Economism: অর্থবাদ
শ্রমিক আন্দোলনে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিত্যাগ করে আংশিক আর্থিক দাবি আদায়ের প্রবণতাকে অর্থবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে আন্দোলনের মধ্যে অর্থবাদ একটি বিতর্কিত ধারা ছিল। লেনিনের অনুসারী বলশেভিকগণ নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অর্থবাদের অভিযোগ আনেন। এঁদের মতে অর্থবাদের অনুসারীগণকে সমাজতন্ত্রবাদী বলা চলে না। কেননা, সমাজতন্ত্রবাদের আন্দোলন কেবলমাত্র শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোল নয়। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শ্রমিকদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও আন্দোলন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন দ্বারা শ্রমিকদের মুক্তি সম্ভব নয়। রুশ বলশেভিক সংগঠনের মধ্যে কারা অর্থবাদী এবং তাদের মত কিরূপে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর, তার বিশ্লেষণ করে লেনিন ‘কি করণীয়’ নামক পুস্তক রচনা করেন। শ্রমিক আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম আজ কোনো বিশেষ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একে একটি আন্তর্জাতিক ধারা বলে অভিহিত করা চলে।
Economic Determinism: অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ
মার্কসবাদের সমালোচকগণ ইতিহাসের মার্কসীয় ব্যাখ্যাতা স্থুলভাবে ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ’ বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে মার্কসবাদ ইতিহাসের মূল চালক-শক্তি হিসাবে কেবল আর্থনীতিক শক্তি তথা উৎপাদন ব্যবস্থার উপর জোর দেয়, মানুষের উপর ভাব তথা সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির প্রভাবকে অস্বীকার করে। মার্কসবাদীগণ এরূপ সমালোচনাকে মার্কসবাদের স্থূল ব্যাখ্যা মনে করেন। মার্কস-এঙ্গেলস তথা মার্কসবাদের প্রবক্তাদের মতে মানুষের জীবনে এবং তার ইতিহাসের বিকাশে মানুষেল জীবন ধারণ তথা তার জীবিকার ক্ষেত্রে বিদ্যমান এবং বিকাশমান উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদের সম্পর্ক মূল শক্তি হিসাবে কাজ করে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মানুষের জীবন স্থূলভাবে উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উৎপাদনের উপায়কে উন্নত এবং পরিবর্তিত করার জন্যই মানুষের চিন্তা ভাবনা এবং তার থেকে উদ্ভুত বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস। উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে এগুলি দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। উৎপাদনের উপায় ও সম্পর্ক যেমন সমাজের ভাবগত সৃষ্টিগুলির উৎস এবং তাদেরকে প্রভাবিত করে, মানুষের ভাবনা, চিন্তা, বিশ্বাস, আবিস্কারও উৎপাদনের উপায় ও সম্পর্ককে তেমনি প্রভাবিত এবং পরিবর্তিত করে। কাজেই এ তত্ত্বকে কেবল অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ কিংবা মানুষের ভাবকে অস্বীকারমূলক তত্ত্ব বলে আখ্যায়িত করা ভুল।
Eleatics: ইলিয়া-দর্শন
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে দক্ষিণ ইতালির ইলিয়া নামক দ্বীপটি প্রাচীন গ্রিক দর্শনচর্চার একটি কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জেনোফেন্স, পারমিনাইডিস, জেনো এবং মিলিসাস এই দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের দার্শনিক অভিমতসমূহ ইলিয়া দ্বীপের দর্শন নামে খ্যাতি লাভ করে। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে উপরোক্ত দার্শনিককের মতের একটি ঐক্য এই ছিল যে, এঁরা সকলেই মনে করতেন, সৃষ্টির মূল সত্তা অপরিবর্তনীয়। বস্তুর মধ্যে যে পরিবর্তন মানুষের ইন্দ্রিয়গোচর এটা বাহ্য এবং মায়া। পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্য সৃষ্টির মূল সত্তার ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য নয়। বিচিত্র বাহ্যবস্তুর মূলে একটিমাত্র সত্তা বিরাজমান। ইলিয়া দার্শনিকদের এই একত্ববাদী চিন্তা প্রাচীন দর্শনের ভাববাদী ধারার সূচনা করে। এতদিন পর্যন্ত গ্রিসের হিরাক্লিটাস এবং অন্যান্য দার্শনিক সৃষ্টির মূলে একটি বদলে একাধিক সত্তার কল্পনা করেছেন। বিশেষ করে মাটি, জল, বায়ু এবং অগ্নি প্রভৃতিকে সৃষ্টির মূল বলে তাঁরা আখ্যায়িত করেছেন। এই বহুত্ববাদী চিন্তাকে ইলিয়া দার্শনিকগণ নাকচ করে এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সৃষ্টির মূল সত্তা এক, অবিভাজ্য, অপরিবর্তনীয় –স্থির এবং অসীম। ইলিয়া দর্শনের পরবর্তীযুগ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ এবং তৃতীয় শতকে প্লেটো এই চিন্তাকেই অধিকতর সূক্ষ্ম যুক্তির মাধ্যমে এক অ-বস্তুমূলক, অসীম, অক্ষয় এবং অজ্ঞেয় ভাবকে সমস্ত প্রকাশের মূল বলে ঘোষণা করেন। ইলিয়ার দার্শনিকগণ বস্তুর বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনকে অস্বীকার করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে কার্যত ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক ইত্যাদি মাধ্যমের নির্ভরযোগ্যতাকে অস্বীকার করেন এবং জ্ঞানকে অতীন্দ্রিয় বিষয় বলে মনে করেন।
Einstein: আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫ খ্রি.)
আধুনিক বিজ্ঞানের বিখ্যাত ‘রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রবক্তা। ধর্মগতভাবে আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদী। তাঁর পিতামাতা তার শিশু বয়সে জার্মানির মিউনিকে আসেন। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার ইতালির মিলানে যান। শিক্ষা জীবন আঙ্কশাস্ত্র এবং পদার্থবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। কিছুকাল একটি স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে বার্লিনে একটি পরিবারে গৃহশিক্ষকতাও করেন। ১৯০৫ সনে আইনস্টাইন আলোর রূপান্তর বা ট্রান্সফরমেশন অব লাইট, অণুর মাত্রা বা মলিক্যুলার ডাইমেনশনস, গতিময় পদার্থের তড়িৎ প্রবাহ বা ইলেকট্রো ডাইনামিকস অব মুভিং বডিস প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে নিবন্ধাদি প্রকাশ করেন। এই সূত্রে ম্যাক্স প্লাক্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘটে। ১৯০৯ সনে আইনস্টাইন জুরিকে তাত্ত্বিক পদার্থের বিশেষ অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৪ সনে তিনি বার্লিনের কাইজার ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৩৩ সনে হিটলারের নাজিবাদের ইহুদী বিদ্বেষের কারণে উক্ত পদ থেকে অপসারিত হন এবং জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং নিউজার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ লাভ করেন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে একথা বলা যায় যে, আলোর বিকিরণ তত্ত্বে তিনি সময় এবং স্থানের আপেক্ষিকতা দ্বারা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন।
তাঁর মতে সময় এবং স্থান কোনো দ্রষ্টা-নিরপেক্ষ সত্তা নয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব আধুনিক দর্শন এবং বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করেছে। বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসমূহের বাইরে সাধারণ পাঠকের জন্যও তিনি সমকালের বিভিন্ন সমস্যার উপর চিন্তা করেছেন এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিধাহীন এবং সুস্পষ্ট। ১৯৩৩ সনে ফ্রয়েডের সঙ্গে যুক্তভাবে শান্তির উপর তিনি যে গ্রন্থ প্রকাশ করেন তার নাম ‘যুদ্ধ কেন?’ ‘হোয়াই ওয়ার’। ১৯৩৪ সনে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আমার দর্শন’ নামক গ্রন্থ। প্রখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) তাঁর ইউরোপে গবেষণা কর্মে নিযুক্ত থাকা কালে আইনস্টাইনের সাহচর্যে আসেন। আইনস্টাইন ১৯২৪ সনে অধ্যাপক বসুর ‘প্ল্যাঙ্ক সূত্র এবং কোয়াণ্টাম প্রকল্প’ প্রবদ্ধটি পাঠ করে চমৎকৃত হন এবং সেটি নিজে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি বোস আইনস্টাইন সংজ্ঞা নাম প্রসিদ্ধি লাভ করে।
Elements: মূল, মূল উপাদান, মৌল পদার্থ
দৃশ্যত বস্তু বিভিন্ন আকারের এবং বহু প্রকারের। দূর অতীতেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে এই বহুর পেছনে বহুর উৎস বা কারণ হিসাবে একটি মূলের সন্ধান করেছে। কিন্তু বিচিত্রের মূলে মাত্র একটি সত্তা আছে, এ সিদ্ধান্ত মানুষ শুরুতেই করতে পারে নি। তবে বাহ্যত যত প্রকার বস্তু দেখা যায়, সবই মূল নয়, এ ধারণা মানুষ বাহ্য বস্তুর দ্রুত পরিবর্তন, রূপান্তর বা বিলুপ্তি করার চেষ্টা করে। এরূপ চেষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বিশেষভাবে প্রাচীন গ্রিস এবং ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকগণ ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ)-কে বিশ্বের মূল বলে মনে করতেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগ৯ণ বস্তুর বদলে তাপ-শৈত্য, আর্দ্রতা-শুষ্কতা প্রভৃতি বিপরীত গুণকে সমস্ত সৃষ্টির একক বলে কল্পনা করেছেন। এই সমস্ত বিপরীত ধর্ম বা গুণের সংযোগে সমস্ত রকম বস্তু বা সৃষ্টির প্রকাশ। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতকে গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস এবং এপিক্যুরাস বস্তুর মূলে অণুর অস্তিত্বের তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁদের মতে, অণু হচ্ছে বস্তুর সূক্ষ্মতম এবং অবিভাজ্য মৌলিক উপাদান। অণুর সংযোগই বস্তুর বৈচিত্রের সৃষ্টি। এ আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, বস্তুর মূল সম্পর্কে ধারণা মানুষের জ্ঞানের বিকাশের সাথে জড়িত। জ্ঞানের প্রাথমিক অবস্থাতে সৃষ্টির মূল উপাদান সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা ছিল, জ্ঞানের বিকাশ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সে ধারণা বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের একটা বিষয় লক্ষণীয়। বস্তুর মূল কি, অর্থাৎ বস্তুর প্রকৃতি স্থির করার গবেষণার মানুষ একদিকে যেমন জটিলতাহীন এবং অবিভাজ্য কোনো এককের সন্ধান লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে তেমনি গবেষণার বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষকে ক্রমান্বয়ে এই সত্য স্বীকারে বাধ্য করেছে যে, বস্তু এক অসীম জটিল অস্তিত্ব। কারণ, মানুষ মূলে অবিভাজ্য কোনো এককের আবিস্কার করতে আজো সক্ষম হয় নি। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধারণা ছিল যে, বস্তুর মূলে একক হিসাবে অপরিবর্তনীয় অবিভাজ্য কোনো উপাদান আছে। কিন্তু উনিশ শতকের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারসমূহ, বিশেষ করে পদার্থ-বিজ্ঞান বস্তুর সেই পুরাতন ধারণাকে একেবারেই নাকচ করে দিয়েছে। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের কাছে বস্তুর মূল বলে যে ইলেকট্রন, প্রোটেন এবং নিউট্রন বিবেচিত হয়, তাদের গঠনও অশেষ জটিলতাপূর্ণ। আধুনিক দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুরবাদ বস্তুর মূল সত্তাকে সদা দ্বান্দ্বিক বা বিরোধাত্মক ধারায় পরিবর্তনশীল অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করে। ভ্রাদিমির লেনিন তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে এরূপ উক্তি করেছিলেন যে, ‘এ্যাটমের ন্যায় ইলেকট্রন হচ্ছে অসীম সম্ভাবনাময় এবং বিশ্বজগতের কোনো শেষ নেই’।
Elite, Elitism: এলিট, অভিজাত, এলিটবাদ, নয়া-অভিজাতবাদ
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাত্ত্বিকদের মধ্যে আলোচিত একটি তত্ত্ব হচ্ছে এলিট তত্ত্ব। ‘এলিট’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ। এ থেকে এলিটবাদকে শ্রেষ্ঠত্ববাদ কিংবা নয়া অভিজাতবাদ বলেও অভিহিত করা চলে। এই তত্ত্বের প্রধান প্রবর্তন হিসাবে ইতালির ভিলফ্রেডো পারেটো (১৮৪৩-১৯২৩) এবং গায়টানো মসকা পরিচিত। এ সমস্ত চিন্তাবিদ প্রধানত অযুক্তি এবং শক্তিবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী। মানুষের চরিত্রের মধ্যে অযুক্তি এবং শক্তির প্রতি আকর্ষণমূলক প্রবণতার উপর এঁরা জোর প্রদান করেন। এঁদের মতে প্রকৃতি মানুষকে সমাজ হিসাবে তৈরি করে নি। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নানা গুণের ভিত্তিতে ‘এলিট’ বা শ্রেষ্ঠ এবং ‘অ-এলিট’ বা ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ হিসাবে বিভক্ত। এবং সমাজের নেতৃত্ব কিংবা রাষ্ট্র শাসন উভয় ক্ষেত্রে চিরকাল যারা বিদ্যা, বুদ্ধি, চাতুর্য, কূট-কৌশল দৈহিক শক্তি ইত্যাদি গুণে শ্রেষ্ঠ তারা শাসন করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এরাই শাসন করবে। এই শ্রেষ্ঠ অংশ অবশ্যই সংখ্যালঘু। সংখ্যায় তারা অল্প। সেদিক থেকে অল্পরাই অধিকের উপর শাসন করে। এরূপ তত্ত্বের অপর এক সমর্থক রবার্ট মিশেল-এর মতে মানুষেল জীবনে অল্পের শাসন হচ্ছে নিয়মের অমোঘ বিধান। তাঁর এরূপ অভিমত ‘আয়রন ল অব অলিগার্কী’ বা ‘কতিপয়ের লৌহ বিধান’ বলে পরিচিত। প্রাচীনকালে প্লেটো-এ্যারিস্টটলও মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিগত গুণের উপর জোর দিয়ে মানুষের একাংশকে অভিজাত বলে অভিহিত করতেন। তার ভিত্তিতে ‘অভিজাততন্ত্র’ বলে এক প্রকার শাসন ব্যবস্থাকেও তাঁরা নির্দিষ্ট করেন। কিন্তু সে বর্তমান কালের এলিটবাদ বা শ্রেষ্ঠত্ববাদ কেবল মহৎ গুণের দ্বারা বিভক্ত করা অর্থহীন। চোর কিংবা ডাকাতের দক্ষতাও দক্ষতা, রাজনীতিকদের মধ্যে বাগ্মী বা কৌশলী রাজনীতিকের দক্ষতাও দক্ষতা। এদিক থেকে মানুষেল যে-কোন পেশা বা গোষ্ঠীর মধ্যেই ‘শ্রেষ্ঠ’ ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ বলে ভাগ থাকে। এবং প্রত্যেকটি অংশের শ্রেষ্ঠরাই তথা অল্পরাই শাসন করে এবং অ-শ্রেষ্ঠ তথা সংখ্যাধিকেরা শাসিত হয়। শাসনের ক্ষেত্রে এলিটদের দুই নামে অভিহিত করা চলে। যারা শাসকমণ্ডলীল অন্তর্গত তারা ‘পাওয়ার এলিট’ বা ‘শাসক-এলিট’ এবং যারা ‘শাসনের বাইরে অবস্থিত’ তারা ‘অ-শাসক’ বা ‘নন পাওয়ার এলিট’ বলে অভিহিত। এর ভিত্তিতে এদের তত্ত্বে ‘এলিট সঞ্চালন’ বা সারকুলেশন অব এলিট’ কথাটি এসেছে। শাসনের বাইরে এলিটরা শাসনের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কালক্রমে শাসক-এলিটরা অ-শাসক এলিট দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সমাজকে শ্রেষ্ঠ, অ-শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যাল্প ও সংখ্যাধিকে বিভক্ত করার তত্ত্ব কোনো মৌলিক বা বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব নয়। এর মাধ্যমে মানুষের সমাজের সংকটের চরিত্র অনুধাবনে তেমন কোনো সুবিধা হয় না। বাহ্যত বিবরণমূলক এবং নীৎসের শক্তিবাদের সমর্থক এ তত্ত্বের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আশাবাদী চিন্তাকে নস্যাৎ করা। এর আক্রমণের প্রধান বিষয় হচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী চেতনা। মার্কসবাদী শ্রেণী বিশ্লেষণকে এ তত্ত্ব নাকচ করার চেষ্টা করেছে। এবং শক্তিবাদী এই তত্ত্বের অনুসরণেই বিংশ শতকে ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সামন্তবাদী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীসমূহ ফ্যাসিবাদ, নাজীবাদ ও সমরবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায়।
Emergent Evolution: আকস্মিক বিকাশ, আকস্মিক বিবর্তন
দ্র: Accidental Evolution
Emotion: আবেগ, প্রক্ষোভ
ব্যক্তির মানসিক অবস্থাবিশেষ। ব্যক্তি তার পরিবেশ অর্থাৎ অপর ব্যক্তি ও বস্তুর সঙ্গে সতত একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। এই ক্রিয়া-প্রক্রিয়া মানসিক অবস্থায় যখন কোনো ব্যতিক্রমের উদ্ভব ঘটায়, তখন তাকে মনের আবেগ বা প্রক্ষোভ বলে অভিহিত করা হয়। আবেগ মনোবিজ্ঞানের একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। এর মাধ্যমে আমরা পরিবেশ অর্থাৎ অপর ব্যক্তি এবং বস্তুজগৎ বা ঘটনার সঙ্গে আমাদের বিশেষ প্রতিক্রিয়াজনিত একটা অবস্থাকে বুঝাই। ব্যক্তি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়। কিন্তু ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেবল যান্ত্রিক নয়। ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পেছনে মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সে ইচ্ছা-অনিচ্ছার আগ্রহ, তীব্রতাও কাজ করে। ব্যক্তির দৈহিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর প্রাচীন গ্রিসে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের জ্ঞানী এমপিডোকলিসকে আলোকপাত করতে দেখা যায়। যে-কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে আবেগের ভূমিকা মানুষের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সক্রিয় আবেগ এবং নিরানন্দ বা বিমর্ষতা উৎপাদক আবেগকে নিষ্ক্রিয় আবেগ বলা হয়। আবেগ শুধু মনের ব্যপার নয়। আবেগের ফলে মস্তিষ্ক এবং দেহের বিভিন্ন অংশে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেহের আভ্যন্তরিক এবং প্রতিক্রিয়া ব্যতীত মনের আবেগের উদ্ভব সম্ভব নয়। মন যখন আনন্দিত হয় দেহের রক্ত সঞ্চালন, পেশির সম্প্রসারণ, ক্রিয়াশীলতা প্রভৃতি তখন বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই সক্রিয় আবেগে মনের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর করতে দেহ অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। নিষ্ক্রিয় আবেগ দেহকে আড়ষ্ট করে তার প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এ কারণে নিরানন্দ, কোনো দুঃখজনক বা ভীতিজনক ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ব্যক্তি অনেক সময়ে যুক্তিগতভাবে প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করতে কিংবা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হয়।
দেহের সঙ্গে আবেগের আত্যন্তিক সম্পর্ক আধুনিক মনোবিজ্ঞানে যান্ত্রিক উপায়ে নির্ধারণযোগ্য বিষয় বলে গণ্য করা হয়। আবেগকে বিশ্লেষণ করে তার অন্তর্ভুক্ত মেজাজ, আধান বা সঞ্চারণ, বৈশিষ্ট্য এবং অতিরাগ নির্দিষ্ট করা হয়। অতিরাগ আর মেজাজের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, মেজাজের স্থায়িত্ব আধান ও প্রতিক্রিয়া সঞ্চারী মানসিকতার চেয়ে অধিককাল স্থায়ী। প্রতিক্রিয়ার সিদ্ধান্তটি ক্ষণমুহুর্তের হতে পারে। বিশেষ মেজাজ অর্থাৎ আনন্দ-নিরানন্দজনক মানসিকতার মধ্যে বিশেষ সিদ্ধান্ত মুহুর্তের উদ্ভব হয়। অতিরাগ বা প্যাশনকে অধিকতর স্থায়ী আবেগ বলে মনে করা হয়। মানুষের আবেগ মহৎ কিংবা অমহৎ বলেও বিভক্ত হতে পারে। নীতিবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, আত্মোৎসর্গ, সমষ্টির জন্য ব্যক্তির স্বার্থ বিসর্জন, মর্যাদাবোধ ইত্যাদিও মানুষের মহৎ আবেগ। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উইল হেলম ভুনড-কে (১৮৩২-১৯২০ খ্রি.) বৈজ্ঞানিক মনোবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। ভুনড-এর মতে ব্যক্তির যে-কোন প্রতিক্রিয়া বা আচরণেই একটি আবেগগত দিক আছে। আধুনিক মনোসমীক্ষার মতে আনন্দ, বেদনা, প্রেম-ভালবাসা, ঘৃণা বিদ্বেষ সবই আবেগ। এবং মানুষ যে কেবল সচেতন অবস্থাতেই আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাই নয়। কোনো আবেগকে দমন করার প্রচেষ্টাও যেমন ব্যক্তির জীবনে সেই আবেগের প্রভাব নির্দেশ করে, তেমনি কোনো অবদমিত আবেগ ব্যক্তির অগোচরে এবং তার অবচেতনে সক্রিয় থেকে তার কোনো বিশেষ বা সমগ্র জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে। অবদমিত যৌনানুভূতির ভিন্নতার প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনে অনেক সময়ে কার্যকর হওয়া এর একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। মনসমীক্ষণবিদ ফ্রয়েডের গবেষণা মানুষের আবেগের জগৎকে মনোবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে।
Empedocles: এমপিডকলিস (৪৮৩-৪২৩ খ্রি.)
প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম কবি, বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে এরূপ কাহিনী আছে যে, তিনি ইটনা পর্বতের গহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ‘প্রকৃতি’ নামে তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক কবিতার মধ্যেই এমপিডকলিস নিজের দার্শনিক অভিমতসমূহ প্রকাশ করেন। তাঁর দর্শনের মধ্যে পূর্বগামী দার্শনিক পাইথাগোরাস, হিরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডসের ভাবধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এঁরা সকলেই সেকালের বস্তুবাদী বা প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। এঁদের সকলের মতামতই এমপিডকলিস কমবেশী গ্রহণ করেন। পারমিনাইডিসকে স্বীকার করে এমপিডকলিস বলেনঃ বস্তু হচ্ছে অ-সৃষ্ট অর্থাৎ বস্তুর কোনো স্রষ্টা নেই এবং বস্তুর কোনো বিলয় নেই। হিরাক্লিটার্স বলেছিলেন বস্তুর ক্ষেত্রে বিরামহীন গতি আর পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। বস্তু অ-সৃষ্ট এবং পরিবর্তনশীল এই দুই অভিশতকে সংযুক্ত করে এমপিডকলিস বলেন যে, দৃশ্যবস্তুপুঞ্জের মধ্যে পরিবর্তন আছে, তার সৃষ্টি এবং লয় দেখা যায় একথা সত্য; কিন্তু দৃশ্যবস্তু মূলত যে সত্তা বা উপাদানে গঠিত তার কোনো শুরু, শেষ বা পরিবর্তন নেই। বস্তুর মূলে রয়েছে চারটি সত্তা যথা, মাটি, পানি, বাতাস এবং আগুন। দৃশ্যবস্তুর সৃষ্টি, লয় এবং পরিবর্তন সাধিত হয় বস্তুর মৌলিক উপাদান মাটি, বায়ু, পানি আর আগুনের পারস্পরিক সংযোজন এবং বিয়োজনের মাধ্যমে। সংযোজন এবং বিয়োজন আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ, প্রেম, অ-প্রেম, ভালবাসা, ঘৃণা বস্তুর মূল উপাদানের মধ্যে সতত সংঘাতের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল। সংযোজন, আকর্ষণ, প্রেম, ভালবাসা যেখানে জয়ী, সেখানে সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি। আর বিয়োজন, বিকর্ষণ, ঘৃণা যেখানে জয়ী সেখানে ক্ষয় এবং ধ্বংস। আকর্ষণ বিকর্ষণের তত্ত্বের ভিত্তিতে এমপিডকলিস প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাঁর বৃত্তের তত্ত্বও তৈরি করেন। আকর্ষণ বা প্রেম জয়ী হতে হতে ক্ষুদ্রকে মহৎ করে, অসম্পূর্ণকে সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এ অবস্থাও স্থায়ী হতে পারে না। সম্পূর্ণের মধ্যে আবার বিকর্ষণ, ঘৃণা বা অ-প্রেম উদ্ভুত হয়। ক্রমান্বয়ে ঘৃণা প্রেমকে পরাভূত করে বৃহৎকে ক্ষুদ্র করে এবং সম্পূর্ণকে অসম্পূর্ণতে পর্যবসিত করে। এই তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির জগতের দ্বান্দ্বিক গতির স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু কেবল চক্রাকারে আবর্তন নয়। এমপিডকলিস এরূপও মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক জগতের একটা বিকাশও আছে। স্বধর্মী অস্তিত্বের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও সংযোজন বিকর্ষণের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অস্তিত্ব সৃষ্টি করে, বিকর্ষণকে পরাভূত করে, আকর্ষণ ও প্রেম সৃষ্টিকে ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করে চলে। এমপিডকলিসের এরূপ চিন্তার মধ্যে আধুনিক বিবর্তনবাদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
Empiricism: অভিজ্ঞতাবাদ
‘অভিজ্ঞতাবাদ’ হচ্ছে একটি জ্ঞান-তত্ত্ব। মানুষের জ্ঞানের উৎস কি এবং জ্ঞানের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা কি, এ বিষয়ে দর্শনে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে। সাধারণভাবে অভিজ্ঞতাবাদ বলতে এরূপ তত্ত্বকে বুঝায় যে, মানুষের ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তবে অভিজ্ঞতা কথাটি দর্শনে একটি ব্যাপক ব্যবহৃত শব্দ। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ উভয় তত্ত্বে অভিজ্ঞতার ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু ভাববাদের অভিজ্ঞতার অর্থ এবং বস্তুবাদের অভিজ্ঞতার অর্থ এক নয়।
জ্ঞানের উৎস কি, এটি দর্শনের একটি মৌলিক প্রশ্ন। সাধারণ ভাবকে জ্ঞানের উৎস বলা হয়। কোনো বিশেষ বস্তু সম্পর্কে আমরা যখন কোনো বক্তব্য প্রকাশ করি, তখন সেই বস্তুটির যে ভাব আমাদের মনে থাকে, সেই ভাবটি নিয়েই আমাদের বক্তব্য তৈরী হয়। ‘ওখানে একটি টেবিল আছে’ –এই বক্তব্যটি আমার মনে ‘টেবিলরূপ’ ভাব কিংবা ভাবসমূহের উপর একটি বক্তব্য। দর্শনে প্রথমে প্রশ্ন জাগে, মনের ভাবকে আমরা কিরূপে বা কোথা থেকে লাভ করি। এই প্রশ্নের চিরাচরিত জবাব দেকার্ত প্রমুখ যুক্তিবাদীগণ এভাবে দিয়ে আসছিলেন যে, মানুষের মনে জন্মগতবাবেই কতকগুলো মৌলিক ভাব থাকে। মানুষ এই মৌলিক ভাবগুলো বিধাতার নিকট থেকে প্রাপ্ত হয়। আর জন্মগত এই মৌলিক ভাবগুলোর ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞানমণ্ডল তৈরি হয়। এক কথায় এ তত্ত্ব হচ্ছে মনসর্বস্ব তত্ত্ব। আর এ তত্ত্বে মনের ভাবের উৎস বস্তু বগতের ঊর্ধ্ব কোনো লোক। বাস্তব বা ব্সতু জগতের স্বাধীন অস্তিত্ব এ মতে অস্বীকৃত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি জ্ঞানের এ তত্ত্বকে ক্রমান্বয়ে অগ্রাহ্য করে তোলে। এবং এর জোরালো প্রতিবাদ আসে ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), জন লক (১৪৩২-১৭০৪) প্রমুখ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকের কাছ থেকে সপ্তদশ শতকের জন লককেই অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান প্রবক্তা মনে করা হয়। ভাব এবং জ্ঞানের উৎস কি এ প্রশ্নে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ভাবের উৎস হচ্ছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। জন্মগতবাবে মানুষের মন আদৌ কোনো ভাব লাভ করে না। জন্মের সময়ে শিশুর মন একখানি ‘ট্যাবুলারাস’ বা ‘নিদাগ শ্লেট’ বৈ আর কিছু নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে এই ‘নিগদাগ শ্লেটে’ ভাবের দাগ এঁকে দেয়। আর সেই ভাবের দাগ দিয়েই মানুষ তার জ্ঞানজগৎ তৈরি করে। জন লকের ‘অভিজ্ঞতাবাদের’ এই বিবরণটি বিশেষ সংক্ষিপ্ত। আসলে তিনি অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাবাদী ছিলেন না। অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাবাদ দ্বারা জ্ঞানের জটিল প্রশ্নের জবাব দানে অসমর্থ হয়ে তিনি মনের অন্তঃঅনুভূতিকেও ভাবের একটি উৎস বলে স্বীকার করেছিলেন।
এ আলোচনায় দেখা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদ দুরকমের হতে পারে ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদ এবং বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদ।
বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদের মত অনুযায়ী আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক –অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ হচ্ছে ভাবের বাহক এবং বস্তুজগৎ হচ্ছে ভাবের উৎসকেন্দ্র। ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের মূল। ইন্দ্রিয়ের বাইরে কোনো ভাবের সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই নিছক অভিজ্ঞতাবাদের দুর্বলতা এই যে, এরূপ তত্ত্ব দ্বারা মানুষের মনের সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ, অনুমান প্রভৃতি জটিল ক্ষমতার ব্যাখ্যা দান সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উৎস বটে, কিন্তু ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার স্তূপই জ্ঞানজগৎ নয়। মানুষের মন ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে ভেঙেচুরে তার জটিল যোগবিয়োগ বস্তু বগতের জ্ঞান তৈরী করেন। মানুষের মনের এই ক্ষমতাকেও স্বীকার করতে হয়। না হলে জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্তূপে পর্যবসিত হয়।
ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদকে যুক্তিবাদ বলা হয়। ভাববাদের সমস্ত দার্শনিকই জ্ঞানের ব্যাপারে মূলত এই তত্ত্বকে অনুসরণ করেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী বার্কলের ন্যায় ভাববাদীর মতে মনের বাইরে জ্ঞেয় বলে কিছু নেই। মনের ভাবই জ্ঞানের একমাত্র বস্তু। আবার কাণ্ট এবং হেগেলের ন্যায় ভাববাদীদের মতে বস্তুজগৎ আছে বটে, আর সে বস্তুজগৎ আমাদের ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির সূত্র হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক ইত্যাদি সূচক মনের এমত কতকগুলো ভাব যার উৎস হচ্ছে মানুষের অজ্ঞেয়, কিন্তু অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্য এক সত্তা।
Empirio-Critism: নব অভিজ্ঞতাবাদ, ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদ
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপে ‘অভিজ্ঞতার সমালোচনা’ নাম দিয়ে আভানারিয়াস (১৮৪৩-১৮৯৬) এবং ম্যাক (১৮৩৮-১৯১৬) একটি দার্শনিক তত্ত্ব দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশেষ করে বস্তুর মৌল উপাদান সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের নবতম গবেষণাসমূহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁরা এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্বকে আর স্বীকার করা চলে না। কাজেই বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে, যুক্তিগতভাবে একথাও ঠিক নয়। মানুষের জ্ঞান কতকগুলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকস্মিক সংযোগ এবং বিয়োগ ব্যতীত আর কিছু নয়। বাস্তব জগতে মানুষ যে কার্যকারণের বিধান আরোপ করে তাও মানুষের মানসিক ব্যাপার –বস্তুগত অভিজ্ঞতা নয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘চিন্তার মিতব্যয়িতা এবং অবিচ্ছেদ্যতার সূত্র’ –অবতারণা করে এই মতবাদীগণ বলেন যে, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর অতি জোরের জন্য এই মতকে ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদও বলা চলে। তা ছাড়া জ্ঞেয় এবং জ্ঞাতার যে ব্যাখ্যা এঁরা উপস্থিত করতে চেয়েছেন তা ইংল্যাণ্ডের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ভাববাদের ব্যতিক্রম বৈ নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পরাজয়ের পরে প্রতিক্রিয়ার পাল্টা আক্রমণের যুগে রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে এই চিন্তা প্রসারলাভ করাতে ভি.আই. লেনিন, ম্যাক এবং অ্যাভানারিয়েসের তত্ত্বকে তীব্রভাবে তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে সমালোচনা করেন। লেনিনের মতে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সামাজিক জীবনে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির বিকাশের মুখে এ তত্ত্ব বিভ্রান্ত মধ্যবিত্তের ঈশ্বরবাদে প্রত্যাবর্তনের একটি আবরণ বিশেষ।