হজ্জের অধ্যায়
হজ্জের বিবরণ
হজ্জ ইসলামের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হজ্জের একটা ঈমান উদ্দীপনা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এর প্রতি লক্ষ্য না রাখলে হজ্জের মহত্ব, তাৎপর্য ও মূল উদ্দেশ্যে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কুফর ও শিরক পরিবেশিত এক শক্তিশালী পরিবেশে এক মুমিন বান্দাহ খালেস তাওহীদের ঘোষণা করেন। তারপর বাতিল যালেম শক্তির চরম বাধা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঈমান, তাকওয়া, ইখলাস, লিল্লাহিয়াত, এশক ও মহব্বত, ত্যাগ ও কুরবানী নির্ভেজাল নিরঙ্কুশ আল্লাহর আনুগত্য ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের নজিরবিহীন প্রেরণা ও আমলের দ্বারা ইসলামের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস তৈরী করেন এবং তাওহীদ ও এখলাসের এমন এক কেন্দ্র তৈরী করেন যা দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার থেকে বিশ্ব মানবতা তাওহীদের পয়গাম পেতে থাকবে।
এ ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করার জন্যে এবং মানুষের মনে আবেগ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করার জন্যে প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে তাওহীদের প্রেম পাগল পতঙ্গসমূহ ঐ কেন্দ্রে জমায়েত হয়ে ঐসব কিছুই করে যা তাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক হযরত ইবরাহীম (আ) করেছিলেন। তারা কখনো দু খন্ড কাপড় পরিধান করে আবেগ উচ্ছ্বাসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং কখনো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে তাদেরকে দৌড়াতে দেখা যায়। কখনো আরাফাতের ময়দানে দাড়িয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং কখনো কুরবানীগাহে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর সাথে মহব্বতের শপথ গ্রহণ করে। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সকাল সন্ধ্যায় তাদের এ একই ধ্বনিতে হেরেমের গোটা পরিবেশ গুঞ্জরিত হতে থাকে আয় আল্লাহ! তোমার দরবারে তোমার গোলাম হাজির আছে। প্রশংসা ও স্তুতি একমাত্র তোমারই, দয়া করা তোমারই কাজ, তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বের কেউ শরীক নেই।
প্রকৃতপক্ষে এসব অবস্থা সৃষ্টি করার এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ওপর সোপর্দ করারই নাম হজ্জ।
হজ্জের অর্থ
হজ্জের আভিধানিক অর্থ হলো যিয়ারতের এরাদা করা। শরীয়াতের পরিভাষায় হজ্জের অর্থ হলো সেই সার্বিক ইবাদাত যা একজন বায়তুল্লাহ পৌঁছে করে থাকে। যেহেতু হজ্জে মুসলমান আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের এরাদা করে সে জন্যে একে হজ্জ বলা হয়।
হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত
ইসলামী ইবাদাত দুই প্রকারের। এক – দৈহিক ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা। দুই – মালের ইবাদত, যেমন সদকা যাকাত দান খয়রাত ইত্যাদি। হজ্জের বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। অন্যান্য স্থায়ী ইবাদতগুলোর দ্বারা এখলাস, তাকওয়া, বিনয়, নম্রতা, বন্দেগীর পিপাসা। আনুগত্য, কুরবানী, ত্যাগ, আত্মসর্মপন, আল্লাহর নৈকট্য প্রভৃতির যে, প্রেরণা ও ভাবাবেগ পৃথক পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করে, হজ্জের সার্বিকতা এই যে, এ সকল অনুভূতি ভাবাবেগ ও মানসিক অবস্থা একই সময়ে এবং একই সাথে তৈরী হয় ও বিকাশ লাভ করে।
যে নামাজ দ্বীনের উৎস, তা কায়েম করার জন্য যমীনের উপর যে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরী করা হয়, হজ্জে মুমিনগণ সে মসজিদের চারপাশে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে তওয়াফ করে। সারা জীবন দূরদূরান্ত থেকে যে মসজিদের দিকে মুখ করে মুসলমান নামাজ পড়ে, হজ্জে তার এ সৌভাগ্য হয় যে, সে ঐ মসজিদে দাড়িয়ে নামাজ সমাধা করে।
যে রোজা মন ও চরিত্রের সংশোধনের উপযোগী ও অনিবার্য উপায় এবং যে রোজায় একজন মুমিন প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে দূরে থেকে ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় শক্তি লাভ করে ও আল্লাহর সিপাহী ও মুজাহিদ হওয়ার অভ্যাস করে।
হজ্জে ইহরাম বাধার সময় থেকে ইহরাম খোলা পর্যন্ত ঐরূপ সংগ্রাম সাধনায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, মন থেকে এক একটা চিত্র মুছে ফেলে দিয়ে আল্লাহর মহব্বতের চিত্র অংকিত করে। দীন রাত তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত করে শুধু মাত্র তওহীদের পতাকাবাহী হয়ে যায়।
সদকা ও যাকাতে নিজের প্রিয় ধনসম্পদ দান করে মুমিন বান্দাহ ধনলিপ্সার প্রবণতা মুছে ফেলে আল্লাহর প্রেমের বীজ বপন করে । হজ্জেও লোক তার সারাজীবনের সঞ্চিত ধন শুধু আল্লাহর মহব্বতে মুক্ত হস্তে দান করে এবং তার পথে কুরবানী করে তার সাথে কৃত ওয়াদা চুক্তি পূরণ করে। মোটকথা, হজ্জের দ্বারা আল্লাহর সাথে প্রেমপূর্ন সম্পর্ক, মন, চরিত্রের সংশোধন এবং আধাত্নিক উন্নতির সকল উদ্দেশ্য একই সাথে পূর্ণ হয়। তবে শর্ত এই যে, হজ্জ শুধু মাত্র যেন হজ্জের অনুষ্ঠান পালনের কাজ না হয়।
হজ্জের হাকীকত
হজ্জের হাকীকত বা মর্মকথা এই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে তার প্রভুর হাতে সোপর্দ করে দেবে এবং একনিষ্ঠ মুসলমান হয়ে যাবে। আসলে আল্লাহ তায়ালার পাত সত্তা থেকে এ শক্তি আশা করা যায় যে, সংস্কার সংশোধনের সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য প্রচেষ্টা সত্বেও বান্দাহর জীবনে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যায় তা হজ্জের করনীয় কাজগুলো এবং হজ্জের স্থানগুলোর বরকতে দূর হয়ে এবং সে হজ্জের মাধ্যমে এমন পাক সাফ হয়ে ফিরে আসবে যেন সে আজই জন্ম গ্রহণ করেছে। সেই সাথে প্রকৃত অবস্থার একটা কষ্টিপাথর ও বটে। অর্থাৎ কার হজ্জ প্রকৃত হজ্জ এবং কে হজ্জের সকল আরকান পালন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা সত্ত্বেও বঞ্চিত রয়ে গেছে। আর এটাও সত্য যে, হজ্জের তাওফীক লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার সম্পর্কে খুব কম আশাই করা যেতে পারে যে, অন্য কোনো উপায়ে তার সংশোধন হতে পারবে। এজন্য হজ্জ পালনকারীর জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী যে, সে যেন তার আবেগ অনুভূতি ও কামনা বাসনার পর্যালোচনা করে এবং এবং হজ্জের এক একটি রুকন আমল পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও অনুভূতির সাথে আদায় করে হজ্জের সেসব ফায়দা হাসিল করে যার জন্য ফরয করা হয়েছে।
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ) এর কাছে এক ব্যক্তি হাজির হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করে (হজ্জ করে) ফিরে এসেছে কিন্তু তার জীবনের উপর হজ্জের কোন ছাপ দেখতে পাওয়া যায়নি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? সে বললো আমি বায়তুল্লাহর হজ্জ করে আসছি।
হযরত জুনাইদ (র) খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন। তুমি হজ্জ করেছ নাকি ?
মুসাফির –জি হ্যাঁ, আমি হজ্জ করেছি।
হযরত – যখন তুমি হজ্জের জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের হয়েছিলে, তখন তুমি গোনাহ থেকে দূরে ছিলে কি না ?
মুসাফির – হযরত আমি এভাবে চিন্তা করেনি।
হযরত – তাহলে তুমিতো হজ্জের জন্য মোটেও বের হওনি। আচ্ছা বলোতো তুমি এ পবিত্র ছফরে তুমি যেসব মনযিল অতিক্রম করেছ এবং যেখানে যেখানে রাত কাটিয়েছে তখন তুমি কি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মনযিলগুলোও অতিক্রম করেছ কি না ?
মুসাফির – হযরত, আমারতো এসব খেয়ালই হয়নি।
হযরত – তাহলে তুমি তো না বায়তুল্লাহর দিকে কোনো সফর করেছ। আর না সেদিকে কোন মনযিল অতিক্রম করেছ। আচ্ছা বল তো তুমি যখন ইহরাম বাধলে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাক খুলে ফেললে তখন তার সাথে সাথে তোমার মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসগুলো তোমার জীবন থেকে দূরে নিক্ষেপ করলে কিনা?
মুসাফির- হযরত, এভাবে তো আমি চিন্তা করে দেখিনি।
হযরত জুনাইদ তখন খুব দুঃখ করে বললেন। তাহলে তুমি ইহরামই বা বাধলে কোথায়? আচ্ছা বলত যখন তুমি আরাফাতের ময়দানে দাড়ালে তখন কিছু মুশাহাদার অনুভূতি হয়েছিল কি?
মুসাফির- হযরত, এর অর্থই বুঝলাম না
হযরত -তার অর্থ এই যে, আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার সময় তুমি তোমার মধ্য এ অবস্থা কি অনুভব করেছ যে, তোমার রব তোমার সামনে এবং তুমি তাকে দেখছ?
মুসাফির- হযরত, এ অবস্থা তো আমার হয়নি।
হযরত – তাহলে তুমি তো আরাফাতে পৌঁছাওনি। আচ্ছা তারপর বল দেখি, মুযদালাফায় পৌছার পর তোমার প্রবৃত্তির কামনা বাসনা পরিহার করেছ কিনা?
মুসাফির- হযরত, আমি এ বিষয় তো কোনো মনোযোগ দেইনি।
হযরত তাহলে তুমি তো মুযদালাফাও যাওনি। আচ্ছা, বল দেখি, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার সময় আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যের জ্যোতি ও অলৌকিক শক্তি লক্ষ্য করেছ কি?
মুসাফির- হযরত আমি এর থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
হযরত -তাহলে তুমি মোটেই তাওয়াফ করনি। আচ্ছা, তারপর তুমি যখন সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করলে তখন সাফা মারওয়া ও তার মধ্যে সায়ী করার হিকমত, মর্মকথা ও তার উদ্দেশ্যে হাসিল করেছ কি?
মুসাফির এসবের তো কোনো অনুভূতিই আমার ছিল না।
হযরত-তাহলে তুমি বলতে গেলে সায়ীও করনি। তারপর তুমি কুরবানগাহে গিয়ে যে কুরবানী কররে, তখন তুমি তোমার প্রবৃত্তি ও তার কামনা বাসনাকেও কুরবানী করেছ কি?
মুসাফির- হযরত এদিক আমি লক্ষ্যই করিনি।
হযরত – তাহলে তুমি কুরবানীই বা করলে কোথায়? আচ্ছা বল দেখি, তুমি জমরাতে পাথর মারলে, তখন তুমি তোমার অসৎ সহকর্মী, সাথী ও কুপ্রবৃত্তিকেও তোমার কাছ থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছ কি?
মুসাফির- তাতো করিনি।
হযরত – তাহলে তুমি রামীও করোনি।
তারপর হযরত জুনাইদ বাগদাদী (র) বড় দুঃখের সাথে বলেন, যাও ফিরে যাও এবং এরূপ মনে অবস্থাসহ আবার হজ্জ কর। যাতে করে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয় যার ঈমান ও ওয়াদা পালনের স্বীকৃতি করতে গিয়ে কুরআন এ সাক্ষ্য দেয়-
*******আরবী*********
এবং তিনি ইবরাহীম (আ ) যিনি তার রবের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের হক আদায় করেছেন।
হজ্জের মহত্ব ও গুরুত্ব
কুরআন ও সুন্নাতে হজ্জের হিকমত, দীনের মধ্যে হজ্জের মর্যাদা, তার মহত্ব ও গুরুত্বের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছ। কুরআন বলে
*******আরবী*********
মানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাবার শক্তি সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ্জ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরের আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)
১. হজ্জ বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক। যারই বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাবার শক্তি সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্যে আল্লাহর হক আদায় করা ফরয। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না, সেসব যালেম আল্লাহর হক নষ্ট করে। আয়াতের এ কথার দ্বারা হজ্জ ফরয হওয়া প্রমাণিত হয়। বস্তুত হযরত আলী (রা) এর বয়ান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নবী (স) এর পক্ষ থেকে হজ্জ ফরয হওয়ার ঘোষণা তখনই করা হয় যখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযি-কিতাবুল হজ্জ)
এ অর্থে সহীহ মুসলিমেও একটি রেওয়ায়েত আছে, যাতে নবী (স) বলেন-
হে লোকেরা! তোমাদের ওপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব হজ্জ আদায় কর।
২. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যের প্রতি এ আয়াত দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে এই যে, সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ না করা কুফরী আচরণ, যেমন বলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কুরআনে নামায ত্যাগ করাকে এক স্থানে মুশরিকী কার্যকলাপ বলা হয়েছেঃ
*******আরবী*********
এবং নামায কায়েম কর এবং (নামায ত্যাগ করে) মুশরিকদের মধ্যে শামিল হয়ো না।
ঠিক তেমনি আলোচ্য আয়াতের এ স্থানে হজ্জ না করাকে কুফরী আচরণ বলা হয়েছে। নবী (স) ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তির কাছে হজ্জের জরুরী খরচের অর্থ সামগ্রী মওজুদ আছে, যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌছাতে পারে, তারপর সে হজ্জ করে না তাহলে সে ইহুদী হয়ে মরুক অথবা খৃষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এ জন্যে যে আল্লাহ বলেন-
*******আরবী*********
হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য এই যে যারা হজ্জ করে না নবী (স) তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য বলেছেন। হজ্জ যারা করে না তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য এবং নামায যারা পড়ে না তাদেরকে মুশরিকদের সমতুল্য ঘোষণা করার মর্ম এই যে, আহলে কিতাব হজ্জ একবারে পরিত্যাগ করেছিল এবং মুশরিকগণ হজ্জ করলেও নামায পরিত্যাগ করেছিল। এজন্যে নামায পরিত্যাগ করাকে মুশরিকী ক্রিয়াকর্ম এবং হজ্জ পরিত্যাগ করাকে ইহুদী খৃষ্টানের ক্রিয়াকর্ম বলা হয়েছ। অতএব এটাও এক মোক্ষম সত্য যে, স্বয়ং কুরআনেও এ ধরনের লোককে এ সতর্কবাণীও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে হাদীস বর্ণনাকারী আয়াতের শুধু প্রথম অংশ পাঠ করেছেন। নতুবা যে সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা আয়াতের এ অংশে রয়েছে। যথাঃ
*******আরবী*********
যারা অর্থ থাকা সত্বেও হজ্জ করতে অস্বীকার করার আচরণ দেখাবে তারা যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বজগতের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। অর্থাৎ হজ্জ পরিত্যাগকারীর কুফরী আচরণের কোনো পরোয়া তিনি করেন না। তিনি ঐসব লোকের কোনো পরোয়া করেন না যে, তারা কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এ হচ্ছে সতর্কবাণীর বড়ো কঠিনতম প্রকাশভঙ্গী। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর তার অসন্তোষ ও মুখাপেক্ষহীনতার কথা ঘোষণা করেন, যে ঈমান ও হেদায়াত দ্বারা কি করে ভূষিত হতে পারে?
হযরত হাসান (রা) বলেন, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) বলেছেন, আমার দৃঢ় ইচ্ছা এই যে যেসব শহর ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেসব শহরে কিছু লোক পাঠিয়ে দেব তারা খোজ খবর নিয়ে দেখবে যে কারা হজ্জ করার সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ করছে না। তাদের ওপর আমি জিযিয়া (জিযিয়া এমন এক প্রতিরক্ষা কর যা অমুসলিমদের নিকট থেকে তার জানমালের নিরাপত্তার বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়) নির্ধারিত করে দেব। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়। (আল মুনতাকা)
মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যে পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেয়। আর হজ্জের মর্মও এ ই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবে। এরা যদি মুসলিম হতো তাহলে কি করে হজ্জের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতো এবং সামর্থ্য থাকা সত্বেও কি করে হজ্জ থেকে উদাসীন থাকতো?
হজ্জের ফযীলত ও প্রেরণা
হজ্জের এ গুরুত্বকে সামনে রেখে নবী (স) বিভিন্নভাবে এর প্রেরণা দান করেছেন। বিভিন্নভাবে এর অসাধারণ ফযীলত বর্ণনা করে এর জন্যে প্রেরণা ও আবেগ সৃষ্টি করেছেন।
১. যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে এলো, তারপর কোনো অশ্লীল যৌন ক্রিয়া করলো না, আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ করলো না, তাহলে সে গোনাহ থেকে এমনভাবে পাকসাফ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন পাকসাফ সে ঐদিন ছিল যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল। (বুখারী মুসলিম)
২. হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। সে তার মেযবান আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন, সে তার কাছে মাগফেরাত চাইলে তিনি তাকে মাগফেরাত দান করেন। (ইবনে মাজাহ)
৩. হ্জ্জ ও ওমরাহ পর পর করতে থাক। কারণ হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র ও অভাব এবং গোনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা দূর করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়। হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো একমাত্র জান্নাত। (তিরমিযি, নাসায়ী)
হজ্জে মাবরুর বলে এমন হজ্জকে যা পরিপূর্ণ এখলাস (নিষ্ঠা) অনুভূতি ও শর্তাবলীর পালনসহ আদায় করা হয় এবং যার মধ্যে হজ্জকারী আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেচে থাকার পুরোপুরি ব্যবস্থা করে।
৪. যদি কোনো হেরেম শরীফ যিয়ারতকারীর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হয়, তাহলে তার বাড়ী পৌঁছাবার আগেই তাকে সালাম কর, তার সাথে মুসাফা কর এবং তাকে অনুরোধ কর তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফেরাতের দোয়া করার। এজন্যে যে, তার গোনাহের মাগফেরাতের ফায়সালা করা হয়ে গেছে। (মুসনাদে আহমদ)
৫. হযরত হুসাইন (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর কাছে আরজ করলো, হুজুর, আমার শরীর মন উভয়ই দুর্বল। ইরশাদ হলো, তুমি এমন জেহাদ কর যাতে একটা কাটাও গায়ে না লাগে। প্রশ্নকারী বলে হুজুর, এমন জেহাদ আবার কেমন, যাতে কোনো আঘাত ও দুঃখ কষ্টের আশংকা নেই? নবী (স) ইরশাদ করেন, তুমি হজ্জ কর। (তাবারানী)
৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে নবী (স) এর একেবারে নিকটে সওয়ারীর উপরে ছিল এমন সময়ে হঠাৎ সে নীচে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করে। নবী (স) বললেন, তাকে গোসল দিয়ে ইহরামের পোষাকসহই দাফন কর। এ কিয়ামতের দিনে তালবিয়া পড়া অবস্থায় ওঠবে। (তালবিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য)। তার মাথা ও মুখমন্ডল খোলা থাকতে দাও। (বুখারী, মুসলিম)
৭. হযরত আবু যর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ ) আল্লাহর কাছে আরয করে বলেন, পরওয়ারদেগার! যে বান্দাহ তোমার ঘর যিয়ারত করতে আসবে তাকে কি প্রতিদান দেয়া হবে? আল্লাহ বলেন, হে দাউদ! সে আমার মেহমান। তার অধিকার হচ্ছে এই যে, দুনিয়াতে আমি তার ভুলত্রুটি মাফ করে দেই এবং আখিরাতে যখন সে আমার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাকে আমি আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি।