Aggression: অন্যায় আক্রমণ, আগ্রাসন
একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর বিনা কারণে সশস্ত্র আঘাত হানলে তাকে আক্রমণ বা আগ্রসন বলা হয়। অন্যায় আক্রমণ কথাটির অর্থ সহজ হলেও যুদ্ধমান পক্ষের কেউই আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করতে চায় না। পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণকারী বলে অভিযুক্ত করে। একমাত্র নিরপেক্ষ কারুর পক্ষে বলা সম্ভব যে, এমন ক্ষেত্রে আক্রমণকারী কে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে তখন আর কেউ নিরপেক্ষ থাকে না। কেবল বিশ্বযুদ্ধ নয়। আধুনিক আন্তর্জাতিক জটিল রাজনীতিতেও নিরপেক্ষ কোনো রাষ্ট্র আছে, একথা বলা কঠিন। কোনো অবস্থায় কোনো কার্য আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে এর কোনো সংজ্ঞা জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রেও গৃহীত হয় নি। ১৯৩৩ সালে আক্রমণের সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য আফগানিস্তান, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ইরান. পোলাণ্ড, রুমানিয়া, তুরস্ক এবং রাশিয়া এই আটটি দেশের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে (ক) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (খ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যাতিরেকে আক্রমণ (গ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতীত অপর রাষ্ট্রের ভূখণ্ড, নৌযান বা বিমানের উপর সশস্ত্র আক্রমণ (ঘ) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নৌঅবরোধ সৃষ্টি এবং (ঙ) প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের বিদ্রোহত্মক কোনো সশস্ত্র বাহিনীকে আশ্রয় দান কিংবা তাকে সশস্ত্রভাবে সজ্জিত করতে সাহায্য করা এবং প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের দাবি সত্ত্বেও এরূপ বাহিনীকে বহিষ্কার করে দিতে অস্বীকার করাকে একের বিরুদ্ধে অপরের আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে।
Ajivika: আজীবিক
শব্দগত অর্থ আজীব আ +জীব+অ জীবনসাধন, জীবনোপায় জীবিকা। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম এবং ষষ্ঠ শতাব্দিতে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের প্রচারের সমকালে ‘আজীবিক’ নামক একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘গোশাল’ বলে এক ব্যক্তি। গোশালে জন্ম বলেই তাঁর নাম গোশাল হয়েছিল এরূপ অনেকে মনে করেন। জীবন, ধর্ম, দেহ, আত্মা, বিশ্ব ইত্যাদি সমস্যা সম্পর্কে আজীবিক সম্প্রদায়ের অভিমত আজীবিকবাদ বলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের ইতিহাসে আখ্যাত হয়েছে।
প্রাচীণ ভারতীয় দর্শনে আজীবিকদের তত্ত্বের একটি গুরুত্ব আছে। এঁরা জীরন ও জগতের ব্যাখ্যায় আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। এঁদেরকে অনুবাদী বলেও আখ্যঅয়িত করা হয়। আজীবিকদের মতে, বস্তু জগতের মূলে রয়েছে চারটি মৌলিক অণু, যথা- মৃত্তিকা, পানি, অগ্নি এবং বায়ু। জগতের যা কিছু সৃষ্টি তার এই চারটি মূল অণুর সম্মেলনেই গঠিত হয়। জীবন নিজে অণু নয়। জীবন এমন একটি শক্তি যার অণুর সম্মেলনকে অনুধাবন করতে সক্ষম। সৃষ্টির মৌলিক পদার্থ অণু শাশ্বত। অণুর বিভাজন নেই। অণু সৃষ্টির মূলে। কিন্তু নিজে সৃষ্ট নয়। অণুর ধ্বংসও সম্ভব নয়। মৌলিক অণুগুলি গতি নয়। এক অণু অন্য অণুতে রূপান্তরিত হতে পারে না। কিন্তু যে কোনো অণু যে কোনো অভিমুখে গতিশীল হতে পারে। বস্তুর যে গুণ তা একটি বিশেষ বস্তুর অণুর সংখ্যা এবং সম্মেলন প্রকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হয়। জীবন ও জগতের এই বিশ্লষেণ তেকে বুঝা যায়, আজীবিকগণ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী মত পোষণ করতেন। সম্ভবত ইতিহাসে এঁরাই প্রথম অনুবাদী। আজীবিকদের অনুবাদী মতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস (খ্রি. পূ. ৪৬০-৩৭০) এবং এপিক্যুরাস (খ্রি. পূ. ৩৪১-২৭০) এর অনুবাদী তত্ত্বের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আজীবিকদের প্রতিষ্ঠাতা গোশাল সম্পর্কে এরূপ কথিত আছে যে, তিনি জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গোশাল জৈনধর্মের জন্মের প্রকারভেদ অস্বীকার করেন। তাঁর মতে জীবন মাত্রই, নিয়তির বন্ধনে আবদ্ধ। জন্মের কোনো প্রকারভেদ বা জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে, এ কথা গোশাল মানতেন না। গোশালের মতে জন্মান্তরের দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব কোনো সড়কেই জীবনের দুঃখ বা কর্মের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তির উপায় নেই। মানুষের জীবনের পথ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। কোনো সাধনা বা আচরণই জীবনের সেই নির্ধারিত পথকে পরিবর্তিত করতে পারে না।
গোশাল এবং আজীবিকগণ জীবনোপায় বা জীবনাচরণে সাধারণের ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁরা দিগম্বর থাকতেন এবং একটি দণ্ড হাতে চলতেন। এজন্য এঁদের ‘দণ্ডী’ও বলা হতো। এঁরা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু ভিক্ষা করেও প্রয়োজনের অধিক জমাতেন না।
সম্রাট অশোকের শাসনকাল ছিল খ্রি. পূ. ২৭৪-২৩২ সন। সম্রাট অশোকের নানা অনুশাসন প্রস্তর খণ্ডে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এরূপ একটি প্রস্তরলিপিতে আজীবিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ দেখা যায়। এই লিপিতে বলা হয়েছে যে, সম্রাটের এরূপ কর্মচারী বা মহামাত্রও নিযুক্ত রয়েছে যাদের দ্বায়িত্ব হচ্ছে আজীবিকদের বিষয়ে তত্ত্বাবধান করা।
Al-Farabi: আল – ফারাবী (৮৭৩-৯৫০ খ্রি.)
আল –ফারাবীর সম্পুর্ণ নাম হচ্ছে আবু নসর মুহাম্মদ আল -ফারাবী। দর্শনের ইতিহাসে ইনি আল –ফারাবী নামেই সুবিখ্যাত। ইসলামি দর্শনে আল –ফারাবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনি বলে মনে করা হয়। মুসলিম দার্শনিকগন মনে করতেন, আল –ফারাবীর শ্রেষ্ঠ যদি কেউ থাকেন তিনি হচ্ছেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। মুসলিম দার্শনিক আলকিন্দী আল -ফারাবীকে নিঃসন্দেহে ইবনে সীনা এবং ইবনে রুশদ-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করেছেন।
ক্রিষ্টাব্দের নবম এবং দশম শতকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষ করে বাগদাদে গ্রিক দর্শনের বিশেষ চর্চা হতো। এই সময়ে গ্রিসের প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের রচনাবলীর আরবি অনুবাদ হতে থাকে। আল –ফারাবী প্রধানত শিক্ষালাভ করেন বাগদাদের এ্যারিস্টটল-এর দর্শন শিক্ষাদানকারী খ্রিষ্টান বিদ্যাকেন্দ্রে। প্লেটোর দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যাদাতা প্লাটিনাস-এর ব্যাখ্যার প্রভাবও আল –ফারাবীকে এত প্রভাবিত করেছিল যে, উপরোক্ত দর্শনের এই দুই স্তম্ভ আল –ফারাবী কাউকে বর্জন করতে পারেন নি। এ কারণে আল –ফারাবী প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের সামঞ্জস্যের বিষয়ে একখানি পুস্তক রচনা করেন। আল –ফারাবী শিক্ষাগত জীবনে কেবল দর্শনের চর্চা করেন নি। তিনি সে-যুগের জ্ঞানের অন্যান্য শাখাও আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সঙ্গীতের বিচিত্র শাখাতে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
আল –ফারাবী প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এবং ‘লজ’ বা ‘বিধান’-এর উপর নিজের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। আল –ফারাবীর সমধিক বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘উত্তম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের ভ্রান্তি সম্পর্কিত গ্রন্থ’। এ গ্রন্থ আদর্শ নগর বা ‘মদিনাল ফাজিলা’ বলেও আখ্যাত। গ্রন্থের নামকরণ এবং বিষয়বস্তু থেকে বুঝা যায়, প্লেটো যেমন ‘রিপাবলিক’ বা আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, আল -ফারাবীও তেমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। আল -ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্র প্লেটোর রাষ্ট্রের ন্যায় সাধারণ মানুষের অসাধ্য বোধ হতো না। প্রকৃত পক্ষে আল –ফারাবী যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে কার্যকর দেখেছে, তাদের উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন। আল –ফারাবী কোনো চরম মত পোষণ করেন নি। চিন্তার ক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি পরস্পর-বিরোধী ধারাকে এক সাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন। এই আপসের প্রমাণ যেমন প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে, তেমনি বিশ্বের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ব্যাখ্যাতেও রয়েছে। আল –ফারাবী একদিকে মনে করেছেন যে, আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা; আর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর প্রকাশ। অপর দিকে আল্লাহকে স্রষ্টা স্বীকার করেও সৃষ্টি বা বিশ্বকে শাশ্বত বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। বিশ্বকে শাশ্বত মনে করার মধ্যে বস্তুজগৎ এবং বিজ্ঞানকে স্বীকারের প্রবণতা আল –ফারাবীর চরিত্রে দেখা যায়। এদিক থেকে সে-যুগে তিনি প্রগতিশীল চিন্তাবিদের স্বাক্ষর রেখেছেন, একথা বলা যায়। ধর্মের ন্যায় তাঁর রাষ্ট্র-ব্যবস্থাতেও একনায়কত্বের প্রকাশ ছিল। আল –ফারাবীর মতে রাষ্ট্রের রইস বা প্রধান থাকবে সবার উপরে। অপর সকলে তার বাধ্য হবে। সে নিজে কারু বাধ্য হবে না। নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্র স্তরভেদ থাকবে। এক স্তর তার উপরের স্তরের আদেশ মান্য করবে। এবং অধঃস্তরের উপর আদেশ জারি করবে। অধঃতম স্তরের নাগরিক কেবল হুকুম মান্যই করবে অপর কাউকে সে হুকুম দিবে না। কারণ হুকুম দেবার মতো তার নিচে অধঃতর কোনো স্তর থাকবে না। মুসলিম সভ্যতার অর্থনীতিক বিকাশের তৎকালীন যুগে একনায়কতন্ত্রের এই ধারণা গোত্রতান্ত্রিক বহুধাবিভক্ত সামন্তবাদী সমাজকে এককেন্দ্রিক বৃহত্তর রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে সংহত করার অনুকূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। যুগের প্রেক্ষিতে এরূপ ভাবধারার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। চরম সত্য বা স্রষ্টার ব্যাখ্যায় আল –ফারাবী যেমন প্লেটোর ভাবধারাকে গ্রহণ করেছেন, মনোজগতের বিশ্লেষণে তেমনি তিনি এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যাকেই অধিকতর স্বীকার করেছেন।
আল –ফারাবীর রচনাসমূহ জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।
Alberuni: আলবেরুণী (৯৭৩-১০৫০ খ্রি.)
পৃথিবীরঅন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং জ্ঞানসাধক। জন্ম মদ্য এশিয়ার (রাশিয়ার) খোরেজাম বা খারিজমের খিবায় ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১০৪৮ কিংবা ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
‘আলবেরুণী’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। আসল নাম আবু রায়হান মুহম্মদ বনি আহমদ । তাঁর সমসাময়িকদের মধ্য ছিলেন বোখারার বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে সিনা (৮৯০-১০৩৭ খ্রি.)। জন্মসূত্রে আলবেরুণী পারসিক এবং শিয়া ছিলেন। ‘তাঁর সমালোচনার ক্ষমতা, সহনশীলতা, সত্যানুরাগ এবং মানসিক সাহস মধ্যযুগে অতুলনীয় ছিল। তিনি আরবি ভাষায় ভূগোল, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।’ গবেষকগণ তাঁর রচনার সংখ্যাকে বিপুল বলে অনুমান করেন। “১০৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এক বন্ধুর জিজ্ঞাসার জবাবে লেখা আল-বেরুণীর একটি চিঠির নকল পাওয়া গেছে যাতে তিনি তখন পর্যন্ত তাঁর লিখিত পুস্তক-পুস্তিকার একটি ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। তালিকা মতে ১৩৮ টি পুস্তকের নাম আছে। এ তালিকা তৈরির পরেও তিনি প্রায় সতের বৎসর জীবিত ছিলেন। পরবর্তী সতের বৎসর ধরে তিনি আরো যেসব বই লিখেছিলেন তা ধরলে এবং অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থপঞ্জিতে যেসব বই-এর নাম পাওয়া যায় সেসব মিলিয়ে বর্তমান পণ্ডিতরা আলবেরুণীর রচিত ১৮০ টি পুস্তকের নাম পেয়েছেন। আলবেরুণীর গ্রন্থাবলী ১২ শতক থেকে ইউরোপে যতটা আদৃত হয়েছে, প্রাচ্যে ততটা হয় নি।”
বাংলাদেশে সাহিত্যিক সত্যেন সনে আলবেরুণীর ভারত আগমন এবং তাঁর জ্ঞান সাধনাকে ভিত্তি করে ‘আলবেরুণী’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন (১৯৬৯)। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের অতুলনীয় উপাদান হিসাবে আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পৃথিবীতে আজ সুপরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ঐতিহাসিক আবু মহামেদ হবিল্লাহ আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থটি মূল আরবি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছেন (১৯৭৪)।
আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থের মূল আরবি নাম ‘কিতাব কি তাহকিক মালিল হিন্দ মাকুলাত মাকবুলাত কি আল আকল উমর যুলাত।’ বাংলঅ গদ্যে এর মানে : বুদ্ধি বিচারে যা গ্রহনযোগ্য আর যা গ্রহনযোগ্য নয়, হিন্দুদের সব রকম চিন্তা পদ্ধতির সঠিক বর্ণনা।
Book on an accurate description of all catagories of Hindu thought, those which are admissible to reason as well as those which are not. এডওয়ার্ড জাকাউ (Edward Zachau) কর্তৃক সম্পাদিত মূল আরবি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে লণ্ডন থেকে। Alberuni’s India- এই নামে দুখণ্ডে এর ইংরেজি অনুবাদ এডওয়ার্ড জাকাউ প্রকাশ করেন ১৮৮৮। কিতাবুল হিন্দ নামেও আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পরিচিত।
গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে তার উত্তর পশ্চিম দখল করছিলেন (১০২২ খ্রি.)। সুলতান মাহমুদ মধ্য এশিয়ার ক্ষূদ্র খারিজাম রাষ্ট্রও জয় করেছিলন। খারিজাম জয় করে সেখানকার গণ্যমান্য নাগরিক এবং জ্ঞানীদের তিনি তাঁর রাজ্য গজনীতে বন্দি করে এনেছিলেন (১০১৭ খ্রি.)। এই বন্দিদের মধ্যে খারিজামের আলবেরুণী ছিলেন। পরবর্তীকালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক হয়তো আলবেরুণীই ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন। জ্ঞানসাধক আলবেরুণী তাঁর এই ভারত গমনকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সাক্ষাৎভাবে অধ্যয়নের বিরাট সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজের তথ্যাবলী গভীর অভিনিবেশ এবং আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করেছিলেন। এই সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আলবেরুণী ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনা সমাপ্ত করেন ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গজনী প্রত্যাবর্তন এবং সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পাঁচমাস পরে।
কিতাবুল হিন্দ্ বা ভারততত্ত্বে আলবেরুণী জটিল এবং বিচিত্র তত্ত্ব এবং তথ্য যেরূপ বিস্তারিতভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থিত করেছেন তা এক বিষ্ময়কর শক্তির ষ্মারক হিসাবে জ্ঞানের ইতিহাসে বিরাজ করছে। ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনার পূর্বে আলবেরুণী কপিলের সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শনসহ পৌলিশ সিদ্ধান্ত, ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত, বৃহৎসংহিতা, খণ্ডখাদ্যক, বরাহমিহিরের লঘুজাত কর্ম প্রভৃতি ছোটবড় ২২ টি ভারতীয় পুস্তক আরবিতে তর্জমা করেছিলেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থের আরবি অনুবাদ থেকে বুঝা যায়, তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তা ছাড়া ফার্সি, গ্রিক, হিব্রু এবং আরামিয় ভাষাতেও তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। আলবেরুণীর মাতৃভাষা ছিল খোরেজামী বা প্রাচীন ইরানি ভাষার একটি আঞ্চলিক শাখা। কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থ আরবি ভাষাতেই রচিত। কারণ তাঁর মাতৃভাষাকে তিনি বৈজ্ঞানিক ভাব প্রকাশের উপযোগী মনে করেন নি।
অধ্যাপক মহামেদ হবিবুল্লাহ বাংলা অনুবাদে দেখা যায় আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ প্রস্তাবনা ব্যতীত আশিটি অধ্যায়ে বিভক্ত। আলোচিত বিষয়ের আভাসদানের জন্যে কিছুসংখ্যক অধ্যায়ের শিরোনাম এখানে উল্লেখ করা গেল: ভারতীয়দের সাধারণ বৈশিষ্ট্য; ঈশ্বর সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস; ভাব এবং ইন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে হিন্দুদের ধারণা; কার্যকরণ- আত্মার সঙ্গে জড় পদার্থের সম্বন্ধ;সৃষ্ট জীবসমূহের শ্রেণীবিভাগ ও তাদের নাম; মূর্তি পূজার সূচনা ও বিগ্রহসমূহের বর্ণনা; হিন্দুদের ব্যকরণ ও ছন্দশাস্ত্র; ভারতীয় পরিমাণ বিজ্ঞান; ভারতীয়দের বর্ণমালা, বর্ণচিহ্ন ও অদ্ভুত রীতি; ভারতবর্ষের নদ-নদী; সমুদ্র নাগরাদির পারস্পারিক দূরুত্ব ও সীমানার সংক্ষিপ্ত বিবরণ; গ্রহ নক্ষত্রাদির নাম, চন্দ্রের কক্ষপথ ও অনুরূপ বিষয়; মেরু পর্বতের কথা; সমুদ্রে জোয়ার ভাটার পারস্পর; সূর্য-চন্দ্রের গ্রহণ; আদালতের মামলা মোকদ্দমা।
মোটকথা, এ এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এ গ্রন্থ দশম-একাদশ শতকের ভারতীয় জ্ঞান, সমাজ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের একটি পূর্ণ জ্ঞান কোষবিশেষ।
আলবেরুণী রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের কাল নিরুপণের পদ্ধতি বিষয়ক ‘আসারূল বাকিয়া’; গণিতশাস্ত্র ও জ্যামিতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাব কানুন আল মাসুদী কি হাইওআল নজুম’; ধাতুবিদ্যা বিষয়ক ‘কিতাবুল জামাহীর ফি মারেফাতুল জওয়াহীর’; চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক ‘কিতাব আল সায়দানা ফিল তিব্ব্’; এবং ভৌগলিক তথ্যমূলক গ্রন্থ ‘তাহদীদ ফি নেহায়াতুল আমাকিন’।
তাঁর রচনায় বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা আলবেরুনীর নিজের প্রস্তুত একটি তালিকার ভিত্তিতে নিন্মরূপ : জ্যোতিষ পদ্ধতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৮; বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক তথ্য, আয়তন , দূরত্ব নির্ণয় ইত্যাদি-১৫; গণিত পদ্ধতি-৮; সূর্যকিরণ ও ছায়ায় বৈজ্ঞানিক তথ্য-৪; জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি নির্মাণ বিষয়ে-৫; কাল ও সময় নির্ণয়-৫; জ্যোতিশাস্ত্রে শুভাশুভ ফলাফল নির্ণয়-১২; জ্যোতিষ গণনাবিধি-৭; উপন্যাস, কাব্য ও অতিপ্রাকৃত কিংবদন্তি বিষয়ক-১৩; ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ বিষয়ে -৬।
(দ্রষ্টব্য: আলবেরুণীর ভারততত্ব: আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ; আলবেরুণী: সত্যেন সেন।)
Al-Ghazali: আল –গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ খ্রি.)
আল গাজ্জালীর সম্পূর্ণ নাম ছিল আবু হামিদ মুহম্মদ আল –গাজ্জালী। খোরাসান বা ইরানের তুশের গাজলা গ্রামে জন্ম বলেই তিনি আল গাজ্জালী নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে আল –গাজ্জালী ইসলামের সর্বশ্রেষ্ট ব্যাখ্যাতা এবং রক্ষক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। আল –গাজ্জালীর দার্শনিক চিন্তাধারার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামকে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে পরলোক, দোজখ ইত্যাদি কল্পলোক সম্পর্কে মানুষের মনে ভয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল। মুসলিম মুক্তবুদ্ধি মোতাজিলাদের দার্শনিক আলোচনা ও মতামতও মানুষের মনে বিশ্বাসের বদলে যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। অবস্থার এই বিকাশে আল –গাজ্জালী চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। মোতাজিলাবাদীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অধিকতর জোরালো যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির পরাক্রমকে পরাস্ত করতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে আল –গাজ্জালী দর্শন চর্চা করেন। তারঁ এই লক্ষ্য অর্জনের চিন্তায় তিনি এত ব্যকুল হরেয় পড়েন যে, ৩৬ বছর বয়সে তিনি বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপনার পদ ত্যাগ করে সুফীজীবন যাপন করতে শুরু করেন। সুফী হয়ে তিনি মুসলিম জগতের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতার শেষে তিনি যুক্তির পথ সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত করে ঘোষণা করেন যে, যুক্তির মাধ্যমে সত্যকার জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব-স্রষ্টার সন্ধান এবং বিশ্ব-রহস্য উদঘাটন কেবল অহি বা আত্মোপলব্ধির মাধ্যমেই সম্ভব। এই সিদ্ধান্তে এসে তিনি ‘তাহফাতুল ফালাসিকা’ বা ‘দর্শনের ধ্বংস’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। এই পুস্তকে তিনি শাশ্বত চরিত্র, বুদ্ধির শক্তি প্রভৃতি তত্ত্বের যাথার্থ্য সম্পর্কে মুসলিম দার্শনিকদের উপস্থাপিত প্রমাণের অসারতা প্রতিপন্নের চেষ্টা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, চরম সত্যের জ্ঞান প্রমাণ-ভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব নয়। আল –গাজ্জালী ঘটনার ক্ষেত্রে কার্যকরণ সম্বন্ধকেও অস্বীকার করেন। কোনো ঘটনাই অপর কোনো ঘটনার কারণ বা ফল নয়। দু’টি ঘটনার মধ্যে সমকালীনতা বা কালক্রম থাকতে পারে। অগ্নির সংঘটনের পরবর্তীকালেই কোনো দাহ্যবস্তুর দহনকে আমরা দেখতে পারি। কিন্তু তাতে এমন প্রমাণিত হয় না যে, আগুন দাহ্যবস্তুর দহনের কারণ হিসাবে কাজ করেছে। মুসলিম চিন্তার ক্ষেত্রে আসারীয় এবং মোতাজিলা নামে গোঁড়ামি এবং মুক্তবুদ্ধির যে দু’টি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় আল –গাজ্জালী তার মধ্যে আসারীয় গোঁড়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। বস্তুত যুক্তি এবং বুদ্ধিবাদের এরূপ শক্তিমান প্রতিপক্ষের সাক্ষাৎ খুব কমই মেলে। তাঁর চিন্তাধারা সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে প্রভূত পরিণামে সাহায্য করেছে বলেই ইতিহাসের বিশ্লেষণকারীগণ মনে করেন। এ জন্য আল –গাজ্জালীকে দার্শনিকের চেয়ে ধর্ম-রক্ষক হিসাবে অধিক মর্যাদা দেওয়া হয়। তৎকালীন ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের অস্থিরতা এবং জটিলতাই আল –গাজ্জালীর অভিমতকে আবশ্যকীয় করেছিল। ইউরোপেও পরবর্তীকালে জ্ঞান-বিরোধী সে সন্দেহবাদ এবং অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব দেখা যায় আল –গাজ্জালীর মাধ্যে তার পূর্বাভাস সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে। বস্তুত আল -গাজ্জালীর দর্শনবিরোধী ভূমিকাই পাশ্চাত্যের সংশয়বাদী এবং অজ্ঞেয়বাদীদের চমৎকৃত করে। সাম্প্রদায়িক বিরোধের ক্ষেত্রেও আল –গাজ্জালী নিরপেক্ষ ছিলেন। আব্বাসীয় খলীফা আল –মোসতাজিরের আদেশে আল –গাজ্জালী শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। ইবনে রুশদ আল –গাজ্জালীর ‘দর্শনের ধ্বংস’ গ্রন্থের পাল্টা জবাব হিসাব ‘দর্শনের ধ্বংসের ধ্বংস’ নাম এককখানা গ্রন্থ লিখেছিলেন।
Aligrah Movement: আলীগড় আন্দোলন
১৮৫৭ সনের সিপাহি বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তীতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উচ্চবিত্ত এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার একটি ধারা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত লাভ করে। উত্তর ভারতের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ইংরেজি শিক্ষিত, ব্রিটিশ শাসনের কর্মচারী স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮) এই ধারার উদ্যোগী ব্যক্তি। সিপাহবিদ্রোহে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে ভারতবাসী, বিশেষ করে তার মুসলিম সম্প্রদায়ের যে বিদ্রোহাত্মক এবং অসহযোগী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল স্যার সৈয়দ আহমদ তাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করেন। তিনি মনে করেন মুসলমান সম্প্রদায়ের তথা তার উচ্চতর বিত্তবান অংশের উন্নতির উপায় ইংরেজি শিক্ষা বর্জন এবং ইংরেজ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতায় নয়। তাদের উন্নতির উপায় হচ্ছে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করা, তার মাধ্যমে পাশ্চাত্তের জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিচয় লাভ করা এবং ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি আলীগড়ে এ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি অনুবাদ সংস্থা তৈরি করে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানকে উর্দূ ভাষায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ সরকারের সহযোগী হলেও ধর্ম এবং সামাজিক সমস্যার ব্যাখ্যা এবং অনুধাবনে তাঁর দৃষ্টি ছিল উদারতাবাদী এবং সংস্কারমূলক। কালক্রমে আলীগড় ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর তরুণদের নিকট জ্ঞানচর্চার অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতে থাকে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আলীগড় গমন করেন এবং তাঁদের মধ্যে ভারতবর্ষের মুসলিম হিসাবে একটি ‘জাতিবোধের’ও সৃষ্টি হতে থাকে। এই আন্দোলন থেকে পরবর্তীকালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় (১৯২০)।
Al-Kindi: আল কিন্দী (৮০০-৮৭০ খ্রি.)
আবু ইউসুফ ইয়াকুব এবনে ইসহাক আল –কিন্দীর মৃত্যুকাল সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। ৮৭০ কিংবা ৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান। বসরার মেসোপটেমিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে আল –কিন্দী জন্মগ্রহণ করেন। নবম শতাব্দীতে তিনি মুসলিম দার্শনিক, বিশেষ করে আরবি ভাষার দার্শনিকদের মধ্যে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। এই যুগে আরবি অনুবাদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শনকে মুসলিম জগতে প্রচার করার যে ঐতিহাসিক চেষ্টা চলছিল তাতে আল –কিন্দীর ষ্মরণীয় আবদান রয়েছে। এ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স বা তত্ত্বকথার আরবি অনুবাদের পরিকল্পনা আল –কিন্দী গ্রহণ করেছিলেন। আল –কিন্দীর রচনাবলীর খুব সামান্য অংশই রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের মতে তার রচনাবলীর সংখ্যা প্রচুর। আল –কিন্দী এ্যারিস্টটলের অর্গানন-এর উপর নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে আলোচনা করেছিলেন। অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকের ন্যায় আল –কিন্দী গ্রিক দর্শনের প্রধান দুই প্রবক্তা প্লেটো এবং এ্যারিসস্টলের ভাবধারায় বিরাটভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বস্তুত আল –কিন্দী প্লেটো, এ্যারিস্টটল এবং পাইথাগোরাস-তিনজন গ্রিক দার্শনিককেই সমধিক শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের মধ্যে তত্ত্বগত পার্থক্য এবং বিরোধ সত্ত্বেও আল –কিন্দী উক্ত গ্রিক চিন্তাবিদগণকে নিজের জন্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।। আল –কিন্দী বিশ্ব-জগতের রহস্যোদঘাটনের জন্য কার্যকরণের বিধানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে বিশ্ব-চরাচরে কার্য-কারণের বিধান অমোঘ এবং সার্বিক। কার্য-করণের মাধ্যেমেই বিশ্বজগৎ আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। কার্য-করণের উপর এই জোর সত্ত্বেও আল –কিন্দী ধর্মের ক্ষেত্রে মনে করতেন যে, বুদ্ধিগত জ্ঞানের চেয়ে অহিগত জ্ঞান শ্রেয়। এতদ্ব্যতীত, যে সমস্ত মুসলিম দার্শনিক জগৎকে শাশ্বত বলেছেন এবং আল্লাহর ন্যায় শাশ্বত কাল থেকে জগৎ বিকশিত হয়ে আসছে বলে মনে করেছেন, তাঁদের মতের তিনি বিরোধিতা করেন। কাল-কিন্দীর মতে বিশ্বজগৎ শাশ্বত নয়। স্রষ্টা কোনো একদিন শূন্যাবস্থা থেকে বিশ্বকে সৃষ্টি করেছের। ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্বজগৎ বিধাতার হুকুমে শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আল –কিন্দীর এ অভিমত মৌলিক নয়। ষষ্ঠ শতকের খ্রিষ্টান দার্শনিকগণ আলেকজান্দ্রিয়াতে এরূপ অভিমত পোষণ করতেন। আল -কিন্দী জ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রকে একটি বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে পদার্থের ন্যায় নিরাময় প্রণালির ক্ষেত্রে আঙ্কিক অনুপাতের প্রয়োগ। ঔষধ প্রস্তুত প্রণালিতে অনুপাতের বিধান যে একটি গুরুত্তপূর্ণ বিধান, বাস্তবভাবে আল –কিন্দী তা পোমাণ করেন। আল্লাহকে আল –কিন্দী সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেছিলেন। বস্তু ও প্রাণীর মধ্যে স্তরক্রমে তাঁর প্রতিচ্ছায়া পড়ে। এই স্তরক্রম্যের মধ্য দিয়ে আত্মা দেহের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করে অমরতা প্রাপ্ত হয়। আল –কিন্দী ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক বিরোধী অভিমত পোষণ না করলেও দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, অঙ্ক অর্থ্যাৎ জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় তাঁর আগ্রহ এবং অধ্যয়নের কারণে গোঁড়াপন্থী মুসলমানগণ আল -কিন্দীকে অবিশ্বাসী বিবেচনা করেন।
Alexander, Samuel: স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার (১৮৫৮-১৯৩৮)
স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার আধুনিককালের ব্রিটিশ দর্শনিকদের মধ্রে ‘নিওরিয়ারিস্ট’ বা নয়া বস্তুবাদী বলে পরিচিত। নয়া বস্তুবাদ প্রকৃত পক্ষে বস্তুবাদী দর্শনও নয়। ভাববাদের সে প্রকারবিশেষ। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডারের দার্শনিক অভিমতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তিনি স্থান এবং কালকে ভাব কিংবা জ্ঞানসূত্র না বলে মহাবিশ্বের মূল বস্তু মনে করেছেন। মহাবিশ্বের এই মৌলিক বস্তু অর্থ্যাৎ স্থান এবং কালকে তিনি আবার গতি হিসাবে চিন্তা করেছেন। তাঁর অভিমতটি মোটামুটি এরূপ যে, স্থান-কালের গতি কিংবা স্থানকালরূপ গতি থেকে অচিন্তনীয় জটিল পরিক্রমায় বস্তু, জীবন, মন, মূল্যবোধ, বিধাতার বাহক এবং বিধাতা-সমস্ত সত্তারই উদ্ভব হয়েছে। অচিন্তনীয় অধিকতর সত্তার উদ্ভব এই পরিক্রমায় হচ্চে এবং হবে। বিশ্বপুঞ্জের এই ব্যাখ্যায় বিবর্তনবাদের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তবে একে বিশিষ্ট করার জন্য স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার তাঁর বিবর্তনবাদকে ‘বিকাশমান বিবর্তন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নবতর সৃষ্টির আন্তপ্রেরণায় এই বিকাশমান বিবর্তন প্রবাহমান। স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডারের ইংরেজি ভাষায় লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘স্পেস, টাইম এণ্ড ডিটি’ অর্থ্যাৎ স্থান, কাল এবং বিধাতা। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গিফোর্ড বক্তৃতাবলী হিসাবে প্রদত্ত এবং ১৯২০ সালে পুস্তকারের প্রকাশিত এই অভিমতের মাধ্যমে আলেকজাণ্ডার সুসংবদ্ধ আকারে তাঁর দর্শন প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি তাঁর পদ্ধতিকে অভিজ্ঞতালব্ধ পরাবিদ্যা আখ্যা দেন। অভিজ্ঞতালব্ধ পরাবিদ্যা বা এমপিরিক্যাল মেটাফিজিক্স বলতে তিনি বিজ্ঞানের সামগ্রিকতাকে যেমন বুঝাতে চান, তেমনি বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত বিজ্ঞান যে-সত্যে পৌছাতে পারে না, বিজ্ঞানোর্ধ্ব সেই সত্যের কথাও তিনি এর মারফত প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে মন এক দিক থেকে যেমন দেহ এবং দেহাভ্যস্তরের স্নায়ুমণ্ডলীর অতিরিক্ত কোনো সত্তা নয়, তেমনি অপরদিকে এ সত্তা বিকাশমান বিবর্তনের এক নতুন উদ্ভব। স্যামুয়েল আলেকজাণ্ডার তাঁর দর্শনে বিজ্ঞান এবং ধর্মের সমন্বয় ঘটাবার চেষ্টা করেছে। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় আলেকজাণ্ডারের দর্শন আধুনিক বিজ্ঞান-বিরোধী অভিমতে পর্যবসিত হয়েছে। উপরোক্ত দার্শনিকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ‘আর্ট এ্যাণ্ড দি ম্যাটেরিয়াল’ (১৯২৫) এবং ‘বিউটি এ্যাণ্ড আদার ফরমস অব ভ্যালু (১৯৩৩)।
Alexandrian School of Philosophy: আলেক্সান্দ্রীয় দর্শন
গ্রিক সভ্যতার পতনের পর মিশরের আলেক্সান্দ্রীয়া শহর প্রায় হাজার বছর ধরে বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ পর্যন্ত বিস্তারিত কালকে উপরোক্ত কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ থেকে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে এর দার্শনিক চিন্তাধারার সমধিক বিকাশের যুগ বলা হয়। আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিকগণ সে যুগের পাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনের যোগসুত্র হিসাবে কাজ করেছেন। আলেক্সান্দ্রীয় দর্শনের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে দার্শনিক হিরোক্লিসের নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। হিরোক্লিসের জন্মকাল সম্ভবত ৪২০ খ্রিষ্টাব্দ। আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিকগণ প্লেটোর দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্লেটোর দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা তাঁরা উপস্থিত করেছেন। হিরোক্লিসের দার্শনিক চিন্তায় প্লেটোর প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। সমস্ত অস্তিত্বের মূলে রয়েছে ‘ভাব’, এ অভিমত ছিল প্লেটোর। প্লেটোর ‘ভাব’-এর প্রতিফলন পাওয়া যায় হিরোক্লিসের ‘ডেমিয়ার্জ’ রূপ ধারণায়। হিরোক্লিসের মতে এউ ‘ডেমিয়ার্জ’ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি এবং সত্তার মূল। ‘ডেমিয়ার্জ’ আপন শক্তিতে শূন্যাবস্থা থেকে সমস্ত অস্তিত্বকে সৃষ্টি করে।
মূল’ডেমিয়ার্জ’ ক্ষুদ্রতর ডেমায়ার্জকে তার শক্তির বাহনরূপে ব্যবহার করে। এই বাহনদের মাধ্যমেই সকল অস্তিত্বের ভাগ্য ‘ডেমিয়ার্জ’ নিয়ন্ত্রিত করে। আরেক্সান্দ্রীয় দর্শনের ইতিহাসে হিপাসিয়া নামক একজন মহিলা দার্শনিকের নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এরূপ কথিত আছে যে, খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী জনতা উক্ত হিপাসিয়াকে তাঁর চিন্তাধারার জন্য নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করে।
আলেক্সান্দ্রীয় দর্শনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মের সঙ্গে দর্শনের মিলন ঘটাবার প্রয়াস। গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসের যুগে বিভিন্ন প্রকার পরস্পর-বিরোধী দার্শনিক তত্ত্ব মানুষের মনে একটি অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছিল। এই অবস্থাতে প্রাচ্যের ইহুদি ধর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন, বিশেষ করে প্লেটোর দার্শনিক তত্ত্বের সংযোগ ঘটে আলেক্সান্দ্রীয়া নগরে। দার্শনিক ফিলো খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে জীবিত ছিলেন। তিনি প্লেটোর দর্শনের সাহায্যে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। ফিলো প্লেটোর ‘ভাব’কে যেমন একদিকে গ্রহণ করেন তেমনি অপরদিকে তাকে বিশ্বচরাচর সৃষ্টিকারী এক বিশাল অগ্নিরূপে কল্পনা করেন। বিশ্বের প্রাণ-অপ্রাণ সমগ্র সত্তার মধ্যেই এই অগ্নির প্রকাশ ঘটেছে বলে ফিলো মনে করতেন।
Alienation: বিচ্ছিন্নতা
কোনো কিছুর গুণ বা শক্তিতে তার মূল আধার নিরপেক্ষভাবে স্বকীয় সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করাকে দর্শনে বিচ্ছিন্নতা বলা হয়। সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশে বিচ্ছিন্নতাবাদ যে একটা প্রতিবন্ধকরূপে কাজ করে, সে সত্যকে মাকর্সবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মাকর্স প্রথমে উদঘাটন করেন। তাঁর মতে মানব সমাজের ক্রমবিকাশে মানুষের শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির বিভিন্ন ফলাফল যেমন- অর্থের উৎপাদন, মুদ্রার আবিস্কার, উৎপাদনের সম্পর্ক ইত্যাদি সবকিছুর আধার হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু কালক্রমে শ্রমের এই ফলগুলোকে মূল আধার-নিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। শ্রম, মুদ্রা বা উৎপাদনের সম্পর্ক সব কিছুই যেন মানুষ-নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তা। মাকর্সবাদী মতে এরূপ বিচ্ছিন্নতাবাদ সামাজিক বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে দেখা দেয়। মার্কসের মতে মানুষের আদি সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রামের ধারায় উন্নততর উৎপাদন বা জীবিকার্জনের উপায়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পতির উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণের পার্থক্যের ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণীবিভাগের সৃষ্টি হয়। শ্রমেরও ক্রমাধিক পরিমাণে বিভাগ ঘটতে থাকে। শ্রমের এক বিভাগ অপর বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পর-বিরোধী হয়ে দেখা দেয়। যে হাতের কাজ করে সে আর মাথার কাজ অর্থ্যাৎ চিন্তার কাজ করতে পারবে না। এক শ্রম অপর শ্রমের চেয়ে শ্রেয় কিংবা হীন বলে বিবেচিত হতে থাকে। কায়িক শ্রম এবং মানসিক শ্রম এভাবে বিরক্ত হয়ে পড়ে।
Allama Abul Fazl: আল্লামা আবুল ফজল
জন্ম জানুয়ায়ী ১৪, ১৫৫১, জন্মস্থান আগ্রা, ভারত। আবুল ফজলের মৃত্যু ঘটে আগষ্ট ২২, ১৬০২।
আবুল ফজল একাধারে ঐতিহাসিক এবং সামরিক অধিনায়ক ছিলেন। আবুল ফজল সম্রাট আকবরের দরবারে ধর্মতাত্ত্বিকও ছিলেন। গোড়াতে আবুল ফজল পিতার শিক্ষালয়ে শিক্ষাগ্রহণের পরে সম্রাট আকবরের দরবারে অঙ্গীভূত হন।
প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আবুল ফজলের সমালোচনায় সম্রাট আকবরের চিন্তার পরিবর্তন ঘটে এবং ধর্মের গোড়ামীর স্থানে তাঁর মনে একাধিক ধর্মের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়।
Altruism: পরার্থবাদ
ইংরেজি ‘অলট্রুইজম’ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি ভাষা থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতে তাঁর মতবাদের ব্যাখ্যায় এই শব্দের ব্যবহার করেন। ইগোইজম বা আত্মবাদের বিরোধীভাব হিসাবে পরার্থবাদ ব্যবহৃত হয়। পরার্থবাদ কথাটির সাধারণ অর্থ সুপরিচিত। এই অর্থে পরার্থবাদ দ্বারা অপরের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা বা ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব বুঝায়। আত্মবাদের ন্যায় পরর্থবাদকেও মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি বলে অগাস্ট কোঁতে মনে করেন। মা যখন সন্তানের জন্য কষ্ট স্বীকার করে তখন মা পরার্থপরতার পরিচয় দেয়। পরার্থপরতা যখন মানুষের একটি সামাজিক অনুভূতি তখন এই অনুভূতির চর্চা এবং উন্নতি সাধন দ্বারা মানুষের সমাজকে স্বার্থের সংঘাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে কোঁতে মনে করতেন। সমাজকে উন্নত করার মাধ্যম হিসাবে পরার্থবাদকে উক্ত দার্শনিক একটি নীতিগত তত্ত্ব হিসাবে দাঁড় করান। কোঁতের মতে স্বার্থপরতা কেবল মানুষের নয়। মনুষ্যেতর জীবের মধ্যেও এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এটা কেবল মৌলিক জৈবিক অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্যই পশু-পাখিও সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নিজে বিপদ বরণ করে।
American Civil War: আমেরিকার গৃহযুদ্ধ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অঞ্চলের সঙ্গে দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি অঙ্গরাষ্ট্রের সশস্ত্র সংঘর্ষ আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বলে পরিচিত। এই গৃহযুদ্ধ ১৮৬১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আব্রাহাম লিংকন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্ট। তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার দাস প্রথা বিরোধী নীতি গ্রহণ করে। দাসপ্রথা বিলোপ কিংবা তাকে অব্যাহত রাখা, এই প্রশ্নে কেন্দ্রের সঙ্গে মত বিরোধের ভিত্তিতে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষনা করে দাস প্রথা সমর্থক রাষ্ট্রের একটি ‘কনফেডারেসী’ গঠন করে। দক্সিণ ক্যারোরিনা রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদী দক্ষিণ ক্যারোলিনার বাহিনী কেন্দ্রীয় বাহিনীর দুর্গের উপর আক্রমন করে। ঐ সালে জুন মাস পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ পূর্ণ আকার গ্রহনণ করে। কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্রোহী দক্ষিণাঞ্চলকে বশীভূত করার জন্য সমুদ্রে অবরোধের সৃষ্টি করে। লোকবল, সৈন্যবল, শিল্প-শক্তি এবং সুসংগঠিত সরকারের শক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং দাসপ্রথা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী কৃষি-প্রধান দক্ষিণাঞ্চলীয় রাষ্ট্রীয় জোটের চেয়ে অবশ্যই অধিক পরাক্রমশালী ছিল। তথাপি ১৮৬১ ও ৬২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সৈন্য বাহিনীকে দুইটি গুরুতর পরাজয়ের ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু পরিণামে সরকারের নৌ অবরোধ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক অধিনায়ক জেনারেল গ্রাণ্ট এবং জেনারেল শারমানের যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণীয় রাষ্ট্রজোট হতবল হতে শুরু করে। তাদের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক আকারে ছাউনীত্যাগ শুরু হয় এবং ১৮৬৫ সালের ৯ এপ্রিল তাদের সেনাধ্যক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেণ্ট আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথার বিলোপ ঘোষণা করেন। এই প্রগতিশীল এবং মানবতাবাদী ভূমিকার জন্য দাস প্রথার সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীলদের গুপ্তঘাতকের হাতে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে আব্রাহাম লিংকন নিহত হন। দক্ষিণাঞ্চলকে পরিপূর্ণরূপে বশীভূত করার নীতি কেন্দ্রীয় সরকার ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখে।
American Civilization: আমেরিকার সভ্যতা
আমেরিকার সভ্যতা বলতে কি বুঝায়? এশীয় সভ্যতা, ইউরোপীয় সভ্যতা এবং আফ্রিকার সভ্যতা- কথাগুলির একটি স্বাভাবিক অর্থ আছে। মহাদেশ হিসাবে বিভক্ত এই সমস্ত অঞ্চলের সভ্যতা বলতে প্রাচীনকাল থেকে এই সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীগণ যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করে এসেছে তাকেই এই সমস্ত অঞ্চলের সভ্যতা বলে নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু ‘আমেরিকার সভ্যতা’ বলতে আধুনিককালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা-এই মহাদেশের আদি অীধবাসীদের নিজেদের গঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বুঝানো হয় না। অস্ট্রেলীয় মহাদেশের সভ্যতার ক্ষেত্রেও এক অবস্থা। আমেরিকার সভ্যতা বলতে আধুনিককালে যাকে বুঝানো হয় তার সূচনা খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে নয়। এবং এ সভ্যতা গঠন করেছে এই অঞ্চলের আদি অধিবাসীগণ নয়। গঠন করেছে ইউরোপ মহাদেশ থেকে আগত স্পেনীয়, পর্তুগীজ, ইংরেজ, জার্মান, ইটালিয়ান প্রভৃতি জাতির ভাগ্যান্বেষীগণ। বস্তুত ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বাসের আমেরিকা ‘আবিস্কারের’ পর থেকে বিপুল আকারে ইউরোপীয় মানুষ আমেরিকায় আগমন করতে শুরু করে। কিন্তু কলম্বাস যখন আমেরিকার সন্ধান পান তখন বিরাট আমেরিকাভূখণ্ড জনশূন্য কিংবা সভ্যতাবিহীন ছিল না। আমেরিকার নিজস্ব অধিবাসীদের প্রতিষ্ঠিত সেই সভ্যতা ইউরোপীয় অধিবাসীদের আক্রমণ এবং গ্রাসের ফলে আজ বিলুপ্তপ্রায়। ইতিহাসের জাদুঘরে তার কেবলমাত্র কিছু রেশ এবং আভাস দেখা যায়। সভ্যতার হাতে সভ্যতার বিনষ্টির এ একটি বিষ্ময়কর এবং আধুনিক দৃষ্টান্ত।
এশিয়া মহাদেশ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যকার বেরিং প্রণালীর বিস্তার অনতিক্রমণীয় না হলেও বিপুল আয়তন আমেরিকা মহাদেশ, উত্তর এবং দক্ষিন আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে ভৌগলিকভাবে মহাসমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। তার একদিকে আটলাণ্টিক মহাসমুদ্র। অপরদিকে প্রশান্ত মহাসমুদ্র বিস্তারিত। প্রাচীনকালে মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে উত্তর আমেরিকার সঙ্গে জল যোগাযোগ একেবারে ছিল না, এমন অনুমান করা চলে না।
গবেষকগণ অনুমান করেন, আমেরিকার আদি অধিবাসীগণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোত্র হিসাবে মহাদেশের বিভিন্ন বাসোপযোগী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল।
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে উত্তর অঞ্চল থেকে একটি শিকারী জনগোষ্ঠীকে মেক্সিকোতে এসে বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়। এই নবাগত জনগোষ্ঠী স্থানীয় কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জীবনযাপন করতে শুরু করে। এদের মিলিত জীবনযাত্রা থেকে টোকটেক নামীয় একটি জাতির বিকাশ ঘটে। মেক্সিকোর টোলটেক জাতির সভ্যতার চিহ্ন তাদের তৈরি মৃৎপাত্র এবং পিরামিড শীর্ষের মন্দিরের মধ্যে পাওয়া গেছে।
এর কয়েক শত বছর পরে খ্রিষ্টীয় দশম শতকে উত্তর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এই নবাগতগণ ছিল আজটেক। এরা টোকটেকদের পরাভূত করে। আজটেক জাতি ‘টেনোছিটলান’ নামে একটি শহরের পত্তন করে। আধুনিক মেক্সিকো শহরের পূর্বভিত্তি আজটেকদের টেনোছিটলান। আজটেকদের সভ্যতা পূর্বের চেয়ে উন্নত ছিল। স্বর্ণ এবং তাম্রের ব্যবহার, গণনার একটি পদ্ধতির আবিস্কার, বর্ষপঞ্জী তৈরির ক্ষমতা এবং চিত্রলিপির ব্যবহার এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ছিল।
আজটেকগণ ক্রমান্বয়ে তাদের বসতি মিক্সিকোর দক্ষিণ পূর্বের ইউকাতান উপদ্বীপে বিস্তারিত করে। ইউকাতানে তখন মায়াসভ্যতা নামে একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল।
আজটেকগণ মায়াসভ্যতাকেও পরাভূত করে। মায়াগণ প্রস্তরের নগর এবং মিশরের পিরামিডের ন্যায় প্রস্তরমন্দির তৈরিতে পারদর্শী ছিল। তারা বিরাটাকারের বাড়ি তৈরি করতে পারত। এ সমস্ত স্থাপত্যের বিচিত্র অঙ্গসজ্জার ধ্বংসাবশেষ তদের স্থাপত্য শিল্পের বিষ্ময়কর বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে। মায়াদের গঠিত নগরের মধ্যে চিতেনইটজা, মায়াপান, উকসমল প্রভৃতি নগর খ্যাতি লাভ করে। এই নগরগুলি নগররাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করেছিল। দশম শতাব্দী থেকে কয়েক শত বছর এই নগররাষ্ট্রগুলি পরস্পরের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ে নিযুক্ত ছিল। আমেরিকার নিজস্ব সভ্যতার মধ্যে মায়া সভ্যতাই সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিকশিত বলে খ্যাত। মায়াসভ্যতার ক্ষয়ের কাল হচ্ছে দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী। মায়াসভ্যতার সমাজ ব্যবস্থায় অভীজাত ও পুরোহিতদের প্রাধান্য ছিল। অভিজাতদের হাতে কোকোয়ার জমি, মৌমাছির চাষ এবং লবণের খনিগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল। অভিজাতদের অধীনে সংখ্যক দাসও থাকত। বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রে বা বসতিতে মায়াগণ সে সংগঠিত জীবনযাপন করত তার মধ্যে গোত্রীয় জীবন-পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য প্রধান ছিল। কিন্তু বিকাশের পথে গোত্রীয় যৌথ জীবনের মধ্যে আর্থিক অসাম্যও ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হতে থাকে। যুদ্ধের বন্দি, দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, ঋণবদ্ধ মানুষ এবং অনাথরা দাসশ্রেণীর প্রধান উৎস ছিল। মায়াদের মধ্যে এইকালে দাসসমাজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে।
মায়াসভ্যতাকে পরাভূত এবং তার বিকাশকে গ্রহণ করে আজটেকগণ সমগ্র মেক্সিকোতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। আজটেকগণ সেচ ব্যবস্থা উন্নতি ঘটিয়ে কৃষিকার্যকে অধিকতর বিকশিত করে। নানা রকম ফল ও সবজি ব্যতীত তামাকের চাষেরও তারা প্রচলন করে। হস্তশিল্পের মধ্যে আসবাসপত্র তৈরি, বস্ত্রবয়ন এবং ধাতবশিল্প বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজটেকগণ প্রস্তর বা ইট দ্বারা বাড়ি তেরি করতে পারত। তা ছাড়া খালখনন ও বাঁধ তৈরিতেও তারা দক্ষতা অর্জন করেছিল।
আজটেকণও গোড়ার দিকে গোত্রীয় জীবনযাপন করত। জমি যৌথ সম্পত্তি ছিল। নির্বাচিত সমরপতি যুদ্ধ ও শান্তি, উভয় সময়ে গোত্রের প্রধান বলে বিবেচিত হতো। কয়েকটি গোত্র মিলে আবার যৌথ জীবনযাপনের জন্য প্রধান সমরপতিকে কোনো বিশেষ গোত্র থেকে নির্বাচিত করত। আজটেকগণ যুদ্ধবাজ ছিল। প্রায়ই তারা অভিযান, যুদ্ধ এবং লুণ্ঠনে লিপ্ত থাকত। আর এই যুদ্ধ পরিচালনা এবং জয়ের মধ্যে ক্রমান্বয়ে তাদের গোত্রীয় সাম্যবাদী জীবনের ভাঙন ঘটে। যুদ্ধের সম্পদ ও দাস প্রধানত সমরপতিগণের অধীকারভুক্ত হয়। এভাবে আজটেকের দাসে পরিণত হয়। এবং দাস ব্যবস্থা আজটেক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকেও আজটেকদের যুদ্ধোম্মাদ জাতি হিসাবে দেখা যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার এণ্ডিজ পর্বত অঞ্চলে আর একটি সভ্যতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এখানে প্রাচীনকাল থেকে কুইচোয়া, আয়মারা এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী বাস করে আসছিল। এদের সভ্যতাএ বিশেষ বিকাশ লাভ করেছিল। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকে কুইচোয়ার গোত্রভূক্ত ইনকাগোত্র অন্যান্য গোত্রকে পরাভূত করে একটি বৃহদাকারের রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। এই রাষ্ট্রের অধিপতি নিজেকে ‘সাপাইনকা’ (একমাত্র ইনকা) বলে অভিহিত করত এবং নিজেকে সূর্যদেবের পুত্র বলে বিশ্বাস করত। ইনকাগণও কৃষি, পশূপালন ও নানাপ্রকার হস্তশিল্পে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ক্রমধিক সংযোগ এবং সংমিশ্রণের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার এ সমস্ত সভ্যতা অধিকতর বিকাশ করতে পারত। কিন্তু এই সভ্যতাসমূহের নিজেস্ব বিকাশ ধারা পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর উন্নততর মরাণাস্ত্রসজ্জিত ইউরোপীয় অভিযানকারীদের আক্রমন,লুণ্ঠন ও শোষণের দুর্বার আঘাতে রুদ্ধ হয়ে যায়।
American Philosophy: আমেরিকার দর্শন
সাম্প্রতিকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক চিন্তাধারাকে চিহ্নিত করার জন্য ‘আমেরিকার দর্শন’ আখ্যাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকা বলতে কেবল মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র বুঝায় না। সে কারণে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার জন্য ‘আমেরিকার দর্শন’ কথাটি উপযুক্ত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ইউরোপ মহাদেশ থেকে আগত অধিবাসীদের দ্বারা গঠিত হয়েছে। এ জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউরোপ মহাদেশে ঊনবিংশ শতকে প্রচলিত ভাবধারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচলিত ছিল। দর্শনের ক্ষেত্রেও ইউরোপের বিভিন্ন ধারা এবং উপধারার সাক্ষাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিকদের মধ্যে পাওয়া যায়। ইউরোপ থেকে ভিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না বলে বিগত শতকে দর্শনের ইতিহাসে ‘মার্কিন দর্শন’ বলে কোনো বিশেষ দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় না। তথাপি অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপ ত্যাগকারী জনসমষ্টি একটি অনাবাদী ভূখণ্ডকে আবাদযোগ্য করে সভ্যতা গঠনে যে ভাবধারার আশ্রয় গ্রহণ করেছে তা বিশ্লেষণের যোগ্য। নতুন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং বৈজ্ঞানিকগণ যেভাবে সহায়তা করেছেন দার্শনিকগণও সেভাবে তাঁদের চিন্তাধারার মাধ্যমে এই গঠনকার্যে অংশগ্রহণ করেছেন। গঠনমূলক এই যুগের চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তবতা। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো সমস্যার তাত্ত্বিক বিচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুগের দার্শনিকগণের মধ্যে প্রকট হয় নাই। বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁরা চিন্তা করেছেন। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিকদের মধ্যে বাস্তব জীবনের স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এই জীবনবোধে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদের জন্ম হয়।
১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা এই সময়ে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে জেমস ডিউই, পিয়ার্স, রয়েস, জর্জ সাণ্টায়ানা এবং আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের মতো মৌলিক চিন্তাবিদদের উদ্ভব ঘটে। উপরোক্ত দার্শনিকদের গ্রন্থরাজি এবং অভিমত দর্শনের সমগ্র ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। হোয়াইটহেডকে প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মনে করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দর্শনে যে সমস্ত তত্ত্ব সমধিক আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে লজিকাল পজিটিভিটিম বা যৌক্তিক দৃষ্টবাদ এবং লিঙ্গুইসটিক ফিলোসফি বা ভাষা-দর্শনই প্রধান।
American War of Independence: আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬-১৭৮১)
ইউরোপের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে আমেরিকার বিপ্লব বলেও অভিহিত করা হয়।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইংল্যাণ্ডের অথনৈতিক বিকাশের একটি পর্যায়ের স্মারক। সপ্তদশ শতাব্দীতেই ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইংল্যাণ্ডে পশম ও সুতার বস্ত্রশিল্প, কয়লা উত্তোলন এবং লৌহ তৈরির শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করে। পশমশিল্পের বিস্তারের সঙ্গে ভূমি ও কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভেড়ার পশম ছিল পশমশিল্পের মূল কাঁচামাল। কুষিপণ্যের চেয়ে পশমের লাভ অধিক দেখে জমিদারগণ জমি থেকে ব্যপকভাবে কুষকদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিদারিকে মেষপালনের খামারে পরিণত করতে শুরু করে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কৃষক ভূমিহীন নিঃস্ব মুজরে পরিণত হয়ে শহরে এবং শিল্পঞ্চলে জমায়েত হতে থাকে। এই নিঃস্ব জমিহীন কৃষকরা শিল্পের সস্তা মজুর হিসাবে শিল্প বিকাশের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করে। ইংল্যাণ্ডের এই বিকশিত শিল্পের জন্যে ক্রমান্বয়ে অধিক পরিমাণে বাজারের আবশ্যক হয়। এই বাজারের প্রয়োজনে শক্তিশালী নৌবহরের মালিক ইংল্যাণ্ডে উপনিবেশের জন্যে বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৭০১ থেকে ১৭১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সঙ্গে সাত বছরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সমস্ত যুদ্ধের ফলে ভারতে এবং উত্তর আমেরিকায় ইংল্যাণ্ডের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। উত্তর আমেরিকাতে ফরাসিগণ কানাডাকে ইংল্যাণ্ডের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু আমেরিকাতে এই বিজয় ইংল্যাণ্ডের শাসকদের জন্যে নতুন সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পঞ্চদশ মতকের শেষদিকে (১৪৯২) কলাম্বাসের আমেরিকা সন্ধান লাভের পর থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানা ধরনের অধিবাসী ধনরত্নের আশায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাতে আগমন করতে থাকে। ইউরোপীয়দের এই আগমন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বিরাট স্রোতের আকার ধারণ করে। এই সমস্ত অভিযানকারীগণ আমেরিকার আদি অধিবাসীদের তুলনায় মারণাস্ত্র এবং অন্যান্য কলাকৌশল অধিকতর উন্নত ও শক্তিশালী ছিল। বিশাল আমেরিকার বিপুল অংশ তখনো অনাবাদী অবস্থাতে ছিল। ইউরোপীয় অভিযাত্রীগণ একদিকে আমেরিকার আদি অধিবাসীগণকে ধ্বংস করে, অপরদিকে অনুধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ দখল এবং আবাদ করে ইউরোপীয় উপনিবেশ বা বসতি স্থাপন করতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেই আটলান্টিক উপকূলব্যাপী ইংরেজদের উপনিবেশ বিরাট আকার ধারণ করে। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কানাডা লাভের ফলে এই উপনিবেশ বৃদ্ধি পায়। এই সকল উপনিবেশের ইউরোপীয় অধিবাসীদের সংখ্যা এই সময়ের মধ্যে ত্রিশ লক্ষে পৌছে যায়। এই উপনিবেশের অধিবাসীগণ এখন আর ইউরোপ থেকে আগত কোনো অস্থায়ী বাসিন্দা নয়। এখন এরা নিজেদেরকে আমেরিকার অধিবাসী বলে গণ্য করে নিজেদেরকে ‘আমেরিকান’ বলে ঘোষণা করতে শুরু করে। এই সমস্ত উপনিবেশবাসীদের সাধারণ স্বার্থের সঙ্গে তাদের মূলদেশ ইংল্যাণ্ডের শাসকদের শাসন ব্যবস্থা ও স্বার্থের বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টে রচিত শাসনবিধি দ্বারা ইংল্যাণ্ডের রাজা আমেরিকার উপনিবেশগুলিকেও শাসন করত। পার্লামেণ্টে আমেরিকার উপনিবেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছির না। উপনিবেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ পূর্ব থেকেই ইংল্যাণ্ডের এই শাসনবিধির প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহাত্মক আন্দোলন ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার সাত বছরের যুদ্ধের পূর্বে তেমন পরিচালিত হয় নি। তার একটা কারণ ছিল, ফ্রান্স সম্পর্কে উপনিবেশের অধিবাসীদের ভয়। ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে গেলে, কানাডা থেকে ফরাসিরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সাত বছরের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় এবং কানাডা ইংরেজ উপনিবেশের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় আমেরিকার অধিবাসীদের সে ভয় এবার দূর হলো।
ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্ট এবার যখন পুরোনো কায়দায় আমেরিকার উপনিবেশগুলির উপর ট্যাক্স ধার্যের আইন পাশ করতে লাগল, উপনিবেশের অধিবাসীদের নিজস্ব শিল্প ও বাণিজ্য প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রকার বাধা নিষেধ আরোপ করে চলল তখন উত্তর আমেরিকার এই সমস্ত ইংরেজ উপনিবেশের অধিবাসীগণ বিদ্রোহাত্মক মনোভাব দেখাতে শুরু করল। এই সময়েই আমেরিকানগণ একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম ধ্বনি উচ্চারণ করে ‘নো ট্যাকসেশন উইদআউট রিপ্রেজেণ্টেশন: প্রতিনিধি নাই, তো ট্যাক্স নাই’ (১৭৬৭)। তারা সরকারের কর দিতে অস্বীকার করতে শুরু করল। ইংরেজ সরকার এর পাল্টা দণ্ডমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উপনিবেশবাসীরা ইংল্যাণ্ডের প্রেরিত চা এবং অন্যান্য দ্রব্য বর্জন করার আন্দোলন শুরু করে (১৭৭৪)। ইংরেজ সরকার তার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার বাণিজ্য নৌযানগুলিকে সমুদ্রপথে অবরোধ করে। এর জবাবে আমেরিকার উপনিবেশগুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৭৭৪ সালে আমেরিকানগণ সশস্ত্রভাবে সরকারের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে রত হয়। ১৭৭৫ সনে লেকসিংটনে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সামান্য রাইফেলধারী কিছূ আমেরিকানদের কাছে ব্রিটিশ সৈন্য ক্ষয়ক্ষতি ভোগ করে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৭৭৫-এর মে মাসে বিদ্রোহী উপনিবেশগুলির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন ফিলাডেলফিয়াতে আহূত হয়। এই সম্মেলনে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে জর্জ ওয়াশিংটনের (১৭৩২-১৭৯৯) অধিনায়কত্বে এক আমেরিকান বাহিনী গঠন করা হয়। ফিলাডেলফিয়ার সম্মেলন ১৭৭৬-এর জুলাই ৪ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে এবং আমেরিকার ইংরেজ উপনিবেশগুলি নিজেদের ‘দি আমেরিকান স্টেইট’ বা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র (ইউ.এস.এ.) হিসাবে ঘোষণা করে। ইতিহাসে এই ঘোষণা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
এই ঘোষণা-পত্রের রচয়িতা ছিলেন টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)। এই ঘোষণার পরে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। গোড়ার দিকে ইংল্যাণ্ডের শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের বাহিনী টিকে থাকতে অক্ষম হয়। ইংরেজ সৈন্য আমেরিকানদের হাত থেকে নিউইয়র্ক দখল করে।
ক্রমান্বয়ে আমেরিকার এই স্বাধীনতা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত আমেরিকানগণ ফ্রান্স ও স্পেনের সাহায্য কামনা করে। ফরাসি জনমত তো বটেই, ফরাসি সরকারও এই সুযোগে ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করে আমেরিকানদের অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে অগ্রসর হয়। স্পেনও সাত সাগরের একচ্ছত্র অধিপতি ইংল্যাণ্ডকে আঘাত করার সুযোগ গ্রহণে পিছিয়ে থাকলো না। স্বাধীনতাকামী আমেরিকানদের পক্ষে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এবার একটি আন্তর্জাতিক জোট তৈরি হয়ে গেল। এই জোটের আঘাতের মুখে ইংরেজশক্তি আর টিককে সক্ষম হলো না। তারা ইয়র্ক টাউনের যুদ্ধে ফরাসি ও আমেরিকানদের নিকট পরাজয় স্বীকার করে আমেরিকার উপনিবেশজোটের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হলো (১৭৮১)।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাদীনতাকামী মানুষের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ইংল্রাণ্ড, ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের অন্যান্য দেশের প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রীমনা চিন্তাবিদদের মধ্যে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। আমেরিকার সৈন্যগণকে ইংল্যাণ্ডের সাধারণ মানুষ ‘স্বাধীনতার সন্তান’ বলে গণ্য করতে শুরু করে। ইংল্যাণ্ডের চিন্তাবিদ সেইণ্ট সাইমন এবং পোলাণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা যোসিসকোসহ অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকাতে উপস্থিত হন। ১৭৮৯ সনের ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লব সংঘটনের ক্ষেত্রে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছিল।