হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী
হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত দশটি। তার মধ্যে কোনো একটি শর্ত পাওয়া না গেলে হজ্জ ওয়াজিব হবে না।
১. ইসলামঃ অমুসলিমের প্রতি হজ্জ ওয়াজিব হতে পারে না।
২. জ্ঞান থাকাঃ পাগল, মস্তিষ্ক বিকৃত ও অনুভূতিহীন লোকের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।
৩. বালেগ হওয়াঃ নাবালেগ শিশুদের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়, কোনো সচ্ছল ব্যক্তি বালেগ হওয়ার পূর্বেই শৈশব অবস্থায় হজ্জ করলে তাতে ফরয আদায় হবে না। বালেগ হওয়ার পর পুনরায় তাকে হজ্জ করতে হবে। শৈশবের হজ্জ নফল হবে।
৪. সামর্থঃ হজ্জকারীকে সচ্ছল হতে হবে। তার কাছে প্রকৃত প্রয়োজন ও ঋণ থেকে নিরাপদ এতোটা অর্থ থাকতে হবে যা সফরের ব্যয়ভার বহনের জন্যে যথেষ্ট হয় এবং হজ্জ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার অধীন পরিবারস্থ লোকের জীবিকা নির্বাহের জন্যে যথেষ্ট অর্থ মওজুদ থাকে, কারণ এসব লোকের ভরণপোষণের দায়িত্ব শরীয়াত অনুযায়ী তার।
৫. স্বাধীনতাঃ গোলাম ও বাদীর ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।
৬. শারীরিক সুস্থতাঃ এমন অসুস্থ না হওয়া যাতে করে সফর করা সম্ভব নয়। অতএব ল্যাংড়া, বিকলাঙ্গ, অন্ধ, এবং অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তির স্বয়ং হজ্জ করা ওয়াজিব নয়। অন্যান্য সব শর্তগুলো পাওয়া গেলে অন্যের সাহায্যে হজ্জ করাতে পারে।
৭. কোনো যালেম ও স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষ থেকে জীবনের কোনো আশঙ্কা না থাকা এবং কারাগারে আবদ্ধ না থাকা।
৮. পথ নিরাপদ হওয়াঃ যদি যুদ্ধ চলছে এমন অবস্থা হয়, পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যানবাহন ধ্বংস করা হচ্ছে, পথে চোর ডাকাতের আশংকা থাকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জলপথে ভ্রমণ সম্ভব না হয় অথবা যে কোনো প্রকারের আশংকা যদি থাকে, তাহলে এসব অবস্থায় হজ্জ ওয়াজিব হবে না। অবশ্য এ অবস্থায় এমন লোকের অসিয়ত করে যাওয়া উচিত যে, তার পরে অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুকূল হলে তার পক্ষ থেকে অন্য কেউ হজ্জ করবে।
৯. হজ্জের সফরে স্বামী অথবা কোনো মুহররম ব্যক্তি থাকতে হবেঃ এর ব্যাখ্যা এই যে, সফর যদি তিন রাত দিনের কম হয় তাহরে মেয়েলোকের স্বামী ছাড়া সফরের অনুমতি আছে।তার বেশী সময়ের সফল হলে স্বামী অথবা মুহররম পুরুষ ছাড়া হজ্জের সফর জায়েয নয়। (যে মহিলার স্বামী নেই এবং কোনো মুহররম পুরুষও নেই, তার ঐসব বন্ধু সফরকারীর সাথে যাওয়া জায়েয যাদের নৈতিক চরিত্রের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে। এ হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম মালেকের অভিমত। নির্ভরযোগ্য বন্ধু বান্ধব এর ব্যাখ্যা ইমাম শাফেয়ী (র) এভাবে করেছেনঃ কিচু সংখ্যক মেয়েলোক নির্ভরযোগ্য হতে হবে এবং তারা মুহররম লোকের সাথে হজ্জে যাচ্ছে। তাহলে এ দলের সাথে স্বামিহীন একজন মেয়েলোক যেতে পারে। অবশ্য দলে মাত্র একজন মেয়েলোক থাকলে যাওয়া উচিত নয়। ইমাম শাফেয়ীর এ অভিমত অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে একজন স্বামীহিন ও মুহাররমহীন মেয়েলোকের হজ্জ আদায় করার সুযোগ রয়েছে এবং ওসব ফেতনার আশংকাও নেই যার কারণে কোনো মেয়েলোকের মুহররম ছাড়া সফর করা নিষিদ্ধ।)এটাও জরুরী যে, এ মুহররম জ্ঞানবান, বালেগ, দীনদার এবং নির্ভরযোগ্য হতে হবে। অবোধ শিশু, ফাসেক, এবং অনির্ভরযোগ্য লোকের সাথে সফর জায়েয নয়।
১০. ইদ্দত অবস্থায় না হওয়াঃ ইদ্দত স্বামীর মৃত্যুর পর হোক অথবা তালাকের পর হোক, ইদ্দতের সময় হজ্জ ওয়াজিব হবে না।
হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত
হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত চারটি। এ শর্তগুলোসহ হজ্জ করলে তা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হবে। নতুবা হবে না।
১. ইসলামঃ ইসলাম হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার যেমন শর্ত, তেমনি সহীহ হওয়ার শর্ত। যদি কোনো অমুসলিম হজ্জের আরকান আদায় করে এবং তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করেন, তাহলে এ হজ্জ সহীহ হওয়ার জন্যে জরুরী যে, হজ্জকারী মুসলমান হবে।
২. হুশ জ্ঞান থাকাঃ হুশ-জ্ঞানহীন ও পাগল ব্যক্তির হজ্জ সহীহ হবে না।
৩. সকল আরকান নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে আদায় করা। হজ্জের মাসগুলো হচ্ছে, শাওয়াল, যুলকাদ, ও যুলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। এমনি হজ্জের সকল আরকান আদায় করার সময়ও নির্দিষ্ট আছে,স্থানও নির্দিষ্ট আছে। আর ব্যতিক্রম করে হজ্জের আরকান আদায় করলে হজ্জ সহীহ হবে না।
৪. যেসব কারণে হজ্জ নষ্ট হয় তার থেকে বেচে থাকা এবং হজ্জের সকল আরকান ও ফরয আদায় করা। যদি হজ্জের কোনো রুকন আদায় করা না হয় কিংবা ছুটে যায় তাহলে হজ্জ সহীহ হবে না।
হজ্জের আহকাম
১. হজ্জ ফরয হওয়ার সকল শর্ত বিদ্যমান থাকলে জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। হজ্জ ফরযে আইন এবং তার ফরয হওয়া কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে। যে ব্যক্তি হজ্জ ফরয হওয়া অস্বীকার করবে সে কাফের এবং যে ব্যক্তি হজ্জের শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করবে না সে গুনাহগার এবং ফাসেক।
২. হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথে সে বছরই তা আদায় করা উচিত। ফরয হওয়ার পর বিনা কারণে বিলম্ব করা এবং এক বছর থেকে আর এক বছর পর্যন্ত টালবাহানা করা গুনাহ।
নবী (স) বলেন, যে হজ্জের ইচ্ছা পোষণ করে তার তাড়াতাড়ি করা উচিত। হতে পরে যে, সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে। অথবা সওয়ারীর উটনী হারিয়ে যেতে পারে। আর এটাও হতে পারে যে, অন্য কোনো প্রয়োজন তার হতে পারে। (ইবনে মাজাহ)
উটনী হারিয়ে যাওয়ার অর্থ সফরের উপায় উপাদান না থাকা। পথ নিরাপদ না থাকা এবং এমন কোনো প্রয়োজন এসে যাওয়া যার জন্যে হজ্জের আর সম্ভাবনা থাকে না। মানুষ ফরযের বোঝা মাথায় নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। পরিস্থিতি কখন অনুকূল হবে এবং জীবনেরই বা কি ভরসা? অতএব কোন ভরসায় মানুষ বিলম্ব করবে এবং হজ্জ করার পরিবর্তে শুধা টালবাহানা করতে থাকবে?
৩. হজ্জের ফরয আদায় করার জন্য যাদের অনুমতি নেয়া শরীয়াতের দিক দিয়ে জরুরী যেমন কারো মা বাপ দুর্বল অথবা রোগাক্রান্ত এবং তার সাহায্য প্রার্থী অথবা কোনো ব্যক্তি কারো কাছে ঋণী অথবা কারো জামিন এমন অবস্থায় অনুমতি ছাড়া হজ্জ করা মাকরূহ তাহরীমি।
৪. হারাম কামাইয়ের দ্বারা হজ্জ হারাম।
৫. ইহরাম না বেধে মীকাতে প্রবেশ করলে হজ্জ ফরয় হয়ে যায়।
৬. হজ্জ ফরয হওয়ার পর কেউ বিলম্ব করলো, তারপর সে অসমর্থ হয়ে পড়লো এবং অন্ধ, পঙ্গু অথবা কঠিন অসুখে পড়লো এবং সফরের যোগ্য রইলো না, তাহলে সে তার নিজের খরচে অন্যকে পাঠিয়ে বদলা হজ্জ করে নেবে।
মীকাত ও তার হুকুম
১. মীকাত অর্থ সেই নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত স্থান যেখানে ইহরাম বাধা ছাড়া মক্কা মুকাররামা যাওয়া জায়েয নয়। যে কোনো কারণেই কেউ মক্কা মুকাররামা যেতে চাক তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধবে। ইহরাম বাধা ছাড়া সম্মুখে অগ্রসর হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। (ইলমুল ফেকাহ)
২. বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লোকদের জন্য পাঁচটি মীকাত নির্দিষ্ট আছে।
ক. যুল হুলায়ফাহঃ
এটি মদীনাবাসীদের জন্যে মীকাত। ঐসব লোকের জন্যেও যারা মদীনার পথে মক্কা মুকাররমা আসতে চায়। এ মীকাত মদীনা থেকে মক্কা আসবার পথে প্রায় আট নয় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ মীকাত মক্কা থেকে অন্যান্য সব মীকাতের তুলনায় অধিকতর দূরত্বে অবস্থিত, আর মদীনাবাসীদের এ অধিকারও রয়েছে এজন্যে যে, সর্বদা মদীনাবাসী আল্লাহর পথে অধিকতর কুরবানী করেছে।
খ. যাতে ইরাকঃ
এটি ইরাক এবং ইরাকের পথে আগত লোকদের মীকাত। এ মীকাত মক্কা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
গ. হুজফাহঃ
এটি সিরিয়া এবং সিরিয়ার দিক থেকে আগমনকারী লোকদের জন্যে মীকাত। মক্কা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
ঘ. কারনুল মানাযেলঃ
মক্কা মুকাররামা থেকে পূর্ব দিকে পথের ওপর এক পর্বতময় স্থান যা মক্কা থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নজদবাসীদের মীকাত এবং ঐসব লোকের জন্যে যারা এ পথে আসে।
ঙ. ইয়ালামলামঃ
মক্কা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ইয়ামেন থেকে এসেছে এমন পথের ওপর একটি পাহাড়ী স্থান যা মক্কা থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে। এটি ইয়ামেন এবং এ পথে আগমনকারী লোকদের মীকাত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের লোকের জন্যেও এ মীকাত।
এসব মীকাত স্বয়ং নবী (স) নির্ধারিত করে দিয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম থেকে একথা জানা যায়। এসব মীকাত ঐসব লোকের জন্যে যারা মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী, যাদেরকে পরিভাষায় আফাকী বর এখন যারা মীকাতের মধ্যে বসবাস করে তারা যদি হেরেমের সীমার ভেতরে হয় তাহলে হেরেমই তাদের মীকাত। আর হেরেমের সীমার বাইরে হিলে অবস্থানকারী হলে তার জন্যে হিল মীকাত। অবশ্য হেরেমের মধ্যে অবস্থানকারী ওমরার জন্যে ইহরাম বাধতে চাইলে তার মীকাত হিল, হেরেম নয়।
হজ্জের ফরয
হজ্জের চারটি ফরয। তার মধ্যে কোন একটি ছুটে গেলে হজ্জ হবে না। ফরয নিম্নরূপঃ
১. ইহরাম – এটি হজ্জের শর্ত এবং হজ্জের রুকন।
২. আরাফাতে অবস্থান কিছু সময়ের জন্য হলেও।
৩. যিয়ারতে তাওয়াফ – এর প্রথম চার চক্কর ফরয এবং বাকী তিন চক্কর ওয়াজিব।
৪. এ ফরযগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত ক্রম অনুসারে আদায় করা।