দীন
আভিধানিক তত্ত্ব
আবরী ভাষায় ‘দীন’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়।
একঃ শক্তি-ক্ষমতা, শাসন-কর্তৃত্ব, অপরকে আনুগত্যের জন্যে বাধ্য করা, তার ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করা, তাকে গোলাম ও আদেশানুগত করা। যেমন বলা হয়ঃ———— অর্থাৎ লোকেদেরকে আনুগত্যের জন্যে বাধা করেছে——— অর্থাৎ আমি তাদের পরাভূত করেছি, আর তারা অনুগত হয়ে পড়েছে।———- অর্থাৎ আমি অমুক দলকে বশীভুত করে গোলাম বানিয়ে নিয়েছি। ——–অমুক ব্যক্তি মর্যাদা ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে,————– আমি তাকে এমন কাজের জন্যে বাধ্য করেছি, যার জন্যে সে রাজী ছিলো না, ———– অমুক ব্যক্তি সে কাজের জন্যে জোরপূর্বক বাধ্য হয়েছে, ———– আমি তার ওপর হুকুম চালিয়ে কর্তৃত্ব করেছি ——লোকের শাসন কর্তৃত্ব আমি অমুক ব্যক্তি সোপর্দ করেছি। এ অর্থে জনৈক কবি তার মাতাকে সম্বেধন করে বলছেঃ
—————————– তোমাকে স্বীয় সন্তানের রক্ষক-তত্ত্বাবধায়ক করা হয়েছিলো, শেষ যর্যন্ত তুমি তাদেরকে আটার চেয়েও সূক্ষ করে ছাড়লে।
হাদীস শরীফে উক্ত হয়েছেঃ-
———————— অর্থাৎ বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি, যে তার নফসকে দমন করে এমন কার্য করেছে যা তার পরকালের জন্যে কল্যাণকর। এ অর্থের দৃষ্টিতে সে ব্যক্তিকে — (দাইয়ান) বলা হয়, যে কোন দেশ জাতি বা দলের ওপর বিজয়ী হয়ে কর্তৃত্ব চালায়। আশা আলহারমাযী নবী (সঃ) কে সম্বোধন করে বলছেঃ ———– (হে মানুষের নেতা, আরবের সর্দার)। এ অর্থে –(মাদীনুন) অর্থ গোলাম আর – (মাদীনাতুন) অর্থ বাদী-দাসী। আর —- অর্থ দাসী- তনয়। কবি আখতার বলছেঃ ————
আর কোরআন বলছেঃ
——————- অর্থাৎ তোমরা যদি কারো কর্তৃত্বাধীন, অনুগত ও বাধ্য না হয়ে থাকো তাহলে মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করো না কেন?
দুইঃ দাসত্ব-অনুগত্য, সেবা, কারো জন্যে বশীভূত হয়ে যাওয়া, কারো নির্দেশাধীন হওয়া, কারো প্রভাব-প্রতাপে নিষ্পেষিত হয়ে তার মোকাবেলায় অপমান সহ্য করে নেয়া। বলা হয়ে থাকে ———- অর্থাৎ আমি তাদেরকে পরাভুত করেছি এবং তারা অনুগত হয়ে পড়েছে। ——- অর্থাৎ আমি অমুক ব্যক্তির খেদমত করেছি। হাদীসে উক্ত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ
——————- আমি কোরায়েশকে এমন এক বাক্যে অনুবতী করতে চাই যে, তারা তা স্বীকার করে নিলে সমগ্র আরব তাদের সামনে মাথা নত করবে। এ অর্থানুযায়ী আনুগত্যপরায়ণ জাতিকে বলা হয় —— (কওমুন দাইয়্যেনুন)। আর এ অর্থেই ‘হাদীসে খাওয়ারেজে’ দীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছেঃ১
১. এ হাদীসের অর্থ এ নয় যে, খারেজীরা দীন অর্থাৎ মিল্লাত থেকে বেড়িয়ে যাবে। কারণ হযরত আলী (রাঃ) -কে যখন তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ- —-তারা কি কাফের? তখন তিনি বলেছিলেনঃ ——– অর্থাৎ কুফর থেকেইতো তারা পলায়ন করেছে। আবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ ——– -তবে কি তারা মোনাফেক? তিনি বললেন, মনুফেকতো আল্লাহ্কে কম স্মরণ করে, আর তাদের অবস্থা এই যে, রাত-দিন আল্লাহ্কে স্মরণ করে আর তাঁর যিকির করে। সুতরাং এ থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, এ হাদীসে দীনের অর্থ ইমামের আনুগত্য। ইবনুল আসীর তাঁর ‘নেহায়া’ গ্রন্থে এর অর্থ লিখিছেনঃ
—————
তিনঃ শরীয়ত আইন-কানুন, পথ-পন্থা, – ধর্ম, মিল্লাত, রসম-প্রথা, অভ্যাস। যেমন বলা হয়ঃ ———- চিরকাল আমার এ পথ -পন্থা রয়েছে। ———- অর্থাৎ মানুষ ভাল-মন্দ যে কোন পন্থাই অনুসারী হোক না কেন, উভয় অবস্থাতেই, সে যে পন্থার অনুসারী তাকে দীন বলা হবে। হাদীস শরীফে আছেঃ ————- কোরায়েশ ও যারা কোরায়েশের মত-পথের অনুসারী ছিলো। হাদীসে আরও আছেঃ ———- নবুয়াতের পূর্বে নবী (সঃ) তাঁর কওমের দীনের ওপর ছিলেন অর্থাৎ বিবাহ-তালাক, মীরাস এবং অনান্য সামাজিক-তমুদ্দুনিক ব্যাপারে তিনি সেসব রীতিনীতি মেনে চলতেন যা তাঁর কওমের মধ্যে প্রবর্তিত ছিল।
চারঃ কর্মফল, বিনিময়, প্রতিদান, ক্ষতিপূরণ, ফয়সালা, হিসাব-নিকাশ। আরবী ভাষায় প্রবাদ আছেঃ ——— -মানে যেমন কর্ম, তেমন ফল। তুমি যেমন কর্ম করবে তেমন ফল ভোগ করবে। কোরআনে কাফেরদের এ উক্তি উল্লেখিত হয়েছেঃ ———– -মৃত্যুর পর আমাদের কাছ থেকে কি হিসাব নেয়া হবে? আমরা কি প্রতিফল পাবো। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর- এর হাদীসে আছেঃ
——————– তোমরা শাসকদের গালি দিও না। যদি কিছু বলতেই হয়, তাহলে বলবেঃ আল্লাহ্! তারা আমাদের সাথে যেমন করছে, তুমি তাদের সাথে তেমন করো। এ অর্থেই ——- (দাইয়্যান) শব্দটি কাজী, বিচারক, আদালতের বিচারপতি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। কোন বুযুর্গকে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ ——- নবী (সঃ) -এর পরে তিনি উম্মতের সবচেয়ে বড় কাজী ছিলেন।
কোরআনে দীন শব্দের ব্যবহার
একঃ প্রভাব-প্রতিপত্তি, অধিপত্য-কোন ক্ষমতাসীনের পক্ষ থেকে।
দুইঃ এতায়াত -বন্দেগী দাসত্ব -আনুগত্য-ক্ষমতাসীনের সামনে মাথা নতকারীর পক্ষ থেকে।
তিনঃ নিয়ন-নীতি, পথ-পন্তা যা মেনে চলা হয়।
চারঃ হিসাব-নিকাশ ফয়সালা, প্রতিদান, প্রতিফলন।
আরবাসীরা এ শব্দটিকে কখনো এক অর্থে, কখনো ভিন্ন অর্থে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতো। কিন্তু যেহেতু এ চারটি বিষয়ে আরবদের ধারণা সম্পূর্ণ স্পষ্ট ছিল না; খুব একটা উন্নতও ছিল না, তাই শব্দটির ব্যবহারে অস্পষ্টতা ছিল। ফলে তা কোন বিধিবদ্ধ চিন্তাধারার পারিভাষিক শব্দ হতে পারে নি। কোরআন এ শব্দটিকে আপন উদ্দেশ্যের জন্যে উপযুক্ত বিবেচনা করে একেবারে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অর্থের জন্য ব্যবহার করেছে। কোরআনের ভাষায় দীন শব্দটি একটি পরিপূর্ণ বিধানের প্রতিনিধিত্ব করে। চারটি অংশ নিয়ে সে বিধান গঠিতঃ
একঃ সার্বোভৌমত্ব, সবোর্চ্চ ও সার্বিক ক্ষমতা।
দুইঃ সার্বোভৌমত্বের মোকাবেলায় আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য।
তিনঃ এ সার্বোভৌমত্বের প্রভাবধীনে গঠিত চিন্তা ও কর্মধারা।
চারঃ সে ব্যবস্থায় আনুগত্যের পুরস্কার বা বিদ্রোহ-বিরোধিতার শাস্তিস্বরূপ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে প্রদত্ত প্রতিদান-প্রতিফল।
কোরআন কখনো প্রথম অর্থে, কখনো দ্বিতীয় অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছে। কখনো তৃতীয় অর্থে, আবার কখনো চতুর্থ অর্থে। কখনো ‘আদ-দীন’ বলে অংশ অংশচতুষ্টয়সহ পুরো ব্যবস্থাটাই গ্রহণ করেছে। তা স্পষ্ট করে জানার জন্যে কোরআনের নিম্মোক্ত আয়াতগুলো লক্ষ্য করুনঃ
দীন প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে
————————- তিনি আল্লাহ্, যিনি তোমাদের জন্যে যমিনকে বাসস্থান করেছেন, আর আসমানকে করেছেন ছাদ, তোমাদের আকৃতি দান করেছেন এবং তাকে কতই না সুন্দর করেছেন! যিনি পবিত্র বস্তু থেকে তোমাদের রিজিক সরবরাহ করেছেন। সে আল্লাহ্ই তোমাদের রব। রাব্বুল আলামীন, মহান মর্যাদার অধিকারী-বরকতের মালিক। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যে নিবেদিত করে তোমরা তাঁকেই ডাকো। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। -আল-মুমিন-৬৪-৬৫
———————— বল, একান্তভাবে দীনকে তাঁর জন্যে খালেছ করে আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্যেই আমি আদিষ্ট হয়েছি। সর্বোপ্রথম আনুগত্যের শির নত করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। …….বল, আমার দীনকে আল্লাহ্র জন্যে খালেছ করে আমি তাঁর ইবাদত করবো। তোমাদের ইখতিয়ার আছে, তাঁকে বাদ দিয়ে যাকে খুশী তার বন্দেগী করে বেড়াতে পার। … আর যারা তাগুতের বন্দেগী হতে নিবৃত্ত থেকে আল্লাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের জন্যে রয়েছে সুসংবাদ।-আজজুমার-১১-১৭
————————- আমরা তোমার প্রতি সত্য-সঠিক গ্রন্থ নাজিল করেছি। সুতরাং আল্লাহ্র জন্যে দীনকে খালেছ করে কেবল তাঁরই ইবাদত কর। দীন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র-ই-জন্যে নিবেদিত-নিদিষ্ট।-আজজুমার -২.৩
আসমান জমীনে যা কিছু আছে, সবাই আল্লাহ্র। দীন একান্তভাবে তাঁরই জন্যে নিবেদিত। তবুও কি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে তোমরা ভয় করবে-তাকওয়া করবে? (অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত এমন কেউ আছে কি, যার নির্দেশে অবাধ্যতা থেকে তোমরা বিরত থাকবে এবং যার অসন্তুষ্টিকে তোমরা ভয় করবে।-আন-নাহাল-৫২
—————– তারা কি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দীন তালাশ করছো? অথচ আসমান-জমীনের সমূদয় বস্তুর ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আল্লাহ্রই নির্দেশানুবর্তী।আর তাঁরই কাছে তাদেরকে ফিরে যেতে হবে।-আল-ইমরান-৮৩
——————– দীনকে একনিষ্টভাবে আল্লাহ্র জন্যে খালেছ করা ব্যতীত তাদেরকে অন্য কিছুর নির্দেশ দেয়া হয় নি। -আল-বাইয়েনা-৫
——————- এসব আয়াতে সবোর্চ্চ ক্ষমতা এবং সে ক্ষমতা স্বীকার করে তার বন্দেগী-আনুগত্য কবুল করার অর্থে দীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্র জন্যে দীনকে খালেছ করার অর্থ এই যে, মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সাবোর্ভৌমত্ব, শাসন-কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্বীকার করবে না, আপন দাসত্ব-আনুগত্যকে এমনভাবে রর জন্যে খালেছ করবে, যাতে অন্য কারো সরাসরি আনুগত্যকে আল্লাহ্র আনুগত্যের সাথে শরীক করবে না মোটেই।১
দীন তৃতীয় অর্থে
————————— বল, হে লোক সকল! আমার দীন সম্পর্কে তোমাদের যদি কোন সন্দেহ থাকে (অর্থাৎ আমার দীন কি সে সম্পর্কে তোমাদের যদি স্পষ্ট জানা না থাকে) তবে শোনঃ তোমরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যাদের বন্দেগী আনুগত্য করছো, আমি ১. অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যার -আনুগত্যই করবে, তা করবে আল্লাহ্র আনুগত্যের অধীনে এবং তাঁরই নির্ধারিত সীমা-রেখার মধ্যে। পুত্র কর্তৃক পিতার আনুগত্য, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর আনুগত্য, গোলাম-চাকর কর্তৃক মনিবের আনুগত্য এবং এ ধরনের অন্য সকল প্রকার আনুগত্য যদি আল্লাহ্র নির্দশের ভিত্তিতে হয়, হয় তাঁর নির্ধারিত সীমা রেখার ভেতরে, তবে তা হবে অবিকল আল্লাহ্রই আনুগত্য। আর যদি তা আল্লাহ্ বিধি-নিষেধ এবং সীমারেখা থেকে মুক্ত হয়, অন্য কথায় তা যদি স্বতন্ত্র আনুগত্য হয়, তা আনুগত্য হবে না; হবে আল্লাহ্র নির্দেশের সাথে প্রকাশ্য বিদ্রোহ-সরাসরি তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা যদি আল্লাহ্র আইনেরও ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁরই নির্দেশ জারি করে, তবে তার আনুগত্য ফরজ-বাধ্যতামূলক। আর যদি এমন না হয়, তবে তার আনুগত্য অপরাধ-এক ধরনের পাপ।
তাদের বন্দেগী আনুগত্য করি না, বরং আমি সে আল্লাহ্র বন্দেগী করি, যিনি তোমাদের জান কবজ করেন! যারা এ আল্লাহ্কে মানে, তাদের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার জন্যে আমি আদিষ্ট- নির্দেশিত। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে; একান্তভাবে এ দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক এবং কিছুতেই শিরকবাদীদের পর্যায়ভুক্ত হয়ো না।
——————— শাসন-কর্তৃক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো নয়। তাঁরই নির্দেশ, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী করো না। এটাই সত্য-সঠিক দীন।
———————- আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সবই তাঁর। সকলেই তাঁর হুকুমের তাবেদার।……….. তোমাদের বোঝবার জন্যে তিনি স্বয়ং তোমাদের ব্যাপার থেকেই একটি উদাহরণ পেশ করছেন। বল, এই যে গোলাম তোমাদের অধীন, আমি তোমাদেরকে যে সব জিনিস দিয়েছি, তাদের কেউ কি সে সব বিষয়ে তোমাদের অংশীদার? তোমরা কি সম্পদের মালিকানায় তাদেরকে তোমাদের সমান অংশীদার কর? তোমরা কি নিজেদের সমপর্যায়ের লোকদের মতো তাদেরকে সমীহ করে থাকো?. সত্য কথা এই যে, এসব যালেমরা জ্ঞান-বুদ্ধি ছাড়াই নিছক নিজেদের খেয়ালখুশীর পেছনে ছুটে চলছে।.সুতরাং তুমি একান্তভাবে নিজেকে সে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো; আল্লাহ্ যে ফিতরাত প্রকৃতির ওপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তুমি তাকেই অবলম্বন কর। আল্লাহ্র বানানো গঠন-আকৃতিতে যেন কোন পরিবর্তন না হয়।১ এটাই সত্য-সঠিক দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞতার মধ্যে পড়ে আছে।
১. অর্থাৎ যে গঠন-প্রকৃতিতে আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাতে এই যে, মানুষের সৃষ্টি, তার রিজিক সরবরাহ করণ, তার রুবুবিয়াত করণ, তার রুবুবিয়াতে স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ শরীক নেই। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মানুষের খোদা নয়, নয় মালিক-মোক্তার-সত্যিকার আনুগত্য পাবার যোগ্য। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়ম এই যে, মানুষ শুধূ আল্লাহ্রই বান্দা হবে-অন্য কারো বান্দা হবে না।
————- ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণী-উভয়কে একশো চাবুক মারো। রর দীনের ব্যাপারে তোমরা যেন তাদের ওপর দয়া না কর।-নূর-২
————————— যখন থেকে আল্লাহ্ আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকে তাঁর বিধানে মাসের সংখ্যা চলে আসছে ১২ টি। এর মধ্যে চারটি হচ্ছে হারাম-সম্মনার্হ। এটাই সত্য- সঠিক দীন।-তওবা-৩৬
———————- আর এমনি করে আমরা ইউসুফের জন্যে পথ বের করেছি। বাদশার বিধানে তার ভাইকে পাকড়াও করা তার জন্যে বৈধ ছিলো না।-ইউসুফ-৭৬
————————————— আর এমনি করে অনেক মুশরিকদের জন্যে তাদের বানানো শরীকরা১ তাদের সন্তান হত্যাকে একটি চমৎকার কার্যে পরিণত করে দিয়েছে, যেন তাদেরকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলতে পারে। আর তাদের জন্যে তাদের দীনকে করে তোলে সন্দেহের বস্তু।২-আল-আনআম-১৩৭
———————————— তারা কি এমন কিছু শরীক বানিয়ে নিয়েছে, যারা তাদের জন্যে দীনের অনুরূপ এমন আইন রচনা করে, আল্লাহ্ যার অনুমতি দেন নি?-শূআরা-২১
১. শরীকের মানে প্রভুত্ব, আধিপত্য এবং আইন প্রণয়নের আল্লাহ্র শরীক।
২.দীনকে সন্দেহের বস্তু করার অর্থ এই যে, মিথ্যা শরীয়ত প্রণেতারা পাপকে এত সুদর্শন করে পেশ করে, যাতে আরবের লোকেরা সন্দেহ পড়ে যায় যে, সম্ভবত এ কাজটি সে দীনের অংশ বিশেষ যা প্রথমত তারা হযরত ইবরাহীম ও ইসরাঈল (আঃ) থেকে লাভ করেছিলো।
—————– তোমাদের জন্যে তোমাদের দীন, আর আমার জন্যে আমার দীন।-কাফেরুন-৬
এসব আয়াতে দীনের অর্থ-আইন-বিধান, নিয়ম-কানুন, শরীয়ত, পথ-পন্থা এবং সেসব চিন্তা এ কর্মধারা, মানুষ যা মেনে চলে জীবন যাপন করে। যে ক্ষমতার সনদ অনুযায়ী কোন বিধি-ব্যবস্থা মেনে চলা হয়, তা যদি আল্লাহ্র তরফ থেকে হয়, তবে মানুষ আল্লাহ্র দীনে আছে; আর তা যদি হয় কোন রাজা-বাদশার, তাহলে মানুষ হবে রাজা-বাদশার দীনে। তা যদি হয় পন্ডিত পুরোহিতের, তাহলে মানুষ হবে তাদের দীনে। আর তা যদি হয় বংশ-গোত্র, সমাজ বা গোটা জাতির, তবে মানুষ হবে তাদের দীনে। মোদ্দাকথা, যার সনদকে চূড়ান্ত সনদ এবং যার ফযসালাকে চূড়ান্ত ফয়সালা মনে করে মানুষ কোন ব্যবস্থা মেনে চলে, সে তার দীনেরই অনুসারী।
দীন চতুর্থ অর্থে
——– যে সংবাদ সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করা হচ্ছে (অর্থাৎ মৃত্যু পরপারের জীবন) তা নিশ্চিত সত্য এবং দীন অবশ্যই ঘটবে।
——————— তুমি কি তাকে দেখেছো, যে দীনকে অস্বীকার করে? এই সে ব্যক্তি, যে এতিমকে ধাক্কা দেয়, মিসকীনদের খাবার ব্যাপারে উৎসাহিত করে না।-মাউনঃ১-৩
—————————- তুমি কি জান, ইয়াওমুদ্দীন কি? হাঁ, তুমি কি জান, কি ইয়াওমুদ্দীন? ইয়াওমুদ্দীন সেদিন, যেদিন অন্যের কাজে আসার কোন ইখতিয়ারই থাকবে না কোন মানুষের। সেদিন সব ইখতিয়ারই থাকবে রবের হাতে। -আল-আনফিতার-১৭-১৯
এসব আয়াতে দীন শব্দটি হিসেব-নিকেশ, ফয়সালা ও কর্মফল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
দীন একটি ব্যাপক পরিভাষা
আরববাসীদের বোলচালে যেসব অর্থে এ শব্দটি ব্যবহৃত হতো, এ পর্যন্ত কোরআন এ শব্দটিকে প্রায় সে অর্থেই ব্যবহার করেছে। এরপর আমরা দেখেছি, কোরআন এ শব্দটিকে একটি ব্যাপক পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার করছে। কোরআন এর অর্থ করছে। কোরআন এর অর্থ করছে, এমন এক জীবন ব্যবস্থা, যাতে মানুষ কারো সর্বোচ্ছ ক্ষমতা স্বীকার করে তার আনুগত্য-আধিপত্য কবুল করে। তার বিধি-বিধান ও আইনের অধীনে জীবন যাপন করে। তার নির্দেশ মেনে চলার জন্যে মর্যাদা, তরক্কী ও পুরস্কারের আশা করে আর তার নাফরমানী, অবধ্যতার জন্যে অপমান-লাঞ্ছনা ও শাস্তির ভয় করে। সম্ভবত দুনিয়ার কোন ভাষায় এত ব্যাপক শব্দ নেই, যা এর সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করতে পারে। আধুনিককালের স্টেট (State) শব্দটি অনেকটি এর কাছাকাছি পৌছেছে। কিন্তু ‘দীন’ শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করার জন্যে এখনো অনেক সম্প্রসারণ প্রয়োজন।
নিম্মোক্ত আয়াতসমূহে এ ‘দীন’ পারিভাষিক শব্দ হিসাবেই ব্যবহৃত হয়েছে।
————————— আহলে কিতাবের মধ্যে যারা আল্লাহ্কে মানে না (১) (অর্থাৎ তাঁকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার একক অধিকারী স্বীকার করে না) ইয়াত্তমূল আখেরাত-শেষদিন (অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ ও প্রতিফলনের দিন মানে না) (২) আল্লাহ্ ও তার রাসূল যেসব জিনিসকে হারাম করেছেন, তাকে হারাম বলে স্বীকার করে না, (৩) দীনে-হককে নিজেদের দীন হিসেবে গ্রহণ করে না, (৪) তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা নিজেদের হাতে জিযিয়া দান করে এবং ছোট হয়ে বসবাস করে।-তওবা-২৯
এ আয়াতে ‘দীনে হক’ একটি পারিভাষিক শব্দ। পরিভাষার প্রয়োগকর্তা আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই এ ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন প্রথম তিনটি বাক্যাংশে। আমরা নম্বর দিয়ে দেখিয়েছি যে, দীন শব্দের চারটি অর্থই এ বাক্যাংশগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে। আর তার সমষ্টিকেই ‘দীনে-হক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
——————————— ফিরাউন বললোঃ ছেড়ে দাও আমাকে, আমি মূসাকে হত্যা করে ছাড়বো। এখন সে তার রবকে ডাকু্ক। আমার আশংকা, সে যেন তোমাদের দ্বীন বদলিয়ে না ফেলে এবং দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে না বসে। -আল-মুমিন-২৬
কোরআনে মূসা ও ফিরাউনের কাহিনীর যতো বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, তাকে সামনে রাখার পর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই থাকে না যে, এখানে ‘দীন’ নিছক ধর্মের অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। বরং ব্যবহৃত হয়েছে রাষ্ট্র (State) ও তমুদ্দুন ব্যবস্থার অর্থে। ফিরাউনের বক্তব্য ছিলঃ মূসা যদি তার মিশনে জয়ী হয়, তাহলে ‘স্টেট’ বদলে যাবে। তদানীন্তন ফিরাউনদের শাসন-কর্তৃক এবং প্রচলিত আইন-প্রথার ভিত্তিতে যে জীবন ব্যবস্থা চলছে, তা সমূলে উৎপাটিত হবে। তার স্থলে হয় ভিন্ন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা আদৌ কোন ব্যবস্থা-ই প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং সারা দেশে বিশৃংখলা ছিড়িয়ে পড়বে।
—————————— মূলত আল্লাহ্র কাছে ইসলামই হচ্ছে দীন। -আলে -ইমরান-১৯
—————————- আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন তালাশ করবে, তার কাছ থেকে সে দীন কখনো গৃহীত হবে না।-আল-ইমরান-৮৫
——————————– তিনি আল্লাহ্, যিনি তাঁর রাসূলকে সঠিক পথ নির্দেশ এবং ‘দীন হক’ সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি তাকে সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকদের কাছে তা অসহ্য। -তওবা-৩৩
—————- তুমি তাদের সাথে লড়াই করে যাও, যতক্ষণ না ফেতনা বিদূরিত হয়ে যায় এবং দীন সর্বতোভাবে আল্লাহ্র জন্যে হয়ে যায়।-আল-আনফাল-৩৯
————————————- যখন আল্লাহ্র সাহায্য উপস্থিত হয়, বিজয় লাভ হয়, আর তুমি দেখতে পাও, লোকেরা দলে দলে আল্লাহ্র দীনে দাখিল হচ্ছে; তখন তোমার রবের প্রশংসা-স্তুতি কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমার আবেদন কর। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল।-আন-নাসর
এসব আয়াতে দীনের অর্থ পরিপূর্ণ জীবন বিধান। চিন্তা, বিশ্বাস, নীতি ও কর্মের সকল দিকই এ পর্যায়ভুক্ত।
প্রথম দুটি আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্র নিকট মানুষের জন্যে সঠিক জীবন ব্যবস্থা একমাত্র তা-ই, যা কেবল আল্লাহ্র আনুগত্য ও বন্দেগী (ইসলাম)-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া অন্য কোন জীবন ব্যবস্থা -কল্পিত ক্ষমতার আনুগত্যের ওপর যার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত-বিশ্ব-জাহানের মালিকের নিকট কিছুতেই গ্রহনীয় নয়। স্বভাবত তা হতেও পারে না। কারণ মানুষ যাঁর সৃষ্ট, অধীন ও প্রতিপালিত, যাঁর রাজ্যে প্রজার মতো সে বসবাস করে, তাঁকে ছাড়া অন্য কোন ক্ষমতার বন্দেগী-আনুগত্যে জীবন যাপন করার এবং অন্য কারো নির্দেশমতো চলার অধিকার মানুষের রয়েছে-তিনি তা কিছুতেই মানতে পারেন না।
তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে যে সত্য-সঠিক জীবন বিধান অর্থাৎ ইসলাম সহকারে পাঠিয়েছেন, আর তাঁর মিশনের চরম লক্ষ্য হচ্ছে, এ জীবন বিধানকে সকল জীবন বিধানের ওপর বিজয়ী করা।
চতুর্থ আয়াতে দীন ইসলামের অনুসারীদের নির্দেশ হয়েছেঃ দুনিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাও, ফেতনা অর্থাৎ খোদাদ্রোহী বিধানের অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে নির্মূল -নিশ্চিহ্ন হয়ে আনুগত্য ও বন্দেগীর সকল বিধান আল্লাহ্র জন্যে নিবেদিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা শান্ত হয়ো না।
পঞ্চম আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে সম্বোধন করা হয়েছে দীর্ঘ তেইশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার পর আরবে বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর এ সম্বোধন করা হয়েছে। ইসলাম তার পরিপূর্ণ বিস্তৃতরূপে একটি চিন্তা-বিশ্বাস, নীতি, শিক্ষা, সমাজ, তমুদ্দুন, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব বিষয়ের পরিপূর্ণ বিধান হিসাবে কার্যত প্রতিষ্ঠিত। আরবের প্রত্যন্তর প্রান্ত থেকে দলে দলে সে বিধানের ছায়াতলে লোকেরা আশ্রয় নিচ্ছিলো। এমনিভাবে মুহাম্মদ (সঃ) যে কাজের জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন, তার সমাপ্তি ঘটলে তাঁকে বলা হয়, এ কার্যকে নিজের কীর্তি মনে করে যেন গর্বিত হয়ে না পড়; ত্রুটিমুক্ত ও পরিপূর্ণ সত্তা একমাত্র তোমার রবের, অন্য কারো নয়। সুতরাং এ মহান কার্য সম্পাদনের জন্যে তাঁর প্রশংসা-স্তুতি প্রকাশ কর এবং তাঁর দরবারে আবেদন করঃ প্রভু পরওয়ারদেগার! দীর্ঘ তেইশ বছরের এ খেদমতকালে আমার দ্বারা যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেছে, তা ক্ষমা করে দাও!
সমাপ্ত —-