দুরন্ত সাহসী সেনাপতি হযরত খালিদ (রা)
এক, ইসলামের আলো মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষ দলে দলে এসে ইসলামের পতাকাতলে জমায়েত হচ্ছিল। সুদূর মদীনায় পৌঁছে গেল দীনের আলো। আল্লাহর সত্য বাণী দ্রুত উদ্ভাসিত হতে লাগল। ফলে মিথ্যায় ঢাকা অন্ধকারের চাদর সরে যেতে লাগল। এক নতুন প্রভাবের আগমনী বার্তা যেন শোনা যাচ্ছিল সর্বত্র। সবখানে ধ্বনিত হচ্ছিল ইসলামের জয়গান। মানুষের মুখে মুখে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর নাম আলোচিত হচ্ছিল। হযরত খালিদ (রা) ছিলেন একজন বীর সেনানী। তিনি তখনও ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নেননি। মুসলমানেরদ জানের দুশমন এই খালিদ। ভয়ানক শত্রু বলে মুসলমানরা তাকে চেনে। ইসলামকে ধাবিয়ে রাখতে তিনি কম কষ্ট করেননি।
তবে সত্যের বিরুদ্ধে আর পেরে উঠতে পারছিলেন না। সারাক্ষণ তাঁর বিবেক ইসলামের আবেশে নাড়া খাচ্ছিল। মনের দরজায় উঁকিবুকি দিচ্ছিল দীনের আলোর সুষমা। ধীরে ধীরে তিনি সত্যের আবেশে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হলেন। তাই তিনি গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। এদিকে ইসলামের বিরুদ্ধেও তিনি খুব পরিচিত নাম। সবাই তাকে লিডার হিসেবে মানে। এটাও যে অনেক বড় মর্যাদা। কিন্তু এটা তো মিথ্যার পথ। মিথ্যাকে আর মেনে নিতে তাঁর বিবেক চাইল না। এদিকে সমাজের পাপ-পঙ্কিলতা তার মনকে বিষিয়ে তুলল। তাই তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। না, এভাবে আর চলা যায় না। অসত্যের জীবন আর নয়। খালিদ শেষমেশ নড়ে চড়ে উঠলেন। ইসলামকে কবুল করতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। একসময় মহানবী (সা)-এর সান্নিধ্য পেতে খালিদের মধ্যে পেরেশানি সৃষ্টি হলো।
একদিন তিনি মদীনার পথে পা বাড়ালেন। মদীনা তখন অনেক দূরের পথ। তাতে কী? নবীজির সাথে তাঁকে দেখা করতেই হবে। অবশেষে খালিদ ঠিকই মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং নবীজির সাথে দেখা করলেন। কালবিলম্ব না করে মহানবী (সা)-এর হাতে হাত রেখে খালিদ ইসলাম কবুল করে নিলেন।
হযরত খালিদ (রা) ইসলামে দাখিল হওয়ার আগে নবীজিকে বললেন,
: হে দীনের নবী (সা)! আমি জীবনের অনেক অন্যায় করেছি। আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। এতদিন ভুল পথে চলে জীবনকে কালিমালিপ্ত করেছি। আমি নিজের ওপরও অনেক জুলুম করেছি। আজ আমি সত্য ও মিথ্যার তফাত বুঝতে পেরেছি। আর না বুঝে ইসলামেরও অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। মুসলমানের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজ আপনি আমাকে মাফ করে দিন। এখনই আমাকে সত্য দীন গ্রহণ করার সুযোগ দিন।
খালিদ এতদিন ছিলেন ইসলামের পরম শত্রু। দীনের আলো নির্বাপণে যার হাত ছিল সক্রিয়, সেই খালিদ এখন ইসলামের মহান সেবকে পরিণত হলেন। তার মতো একজন বীর পুরুষের ইসলাম গ্রহণে মুসলমানদের শক্তি আরও বেড়ে গেল। এদিকে মহাবীর খালিদের জন্য শুরু হলো আরেক ভিন্ন জীবন। এ জীবন সুন্দর ও সৌরভে ভরা, এ জীবন বেহেশতী আলোয় উদ্ভাসিত। দীন কায়েমের দীর্ঘ সংগ্রামে খালিদ (রা) শামিল হলেন। ফলে কাফেররা আঁতকে উঠল। মুশরেকদের হৃদকম্পন শুরু হলো। হযরত খালিদের যে তরবারি ইসলামের ধ্বংসে ব্যবহৃত হতো, তা এখন দীন কায়েমের লড়াইয়ে শতগুণ দৃঢ়তায় গর্জে উঠল। তাঁর ক্ষুরধার তরবারির সামনে দাঁড়াতে কাফেররা আর সাহস পেল না। কাফেররা জানে খালিদের বীরত্ব কতটা ভয়ানক ও সুকঠিন। ইসলামে আসার পর তাঁর তরবারি বহু মুশরেক ও কাফেরের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করেছে, তাদের প্রচণ্ড তছতছ করে দিয়েছে।
দুই, ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খালিদ (র) প্রথম মুতার জেহাদে অংশ নিলেন। সেই যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব সবাইকে অবাক করে দিল। একে একে তিনজন মুসলিম সেমানপতি সেদিন শহীদ হলেন। এতে মুসলিম সেনারা হতবিহবল হয়ে পড়লেন। তারা সবাই ঘাবড়ে গেলেন। চরম পরাজয়ের অন্ধকার সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কিন্তু নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন হযরত খালিদ। সাহসিকতার সাথে তিনি সেনাপতির দায়িত্ব নিলেন। এরপর খালিদের সুনিপুণ নেতৃত্বে মুসলমানরা শত্রু সেনাদের ওপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তাঁর যুদ্ধ পরিচালনায় শত্রু শিবিরে নেমে এলো অমানিশা। ফলে শত্রুরা দিকশূন্য হয়ে পড়ল। যুদ্ধ করতে করতে একে একে খালিদের সাতটি তরবারি ভেঙে গেল। তারপরও থামলেন না তিনি। প্রাণপণে লড়াই করে অগণিত শত্রু খতম করলেন খালিদ (রা)। হযরত খালিদ (রা)-এর বুদ্ধি, অপরাজেয় সাহস ও অমিত বীরত্বের কাছে হেরে গেল কাফের মুশরেক দল। মুতায় নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে রেহাই পেল মুসলিম বাহিনী।
তিন, হুনাইনের জেহাদে হযরত খালিদের বীরত্বও ছিল প্রশংসনীয়। তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে হুনাইনে লড়াই করেন। শত্রুদের তীরের আঘাতে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। সেই ক্ষত দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরে পড়ল। তবু থেকে যাননি হযরত খালিদ (রা)। হুনাইনের ময়দানে তাঁর তরবারির ধার এতটুকুও কমেনি, বরং তিনি দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে মুসলিম শিবিরে সাহসের দোলা জাগান। এখানেও শত্রুরা পরাজিত হয়।
চার, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মক্কা অভিযানে হযরত খালিদ (রা) ছিলেন সক্রিয়। বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজিত হলেও সেদিন সামান্য রক্ত ঝরেছিল। আবু জেহেলের ছেলে মুসলমানদের অবস্থা বুঝে উঠতে পারেনি। তাই সে সামান্য প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল। তার লোকেরা হযরত খালিদকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেছিল। এর জবাবে খালিদের তীর শত্রুদের দিকে ধাবিক হলো। বিদীর্ণ হলো শত্রুদের বুক। সেখানেই মারা পড়ল কয়েকজন মুশরেক। আর ব্যর্থ হলো তাদের প্রতিরোধ।
পাঁচ, মহানবী (সা)-এর ওফাতের পরের ঘটনা। হযরত আবু বকর (রা) ভণ্ডনবী তুলাইহাকে দমন করার জন্য হযরত খালিদকে দায়িত্ব দিলেন। খালিত তাঁর বাহিনী নিয়ে তুলাইহাকে শায়েস্তা করতে বের হলেন। তুলাইহার বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই হলো। জেহাদে তুলাইহা চরমভাবে পরাজিত হলো। সেদিন আরও অনেকে হযরত খালিদের বাহিনীর কাছে খতম হলো। তুলাইহার ত্রিশজন সেনাকে খালিদের লোকেরা বন্দী করল। তাদের এনে হাজির করা হলো হযরত আবু বকর (রা)-এর সামনে।
ছয়, এরপর হযরত আবু বকর (রা) ভণ্ডনবী মুসাইলামা কাজ্জাবের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করেন। এবারও সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হলো হযরত খালিদকে। তাঁর বীরত্বে মুসাইলামার বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হলো। হযরতওয়াহিশীর হাতে নিহত হলো মুসাইলামা। এই মুসাইলামাই ছিল নবীজির চাচা হযরত হামজার হন্তা। ভণ্ড নবীদের পরাভূত করে এবার খালিদ (রা) মুরতাদদের নির্মূলে অভিযানে নামলেন। তাদেরও দৃঢ়তার সাথে পরাজিত করলেন তিনি। জাকাত অস্বীকারকারী মুনাফেকরাও হযরত খালিদের তরবারিরর কাছে পরাজিত হলো। তিনি প্রতিটি জেহাদে অত্যন্ত সফল হলেন। এরপর হযরত খালিদ ইরাকে অনেক লড়াই পরিচালনা করেন। তাতেও খালিদের অতুলনীয় সফলতা আসে। হযরত খালিদ (রা)-এর সাহস ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে একসময় সমগ্র ইরাক মুসলমানদের করতলগত হলো।
সাত, ফাহলের যুদ্ধে রোমান শত্রুরা হযরত খালিদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করল। তবে তাদের জেহাদ থামল না। রোমানরা এবার দামেস্ক আক্রমণ করে বসল। প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিল মুসলিম বাহিনীর সাথে। হযরত খালিদ (রা) অসীম সাহস ও যোগ্যতার সাথে যুদ্ধ পরিচালন করলেন। রোমান বাহিনী হযরত খালিদের নেতৃত্বে একসময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের বহু সেনা সেদিন নিতহ হলো, আহত হলো অসংখ্য শত্রুসেনা। অহঙ্কারী রোমান সম্রাট ও পরাজয় মেনে নিতে পারল না। তাই তারা আবারও যুদ্ধের জন্য তৈরি হলো। এবার বিপুল রণসম্ভার ও সৈন্য নিয়ে রোমানরা প্রস্তুতি নিলো। রোমান সেনাপতির নাম মাহান। তিনি দু’লাখ চব্বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ইয়ারমুক ময়দানে সমবেত হলেন।
রোমানদের যুদ্ধ যাত্রার খবর পেয়ে হযরত আবু বকর (রা)ও বসে থাকরেন না। তিনি মহাবীর হযরত খালিদকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন ইয়ারমুকে। ৫০,০০০ সেনার এক বিশাল মুসলিম বাহিনী। ইয়ারমুকে এসে হযরত খালিদ প্রতিপক্ষ সেনাপতি মাহানের সামনাসামনি হলেন। কিন্তু রোমান সেনাপতি মাহান বুঝতে পারল, এই যুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারবে না। তাই চতুর রোমান সেনাপতি মুসলমানদের সাথে সমঝোতার চিন্তা করলেন। হযরত খালিদের সাথে রোমান সেনাপতি মাহান কথা বললেন। মাহান প্রস্তাব করলেন,
: শোন খালিদ! তোমাদের অনেক অভাব। তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ। তোমার সেনারা ক্ষুধার্ত। তাই বলি, আমার আপস প্রস্তাব মেনে নাও। তুমি রাজি হলে তোমাদের প্রত্যেককে দশটি দিনার করে দেব, এক প্রস্থ কাপড় দেব। তোমাদের খাবারও দেব। আগামী বছরও তোমরা এভাবে জিনিসপত্র পাবে। এসব কিছুর জন্য শর্ত হলো, তোমরা যুদ্ধ না করে এখান থেকে চলে যাবে।
মাহানের এ প্রস্তাবে হযরত খালিদ অপমানবোধ করলেন। তিনি রোমান সেনাপতিকে বললেন,
: মাহান! তুমি জান, মুসলমানরা ভিখেরির জাত নয়। তারা আল্লাহর সৈনিক। অর্থের বিনিময়ে তাদের কেনা যায় না। একথা বলেই হযরত খালিদ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। তারপর সোজা ছুটলেন তাঁর সেনা ছাউনির দিকে। মুসলিম সেনারা ছিল প্রস্তুত। খালিদ ‘আল্লাহু আকবার’ বলে জেহাদের ঘোষণা দিলেন। আর অমনি তিনি বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন রোমান বাহিনীর সামনে। মহানবীর খালিদ প্রথমেই ঢুকে পড়লেন রোমান অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ঠিক মাঝখানে। তারপর তীব্রভাবে চলালেন তরবারি। যারাই সামনে এলো তারাই হযরত খালিদের ক্ষুরধার তরবারিরর নিচে পড়ে মারা পড়ল।
মুসলিম সেনারা সবাই প্রাণপণে লড়াই করলেন। মুসলমানদের বীরত্ব হযরত খালিদের সুনিপুণ নেতৃত্ব রোমান বাহিনীকে দিশেহারা করে তুলল। তারা আর টিকে থাকতে পারল না।
পরদিন সকাল বেলা। রোমান বাহিনীর একেবারে তছনছ অবস্থা। তাদের অসংখ্য লাশে ভরা ইয়ারমুক ময়দান। আহত হয়ে যারা বেঁচে গেছে তারা ছাউনিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে হযরত খালিদকে দেখা গেল তিনি রোমান সেনাপতি মাহানের মঞ্চের ওপর বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছেন। এ কাণ্ড দেখে রোমানরা আঁতকে উঠল। মুসলিমদ সেনারাও হতবাক হলো। হযরত খালিদের বীরত্ব ও সাহসিকতায় সবাই চমকে গেল। সেদিন রোমানদের আরেক কমাণ্ডার ছিলেন জারজাহ। তিনি হযরত খালিদের অসীম সাহস, দৃঢ় নেতৃত্ব ও খোদাভীতি দেখে বিস্মিত হলেন। আর তখনই তিনি ইসলাম কবুল করে নিলেন এবং রোমানদের পক্ষ ছেড়ে মুসলিম ছাউনিতে এসে আশ্রয় নিলেন।
এভাবে হযরত খালিদ (রা) তাঁর দায়িত্ব নিবিড়ভাবে পালন করেছেন। তাঁর সাহস, নেতৃত্ব, দায়িত্ববোধ ও বীরত্ব ইসলামের সুমহান আদর্শকে অনেক ওপরে তুলে ধরেছিল। ইসলামের শক্তি হযরত খালিদের যোগ্য নেতৃত্বে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। হযরত খালিদ (রা) সকল জেহাদে অসীম বীরত্ব ও সাহসকিতার পরিচয় দিয়েছেন। যুদ্ধ করকে করতে খালিদ (রা) তাঁর জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে তাঁর শরীরের প্রতিটি জায়গায় তীর কিংবা বর্শার চিহ্ন দেখা যেত।
ইসলামের ইতিহাসে মহাবীর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ এক অনন্য নাম। মহানবী (সা) হযরত খালিদকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বলতেন,
: তোমরা খালদকে কষ্ট দিও না। কেননা, সে কাফেরদের বিরুদ্ধে চালিত আল্লাহর তরবারি আর তখন থেকেই খালদের উপাধি হয়েছিল ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তরবারি’। এ উপাধি নবী (সা) একজনকেই দিয়েছিলেন। সেই সৌভাগ্যবান সাহাবী আমাদের প্রিয় বীর হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা)।
হযরত খালিদ (রা)-এর মৃত্যুর পর হযরত উমর (রা) দুঃখ করে বলতেন, ‘আমাদের নারীরা খালিদের মতো সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে, সত্যিই হযরত খালিদের মতো এমন মহান বীর ইসলামের ইতিহাসে তেমনটি আর দেখা যায়নি’।
ব ল তে পা রো?
১। হযরত খালিদ কে ছিলেন?
২। ইসলামে দাখিল হবার আগে খালিদ মহানবী (সা)-কে কী বলেছিলেন?
৩। ইয়ারমুক যুদ্ধে রোমান সেনাপতি কে ছিলেন?
৪। ইয়ারমুক জেহাদে রোমান ও মুসলিম সৈন্যসংখ্যা কত ছিল?
৫। রোমান সেনাপতি হযরত খালিদকে কী প্রস্তাব দিলেন?
৬। কোন রোমন কমাণ্ডার কেন এবং কিভাবে ইসলাম কবুল করলেন?
৭। মহানবী (সা) হযরত খালিদকে কী উপাধিতে ভূষিত করেন?
মজবুত ঈমানের সুরভিত গোলাপ
আবু জেহেল। ইতিহাসের পাতায় একটি অভিশপ্ত নাম। আবু জেহেলের মন ছিল কপটতায় ভরা, জীবন ছিল পাপ ও পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ। তাই সততা ও ন্যায়নীতি ছিল তার কল্পনার বাইরে। বিপদগামীদের সর্দার ছিল আবু জেহেল। সত্যকে পছন্দ করা তো দূরের কথা, সত্যের নামও সে শুনতে পারত না।
সে সময় আরবের সমাজ ভালো ছিল না। গোটা সমাজ অন্যায়, পাপাচার, অনাচার ও অবিচারে পরিপূর্ণ ছিল। মানুষ এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে অনেক প্রভুর ইবাদাত করত। আরবে তখন হানাহানি ও দলাদলি লেগেই থাকত। প্রাচীন আরবের লোকেরা মেয়েদের জীবন্ত কবর দিত। এভাবে এক ঘোর অন্ধকারে ডুবে ছিল আরব সমাজ।
একসময় দুনিয়ায় এলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহ তাঁকে নবী করে পাঠালেন। মহানবী (সা)-এর কাজ ছিল মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানো। তাঁর সাথে ছিল সত্যের আলো। এ আলোর নাম ইসলাম। মানুষকে অসত্য ও অন্যায়ের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করার জন্য এটা ছিল একমাত্র পথ। কিন্তু আবু জেহেলের কাছ এটা পছন্দ হলো না। সে ছিল অন্ধকার পথের মানষ। বাপ-দাদার ধর্ম ছাড়া সে কিছুই বুঝতে চাইত না। তাই সে ইসলামের বিরোধিতা করল। এ জন্য নবী (সা)-কেও সে অনেক কষ্ট দিল। শুধু তাই নয়, যারা মুহাম্মদ (সা)-এর ধর্ম মেনে নিত তাদের ওপরও চালাত নির্যাতন। মাঝে মাঝে চাবুক মেরে তাদের চামড়া তুলে নিত। আবু জেহেলের সাঙ্গো-পাঙ্গরা ছিল একই প্রকৃতির। মুসলমানরে দেখলেই তাদের গা জ্বলে উঠত।
আবু জেহেলের পুত্রের নাম ইকরামা। পুরো নাম ইকরামা বিন আবু জেহেল। পিতার মতো ইকরামাও ভালো লোক ছিল না। সে ছিল আল্লাহর দীনের ঘোর শত্রু। বাবার পঙ্কিল চরিত্র ইকরামাকে পেয়ে বসেছিল। তাই সে ইসলামকে ভালো চোখে দেখত না। ইসলামের প্রতি তার ছিল সীমাহীন বিদ্বেষ। মুসলশানদের সাথেও সে ভালো ব্যবহার করত না। সুযোগ পেলেই সে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালাত। ইসলামের আলো তার অন্ধকার মনকে নাড়া দিতে পারল না, বরং ইসলামের প্রসার দেখে তার বৈরী মনোভাব আরও প্রকট হয়ে উঠল।
তবে আবু জেহেল ও ইকরামাদের দাপট বেশী দিন টিকল না। ধীরে ধীরে ইসলামের আলো মক্কার জনপদে ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে মুসলমানদের দল ভারী হয়ে উঠল। একসময় মুসলমানদের জীবনে দেখা দিল সোনালী সুদিন। আরবের মরুতে ফুটতে শুরু করল ঈমানের সুরভিত গোলাপ। আর তার সুরভি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
এরি মধ্যে কাফেরদের সাথে মুসলমানদের শক্তির লড়াই শুরু হলো। আর এর ফলে ঘটে গেল বদর যুদ্ধ, ইসলামের প্রথম জেহাদ। সেটা ৬২৪ সালের কথা। মদীনা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক বদর প্রান্তর। সেখানে সুসজ্জিত কাফেরদের সাথে মুসলমানদের তুমুল লড়াই হলো। শত্রুরা ছিল অস্ত্র-শস্ত্র ও লোকবলে বহুগুণে শক্তিশালী। কাফেরদের সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজার। অন্যদিকে মুসলমানদের অস্ত্র ছিল নামমাত্র। তাদের সংখ্যাও ছিল অনেক কম, তিনশ’ তেরজন মাত্র। মুসলমারা সংখ্যায় কম হলে কী হবে, আল্লাহর কৃপায় তারা যুদ্ধে জয়ী হলো, কাফেরদের ঘটল চরম পরাজয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আবু জেহেল বদর প্রান্তরে নিহত হলো। পুত্র ইকরামাও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তবে বাগ্যক্রমে সে বেঁচে গেল।
তারপর কেটে গেল অনেক বছর। এর মধ্যে শত্রুদের সাথে মুসলমানদের আরও অনেক লড়াই হলো। কিন্তু কাফেররা বারবার পরাজিত হলো। ফলে মদীনায় ইসলামের সুষমা আরও বিস্তৃত হলো। মহানবী (সা) এবার মাতৃভূমি মক্কায় ফিরে আসতে চাইলেন। কারণ, জন্মভূমিতে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। তাই তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। মক্কা বিজয়ের স্বপ্ন দেখলেন মহানবী (সা)।
ঐতিহাসিক অষ্টম হিজরি সালের ঘটনা। দশই রমজাদের এক আলো ঝলমল দিন। মাত্র দশ হাজার সাহাবী নিয়ে মহানবী (সা) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করলেন। প্রায় বিনা বাধায় তিনি মক্কা নগরী জয় করলেন। মক্কার আকাশে উড়ল ইসলামের বিজয় কেতন। তাই মক্কার বড় বড় শত্রুরা হতবাক হয়ে গেল। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মক্কা শত্রুদের হাতছাড়া হয়ে গেল। তাই তারা দিশেহারা হয়ে পড়ল। এখন উপায়! তারাযে মুসলমানদের পরম শত্রু। অথচ আজ তাদের জন্মভূমি মুসলমানদের দখলে! তাই প্রচণ্ড মৃত্যুভয় তাদের তাড়া করল। কাফেররা ভাবল, আজ আর রক্ষা নেই। মুহাম্মদের লোকেরা তাদের ছাড়বে না। হাতের নাগালে গেলেই তারা মারা পড়বে। তাই তারা চারদিকে ছোটাছুটি করতে লগাল। জান বাঁচাতে যে যার মতো পালাতে শুরু করল।
কিন্তু তাদের এ ধারণা অল্পক্ষণ পরেই ভুল বলে প্রমাণিত হলো। শত্রুরা মহানবী (সা)-এর চরিত্রমাধুর্য ভালো করে জানত না। তিনি যে ক্ষমতার নবী, তাঁর মন যে পবিত্র ও সুন্দর তা তারা অনুমানও করতে পারল না। তবু তাদের অনেকে মনে সাহস জুগিয়ে মহানবী (সা)-এর কাছে এলো, নিজেদের অপরাধের জন্য করজোড়ে ক্ষমা চাইল। নবী মুহাম্মদ (সা) সাথে সাথেই তাদের ক্ষমা করে দিলেন। ইসলামের অনেক বড় দুশমনও সেদিন ক্ষমা পেয়ে গেল। মহানবী (সা)-এর এ ক্ষমা ও উদারতার মহিমা বিদ্যুৎ গতিতে মক্কায় ছড়িয়ে পড়ল। তাই মানুষ দলে দলে মহানবী (সা)-এর কাছে ছুটে এলো। তারা নবীজির ভালো ব্যবহার ও উদার মন দেখে অবাক হলো। তাদের ভুল ভেঙে গেল। তাই কাফের মুশরেকরা ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের পবিত্র করে নিল। দেখতে দেকতে ইসলামের পতাকার নিচে এসে জড়ো হলো হাজার মানুষ।
এ অবস্থা দেখে আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা ভয় পেয়ে গেল। সে বুঝতে পাল তার আজ রক্ষা নেই। সে যে বড় অপরাধী। তার সীমাহীন অপরাধ যা ক্ষমার অযোগ্য, তা সে ঠিকই অনুধাবন করতে পারল। তাই ইকরামা পালাবার পথ খুঁজল। মক্কার অদূরেই জেদ্দার উপকূল। সেখান থেকে নৌকায় চড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছূটে চলল ইকরামা। লোহিত সাগরের পানিতে ভেসে চলছে তার নৌকা। কিন্তু ইকরামার বদনসিব। সাগরের ভয়ঙ্কর উর্মিমালা আর প্রবল ঝড় তার যাত্রাপথ আগলে ধরল। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ইকরামার নৌকার ওপর আছড়ে পড়ছিল। ঢেউয়ের আছাড় খেয়ে ইকরামার নৌকা সাগরের অথৈ পানিতে তলিয়ে যাবার উপক্রম হলো। ইকরামা দেখতে পেল পাহাড়সম ঢেউ এসে তাকে ডুবিয়ে দিতে চাইছে। ওদিকে পেছনে আবার মুহাম্মদ (সা)-এর লোকেরা তাকে মৃত্যুর হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
এমন সময় ঘটে গেল এক অভিনব ঘটনা। ইকরামার স্ত্রী এম্ম হাকিম স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে তীরে এসে উপস্থিত হলো। অনেকক্ষণ ধরে সে স্বামীর দূরবস্থা দূর থেকে অবলোকন করছিল। তাই স্বামীকে সাহায্য করতে সে দৌড়ে এলো। উম্মে হাকিম চিৎকার করে বলল,
: ওগো! শোন, তাড়াতাড়ি তীরে উঠে এসো। তোমার জন্য ভালো খবর নিয়ে এসেছি। তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি তীরে চলে এসো।
‘ভয় নেই?’ –শব্দটি ইকরামার কর্ণকুহরে এসে প্রবেশ করতেই সে চমকে উঠল। প্রচণ্ড ঝড় ও সাগরের প্রকাণ্ড ঢেউয়ের আচরণে সে স্থির থাকতে পারছিল না। আবার স্ত্রী মুখে অভয় বানী শুনে তাও সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। তাই ইকরামা তীরে এসে পা রাখল। তখনও ভয়ে ইকরামার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। উম্মে হাকিম তাকে শান্ত হতে বলল। সে জানাল,
: আমি রাসূলের কাছ থেকে তোমার নিরাপত্তার আশ্বাস নিয়ে এসেছি। তিনি তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। তোমার আর কোনো ভয় নেই। তাই চলো, নবীজির কাছে চলো।
স্ত্রীর কথা ইকরামা বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার মন বলছিল, তার মতো এত বড় অপরাধীকে কেউ মাফ করতে পারে না। যদি কেউ করে তা হলে তার মন অবশ্যই অনেক বড়। সে অবশ্যই মহামানব ছাড়া আর কেউ নয়। আল্লাহর নবী (সা) সম্পর্কে ইকরামার যে খারাপ ধারণা ছিল স্ত্রীর কথায় তা খানিকটা কেটে গেল। তারপরও ইকরামা মুহাম্মদ (সা)-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার মতো সাহস করতে পারল না।
ইকরামার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তখনও কাটছিল না। এদিকে মহানবী (সা)-এর সাথে খারাপ ব্যবহারের জন্য তার মধ্যে লজ্জা ও অনুশোচনা কাজ করছিল। এভাবে ভয়, দ্বিধা ও লাজুকতা নিয়েই ইকরামা একসময় এগিয়ে চলল। সে যাচ্ছে আল্লাহর নবীর সাথে দেখা করতে। খানিকক্সণ পরই ইকরামা মহানবী (সা)-এর কাছাকাছি এসে পৌঁছাল।
একটু দূরে থাকতেই ইকরামা মুহাম্মদ (সা)-এর চোখে পড়ে গেল। তার চোখও গিয়ে পড়ল মহানবী (সা)-এর চোখের ওপর। ইকরামা এবার লাজে ও ভয়ে আরও বেশী আড়ষ্ট হয়ে পড়ল।
আল্লাহর নবী তো মহামানব। বড় মনের মানুষ। তাই তিনি নিজে এগিয়ে এসে ইকরামাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নবীজির এই অপূর্ব ব্যবহারে ইকরামা সীমাহীন বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেল। মহানবী (সা)-এর এ আচরণ যে তার কল্পনারও বাইরে। তাই দুনিয়ার সব বিস্ময় এসে তাকে যেন নির্বাক করে দিল। তার গোটা দেহমনে তৃপ্তির এক অভিনব শিহরণ খেলে গেল। কৃতজ্ঞতার আতিশয্য ইকরামার জীবনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিল। ইকরামা যেন আর কিছুই ভাবতে পারছে না। মহানবী (সা)-এর চরিত্রমাধুর্যে সে এখন সীমাহীন মুদ্ধ। তাই তার শির অনায়াসে মহানবী (সা)-এর সামনে নত হয়ে এলো। ইসলামের অনুপম সৌন্দর্য দেখে সে আর স্থির থাকতে পারল না। কিছুক্সণ পর ইকরামার বিস্ময়ের ঘোর কাটলে সে কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এবার ইকরামা ধীরে ধীরে মহানবী (সা)-এর মুখের দিকে সহানুবূতি পাওয়ার দৃষ্টিতে তাকাল। তাঁর কাছে অত্যন্ত বিনীতভাবে ক্ষমা চাইল। সে বলল,
: হে আল্লাহর নবী! আমি না বুঝে গুরুতর অপরাধ করেছি। আপনার সাথে অনেক অন্যায় আচরণ করেছি। আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি অমানুষের মতো কাজ করেছি। আমি আপনাকে অনেকবার কষ্ট দিয়েছি। আজ আমি ক্ষমা চাই। আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আর আমাকে মুসলমান করে নিন।
মহানবী(সা) যে ইকরামাকে আগেই মাফ করে দিয়েছেন। তবে তার কাতর অনুরোধ এবং অনুতাপ দেখে তিনি যারপরনাই খুশি হলেন। নতুন এক ইকরামাকে পেয়ে মহানবী (সা)-এর মন ভরে গেল। এ জন্য তিনি আল্লাহকে শোকরিয়া জানালেন। আর দু’হাত তুলে মহান স্রষ্টার কাছে ইকরামার হেদায়াতের জন্য দোয়া করলেন। মহানবী (সা)-এর এই মুনাজাত দেখে ইকরামা আরেকবার অবাক হলো। তার মনের ভেতর যেন ইসলামের আলো নড়ে উঠল। ফলে ইকরামার দুচোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দের অশ্রুধারা।
খানিকক্ষণ ধরে আর কোনো কথাই বলতে পারল না। এরি মধ্যেই তার মনে কেলে গেল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, নিজেকে এবার ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে দেবেন। তাই নিতি নবীজিকে বললেন,
: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি দীনের পথে কাজ করতে চাই। আমি এতদিন হক ও সত্যের যতটা বিরোধিতা করেছি, ইসলামের জন্য তার দ্বিগুণ কাজ করব। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন।
মহানবী (সা) ইকরামার জন্য আবারও প্রাণভরে দোয়া করলেন। এর মধ্যেই অনেকক্ষণ সময় গড়িয়ে গেল। এবার ইকরামা ঘরে ফিরে যাবার জন্য মনস্থ করলেন। কিন্তু প্রাণের নবীকে ছেড়ে যেতে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। ইকরামার বুক যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল, মন ছিঁড়ে যাচ্ছিল।ফলে তার দু’চোখ বেয়ে আবারও নামল অশ্রুধারা। এ অশ্রু মুছতে মুছতেই ইকরামা একসময় মহানবী (সা)-এর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তারপর থেকে ইকারাম আর বসে থাকেননি। ইসলামের খেদমতে তিনি সবসময় ব্যস্ত থেকেছেন। ঈমানের যে গোলাপ মহানবী (সা) তার মনে সবসময় ব্যস্ত থেকেছেন। ঈমানের যে গোলাপ মহানবী (সা) তার মনে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার সুরীভ মেখে তিনি কাটিয়ে দিলেন বাকিটা জীবন।
ব ল তে পা রো?
১। ইকরামা কে ছিলেন? তিনি কেমন লোক ছিলেন?
২। মক্কা কখন বিজিত হয়? এ অভিযানে মহানবী (সা)-এর সাথে কতজন সাহাবী ছিলেন?
৩। ইকরামা কিসের ভয় পাচ্ছিলেন? তার স্ত্রী কী খবর নিয়ে এলো?
৪। ইকরামা ইসলামের কাজ করার জন্য মহানবী (সা)-কে কী বলেছিলেন?
ধনীর দুলাল ওজ্জা হলেন নিঃস্ব
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগের কথা। আরবে তখন ধবী গরিব সব ধরনের লোকই বাস করত। সে সময়ের এক ধনী লোকের কাহিনী বলি। শোন তা হলে।
লোকটির নাম ছিল ওজ্জা। তবে ইসলাম কবুল করে তার নাম হয়ে গেল আবদুল্লাহ (রা)। মহানবী (সা)-এর সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম সাহাবী ছিলেন তিনি। ওজ্জা ছিলেন পিতা-মাতার অতি আদরের সন্তান। তাঁর পরিবারের ছিল অঢেল সম্পদ ও বিত্ত-বৈভব। তাদের কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। ফলে ওজ্জার শৈশব ও কৈশোর বেশ আরাম-আয়াসের মধ্যেই কেটেছিল। বয়স হলে মা-বাবা তাঁকে বিয়ে করান। এক ধনীর দুলালীদের সাথে ওজ্জার বিয়ে হলো।
আরবে সময়টা তখন খুব এটা ভালো যাচ্ছিল না। মানুষ তার প্রভুকে ভুলে গিয়ে মূর্তির পূজা করত। নানা রকম কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল আরবের মানুষ। আরবের অধিকাংশ মানুষ ছিল পৌত্তলিক। আরব সমাজের মানুষের স্বভাব-চরিত্রও তেমন ভালো ছিল না। তারা মারামারি হানাহানি নিয়ে মেতে থাকত। এমন সময় কঠিন সময়ে আরবে আল্লাহতাআলা তাঁর পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে পাঠালেন। তিনি মানুষকে কল্যাণ ও মুক্তির পথে ডাকছিলেন। পুরোদমে তখন চলছে দীনের কাজ, ইসলাম প্রচারের দাওয়াত। মহানবী (সা)-এর দাওয়াত অনেকেই কবুল করে নিচ্ছিল। বহু খোদার গোলামী ছেড়ে মানুষ এক আল্লাহকে মেনে চলতে আগ্রহী হলো। ধীরে ধীরে এ দাওয়াত মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওজ্জার কাছেও গিয়ে পৌঁছল ইসলামের বাণী। ইসলামের সৌন্দর্য ওজ্জাকে আকৃষ্ট করল। রাসূল (সা)-এর মুখে এক আল্লাহর কথা ওজ্জার মনকে নাড়া দিল। তাই তিনি ইসলাম কবুল করে মুসলমান হলেন।
তবে তাঁর ইসলাম কবুরের বিষয়টি সহজ ছিল না। সেই সময়ে ওজ্জার বাবা জীবিক ছিলেন না। মা আর পিতৃব্য ছিলেন তাঁর অভিভাবক। ইসলাম গ্রহণ করে ওজ্জা তাঁর পিতৃব্যকে এ খবর জানালেন। তিনি একথাও বললেন,
: চাচা! আমি তোমাকে এক মহাসত্যের খবর দিচ্ছি। তোমাকে আল্লাহর কথা বলছি। তিনিই আমাদের স্রষ্টা এবং আসল প্রভু। আর আবদুল্লাহর পুত্র হযরত মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। তিনি সত্য নবী। আমি তাঁর কথা মেনে নিয়েছি। তুমিও তাঁর কথা মেনে নাও। ইসলাম কবুল করে মুসলমান হও।
ওজ্জার পিতৃব্য ইসলামকে বিশ্বাস করত না। এটা তার কাছে ছিল অসহ্য। সে আল্লাহর নবীকে ঘৃণার চোখে দেখত। তাঁর কথাবার্তাকে সে অমূলক বলে উড়িয়ে দিত। তাই ভ্রাতুষ্পুত্রের কথায় পিতৃব্য অবাক হলো। তার মুখে মুহাম্মদের কথা শুনে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। প্রচণ্ড রাগে পিতৃব্য ছটফট করতে লাগল। পারে না ওজ্জাকে মেরে ফেলবে। চাচার এ অবস্থা দেখে ওজ্জা ভয় পেয়ে গেলেন।
পিতৃব্য এবার হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
: দেখ ওজ্জা! তুই এতিম। তোকে আমি আমার নিজের সন্তানের মতো দেখি। তোকে আমি অতিশয় পছন্দ করি। বলি শোন, তুই আমার অবাধ্য হবি না। আমাদের ধর্ম ছেড়ে তুই মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করতে পারিস না। এ ধর্ম সত্য নয়। এ নতুন ধর্ম তোকে ত্যাগ করতে হবে। নইলে তোর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না।
ওজ্জা চাচার কথা অবাক হয়ে শুনলেন। তবে তাঁর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। এতে চাচা আরও ক্ষিপ্ত হলো। সে আবারও বলতে লাগল, ‘শোন ওজ্জা! তুই বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে নাস্তিক হয়ে গেছিস। তুই যদি নতুন ধর্ম না ছাড়িস, তা হলে আমার সম্পত্তির এক কপর্দখও তোকে দেব না।
ওজ্জা চাচার শেষ কথা শুনে ঠিকই চমকে উঠলেন। ক্ষণিকের জন্য তিনি ভয়ও পেলেন। তবে তাঁর এই ভয় নিমিষেই কেটে গেল। তিনি মনকে শক্ত করলেন। তারপর অতি দৃঢ়তার সাথে চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
: দেখুন চাচা! আমি সত্যকে খুঁজে পেয়েছি। এটাই আমার কাছে বড় সম্পদ। আপনার সম্পত্তির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনি আমার চাচা বটে। আপনি আমার গুরুজন। তবে বলি চাচা, আমি যে সম্পদ পেয়েছি তা আমার কাছে সবচেয়ে বড়। ইসলামই আামর বড় সম্পদ। তাই আপনার সম্পদের আমার কোন প্রয়োজন নেই।
পিতৃব্যের মুখের ওপর সত্যকে সাহসের সাথে উচ্চারণ করেই ওজ্জা ক্ষান্ত হলেন না। তিনি সাথে সাথে তাঁর গায়ের দামি পোশাক খুলে ফেলে দিলেন। এসব কিছু তাঁর কাছে অসত্য ও অসহ্য বলে মনে হলো। এবার তিনি বিধবা মায়ের কাছে ছুটে গেলেন। মাকে বললেন,
: শোন মা! আমি ইসলাম কবুল করেছি। এটাই আমার জীবন। আমি তোমাদরে এসব ঐশ্বর্য ও আরাম-আয়েষ চাই না। তোমাদের সম্পদেও আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি সবকিছু ত্যাগ করলাম। আমার গায়ের দামি পোশাকও ছেড়ে দিলাম। পার যদি গায়ে দেয়ার মতো আমাকে সামান্য এক টুকরো কাপড় দাও।
শত হলেও তো মা। মা ওজ্জার ধর্মকে পছন্দ না করলেও বুকের ধন ছেলেকে ফেলতে পারেন না। তাই ওজ্জার অবস্থা দেখে মা মনে কষ্ট পেলেন। হাতের কাছে মা ভালো কোনো পোশাক পেলেন না। পিতার আমলের একটা জীর্ণ কম্বল ছিল সেখানে। মা সেটাই পুত্রের হাতে তুলে দিল। ওজ্জা আর কী করবেন! ছেঁড়া কম্বল নিয়ে এটাকে দুই টুকরো করলেন। একখণ্ড গায়ে জড়িয়ে নিলেন আর একখণ্ড পরিধান করলেন। এরপর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মহানবী (সা)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে ছুটে চললেন তিনি। নবী (সা) তখন মদীনায় অবস্থান করছিলেন। তাই অনেক কষ্ট স্বীকার করে ওজ্জাকে দীর্ঘপথ চলতে হলো। অবশেষে ওজ্জা একসময় মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন। ওজ্জা খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলেন মহানবী (সা) মসজিদে আছেন। তাই তিনি নবী (সা)-এর অপেক্ষায় মসজিদের দরজায় অপেক্ষা করছিলেন। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর তাঁর। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন আবদুল ওজ্জা। হঠাৎ তিনি মহানবী (সা)-এর চোখে পড়ে গেলেন। ওজ্জার মনের অবস্থা বুঝতে আল্লাহর নবীর অসুবিধা হলো না। তিনি ওজ্জাকে কাছে ডেকে আনলেন। তারপর কথার ছলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওজ্জা না?
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন নবীজি, আমি ওজ্জা। আপনার দীনের সেবক। মহানবী (সা) বললেন: তুমি ওজ্জা ছিলে। তবে আজ থেকে তুমি আর ওজ্জা নও। তুমি আল্লাহর দাস আবদুল্লাহ। তোমার আর কোনো ভয় নেই। যাও, তুমি আসহাবে সুফফার লোকদের সাথে গিয়ে মিলিত হও। তাদের জামাতে শামিল হও। আর আমার নিকট এ মসজিদেই তুমি থাকবে।
মহানবী (সা)-এর কথা শুনে ওজ্জা যারপরনাই খুশী হলেন। তাঁর সব দুঃখ-ব্যাথা যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল। সে যে আজ গর্বিত। যে সত্যের সন্ধানে সে সবকিছু ছেড়েছে সেই সত্যের মানুষকে এখন সে কাছে পেয়েছে। তাই তাঁর আনন্দ আর কে দেখে! ওজ্জার চোখেমুখে সত্যের আলো যেন ঝলমল করে উঠল। তাঁর বুক ভরে গেল সুখের সীমাহীন আবেশে। আর সেই খুশির ঝিলিক যেন ছড়িয়ে পড়ল মদীনার আকাশে বাতাসে।
ব ল তে পা রো?
১। ওজ্জা কে ছিলেন? তাঁর পারিবারিক অবস্থা কেমন ছিল?
২। ইসলাম গ্রহণ করে ওজ্জা চাচাকে কী বললেন?
৩। চাচা ওজ্জাকে কী বলে হুঁশিয়ার করেছিলেন?
৪। অবশেষে ওজ্জা কী করলেন?