সিহরী ও ইফতার
রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদেকের পূর্বে যে খাওয়া দাওয়া করা হয় তাকে সিহরী বলে। নবী (স) স্বয়ং সিহরীর ব্যবস্থাপনা করতেন এবং অন্যকেও সিহরী খাওয়ার তাকীদ করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) সিহরীর সময় আমাকে বলতেন, আমার রোযা রাখার ইচ্ছা আমাকে কিছু খেতে দাও। তখন আমি তাকে কিছু খেজুর এবং এক বাটি পানি খেতে দিতাম।
নবী (স) সিহরীর তাকীদ করতে গিয়ে বলেন, সিহরী খেয়ো এজন্য যে, এতে বিরাট বরকত রয়েছে।
বরকত বলতে এই যে, দিনের কাজকর্মে এবং ইবাদাত বন্দেগীতে দুর্বলতা মনে হবে না এবং রোযা সহজ হবে।
একবার নবী (সা) বলেনঃ দিনে রোযা রাখার জন্যে সিহরী খাওয়া দ্বারা সাহায্য নাও এবং রাতের ইবাদাতের জন্যে কায়লূলা দ্বারা সাহায্য নিও।
সিহরী খাওয়া সুন্নাত। মুসলমান এবং ইহুদী নাসারাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তারা সিহরী খায় না, মুসলমান খায়, ক্ষিধে না হলে কিছু মিষ্টি, অথবা দুধ অথবা পানি খেয়ে নেয়া উচিত এজন্যে সিহরী খাওয়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব আছে।
নবী (স) বলেন, সিহরী খাওয়া প্রত্যক্ষ বরকত। সিহরী খেতে ভুলো না, তা এক চুমুক পানি হোক না কেন। কারণ সিহরী যারা খায় তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্যে এস্তেগফার করেন।
সিহরী বিলম্বে করা
সুবহে সাদেক হতে সামান্য বাকী আছে এতোটা বিলম্ব করে সিহরী খাওয়া মুস্তাহাব।অনেকে সাবধানতার জন্যে অনেক আগে সিহরী খায়। এটা ভালো নয়। বিলম্বে খাওয়াতে সওয়াব আছে।
ইফতার তাড়াতাড়ি করা
ইফতার তাড়াতাড়ি করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সাবধানতার জন্যে বিলম্ব করা মনাসিব নয়, বরঞ্চ তৎক্ষণাৎ ইফতার করা উচিত। এভাবে অপ্রয়োজনীয় সাবধানতার ফলে দ্বীনি মানসিকতা লোপ পায়। এটা দীনদারি নয় যে, লোক অযথা নিজেদেরকে কষ্টে ফেলবে। বরঞ্চ দীনদারি হচ্ছে এই যে, বিনা বাক্যে ব্যয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে।
নবী (স) বলেন, তিনটি বিষয় পয়গম্বরসুলভ আচরণের শামিলঃ
১. সিহরী বিলম্বে খাওয়া।
২. ইফতার তাড়াতাড়ি করা।
৩. নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা।
হযরত ইবনে আবি আওফা(রা) বলেন, আমরা একবার সফরে নবী (স) এর সাথী ছিলাম। তিনি রোযা ছিলেন। যখন সূর্য দৃষ্টির আড়াল হলো তখন তিনি একজনকে বললেন, ওঠ আমার জন্যে ছাতু গুলে দাও। লোকটি বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আর একটু দেরী করুন সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভালো হয়। এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নাম এবং আমাদের জন্যে ছাতু গুলে দাও। সে আবার বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ,এখনো দিন আছে বলে মনে হচ্ছে। আবার এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নেমে পড় এবং আমাদের জন্যে ছাতু তৈরী করে দাও। তখন সে নামলো এবং সকলের জন্যে ছাতু তৈরী করলো। নবী (সা) ছাতু খেয়ে বললেন, তোমরা যখন দেখবে যে রাতের কালো ছায়া ওদিক থেকে ছেয়ে আসছে তখন রোযাদারের রোযা খোলা উচিত।(বুখারী)
নবী (স) বলেন, আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, আমার বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে ঐ বান্দাহকে আমার পছন্দ হয়, যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে। (তিরমিযি) (অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর কিছুতেই বিলম্ব করো না।)
নবী (স) আরো বলেন, লোক ভালো অবস্থায় থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার তাড়াতাড়ি করতে থাকবে। (বুখারী, মুসলিম)
কোন জিনিস দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব
খেজুর এবং খুরমা দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব তা না হলে পানি দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব।নবী (স)স্বয়ং এসব দিয়ে ইফতার করতেন।
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) মাগরিবের নামাযের পূর্বে কয়েকটি ভিজানো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না হলে খুরমা দিয়ে। তাও না হলে কয়েক চুমুক পানি পান করতেন। (তিরমিযি, আবু দাউদ)
এসব জিনিস দিয়ে ইফতার করার জন্যে নবী (স) সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ রোযা রাখলে খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। তা না হলে পানি দিয়ে। আসলে পানি অত্যন্ত পবিত্র। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)
খেজুর ছিল আরবের উপাদেয় খাদ্য এবং ধনী গরীব সকলেই তা সহজেই লাভ করতো। আর পানি তো সর্বত্র প্রচুর পাওয়া যায়। এসব দিয়ে ইফতার করার জন্যে প্রেরণা দেয়ার তাৎপর্য এই যে, উম্মত যেন কোনো কষ্ট বা অসুবিধার সম্মুখীন না হয়, সময় মতো সহজেই রোযা খুলতে পারে। পানির একটা বৈশিষ্ট্য নবী (স) বলেন যে, তা এতোটা পাক যে তার দ্বারা সবকিছু পাক করা যায়। বাহ্যিক পাক তো অনুভবই করা যায়। তার সাথে রূহানী পবিত্রতাও হয়। রোযাদার যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সচেতন ঈমানের সাথে সারাদিন তৃষ্ণার্ত থেকে এবং সূর্যাস্তে ঠান্ডা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে শোকর গুজারির প্রেরণা সৃষ্টি হয় যার দ্বারা তার বাতেন বা আধ্যাত্মিক দিক আলোকিত করার সৌভাগ্য হয়।
কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা এবং অন্য কোনো জিনিস দিয়ে ইফতার করা তাকওয়ার খেলাফ মনে করা একেবারে ভুল। এমনি এ ধারণা করাও ভুল যে লবণ দিয়ে ইফতার করা বড়ো সওয়াবের কাজ।
ইফতারের দোয়া
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ তোমার জন্য রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।
ইফতারের পরের দোয়া
*******আরবী*********
পিপাসা চলে গেলে, রগ শো ঠিক হয়ে গেল এবং আল্লাহ চাইলে প্রতিদানও অবশ্যই মিলবে। (আবু দাউদ)
ইফতার করাবার সওয়াব
অন্যকে ইফতার করানোও পছন্দনীয় আমল এবং ইফতার যে করায় তাকেও ততোটা সওয়াব দেয়া হয় যতোটা দেয়া হয় রোযাদারকে। তা রোযাদারকে দু লোকমা খানা খাইয়ে দেয়া হোক অথবা একটা খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হোক।
নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের মতোই সওয়াব পাবে। (বায়হাকী)
সিহরী ছাড়া রোযা
রাতে সিহরীর জন্যে যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তবুও রোযা রাখা উচিত। সিহরী খাওয়া না হলে রোযা না রাখা কাপুরুষের কাজ। সিহরী না খাওয়ার জন্যে রোযা ছেড়ে দেয়া বড় গোনাহের কাজ।
যদি কখনো দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে এবং মনে হয় যে, রাত বাকী আছে এবং কিছু খানাপিনা করা হলো। তারপর দেখা গেল যে, সুবহে সাদেকের পর খানাপিনা করা হয়েছে। তাহলে এ অবস্থায় যদিও রোযা হবে না, তথাপি রোযাদারের মতোই থাকতে হবে কিছু পানাহার করা যাবে না।
এতো বিলম্বে যদি ঘুম ভাঙ্গে যে, সুবহে সাদেক হওয়ার সন্দেহ হয় তাহলে এমন সময় খানাপিনা মাকরূহ এবং সন্দেহ হওয়ার পর খানাপিনা গোনাহর কাজ। পরে সত্যি সত্যিই জানা গেল যে, সুবেহ সাদেক হয়েই গেছে তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে। কিন্তু সন্দেহেই যদি থেকে যায় তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে না। তবে সতর্কতার জন্যে কাযা করবে।