হেদায়াত
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুর রহীম
বইটির অডিও শুনুন
ভূমিকা: ১৯৫১ সালের ১৩ই নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত জামায়াত ইসলামীর বার্ষিক সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে কর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বক্তৃতা।
সহকর্মী বন্ধুগণ!
চারদিন ব্যাপী সম্মেলনের পর এখন সকলেই এখান থেকে বিদায় নিচ্ছে। এ সম্মেলন উপলক্ষে নির্ধারিত কার্যসূচী আল্লাহর ফযলে সম্পন্ন হয়েছে এবং সেই সম্পর্কে আমরা বিশেষ অধিবেশনে মোটামুটি ভাবে পর্যলোচনাও করেছি। এখান থেকে বিদায় গ্রহণের পূর্বে আমি আমার সহকর্মী রুকন এবং মুত্তাকীগণকে (বর্তমানে সহযোগী সদস্য) আমাদের কর্মপন্থা সম্পর্কে কয়েকটি জরুরী কথা বলতে চাই; যেন তারা ভবিষ্যতে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন।
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক
আম্বিয়ামে কিরাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং জাতির আদর্শ ও সৎ ব্যক্তিগণ প্রত্যেকটি কাজ উপলক্ষে তাদের সহকর্মীগণকে যে বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সর্বপ্রথম আমি তার উল্লেখ করতে চাই। তাঁরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে,, মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি ভক্তিভাব পোষণ করতে এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক ঘন্ঠিষ্ঠতর করতে তাকীদ করেছেন। তাঁদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে আমিও আপনাদের কে আজ এ উপদেশই দিচ্ছি। আর ভবিষ্যতেও আমি যখন সুযোগ পাবো, ইনশাআল্লাহ একথাই আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবো। কারণ এ বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্যান্য সকল বিষয়ের তুলনায় এটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি ঈমান, ইবাদতের বেলায় আল্লাহর সাথে নিবিড়তর সম্পর্ক স্থাপন, নৈতিক চরিত্রে আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ এবং আচার-ব্যবহার ও লেন-দেনের বেলায় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ করাকেই প্রাধান্য লাভ করা বাঞ্চনীয়। বিশেষত আমরা যে কাজের জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছি, এটা শুধু আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সম্পন্ন হতে পারে। আমরা আল্লাহ্ তাআলার সাথে যতখানি গভীর ও দৃঢ় সম্পর্ক করবো আমাদের আন্দোলন তাতোই মযবুত হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক দুর্বল হলে এ আন্দোলও দুর্বল হয়ে পড়বে। আল্লাহ যেন এটা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন।
বলা বাহুল্য মানুষ যে কাজেই অংশগ্রহণ করুক না কেন-সেই কাজ দুনিয়ার হোক কি আখেরাতের তার প্রেরণা সেই কাজের মূল উদ্দেশ্য হতেই লাভ করে। যে কাজের জন্য সে উদ্যোগ-আয়োজন করেছে, সে কাজে তার চেষ্টা-তৎপরতা তখনই পরিলক্ষিত হবে যখন মূল উদ্দেশ্যে সাথে তার মনে প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা যাবে। আত্মকেন্দ্রিক স্বর্থপর ব্যক্তি ছাড়া কেউ প্রবৃত্তির পূজা করতে পারে না। সুতরাং যে ব্যক্তি যতবেশী স্বার্থপর হবে, ততোই সে আপন প্রবত্তির জন্য কাজ করতে থাকবে। সন্তান-সন্তির মঙ্গলের জন্য নিজের পার্থিব জীবনেই নয় নিজের আখেরাতকেও বরবাদ করতে ইতস্তত করে না। কারণ তার সন্তান-সন্ততি অধিকতর সুখ-শান্তি লাভ করুক এটাই হচ্ছে তার একমাত্র কামনা।
অনুরূপভাবে দেশ ও জাতির খেদমতে আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তি মূলত দেশ ও জাতির প্রেমে আবদ্ধ হয়। এর ফলেই সেই ব্যক্তি দেশ ও জাতির আযাদী, নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে, কয়েদখানার দুর্বিসহ যাতনা অনায়াসে বরণ করে এবং এজন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে। এমনকি একাজে সে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও আদৌ কুন্ঠিত হয় না। সুতরাং আমরা যদি এ কাজ আপন প্রবৃত্তির জন্য, আত্নীয়-স্বজনের জন্য, দেশ ও জাতির বিশেষ কোনো স্বার্থের জন্য না-ই করি বরং একমাত্র আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীল এবং মজবুত না হলে যে আমদের এ কাজ কখনো অগ্রসর হতে পারে না, একথা আপনারা সহজেই উপলবদ্ধি করতে পারেন। আর এ কাজের জন্য আমাদের চেষ্টা-তাৎপরতা শুধু তখনই শুরু হতে পারে যখন ও প্রতিষ্ঠার জন্যই কেন্দ্রীভূত হবে। এ কাজে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার সাথে শুধু সম্পর্ক স্থাপন করাই যথেষ্ট নয় বরং তাদের যাবতীয় আশা-ভরসা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সাথেই সম্পর্কিত হওয়া আব্শ্যক। এটা একাধিক সম্পর্কের এতটি অন্যতম সম্পর্ক হলে চলবে না, বরং এটাকেই একমাত্র মৌলিক ও বাস্তব যোগসূত্রে পরিণত হতে হবে। পরন্তু আল্লাহ তাআলার সাথে এ সংযোগ-সম্পর্ক হ্রাস না পেয়ে বরং যাতে ক্রমশ বৃদ্ধি পায় সেই চিন্তাই যেন তাদের মনে প্রতিটি মুহূর্তে জাগরুক থাকে। বস্তুত আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই যে আমাদের এ কাজের মূল প্রাণ স্বরূপ : এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো প্রকার দ্বিতম নেই। আল্লাহর ফযলে আমাদের কোনো সহকর্মীই এর গুরুত্ব সম্পর্কে অসতর্ক নয়। তবে এ ব্যাপারে কতকগুলো প্রশ্ন অনেক সময় লোকদেরকে বিব্রত করে তোলে, তাই এই যে, আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সঠিক তাৎপর্য কি, এটা কিরূপে স্থাপিত এবং বর্ধিত হয়। আর আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, থাকলেই বা কতখানি এবং এসব কথা জানাবার সঠিক উপায় কি হতে পারে?
এ সকল প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর জানা না থাকার কারণে আমি অনেক সময় অনুভব করেছি যে, অনেকেই এ ব্যাপারে নিজেদেরকে সীমাহীন মরুভূমির ম্যধে পতিত ও সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় দেখতে পায়। সেখানে বসে তারা আপন লক্ষ্য পথের সন্ধান করতে পারে না। এমনকি কতখানি পথ অতিক্রম করেছে, কোনখানে এসে পৌঁছেছে এবং কতখানি পথ বাকি আছে, তাও সঠিকরূপে অনুমান করতে পারে না। ফলে অনেক সময় আমাদের কোনো সহকর্মী হয়তো অস্পষ্ট ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েন। কেউ বা এমন পথে অগ্রসর কারো পক্ষে লক্ষ্যস্থলের দূরে কিংবা নিকটবর্তী বস্তুত মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা দু:সাধ্য হয়ে পড়েছে। কেউ বা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণেই আমি আপনাদেরকে শুধু আল্লাহ তাআলার সাথে সংযোগ স্থাপন সম্পর্কে উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হবো না, বরং উল্লেখিত প্রশ্নাবলীর একটা সুষ্ঠু জবাব দেয়ার জন্য সাধ্যনুযায়ী চেষ্টা করবো।