তাত্ত্বিক আলোচনা
যে সমস্ত কারণে পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করা হয় তাহা নিছক নেতিবাচক নহে। প্রকৃতপক্ষে ইহা একটি প্রামানিক ইতিবাচক ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। বিরোধী দলের বিরোধিতার ভিত্তি শুধু ইহা নহে যে, যেহেতু লোকে নারীদের গৃহমধ্যে আবদ্ধ থাকা এবং দেহাবরণসহ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হওয়াকে অন্যায় অবরোধ মনে করে; সুতরাং পর্দাপ্রথাকে রহিত করিতে হইবে, বরং প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তাহাদের সম্মুখে নারী জীবন সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র চিত্র রহিয়াছে। নারী-পুরুষের মেলামেশা সম্পর্কে তাহারা একটি স্থায়ী নিজস্ব মতবাদ পোষণ করে। তাহারা চায় যে, নারী এইরূপ না করিয়া অন্য কিছু করুক। পর্দার বিরুদ্ধে তাহারা এইজন্য আপত্তি উত্থাপন করে যে, নারী গৃহমধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া অবগুণ্ঠনসহ জীবনের সেই বাঞ্চিত চিত্রও পরিস্ফুট করিতে পারে না। অথবা ‘অন্য কিছু’ও করিতে পারে না।
এখন আমাদের পরীক্ষা করিয়া দেখা আবশ্যক যে, নারীদের করণীয় সেই ‘অন্য কিছু’ বস্তুটি কি। ইহার পশ্চাতে কোন মতবাদ ও মূলনীতি রহিয়াছে, ইহা কতখানি ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইহার কি-ইবা পরিণাম ফল ঘটিয়াছে? ইহা সুস্পষ্ট যে, তাহাদের মতবাদ মূলনীতিকে যদি আমরা সরাসরি গ্রহণ করিয়া লই, তাহা হইলে পর্দাপ্রথা এবং সেই সামাজিক ব্যবস্থা – যাহার অবিচ্ছেদ্য অংগ এই পর্দা-প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হইবে। কিন্তু আমরা যাচাই ও যুক্তিসংগত পরীক্ষা ব্যতিরেকে তাহাদের মতবাদ কেনই বা মানিয়া লইব? তবে কি কোন বস্তুকে শুধু তাহার নূতনত্বের জন্য এবং সর্বসাধারণ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করার জন্য আমরা বিনা পরীক্ষায়ই শিরোধার্য করিয়া লইব?
অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বাধীনতার ধারণা
পূর্বেই করা হইয়াছে যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে সকল দার্শনিক, প্রকৃতিবিদ ও সাহিত্যিক সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা চালাইয়াছিলেন, তাহাদিগকে প্রকৃতপক্ষে এমন এক তামাদ্দুনিক ব্যবস্থার সম্মুখীন হইতে হয় যাহার মধ্যে নানাবিধ জটিলতা বিদ্যমান ছিল এবং যাহাতে কমনীয়তার লেশমাত্র ছিল না। তাহা ছিল অযৌক্তিক গতানুগতিক আচারানুষ্ঠান এবং জ্ঞান ও স্বভাববিরোধী অসামঞ্জস্যে পরিপূর্ণ। কয়েক শতাব্দীর ক্রমাগত অধপতন তাহার উন্নতির পথ রুদ্ধ করিয়াছিল। একদিকে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধির নবজাগরণ উদ্বেলিত হইয়া ব্যক্তিগত চেষ্টা-সাধনার সীমা অতিক্রম করিবার অনুপ্রেরণা দিতেছিল; অপরদিকে সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতার দল প্রচলিত প্রবাদ-কিংবদন্তীর বন্ধন দৃঢ়তর করিতে ব্যাপৃত ছিল। গীর্জা হইতে সৈন্যবিভাগ ও বিচারালয় পর্যন্ত রাজপ্রাসাদ হইতে কৃষিকৃত্য ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদান পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি বিভাগ ও সংগঠনের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এমনভাবে কাজ করিয়া যাইত যে, বুর্জোয়া শ্রেণীর সহিত সংশ্লিষ্ট নবজাগ্রত দলের সকল শ্রম ও যোগ্যতার ফল কতিপয় বিনষ্ট শ্রেণীর তাহাদের পূর্ব প্রতিষ্ঠিত অধিকার বলে হরণ করিয়া লইত। এহেন পরিস্থিতিতে সংস্কার-সংশোধনের সকল প্রকার প্রচেষ্টা, ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থপরতা ও অজ্ঞতার সম্মুখে ব্যর্থকাম হইতে লাগিল। এই সমস্ত কারণে সংশোধন ও পরিবর্তনকারীদের মধ্যে বিপ্লবের একটি অন্ধ অনুপ্রেরণা দৈনন্দিন জাগ্রত হইয়া উঠিতেছিল। অবশেষে তদানীন্তন গোটা সমাজ ব্যবস্থা এবং তাহার প্রতিটি বিভাগ ও অংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলিয়া উঠিল। অতপর ব্যক্তি স্বাধীনতার এমন এক চরম মতবাদ গণস্বীকৃতি লাভ করিল যাহার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের বিরুদ্ধে ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও অনাবিল মুক্তি দান করা। এইরূপ মতবাদ প্রচারিত হইতে লাগিল যে, ব্যক্তিকে যেমন পূর্ণ স্বাধীনতার সহিত স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী আপন অভিপ্সিত কার্য করিবার অধিকার দান করিতে হইবে, তদ্রুপ তাহার অনভিপ্রেত কার্য হইতে বিরত থাকিবার স্বাধীনতাও তাহার থাকিবে। কাহারো ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করিবার কোন অধিকারই সমাজের থাকিবে না। ব্যক্তিবর্গের কর্মস্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখাই হইবে সরকারের একমাত্র কর্তব্য। গণ-প্রতিষ্ঠানগুলি শুধু ব্যক্তিকে তাহার উদ্দেশ্য সাধনের পথে সাহায্য করিবে।
নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক বিক্ষোভ ও ক্রোধের মধ্যে যে স্বাধীনতার অতিরঞ্জিত চরম মতবাদ জন্মলাভ করিল তাহার মধ্যে একটি বৃহত্তর অমঙ্গল ও ধ্বংসের বীজাণু বিদ্যমান ছিল। এই মতবাদকে যাহারা সর্বপ্রথমে উপস্থিত করিয়াছিল, তাহারাও ইহার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ফল সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবহিত ছিল না। এবম্বিধ বল্গাহীন স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিণাম ফল যদি তাহাদের জীবদ্দশায় প্রকাশ হইয়া পড়িত, তাহা হইলে সম্ভবত তাহারাও আতংকিত হইয়া পড়িত। তাহাদের সময়ে সমাজে যে সকল অসংগত বাড়াবাড়ি এবং অযৌক্তিক বাধাবন্ধন ছিল, তাহার মূলোৎপাটনের অস্ত্রস্বরূপই তাহারা এইরূপ মতবাদ চালু করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু অবশেষে ইহাই পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের মন-মস্তিস্কে বদ্ধমূল হইয়া ক্রমবিকাশ লাভ করিতে লাগিল।
{ব্যক্তি স্বাধীনতার এই ধারণা হইতেই বর্তমান গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং নৈতিক লাম্পট্য (Licentiousness) জন্মলাভ করিয়াছে। প্রায় দেড় শতাব্দিকাল ব্যাপী এই মতবাদ ইউরোপ ও আমেরিকার যে অনাচার-উৎপীড়নের বন্যা প্রবাহিত করিয়াছে, তাহার ফলে মানবতা ইহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে বাধ্য হইয়াছে। কারণ এইরূপ সমাজ ব্যবস্থা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অবাধ অধিকার দান করিয়া জনস্বার্থকে পদদলিত এবং সমাজকে ধ্বংস করিয়াছে। ক্রমশ এই বিদ্রোহের ভিতর দিয়া সোস্যালিজম ও ফ্যাসিজম আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। কিন্তু নবজাত ইজমগুলির সৃষ্টির গোড়াতেই এক অনাচার, অমঙ্গলের বীজ অন্তর্নিহিত রহিয়া গেল। প্রকৃতপক্ষে একটি চরম মতবাদের সমাধানকল্পে অপর একটি চরম মতবাদ উত্থাপিত করা হইল। অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যক্তি স্বাধীনতা আন্দোলনের ত্রুটি এই যে, ইহা ব্যক্তির খাতিরে সমষ্টিকে বিসর্জন দিয়াছে।
পক্ষান্তরে বর্তমান বিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক মতবাদের ত্রুটি এই যে, ইহা ব্যক্তিকে সমষ্টির যূপকাষ্ঠে বলিদান দিয়াছে। মানবতার মঙ্গলের জন্য একটি সুসামঞ্জস্য মতবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর ন্যায় আজও বিদ্যমান রহিয়াছে।}
ঊনবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তন
ফরাসী বিপ্লব এই স্বাধীনতার ক্রোড়েই প্রতিপালিত হইয়াছিল। এই বিপ্লবের দ্বারা পূর্বতন বহু নৈতিক মতবাদ, তামাদ্দুনিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি রহিত করা হইয়াছিল। এই সকল রহিতকরণের ফলে যখন উন্নতি দেখা গেল, তখন বিপ্লবী মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তিগণ ইহাই বলিতে লাগিল যে, আবহমান কাল হইতে প্রচলিত জীর্ণ কর্মনীতিই উন্নতির পথে কণ্টকস্বরূপ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার পরিবর্তন ব্যতীত সম্মুখে পদক্ষেপ সম্ভব নহে। খ্রীস্টীয় নৈতিকতার ভ্রান্ত মৌলিক নীতি রহিত হইবার পর তাহাদের সমালোচনার অস্ত্র মানবীয় নৈতিকতার বুনিয়াদী মতবাদের উপরে ক্ষীপ্র গতিতে নিক্ষিপ্ত হইল। সম্ভ্রম সতিত্ব আবার কোন বিপদ? যৌবনের উপর আল্লাহর ভীতির সংকটই বা কেন চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে? বিবাহ ব্যতিরেকে যদি কেহ কাহারও প্রণয়াবদ্ধ হয়, তবে তাহাতে দোষই বা কোথায়? বিবাহোত্তরকালে মানুষ কি এতই নির্মম হইয়া পড়ে যে, তখন তাহাকে অন্যত্র প্রেম নিবেদনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইবে? এই ধরনের প্রশ্নাবলী নূতন বিপ্লবী সমাজের চতুর্দিকে মুখরিত করিল, বিশেষ করিয়া ঔপণ্যাসিক লিখনীর মাধ্যমে এই সকল প্রশ্নাবলী দৃপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসিত হইল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে (George Sand)এই দলের নেত্রী ছিল। যে সমস্ত নৈতিক মূলনীতির উপর মানব সভ্যতা, বিশেষ করিয়া নারীর সতিত্ব সম্ভ্রম নির্ভরশীল, এই নারী স্বয়ং তা চূর্ণ করিল। যে একজনের বিবাহিতা পত্নী হইয়াও বিবাহ বন্ধন লঙ্ঘন করিয়া অপরের সহিত অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করিল। অবশেষে স্বামীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তারপর তাহার প্রণয়ী পরিবর্তনের পালা আরম্ভ হয় এবং কাহারো দুই বৎসরাধিককাল একত্রে বসবাস করা তাহার সম্ভব হয় নাই। তাহার জীবনীতে এমন ছয় ব্যক্তির কথা জানিতে পারা যায়, যাহাদের সহিত তার প্রকাশ্যে প্রেম নিবেদন চলিয়াছে। তাহার জনৈক প্রণয়ী তাহার প্রশংসায় নিম্নরূপ মন্তব্য করিয়াছেঃ
-জর্জ স্যান্ড প্রথমে একটি প্রজাপতিকে ধরিয়া পুষ্প পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া রাখে-ইহাই তাহার প্রনয় নিবেদনের কাল। অতপর সে তাহার শুণ্ডের সূচাগ্র দ্বারা তাহাকে বিদ্ধ করিলে সে ফড়ফড় করিতে থাকে এবং ইহাতে সে চরমানন্দ লাভ করে।– অতপর একদা তাহার প্রেমে ভাটা পড়িয়া যায়।– অতপর সে তাহার পালক উৎপাটিত করিয়া তাহাকে ঐ সকল পতঙ্গের শ্রেণীভুক্ত করিয়া লয়, যাহাদিগকে তাহার উপন্যাসের জন্য প্রধান চরিত্র হিসাবে মনোনীত করা হয়।
ফরাসী কবি ‘Alfred Musse’ – ও তাহার একজন প্রেমিক ছিল। সে অবশেষে তাহার বিশ্বাসঘাতকতায় এতখানি মর্মাহত হইয়াছিল যে, মৃত্যুর সময় সে এই বলিয়া ওসীয়ত করিয়া যায় যে, George Sand যেন তাহার জানাযায় যোগদান করিতা না পারে। ইহাই ছিল সেই নারীর ব্যক্তিগত নৈতিক চরিত্র। ত্রিশ বৎসর যাবত তাহার সাহিত্যের মাধ্যমে তাহার চরিত্র ফরাসীর যুবক সমাজকে প্রভাবান্বিত করিয়াছিল। সে তাহার স্বরচিত উপন্যাস লেলীয়ায় (Lelia)। লেলিয়ার পক্ষ হইতে স্টেনোকে লিখিতেছেঃ
-জগতকে যতখানি দেখিবার আমার সুযোগ হইয়াছে, তাহাতে আমি অনুভব করি যে, প্রেম সম্পর্কে আমাদের যুবক-যুবতীদের ধারণা কতখানি ভ্রান্ত। প্রেম শুধু একজনের জন্যই হইবে অথবা তাহার মনকে জয় করিতে হইবে এবং তাহাও চিরদিনের জন্য-এইরূপ ধারণা নিতান্তই ভুল। অন্যান্য যাবতীয় কল্পনাকেও নিসন্দেহে মনে স্থান দিতে হইবে। আমি একথা মানিয়া লইতে প্রস্তুত আছি যে, কিছু সংখ্যক লোকের দাম্পত্য জীবনে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়ার অধিকার আছে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই অন্যরূপ প্রয়োজন বোধ করে এবং তাহা অর্জনের যোগ্যতাও রাখে। ইহার জন্য আবশ্যক যে, নারী-পুরুষ একে অপরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিবে, পারস্পরিক উদারতা প্রদর্শন করিবে এবং যে সমস্ত কারণে প্রেমের ক্ষেত্রে হিংসা ও প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় তাহা অন্তর হইতে নির্মূল করিবে, সকল প্রেমই সঠিক, তাহা উগ্র হউক অথবা শান্ত, সকাম অথবা নিষ্কাম, দৃঢ় অথবা পরিবর্তনশীল, আত্মঘাতী অথবা সুখদায়িনী-
সে তাহার জাক (Jacus) নামক অন্য এক উপন্যাসে এমন এক স্বামীর বর্ণনা দিয়াছে, যাহাকে সে একটি আদর্শ স্বামী হিসাবে সমাজের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জাকের স্ত্রী নির্জনে পরপুরুষকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করিতেছে অথচ উদারচেতা স্বামী তাহাতে কোন প্রকার আপত্তি করিতেছে না। ইহার কারণস্বরূপ স্বামী বলিতেছেঃ
যে পুষ্প আমা ব্যতীত অন্যকে তাহার সুরভী দান করিতে চায়, তাহাকে পদদলিত করিবার আমার কি অধিকার আছে?
লেখিকা অন্যত্র ‘জাকে’র ভাষায় নিম্নরূপ মন্তব্য করিতেছেঃ
আমি আমার মতের পরিবর্তন করি নাই, সমাজের সঙ্গে কোন আপোষও আমি করি নাই। যত প্রকার সামাজিক পন্থা আছে, আমার মতে বিবাহ তন্মধ্যে এক চরম পাশবিক পন্থা। আমার বিশ্বাস, যদি মানুষ ও জ্ঞানবুদ্ধির উৎকর্ষ সাধন করিতে ইচ্ছা করে, তাহা হইলে নিশ্চয় এই পন্থাকে তাহারা রহিত করিয়া দিবে। অতঃপর তৎপরিবর্তে তাহারা একটি পবিত্র মানবীয় পন্থা বাছিয়া লইবে। তখন মানব সন্তানগণ এই সকল নারী পুরুষ হইতে অধিকতর অগ্রগামী হইবে এবং একে অপরের স্বাধীনতায় কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না। বর্তমানে পুরুষ এমন স্বার্থপর এবং নারী এত ভীরু যে, তাহারা বর্তমানের প্রচলিত রীতিনীতির পরিবর্তে কোন উন্নততর ও সম্ভ্রান্ত রীতিনীতির দাবি করে না। হ্যাঁ, যাহাদের মধ্যে বিবেক ও পূণ্যের অভাব আছে, তাহাদিগকে তো কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধই থাকিতে হইবে।
এই সকল মতবাদ ও ধ্যান-ধারণা ১৮৩৩ খ্রীঃ এবং সমসাময়িক কালে প্রচারিত হইতেছিল। জর্জ স্যান্ড শুধু ঐ পর্যন্তই পৌঁছাতে পারিয়াছিল। সে তাহার মতবাদ ও ধ্যানধারণাকে অবশ্যম্ভাবী শেষ পরিণতি ফল পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিতে সাহসী হয় নাই। তথাপি স্বাধীনচিত্ততা, প্রগতিশীলতা ও প্রাচীন গতানুগতিক নৈতিকতার অন্ধকার কিছু না কিছু তাহার মনমস্তিস্কে বিদ্যমান ছিল। তাহার ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বৎসর পরে ফ্রান্সে নাট্যকার, সাহিত্যিক ও নৈতিকতাবাদী দার্শনিক প্রভৃতির দ্বিতীয় বাহিনী আবির্ভূত হয়। আলেকজান্ডার দুমা (Alexander Dumas) ও আলফ্রেড নাকেট (Alfred Naquet) তাহাদের অন্যতম নেতা ছিল। তাহাদের সমগ্র শক্তি এই মতবাদ প্রচারে নিয়োজিত করে যে, স্বাধীনতা ও জীবনের সুখ-সম্ভোগে মানুষের জন্মগত অধিকার আছে। এই অধিকারের উপর নৈতিক নিয়মনীতি ও সামাজিক বন্ধন চাপাইয়া দেওয়া ব্যক্তির প্রতি সমাজের উৎপীড়ন বিশেষ। ইহার পূর্বে ব্যক্তির জন্য কর্মস্বাধীনতার দাবী শুধু প্রেমের নামেই করা হইত। উত্তরসূরিদের নিকট এইরূপ নিছক ভাব প্রবণতাপ্রসূত ভিত্তি দুর্বল মনে হইল। অতএব তাহারা ব্যক্তিগত ঔদ্ধত্য, লাম্পট্য ও বল্গাহীন স্বাধীনতাকে যুক্তি, দর্শন এবং বিজ্ঞানের দৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করে। ইহার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, যুবক-যুবতীরা যাহা কিছু করুক না কেন, তাহা যেন মন ও বিবেকের পরিপূর্ণ তুষ্টি সহকারে করিতে পারে এবং সমাজও যেন তাহাদের যৌবনের উচ্ছৃঙ্খলতায় রুষ্ট না হইয়া উহাকে নৈতিকতার দিক দিয়া সঙ্গত ও সমীচীন মনে করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে Paul Adam, Henry Betaille, Pierrelouis প্রমুখ সাহিত্যিকগণ তরুণ তরুণীদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতায় সাহস সঞ্চার করিবার জন্য সাহিত্যের মাধ্যমে তাহাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। ফলে প্রাচীন নৈতিকতার ধারণা মানব প্রকৃতির মধ্যে যে একটি দ্বিধাসঙ্কচ ও প্রতিবন্ধকতার অনুভূতি জিয়াইয়া রাখিয়াছিল, এখন তাহাও নিঃশেষিত হইয়া গেল। বস্তুত Poul Adam ‘La-Morale-De-La Amour’ – এ তরুণ-তরুণীদের এই নির্বুদ্ধিতার জন্য তিরস্কার করিয়াছে যে, তাহারা প্রেম করিবার কালে অযথা এইরূপ আশ্বাস দেয় যে, প্রেমিকার জন্য জীবন দান করিবে, তাহার জন্য আন্তরিক প্রেম করিবে, চিরকাল তাহারই হইয়া থাকিবে ইত্যাদি। পল আদম বলেঃ
এই সকল কথা এইজন্য বলা হইতেছে যে, দেহ সম্ভগের বাসনা-যাহা প্রকৃতিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে এবং যাহার মধ্যে কোন পাপ নাই – প্রাচীন মতবাদ অনুযায়ী দূষণীয় মনে করা হয়। এইজন্য মানুষ ইহাকে অযথা মিথ্যার আবরনে ঢাকিবার চেষ্টা করে।,,, জাতির মারাত্মক দুর্বলতা এই যে, তাহাদের প্রেমিক-প্রেমিকা এই কথা স্পষ্ট করিয়া বলিতে সংকোচ বোধ করে যে, তাহাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্য নিছক দৈহিক বাসনাকে চরিতার্থ করিয়া সুখসম্ভোগ ও চরমানন্দ লাভ করা।
ইহার পর সে তরুণ-তরুণীদিগকে এই বলিয়া উপদেশ দান করিতেছেঃ
অমায়িক ও যুক্তিবাদি মানুষ হও। আপন প্রবৃত্তি ও আনন্দ উপভোগের অনুচরকে তোমাদের মা’বুদ বানাইও না।(ইহার তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে কেহ যেন ভুল না করেন। ইহা দ্বারা ঐ সকল নারী-পুরুষকে বুঝানো হইতেছে, যাহারা একে অপরকে আপন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে পারে।) যে ব্যক্তি প্রেমমন্দির নির্মাণ করত একই বিগ্রহের পূজারী হইয়া বসিয়া থাকে, সে প্রকৃতই নির্বোধ। প্রতি আনন্দ মুহূর্তে একজন অভ্যাগতের নির্বাচন করা তাহার উচিত।
Pierre Louis অন্যদের অপেক্ষা কয়েক ধাপ অগ্রসর হইয়া মুক্ত কন্ঠে ঘোষণা করিতে লাগিল যে, নৈতিক বন্ধন প্রকৃতপক্ষে মানবীয় প্রতিভা ও মস্তিস্ক শক্তির উন্মেষ সাধনে বাধার সৃষ্টি করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সকল বন্ধন ছিন্ন করিতে মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতার সহিত দৈহিক সুখসম্ভোগের সুযোগ দেওয়া না হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রকার জ্ঞানবুদ্ধির বিকাশ অথবা বৈষয়িক ও আত্মিক উন্নতি সম্ভবপর নহে। সে তাহার গ্রন্থ Afrodite- এ দৃঢ়তার সহিত ইহা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছে যে, বেবিলন, আলেকজান্দ্রিয়া, এথেন্স, রোম, ভেনিস এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্যান্য কেন্দ্রের চরম উন্নতি ঠিক তখনই হইয়াছিল, যখন সেখানে চরিত্রহীনতা, লাম্পট্য ও প্রবৃত্তির দাসত্ব পূর্ণ মাত্রায় চলিয়াছিল। কিন্তু যখনি সেখানে নৈতিক ও আইন-কানুনের বন্ধন মানবীয় কামনা বাসনার উপর চাপাইয়া দেওয়া হইল, তখনই প্রবৃত্তি বাসনার সঙ্গে সঙ্গে মানবীয় আত্মাও সেই সকল বন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পরিল।
তৎকালীন ফ্রান্সে Pierre Louis একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রবন্ধ রচনাকারী ছিল। এই ব্যক্তি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও ছিল। তাহার অধীনে গল্পলেখক, নাট্যকার, নৈতিকতাবাদী প্রভৃতি একটি দল তাহার মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রচারে লিপ্ত থাকিত। সে তাহার গোটা লেখনী শক্তির সাহায্যে নগ্নতা ও নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশার বহুল প্রচার করিয়াছে। তাহার গ্রন্থ Afrodite- এ সে গ্রীসের এমন এক সময়ের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করিতেছেঃ
যখন উলঙ্গ মানবতা ধারণাতীত সৌন্দর্যের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি, যাহার সম্পর্কে ধর্মাবলম্বীগণ এই আশ্বাস দান করিয়াছে যে, খোদা তাহাকে আপন মূর্তিতে সৃষ্টি করিয়াছে- এক পবিত্র বেশ্যার মূর্তিতে নানাবিধ ঠাকঠমক ও কমনীয় ভঙ্গিতে বিশ হাজার দর্শকের সম্মুখে আপন দেহ সম্ভার উপস্থাপিত করিত, তখন পরিপূর্ণ কামভাবসহ তাহার প্রতি প্রণয় নিবেদন সেই পূত পবিত্র স্বর্গীয় প্রণয়, যাহার দ্বারা আমরা সকলে সৃষ্ট হইয়াছি-
কোন পাপ, লজ্জাকর অথবা অপবিত্র কার্য বিবেচিত হইত না।
মোদ্দাকথা এই যে, সে কবিত্বের সকল আবরণ উন্মেচন করিয়া স্পষ্ট ভাষায় এতখানি উক্তি করিয়াছেঃ
বলিষ্ঠ নৈতিক শিক্ষার দ্বারা আমাদিগকে এই গর্হিত কার্যের মূলোৎপাটন করিতে হইবে যে, নারীর মাতা হওয়া কোন অবস্থাতেই লজ্জাকর, অন্যায় ও অসম্মানজনক নহে।
বিংশ শতাব্দীর উন্নতি
ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিন্তাধারা ও মতবাদ এতদূর পর্যন্তই পৌছিয়াছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অন্তরীক্ষে এমন এক নূতন শ্যেনপক্ষীর আবির্ভাব হইল, যে তাহার পূর্ববর্তীগণ অপেক্ষা অধিক উচ্চে উড়িবার চেষ্টা করিল। ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে Peorr Wolff এবং Caston Leronx- এর একখানা নাটক Lelys প্রকাশিত হইল। এই নাটকে দুইটি বালিকা তাহাদের যুবক ভ্রাতার সম্মুখে পিতার সহিত এই বিষয়ে তর্ক করিতেছে যে, তাহাদের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীনভাবে প্রেম নিবেদন করিবার অধিকার আছে। তাহারা ইহাও বলিতেছে যে, প্রেম ব্যতিরেকে একজন যুবতীর জীবন কত মর্মন্তুদ হইতে পারে! একজন বৃদ্ধ পিতা তাহার কন্যাকে জনৈক যুবকের সহিত অবৈধ প্রেম করার জন্য তিরস্কার করিতেছে। তদুত্তরে কন্যা বলিতেছেঃ
আমি তোমাকে কিরূপে বুঝাইব? একটি বালিকা প্রেম না করিয়াই আইবুড়া হউক-ইহা কোন বালিকাকে বলিবার অধিকার কাহারও নাই, সে তাহার ভগ্নি হউক অথবা কন্যা হউক, ইহা তুমি কিছুতেই বুঝিতে পার নাই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এই স্বাধীনতার আন্দোলন শুধু বাড়াইয়াই দেয় নাই বরং এক চরম সীমায় পৌঁছাইয়া দিয়াছে। গর্ভনিরোধ আন্দোলনের প্রভাব ফ্রান্সের উপর অধিকতর পড়িয়াছে। ক্রমাগত চল্লিশ বৎসর যাবত ফ্রান্সের জন্মহারের পতন ঘটিতেছিল। ইহার সাতাশিটি জেলার মধ্যে মাত্র বিশটি জেলার জন্মহার মৃত্যুহারের অধিক ছিল। দেশের কোন কোন অঞ্চলে এরূপ অবস্থা ছিল যে, একশ শিশুর জন্মের বিপক্ষে মৃত্যুহার ছিল ১৩০ হইতে ১৬০ এর মাঝামাঝি। যখন ফরাসি জাতির জীবন-মৃত্যু সিদ্ধান্তকারী মহাযুদ্ধ শুরু হইল, তখন দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ জানিতে পারিলেন যে, জাতির ক্রোড়ে যুদ্ধোপযোগী যুবকের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। এই অল্প সংখ্যক যুবককে উৎসর্গ করিয়া জাতীয় জীবনকে হয়ত নিরাপদ করা যাইতে পারে, কিন্তু শত্রুর পরবর্তী আক্রমনে রক্ষা পাওয়া দুস্কর হইবে। এই অনুভূতি সমগ্র ফরাসীদেশে জন্মহার বর্ধিত করিবার এক তিব্র অনুপ্রেরণা জাগাইয়া তুলিল। চতুর্দিক হইতে গ্রন্থকার, সাংবাদিক, বক্তা, বিদ্বানমণ্ডলী ও রাজনীতিবিদগণ সমবেত কণ্ঠে প্রচার শুরু করিল “সন্তান জন্মাও। বিবাহের প্রচলিত বন্ধনের ভয় করিও না। যে সমস্ত কুমারী নারী ও বিধবা জন্মভূমির কল্যাণের জন্য তাহাদের গর্ভে সন্তান ধারণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হইবে, তাহারা সমাজের নিন্দনীয় না হইয়া বরং সম্মানের অধিকারিণী হইবে।”
এই সময়ে স্বাধীনতাকামী ভদ্রলোকদের স্বাভাবিকভাবেই এক সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হইল। তাহারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিয়া শয়তানের ঝুলিতে অবশিষ্ট যাবতীয় মতবাদ ও চিন্তাধারার প্রচার শুরু করিল।
তৎকালীন জনৈক বিশিষ্ট গ্রন্থকার Lo-Lyon Republican- এর সম্পাদক ‘বলপূর্বক ব্যভিচার অপরাধজনক কেন?’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিম্নরূপ মন্তব্য করেনঃ
নিরন্ন দরিদ্র যখন ক্ষুধার তাড়নায় অতিষ্ঠ হইয়া চুরি ও লুটতরাজে লিপ্ত হয়, তখন বলা হয় যে, তাহার অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করিয়া দাও, চুরি ও লুটতরাজ আপনিই বন্ধ হইয়া যাইবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দেহের একটি প্রাকৃতিক চাহিদা মিটাইবার জন্য যে সাহায্য সহানুভূতি করা হয়, অনুরূপ দ্বিতীয় প্রাকৃতিক এবং গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মিটানো অর্থাৎ যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির বেলায় তাহা করা হয় না। ক্ষুধার তীব্র তাড়নার পরিণামে যেমন মানুষ চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হয়, তেমনই বলপূর্বক ব্যভিচার এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাণহত্যাও যৌনক্ষুধার অনুরূপ তীব্র তাড়নার পরিণাম হিসাবেই হইয়া থাকে – যাহা ক্ষুধাতৃষ্ণা অপেক্ষা কম প্রাকৃতিক নহে। একটি স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ যুবক স্বীয় কামরিপু জোরপূর্বক সংযত রাখিতে পারে না – যেমন সে তাহার ক্ষুধা এই প্রতিশ্রুতিতে নিবৃত্ত রাখিতে পারে না যে, আগামী সপ্তাহে তাহার অন্ন জুটিবে। আমাদের শহরগুলিতে সব কিছুরই প্রাচুর্য রহিয়াছে। কিন্তু একজন নিঃস্বের উদরান্নের অভাব যেমন মর্মন্তুদ, তেমনই তাহার যৌন সম্ভোগের অভাবও অতি মর্মন্তুদ। ক্ষুধার্তকে যেমন বিনা মুল্যে খাদ্য বিতরণ করা হয়, তেমনই দ্বিতীয় প্রকারের ক্ষুদায় যাহারা অতিষ্ঠ, তাহাদের জন্যও কিছু ব্যবস্থা করা আমাদের কর্তব্য।
মনে রাখা আবশ্যক যে, ইহা কোন পরিহাসব্যঞ্জক প্রবন্ধ নহে। ইহা যেমন অতি দায়িত্ব ও গুরুত্ব সহকারে লিখিত হইয়াছিল, তেমনই ফরাসী দেশে অতি গুরুত্ব সহকারেই ইহা প্রচারও হইয়াছিল।
এই সময়ে প্যারিসের Faculty of Medicine জনৈক অভিজ্ঞ ডাক্তারকে তাহার একটি প্রবন্ধের জন্য ‘ডক্টরেট’ উপাধি প্রদান করে। প্রবন্ধটি সরকারি মুখপত্রেও প্রকাশ করা হয়। উক্ত প্রবন্ধের এক স্থানে নিম্নরূপ মন্তব্য করা হইয়াছেঃ
আজ আমরা বিনা দ্বিধায় বলিয়া থাকি যে, রক্তনিষ্ঠীবন (থুথু) ত্যাগের জন্য আমাকে পর্বত শিখরে প্রেরণ করা হইয়াছিল। আমাদের বিশ্বাস, এমন একদিনও আসবে, যেদিন আমরা কৃত্রিম গর্ব ও লজ্জা ব্যতিরেকে বলিতে পারিব, বিশ বৎসর বয়সে আমার সিফলিস হইয়াছিল। এই ব্যাধিগুলি তো জীবনের সুখসম্ভোগের মূল্যবিশেষ। যে ব্যক্তি তাহার জীবন এমনভাবে অতিবাহিত করে যে, তাহার দ্বারা কোন ব্যাধির উপক্রম হয় না, – তাহার জীবন অসম্পূর্ণ। সে কাপুরুষতা, নম্র স্বভাব অথবা ধর্মীয় বিভ্রান্তির কারণে তাহার প্রকৃতিগত দৈহিক চাহিদা পূরণে নিবৃত্ত থাকে অথচ ইহা তাহার স্বাভাবিক চাহিদাগুলির মধ্যে একটা নগণ্য চাহিদামাত্র।
নওমালথুসীয় সাহিত্য
সম্মুখে অগ্রসর হইবার পূর্বে গর্ভনিয়ন্ত্রন বা গর্ভনিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচিত মতবাদ ও চিন্তাধারার প্রতি একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা প্রয়োজন মনে করি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রেষ্ঠ ইংরেজ অর্থনীতিবিদ মালথুস যখন বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য বার্থ কন্ট্রোল বা জন্মনিয়ন্ত্রনের প্রস্তাব করেন, তখন তিনি স্বপ্নেও ইহা ভাবিয়া দেখেন নাই যে, তাঁহার সেই পরামর্শ এক শতাব্দীর পরে ব্যভিচার ও অশ্লীলতা প্রচারের সহায়ক হইবে। মালথুস জনসংখ্যা বৃদ্ধি বন্ধ করিবার জন্য আত্মসংযম, অধিক বয়সে বিবাহ প্রভৃতির পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে যখন নও মালথুস আন্দোলন (New Multhusian Movement) শুরু হইল, তখন তাহার মূলনীতি ছিল স্বাধীনভাবে কামরিপু চরিতার্থ করা এবং উহার স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবে সন্তানের জন্মলাভ বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে বন্ধ করা। ইহার ফলে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের যে শেষ প্রতিবন্ধকতাটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাহাও দূরীভূত হইয়া পাপাচারের পথ নিষ্কণ্টক হইল। কারণ এখন একজন নারী স্বাধীনভাবে তাঁহার দেহসম্ভারকে পর পুরুষের জন্য বিলাইয়া দিতে পারে। অতপর সন্তান লাভ বা তাঁহার প্রতিপালনের দায়িত্ব সম্পর্কে আর কোন শঙ্কাই থাকিল না। এই সবের ভয়াবহ পরিণাম ফল বর্ণনা করিবার অবকাশ এখানে নাই, তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কীয় সাহিত্যাবলিতে যে সকল মতবাদের প্রচার করা হইয়াছে, এখানে তাহার কিঞ্চিত উদাহরণ দিব।
যে সব যুক্তিপ্রমাণাদির দ্বারা এই সকল সাহিত্যে নও মালথুসীয় ভূমিকা লেখা হইয়াছে, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপঃ
প্রত্যেক মানুষকে প্রকৃতিগতভাবে তিনটি বিরাত ও প্রচণ্ড অভাবের সম্মুখীন হইতে হয়। প্রথম খাদ্য, দ্বিতীয় বিশ্রাম ও তৃতীয় কামরিপু চরিতার্থকরণ। প্রকৃতি এই তিনটি বস্তু মানুষের মধ্যে পূর্ণ শক্তিতে গচ্ছিত রাখিয়াছে। এই সবের অভাব পূরণের মধ্যে বিশেষ আনন্দও ঢালিয়া দিয়াছে। সেইজন্য মানুষ এই সকল অভাব পূরণের জন্য স্বভাবতই অভিলাষী হয়। যুক্তি ও তর্ক মানুষকে ইহার জন্য তীরবেগে ধাবিত হইতে বাধ্য করে। প্রথম দুইটি বিষয়ে তাহার কার্যপ্রণালী একইরূপ হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তৃতীয়টির ব্যাপারে তাঁহার কার্যপ্রণালী ভিন্নরূপ। সামাজিক নৈতিক বিধান তাহার উপর এই বাধ্যবাধকতা আরোপিত করিয়াছে যে, যৌন অভিলাষ বিবাহ ব্যতিরেকে পূর্ণ করা চলিবে না। বৈবাহিক সীমারেখার মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের জন্য বিশ্বস্ততা এবং সতিত্ব-সম্ভ্রমকে অনিবার্য করা হইয়াছে। উপরন্তু ইহাও শর্ত করিয়া দেয়া হইয়াছে যে, সন্তানের জন্মনিরোধ করা চলিবে না। এই ধরনের বিধিবিধান সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। ইহা জ্ঞান ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ইহা নীতিগতভাবেও ভ্রান্ত ও মানবতার জন্য ভয়াবহ পরিণামদর্শী।
এবম্বিধ ভূমিকার উপর যে সকল মতবাদের প্রাসাদ নির্মিত হয়, তাহাও একবার লক্ষ্য করিয়া দেখুন। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা Babel স্পষ্ট ভাষায় লিখিতেছেনঃ
- নারী ও পুরুষ তো পশুই। পশু-দম্পতির মধ্যে কি কখনো বিবাহের-স্থায়ী বিবাহের – প্রশ্ন উত্থাপিত হয়?
Dr. Drysdale বলেনঃ
আমাদের যাবতীয় অভিলাষের মধ্যে প্রেমও একটি পরিবর্তনশীল বস্তু। ইহাকে একক পন্থায় নির্দিষ্ট করিয়া দেয়ার অর্থ প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের সংশোধন করা। তরুণ-তরুণী একটা বৈশিষ্ট্য সহকারে এই পরিবর্তনের বাসনা রাখে। প্রাকৃতিক বিরাট সুবিচারপূর্ণ ব্যবস্থানুযায়ী আমাদের বাসনা এই যে, এই ব্যাপারে তাহাদের অভিজ্ঞতা যেন রকমারী হয়। স্বাধীন সম্পর্ক উৎকৃষ্ট চরিত্রের অভিব্যক্তি এইজন্য যে, ইহা প্রাকৃতিক নিয়মনীতির সহিত অধিকতর সাদৃশ্য রাখে। উপরন্তু ইহা ভাবপ্রবণতা, অনুভূতি ও নিস্বার্থ প্রেম হইতে সরাসরি প্রকাশ পায়। যে অনুপ্রেরণা ও বাসনার দ্বারা এই সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, তাহার বিরাট নৈতিক মূল্য রহিয়াছে। এমন সৌভাগ্য সেই ব্যবসাসুলভ আদানপ্রদানের দ্বারা কিরূপে সম্ভব হইবে, যাহা বিবাহকে প্রকৃতপক্ষে একটি পেশায় পরিণত করে?
পাঠক লক্ষ্য করুন, দৃষ্টিভঙ্গীর কিরূপে কখন পরিবর্তন হইতেছে এবং ক্রমশ কিভাবে বিপরীত মতাদর্শ গ্রহণ করা হইতেছে। প্রথমত এই চেষ্টা চলিয়াছে যে, ব্যাভিচারকে নৈতিকতার দিক দিয়া নির্দোষ মনে করা হইবে এবং বিবাহ ও ব্যাভিচার সমপর্যায়ভুক্ত হইবে। কিন্তু এখন সম্মুখে অগ্রসর হইয়া বিবাহকেই দূষণীয় মনে করা হইতেছে এবং ব্যাভিচারকে উৎকৃষ্টতর মর্যাদা দান করা হইতেছে।
উক্ত ডাক্তার অন্য এক স্থানে বলিতেছেনঃ
এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন, যাহার দ্বারা বিবাহ ব্যতিরেকে প্রেম করাকে সম্মানজনক মনে করা যায়। ইহা আনন্দের বিষয় যে, তালাকের পন্থা শিথিল হওয়ায় বিবাহের পথও বন্ধ হইয়া আসিতেছে। কারণ এখন বিবাহটা মিলিতভাবে জীবন যাপন করিবার জন্য দুই ব্যক্তির মধ্যে একটি চুক্তি এবং উভয় পক্ষ যখন ইচ্ছা তখনই এই চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটাইতে পারে। যৌন মিলনের ইহাই একমাত্র সুষ্ঠু পন্থা।
ফরাসীদেশের খ্যাতনামা নও-মালথুসীয় নেতা Paul Robin লিখিতেছেনঃ
বিগত পঁচিশ বৎসরে আমরা এতখানি সাফল্য অর্জন করিয়াছি যে, অবৈধ সন্তানকে আমরা প্রায় বৈধ সন্তানের পর্যায়ে আনিয়া ফেলিয়াছি। এখন এতটুকু করিবার আছে, যাহাতে এখন শুধু হারামী বা অবৈধ সন্তানই জন্মলাভ করিতে পারে। কারণ তাহা হইলে আর প্রতিযোগিতার প্রশ্নই উঠিবে না।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক ‘মিল’ সাহেব তাঁহার গ্রন্থ On Liberty তে দৃঢ়তার সহিত ইহা বলিতেছেন, যে ব্যক্তি জীবন যাপন করিবার জন্য যথেষ্ট উপায়-উপাদানের প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহাকে আইনের সাহায্যে বিবাহ হইতে বিরত রাখা হইবে। কিন্তু ইংল্যান্ডে যখন বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করার প্রশ্ন উঠিল, তখন এই বিজ্ঞ দার্শনিকই উহার প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন। তাঁহার যুক্তি এই ছিল যে, ইহা দ্বারা ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করা হয় এবং শ্রমিকদের অবমাননা করা হয়। কারণ ইহার দ্বারা তাহাদের সহিত ছেলেমী করা হইয়াছিল।
চিন্তা করিয়া দেখুন, ব্যাক্তি স্বাধীনতার মর্যাদা এইজন্য দিতে হইবে যে, উহার সুযোগে ব্যভিচার করা হইবে। কিন্তু কোন মূর্খ যদি ব্যক্তি স্বাধীনতার বলে বিবাহ করিতে চায়, তবে তাহার সে স্বাধিনতার রক্ষার অধিকার থাকিবে না। তাহার স্বাধীনতায় আইনের হস্তক্ষেপ শুধু গ্রহণযোগ্যই নহে, বরং স্বাধীনতাপ্রিয় দার্শনিকের বিবেক উহাকে প্রয়োজনীয় মনে করে। এখানে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিপ্লব চরম সীমায় উপনীত হইতেছে। যাহা দূষণীয় ছিল, তাহা এখন নির্দোষ হইয়াছে এবং যাহা নির্দোষ ছিল তাহা এখন দূষণীয়।