ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ ও শাস্তি
আলোকপ্রাপ্ত দৃষ্টিভংগির নতুন যুক্তি
“আজকের উন্নত যুগে সেই পাশবিক ও বর্বরোচিত শাস্তির বিধান কেমন করে সম্ভবপর যা প্রাচীন যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বর্বর লোকদের জন্যে রচনা করা হয়েছিল? কয়েকটা টাকার জন্যেই কি একটা চোরের হাত কাটা সংগত হতে পারে? অথচ একজন অপরাধী –সে চোর হোক কিংবা ডাকাত হোক –আধুনিক চিন্তাধারা অনুযায়ী সামাজিক অবিচার ও উৎপীড়নের এক করুন শিকার, সে শাস্তি যোগ্য নয়; বরং সহানুভূতিপূর্ণ মনস্তাত্বিক চিকিৎসার হকদার।” –ইসলামী আইন-কানুন প্রসংগে আধুনিক যুগের আলোকপ্রাপ্ত চিন্তাধারার দাবীদারদের মুখে এই যুক্তি (Logic) প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু আশ্চার্যের কথা এই যে, বিশ শতকের এই আলোকপ্রাপ্ত চিন্তাবিদরা উত্তর আফ্রিকার চল্লিশ হাজার নিরপরাধ মানুষকে পাইকারীভাবে জবাই করা হচ্ছে দেখেও নিজেদের অন্তরে সামান্যতম দুঃখ অণুভব করে না অথচ একজন অপরাধীর আইনগত শাস্তি সম্পর্কে এতদূর অস্থির ও পেরেশান যে তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। আফসোস! মানুষ কিছু চটকদার বুলি শুনেই প্রতারিত হয় এবং প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে তারা অজ্ঞই থেকে যায়। যাই হোক বিশ শতকের সভ্যতা ও উহার ব্যধিগুলোর প্রতি না তাকিয়ে, শাস্তি সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভংগির কথা প্রথমেই আলোচনা করা যাক।
অপরাধ ও সমাজ
অপরাধের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়: সমাজের বিপক্ষে কোনরূপ সীমালংঘনই অপরাধ। এ কারণে অপরাধ ও শাস্তির ধারণা এবং ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সমাজের সমষ্টিগত দৃষ্টিভংগিই সর্বাধিক কার্যকরী বিষয়।
পুঁজিবাদী দেশসমূহে
পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ও জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহে ব্যক্তি সম্মানের পক্ষে বহু ঢাক-ঢোল পিটানো হয় এবং উহাকেই গোটা সমাজ জীবনের একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সকল দেশে ব্যক্তির আজাদী সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয় এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে দারুণভাবে সীমিত করে দেয়া হয়। তাদের এই দৃষ্টিভংগির পরিচয তাদের রাষ্ট্রের অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত আইন-কানুনেও প্রতিফলিত হয়। তারা অপরাধী ব্যক্তিকে সহানুভূতি লাভের উপযুক্ত বলে মনে করে। কেননা তাদের ধারণায় একজন অপরাধী বিপর্যস্ত পরিবেশ, মানসিক বিভ্রান্তি ও দলীয় কোন্দলের নিষ্ঠুর শিকার এবং উহার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার শক্তি তার নেই। এ কারণেই ঐ সকল দেশেযে কোন অপরাধের –বিশেষ করে নৈতিক অপরাধের শাস্তি যথাসম্ভব কম করে দেয়ার প্রবণতা বিরাজমান। এমনকি কোন কোন অপরাধকে তো শাস্তিযোগ্র অপরাধ বলেই গণ্য করা হয় না।
আধুনিক মনস্তত্ব ও অপরাধ
এই পর্যায়ে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ (Psycho Analysis)-এর কথাই প্রথমে ধরা যাক। অপরাধ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই চিন্তাধারার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, ফ্রয়েড (Freud) হচ্ছে এই ঐতিহাসিক বিপ্লবের একজন খ্যাতনামা পথিকৃত। তার দাবী ছিল: একজন অপরাধী মূলত যৌন বিভ্রান্তির শিকার। যখন সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা ও বিভিন্ন ঐতিহ্য মানুষের স্বভাবকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে তখনই সে এরূপ শিকারে পরিণত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের সাথে সম্পর্কিত সকল পণ্ডিতই ফ্রয়েডের অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই যৌনতা (Sex)-এ হচ্ছে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু’ –এই মতকে সমর্থন করতে পারেনি। তারা অপরাধীকে কেবল ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিবেশ ও ঘটনাবলীর নিরুপায় শিকার বলে গণ্য করেছে। এরা সকলেই ‘মনস্তাত্বিক বাধ্যবাধকাত’ (Psychological Determinism)-এর সমর্থক। তাদের ধারণায়, মনস্তাত্বিক শক্তির সীমারেখার মধ্যে কোন মানুষ যমন কাস্পৃহা থেকে রেহাই পেতে পারে না। তেমনি কাজের ঊর্ধেও সে অবস্থান করতে পারে না। বরং উহার বিপক্ষে সে একেবারেই নিরুপায় ও অসহায় জীব মাত্র। কোনরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে এক বাঁধাধরা নিয়মের অধীনে তাকে প্রতিনিয়তই কাজ করে যেতে হচ্ছে।
সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে
সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের মতে, সমাজ ও সমষ্টিগত জীবন এক অখণ্ড সত্তা। এর বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটি করার অধিকার কোন ব্যক্তির নেই। এই সকল রাষ্ট্রে যদি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে তাকে চরম পর্যায়ের শাস্তি অন্তর্ভুক্ত। সমাজতন্ত্রী ফ্রয়েড ও তার সমমনা মনস্তত্ব বিশারদরা অপরাধের মূলকারণ মনস্তাত্বিক পর্যায়ের অনুসন্ধান না করে কেবল অর্থব্যবস্থার মধ্যেই খোঁ করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক দর্শনে যে সমাজ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পতিত হয় তাতে কল্যাণকর বলে কিছুই থাকতে পারে না। সুতরাং এরূপ সমাজে অপরাধীদের কোন শাস্তি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় অর্থনৈতিক দূলবস্থা থাকার কথা নয় এবং যেখানে পূর্ণাঙ্গ সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেখানে অপরাধ সংঘটিত হয় কেন? সেখানে জেল-জরিমানা বা আদালতেরই বা প্রয়োজন কেন?
ভুলের প্রকৃত কারণ
ব্যীক্তবাদ (Individualism) বা সমাজতন্ত্রের দর্শনকে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে নির্ভুল বলা যায়। একথা ঠিক যে, একটি ব্যক্তি তার পরিবেশ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয় এবং এই পরিবেশের চাপে কোন কোন সময়ে সে অপরাধও করে বসে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিপক্ষে মানুষ কোন অসহায় জীব নয়। মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণবাদীদের ভুলের প্রকৃত কারণ হলো এই যে, তারা মানুষের গতি-শক্তির (Dynamic Energy) উপর এত অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে যে, মানুষের স্বভাবগত নিয়ন্ত্রণ শক্তিকে (Controlling Energy) আদৌ কোন মূল্য দেয়া হয়নি। যে শক্তির বলে একটি শিশু তার লালাগ্রন্থি (Secretive Glands) নিয়ন্ত্রণ করে, বড় হলে বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ করতে সক্ষম হয়। সেই শক্তির সাহায্যেই সে নিজের চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে এবং যাবতীয় উত্তেজনা-উন্মাদনা ও কামনা-বাসনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে শেখে।
অর্থনৈতিক অবস্থা ও অপরাধ
অধিকন্তু একথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে মানুষের চিন্তা ও কাজ উভয়ই প্রভাবিত হয় এবং একথাও ঠিক যে, ক্ষুধা মানুষের নৈতিক অনাচার ও সামাজিক বিতৃষ্ণার মূল কারণ হয়ে কোন কোন সময়ে অপরাধ ও নৈতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কেবল অর্থনৈতিক অবস্থাকেই মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের একমাত্র মূল কারণ বলে অভিহিত করা কোনক্রমেই সংগত নয়। -কেবল এক নির্ধারিত সীমার মধ্যেই উহাকে আংশিকভাবে সংগত মনে করা যায়। খোদ সোভিয়েত রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা ও বাস্তব ঘটনাবলী এই দাবীর প্রতিবাদ করার জন্যে যথেষ্ট। অথচ রাশিয়া দাবী করে ছিল যে, তারা তাদের দেশ থেকে ক্ষুধা ও দরিদ্রতাকে চিরতরে নির্মূল করে দিয়েছে।
অপরাধ করার ক্ষেত্রে অপরাধীর দায়িত্ব
একজন অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার কিংবা না দেয়ার ফায়সালঅ করার পূর্বে অপরাধ করার ক্ষেত্রে তার দায়িত্বের নির্ভুল সীমারেখা নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা অপরাধ ও উহার শাস্তির সাথে যা কিছু সংশ্লিষ্ট তার কোনটিই ইসলাম বিন্দুমাত্র উপেক্ষা করে না।
ইসলামের কর্মপদ্ধতি
ইসলাম অন্ধের মত কোন শাস্তির ব্যবস্থা করে না এবং কোনরূফ চিন্তা-ভাবনা না করে উহাকে প্রবর্তন করতেও অগ্রসর হয় না। ইসলামী দর্শনের ব্যক্তিবাদ (Indiviualism) ও সমাজতান্ত্রিক (Socialism) দর্শনের সকল কল্যাণকর দিকই বর্তমান। ঐ দু’টির খারাপ বা অকল্যঅণকর কোন কিছুর সাথেই ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম সঠিক অর্থেই সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে; উহা চায়, অপরাধের শাস্ত দেয়ার পূর্বে উহার সাথে যে সকল কারণ ও অবস্থাবলীল যোগসূত্র বর্তমান তারও সঠিক বিশ্লেষণ হোক। অপরাধীকে শাস্তি দেয়অর সময় ইসলাম একই সময়ে দু’টি বিষয়েল প্রতি লক্ষ্য রাখে। প্রথমটি হলো অপরাধীর দৃষ্টিভংগি এবং দ্বিতীয়টি হলো যে সমাজের বিপক্ষে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে তার দৃষ্টিকোণ। এ দু’টি বিষয়ের স্পষ্ট আলোকে ইসলাম যথাযথ শাস্তির বিধান দেয়। বস্তুত এই বিধানই বুদ্ধি ও যুক্তি উভয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং ব্যক্তিবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত।
ইসলামের দৈহিক শাস্তি
ইসলামের কিচু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকে আপত দৃষ্টিতে অমানুষিক ও অশোভনীয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, এই শাস্তি অমানুষিকও নয় এবং অশোভনয়ও নয়। কেননা ইসলাম এই শাস্তির ব্যবস্থা ঠিক তখনই দেয় যখন এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অপরাধীর পেছনে বিন্দুমাত্রও কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না এবং উহা করার পক্ষে কোন যুক্তিসংগত কারণও বর্তমান ছিল না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ইসলাম চোরের হাত কাটার বিধান দেয়। কিন্তু যেখানে সামান্য মাত্রও সন্দেহ থাকবে যে, একমাত্র ক্ষুধার কারণেই চুরি কতে বাধ্য হয়েছে সেখানে চোরকে হাত কাটার শাস্তি দেয়া হয় না।
একইরূপে ইসলাম ব্যভিচারী পুরুষ এবং ব্যভিচারিণী নারীকে পাথর মেরে হত্রা করার বিধান দিয়েছে। কিন্তু এই শাস্তি কেবল বিবাহিত পুরুষ ও বিবাহিতা নারীর জন্যেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এবং এটা শুধু তখনই দেয়া হয় যখন চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ব্যভিচার করতে দেখবে। বলা বাহুল্য ইসলাম অন্যান্য শাস্তির ক্ষেত্রেও একই রূপ সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
হযরত উমর (রা)-এর পদ্ধতি
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর –যিনি ইসলামের শীর্ষস্থানীয় আইনবিদদের অন্যতম ছিলেন –বর্ণিত একটি নীতির মাধ্যমেও উপরোক্ত সত্যটি পরিস্ফূট হয়ে উঠে। ইসলামী আইন কার্যকরী করার ক্ষেত্রে হযরত উমরের কঠোরতার একটি সর্বজনবিদিত ব্যাপার। এ কারণে তাঁর গৃহীত নীতিকে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যায় কোনরূপ শিথিলযোগ্য বলেও গণ্য করা যায় না। হযরত উমরের সময়ে একবার যখন দুর্ভিক্ষ শুরু হয় তখন তিনি চুরির অপরাধে হাত কাটার শাস্তি স্থগিত করে রাখেন। এর কারণ ছিল, কেউ হয়ত ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে চুরি করতে পারে। নিম্নলিখিত ঘটনাটিও ইসলামী আইনের মূলনীতির উপর আলোকপাত করছে।
একটি ঐতিহাসিক ঘটনা
হযরত উমর (রা)-কে জানানো হলো যে, হাতেম ইবনে আবি বালতার কয়েকজন গোলাম মুজনা গোত্রের এক ব্যক্তির উটনী চুরি করেছে। হযরত উমর জিজ্ঞাসাবাদ করায় তারা চুরির কথা স্বীকার করলো এবং তিনি তাদের হাত কাটার আদেশ প্রদান করলেন। কিন্তু পর কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বললেন: আল্লাহর শপথ! যদি আমি একথা জানতে না পারতাম যে, ঐ সকল গোলামকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করার পরে তুমি তাদেরকে খাবার না দেয়ায় তারা হারাম খেতে বাধ্য হয়ে যেত তাহলে আমি অবশ্যই তাদের হাত কেটে দিতাম। এই বলে তিনি তাদের হাত কাটার শাস্তি মওকুফ করে দেন। অতপর তিনি তাদের মুনিব হাতেম ইবনে আবি বালতাকে লক্ষ্য করে বললেন: “আল্লাহর কসম! আমি তাদের হাত তো কাটাইনি, কিন্তু তোমার জরিমানা হবে অত্যন্ত ভারী, কষ্ট করেই তোমাকে উহা পরিশোধ করতে হবে।” এই বলে তিনি হুকুম দিলেন যে তাকে উটনীর মালিককে দু’টি উটনীর মূল্য প্রদান করতে হবে।
ইসলামী আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি
এই ঘটনায় ইসলামী আইনের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পরিস্ফুট হয়ে উঠে। সে নীতিটি হলো: কোন অপরাধীকে আইনগত শাস্তি এমন অবস্থায় দেয়া যায় না যাখন পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে উক্ত অপরাধ করতে হয়। এই মূলনীতির সমর্থনে হযরত বিশ্বনবী (স)-এর এই বাণীও প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেণ (আরবী************)
“সন্দেহপূর্ণ অবস্থায় দণ্ড কার্যকর করো না।”
ইসলামী দৈহিক শাস্তি ও সমাজ সংস্কার
শাস্তি সম্পর্কে ইসলামের নীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম সর্বপ্রথম যে অবস্থা ও পরিবেশ বিরাজমান থাকলে মানুষ অপরাধ করতে অগ্রসর হয় তার হাত থেকে সমাজকে মুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর পরেও যারা অপরাধ করবে তাদেরকে শিক্ষামূলক ও ইনসাফভিত্তিক শস্তির বিধান দেয়। কিন্তু অপরাধের কারণ যদি বর্তমান থাকে এবং অপরাধী সম্পর্কে সামান্য মাত্র সন্দেহও হয় যে, পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েই সে উক্ত অপরাধ করেছে তাহলে নির্দিষ্ট শাস্তি তাকে দেয়া হবে না। বরং অপরাধের সাথে সংগতি রেখে হয় তাকে লঘু শাস্তি দেয়া হবে নতুবা একেবারে শাস্তি না দিয়েই খালাস দেয়া হবে।
অপরাধের কারণসমূহের মূলোৎপাটন
যে সকল কারণে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে সেগুলোকে নির্মূল করার জন্যে সম্ভাব্য সকল উপায়ই ইসলাম অবলম্বন করেছে। এবং সাথে সাথে যাবতীয় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর অনিবার্য ফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই: হযরত উমর ইবন আবদুল আজীজের সময়ে (বিশ্বের অর্ধেক এলাকা ব্যাপী) ইসলামী রাষ্ট্রের কোথাও দারিদ্রতা বলতে কিছুই নেই। ইসলামী রাষ্ট্র সমস্ত নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন মিটাবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর এ ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্র, ভাষা ও পেশার কোন পার্থক্যকে বিন্দুমাত্রও স্বীকার করে না। অনুরূপভাবে এই রাষ্ট্রই নাগরিকদের প্রয়োজনীয় রুজি-রোজগারের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। রাষ্ট্র যদি এ ক্ষেত্রে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয় কিংবা কোন নাগরিক উপার্জন করতে অক্ষম হয তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়।
যৌন স্পৃহা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি
ইসলাম যৌন স্পৃহার গুরুত্বকে কখনো অস্বীকার করে না; বরং উহা চরতার্থ করার জন্য আইনগত বৈধ মাধ্যম- বিবাহের দরযা উন্মুক্ত করে দেয়। এ কারণেই ইসলাম কম বয়সে বিবাহ দেয়ার জন্যে উৎসাহ দেয়। আর যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিবাহ করতে অপারগ তাদেরকে সরকারী কোষাগার থেকে সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এরই সাথে যে সকল কারণ যৌবনসুলভ উত্তেজনা ও উদ্দীপনাকে সীমার বাইরে ঠেলে দিতে চায় সেগুলোকে নির্মুল করে সমাজকে পবিত্র করে তুলতে চায়। ইসলাম মানুষের নিকট এমন এক মহান ও পবিত্র লক্ষ্য উপস্থাপিত করে যে, উহা গ্রহণ করলে তার যাবতীয় শক্তিই সমাজের সমষ্টিগত কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যয়িত হতে পারে। ইহা মানুষকে তার অবসর সময়ে আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্যে সাধনা করতে শিক্ষা দেয়। যে সকল উপাদান অপরাধ বিস্তারের কারণ হয় দাঁড়ায় ইসলাম সেগুলোকে প্রথমেই নির্মূল করে দেয়।কিন্তু এ সত্ত্বেও ইসলাম কোন পাপিষ্ঠকে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন শাস্তি দেয় না যতক্ষণ না সে সমাজর যাবতীয মূল্যবোধকে পদদলিত করে পশুত্বের নিম্নতম স্তরে গিয়ে পতিত হয় এবং এতদূল প্রকাশ্যে উক্ত অপরাধটি করে বসে যে, ন্যূনকল্পে চারজন সাক্ষী উহা স্বচচ্ছে দেখে ফেলে।
প্রশ্ন হতে পারে যে, বর্তমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক পরিস্থিতিতে যুবকদের পক্ষে বিবাহ করা অত্যন্ত কঠিন হ য়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ কারণেই তারা যৌন অপরাধ করতে বাধ্য হয়। বিষয়টি সত্য বটে, কিন্তু যখন আমরা সত্যিার অর্থে ইসলাম অনুসরণ করে চলব তখন নোংরা ও অশালীন চিন্তাধারার উত্তেজক এবং তরুণদরে চরিত্র বিধ্বংসী জঘন্য ও উলংগ ফিল্ম, পত্র-পত্রিকা এবং যৌন আবেদন সৃষ্টিকারী সংগীত বলতে কিছুই থাকবে না; তরুণদের যৌন চিন্তার উদ্রেককারী সকল কারণকেই নির্মূল করে দেয়া হবে। সমাজের বুক থেকে সেই দারিদ্রতাকেও চিরতরে খতম করে দেয়া হবে যে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ বিবাহ ক রতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এরূপ যে সমাজ থেকে অন্যায় কাজের কারণগুলোকে বিলুপ্ত করে দেয়া হবে সে সমাজের নিকট ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করবে যে, সবাই সৎ মানুষ হিসেবে বসবাস করবে। কিন্তু এরপরেও যদি কেউ অন্যায় কাজ করে তাহলে তাকে শাস্তি না দিয়ে কোন উপায় থাকে না। কেননা এ অবস্থায় কোন শাস্তির বিদান না করলে সে সমাজে কস্মিনকালেও শান্তি স্থাপিত হতে পারে না।
ইসলামী দৈহিক শাস্তির বৈশিষ্ট্য
যে সকল বৈশিষ্ট্যের কারণে ইসলাম অন্যান্য জীবন পদ্ধতি বা মতাদর্শের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত তা শুধু এতটুকুই নয় যে, শাস্তি কার্যকরী করার পূর্বে উহা মানুষের অপরাধ করার যাবতীয কারণ ও উপায়-উপাদানসমূহকে দূরীভূত করে দেয়। বরং সে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি হলো: অপরাধের কারণ দূরীভূত করার পরেও কোন অপরাধীর ব্যাপারে সামান্যমাত্র সন্দেহও দেখা দেয় যে, হয়ত পরিবেশের চাপে বাধ্য হয়েই সে অপরাধটি করে ফেলেছে তাহলে তাকে নির্ধারিত শাস্তি দেয়া যাবে না। সমগ্র দুনিয়ায় এমন কোন জীবন পদ্ধতি আছে কি যা ইসলামর এই ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের সমকক্ষ হতে পারে?
ইউরোপবাসীদের বিভ্রান্তির মূলভিত্তি
অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভংগি না জানার কারণে কিছু সংখ্য ইউরোপীয় গ্রন্থকার ইসলামের বিধিবদ্ধ শাস্তিকে বর্বরোচিত ও মানহানিকর বলে মন্তব্য করে থাকে। কেননা ভুল করে তারা বুঝে বসেছেন যে, তাদের ইউরোপীয় দৈহিক শাস্তি বিধানের ন্যায় ইসলামী শাস্তি প্রদানও খুব ঘন ঘন অহরহ ঘটতে থাকবে! অন্য কথায় তাদের ধারণায় ইসলামী সমাজে কোরা (বা বেত্রাঘাত) হাত কাটা বা পাথর মারার শাস্তি মুহূর্মুহু চলতেই থাকবে। অথচ বাস্তব ঘটনা এই যে, ইসলামী সমাজে এরূপ শিক্ষামূলক শাস্তি ধারণাতীতরূপে খুব অল্পই হয়ে থাকে। ইসলামী ইতিহাসের দীর্ঘ চারশ’ বছরের মধ্যে চুরির অপরাধে মাত্র ছ’জন লোকের হাত কাটা হয়েছে। সুতরাং স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের উদ্দেশ্যে চোরের হাত কাটা নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো চুরিকেই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া। আর এ কারণেই ইসলাম শাস্তির পূর্বে অপরাধকেই নির্মূল করার চেষ্টা করে। ইসলামী শাস্তি প্রবর্তনের যে ঘটনাগুলো আমরা দেখতে পাই তা সত্যিকার সুবিচার প্রতিষ্ঠার জ্বলন্ত উদাহরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
জানি না ইউরোপের কিছু সংখ্যক লেখক ইসলামী আইনের বাস্তবায়নকে কেন এতদূর ভয় করে। চোর স্বভাবগতভাবেই চুর করুক কিংবা কোন কারণ বা বাধ্যতামূলক ব্যতিরেকেই অপরাধ হতে থাকুক –এর জন্যে যদি তারা ব্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে তারা যে অবশ্যই ভীত হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
শাস্তির কল্যাণকর দিক
অনেকেই ধারণা করেন যে, বাস্তবে এই ধরনের শাস্তির মধ্যে কোন কল্যাণকর দিক নেই। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণরূপেই ভিত্তিহীন। ইসলামী শাস্তি কেবল তাদেরই ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে, যারা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই অপরাধ করার নেশায় মেতে উঠে। তাদের সংশোধনের জন্যে এই শাস্তি একান্তই যুক্তিসংগত। কেননা তাদের অপরাধ প্রবণতা যতই প্রচণ্ডহোক না কেন, অপরাধ করার পূর্বে শাস্তির এই ব্যবস্থা নিসন্দেহে তাদেরকে শংকিত করে তুলবে। অনস্বীকার্য যে, কিছু সংখ্যক তরুণ যৌন অতৃপ্তির শিকার হতে বাধ্য হবে। কিন্তু যে সমাজব্যবস্থা উহার সকল সদস্যদের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্যে তৎপর উহার এ অধিকার অবশ্যই রয়েছে যে, সকলের জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করবে –যাতে করে কেউ কারুর জান-মালকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পরে।
অন্যদিকে যারা কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই অপরাধ করে তাদেরকে (শ্যুধু বিচার করেই) ছেড়ে দেয় না। বরং সকল সম্ভাব্য পন্থায় তার প্রতিকার করতে অগ্রসর হয় –একটি সামঞ্জস্যপূল্ণ ও যুক্তিসম্মত জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
বড়ই মর্মান্তিক
কিন্তু বড়ই দুঃখজনক যে, আধুনিক যুগের কিছু সভ্য তরুণ ও আইনজীবী ইসলামী আইনের সমালোচনা নিছক এ কারণেই করে থাকে যে, ইউরোপের লোকেরা একে বর্বরোচিত বলে বিদ্রূপ করে তাকে। কিন্তু আমরা সুনিশ্চিত যে, তারা যদি ইসলামী আইনের হেকমত ও গূঢ় উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে অধ্যয়ন করতো তাহলে অবশ্যই তাদের যাবতীয় ভুল ধারণার নিরসন হতো।