কুরবানীর আহকাম ও মাসায়েল
কুরবানী দাতার জন্যে মসনূন আমল
যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটে, মাথা না মোড়ায় এবং নখ না কাটে। কুরবানী করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটবে। এ আমল মসনূন, ওয়াজিব নয়। যার কুরবানী করার সামর্থ্য নেই, তার জন্যেও এটা ভালো যে, সে কুরবানীর দিন কুরবানীর পরিবর্তে তার চুল কাটবে, নখ কাটবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। এ কাজ তার কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে।
হযরত উম্মে সালাম (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যার কুরবানী করতে হবে সে যেন চাঁদ দেখার পর যতক্ষণ না কুরবানী করেছে ততোক্ষণ চুল ও নখ না কাটে।(মুসলিম, জামউল ফাওয়ায়েদ)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আমাকে হুকুম করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদুল আযহার দিনে (যুলহজ্জের দশ তারিখে) ঈদ পালন করি। আল্লাহ তায়ালা এ দিন উম্মতের জন্যে ঈদ নির্ধারিত করেছেন। একজন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, একজন আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা বকরী দিয়েছেন। এখন ঐ বকরী কি আমি কুরবানী করব? নবী (স) বলেন, না তুমি তা কুরবানী করবে না। কিন্তু কুরবানীর দিন তোমার চুল ছাঁটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। বাস আল্লাহর কাছে এ তোমার পুরো কুরবানী হয়ে যাবে। (জামউল ফাওয়ায়েদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)
কুরবানীর পশু ও তার হুকুম
১. কুরবানীর পশু নিম্নরূপ:
উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ। এসব পশু ছাড়া অন্য পশু কুরবানী জায়েয হবে না।
২. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া শুধু এক ব্যক্তির জন্যে হতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি তাতে অংশীদার হতে পারবে না।
৩. গরু, মহিষ ও উটের মধ্যে সাতজন অংশীদার হতে পারে, তার বেশী নয়। তবে তার জন্য দুটি শর্তঃ
প্রথম শর্ত এই যে, প্রত্যেক অংশীদারের নিয়ত কুরবানী অথবা আকিকার হতে হবে। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত যেন না হয়।
দ্বিতীয় শর্ত এই যে, প্রত্যেকের অংশ ঠিক এক সপ্তমাংশ হবে। তার কম কেউ অংশীদার হতে পারে না।
এদুটো শর্তের মধ্যে কোনো একটি পূরণ না হলে কুরবানী ঠিক হবে না।
৪. উট ও গরু-মহিষে সাতজনেরও কম অংশীদার হতে পারে, যেমন দুই, চার অথবা তার কম বেশী অংশ কেউ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও এ শর্ত জরুরী যে, কোনো অংশীদার সাত ভাগের এক ভাগ এর কম অংশীদার হতে পারবে না। নতুবা কারো কুরবানী ঠিক হবে না।
৫. এক ব্যক্তি গরু খরিদ করলো এবং তার ইচ্ছা যে অন্য লোককে অংশীদার করে কুরবানী করবে। এটা দুরস্ত হবে। যদি খরিদ করার সময় গোটা গরু নিজের জন্যে খরিদ করার নিয়ত করে পরে অন্য লোককে অংশীদার করার ইচ্ছা করে, তাও জায়েয হবে। অবশ্য এটা করা ভালো যে, সে এমন অবস্থায় তা প্রথম ইচ্ছা অনুযায়ী গোটা পশু নিজের জন্যই কুরবানী করবে। তবে কাউকে শরীক করতে চাইলে সচ্ছল ব্যক্তিকে শরীক করবে, যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এমন ব্যক্তিকে যদি শরীক করা হয় যার কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।
৬. গরু মহিষের কুরবানীতে কেউ এক বা একাধিক অতিরিক্ত লোকের অংশ নিজে নিজেই ঠিক করলো, অংশীদারদের অনুমতি নেয়া হলো না, তাহলে এ কুরবানী জায়েয হবে না। যাদের অংশ রাখা হবে তাদের তাদের অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। এটা করা যাবে না যে, কুরবানীর অংশীদার মনে মনে ঠিক করে প্রথমে কুরবানী করা হলো এবং তারপর অংশীদারের অনুমতি পরে নেয়া হলো।
৭. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া পূর্ণ এক বছর বয়সের হলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে। এক বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। গরু মহিষ পূর্ণ দু বছরের হতে হবে। দু বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। উট পাঁচ বছরের হলে কুরবানী হবে। তার কম হলে জায়েয হবে না।
৮. যে পশুর শিং জন্ম থেকে ওঠেনি, অথবা ওঠার পর কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে তাহলে তার কুরবানী করা জায়েয হবে। কিন্তু শিং যদি গোড়া থেকেই ভেঙ্গে যায় তাহলে তা কুরবানী জায়েয হবে না।
৯. অন্ধ, কানা পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যে পশু তিন পায়ের ওপর চলে এমন ল্যাংড়া পশু কুরবানী করাও জায়েয হবে না। চতুর্থ পা যদি মাটিতে রাখে কিন্তু খুড়িয়ে চলে, তাহলে দুরস্ত হবে।
১০. যে পশুর কান এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা অথবা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।
১১. দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হলেও মোটাতাজা ও সুন্দর পশু কোরবানী করা ভালো। পশু যদি এমন দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয় যে, তার হাড় একেবারে মজ্জাহীন হয়ে পড়েছে তাহলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) শিং বিশিষ্ট মোটা তাজা একটা দুম্বা কুরবানী করছিলেন যার চোখের চারপাশে কালো রং ছিল, যার মুখও কালো রঙের ছিল এবং যার পাগুলো ছিল কালো রঙের। (আবু দাউদ)
১২. যে পশুর জন্ম থেকেই কান হয়নি অথবা হয়ে থাকলে খুব ছোট ছোট তা কুরবানী করা দুরস্ত হবে।
১৩. যে পশুর দাঁত মোটেই নেই তার কুরবানী করা দুরস্ত হবে না। কিন্তু দাঁত পড়ে গেছে এবং অধিকাংশ দাঁত আছে তাহলে জায়েয হবে।
১৪. খাসি, পাঠা কুরবানী জায়েয। নবী (স) স্বয়ং খাসি দুম্বা কুরবানী করেছেন।
১৫. যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব এমন এক সচ্ছল ব্যক্তি কুরবানীর জন্যে একটি পশু খরিদ করলো। খরিদ করার পর তার মধ্যে এমন ত্রুটি পাওয়া গেল, যার জন্যে তা কুরবানী করা দুরস্ত হলো না। তখন সে আর একটি পশু খরিদ করে কুরবানী করবে। তবে কোনো দরিদ্র লোকের এমন অবস্থা হলে- যার ওপর কুরবান ওয়াজিব ছিল না, তার পক্ষে ঐ ত্রুটি পূর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হবে।
১৬. গাই-বকরী গর্ভবতী হলেও তা কুরবানী জায়েয হবে। বাচ্চা জীবিত হলে তাও যবেহ করা উচিত।
কুরবানীর হুকুম
১. কুরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) কে একজন জিজ্ঞেস করলো কুরবানী কি ওয়াজিব? তিন বলেন, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন। ঐ ব্যক্তি পুনরায় সে প্রশ্ন করলে তার জবাবে হযরত আবদুল্লাহ বলেন, তুমি বুঝতেছ না যে, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন।
২. কুরবানী কারেন এবং মুতামাত্তার ওপরে ওয়াজিব। তবে মুফরেদের ওপর ওয়াজিব নয়। সে যদি আপন ইচ্ছায় করে তাহলে তার সওয়াব পাবে।
৩. হাজীদের ছাড়া অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত এই যে,যে সচ্ছল হবে। সচ্ছল হওয়ার অর্থ তার ততোটা ধন-সম্পদ থাকতে হবে যে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত এতো সম্পদ থাকবে যে, তার হিসেব করলে নেসাব পরিমাণ হবে।
অর্থাৎ যার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।
দ্বিতীয় শর্ত এই যে, মুকীম হতে হবে। মুসাফিরের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৪. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব- না বিবির পক্ষ থেকে, আর না সন্তানের পক্ষ থেকে।
৫. কোন ব্যক্তির ওপরে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কুরবানী ওয়াজিব ছিল না। কিন্তু সে কুরবানী করার নিয়তে পশু খরিদ করেছে। তাহলে সে পশু কুরবানী করা তার ওয়াজিব হবে।
৬. এক ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল, কুরবানীর তিন দিন অতীত হয়ে গেলে কোনো কারণে সে কুরবানী করতে পারলো না। যদি এ উদ্দেশ্যে সে কোনো ছাগল খরিদ করে থাকে তাহলে জীবিত সে ছাগল খয়রাত করে দেবে। খরিদ করে না থাকলে একটি ছাগলের মূল্য খয়রাত করবে।
৭. কেউ এ বলে মানত মানলো যে, যদি আমার অমুক কাজটি হয়ে যায় তাহলে কুরবানী করবো। আল্লাহর ফযলে তার সে কাজ হয়ে গেল। এখন সে ব্যক্তি সচ্ছল হোক অথবা অসচ্ছল তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। মানত কুরবানীর হুকুম এই যে, তার সমস্ত গোস্ত গরীব ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে- না কুরবানীকারী খাবে এবং না কোনো সচ্ছল ব্যক্তিকে খাওয়াবে।
কুরবানীর দিনগুলো ও সময়
১. ঈদুল আযহা অর্থাৎ যুলহজ্জের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে কোনো দিনে সুযোগ সুবিধা মতো কুরবানী করা জায়েয। তবে কুরবানী করর সবচেয়ে উত্তম দিন হলো ঈদুল আযহার দিন। তারপর এগারো তারিখে এবং তার বারো তারিখে।
২. শহর ও বন্দরের অধিবাসীদের জন্যে ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী জায়েয নয়। নামাযের পর কুরবানী করবে। তবে গ্রামাঞ্চলের লোক ফজর নামাযের পরও কুরবানী করতে পারে। (সম্ভবত এজন্যে যে, বহু দুর দূরান্তের ঈদগাহ থেকে নামা পড়ে আসতে বহু বিলম্ব হবে এমন কি বিকেল হয়ে যেতে পারে।)
৩. শহরের অধিবাসী যদি তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে করায় তাহলে তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে ফজরের পরও হতে পারে। ঈদের নামাযের পূর্বই যদি গোস্ত এসে যায় তাহলেও কুরবানী জায়েয হবে।
৪. কুরবানীর দিনগুলোতে অর্থাৎ ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময়ে দিনে বা রাতে, কুরবানী করা জায়েয।
তবে রাতে কুরবানী না করা ভালো। কারণ কোনো রগ হয়তো ভালোভাবে কাটা নাও যেতে পারে যার জন্যে কুরবানী দুরস্ত হবে না।
৫. কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত মুকীম হওয়া এবং সচ্ছল হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি সফরে থাকে এবং বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ী পৌঁছে এবং সে যদি সচ্ছল হয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে; সে যদি মুকীম এবং দরিদ্র হয়, কিন্তু ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যদি আল্লাহ তাকে মালদার বানিয়ে দেয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।
কুরবানীর বিভিন্ন মাসায়েল
১. কুরবানী করার সময়ে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বা দোয়া পড়া জরুরী নয়। শুধু মনের নিয়ত ও ইরাদা কুরবানী সহীহ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে মুখে দোয়া পড়া ভালো।
২. নিজের কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করা ভালো। কোনো কারণে নিজে যবেহ করতে না পারলে- পশুর কাছে হাজির থাকা দরকার। যেমন নবী (স) হযরত ফাতেমা (রা) কে বলেছিলেন ফাতেমা চল, তোমার কুরবানীর কাছে দাঁড়িয়ে থাক। এ জন্যে যে, তার প্রতিটি রক্ত কণার বদলায় তোমার পূর্বের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। ফাতেমা বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। একি আমাদের আহলে বায়তের জন্যে নির্দিষ্ট, না সকল সাধারণ মুসলমানদের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের জন্যেও এবং সকল মুসলমানদের জন্যেও। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)
৩. গরু মহিষ প্রভৃতি কুরবানীতে কয়েকজন শরীক হলে গোস্ত ভাগ অনুমান করে করা চলবে না। বরঞ্চ মাথা, গুর্দা, কলিজী প্রভৃতি প্রত্যেক জিনিস সমান সমান সাত ভাগ করতে হবে। তারপর যার যেতো অংশ তাকে ততোটা দিতে হবে।
৪. কুরবানীর গোস্ত নিজেও খাবে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যেও বণ্টন করা যায়। এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে বাকী নিজের মধ্যে এবং আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বন্টন করা ভালো। কিন্তু এটা অপরিহার্য নয় যে, এক তৃতীয়াংশ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। তার কম গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করলেও কোন দোষ নেই।
৫. গরু মহিষ বা উটে কয়েক ব্যক্তি অংশীদার রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোস্ত ভাগ করে নেয়ার পরিবর্তে যদি সব একত্রে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে অথবা রান্না করে তাদেরকে খাওয়াতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে।
৬. কুরবানীর গোস্ত অমুসলিমকে দেয়াও জায়েয। তবে মজুরী বাবদ দেয়া জায়েয নয়।
৭. কুরবানীর চামড়া অভাবগ্রস্তকে দেয়া যায় অথবা তা বিক্রি করে মূল্যও খয়রাত করা যায়। এ মূল্য তাদেরকে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়।
৮. কুরবানীর চামড়া নিজের কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন জায়নামাজ বানানো হলো।
৯. কসাইকে গোস্ত বানাবার মজুরী স্বরূপ গোস্ত, চামড়া, রশি প্রভৃতি দেয়া ঠিক হবে না। মজুরী পৃথক দিতে হবে। রশি, চামড়া প্রভৃতি খয়রাত করতে হবে।
১০. যার ওপর কুরবানী ওয়াজেব তাকে তো করতেই হবে। যার ওপর ওয়াজিব নয়, তার যদি খুব বেশী কষ্ট না হয় তাহলে তারও করা উচিত। অবশ্য ধার কর্জ করে কুরবানী করা ঠিক নয়।
মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কুরবানী
আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন সে শুধু তার ওয়াজিব কুরবানী করেই ক্ষান্ত হবে না। বরঞ্চ কুরবানীর অফুরন্ত সওয়াব পাওয়ার জন্যে আপন মুরব্বীদের পক্ষ থেকে যথা মৃত মা-বাপ, দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ভালো। এমন কি যার বদৌলতে হেদায়াত ও ঈমানের সম্পদ লাভ সম্ভব হয়েছে এমন হাদী ও মুরশিদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া তো মুমিনের জন্যে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। এভাবে আযওয়াজে মুতাহহেরা অর্থাৎ রূহানী মা-দের পক্ষ থেকে কুরবানী করাও অশেষ সৌভাগ্যের কথা।
হাদীর বয়ান
হাদী শব্দের আভিধানিক অর্থ হাদীয়া তোহফা, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী ঐ পশুকে বলা হয় যাকে হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পাঠিয়ে দেয়।
১. হাদী তিন প্রকারঃ উট, গরু, ছাগল। উট সর্বোৎকৃষ্ট হাদী এবং ছাগল সর্বনিম্ন। ভেড়া, দুম্বা প্রভৃতি ছাগলের পর্যায়ে এবং মহিষ প্রভৃতি গরু গাভীর পর্যায়ে।
২. হাদীর পশুর বয়স, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সম্পর্কে হুকুম ও শর্ত তাই যা কুরবানীর পশু সম্পর্কে রয়েছে।
৩. হাদী যদি ইচ্ছাকৃত হয়,যেমন ইফরাদ হজ্জকারী আপন ইচ্ছায় নফল কুরবানী করে। তাহলে সে কুরবানীর গোস্ত হাদীকারী নিজেও খেতে পারে। তেমনি কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারী আপন আপন কুরবানীর গোস্ত খেতে পারে। যেমন সাধারণ কুরবানীর গোস্ত খাওয়া জায়েয। কারণ কেরান এবং তামাত্তুর হাদী কোনো অপরাধ অথবা ত্রুটি বিচ্যুতির কাফফারা নয়। বরঞ্চ শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারীর ওপর ওয়াজিব করেছেন। এজন্যে সাধারণ কুরবানীর গোস্তের মতো তা খাওয়া জায়েয। নবী (স) তার হাদীর প্রত্যেকটি পশুর এক এক টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন এবং তার শুরবাও পান করেছেন। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবের (রা) এর বর্ণনা এবং অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত আছে যে, নবী (স) হজ্জে কয়েকটি কুরবানী করেন।
প্রকাশ থাকে যে, কেরান এবং তামাত্তু তো একটি কুরবানীই হয়ে থাকে এবং বাকীগুলো নফলই হয়ে থাকবে। তিনি যখন প্রত্যেকটি থেকে এক একটা টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন তাহলে জানা গেল যে, তামাত্তু, কেরান এবং নফল তিন প্রকারের গোস্ত কুরবানীকারী স্বয়ং খেতে পারে।
৪. তামাত্তু, কেরান ও ইচ্ছাকৃত নফল কুরবানীর গোস্ত ছাড়া কোনো হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয়। তা সে কোনো অপরাধের কাফফারার হাদী হোক কিংবা মানতের অথবা ইহসাবের দমের (পরিভাষা দ্রষ্টব্য) কুরবানী হোক। নবী (স) যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় বাধাপ্রাপ্ত হলেন এবং বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যেতে পারলেন না, তখন তিনি নাজিরা আসালামীর মাধ্যমে ইহসারের হাদী পাঠিয়ে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, তার গোস্ত সে যেন না খায় এবং সঙ্গীকেও খেতে না দেয়।
৫. যে হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয় তার সমস্ত গোশত ফকীর মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে এবং তা করা ওয়াজিব। হেরেমের গরীবদের মধ্যে হোক অথবা তার বাইরের হোক উভয়ই জায়েয। হেরেমের গরীবদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। (আয়নুল হেদায়া)
৬. যে হাদীর গোস্ত খাওয়া জায়েয তার সমস্ত গোস্ত ফকীর মিসকিনকে সদকা করা ওয়াজিব নয়। বরঞ্চ মুস্তাহাব। তার তিন ভাগ করা উচিত। এক ভাগ নিজের জন্যে, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্যে এবং এক ভাগ ফকীর মিসকিনের জন্যে। তবে এমন করা জরুরী নয়। সমস্তই ফকীর মিসকিনকে দিলেও তা জায়েয হবে।
আবে যমযম, আদব কায়দা ও দোয়া
বায়তুল্লাহর পূর্বদিকে একটি ঐতিহাসিক কূপ আছে যাকে যমযম বলে। হাদীসে এ কুয়ার অনেক ফযিলত ও তার পানির অনেক বরকত ও ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ ) আল্লাহর হুকুমে যখন হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মা হযরত হাজেরা (আ ) কে মক্কার বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করলেন তখন আল্লাহ তায়ালা মাতা ও সন্তানের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্যে যমযম প্রস্রবণ প্রবাহিত করে ছিলেন। হাদীসে আছে-
*******আরবী*********
এ হচ্ছে জিবরাঈলের তৈরী করা কূপ এবং ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের ছোট হাউজ। (দারু কুতনী)
সায়ী এবং মাথা মুণ্ডন প্রভৃতি শেষে পেট ভরে যমযমের পানি পান করা উচিত। এমন বেশী করে পানি পান করা, যাতে পাঁজরাগুলো ডুবে যায়, এটা ঈমানের আলামত। ঈমান থেকে বঞ্চিত মুনাফিক এতোটা পান করতে পারে না। নবী (স) বলেন আমাদের এবং মুনাফিকদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন এই যে, মুনাফিক যমযমের পানি পেটভরে পান করতে পারে না যাতে পাঁজরা ডুবে যায়। (ইবনে মাজাহ)
আবে যমযমের বরকত ও ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, আবে যমযম যে উদ্দেশ্যেই পান করা হয় তার জন্যেই ফলদায়ক হয়। রোগ আরোগ্যের জন্য পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। তৃপ্তি লাভের জন্যে পান করা হলে আল্লাহ তৃপ্তিদান করবেন। পিপাসা নিবারণের জন্যে পান করলে আল্লাহ পিপাসা নিবারণ করবেন। এ হচ্ছে সেই কুয়া যা জিবরাঈল (আ ) পায়ের গোড়ালির আঘাতে খনন করেন এবং এ হচ্ছে ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের উন্মুক্ত জলাধার। (দারু কুতনী)
অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ )বিশেষভাবে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরা (আ )এর জন্যে বারিহীন অনুর্বর প্রান্তরে যমযম বানিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে যায়।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) এরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সকল পানি থেকে উৎকৃষ্ট যমযমের পানি। ক্ষুধার্তদের জন্যে এ আহার, রোগীর জন্য আরোগ্য। (ইবনে আব্বাস)
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ও উদ্দেশ্যে যমযমের পানি পান করে যে, সে দুশমন থেকে আশ্রয় লাভ করবে- তাহলে সে আশ্রয় পাবে।(হাকেম)
যমযমের পানি দাড়িয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে পান করা উচিত এবং পেটভরে পান করা উচিত। পান করার সময় এ দোয়া পড়বে।
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ আমি তোমার কাছে মঙ্গলকর ইলম চাই, প্রশস্ত রুজি চাই এবং প্রত্যেক রোগ থেকে আরোগ্য চাই। (নায়লুল আওতার)