Identity : অভিন্নতা
Law of Identity : অভিন্নতার বিধান
কোনো দুটি বিষয়, ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে হুবহু সাদৃশ্য বা মিল থাকলে তাদের অভিন্ন বলা হয়। ‘অভিন্নতা’ কথাটি তুলনার ক্ষেত্রে এবং বস্তুর ধারাবাহিকতা বুঝাবার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। ক এবং খ উভয়ের মধ্যে যদি একই গুণের অস্তিত্ব দেখা দেয় তবে ক এবং খ কে অভিন্ন বলা হবে।
কিন্তু বাস্তব জগতে আদৌ অভিন্নতা কল্পনা করা যায় কিনা এটি দর্শনের একটি প্রশ্ন। প্রাচীন গ্রিসের হিরাক্লিটাস এবং অন্যান্য বস্তুবাদী দার্শনিক থেকে শুরু করে আধুনিককালের বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, কোনো দুটি স্বতন্ত্র অস্তিত্বই অভিন্ন হতে পারে না। একই নদীতে কেউ দুবার নামতে পারে না, হেরাক্লিটাসের এরূপ উক্তিতে বস্তুজগতের নিয়মিত পরিবর্তনশীল প্রবাহের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কিছুকেই অপর কিছুর সঙ্গে তুলনা করে অভিন্ন বলা চলে না। কারণ ‘ক’ এবং ‘খ’ কে অভিন্ন বলার আগে তাদের উভয়ের চরিত্র পর্যায়ক্রমে পর্য্যবেক্ষণ করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তাদের সাদৃশ্য নিরূপণ করতে হবে। এটি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সমাধান করতে কিছু না কিছু সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সময়ের ব্যবধান তুলিত বস্তুর মধ্যে নুতন পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। সে কারণে যারা তুলিত এবং যাদের সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা পরিশেষে গ্রহণ করি তারা একই সত্তা-এরূপ বলা যায় না। কেবল একাধিক বস্তুর মধ্যে অভিন্নতা আরোপের ক্ষেত্রে নয়। নির্দিষ্ট কোনো একটি ব্যক্তি বা বস্তুর উপরও অভিন্নতা আরোপ করা চলে না। সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রি.পূ. জন্মগ্রহণ করে ৩৯৯ খৃ.পূ. এ মারা গিয়েছিলেন, এরূপ বলা কখনো সম্ভব নয়। কারণ, এরূপ বিবৃতির তাৎপর্য্য হচ্ছেেএই যে, ৪৬৯ খৃ.পূর্বাব্দে যে সক্রেটিস জন্মগ্রহণ করেছিলেন, অভিন্নরূপে সে সক্রেটিস ৩৯৯ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু চরমভাবে দেখতে গেলে ৪৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সক্রেটিস অভিন্নভাবে ৩৯৯ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন নি। এঁরা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।
পরিবর্তনের এই প্রবাহকে সর্বদা চরমভাবে গ্রহণ করলে, মানুষের পক্ষে পর্য্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত এই পর্যায়ে জ্ঞানের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ কারণে চরম অভিন্নতা যেমন অকল্পনীয়, তেমনি চরম ভিন্নতাও জ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। দর্শনে তাই অভিন্নতার বিধান বলতে চরম অভিন্নতার বদলে আপেক্ষিক অভিন্নতা বুঝায়। আপেক্ষিক অভিন্নতা তুলিত বস্তুর সাদৃশ্যকে সময় ও বিষয় নিরপেক্ষভাবে কল্পনা করে বিশেষ বস্তুর উপর প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে মনে করা হয় যে, ৪৬৯ খৃস্টপূর্বাব্দের সক্রেটিস ৩৯৯ খ্রি.পূর্বাব্দের সক্রেটিসের সঙ্গে চরমভাবে অভিন্ন না হলেও উভয়ের মধ্যে সাধারণ কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা রয়েছে এব ং এ কারণে তাঁরা উভয়েই সক্রেটিস এ কথা বলা যায়। এবং এরূপ না বললে মানুষের পক্ষে বস্তুর জ্ঞান অর্জন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তিশাস্ত্রে অভিন্নতার বিধানের শর্ত হচ্ছে এই যে, একটি নির্দিষ্ট যুক্তির মধ্যে ব্যবহৃত ভাব বা পদকে একই অর্থে ব্যবহার করতে হবে।
Immediate Inference : প্রত্যক্ষ অনুমান
Immediate Knowledge : প্রত্যক্ষ জ্ঞান
প্রচলিত যুক্তিশাস্ত্রে প্রত্যক্ষ অনুমান বলতে সেই সিদ্ধান্ত বা অনুমানকে বুঝানো হয় যে অনুমান একটিমাত্র হেতু বা দত্ত বাক্য দ্বার গৃহীত হয়। যেমনঃ
সকল মানুষ মরণশীল।
অতএব, কোনো মানুষ অমর নয়।
এখানে একটিমাত্র হেতু বাক্য ‘সকল মানুষই মরণশীল’ থেকে সুতরাং ‘কোনো মানুষ অমর নয়’ সিদ্ধান্তটি অনুমান করা হয়েছে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, এই বিশেষ্যটির দত্তবাক্যের বিধেয় পদ মরণশীল এর বিপরীত পদ ‘অমর’কে সিদ্ধান্ত পদের বিধেয় পদ হিসেবে ব্যবহার করে এবং দত্তবাক্য যেখানে ‘হ্যঁ’ বাচক সেখানে সিদ্ধান্ত বাক্যকে ‘না’ বাচক করে অনুমানটি গৃহীত হয়েছে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় আবর্তন বা ইংরেজিতে কনভার্সন। একটিমাত্র বাক্য হতে গৃহীত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আরো কয়েকটি কৌশল বা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী প্রত্যক্ষ অনুমানকে অবভারশন বা পরিবর্তন, কন্ট্রাপজিশন বা প্রতি আবর্তন প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
প্রত্যক্ষ অনুমানের বিপরীত হচ্ছে পরোক্ষ অনুমান। অনুমানের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে পরোক্ষ অনুমান। পরোক্ষ অনুমান একাধিক হেতু বা দত্তবাক্যের ভিত্তিতে একটি অনুমান বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমনঃ
সকল মানুষ মরণশীল
সক্রেটিস একজন মানুষ
সক্রেটিস মরণশীল।
প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলতে প্রত্যক্ষ অনুমানের ন্যায় কোনোরূপ মাধ্যম ব্যতীত অর্জিত জ্ঞান বুঝানো হয়্। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। জ্ঞানতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পূর্বে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেই জ্ঞানের প্রধান উপায় বলে মনে করা হতো। প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও বুদ্ধিগত প্রত্যক্ষ জ্ঞান-এ দুই ভাগে ভাগ করা হতো। প্লেটো, দেকার্ত, স্পিনোজা, লাইবনিজ এই সমস্ত দার্শনিক বুদ্ধিগত প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করতেন। এঁদের মতে অঙ্ক ও জ্যামিতি শাস্ত্রের স্বতঃসিদ্ধগুলি বুদ্ধিগত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অন্যতম দৃষ্টান্ত। কেননা এই সত্যগুলিকে মানুষ কোনো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য বলে উপলব্ধি করে না। এগুলি মানুষের সহজাত। মানুষ তার অন্তর্নিহিত বুদ্ধির আলোকেই এগুলি সত্য বলে বুঝতে পারে।
আধুনিককালে জার্মান দার্শনিক হেগেল প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ধারণাটি সমালোচনা করেন। হেগেল পরোক্ষ জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কশূণ্য কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে অসম্ভব বলে মনে করেন। তাঁর মতে জ্ঞান হচ্ছে একটি দ্বান্ধিক প্রক্রিয়া। এই দ্বান্ধিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বোধ বা অনুভূতি পরোক্ষ জ্ঞানের সঙ্গে মিলিত হয়ে জ্ঞান-সমগ্রকে তৈরি করে। কিন্তু হেগেলের জ্ঞানতত্ত্বও শেষাবধি বস্তুবাদী থাকে নি। তিনি মনে করতেন যে, বস্তু, ব্যক্তি, সমাজ, ইতিহাস, জ্ঞান সবই পরস্পর সম্পর্কিত এবং সবটা মিলিয়ে যে সত্তা তা হচ্ছে ভাব, বস্তু নয়। কেননা ভাব বা জ্ঞানের মাধ্যমেই সে বোধ্য, অন্য কোনো উপায়ে নয়। জ্ঞানতত্ত্বের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হেগেলের বস্তুবাদী ধারার অনুসরণকারী মার্কসবাদীগণের ব্যাখ্যাত দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদে। এই মত অনুযায়ী অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের উর্ধে্ব প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলে বস্তুজগতের জ্ঞানলাভের কোনো উপায় থাকতে পারে না। যাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয় সে হচ্ছে মানুষের যুগ যুগ অনুসন্ধান, অভিজ্ঞতা ও প্রমাণের ভিত্তিতে লব্ধ জ্ঞান যা আর কোনো নতুন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
Imperialism : সাম্রাজ্যবাদ
সাধারণ অর্থে সাম্রাজ্যবাদ বলতে কোনো রাষ্ট্র বা জাতি কর্তৃক অপর কোনো রাষ্ট্র বা জাতির উপর শাসন বা প্রভুত্ব বোঝায়।
এই ব্যাপক অর্থে ইতিহাসের প্রাচীন কালেও সাম্রাজ্য এবং সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব দেখা দেয়। প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে সুমেরিয়, মিশরীয়, আসেরিয়, পারস্য, রোম এবং চীন সাম্রাজ্যের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আধুনিক ইতিহাসে ইংরেজ, ফরাসি, স্পেনীয় ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাম বিশেষভাবে পরিচিত। অপরের উপর নিজের শাসন ও সভ্যতা বিস্তারের মারফত প্রভুত্ব কায়েম করা, অসম আচরণ ও অত্যাচার ও শোষণের মাধ্যমে অধীনস্থ জাতির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী রাখার ব্যবস্থা, ইচ্ছা ও কৌশলে প্রাচীন ও আধুনিক সাম্রাজ্যসমূহের মধ্যে অনেক মিল দেখা যায়। অতীতে সাম্রাজ্য বিস্তারের একটি প্রধান প্রেরণা ছিল কোনো বিশেষ সম্রাট বা জাতির নিজের ক্ষমতার পরিচয় দানের ইচ্ছা। অপর জাতির শোষন ও দমনের মধ্যে প্রভু জাতি ও তার সম্রাট আপন শৌর্য্-বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখতে পেত।
এই মিল সত্ত্বে ও আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ ও প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদ এক নয়। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভুত্ব বিস্তারের প্র্রয়াস, তার প্রভুত্ব রাখার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি পররাজ্য গ্রাসের কারণ প্রাচীন কালের তুলনায় ভিন্নতর ও জটিল। আধুনিককালের সাম্রাজ্যবাদের যথাযথ সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন রুশ বিপ্লবের নেতা ভি.আই.লেনিন। তিনি তার ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের চরম স্তর’ গ্রন্থে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিয়ে তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের বিকাশের একটা বিশেষ স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত; (২) পুঁজিবাদের জাতীয় ভিত্তিক বিকাশ নিঃশেষ হলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পুঁজিবাদে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ইংল্যান্ড সাম্রাজ্যবাদী শাসকের রূপ গ্রহণ করে; (৩) সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ও পুঁজি কেন্দ্রীভুত হতে হতে গুটি-কয় একচেটিয়া অর্থনৈতিক পরিবার বা গোষ্ঠীর সৃষ্টি করে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে এই সমস্ত একচেটিয়া পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয়ে পড়ে; (৪) কালক্রমে একচেটিয়া ব্যান্কপুঁজি একচেটিয়া শিল্পপুঁজির সঙ্গে মিলিত হয়ে অর্থনৈতিক স্বৈরতান্ত্রিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটায়; (৫) অধীনস্থ দেশে উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানির স্থলে পুঁজি রপ্তানি ক্রমাণ্বয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়; (৬) বিভিন্ন সাম্রাজ্যের একচেটিয়া পুঁজিপতিগণ সম্মিলিত হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশ্বের সমস্ত দুর্বল জাতিকে শাসন ও শোষনের জন্য নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবার চেষ্টা করে। লেনিন মনে করতেন যে, পুঁজিবাদের এরূপ বিকাশ তার অর্থনৈকি আভ্যন্তরীণ সংকটের পরিচায়ক। যে পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে একসময় সম্ভাবনাময় অগ্রসর শক্তির কাজ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদের স্তরে সে পুঁজিবাদের বিকাশ-সম্ভাবনা নিঃশেষিত। সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পুঁজিবাদের সংকট আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে অধিকতর তীব্র আকার ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদকারী বিপ্লবী অবস্থার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আধুনিককালের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের অস্তিত্ব আজো Iবিলুপ্ত হয় নি। তাদের প্রভুত্ব বজায় রাখার নতুন নতুন কৌশল তারা উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছে।
Imperialism, The Highest Stage of Capitalsim : ‘সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্রবাদের চরম স্তর’
ধনতন্ত্রবাদের ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকের বিকাশের বিশ্লেষণমূলক যে গ্রন্থ লেনিন ১৯১৬ সনে রচনা করেন, সেই গ্রন্থের নাম ‘ইম্পেরিয়ালিজম, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্রবাদের চরম স্তর’। ১৯১৭ সনের রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে বিপ্লবী আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতৃত্বদানের জন্য লেনিন তাঁর এই গ্রন্থে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলনসমূহের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্কস এবং এঙ্গেলস এর পরবর্তীকালে ধনতন্ত্রবাদের বিকাশের বৈশিষ্ট্য এবং তার বিদ্যমান দ্বন্ধসমূহের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন।
Independence, Concept of Independence : স্বাধীনতা, স্বাধীনতার ধারণা
ব্যক্তি স্বাধীনতা, জাতীয় স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা : এই প্রত্যয়গুলির উদ্ভব ও বিকাশ প্রধানত আধুনিক কালে। প্রাচীনকালেও মানুষ গোত্রবদ্ধ এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রবদ্ধভাবে গোত্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজার অধীনে জীবন যাপন করছে। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সেকালের স্বাধীনতার মধ্যে বর্তমানকালের আবেগের অস্তিত্ব দেখা যায় না। ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নেও ব্যক্তি নিজেকে যতটা সমাজ ও রাষ্ট্রের অধীনে থাকার অনিবার্যতা স্বীকার করে নিত, ব্যক্তির নিজের অধিকার এবং স্বাধীনতা বোধের তত প্রকাশ ছিল না। প্রাচীন গ্রীসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটে। এথেন্সের দার্শনিকগণ বিশেষ করে প্লেটো এবং এরিস্টটল একালের রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক প্রভৃতি প্রশ্নের দার্শনিক আলোচনা করেন। কিন্তু তাঁদের দর্শনেও অধিক জোর ছিল ব্যক্তির উর্ধ্বে রাষ্ট্র বা সমাজের উপর; ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতার উপর নয়। প্রাচীন ভারতীয় ও চীনা দর্শনে এই প্রবণতা অধিক প্রবল ছিল। ইউরোপে রিনাইসেন্স বা নব জাগরণ বলে অভিহিত যুগের সূচনা থেকে চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতক থেকে ভূখন্ড ও ভাষাভিত্তিক কেন্দ্রীয় শাসনবদ্ধ রাষ্ট্রের উদ্ভব থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা একটি নতুন অর্থ লাভ করতে থাকে। এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্র হতে শৌর্য্-বীর্যে প্রধান এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা কেবল শাসকের স্বাধীনতা এবং গৌরবের ব্যাপার নয়, রাষ্টের সকল অধিবাসীরই আরাধ্য ব্যাপার, এরূপ ধারণা বিকশিত হতে থাকে। এরূপ ধারণার ভিত্তি হিসাবে কাজ করছে সমাজের অর্থনৈতিক রূপান্তর, জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্রমপ্রতিষ্ঠা। এই সময়ে ইউরোপে, ইতালি, ফরাসি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের পরে এই ধারণা অধিকতর সর্বজনীনতা প্রাপ্ত হয়। এই সঙ্গে ব্যক্তির স্বাধীনতাবোধও বিকশিত হতে থাকে। কালক্রমে ভাষা, ধর্ম, ঐতিহাসিক একাত্মবোধে ইত্যাদি জাতি এবং রাষ্ট্রের প্রধান ঐক্যসূত্র হয়ে দাঁড়ায়। এই ঐক্যবোধেরই অপর নাম জাতীয়তাবাদ। এই সময় হতে মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা প্রবল হতে থাকে যে, ভাষা-ধর্ম ঐতিহাসিক ঐক্যবোধসম্পন্ন মানুষের অধিকার আছে স্বীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে স্বাধীন শাসন ও রাষ্ট্র তৈরি করার। আমেরিকার ইউরোপীয় উপনিবেশগুলি অষ্টাদশ শতকে এরূপ ঐক্যবোধ থেকে ‘আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলেও এরূপ ক্ষুদ্র-বৃহৎ রাষ্ট্র তৈরি হতে থাকে।
Independence of Bangladesh : বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ভারতীয় উপমহাদেশ সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতক থেকে ক্রমাণ্বয়ে ইউরোপের ধনবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ দখল এবং শাসনের অধীনে আসতে থাকে। ভারতবর্ষের প্রধান দখলদারি ঔপনিবেষিক শক্তি ছিল ইংল্যান্ড। ১৭৫৭ সালে পলাশীতে ইংরেজদের হাতে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও নিহত হওয়ার ঘটনাকে ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষভাবে ইংল্যান্ডের শাসনাধীনে যাওয়ার একটি তারিখ বলে উল্লেখ করা হয়। সময় ও ক্রমবিকাশে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন অল্প থেকে অধিকে নানা ঘটনা ও আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু এই আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ শক্তির ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত সমাজের জটিলতা ক্রমাণ্বয়ে, বিদেশী শক্তির প্ররোচনা, সহায়তা এবং বিকাশমান ভারতীয় ধনিক সমাজ, যাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াও কার্য্কর ছিল, তাদের দুর্বলতায় প্রবল হয়ে উঠে। ভারতের ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়সমূহের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলমান সমাজের উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত নেতৃবর্গ মুসলমান সমাজের অধিকারের কথা এবং ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে মুসলমান রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ইংরেজ শক্তি ১৯৪৭ সনে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাদের ভারত ত্যাগের ভিত্তি হয় মুসলিম ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের পত্তন।
কিন্তু আধুনিককালে কোনো ধর্মের ভিত্তিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধান দুটি অংশ হলো পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতায়, একটি সঙ্গতিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় নীতি ও কাঠামোগত ক্ষমতা সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বপ্রধান পাকিস্তানের ছিল না। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সংকীর্ণ এবং পূর্ববঙ্গের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নীতির কারণে পূর্ববঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ১৯৫২ সনের রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তীব্রতর হতে থাকে। গোড়া থেকে স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যভাবে উচ্চারিত না হলেও ১৯৬৬ সনের আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের অনুভূতিকে দমনমূলক ব্যবস্থা দ্বারা নিবৃত্ত করতে চায়। পালাক্রমে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং ১৯৫৬ সনের সংবিধানও বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তারিত বিবরণ এখানে প্রদান সম্ভব নয়। ১৯৬৯ সনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সর্বত্র, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে, গণজাগরণ শুরু হয়। এই গণজাগরণই কালক্রমে ১৯৭১ সনে নানা ঘটনা এবং বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের সামরিক আক্রমণ এবং গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চ আপস-আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ব্যাপক আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ববঙ্গ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এপ্রিল মাসে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোড়াতেই এই সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন নি, তবে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করেন এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন। মার্কিন সরকার এবং চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার না করায়, গণহত্যা অব্যাহত রাখায় এবং পরিশেষে ভারতের উপর আক্রমণ করায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ডিসেম্বর ৭১ এ আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর তারিখে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর নিকট পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক লক্ষ পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। ভুটান, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত অপরাপর অনেক রাষ্ট্র ডিসেম্বর, জানুয়ারি’ ৭২ এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
Indian Philosophy : ভারতীয় দর্শন
ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্মের মূল তত্ত্ব ও তার ব্যাখ্যাকে প্রাচীনকাল হতে ভারতীয় দর্শন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভারতীয় দর্শন বিশ্বের প্রাচীনতম দর্শনসমূহের অন্যতম। খ্রিষ্টপূ্র্ব দশ অথবা পনের শতকের ইতিহাসেও এই দর্শনের সাক্ষাত পাওয়া যায়।
ভারতীয় দর্শনকে সাধারণত বেদান্ত, মীমাংসা, বৈশেষিক, ন্যায়, সংখ্যা ও যোগ এই ছয়টি শাখায় বিভক্ত বলে বর্ণনা করা যায়। অনেকে আবার সমগ্র ভারতীয় দর্শনকে সনাতনী এবং অসনাতনী এ দুটি বিভাগে বিভক্ত করে দেখান। এই অভিমতে বেদান্তে, মীমাংসা, বৈশেষিক, ন্যায়, সংখ্যা এবং যোগ এই আদি শাখাগুলি হচ্ছে সনাতনী শাখা। এর পরবর্তী বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক বা লোকায়াত শাখাগুলি হচ্ছে অ-সনাতনী শাখা। ভারতীয় দর্শনের এরূপ বিভাগকরনের কিছুটা ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকলেও এ বিভাজন কৃত্রিম। কেননা বস্তুবাদী বা লোকায়ত চিন্তার উদ্ভব সনাতনী ধারার পরে ঘটেছে, এ কথা ঠিক নয়। আদিকাল থেকেই সনাতনী চিন্তাধারার বিরোধী চিন্তা হিসাবে বস্তুবাদী চিন্তাধারারও অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
ভারতীয় দর্শনের উল্লিখিত ধারাগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হিসাবে বলা যায়
১. বেদান্ত: বেদের অন্ত বা শেষ অর্থ ‘বেদান্ত’। বেদের উপর উপনিষদের ব্যাখ্যা নিয়ে বেদান্ত তৈরি। ব্রহ্ম বা বিশ্বাত্মা কিংবা পরমাত্মা ও বিশেষ আত্মার তত্ত্ব বেদান্ত ধারার বৈশিষ্ট্য। বস্তুত পরমাত্মা ও বিশেষ আত্মার যে ব্যাখ্যা উপনিষদসমূহে দেওয়া হয়েছে তার গ্রহণ ও বর্জনের ভিত্তিতেই পরবর্তী ভারতীয় দর্শনের ধারাগুলির বিকাশ ঘটেছে। উপনিষদে ধর্মের রহস্যমূলক ব্যাখ্যা প্রদান করা হলেও এর মধ্যে বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তার যে বিরূপ সমালোচনার সাক্ষাত পাওয়া যায় তাতে এই পর্যায়ে জনসমাজে বস্তুবাদী চিন্তাও যে কিছুটা প্রভাবশালী ছিল তা বুঝতে পারা যায়।
২. মীমাংসা: বেদ সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও সমস্যার আলোচনা নিয়ে মীমাংসা সৃষ্টি। মীমাংসার তত্ত্বগত তাৎপর্য্য তেমন কিছু আছে বলে পন্ডিতগণ মনে করেন না। তবে তাঁরা এই পর্যায়ের একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন। মীমাংসায় বেদকেই অবিনশ্বর বলে স্বীকার করা হয়েছে। বেদই ভগবান। বেদের বাইরে কোনো ভগবানকে মীমাংসায় উল্লেখিত হতে দেখা যায় না।
৩. বৈশেষিক: বিশেষ থেকে বৈশেষিক। বৈশেষিকের দর্শন অনুগামী। ক্ষিতি, অপ, তেজ, ব্যোম, মন সবই হচ্ছে বস্তু। এই সমস্ত বিশেষ বস্তু সম্মেলনেই সর্বপ্রকার বস্তুর সৃষ্টি। এমনকি আত্মা, স্থান, সময় ইত্যাকার সত্তাও মূল বস্তুর সম্মেলনের ফল। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। বৈশেষিক বা সংখ্যা উভয় ধারাতেই মনকে বস্তু এবং আত্মা থেকে পৃথক বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
৪. ন্যায়: যুক্তি ও তর্কের পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে ন্যায়। ভারতীয় দর্শনের বিপুল ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা-উপধারার মধ্যে তীব্র বিরোধ ও কূটতর্কের মাধ্যমে পরস্পরকে খন্ডন করার চেষ্টা চলত। তার ফলে ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্র বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে। জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্র বিশ্বের প্রাচীন ন্যায়শাস্ত্রসমূহের মধ্যে সর্বাধিক বিকশিত, সূক্ষ্ম ও বিস্তারিত বলে বিবেচনা করা হয়। ন্যায়শাস্ত্রে পঞ্চস্তর বিশিষ্ট অনুমানের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা আরোহী অনুমানের প্রকৃষ্ট পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয়। প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, সাদৃশ্য বা উপনয় এবং উপসংহার-এই পাঁচটি স্তরকে অনুমানের অঙ্গ বলে অভিহিত করা হতো। যুক্তির পদ্ধতি ব্যতীত ন্যায়ের অপর একটি তাত্ত্বিক মত হচ্ছে: ক্ষিতি, অপ, তেজ ইত্যাদির সম্মেলনে বিশ্বলোক সৃষ্টির জন্য একটি আদি কারণের প্রয়োজন আছে। আর সেই আদি কারণই হচ্ছে ভগবান।
৫. সাংখ্য: সংখ্যা থেকে সাংখ্য। তত্ত্বগতভাবে সাংখ্য অণুবাদী নয়। সাংখ্যর মতে বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতি এবং পুরুষ এর সহযোগে। প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু আর পুরুষ হচ্ছে অচেতন আত্মা। আত্মার চেতনা ও মুক্তিলাভ প্রকৃতির বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে সম্ভব।
৬. যোগ: সাধনার জন্য দেহ এবং মনের উপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাখ্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে যোগ। সনাতনী এই ছটি ধারার প্রত্যেকেই যেমন বেদকে একমাত্র মান্য বলে স্বীকার করে তেমনি পুনর্জন্মের বন্ধন থেকে আত্মার প্রশ্নেও তারা ঐকমত্য পোষণ করে।
৭. জৈনতত্ত্ব: অ-সনাতনী ধারার মধ্যে জৈনশাখা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বলে পরিচিত।
৮. বৌদ্ধবাদ: বৌদ্ধবাদ সনাতনী সকল ধারা থেকে আত্মার প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব পোষণ করে। বৌদ্ধবাদের মতে ভগবান বা পরমাত্মা বলে কিছু নেই। আত্মা হচ্ছে বস্তুপুঞ্জের প্রবাহ। এই প্রবাহের অন্তরালে স্থির সত্তা বলে কিছু নেই। বস্তুত বৌদ্ধবাদের মতে, বিশ্বে স্থির বা নিত্য সত্তা বলে কিছু নেই। সবই অনিত্য। মানুষের অভিজ্ঞতা মুহুর্তের ঘটনার সমাহার ব্যতীত আর কিছু্ই নয়।
৯. বস্তুবাদ: পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সকল ধারার শেষে বস্তুবাদ উদ্ভূত হয়েছে এরূপ ধারণা ঠিক নয়। সমস্ত সনাতনী ও ভাববাদী ধারার প্রভাবকালেই তার প্রতিধারা হিসাবে বস্তুবাদী বা লোকায়ত চিন্তার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। চারুবাক বা জনপ্রিয় তত্ত্ব হিসাবে চার্বাক মতের সমালোচনা সনাতনী শাখাগুলির প্রায়টির মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় প্রাচীন বস্তুবাদের প্রকাশ দেখা যায় প্র্রধানত অস্তিত্ব, জ্ঞান ও আত্মার প্রশ্নে। অস্তিত্ব বস্তুবাদের মতে মনসহ সব অস্তিত্বই বস্তু। বস্তুর সম্মেলনেই বস্তু গঠিত। জ্ঞান: অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরোক্ষ অনুমান একেবারে সম্ভব না হলেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়। আত্মা: আত্মার পুনর্জন্মের কোনো প্রমাণ নেই। কাজেই আত্মার পুনর্জন্ম ঘটে, এ তত্ত্ব গ্রহণ করা চলে না।
দশম শতাব্দীতে ইসলামের ভারতে আগমন ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে একটি নতুন সংযোজনের সূচনা করে। ইসলাম ধর্ম একশ্বেরবাদী। ইসলামের প্রভাবে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনেও একেশ্বরবাদের প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে কবীর পন্থা ও শিখ ধর্মের উল্লেখ করা যায়।
ভারতীয় রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনে নতুনতর পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে আধুনিককালের ইংরেজ সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের ভারত আগমনের সঙ্গে। আধুনিক ইংরেজ ও ইউরোপীয় সভ্যতার বৈজ্ঞানিক দক্ষতার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসীগণ নিজেদের স্বাধীনতার প্রয়োজন উপলব্ধি করতে শুরু করে। সনাতন সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির স্থলে আধুনিক পুঁজিবাদের বীজ উপ্ত হতে শুরু করে। েএই পর্যায়ে জাতীয় মর্যাদা, ঐতিহ্য, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে নব্য শিক্ষিতদের পুরোধাদের মধ্যে যে চিন্তাপ্রবাহ সৃষ্টি হয় তাকে ভারতীয় দর্শনের আধুনিক পর্যায় বলা যায়। এই পুরোধাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়, তিলক গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, মোহাম্মদ ইকবাল, সর্বপল্লী রাধা কৃষ্ঞন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের কারোর মধ্যে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের কিংবা নবতর উদার ধর্মের সৃষ্টি (ব্রাহ্ম সমাজ) এবং কারো মধ্যে ইউরোপীয় বিজ্ঞানের সঙ্গে ভারতীয় ভাববাদের সম্মেলন ঘটাবার প্রয়াসমূলক চিন্তার সাক্ষাত পাওয়া যায়।
Individual : ব্যক্তি
Individual and Society : ব্যক্তি ও সমাজ
১. ব্যক্তি বলতে সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত সামাজিক একক বা মানুষকে বুঝান হয়।
২. মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তি হচ্ছে বুদ্ধি এবং আবেগের বিশিষ্ট প্রকাশ সমন্বিত চরিত্র।
ব্যক্তি নিয়ে সমাজ। আবার সমাজের মধ্যেই ব্যক্তির অস্তিত্ব। সমাজের বাইরে ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্ভব নয় বলেই একদিন সমাজের সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সম্পর্কের বিষয়টি দর্শন ও সমাজতত্ত্বের একটি বিশেষ আলোচিত প্রশ্ন। কারণ ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনস্বীকার্য হলেও ব্যক্তি বা সমাজ যুগ নিরপেক্ষ কোনো সত্তা নয়। সমাজ বলতে মানুষের তৈরি একটি সংগঠনকে বুঝায়। এ সংগঠন যুগ হতে যুগে পরিবর্তিত হয়। সমাজের একক ব্যক্তি বটে, কিন্তু ব্যক্তিমাত্রই সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করে না। বহু ব্যক্তির সম্মেলনে সৃষ্ট সমাজ ক্রমাণ্বয়ে একটা জটিল স্বাধীন অস্তিত্বময় সত্তা হিসাবে ইতিহাসে বিকাশ লাভ করেছে। সামাজিক সংগঠনের প্রকৃতি নির্ধারিত হয় প্রধানত তার উৎপাদনের উপায় কবলিত করার মাধ্যমে কোনো শ্রেণী অপর শ্রেণীর উপর শোষণ ও প্রভুত্ব কায়েম করে রাখতে পারবে ততদিন ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক বিরোধাত্মত থাকা স্বাভাবিক। কেননা, এমন পর্যায়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামো কার্য্যত প্রভু-শ্রেণীসমূহের সমাজ বা মুখপাত্ররূপে শোষিত শ্রেণীসমূহের নিকট প্রতিভাত হয়। তাই বলে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক চিরকাল এরূপ বিরোধাত্মক থাকবে তেমন ভাবাও সঙ্গত নয়। আসলে সমাজের উদ্ভব ব্যক্তির সঙ্গে বিরোধের মাধ্যমে নয়। পারস্পরিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমাজের সৃষ্টি। সমাজের বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে সাম্যবাদের প্রবক্ত কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখ সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দার্শনিকগণ এরূপ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ভবিষ্যতে একদিন যখন জীবিকার ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে তখন সমাজে বিরোধাত্মক শ্রেণীসমূহের যখন অস্তিত্ব থাকবে না, তেমনি ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক পরিপূর্ণরূপে পরস্পর নির্ভরশীল সম্পর্ক বলে আবার প্রতিভাত হবে।
Individual, Particular & Universal : বিশিষ্ট, বিশেষ ও সার্বিক
জ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বস্তু জগৎকে জানার জন্য মানুষের তৈরি কয়েকটি দার্শনিক সূত্র। বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর সম্পর্কের বিভিন্নতাকে এই সূত্রগুলির সাহায্যে মানুষ প্রকাশ করে। বস্তুজগতে বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক সাদৃশ্য ও পার্থক্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়। একটি ব্যক্তি বা বস্তু অপর ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে তুলনায় যে কারণে পৃথক বলে চিহ্নিত হয় সে কারণ বা গুণকে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বলা হয়। এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুকে আমরা বিশিষ্ট বা বিশেষ বলি।
যুক্তিবিদ্যায় বিশেষ বলতে এক কিংবা একাধিক সংখ্যাবাচক পদ বা বাক্যকে বুঝায়। যেমন ‘এই ঝুড়ির একটি আম কাঁচা’ কিংবা ‘এই ঝুড়ির অনেকগুলি আম কাঁচা’ বাক্য দুটিকে বিশেষ বাক্য বলে।
বস্তুর সঙ্গে বস্তুর পার্থক্য যেমন বস্তুকে বিশিষ্ট করে, তেমনি বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সাদৃশ্য বস্তুর কোনো গুণকে সার্বিক বলে চিহ্নিত করে। ‘রাম, রহিম, বা লাল রঙের কুকুরটি’ পদগুলি বিশিষ্ট পদ। আবার রাম, রহিম, করিম প্রভৃতি ব্যক্তির মধ্যে সাদৃশ্য হচ্ছে এই যে, তারা সকলেই মানুষ। সুতরাং তাদের মানুষ হওয়ার গুণটি বা মনুষ্যত্ব সার্বিক বা সাধারণ। যুক্তিবিদ্যায় সার্বিক বা সাধারণ পদ দ্বারা সে সমস্ত গুণকেই বুঝায় যে গুণ কোনো একটি জাতির অন্তর্গত কোনো সকল ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যেই বিরাজিত। মানুষ বা মনুষ্যত্ব সার্বিক বা সাধারণ। কারণ মানুষ জাতির অন্তর্গত সকল ব্যক্তির এই গুণ রয়েছে। ‘একটি লাল কুকুর’ বিশেষ বা বিশিষ্ট পদ। কিন্তু ‘কুকুর’ পদটি সার্বিক বা সাধারণ। কারণ কুকুর বলতে কুকুর প্রজাতির সকল জীবকে বুঝায়।
বিশিষ্ট, বিশেষ এবং সার্বিক পদগুলি পরস্পর সম্পর্কিত। তথাপি সার্বিক বা সার্বিকতা বলতে কি বুঝায়, এটি দর্শনের একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। ইতিহাসগতভাবে বলা যায় যে, মানুষের মধ্যে সার্বিকতার বোধ প্রথমে উদ্ভব হয় বস্তুর সঙ্গে বস্তুর গুণের সাদৃশ্য এবং কোনো গুণের পৌনঃপুনিক অস্তিত্বের প্রকাশ থেকে। কালক্রমে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়। বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সাদৃশ্য যে গুণের ক্ষেত্রে দেখা যায় সে গুণের মূল কি? গুণটির কি নিজস্ব কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে না এটি মানুষের মনের কল্পনা বা বিভিন্ন বস্তুর বিশেষ গুণের মানসিক বিশ্লেষণ? দৃষ্টান্তসরূপ ‘মানুষ’ একটি সার্বিক পদ অর্থাৎ যাদের মানুষ হওয়ার গুণ আছে তারা সকলেই মানুষ। তা হলে মানুষ হওয়ার গুণ বা ‘মনুষ্যত্ব’ কি বিশেষ মানুষের বাইরের কোনো অস্তিত্ব? না ‘মনুষ্যত্ব’টা মানুষের মনের একটি কল্পনা যার সঙ্গে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে কোনো জীবকে মানুষ বলা হয়।
আদি গ্রীক দার্শনিকগণ ‘সার্বিক’ গুণকে এক প্রকার বিশেষ অস্তিত্বময় বস্তু বলে বিবেচনা করতেন। থেলিস এর কাছে ‘পানি’ ছিল সার্বিক। কারণ তিনি মনে করতেন আর সব বস্তুর মধ্যে পানি আছে; পানির দ্বারা আর সব বস্তু তৈরি। হেরাক্লিটাস মনে করতেন, ‘আগুন’ হচ্ছে সার্বিক বস্তু। ডিমোক্রিটাস মনে করতেন ‘অণু’ হচ্ছে সার্বিক বস্তু বা সকল সৃষ্টির মূল।
কিন্তু প্লেটো তাঁর কূট যুক্তি দিয়ে বললেন, সার্বিক কোনো বিশেষ বস্তু হতে পারে না। সবার মধ্যে আছে বলে সার্বিক। কিন্তু সে নিজে বস্তু হিসাবে থাকলে বিশেষ হয়ে যায়। তাই সার্বিক এর স্বাধীন অস্তিত্ব যেমন আছে তেমনি সে আবার বস্তু নয়। সার্বিক হচ্ছে স্বাধীন অস্তিত্বময় ভাব। এরিস্টটল প্লেটোর মতকে পুরো স্বীকার করেন নি। তিনি সার্বিক গুণকে একদিকে বিভিন্ন বস্তুর বিশ্লেষণে মনের আহ্নত গুণ বলে উল্লেখ করেছেন, আবার অপর দিকে এ গুণকে কেবল মনের নির্ভরশীল বা মনের কল্পনাতে পর্যবসিত করেন নি। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ দার্শনিক লক সার্বিকতাকে মানুষের মনের বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রকাশ বলে আখ্যায়িত করে সার্বিক গুণের স্বাধীন অস্তিত্বকে একেবারেই অস্বীকার করেন।
বিশেষ ও সার্বিকের সম্পর্কটি দ্বন্ধমূলকভাবে বুঝা সঙ্গত। বস্তু-জগতের সামগ্রিকতা হচ্ছে ‘সার্বিক’। এই সমগ্র বা সার্বিকতার মধ্যে বিশেষ বস্তু একটির সঙ্গে আর একটি সম্পর্কিত। সম্পর্কের অনিবার্য দুটি দিক হচ্ছে তার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য, বিশিষ্টতা এবং সর্বজনীনতা। মানুষ বস্তুজগতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বস্তুর এই পারস্পরিক ও সামগ্রিকতাকে যত বুঝতে সক্ষম হয়েছে তত সে তার মধ্যে বিশেষ ও সার্বিককে মানসিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে।
Individualism : ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ইউরোপে মধ্যযুগের পরবর্তীকালে নিরঙ্কুশ শক্তিসম্পন্ন রাজা বা সরকারকে রাষ্ট্রের প্রতিভূ বিবেচনা করে রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি হিসাবে ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার প্রভৃতির পক্ষে যুক্তিমূলক তত্ত্বকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এই পটভূমিতে এমন কথাও বলা হয় যে, কোনো একটি সমাজে ব্যক্তি হচ্ছে সার্বভৌম, সরকার তথা রাষ্ট্র নয়। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে এবং ফরাসি দেশে অষ্টদশ শতকে এই তত্ত্বের বিশেষ আলোচনা দেখা যায়। রাষ্ট্রের উদ্ভব কিভাবে হয়েছে? রাষ্ট্রচিন্তার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভিত্তিতে বলা হতে থাকে, ঈশ্বর কিংবা রাজা নয়; রাষ্ট্র উদ্ভূত হয়েছে মানুষের আদি বা প্রাকৃতিক অবস্থাতে সার্বভৌম ব্যক্তির সঙ্গে সার্বভৌম ব্যক্তির চুক্তির ভিত্তিতে। এই তত্ত্ব ‘সোশ্যাল কনট্রাস্ট থিউরি’ বা ‘সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের টমাস হবস এবং জন লক সপ্তদশ শতকে এবং ফ্রান্সের রূশো অষ্টাদশ শতকে তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ যথা ‘লেভিয়াথান’, ‘টু ট্রিটিজেস অন সিভিল গভর্ণমেন্ট’ এবং ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ এ রাষ্ট্রের উদ্ভব, সরকারের ভূমিকা এবং ব্যক্তির অধিকার প্রভৃতি প্রশ্নের উপর সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের ভিত্তিতে তাঁদের নিজ নিজ চিন্তা প্রকাশ করেন। এই সকল চিন্তাবিদের চিন্তায় এবং একালের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থায় ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতা বোধের প্রকাশ। আসলে এই কাল ছিল সামন্ততান্ত্রিক পর্যায় থেকে ধনতান্ত্রিক পর্যায়ে সমাজের বিকাশ কাল। নতুন উদীয়মান ধনতান্ত্রিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্র এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অধিকারের ঘোষণাই ছিল ইংল্যান্ডের ১৬৪৯ এবং ১৬৮৮ সালের বিপ্লবাত্মক ঘটনাসমূহ, আমেরিকার ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য। সেই সময় থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বেরও বিকাশ ঘটেছে। গোড়াকার সেই আমলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্র এবং সরকারকে ব্যক্তির বিরোধী অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করত। এবং সে কারণে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্র এবং সরকারের যত কম হস্তক্ষেপ ঘটে, তত মঙ্গল বলে মনে করা হত। রাষ্ট্র বা সরকার ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা এবং বাইরের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করবে। এর অধিক কোনো দায়িত্ব ব্যক্তি রাষ্ট্র বা সরকারকে প্রদান করে নি। এ চিন্তার মধ্যে জোর ছিল ব্যক্তির সর্বপ্রকার কর্মকান্ডে, বিশেষ করে তাঁর অর্থনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার উপর। পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে অবাধ প্রতিযোগিতার একটি তাত্ত্বিক ভূমিকা একালের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পালন করে। হবস, লক এবং রুশোর পরে হার্বাট স্পেন্সারের মধ্যে চরম ব্যক্তিস্বা্তন্ত্র্যবাদী চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ এবং তার অন্তর্নিহিত সামাজিক সমস্যার ক্রমবৃদ্ধি চিন্তাবিদদের মধ্যে আবার এই বোধের ও সৃষ্টি করতে থাকে যে, রাষ্ট্র বনাম সরকার তথা ব্যক্তি বোধটি বিদ্যমান সামাজিক সমস্যার চরিত্র অনুধাবনে এবং তার সমাধানে যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্র এবং সরকার যেমন ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি, তেমনি ব্যক্তির জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয় ভূমিকাকে বাঞ্চিত বলে গণ্য করা যায় না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এরূপ ব্যাখ্যার সাক্ষাৎ বেনথাম, জন ষ্টুয়ার্ট মিল এবং টি.এইচ.গ্রীন প্রমুখের রচনার মধ্যে পাওয়া যায়। এরূপ ব্যাখ্যাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা উদারতাবাদের সংশোধন বলেও অনেক সময়ে আখ্যায়িত করা হয়। (দ্র. সামাজিক চুক্তি, গ্রীন, উপযোগবাদ প্রভৃতি)।
Induction : আরোহ
Induction Method : আরোহ পদ্ধতি
জ্ঞান আরোহনের দুটি পদ্ধতি প্রধান। একটি অবরোহী, অপরটি আরোহী। অবরোহীতে কোনো সাধারণ সত্যের সাহায্যে কোনো বিশেষণের জ্ঞান আমরা লাভ করি। আরোহীর ক্ষেত্রে বিশেষণের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা একটি সাধারণ বা সার্বিক সত্যে উপনীত হই।
ইউরোপীয় দর্শনে জ্ঞান ও যুক্তির পদ্ধতি প্রথমে বিশ্লেষণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন এরিস্টটল। এরিস্টটলের পরে আরোহী পদ্ধতির বিকাশ ঘটে আধুনিককালের প্রধানত ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলিউ, নিউটন, মিল প্রমুখ বিখ্যাত ইউরোপীয় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের হাতে। জ্ঞানের আরোহী পদ্ধতির বিকাশ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে আরোহী পদ্ধতির প্রয়োগ যেমন সহজতর করেছে তেমনি বিজ্ঞানের বিকাশ আরোহী পদ্ধতিকে সুবিস্তারিত এবং সঠিক করে তুলেছে।
সাধারণত আরোহী যুক্তি ও অনুমানকে তিন প্রকারে বিভক্ত করা হয়। (১) পূর্ণা্ঙ্গ আরোহ, (২) আংশিক আরোহ বা সাধারণ আরোহ, (৩) বৈজ্ঞানিক আরোহ।
পূর্ণাঙ্গ আরোহ বলতে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক বস্তু বা বিষয়ের প্রত্যেকটি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত বুঝানো হয়। পর্যবেক্ষণের সম্পূর্ণতার ভিত্তিতে এই অনুমানকে পূর্ণাঙ্গ বলা হয়। একটি বিদ্যায়তনের প্রত্যেকটি ছাত্রকে পর্যবেক্ষণ করে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে, উক্ত বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ছাত্র বাংলা ভাষাভাষী তা হলে এই অনুমানটি পূর্ণাঙ্গ আরোহী অনুমান হবে। কারণ বিদ্যায়তনের সকল ছাত্রকে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছে। এমন অনুমানের সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিশ্চিত। কিন্তু এরূপ অনুমান কেবলমাত্র তেমনক্ষেত্রেই সম্ভব যেখানে পরীক্ষণীয় বা বিবেচ্য বস্তু বা বিষয়ের সংখ্যা সীমাবদ্ধ। পূর্ণাঙ্গ অনুমানের বিপরীত হচ্ছে অপূর্ণাঙ্গ অনুমান। একটি স্কুলের কয়েকটি মাত্র ছাত্রকে পরীক্ষা করে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে, এই স্কুলের সকল ছাত্র বুদ্ধিমান কিংবা ইংরেজ জাতির কিছু সংখ্যক লোকের পরিচয় পেয়ে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে, ইংরেজ জাতি পরিশ্রমী অর্থাৎ সকল ইংরেজ পরিশ্রমী, তাহলে সিদ্ধান্তটি অ-পূর্ণাঙ্গ অনুমানের দৃষ্টান্ত হবে। এখানে বিবেচ্য বিষয়ের সকলকে পর্যবেক্ষণ করা হয় নি। এরূপ অনুমানের সংখ্যাই অধিক। মানুষ এই পদ্ধতিতে সাধারণত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে অপূর্ণাঙ্গ অনুমানকে সাধারণ বা জনপ্রিয় আরোহী অনুমান বলে অভিহিত করা হয়। বৈজ্ঞানিক আরোহেও আংশিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমন রাম মরেছে, রহিম মরেছে, জালাল মরেছে, সুতরাং সকল মানুষ মরবে বা সকল মানুষ মরণশীল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক আরোহীর প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং শর্ত হচ্ছে এই যে, অ-পূর্ণাঙ্গ অনুমান যেখানে পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলির মধ্যে সাধারণ সাদৃশ্যের ভিত্তিতে করা হয়, সেখানে বৈজ্ঞানিক আরোহে পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ কারণে বৈজ্ঞানিক অনুমানে পর্যবেক্ষণের বিষয়ের সংখ্যা কম বা আংশিক হলেও সিদ্ধান্ত সুনিশ্চিত।
জ্ঞানের জন্য বৈজ্ঞানিক আরোহীই প্রধান উপায়। বৈজ্ঞানিক আরোহের ক্ষেত্রে প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে পর্যবেক্ষণের বিষয় বা বস্তুর মধ্যে অনিবার্য কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা। প্রচলিত যুক্তিবিদ্যায় এই সম্পর্ক আবিষ্কারের জন্য আরোহী অনুমানের কয়েকটি পদ্ধতির বিবরণ দেওয়া যায়। এই পদ্ধতিগুলি আরোহী পদ্ধতি বা আরোহী অনুমানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। সাধারণভাবে এরূপ পদ্ধতির সংখ্যা হচ্ছে পাঁচটি। ১. সাদৃশ্যপদ্ধতি: বিবেচিত বিষয়ের মধ্যে একাধিক গুণের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সকল সম্পর্কে অনুমান। ২. ব্যতিরেকে পদ্ধতি: বিবেচিত বিষয়গুলির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট গুণের ক্ষেত্রে পার্থক্যের ভিত্তিতে বিষয়গুলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ৩. সাদৃশ্য ও ব্যতিরেকের সংযোগগঠিত যুক্ত পদ্ধতি। ৪. সহপরিবর্তন পদ্ধতি : বিবেচিত বিষয়ের একটির মধ্যে কোনে পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপর কারুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হতে দেখলে উভয় কার্যকারণ রূপে সম্পর্কিত বলে অনুমান গ্রহণ। ৫. অবশেষ পদ্ধতি : কোনো বিষয়ের এক অংশ যদি অপর কোনো অংশের কারণ বলে আমাদের জানা থাকে তা হলে তার ভিত্তিতে এই বিষয়ের অবশিষ্ট অংশকে অপর বিষয়ের অবশিষ্ট অংশের কারণ বলে অনুমান করা।
অবরোহ অনুমানে আমরা সাধারণ বা সার্বিক সত্য থেকে বিশেষ সত্যে উপনীত হই এবং আরোহ অনুমানে বিশেষ থেকে সার্বিকের দিকে অগ্রসর হই বলে এরূপ মনে হতে পারে যে, অবরোহ এবং আরোহ পরস্পর বিরোধী। কিন্তু তা ঠিক নয়। বস্তুত, জ্ঞানের ক্ষেত্রে অবরোহ এবং আরোহ হচ্ছে পরস্পর সম্পর্কিত এবং পরিপূরক পদ্ধতি।
Inference : অনুমান
যুক্তির ক্ষেত্রে এক কিংবা একাধিক যৌক্তিক বাক্যের মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিকে অনুমান বলা হয়। অনুমান প্রধানত অবরোহ এবং আরোহ অনুমান হিসাবে বিভক্ত।
অবরোহ অনুমানের মধ্যে এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার সিলোজিজম বা দুটি যৌক্তির বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রধান বলে মনে করা হয়। সকল মানুষ মরণশীল, সক্রেটিস একজন মানুষ; সুতরাং মানুষ-এটি সিলোলিজমের একটি প্রচলিত দৃষ্টান্ত।
এরূপ অনুমানের মূল ভিত্তিকে এ্যরিস্টটলের ‘ডিকটাম ডি অমনি এট নালো’ বলে উল্লেখ করা হয়। এরিস্টটলের এই বিধান অনুযায়ী সামগ্রিকভাবে একটি শ্রেণী বা জাতি সম্পর্কে যে কথা সত্য, উক্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কেও সে কথা অনুরূপভাবে সত্য। অবরোহ অনুমানের সিদ্ধান্তের সত্যতা নির্ভর করে যুক্তির কাঠামোর মধ্যে গৃহীত বাক্য বা বিবৃতির সত্যতার উপর। গৃহীত হেতু বা যৌক্তিক বাক্য যদি সত্য হয় তা হলে সিদ্ধান্ত সত্য হবে। অবরোহ অনুমান তাই যুক্তির কাঠামোগত সঙ্গতি বা আঙ্গিক সত্যতার উপর অধিক জোর দেয়। এই সঙ্গতি বিধানের জন্য যুক্তিবিদগণ অনুমানের কতকগুলি নিয়ম নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। এগুলির মধ্যে নিম্নোক্তগুলি উল্লেখযোগ্য। ১. একটি যুক্তির মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ বা পদকে একটি নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করতে হবে, একাধিক অর্থে নয়। ২. একটি যুক্তির মধ্যে যদি না বাচক বাক্য থাকে তবে তার সংখ্যা একের অধিক হতে পারবে না। ৩. মধ্য পদের মাধ্যমে যুক্তির প্রধান ও অপ্রধান পদকে সম্পর্কিত হতে হবে। এই নিয়মগুলি পালন করে যুক্তি গঠন করলে সে যুক্তিসঙ্গতসম্পন্ন হবে। কিন্তু কার্যত মানুষ নিয়মগুলি পালনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে না বলে অনেক সময় যুক্তিতে পরস্পরবিরোধী এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বাক্য এবং সিদ্ধান্তের ব্যবহার দেখা যায়।
Infinite and Finite : অসীম এবং সসীম
বস্তুজগতকে সামগ্রিকভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় দুটি সূত্র। দর্শনের ইতিহাসে অসীম ও সসীম ভাব দুটি বিশেষ বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। অনেক দার্শনিকের মতে অসীম ও সসীমের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট করার সমস্যা একটি চিরন্তন সমস্যা এবং এর সমাধান সম্ভব নয়। অনেকে আবার অসীমকে একেবারে অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে মানুষ অভিজ্ঞতায় কেবল সসীমকেই পায়, অসীমকে নয়। এ কারণে অসীম বলে কিছু আছে বলে মানুষ দাবি করতে পারে না।
অসীমের ধারণা মানুষ তার জীবনের শুরুতে করতে পারে নি। অসীমের ধারণা নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে জন্মলাভ করে নি। সসীম বা খন্ডবস্তুর সঙ্গেই তার প্রথম পরিচয়। কিন্তু খন্ডবস্তুর অভিজ্ঞতা যত বিস্তার লাভ করতে থাকে তত মানুষের মনে বস্তু ও বিশ্বজগতের ব্যাপকতার বোধ জাগ্রত হতে থাকে। এই ব্যাপকতা বোধ থেকেই মানুষের মনে অসীম ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। ‘অসীম’ মানুষের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা নয়। ‘অসীম’ একটি যৌক্তিক ভাব। বস্তুকে সসীম ভাবা যায়না বলেই মানুষকে অসীমের কল্পনা করতে হবে। খন্ডবস্তুর সঙ্গে মানুষের পরিচয়। সমস্ত খন্ডবস্তু নিয়ে অখন্ড বিশ্ববস্তু। কিন্তু এমন চিন্তা করা যায় না যে, কাল বা স্থানের মধ্যে এই অখন্ড বিশ্ববস্তুর কোনো সীমানা আছে। যদি তেমন কোনো সীমানা থাকে তাহলে সেই সীমানার বাইরে বিস্তারিত যা তার চরিত্র নির্ধারণ করতে হয়। সীমানার বাইরে যা তা নিশ্চয়ই কোনো অস্তিত্ব। কেননা, অস্তিত্বহীনতার মধ্যে কোনো অস্তিত্ব বিরাজ করতে পারে না। নিরেট শূণ্য বা নাস্তিত্ব বলতে কিছু থাকতে পারে না। নাস্তিত্বের মধ্য থেকে কোনো অস্তিত্ব আবির্ভুত হতে পারে না। কাজেই বস্তুর কোনো সীমানা নির্দিষ্ট করলে তার বাইরে সীমাহীনতাও একটি অস্তিত্ব। আর তা বস্তু ছাড়া কিছু হতে পারে না। বস্তু ছাড়া কোনো অস্তিত্বের কল্পনা বিজ্ঞান করে না। এ কারণে বস্তুর সীমানার বাইরেও বস্তু। অর্থাৎ বস্তু সীমাহীন ও সময়হীন। বস্তুর মধ্যে সীমা আছে অর্থাৎ সীমাবদ্ধ বস্তুপুঞ্জ দিয়েই বস্তু গঠিত; কিন্তু সমগ্র বস্তুর কোনো সীমা নেই। বস্তুর সময় নেই অর্থাৎ বস্তু কোনো এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে শূণ্যতা ছিল এমন কল্পনাও বৈজ্ঞানিকভাবে করা সম্ভব নয়। কিন্তু খন্ডবস্তুর সময় আছে, পরিবর্তন আছে। খন্ডবস্তুর জন্ম ও পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু সমগ্র বস্তুর নয়। এ আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, সসীম হচ্ছে একটি আপেক্ষিক ধারণা এবং অসীম ও সসীমের সম্পর্ক হচ্ছে একটি দ্বান্ধিক সম্পর্ক। সসীম দিয়েই অসীম তৈরি। কিন্তু সে কারণে অসীমকে সসীম বলা যায় না। আবার কোনো সসীমই অপর সসীম হতে বিচ্ছিন্ন নয়। খন্ডবস্তুর সঙ্গে খন্ডবস্তুর সম্পর্ক একটি খন্ডবস্তুর সসীমতা যেমন নির্দিষ্ট করে তেমনি আবার এই অচ্ছেদ্য সম্পর্ক তাকে অসীমের অংশ করে অসীমের কল্পনাকে সম্ভব করে তোলে। অসীম ও সসীমের এই পারস্পরিক দ্বান্ধিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিককালের হেগেলের দর্শনে এবং তাঁর পরবর্তীকালে মার্কসবাদী দর্শনে পাওয়া যায়।
ধর্ম অবশ্যক অসীমকে বস্তু বলে কল্পনা করে না। ধর্মীয় বিশ্বাসে বস্তুজগত হচ্ছে সসীম, কিন্তু বস্তুজগতের স্রষ্টা যিনি তিনি যেমন অ-বস্তু তেমনি অসীম। ধর্মের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এই যে, সেই অসীম অবস্তুকে বস্তুগত গুণ বা ধারণা ছাড়া অপর কিছুর দ্বারা ধর্ম প্রকাশ করতে পারে না। ধর্মীয় অসীম বস্তু হলেও তাঁর দয়া-মায়া, দন্ডদানের এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের ক্ষমতা আছে। ধর্মীয় অসীমের মধ্যে মানুষ মাত্রেরই অসীমবোধের একটা প্রয়োজনীয়তার যেমন স্বীকৃতি আছে তেমনি সে ব্যাখ্যা রহস্যময় হয়ে সসীম ও অসীম উভয়ের বৈজ্ঞানিক ধারণার বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
Innate Ideas : সহজাত ভাব
ভাববাদী দর্শনের মতে মানুষের মনের ভাব বা ধারণা দুরকমের। ১. অভিজ্ঞতাগত ভাব; ২. জন্মগত বা সহজাত ভাব।
সহজাত বা জন্মগত ভাব বলতে ভাববাদী দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, মানুষেরে মনের সব ভাব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত নয়। তার মনে এমন কতকগুলি ভাব থাকে যেগুলি তার জন্মগত। এগুলিকে মানুষ ইন্দ্রিয়ানুভুতি বা অভিজ্ঞতা থেকে লাভ করতে পারে না। এঁদের মতে ধর্ম, নীতি, ন্যায়শাস্ত্র, অংকশাস্ত্র প্রভৃতি এরূপ জন্মগত ভাবের ভিত্তিতে গঠিত। সংখ্যা কিংবা ২+২=৪, ঈশ্বর, ধর্ম কিংবা ন্যায়শাস্ত্রের বিধান বা সময়, স্থান ইত্যাদির ধারণা মানুষের সহজাত ধারণা। সহজাত ধারণার অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে তাদের মতে সহজাত ধারণা যেমন সার্বিক অর্থাৎ স্বভাবস্বীকৃত, তেমনি সেগুলি সত্য ও অনিবার্য। সত্য, কেননা মানুষের মন সেগুলি অসত্য বলে কল্পনা করতে পারে না। এগুলি অসত্য হলে বিশ্বজগতের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত বলেন ‘আমি চিন্তা করি’-এটি এমন একটি ধারণা যাকে মানুষ আদৌ সন্দেহ বা অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, মানুষের সন্দেহ করাটাও একটা চিন্তার প্রকাশ। সন্দেহের অতীত এই ধারণা মানুষের জন্মগত। এই ধারণার মূল ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞানরাজ্য গঠিত। সহজাত ধারণা অনিবার্য। কারণ, সহজাত ধারণা ব্যতীত মানুষের জ্ঞানজগৎ অকল্পনীয় হয়ে পড়ে।
ভাবের উদ্ভব এবং প্রকারভেদ দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ ‘সহজাত ধারণাগুলিকে’ মানুষের মনের বিশ্লেষণমূলক ক্ষমতার এবং যুগ যুগব্যাপী অভিজ্ঞতার পরিফল বলে মনে করেন। এগুলিকে আদিকাল থেকে সহজাত বলে বলে স্বীকার করেন না। ভাবের উৎস সম্পর্কে অবৈজ্ঞানিক মনোভাবের কারণেই বহু পরীক্ষিত এবং বহু অভিজ্ঞতালব্ধ আপাত সহজ ও সন্দেহের অতীত ভাবকে মানুষ স্বতঃসিদ্ধ ও সহজাত বলে মনে করে। মানুষ ভাবের আকর। মানুষের সঙ্গে বস্তুজগতের নিয়ত প্রবাহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের মনে বস্তু সম্পর্কে ভাবের সৃষ্টি হয়। বস্তুবাদীদের মতে সকল প্রকার ভাব সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য।
Inhibition : বাধা
‘ইনহিবিশান’ বা বাধা মনোবিজ্ঞানের একটি বিশেষ অর্থবোধক শব্দ। ব্যক্তির চরিত্র বিভিন্ন প্রকার কামনা পূরণ করার সুযোগ দেয় না। সমাজের নিকট ব্যক্তির যে ইচ্ছাগুলি অবাঞ্চিত বলে বিবেচিত হয় সমাজ সে ইচ্ছাগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ব্যক্তির ইচ্ছা বা বাসনামাত্রই একটা শক্তি। তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও সে বিনা প্রতিরোধে নিরুদ্ধ হয়ে যায় না। সামাজিক আইন কানুন, বিধিনিষেধ ব্যক্তির মনে বিবেক বা সচেতন প্রহরীর রূপ গ্রহণ করে। একে আমরা চেতনাও বলতে পারি। ব্যক্তির বিবেক বা চেতনা নিষিদ্ধ বাসনার আত্মপ্রকাশের বিরুদ্ধে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করে। অপরদিকে ‘নিষিদ্ধ’ বাসনাও আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে চরিতার্থতার পথ অন্বেষণ করে। এই নিষিদ্ধ বাসনা এবং তাদের চরিতার্থতা লাভের প্রয়াসকে মনোবিজ্ঞানের বাধা বা ইনহিবিশন বলে আখ্যাত করা হয়।
Inquisition : নির্দয় ধর্মীয় বিচার
‘ইনকুইজিশন’ শব্দের অর্থ ‘বিচারের জন্য অনুসন্ধান’ হলেও ইউরোপের ইতিহাসে ইনকুইজিশন বলতে ধর্মান্ধতার যুগে ধর্মীয় প্রতিপক্ষ বা ধর্মীয় গোড়া সংস্কার ও বিশ্বাসের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও নির্দয় বিচার ব্যবস্থাকে বুঝায়। ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় বিচারের সূচনা ঘটে ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে। খ্রিষ্টীয় জাযকগণ যাদেরকে অবিশ্বাসী বা খ্রিষ্টীয় ধর্মবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করত তাদের বিচার করার জন্য অনুসন্ধানকারী এবং একদল বিচারক নিযুক্ত করত। খ্রিষ্টীয় জাযকদের এই বিচারব্যবস্থা বিভিন্ন দেশের খ্রিষ্টান সম্রাটগণ অনুমোদন করেন। যারা খ্রিষ্টানধর্ম পরিত্যাগ করে অপর কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণ করত তাদের বিরুদ্ধেও ‘ইনকুইজিশন’ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হত। গোড়ার দিকে ধর্মত্যাগী কিংবা অবিশ্বাসীদের নিকট থেকে স্বীকারোক্তি আদায় এবং ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া দৈহিক নিপীড়ন প্রয়োগ করা না হলেও ক্রমান্বয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখা, নির্মম অত্যাচার ও অভিযুক্তকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা ‘ইনকুইজিশনের’ অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এ বিচার ব্যবস্থায় অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোনো সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন হতো না। দুজন লোকের গোপন অভিযোগের ভিত্তিতে যে কোনো নাগরিককে এই ধর্মান্ধ বিচারকদের নিকট সোপর্দ করে তাকে দন্ডিত করা যেত। ইনকুইজিশনের চরম রূপ গ্রহণ করে স্পেনে পঞ্চদশ শতকে। স্পেনীয় ইনকুইজিশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত কিংবা ইহুদী ধর্মে বিশ্বাস করত তারা। স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা যাকে প্রথম ইনকুইজিটার বা প্রধান বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন সে তার কার্যকালে দুই হাজার লোককে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করেছিল। ইনকুইজিশনের আতঙ্কে মধ্যযুগের ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষকগণ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে কিংবা মতামত প্রকাশ করতে সাহস পেত না। এই সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। অনেক চিন্তাবিদ ও মুক্তবুদ্ধির মানুষকে এই ধর্মীয় বিচারের যূপকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হয়। এঁদের মধ্যে ইউরোপীয় পুনর্জাগরণের অন্যতম পুরোধা গিওনার্দো ব্রুনোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর যুক্তিবাদী ও স্বাধীন মতামতের জন্য তাঁকে ইনকুইজিশনের হুকুমে ১৬০০ সনে রোম শহরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
Insanity : বাতুলতা, পাগলামী, মানসিক অসুস্থতা
মানসিক অসুস্থতা কিংবা পাগলামীর সূচনা বা উহার সীমা নির্দিষ্ট করে সংজ্ঞাদান করা কঠিন। কারণ মানসিক অসুস্থতা কেবল মন কিংবা কেবল দেহের ব্যাপার নয়। মামমমমামমানসিক রোগ বা অসুস্থতার প্রধান লক্ষণ ব্যক্তির জাগতিক ক্রিয়াকর্মে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণক্ষমতার হ্রাস কিংবা অভাব। জাগতিক উদ্দীপকের জবাবে মানুষ যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সে সমস্ত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা পারম্পর্য এবং সম্পর্ক বিদ্যমান। এই পারম্পর্য এবং সম্পর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি বা বিবেচনার ফল। ব্যক্তির মন বা মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্ত উদ্দীপকের বিবেচনা করে এবং তার জবাবে নিজের জীবন ও স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাব ঘটলে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ামূলক জবাবের মধ্যে আর শৃংখলা, ভারসাম্য এবং আত্মস্বার্থমূলক চিন্তার লক্ষণ থাকে না। অবশ্য শৃঙ্খলা, ভারসাম্য প্রভৃতি বিষয়গুলি আপেক্ষিক। ব্যক্তির সামাজিক আচরণের যদি কোনো আদর্শ মান স্থির করে তাকে ‘স্বাভাবিক’ বলা যায় তা হলে তার বিচারে যে কোনো ব্যক্তির কোনো না কোনো আচরণকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা যাবে। এজন্য পাগলামি বা মানসিক রোগের লক্ষণ যদি ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ হয় তা হলে মানুষমাত্রই আপেক্ষিকভাবে কম কিংবা অধিক মাত্রায় অস্বাভাবিক অর্থাৎ পাগল। সাধারণত যে ব্যক্তির আচরণ সমাজের অপর দশজনের চোখে অত্যধিক অস্বাভাবিক বলে বোধ হয় তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করা হয়।
পাগলামির কারণের গবেষণা চিকিৎসাশাস্ত্র এবং মানোবিজ্ঞানে দীর্ঘকাল যাবত চলে আসছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির পূর্বে সাধারণ ধারণা ছিল যে পাগলামির কারণ অতি-প্রাকৃতিক এবং দেহের বাইরের কোনো অশরিরী অশুভ শক্তি ব্যক্তির উপর ভর করে তার সমস্ত আচরণ অস্বাভাবিক করে তোলে। এ কারণে অতীতে পাগলামি থেকে রোগীকে নিরাময় করার প্রধান পদ্ধতি হিসাবে মানুষ জাদু, মন্ত্র ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করত। পরবর্তীকালে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষয় কিংবা ক্ষতির মধ্যে নির্ধারিত করার চেষ্টা করা হয়। চিকিৎসকগণ বলেন যে, মস্তিষ্কের করটেক্স বা বহিঃস্তরে আঘাতের ফলে কিংবা বিষাক্ত রক্তের কারণে ক্ষতি সাধিত হলে ব্যক্তির চেতনায়ও নানা প্রকার বিভ্রান্তি বা বিকারের সৃষ্টি হয়। এরূপ বিকারেই মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়। এরূপ বিকারকেই মানসিক রোগ বলে। আসলে মানসিক বা মনের রোগ বলে কিছু নেই। সবই ঘটে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ করে মস্তিষ্কের ক্ষয়ক্ষতির ফলে। কিন্তু এই অভিমত মনোবিজ্ঞানীগণ সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন না। মনোবিজ্ঞানে মনের অস্তিত্বের উপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করেন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড(১৮৫৬-১৯৩৯)। তিনি মানসিক রোগের উপর গবেষণা করেন এবং তার গবেষণার তত্ত্ব মনোসমীক্ষণ নামে পরিচিত। ফ্রয়েড এই অভিমত পোষণ করেন যে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মস্তিষ্কের কোষসমূহ স্বাভাবিক থাকলেও মানসিক বিকারের উদ্ভব ঘটতে পারে। এর কারণ মানুষের মন আছে এবং মন হচ্ছে মানুষের জীবন যাপনের এবং সুখলাভের জন্য কামনা বাসনার সমষ্টি। মানুষের মন চেতন এবং অচেতনে বিভক্ত। সামাজিকভাবে অবাঞ্চিত কামনা নিয়ে ‘অচেতন’ তৈরি। ‘অচেতন’ ভাগের আত্মতৃপ্তি লাভের প্রচেষ্টা এবং সচেতন মন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়াসে মানুষের মনে দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্ধের তীব্রতা ব্যক্তির চরিত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে ব্যক্তিকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে তোলে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ফ্রয়েড তাই মানসিক রোগের নিরাময়ের জন্য দেহের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ঔষধযোগে নিরাময়ের পরিবর্তে মনের দ্বন্ধ নিরসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তার উপযুক্ত উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। এই উপায়ের মধ্যে ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ অন্যতম।
পাগলামির প্র্রধান লক্ষণ হিসাবে ব্যক্তির মধ্যে ডেল্যুশন বা বিশ্বাসভ্রম, হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিভ্রম, অপরকে অকারণে দৈহিকভাবে আঘাত কিংবা নিজের আত্মহত্যার চেষ্টা প্রভৃতি আবেগমূলক আচরণ উল্লেখ করা যায়। রোগের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে, রোগী কোনো বিষয়ের উপর সামান্যতম মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে না। সে প্রতিমুহুর্তে বিষয় হতে বিষয়ান্তরে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার এমন ও হতে পারে যে, রোগী আপাতঃদৃষ্টিতে এত গভীরভাবে আত্মবিলীন হয়ে থাকে যে তার মনোযোগ কোনো উদ্দীপক দ্বারাই আকৃষ্ট করা সম্ভব হয় না। স্মৃতি-ভ্রংশ কিংবা স্মৃতির পরস্পর বিচ্ছিন্ন খন্ডে খন্ডিত হয়ে যাওয়া মানসিক রোগের অপর একটি সাধারণ লক্ষণ। মানসিক রোগের মূলে দৈহিক কোনো ক্ষতি থাকে কিনা সে সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকেই বলা চলে মানসিক অসুস্থতা নানা প্রকার দৈহিক অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি করে। মানসিক বিকার রোগীর নিদ্রাল্পতা বা নিদ্রাহীনতা, ধমনীর দ্রুতগতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর রোগীর নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতার মাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
Instinct : সহজাত প্রবৃত্তি, সহজাত প্রতিক্রিয়া, অচেতন প্রতিক্রিয়া
উত্তেজনা অর্থাৎ পরিবেশের সংস্পর্শে প্রাণীমাত্রেরই একটা প্রতিক্রিয়া ঘটে। উত্তেজকের প্রভাবে প্রাণী তার দেহে সাড়া দেয়। উন্নত বা জটিল প্রাণী, বিশেষ ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া প্রধানত দুরকমের অচেতন এবং সচেতন। নিম্নতর প্রাণীর মধ্যে অচেতন প্রতিক্রিয়ার পরিমাণই অধিক। কীট-পতঙ্গ অতি নিম্নমানের প্রাণী। জীবন রক্ষার জন্য পরিবেশের সঙ্গে তাদের খাপ খাইয়ে চলতে হয়। এজন্য তাদের বিভিন্ন প্রকার প্রতিক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হয়; কিন্তু এ সমস্ত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিবেচনা সম্মত চিন্তা আছে বলে আমরা মনে করি না। এ জন্যই এরূপ প্রতিক্রিয়াকে প্রাণীর অচেতন, প্রাথমিক কিংবা সহজাত প্রতিক্রিয়া বলা হয়। মানুষের ব্যবহারের প্রধান ভাগ সচেতন। কিন্তু ব্যবহার বা প্রতিক্রিয়ার একটা ভাগ অচেতন বা সহজাত সাড়া দিয়ে গঠিত। আঙুলের ডগায় সুঁচ ফুটলে বা প্রজ্জ্বলিত দীপকাঠি স্পর্শ করলে শিশু হতে বৃদ্ধ সকলেই অবিলম্বে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। চোখে তীব্র আলোর প্রক্ষেপ ঘটলে আমাদের সবার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। কোনো উত্তেজকের জবাবে দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এরূপ প্রতিক্রিয়াকে সহজাত প্রতিক্রিয়া বলা হয়। রুশ মনোবিজ্ঞানী পাভেলভের মতে মানুষ বা মনুষ্যত্বের প্রাণীর সহজাত প্রতিক্রিয়াগুলি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত অণুক্রিয়া বা আনকন্ডিশান্ড রিফ্লেক্স অ্যাকশন। তাঁর মতে অণুক্রিয়া বলতে উত্তেজকের জবাবে দেহের অঙ্গাদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সেই আচরণকে বুঝায়। অণুক্রিয়াকে যে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রিত করে ‘নিয়ন্ত্রিত অনুক্রিয়া’ বা কনডিশন্ড রিফ্লেক্সের সৃষ্টি করা যায় তা তাঁর কুকুরের বিখ্যাত পরীক্ষায় প্রমাণ করেন।
সহজাত প্রতিক্রিয়া অভিজ্ঞতাপূর্ব। কোনো প্রাণীর পক্ষে একে শিক্ষা করার আবশ্যক হয় না। বাবুই পাখির বাচ্চা ভিন্নতর পরিবেশে লালিত হলেও সে তার জাতির অন্যান্য পাখির মতোই বাসা বানাতে পারবে। এই মত অনুযায়ী সহজাত এবং সচেতন ব্যবহার পরস্পর বিরোধী। কিন্তু অনেকে সহজাত এবং সচেতন প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগহীন বিরোধিতার কথা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে যা আজ সহজাত বলে মনে হচ্ছে সে আচরণ যুগ যুগ ব্যাপী সচেতন পূর্বশিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি হতে পারে। মানুষের হাঁটার ছন্দটি পরিণত বয়সে সহজাত বলে বোধ হতে পারে। কিন্তু শিশুকালে তাকে হাঁটতে শিখতে হয়েছে। সেই দীর্ঘ পরিচর্যার ফলে হাঁটার ছন্দ পরবর্তীকালে সহজাত বলে বোধ হয়।
Intellectualism : বুদ্ধিবাদ
জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধির ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি তার দেহ এবং বাস্তব পরিবেশ-বিচ্ছিন্ন কোনো স্বাধীন শক্তি নয়। বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তিক প্রত্যক্ষ সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক বা বুদ্ধিগত ক্ষমতার জন্ম হয়েছে এবং তার বিকাশ ঘটেছে। বুদ্ধির এই আপেক্ষিক বিচার এবং তার দ্বন্ধমূলক বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি সর্বযুগে সমান নয়। প্রাচীনকালে মানুষের অসহায় অবস্থায় বুদ্ধি এবং বাস্তব অবস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক সহজবোধ্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মানুষের বুদ্ধির যত বিকাশ ঘটেছে, তত অনেকের কাছে বুদ্ধি বাস্তব অবস্থা এমনকি মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা মস্তিষ্ক হতে বিচ্ছিন্ন এক বিদেহী এবং বিমূর্ত শক্তিরূপে প্রতিভাত হয়েছে। এই ধারণার ভিত্তিতে ভাববাদী জ্ঞানতত্ত্ব মানুষের জ্ঞানকে কেবলমাত্র বুদ্ধিসঞ্জাত বলে বিবেচনা করেছে। এবং বুদ্ধি যেহেতু একটি স্বাধীন শক্তি এবং ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই, এই অনুমানে ভাববাদ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে অসত্য বলে সিদ্ধান্ত করেছে। এইভাবে জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধিগত জ্ঞান সত্য এবং ইন্দ্রিয়গত জ্ঞান অসত্য, ভাববাদীগণ এরূপ অভিমত পোষণ করেছেন। ইন্দ্রিয়-বিচ্ছিন্ন এই বুদ্ধিবাদী তত্ত্বের সাক্ষাৎ আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে দেকার্ত, তার অনুসারী এবং স্পিনোজার মধ্যে পাওয়া যায়। জ্ঞানের এই তত্ত্ব র্যাশনালিজম বলে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে পরিচিত। একদিকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, অন্যদিকে মানুষের সমাজে ধনী এবং নির্ধনের আধুনিক শ্রেণীসংগ্রাম বুদ্ধি এবং বাস্তবের পারস্পরিক অন্তঃসম্পর্ককে সাধারণভাবে অনস্বীকার্য করে তুললেও, বর্তমানকালেও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে বুদ্ধিকে একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে অত্যধিক গুরুত্বদানের একটি প্রবণতা দেখা যায়। বুদ্ধিকে মানুষের সমাজ ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করার এই প্রবণতাকে বুদ্ধিবাদ বলা চলে।
Intelligence Quotient (I.Q.): বুদ্ধ্যঙ্ক
ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মানসিক ক্ষমতা বা বুদ্ধির পার্থক্য নির্ধারণ করার জন্য ঊনবিংশ শতক থেকেই ফেকনার, গালটন, হেলমজ প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা বা অভিক্রিয়ার চেষ্টা করতে শুরু করেন। গোড়ার দিকে মনোবিজ্ঞানীগণ কোনো উদ্দীপকের জবাবে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ার ব্যবধান-সময় পরিমাপের চেষ্টা করেন। এবং এই ব্যবহার-সময়ের তারতম্য দ্বারা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মানসিক ক্ষমতার পার্থক্য নিরূপণ করেন। চোখ, কান, স্পর্শ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা পরিমাপের জন্য বিভিন্ন যান্ত্রিক ক্রিয়া এরা ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে উচ্চতর বুদ্ধি বা মানসিক ক্ষমতাকেও পরিমাপ করার পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করা হয়। এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মনোবিজ্ঞানী এবিনহস(জ. ১৮৯৭) এবং বাইনেট ও সাইমন এর নাম(জ ১৯০৫)। বাইনেট এবং সাইমন বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহজ বুদ্ধির পরীক্ষা বা অভিক্রিয়া প্রস্তুত করেন। এর মারফত এঁরা বিভিন্ন বয়সের বুদ্ধির সূচক তৈরি করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি আটবছর বয়সের শিশুর পক্ষে যে সমস্ত প্রশ্নের জবাবদান সম্ভব কিংবা অধিকসংখ্যক আট বছরের শিশু যে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে পারে তাকে উক্ত বয়সের বুদ্ধির নির্দেশক বলে বাইনেট ও সাইমন স্থির করেন। এই ভিত্তিতে একটি ছয় বছরের শিশু যদি আট বছরের জন্য নির্দিষ্ট প্রশ্ন বা পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় তাহলে উক্ত ছ বছরের শিশুর বৃদ্ধি তার নিজের দৈহিক বয়সের চেয়ে অধিক এবং আট বছর বয়সের সমান। বাইনেট ও সাইমন মনে করতেন যে প্রত্যেক ব্যক্তিরই বুদ্ধির একটি কুশেন্ট অর্থাৎ সূচক বা বুদ্ধ্যঙ্ক আছে। যে কোনো শিশু বা ব্যক্তির বুদ্ধ্যঙ্ক নির্ণয় করার জন্য তাঁরা নিম্নোক্ত পদ্ধতির উল্লেখ করেন।
মানসিক বয়স x ১০০%
বুদ্ধ্যঙ্ক(আই. কিউ.)= দৈহিক বয়স
যেমন রহিমের বয়স যদি দশ বছর হয় এবং পরীক্ষার ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় যে রহিম ৮ বছরের শিশুর উপযুক্ত সমাধানে সক্ষম তা হলে তার বুদ্ধ্যঙ্ক হবে ৮০। এই মনোবিজ্ঞানীদের মতে বুদ্ধির গড় বুদ্ধ্যঙ্ক বা সূচক ১০০ ধরে উপরোক্ত পদ্ধতিতে কোনো শিশু বা ব্যক্তির বৃদ্ধি ১০০ এর কম কিংবা বেশি বলে নির্দিষ্ট হতে পারে।
Intelligentsia : বুদ্ধিজীবি
আমাদের দেশের সামাজিক রাজনীতির ইতিহাসের পটভূমিতে শিক্ষিত মহলে ‘বুদ্ধিজীবি’ কথাটি বেশ পরিমাণে ব্যবহৃত হয় তেমনি তার আবেগগত অর্থও বিদ্যমান। আবেগের দিক থেকে বুদ্ধিজীবি শব্দ দ্বার চিন্তাশীল, এমনকি বিবেকবান, প্রগতিশীল একটি মহলকে বুঝান হয়। কথাটির এরূপ প্রচলন বিশেষভাবে ঘটেছে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নানা মর্মান্তিক ঘটনা থেকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করে তাকে এবং পরবর্তীতে যুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং তাদের এদেশীয় অনুচরদের হাতে ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ও শহরের অগণিত চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক নির্মমভাবে নিহত হন। এরা শহীদ বুদ্ধিজীবি বলে শ্রদ্ধার সাথে স্মৃত হন এবং আমাদের অনুপ্রেরণা দান করেন।
কিন্তু ব্যুৎপত্তিগতভাবে ইংরেজী ‘ইনটেলিজেন্সিয়া’র বাংলা অনুবাদ হিসাবে ‘বুদ্ধিজীবি’র এমন অর্থ প্রধান অর্থ নয়। অন্যান্য দেশেও বুদ্ধিজীবি বলতে তেমন কোনো আবেগের সঞ্চার ঘটে না। ‘বুদ্ধি’ থেকে ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য দেশেও এ শব্দের কিছু বিশেষ অনুষঙ্গ দেখা যায়। বুদ্ধিবিহীন মানুষ নেই। আবার ‘জীবি’ দ্বারা যদি জীবিকা বুঝায়, তাহলে আমাদের দেশেও কেবল বুদ্ধি দ্বারা কেউ জীবিকা নির্বাহ করে না। জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশা এবং এই পেশাগত সম্প্রদায় বা শ্রেণী আছে। তথাপি এই শব্দটির একটি সাধারণ প্রচলন আছে এবং বিশেষ করে আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবি বলতে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতিকে বুঝানো হয়। আমাদের দেশের ইতিহাসের পটভূমিতে শব্দটি আবেগের দিক বাদ দিলে ‘বুদ্ধিজীবি’ কথাটি অনির্দিষ্ট কথা। ইন্টেলিজেন্টশিয়া বা বুদ্ধিজীবির আর একটি সহগামী শব্দ হচ্ছে ‘ইন্টেলেকচ্যুয়াল’ বা ‘বুদ্ধিবাদী’ শব্দ।
International, 1st, 2nd & 3rd : আন্তর্জাতিক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকের সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আন্তর্জাতিকতা। কার্লমার্কস (১৮১৮-৮৩) এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস(১৮২০-৯৫) সমাজবিকাশের দ্বন্ধমূলক বিশ্লেষণ দিয়ে দেখান যে, সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী যে ধনতান্ত্রিক যুগ বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার পরিণামে সমাজতান্ত্রিক যুগ এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদ্ভব ঘটবে। এটি সমাজ বিকাশের নিয়মের অনিবার্য পরিণাম হিসাবেই ঘটবে। তাঁরা বলেন যে, ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রধান দ্বন্ধ এর উৎপাদন-উপায় এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে, তথা উৎপাদন উপায়ের মুষ্টিমেয় মালিকের সঙ্গে উৎপাদনের প্রধানশক্তি অধিক সংখ্যক বঞ্চিত শ্রমিকের। কার্লমার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সমাজবিকাশকে কেবলমাত্র তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন নি। সমাজের বিকাশের ও পরিবর্তনের অনিবার্য আইন আছে সত্যি। কিন্তু সেই আইন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্যকর হবে এমন নয়। সে আইনের অপর সত্য হচ্ছে, মানুষ এই পরিবর্তনের সক্রিয় মাধ্যম হিসাবে কাজ করতে বাধ্য থাকে এবং সে এই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আর তাই কেবল বিশ্লেষণ নয়, বাস্তব কাজও প্রয়োজন। এই উপলব্ধি থেকে মার্কস এবং এঙ্গেলস ব্যক্তিগতভাবে কেবল যে অত্যন্ত আগ্রহ এবং ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে তাঁদের জীবনকালে বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে ধনবাদী ব্যবস্থার অগ্রগামী দেশসমূহের সামাজিক বিপ্লব এবং বিপ্লবী আন্দোলনসমূহকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাই নয়। প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা এই সমস্ত বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন।
নতুন যুগের প্রধান শক্তি শ্রমিক শ্রেণী। শ্রমিক শ্রেণীর সাংগঠনিক শক্তিই প্রধান বল। কেবল তাই নয়। এই নতুন যুগে কোনো দেশের সামাজিক বিপ্লব আর পূর্বের ন্যায় পরস্পরবিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এক দেশের মানুষ অপর দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আজ সংযুক্ত। তাই প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও আজ আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত। এ কারণে কোনো দেশের শ্রমিক শ্রেণী তার নিজের দেশে সামাজিক রূপান্তর ঘটাতে চাইলে তার নিজের শক্তিই যথেষ্ট নয়। তাকে সকল দেশের বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে আত্মিক এবং সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হতে হবে। এরূপ যু্ক্ত হওয়ার উপায় তৈরি করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত থেকে মার্কস এবং এঙ্গেলস ১৮৪৭ সালে কমিউনিস্ট লীগ নামে একটি সাম্যবাদী দলের প্রতিষ্ঠা করেন। কমিউনিষ্ট লীগকে এই চিন্তার কারণে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক প্রতিষ্ঠান বলা যায়। তখন ইউরোপের সকল দেশের শাসক শ্রেণীর নির্যাতন ও প্রতিরোধের আবহাওয়ায় কমিউনিষ্ট লীগকে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে তার সাংগঠনিক কাজ পরিচালনা করতে হয়। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে কমিউনিষ্ট লীগের যে অধিবেশন শুরু হয় তার সিদ্ধান্তরূপে মার্কস এবং এঙ্গেলস যৌথভাবে এই সংঘের ইশতেহার হিসাবে ঐতিহাসিক ‘ম্যানিফেসটো অব দ্য কমিউনিষ্ট পার্টি’ রচনা করেন। এই ইশতেহারে মার্কস এবং এঙ্গেলস সংক্ষিপ্তভাবে কিন্তু গভীর চিন্তামূলক বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে প্রাঞ্জল ভাষায় দ্বন্ধমূলক সমাজবিজ্ঞান এবং সাম্যবাদী আন্দোলনের তত্ত্ব ও কৌশলকে তুলে ধরেন। ইশতিহারের সর্বশেষ ছত্রে: ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও : শৃঙ্খল ব্যতীত তোমাদের হারাবার কিছু নেই’- আধুনিক বিশ্বের অন্যতম এই বিপ্লবী আওয়াজ উচ্চারিত হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের অধিকতর সংগঠিত রূপ প্রকাশিত হয় ‘প্রথম আন্তর্জাতিকে’র প্রতিষ্ঠায় ১৮৬৪ সনে। লন্ডনে আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী সম্মেলনে বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী প্রভৃতি দেশের শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিনিধিবর্গ যোগদান করেন। মার্কস এবং এঙ্গেলস এই সংগঠনেরও নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন। প্রথম সম্মেলনে মার্কস সংগঠনের উদ্বোধনী ভাষণ তৈরি করেন এবং তাঁর সেই ভাষণে শ্রমিক শ্রেণীর বিভিন্ন দেশের আন্দোলনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখান, দেশে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর সামনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী সাংগঠনিক দৃঢ়তা, ঐক্য এবং অভিজ্ঞতা ব্যতীত ক্ষমতা দখলের এই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে না। প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের যে সমস্ত প্রতিনিধি জমায়েত হয়েছিলেন তাদের সকলের সমাজের বিশ্লেষণ ও চিন্তা সর্বক্ষেত্রে েএক ছিল না। এমন অনেক পন্ডিত এবং আন্দোলনকারী ছিলেন (যেমন প্রুধো, বাকুনিন) যারা পাতিবুর্জোয়াকে শ্রমিকশ্রেণীর চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। এর ফলে মার্কসের সঙ্গে এ সমস্ত চিন্তাবিদদের মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। ১৮৭৬ সনে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রধান দপ্তর নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত করা হয়। সংগঠনের মধ্যে বাকুনিন এর নৈরাষ্ট্রিক চিন্তার বিরুদ্ধে মার্কস তার সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চালিয়ে যান। ১৮৮৩ সনে মার্কসের মৃত্যু হয়।
ইউরোপে ১৮৪০ এর দশকে বিভিন্ন দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল। সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই প্রথম আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা ঘটে। পরবর্তীকালে আন্দোলনে ভাটা আসে। ১৮৭৬ সনে প্রথম আন্তর্জাতিকের অবসান ঘটে।
১৮৭০ এর দশকে ইউরোপে আবার আন্দোলনের ঢেউ জাগে। পুঁজিবাদ ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে অধিকতর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শক্তি অর্জন করেছে। প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলি অর্থনৈতিক সংকট হতে মুক্তির জন্য নতুন বাজারের খোঁজে উপনিবেশিক অধিকার এবং দখলের জন্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজরূপ গ্রহণ করেছে। এই দশকের গোড়াতেই ফরাসি দেশ প্যারিস শহরের শ্রমিকদের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৮৭১ সালে ‘প্যারিকম্যুন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্যারিকম্যুন ইতিহাসে প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লবাত্মক প্রচেষ্টা। এ অভ্যুত্থান তখনকার অধিকতর শক্তিশালী বুর্জোয়া সরকার অপর সকল প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই দশকের আন্দোলনের জোয়ারে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, সুইডেন প্রভৃতি দেশে সংগঠিত হয়। এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দলকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালনা করার জন্য ১৮৮৯ সনে ১৪ই জুলাই ফরাসি বিপ্লব বার্ষিকী দিবসে প্যারিসে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের’ প্রতিষ্ঠা হয়। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যেই বিপ্লবের পর্যায় এবং পন্থা নিয়ে মতাদর্শগত লড়াই চলে। মার্কসের অনুসারী চিন্তাবিদ এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিসমূহ বিপ্লবকে মূল লক্ষ্য রেখে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য পার্লামেন্ট ও অন্যান্য সমস্ত সংগঠন ব্যবহারের কৌশল আয়ত্ত করাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তাছাড়া এই যুগে শ্রমিক শ্রেণী নিজ নিজ দেশের সরকারের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে নিজেদের স্বার্থবহ মনে করবে কি করবে না, এ নিয়েও মতামতের তফাত ঘটতে থাকে। মার্কসবাদীগণ ঘোষণা করেন, এই পর্যায়ে প্রত্যেক দেশের শ্রমিক শ্রেণীর একটি প্রধান কাজ হবে নিজ দেশের সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং যুদ্ধের সমালোচনা এবং প্রতিরোধ করা। কিন্তু কোনো কোনো দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং নেতা এ মত দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে অপারগ হয়। মতাদর্শের এই বিরোধ ১৯১৪ সালের প্রথম মহাযুদ্ধের কালে প্রকট হয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকাকে বিনষ্ট করে।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১৯ এ লেনিন(১৮১৭-১৯২৪) এর নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক ১৯৪৩ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে কার্যকর থাকে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের পরে মুক্তি আন্দোলন ও সমাজতন্ত্রের ঢউ এশিয়া এবং আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়ার চীনদেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাধিত হয় এবং ১৯২১ এ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশেও স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতা ও ব্যাপকতা লাভ করে। ভারতবর্ষের কলকারখানার যে প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল তাতে শ্রমিকশ্রেণীও একটি শক্তিশালী শ্রেণী হিসাবে বিকাশ লাভ করেছিল। ভারতে ১৯৩০ এর দশকে সাম্যবাদী দলের জন্ম হয়। ইউরোপে ইতালী এবং জার্মানীতে কমউনিষ্ট পার্টি বিশেষ শক্তি অর্জন করে। ১৯২০ ও ৩০ এর দশকে ইউরোপে শ্রমিক শ্রেণীর শক্তি বৃদ্ধিতে ও তাদের সংগঠনের আদর্শগত ও সাংগঠনিক জঙ্গীত্বে শাসক শ্রেণী সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। তার শ্রমিকশ্রেণী ও তার সংগঠনকে নির্যাতনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এর প্রকাশ হিসাবে ইতালী এবং জার্মানীতে ফ্যাসিবাদী শক্তির উদ্ভব এবং ফ্যাসি ও নাজীবাদী দল কর্তৃক ইতালী ও জার্মানীতে যথাক্রমে ১৯২৯ ও ১৯৩৩ এ এবং পরবর্তীতে স্পেনে ক্ষমতা দখল করে। পরিণামে ১৯৩৯ এ ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের ক্রমগতিতে ফ্যাসীবাদী ইতালী, জার্মানী ও জাপানের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গণতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রসমূহের একটি বৃহৎ জোট তৈরি হয়। এই জোটের ধনতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী সংস্থা কমিনটার্ন বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অস্তিত্বকে মিত্রজোটের জন্য অবাঞ্চিত বলে গণ্য করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব রক্ষার এই সংকটকালের কথা বিবেচনা করে এবং বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আন্দোলন ও তার নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান আদর্শ ও অভিজ্ঞতায় অতীতের চেয়ে অধিক পরিমাণে শক্তিশালী হওয়াতে কোনো আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের নেতৃত্বদান আর তত প্রয়োজনীয় নয় বিবেচনা করে সোভিয়েত কমউনিষ্ট পার্টির উদ্যোগে ১৯৪৩ এ তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরো ব্যাপক ও শক্তিশালী হয়েছে। এখন বিভিন্ন দেশের আন্দোলন ও সংগঠনের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্মেলন, আলোচনা ও মতামতের আদান-প্রদান অতীতের চেয়ে অধিক। কিন্তু এখন আর আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত কোনো ‘আন্তর্জাতিকের’ অস্তিত্ব নেই।
Internationalism : আন্তর্জাতিকতাবাদ
ইন্টারন্যাশনালিজম বা আন্তর্জাতিকতাবাদ এর একটি সাধারণ অর্থ বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার নীতি। কিন্তু শব্দটির বিকাশ ঘটেছে আধুনিককালে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরোধী চিন্তা হিসাবে। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রবণতা হচ্ছে নিজের জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রধান বলে গণ্য করা এবং অপর জাতি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থসমূহকে উপেক্ষা করা। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মারাত্মক প্রকাশ দেখা যায় এই শতকের বিশ এবং ত্রিশ শতকে ইতালী এবং জার্মানীতে। ইতালির ফ্যাসিস্ট দল এবং জার্মানীর নাৎসী দল তাদের দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে নিজেদের জাতি এবং রাষ্ট্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে এবং অপর জাতি এবং রাষ্ট্রকে অধম এবং পদানত হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করে। এই নীতিতে তারা জঙ্গীভাবে সংঘটিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী দুর্বল রাষ্ট্রসমূহকে নানা অজুহাতে গ্রাস করতে শুরু করে। এই নীতির পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং জার্মানী এবং ইতালি ও তাদের মিত্র জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের এই অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ায় জাতিতে জাতিতে সমতাবোধ এবং শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। অনেক চিন্তাবিদ জাতীয়তাবাদ তথা জাতীয় রাষ্ট্রের অবাঞ্চনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং একটি বিশ্বরাষ্ট্রের কল্পনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতা ওয়েনডেল উইলকী(১৮৯২-১৯৪৪) এর ‘ওয়ান ওয়ার্লড’ বা ‘এক পৃথিবী’ গ্রন্থখানির কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
আন্তর্জাতিকতাবাদ অধিকতর সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ অর্থে আধুনিককালের সকল দেশের সাম্যবাদী আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়। সাম্যবাদী বা কমউনিস্ট দলসমূহ আন্তর্জাতিকতাবাদকে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন তথা শ্রেণীহীন সমাজ তৈরির সংগ্রামে আদর্শগত হাতিয়ার বলে গণ্য করে। সাম্যবাদী আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যেক রাষ্ট্রে যেমন সবচেয়ে শোষিত শ্রেণী, তেমনি ধনিক শ্রেণীর পাল্টা শক্তি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। কোনো দেশের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন কেবলমাত্র কোনো বিশেষ দেশের শ্রমিকদের উপর শোষণ বিলোপের আন্দোলন নয়। এককভাবে কোনো দেশের শ্রমিক চূড়ান্তভাবে শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কেবলমাত্র কোনো বিশেষ দেশের শোষণকারী শ্রেণী নয়। সকল দেশের ধনিকগণই তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় পরস্পরযুক্ত। ধনিকশ্রেণী আন্তর্জাতিক শ্রেণী, তারা আন্তর্জাতিকভাবে সংঘবদ্ধ। শোষিত শ্রমিকশ্রেণীও আন্তর্জাতিক শ্রেণী। দেশ নির্বিশেষে তাদের মৌলিক স্বার্থ অভিন্ন। এ কারণে আন্তর্জাতিক ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এক দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে অপর দেশের শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতার এই হচ্ছে মৌলভাব। এই আদর্শের ক্ষেত্রে তাই কোনো বিশেষ দেশ বা জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা আসতে পারে না। ছোট বড় সকল জাতি ও রাষ্ট্রের শোষিত মানুষই হচ্ছে সমান এবং তাদের মূল লক্ষ্য এবং স্বার্থ এক। এই নীতির প্রকাশ করে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের রচিত ‘কমউনিস্ট ম্যানিফেসটো’তো বিশ্বের সকল দেশের সর্বহারাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন: ‘ওয়ার্কারস অব অল কান্ট্রিজ, ইউনাইট :‘সকল দেশের সর্বহারাগণ এক হও’। এই আন্তর্জাতিকতা বোধকে প্রকাশ করে সাম্যবাদী দলসমূহ একটি আন্তর্জাতিক সঙ্গীতও রচনা করেছে। ইউরোপে সংঘটিত শ্রমিক এবং সাম্যবাদী দলসমূহ নিজেদের সমন্বয়ে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা’ ও স্থাপন করেছিলেন। এই সংগঠন ওয়ার্কার্স ইন্টারন্যাশনাল বা শ্রমিক আন্তর্জাতিক নামে পরিচিত ছিল।
Introspection : আত্মনিরীক্ষণ
ব্যক্তি তার মনের কোনো অবস্থা যখন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে তখন এই পর্যবেক্ষণকে আত্মনিরীক্ষণ বলা হয়। নিজের মনের অবস্থা ব্যক্তির নিজের পক্ষে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা মানুষের মনের উন্নততর বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। আত্মনিরীক্ষণের ফল ব্যক্তির বর্ণনার মাধ্যমেই মাত্র অপরে জানতে পারে। তার সে বিবরণ যথার্থ কিনা তা প্রমাণ বা পরীক্ষার উপায় থাকে না। তথাপি মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগগত দিক বিকশিত হওয়ার পূর্বে বিংশ শতকের প্রায় তিন দশক পর্যন্ত আত্মনিরীক্ষণকেই মনোবিজ্ঞানীগণ মনের সব রকম প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের একমাত্র উপায় বলে মনে করতেন। কারণ তাঁদের ধারণা ছিল, মনোবিজ্ঞান হচ্ছে মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিজ্ঞান। মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যার মন সে ব্যতীত অপরে কেমন করে জানবে? যার দাঁতে ব্যথা একমাত্র সেই বলতে পারবে ব্যথা কিরূপ। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে পুত্রের মনে কি ভাবে উদ্ভব হয়েছে তা পুত্রই মাত্র বলতে পারবে। আর এর উপায় হচ্ছে ব্যক্তির মনের চোখকে মনের ঘটনার উপর নিক্ষেপ করে তা নিরীক্ষণ করে তার বিবরণ অপরকে জানানো। একথা সহজেই বুঝা যায় যে, আত্মনিরীক্ষণের এই উপায় একান্ত ব্যক্তিগত। তা ছাড়া ব্যক্তির মনে যখন কোনো আবেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় সেই মুহুর্তে উত্তেজিত ব্যক্তির পক্ষে নিরপেক্ষ এবং অনুত্তেজিত ভাব নিয়ে নিজের উত্তেজিত মনকে নিরীক্ষণ করা কতখানি সম্ভব, এটা একটা বড় প্রশ্ন হিসাবে দেখা দেয়। মনের কোনো ক্রিয়ার উপর মন দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে সেই ক্রিয়ার তীব্রতা হ্রাস পায়। আবার ঘটনার পর ব্যক্তি তাকে স্মরণ করার চেষ্টা করলে সে স্মৃতিও যথাযথ নাও হতে পারে। আত্মনিরীক্ষণের এসকল অসুবিধার কারণে মনোবিজ্ঞানীগণ পরবর্তীকালে নতুন পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে আত্মনিরীক্ষণবাদী মনোবিজ্ঞানের স্থলে আচরণবাদী ও প্রয়োগবাদী মনোবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে আত্মনিরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের প্রধান পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয় না। দেহের সঙ্গে মনের সম্পর্কের ভিত্তিতে দেহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং পৌণঃপুনিক পরীক্ষাযোগ্য বিভিন্ন পরীক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে।