বলদর্পী নমরূদ
বেবিলন দেশের নাম হয়তো তোমরা শুনেছো! সেই দেশের সম্রাট নমরূদ ছিলেন যেমন অহঙ্কারী তেমনি অত্যাচারী। রাজকোষে ছিল তাঁর প্রচুর মণিরত্ন, ধন-ঐশ্বর্য-দেহে বীর্য, অগণিত লোক-মস্কর।
একবার অগণিত সৈন্যসামন্ত নিয়ে তিনি অভিযানে বের হলেন। দেশের পর দেশ তাঁর করায়ত্ত হতে লাগলো। চারদিকে বয়ে গেলো রক্তের নদী –শোনা যেতে লাগলো নিপীড়িতের আর্তনাদ –দুর্বলের হাহাকার –বুকফাটা ক্রন্দন। তবু বিরাম নাই –বিশ্রাম নাই –শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস –জয় আর জয়। গ্রীস, তুরস্ক, আরব, পারস্য ও পাকভারতে তাঁর বিজয়-নিশান উড়তে লাগলো। তিনি হলেন অর্ধ পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি। দম্ভে তাঁর বুক উঠলো ফুলে –দুনিয়াটাকে খেলাঘর বলে তাঁর মনে হতে লাগলো।
একদিন নমরূদ আম-দরবারে বসে অমাত্য-পারিষদ নিয়ে খোশগল্পে মশগুল আছেন, এমন সময়ে একজন ফকির এসে দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিলোঃ সর্বশক্তিমান খোদার নামে কিছু দান করুন জাঁহাপনা।
নমরূদ এ কথা শুনে চমকে উঠলেন। বললেনঃ সর্বশক্তিমান খোদা? সে কি বলছো তুমি? সর্বশক্তিমান আমি।
সম্রাটের কথার ওপরেকথা চলে না –সুতরাং অমাত্যবর্গ ক্ষুণ্ণমনে নীরব হয়ে রইলেন।
ফকির বললোঃ জাহাঁপনা আপনি ভুল করছেন –এমন পাপকথা মুখে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে নেই। তিনি এতো বিরাট যে, তাঁর তুলনায় আপনি অতিশয় তুচ্ছ।
নমরূদ ক্রুব্ধকণ্ঠে চীৎকার করে উঠলেনঃ এতো বড় স্পর্ধা! আমার কথার ওপরে কথা!! প্রতিহারী-
প্রতিহারী এসে জোড়হাতে আদেশের প্রতীক্ষা করতে লাগলোঃ নমরূদ ক্ষিপ্তকণ্ঠে হুকুম করলেনঃ এই ভিখারীর গর্দান চাই।
প্রতিহারী ফকিরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে শিরচ্ছেদের জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে গেলো।
অমাত্যবগ্য তাঁদের সম্রাটকে চিনতেন, তাই তাঁরা বিন্দুমাত্র বিস্মিত হলেন না; কিন্তু মনে মনে দুঃখ বোধ করতে লাগলেন।
নমরূদ সভাসদদের ডেকে বললেনঃ আপনারা আমার রাজ্য মধ্যে প্রচার করে দিন, আমি সর্বশক্তিমান –আমি খোদা। যে আমাকে ছাড়া অন্য খোদার বন্দনা করবে সে সবংশে ধ্বংস হবে।
অমাত্যগণ নিরুপায়। তাঁরা তখনই রাজাদেশ দেশে দেশে, নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে ঢাক পিটিয়ে প্রচার করে দেবার ব্যবস্থা করলেন।
দেশের লোকেরা আতঙ্কে শিউরে উঠলো। অন্তঃপুরে মেয়েরা কানে আঙ্গুল দিলো। সামান্য মানুষের এমন স্পর্ধা। বামন হয়ে আকাশে খেলাঘর নির্মাণের সাধ! কিন্তু প্রতিকার নেই। গোপনে গোপনে তারা উপাসনা করতে লাগলো। প্রকাশ্যে নমরূদের আদেশ পালন করবার ভান করা ছাড়া কোনো উপায় রইলোনা। নমরূদ অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন; সুতরাং দিনে দিনে স্পর্ধা তাঁর বেড়েই চলেছিলো। আপনার নানা রকমের মূর্তি নির্মাণ করিয়ে প্রাসাদের এক প্রকোষ্ঠে রেখে দিয়ে রাজধানীর সকলের ওপরে আদেশ দিলেনঃ দুধ আরকলা দিয়ে আমারমূর্তি পূজা করতে হবে। যে আদেশ অমান্য করবে তার গর্দান যাবে।
প্রাণের দায়ে সবাই নমরূদের খেয়াল অনুসারেই চলতে লাগলো। নমরূদের অনুগত ভৃত্য অজর প্রভু-অন্তপ্রাণ। তাঁর দ্বাদশ বৎসর বয়স্ক পুত্র ইবরাহিম একদিন এমন কাজ করলেন যা দেখে আতঙ্কে সকলের বাকরোধ হবার উপক্রম হলো।
নমরূদ সৈন্যসামন্ত নিয়ে বেরিয়েছিলেন কোনো উৎসবে যোগদান করতে। প্রাসাদে ফিরে এসে দেখতে পেলেন তাঁর প্রতিমূর্তিগুলো ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। নমরূদ সেদিক পানে চেয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে চিৎকার করে বললেনঃ কে এ কাজ করলো?
ইবরাহিম নির্ভয়ে এগিয়ে এলেন। বললেনঃ আমি করেছি। সকলে বালকের দুঃসাহস দেখে বিস্মিত হলো। এই নির্ভীকতার যে কী পরিণাম, তা কল্পনা করে সকলে শিউরে উঠলো।
মনরূদ ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেনঃ কেন? কেন করলে?
ইবরাহিম সাহসে বুক ফুলিয়ে বললেনঃ যে সামান্য মানুষ হয়ে খোদা হবার স্পর্ধা করে তাঁর শাস্তি দিয়েছি। এখনো সবাধান হোন জাহাঁপনা –নইলে খোদা আপনাকে ক্ষমা করবেন না।
অমাত্যবর্গ অবাক। এতো বড় উচিত কথা মুখের ওপর কেউ কোনদিন তাঁকে বলেনি।
নমরূদ হুঙ্কার দিলেনঃ এই, কে আছিস?
মুক্ত তরবারি হস্তে প্রতিহারী এসে কুর্ণিশ জানালো।
নমরূদ হুকুম করলেন। এই মুহুর্তে এর গর্দান চাই।
জল্লাদের হাতের অস্ত্র উজ্জ্বল আলোকে ঝলমল করে উঠলো। নমরূদ তাকে থামবার ইঙ্গিত জানিয়ে দু’হাত আন্দোলিন করে বললেনঃ না-না না, বধ করো না –এত আরামে এর মৃত্যু হতে পারে না। একে আগুনে দগ্ধ করে হত্যা করতে হবে। তোমরা সবাই কাঠের যোগাড় করো।
জীবন্ত মানব দগ্ধ করা একটা কৌতূককর ব্যাপার। সুতরাং লোক-লস্কর, পাইক-সেপাই বনবাদাড় উজাড় কলে শহরের বাইরে এক ময়দানে কাঠ স্তূপ করতে লাগলো। কিছুকাল পরে একটি নির্দিষ্ট দিনে বিরাট স্তূপীকৃত কাঠের ওপরে ঘি ঢেলে এমন অগ্নিকুণ্ড করা হলো যার তাপে এক মাইলের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলছে –নমরূদ সেদিক পানে চেয়ে চিৎকার করে বললেনঃ শীঘ্রই ইবরাহিমকে আগুনের মধ্যে ফেলে দাওঃ
সিপাহী-শাস্ত্রী করজোড় নিবেদন করলোঃ জাঁহাপনা, আধমাইলের মধ্যে যে সব পাখি উড়ছিলো তার অবধি পুড়ে মরে গেছে। আগুনের নিকটবর্তী না হলে কি করে আমরা ইবরাহিমকে ওর মধ্যে ফেলতে পারি।
নমরূদ দেখলেন কথাটা সত্য, কিন্তু তথাপি মুখ বিকৃত করে চিৎকার করে উঠলেনঃ তবে কি তাকে রেহাই দিতে চাও নাকি? কাঠের সঙ্গে কাঠ বেঁধে চরকির মতো তৈরি করো –তার সঙ্গে ইবরাহিমকে বেঁধে দূর থেকে নিক্ষেপ করো।
ঠিক-ঠিক, একথাটা কারুর মনেই হয়নি। ইবরাহিমকে আগুনে ফেলতে না পেরে উৎসাহটা কেমন ঝিমিয়ে এসেছিলো। সুতরাং এবার সকলেই পৈমাচিক আনন্দে করতালি দিয়ে উঠলো।
নমরদের হুকুম মতো চরকির কাঠের আগায় ইবরাহিমকে বেঁধে কয়েক পাক ঘুরিয়ে দূর থেকে আগুনের মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো।
কিন্তু আশ্চর্য, যে প্রচণ্ড আগুনের লেলিহান শিখা এতক্ষণ দাউ-দাউ করে জ্বলছিলো –ইবরাহিম আগুনে পড়বামাত্র আগুনের ফুলকিগুলো বিচিত্র রঙের ফুলে পরিণত হলো। যে সকল কাঠ অগ্নিদগ্ধ হয়ে একেবারে ছাই হয়ে গিয়েছিল মুহুর্ত মধ্যে সেগুলো পত্র পুষ্প ভরে উঠলো। দেখতে দেখতে সেই ভীষণ অগ্নিকুণ্ড পুষ্প উদ্যানে পরিণত হলো। তার মধ্যে ইবরাহিম কাণ্ড দেখে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু সে মুহুর্তের জন্যই –পরক্ষণেই চীৎকার করে বললেনঃ হতভাগাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলো।
নমরূদের হুকুম পেলে লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর দিকে পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগলো, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, একটা পাথরের কণাও তাঁর গায়ে আঘাত করলো না –সব পাথর জমাট বেঁধে মেঘের রূপ ধরে ইবরাহিমের মাথার উপরে ছায়া করে রইলো।
ব্যাপার দেখে নমরূদ বুঝতে পারলেন অনুচরবর্গকে বেশি দিন শক্তিসামর্থের কথা গায়ের জোরে বিশ্বাস করানো চলবে না –কিন্তু বাইরে সে কথা প্রকাশ করলেন না। বললেনঃ ও ছোকরা যাদু জানে –যাদুবিদ্যার গুণে এসব করছে।
ইবরাহিম আগুন থেকে বেরিয়ে এসে নমরূদকে ডেকে উচ্চকণ্ঠে বললেনঃ দেখরেন জাঁহাপনা খোদা যাকে রক্ষা করেন –কেউ তাকে মারতে পারে না। তাই বলছি, অহঙ্কার ত্যাগ করে খোদার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
নমরূদ বিরস কণ্ঠে বললেনঃ তোর খোদার নিকট তো কিছু আমি চাই না, তবে নিরর্থক তাকে মানতে যাবো কেন?
ইবরাহিম বললেনঃ এখন চান না বটে, কিন্তু আপনাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি –এই সাম্রাজ্য তিনিই আপনাকে দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছা করলে এই মুহুর্তে আপনাকে ধ্বংস করতে পারেন।
নমরূদ ক্রোধে সিংহাসক থেকে লাফিয়ে উঠলেন। হুঙ্কার ছাড়লেনঃ এতো বড় স্পর্ধা! তোর খোদা আমাদের ধ্বংস করবে। শোন ইবরাহিম তোর খোদাকে খুন করে আমি তার রাজ্য কেড়ে নেবো।
কিন্তু খোদা যে আকাশে থাকেন এই নিয়েই বাঁধলো গোল, সেখানে যাওয়া যাবে কি উপায়ে তাই হলো নমরূদের চিন্তার বিষয়।
মন্ত্রীদের নিয়ে পরামর্শ-সভা বসলো। অনেক বাদানুবাদ এবং বিতর্কের পর মন্ত্রীরা একমত হয়ে অভিমত প্রকাশ করলেন, যদি চারিটি শুকুনি সংগ্রহ করা যায়, তবে একটি জলচৌকির চারি-পাশে তাদের বেঁধে প্রত্যেকের মুখের সম্মুখে কিছু দূরে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে রাখলেই তারা মাংসের লোভে ওপরের দিকে উঠতে থাকবে –তাহলে আকাশের ওপরে খোদার দেশে যেতে পারা যাবে। যুক্তিটা নমরূদের মনঃপুত হলো। তিনি তৎক্ষণাৎ শকুনি ধরে আনবার জন্যে সিপাহী-শাস্ত্রীর ওপরে হুকুম করলেন।
গোটা চারেক শকুনি অত অল্প দিনেই সংগৃহীত হলে গেলো। অতঃপর নমরূদ একদিন প্রচার করলেন, তিনি খোদাকে হত্যা করবার জন্য আকাশে উঠবেন।
এই অভাবনীয় কাণ্ড দেখবার জন্যে রাজ্যের চারিদিক থেকে দলে দলে লোক প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে সমবেত হলেন।
যথাসময়ে জলচৌকির চারটা খুঁটির সঙ্গে শকুন চারটাকে বেঁধে মুখের খানিকটা ওপর মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হলো নমরূদ দু’জন সঙ্গী নিয়ে সেই চৌকির ওপরে গিয়ে বসলেন। শকুনগুলো মাংসের লোভে উড়তে শুরু করলো।
উড়তে উড় মেঘলোক পার হয়ে আরো ওপরে –আরো ওপরে –এত ওপরে উঠলো যে, পৃথিবীকে একটা ধোঁয়ার মতো মনে হতে লাগলো। নমরূদ নিচের দিকে চেয়ে শিউরে উঠলেন। যদি দড়ি ছিঁড়ে জলচৌকিটা পড়ে যায় –কী যে দশা ঘটবে ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। কিন্ত সঙ্গী দু’জনের কাছে তাঁর ভয়ের কথা তিনি গোপন করলেন। বললেনঃ আমরা তবে এবার ইবরাহিমের খোদার রাজ্যে এসেছি। শুনেছি তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। তাও নাই বা গেলো-চারিদিকে তীর ছুঁড়ি, যেখানেই থাকে –দফা ঠাণ্ডা হবে। এইবলে তিনি চারদিকে তীর ছুঁড়তে শুরু করলেন।
খোদাতা’লা স্বর্গদূত জিবরাইলকে বললেনঃ নমরূদ অনেক আশা করে আমাকে বধ করতে এসেছে। যে আমার নিকট যা চেয়েছে আমি তাকে তা দিয়েছি। তুমি নমরূদের তীরগুলো ধরে প্রত্যেক ফলকের আগায় মাছের রক্ত মাখিয়ে নমরূদকে ফিরিয়ে দাও। তাকে নিরাশ করো না।
খোদার আদেশ মতো স্বর্গদূত জিবরাইল মৎস্যের নিকটে রক্ত চাইতে গেলো। মৎস্য বললোঃ খোদা যেন আমাকে ক্ষমা করেন, একজন ধর্মদ্রোহীতার জন্য রক্ত দিতে আমি স্বীকৃত নই।
জিবরাইল বললেনঃ তুমি রক্ত দান কর। দয়ালু খোদা তার প্রতিদানের এই সুযোগ তোমাকে প্রদান করবেন, কোন পশু জীবিতাবস্থায় বধ না করলে মানবগণ তার মাংস আহার করবে না, কিন্তু তুমি জীবিক বা মৃত অবস্থাতেই মানবের ভক্ষ্য হবে।
চিংড়ী, বেলে ইত্যাদি মৎস্য আনন্দের সঙ্গে স্বীকৃত হয়ে রক্ত দান করলো। সেদিন হতে তাদের দেহ আজ অবধি রক্তহীন, তোমরা লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে।
নমরূদের চৌকির উপর রক্তমাখা তীর এসে পড়তে লাগলো। তীরের অগ্রভাবে রক্ত দেখে আনন্দে তিনি উৎফুল্লা হয়ে উঠলেন। তাঁর শত্রু-তার প্রতিদ্বন্দ্বী খোদা তবে মারা পড়েছেন! যাক –এতদিনে নিষ্কণ্টক হওয়া গেল।
নমরূদ নিচে নামবার জন্য মাংসের টুকরোগুলো শকুনির মুখের নিচে ঘুরিয়ে দিলেন। শকুনিগুলো শাঁ-শাঁ শব্দে পৃথিবীর দিকে দ্রুত বেগে নেমে এলো।
নমরূদ মাটিতে নেমে রক্তমাখা তীরগুলো সমবেত প্রজাদের দেখিয়ে বললেনঃ ইবরাহিমের খোদাকে আমি হত্যা করে এসেছি। এই দেখ তীরের আগায় তাঁর দেহের রক্ত।
সকলে একবাক্যে তাঁকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। ইবরাহিমও সেই জনতার মধ্যে ছিলেন। তিনি নমরূদের সমুখে এগিয়ে এলেন। বললেনঃ খোদাকে কেউ কখনো হত্যা করতে পারবে না।
নমরূদ খুশীভরা কণ্ঠে বললেনঃ মূর্খ ইবরাহিম, বিশ্বাস কর –এইমাত্র তাঁকে বধ করে আমি ফিরছি। তোর বিশ্বাস না হয় –তাঁকে ডেকে দ্যাখ –তিনি কেমন করে তোর কাছে আসেন দেখি।
ইবরাহিম জবাব দিলেনঃ তাঁকে কোথাও যেতে আসতে হয় না –তিনি সব জায়গাতেই সব সময়ে রয়েছেন।
নমরূদ বললেনঃ বিশ্বাস করলি না ইবরাহিম? তোর খোদা যদি জীবিতই থাকেন তবে তাঁকে বল সৈন্যসামস্ত যোগাড় করতে –আমি তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করবো।
ইবরাহিম প্রত্যুত্তর করলেনঃ তাঁর সন্য সর্বদা প্রস্তুত, আপনি বরঞ্চ প্রস্তুত হোন। যখন বলবেন তখনই তিনি রাজি।
এ কথায় নমরূদ মনে মনে ভীত হলেন –সত্যই কি তবে ইবরাহিমের খোদা মারা যাননি।
সেদিন হতে নমরূদ সৈন্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করলেন। বহু নতুন সৈন্য নিযুক্ত হতে লাগলো। নমরূদ তাঁর অধীন রাজন্যবর্গের নিকটে সৈন্য চেয়ে পাঠালে অল্প দিনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ সেনা সংগৃহীত হয়ে গেলো।
ইবরাহিম খোদার নিকট আবেদন জানালেনঃ হে নিখিল পতি, হে সর্বশক্তিমান একজন সামান্য মানুষ তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তুমি তাকে সাজা দিয়ে সমগ্র ধর্মদ্রোহীকে বুঝিয়ে দাও, তোমার বিরুদ্ধাচরণ যারা করে তারা তোমার রোষ থেকে ক্ষমা পায় না। হে প্রভু, যদি তাদের ক্ষমা করো তবে তোমাকে যে কেউ মানতে চাইবে না। তাকে শাস্তি দেবার জন্যে আমাকেও সাহায্য করো।
এই আবেদনের প্রত্যুত্তরে দৈববাণী শুনতে পাওয়া গেলঃ কিরূপ শাস্তি তুমি পছন্দ করো –কি সাহায্য তুমি চাও?
ইবরাহিম বললেনঃ তুমি সর্বজ্ঞ, তোমাকে নতুন করে কি বলবো প্রভু! তবে আমার ইচ্ছা, তুমি তোমার সৃষ্টির অতি ক্ষুদ্র এবং অতি দুর্বল প্রাণী দিয়ে নমরূদের সৈন্যগণকে হত্যা করো। ধর্মদ্রোহীরা বুঝুক, তোমার লীলা কি বিচিত্র –কত রহস্যময়।
পুনরায় দৈববাণী হলোঃ তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
এদিকে নমরূদ ইবরাহিমকে যথাসময়ে সংবাদ পাঠালেন তাঁর সৈন্য প্রস্তুত –এবার তিনি খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে ইচ্ছা করেন।
এই সংবাদ শুনে ইব্রাহিম নির্দিষ্ট দিনে যুদ্ধক্ষেত্রে নমরূদের সৈন্যরা যেখানে খোদার প্রেরিত সৈন্যের জন্য অপেক্ষা করছিলো, সেখানে এলেন। নমরূদকে ডেকে বললেনঃ খোদার সৈন্য এবারে যুদ্ধে আসছে –আপনারা প্রস্তুত হোন।
নমরূদ এবং তাঁর সৈন্যরা চেয়ে দেখলো দূরে ‘কাফ’ পর্বতের গায়ে অসংখ্য ছিদ্র –সেই ছিদ্র হতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মশা ভন ভন শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে উড়ে আসতে শুরু করেছে।
নমরূদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। বললেনঃ ইব্রাহিম পালে পালে মশা আসছে দেখতে পাচ্ছি। ঐ কি তোমার খোদার সৈন্য।
ইব্রাহিম বললেনঃ ওরাই খোদার সৈন্য, ওদের অস্ত্রই আপনার সৈন্যগণ আগে সহ্য করুক –পরে অন্যরূপ ব্যবস্থা হবে।
নমরূদ অবজ্ঞাভরে বললেনঃ তবে যুদ্ধ আরম্ভ হোক।
তাঁর আদেশ পেয়ে যুদ্ধের বাজনা বেজে উঠলো।
অমনি মশারা নমরূদের লোক-লস্করের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এক একটি মশা একজন সৈন্যের নাকের ছিদ্রপথে মস্তকে প্রবেশ করে এমন বিষম কামড় দিতে আরম্ভ করলো যে, তারা যন্ত্রণায় নাচতে শুরু করলো। যাতনা সহ্য করতে না পেরে হাতের গদা দিয়ে তারা পরস্পরের মাথায় আঘাত করতে লাগলো। নিদারুণ আঘাতে অনেকেই ভূমিশয্যা গ্রহণ করলো।
কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়। দলে দলে মশা তাদের মাথার ওপরে ভন ভন করতে করতে যেতে লাগলো। একে একে সমস্ত সৈন্যের জীবনলীলা এমনি করে শেষ হলো। বেগতিক দেখে নমরূদও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে যাচ্ছিলেন এমন সময়ে সুডুৎ করে একটা মশা তাঁর নাকের মধ্যে প্রবেশ করলো। যন্ত্রনায় অধীর হয়ে তিনি প্রাসাদের দিকে ছুটে চললেন। প্রসাদে প্রবেশ করে তিনি হেকিমকে হুকুম করলেন মস্তক থেকে মশা বের করে দিতে। শত রকমের ওষুধ সহস্র রকমের প্রক্রিয়া –কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মশার কামড়ের যন্ত্রনায় প্রাণ যায় আর কি! নমরূদ কাতর হয়ে পড়লেন। একজন প্রহরীকে মাথায় কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে আঘাত করতে হুকুম করলেন। আঘাত করাতে কিছুটা যেন আরাম বোধ হলো মনে করলেন। সুতরাং এই উপায়েই রোগের চিকিৎসা চলতে লাগলো। যতক্ষণ আঘাত করা যায় ততক্ষণ মশাটা চুপ করে থাকে –আঘাত বন্ধ হলে মশাটা কামড়াতে শুরু করে।
এই ভাবে কাটতে লাগলো। আহার নেই –শয়ন নেই –নিদ্রা নেই –অবিরাম আঘাত চলতে থাকলো।
এই ঘটনার চল্লিশ দিন পরে ইব্রাহিম একদিন এসে নমরূদকে বললেনঃ শাহানশাহ নমরূদ, আপনি করুণাময় খোদার নিকটে আপনার কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি পরম দয়ালু –আপনাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন। আপনি এই দারুণ যন্ত্রণা হতে মুক্তি পাবেন।
নমরূদ ইব্রাহিমের কথা গ্রাহ্য মাত্র করলেন না। বললেনঃ চল্লিশ দিন তো সামান্য –যদতিন জীবন আছে ততদিন যদি এমনি কষ্ট ভোগ করি তথাপি তোর খোদার কাছে ক্ষমা চাইবো না –তোর খোদাকে মানবো না।
ইব্রাহিম বললেনঃ আপনি খোদাকে মানেন না বটে, কিন্তু আপনার ঘরবাড়ি আসবাবপত্র যা আপনি দেখছেন সকলেই তাঁর বন্দনা করে।
নমরূদ অত্যন্ত সবলকণ্ঠে বললেনঃ কখনো নয়।
ইব্রাহিম বললেনঃ শুনুন তবে।
তন্মুহূর্তে প্রাসাদের চারদিক থেকে শব্দ হতে লাগলোঃ ‘খোদা এক এবং অদ্বিতীয়, ইব্রাহিম তাঁর বন্ধু’।
নমরূদ বললেনঃ ইব্রাহিম তুমি যাদু জানো।
ইব্রাহিম জবাব দিলেনঃ সকল যাদুর যিনি অধিপতি এসব তাঁর দ্বারাই সম্ভব। নমরূদ অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে আদেশ করলেনঃ এই প্রাসাদ, এই আসবাবপত্র –এই ব্যাবিলন পুড়িয়ে দাও।
প্রহরীরা ইতস্ততঃ করতে লাগলো। কিন্তু নমরূদ পুনরায় গর্জন করে উঠতে তারা শহরের চারিদিকে আগুন ধরিয়ে দিলো। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করলো।
নমরূদ নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেই উজ্জ্বল অগ্নির দিকে চেয়ে রইলেন।
ইব্রাহিম বললেনঃ ব্যাবিলন পুড়ে গেল বটে, কিন্তু আপনার গায়ের জামা-কাপড় আপনার হাত-পা সবাই তো খোদাকে মানে।
নমরূদ শুনতে পেলেন, সত্যই তাঁর দেহের বস্ত্রখণ্ড হতে –পদযুগল হতে শব্দ উত্থিত হচ্ছেঃ ‘খোদা এক এবং অদ্বিতীয়, ইব্রাহিম তাঁর বন্ধু’।
নমরূদ জামা খুলে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিলেন। কোষ থেকে তরবারি মুক্ত করে আঘাত করতেই দেহ থেকে পা-দুটো বিচ্ছিন্ন হয়ে লাফাতে লাগলো। তবু পাপাচারী নমরূদের মুখে খোদার নাম উচ্চারিত হলো না।
ইব্রাহিম অনুরোধ করলেনঃ এখনো আপনি খোদার স্মরণ নিন তিনি আপনাকে শান্তি দিবেন।
নমরূদের জিদ অত্যন্ত প্রবল। বিকৃত কণ্ঠে বললেনঃ ও-সব বুজরুকি আমার কাছে চলবে না।
কিছুক্ষণ পরে হতভাগ্যের দেহ ধূলায় লুটিয়ে পড়লো। তাঁর দম্ভ, অহঙ্কার, অভিমান বাতাসে মিশে গেলো।
বিহি হাজেরা কাঁদে দূর মরু ময়দানে,
ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ তাঁরে ত্যাজে কোন প্রাণে।
সারা ও হাজেরা বিবি সতীন দুইজন,
হাজেরাকে ইব্রাহিম দেন নির্বাসন;
মরু আরবের ময়দানে একা কাঁদিছে হায়!
ধূ ধূ বালু-পানি হায় নাহি কোন খানে।
‘পানি কোথা পানি দাও’ পানি বলি ফুকারে নারী;
পিপাসায় প্রাণ বাহিরায় –কোথায় বারী।
দেহ পুড়ে যায় সাহারার ‘লু’ হাওয়ায়
আগুন ঢালিছে রোদ প্রাণ বুঝি যায়-
থৈ-থৈ জ্বলে বালু-বালুর সাগর,
মরীচিকা মনে হয় ওই সরোবর,
অভাগী ছুটিয়া যায় পানির সন্ধানে।
নয়নে অশ্রু নাই-দেহ ফেটে লহু বুঝি ঝরে,
এক ফোঁটা পানি দাও –কলিজা বিদরে!
শিশু ইসমাইল পড়ে মাটিতে লুটায়
হাত পা ছুঁড়িয়া শিশু খেলা করে তায়,
পায়ের আঘাতে তার জমিন ফাটিয়া
পানির ঝরনা-ধারা আসে বাহিরিয়া,
হাজেরা শোকর করে খোদা মেহেরবানি।
হাজেরা বিবি সেই ‘আবে জম্ জম্’ পান করে প্রাণ বাঁচালেন।
হাজেরার নির্ব্বাসন
হযরত ইব্রাহিম একবার ভ্রমণ করতে বেরিয়ে নানা স্থানে ঘুরতে ঘুরতে হারাম দেশে এসে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে কিচুদিন বাস করার পরে সারা খাতুনকে বিবাহ করবার তার সুযোগ ঘটে। আরো কিছুকাল সেখানে কাটিয়ে তিনি মিশর রাজ্যে গিয়ে সেখানকার সুলতানের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। সম্রাট তাঁর সৌজন্য ও সহৃদয়তার পরিচয় পেয়ে অতিশয় আকৃষ্ট হলেন এবং তাঁর ধর্মালোচনায় মুগ্ধ হয়ে একান্ত অনুগত হয়ে পড়লেন। কিছুকাল থাকবার পর ইব্রাহিম মিশর ত্যাগ করবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে সম্রাট তাকে বহু ধনরত্ম পারিতোষিক প্রদাণ করেন এবং সেই সঙ্গে একটি পবিত্র-চরিত্রা বাঁদীও তাকে উপহার দেন। সেই বাঁদীটির নাম হাজেরা। হাজেরাকে সঙ্গে নিয়ে নানা দেশ-বিদেশে পরিভ্রমণ করে অবশেষে তিনি প্যালেস্টাইন এসে উপনীত হলেন।
সারা খাতুনের কোন সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করলো না। প্রতিবেশীরা মনে ভাবলেন, তিনি বন্ধ্যা। হযরত ইব্রাহিম পুত্রমুখ দেখতে না পেয়ে মনের কষ্টে দিন কাটান। তাঁকে সর্বদা অতিশয় ম্লান দেখানো। স্বামীর দুঃখ বুঝতে পেরে সারা খাতুন চিন্তা করলেন, তাঁর নিজের গর্ভে তো সন্তানাদি হলো না। হাজেরার সাথে স্বামীর বিবাহ দিলে হয়তো সকলের মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে।
কথাটা তিনি একদিন প্রসঙ্গক্রমে স্বামীর নিকটে ব্যক্ত করলেন। হযরত ইব্রাহিম অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। অনেক দ্বিধার পর তিনি সারা খাতুনকে খুশী করবার অভিপ্রায়ে অবশেষে স্বীকৃত হলেন। এক শুভক্ষণে ইব্রাহিম বিবি হাজেরার পাণি গ্রহণ করলেন এবং সন্তান কামনা করে খোদাতা’লার অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন।
ভক্তের প্রার্থনা কখনো বিফলে যায় না। খোদাতা’লা তাঁর আরজ মঞ্জুর করলেন। যথাসময়ে ইব্রাহিমের একটি চাঁদের মতো শিশু জন্মগ্রহণ করলে। শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বিষন্নপুরী আনন্দে মশগুল হয়ে উঠলো। শিশুটির নাম রাখা হইল ইসমাইল।
নারীর মন অতি বিচিত্র। যে সন্তানের জন্য সারা খাতুন স্বেচ্ছায় সপত্নী গ্রহণ করলেন চাঁদের মতো সেই সন্তানকে দেখে তাঁর মনে হিংসার উদ্রেক হলো। ক্রমে এমন অবস্থা হলো যে, সতীনের পুত্রকে কিছুতেই তিনি আর বরদাশত করতে পারলেন না। এক বাড়িতে নিজের চোখের সম্মুখে সপত্মীপুত্রকে সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠলো। তিনি হযরত ইব্রাহিমকে সর্বদা বিবি হাজেরার দুর্নাম শোনাতে লাগরেন এবং তাদের পরিত্যাগ করবার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু ইব্রাহিম তাঁর অন্যায় আবদার রক্ষা করলেন না।
কিন্তু ভাগ্য যাদের অপ্রসন্ন দুঃখ তাদের সইতেই হয়! শেষ অবধি হাজেরাও খোদার রোষ থেকে রক্ষা পেলেন না। আল্লাহতা’লা ইব্রাহিমকে হাজেরা ও তাঁর পুত্রকে মক্কা নগরীর নিকটে এক মরুভূমিতে নিয়ে গেলেন, তার পর অশ্রুপূর্ণ কণ্ঠে হাজেরাকে বললেনঃ খোদার হুকুমে তোমাকে এখানে রেখে যাচ্ছি। তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। এই বলে তিনি এক মশক পানি ও কিছু খেজুর তাঁকে দিয়ে চলে গেলেন। কিছু দূরে গিয়ে প্রার্থনা করলেনঃ হে খোদা, তোমারই হুকুমে আমার স্ত্রী ও পুত্রকে এস্থানে রেখে যাচ্ছি। তুমি সকলের রক্ষাকর্তা প্রভু, এরা যেন কোন বিপদে না পড়ে –তুমিই এদের রক্ষা করো।
কিছুদিন পরে খাদ্য এবং পানীয় নিঃশেষ হয়ে গেলো। জননীর বুকের দুধের ধারা ক্ষীণ হয়ে এলো। শিশু ইসমাইল ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় চিৎকার করতে লাগলো। হাজেরা নিকটবর্তী পাহাড়ের ওপরে উঠে জলাশয়ের সন্ধান করতে লাগলেন। নিরাশ হয়ে অপর একটি পাহাড়ের শীর্ষদেশে উঠে নিকটে কোনো জনমানবের বসতি আছে কিনা লক্ষ্য করতে লাগলেন এবং মনে মনে খোদার অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে লাগলেন। বারে বারে নিরাশ হয়েও বেচারী হাজেরা একবার সম্মুখে ও একবার পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে ছুটোছুটি করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানির সন্ধান তিনি পেলেন না।
হঠাৎ তাঁর নজরে শিশু ইসমাইলের পায়ের আঘাতে পাথরের টুকরা সরে গিয়ে একটা গর্ত হয়েছে ও তার মধ্যে থেকে ক্ষীণ পানির ধারা ধীরে ধীরে বের হচ্ছে। তিনি পরম দয়াবান খোদাতা’লাকে অন্তরে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রাণভরে পানি পান করলেন এবং শিশুর মুখে দিলেন।
ঝরণার চারিধারে বিবি হাজেরা বাঁধ দিয়ে দিলেন, ফলে সেটা একটা সুমিষ্ট পানীয় কূপ তৈরী হলো। ঐ কূপ চার হাজার বৎসর ধরে লোককে পানীয় জুগিয়ে আজও হযরত হাজেরার মাতৃহৃদয়ের আকুল প্রার্থনার সাক্ষ্য দান করছে। ক্রমে ক্রমে ঐ স্থানে লোকের বসতি হয়ে সুবিখ্যাত মক্কা নগরী তৈরী হয়েছে।
সেই সময়ে সদোম নগরীর লোকেরা খোদাতা’লার বিধিনিষেধ না মেনে নানা রকম কুৎসিৎ কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। হযরত লুত তাদের সৎপথে আনবার এবং ধর্মপথে চালাবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। লুতের সদুপদেশ তাদের একেবারেই ভাল লাগে না।
খোদাতা’লা কয়েকজন ফেরেশতাকে সদোম নগরী ধ্বংস করাবর জন্যে প্রেরণ করলেন।
ফেরেশতারা প্রথমে হযরত ইব্রাহিম নিকটে উপস্থিত হলেন। ইব্রাহিম তাদের যথোচিত সমাদরের ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু ফেরেশতারা কিছুই আহার করলেন না, কারণ, তাঁরা সমস্ত আহার বিহারের অতীত। ইব্রাহিম ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রদান করে বললেনঃ সদোম নগরী ধ্বংস করবার জন্য খোদাতা’লা কর্তৃক তাঁরা প্রেরিত হয়েছেন। কারণ নগরের লোকেরা নানারূপে পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ফেরেশতারা সারা খাতুনকে বললেন যে, শীঘ্রই তাঁর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তাঁর নাম হবে ইসহাক এবং সেই পুত্রের পুত্র হলে তাঁর নাম হবে ইয়াকুব।
কিন্তু সারা খাতুন তাঁদের কথায় সন্দিহান হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে কি করে তার পুত্র হওয়া সম্ভব।
ফেরেশতারা বললেনঃ খোদাতা’লার কৃপায় সকলই সম্ভব।
হযরত ইব্রাহিম সদোম নগরীর ধ্বংস অনিবার্য জেনে পাপী লোকদের জন্য খোদাতা’লার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। কিন্তু খোদাতা’লা তাঁকে জানালেন সেদাম নগরীর ধ্বংস কিছুতেই নিবারিত হবে না।
ফেরেশতারা হযরত লুতের নিকটেও অতিথির ছদ্মবেশে উপস্থিত হলেন এবং তাকেও সদোম নগরীর ধ্বংস সম্পর্কে আল্লাহর অভিপ্রায় জ্ঞাপন করলেন এবং বললেনঃ
তুমি অনুচরবর্গকে সঙ্গে নিয়ে অদ্য রাত্রেই এ-স্থান পরিত্যাগ করো। নইলে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। কারণ খোদাতা’লার রোষ শীঘ্রই এই লোকদের ওপরে পতিত হবে, এমন কি তোমার স্ত্রীও সে গজব থেকে রক্ষা পাবে না।
হযরত লুত সেই রাত্রেই সদোম নগরী পরিত্যাগ করলেন। রজনী প্রভাতের সঙ্গেসঙ্গে প্রবল ঝঞ্ঝা ও ভূমিকম্পে সেই বিশাল নগরীর বিপুল ঐশ্বর্য, অতুল দম্ভ এবং অগণিত নরনারীসহ চিরদিনের জন্য পৃথিবীর বক্ষ বিলুপ্তহয়ে গেলো।
ইব্রাহিম খলিলুল্লা খোদাতা’লার প্রিয়জন
কোরবানি দেন ইসমাইলে তার সন্তান আপন।
এক রাত্রে তিনি খোয়াব দেখলেন
খোদা যেন তাকে হুকুম করেছেন,
‘ইয়া ইব্রাহিম কোরবানি দে কোরবানি দে’।
(তিনি) তিনি ভোরে উঠে শত উট করলেন জবেহ।
ভাবলেন –খোদার আদেশ হরে সমাপন।
পরের রাতে স্বপন দেখেন হুকুম আল্লাহর
প্রাণের চেয়ে প্রিয় যাহা কোরবাহি দিস তার।
প্রাণের চেয়ে প্রিয়! সে ত অপর কেহ নয়
পুত্র কেবল ইসমাইল জবিউল্লাহ হয়।
ইসমাইলে সঙ্গে নিয়ে ময়দানেতে যান
তাঁরে তিনি বধ করবেন একথা জানান,
শহীদ হবে শুনে পুত্র অতি খুশী হন।
ছুরি হাতে ইব্রাহিম বেঁধে নিলেন আখিঁ,
হয়তো মমতা হবে (খোদার কাজে) আসতে পারে ফাঁকি।
চোখ বেঁধে তাই ছুরি চালন পুত্রের গলায়
দেহ হতে মাথা কেটে ভূমিতে লুটায়।
চোখ খুলে চেয়ে দেখন পুত্র বেঁচে আছে
তার বদলে (এক) দুম্বা জবেহ করিয়াছে;
ঈমান পরীক্ষা হলো –ধন্য হলো সে পাক জীবন।
কোরবানি
হযরত ইব্রাহিম বিবি হাজেরাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি সারা খাতুনের অনুমতি গ্রহণ করে মক্কা নগরীতে মাঝে মাঝে স্ত্রী ও পুত্র ইসমাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যেতেন।
একদিন ইব্রাহিত স্বপ্নে দেখতে পেলেন, খোদাতা’লা যেন তাকে কোরবানি করবার জন্যে হুকুম করছেন। পরদিন আল্লাহের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি একশত উট ও দুম্বা কোরবানি করলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও সেদিন রাত্রে তিনি পুনরায় খোদাতা’লার আদেশ পেলেন যে, তাঁকে পুনরায় কোরবানি করতে হবে। তিসি সে হুকুমও পালন করলেন। কিন্তু অতিশয় তাজ্জবের কথা তাঁর সে কোরবানি গ্রহণ করলেন না। পরের রাত্রে তিনি পুনরায় খোয়াব দেখলেন, খোদা তাঁকে যেন হুকুম করেছেনঃ ইব্রাহিম, তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু আমার উদ্দেশ্য কোরবানি করো।
ইব্রাহিম বিষম বিপদে পতিত হলেন। সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কি? ধন-ঐশ্বর্য বিষয় সম্পত্তি –এ সকল তো প্রিয়। স্ত্রী এদের চেয়ে প্রিয়। স্ত্রী অপেক্ষা আপনার প্রাণ অধিক প্রিয়। জগতে সকলের চেয়ে প্রিয়তম তাঁর পুত্র। নানা চিন্তায় রাত্রি প্রভাত হলো। তিনি ভাবলেন, খোদাতা’লা সম্ভবত তাঁর পুত্রকেই কোরবানিরূপে চাইছেন। উত্তম, তাই হবে। ইহা অপেক্ষা সৌভাগ্যের বিষয় আর কি আছে। অনেক পূণ্যে ইব্রাহিমকে এই কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। খোদার অনুগ্রহ থাকলে নিশ্চয়ই এই হৃদয়-দ্বন্দ্ব এবং ঈমান পরীক্ষায় তিনি জয়ী হতে পারবেন। সঙ্কল্প স্থির করে হযরত ইব্রাহিম পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে দূরবর্তী পাহাড়ের নিকটে গেলেন এবং ইসমাইলকে খোদার আদেশ জ্ঞাপন করলেন। ইসমাইল পিতার কথা শুনে আপনার জীবন বলি দিতে সানন্দে স্বীকৃত হলেন। বললেনঃ আব্বা, খোদা আমায় জীবন দিয়েছেন, তিনিই যখন গ্রহণ করতে চাচ্ছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্য। আপনি যথা-সম্ভব শীঘ্র কোরবানি করুন।
ইব্রাহিম মনকে দৃঢ় করে বস্ত্রের মধ্য থেকে ছুরিকা বের করলেন। তীক্ষ্ণ ধার অস্ত্র প্রথম রৌদ্র ঝলসে উঠলো। একখানা রুমাল দিয়ে তিনি পুত্রের চোখ বেঁধে দিলেন এবং জবেহ করতে মনে মমতার সঞ্চার হতে পারে ভেবে অপর একখানি বস্ত্রখণ্ড দ্বারা আপনার চক্ষু আবৃত করলেন। দৃঢ়হস্তে ইসমাইলের গলায় ছুরিকা চালালেন।
কার্য সমাপ্ত করে চোখের বন্ধন তিনি মুক্ত করলেন। কী আশ্চর্য, খোদার এমনি মরতবা পুত্র ইসমাইল অক্ষত দেহে সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার পরিবর্তে একটি দুম্বা জবেহ হয়ে ভূমিতলে পড়ে আছে।
এমন সময় গায়েবী আওয়াজ (দৈববাণী) শুনতে পাওয়া গেলোঃ ইব্রাহিম তোমার কোরবানি আল্লাহ কবুল করেছেন। পুত্রকে জবেহ করবার আর প্রয়োজন নাই।
পিতা ও পুত্রের হৃদয় খোদার অসীম করুণার প্রতি কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে গেল।