পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
কুরআন সন্পর্কে সাধারণ পাঠকও শুনেছেন যেমন এটি একটি বিস্তারিত পথনির্দেশনা, জীবন বিধান ও আইন গ্রন্থ। কিন্তু কুরআন পড়ার পর সেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সন্পর্কে বিস্তরিত নির্দেশনা ও বিধি-বিধানের সন্ধান সে পায় না। বরং সে দেখে, নামায ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও – যার ওপর কুরআন বার বার জোর দিয়েছে, তার জন্যও এখানে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিধান বিস্তারিতভাবে দান করা হয়নি। কাজেই এ কিতাবটি কোন্ অর্থে একটি পথনির্দেশনা ও জীবন বিধান তা বুঝতে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। পাঠকের মনে এ সন্পর্কে সন্দেহ জাগে।
সত্যের একটি দিক মানুষের দৃষ্টির সন্পূর্ন আড়ালে থেকে যাওয়ার কারণেই এ ব্যাপারে যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল এই কিতাবটিই নাযিল করেননি, তিনি এই সাথে একজন পয়গান্বরও পাঠিয়েছেন। আসল পরিকল্পনাটাই যদি হতো লোকদের হাতে এবং কেবলমাত্র একটি গৃহনির্মাণের নক্শা দিয়ে দেয়া এবং তারপর তারা সেই অনুযায়ী নিজেদের ইমারতটি নিজেরাই বানিয়ে নেবে, তাহলে এ অবস্থায় নিসন্দেহে গৃহনির্মাণ সংক্রান্ত ছোট বড় প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু গৃহনির্মাণের নির্দেশের সাথে সাথে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ারও সরকারীভাবে নিযুক্ত হয় এবং তিনি ঐ নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইমারতও তৈরি করে ফেলেন তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর নির্মিত ইমারতটিকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নক্শার মধ্যে সমগ্র ছোট বড় খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত চিত্র সন্ধান করা এবং সেখানে তা না পেয়ে নক্শাটার বিরুদ্ধে অসন্পুর্ণতার অভিযোগ আনা কোনক্রমেই সঠিক হতে পারে না। কুরআন খুঁটিনাটি বিষয়রে বিস্তারিত বিবরণ সন্বলিত কোন কিতাব নয়। বরং এই কিতার মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। এর আসল কাজ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তিগুলোর কেবল পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থাপনাই নয় বরং এই সংগে বৈজ্ঞানিক যুক্তি –প্রমান ও আবেগময় আবেদনের মাধ্যমে এগুলোকে প্রচন্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ করা। অন্যদিকে ইসলামী জীবনধারার বাস্তব কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে কুরআন মানুষকে জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগ সন্পর্কে বিস্তারিত নীতি –নিয়ম ও আইন বিধান দান করে না করং জীবনের প্রতিটি বিভাগের চৌহদ্দি বাতলে দেয় এবং সুস্পষ্টভাবে এর কয়েকটি কোণে নিশান ফলক গেঁড়ে দেয়। এ থেকে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গঠন ও নির্মাণ কোন্ পথে হওয়া উচিত, তা জানা যায়। এই নির্দেশনা ও বিধান অনুযায়ী বাস্তবে ইসলামী জীবনধারার কাঠামো তৈরি করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ ছিল দুনিয়াবাসীদের সামনে কুরআন প্রদত্ত মূলনীতি ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি চরিত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব আদর্শ উপস্থাপন করার জন্যই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
বৈধ মতপার্থক্য
আর একটি প্রশ্ন এই প্রসংগে সাধারণভাবে লোকদের মনে জাগে। প্রশ্নটি হচ্ছে, একদিকে কুরআন এমন সব লোকের কঠোর নিন্দা করে যারা আল্লাহর কিতাব অবতীর্ণ হবার পরও মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির পথে পাড়ি জমায় এবং এভাবে নিজেদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ও খন্ডিত করে। অথচ অন্যদিকে কুরআনের বিধানের অর্থ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পরবর্তীকালের আলেমগণই নন, প্রথম যুগের ইমামগণ, তাবেঈন ও সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও বিপুল মতবিরোধ পাওয়া যায়। সন্ভবত বিধান সন্বলিত এমন একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যার ব্যাখ্যায় সবাই একমত হয়েছেন। তাহলে কুরআনে উল্লেখিত নিন্দা কি এদের ওপর প্রযোজ্য হবে?যদি এরা ঐ নিন্দার পাত্র না হয়ে থাকেন, তাহলে কুরআন কোন্ ধরনের মতবিরোধ ও দলাদলির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে?
এটি একটি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। এখানে এ ধরনের আলোচনার সুযোগ নেই। কুরআনের একজন সাধারণ পাঠক ও একজন প্রাথমিক জ্ঞানার্জনকারীর সংশয় দূর করার জন্য এখানে কেবল সামান্য একটু ইংগিত দেয়াই যথেষ্ট মনে করি। দীন ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একমত এবং ইসলামী দলীয় সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ থেকেও নিছক ইসলামী জীবন বিধান ও আইনের ব্যাখ্যা –বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে আন্তরিক মতবিরোধের প্রকাশ ঘটে কুরআন তার বিরোধী নয়। বিপরীত পক্ষে কুরআন এমন ধরনের মতবিরোধের নিন্দা করে, যার সূচনা হয় স্বার্থন্ধতা ও বক্র দৃষ্টির মাধ্যমে এবং অবশেষে তা দলাদলি ও পারস্পরিক বিরোধে পরিণত হয়। এই দুই ধরনের মতবিরোধ মূলত একই পর্যায়ের নয় এবং ফলাফলের দিক দিয়েও উভয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। কাজেই একই লাঠি দিয়ে উভয়কে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং উভয়ের বিরুদ্ধে একই হুকুম জারী করা উচিত নয়। প্রথম ধরনের মতবিরোধ উন্নতির প্রাণকেন্দ্র ও মানুষের জীবনে প্রাণস্পন্দন স্বরূপ। বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল লোকদের সমাজে এর অস্তিত্ব পাওয়া যাবেই। এর অস্তিত্বই জীবনের আলামত। যে সমাজে বুদ্ধির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে বরং সেখানে রক্তমাংসের মানুষের পরিবর্তে কাঠের মানুষেরা বিচরণ করছে একমাত্র সেখানেই এর অস্তিত্ব থাকতে পারে না আর দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধটির ব্যাপারে সারা দুনিয়ার মানুষই জানে, যে দেশে ও যে সমাজে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তার অস্তিত্ব স্বাস্থ্যের নয়, রোগের আলামত। কোন উম্মাতকে সে শুভ পরিণতির দিকে এগিয়ে দিতে পারেনি। এই উভয় ধরনের মতবিরোধের পার্থক্যের চেহারাটি নিম্নোক্তভাবে অনুধাবন করুনঃ
এক ধরনের মতপার্থক্যে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যর ক্ষেত্রে সমগ্র ইসলামী সমাজে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বসম্মতিক্রমে জীবন বিধানের উৎস হিসাবে মেনে নেয়া হবে। এরপর দু’জন আলেম কোন অমৌলিক তথা খুঁটিনাটি বিষয়ের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অথবা দু’জন বিচারক কোন মামলার সিদ্ধান্ত দানে পরন্পরের সাথে বিরোধ করবেন, কিন্তু তাদের কেউই এই বিষয়টিকে এবং এর মধ্যে প্রকাশিত নিজের মতামতকে দীনের ভিত্তিতে পরিণত করবেন না। আর এই সাথে তার সংগে মতবিরোধকারীকে দীন থেকে বিচ্যুত ও দীন বহির্ভূত গণ্য করবেন না। বরং উভয়েই নিজেদের যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ পেশ করে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী অনুসন্ধানের হক আদায় করে দেবেন। সাধারণ জনমত, অথবা বিচার বিভাগীয় বিষয় হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অথবা সামাজিক বিসয় হলে ইসলামী সমাজ সংগঠনই উভয় মতের মধ্য থেকে যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করে নেবে অথবা চাইলে উভয়মতই গ্রহণ করে নেবে –এটা তাদের নির্বাচনের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
দ্বিতীয় ধরনের মতপার্থক্য করা হবে দীনের মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে। অথবা যে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রসূল দীনের মৌলিক বিষয় বলে গণ্য করেননি এমন কোন বিষয়ে কোন আলেম, সুফী, মুফতী, নীতি শাস্ত্রবিদ বা নেতা নিজে একটি মত অবলন্বন করবেন এবং অযথা টেনে হেঁচড়ে তাকে দীনের মৌলিক বিষয়ে পরিণত করে দেবেন, তারপর তার অবলন্বিত মতের বিরোধী মত পোষনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকেই দীন ও মিল্লাত বহির্ভূত গণ্য করবেন। এই সংগে নিজের একটি সমর্থক দল বানিয়ে এই মর্মে প্রচারণা চালাতে থাকবেন যে, আসল উম্মাতে মুসলিমা তো এই একটি দলই মাত্র, বাদবাকি সবাই হবে জাহান্নামের ভাগীদার। উচ্চকন্ঠে তারা বলে যেতে থাকবে ঃমুসলিম হও যদি এই দলে এসে যাও, অন্যথায় তুমি মুসলিমই নও।
কুরআনের আলোচনায় এই দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির বিরোধিতা করা হয়েছে। আর প্রথম ধরনের মতবিরোধের কতিপয় ঘটনা তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের সামনেই উপস্থাপিত হয়েছিল। তিনি এটিকে কেবল বৈধই বলেননি বরং এর প্রশংসাও করেছেন। কারণ এ মতবিরোধ প্রমাণ করছিল যে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে চিন্তা-ভাবনা করার, অনুসন্ধান –গবেষণা চালাবার এবং সঠিকভাবে বুদ্ধি প্রয়োগ করার যোগ্যতা সন্পন্ন লোকের অস্তিত্ব রয়েছে। সমাজের বুদ্ধিমান ও মেধা সন্পন্ন লোকেরা নিজেদের দীন ও তার বিধানের ব্যাপারে আগ্রহী। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি দীনের বাইরে নয়, তার চৌহদ্দির মধ্যেই জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজতে তৎপর। ইসলামী সমাজ সামগ্রিকভাবে মূলনীতিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজের ঐক্য অটুট রেখে এবং নিজের জ্ঞানবান ও চিন্তাশীল লোকদেরকে সঠিক সীমারেখার মধ্যে অনুসন্ধান চালাবার ও ইজতিহাদ করার স্বাধীনতা দান করে উন্নতি ও অগ্রগতির পথ খোলা রাখার স্বর্ণোজ্জল ঐতিহ্যের পতাকাবাহী
—— ——- ——আমি যা সত্য মনে করলাম তা এখানে প্রকাশ করলাম। আর আমল সত্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে আছে। আমার সমস্ত নির্ভরতা একমাত্র তাঁরই ওপর এবং তাঁরই কাছে আমাকে ফিরে যেতে হবে।]
কুরআন অধ্যয়নকালে একজন পাঠকের মনে যতো রকমের প্রশ্নের উদয় হয় তার সবগুলোর জবাব দেয়ার জন্য আমি এ ভূমিকা ফাঁদিনি। কারণ এ প্রশ্নগুলোর মধ্যে এমন বহু প্রশ্ন রয়েছে যেগুলো কোন না কোন আয়াত বা সূরা পাঠকালে মনে জাগে। সেগুলোর জবাব তাফহীমুল কুরআনের সংশ্লিষ্ট অংশে যথাস্থানেই দেয়া হয়েছে। কাজেই এ ধরনের প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে আমি এখানে কেবলমাত্র এমন সব প্রম্নের জবাব দিয়েছি সামগ্রিকভাবে যা সমগ্র কুরআনের সাথে সন্পর্কিত। কাজেই পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, শুধুমাত্র এই ভূমিকাটুকু পড়েই একে অস্পূর্ণ হবার ধারণা নিয়ে বসে থাকবেন না। বরং সমগ্র গ্রন্থখানি পাঠ করুন। তারপর দেখুন আপনার মনে এমন কোন প্রশ্ন রয়েছে কি –না যার জবাব পাওয়া যায়নি অথবা জবাব যথেষ্ট বলে আপনার মনে হয়নি। এ ধরনের কোন প্রশ্ন থাকলে গ্রন্থকারকে জানাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।*
*গ্রন্থাকার অবশ্যি ১৯৭১ সালে ইন্তেকাল করেছেন। কাজেই তাঁর কাছে প্রশ্ন করার আর কোন সুযোগই নেই। তবে আমার মনে হয় এ গ্রন্থ পাঠ করার পর পাঠকদের যদি কোথাও কোন অতৃপ্তি থেকে যায়, তাহলে গ্রন্থকারের বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের মধ্যে খুঁজলে তার জবাব পাওয়া যাবে। কারণ ইসলামী আন্দোলনের জন্য গ্রন্থকার যে সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করে গেছেন তার উৎস এই কুরআন এবং তাফহীমুল কুরআন। জীবনের সূচনা লগ্ন থেকে নিয়ে যেদিন থেকে তিনি কলম হাতে নিয়েছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই কুরআনী দাওয়াতের সন্প্রসারণের কাজই করে গেছেন। কাজই এ ক্ষেত্রে তাঁর সাহিত্য ভান্ডার তাঁর মূর্তমান প্রতিনিধি।
— সমাপ্ত —