৮৬। হযরত ইবরাহীম (আ) ও ভিক্ষুক
বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীম(আ) এত অতিথিপরায়ণ ছিলেন যে, প্রতিদিন অন্তত একজন অতিথিকে সাথে না নিয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন না।
একদিন সারাদিনেও তিনি কোন অতিথি খুঁজে পেলেন না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সময় তিনি যখন হতাশ হয়ে গৃহের ভেতর প্রবেশ করতে যাবেন এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে হাজির হলো। তিনি পরম আনন্দে ভিক্ষুককে বসালেন এবং খাবার দিলেন।
সারা দিনের ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকটি খাবার পেয়েই গোগ্রাসে খেতে শুর করল। হযরত ইবরাহীম দেখলেন, বিসমিল্লাহ না বলেই ভিক্ষুকটি খাওয়া শুরু করেছে এবং বুভুক্ষের মত গিলছে। আল্লাহর প্রিয় নবী ইবরাহীম(আ)এর এটা সহ্য হলো না। তিনি ক্রদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “কি হে! তুমি খাওয়ার আগে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলে না যে!”
ভিক্ষুক বললোঃ (নাউজুবিল্লাহ) আমি বাপু আল্লাহ-টাল্লা মানিনে। খাবার পেলে খাবো, না পেলে উপোষ করবো। এর সাথে আবার আল্লাহর নাম নেবার কি সম্পর্ক।
হযরত ইবরাহীম(আ) রেগে আগুন হয়ে বললেনঃ তবেরে হতভাগা! এর একটি দানাও তুই স্পর্শ করতে পারবি নে। এক্ষুনি দুর হ আমার সামনে থেকে।
বেচারা ভিক্ষুক আর কি করবে! এক,দুগ্রাস খেয়েছিল। এর মাঝে হযরত ইবরাহীম(আ) তার খাবারের থালাটা কেড়ে নিয়েছেন। অগত্যা সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিদায় হলো।
কিছুক্ষণ পরেই ওহী এল। আল্লাহ ধমকের সুরে হযরত ইবরাহীমকে (আ) বললেন, “হে ইবরাহীম! দীর্ঘ আশি বছর যাবত এই অবিশ্বাসী নাস্তিককে আমি আমার পৃথিবীতে চলাফেরা ও বসবাস করতে দিয়েছি, খাবার সরবরাহ করেছি। আর তুমি কিনা একটি বেলাও তাকে সহ্য করতে ও খাওয়াতে পারলে না।”
অনুতপ্ত হয়ে হযরত ইবরাহীম(আ) ভিখারীটিকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না। সেই থেকে হযরত ইবরাহীম(আ) মুমিন ও কাফির নির্বিশেষে সকল মানুষকে দয়া প্রদর্শন করতে এবং সব রকমের অতিথিকে সমাদর করতেন।
শিক্ষাঃ
বিপন্ন মানুষের সেবা করার ব্যাপারে জাতি ধর্ম বর্ণ প্রভৃতির ভেদাভেদ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূল(সা) অমুসলিম পথিক বা অতিথিকে পরম সমাদরে আপ্যায়ন করাতেন-এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। হযরত ঈসা(আ) ও অন্যান্য নবীদের জীবনেও এর নজীর রয়েছে। অমুসলিম দরিদ্র ব্যক্তিকে যাকাতের টাকা বা জিনিসপত্র এবং অন্যান্য নফল সদকাও দেয়া যায়। তবে অমুসলিমের ব্যাপারে ইসলাম যে তিনটি জিনিসকে গুরুত্ব দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে তাহলো এই যে,
১. কোন মুসলিমের চেয়ে তাকে অগ্রাধিকার দেয়া যাবে না।
২. তাদের সাথে নিষ্প্রয়োজনে বন্ধুত্ব ও মাখামাখি করা যাবে না।
৩. মুসলমানদের নেতৃত্ব ও শাসনক্ষমতায় তাদেরকে অংশীদার করা যাবে না।
৮৭। হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও তদীয় পরিবারের মক্কায় পুনর্বাসন
মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ:
হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কোন মহতী পরিকল্পনা লুক্কায়িত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাঈল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না।
অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি সহ তাদের বিজনভূমিতে রেখে যখন ইবরাহীম (আঃ) একাকী ফিরে আসতে থাকেন, তখন বেদনা-বিস্মিত স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে লাগলেন। আর স্বামীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইবরাহীমের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তখন হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এভাবে ফেলে যাচ্ছেন? ইবরাহীম ইশারায় বললেন, হ্যাঁ। তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে উঠলেন, إذَنْ لايُضَيِّعُنَا اللهُ ‘তাহ’লে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না’। ফিরে এলেন তিনি সন্তানের কাছে। দু’একদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কি হবে উপায়? খাদ্য ও পানি বিহনে বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে কচি বাচ্চা কি খেয়ে বাঁচবে। পাগলপরা হয়ে তিনি মানুষের সন্ধানে দৌঁড়াতে থাকেন ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ মাথা আর ও মাথায়। এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণার ফল্গুধারা, জিব্রীলের পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল। ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়ায শুনে তিনি চমকে উঠলেন। উনি জিবরীল। বলে উঠলেন, لا تخافوا الضَّيعةَ، إنَّ هذا بيتُ الله يَبْنى هذا الغلامُ و أبوه وإن الله لايُضيعُ أهلَه- ‘আপনারা ভয় পাবেন না। এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনর্নির্মান করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’। বলেই শব্দ মিলিয়ে গেল’।
অতঃপর শুরু হ’ল ইসমাঈলী জীবনের নব অধ্যায়। পানি দেখে পাখি আসলো। পাখি ওড়া দেখে ব্যবসায়ী কাফেলা আসলো। তারা এসে পানির মালিক হিসাবে হাজেরার নিকটে অনুমতি চাইলে তিনি এই শর্তে মনযুর করলেন যে, আপনাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হবে। বিনা পয়সায় এই প্রস্তাব তারা সাগ্রহে কবুল করল। এরাই হ’ল ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। বড় হয়ে ইসমাঈল এই গোত্রে বিয়ে করেন। এঁরাই কা‘বা গৃহের খাদেম হন এবং এদের শাখা গোত্র কুরায়েশ বংশে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে।
ওদিকে ইবরাহীম (আঃ) যখন স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে যান তখন হাজেরার দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এই বলে,
رَّبَّنَا إِنِّيْ أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِيْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِيْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِيْ إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ- (ابراهيم ৩৭)-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদামন্ডিত গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। প্রভুহে! যাতে তারা ছালাত কায়েম করে। অতএব কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর। সম্ভবত: তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে’।
ইসমাইলের মা ঐ পানি পান করতে ও ইসমাঈলকে দুধ খাইয়ে লালন পালন করতে লাগলেন। যখন পানি ফুরিয়ে গেল, উভয়ে পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। শিশু ইসমাঈল তখন ভীষণভাবে ছটফট করছেন। তা দেখে হাজেরা অস্থির হয়ে নিকটবর্তী সাফা পাহাড়ে কোন মানুষ বা পানি পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কিছুই পেলেন না। সেখান থেকে মারওয়া পাহাড়ে গেলেন। কিন্তু কিছুই ফেলেন না সেখানেও। নিরূপায় ও দিশেহারা অবস্থায় তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার ছুটোছুটি করলেন। বস্তুতঃ এ কারণেই মানুষ সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে ছুটোছুটি করে থাকেন। সহসা মারওয়ায় দাঁড়িয়ে তিনি একটি আওয়াজ শুনলেন। হাজেরা সেই অজানা আওয়াজ উত্থাপনকারীকে বললেনঃ “তোমার আওয়াজ আমার কানে পৌঁছেছে। তবে তোমার কাছে কোন সাহায়্যের উপকরণ আছে কিনা জানাও।” সহসা দেখলেন, জমজমের স্থানে এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে আছে। সেই ফেরেশতা তাঁর পাখা দিয়ে একটু মাটি খুঁড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে পানি বেরিয়ে এলো। হযরত হাজেরা তাঁর মশকটিতে পানি ভরে নিলেন। রাসূল (সা) বলেন, “হাজেরা যদি সাথে সাথে পানিতে হাত না দিতো তবে তা একটি বিরাট নদীতে পরিণত হতো।” হযরত হাজেরা সেই পানি নিজে পান করলেন এবং ইসমাঈলকে দুধ খাওয়ালেন। ফেরেশতা তাকে বললেনঃ তুমি চিন্তিত হয়ো না। এই স্থানে আল্লাহর একটি ঘর আছে। এই শিশু ও তার বাবা ঘরটি নতুন করে নির্মাণ করবে। এই ঘরের প্রতিবেশীদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করবেন না।
তারপর হাজেরা ও ইসমাঈল বসবাস করতে লাগলেন। হযরত ইবরাহীম মাঝে মাঝে তাদেরকে দেখতে আসতেন। আবার চলে যেতেন। (ইত্যবসরে ইসমাঈলের কুরবানির ঘটনা ঘটে)। ইতিমধ্যে জমজমের পানির সুবাদে ঐ এলাকায় মানব বসতি গড়ে ওঠে ও যৌবনে পদার্পন করার পর হযরত ইসমাইল বিয়ে করেন।
একদিন হযরত ইবরাহীম হযরত ইসমাইলের গৃহে এলেন। তখন হাজেরার ইন্তিকাল হয়েছে এবং ইসমাইলের স্ত্রী গৃহে ছিলেন। হযরত ইবরাহীম পুত্রবধূকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসমাইল কোথায়? সে বললোঃ খাদ্য সংগ্রহ করতে বাইরে গেছেন।
হযরত ইবরাহীমঃ তোমরা কেমন আছ?
পু্ত্রবধুঃ আমরা খুব অনটনে ও দুরবস্থায় আছি।
হযরত ইবরাহীমঃ ইসমাইল এলে তাকে আমার ছালাম দিও এবং বলো, সে যেন ঘরের কপাটটি পাল্টে ফেলে। এই বলে পুত্রবধুকে নিজের পরিচয় না দিয়ে ইবরাহীম(আ) প্রস্থান করলেন।
ইসমাইল গৃহে ফিরলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আগন্তুক ও তার সাথে তার কথোপকথনের বিবরণ দিলেন। হযরত ইসমাইল বৃদ্ধ আগন্তুকের হুলিয়া ও কথোপকথনের বিবরণ শুনে বললেন, “উনি আমার পিতা। আমাকে তোমার কাছ হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও।” অতঃপর ইসমাইল তাকে তালাক দিয়ে নতুন স্ত্রী ঘরে আনলেন।
কিছুদিন পর পুনরায় ইবরাহীম (আ) এলেন। এদিনও ইসমাইল গৃহে ছিলেন না। নতুন পুত্রবধু ছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার স্বামী কোথায়? সে বললোঃ তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনতে গেছেন। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কেমন আছ?” সে বললো, “আল্লাহর শোকর, আমরা খুব ভাল আছি।”
হযরত ইবরাহীমঃ তোমরা কি খাও?
পুত্রবধুঃ গোশত।
হযরত ইবরাহীমঃ কি পান কর?
পুত্রবধুঃ পানি।
হযরত ইবরাহীমঃ হে আল্লাহ! এদের খাদ্য ও পানিতে বরকত দাও।
রাসূল(সা) বলেনঃ সেদিন ইসমাইলের ঘরে কোন চাউল বা গম ছিল না। থাকলে সেগুলিতেও তিনি বরকত কামনা করতেন। আজ মক্কায় যে খাদ্যের প্রাচূর্য, তা হযরত ইবরাহীমের দোয়ার ফল।
হযরত ইবরাহীম বললেনঃ ইসমাইল এলে তাকে বলো, সে যেন তার ঘরের কপাট আর না পাল্টায়।
অতঃপর ইসমাইল গৃহে ফিরলে তাঁর স্ত্রী তাকে সমস্ত ঘটনা জানালেন। ইসমাইল বললেনঃ এই আগন্তুক আমার পিতা। ‘কপাট’ বলে তিনি তোমার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এবং তোমাকে বহাল রাখতে বলেছেন।
কিছুদিন পর হযরত ইবরাহীম এসে ইসমাইলকে জানালেন যে, আল্লাহ তাকে কাবাশরীফ পুনঃনির্মাণের আদেশ দিয়েছেন। ইসমাইল সানন্দে সায় দিলেন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। ইসমাইল পাথর বয়ে আনেন এবং হযরত ইবরাহীম কাবা নির্মাণ করেন। (সংক্ষেপিত) (বুখারী)।
শিক্ষাঃ
এই ঘটনাটি বহু মূল্যবান শিক্ষায় পরিপূর্ণ। যেমনঃ
১. সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। সংসারে অভাব অনটন থাকলে তা মানুষের কাছে ব্যক্ত করা অনুচিত।
২. ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা এবং এজন্য পরিবার পরিজনকে রেখে বিদেশে সফরের প্রয়োজন হলে তাতেও কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। বিশেষতঃ মুমিন মহিলাদের পক্ষ থেকে পুরুষদেরকে এ ব্যাপারে বাধা দেবার পরিবর্তে উৎসাহ দেয়া কর্তব্য।
৩. আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতার অর্থ খাদ্য দ্রব্যের সন্ধানে চেষ্টা না চালিয়ে ঘরে বসে থাকা নয়। হযরত হাজেরা স্ত্রীলোক হয়েও দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ঘরে রেখে খাদ্য ও পানির সন্ধানে বাইরে ছুটাছুটি করছিলেন। হালাল রুজীর সন্ধানে পর্দা সহকারে বাইরে যাওয়া নারীর জন্যও অবৈধ নহে। তবে স্থায়ী পেশা হিসেবে বহিরাঙ্গনে (যেখানে পুরুষদের উপস্থিতি রয়েছে) চলাফেরা এড়িয়ে চলাই উত্তম।
৪. পুরুষদের ইসলামী দাওয়াতের কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও নিজ পরিবারের লোকজনদের নৈতিকতা ও তাকওয়া পরহেজগারীর তদারকী অব্যাহত রাখা কর্তব্য এবং তাদের সততা অনুশীলনের বাধা অপসারণ করা অত্যন্ত জরুরী।
৮৮। হযরত মূসা (আ) ও পানির বোতল
হযরত আবু হুরায়রা(রা) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল(সা) বলেন, একবার হযরত মূসা(আ) এর মনে প্রশ্ন জাগলো যে, আল্লাহ তায়ালা কেন ঘুমান না? আল্লাহ তার মনের প্রশ্ন জানতে পেরে তার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠালেন। এই ফেরেশতা হযরত মূসার(আ) দুই হাতে দুটি পানিভর্তি বোতল দিয়ে তা ধরে রাখতে বললেন এবং যতক্ষণ অনুমতি না দেয়া হবে, ততক্ষণ বোতল কোথাও নামিয়ে রাখা চলবে না বলে সাবধান করে দিলেন। হযরত মূসা ফেরেশতাকে আল্লাহর প্রেরিত মনে করে তার আদেশকেও আল্লাহর আদেশ বলে বিশ্বাস করলেন এবং তদনুযায়ীয় কাজ করলেন।
দীর্ঘ সময় বোতল দুটি ধরে রাখতে রাখতে তিনি ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর দু’চোখে ঘুম আসতে লাগলো। যখনই ঘুম গাঢ় হয় অমনি দু’হাতের বোতল দুটি কাছাকাছি চলে আসে এবং সংঘর্ষের উপক্রম হয়। অমনি ফেরেশতা তাকে জাগিয়ে দেন এবং তিনি সতর্ক হয়ে যান। এক সময় তার ঘুম অত্যন্ত প্রবল হলো। দু’হাতের বোতল দু’টো প্রচন্ড শব্দে পরস্পর আঘাত লেগে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। তখন ফেরেশতা বললেনঃ আল্লাহ আপনার জন্য শিক্ষা স্বরূপ এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এই বোতল দুটির মতই আকাশ ও পৃথিবীকে সামাল দিয়ে রেখেছেন। তিনি যদি ঘুমাতেন তাহলে আকাশ ও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত।(বায়হাকী, দারকুতনী)।
শিক্ষাঃ এ ঘটনাটি হতে মূল্যবান শিক্ষা লাভ করা যায়।
১. ক্ষুধা, ঘুম প্রভৃতি জৈবিক প্রয়োজন সাধারণ সৃষ্ট জীবের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ এসব দুর্বলতার অনেক উর্ধে্ব। তিনি সদা সচেতন ও সদা জাগ্রত। এ জন্যই বিশ্ব জগতের নিয়ম শৃংখলা সুষ্ঠুভাবে চালু রয়েছে।
২. এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগতকে শুধু সৃষ্টি করেই অবসর গ্রহণ করেন নি বা ক্ষান্ত থাকেন নি। বরং তিনি প্রতিটি সৃষ্টির লালন পালনেরও দায়িত্ব পালন করে চলেছেন এবং প্রতি মুহুর্তে তার তত্ত্বাবধান করছেন।
এখানে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, হযরত মূসা (আ) এর মতো একজন বিশিষ্ট নবীর মনে কেন এমন প্রশ্ন জাগলো। এর জবাব এই যে, আল্লাহকে যে ঘুম বা তন্দ্রা স্পর্শ করে না-এ ব্যাপারে হযরত মূসার(আ) মনে কোনই সন্দেহ ছিল না। তিনি কেবল বিষয়টি প্রত্যক্ষ নিরীক্ষণের মাধ্যমে অধিকতর নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ একটি শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। হযরত ইবরাহীম(আ) সম্পর্কেও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ কিভাবে মৃতকে জীবিত করবেন সে সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা একটি মৃত পাখিকে টুকরো টুকরো করে তাকে পুনরুজ্জীবিত করে দেখিয়েছিলেন এবং তাকে নিশ্চিত করেছিলেন।
মুসনাদে আহমাদে উদ্ধৃত অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, আসলে হযরত মূসার পক্ষ হতে নয় বরং বনী ইসরাঈলের পক্ষ হতে হযরত মূসার নিকট প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আল্লাহ ঘুমান না কেন?
৮৯। হযরত মূসা(আ) ও হযরত খিজির(আ) এর সফর
হযরত ইবনু আব্বাস (রা:) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:) হ’তে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) একদা বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী? তিনি বললেন, আমিই সর্বাধিক জ্ঞানী।
জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ না করার কারণে আল্লাহ তাকে তিরস্কার করে বললেন, বরং দু’সাগরের সঙ্গমস্থলে আমার এক বান্দা আছে, যিনি তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী।
হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তার নিকট পৌছাতে কে আমাকে সাহায্য্ করবে? কখনো সুফইয়ান এভাবে বর্ণনা করেছেন, আমি কিভাবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি? তখন বলা হ’ল, তুমি একটি থলিতে করে একটি মাছ নাও। যেখানে তুমি মাছটি হারাবে, সেখানেই আমার সে বান্দা আছে। অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) একটি মাছ ধরলেন এবং থলিতে রাখলেন।অতঃপর মাছ নিয়ে তাঁর সঙ্গী ইউশা বিন নূনকে সাথে নিয়ে চললেন।শেষ পর্যন্ত তারা একটি পাথরের কাছে পৌছলেন এবং তার উপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিলেন।মূসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় মাছটি থলি থেকে বের হয়ে লাফিয়ে সমুদ্রে চলে গেল।অতঃপর সে সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ করে নিল।আর আল্লাহ্ মাছটির চলার পথে পানির প্রবাহ থামিয়ে দিলেন।ফলে তার গমনপথটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। অতঃপর তারা উভয়ে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন পথ চললেন।
পরদিন সকালে হযরত মূসা (আঃ) তার সাথীকে বললেন, আমরা তো সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমাদের খাবার নিয়ে এস।হযরত মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ্ যে স্থানে যাবার কথা বলেছিলেন, সেই স্থান অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোনরূপ ক্লান্তিবোধ করেননি। সাথী ইউশা বিন নুন তখন বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, যে পাথরটির নিকট আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেখানেই মাছটি অদ্ভুতভাবে সমুদ্রের মধ্যে চলে গেছে।কিন্তু আমি মাছটির কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। মূলত: শয়তানই আমাকে এ কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, পথটি মাছের জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গের মত আর তাঁদের জন্য ছিল আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
হযরত মূসা (আঃ) বললেন, আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছি।অতঃপর তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন এবং ঐ পাথরের নিকটে পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মূসা (আঃ) তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো? তিনি বললেন, আমি মূসা। খিযির জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈল বংশীয় মূসা? মূসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি এসেছি এজন্য যে, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হ’তে আপনি আমাকে শিক্ষা দিবেন। খিযির বললেন, হে মূসা! আমার আল্লাহ্ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আপনি জানেন না। আর আপনিও আল্লাহ্ প্রদত্ত এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, আমি কি আপনার সাথী হ’তে পারি? খিযির বললেন,
‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। যে বিষয় আপনার জ্ঞানের আওতাধীন নয় সে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করবেন কেমন করে?’ মূসা (আঃ) বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ্ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না’ (কাহফ ৬৭-৬৯) ।
অতঃপর তাঁরা দু’জনে সাগরের কিনারা ধরে হেঁটে চললেন। তখন একটি নৌকা তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাদেরকে নৌকায় তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তারা খিযিরকে চিনতে পেরে বিনা ভাড়ায় তাঁদেরকে নৌকায় তুলে নিলো। যখন তাঁরা দু’জনে নৌকায় চড়লেন, তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকাটির কিনারায় বসল এবং সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা বা দুই ফোঁটা পানি পান করল। খিযির বললেন, ‘হে মুসা! আমার ও আপনার জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহর জ্ঞান হ’তে ততটুকুও কমেনি যত টুকু এ পাখিটি তাঁর ঠোটের দ্বারা সাগরের পানি হ্রাস করেছে’।
তখন খিযির একটি কুড়াল নিয়ে নৌকাটির একটা তক্তা খুলে ফেললেন। মূসা (আঃ) অকস্মাৎ দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন যে, তিনি কুড়াল দিয়ে একটি তক্তা খুলে ফেলেছেন। তখন তিনি তাঁকে বললেন, আপনি একি করলেন? এ লোকেরা বিনা ভাড়ায় আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিলো, আর আপনি তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকা ছিদ্র করে দিলেন? আপনি তো একটি গুরুতর কাজ করলেন। খিযির বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। মূসা (আঃ) বললেন, আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার এ ব্যবহারে আমার প্রতি কঠোর হবেন না।মূসা (আঃ)-এর পক্ষ থেকে প্রথম এ কথাটি ছিল ভুলক্রমে।
অতঃপর তাঁরা যখন উভয়ে সমুদ্র পার হলেন, তখন তারা একটি বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করছিল।খিযির ছেলেটির মাথা দেহ হ’তে ছিন্ন করে ফেললেন। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? আপনি খুবই খারাপ একটা কাজ করলেন। খিযির বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। মূসা (আঃ) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আমাকে আর সঙ্গে রাখবেন না।অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে তাঁরা একটি জনপদের অধিবাসীদের নিকট পৌঁছে তাদের নিকট কিছু খাবার চাইলেন। কিন্তু জনপদ বাসী তাদের দু’জনের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল।সেখানে তারা একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন, যা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল।হযরত খিযির প্রাচীরটি মেরামত করে সুদৃঢ় করে দিলেন।হযরত মুসা (আঃ) বললেন, এই বসতির লোকদের নিকট এসে আমরা খাবার চাইলাম।তারা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল।অথচ আপনি এদের দেয়াল সোজা করে দিলেন।আপনি তো ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন।হযরত খিযির বললেন, এবার আমার এবং আপনার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল।এক্ষণে যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, আমি এর তাৎপর্য বলে দিচ্ছি।
নৌকাটির ব্যাপার ছিল এই যে, সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির।তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত।আমি নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিতে চাইলাম। কারণ, তাদের সামনে ছিল এক রাজা, যে ভাল নৌকা পেলেই জোরপূর্বক কেড়ে নিত। তারপর যখন এটাকে দখল করতে লোক আসল, তখন ছিদ্রযুক্ত দেখে ছেড়ে দিল। অতঃপর নৌকাওয়ালারা একটা কাঠ দ্বারা নৌকাটি মেরামত করে নিলো।আর বালকটি সূচনা লগ্নেই ছিল কাফের। আর সে ছিল তার ঈমানদার বাবা- মার বড়ই আদরের সন্তান । আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্যতা ও কুফরি দ্বারা তাদেরকে কষ্ট দিবে। অতঃপর আমি ইচ্ছা করলাম যে, তাদের পালনকর্তা তাদেরকে তার চেয়ে পবিত্রতায় ও ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুন।আর প্রাচীরের ব্যাপার এই যে, সেটি ছিল নগরের দু’জন ইয়াতীম বালকের। এর নীচে ছিল তাদের গুপ্তধন। তাদের পিতা ছিলেন সৎকর্ম পরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াপরবেশ হয়ে ইচ্ছা পোষণ করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করে নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ ইচ্ছায় এসব করিনি। আপনি যে বিষয়গুলোতে ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, এই হ’ল তার ব্যাখ্যা ।
(কাহফ ৭৯-৮২; ছহীহ বুখারী হা/৩৪০১ ‘নবীদের কাহিনী’অধ্যায়,‘খিযিরের সাথে মূসা (আঃ)-এর কাহিনী’অনুচ্ছেদ, মুসলিম হা/২৩৮০, ‘ফাযায়েল’অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৬)
পর্যালোচনা ও শিক্ষাঃ
অধিকাংশ বিজ্ঞা মুফাসসিরের মতে হযরত খিজির একজন ফেরেশতা। কেননা এ ধরনের শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ড একজন নবীতো দূরের কথা, কোন সাধারণ মুসলমানের দ্বারাও সংঘটিত হতে পারে না। তবে ফেরেশতাগণ আল্লাহর হুকুমে এ ধরনের কাজ করতে পারেন। এ ঘটনার প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলোঃ
১। কোন ব্যাপারে অহংকার করা উচিত নয়। বিশেষ করে জ্ঞানের বড়াই অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
২। যে কাজ শরীয়ত বিরোধী মনে হবে, তার প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গেই করা উচিত। এমনকি প্রতিবাদ না করার ওয়াদা করে থাকলেও সেই ওয়াদা ভঙ্গ করে ওয়াদা করা কর্তব্য। হযরত মূসা(আ) এই আদর্শই সমুন্নত রেখেছেন।
৯০। হযরত মূসা (আ) ও ইসতিসকার নামায
হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত মূসা (আ.)-এর যুগে একবার অসহনীয় তাপদাহ, অসহ্য গরম আর কঠিন অনাবৃষ্টি দেখা দিল। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে দোয়া ও মুনাজাতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর সকাশে হাত তুললেন। নির্দেশ এলো, শুধু আপনি এবং আপনার অনুগত লোকজন কেন? যারা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে রেখেছে, যারা অন্যায় অনাচার দুর্নীতি পাপাচারে লিপ্ত তাদের কি বৃষ্টির প্রয়োজন নেই? তারা কি শীতল বায়ু, প্রবাহিত পানি, ফুল ও ফসলের মুখাপেক্ষী নয়? হযরত মূসা (আ.) বললেন, হে আল্লাহ আপনার দেয়া কোন নেয়ামত থেকে কাফির-মুমিন, ভালো-মন্দ, পাপী-পূণ্যবান কেউ কি অমুখাপেক্ষী হতে পারে? তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হলো, গোটা দেশবাসীকে তওবা করতে বলুন। যথাসম্ভব অধিক লোককে সাথে নিয়ে প্রচ- উত্তাপের সময় ময়দানে জমা হয়ে ভুল স্বীকার, তওবা ও কান্নাকাটি করুন। সাথে সমাজের চিহ্নিত খারাপ লোকগুলোকে বিশেষভাবে আনবেন। হযরত মূসা (আ.) তাই করলেন।
প্রচ- খরতাপে উত্তপ্ত বালির মাঠে শত সহস্র লোক সমবেত। বাদ যায়নি নারী শিশুরাও। অনেকে নিজেদের গৃহপালিত পশুদেরও সাথে নিয়ে এসেছে। সবার মুখে তওবা, অনুতাপ, অনুশোচনা, দোয়া আর মুনাজাত। ফেরেশতা ওহী নিয়ে এলেন, আল্লাহ বলে পাঠিয়েছেন, সমাবেশের একজন লোক আছে যে শুধু তার অন্যায় অপরাধের ফলেই চলমান এ খরা উত্তাপ আর অনাবৃষ্টি। তাকে এখান থেকে চলে যেতে বল। সে যেন দাঁড়িয়ে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে ময়দান ছেড়ে চলে যায়। অপরাধ ও পাপাচারের কথা জনসমক্ষে স্বীকার করে, তওবা করে এ লোকটি চলে গেলেই সমবেত লোকদের দোয়া কবুল হবে।
আল্লাহর প্রত্যাদেশ শুনে হযরত মূসা (আ.) লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির নাম বলেন নি তবে ঐ ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে নিজে ওয়াকিবহাল। আমি দেশের সমগ্র জনগণের স্বার্থে তাকে এই স্থান ত্যাগ করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
কয়েক ঘন্টা কেটে গেল এভাবে। মূসা বারবার অনুরোধ জানাতে লাগলেন, কোনো ফলোদয় হলো না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আকাশ মেঘে ছেয়ে গেল। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হল।
বৃষ্টির ফলে জনগণ খুশী হলেও হযরত মূসা বেকায়দায় পড়ে গেলেন। কারণ ওহীর নির্দেশমত কোনো পাপী লোককে বের হয়ে যেতে দেখা না গেলেও বৃষ্টি এল। এতে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিল যে, হযরত মূসা(আ) ওহীর নামে যা বলছেন তা সত্যি ছিল কিনা।
আল্লাহ ওহী নাযিল করলেন, “হে মূসা! তুমি যখন পাপীকে স্থান ত্যাগ করার জন্য আবেদন জানাচ্ছিলে, সে তখন মনে মনে আমার কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করে তওবা করেছিল এবং বললো “হে আল্লাহ! আমাকে এত লোকের সামনে অপদস্থও করোনা, আর আমার জন্য দেশবাসীকে কষ্টও দিওনা। আমাকে মাফ করে দিয়ে বৃষ্টি দাও।” আমি তার দোয়া কবুল করে বৃষ্টি দিয়েছি।(বুখারী)।
শিক্ষাঃ গুনাহ বা ভুলত্রুটির জন্য কাউকে লোকজনের সামনে হেয় না করে তাওবার মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ দেয়া উচিত।
৯১। হযরত খিজিরের (আ) বদান্যতা
হযরত খিজির বনী ইসরাঈলের কোন এক বাজারে ঘোরাঘুরি করছিলেন। এমন সময় এক লোক এসে বললো, “আমি একজন ক্রীতদাস। আমার মনিব চারশো দিরহামের বিনিময়ে আমাকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন মুক্তিপণের জন্য আপনার কাছে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করছি। আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন।”
হযরত খিজির বললেনঃ আল্লাহ যা ইচ্ছা তা একভাবে সম্পন্ন হবেই। আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার মত এক কানাকড়িও নেই। আমাকে মাফ কর।
কিন্তু লোকটি পীড়াপিড়ি করতে লাগলো। হযরত খিজির (আ) তখন তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রয় করে সে অর্থ দিয়ে তাঁকে মুক্তিপণ দিয়ে উক্ত লোককে দাসমুক্তির প্রস্তাব দিল। এরপর লোকটি খিজির(আ) কে বাজারে নিয়ে গিয়ে চারশো দিরহামে বিক্রয় করে। যে লোকটি হযরত খিজিরকে কিনলেন তিনি খিজির (আ) কে কোন কাজ না দিয়ে অতিথির মত যত্ন করতে লাগলো। এতে হযরত খিজির আপত্তি জানালে মনিব বললেন, “আপনি বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি। আপনাকে কষ্ট দেয়াটা আমার পছন্দ নয়।” হযরত খিজির বললেন, “আমার কোন কষ্ট হবে না। আপনি আদেশ করে দেখুন।” তখন মনিব বললো, “বেশ, তাহলে এই পাথরটি সরিয়ে ওখানটায় রাখুন।” আদেশ দিয়ে মনিব বাইরে গেলেন। কিন্তু পাথরটি ছিল এত বিরাট ও ভারী যে, ছয়জন লোক সারাদিন পরিশ্রম করেও তা সরানো সম্ভব ছিল না। অথচ একঘন্টা পর মনিব ফিরে এসে দেখেন, পাথরটি যথাস্থানে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মনিব খুব খুশী হলেন। মনিব তার বৃদ্ধ ক্রীতদাসকে বললেন, “আল্লাহর দোহাই, আপনার রহস্য কি আমাকে খুলে বলুন।” এরপর হযরত খিজির (আ) বিস্তারিত বললেন এবং তিনি যে হযরত খিজির (আ) সে পরিচয় দিলেন।
সব শুনে মনিব বললেন, “আমি আল্লাহর ও আপনার ওপর ঈমান এনেছি। না জেনে শুনে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি অনুতপ্ত।” হযরত খিজির বললেন, “না তাতে আপনার দোষ হয়নি। আপনি যা করেছেন সততা ও নিষ্ঠার সাথেই করেছেন।” মনিব বললো, “আপনি আমার সহায় সম্পদ ও পরিবার পরিজন সম্পর্কে যেমন ভাল মনে করেন তদনুযায়ী আদেশ দিন। আর আপনার মুক্তি চাইলে মুক্ত করে দেব।”
হযরত খিজির বললেন, “আমার প্রত্যাশা এই যে, আমাকে মুক্তি দিন যাতে আমি নিজের আসল মনিব আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত হতে পারি।” অতঃপর মনিব তাকে মুক্ত করে দিল। তখন হযরত খিজির(আ) বললেন, “মহান আল্লাহর শোকর আদায় করছি। যিনি আমাকে মানুষের গোলামীর বন্ধনে আবদ্ধ করার পর তা হতে মুক্তি দিয়েছেন।”।
৯২। শাদ্দাদের বেহেশতের কাহিনী
হযরত হুদ (আঃ) এর আমলে শাদ্দাদ নামে একজন অতীব পরাক্রমশালী ঐশ্বর্যশালী মহারাজা ছিল। আল্লাহর হুকুমে হযরত হুদ (আঃ) তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং দাওয়াত গ্রহণ করলে আখেরাতে বেহেশত লাভ অন্যথায় দোযখে যাওয়া অবধারিত বলে জানান। শাদ্দাদ হযরত হুদ (আঃ) এর কাছে বেহেশত ও দোযখের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাইলে তিনি জানান। শাদ্দাদ তাকে বলল,তোমার আল্লাহর বেহেশত আমার প্রয়োজন নেই।বেহেশতের যে নিয়ামত ও সুখ-শান্তির বিবরণ তুমি দিলে ,অমন বেহেশত আমি নিজে এই পৃথিবীতেই বানিয়ে নিব।তুমি দেখে নিও।
হযরত হুদ (আঃ) তাকে হুশিয়ার করে দিলেন যে,আল্লাহ পরকালে যে বেহেশত তৈরী করে রেখেছেন,তোমার বানানো বেহেশত তার ধারে কাছেও যেতে পারবেনা। অধিকন্তু তুমি আল্লাহর সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য অভিশপ্ত হবে। কিন্তু শাদ্দাদ কোন হুশিয়ারীর তোয়াক্কা করলো না। সে সত্যি সত্যিই দুনিয়ার উপর একটি সর্ব-সুখময় বেহেশত নির্মানের পরিকল্পনা করল। তার ভাগ্নে জোহাক তাজী তখন পৃথিবীর অপ্র প্রান্তে এক বিশাল সম্রাজ্যের অধিকারী ছিল। অধিকন্তু পারস্যের সম্রাট জামশেদের সম্রাজ্য দখল করে সে প্রায় অর্ধেক দুনিয়ার প্রতাপন্বিত সম্রাটে পরিনত হয়েছিল।
মহারাজা শাদ্দাদ সম্রাট জোহাক তাজী কে চিঠি লিখে তার বেহেশত নির্মানের পরিকল্পনা জানালো। অতঃপর তাকে লিখলো যে,তোমার রাজ্যে যত স্বর্ণ-রৌপ্য,হিরা-জহরত ও মনি-মাণীক্য আছে,তা সব সংগ্রহ করে আমার দরবারে পাঠিয়ে দাও। আর মিশক-আম্বর জাতীয় সুগন্ধী দ্রব্য যত আছে,তা পাঠিয়ে দাও।
অন্যান্য রাজা-মহারাজাদের কাছেও সে একই ভাবে চিঠি লিখলো এবং বেহেশত নির্মানের পরিকল্পনা জানিয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্মান সামগ্রী পাঠানোর আদেশ জারী করলো।পৃথিবীর সকল অঞ্চলের অনুগত রাজা-মহারাজারা তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল।
এবার বেহেশতের স্থান নির্বাচনের পালা। বেহেশত নির্মানের উপযুক্ত স্থান খুজে বের করার জন্য শাদ্দাদ বহু সংখ্যক সরকারী কর্মচারী কে নিয়োগ করল। অবশেষে ইয়ামানের একটি শস্য শ্যামল অঞ্চলে প্রায় একশ চল্লিশ বর্গ মাইল এলাকার একটি জায়গা নির্বাচন করা হল।
বেহেশত নির্মানের জন্য নির্মান সামগ্রী ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে বাছাই করা দক্ষ মিস্ত্রী আনা হল।প্রায় তিন হাজার সুদক্ষ কারিগর কে বেহেশত নির্মানের জন্য নিয়োগ করা হল। নির্মান কাজ শুরু হয়ে গেলে শাদ্দাদ তার অধীনস্থ প্রজাদের জানিয়ে দিল জে,কারো নিকট কোন সোনা রূপা থাকলে সে যেন তা গোপন না করে এবং অবিলম্বে তা রাজ দরবারে পাঠিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে তল্লাশী চালানোর জন্য হাজার হাজার কর্মচারী নিয়োগ করা হল। এই কর্মচারীরা কারো কাছে এক কণা পরিমাণ সোনা-রূপা পেলেও তা কেড়ে নিতে লাগল। এক বিধবার শিশু মেয়ের কাছে চার আনা পরিমান রূপার গহণা পেয়ে তাও তার কেড়ে নিল। মেয়েটি কেদে গড়াগড়ি দিতে লাগল। তা দেখে বিধবা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাল যে, হে আল্লাহ ,এই অত্যাচারী রাজা কে তুমি তার বেহেশত ভোগ করার সুযোগ দিও না। দুঃখিনী মজলুম বৃদ্ধার এই দোয়া সম্ভবত কবুল হয়ে গিয়ে ছিল।
ওদিকে মহারাজা শাদ্দাদের বেহেশত নির্মানের কাজ ধুমধামের সাথে চলতে লাগল। বিশাল ভূখন্ডের চারদিকে চল্লিশ গজ জমি খনন করে মাটি ফেলে মর্মর পাথর দিয়ে বেহেশতের ভিত্তি নির্মান করা হল। তার উপর সোনা ও রূপার ইট দিয়ে নির্মিত হল প্রাচীর। প্রাচীরের উপর জমরূদ পাথরের ভীম ও বর্গার উপর লাল বর্ণের মূল্যবান আলমাছ পাথর ঢালাই করে প্রাসাদের ছাদ তৈরী হল। মূল প্রাসাদের ভিতরে সোনা ও রূপার কারূকার্য খচিত ইট দিয়ে বহু সংখ্যক ছোট ছোট দালান তৈরী করা হল।
সেই বেহেশতের মাঝে মাঝে তৈরী করা হয়েছিল সোনা ও রূপার গাছ-গাছালি এবং সোনার ঘাট ও তীর বাধা পুস্করিনী ও নহর সমূহ। আর তার কোনটি দুধ,কোনটি মধু ও কোনটি শরাব দ্বারা ভর্তি করা হয়েছিল। বেহেশতের মাটির পরিবর্তে শোভা পেয়েছিল সুবাসিত মেশক ও আম্বর এবং মূল্যবান পাথর দ্বারা তার মেঝে নির্মিত হয়েছিল। বেহেশতের প্রাঙ্গন মনি মুক্তা দ্বারা ঢালাই করা হয়েছিল।
বর্ণিত আছে যে,এই বেহেশত নির্মাণ করতে প্রতিদিন অন্ততঃ চল্লিশ হাজার গাধার বোঝা পরিমান সোনা-রূপা নিঃশেষ হয়ে যেত।এইভাবে একাধারে তিনশ’ বছর ধরে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
এরপর কারিগরগণ শাদ্দাদ কে জানাল যে,বেহেশত নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। শাদ্দাদ খুশী হয়ে আদেশ দিল জে,এবার রাজ্যের সকল সুন্দ যুবক-যুবতী ও বালক-বালিকাকে বেহেশতে এনে জড়ো করা হোক। নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হল।
অবশেষে একদিন শাদ্দাদ সপরিবারে বেহেশত অভিমুখে রওনা হল।তার অসংখ্য লোক-লস্কর বেহেশতের সামনের প্রান্তরে তাকে অভবাদন জানাল। শাদ্দাদ অভবাদন গ্রহণ করে বেহেশতের প্রধান দরজার কাছে গিয়ে উপনীত হল। দেখল,একজন অপরিচিত লোক বেহেশতের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শাদ্দাদ তাকে জিজ্ঞেস করল,তুমি কে?
লোকটি বললেনঃ আমি মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাঈল।
শাদ্দাদ বললঃ তুমি এখন এখানে কি উদ্দেশ্য এসেছ?
আজরাঈল বললেনঃ আমার প্রতি নির্দেশ এসেছে তোমার জান কবজ করার।
শাদ্দাদ বললঃ আমাকে একটু সময় দাও।আমি আমার তৈরী পরম সাধের বেহেশতে একটু প্রবেশ করি এবং এক নজর ঘুরে দেখি।
আজরাঈল বললেনঃ তোমাকে এক মুহুর্তও সময় দানের অনুমতি নেই।
শাদ্দাদ বললঃ তাহলে অন্ততঃ আমাকে ঘোড়া থেকে নামতে দাও।
আজরাঈল বললেনঃ না,তুমি যে অবস্থায় আছ,সে অবস্থায়ই তোমার জান কবজ করা হবে।
শাদ্দাদ ঘোড়া থেকে এক পা নামিয়ে দিল।কিন্তু তা বেহেশতের চৌকাঠ স্পর্শ করতে পারলনা। এই অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটল।তার বেহেশতের আশা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেল।
ইতঃমধ্যে আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আঃ)এক প্রচন্ড আওয়াজের মাধ্যমে শাদ্দাদের বেহেশত ও লোক-লস্কর সব ধ্বংস করে দিলেন।এভাবে শাদ্দাদের রাজত্ব চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
বর্ণিত আছে যে,হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) রাজত্বকালে আব্দুল্লাহ বিন কালব নামক এক ব্যক্তি ইয়ামানের একটি জায়গায় একটি মূল্যবান পাথর পেয়ে তা হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) নিকট উপস্থাপন করেন।
সেখানে তখন কা’ব বিন আহবার উপস্থিত ছিলেন।তিনি উক্ত মূল্যবান রত্ন দেখে বললেন,এটি নিশ্চয় শাদ্দাদ নির্মিত বেহেশতের ধ্বংসাবশেষ। কেননা আমি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে,আমার উম্মতের মধ্যে আব্দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি শাদ্দাদ নির্মিত বেহেশতের স্থানে গিয়ে কিছু নিদর্শন দেখতে পাবে।
শিক্ষাঃ এই কাহিনীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দখলকৃত সম্পদ অনেক সময় কাজে লাগেনা। আর মজলুমের দোয়া যে আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়, সে কথা একাধিক হাদীস থেকেও জানা যায় এবং এই ঘটনার মাধ্যমেও আরেকবার জানা গেল।
৯৩। হযরত ঈসা (আ) এর উম্মতের এক দরবেশের কাহিনী
ইবনে ইসহাক হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ঈসা(আ) আকাশে উত্থিত হওয়ার পর যখন তাঁর উম্মতের মধ্যে নানারকম শিরক বিদআত এর অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে, তখন যারা হযরত ঈসা(আ) এর আনীত দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন এবং তার প্রচার চালাতে থাকেন, তাদের একটি দল একসময় ইয়ামানের নাজরান প্রদেশে বসতি স্থাপন করেন। এই দলটির নেতা ছিলেন ফিমিউন নামে দুনিয়ার স্বার্থত্যাগী, সৎ, ন্যায়পরায়ন ও কঠোর পরিশ্রমী এক ব্যাক্তি। তাঁর দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হতো। তিনি দেশ দেশান্তর সফর করে আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতেন এবং প্রধানত পল্লী অঞ্চলের মানুষের অতিথি হতেন।
ভক্তদের আতিথেয়তা ও ভক্তির বাড়াবাড়ি তাকে দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন করে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যেতে পারে-এই আশংকায় তিনি এক স্থানে বেশিদিন থাকতেন না। তিনি শুধু নিজ উপার্জন হতে খাওয়া দাওয়া করতেন। ঈসায়ী ধর্মের বিধান অনুযায়ী তিনি রবিবার কোন কাজ করতেন না এবং জনবসতি হতে দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত নামায ও ইবাদতে মশগুল থাকতেন। একবার সিরিয়ার একটি গ্রামে গোপনে নামায পড়াকালে সালেহ নামে একজন গ্রামবাসী তা দেখে ফেলে এবং ফিমিউনকে অত্যন্ত ভালোবেসে ফেলে। ফিমিউন যেখানে যেতেন সে তার সাথে সাথে সেখানে যেত, কিন্তু ফিমিউন টের পেতেন না। এক পর্যায়ে ফিমিউন সালেহ এর উপস্থিতি টের পেলেন। সালেহ বললেন, “হে ফিমিউন! তুমি নিশ্চয়ই অবগত আছ যে, আমি আজ পর্যন্ত তোমার মত কাউকে ভালবাসিনি। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।”
ফিমিউন বললেন, “তোমার ইচ্ছাটা মন্দ নয়। কিন্তু আমার অবস্থাতো দেখতেই পাচ্ছ। তুমি যদি মনে কর, আমার সাথে টিকতে পারবে, তাহলে থাকো।” এরপর সালেহ তাঁর সহচর হয়ে গেল। কেউ অসুস্থ হলে বা কোন দূর্ঘটনা ঘটলে ফিমিউন দোয়া করতেন এবং সে ভাল হয়ে যেত। কিন্তু কোন রুগ্ন ব্যক্তি ডাকলে তিনি যেতেন না। তবে তিনি মজুরীর বিনিময়ে মানুষের বাড়ীঘর নির্মাণ করতেন। এক গ্রামবাসীর ছেলে খুব অসুস্থ। তিনি ফিমিউনকে আনার উপায় খুঁজতে লাগলে। ফিমিউনের নিকট এসে বললেন, “ওহে ফিমিউন। আমি নিজের বাড়িতে কিছু কাজ করাতে চাই। তুমি আমার সাথে চল।” লোকটির ঘরে গেল লোকটি তার ছেলের উপর হতে চাদর সরিয়ে বলল, “হে ফিমিউন! আল্লাহর এক বান্দা অসুস্থ। তার ভাল হওয়ার জন্য দোয়া করুন।” ফিমিউন দোয়া করতেই বালকটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল।
একবার ফিমিউন ও সালেহ আরব ভূখন্ড দিয়ে ভ্রমণ করছিল। এমতাবস্থায় একটি আরব কাফেলা তাদেরকে অপহরণ করে গিয়ে নাজরানের পৌত্তলিকদের নিকট বিক্রয় করে দিল। ঐ পৌত্তলিকরা একটি খেজুর গাছের পূজা করতো। নাজরানের জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ঐ কাফেলার নিকট হতে তাঁদের উভয়কে কিনে নিল। ফিমিউনকে তাঁর মনিব যে ঘরে থাকতে দিতেন তিনি রাতে সেখানে তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন েএবং তাঁর ঘরটি কোন আলো ছাড়াই আলোকিত থাকতো। তাঁর মনিব এটি দেখে বিস্মিত হলো। জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর ধর্ম কি? ফিমিউন বিস্তারিত জানালেন এবং বললেন, “তোমরা গোমরাহীর ভিতর আছ। এ গাছ তোমাদের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। আমি যে খোদার ইবাদত করি তাঁর নিকট প্রার্থনা করলে সে গাছটি তিনি ধ্বংস করে দিবেন। তিনি আল্লাহ, তাঁর কোন শরীক নেই।” তারঁ মনিব বললো, “বেশ তুমি গাছটিকে ধ্বংস করে দেখাওতো দেখি।”
ফিমিউন ওযূ করে দুই রাকায়াত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তৎক্ষনাত একটি ঝড় এসে গাছটিকে সমূলে উৎপাটিত করে মাটিতে ফেলে দিল। তখন তাঁর মনিবসহ নাজরানবাসী তার ধর্মে দীক্ষিত হলো। তারা হযরত ঈসা (আ) এর আসল ও অবিকৃত শরীয়তের অনুসারী হলো। এরপর নাজরানবাসীর ওপর এমন কিছু আপদ নেমে আসে যা দুনিয়ার সর্বত্র সত্য দ্বীনের অনুসারীদের ওপর নেমে এসেছে। সেই থেকে নাজরানে ঈসায়ী ধর্মের অভ্যূদয় ঘটে।
শিক্ষাঃ এই ঘটনাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এই যে, ইসলাম প্রচারের কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের সবসময় নিজস্ব স্বতন্ত্র জীবিকার ব্যবস্থা রাখা উচিত। যাতে জীবিকার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল, লোভমুক্ত ও হালাল উপার্জনে ব্রতী থাকা যায়। আর সর্বাবস্থায় তাদের দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়া ও তাকওয়া ভিত্তিক জীবন যাপন করা উচিত।
৯৪। হযরত সোলায়মানের (আ) ন্যায়বিচার
ক) হযরত সোলায়মান(আ) এর আমলে একদিন দুই মহিলা একটি ছেলেকে উভয়ে নিজের দাবি করে তাঁর দরবারে বিচারপ্রার্থী হলো।
হযরত সোলায়মান প্র্রথমে উভয়ের যুক্তি প্রমাণ আলাদা আলাদা ভাবে শুনলেন। তারপর উভয়কে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তারা সমঝোতায় পৌছতে ব্যর্থ হলো। অগত্য হযরত সোলায়মান(আ) এই মর্মে রায় দিলেন যে, তোমরা যখন কোনমতেই আপোষরফা করতে রাজী নও, তখন এই শিশুকে আমি দ্বিখন্ডিত করে উভয়কে সমান সমান অংশ দিয়ে দেব।
এ কথা শুনে এক মহিলা নীরব রইলো। কিন্তু অপরজন চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। সে বললোঃ “দোহাই আল্লাহর! আপনি শিশুটিকে কাটবেন না। ওকে বরং ঐ মহিলার কোলেই দিয়ে দিন, ও বেঁচে থাকুক। আমি না হয় মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবো।”
একথা শোনার পর হযরত সোলায়মানের (আ) আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, শেষোক্ত মহিলাই শিশুটির আসল মা। তাই শিশুটি তিনি তাকেই দিলন।(বুখারী)।
শিক্ষাঃ একজন ন্যায়পরায়ন ও বিচক্ষণ শাসক বা বিচারককে শুধু শরীয়ত ও আইন জানলেই চলে না সেই সাথে মানুষের মনস্তত্ত্বও জানতে হবে। নচেৎ সুবিচার নিশ্চিত করা যায় না।
(খ) একদিন বাদশাহ দাউদ (আ.)-এর আদালতে এক বিচার এলো। এক শস্যক্ষেত্রের মালিক এসে তার প্রতিবেশী সম্পর্কে বাদশাহর কাছে নালিশ করল। মালিক জানাল, প্রতিবেশীর ছাগলের পাল তার শস্যক্ষেতে ঢুকে সব শস্য খেয়ে ফেলেছে। এতে তার অনেক ক্ষতি হয়েছে। এর সুষ্ঠু বিচার চায় শস্যক্ষেত্রের মালিক।
বাদশাহ দাউদ (আ.) সবকিছু শুনে তাঁর রায় দিলেন। ছাগলের মালিককে জরিমানা করা হলো এবং এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছাগলের পাল পুরোটাই শস্যক্ষেত্রের মালিককে দিয়ে দেয়া হলো। ক্ষতিপূরণ পেয়ে ফসলের মালিক তো মহাখুশি। কিন্তু ছাগলের মালিকের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল। সব ছাগল হারিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে গেল। তাই সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল।
এখন তার উপায় কী হবে, পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে সে চলবে? সে চিন্তায় সে প্রায় পাগলপারার মতো পথ চলছিল। এমন সময় বালক সোলায়মান (আ.) রাস্তায় খেলা করছিলেন। তিনি লোকটির কান্না খেয়াল করলেন এবং এতে তাঁর মন নড়ে উঠল। তাই সোলায়মান (আ.) লোকটিকে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
ছাগলের মালিক সব ঘটনা বালক সোলায়মান (আ.) কে খুলে বলল। সব শুনে সোলায়মান (আ.) বললেন,
‘ভাই! আপনি এক কাজ করুন। আপনি আবার বাদশাহর দরবারে যান এবং তাঁকে রায়টি পুনরায় বিবেচনার অনুরোধ করুন।’
লোকটি সোলায়মান (আ.) এর কথা মতো আবার বাদশাহর দরবারে গেল এবং তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য বাদশাহকে অনুরোধ জানাল।
বাদশাহ লোকটির কথা শুনে কী যেন ভাবলেন। খানিক পরে তিনি লোকটিকে প্রশ্ন করলেন,
-আচ্ছা বলতো, বিচারটি পুনরায় বিবেচনার জন্য কে তোমাকে পরামর্শ দিয়েছে?
লোকটি কালবিলম্ব না করে জবাব দিলো,
সোলায়মান (আ.), বালক সোলায়মান (আ.) আমাকে এ পরামর্শ দিয়েছেন।
দাউদ (আ.) সবই বুঝতে পারলেন। এবার তিনি পুত্র সোলায়মানকে দরবারে ডেকে পাঠালেন এবং এই রায়ের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করে তাঁকে আদেশ দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
বালক সোলায়মান (আ.) পিতার আদেশ পালন করলেন। তিনি খানিকটা ভেবে তাঁর রায় ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন,
‘ফসলের ক্ষতিপূরণ হিসেবে শস্যক্ষেত্রের মালিক ছাগলের পাল পাবে এই শর্তে যে, সে ছাগলের দুধ খেতে পারবে এবং পশমও বিক্রি করতে পারবে। তবে ক্ষেত্রে আবার যখন আগের মতো ফসল হবে তখন ছাগলগুলো ছাগলের মালিককে ফেরত দিতে হবে।’
বিচারের রায় শুনে সবাইতো হতবাক। এ যে সুন্দর রায়। এ রায়ে শস্যক্ষেতের মালিক ও ছাগল পালের মালিক উভয়ে মহাখুশি। তাই তারা সানন্দে সোলায়মান (আ.) এর রায় মেনে নিল। তারা এবার যার যার বাড়িতে ফিরে গেল। আর বাদশাহ দাউদ (আ.)ও পুত্রের সুবিবেচনা ও বুদ্ধির বহর দেখে যারপরনাই আনন্দিত হলেন। তিনি এ জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন।
শিক্ষাঃ অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি তার কল্যাণের কথা চিন্তা করাও প্রত্যেক বিচারকে কর্তব্য। অপরাধীকে এমন শাস্তি দেওয়া উচিত নয় যাতে সে দেউলে হয়ে যায় এবং পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়।
৯৫। হযরত ইউনূস (আ) এর কাহিনী
ইউনুস (আঃ) বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ (نينوى) জনপদের অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হ’লে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হ’তে পারে। তারা ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুসের কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শিরক হ’তে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশু গুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্ত:করণে তওবা করে এবং আসন্ন গযব হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
فَلَوْلاَ كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلاَّ قَوْمَ يُوْنُسَ لَمَّا آمَنُوْا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَى حِيْنٍ- (يونس ৯৮)-
‘অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম’ (ইউনুস ১০/৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।
ওদিকে ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময় আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।
মাছের পেটে ইউনুস :
আল্লাহ বলেন,
وَإِنَّ يُونُسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ- إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُوْنِ- فَسَاهَمَ فَكَانَ مِنَ الْمُدْحَضِيْنَ- فَالْتَقَمَهُ الْحُوْتُ وَهُوَ مُلِيْمٌ- (الصافات ১৩৯-১৪২)-
‘আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন’। ‘যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল’। ‘অতঃপর লটারীতে সে অকৃতকার্য হ’ল’। ‘অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দানকারী’ (ছাফফাত ৩৭/১৩৯-১৪২)।
আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়াও করেন। ফলে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পতিত হন।
হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হ’লে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী হ’লে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)।
ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে কত সময় বা কতদিন ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন- (১) এক ঘণ্টা ছিলেন (২) তিনি পূর্বাহ্নে প্রবেশ করে অপরাহ্নে বেরিয়ে আসেন (৩) ৩ দিন ছিলেন (৪) ৭ দিন ছিলেন (৫) ২০ দিন ছিলেন (৬) ৪০ দিন ছিলেন। আসলে এইসব মতভেদের কোন গুরুত্ব নেই। কেননা এসবের রচয়িতা হ’ল ইহুদী গল্পকারগণ। প্রকৃত ঘটনা আল্লাহ ভাল জানেন।
শিক্ষাঃ
১। কোন ব্যাপারে শরীয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকলে সে ব্যাপারে নিজস্ব বা অন্যের মত অনুসরণ করা কোন মুসলমানের জন্য বৈধ নয়। আর নির্দেশ নিজের অজানা থাকলে যারা অভিজ্ঞ, তাদের কাছ হতে জেনে নেওয়া এবং অপেক্ষা করা জরুরী।
২। বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটি স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া ও মুক্তি চাওয়া যখন আল্লাহর নবীদের নীতি, তখন সাধারণ মুসলমানদের জন্য তা আরো বেশি কর্তব্য।
৯৬। ওয়াইস কারনীর ঘটনা
ইয়ামানে বসবাসকারীদের পক্ষ থেকে ওমর (রা:)-এর নিকট সাহায্যকারী দল আসলে তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করতেন, ‘তোমাদের মাঝে কি উয়াইস ইবনু আমির আছে’? অবশেষে (একদিন) উয়াইস (রহঃ) এসে গেলেন। তাকে ওমর প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি উয়াইস ইবনু আমির’? সে বলল, হ্যাঁ। ওমর (রা:) আবার বললেন, ‘মুরাদ’ সম্প্রদায়ের উপগোত্র ‘কারনের’লোক? তিনি বললেন, হ্যাঁ । তিনি বললেন, ‘আপনার কি কুষ্ঠরোগ হয়েছিল, আপনি তা হতে সুস্থ হয়েছেন এবং মাত্র এক দিরহাম পরিমাণ স্থান বাকী আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘আপনার মা জীবিত আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
ওমর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘ইয়ামানের সহযোগী দলের সাথে উয়াইস ইবনু আমির নামক এক লোক তোমাদের নিকট আসবে। সে ‘মুরাদ’জাতির উপজাতি ‘কারনের’লোক। তার কুষ্ঠরোগ হবে এবং তা হ’তে সে মুক্তি পাবে, শুধুমাত্র এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া। তার মা বেঁচে আছে, সে তার মায়ের খুবই অনুগত। সে (আল্লাহ্র উপর ভরসা করে) কোন কিছুর শপথ করলে তা আল্লাহ্ তা’আলা পূরণ করে দেন। তুমি যদি তাকে দিয়ে তোমার গুনাহ মাফের জন্য দোআ করাবার সুযোগ পাও, তাহলে তাই করবে।
ওমর (রা:) বলেন, ‘কাজেই আমার অপরাধ ক্ষমার জন্য আপনি দোআ করুন। তখন তিনি (উয়াইস) ওমরের অপরাধের ক্ষমা চেয়ে দোআ করলেন। ওমর (রা:) তাকে বললেন, ‘আপনি কোথায় যেতে চান? তিনি বললেন, ‘কূফায়। তিনি (ওমর) বলেন, ‘আমি সেখানকার গভর্নরকে আপনার (সাহায্যের) জন্য লিখে দেই?” উয়াইস বললেন, ’‘না, সাধারণ মানুষের কাছে থাকতেই আমি ভালোবাসি।”
এরপর কুফাবাসীরা যখনই হজ্জ্ব করতে মক্কা ও মদীনায় আসতো, তখনই হযরত ওমর তাদের কাছে উয়াইসের খোঁজ খবর নিতেন এবং তাঁর সম্পর্কে রাসূল (সা) এর উক্তি সবাইকে বলতেন। তারপর দলে দলে লোকেরা উয়াইসের কাছে যেতো এবং গুনাহ মাফের দোয়া চাইতো।
অপর রেওয়ায়াতে আছে যে, হযরত ওমর (রা) বলেন, রাসূল (সা) উয়াইসকে শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী বলেছেন। রাসূল (সা) এর জীবদ্দশায় ঈমান আনা সত্ত্বেও উয়াইস নিজের কুষ্ঠ রোগ ও পঙ্গু মায়ের সেবা শুশ্রুষার কারণে রাসূল (সা) এর সাথে দেখা করতে ও সাহাবীর মর্যাদা লাভ করতে পারেন নি। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীর মর্যাদাই শুধু দেন নি, সাহাবীদেরকেও তাঁর কাছে গুনাহ মাফের জন্য দোয়া চাইবার উপদেশে দিয়েছেন। কথিত আছে যে, উয়াইস ওহোদ যুদ্ধে রাসূল (সা) এর দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার খবর শুনে প্রচন্ড আবেগে বেসামাল হয়ে গিয়ে নিজের কয়েকটি দাঁত পাথর দিয়ে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন।
শিক্ষাঃ ইসলামের যথার্থ অনুসারী ও শুভাকাংখী হলে সাহাবী না হয়েও মানুষ উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে ও আল্লাহর প্রিয় হতে পারে। বিশেষতঃ পিতামাতার সেবা যে মানুষকে কত উর্ধে্ব তুলে দিতে পারে তা এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
…..সমাপ্ত…