পরিশিষ্ট
ইহা এমন এক সুবিচারসম্মত দৃষ্টিকোণ ও মধ্যম পন্থা যে, পৃথিবী তাহার উন্নতি, স্বাচ্ছন্দ্য ও নৈতিক নিরাপত্তার জন্য ইহার মুখাপেক্ষী, চরম মুখাপেক্ষী। যেমন প্রথমেই বলিয়াছি যে, শত-সহস্র বৎসর ধরিয়া তমদ্দুনে নারীর [অর্থাৎ মানব জগতের অর্ধাংশের] স্থান নির্ণয়ে পৃথিবী হিমশিম খাইতেছে। কখনও চরম বাড়াবাড়ি এবং কখনও চরম ন্যূনতার দিকে অগ্রসর হইয়াছে এবং এই উভয় চরম প্রান্তই তাহার জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হইয়াছে; পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ এই ক্ষতির সাক্ষ্য দান করে। এই উভয় চরম প্রান্তের মধ্যে সুবিচার ও মধ্যম পন্থা উহাই, যাহা ইসলাম উপস্থাপিত করিয়াছে। ইহাই জ্ঞান ও প্রকৃতিসম্মত এবং মানবীয় প্রয়োজনের সম্পূর্ণ উপযোগী। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আধুনিক যুগে এমন সব বাধা-বিঘ্নের সৃষ্টি হইয়াছে, যাহার কারণে ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ হৃদয়ংগম এবং তাহার মর্যাদা দান মানুষের পক্ষে কঠিন হইয়া পড়িয়াছে।
এই সকল বাধা-বিঘ্নের মধ্যে প্রধান বিঘ্ন এই যে, নব্যযুগের মানুষ পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে এবং প্রাচ্যের পাশ্চাত্যমনা লোকের উপরে এই পাণ্ডুরোগের আর এক মারাত্মক আক্রমণ হইয়াছে যাহাকে শ্বেত পাণ্ডুরোগ বলা যায়। আমার এই স্পষ্ট উক্তির জন্য আমি আমার বন্ধু ও ভ্রাতৃবর্গের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী; কিন্তু যাহা সত্য তাহা প্রকাশে কোন তিক্ততা প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত নহে। ইহা এক বাস্তব ঘটনা যে, ইসলামের এমন কোন নির্দেশ এবং এমন কোন বিষয় নাই, যাহা প্রমাণিত দার্শনিক তথ্যের পরিপন্থী বরং অধিকতর সত্য কথা এই যে, যাহাই দার্শনিক তথ্য তাহাই ইসলাম। কিন্তু উহা দেখিবার জন্য বর্ণহীন দৃষ্টির প্রয়োজন যেন প্রতিটি বস্তুকে তাহার সত্যিকার বর্ণে দেখিতে পাওয়া যায়। উন্মুক্ত মন ও সুস্থ প্রকৃতির প্রয়োজন যাহাতে তথ্যকে তাহার অবিকলরূপে গ্রহণ করা যায় এবং উহাকে স্বীয় ঝোঁক-প্রবণতার অধীন না করিয়া প্রবৃত্তির ঝোঁক-প্রবণতাকেই বরং তাহার অধীণ করা যায়। যেখানে ইহার অভাব হইবে, সেখানে জ্ঞানবিদ্যা থাকিলেও তাহা নিষ্ফল হইবে। রঙিন দৃষ্টিতে যাহা কিছুই দেখিবে, তাহাকে নিজের রঙেই দেখিবে। সংকীর্ণ দৃষ্টি সমস্যাবলী ও ব্যাপারসমূহের শুধু ঐ দিক পর্যন্তই পৌছিতে পারে যাহা ঐ কোণের [angle] সম্মুখে উপস্থাপিত ও সংঘটিত হয় যেখান হইতে সে উহাকে দেখিতে পায়। অতপর ইহা সত্ত্বেও যে সকল দার্শনিক তথ্য প্রকৃত অবস্থায় মনের অভ্যন্তরে পৌঁছিবে তাহার উপর মনের সংকীর্ণতা ও স্বভাবপ্রকৃতির বক্রতা ক্রিয়া করিবে। তথ্যাবলী তাহার মনের চাহিদা, আবেগ, অনুভূতি ও ঝোঁকপ্রবণতা অনুযায়ী হইয়া যাউক, ইহাই হইবে তাহাদের দাবি। উহা তাহার মনমত না হইলে উহাকে সত্য জানিবার পরও উপেক্ষা করিয়া চলিবে এবং স্বীয় প্রবৃত্তিরই আনুগত্য করিবে। প্রকাশ থাকে যে, মানুষ যখন এই রোগে আক্রান্ত হয়, তখন জ্ঞান, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ কিছুই তাহাকে পথ প্রদর্শন করিতে পারে না। এইরূপ রোগীর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নহে যে, সে ইসলামের কোন নির্দেশ সঠিকভাবে বুঝিতে পারে। কারণ ইসলাম ‘প্রাকৃতিক দীন’ তথা প্রকৃতিই বটে। পাশ্চাত্য জগতের জন্য ইসলাম হৃদয়ংগম করা এইজন্য কঠিন যে, সে এই রোগে আক্রান্ত। তাহার নিকটে যতটুকু জ্ঞান আছে, তাহা সকলই ‘ইসলাম’ কিন্তু তাহার দৃষ্টি রঙিন। অতপর এই রঙপাণ্ডুরোগ হইয়া প্রাচ্যের নব্য শিক্ষিত দলের দৃষ্টি রঙিন করিয়াছে। দার্শনিক তথ্য হইতে সঠিক ফল বাহির করিতে এবং জীবনে সমস্যাগুলিকে তাহার স্বাভাবিক রঙে দেখিতে এই রোগ প্রতিবন্ধক হয়। উহাদের মধ্যে যাহারা মুসলমান হইতে পারে তাহারা দ্বীন ইসলামের উপর ঈমান রাখে, উহার সত্যতা স্বীকার করে, দীনের আনুগত্যের অনুরাগ হইতেও বঞ্চিত নহে। কিন্তু হতভাগা তাহার চক্ষুর পাণ্ডুরোগের কি করিবে? এই চক্ষু দ্বারা তাহারা যাহাই দেখে, তাহাই আল্লাহর রঙের বিপরীত দেখিতে পায়।
সঠিক বোধশক্তির প্রতিবন্ধক দ্বিতীয় কারণ এই যে, সাধারণভাবে মানুষ যখন ইসলামের কোন বিষয় লইয়া চিন্তা করে তখন যে ব্যবস্থার সংগে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট তাহার প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না, বরং উক্ত ব্যবস্থা হইতে বিষয়টি পৃথক করিয়া তৎসম্পর্কে আলোচনা করে। ফল এই হয় যে, বিষয়টি যাবতীয় জ্ঞান-বিবেচনা-বহির্ভূত মনে হয় এবং ইহার মধ্যে নানা প্রকারের সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সূদের বিষয়ে এই হইয়াছে যে, ইহাকে ইসলাম তথা প্রকৃতির অর্থনৈতিক মূলনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হইতে পৃথক করিয়া দেখা হইয়াছে। ফলে ইহার মধ্যে সহস্র ব্যাধি দেখা দিতে লাগিল। এমন কি বড় বড় ইসলামী পণ্ডিতও ইহার মধ্যে শরীয়তের পরিপন্থী সংশোধনীর প্রয়োজন বোধ করিলেন। দাসপ্রথা, বহু বিবাহ ও স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং এই প্রকার বহু বিষয়ে ঐরূপ মৌলিক ভ্রান্তি করা হইয়াছে। পর্দা সমস্যাটিও ইহারই শিকারে পরিণত হইয়াছে। যদি আপনি সমগ্র অট্টালিকা দেখিবার পরিবর্তে শুধূ উহার একটি স্তম্ভ দেখেন তাহা হইলে আপনার নিকট ইহা এক বিস্ময় রহিয়া যাইবে যে,য কেন ইহা স্থাপন করা হইয়াছে। উহার প্রতিষ্ঠা আপনার নিককে সকল বুদ্ধি-বিবেচনার উর্ধ্বে মনে হইবে। আপনি কিছুতেই উপলব্ধি করিতে পারিবেন না যে, ইনজিনিয়ার অট্টালিকাটিকে অটল রাখিবার জন্য কিরূপ সৌষ্ঠব ও উপযোগিতা সহকারে উহা স্থাপন করিয়াছেন এবং উহা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে কিভাবে সমগ্র অট্টালিকা ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। পর্দার দৃষ্টান্ত অবিকল ঐরূপ। যে সকাম ব্যবস্থায় অট্টালিকার স্তম্ভের ন্যায় প্রয়োজন বোধে ইহা স্থাপন করা হয়েছিল তাহা হইতে যদি ইহা পৃথক করা হয়, তাহা হইলে ইহা সকল বুদ্ধি-বিবেচনা বহির্ভূত হইয়া পড়িবে। এই কথা কিছুতেই বুঝিতে পারা যাইবে না যে, মানব জাতির উভয় শ্রেণীর মধ্যে এই বৈষম্যমূলক সীমারেখা কেন নির্ধারিত করা হইয়াছে। অতএব স্তম্ভের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি করিতে হইলে যে অট্টালিকায় ইহা স্থাপিত হইয়াছে তাহাকেই পরিপূর্ণরূপে দেখিতে হইবে।
এখন ইসলামের প্রকৃত পর্দা আপনার সম্মুখে। যে সমাজ-ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্দার নিয়ম-নীতি নির্ধারণ কর হইয়াছে সেই সমাজ ব্যবস্থাও আপনার সম্মুখে। এই ব্যবস্থার প্রধান প্রদান মৌলিক বিষয়ও আপনার সম্মুখে আছে, যাহার সহিত বিশেষ ভারসাম্য রক্ষা করিয়া পর্দার প্রধান বিষয়গুলি সংযোজিত করা হইয়াছে। যাবতীয় প্রমাণিত দার্শনিক তথ্য আপনার সম্মুখে, যাহাকে ভিত্তি করিয়া এই সমাজ ব্যবস্থা রচিত হইয়াছে। এই সকল দেখিবার পর আপনি বলুন, ইহার মধ্যে কোথাও কোন দুর্বলতা আছে কি? কোন স্থানে ভারসাম্যহীনতার কোন লেশ আছে কি? কোন স্থান কি এমন আছে, যেখানে বিশেষ কোন দলীয় প্রবণতা পরিত্যাগ করত শুধু জ্ঞান-বুদ্ধির ভিত্তিতে কোন সংস্কারের প্রস্তাব করা যাইতে পারে? আমি গভীর অন্তদৃষি।ট দিয়া বলিতেছি যে, পৃথিবী ও আকাশ যে ন্যায়-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনার মধ্যে যে পরিপূর্ণ সাম্য-শৃংখলা দেখিতে পাওয়া যায়, একটি অণুর গঠন ও সৌর-ব্যবস্থার বন্ধনের মধ্যে যে ধরনের পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্য ও সাদৃশ্য আপনি দেখিতে পান, ঠিক সেই ধরনের ন্যায়নীতি, সাম্য-শৃংখলা, ভারসাম্য এবং সৌষ্ঠব এই সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান। চরম বাড়াবাড়ি, চরম ন্যূনতা ও একমুখীনতা মানবীয় কাজের অপরিহার্য দুর্বলতা। এই ব্যবস্থা [ইসলামী ব্যবস্থা] এই সকল দুর্বলতা হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত। ইহার মধ্যে সংস্কার-সংশোধন মানব ক্ষমতা বহির্ভূত। মানুষ যদি তাহার ভ্রান্তিপূর্ণ জ্ঞানের দ্বারা ইহার মধ্যে সামান্য পরিমাণেও কিছু পরিবর্তন করিতে চায় তাহা হইলে ইহার সংস্কার না করিয়া বরং ইহার ভারসাম্য নষ্ট করিয়া ফেলিবে।
পরিতাপের বিষয়, আমার নিকটে এমন কোন উপায়-উপাদান নাই, যাহা দ্বারা আমি আমার বাণী ঐ সকল ভ্রাতৃবৃন্দের নিকটে পৌঁছাইতে পারি, যাঁহারা ইউরোপ, আমেরিকা, রুশ ও জাপানে বসবাস করেন। তাঁহারা একটি সুষ্ঠু সমপরিমিত তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা না পাইবার কারণে নিজেদের জীবন ধ্বংস করিতেছেন এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতিরও ধ্বংসের কারণ হইতেছেন। আহা, যদি আমি তাঁহাদের নিকটে এই মৃতসঞ্জীবনী পৌঁছাইতে পারিতাম, যাহার জন্য তাঁহার প্রকৃতই তৃষ্ণার্ত! হয়ত তাঁহারা এই তৃষ্ণা অনুভব করিতে পারেন না। যাহা হউক, আমার প্রতিবেশী দেশের হিন্দু, খৃীষ্টান, পার্শী আমার নাগালের মধ্যে। তাঁহাদের অধিকাংশই আমার ভাষা বুঝিতে পারেন। আমি তাঁহাদের নিকটে আহবান জানাইতেছি যে, মুসলমানদের সহিত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ইসলামের বিরুদ্ধে তাঁহাদের মনে যে বিদ্বেষের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা হইতে মন পরিস্কার করিয়া নিছক সত্যানুসন্ধানী হিসাবে এই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে তাঁহারা জানিয়া বুঝিয়া দেখুন, যাহা আমি এই গ্রন্থে বর্ণনা করিয়াছি। অতপর যে পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাঁহারা দ্রুত ধাবমান, তাহার সহিত ইহার যাচাই-পরীক্ষা করিয়া দেখুন। অবশেষে আমার অথবা অন্য কাহারও জন্য নহে, বরং নিজেরই মংগলের জন্য সিদ্ধান্ত করিয়া দেখুন যে, প্রকৃত কল্যাণ কোন পথে।
অতপর সাধারণ পাঠকবৃন্দ হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া ঐ সকল গুমরাহ ভাইদিগকে কিছু বলিতে চাই যাহাদিগকে মুসলমান বলা হয়।
আমাদের কিছু সংখ্যক নব্য শিক্ষিত মুসলমান ভাই উপরে বর্ণিত সকল কথাই স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁহারা বলেনঃ
অবস্থা ও যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী আইন-কানুনের মধ্যে কঠোরতা লাঘব করিবার যথেষ্ট অবকাশ আছে, যাহা অনস্বীকার্য। অতএব, আমাদের শুধু ইচ্ছা এই যে, ইহারই সুযোগে আমরা কিছু সুবিধা ভোগ করি। বর্তমান অবস্থা পর্দার লাঘব দাবি করে। মুসলমান নারীদের স্কুল-কলেজে যাইবার প্রয়োজন হইয়াছে, যাহাতে তাহারা উচ্চ শিক্ষা লাভ করিতে পারে। তাহাদের এমন শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন,যাহাতে তাহারা তামাদ্দুনিক, সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা বুঝিতে পারে এবং তাহার সমাধানের যোগ্যতা লাভ করিতে পারে। ইহা ব্যতীত মুসলমানগণ জীবন সংগ্রামে প্রতিবেশী জাতিসমূহের পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে। ভবিষ্যতে আরও ক্ষতির আশংকা আছে। দেশের রাজনৈতিক জীবনে নারীদিগকে যে অধিকার দেওয়া হইতেছে, তাহা হইতে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করিবার যোগ্যতা যদি মুসলমান নারী লাভ না করে এবং পর্দার বাধা-বন্ধনের কারণে যদি সেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করিতে না পারে, তাহা হইলে দেশের রাজনৈতিক নিক্তিতে মুসলমানের ওজর বহু পরিমাণে কমিয়া যাইবে। ইসলামী যুগের অবস্থার দিকে লক্ষ্য করিয়া ইসলামী পর্দাকে বহুল পরিমাণে লাঘব করিয়াছে।–[তর্কের খাতিরে শুধু ‘লাঘব’ বলা হয়, নতুবা পর্দাকে তাহারা লাঘব করে নাই; বরং রহিত করিয়াছে।] ইহার কয়েক বৎসর পরই যথেষ্ট উন্নতি লাভ হইয়াছে। আমরাও যদি তাহাদের পদাংক অনুসরণ করি, তাহাতে দোষ কি?
যতই আশংকা বর্ণনা হইতেছে, আমরা উহার সবখানিই স্বীকার করিয়া লইতেছি, বরং আশংকা ইহার দশগুণ হইলেও আসে যায় না। বস্তুত এই ধরনের কোন আশংকার কারণে ইসলামী আইন-কানুনে কোন প্রকার সংশোধনী অথবা লাঘব জায়েয হইতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের নির্বুদ্ধিতাবশত অথবা বাধ্য হইয়া আপন দুর্বলতার কারণে একটি মলিন ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে বসবাস করেন। সেখানে স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম পালন আপনার জন্য শুধু কঠিনই হইয়া পড়ে নাই বরং অপরিচ্ছন্ন লোকেরে বস্তিতে অপরিচ্ছন্ন না থাকাই আপনার পক্ষে কঠিন হইয়া পড়িবে। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম-নীতির সংশোধনী অথবা লাঘবের প্রশ্নই উঠিতে পারে না। যদি আপনি ঐ সকল নিয়ম-নীতিকে সঠিক মনে করেন, তাহা হইলে আপনার কর্তব্য হইবে আপন পরিবেশকে চেষ্টা-সংগ্রাম করিয়া পরিচ্ছন্ন করিয়া তোলা। যদি সংগ্রাম করিবার শক্তি ও সাহস আপনার না থাকে এবং নিজের দূর্বলতার কারণে পরিবেশ কর্তৃক পরাভূত হন, তাহা হইলে যতই ময়লা আপনার উপর নিক্ষিপ্ত হউক, তাহাতে অবগাহন করুন। আপনার জন স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম-নীতিকে পরিবর্তন কেন করা হইবে? কিন্তু যদি প্রকৃতই আপনি ঐ সকল নিয়ম-নীতি ভ্রান্ত মনে করেন এবং এই অপরিচ্ছন্নতা আপনার সহিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে আপনি নিজের জন্য যেমন ইচ্ছা, তেমন নীতি নির্ধারণ করিয়া লউন। যাহারা অপরিচ্ছন্নতার প্রতি অনুরক্ত, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম-নীতিতে তাহাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন অবকাশ নাই।
ইহাতে সন্দেহ নাই যে, প্রতিটি আইনের ন্যায় ইসলামী আইনেও অবস্র প্ররিপ্রেক্ষিতে কঠোরতা ও লাঘব করিবার অবকাশ আছে। কিন্তু প্রতিটি আইনের ন্যায় ইসলামী আ্ইনও দাবি করে যে, কঠোরতা অথবা লাঘবের সিদ্ধান্ত করিবার জন্য অবস্থাকে এমন দৃষ্টি ও স্পিরিট সহকারে দেখিতে হইবে, যাহা হইতে হইবে ইসলামেরই দৃষ্টি এবং ইসলামেরই স্পিরিট। কোন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়া অবস্থা দর্শন করা এবং তৎপর লাঘবের কাঁচি লইয়া আইনের ধারাগুলির প্রতি আক্রমণ করাকে লাঘব বলে না, বরং বলে স্পষ্ট পরিবর্তন। যে অবস্থাকে অনৈসলামী দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিতে ইসলামী আইনের লাঘব আনয়নের দাবি করা হইতেছে, তাহা যদি ইসলামী দৃষ্টিকোণ হইতে দেখা যায়, তাহা হইলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইবে যে, এইরূপ অবস্থায় লাঘবের পরিবর্তে অধিকতর কঠোরতা অবলম্বন করিবার প্রয়োজন আছে। লাঘবতা একমাত্র ঐ সময়ে অবলম্বন করা যায়, যখন আইনের উদ্দেশ্য অন্য উপায়ে সহজেই পূরণ হয় এবং রক্ষণাপেক্ষণে বেশী কঠোরতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যখন আইনের উদ্দেশ্য অন্য উপায়ে পূরণ হয় না, বরং অন্যান্য সমগ্র শক্তি তাহা নষ্ট করিবার কাজে লাগিয়া থাকে এবং তাহার উদ্দেশ্য পূরণ রক্ষণাবেক্ষণের উপরই নির্ভর করে, এমতাবস্থায় শুধু ঐ ব্যক্তিকে লাঘবের চিন্তা করিতে পারে, যে আইনের স্পিরিট সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত।
উপরে বিস্তারিত আলোনা করা হইয়াছে যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার আইন-কানুনের উদ্দেশ্য দাম্পত্য জীবনের রীতিনীতির রক্ষণাবেক্ষণ, যৌন-উচ্ছৃংখলতার প্রতিরোধ এবং অপরিমিত যৌন-উত্তেজনার দমন। এই উদ্দেশ্যে শরীয়ত প্রণেতা তিনটি পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন। প্রথমত চরিত্রের সংশোধন, দ্বিতীয়ত শাস্তিমূলক আইন এবং তৃতীয়ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্থাৎ সতর ও পর্দা। ইহা যেন তিনটি স্তম্ভ, যাহার উপরে এই প্রাসাধ দাঁড়াইয়া আছে। যাহার দৃঢ়তার উপরে ইহার দৃঢ়তা এবং যাহার ধ্বংসের উপরে ইহার ধ্বংস নির্ভর করে। আসুন, আপনি একবার আপন দেশের বর্তমান অবস্থা অবলোকন করিয়া দেখুন যে, এই তিনটি স্তম্ভের কি অবস্থা হইয়াছে।
প্রথমত নৈতিক পরিবেশের প্রতি লক্ষ্য করুন। আপনি এমন দেশে [বিভাগপূর্ব ভারত] বাস করেন যাহার শতকরা পঁচাত্তর জন অধিবাসী আপনার দেশের উপরে একটি অমুসলিম জাতি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত, একটি অমুসলিম সভ্যতা ইহাকে প্রবল ঝটিকার ন্যায় আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। প্লেগ-কলেরা জীবাণুর ন্যায় অনৈসলামী চরিত্রের মূলনীতি ও অনৈসলামী সভ্যতার ধ্যান-ধারণা পরিবেশকে সংক্রমিত করিয়া ফেলিয়াছে। আবহাওয়া উহার দ্বারা বিষাক্ত হইয়াছে। উহার বিষক্রিয়া আপনাকে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। যে সকল অশ্লীল-অশ্রাব্য কথায় কিছুকাল পূর্বে আপনার শরীর রোমাঞ্চিত হইত, তাহা এখন এমন সাধারণ বস্তুতে পরিণত হইয়াছে যে, আপনি উহাকে দৈনন্দিনের বিষয়ব্স্তু মনে করেন। আপনার সন্তানগণ পত্র-পত্রিকায় ও বিজ্ঞাপনাদিতে প্রতিদিন অশ্লীল ছবি দেখিতেছে এবং নির্লজ্জতায় অভ্যস্ত হইয়া পড়িতেছে। আপনার সমাজের আবাল-বৃদ্ধ-বণতা সিনেমা দর্শন করে, যেখানে নগ্নতা, অশ্লীলতা ও যৌন উন্মাদনাপূর্ণ প্রেমলীলা অপেক্ষা অধিকতর আনন্দদায়ক আর কিছু হয় না। পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, মাতা-কন্যা পাশাপাশি বসিয়া প্রকাশ্যে চুম্বন-আলিঙ্গন, প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন ও প্রেম নিবেদনের দৃশ্য উপভোগ করিতে কণামাত্র লজ্জাবোধ করে না। চরম অশ্লীল ও যৌন-উত্তেজক গীতি প্রতি ঘরে ঘরে এবং দোকানে দোকানে গাওয়া হইতেছে। ইহা হইতে কাহারও কর্ণকুহর মুক্ত নহে। উচ্চ শ্রেণীর দেশীয় ও ইংরাজ মহিলাগণ অর্ধনগ্ন পোশাকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং উহা চক্ষে এমনভাবে সহিয়া গিয়াছে যে, উহাতে কেহই নির্লজ্জতা অনুভব করে না। নৈতিকতার যে ধারণা পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার দ্বারা প্রসার লাভ করিতেছে, তাহার বদৌলতে বিবাহকে একটি জীর্ণ প্রাচীন প্রথা, ব্যভিচারকে চিত্তবিনোদন, নারী-পুরুষের একত্র মিলনকে একটি আপত্তিহীন, বরং প্রশংসনীয় বস্তু, তালাককে একটি খেলা, দাম্পত্য-দায়িত্ব পালনকে একটা অসহনীয় বন্ধন, সন্তানের জন্মদান ও বংশবৃদ্ধিকে একটা মূঢ়তা, স্বামীর আনুগত্যকে এক প্রকার দাসত্ব, স্ত্রী হওয়াকে একটা বিপদ এবং প্রেমিক-প্রেমিকা সাজাকে একটা কাল্পনিক স্বর্গ মনে করা হয়।
অতপর লক্ষ্য করুন, এই পরিবেশের কি ধরনের প্রভাব আপনার জাতির উপর পড়িতেছে। আপনার সমাজে কোথাও কি দৃষ্টি সংযমের অস্তিত্ব আছে? লক্ষ লোকের মধ্যেও কি এমন একজন পাওয়া যায়, যে অপরিচিত নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনে ভীত হয়? চক্ষু ও জিহবার কি প্রকাশ্যে ব্যভিচার হইতেছে না? আপনার নারিগণও কি জাহিলী যুগের ঠাট-ঠমক ও সৌন্দর্য প্রদর্শন হইতে বিরত থাকে? আপনার গৃহে কি আজও এমন পোশাক পরিধান করা হয় না, যেগুলি সম্পর্কে নবী করীম (স) বলিয়াছেন যে, ‘ঐ সকল নারীর উপর অভিসম্পাত, যাহারা বস্ত্র পরিধান করিয়াও উলংগ থাকে’। আপনার মাতা, ভগ্নি ও কন্যাকে কি এমন পোশাকে দেখিতেছেন ন, যাহা মুসলমান নারী তাহার স্বামী ব্যতীত অন্য কাহারও সম্মুখে পরিধান করিতে পারে না? আপনার সমাজে কি অশ্লীল কিসসা-কাহিনী ও প্রেমের অকথ্য ও অশ্রাব্য ঘটনাগুলি দ্বিধাহীনচিত্তে বর্ণিত এবং শ্রুত হয় না? বৈঠাদিতে লোকে তাহাদের কৃত অপকর্মগুলি বর্ণণা করিতে কি কোন লজ্জাবোধ করে? অবস্থা যদি এই হয়, তাহা হইলে বলুন, নৈতিক পবিত্রতার সেই প্রথম সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় স্তম্ভ কোথায় রহিল, যাহার উপর ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রসাদ রচনা করা হইয়াছে? ইসলামী মর্যাদাবোধ এমন পরিমাণে মিটিয়া গিয়াছে যে, মুসলমান নারী শুধু মুসলমানের নহে; বরং অমুসলমানেরও শয্যা-সংগিনী হইতেছে! ব্রিটিশ রাজ্যে নহে, মুসলমান রাজ্যেও এই ধরনের ঘটনা দেখিয়াও মুসলমানদের রক্ত উত্তেজিত হয় না। এমন মর্যাদাবোধহীন মুসলমানও দেখা গিয়াছে যাহারা আপন ভগ্নি কোন অমুসলমানের স্ত্রী হইয়াছে এবং সে ব্যক্তি গর্বভরে প্রকাশ করিয়াছে যে, সে অমুক বড়লোক কাফিরের শ্যালক।–[ইহা দক্ষিণ ভারতের একটি ঘটনা। আমার জনৈক বন্ধু ইহা হইতেও মর্মবিদারক একটি ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন। পূর্ব ভারতে জনৈকা মুসলমান নারী প্রকাশ্যে একজন ধনী অমুসলমানের সহিত সম্পর্ক রাখিত। ফলে সে বহু ধন-সম্পদের অধিকারিণী হইয়াছিল। আমার বন্ধু স্থানীয় তথাকথিত মুসলমানদিগকে এ বিষয়ে গর্ব করিতে দেখিয়াছেন।] ইহার পরও নির্লজ্জতা ও নৈতিক অধপতনের কিছু অবশিষ্ট থাকিল কি?
এখন একবার দ্বিতীয় স্তম্ভটির অবস্থা অবলোকন করিয়া দেখুন। সমগ্র ভারতে ইসলামের শাস্তিমূলক আইনগুলি রহিত হইয়াছে। ব্রিটিশ ও মুসলমান রাজ্যের কোথাও ব্যভিচারের শাস্তি প্রচলিত নাই। শুধু ইহাই নহে, বরং যে আইন বর্তমানে প্রচলিত আছে তাহা ব্যভিচারকে কোন অপরাধই মনে করে না। কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের কুলবালাকে কোন ব্যক্তি প্ররোচিত করিয়া পাপাচারে লিপ্ত করিতে ইচ্ছা করিলে এমন কোন আইন নাই, যাহা দ্বারা তাহার সতীত্ব-সম্ভ্রম রক্ষা করা যাইতে পারে। যদি কেহ কোন সাবালিকার সহিত তাহার সম্মতিক্রমে অবৈধভাবে যৌন ক্রিয়া করে, তাহা হইলে কোন আইনবলেই তাহাকে শাস্তি দেওয়া যাইবে না। কোন নারী প্রকাশ্যে ব্যভিচার কার্যে লিপ্ত হইলে এমন শক্তি নাই, যাহা দ্বারা তাহার প্রতিরোধ করা যাইতে পারে। দেশের আইন শুধু বলপূর্বক ব্যভিচারকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে। কিন্তু আইন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন যে, বলপূর্বক ব্যভিচার প্রমাণ করা কত কঠিন! বিবাহিতা নারীকে অপহরণ করাও অপরাধ। কিন্তু ব্রিটিশ আইনজ্ঞদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন যে, বিবাহিত নারী স্বেচ্ছায় কাহারও গৃহে যাইয়া উঠিলে শাসকদের আদালতে ইহার কি প্রতিকার আছে।
চিন্তা করিয়া দেখুন, এই উভয় স্তম্ভদ্বয় ধ্বসিয়া পড়িয়াছে। এখন আপনার সমাজ ব্যবস্থাপনার সমগ্র প্রাসাদ শুধু একটি মাত্র স্তম্ভের উপর দাঁড়াইয়া আছে। ইহাকেও কি আপনি ধ্বংস করিতে চান? একদিকে আপনার বর্ণিত পর্দাপ্রথার ক্ষতিসমূহ এবং অপরদিকে পর্দা রহিত করিলে নৈতিক চরিত্র এবং সমাজ ব্যবস্থার পরিপূর্ণ ধ্বংস উভয়ের মধ্যে যাচাই-পরীক্ষা করিয়া দেখুন। উভয়ই বিপদ এবং একটিকে গ্রহণ করিতেই হইবে। এখন আপনি নিজেই নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করুন, কোন বিপদটি অপেক্ষাকৃত ছোট।
যুগের অবস্থার উপরেই যদি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়, তাহা হইলে আমি বলিব, ভারতের অবস্ পর্দা লাঘব করিবার পক্ষে নহে, বরং ইহার অধিকতর কড়াকড়ির দাবি করে। কারণ সামাজিক ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের দুইটি স্তম্ভই ধ্বসিয়া পড়িয়াছে এবং এখন সকল কিছুই মাত্র একটা স্তম্ভের উপরে নির্ভরশীল। তমদ্দুন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি সমাধান করিতে হইলে স্থির মস্তিস্কে বসিয়া পড়ুন এবং চিন্তা করিয়া দেখুন। ইসলামী সীমারেখার ভিতরে তাহার সমাধানের অন্য পন্থাও বাহির হইতে পারে। কিন্তু অবশিষ্ট এই একটিমাত্র স্তম্ভ, যাহা ইতিমধ্যেই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে, তাহাকে অধিকতর দুর্বল করিবেন না। ইহা লাঘব করিবার পূর্বে আপনাকে এমন শক্তি সঞ্চয় করিতে হইবে যে, যদি কোন মুসলমান নারী বেপর্দা হয় এবং তাহাকে দেখিবার জন্য কোথাও দুইটি চক্ষু পাওয়া যায়, তাহা হইলে উক্ত চক্ষুদ্বয় উৎপাটিত করিবার জন্য যেন পঞ্চাশটি হস্ত প্রস্তুত থাকে।
##সমাপ্ত##
১। গ্রামাঞ্চলে স্ত্রীলোকেরা মাসিক ঋতুকে ‘মাসিক ব্যারামই’ বলিয়া থাকে। -অনুবাদক
১। প্রকাশ থাকে যে, ‘পর্দা’ নামক মূল গ্রন্থখানি প্রায় একষট্টি বৎসর পূর্বে লিখিত হয় এবং সহজেই অনুমান করা যায় যে, তথাকথিত প্রগতি বা আধুনিকতার উন্নতির সংগে অপরাধ প্রবণতাও উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে।
২। Blue Book of Crime Statistics for 1934 দ্র
১। Wester Marck তাঁহার The History of Human Marriage গ্রন্থে অবিকল এই মত পোষণ করিয়াছেন।