়া শিখতে পারত। প্রদেশের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর ভাগ্যাবনতি ঘটার সাথে সাথে এই সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবং কার্যদক্ষতাও কমে যেতে লাগল। অবশ্য আমাদের শাসনের দ্বিতীয় অর্ধশতকের আগে পর্যন্ত আমরা তাদের বিরুদ্ধ ব্রিটিশ আইনের অনিবার্য ক্ষমতা প্রয়োগ করিনি। স্মরণাতীতকাল থেকে ভারতের দেশীয় নৃপতিরা তরণদের শিক্ষা এবং দেবতাদের পূজার ব্যয় নির্বাহের জন্য জমি দান করে আসছেন। এ ব্যাপারে তৎকালীন শাসকদের হাতে প্রশ্নাতীত ও সীমাহীন ক্ষমতা ছিল। মোগলদের ত্রুটিপূর্ণ শাসনে, এবং পরবর্তীকালের গোলযোগপূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে এই ক্ষমতার কতকটা প্রাদেশিক শাসকদের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাদেশিক শাসকরা এই ক্ষমতার বেশিরভাগই নিজেদের হাতে ছিনিয়ে নিয়ে আসে। সুদূর পূর্ববাংলায় কি ঘটছে তা নিয়ে দিল্লীর দরবারে তেমন একটা মাথা ছিল না; তারা শুধু প্রদেশের রাজস্ব পেয়েই খুশি ছিলেন। ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের বিলাসপ্রিয় শাসনকর্তাও একইভাবে জেলা প্রশাসনের বিস্তারিত বিষয়ের প্রতি অমনোযোগী ছিলেন। প্রত্যেক বড় ভূস্বামী নির্ধারিত ভূমি রাজস্ব পরিশোধ করতে পারলে তার অধীনস্থ জমি নিয়ে যা খুশী তাই করতে পারত। সে তার নিজের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মন্দির বা মসজিদের জন্য নিষ্কর জমি বন্দোবস্ত দিতে পারত। এবং সারা জীবনের শোষণ পীড়ন ও নিষ্ঠুরতা শেষ বয়সের বদান্যতা দিয়ে সবাই কাটাবার চেষ্টা করে।
আমরা যে সময় বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করি তখনকার সর্বাধিক কর্মদক্ষ রাজস্ব অফিসার (মিঃ জেমস গ্রান্ট)হিসেব করে দেখেন যে, গোটা প্রদেশের এক চতুর্থাংশ জমিই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। ১৭৭২ সালে ওরায়েন হেস্টিংস এই বিরাট প্রতারণা প্রত্যক্ষ করেন; কিন্তু তখন ঐ সব জামির রাজস্ব সরকারী অধিকারে আনার বিরুদ্ধে এত তীব্র মনোভাব বিরাজ করছিল যে, কোনরূপ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস অননুমোদিতভাবে বন্টিত সকল নিষ্কর জমির উপর সরকারের প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব আরোপের কথা পুনরায় জোরের সাথে উল্লেখ করেন। কিন্তু অধিকতর শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন সরকার এ বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায় এবং তারপর ১৮১৯ সালে সরকার পুনরায় নিজের অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন; কিন্তু সক্রিয় কর্মব্যবস্থা গ্রহণে এবারও দ্বিধান্বিত হন। কেবলমাত্র ১৮২৮ সালে আইনসভা এবং শাসন বিভাগ একতাবদ্ধ হয়ে এ ব্যাপারে বিরাট উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বহু সংখ্যক বিশেষ আদালত বসানো হয় এবং পরবর্তী আঠারো বছর গোটা প্রদেশ গুপ্ত সংবাদ সরবরাহকারী ভুয়া সাক্ষী এবং বিবর্ণ চেহারার রিজামশান অফিসারে ছেয়ে যায়।
পুনরুদ্ধারকৃত জমির উপর ৮ লক্ষ পাউন্ড আয়ের হিসাব ধরা হয় এবং রাষ্ট্রে বার্ষিক ৩ লক্ষ পাউন্ড অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের নিশ্চিত সুযোগ লাভ করে; আর এটা ছিল ৬০ লক্ষ ষ্টার্লিং এর পাঁচ শতাংশের সমান মূলধন। (ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া পত্রিকার ১৮৬৪ সালের ৩০শে এপ্রিল সংখ্যা দ্রষ্টব্য। রাজস্ব বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ পত্রিকাটির হিসাবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।)মুসলমানদের বা মুসলিম প্রতিষ্ঠানসমূহের দখলে যেসব নিষ্কর জমি ছিল সেখান থেকেই উপরোক্ত অর্থের বেশিরভাগ আদায় হয়। যে ভীতি ও ঘৃণা এতকাল ধরে চলে আসছিল, এখন তা পল্লী বাংলার জমির দলিলে স্থায়ী স্বাক্ষর একে দিল। শত শত প্রাচীন সম্ভ্রান্ত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল এবং নিষ্কর জমির আয়ের উপর নির্ভর করে মুসলমানদের যে শিক্ষা ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছিল তা মরণ আঘাত প্রাপ্ত হল। আঠারো বছরের (পুনরুদ্ধার কর্মসূচী প্রথম দিকে তীব্র আকারে কার্যকর করা হয় এবং তারপর কয়েক বছরের ঢিলেমীর পর ১৮৪৬ সালের ৪ঠা মার্চ তারিখের সরকারী নির্দেশ বলে এ কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়।) গড়িমসির ফলে মুসলমানদের মধ্যে যেসব শিক্ষিত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল তারাও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। যেকোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক এই ধারনা পোষণ করবেন যে, পুনরুদ্ধার আইনের দ্বারা আমাদের সংরক্ষিত অধিকার বলবৎ করা হলে এই আইনের প্রয়োগ মূলত ঃ চরম হয়রানিমূলক এবং ভারতীয় জনমতের বিরোধী বলে গণ্য হবে। প্রকাশ্য আইনের মোকাবিলায় অন্য কোন ব্যবস্থা টিকতে পারে না। আমাদের পুনরুদ্ধারকারী অফিসাররা দয়া মায়া বলতে কিছু জানত না; তারা নিশ্চিত মনে আইন কার্যকরী করে। সে সময় যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় তার স্মৃতি আজও অম্লান রয়েছে এবং এটা আমাদের তিক্ত ঘৃণার উত্তরাধিকারী করে রেখেছে। (ঢিলেমির পর ১৮৪৬ সালের ৪ঠা মার্চ তারিখের সরকারী নির্দেশ বলে এ কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়।) দেশীয় নৃপতিদের শাসনামলে শিক্ষিত ব্যক্তিরা যে মর্যাদা ও অর্থ রোজগারের সুযোগ পেতেন, পুনরুদ্ধার আইন প্রয়োগের পর বাংলায় তার অবসান ঘটে।
মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কারণ এই কাজে দান হিসেবে প্রাপ্ত সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ উপস্থিত করার ব্যাপারে ভারতের সাবেক শাসকশক্তির বংশধররা গর্বোদ্ধত ঔদাস্য প্রদর্শন করে তাদের এহেন ব্যবহার চতুর হিন্দুদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নিষ্কর সম্পত্তির সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণাদি উপস্থিত করতে বলা হয়; কিন্তু তৎকালীন প্রকৃত সম্পত্তি আইনের অনিশ্চিত অবস্থায় তারা তাদের স্বীকৃত ব্যক্তিগত ভূমি মালিকানার সমর্থনে অনুরূপ প্রমাণপত্র হাজির করতে পারেনি। প্রবল প্রতিবাদের মুখে পঁচাত্তর বছর ধরে আমরা একটা বিরাট জালিয়াতি পূর্ণ ব্যবস্থা সহ্য করে এসেছি এবং তার পুঞ্জিভূত কুফল একটি জেনারেশনের উপর নিপতিত হয়। ইতিমধ্যে বড় বড় দখলকারীরা দান হিসেবে প্রাপ্ত ঐসব সম্পত্তি নিয়ে নানা অনাচারে লিপ্ত হয় এবং স্বত্বাধিকার সম্পর্কিত দলিলে তাদের দাবী সমর্থিত হয়। এ বিষয়ে কদাচিৎ কোন সন্দেহ থাকতে পারে যে, আমাদের অপহৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার আইন যথেষ্ট ছিল না; তেমনি এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, পুনরুদ্ধার আইন প্রয়োগের সময় থেকেই মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের সূচনা হয় ওয়াহাবী মামলায় সরকার পক্ষের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অফিসারের মতে এই ঘটনাটি হচ্ছে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি বিলুপ্তির দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
এ সত্ত্বেও পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার ন্যায্যতা স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষা তহবিল সম্পূর্ণ তসরুপ করা হয়েছে বলে মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে তা ধোপে টিকে না। তবে এটা গোপন করা ঠিক হবে না যে উদ্ধারপ্রাপ্ত সম্পত্তি যদি আমরা তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে পরতাম তাহলে বর্তমানে বাংলায় মুসলমানরা অতি মহৎ ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতির একটা শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হত। ১৮০৬ সালে হুগলী জেলার একজন ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত মুসলমান মৃত্যুর সময় তার বিরাট জমিদারী সৎকার্যে ব্যয়ের জন্য দান করে যান। পরে তার দুইজন ট্রাষ্টির মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে যায়। ১৮১০ সালে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সম্পত্তি অপব্যবহারের অভিযোগ আনলে সংকট গভীরতর হয়। এবং জেলার ইংরেজ কালেক্টর আদালতের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষ সম্পত্তির দখল নিয়ে নেন। ১৮১৬ সাল পর্যন্ত মোকদ্দমা চলতে থাকে এবং তখন উভয় ট্রাষ্টিকে বরখাস্ত করে উক্ত জমিদারীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করে। একজন ট্রাষ্টির জায়গায় সরকার নিজেই দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির জায়গায় নতুন একজন ট্রাষ্টি মনোনীত করা হয়। পরের বছর নির্ধারিত রাজস্ব প্রদানের শর্তে সকল সম্পত্তি ইজারা দেওয়া হয়। মামলা চলাকালীন বকেয়া পাওনাসহ ইজারা বাবদ প্রাপ্ত মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৫৭০০ ষ্টার্লিং পাউন্ড; এই আয় থেকেই কলেজ বিল্ডিং এর মূল্য পরিশোধ করা হয়) এছাড়াও জমিদারীর বার্ষিক আয় থেকে এ পর্যন্ত ১২০০০ ষ্টার্লিং পাউন্ডের অধিক উদ্বৃত্ত রয়েছে।
আগেই বলেছি যে, জমিদারীর আয় বিভিন্ন সৎ কাজে ব্যয় করার জন্য ট্রাস্ট গঠিত হয়। উইলে যেসব সৎ কাজে ব্যয় করার কথা বলা হয় তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সংরক্ষণ, ইমামবাড়ী বা হুগলীর বড় মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং একটি গোরস্তান, কতিপয় বৃত্তি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ যোগান দেওয়া ট্রাস্ট গঠনের উদ্দেশ্যে আওতায় আসে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার ইচ্ছানুসারে সেটাকে মুসলমানদের রীতি মাফিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে হবে। মুসলিম দেশগুলোতে মেধাবী দরিদ্র ছাত্রদের জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করাকে ধর্মীয় কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু তহবিলের অর্থ কোন অ-মুসলিম কলেজের কাজে ব্যয় করা উইলকারীর ইচ্ছার ব্যতিক্রম বলে বিবেচিত হবে। এবং সেটা ট্রাষ্টিদের ক্ষমতার গুরুতর অপব্যবহার হিসেবেই গণ্য হবে। কিন্তু কোন মুসলমানের দানের সাথে ধর্মীয় উদ্দেশ্য এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে যে শিয়া সম্প্রদায়ের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রবর্তিত ট্রাস্টকে সুন্নি মুসলমানদের শিক্ষার কাজে নিয়োজিত করার বৈধতা সরকারকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
সুতরাং এই তহবিলের টাকা একটি ইংরেজি কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করারয় মুসলমানরা কিরূপ ক্রোধের সাথে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে তহবিল তসরূপকারীর অভিযোগ আনতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। কার্যত হয়েছেও তাই। কেবলমাত্র ইসলামী ধর্মীয় কাজে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সম্পত্তির টাকা দিয়ে সরকার এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে যেখানে ইসলামের নীতিবিরোধী বিষয়সমূহ শিক্ষা দেওয়া হয়। এবং যে প্রতিষ্ঠান থেকে মুসলমানদের কার্যত বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ একজন ইংরেজ ভদ্রলোক যিনি ফার্সী বা আরবী ভাষার একটি বর্ণও জানেন না। মুসলমানরা ঘৃণা করে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই অধ্যক্ষ কেবলমাত্র মুসলমানদের কাজে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত তহবিল থেকে বছরে ১৫০০ ষ্টার্লিং পাউন্ড বেতন পেয়ে থাকেন অবশ্য এটা ঐ অধ্যক্ষের কোন অপরাধ নয়; এজন্য অপরাধী হচ্ছে সরকার যে নাকি ঐ দায়িত্বে তাকে নিযুক্ত করেছে। গত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত সরকার এ বিরাট শিক্ষা তহবিলের অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবে তসরুপ করে আসছে। সরকারের নিজের গুরুত্বর বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ ঢাকা দেওয়া ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে ইংরেজি কলেজটির সাথে একটি ছোট মুসলমান স্কুলকে সংশ্লিষ্ট করে কলেজের বিল্ডিং নির্মাণের জন্য উক্ত তহবিলের বিরাট অংকের টাকা তসরুপ করা ছাড়াও কলেজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও তহবিল থেকে বার্ষিক ৫০০০ ষ্টার্লিং পাউন্ড ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ প্রকৃত অবস্থাটা হচ্ছে এই যে, তহবিলের ৫২৬০ ষ্টার্লিং পাউন্ড আয়ের মধ্যে সরকার মাত্র ৩৫০ ষ্টার্লিং পাউন্ড উক্ত ক্ষুদ্র মুসলিম স্কুলের জন্য ব্যয় করছে। এবং ট্রাষ্টের মৌল বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ হিসেবে এই ক্ষুদ্র মুসলিম স্কুলটিই শুধু টিকে আছে।
এই তসরুপের অভিযোগ নিয়ে বাদানুবাদ করা খুব কষ্টকর ব্যাপার, কারণ এ অভিযোগ খণ্ডন করা সম্ভবপর নয়। মুসলমানরা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে যে, মুসলমানদের এই বিরাট ধর্মীয় সম্পত্তির মালিকানা দখলের অসদুদ্দেশ্যে বিধর্মী ইংরেজ সরকার সম্পত্তির মুসলিম ট্রাস্টিদের অব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেছে; এবং তারপর দাতার পবিত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যের বরখেলাপ করে সরকার মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন, যার ফলে সরকারের কৃত অপরাধ অধিকতর গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, কয়েক বছর আগে আলোচ্য ইংরেজি কলেজের মোট তিনশ ছাত্রের মধ্যে এক শতাংশও মুসলমান ছিল না; এবং তারপর এই অবমাননাকর বৈষম্য হ্রাস পেলেও অবিচারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অসন্তোষ এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছেন এমন একজন সিভিলিয়ান লিখেছেন ঃ এই বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার নিজের কাজের দ্বারা যে ঘৃণা ও অমাননা কুড়িয়েছেন তাকে অতিরঞ্জিত করে দেখা অসুবিধাজনক বলে আমি মনে করি। আমার মন্তব্যের ভাষা কঠোর মনে হতে পারে, কিন্তু আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারি যে ভারতে আমার আটাশ বছর বসবাসকালে আমি বিষয়টির সত্যাসত্য যাচাই করে দেখেছি (এদেশে প্রথম আগমনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমি হুগলী সফর করি) এবং আমি বলতে পারি যে, তখন এদেশীয় বা ইউরোপীয় কারো কাছ থেকেই অন্য কিছু আমি শুনিনি। যথার্থ হোক বা না হোক মুসলমানরা মনে করে যে, এ ব্যাপারে সরকার তাদের প্রতি অন্যায় ও সংকীর্ণমনা আচরণ করেছে; এবং তাদের কাছে এটা একটা স্থায়ী তিক্ত অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়েছে।
ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা যেসব অন্যায় ব্যবহারের অভিযোগ উত্থাপন করেছে এখানেই তার শেষ নয়। তাদের অভিযোগ শুধু এই নয় যে, আমরা তাদেরকে আত্মোন্নতির যাবতীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছি। বরং এ অভিযোগও তারা তুলেছে যে, আগামীতেও তাদের কল্যাণের যাবতীয় পথ আমরা রুদ্ধ করে ফেলেছি। সব মহৎ ধর্মের অনুসারীরাই তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য বিশেষ বিশেষ দিন নির্দিষ্ট করে রেখেছে। কোন বৈদেশিক বিজেতা যদি ঘোষণা করে যে, রবিবার আর ছুটির দিন বলে গণ্য হবে না, তাহলে ইংরেজদের মনে যে ক্রোধ ও ক্ষোভের সঞ্চার হবে তা সহজেই অনুমেয়। নিজেদের ধর্মীয় পর্ব সম্পর্কে মুসলমানদেরও মনেও একই ভাবালুতা বিদ্যমান। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে জনসাধারণের এই মনোভাবের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি। কিন্তু পূর্ববাংলায় মুসলমানরা সম্প্রতি এতদূর দৃষ্টির অন্তরালে তলিয়ে গেছে যে, তাদের ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তার প্রতি আমরা ক্রমাগত উপেক্ষা ও পরে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে সব শেষে একেবারে অস্বীকার করেছি। গত বছর হাইকোর্টের মুসলমান উকিলরা এ বিষয়ে দুইটি স্মারকলিপি পেশ করেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে, খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের বেলায় যথাক্রমে বাষট্টি ও বায়ান্ন দিন করে ছুটি মঞ্জুর করা হলেও মুসলমানদের জন্য মঞ্জুর করা হয়েছে মাত্র এগার দিন। ইতোপূর্বে মুসলমানদের জন্যে একুশ দিন ছুটি বরাদ্দ ছিল; এবং আবেদনকারীরা বর্তমানে শুধু এই প্রার্থনাই পেশ করছে যে, তাদের ছুটির দিন কমাতে কমাতে যে এগার দিনে এনে ঠেকানো হয়েছে,সেখান থেকে আর যেন কমানো না হয়। এই আবেদনের দ্রুত প্রতিক্রিয়া হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ জারি করা হয় যে, নেটিভদের জন্য অন্যান্য সরকারী অফিসে ছুটির যে সুযোগ প্রচলিত আছে হাইকোর্টেও যেন তা পালন করা হয়। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, অন্যান্য সরকারী অফিসে মুসলমানদের পর্ব উপলক্ষে কোন সরকারী ছুটি আদৌ মঞ্জুর করতে পারে; কিন্তু ঐ সব দিন অফিস খোলা থাকবে এবং স্বাভাবিক কাজকর্মও চলতে থাকবে।
মুসলমান উকিলরা উল্লেখ করে যে, অনুমতি নিয়ে ছুটি ভোগ করার এই ব্যবস্থায় কিছুতেই সরকারী আদালতের ছুটির চাহিদা পূরণ হতে পারে না। এই সব আদালতকে শুধ কর্মচারী ও আইনজীবীদের প্রয়োজন বিবেচনা বললেই চলবে না, মামলাকারী জনসাধারণের প্রয়োজন ও বিবেচনায় আনতে হবে। তারা উল্লেখ করে যে, মুসলিম আইনজীবীর সংখ্যা হ্রাস পেলেও রেল যোগাযোগের সুবিধার ফলে মুসলিম মামলাকারীদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমানি ছুটির দিন মুসলমান আইনজীবীদের অবকাশ ভোগের সুযোগ দেওয়া হলেও ঐ দিন আদালত খোলা থাকলে তারা নিশ্চিন্তে ছুটি ভোগ করতে পারবে না; কারণ সে অবস্থায় তাদের মক্কেলদের মোকদ্দমা হিন্দু বা ইংরেজ আইনজীবীদের হাতে চলে যাবে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, উপরোক্ত সরকারী নির্দেশ মুসলমানদের যাবতীয় ধর্মীয় পর্বের দিন ছুটি বিলোপ করার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় পর্বের দিন ছুটির যে রেওয়াজ গত সাতাশ বছর যাবত আদালতে চালু ছিল, উক্ত নির্দেশে তাকে অকেজো করে ফেলা হয়েছে। হিন্দু ও খ্রিস্টানদের যদি তাদের ধর্মীয় পর্ব উপলক্ষে ছুটির সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আপনার আবেদনকারীদের প্রার্থনা এই যে, মুসলমানদেরও তাদের ধর্মীয় পর্বের দিনগুলোতে ছুটি ভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। (অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি ও সহযোগী বিচারপতিদের কাছে পেশকৃত হাইকোর্টের মুসলমান আইনজীবীদের স্মারকলিপির ৩য় অনুচ্ছেদ) তাদের কষ্ট আরো বেড়েছে এ কারণে যে, দুটি ধর্মোৎসব (ঈদুল ফিতরের ৩দিন এবং ঈদুজ্জোহার একদিন) ছাড়া মুসলমানদের অন্যান্য পর্বগুলো দুঃখ ও বেদনায় স্মৃতিবাহী হওয়ায় ঐ সব দিন প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষে দুনিয়ার কাজকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
যে সম্প্রদায়ের লোকের আগে সারা ভারত জুড়ে আইন বিভাগের চাকরিতে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করেছে, তাদের অবস্থা আজ এতদূর নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে আনন্দের বিসয়, অন্ততঃ এই অবিচারটি কার্যকরী হতে দেয়া হয়নি। সর্বোচ্চ সরকার কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে মুসলমানদের ছুটির কতিপয় দিন আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। অবশ্য, মুসলমানরা যতদিনের ছুটি দাবী করেছিল তার সব পূরণ হয়নি বটে; তাহলেও সরকার কাজকর্ম সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা ক্ষুণ্ণ না করে যতটা সম্ভব, বিশেষ করে তাদের প্রধান প্রধান ধর্মোৎসবের দিনগুলোকে ছুটির দিন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
আরেকটা অভিযোগ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। মুসলমানরা অভিযোগ করেছে যে, আমাদের প্রবর্তিত ব্যবস্থায় তারা শুধু যে আইন ব্যবসায়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাই নয়, এমনকি আমাদের আইনসভা কর্তৃক প্রণীত একটি বিধান তাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ধর্মীয় পদের বিলুপ্তি সাধন করেছে। এই পদের বিলুপ্তির ফলে পারিবারিক ও ধর্মীয় আইন কানুনের সুযোগ থেকে মুসলমানরা বঞ্চিত হবে। ক্রিমিনাল সিভিল এবং ধর্মীয় আইনের অনেক বিষয়ের বিচার কাজী সম্পন্ন করে থাকে। প্রথম যখন আমরা এদেশের কর্তৃত্ব লাভ করি তখন বিচারের যাবতীয় দায়িত্ব কাজীর উপর ন্যস্ত রাখাই আমরা সঙ্গত বলে মনে করেছিলাম। আমাদের প্রাথমিক বিধানে এই পদের গুরুত্ব স্বীকার করে তা বহাল রাখা হয়। এবং ভারতীয় সংবিধান পুস্তকে কাজীর দায়িত্ব বর্ণনা করে পঁচিশটি রেগুলেশনের যে দীর্ঘ তালিকা সন্নিবেশিত হয় তা আজও পড়ে দেখা যেতে পারে। (বেঙ্গল কোড রেগুলেশন ৪ ১৭৯৩, রেগুলেশন ১২ ১৭৯৩ম রেগুলেশন ১৭৯৩, রেগুলেশন ৮ ১৭৯৫, রেগুলেশন ৯ ১৭৯৫, রেগুলেশন ৩৯, ১৯ ১৭৯৫, রেগুলেশন ২ ১৭৯৮, রেগুলেশন ৩ ১৮০৩, রেগুলেশন ১১ ১৮০৩, রেগুলেশন ১৭ ১৮০৩, রেগুলেশন ১০, ১৮০৬, রেগুলেশন ৮ ১৮০৯, রেগুলেশন ১৮ ১৮১৭, রেগুলেশন ২১ ১৮২৬, রেগুলেশন ১৮২৭, রেগুলেশন ৩ ১৮২৯; মাদ্রাজ কোড রেগুলেশন ২১, ১৮০২, রেগুলেশন ৩ ১৮০৮, রেগুলেশন ৭ ১৮২২, এ্যাক্ট ২৭ ১৮৬৩, এ্যাক্ট ৭ ১৮৪৩, এ্যাক্ট ৫ ১৮৫৪ খৃঃ) মুসলমানদের পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের জন্য কাজীর প্রয়োজনীয়তা এরূপ অপরিহার্য যে, মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদরা সিদ্ধান্ত করেন যে, কাজীর পদ যতদিন বহাল থাকবে ততদিন ভারত ইসলামী দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে, কিন্তু এই পদের অবলুপ্তির সাথে সাথে ভারত শত্রুদের দেশে রূপান্তরিত হবে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, কেবলমাত্র অতি সম্প্রতি আমরা মুসলমানদের মনোভাবের সাথে পরিচিত হয়েছি; তাও মুসলমানদের বৈরী মনোভাবের জন্যই আমরা বাধ্য হয়েছি তাদের সমস্যা জানতে। ১৮৬৩ সালে একজন প্রাদেশিক গভর্নরটি ধারণা করেছিলেন যে, মুসলমানরা নিজেরাই হয়ত কাজী পদে লোক নিয়োগের কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে।বোম্বাই থেকেও কাজী বহাল রাখার বিরুদ্ধে আপত্তি ওঠে। প্রশ্নটা নিয়ে আরো কিছু আলোচনার পর এতদসংক্রান্ত সকল পূর্ববর্তী আইন রহিত করা হয় এবং সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কাজী পদে লোক নিয়োগ প্রথা বিলুপ্ত করেন (পুরনো যে সব রেগুলেশনের বলে কাজী পদে লোক নিয়োগ করা হত, ১৮৬৪ সালের ২১নং আইন বলে তা রহিত করা হয়। পরে ১৮৬৮ সালের ৮নং আইনের তফসিল অনুসারে এই পদে পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হয়)।
গত সাত বছর যাবত বিপুল সংখ্যক মুসলমান, যাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, বিয়ে শাদী ও পারিবারিক প্রয়োজনে অন্যান্য অপরিহার্য কাজকর্ম সম্পাদনে কাজীর সাহায্য থেকে বঞ্চিত রয়েছে। নতুন আইনের ক্ষতিকর দিকটা অনেক পরে ধরা পড়ে। কারণ পুরনো কাজীরা থেকে যায়; এবং কেবলমাত্র কেউ পরলোকগমন করলে বা অবসরগ্রহণ করলে শূন্যস্থান পূরণের প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় সে ক্ষেত্রেই শুধু আইন কার্যকরী হয় প্রথমদিকে বিষয়টি বর্তমান বড়লাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে; কিন্তু ১৮৭০ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট এবিষয়ে সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত এ সম্পর্কে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বিচারপতি কলেটের সিদ্ধান্ত (১৮৬৯ সালের অরিজিনাল স্যুট নং ৪৫৩ মোহাম্মাদ আবু বকর বনাম মীর গোলাম হোসেন আরো একজনের মধ্যেকার মামলা) ঘোষিত হওয়ার পর আর কোন সন্দেহ থাকল না যে, একমাত্র ক্ষমতাসীন সরকারই কাজী নিয়োগ করতে পারবে। এবং সরকার কাউকে নিয়োগ না করলে সে ক্ষেত্রে মনোনয়ন দানের কোন ক্ষমতা মুসলমানদের নেই। অতএব ১৮৬৪ সালেরই আইন মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় বিধান কার্যকরী করার অপরিহার্য অফিসারের সাহায্য থেকে বঞ্চিত করে হস্তান্তর দলিলের মুসাবিদা প্রণয়ন ও সত্যায়িত করণ, বিবাহ উৎসব এবং আরো কতিপয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করা ছিল কাজীর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বর্তমানে সমতল বাংলায় যে জটিল সমস্যা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিব্রত করে ফেলেছে সেটা হল মুসলমানদের বিবাহ সংক্রান্ত মোকদ্দমা। যেকোনো কারণে হোক, বিবাহের শর্তাবলীর কঠোরতা ইদানীং শিথিল হয়েছে। বদ্বীপ অঞ্চলের জিলাগুলোতে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত ব্যভিচার বা অপহরণের অভিযোগ ক্রমাগত আদালতে দায়ের হচ্ছে। এবং দশটির মধ্যে নয়টি মামলাতেই বিবাহের বৈধতা প্রমাণ করা কঠিন। কাজী পদে সরকারীভাবে লোক নিয়োগ বন্ধ হওয়ার দুবছর আগে ১৮৬২ সালে পূর্ব বাংলার দুটি বিভাগে অনুরূপ মামলার সংখ্যা ছিল ৫৬১টি, কিন্তু সরকারীভাবে কাজী নিয়োগ বন্ধ হওয়ার দুবছর পরে ১৮৬৬ সালে এই মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৪টিতে এসে দাড়ায়। তারপর থেকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় এই ধরণের মামলার সংখ্যা হ্রাস পেলেও দেওয়ানী আদালতে তা সমানে রুজু হতে থাকে। (ভারতীয় দণ্ডবিধির কার্যকারিতা সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়াই বিবাহ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে আমরা ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত করায় বিবাহ আইন সুস্পষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ করার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। অত্যন্ত অসময়ে আমরা মুসলিম বিবাহ অফিসারের পদ বিলোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।)
ওয়াহাবী মামলার ভারপ্রাপ্ত জনৈক অফিসারের গুরুত্বপূর্ণ নোট থেকে উপরের তথ্যগুলো আমি সংগ্রহ করেছি। কিন্তু কাজী পদে লোক নিয়োগ সরকারীভাবে রহিত করার রাজনৈতিক ক্ষতিকর দিকটি বর্ণনা করে অধিকতর গুরুত্বসম্পন্ন আরেকজন অভিজ্ঞ অফিসার লিখেছেন: আমার মতে, ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কাজী পদ বিলুপ্তির দুটি ক্ষতিকর দিক রয়েছে। বিদ্বেষ পরায়ণ অর্ধ শিক্ষিত (এই শ্রেণী থেকে কাজী নিয়োগ করা হত এবং তারা এই পদকেই তাদের আত্মোন্নতির উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল।) লোকের জীবিকার কোন বিকল্প উপায় খুঁজে না পেয়ে বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগে অশিক্ষিত মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে রাজদ্রোহমূলক প্রচারণায় আত্মনিয়োগ করেছে। কিন্তু এরা আরো একটি সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর দিকে রয়েছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে কর্মরত কাজীর অবর্তমানে কোন মুসলমানের জীবন তার ধর্মীয় বিধিবিধান মোতাবেক সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আচার অনুষ্ঠানেই যে কেবল কাজীর অনুমোদন প্রয়োজন তাই নয়, এমনকি আরো অনেক ছোটখাটো ধর্মীয় ব্যাপারে কাজীর অবর্তমানে মুসলমানদের কাজ চালানো কঠিন, কারণ এসব ব্যাপারে বেকল কাজীই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারে। সুতরাং এহেন অফিসারের পদ বিলুপ্ত হলে সরকারের অবাধ্য যেকোনো লোক জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তোলার অবাধ সুযোগ পেয়ে যাবে। এবং তারা মুসলমানদের কাছে এ কথা বুঝাবে যে, এই সরকারের অধীনে মুসলমানদের বসবাস করা আর সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে সরকার নিযুক্ত কাজীকে ব্যবহার করা ও স্বীকার করে নেয়ার অর্থ হল সরকারের কর্তৃত্ব ও আইনসংগত অস্তিত্ব মেনে নেয়া।
ভারতীয় আইনসভায় যতগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে, এটা তার অন্যতম কোন স্বীকৃত সাময়িক দখলের অধীনে, যেমন আলজিয়ার্সে কাজী পদে সরকারী অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে, ব্রিটিশ ভারতের মত একটি রাষ্ট্রে যেখানে স্থিতিশীল বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে অনুরূপ পদে সরকারী অনুমোদন ও স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। বিষয়টি বিতর্কমূলক, কিন্তু ইতিমধ্যে মাদ্রাজ হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত কাজী পদের মর্যাদা ও আইনানুগ কর্তৃত্বকে বাতিল করে দিয়েছে। বিপদমুক্তভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হলে বিষয়টির সকল দিকগুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা এবং ভারতের দশটি প্রাদেশিক সরকারের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করা প্রয়োজন। তবে বড়লাট যে সদিচ্ছা প্রণোদিত মনোভাব গ্রহণ করেছেন এবং পূর্ববর্তী ভ্রান্তি সংশোধন করে যেকোনো মূল্যে মুসলমানদের প্রতি ন্যায়বিচার করার যে দৃঢ় সংকল্প সরকার নিয়েছেন তাতে করে আশা করা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধ মুসলমানদের অভিযোগের তালিকা থৈকে আলোচ্য বিষয়টিও প্রত্যাহৃত হবে।
পূর্ববাংলার মুসলমানদের প্রতি বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে যে উপেক্ষা ও অপমানজনক ব্যবহার প্রদর্শিত হয়েছে, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যেও তার প্রমাণ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের সকল ওরিয়েন্টাল জার্নাল ও লাইব্রেরী থেকে এবং আত্মোন্নতির অন্যান্য সকল ক্ষেত্র থেকেই পূর্বাঞ্চলের এই সাবেক বিজেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। পুরনো কোর্ট অব ডাইরেক্টরবৃন্দ মুসলমান হিন্দুদের মধ্যে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা সমভাবে বণ্টন করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন; এবং বাইবেলের পূর্ববর্তী ভারতীয় সংস্করণগুলোতে আরবী ও ফার্সী ভাষার যে বিস্ময়কর পাণ্ডিত্য প্রতিফলিত হয়েছে তা এই রাজনৈতিক সুবিচারেরই পরিচায়ক। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয় সাহিত্যঙ্গন থেকে হিন্দুরা মুসলমানদের সমভাবে বহিষ্কৃত করেছে। বাংলায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার একদেশদর্শী নীতির মত বাইবেলের ভারতীয় সংস্করণের জন্য কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এর বরাদ্দকৃত বার্ষিক ৬০০ পাউন্ডের অনুদানও পক্ষপাতমূলকভাবে বন্টিত হয়েছে। ডক্টর রোয়ারের আমলে ১৮৪৭ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে আরবী ফার্সী ও সাহিত্যকর্মের জন্য কদাচিৎ দু একটি বড় রকমের রচনা কার্য শুরু করা হলেও তা সম্পূর্ণ করা হয়নি।
ডক্টর হোরেস হাইম্যান উইলসনের প্রবর্তিত অতি উৎসাহমূলক সংস্কৃত স্কলারশিপ আরবী সাহিত্যকর্মের উপরে ভারতীয় সাহিত্যকে অগ্রগণ্য করার একটা নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখান যেতে পারে। তার দ্বারা উৎসাহিত হয়েই কোট অব ডাইরেক্টর্স এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যে, অতঃপর বাইবেলের ভারতীয় সংস্করণ শুধুমাত্র ভারতীয় বিষয়াবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বার্ষিক ৬০০ পাউন্ডের অনুদান প্রত্যাহারের দুঃখজনক সিদ্ধান্তও তারা গ্রহণ করেন। চরিত্রবল ও নিজের বিষয়সমূহের উপর গভীর দক্ষতাসম্পন্ন এই ব্যক্তিটি বেশিদিন এই দায়িত্বে বহাল থাকেননি। ডক্টর এইচ, উইলসন আধুনিক সংস্কৃত শিক্ষার মূল ভিত্তি রচনা করনে এবং তার উপর ভিত্তি করেই ম্যাক্সমুলর বর্তমানে কারুকার্যময় সৌধ রচনায় ব্যাপৃত আছেন। ইতিমধ্যে গোল্ড স্ট্যাকার আউপ্রেট ফিজ এডওয়ার্ড হল এবং মূল ভিত্তিটাকে এমনভাবে মজবুত করে তুলেছেন যাতে করে এই সুন্দর সৌধটি চিরকাল টিকে থাকতে পারে।
কিন্তু সেমিটিক স্কলারদের একটা ক্ষুদ্রদল এখনও সংঘবদ্ধভাবে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার চেষ্টায় ব্যাপৃত আছেন। কোট অ ডাইরেক্টর্স কোন অভারতীয় পরিকল্পনায় সাহায্য না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেমিটিক পণ্ডিতরা এই ব্যাপারটা নিয়ে লড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং বাধ্য হয়ে তারা আরবী সাহিত্যকর্মের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। তারা মুসলমান সাম্রাজ্যের ফার্সী সাহিত্যকর্মের মধ্যেই শুধু তাদের কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। স্যার হেনরী ইলিয়ট অবিচলিতভাবে তার কা চালিয়ে যান। মিঃ থমাস, মিঃ হ্যামন্ড স্যার উইলিয়াম মূর এবং আরো কতিপয় সিভিলিয়ানের একটা চমৎকার গ্রুপ দূরবর্তী কোট অব ডাইরেক্টর্স কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত সুযোগ সুবিধাগুলো স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে সমর্থ হন। ১৫৫ সালে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফার্সী এম এস এস সংগ্রহের জন্য সরকারী তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব মঞ্জুর করেন। প্রথম উদ্যোগেই ৬৭টি গ্রন্থ সংগৃহীত হয়। মিঃ থমাসের প্রশংসনীয় সম্পাদনায় স্যার হেনরী ইলিয়টের নিবন্ধগুলো প্রকাশিত হওয়ায় প্রফেসর ডউসন এবং মিঃ বীমশ ব্যাপকতর ক্ষেত্রে কার্যরত রয়েছেন। এদিকে লক্ষৌর মুসলমান চাপাখান থেকে বিভিন্ন ধরনের বই চেপে বেরুচ্ছে। কর্নেল নাসাউ লেস তার সকল প্রভাব ও জ্ঞান এই কাজে নিয়োজিত করেছেন। এবং ইন্ডিয়া অফিসের নবনিযুক্ত লাইব্রেরিয়ান ডক্টর রোস্টের সহযোগিতায় প্রাচ্য দেশীয় ভাষা বিদরা একটা অতি উল্লেখযোগ্য বৃত্তি লাভ করেছেন। ভারতেও শুভ সূচনা দেখা দিয়েছে। এবং এখানে মিঃ ব্লকম্যানের মত একজন কর্মৎসাহী পণ্ডিত ব্যক্তি প্রাচ্য দেশীয় সাহিত্যকর্মে ইতিমধ্যে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছেন।
মুসলমানদের দরখাস্ত এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ নিয় আলোচনা করলাম। তহবিল তসরুপ এবং অবিচারের যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তারা এনেছে, তার সমাধানের দায়িত্ব সরকারের। গত দুবছরে সরকার অসন্তোষ নিরসনের এবং অসন্তোষের কারণসমূহ দূরীকরণের জন্য আন্তরিক প্রয়াস নিয়েছেন। কিন্তু মুসলমানদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের যে সাধারণ ও সাময়িক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সে সম্পর্কে আমার কিছু বলার আছে। অভিযোগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে আমাদের প্রবর্তিত অসম শিক্ষা ব্যবস্থাই হচ্ছে তাদের ক্ষোভের মূল কারণ। এই শিক্ষায় সুশিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলার মুসলমানরা জীবনে উন্নতি সাধন কিংবা সরকারী চাকরিতে ন্যায্য অংশ লাভের আশা করতে পারে না। কিন্তু আমাদের স্কুলসমূহে মুসলমানি শিক্ষার প্রবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণে তারা এগিয়েও আসবে না। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটা আমার মতে, অত্যন্ত সহজ এবং ব্যয়মুক্ত। তবে সে বিষয়ের অবতারণার আগে ইতিমধ্যেই আমরা এতদসংক্রান্ত বিরাট উদ্যোগ নিয়েছি সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব ভারতে মুসলমানদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে ইংরেজরা ব্যর্থ হয়েছে; কিন্তু দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করতে গিয়ে তারা যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে কেবল সেগুলো আলোচনা করাই সঙ্গত হবে।
ঠিক নব্বই বছর ধরে রাষ্ট্রীয় খরচায় কলকাতার মুসলমানদের একটি কলেজ চালিয়ে আসা হচ্ছে। (বাংলায় এই কলেজটি মাদরাসা নামে পরিচিত) জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এটি তাদের অন্যতম। মুসলমানদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্য বঞ্চিত পরিবর্তনটি ১৭৮১ সালে বড়লাটের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এবং তাদেরকে তিনি এই উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করতে থাকেন। বড় বড় মুসলমান পরিবারগুলোর আর্থিক সঙ্গতি বিনষ্ট হওয়ায় তাদের সন্তানদের উপরি স্তরের সরকারী চাকরির উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার সামর্থ্য তারা হারিয়ে ফেলেন। তাদের অনুকূলে সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ওয়ারেন হেষ্টিংস রাজধানীতে একটা মোহামেডান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার স্থায়ী ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিলের একটা অংশ বরাদ্দ করেন। মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে কলেজটির পরিচালনার দায়িত্ব তিনি মুসলমানদের উপর ন্যস্ত করেন। সরকারী চাকরির জন্য ফার্সী ও আরবির প্রয়োজনীয়তা রহিত হওয়ার দীর্ঘকাল পরেও কলেজটিতে শিক্ষার একমাত্র বাহন হিসেবে আরবী ও ফার্সী চালু রাখা হয়। প্রাপ্ত সুযোগে বড় রকমের অপব্যবহার ঘটার পর ১৮১৯ সালে কলেজটিতে একজন ইউরোপীয় সেক্রেটারি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮২৬ সালে একটি ইংরেজি ক্লাস চালু করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অল্পদিনের মধ্যেই সেটা বন্ধ করতে হয়। তিন বছর পর অধিকতর প্রয়োজনীয় সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তাতেও প্রয়োজনীয় সুফল পাওয়া যায়নি। পরবর্তী পঁচিশ বছর কলেজটির কথা দৃষ্টির অগোচরে চলে যায় এবং স্থানীয় সরকার এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অসহিঞ্চু হয়ে পড়েন।
১৮৫১ থেকে ১৮৫৩ সালের মধ্যে কর্তৃপক্ষ অনুভব করেন যে, শোচনীয় অবস্থায় পতিত এই প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারের জন্য কিছু করা দরকার। এ সম্পর্কে উত্থাপিত প্রস্তাবের (ফার্সী ও আরবীতে ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন এবং মুসলমানদের আস্থাভাজন সিভিলিয়ান মিঃ জে. আর কলভিন প্রস্তাবটি পেশ করেন। মিঃ থমসনের মৃত্যুর পর তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় আগ্রা দুর্গে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ) ফলাফল দুরকমের হয়। কলেজটিকে দুটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। নিম্নতর বিভাগের মধ্যম মানের (বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকার সমান মান) উর্দু, ফার্সী ও ইংরেজি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয় এবং এই বিভাগের নাম রাখা হয় এ্যাংলো পার্সিয়ান শাখা। উচ্চতর বিভাগে কেবলমাত্র আরবী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এই পরিকল্পনার ত্রুটি অনতিকাল মধ্যে ধরা পড়ে। ছাত্ররা উচ্চতর বিভাগের আরবী শাখায় প্রবেশের পর নিম্নতর বিভাগে বিভিন্ন ভাষায় প্রাপ্ত শিক্ষা ভুলে যেতে থাকে। এই ব্যবস্থার ফলাফল বর্ণনা করে ১৮৫৮ সালে বরা হয়: মুষ্টিমেয় কয়েকজন পণ্ডিত ব্যক্তি এখান থেকে শিক্ষা পেয়ে বেরিয়ে যান; তাদের বিশিষ্ট সংকীর্ণ গণ্ডীতে তারা সুশিক্ষিত কিন্তু সরকারী চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যোগ্যতা তারা অর্জন করেত পারেননি। ফলে তারা আত্মম্ভরি, আত্মনির্ভর হতাশ এবং অবাধ্য না হলেও অসন্তুষ্ট একটা শ্রেণীতে পর্যবসিত হন। (মিঃ ই সি বেইলীর নোট থেকে সংগৃহীত। আলোচ্য অধ্যায়ের কিছু মাল মশলা সংগ্রহের জন্য আমি তার কাছে অনেক ঋণী)
কলেজটির সংস্কারের জন্য আরো একবার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং তাতে মাত্র দু এক বছরের জন্য কিছুটা সুফল পাওয়া যায়। (কলেজের অনারারী প্রিন্সিপাল কর্নেল মাসাউ লীসের সুপারিশক্রমে গৃহীত ব্যবস্থা। (তিনি এখন ভারতে নেই এবং এ সম্পর্কে কিছু বলতেও পারবেন না) তিনি পুনঃ পুনঃ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং পরে এ সম্পর্কে যে সুপারিশের কথা আমি বলবো তা কয়েক বছর আগে তিনিই বলে গিয়েছিলেন।) কিন্তু শীঘ্রই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় এবং কলেজটির অবনমিত অবস্থা তদারকের জন্য ১৮৬৯ সালে বাংলা সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করেন, যার কাজ এখনও শেষ হয়নি। বাস্তব অবস্থা এই যে, এই মোহামেডান কলেজটি তার ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেনি। বর্তমান সময়ের সর্বাধিক প্রথিতযশা মুসলিম সংস্কারকের (মৌলবি আবদুল লতিফ খান বাহাদুর) ভাষায় ঃ সমগ্র ব্যবস্থাটি ছাত্রদের শুধু মাঝ পথে অবতরণ করাতে পারে। ছাত্ররা প্রথম স্তরে যে যৎসামান্য ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে; পরবর্তী স্তরের কেবলমাত্র আরবী শিক্ষার ফলে তা কোন কাজে আসে না; কারণ ইংরেজি শিক্ষা অব্যাহত রাখার কোন ব্যবস্থা কলেজটিতে নেই। নিচের স্তরের যে সামান্য ইংরেজি জ্ঞান তারা লাভ করে, উচ্চতর স্তরে গিয়ে সেটুকুও তারা ভুলে যায়।
একটা চমৎকার উদ্যোগের ফল কেন এ রকম শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো সে সম্পর্কে দু একটি কথা বলতে চাই। প্রথম বলা দরকার যে, কলেজটির কাজকর্ম তদারকের ব্যবস্থা আশানুরূপ নয়। অতি অল্প সময়ের মেয়াদে একজন ইংরেজি প্রিন্সিপাল থাকলেও তিনি নামমাত্র কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। তার উপর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য সরকারী দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল বাংলায় আমাদের প্রতিষ্ঠিত এই বিরাট মোহামেডান কলেজটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি মাত্র অবৈতনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। অন্যান্য কাজের জন্য বেতন তিনি পেতেন, কলেজটির প্রিন্সিপাল হিসেবে তার চেয়ে মাত্র সামান্য কিছু বেশী তাকে দেয়া হত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, বর্তমান প্রিন্সিপালের মূল চাকরি হল সেক্রেটারি টু দি বোর্ড অব একজামিনার্স। তার হাত দিয়েই প্রেসিডেন্সী বিভাগের সকল মিলিটারি অফিসারদের চাকরির জন্য পাস করে বেরোতে হয় এবং সিভিলিয়ানদের মধ্যে যারা ভারতীয় ভাষায় অনার্স কোর্সে পড়েছেন তাদেরকেও এই ভদ্রলোকের হাত দিয়ে পাস করে বেরোতে হয়। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট দফতরের অস্থায়ী এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও অনুবাদকের দায়িত্বে তিনি নিযুক্ত আছেন। এ ছাড়াও সরকারের আরো অনেক খুঁটিনাটি কাজের দায়িত্বও তার উপর চাপানো আছে। এই সকল দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও মোহামেডান কলেজের প্রিন্সিপালের কাজটিও তার ঘাড়ে চাপানো হয়েছে এবং তার যতই কর্মোৎসাহ থাকুক না কেন, এত অসংখ্য দায়িত্ব পালনের পর কলেজটির মান উন্নয়নের জন্য তিনি আর কতটুকুইবা করতে পারেন। কলেজের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা তো আরও শোচনীয়। নিম্নতর বিভাগের অধ্যক্ষ একজন কর্মদক্ষ পণ্ডিত ব্যক্তি; কিন্তু উচ্চতর বিভাগে যেখানে আরবী পড়ানো হয় সে পর্যন্ত তার কর্তৃত্ব পৌছুতে পারে না।এই বিভাগটির উপর গোটা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও গোটা কতক নেটিভ মৌলবির উপরই শুধু তার পরিচালনা ভার ন্যস্ত রয়েছে। এদের মধ্যে হেড মৌলবি পদবাচ্যের একজন কর্মকর্তা আছেন বটে; কিন্তু তার কর্তৃত্বের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি, ফলে অধীনস্থ শিক্ষকরা তার কাছে দায়ী নন। এবং তাকে কখনও নিজের ক্লাসরুমের বাইরে দেখতে পাওয়া যায় না। (পরিস্থিতি তদন্তের জন্য গঠিত কমিশন সংস্কারের উদ্দেশ্যে কোন প্রস্তাব প্রণয়ন করেছেন কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু কমিশন নিয়োগের সময় কলেজটির বাস্তব অবস্থা যেরূপ ছিল তার সঠিক ও যথার্থ বর্ণনা আমি এখানে লিপিবদ্ধ করেছি।) মাসিক বা ত্রৈমাসিক পরীক্ষা গ্রহণের কোন ব্যবস্থা নেই; এবং শ্রেণীসমূহের পড়াশুনা দৈনিক বা সাপ্তাহিক তদারকির কোন ব্যবস্থাও করা হয়নি। এটা স্পষ্ট যে এ ধরনের ব্যবস্থায় কোন সুফল আশা করা যায় না। অন্য কাজ থাকায় প্রিন্সিপাল কলেজের কাজ তদারকের সময় পান না। হেড মৌলভী তদারকের চেষ্টা করেননি এবং এর বাস্তব ফল যা হয়েছে সে তো আমরা দেখছি।
এই উপেক্ষা বাংলার মুসলমান যুবকদের কত যে ক্ষতি করেছে তা অতিরঞ্জিত করে দেখান অসম্ভব। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এক পুরুষ আগে আমরা যখন হুগলী অনুদান তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করেছি, তখন কলকাতা কলেজটিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে পারলে মুসলমানরা উচ্চস্তরের শিক্ষা আশা করতে পারত। প্রায় একশ জনের একদল মুসলমান যুবক প্রাচ্য দেশীয় একটি কর্মচঞ্চল রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জমায়েত হয়ে ত্রুটিপূর্ণ পরিবেশে সাত বছর অতিবাহিত করে। তাদের আচরণবিধির উপরে কোন নিন্ত্রয়ণ ছিল না; সম্মানজনক দক্ষতার কোন দৃষ্টান্তও তাদের সামনে ছিল না; এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মত যোগ্য শিক্ষা ছাড়াই তাদেরকে শেষ পর্যন্ত নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের শতকরা প্রায় আশিজন এসেছে পূর্বাঞ্চলে ধর্মান্ধ জিলাসমূহ (বেশীর ভাগ ছাত্র এসেছে চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ ও শাহবাজপুর থেকে) থেকে। ইংরেজি বর্জিত এই শিক্ষা গ্রহণ করে ভাল বেতনের আকর্ষণীয় চাকরি পাওয়া সম্ভব নয় বলেই বাংলার অপেক্ষাকৃত রাজানুগত জিলাগুলো থেকে ছাত্ররা এই কলেজে আসতে চায়নি। সরকার বিদ্বেষী পরিবেশে ছাত্রদের বাল্যকাল কেটেছে। তাদের অনেকেই গরীব এবং কলকাতায় এসে তারা ইংরেজ ভদ্রলোকদের খানসামাদের (ধর্মীয় কাজ বিবেচনা করে খানসামারা দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য করে এই ধরনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাকে জায়গীর বলা হয়। মুসলিম সাম্রাজ্যের সামরিক শাসনকর্তাদের জায়গীরদার পদবীর সাথে এই নামের মিল লক্ষণীয়।) আতিথ্য গ্রহণ করে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই খানসামারাই বেশ অর্থবান এবং তারা তাদের প্রভুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে স্বধর্মীয় দরিদ্র যুবকদের পোষকতা করে থাকে। ছাত্রদের অধিকাংশের বয়স ষোল বছরের উপরে, অনেকের বিশের উপরে; এবং আমাকে জানানো হয়েছে যে অনেকের বয়স আবার তিরিশের উপরে। এদের আশ্রয়দাতা খানসামারা এটাকে একটা ধর্মীয় কাজ মনে করেই ক্ষান্ত থাকে না; মেটা যৌতুকসহ তারা তাদের কন্যাদের এদের সাথে বিয়ে দিয়ে থাকে। অবশিষ্ট ছাত্ররা ক্ষুদে ভূস্বামী পরিবারের ছেলে। ইংরেজি বা বিজ্ঞান পড়ার কোন প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করে করে না। কিছুটা ফার্সী এবং খানিকটা আরবী গ্রামার ও আইন শিখতে পারলেই তারা যথেষ্ট মনে করে। বাড়িতে তারা জমি চাষ ও নৌকা চালিয়ে কাটাত। তারা বদ্বীপ অঞ্চলের কৃষকদের উচারণভঙ্গীতে কথা বলে এবং কলিকাতার মুসলমানদের কাছে তাদের উচ্চারণ দুর্বোধ্য ঠেকে।
এরাই হচ্ছেন নবাগত ছাত্র। কয়েক বছরের মধ্যে তাদের গেয়ো অভ্যাস পরিবর্তিত হয় দাড়ি ছেঁটে তারা মুসলিম আইনের তরুণ অধ্যাপক সেজে বসে। দয়াবান সরকার একশ জনের মধ্যে আটাশটি বৃত্তি মঞ্জুর করেন যাতে করে প্রতিটি আবেদনকারী ছাত্র দুদিন আগে বা পরে বৃত্তি পেতে পারে। তাদের মধ্যে লেখাপড়ার অমনোযোগী অথচ করিৎকর্মা যারা, তারা অল্পদিনের মধ্যে ছোটখাটো ব্যবসায় ফেঁদে বসে। যারা উপরি ক্লাসের ছাত্র তারা তো আত্মগর্বে বুক ফুলিয়ে হাটে। তারা যে গরীব বৃত্তিভোগী ছাত্র একথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে বড় বড় বই কেতাব বোগলে চেপে তারা কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর আশ্রয়দাতা খানসামাদের কাছে শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সমান মর্যাদা পাবার আকাংখা পোষণ করে। আমরা কাজীর পদ বিলোপ করায় এদের জন্য সেটা শাপে বর হয়েছে। কারণ ইসলামী পারিবারিক আইন ব্যাখ্যার দায়িত্ব এখন এদেরই এখতিয়ারে এসে গেছে। এই কলেজের ছাত্ররা এখন নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানদের বিবাহানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করে, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি করে এবং হেদায়েত ও জামি উর রুমুজ মোতাবেক সিদ্ধান্ত বিক্রি করে।
এ দেশের যুবকদের মধ্যে এই মোহামেডান কলেজটির ছাত্রদের জন্যই উত্তম অভিভাবকত্ব সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু তারা কি ধরনের অভিভাবকত্ব পেয়ে থাকে সে কথা আগেই বর্ণনা করেছি।আমাদের কাছ থেকে যে শিক্ষা তারা পেয়ে থাকে তাতে নিজস্ব সংকীর্ণ শিক্ষা পদ্ধতির উপর তাদের আস্থা দৃঢ়মূল হয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মত যোগ্যতা তারা অনেক কম অর্জন করতে পারে; এবং আমাদের সরকারের প্রতি তাদের অবাধ্যতা বৃদ্ধি পায়। কোন ইংরেজকে দেখামাত্র ঘৃণায় তাদের নাসিকা কুঞ্চিত হয়। এই অবনতি সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় কলেজটিতে একজন আবাসিক ইংরেজ অধ্যাপক (বর্তমানে মিঃ ব্লকম্যান এই পদে অধিষ্ঠিত আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আরবী ও উচ্চতর বিভাগের উপর আবাসিক ইংরেজ অধ্যাপকেরা কোন কর্তৃত্ব নেই) নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়,কিন্তু তাকে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে কলেজে ঢুকাতে হয়। নব্বই বছরের অধিককাল যাবত কলেজটি পাঠ্যসূচীতে কাফেরদের বিরুদ্ধে পবিত্র জিহাদের পাঠ অগ্রাধিকার লাভ করে এসেছে; এবং আমার যতটা মনে পড়ছে ১৮৬৮ বা ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত ছাত্রদের পরীক্ষায় জিহাদের ফতোয়ার উপর নিয়মিত প্রশ্নপত্র দেয়া হত। কলেজের প্রায় চৌহদ্দির মধ্যে বিদ্রোহীদের একটা মসজিদ (ফারায়েজী মসজিদ) গজিয়ে উঠেছে এবং ছাত্ররা প্রায়ই কলকাতার বিভিন্ন মসজিদে বিদ্রোহের বাণী প্রচার করে বেড়ায়। বর্তমান হেডমাস্টারের পিতা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে এবং রাজদ্রোহমূলক কাজের শাস্তি হিসেবে ভারত মহাসাগরে একটা দ্বিপে তাকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত করা হয়। এই শিক্ষিত রাজদ্রোহীর লাইব্রেরীটি সরকারের বাজেয়াপ্ত করা হয়, কিন্তু সেখানকার বইগুলো এখন কলকাতার আলোচ্য কলেজেই স্থান লাভ করেছে। গত কয়েক মাসের মধ্যে আবাসিক ইংরেজ অধ্যাপক কলেজের সীমানা থেকে এমন একজন আরব মুসাফিরকে বহিষ্কার করেছেন যিনি ধর্ম প্রচারের নামে এমন এক মতবাদ প্রচার করছিলেন যার দরুন আমাদেরকে তিনটি সীমান্ত যুদ্ধে পড়তে হয়েছে এবং যে প্রচারণার ফলশ্রুতিতে গোটা সাম্রাজ্যব্যাপী বিদ্রোহের চক্রান্তের জাল বিস্তৃত হয়েছে।
সতা বছর ধরে এই জাতীয় শিক্ষা লাভ করার পর এই সব মুসলমান যুবকদের আমরা পূর্বাঞ্চলের ধর্মান্ধ জিলাগুলোতে ফেরত পাঠাই। দুর্ভাগ্যের বিষয় অধিকতর দুঃখজনক ঘটনাগুলো এখনও বলা হয়নি। গত দুবছরের ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছু বলিনি, কারণ বিশেষ কমিশন ঐ দুবছর যাবত কার্যরত রয়েছে। কিন্তু এটা প্রমাণের মত যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে যে, অতি সম্প্রতি ছাত্ররা তাদের অসতী উপ পত্নীদের কলেজে নিয়ে আসে (এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কলেজের নন রেসিডেন্ট প্রিন্সিপাল কর্নেল সীস এ ঘটনার জন্য মোটেই দায়ী ছিলেন না। উপ পত্নী আনার ঘটনা ধরা পড়ার পর তিনি এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে)।
তাদের ছাব্বিশ জনেরই নিজস্ব কামরা আছে এবং সরকার কর্তৃক বরাদ্দ ছাত্রাবাসে এভাবে লাম্পট্যগিরির আখড়ায় রূপান্তরিত হয়। কারলাইল যাদেরকে ভ্রষ্টা নারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং খ্রিস্টান ধর্ম যে পাপ ব্যবসাকে ইউরোপ থেকে বিতাড়িত করেছে, সেই ব্যবসায় ভারতের প্রতিটি বড় শহরে বেশ জেঁকে বসেছে। গত পাঁচ বা ছয় বছরের কলেজে ছাত্রদের মধ্যে অনুরূপ তিনটি ঘটনা ধরা পড়েছে; কিন্তু আদতে কতটা ঘটনা যে ঘটেছে তা জানা যায়নি।
এমনকি এমন অল্প সংখ্যক ছাত্র আছে যারা নিজেদের চেষ্টাতেই ভাল ফল দেখাতে পারে, কিন্তু তাদেরকে ফলপ্রসূ শিক্ষাদানের কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। প্রথমত, প্রতিদিন খুব অল্প সময় তাদেরকে পড়ানো হত। ক্লাস নেয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় ছিল সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার শিক্ষক ও ছাত্রদের হুঁকা টানার (ধূমপান) জন্য প্রায় বিশ মিনিট চলে যেত (কলেজে এই হুঁকাকে তামাসা করে মূসার ডাণ্ডা নামে অভিহিত করা হয়)। তারপর রোলকল করার জন্য আধঘন্টা ব্যয়িত হত রোজ দুবার করে রোলকল করা হত,কারণ বহু ছাত্র বারোটার পর ক্লাস ছেড়ে চলে যেত। কিছুসংখ্যক অধ্যবসায়ী ছাত্র আবার কলেজের অপর্যাপ্ত পড়া পুষিয়ে নেয়ার জন্য বাইরের বেসরকারি মুসলমান স্কুলে গিয়ে ধর্মশিক্ষা গ্রহণ করত। হাদিস, মুসলমানি আইনশাস্ত্র ও মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধমূলক কিতাব পড়ার জন্যেই এসব ছাত্র বাইরের প্রাইভেট স্কুলে গিয়ে থাকে এবং এতে করে কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়েও সংকীর্ণ মতভেদ দানা বেধে ওঠে। ইংরেজ আবাসিক অধ্যাপক সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় টহল দেয়ার সময় ছাত্রাবাসে হট্টগোল শুনতে পান। তোমার ধর্মীয় জ্ঞান ভ্রান্ত (তুমহারা ইমান ঠিক নেহী) এই জাতীয় পারস্পরিক নিন্দাবাদ চারদিক থেকে উঠছিল তিনি দ্রুত ছাত্রদের কক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পান যে, নামায পড়ার সময় দুপায়ের গোড়ালি যুক্ত থাকবে কিনা সে সম্বন্ধে ছাত্ররা তুমুল বাদানুবাদে রত হয়েছে।
কলেজের একজন শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন যে, পড়ার জন্য তিন ঘণ্টা সময় নির্দিষ্ট করা হলেও প্রকৃতপক্ষে আড়াই ঘণ্টার বেশী কদাচিৎ ক্লাস হয়ে থাকে। বাড়ি থেকে পড়া তৈরি করে আনার কোন বিষয়ই এখানে প্রচলিত নেই এবং এটা মুসলমানদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ব্যাপার। প্রত্যেক শিক্ষক এক এক লাইন আরবী পড়ে শব্দগুলোর অর্থ ছাত্রদের শুনায়। উৎসাহী ছাত্ররা শিক্ষকের কাছ থেকে শ্রুত শব্দের অর্থগুলো তার মূল আরবী কিতাবের প্রতিটি লাইন নিচে টুকে নেয় এবং তারপর নিজের পছন্দমত ব্যাখ্যা জুড়ে নেয়। বাড়িতে বসে কি করে অভিধান থেকে শব্দের অর্থ খুঁজে বের করতে হয় অথবা প্রতিটি পঙক্তির ব্যাখ্যা কিভাবে নির্ণয় করতে হয়, এসব বিষয় তাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সম্ভবত তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে এ পদ্ধতি বিপদজনক। সাত বছরের পড়া শেষ হওয়ার পর ছাত্ররা তাদের পাঠ্যপুস্তকের অনেক কিছু মুখস্থ বলতে পারে। কিন্তু ঐ সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরের কোন বিষয় উপস্থিত করা হলে তারা লা জওয়াব হয়ে যায়। এ ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকরা তাদের পাঠ্য তালিকার বহির্ভূত কোন বিষয়ের সম্মুখীন হলে অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে পড়ে যে, আরবী ব্যাকরণ, আরবী আইন, আরবী সাহিত্য এবং আরবী ন্যায়শাস্ত্র ছাড়া দুনিয়ার বুকে আর যা কিছু আছে সবই বাজে। তারা শিখেছে যে, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যে হচ্ছে আরব দেশ, তারপরেই হল ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া; এবং সবচেয়ে বড় শহর হচ্ছে মক্কা, মদিনা ও কায়রো এবং তারপরেই হচ্ছে লন্ডন। তারা আরো শিখেছে যে, ইংরেজরা হচ্ছে কাফের এবং পরকালে তারা হবে জাহান্নামের বাসিন্দা। এই বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারের পর আর কিইবা অবশিষ্ট থাকতে পারে।জনৈক ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ তাদের পাঠ্যসূচিতে ব্যবহারিক বিজ্ঞান (তাও তাদেরই উর্দু ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করলে ছাত্ররা তাকে ইট মেরে নাজেহাল করে কি ঠিক কাজ করেনি?
মুসলমানদের প্রকৃত সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সরকার বর্তমানে সচেতন হয়েছেন বলেই আমি কলেজটির অভ্যন্তরীণ অবস্থার দুঃখজনক দিকগুলোর উপর বিশদ আলোকপাত করলাম। কলকাতা মোহামেডান কলেজটির পরিচালনার দায়িত্ব কেবলমাত্র মুসলমানদের উপর ন্যস্ত করা হয় এবং তাদের ব্যবস্থাপনাতেই প্রতিষ্ঠানটির এহেন শোচনীয় অধঃপতন দেখা দিয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাগ্যবনতি সম্পর্কে আমাদের সরকারের উপেক্ষা ও অমনোযোগী নীতির ফলেই কলেজটির মান দ্রুত অবনতি হয়ে পড়া সত্বেও মানোন্নয়নের জন্য সরকার এতদিন কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন নি। একশ বছর ধরে কলেজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেটিভদের হাতে থাকার কারণেই মুসলমানরা সেখান কেবল কুশিক্ষাই পেয়েছে; মুসলমানদের নিজেদের জন্য কল্যাণকর কোন শিক্ষাই সেখানে কেউ পায়নি। এই মোহামেডান কলেজের পরিচালন ভার শুধুমাত্র মুসলমানদের উপর ছেড়ে দিয়ে আমরা একটা মস্ত ভুল করেছি। ১৮১৯ সালেই সরকার এটা উপলব্ধি করেন,কিন্তু সরকার আশা করেন যে,একজন ইউরোপীয় সেক্রেটারীর মামুলী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করাই যথেষ্ট হবে। হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছা প্রকাশের কারণেই গত বিশ বছরের সকল সংস্কারমূলক উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। শেষ পর্যন্ত একজন প্রিন্সিপাল নিয়োগ করা হয় বটে, কিন্তু তার দায়িত্ব ছিল সামরিক ও অবৈতনিক। অবশেষে একজন আবাসিক অধ্যাপক নিয়োগ করা হলেও নিজের বিভাগের দায়িত্ব পালনের মধ্যেই তার কর্তৃত্ব সীমিত রাখা হয়।
একটি রাষ্ট্রীয় পত্রিকায় সম্প্রতি অভিযোগ করে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র উত্তর ভারতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্যা ও অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপারে মুসলমানরা ভাল অবদান রাখতে পেরেছে। এ অভিযোগের জওয়াব অতি পরিষ্কার। বাংলায় ধর্মপ্রাণ ও ধনী মুসলমানরা (যেমন কলকাতার নাখোদা সম্প্রদায়) ফার্সি ও আরবী পড়ানো হয় না এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহশীল নয়; এবং তারা মনে করে যে, এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাফের হিন্দু শিক্ষকদের হাতে তাদের ছেলেমেয়েদের ধর্মবিশ্বাস বিনষ্ট হয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের আমাদের স্কুলে পাঠায়, কিন্তু বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যা অতি নগণ্য। নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পৌছাতে পারেনি। যদিও রেভারেন্ড জেমস লং এর মত মিশনারিদের স্কুল তাদের ছেলে পেলের ভর্তি এটা আমি দেখেছি। পূর্ববাংলার ধর্মান্ধ মুসলমান কৃষক সমাজে ইংরেজী শিক্ষা বা ইংরেজ প্রভাবের বাইরে রয়ে গেছে।
তবু আমার বিশ্বাস, সরকারী তহবিলের সামান্য একটা অংশ ব্যয় করে সকল শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য একটি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। অনুরূপ ব্যবস্থায় নিম্ন শ্রেণী, মধ্যম শ্রেণী এবং উচ্চ শ্রেণীর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রথম শ্রেণীর জন্য বর্তমান সাহায্য ব্যবস্থা ও নিয়ম কানুন সামান্য রদবদল করলেই চলবে। বেশি অর্থের প্রয়োজনের চেয়ে বরং মুসলমানদের বিশেষ চাহিদা পূরণ করা বেশি দরকার, সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন যে পাঁচ মাইলের মধ্যে দুইটি স্কুলে সরকারী সাহায্য দেওয়া হবে না কারণ তাহলে সরকারী অর্থের বিনিময়ে বেহুদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য সকল ব্যাপারের মত এই ব্যাপারেও চতুর হিন্দুরা আগে মাঠে নেমেছে। তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রয়োজন মেটাবার মত করে সারা দেশে স্কুল গড়ে তুলেছে, কিন্তু তাদের স্কুল মুসলমানদের কোন প্রয়োজন মিটাতে পারে না। সুতরাং পাশে হিন্দু স্কুল থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা যাতে সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পার তার সুবিধার জন্য পাঁচ মাইলে নিয়ম শিথিল করতে হবে। পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেখানে প্রয়োজন নেই সেসব ক্ষেত্রে বর্তমান হিন্দু স্কুলে একজন মুসলিম শিক্ষক নিয়োগ করে সরকার মুসলমানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারেন। সপ্তাহে পাঁচ শিলিং বেতনের বিনিময়ে অনুরূপ মুসলমান শিক্ষক পাওয়া যেতে পারে।
পূর্বাঞ্চলে ধর্মান্ধ জিলাগুলোর মুসলমান কৃষকদের মধ্যে পৌঁছাবার জন্য সরকার একটা বিশেষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারলে বেশ সুফল পাওয়া যাবে। হিন্দুদের জন্যও একবার অনুরূপ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। যেসব জিলায় স্বনির্ভর শিক্ষার কোন চাহিদা নেই সেখানে শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে লর্ড হার্ডিঞ্জ বহু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৮৬৬ সালে আমি যে সময় কর্মরত ছিলাম তখন বঙ্গীয় শিক্ষা বিভাগের অধীনে অনুরূপ স্কুলের আটত্রিশটি টিকেছিল। এদের জন্য সরকারকে বার্ষিক ১১০০ পাউন্ড খরচ বহন করতে হয়েছে। এছাড়াও স্কুলগুলোর ফিস বাবদ আয় হত ২৬৭ পাউন্ড, কিন্তু তা মোটেই স্বনির্ভরতার পরিচায়ক নয়। কিন্তু এই সব স্কুলের দ্বারা যে কল্যাণ হয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। যেখানেই কৃষকরা ছিল অজ্ঞ দরিদ্র ও কুসংস্কারে ঢাকা, সেখানেই অনুরূপ একটি হার্ডিঞ্জ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হইয়াছে। প্রথম দিকে গ্রামবাসীদের শিক্ষার জন্য কোন পয়সা খরচ করতে হয়নি। কিন্তু পরে শিক্ষা সম্প্রসারণের ফলে উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় স্কুলগুলোতে ছাত্র বেতন প্রবর্তিত হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই স্বনির্ভরতার সৃষ্টি হয়ে উচ্চতর শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং হার্ডিঞ্জর সস্তায় শিক্ষাদান পদ্ধতি তখন দেশের অধিকতর অনগ্রসর অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা হয়। দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় এভাবেই শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়েছিল। (১৮৬৫-৬৬ সালে দক্ষিণ পশ্চিম মোট ১৮৩টি স্কুলে ১৪০৪৩জন ছাত্র ছিল।)
আমার মতে বর্তামানে পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেও উক্ত একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের সরকারের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিরূপ মানসিকতাসম্পন্ন জনসাধারণের মধ্যে গ্রান্ট ইন এইড পদ্ধতি পৌছাতে পারবে না কিন্তু সরকারী সাহায্য প্রতিষ্ঠিত এবং অল্প বেতনের মুসলমান শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত পঞ্চাশটি সস্তা স্কুল এক পুরুষের মধ্যেই পূর্ববাংলার জনমতে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। এই ব্যবস্থায় প্রথম দিকে কম সাফল্য পাওয়া গেলেও ক্রমান্বয়ে তা শুধু মুসলমান কৃষক সন্তানদেরই আকর্ষণ করবে তাই নয় (দক্ষিণ পশ্চিম বিভাগে মোট ২৮৩টি স্কুলে ১৭০৪৩ জন ছাত্র ছিল) এমনকি মুসলমান শিক্ষকদেরও যথেষ্ট উপকার করবে। মুসলমান শিক্ষকদের জীবিকার ব্যবস্থা বর্তমানে বেশ শোচনীয়, কিন্তু সরকারী তহবিল থেকে সপ্তাহে অতিরিক্ত পাঁচ শিলিং করে পেলে তা তাদের স্বাধীনভাবে ভাগ্যোন্নতির পথ খুলে দেবে। এভাবে এমন একটা শ্রেণীকে আমরা আমাদের সাথে পেয়ে যাব যারা বর্তমানে আমাদের ঘোর বিরোধিতা করে বেড়াচ্ছে। (দক্ষিণ পশ্চিম বিভাগের ৩৮টি হার্ডিঞ্জ ও মডেল স্কুলের ছাত্র সংখ্যা ১৮৬১-৬২ সালের ১৪২১ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৬৫-৬৬ সালে ২০৩৪ হয়। ঐ বছরই আমি আমার রিপোর্ট প্রণয়ন করি। উক্ত একই সময় প্রতি ছাত্র বাবদ ব্যয় ১২ শিলিং থেকে হ্রাস পেয়ে ৮ শিঃ ৪ পেঃ হয়)
মুসলমানদের জন্য নিম্নস্তরের শিক্ষার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এতক্ষণ বলা হল। তাদের মধ্যম স্তরের শিক্ষার জন্য পরিবর্তন আরো কম প্রয়োজন হবে; ওয়াহাবী মামলায় সরকারী ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি ইতিপূর্বেেই প্রত্যেক সরকারী জিলা স্কুলে একজন করে মুসলমান শিক্ষক (মৌলভী) নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন, এবং এটাই যথেষ্ট হবে।এই শিক্ষকরা তাদের নিজস্ব শাখায় উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষা দেবেন। উর্দুর পর কিছুটা ফার্সি ও আরবী তারা শিখাবেন। বর্তমান সরকারী জেলা স্কুলগুলোতে এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে ইংরেজী শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
উপরোক্ত পরিবর্তনের জন্য সরকারী ব্যয় খুব সামান্য হবে, কিন্তু মুসলমানদের জন্য উচ্চতর শ্রেণীর শিক্ষা প্রবর্তনে সরকারী তহবিলের একটি পয়সাও ব্যয় করার দরকার হবে না। কলকাতা মোহামেডান কলেজের জন্য ওয়ারেন হেষ্টিংস যে তহবিল আলাদা করে রেখেছেন সেটা এবং হুগলী ওয়াকফ সম্পত্তির বিস্তর আয় সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো হলে তা দিয়েই এই ব্যয় সংকুলান হয়ে যাবে। একটি ইংরেজী কলেজের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে তহবিলের অর্থ আমরা বর্তমানে তসরুপ করছি, দাতার ইচ্ছা মোতাবেক তা সৎভাবে ব্যয়িত হওয়া উচিত। দুটি কলেজের পরিবর্তে একটিমাত্র ভাল কলেজ থাকা উচিত কিনা, অথবা কলেজটি কলকাতায়, না হুগলীতে প্রতিষ্ঠিত হবে (যাদের দূরত্ব রেলপথে মাত্র বিশ মাইল) সেই সব বিস্তারিত বিতর্কে আমি এখন যেতে চাই না। অধিকাংশ বিষয়ের শিক্ষার দায়িত্ব বর্তমানের মত মুসলমান শিক্ষকদের উপর ন্যস্ত করতে হবে; তবে প্রতি কলেজে একজন করে আবাসিক ইউরোপীয় প্রিন্সিপাল থাকতে হবে। এই পদের জন্য বার্ষিক ১২০০ পাউন্ড থেকে ১৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত বেতন দেওয়া হলে ব্রিটিশ ও জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বহু পণ্ডিতের জন্যই তা আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
বর্তমান কলকাতা কলেজটির মত নিম্ন ও উচ্চস্তরের শিক্ষার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি না করে সুবিন্যস্ত পাঠ্যসূচীর মাধ্যমে নিম্ন ও উচ্চতর শ্রেণীর মধ্যে সুষ্ঠু যোগসূত্র বজায় রাখতে হবে। বর্তমান উচ্চতর বা আরবী বিভাগকে ইঙ্গ আরবী বিভাগে রূপান্তরিত করতে হবে। এবং নিম্নতর শ্রেণী অর্থাৎ ইঙ্গ ফার্সি বিভাগের সাথে তার সুসামঞ্জস্য যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। এভাবে পুনর্বিন্যাস করা হলে মুসলমান ছাত্ররা জিলা সরকারী স্কুল থেকে পাশ করে সহজেই কলেজের দুইটি বিভাগ অতিক্রম করে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হতে পারবে। মুসলমানী আইনশাস্ত্র আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নিয়মিত পড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়েছে। কিন্তু এটাকেই শিক্ষার মৌল লক্ষ্য হিসেবে ধরা নেয়া ঠিক হবে না। মুসলমানী আইন মানে মুসলমান ধর্ম, এবং পাঠ্যসূচী থেকে এটাকে সম্পূর্ণ উঠিয়ে দেয়া বুদ্ধিমানের পরিচায়ক হবে না। কারণ সম্পূর্ণ উঠিয়ে দিলে এই কলেজ বর্তমান মুসলমান বংশধরদের কাছে আকর্ষণীয় হবে না। তথাপি এটা মনে রাখতে হবে যে, যোগ্য মুসলমান আইন অফিসার সৃষ্টির যে মৌল উদ্দেশ্যে প্রথম দিকে আমরা মুসলমানী আইন অধ্যয়নকে উৎসাহিত করেছি, তা প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই। সরকারী চাকরি বা ব্যক্তিগত আত্মোন্নতি, কোনটির জন্যই বর্তমানে আর এটা শিখে লাভ নাই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পদ্ধতিতে হিন্দু আইন শিখানো হয় সেইরূপ পৃথক বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলমানী আইনশাস্ত্র ভালভাবেই শিখানো যেতে পারে। বর্তমানে ইসলামী বিধি মোতাবেক প্রাত্যহিক ড্রিলের পরিবর্তে আরবী ও ফার্সি সাহিত্য এবং উর্দুর মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান পড়ানো যেতে পারে।
এইভাবে আমাদের উচিত এমন একটা উদীয়মান মুসলিম জেনারেশন গড়ে তোলা যারা নিজস্ব সংকীর্ণ শিক্ষা পদ্ধতি ও মধ্যযুগীয় ভাবধারার গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও বিজ্ঞানের নমনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। নিজ সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা আকর্ষণের মত উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার সাথে তাদেরকে কর্মজীবনে লাভজনক পেশায় অংশগ্রহণের উপযোগী ইংরেজী শিক্ষায়ও শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
মুসলমানদের মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম শ্রেণীর শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে তাদের নিজ সম্প্রদায় থেকে একজন স্পেশাল ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুলস নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। বার্ষিক ২০০ পাউন্ড বেতনে তাকে নিয়োগ করা যেতে পারে। তার অন্যতম দায়িত্ব হবে মুসলমান স্কুল ও কলেজসমূহ (মাদ্রাসা) সম্পর্কে তদারকি চালিয়ে রিপোর্ট পেশ করা। অনুরূপ একটি চমৎকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতায় রয়েছে এবং তার ছাত্র সংখ্যা ১১০, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কোন সরকারী গ্রান্ট পায়নি। ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনুরূপ আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতার অদূরে পশ্চিম হাওড়ার এক গ্রামে এখনও টিকে আছে, কিন্তু সেটা ভালভাবে চলছে না। ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের মাইমারীতে এবং সাসারামে অনুরূপ আর দুটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকে আছে। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের শিক্ষা বিভাগীয় ইন্সপেক্টরের সম্পূর্ণ অগোচরে রয়েছে। আমার মনে হয় ,এদের মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে এখনও কার্যদক্ষতা অক্ষুণ্ণ আছে এবং তাদের মান উন্নয়নের জন্য কিছু করা যায় কিনা তা তদারক করে দেখা প্রয়োজন। তারা ইংরেজী অফিসারদের নিয়মিত তদারকিতে রাজী হবে বলে মনে হয় না, কিন্তু সরকারী গ্রান্টের বিনিময়ে তাদের নিজ সম্প্রদায় থেকে নিযুক্ত একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টরের তদারকি ব্যবস্থায় সম্মত হবে। এভাবে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বাংলার কট্টর রাজদ্রোহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা রাজানুগতের পক্ষভুক্ত না করতে পারলেও অন্তত শান্তি শৃঙ্খলার সপক্ষে টেনে আনতে পারব। মুসলমান স্কুলগুলোতে বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সতর্কতার সাথে নির্বাচিত ও সুসম্পাদিত উত্তম পাঠ্য বই প্রবর্তন করতে হবে। কলেজগুলোকে নির্দ্বিধায় ইংরেজ অধ্যক্ষদের এখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে এবং এজন্য যে তহবিল বর্তমান আছে, সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে তাই যথেষ্ট এবং সরকার তহবিলের একটা পয়সাও ব্যয় করার প্রয়োজন হবে না।
এভাবে মুসলমান যুবকদেরকে আমরা আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনার ভিত্তিতে শিক্ষিত করে তুলতে পারি। তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে এবং ধর্ম শিক্ষার বিষয়ে সামান্যতম হস্তক্ষেপ না করেই আমরা তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে পারি যাতে করে তারা ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করলেও ধর্মান্ধ হবে না। বিশ্বের অন্যতম চরম গোড়া সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুরা যেভাবে সহনশীলতার শিক্ষা পেয়েছে, মুসলমানদেরও সেই পদ্ধতি অনুসরণে উৎসাহিত করা যেতে পারে। অনুরূপ সহনশীলতা মুসলমানদের তাদের পূর্বপুরুষদের গোঁড়ামি তেকে মুক্ত করে আনবে,যে গোঁড়ামি তাদেরকে নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা ও অপরাধজনক কাজের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে। আর এ সবই তারা করে এসেছে ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে। কোন পদ্ধতির প্রবর্তনের দ্বারা হিন্দু ও মুসলমানদের সমভাবে উচ্চতর ধর্মীয় ধারণায় উন্নীত করা সম্ভব সে সম্পর্কে এখানে কিছু বলতে চাই না। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, অনুরূপ উন্নত অবস্থায় তারা একদিন উপনীত হবে এবং এতদিন নেতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও আমাদের প্রবর্তিত শিক্ষা পদ্ধতি হচ্ছে এ বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ। ইংরেজরা ভারতে এতদিন শুধু প্রতিমা ভঙ্গকারীর নগণ্য ভূমিকাই পালন করে এসেছে।
ইত্যবসরে সরকারের কর্তব্য হবে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ দমনের সাথে সাথে তাদের অসন্তুষ্টির কারণগুলো দূর করা। আমাদের বিজয় ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে তারা যে দুর্দশায় পতিত হয়েছে এবং যে চরম সর্বনাশের মধ্যে তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তাদের প্রতি আমাদের অনুসৃত নীতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজদ্রোহী অংশের সাথে এমনভাবে মোকাবিলা করতে হবে যাতে করে তারা শুধু আদালতের বিচারেই নয়, এমনকি জনমতের কাছেও দোষী সাব্যস্ত হবে। উপযুক্ত সিদ্ধান্তের কার্যকরীকরণের ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণের ফল রোমের সর্বাধিক গুণান্বিত সম্রাটের নামের উপর শত শত বছর ধরে অপবাদ আরোপিত হয়েছে। (জুলিয়ানের অধীনস্থ আফ্রিকার ভাইসরয় এবং মিসরের অত্যাচারী ডিউকের ব্যবহার)এতদিন কেবল যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও আমরা রক্তপাত ঘটাইনি এবং তার ফলে একদল ওয়াহাবী ধর্ম প্রচারকের সৃষ্টি হলেও ওয়াহাবী মুজাহিদের একটা বাহিনী গড়ে উঠতে পারেনি। আমি যখন এই পৃষ্ঠাটা লিখছি সেই সময় ব্রিটিশ বাহিনীর সেই কুখ্যাত মাংস সরবরাহকারী (মোহাম্মাদ শফি)১৮৬৪ সালে যাকে মৃত্যুদন্ড দণ্ডিত করা হয়, পাটনায় তার সাবেক ধর্ম ভাইদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে। তার দণ্ডাদেশ যদি কার্যকরী করা হত, তাহলে প্রতি বচর হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান তার মাজার জিয়ারত করতে যেত। ধর্মের জন্য মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিরা সব যুগেই অখ্যাতি থেকে খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করে থাকে। দিল্লীর সেই অখ্যাত মাংস বিক্রেতার মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরী না করার মধ্য দিয়ে আমাদের সরকার মৃত্যুদন্ড প্রদানের অপকারিতা সম্পর্কে সতর্ক হতে পেরেছেন। কারণ দণ্ডাদেশ কার্যকরী করা হলে মুসলমানরা সেটাকে ধর্মের জন্য শাহাদত বরণ বলেই গণ্য করত। এটা এখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, রোমান সেনাবাহিনীর শুকরের মাংস সরবরাহকারী ক্যাপাডসিয়ার জর্জ কিভাবে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুবরণের পর অখ্যাত, অজ্ঞাত জীবন থেকে দেবতার মর্যাদায় উন্নীত হয়ে মেরী ইংল্যান্ডের সেন্ট জর্জ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।