ইসলাম ও আধুনিকতা
মরিয়ম জামিলা
অনুবাদ
এ কে এম হানিফ
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
প্রসঙ্গ কথা
‘ইসলাম ও আধুনিকতা’ বইটি মরিয়ম জামিলার ‘ইসলাম ও মডার্নিজম’ গ্রন্হের অনুবাদ।
লেখিকা একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান। দেশ, কাল, পাত্র, ভাষা, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে ইসলামের সার্বজনীন শাশ্বত আবেদনে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর নিজ ধর্ম ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে ১৯৬১ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহনের আগে তিনি তাঁর নিজ ধর্ম, ইসলাম এবং সমসাময়িক অন্যান্য ধর্ম ও মতাদশ্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে পত্র বিনিময় করেন। ফলে ইসলাম সম্পর্কে তিনি যে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন, এই বই-এর প্রতিটি পাতায় তার ছাপ সুস্পষ্ট।
ইসলামের যে মহান সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে মরিয়ম জামিলা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন, তার প্রতি তাঁর নিষ্ঠা অপরিসীম। মুসলিম নামধারী ব্যক্তিবর্গ এসবের যে বিকৃতি ঘটাতে চেষ্টিত হয়েছেন, তা দেখে তিনি বড়ই ব্যথিত হয়েছেন। মুসলিম পণ্ডিত ও নেতাদের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনা এই ব্যথারই বহিঃপ্রকাশ।
মরিয়ম জামিলা তার জীবনের মিশন হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ কারণে তিনি নিজ জন্মভূমি আমেরিকা ও পরিবার পরিজনকে ত্যাগ করে ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানে যান এবং লাহোরের একজন মুসলমানকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যা ধর্মান্তরিত মুসলমান, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। কাজের সঙ্গে জীবনের সমন্বয় থাকায় মরিয়ম জামিলার বই-এর আবেদন হৃদয়স্পর্শী। লেখিকার মূল বক্তব্য Either accept Islam in to to or keep it aside, Islam admits no compromise. এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি ভারত উপমহাদেশ, তুরস্ক ও আরব জগতের মুসলিম নেতা ও পণ্ডিতদের কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার কারণে কোন ক্ষেত্রে তাঁর সমালোচনা হয়েছে রুঢ়।
মূল বইটি লিখিত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেদিকে খেয়াল রেখেই অনুবাদে বই-এর কিছু কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। পারম্পর্য রক্ষার শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে কিছুটা ব্যত্যয় যে ঘটেনি তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
পরিপূর্ণ গ্রন্হ হিসেবে এই বইটি আমার প্রথম অনুবাদ। ১৯৭৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বর্তমান সংস্করণ প্রকাশের পূর্বে বইটি আরেকবার আগাগোড়া দেখে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সংশোধন করে দিয়েছি। আশা করি এ সংস্করণ পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বেশি পাবে।
ইসলামী সাহিত্যের পাঠকদের কাছে মরিয়ম জামিলা অপরিচিতা নন। তবে বাংলা ভাষায় এইটিই তাঁর প্রথম গ্রন্হ। বাংলা ভাষাভাষী পাঠক পাঠিকাদের কাছে মূল বইটির অনুবাদ গ্রন্হটিও সমাদৃত হলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।
এ কে এম হানিফ
লাল মাটিয়া, ঢাকা
নভেম্বর, ২০০৩
আমি কেন মুসলমান হলাম
দশ বৎসর বয়সে ইসলামের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে। তখন আমি ইহুদীদের রবিবাসরীয় স্কুলের ছাত্রী। আমি আরব ইহুদীদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। ইহুদী পাঠ্যপুস্তক থেকে আমি জানতে পারি যে, ইব্রাহিম (আঃ) আরব ও ইহুদীদের জনক। শত শত বছর পরে মধ্য ইউরোপের খৃস্টানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইহুদীরা মুসলমান শাসিত স্পেনে কিভাবে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করে তাও আমাদের পড়ানো হয়। আরব ইসলামী সভ্যতার এই মহানুভবতা হিব্রু সংস্কৃতিকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিয়ে পৌঁছায়। ইহুদীবাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতাহেতু আমি মনে করেছিলাম আরব ভাইদের সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্যেই ইহুদীরা ফিলিস্তিনে ফিরে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমি এও বিশ্বাস করেছিলাম যে, মধ্যপ্রাচ্যে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার স্বর্ণযুগ সৃষ্টিতে আরব ইহুদীরা পরস্পর সহযোগিতা করবে।
ইহুদীদের ইতিহাস পড়ার প্রতি গভীর অনুরাগ সত্ত্বেও রবিবাসরীয় স্কুলে আমি মোটেই সুখী ছিলাম না। এই সময় ইহুদীদের ওপর ‘নাজি’দের চরম অত্যাচার নেমে আসে। ইউরোপীয় ইহুদী সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে আমি নিজেও তার শিকার হয়ে পড়ি। কিন্তু আমি এই ভেবে হতাশ হয়ে পড়ি যে আমার সহপাঠি এবং তাদের অভিভাবক কেউই ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ নয়। ধর্মীয় সমাবেশের সময় শিশুরা প্রার্থনা পুস্তকের রসালো অংশগুলো পাঠ করে হেসে লুটোপুটি খেতো। শিশুরা এতই বেয়াড়া ও উচ্ছৃঙ্খল ছিল যে, তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং ক্লাস পরিচালনা করা শিক্ষকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বাড়ীতেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। আমার বড়বোন রবিবাসরীয় স্কুলের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ে। কারণ মা প্রতিদিনই তাকে শয্যা থেকে টেনে উঠাতেন আর এ কারণে প্রতিদিন ঝগড়া এবং কান্নাকাটি না করে সে ওদিকে পা-ই বাড়াতো না। এরূপ করতে করতে মা বাবা তার উপর বিরক্ত হয়ে তাকে তার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন। ইহুদীদের ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে ধর্মীয় সমাবেশে যোগদান এবং yom kippur- এর উপবাস করার পরিবর্তে আমাদের দু’জনকে পারিবারিক বনভোজন এবং অভিজাত রেস্তোঁরায় জাঁকালো অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হতো। যখন আমরা দু’জনে রবিবাসরীয় স্কুলে আমাদের অসহায়তার কথা বাবা মাকে বুঝালাম তখন তারা Ethical culture movement নামে স্রষ্টা সম্পর্কো হতাশ একটি মানবতাবাদী সংস্থায় যোগ দিলেন।
ঊনিশ শতকের শেষ ভাবে Felix adler এই নৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্মদাতা। পৌরহিত্য করার জন্য লেখাপড়া করতে গিয়ে Felix adler বুঝতে পারেন যে, অতি প্রাকৃত বা ধর্মতাত্মিক নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি নিষ্ঠা আপেক্ষিক এবং মানব রচিত। একটি মাত্র ধর্মই বিশ্বের জন্যে উপযোগী। এগার বছর বয়স থেকে আমি Ethical culture রবিবাসরীয় স্কুলে প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত আরস্ত করি এবং পনের বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখি। এখানে আমি আন্দোলনৈর ধারণার সঙ্গে পূর্ণ পরিচয় লাভ করি এবং সকল চিরাচরিত ধর্মীয় আচারের প্রতি আমার অবজ্ঞা জন্মে।
বয়সন্ধি পর্যন্ত আমি মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত ছিলাম এবং বুদ্ধি পরিপক্ক হওয়ার পর আমি নাস্তিক্যবাদে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারলাম না। আমি আমার জীবন সম্পর্কে নতুন করে অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়লাম। কিছুদিনের জন্যে আমি নিউইয়র্কের ‘বাহাই’ দলে যোগ দিলাম। মির্জা আহমদ সোহরাব (মৃত্যু-১৯৫৮ নামীয় জনৈক পারসী ‘পূর্ব পশ্চিমের পর্যটকদল’ নামীয় এই সংগঠনের নেতৃত্ব করছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন যে, ‘বাহাই’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল বাহা’-এর তিনি সচিব ছিলেন।
প্রথমতঃ ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভেবে এ মানবজাতির একত্ব প্রচারের কারণে ‘বাহাই-এর প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে।কিন্তু আমি এই আদর্শের বাস্তবায়নে তাদের নিদারুণ ব্যর্থতা আবিস্কার করলাম। এক বছর পর বিরক্ত হয়ে তাদের প্রতি আমার মোহমুক্তি ঘটে। অষ্টাদশ বছর বয়সে ইহুদী যুব সংগঠনের স্থানীয় শাখা Mizrachi Hatzair-র সদস্য হয়ে যাই। কিন্তু কয়েক মাস পর যখন ইহুদীদের সত্যিকার চেহারার (যা আরব ও ইহুদীদের বিরোধের সঞ্চার করেছে এবং পুনর্মিলন অসম্ভব করেছে) সঙ্গে পরিচিত হয়ে হতাশার সঙ্গে যুব সংগঠন ত্যাগ করলাম।
আমার বয়স যখন বিশ এবং আমি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার পাঠ্যসূচির এক নৈর্বাচনিক বিষয় ছিল ইহুদী ধর্ম ও ইসলাম (Judaism and Islam)। আমাদের হিব্রু ভাষা বিভাগীর প্রধান অধ্যাপক Rabbi Abraham Isaac katash তার ছাত্রদের বুঝাতে চেষ্টিত হন যে, ইসলামের উৎপত্তি ইহুদী ধর্ম থেকে। তিনি আমাদের পাঠ্য পুস্তকে [Judaism in Islam, Washington square press New York, 1954 পূনর্মূদ্রণ Judaism and The Koran A, S, Barnes company New York 1962.] কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে কষ্টের সঙ্গে সেগুলোকে ইহুদী সূত্রের বলে প্রমাণের চেষ্টা করেন। যদিও তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের কাছে ইসলামের উপর ইহুদী ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, তিনি আমাকে সোজাসুজি তার বিপরীত দিকটি বুঝিয়েছেন। কোরআনে বিস্তৃতভাবে পরকালের যে ধারণা দেয়া হয়েছে আমি তা মেনে নিতে পারলাম না। ফিলিস্তিনের ওপর ইহুদীদের ঐশ্বরিক অধিকারও আমি শিকার করে নিতে পারলাম না। প্রাচীন বাইবেল এবং ইহুদীদের প্রার্থনা বইতে যে খোদার চিত্র অঙ্কিত রয়েছে তা আমার কাছে বিকৃত, অধঃপতিত অনেকটা স্থাবর সম্পত্তির প্রতিভু হিসেবে মনে হয়েছে।
ধর্মের সঙ্গে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ আধ্যাত্মিকভাবে ইহুদী ধর্মকে এমন দুর্বল করে গিয়েছে যা মোচন করা অসাধ্য বলে আমার মনে হয়েছে। ইহুদী ধর্মের অনমনীয় একলা চলো নীতির কারণেই ইহুদীরা সারা জীবন লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমার দৃঢ় ধারণা ইহুদীরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ ধর্মে আনার চেষ্টা করলে এমন করুণ পরিণতি কখনো আসতো না। কিছুদিনের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম ইহুদীবাদ হচ্ছে ইহুদী ধর্মের বর্ণবাদী ও গোত্রীয় নীতির সমন্বয়। এর সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ। আমি যখন আরও জানলাম যে ইহুদীবাদের নেতাদের অনেকেই পর্যবেক্ষণশীল ইহুদী এবং সম্ভবতঃ ইসরাঈলের মত কোথাও ইহুদী ধর্ম এত গোঁড়া এবং চিরাচরিত আচার নিষ্ঠা নয়। তখন ইহুদী ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস আরও শিথিল হয়ে আসলো। যখন আমি দেখলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল ইহুদী নেতারাই ইহুদীবাদের সমর্থক এবং আরব ফিলিস্তিনীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও অবিচারের প্রতি নির্বিকার, তখন অন্তরের দিক থেকে আমি আর নিজেকে ইহুদী ভাবতে পারলাম না।
১৯৫৪ সালের নভেম্বরের এক সকালে অধ্যাপক Katsh বক্তৃতার সময় অখণ্ডনীয় যুক্তি দিয়ে বলেন, হযরত মূসা (আ) যে একত্ববাদ প্রচার করেছেন এবং সিনাই পর্বতে তার ওপর যে সব ওহি নাযিল হয়েছে সেগুলো সকল উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি হিসাবে অপরিহার্য। Ethical culture এর মত নাস্তিক্যবাদী দার্শনিকদের শিক্ষা [See ethical religion, David muzzey, American Ethical union, New York 1952, and religion without-revelation, Julian Huxley, New American library, New York, 1956.] অনুযায়ী সকল নৈতিকতা যদি সম্পূর্ণ মানব রচিত হয় তাহলে সময়, পরিস্থিতি এবং আবেগের বশে সেগুলো পরিবর্তন করা যেত। ফলে ব্যক্তি ও সমষ্টির ধ্বংসের জন্য সম্পূর্ণ অব্যবস্থার সৃষ্টি হতো।
অধ্যাপক Katsh বলেন, ইহুদী পুরোহিত Talmud গ্রন্হে পরকালের যে ধারণা দিয়েছেন তা স্বেচ্ছাচারী কোন চিন্তার ফসল নয় বরং নৈতিক প্রয়োজন। তিনি বলেন যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং শেষ বিচারের দিন আমাদের সকল কাজের হিসাব দিতে হবে এবং কাজ অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার পাব তারাই দীর্ঘ কল্যাণের নিমিত্তে সাময়িক সুখ বিসর্জন ও ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। অধ্যাপক Katsh যখন এরূপ বক্তব্য দিচ্ছিলেন আমি তখন প্রাচীন বাইবেল ও Talmud এর জ্ঞানের সঙ্গে কোরআন ও হাদীসের শিক্ষাকে তুলনা করছিলাম এবং ইহুদী ধর্মের গলদ লক্ষ্য করছিলাম। এরপর আমি ইসলাম গ্রহণ করি।
যদিও আমি ১৯৫৪ সালে মুসলমান হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে যুক্তি দিয়ে এর বাইরে রাখার ব্যবস্থা করলো। আমাকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হলো যে, ইসলাম আমার জীবনে জটিলতার সৃষ্টি করবে কারণ এই ধর্ম ইহুদী ধর্ম এবং খৃষ্টান ধর্মের মত উদার নয়। আমাকে বলা হলো ইসলাম আমাকে আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং সম্প্রদায় থেকে পৃথক করে দেবে। সেই সময় আমার ঈমার এসব চাপ মোকাবিলা করার মত যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এসব আভ্যন্তরীণ গোলযোগের ফলে আমি এতই অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে, স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার আগেই আমাকে কলেজ ছাড়তে হলো। যার ফলে আমি কোন ডিপ্লোমা অর্জন করতে পারলাম না।
পরবর্তী দু’বছর আমি বেসরকারী চিকিৎসাধীনে বাড়ীতে কাটালাম। আমার অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে লাগল। আমার পরিবার বেপরোয়াভাবে আমাকে ১৯৫৭-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বেসরকারী ও সরকারী হাসপাতালে অন্তরীণ রাখলেন কারণ আমি শপথ নিয়েছি কোন রকমে সুস্থ হলেই ইসলাম গ্রহণ করব। বাড়ী ফেরার অনুমতি পাওয়ার পরই নিউইয়র্ক শহরের মুসলমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সব সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। সৌভাগ্যবশতঃ অপ্রত্যাশিতভাবে কয়েকজন পুরুষ ও মহিলার সঙ্গে পরিচিতও হলাম। এ সময় মুসলিম সাময়িক পত্রের জন্য লেখা এবং বিশ্বের মুসলমান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ শুরু করলাম।
আলজিরিয়ার আলেমদের নেতা মরহুম শেখ ইব্রাহিমী, ওয়াশিংটন ডি সি’র তখনকার ইসলাম কেন্দ্রের পরিচালক ডঃ মাহমুদ এফ হোবাল্লা, আল আজহার-এর ডঃ মুহাম্মদ এল বাহাই, প্যারিসের ডঃ হামিদুল্লাহ, জেনেভা ইসলামী কেন্দ্রের পরিচালক ডঃ সৈয়দ রমজান এবং মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদীর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম কবুল করার আগে আমি দেখেছি তথাকথিত আধুনিকতা আন্দোলন সমসাময়িক বিশ্বের ঈমানের পূর্ণতার ওপর বিরাট হুমকির সৃষ্টি করেছে। এর লক্ষ্য ছিল ঈমানের ধারণার সঙ্গে মানব রচিত দর্শন ও সংস্কারের গোঁজামিল দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। আমি বুঝতে পারলাম এই আধুনিকতাবাদীরা বিজয়ী হলে কোন কিছুই আর খাঁটি থাকবে না। শিশু হিসেবে আমি আামার নিজের পরিবারে দেখেছি কিভাবে উদার নৈতিকরা ওহির বিশ্বাসের অঙ্গচ্ছেদন করেছে। ইহুদী হিসেবে জন্ম এবং ইহুদী পরিবারের লালিত হয়ে আমি দেখেছি নাস্তিক্যবাদী পরিবেশের সঙ্গে ধর্মের আপোষের জন্যে কি অসার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
সংস্কার প্রাপ্ত ইহুদী ধর্ম কেবলমাত্র ইহুদীদের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে তা নয় বরং তাকে সরাসরি উৎসাহিত করেছে। নাম ছাড়া কারও কোন ধর্মই ছিল না। আমার পুরো শিশুকালটাই আমি সংস্কার প্রাপ্ত ইহুদী ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা, মোনাফেকী এবং অন্তসারশূণ্যতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এমনকি অল্প বয়সেও আমার মনে হয়েছে এমন অসম্পূর্ণ সমঝোতা ধর্মের অনুসারী এমনকি শিশুদেরও আনুগত্য আকর্ষণ করতে পারে না। মুসলমানদের মধ্যে একই দশা দেখে আমি বড় নিরাশ হয়েছিলাম।
আমি দেখলাম মুসলমানদের মধ্যকার কিছু পণ্ডিত এবং নেতা ঐ ধরনের পাপ করছেন। যে পাপের জন্যে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইহুদীদের সীমাহীন লানত দিয়েছেন। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম যে, অপরাধের জন্যে আন্তরিক অনুতাপ এবং কার্যপ্রণালী পরিবর্তন না করলে ইহুদীদের মত আমাদেরকেও আল্লাহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আমি শপথ নিলাম এসব বিপর্যয় ও বিচ্যুতি প্রতিরোদ করার জন্যে জেহাদ চালিয়ে যাব।
১৯৬১ সালের জানুয়ারীতে আমাকে লিখা প্রথম পত্রে মাওলানা মওদূদী লিখেছেন: “আমি যখন আপনার রচনা পড়ছিলাম, আমার মনে হয়েছে আমি আমার নিজের ভাবধারাই পড়ছি। আমার বিশ্বাস আপনি যখন উর্দূ শিখে আমার বই পড়ার সুযোগ পাবেন তখন আপনারও একই ধারণা হবে। আপনার সঙ্গে আমার পূর্বে পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও এই পারস্পরিক সহানুভূতি এবং চিন্তার ঐক্য নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করছে যে, আমরা দুজনই ইসলামের দ্বারা অনুপ্রাণিত”।
মরিয়ম জামিলা, সাবেক মার্গারেট মারকিউস।