Form and Content: আকার ও বস্তু; আধেয় ও আধার
কোনো বস্তু বা অস্তিত্বের সামগ্রিক চরিত্র উপলব্ধির সূত্র। আধেয় বলতে কোনো অস্তিত্বের অন্তর্গত বস্তুপুঞ্জকে বুঝায়। আধার বলতে আধেয়র অন্তর্গত বস্তুপুঞ্জের পারস্পরিক সম্পর্কের সামগ্রিক রূপকে বুঝায়। একটি টেবিলের বস্তুর বা আধেয় বলতে টেবিলটা যা দিয়ে তৈরি আমরা তাকে বুঝি। টেবিলের আধার বা আকার বলতে বস্তুর সাংগঠনিক রূপ বুঝি। আকার ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক একটি দার্শনিক প্রশ্ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে আকার ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক। এই দর্শন অনুযায়ী আকার ও বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্বের মূল হচ্ছে অস্তিত্বের বিকাশে আকার ও বস্তুর ভূমিকার পার্থক্য। বস্তুই হচ্ছে বিকাশের মূল। আকার হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্বের সাংগঠনিক রূপ। ভাববাদী দর্শনে আকারকে বস্তুনিরপেক্ষ শক্তি বলে মনে করা হয়। প্লেটো, কাণ্ট প্রমুখ বিশিষ্ট ভাববাদী দার্শনিকের মতে বস্তু হচ্ছে আকারের প্রকাশ। বস্তুর পরিবর্তন বা বিকাশও তাই আকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই দর্শনে আকরই মূল, বস্তু নয়। চরম আকার অদৃশ্য এবং অজ্ঞেয়। কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মনে করে যে, বস্তুর নিজস্ব গতি আছে। আকার বস্তুর বিকাশে প্রায় ক্ষেত্রে সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক শক্তি হিসাবে কাজ করে। বস্তুর আভ্যন্তরিক পরিবর্তনের ফলেই তার আকারের পরিবর্তন ঘটে। সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে বস্তু ও আকারের এই বিরোধাত্মক সম্পর্কের উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সমাজের মানুষ, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি, সম্পদ হচ্ছে সমাজের বস্তু। সমাজের আকার হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক। সমাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সামাজিক বস্তুর পরিবর্তনে আকার এক সময়ে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আবার বস্তু পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আকারে পরিবর্তন ঘটে না। পুরাতন আকারের রেশ কিছুকাল চলতে থাকে। কিন্তু পুরাতন আকার স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে না। বস্তুর পরিবর্তনের আকারও পরিশেষে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
Fourier: ফোরিয়ার (১৭৭২-১৮৩৭ খ্রি.)
ফ্রাঙ্কো-ম্যারি-চার্লস ফোরয়ান ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী। ফোরিয়ার একটি অর্থবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং পিতার মৃত্যুর পরে নিজে যথেষ্ট অর্থের মালিকও হ। কিন্তু পরিবর্তীকালে রাজনৈতিক গণ্ডগোলে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। ফোরিয়ার প্রথমে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন। পরে তিনি একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে নিজের জীবিকানির্বাহ করেন। সমাজ সম্পর্কে তাঁর প্রথম বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ ১৮০৮ সনে প্রকাশিত হয়। একদিকে ফরাসি বিপ্লবের সাম্যমৈত্রীয় আদর্শ, অপর দিকে ধনতন্ত্রের বাস্তব জীবনে শোষক শোষিতের ব্যবধা ফোরিয়ারকে সমাজের এই বৈপরিত্যের বিশ্লেষণে উদ্ধুদ্ধ করে। ফোরিয়ার অত্যন্ত প্রাহ্জলভাবে সমাজের এক শ্রেণীর সম্পদ এবং অপর শ্রেণীর দারিদ্র্যের চিত্র অঙ্কন করেন। এই অসঙ্গতি তাঁকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার পথে নিয়ে যায়। এই বৈষম্যের কারণ কি? মানুষ কি স্বভাবগতভাবে কেউ শোষক এবং কেউ শোষিত হবে? এ প্রশ্নের জবাবে ফোরিয়ার ফরাসি বস্তুবাদীদের দর্শনকে সমর্থন করে বলেন যে, মানুষ স্বভাবগতভাবে শোষবক বা শোষিত নয়। মানুষের কোনো প্রবৃত্তিই তার মনজাত নয় –তা তার সমাজ বা পরিবেশজাত। যে চরিত্র অধিকাংশ মানুষের জন্য অমঙ্গলকর তা দূরীকরণের উপায় হচ্ছে বাস্তব পরিবেশকে পরিবর্তন করা। সুখ কিংবা স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার ইচ্ছা মানুষমাত্রেরই স্বাভাবিক। প্রয়োজন হচ্ছে এমন এক সমাজ সৃষ্টির যে সমাজে প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছা চরিতার্থ হতে পারবে। ফোরিয়ারের মতে এ সমাজ সৃষ্টিতে বিপ্লব বা জবরদস্তির কোনো প্রয়োজন নেই। এজন্য আবশ্যক মানুষের বৃহৎ সমাজকে স্বল্পসংখ্যক (চারশত পরিবারের) উৎপাদনশীল কতকগুলি ফ্যালাঞ্জ বা বাহিনীতে বিভক্ত করা। ফোরিয়ারের মতে এরূপ স্বল্পায়তন একই ভবিষ্যৎ সমাজের মূল কোষ হিসাবে কাজ করবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যরা গৃহের ন্যায় স্বাধীনভাবে পরিশ্রম করবে। পরিশ্রমের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকবে না এবং শ্রমের বিভাগও এই ফ্যালাঞ্জ সমাজে এরূপ হবে না যে, একজন উৎপাদক উৎপাদিত দ্রব্যের মাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে জড়িত থাকবে। আধুনিক শিল্পোৎপাদনের এই চরম শ্রমবিভাগ শ্রমকে অর্থহীন একঘেঁয়েমিপূর্ণ যাতনাকর দৈহিক শ্রমে পর্যবসিত করেছে। পরিকল্পিত সমাজে একজন শ্রমিক শুধু এক রকম নয়, সব রকম উৎপাদনের সঙ্গেই জড়িত থাকবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যদের দৈনন্দিন শ্রম এরূপভাবে সংগঠিত হবে যাতে একজন শ্রমিক একটা নির্দিষ্ট সময় (দেড় ঘণ্টা থেকে দুঘণ্টা) একটা নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত থাকার পরে ভিন্নতর কাজে নিযুক্ত হবে। এভাবে সংকীর্ণ পেশাদারী চরিত্র কারুর মধ্যে জন্মলাভ করতে পারবে না। সবাই উৎপাদনের সামগ্রিকরূপের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। এভাবে ফ্যালাঞ্জ-এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সম্পদে প্রাচুর্য আসবে। উৎপাদিত সম্পদ ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যদের মধ্যে তাদের নিজ নিজ দক্ষতা এবং শ্রমের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। ফোরিয়ার শহর এবং গ্রাম এবং দৈহিক শ্রম এবং মানসিক শ্রমের মধ্যকার পুঁজিবাদী সমাজের বিরোধ দূর করার প্রয়োজনের উপরও জোর দিয়েছিলেন। ফোরিয়ারের এসব মানবতাবাদী কল্পনার মহত্ত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ পরিবর্তনে শ্রমিক শ্রেণী যে অগ্রসর ভূমিকা পালন করবে –এ সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। অন্যান্য কল্পনাবাদী সমাজতান্ত্রিকের মত ফোরিয়ারও পুঁজিবাদীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন।
Freedom and Necessity: স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা, নিয়মাধীনতা
মানুষের ক্রিয়াকর্ম এবং সমাজ ও প্রকৃতির বিধানের মধ্যকার সম্পর্কের সমস্যাসূচক দার্শনিক ধারণা। মানুষ তার কর্মের ক্ষেত্রে কি স্বাধীন, না প্রকৃতি ও সমাজের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? মানুষ স্বাধীন না নিয়মের দাস? স্বাধীনতার অর্থ কি? নিয়ম-নিরপেক্ষ কোনো স্বাধীনতার অস্তিত্ব কি সম্ভব? এই প্রশ্নগুলি দর্শনে বিশেষ আলোচিত প্রশ্ন। ভাববাদী দর্শনে স্বাধীনতা ও নিয়মাধীনতা বা অনিবার্যতাকে পরস্পর-বিরোধী ধারণা বলে মনে করা হয়। এই দর্শনের মতে স্বাধীণতা হচ্ছে আত্মা বা ইচ্ছার স্বাধীনতা। এ স্বাধীণতার সঙ্গে আত্মার বহির্গত কোনো অবস্থা বা বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। মানুষের আত্মা বা ইচ্ছা হচ্ছে চরম আত্মা বা চরম ইচ্ছার প্রকাশ। চরম আত্মা চরমভাবে স্বাধীন। ব্যক্তির মধ্যেতার প্রকাশও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। কারণ মানুষের ইচ্ছা যদি পরিবেশের অধীন হয়, তা হলে মানুষের উপর কোনো কাজের নৈতিক দায়িত্ব আরোপ করা চলে না। মানুষ ইচ্ছার ক্ষেত্রে স্বাধীন বলেই তার কাজের নীতিগত বিচার সম্ভব। কাজেই মানুষের স্বাধীনতার কোনো নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতার একেবারে বিপরীত প্রান্তের মত হচ্ছে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদ। যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদের মতে, মানুষের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকতে পারে না। মানষ হচ্ছে প্রাকৃতিক বিধানের দাস। তার প্রতিটি আচরণ ও তার কাজ অনিবার্যভাবে এই বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ দর্শনে তাই মানুষ প্রাকৃতিক বিধানের অসহায় ক্রীড়নক বৈ আর কিচু নয়। কিন্তু ভাববাদী স্বাধীনতা আর যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রনবাদ উভয়ই স্বাধীণতা ও নিয়মাধীনতা বা অনিবার্যতার অবৈজ্ঞানিক একতরফা ব্যাখ্যা। স্বাধীণতা ও নিয়মাধীনতা পরস্পর সম্পর্কিত সত্য। উভয়ের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক উপলব্ধির মধ্যেই এদের যথার্থ চরিত্র বোঝা সম্ভব। এই সম্পর্ক উপলব্ধির প্রথম প্রয়াস দেখা যায় স্পিনোজার দর্শনে। তিনি কোনো বিধান বা অবস্থার অপরিহার্যতার উপলব্ধিকে ব্যক্তির স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ মাধ্যাকর্ষণের অধীন। মানুষ এমন কোনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না, যে স্বাধীনতায় সে মাধ্যাকর্ষণের অধীন তখনি মাত্র সে মাধ্যাকর্ষণের অধীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম বা নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সে অর্জন করতে পারে। কাজেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব বিধানের অপরিহার্যতার কারণ সচেতনভাবে উপলব্ধির মধ্যেই মানুষের স্বাধীনত নিহিত। মানুষ প্রকৃতির পরিপূর্ণ দাস ছিল সেই আদিম যুগে, যখন সে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করতে অক্ষম ছিল। তখন সে প্রকৃতির বিধানকে জানত না। আজ মানুষ ক্রমাধিক পরিমাণে প্রকৃতির প্রভু হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রকৃতির বিধানকে লঙ্ঘন করে নয়, প্রকৃতির বিধান সম্যকভাবে জ্ঞান হওয়ার মাধ্যমেই। বিধানহীন চরম স্বাধীনতা বলে মানুষের কিছু থাকতে পারে না। আবার বস্তুজগতের সে অসহায় ক্রীড়নকও নয়। মানুষ বস্তু, জগৎ ও সমাজের বিধান যত জ্ঞাত হতে পারে, বস্তু, জগৎ ও সমাজকে পরিবর্তন করার স্বাধীনতাও সে তত অর্জন করতে পারে।
French Revolution: ফরাসি বিপ্লব
Paris Commune: প্যারিসের কমিউন শ্রমিকদের বিপ্লবী ব্যবস্থা। কিন্তু শাসকশ্রেণীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়েছিল। ১৫ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত প্যারিস কম্যুনের অস্তিত্ব ছিল। তথাপি শ্রমিকদের বিপ্লবী ক্ষমতা দখল হিসাবে ‘প্যারিস কম্যুনকে’ মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়।
Freud, Sigmund: সিগমাণ্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯ খ্রি.)
সিগমাণ্ড ফ্রয়েড মনোসমীক্ষণের প্রবক্তারূপে মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত। অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়াতে ফ্রয়েডের জন্ম। অধ্যয়নজীবনে আইন থেকে বিজ্ঞান এবং পরবর্তীকালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৮৪ সনে ফ্রয়েড ভিয়েনার হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৮৮৫ সনে ফ্রয়েড ফরাসি স্নায়ুতন্ত্রবিদ চারকটের সংযোগে আসেন। চারকট মনে করতেন মৃগীরোগের মূলে মানসিক কারণ নিতিহ। চারকটের নিকট থেকে মনোসমীক্ষার আগ্রহ নিয়ে ফ্রয়েড ভিয়েনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৯৩ সালে ফ্রয়েড ব্রুয়ারের সহযোগিতায় ‘স্টাডিয়েন উবার হিস্টোরি’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, হিপনোসিস বা সংবেশনের মাধ্যমে রোগীর অচেতন মনের অবদমিত ভাবকে অর্গলমুক্ত করে মৃগীরোগীকে রোগমুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এমন চিকিৎসার ফল তেমন স্থায়ী হয় না দেখে ফ্রয়েড পরবর্তীকালে হিপনোসিস বা সংবেশন পদ্ধতি পরিত্যাগ করেন। এর পরে তিনি এককভাবে তাঁর মনোসমীক্ষণের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর স্বপ্নের তত্ত্বও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফ্রয়েপ মনে করতেন স্বপ্নের মধ্যে অচেতন জগতে অবদমিত বাসনা আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানসিক রোগের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডের প্রধান অবদান হচ্ছে তাঁর ‘আনকনসাস’ বা অচেতন মনের ব্যাখ্যা (দ্র. Unconscious অচেতন)। ফ্রয়েডের অচেতনকে ‘ইড’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘ইড’ হচ্ছে ব্যক্তির রোগ নিরপেক্ষভাবে হতে পারে এই তত্ত্বই যে ফ্রয়েড প্রবর্তন করেন, তাই নয়। তিনি আরো বলেন, সকল মানসিক রোগের মূলে আছে যৌনকামনা বা প্রবৃত্তির অবদমন। যৌনাবেগ হচ্ছে মানুষের জীবনের মূল আবেগ। কিন্তু সমাজের এই আবেগের স্বতঃস্ফুর্ত পূরণ সম্ভব নয়। বিভিন্নভাবে যৌন আবেগ ও ইচছাকে অবদমিত করা হয়। এই অবদমিত ইচ্ছা নিয়ে মনের বৃহত্তর এবং অচেতন ভাগের সংগঠন। অবদমিত ইচ্ছার আত্মপ্রকাশ এবং আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা এবং সচেতন মন বিবেক বা সেন্সরের প্রহরা ও প্রতিরোধ চেষ্টায় ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে। দ্বন্দ্বের তীব্রতায় ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। ফ্রয়েড ১৮৮৯ সালে ঘোষণা করেন, যৌনানুভূতি কেবল যে মৌলিক অনুভূতি তাই নয়। সাধারণভা মনে করা হয় যে, যৌনানুভূতি কেবল যে মৌলিক অনুভূতি তাই নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, যৌনানুভূতি বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যক্তির মধ্যে জন্ম লাভ করে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু ফ্রয়েড বলেন, বয়ঃপ্রাপ্তিতে নয়, ব্যক্তির জন্ম থেকেই যৌনানুভূতির জন্ম। ফ্রয়েডের তত্ত্বের অভিনবত্ব সমকালীন চিন্তার ক্ষেত্রে আলোড়ন এবং প্রতিবাদের সৃষ্টি করে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, ফ্রয়েডের পূর্বে মনের এরূপ গভীর বিশ্লেষণ আর কেউ করেন নি। তাছাড়া যৌনানুভূতি যে ব্যক্তি চরিত্রের একটি শক্তিশালী নিয়ামক তা আজ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ফ্রয়েড তাঁর এই তত্ত্বে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে যৌন অনুভূতিকে সব বিকারের একমাত্র কারণ বলে নির্দিষ্ট করার যে প্রবণতা দেখিয়েছেন তাকে গ্রাহ্য বলে অনেকে মনে করেন না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বের অভিনবত্বে কিছুটা বিমোহিত হয়ে কল্পনাবাদীতে পরিণত হয়েছেন। মানসিক রোগের কারণকে তিনি ব্যক্তির দেহ এবং সামাজিক পরিবেশ বিচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে মানসিক রোগ নিরাময়ের সমাজ বিচ্ছিন্ন যে পদ্ধতির তিনি আবিস্কার করেছেন তা দ্বন্দ্ব সংঘাতময় সমাজে অসহায় ব্যক্তির মানসিক বিকারের নিরসনে খুব কার্যকর কোনো ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় নি।
১৯০৩ সালে তিনি ভিয়েতনাতে ‘মনোসমীক্ষণবিদ চক্র’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে এই সংগঠনের শাখা প্রসার লাভ করে। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৮ সালে সুইজারল্যাণ্ডের সালজবার্গে বিকৃতি নিবারণের উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোসমীক্ষণ সমিতি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৬ সালে ফ্রয়েডের আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে ফ্যাসিস্ট হিটলারের বাহিনী ভিয়েনা দখল করার পরে নিরাপত্তার জন্য লণ্ডনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ১৯৩৯ সনে লণ্ডনেই মারা যান।
Futurism: ভবিষ্যবাদ
১৯০৯-১১ সালে ইতালির কবি মারিনেতী (১৮৭৬-১৯৪৪) শিল্প এবং সাহিত্যে ‘যন্ত্রই সব’ এরূপ একটি নতুন ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। মারিনেতী তাঁর ‘মেফেস্টি দাল ফিউচারিজমো’ নামক গ্রন্থে ঘোষণা করেন: ‘যন্ত্রই আমাদের অরাধ্য। যন্ত্রকে আমরা শীর্ষে স্থাপন করব। আমরা যন্ত্রের গুণ কীর্তন করব’। শিল্পবোধে নতুনত্ব আমদানি করে মারিনেতী বলেনঃ একটা বিদ্যুৎগতি মোটর গাড়ি একটি তথাকথিত সুন্দর ভাস্কর মূর্তির চেয়ে আমাদের নিকট অনেক বেশী সুন্দর। ১৯১১ সালে মারিনেতী ইতালির পাঁচজন তরুণ শিল্পীর একটি চিত্রপ্রদর্শনী সংগঠিত করেন। এই শিল্পীগণ তাঁদের ঘোষণাপত্রে নিজেদের বিপ্লবী ঘোষণা করে বলেন যে, প্রতিষ্ঠিত শিল্পবোধের তাঁরা বিরোধী। ‘আমরা গতির শিল্পী। গতিকে আমরা মূর্ত করে তলব। চিত্রকলা আর ইন্দ্রিয়ানুভূতি আচ্ছেদ্য। একটি খণ্ডকে অঙ্কন করা যথেষ্ট নয়। যেটা আবশ্যক সে হচ্ছে সেই বস্তুর মধ্যে যে গতি আছে তাকে অঙ্কন করা’। কবি মারিনেতীর এ ধারাটি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। কিন্তু স্বল্পকাল স্থায়ী এই ধারাটির মধ্যে অতীতের বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়ার এবং আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার যন্ত্রশক্তির অনিবার্য প্রভাবের সচেতন স্বীকৃতির একটা প্রয়াস দেখা যায়। ভবিষ্যবাদের আর একটি দিক আছে। যন্ত্রকে একমাত্র আরাধ্য করার মধ্যে এই যন্ত্রের সত্যকার স্রষ্টা যে শ্রমজীবী মানুষ তার গুরুত্বের যেমন স্বীকৃতি নেই, তেমনি এই শ্রমজীবী মানুষের যে দুর্দশা যন্ত্র দ্বরাই অনড় করে রাখার সুকৌশল চেষ্টা চরছে তার উপলব্ধির সাক্ষাৎও ভবিষ্যবাদের প্রবক্তাদের চিন্তায় পাওয়া যায় না। বস্তুত ভবিষ্যবাদ প্রকারান্তরে পুঁজিবাদের সৃষ্টি যান্ত্রিক শক্তিবাদের পরিপোষক।
G
Galaxy: ছায়াপথ
সূর্যসহ জ্যোতির্মণ্ডলের দশ হাজার কোটি তারকার সমবায়ে গঠিত জগৎকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ ছায়াপথ বলে অভিহিত করেন। ছায়াপত হচ্ছে তারকারাজি ও নীহারিকার পারস্পরিক আকর্ষণের ভিত্তিতে গঠিত ঘুর্ণ্যমান এক জটিল মণ্ডল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটা ছায়াপথের পরিধি আলোক বৎসরের হিসাবে পরিমাপ করেন। সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিসম্পন্ন আলো এক বৎসরে যতটা পথ অতিক্রম করতে পারে, তাকে আলোক বৎসর বলা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ মনে করে যে, একটা ছায়াপথের পরিধি এমনি একশ হাজার বা একলক্ষ আলোক বৎসরের পরিমাণ। জ্যোতির্মণ্ডলে ছায়াপথ কেবল একটি নয়। কয়েক শ কোটি থেকে কয়েক লক্ষ কোটি তারকার সমন্বয়ে গঠিত একাধিক ছায়াপথ নিয়ে তৈরি হয় অধিছায়াপত। জ্যোতির্বিজ্ঞান মানুষের দৃষ্টিতে সীমাহীন দিহন্তে প্রসারিত করে দিয়েছে। মহাবিশ্বের বিপুলতার কিছুটা ধারণা মানুষ ছায়াপথের বিবরণ থেকে করতে পারে।
Galen: গ্যালেন (১৩০-২০১ খ্রি.)
চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিসের পরেই চিকিৎসাবিদ গ্যালেনের স্থান। প্রাচীন এশিয় মাইনরের পারগামসে গ্যালেনের জন্ম। পারগামস, কোরিনথ এবং আলেকজান্দ্রিয়াতে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নের পরে গ্যালেন রোম গমন করে এবং পরবর্তীকালে রোমের সম্রাট মারকাস অরেলিয়াস-এর চিকিৎসাবিদ হিসাবে নিযুক্ত হন। হিপোক্রিটাস ব্যতীত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপর কেউ গ্যালেনের মতো সুদীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন নি। ষোড়শ শতকের ভেসালিয়াসের পূর্বে গ্যালেনের ন্যায় শারীরবিদ বা এ্যানটমিস্ট যেমন অপর কেউ ছিলেন না, তেমনি সপ্তদশ শতকের হারভের পূর্ব পর্যন্ত এমন দক্ষ ফিজিওলজিস্ট বা দেহতত্ত্ববিদও ছিলেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর তাঁর রচনার সংখ্যা গবেষকদের মতে ছিল ১৩০ এবং দর্শন, আইন এবং ব্যাকরণের উপর তাঁর সংখ্যা ছিল ১২৫।
Galileo: গেলিলিও (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রি.)
গেলিলী গেলিলিও ছিলেন ইতালির পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এ্যারিস্টটলের অনড় অভিমত এবং মধ্যযুগের বন্ধ্যা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলিলিও ছিলেন বিদ্রোহী পথপ্রদর্শক। তিনি বৈজ্ঞানি বিশ্বদৃষ্টির প্রবক্তা এবং আপেক্ষিকতা ও ‘ল অব ইনারসিয়া’ বা বস্তুর জড্যতার বিধানের আবিস্কারক। গেলিলিওর গবেষণা কপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিকতার তত্ত্বকে সুপ্রমাণিত করে বিশ্ব সম্পর্কে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। এই আঘাতে যাজক সম্প্রদায় সন্ত্রস্ত হয়ে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘোষণা করে যে, কপারনিকাসের তত্ত্ব সঠিক বলে কোনো অভিমত প্রকাশ করতে পারবে না। তেমন অভিমত কেউ প্রকাশ করলে তাকে জীবন্দ দগ্ধ করা হবে। এর ফলে গেলিলিও দীর্ঘকাল নীরব থাকতে বাধ্য হন। গেলিলিওর বিশ্বদৃষ্টি ছিল সুস্পষ্টরূপে প্রগতিশীল। তিনি মনে করতেন, বিশ্ব হচ্ছে অসীম এবং বস্তু হচ্ছে শাশ্বত। বিশ্ব প্রকৃতিকে জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা।
Ghose, Aurobindo: অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০ খ্রি.)
বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তাবিদ, এককালের রাজনৈতিক নেতা এবং শেষ বয়সে যোগী শিক্ষাজীবনের পর অরবিন্দ স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯০৮ সালে তিনি বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার এবং বে-আইনিভাবে বোমা তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। অরবিন্দ এবং অন্যান্য গোপন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে, ‘আলীপুর বোমার মামলা’ বলে বিখ্যাত মামলা দায়ের করা হয়। বোমার মামলা থেকে মুক্ত হয়ে অরবিন্দ রাজনীতি পরিত্যাগ করে ধর্ম-সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত দার্শনিক ধারণা প্রচারের জন্য অরবিন্দ দক্ষিণ ভারতরে পণ্ডিচেরিতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। অরবিন্দ বেদান্ত দর্শনের নতুন ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেন। তাঁর ব্যাখ্যাকে সমন্বিত বেদান্ত দর্শন বলা হয়। তাঁর এই ব্যাখ্যার প্রাচীন ভারতের বেদান্ত দর্শন এবং ইউরোপীয় আধুনিক দর্শন, বিশেষ করে হেগেল, ব্রাডলে, আলেকজাণ্ডার প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকদের ভাবসমূহের মিশ্রণ দেখা যায়। অরবিন্দ মানুষের ইতিহাসকে চেতনার স্তর-ক্রমিক বিকাশ বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে অর্ধ-চেতন, এবং অতি-চেতন মানুষের চেতনা এইরূপ বিভিন্ন পর্যায়ের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করেছে। সামাজিক বিকাশে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র কোনোটাকে শ্রেয় মনে করতে না পেরে অরবিন্দ বিকাশের এক তৃতীয় পথের কল্পনা করেন। অরবিন্দের দর্শন প্রধানত ভাববাদী।
Gandhism: গান্ধীবাদ
অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রখ্যাত রানীতিক মোহন দাস করমচান্দ গান্ধীর (১৮৬৯০১৯৪৮ খ্রি.) সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অভিমত গান্ধীবাদ বলে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। গান্ধীবাদ রাজনীতি ও সমাজনীতির সাথে ধর্মের সংমিশ্রণে গঠিত। গান্ধীবাদ বলতে অহিংসাবদও বুজায়। কারণ গান্ধী অহিংসাকে কোনো লক্ষ্য সাধনের কেবল উপায় নয়, অহিংসাকেই চরম লক্ষ্য বলে মনে করতেন। তাঁর মতে অহিংসা ও নৈতিক শক্তি হচ্ছে সকল পরিবর্তনের মূল উপায়। অহিংসা নিছক একটা কর্মকৌশল নয়। অহিংসা মানবজীবন ও সমাজের মূল ভিত্তি। গান্ধীর অহিংসাবাদের সঙ্গে কাউন্ট লিও টলস্টয়ের নৈরাষ্ট্রবাদী মতের মিল ছিল। বস্তুত গান্ধীর সমাজদর্শনে টলস্টয়ের সমাজদর্শনের সুস্পষ্ট প্রবাবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘হরিজন’ পত্রিকা এবং আপন স্মৃতিকথা ও তাঁর অপরাপর গ্রন্থে গান্ধীবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। গান্ধী তাঁর অহিংসাবাদ বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে অহিংস অসযোগিতার নীতি দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর অহিংসাবাদ বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে অহিংস অসহযোগিতার নীতি দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর রাজনীতিক জীবনের শুরুতে প্রয়োগ করেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতালাভের উপায় হিসাবে ভারবতবর্ষে এই পদ্ধতি প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীবাদের প্রয়োগ অবিমিশ্র এবং সর্বদা সার্থক না হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব, সারল্য এবং অনমনীয়তা ভারত ভূখণ্ডের জনসাধারণের, বিশেষ করে বৃহত্তর হিন্দুসমাজের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগাতে এবং ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে ইংরেজ শাসকদের কাছে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে বিপুলভাবে সাহায্য করে। গান্ধীবাদ একান্তই ব্যক্তিবাদী ধর্মাশ্রয়ী বুর্জোয়া কল্পনাবিলাসী দর্শন। সমাজের বৈষম্যের জন্য দুৎখবোধ করলেও গান্ধীবাস সেই বৈষম্যের মূল কারণ বিশ্লেষিত হয় নি। ফলে অহিংসার মাধ্যমে সব বৈষম্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা বাস্তবে স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। গান্ধীর মৃত্যুর (১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী তিনি গোঁড়া হিন্দু বিনায়ক গডসের গুলিতে নিহত হন) সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভারতীয় সমাজ জীবন হতে হ্রাস পেতে থাকে। গান্ধীবাদের কোনো শক্তিশালী উত্তরাধিকার ভারতীয় সমাজে দৃষ্ট হয় না।
General Will: সাধারণ ইচ্ছা
রুশোর রাষ্ট্র-তত্ত্বমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সোস্যাল কণ্ট্রাক্ট’ বা ‘সমাজ চুক্তি’ কিংবা ‘সামাজিক চুক্তি’র একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে ‘জেনারেল উইল’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’। এই পদের মাধ্যমে রুশো একদিকে যেমন অষ্টাদশ শতকে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতার লড়াইতে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের উপর জোর প্রদান করেছেন, অপরদিকে তেমনি তিনি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যক্তির ইচ্ছা বা স্বাধীনতা যে মূল নয়, মূল যে মানুষের যৌথ স্বেচ্ছায় সৃষ্ট সমাজসত্তা, তাকেও যুক্তিগতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে রুশো ব্যক্তি ইচ্ছাকে দুইভাবে বিভক্ত করেছেন। ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছার ভিত্তিতে সৃষ্ট যৌথ সত্তা হচ্ছে রাষ্ট্র বা সমাজ। এই সমাজ একটি ক্রিয়াশীল অস্তিত্ব। এ অস্তিত্বেরও ইচ্ছারূপ শক্তি আছে। এবং এই ইচ্ছা’র উৎস হচ্ছে ব্যক্তির সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি করার ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে ঐকমত্য। রাষ্ট্র বা সমাজ হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইচ্ছা। এবং এই ইচ্ছাই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছার সাধারণ রূপ। সাধারণ বা জেনারেল এই অর্থে যে এ ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তির ইচ্ছাই এক। সকলের ইচ্ছা অভিন্ন। সকলে মিলে যৌথ জীবন যাপনের ইচ্ছা। এবং সমাজ জীবনে এই অভিন্ন ইচ্ছাই হচ্ছে সার্বভৌম। ‘ব্যক্তির ইচ্ছার ভিত্তিতে সমাজ বা রাষ্ট্রের ইচ্ছা’ এই তত্ত্বের কারণেই রুশোকে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ প্রবক্তা বলা হয়। কিন্তু ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিমুহুর্তে কার্যে যে ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে সে হচ্ছে ব্যক্তির বিশেষ বা ‘পারটিকুলার’ ইচ্ছা। অনেক সময়ে ব্যক্তির এই বিশেষ ইচ্ছার সঙ্গে তার সাধারণ ইচ্ছার বিরোধ ঘটে। ব্যক্তি যখন সচেতন বা অচেতনভাবে যৌথের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হয় তখনি ব্যক্তির ইচ্ছার এই বিরোধের দিকটি প্রকাশিত হয়। রুশো তাঁর ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে এই তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসঙ্গতির প্রকাশ ঘটেছে। তথাপি ‘সাধারণ ইচ্ছার’ তত্ত্ব যে রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু এবং রাষ্ট্রদর্শনে এটি যে অনন্য অবদান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। (দ্র. Rousseau: রুশো; Social Contract: সামাজিক চুক্তি)।
Gibbon: গিবন
Gibbon Edward (1737-94) বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক। ১৭৬৪ খৃষ্টাব্দে রোম ভ্রমনকালে গিবন প্রাচীন রোমসাম্রাজ্যের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা করেন। তাঁর রচিত রোমের এই ইতিহাসই ইংরেজি সাহিত্যের অতুলনীয় এক রোম সাম্রাজ্যের পরিচিতি লাভ করে। তিনি তাঁর এই গ্রন্থের নাম রাখেন রোমসাম্রাজ্যের ক্ষয় এবং পতনের ইতিহাস (১৭৭৬-৮৮) ছয় খণ্ডে বিভক্ত এই ইতিহাস গ্রন্থে গিবন প্রাচীনকাল হতে আধুনিক কাল পর্যন্ত ধারা বিবরণী তৈরি করেন। এই বিবরণে খৃষ্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার, টিউটনদের উদ্ভব, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে খৃষ্টান ধর্মের যুদ্ধ (ক্রুসেড) ইত্যাকার সব কিছুর বিবরণ গিবন অন্তর্ভুক্ত করেন।
Good and Evil: ভালো এবং মন্দ
মানুষের সামাজিক আচরণের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য সাধনের উপায়ের মূল্যায়নসূচক নীতিবাদ সূত্র। একটা বিশেষ সমাজে যে আচরণকে বাঞ্ছিত ও অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় তাকে ভালো এবং যা অবাঞ্ছিত ও পরিত্যজ্য তাকে মন্দ বলে চিহ্নিত এবং অভিহিত করা হয়। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় –এই নীতিবাদী সূত্রকাল ও সমাজ নিরপেক্ষ সূত্র নয়। আদি গোত্রতান্ত্রিক সমাজে এবং প্রথম উদ্ভব। ব্যক্তির সমন্বয়ে গোত্র কিংবা সমাজ- কিন্তু গোত্র সমাজভুক্ত ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী আচরণ করতে থাকে তা হলে আর গোত্র বা সমাজ সংবদ্ধ থাকতে পারে না। তখন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আচরণের বিরোধ ও সংঘর্ষে সমাজ ভেঙে যায়। কিন্তু সমাজ বাদে ব্যক্তির জীবন ধারণ সম্ভব নয়। মানুষের এই মৌলিক অভিজ্ঞতা থেকেই ব্যক্তির আচরণের সামাজিক মূল্যায়ন এবং সমাজের সংগঠন ও শৃঙ্খলার সহায়ক আচরণ বাঞ্ছিত ও কাম্য বা ভারো এবং সমাজের অহিতকর আচরণ মন্দ বলে অভিহিত হতে শুরু করে। সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশে ক্রমান্বয়ে যখন রাষ্ট্রীয় সংগঠন উদ্ভুত হয় তখন ‘ভালো’, ‘মন্দ’, ‘ন্যায়’, ‘অন্যায়’ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় বিধান হিসাবে করণীয়, অকরণীয়, শাস্তিযোগ্য, পুরস্কারযোগ্যরূপে লিপিবদ্ধ হতে থাকে। এই পর্যায় থেকে সামাজিক ভালো-মন্দ বোধগুলি শ্রেণী চরিত্রও লাভ করতে শুরু করে। সমাজের ভালো-মন্দ এখন থেকৈ শাসক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য আইন বিধিবদ্ধ হতে থাকে। ভালো মন্দের দার্শনিক আলোচনায় দুটি প্রধান ধারা লক্ষনীয়। এর একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা। ইমানুয়েল কাণ্টের রচনায় এর প্রকৃষ্ট প্রকাশ দেখা যায়। এই মত অনুযায়ী ভালো-মন্দ সমাজ ও কাল-নিরপেক্ষ এক অলৌকিক আদর্শ দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। মানুষের মধ্যে ভালোত্বর যে বোধ আছে এটা তার সহজাত ধারণা। তার এ ধারণা হচ্ছে চরম অলৌকিক ভালোর প্রকাশ। মানুষের এই ভালোত্ববোধের জন্ম কোনো বাস্তব অবস্থার উপর নির্ভর করে না। বস্তুবাদী ধারণা এর বিপরীত। বস্তুবাদ, বিশেষত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে ভালোমন্দ বোধ মানুষের জীবন যাপনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনবোধ থেকেই সৃষ্ট হয়েছে। যে আচরণ জীবনের সহায়ক তাই ভালো। যা জীবনের জন্য ক্ষতিকর তাই মন্দ। এই ভালো-মন্দর ধারণা যুগ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সুতরাং চরম ভালো বলে কোনো অলৌকিক আদর্শ নেই। এই দুই ধারার মধ্যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিক ভালো-মন্দর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।। প্রাচীন গ্রিসের এরিসটিপাস এবং এপিক্যুরাস বলতেন, যে আচরণ মানুষের জন্য সুখ আনয়ন করে সেই আচরণ বা বস্তু ভালো এবং যা মানুষের দুঃখের কারণ তা মন্দ। এজন্য তাঁদের নীতিবাদকে সুখবাদ বলে অভিহিত করা হয়।
Generalisation: সামান্যীকরণ, সাধারণীকরণ
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অন্বেষার প্রয়োজনীয় স্তরসমূহের মধ্যে সাধারণীকরণ অন্যতম। জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে এভাবে বিবৃত করা যায়: কোনো প্রশ্নের মীমাংসার জন্য আমরা প্রথমে প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষ বিশেষ ঘটনা বা বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করি; এটি প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে পর্যবেক্ষিত বস্তু বা ঘটনাকে তুলনা ও বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষিত বস্তু বা ঘটনা এবং অনুরূপ বস্তু বা ঘটনার উপর প্রয়োগযোগ্য একটি ব্যাখ্যা বা সমাধান তৈরি করি। এই স্তরটি সাধারণীকরণের স্তর। সাধারণীকরণ দ্বারা বা সাধারণ ধারণাটি বাস্তবে প্রয়োগ করে আমাদের অনুমিত সিদ্ধান্তের সঠিকতা কিংবা বেঠিকতাকে আমরা যাচাই করি। বাস্তব অভিজ্ঞতা গৃহীত সাধারণ সিদ্ধান্তটি সঠিক প্রমাণ করলে সাধারণ সিদ্ধান্তটি একটি নিয়ম বা বিধানের মর্যাদা লাভ করে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ম্যালেরিয়া জ্বরের কারনের অনুসন্ধানের উল্লেখ করা যায়। ম্যালেরিয়া জ্বরের কারণ জানার জন্য প্রথম স্তরে এই জ্বরে আক্রান্ত একাধিক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণের পরে রোগীদের মধ্যকার সাধারণ বা সর্বদা উপস্থিত অবিচ্ছেদ্য বিষয় বা উপাদান (এনোফেলিস মশার কামড়) বিশ্লেষণের মারফত নির্দিষ্ট করে এই জ্বরের কারণ সর্বদাই যে এনোফেলিস মশার কামড়, সেরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী স্তরে সিদ্ধান্তটিকে বাস্তবে আরো প্রয়োগ ও পরীক্ষার মাধ্যমে তার নিসংশয়তা স্থির করা হয়। জ্ঞানের বিকাশে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা মানুষের একটি উন্নততর স্তরকে চিহ্নিত করে। মানুষ আদিতেই বস্তুপুঞ্জ পর্যবেক্ষণ করে তাকে তুলনা ও বিশ্লেষণ করে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে নি। তার জন্য তার মনন ক্ষমতার অধিকতর বিকাশের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সাধারণ ধারণায় আমরা যেমন বস্তুর সারকে জানার চেষ্টা করি, তেমনি আবার বিশেষ বস্তুর যে বৈচিত্র্য, সাধারণ সিদ্ধান্তে তার অনুপস্থিতি ঘটে। আমরা একত্রে সন্নিবেশিত বৃক্ষরাজিকে পর্যবেক্ষণ করে তাকে সামগ্রিকভাবে বন বলে আখ্যায়িত করি। বৃক্ষরাজির সম্মেলনে বন তৈরি হয়; সে ‘বনে’র একটি সাধারণ রূপ আছে –বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের বৈচিত্র্য তাতে নেই।
Genetic Method: জনিতপদ্ধতি
কোনো বস্তু বা বিষয়ের উদ্ভব এবং বিকাশের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত গবেষণার পদ্ধতিকে জনিত বা জনিতপদ্ধতি বলা হয়। একে ঐতিহাসিক পদ্ধতিও বলা চলে। সপ্তদশ শতকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিকাশের তত্ত্ব যখন প্রাধান্য পেতে শুরু করে, তখন থেকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জনিতপদ্ধতির ব্যবহার ও প্রয়োগ শুরু হয়। এর পূর্বে দর্শন বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রে বিশ্লেষক পদ্ধতিরই প্রাধান্য ছিল। বিশ্লেষক পদ্ধতিতে কোনো সমস্যা সমাধানে বস্তু বা বিষয়ের চরিত্র বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হয়। কোনো সমস্যার চরিত্র যে তার উদ্ভব এবং বিকাশ দ্বারা নির্দিষ্ট, এই সত্যের স্বীকৃতি বিশ্লেষক পদ্ধতিতে পাওয়া যায় না। ফলে, বিশ্লেষক পদ্ধতির বিষয় জ্ঞান ও কালনিরপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্লেষক পদ্ধতিরই তাই সিদ্ধান্ত অনেক সময়ে কাল্পনিক, অবাস্তব এবং জ্ঞানের বিকাশের প্রতিকূল। দর্শনে প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিশ্লেষক পদ্ধতিই ছিল প্র্রধান পদ্ধতি। কিন্তু জ্ঞানের প্রসার এবং জনিতপদ্ধতির কার্যকারিতার অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় দর্শনও জনিতপদ্ধতি গ্রহণ করতে শুরু করে। বস্তুত দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের আজ জনিতপদ্ধতি জ্ঞানের বিকাশে অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি বলে বিবেচিত। জনিতপদ্ধতি কোনো সমস্যার বিচারে তার উদ্ভবকালের অবস্থা, তার পরবর্তী বিকাশের পর্যায়সমূহ এবং এই বিকাশের অন্তর্নিহিত ধারা নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। জনিতপদ্ধতির মৌলিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, সমস্যা, বস্তু বা বিষয়মাত্রেরই উদ্ভব এবং বিকাশ আছে। তার আভ্যন্তরিক বিধান ও চরিত্র কেবলমাত্র বিবেচ্য সমস্যাকে স্থান ও কালের সঙ্গে সংযুক্ত করেই নির্ধারণ করা সম্ভব। জনিতপদ্ধতির যেমন কার্যকারিতা আছে তেমনি তার কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। জনিতপদ্ধতি বলতে যদি কেবল বিকাশের বিবরণ বুঝায়, তা হলে সে পদ্ধতি বিবরণকে অতিক্রম করে কোনো বস্তু বা বিষয়ের ভবিষ্যৎ বিকাশ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত দানে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং বিকাশের বিবরণেই তা পর্যবসিত হয়ে পড়ে। সে জন্য প্রয়োজন বিকাশকে বিশ্লেষণ করা। এ কারণে কার্যকর জনিতপদ্ধতি বলতে এমন পদ্ধতি বুঝায়, যে পদ্ধতি সমস্যার উদ্ভব এবং বিকাশের বিবরণেই তা পর্যবসিত হয়ে পড়ে। সে জন্য প্রয়োজন বিকাশকে বিশ্লেষণ করা। এ কারণে কার্যকর জনিতপদ্ধতি বলতে এমন পদ্ধতি বুঝায়, যে পদ্ধতি সমস্যার উদ্ভব এবং বিকাশকে যেমন বিবেচনা করবে, তেমনি বিশ্লেষণের সাহায্যে এই বিকাশের ধারা উদঘাটিত করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
Getty Burg Address: গেটিস বার্গ-ভাষণ (১৮৬১-১৮৬৫)
আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলীয় এবং উত্তর অঞ্চলীয় ব্রিটিশ কলোনিসমূহের মধ্যে দাসপ্রথার পক্ষ ও বিপক্ষ হিসাবে বিভক্ত অঙ্গরাষ্ট্রগুলি পাঁচ বছরব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বলা হয়।
উত্তর অঞ্চলের জয়লাভের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধ শেষে মৃত সৈনিকদের সম্মানে গেটিস বার্গে যে শোক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তাতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন যে শোকভাষণ দেন সে ভাষণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য ঐতিহাসিক ভাষণ তথা গেটিসবার্গ ভাষণ নামে অভিহিত হয়ে আসছে।
আব্রাহাম লিংকনের ভাষনটি যেমন ছিল ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম ভাষণসমূহের অন্যতম একটি ক্ষুদ্র ভাষণ, তেমনি বক্তব্যের তাৎপর্যেও ভাষণটি ছিল যথার্থই একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। একজন ঐতিহাসিকের বর্ণনায় সমাবেশ যখন অধীর আগ্রহের সঙ্গে লিংকনের ভাষণের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনি তারা দেখল আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ শেষ হয়ে গেছে।
মাত্র উনিশটি বাক্যে প্রদত্ত ভাষণটির শেষ কয়েকটি বাক্য ছিল এরূপঃ “…that from these honoured dead we take increased devotion to that cause for which they gave the last full measure of devotion; that we here highly resolve that these dead shall not have died in vain; that this nation, under God, shall have a new birth of freedom; and that government of the people, by the people, for the people, shall not parish from the earth.
গৃহযুদ্ধের অবসানের পরবর্তীতে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে গুপ্তগাতকের গুলিতে আব্রাহাম লিংকন নিহত হন। তখন লিংকনের বয়স ছিল মাত্র ৬৫ বৎসর। (দ্রষ্টব্য: আমেরিকার গৃহযুদ্ধ।)
Godwin, Willam: উইলিয়াম গডউইন (১৭৫৬-১৮৩৬ খ্রি.)
ইংল্যাণ্ডের একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং ঔপন্যাসিক। কবি শেলী তাঁর জামাতা ছিলেন। গডউইনের খ্যাতি এ কারণে যে, তিনি জীবনের প্রথম দিকে একজন ধর্মযাজক থাকলেও ফরাসি দার্শনিকদের রচনাপাঠে প্রভাবিত হয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে ধর্ম সম্পর্কে সমালোচনাবাদী হয়ে ওঠেন এবং গ্রন্থরচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘রাজনৈতিক ন্যায়ের বিষয়ে’ বা ‘কনসারনিং পলিটিক্যাল জাসটিস’ তাঁর শ্রেণীগত চিন্তাবিদদের চিন্তার ব্যতিক্রমী চিন্তা হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এই গ্রন্থের অভিমতসমূহ ফরাসি বিপ্লবের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ পায়। ইংল্যাণ্ডের প্রগতিবাদী চিন্তারও তিনি সমর্থক হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর চিন্তায় ক্রমান্বয়ে কল্পনাবাদী সমাজতন্ত্রীয় এবং নৈরাষ্ট্রবাদী ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি বলেন রাষ্ট্রে মানুষ বাস করে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের শেষ লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র হচ্ছে জবরদস্তির প্রতীক। মানুষের লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র হচ্ছে জবরদস্তির প্রতীক। মানুষের লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে সামাজিক জীবনযাপন করা। জোর বা জবরদস্তির মৌল বিরোধিতা করেন। মানুষ প্রকৃতির বিধানে সমান। এবং সে কারণে মানুষে মানুষে সম্পদে অসাম্য থাকা অসঙ্গত। মানুষের সমাজে বিদ্যমান অসঙ্গতির মূলে হচ্ছে অজ্ঞতা। অশিক্ষা দূর হলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যকার অসাম্য, অবাঞ্ছিত আইন-কানুন, সরকারের শক্তিপ্রয়োগ প্রভৃতির বিলোপ ঘটবে। গডউইনের এরূপ চিন্তায় প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের কল্পনাবাদী টমাস মুরের চিন্তার মিশ্রণ দেখা যায়। যুক্তিবাদী হিসাবে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। ধর্ম মানুষকে পরলোকবাদী হিসাবে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। ধর্ম মানুষকে পরলোকবাদী করে তার জাগতিক শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিভ্রান্ত এবং বিনষ্ট করে। খ্রিষ্টধর্মকেও তিনি এই কারণে ক্ষতিকর বলে সমালোচনা করেন। নিজের বৈবাহিক জীবন থাকলেও বৈবাহিক রীতির প্রয়োজনকে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর এসব চিন্তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের অভিজাত সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিবাদী অভিমত প্রকাশিত হয়। এ কারণে তাঁর সমকালীন স্বীকৃতি এবং জনপ্রিয়তা ইংল্যাণ্ডের চাইতে ফ্রান্সে অধিক ঘটে। ফ্রান্সের সেণ্ট সাইমন এবং প্রুধো তাঁর চিন্তাধারার সমর্থক হন।
Great Leap Forward (1958): আধুনিক চীনের শিল্পায়নে দ্রুত উন্নয়নের চেষ্টা
উৎপাদনের পরিমাণে বিরাট পরিমাণ ধার্য করা এবং কৃষি ও শিল্প উভয়ক্ষেত্রে একই সাথে তা পূর্ণ করার চেষ্টা ঘোষণা করা হয়। কৃষিতে কম্যুন ব্যাপক সংখ্যায় সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উচ্চমান অর্জন করতে না পারায় পরিকল্পনা বিফল হয়। জাতীয় নেতা মাওসেতুঙের উপর এই বিফলতার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এবং মাওসেতুঙ দ্রুত উন্নয়নের এই পরিকল্পনায় ব্যর্থ হওয়ার সমালোচনার পাত্র হতে শুরু করেন।
Great Wall of China: চীনের প্রাচীর
উত্তর চীনে আত্মরক্ষামূলক এক বিরাট ঐতিহাসিক দেয়াল। দৈর্ঘে ছিল ৪২০০ মাইল। এই দেয়াল তৈরি করা শুরু হয় মিং রাজবংশের শাসনকালে ১৩৬৮ খৃষ্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৫৪৪ খৃষ্টাব্দে। আত্মরক্ষামূলক হলেও চীনের এই বিরাট দীর্ঘ দেয়ালের উপর দিয়ে মানুষও চলাচল করতে পারত। অদ্যাবধি চীনের এই দেয়াল চীন ভ্রমণকারীদের একটি অন্যতম দ্রষ্টব্যের বিষয় হিসাবে বিরাজ করছে।
Green, T.H.: টি.এইচ.গ্রীন (১৮৩৬-১৮৮২ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক ছিলেন টমাস হিল গ্রীন। টমাস হিল গ্রীন এবং তাঁর সমকালের এবং এই চিন্তার অধিকারী দার্শনিক ব্রাডলে এবং বোসাঙ্কোয়েটকে সাধারণত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নব ভাববাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রীনের রচনাবলীর মধ্যে নীতিশাস্ত্রের উপর ‘প্রলেগোমেনা টু এথিক্স’ এবং রাজনীতির উপর ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল অবলিগেশন’ বিশেষভাবে পরিচিত। ফরাসি বিপ্লবোত্তর কালে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে যেসব আর্থিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যার উদ্ভব হয় গ্রীন এবং তাঁর সঙ্গীরা তাকে তাঁদের নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার চেষ্টা করেন। এই বিচারের বৈশিষ্ট্য এই যে, এঁরা এ্যারিস্টটল এবং প্লেটোর মতো, রাষ্ট্রকে যেমন একটি নৈতিক সংস্থা বলে বিবেচনা করেন, তেমনি রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তিরূপে গোড়ার দিকে যেখানে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ সার্বভৌমিকতা এবং ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার উপর জোর ছিল, সেখানে ঊনবিংশ শতকের অবস্থাতে এই তাত্ত্বিকেরা রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি যে একটি যৌথ সংস্থা, তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের মতে ব্যক্তি বাদে যেমন রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র বাদেও তেমনি ব্যক্তি নয়।
উভয়ই নৈতিক সত্তা। এবং নৈতিক সত্তার আসল বিচার সে কি করে, তার চাইতে কি তার করা উচিত তথা তার লক্ষ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। ব্যক্তির লক্ষ্য নৈতিক প্রাণী হিসাবে অধিকতর উত্তম প্রাণী হিসাবে বিকাশ লাভ করা। এ বিকাশ ব্যক্তি এককভাবে সাধন করতে পারে না। নৈতিকতার বোধটিই হচ্ছে একটি সামাজিক বোধ। সমাজ-শূন্য কোনো ব্যক্তি কাল্পনিক ব্যক্তি, বাস্তব অস্তিত্ব নয়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে গঠিত যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রও উন্নতি, ব্যক্তির উন্নতি বাদে সাধিত হতে পারে না, যেমন, ব্যক্তির উন্নতি রাষ্ট্রের উন্নতি বাদে সাধিত হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের উন্নতির মাধ্যমে ব্যক্তির উন্নতি অর্জন করা। এই অবস্থাটিকে প্রকাশ করে গ্রীন বলেছেন, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তির সম্মতি বা ‘উইল’, শক্তি তথা ফোর্স নয়। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে ব্যক্তির জীবনে এমন বাস্তব অবস্থা তৈরি করা যে বাস্তব অবস্থায় ব্যক্তি নৈতিক প্রাণী হিসাবে যা তার করা উচিত সে তাই করতে পারে। এই প্রসঙ্গে গ্রীন ‘পজিটিভ’ এবং ‘নেগেটিভ’ ফ্রিডম –তথা বাস্তব স্বাধীনতা এবং অবাস্তব স্বাধীনতার ধারণাটি তৈরি করেন। তিনি বিদ্যমান ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করে দেখান যে অন্নহীন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে কোনো নৈতিক বা স্বাধীন ব্যক্তি বলা যায় না। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অপরের খাদ্য দ্রব্য ‘চুরি’ করলে তাকে অপরাধী বলে বিচার করা চলে না। কারণ, বুভুক্ষু ব্যক্তির যেখানে চুরি করে খাদ্য সংগ্রহ করা ব্যতীত উপায় নেই, সেখানে তার এমন বাধ্যতামূলক কার্যকে স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী কৃত কার্য বলা চলে না। আসলে আধুনিক ধনবাদী সমাজের তথাকথিত স্বাধীনতা হচ্ছে প্রধাতন এরূপ অসহায় ব্যক্তির জন্য অবাস্তব বা নেগেটিভ স্বাধীনতা। এরূপ অসহায় ব্যক্তি প্রাচীনকারের শেকলে আবদ্ধ থাকত, বর্তমানে সমাজের এমন দাসরা ক্ষুধার শিকলে আবদ্ধ। এরা পুরো নাগরিক বা ‘সিটিজেন’ নয় এদেরকে বলা উচিত “ডেনিজেন” বা অ-নাগরিক।ধনতান্ত্রিক সমাজের অসঙ্গতির এরূপ তাত্ত্বিক জোরালো সমালোচনার মধ্যে ঊনিশ শতকে ক্রমবর্ধমানরূপে প্রচারিত সমাজতান্ত্রিক ভাবের প্রকাশ পাওয়া যায়। গ্রীনের মতে, এ কারণে, রাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। কোনো ব্যক্তি যেন তার অবাধ প্রতিযোগিতার অধিকার ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির একচেটিয়া মালিকানার মাধ্যমে সামাজিক সম্পদের অপব্যবহার দ্বারা অসংখ্য ব্যক্তিকে মানবেতর প্রাণীতে পর্যবসিত করতে না পারে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এরূপ বিচারে গ্রীন সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হলেও তিনি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না। তিনি একদিকে যেমন ব্যক্তিবাদী তথা ব্যক্তির উন্নতিকে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য বলেছেন, অপরদিকে তেমনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন, তার পুরো বিলোপের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে সমর্থন করেন নি। এ কারণে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী চিন্তাবিদদের চিন্তাকে ‘ব্যক্তিবাদ তথা উদারনীতিবাদের ভাববাদী সংশোধন’ বা ‘আইডিয়ালিস্ট রিভিশন অব লিবারেলিজম’ বলে অভিহিত করা হয়।
H
Haridas Bhattacharyya: হরিদাস ভট্টাচার্য (১৮৯০-১৯৫৫ খ্রি.)
অবিভক্ত ভারতের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, অধ্যাপক ও বাগ্মী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তার গোড়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সঙ্গে আলাপক্রমে সংগৃহীত বিশিষ্ট অধ্যাপকদের একজন ছিলেন তরুণ অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘রিডার’ হিসাবে ১৯২১ সনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১৯৪৫ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় গমন করেন। হরিদাস ভট্টাচার্য বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষায় দক্ষ এবং ওজম্বিনী রীতিকে বক্তৃতাদানের তিনি ক্ষমতা রাখতেন। নিজে পরিবারবগভাবে নদীয়ার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। প্রথিতযশা দার্শনিক হলেও নিজের পৈতৃক ধর্মের সকল আচার-অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে বিম্বাস ও পালন করতেন। কিন্তু সংকীর্ণমনা ছিলেন না। ভারতের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবির তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং পরবর্তীতে খ্যাতিমান বহু প্রখ্যাত দার্শনিক এবং সাহিত্যিক তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র ছিলেন। ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁর উদার দার্শনিক মনোভাবের পরিচয় বহন করে তাঁর বিশিষ্ট গবেষণা গ্রন্থ ‘ফাউণ্ডেশনস অব লিভিং ফেইথস’ বা ‘প্রচলিত ধর্মসমূহের ভিত্তি’। এই গ্রন্থের মধ্যে ইসলাম ধর্মের দর্শন এবং তার অন্তর্গত সমস্যাসমূহ সম্পর্কেও তাঁর গভীর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম দিকে অধ্যাপনাকালে হরিদাস ভট্টাচার্য প্রখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক আচার্য ব্রজেন্দ্র নাথ শীলের প্রশংসাধন্য একজন তরুণ সহকর্মী ছিলেন।
Hervey William: উইলিয়াম হারভে (১৫৭৮-১৬৫৭ খ্রি.)
ইংল্যাণ্ডের উইলিয়াম হারভে একজন চিকিৎসাবিদ। উইলিয়াম হারভে দেহের রক্তসঞ্চালন সত্যের আবিস্কারক। শিক্ষাজীবনে তিনি নিজ দেশের ক্যাণ্টারবেরি এবং ক্যাম্ব্রিজে শিক্ষালাভের পর ফ্রান্স এবং জার্মানি পরিভ্রমণ করে তৎকালে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ইতালির পদুয়াতে গমন করে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তাঁকে অধ্যাপনা এবং চিকিৎসকের পদে নিযুক্ত করে এবং বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত করে। ১৬১৬ সনে হারভে তাঁর একটি নিবন্ধে তাঁর ‘রক্ত সঞ্চালন’ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের অগ্রগতিতে হারভের ‘রক্ত সঞ্চালন’ তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি তাঁর তত্ত্বে দেখান যে রক্ত প্রথমে ডানদিকের অরিকলে বা অলিন্দে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে ডান ভেনট্রিকলে বা নিলয়ে অন্তর্গত হয়। এই রক্ত তখন পালমুনারী বা ফুসফুসের শিরার মাধ্যমে ফুসফুসে সঞ্চালিত হয় এবং সেখান থেকে ভেনট্রিকলে প্রবেশ করে। এর পরে রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশে শিরা উপশিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই রক্ত পুনরায় আরটারি বা ধমীর মাধ্যমে এবং শিরার দ্বারা ফুসফুসে প্রেরিত হয়ে একটা পুরো বৃত্তত তৈরি করে। এ বিবরণ আমাদের নিকট জটিল বলে বোধ হলেও এই তত্ত্ব আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় সূত্র হিসাবে ভূমিকা পালন করে উইলিয়াম হারভেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
Hedonism: সুখবাদ
সুখবাদ হচ্ছে নীতিবাদের একটি তত্ত্ব। মানুষের জীবনে চরম কামনা কি এবং মানুষের সামাজিক আচরণের মূল প্রেরণা কি, এই মৌলিক প্রশ্নের জবাব মানুষ বিভিন্নভাবে দেবার চেষ্টা করেছে। সুখবাদ এই সমস্ত জবাবের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এটি একটি প্রাচীন তত্ত্ব। গ্রিসের দার্শনিক এপিক্যুরাসের রচনায় এই তত্ত্বের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আধুনিক ইউরোপের মিল, বেন্থাম প্রমুখ দার্শনিকের উপযোগবাদ বা হিতবাদ নামক নীতিতত্ত্বের উৎস হিসাবে এপিক্যুরাসের অভিমতকে উল্লেখ করা হয়।
প্রেরণা বাদে মানুষ কোনো কাজই সম্পাদন করতে পারে না। সুখবাদের প্রতিপাদ্য হলো, আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে মানুষের সকল কাজের অন্তর্নিহিত প্রেরণা। কিন্তু সুখ বলতে কি বুঝবে, এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কেউ বলেছেন, সুখ হচ্ছে দৈহিক সুখ। আবার কেউ বলেছেন, দেহের সুখই একমাত্র সুখ নয়। ন্যায় ও ধর্মের কারণে দৈহিক সুখের বিসর্জনও মানুষের জন্য সুখকর এবং কাম্য হতে পারে। ব্যাখ্যার এই পার্থক্যের ভিত্তিতে সুখবাদকে মনস্তাত্ত্বিক এবং নীতিগত সুখভাদ এই দুটি উবিভাগে বিভক্ত করা হয়। মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদের মতে, মানসিক সুখ হচ্ছে সকল কাজের মূল। মানুষ যখন কোনো বিশেষ সুখকে বিসর্জন দেয় তখনও সে অপর কোনো সুখলাভের কথা মানসিকভাবে কল্পনা করে। নীতিবাদী সুখবাদের মতে সুখের কামনা মানুষের কেবল ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। সুখের কামনা মানুষের একটি দায়িত্ব বা কর্তব্য। কেননা সুখলাভের কামনা ব্যতীত মানুষের জীবন আদৌ ক্রিয়াশীল হতে পারে না। সুখের ক্ষেত্রে আর একটি প্রশ্ন হচ্ছে: সুখ কি ব্যক্তিগত হবে, না সমষ্টিগত হবে। এ প্রশ্নে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত সুখবাদ বলে দুটি উপধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত সুখবাদের ব্যক্তির কাছে নিজের সুখ হচ্ছে চরম কথা ও একমাত্র কাম্য। সমষ্টির সুখ যদি ব্যক্তির সুখের পরিপোষক হয় তবেই ব্যক্তি সমষ্টির সুখেরও কামনা করতে পারে। ব্যক্তির সুখের পরিপন্থী হলে নয়। অনেকে এপিক্যুরাস এবং এরিসটিপাসকে ব্যক্তিগত সুখবাদের প্রবক্তা মনে করেন। কিন্তু সুখের ব্যাখ্যায় এপিক্যুরাস এবং এরিসটিপাসের মধ্যেও পার্থক্য আছে। এরিসটিপাস যেখানে মুহুর্তের সুখকেই প্রধান মনে করেছেন, এটিক্যুরাস সেখানে মুহুর্তের বাইরে ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনের সুখকে ব্যক্তির লক্ষ্য বলে নির্দেশ করেছেন। মিল ও বেন্থামের উপযোগবাদ সমষ্টিগত সুখবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উপযোগবাদ বা হিতবাদের একটি বহুল উল্লিখিত বাক্য হচ্ছে: ‘বৃহত্তম সংখ্যার বৃহত্তম পরিমাণ সুখ হবে মানুষমাত্রের লক্ষ্য’। মিল অবশ্য বৃহত্তম পরিমাণ সুখ বলতে কেবল সুখের পরিমাণই বুঝাতে চান নি। তিনি সুখের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও গুণের প্রশ্নটি বিবেচনা করেছেন এবং গুণগতভাবে যে সুখ কাম্য তাকে পরিমাণ নির্বিশেষে কাম্য বলে মনে করতেন।
Hegel: হেগেল (১৭৭০-১৮৩১ খ্রি.)
জর্জ উইলহেলম ফ্রেডারিক হেগেলের মধ্যে জার্মান ভাববাদী দর্শনের চরম প্রকাশ ঘটে। ভাবের বাস্তব তত্ত্বের জন্য অনেকে তাঁর দর্শনকে ‘বাস্তব ভাববাদ’ বলেও আখ্যায়িত করেন। হেগেল কাণ্টের দর্শনের সমালোচনার ভিত্তিতে নিজের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এতে কাণ্টের নিকট হেগেলের ঋণ প্রমাণিত হয়। কাণ্টের অভিমতের উল্লেখ ব্যতীত হেগেলের চিন্তার বিকাশ বুঝা সম্ভব নয়। নিম্নোক্ত তিনটি ক্ষেত্রে কাণ্ট ও হেগেলের দর্শনের পারস্পরিক পার্থক্য নির্দিষ্ট করা যায়: (১) কাণ্ট তাঁর দর্শন দ্বারা এই কথা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন যে, মানুষের কাছে দৃশ্য বা জ্ঞেয়জগৎ মানুষের বুদ্ধিকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। বুদ্ধির সূত্র হচ্ছে মানুসের কাছে জ্ঞানের একমাত্র সূত্র। বুদ্ধির মাধ্যমে জগৎ মানুষের কাছে যেভাবে উপস্থিত হয় মানুষ জগৎকে সেইভাবে উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই জ্ঞেয় বা দৃশ্য জগৎই একমাত্র জগৎ নয়। বুদ্ধির অগম্য এবং মানুষের অজ্ঞেয় আর একটা জগৎ আছে –যাকে বলা যায় আসল জগৎ বা সত্তার সত্তা। হেগেল কাণ্টের বুদ্ধির সূত্র স্বীকার করে বলেন: বুদ্ধি দ্বারাই আমরা জগৎ বা সত্যকে জানি। বস্তুত বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই মানুষের জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম। বুদ্ধি অগম্য এবং মানুসের অজ্ঞেয় আসল জগৎ বলে কিছু আছে এরূপ কতা মানুষ বলতে পারে না। মানুষ জ্ঞেয় জগৎই একমাত্র জগৎ। (২) কাণ্ট বুদ্ধিকে বোধ এবং প্রজ্ঞা বলে দুভাগে ভাগ করে বোধকে আংশিক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যাতা এবং প্রজ্ঞাকে চরম সত্য উপলব্ধির মাধ্যম হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। হেগেল বলেন, বুদ্ধির মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য করা গেলেও সমগ্র, বুদ্ধিদত্ত যে সত্য তার মধ্যে কোনো বিভাগ করা চলে না। সত্যের কোনো ভাগ নেই: সত্য সমগ্র, সমগ্রই সত্য। (৩) কাণ্ট মানুষের জ্ঞানের সীমা জ্ঞেয় বা দৃশ্যজগতে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। হেগেল বলেন, আমাদের জ্ঞানের জগৎকে আমরা দৃশ্য জগৎ বা মায়া বলি কারণ আমরা এই জগতের প্রকাশের সামগ্রিকতকে উপলব্ধি করতে পারি নে। দৃশ্য জগতের প্রকাশের কারণ যখন আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই, তখন আর দৃশ্য জগৎ আংশিক বা মায়া বলে বোধ হয় না। তখন আমরা বুঝতে পারি, এটাই একমাত্র জগৎ। (৪) নীতির ক্ষেত্রে কাণ্ট এমন এক মহৎ বা আদর্শের কল্পনা করেছেন যে আদর্শ কখনো বাস্তবায়িত হতে না পারলেও মানুষ তাকে একমাত্র বাস্তব বলে ভাবতে বাধ্য। হেগেল বলেন, আমর আদর্শের বিকাশের পর্যায়গুলি বুঝতে সক্ষম বলেই কোনো আদর্শ আমাদের কাছে অন্যায় ও অবাস্তব বলে বোধ হয়। আদর্শের বিকাশের পর্যায়কে সম্যকভাবে উপলব্ধি করলে বাস্তব-অবাস্তবের বিরোধ দেখা দিতে পারে না। (৫) কাণ্ট জ্ঞানের সূত্রকে বিকাশের সম্ভাবনাহীন অনড় স্থির সূত্র বলে মনে করেছেন। কাণ্টের কাছে জ্ঞান-সূত্রের উৎস মানুষের কাছে অজ্ঞেয়। অজ্ঞাত কোনো শক্তি মানুসের জন্য অপরিহার্য এই জ্ঞানসূত্রগুলি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। হেগেল মনে করেন, জ্ঞানের সূত্রগুলি অপরিহার্য বটে। কিন্তু এগুলি বিকাশের সম্ভাবনাহীন, অনড় বা এর উৎস অজ্ঞেয় নয়। হেগেলের মতে দর্শনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি সেগুলি আমরা কেনইবা ব্যবহার করি এবং সূত্রগুলি কীভাবে মানুষের জীবনে বিকশিত হয়েছে।
কাণ্টের সঙ্গে নিজের দর্শনের এই পার্থক্য ব্যাখ্যা করে হেগেল ভাবের বিকাশের দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব তৈরি করেন। দ্বন্দ্বই হচ্ছে ভাব বা অস্তিত্বের বিকাশের মূল কারণ। অস্তিত্বের মধ্যে নিরন্তর ‘হাঁ’ এবং ‘না’-এর দ্বন্দ্ব চলছে। বিকাশের এই তত্ত্বের ব্যাখ্যায় হেগেল ‘পরিমাণ থেকে গুণের’ তত্ত্বও উপস্থিত করেন। অস্তিত্বের মধ্যে পরিবর্তন পরিমাণগতভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে বিশেষ পর্যায় নূতন গুণের উদ্ভব ঘটায়।
সমাজের ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিকাশকে অগ্রসর সচেতন চিন্তার দ্বারা উপলব্ধি করে হেগেল এই তত্ত্ব তৈরি করেন। কিন্তু হেগেল কাণ্টের সমালোচনা করলেও তিনি ভাববাদকে অতিক্রম করতে পারেন নি। জগৎ বা সত্যের ক্ষেত্রে জ্ঞেয় এবং অজ্ঞেয়-র দ্বৈত রূপ হেগেল অস্বীকার করলেও হেগেলের নিকটও মূল হচ্ছে ভাব; বস্তু নয়। যা কিছু জ্ঞেয় বা দৃশ্য সর্বই হচ্ছে ভাবের প্রকাশ ও বিকাশ। এ ছাড়া ভাবের চরম বিকাশ জার্মান রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘটেছে বলে হেগেলের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের আদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পেরেছে। বস্তুত হেগেল-দর্শন থেকে উত্তরকালে দুটি পরস্পর-বিরোধী ধারার বিকাশ ঘটেছে: এর একটি হচ্ছে মার্কসবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ; অপরটি হচ্ছে নবভাববাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতবাদ।