বিরূপ প্রতিক্রিয়া
পূর্বে যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তার ফলে পাশ্চাত্য জাতিগুলোর দূরদর্শী লোকেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। চিন্তাবিদেরা এ অবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষ ও অস্থিরতা প্রকাশ করছেন। প্রত্যেক দেশেই জনসংখ্যা সমস্যার নূতন নূতন রূপ দেখা যাচ্ছে এবং কিছু নূতন আন্দোলন শুরু হয়েছে ও হচ্ছে। এতদসঙ্ঘে বাস্তব কর্মপন্থায়ও পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আমরা নিম্নে এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তারই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
ইংলন্ড- এদেশের প্রথম মহাযুদ্ধের সময় (১৯১৬ সালে) একটি জাতীয় জন্মহার কমিশন (National Birth-Rate Commission) নিয়োগ করা হয়। এই কমিশনে চিকিৎসা, অর্থনীতি বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, শিক্ষা ও ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ের মোট ২৩ জন বিশেষজ্ঞকে শামিল করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মকর্তা ডাঃ ষ্টিভেনসন, (Stevenson) এবং প্রধান মেডিকেল অফিসার স্যার আর্থার নিউজহোম (Newsholme) ও এতে যোগদান করেন। এ কমিশনের পক্ষ থেকে অনেকগুলো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি রিপোর্ট নিম্নরূপঃ
“বৃটেনকে জনসংখ্যা উত্তরোত্তর হ্রাস প্রাপ্তি সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্বেগ সহকারে চিন্তা করা উচিত এবং সংখ্যার নিন্মগতি রোধ ও একে যথা সম্ভব বৃদ্ধি করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করা অত্যন্ত জরুরী।”
ইংলন্ডের স্বাস্থ্য দফতরের অধীনস্থ প্রধান মেডিকেল অফিসার স্যার জর্জ সিলম্যান জনসংখ্যা হ্রাস সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেনঃ
“যদি জনসংখ্যার নিম্নগতি অব্যাহত থাকে তাহলে বৃটেন একটি ৪র্থ শ্রেণীর শক্তিতে পরিণত হবে।”
লন্ডন স্কুল অব-ইকনমিক্স- এর ডিরেক্টর স্যার উইলিয়াম বিভারিজ (Beveridege) এক বেতার ভাষণে বলেন যে, মৃত্যু জন্মের অনুপাত বর্তমানের মত সামঞ্জস্যহীন অবস্থায় চলতে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে ইংলন্ডের জনসংখ্যা নিম্নগতি হয়ে পড়বে এবং পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ২০ লক্ষ লোক কমে যাবে। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার কার সানডাসও প্রায় একই মত প্রকাশ করেন। এ বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য জন্মনিরোধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এবং জাতীয় জীবন সংরক্ষণ সংস্থার (League of National Life) নামে ঐ দেশে একটি সংঘও কায়েম হয়েছে। এ সংস্থায় দেশের বিশিষ্ট পুরুষ ও মহিলাগণ যোগদান করেছেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও বৃটেনের শাসক শ্রেণী পুনরায় তীব্রভাবে জনসংখ্যা হ্রাস জনিত ক্ষতি অনুভব করেন, তাই ১৯৪৩ সালে বৃটেনের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র উজির (Home Secretary) মিঃ হার্বার্ট মরিশন বলেন যে, বৃটেনকে তার বর্তমান মর্যাদা কায়েম রাখতে ও ভবিষ্যতের তরক্কীর পথ খোলাসা করতে হলে, বৃটেনের প্রতিটি ঘরে শতকরা ২৫ জন হারে লোক বেশী হওয়া দরকার। সে সময় দেশের চিন্তাশীল লোকদের ধারণা ছিল এই যে, দুনিয়ার বুকে ইংলন্ডের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে নিজের স্বার্থেই জনসংখ্যা সম্পর্কে একটি নূতন ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে এবং জনসংখ্যার নিম্নগতি প্রতিরোধ করতে হবে। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে একটি রয়েল কমিশন গঠিত হয়। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতের জাতীয় পলিসী নির্ধারণের উপযোগী কোন কর্মসূচী পেশ করাই ছিল এই কমিশনের কাজ। কমিশন ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে রিপোর্ট পেশ করে এবং রিপোর্টে স্পষ্টভাবে বলা হয় যেঃ
“পরিবারের ক্ষুদ্রাকৃতির প্রধানত এবং একমাত্র কারণ হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে বংশ সংকোচ করার প্রচেষ্টা।”
এ রিপোর্টে কমিশন বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে যে, ঊনিশ শতক ও বিশ শতকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও তামাদ্দুনিক অবস্থা বড় বড় পরিবারের উপর বিরাট বহরের অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে এবং ফ্যাক্টরী এ্যাক্ট ও শিক্ষা বিভাগীয় আইন-কানুন শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করার সম্ভাবনা দূরীভূত করেছে। এতদসঙ্ঘে অন্যান্য কতিপয় কারণ যুক্ত হয়ে পরিবারে বেশী সংখ্যক সন্তানের জন্মকে অর্থনৈতিক বোঝায় পরিণত করেছে এবং জনগণ জন্মনিরোধের মাধ্যমে পরিবারকে সীমিত করার নীতি গ্রহণ করেছে। এরপর শিশুরা যেন পরিবারের অর্থনৈতিক দায় না হয়ে পড়ে এবং সন্তানের পিতা মাতা হওয়া যেন একটা বিপদে পরিণত না হয় সে জন্যে কমিশন বিস্তৃত সুপারিশাদী পেশ করেছে। কমিশনের সুপারিশগুলো নিম্নরূপঃ
১। প্রত্যেক পরিবারকে সন্তান সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রেখে ভাতা দান করতে হবে।
২। ইনকাম ট্যাক্সের নিয়ম পরিবর্তন করে ছাপোষা লোকদের ট্যাক্স হ্রাস ও অবিবাহিতদের ট্যাক্স বৃদ্ধি করতে হবে।
৩। ব্যাপকাকারে এমন সব বাড়ী তৈরী করতে হবে যাতে তিনটার অধিক শোবার ঘর থাকবে।
৪। স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণের পরিকল্পনার মাধ্যমে বড় বড় পরিবারগুলোর স্বচ্ছন্দে বসবাস করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। জনসংখ্যা সম্পর্কে স্থায়ী গবেষণা ও তৎসম্পর্কিত শিক্ষা দান ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।
এমন কি কমিশন এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম প্রজনন (Artificial Insemination) এর মত ঘৃণ্য ও অবাঞ্ছিত পন্থা উদ্ভাবনের সুপারিশ পর্যন্ত করেছে। এসব সুপারিশের প্রতি লক্ষ্য করে ইংলন্ডের সমাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন সে দেশে শিশুদের জন্য ভাতা নির্ধারিত হয়েছে। প্রসবকালে ছুটি, বিশেষ ভাতা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষা এবং বাসস্থানের সুযোগ সুবিধা দিয়ে লোকদের সন্তান জন্মানোর ভয় থেকে রেহাই দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর সুফলও দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে সে দেশে জন্মসংখ্যা বেড়ে চলেছে। ১৯৩১ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মহার ছিল হাজার প্রতি ১৪৮ কিন্তু ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মধ্যবর্তী সময়ে জন্মসংখ্যার হার দাঁড়িয়েছে হাজার প্রতি ১৭৪টি। ১৯৩১-১৯৪১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক গড়পরতা ছিল ১,০৭,০০০ কিন্তু ১৯৫১-৬০ সালের মধ্যবর্তীকালে এ সংখ্যা ২,৫০,০০০-এ উঠেছে। সম্প্রতি আদমশুমারীর ফলাফলে ঘোষণা করা হয়েছে যে, বৃটেনে বিগত দশ বছরে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে গত অর্ধশতাব্দীর তুলনায় এর হার অনেক বেশী।
ফ্রান্স-ফরাসী সরকার উপলদ্ধি করেছে যে, জন্মহার কমে যাওয়ার অর্থ ফরাসী জাতির ক্রমিক অধপতন। ফ্রান্সের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ আজ অনুভব করছেন যে, বর্তমান হারে জনসংখ্যা কমতে থাকলে, এমন একদিন আসবে যে দিন ফরাসী জাতি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আদমশুমারীর রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৯১১ সালের তুলনায় ১৯২১ সালে ফ্রান্সের জনসংখ্যা ২১ লক্ষ কমে গেছে। ১৯২৬ সালে ১৫ লক্ষ লোক বেড়েছে সত্যি, তবে তাদের বেশীর ভাগই অন্যান্য দেশ থেকে আগত। ফ্রান্সে ভিন্ন দেশীয় লোকদের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। বর্তমানে সে দেশে শতকরা ৭.২ জন অধিবাসী ভিন্ন দেশীয়। এটাও ফ্রান্সের জন্য নিতান্ত উদ্বেগজনক বিষয়। কেননা উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্তমান জামানায় কোনো জাতির লোকসংখ্যা কম হওয়া আর ভিন্ন জাতির লোকসংখ্যা ঐ দেশেই বেড়ে চলা ধ্বংসের পূর্বাভাস ছাড়া কিছুই নয়। ঐ বিপদ থেকে ফ্রান্সকে উদ্ধার করার জন্য National Alliance for the Increase Population নামে সে দেশে একটি শক্তিশালী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ফরাসী সরকার জন্মনিরোধের শিক্ষা এবং প্রচারকেও বে-আইনী ঘোষণা করেছে। জন্মনিরোধের স্বপক্ষে প্রাকাশ্যে বা গোপনে বক্তৃতা, রচনা বা পরামর্শ দান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন কি ডাক্তারদের প্রতি কড়া আদেশ জারী হয়েছে যে, তারা গোপনে বা প্রকাশ্যে এমন কোন কাজ করতে পারবেন না, পারবে না যার ফলে জন্মনিরোধের পথ প্রশস্ত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সে দেশে প্রায় এক ডজন আইন প্রবর্তন করা হয়ছে। এসব আইনের ফলে অধিক সংখ্যক সন্তান জন্মদানকারী পরিবারবর্গকে আর্থিক সাহায্য দান, তাদের ট্যাক্সের হার হ্রাসকরণ এবং বেতন, মঞ্জুরী ও পেন্সন বৃদ্ধিকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদের জন্য রেলের ভাড়া কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন কি বিশেষ মেডেল বিতরণেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। অপর দিকে যারা বিয়ে করে না কিংবা যাদের কোন সন্তান নেই, তাদের উপর অতিরিক্ত ট্যাক্স (Surtax)ধার্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ অবস্থা বিগড়ে যাবার পর ফরাসী জাতির চোখ খুলেছে এবং তারা স্বাভাবিক খোদায়ী বিধান পরিবর্তনের যে কুফল ভোগ করেছে, তার কাফফারা আদায় করতে শুরু করছে।
নয়া ব্যবস্থার ফলে ফ্রান্সের জনসংখ্যা কিভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছে তা নিম্নের সংখ্যাতত্ত্ব থেকে পরিস্কার বুঝা যাবে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
টেবিল পৃষ্টা ৪২ পিডিএফ
++++++++++++++++++++++++++++++
এ নয়া ব্যবস্থার ফলেই ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে ফ্রান্সের জনসংখ্যা শতকরা ২৬ জন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জার্মানী-নাৎসীদের ক্ষমতা লাভ করার পর জনসংখ্যা হ্রাসের হার বৃদ্ধি হতে দেখে বিষয়টিকে অত্যন্ত ‘বিপজ্জনক’ বলে আখ্যা দান করে এবং এর প্রতিকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ঐ সময় একটি পত্রিকায় নিম্নরূপ মন্তব্য প্রকাশিত হয়ঃ
“যদি আমাদের জন্মহার বর্তমান অবস্থায় হ্রাস পেতে থাকে তাহলে আমাদের জাতি একদিন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ্যা হয়ে যাবার আশংকা আছে। ফলে দেশের বর্তমান অধিবাসীদের স্থলাভিষিক্ত হবের উপযোগী নূতন মানব গোষ্ঠীর জন্ম আর হবে না।”
এ অচলাবস্থা থেকে রেহাই পাবার জন্যে জার্মান সরকার জন্মনিরোধের শিক্ষা ও প্রচারণাকে আইন জারী করে বন্ধ করে দেয়। স্ত্রীলোকদের কারখানা এবং অফিসের চাকুরী থেকে বহিস্কার করতে শুরু করে। যুবকদের বিয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ‘বিয়ে-ঋণ’ (Marriage Loan) নামে এক প্রকার আর্থিক ঋণ দানের ব্যবস্থা চালু করা হয়। অবিবাহিত ও সন্তানহীনদের উপর ট্যাক্স ধার্য করা হয় এবং অধিক সংখ্যক সন্তানের মাতা-পিতাদের ট্যাক্স হ্রাস করা হয়। ১৯৩৪ সালে এক কোটি টাকা পর্যন্ত ‘বিয়ে ঋণ’ দান করা হয় এবং এর দ্বারা ৬ লক্ষ নর-নারী উপকৃত হয়। ১৯৩৫ সালের নূতন আইন অনুসারে স্থিরিকৃত হয় যে, একটি সন্তান জন্ম হলেই আয়কর শতকরা ১৫, দুইটি শিশুর জন্ম হলেই শতকরা ৩৫, ৩ টি শিশুর জন্মের দরুন শতকরা ৫৫, ৪ টি শিশুর জন্মের দরুন শতকরা ৭৫ এবং ৫ টি সন্তানের দরুন শতকরা ৯৫ ভাগ কমিয়ে দেয়া হবে। আর ছয়টি সন্তানের জন্ম হলে আয়কর সম্পূর্ণরূপে মাফ করে দেয়া হবে। এসব ব্যবস্থার ফলে নাৎসী জার্মানীর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১-৩৫ সালে জন্মহার প্রতি হাজারে ১৬.৬ জন ছিল। ১৯৩৬-৪০ সালে এ হার বৃদ্ধি পেয়ে হাজার প্রতি ১৯.৬ এ পৌছে।
ইতালী-মুসোলিনী সরকার ১৯৩৩ সালের পর বিশেষভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগ প্রদান করে। জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচার প্রোপাগান্ডাকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। বিয়ে ও সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ফ্রান্স ও জার্মানী যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করে, তার সব কয়টিই ইটালীতে প্রবর্তন করা হয়। ইটালীর আইনে স্পষ্ট ভাষায় একবার উল্লেখ করা হয় যে, যে কোনো কাজ, বক্তৃতা বা প্রচার যদি জন্মনিয়ন্ত্রণের সমর্থন সূচক হয়, তাহলে এ কাজ, বক্তৃতা বা প্রচার পুলিশ কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণের যোগ্য অপরাধ এবং উক্ত অপরাধীকে এক বছরের কারাদন্ড অথাবা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। সাধারণ অবস্থায় এ আইন ডাক্তারদের উপরও প্রযোজ্য।
সুইডেন-কিছুদিন পূর্বে ট্রাইগার নামীয় সুইডেনের জনৈক প্রাক্তন উজীর পার্লামেন্টে (Ricksdag) বক্তৃতাকালে বলেছিলেনঃ “যদি সুইডিশ জাতি আত্মহত্যা করতে না চায় তাহলে নিত্যক্ষয়িষ্ণু জনসংখ্যা রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে উপায় উদ্ভাবন করা অত্যন্ত জরুরী। ১৯১১ সন থেকে জন্মহার কমতে শুরু হয়েছে এবং তা বর্তমানে উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌছে গেছে। জনসংখ্যা আর বাড়ছে না।” এ সতর্কবাণীর ফলে সুইডিশ পার্লামেন্ট ১৯৩৫ সালের মে মাসে একটি কমিশন নিয়োগ করে এবং উক্ত কমিশন তার দীর্ঘ রিপোর্টের মাধ্যমে একটি নূতন প্রস্তাব পেশ করে। উক্ত কমিশন পরিবারের আকার বৃদ্ধির পরামর্শ দেয় এবং প্রতিটি পরিবারের জন্য অন্তত ৩টি অথবা ৪টি সন্তানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। কমিশনের সুপারিশ মুতাবিক নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থাগুলো অবলম্বন করা হয়েছেঃ
- গর্ভনিরোধ ঔষধপত্রাদি বিক্রির উপর জাতীয় স্বাস্থ্য বোর্ডের কড়া নজর রাখা।
- ১৮ বছরের নিম্নবয়স্ক সন্তানের মাতাপিতাকে ট্যাক্স হ্রাসকরণ।
- অল্প ভাড়ার বাড়ী তৈরীকরণ।
- তিন বা ততোধিক সংখ্যক শিশুর জন্য ক্রমশ বার্ষিক রিবেট (Rebate) প্রদান।
- স্বাস্থ্য রক্ষা, বিশেষত শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে ঔষধ সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ।
এ নয়া ব্যবস্থার ফলে সুইডেনের জন্মসংখ্যায় যে প্রভাব পড়েছে, তা স্পষ্টরূপে নিম্নের সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায়ঃ
++++++++++++++
টেবিল পৃষ্টা ৪৪ পিডীএফ
++++++++++++++
যুদ্ধের অব্যবহিত পরে সুইডেনের জন্মহার পুনরায় হ্রাস পায়।
এ পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে, তা থেকে নিশ্চয়ই জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য অবগত হওয়া সম্ভব হয়েছে। এ আন্দোলনের যুক্তি কি, কি কি কারণে এ মতবাদের জন্ম, কোন কোন উপায়-উপাদান এ ব্যবস্থার প্রসারে সাহায্য করেছে, যেসব দেশে এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে সেখানে এর কি প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং যারা এথেকে তিক্ত অভজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, তারা বর্তমানে কোন দৃষ্টিতে চিন্তা করছে; এসব বিষয় আপনার সম্মুখে এসেছে। এরপর আমাদের বিশ্বাস, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভংগি উপলদ্ধি করা ও এর গভীরে প্রবেশ করা খুবই সহজ হবে।
ইসলামের মূলনীতি
পূর্বের আলোচনায় জন্মনিরোধের আন্দোলনের প্রসার, এর কারণ ও ফলাফলের যে বর্ণনা দান করা হয়েছে তা মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে দু’টি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠেঃ
একঃ পাশ্চাত্য জাতিসমূহের মনে জন্মনিরোধের ইচ্ছা জেগে ওঠা এবং বিপুল সংখ্যক অধিবাসীর মধ্যে এর প্রসার লাভ করার কারণ তাদের সন্তান ও বংশ বৃদ্ধির প্রতি স্বাভাবিক বৈরাগ্য নয় বরং দু’শতাব্দী যাবৎ সেখানে যে ধরনের কৃষ্টি, সভ্যতা, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, তার দরুন তারা এ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। যদি অবস্থা এরূপ হয়ে না পড়তো তাহলে আজও তারা উনিশ শতকের মতই জন্মনিরোধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতো। কেননা পূর্বে এদের মনে সন্তানের প্রতি যে মহব্বত ও বংশ বৃদ্ধির প্রতি যে স্বাভাবিক অনুরাগ ছিল, তা আজও বর্তমান আছে। মাত্র এক শতাব্দীকালের মধ্যে তাদের মনোভাবে কোন বিপ্লব আসে নি।
দুইঃ জন্মনিরোধ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পাশ্চাত্য জাতি গুলো যে সব জটিলতা ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে, তা থেকে সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এ আন্দোলন স্বাভাবিক ব্যবস্থায় যে রদবদল করতে চায়, তা মানব জাতির জন্য নিতান্ত ক্ষতিকর। আর প্রকৃত ব্যাপার এই যে, প্রকৃতির নিয়ম পরিবর্তনযোগ্য নয়। পরন্তু সভ্যতা, কৃষ্টি, অর্থনীতি ও সমাজ নীতির যে ব্যবস্থা মানুষকে প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত মুখে ঠেলে দিয়ে ধ্বংসের সম্মুখীন করে, তা পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরী।
মূলনীতি
পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতালব্ধ উপরক্ত দুটি বিষয় আমাদেরকে ইসলামের মূলনীতির অনেক নিকটবর্তী করে।
ইসলাম মানুষের স্বভাবের অনুসারী জীবন ব্যবস্থা। ব্যক্তি ও সমাজক্ষেত্রে তার যাবতীয় আদর্শ এ মূল সূত্রের ভিত্তিতে রচিত যে, মানুষ সমগ্র বিশ্বের স্বাভাবিক গতিধারার সংগে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলবে এবং প্রাকৃতিক নিয়মের উলটো পথে কখনও পা বাড়াবে না। কোরআন মাজীদ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি জীবকে পয়দা করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রকৃতিগতভাবে এমন পদ্ধতিও শিক্ষা দিয়েছেন, যা অনুসরণ করে এ জীব অস্তিত্ব লাভের পর নিজের কর্তব্য সঠিকভাবে সম্পাদন করার যোগ্য হয়-
++++আরবী পৃষ্ঠা- ৪৬ পিডিএফ ৫০ বই++++
অর্থঃ “আমাদের প্রতিপালক প্রতিটি বস্তুকে বিশেষ ধরনে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর যে উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সম্পাদন করার পথও বাতলিয়ে দিয়েছেন।”
সৃষ্টির সকল বস্তু বিনা দ্বিধায় এ হেদায়াত মেনে চলছে। এর কারণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা এদের যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, সে উদ্দেশ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবার বা এ পথে চলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করার কোন ক্ষমতাই তাদের দেয়া হয় নি। অবশ্য নিজের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির ব্যবহারের দ্বারা ভুল সিদ্ধান্ত করে স্বাভাবিক নিয়মের বিপরীত পথ আবিষ্কার করা ও সে পথে চলার চেষ্টা করাও তার ইচ্ছেধীন। তবে আল্লাহর তৈরী পথ পরিহার করে মানুষ নিজের খাহেশের অনুসরণ করে যে পথ তৈরী করে তা বক্র পথ এবং সে পথ ভ্রান্তিপূর্ণ-
+++ আআরবী++++++++++++
আল্লাহর হেদায়াত ব্যতীত যে নিজের নফছের অনুসরণ করে চলে তার চাইতে অধিকতর গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) আর কে হতে পারে?
এ গোমরাহীকে বাহ্যত যতই কল্যাণকর মনে করা হোক না কেন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ নির্দেশিত পথ পরিহার করে ও তাঁর নির্দেশিত সীমা লংঘন করে মানুষ নিজের ওপরই যুলুম করে থাকে। কেননা তাঁর ভুলকাজের পরিণাম তারই জন্যে ক্ষতি ও ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে।
+++ আরবী+++++
যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশিত সীমা লংঘন করে, সে নিজেরই ওপর যুলুম করে থাকে। আত-তালাক-১
কোরআন বলে যে, আল্লাহর সৃষ্ট গঠন-প্রকৃতিতে পরিবর্তন্ত সাধন করে আল্লাহ প্রবর্তিত প্রাকৃতিক নিয়ম ভংগ করা শয়তানী কাজ। আর শয়তান এ ধরনের কাজের কুমন্ত্রণা দাতা-
+++ আরবী++++
“(শয়তান বললো) আমি আদম সন্তানদের আদেশ দেবো, আর তারা আল্লাহর গঠন-প্রকৃতিতে পরিবর্তন সাধন করবে।” আন-নিসা-১১৭
আর শয়তান কে? সৃষ্টির আদিকাল থেকে যে মানুষদের দুশমন সেই শয়তানঃ
++++ আরবি+++++
-“তোমরা শয়তানের অনুসরণ করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন, সে তোমাদের অন্যায় ও অশ্লীল কাজের আদেশ দান করে। ” আল-বাকারা ১৬৭-৬৮
ইসলাম যে, মূলসূত্রের উপর তার তাহজীব, তামদ্দুন, অর্থনীতি ও সমাজ নীতির কাঠামো দাঁড় করেছে তা হচ্ছে, মানুষ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে নিজের প্রকৃতিগত সকল চাহিদা প্রাকৃতিক নিয়মানুসারেই পূর্ণ করবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত শক্তিগুলোকে তাঁর নির্দেশিত পথেই কার্যকরী করবে। উপরন্তু সে কখনো আল্লাহপ্রদত্ত কোন শক্তিকে অকেজো বা নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারবে না এবং কোন শক্তি ব্যবহার করার ব্যপারে আল্লাহ প্রদত্ত সীমারেখা লংঘন করবে না। এছাড়া শয়তানের প্রলোভন ও কুমন্ত্রণায় ভ্রষ্ট ও প্রকৃতির সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে কোন ভ্রান্ত পন্থায় নিজের কল্যাণ ও উন্নতির উপায় অনুসন্ধানও করবে না।