রোযার অধ্যায়
রোযার বিবরণ
রমজানের রোজা ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কুরআনে শুধু রোজা রাখার হুকুম দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ রোজার নিয়ম পদ্ধতিও বলে দেওয়া হয়েছে। রমজানের মহত্ব ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে মাসের রোজা শরীয়ত ফরজ করেছে তার ফযিলত ও বরকত প্রথমে আমরা বর্ণনা করবো।
রমজানুল মুবারকের ফযিলত
কুরআনে রমজানের মহত্ব ও ফযিলত
কুরআন পাকে রমজানের মহত্ব ফযিলতের তিনটি কারণ বলা হয়েছেঃ
১. কুরআন নাযিল হওয়া অর্থাৎ এ মাসে কুরআন নাযিল হয়।
২. লায়লাতুল কদর। অর্থাৎ এ মাসে এমন এক রাত আছে যা মঙ্গল ও বরকতের দিক দিয়ে এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
৩. রোজা ফরজ হওয়া। অর্থাৎ এ মাসে মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ হয়েছে।
এসব ফযিলতের জন্য নবী (স) এ মাসকে ********** আরবী ************বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস থেকে উৎকৃষ্টতম বলেছেন। নিম্নে তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া হলোঃ
রমজানের ফযিলতের কারণ
১. কুরআন নাযিল হওয়াঃ কুরআন বলেন-********** আরবী ************
রমজান এমন এক মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে- যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ। যা সত্য পথ প্রদর্শনকারী, সুস্পষ্ট শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং হকও বাতিলকে সুস্পষ্ট করে উপস্থাপনকারী। (সূরা আল বাকারাঃ১৮৫)
রমজানের মহত্ব ফযিলত বুঝবার জন্য একথাই যথেষ্ট নয় যে, তার মধ্যে আল্লাহর হেদায়েতের সর্বশেষ কেতাব নাযিল করা হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে,মানবতা যদি হেদায়েতের উৎস থেকে বঞ্চিত হতো। তাহলে গোটা বিশ্ব প্রকৃতির অস্তিত্বের এ বিরাট কারখানাটির সূর্যের আলো ও চাঁদ তারার শুভ্র রশ্মি সত্ত্বেও লন্ড ভণ্ড হয়ে যেত।বিশ্ব প্রকৃতি তার সুনিপুণ কারুকার্য ও সৌন্দর্য সত্বেও অর্থহীন অপূর্ণ ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়তো। ফলে কুফর নাস্তিকতা শিরক ও সত্ত্বেও মানুষ বনের হিংস্র পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে পড়তো। কুরআনও পৃথিবীতে হেদায়েতের আলোকের একমাত্র উৎস। এর থেকে যে বঞ্চিত সে সে হেদায়েত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
২. লাইলাতুল কদরঃ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, তা রমজান মাসে শামিল করা হয়েছে এবং তা লাইলাতুল কদরে নাযিল করা হয়েছে। তার অনিবার্য অর্থ এই যে, লাইলাতুল কদর রমজানের কোনো একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেনঃ রমজানের শেষ দশ বেজোড় রাতের রাতগুলোর মধ্যে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)
৩. রোজা ফরজ হওয়াঃ রোজার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ মাসকে নির্ধারণ করেছেন এবং গোটা মাসের রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন:
********** আরবী ************ অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে তার জন্য অপরিহার্য যে সে পুরো মাস রোজা রাখবে।
রমজানের মহত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে হাদীস
নবী (স) রমজানের মহত্ব ও ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জ্বিনগুলিকে শৃঙ্খল দিয়ে বেধে রাখা হয় এবং দোযখের সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার কোন একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। তার কোনো একটি দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয় না। তারপর আল্লাহর একজন আহ্বানকারী বলতে থাকে। যারা কল্যাণ ও মঙ্গল চাও তারা সামনের দিকে অগ্রসর হও। যারা বদকাম পাপাচার করতে চাও তারা থাম। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক নাফরমান বান্দা কে দোযখ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। আর এ কাজ রমজানের প্রত্যেক রাতেই করা হয়। (তিরমিযি,ইবনে মাযাহ)
- এ এমন একটি মাস যে মসে মুমিনদের রুজি বৃদ্ধি করা হয়।(মিশকাত)
- রমজান মাস সকল মাসের সরদার ।(ইলমুল ফেকাহ)
- এ মাসের প্রথম অংশ রহমত, দ্বিতীয় অংশ মাগফেরাত, তৃতীয় এবং শেষ অংশ জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই ও মুক্তি।(মিশকাত)
- এ মাসে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আপন ইচ্ছায় কোন নফল নেকী করবে সে অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াবের হকদার হবে। (মিশকাত)
ইতিহাসে রমজানের মহত্ব ও গুরুত্ব
ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, হক ও বাতিলের প্রথম সিদ্ধান্তকর যুদ্ধ এ মাসে হয়েছিল। এবং হক কে বাতিল থেকে আলাদা করে দেওয়ার যে দিন কে কুরআনে ইয়ামুল ফোরকান বলা হয়েছে তা ছিলো এ মাসের একটি দিন। এ দিনেই হকের প্রথম বিজয় সূচিত হয় এবং বাতিল পরাজিত হয়। ইতিহাস এ কথাও বলে যে, এ মাসেই মক্কা বিজয় হয়।এসব তথ্য সামনে রেখে চিন্তাভাবনা করুন তাহলে উপলব্ধি করবেন।
- হকের হেদায়েত এ মাসেই নাযিল হয়।
- ইসলামের প্রাথমিক বিজয় এ মাসেই হয়।
- ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় এ মাসেই হয়।
এসব সত্য কে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রমজান মাস প্রতি বছর আসে। শরীয়ত এ মাসে রোজা ফরজ করেছে, রাতের নামাজ ও তেলাওয়াতে কুরআনের ব্যবস্থা করেছে যাতে করে মুমিনের মধ্যে জেহাদের প্রাণ শক্তি নিষ্প্রাণ না হয়ে পড়ে। এবং বছরের অন্তত একবার রমজান মাসে কুরআন শুনে বা পড়ে আপন পদমর্যাদায় দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতি সহকারে মনের মধ্যে তরজমা করতে পারে।কুরআনের নাযিল হওয়া, তার অধ্যয়ন এবং রোজার মুজাহিদ সুলভ তরবিয়ত এ জন্য যে, ইসলামের সন্তানগণ দীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই জীবিত রয়েছে এবং কখনো যেন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফিল না হয়।
রোজার অর্থ
রোজাকে আরবী ভাষায় সাওম বা সিয়াম বলে। তার অর্থ কোন কিছু থেকে বিরত থাকা এবং তা পরিত্যাগ করা। শরীয়তের পরিভাষায় সাওমের অর্থ
সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা পিনা ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা।
রোজা ফরজ হওয়ার হুকুম
হিজরতের দেড় বছর পর রমজানের রোজা মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়।
********** আরবী ************
হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো। রোজা ফরজে আইন যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের এবং বিনা ওজরে যে রাখবে না সে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে।
রোজার গুরুত্ব
কুরআন এ সাক্ষ্য দেয় যে, সকল আসমানী শরীয়তের অধীন রোজা ফরজ ছিলো। এবং প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের মধ্যে তা ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
********** আরবী ************
যেমন রোজা ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর।
এ আয়াত শুধু একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয়, বরঞ্চ এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোজার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার তার একটা স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। বরঞ্চ এমন মনে হয় যে, তরবিয়ত ও তাযকিয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া তা পূর্ণ হতে পারে না। অন্য কোন ইবাদত তার বিকল্প হতেই পারে না।এজন্যই রোজা সকল নবী গনের শরীয়াতে ফরজ ছিল।
রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওজর অথবা রোগ ছাড়া রমজানের একটি রোজা ছেড়ে দেবে যদি সে সারা জীবন ধরে রোজা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরন হবে না। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)
অর্থাৎ রমজানের রোজার মহত্ব, কল্যাণ, বরকত ও গুরুত্ব এইযে, যদি কোন উদাসীন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন রোজা নষ্ট করে বা না রাখে, তার ফলে তার যে ক্ষতি হলো তা জীবনব্যাপী রোজা রাখলেও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। তবে তার আইনগত কাযা হতে পারে।
রোযার উদ্দেশ্য
রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া পয়দা করার ……. আরবী …… যাতে করে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া পয়দা হতে পারে। তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহর সত্তার ওপর ঈমান,ও তার গুণাবলী দয়া অনুগ্রহের গভীর অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তা অন্য গুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তিদানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাচার সত্যিকার উপায়।
রোযা আল্লাহর সত্তার ওপরে দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার অনুগ্রহ ও অসন্তোষের গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। সারাদিন ক্রমাগত কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রবৃত্তির একেবারে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় দাবী পূরণ থেকে বিরত থাকার কারণে মানুষের ওপর এ প্রভাব পড়ে যে, সে চরম অক্ষম, অসহায় ও মুখাপেক্ষী হয়। সে জীবনের প্রতি মূহুর্তের জন্য আল্লাহর রহম ও করমের ভিখারি হয়। তারপর সে যখন তার জীবনকে আল্লাহর নিয়ামতে সমৃদ্ধ দেখতে পায়, তখন সে আল্লাহর মহব্বতের আবেগ উচ্ছ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয় এবং আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীতে তৎপর হয় তখন সে নিভৃতে তার প্রবল যৌন বাসনাকে সংযত করে রাখে যেখানে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ থাকে না তখন তার মনে আল্লাহর ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ফলে তার মনের ওপর আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন ছাপ পড়ে যে গোনাহের চিন্তা করতেও তার শরীর কেপে ওঠে।
প্রকৃত রোযা
রোযার এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসির করা যেতে পারে, যখন রোযা পূর্ণ অনুভূতির সাথে রাখা হয় এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে রোযাকে রক্ষা করা হয় যার প্রভাবে রোযা প্রাণ হীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত রোযা তো তাই যার সাহায্যে মানুষ তার মন মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করবে।
নবী (স) বলেন, তুমি যখন রোযা রাখবে তখন তোমার কর্তব্য হবে তোমার কান, চোখ, মুখ, হাত, পা এবং সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখা। (কাশফুল মাহজুব)
নবী (স) আরো বলেন, যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন ছিল না। (বুখারী)
এমন বহু রোজাদার আছে যে, রোযায় ক্ষুধা তৃষ্ণা ভোগ করা ছাড়া তাদের নেকীর পাল্লায় আর কিছু পড়ে না। (মিশকাত)