যাকাতের বিভিন্ন মাসয়ালা
১. কাউকে আপনি টাকা কর্জ দিয়েছেন। কিন্তু তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন যদি আপনি আপনার যাকাতের মধ্যে ঋণ কেটে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। কিন্তু যদি ঋণের পরিমাণ টাকা তাকে যাকাত দিয়ে দেন এবং তাপর তার কাছে তা আবার ঋণ হিসেবে আদায় করে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
২.ঘরে কাজ কর্মের যেসব চাকর চাকরানি, দাই প্রভৃতি থাকে তাদের কাজের পারিশ্রমিক ও বেতন হিসেবে তোদেরকে যাকাত থেকে দেয়া জায়েয হবে না।
৩. দুঃস্থ অভাবগ্রস্তদের কাপড় বানিয়ে দিতে, শীতের মওসুমে লেপ কম্বল বানিয়ে দিতে, বিয়ে শাদীতে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে যাকাত থেকে ব্যয় করা যেতে পারে।
৪. যে মেয়েলোক কোনো শিশুকে দুধ খাইয়েছে সে যদি গরবী দুঃস্থ হয় তাহলে তাকে যাকাতের টাকা পয়সা দেয়া যেতে পারে। সে শিশু বয়স্ক হওয়ার পর তার দুধ মাকে যাকাত দিতে পারে।
৫. একজনকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়া হলো। তারপর জানা গেল যে সে সাহেবে নেসাব অথবা হাশেমী সাইয়েদ, অথবা অন্ধকারে যাকাত দেয়া হলো তারপর জানা গেল যে, সে আপন মা অথবা মেয়ে অথবা এমন কোনো আত্মীয় যাকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়, তাহলে এ অবস্থায় যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দেয়ার প্রয়োজন নেই। অবশ্যি যে নেবে সে যদি হকদার না হয় তাহলে তার নেয়া উচিত নয় এবং নেয়ার পর তার ফেরত দেয়া উচিত।
৬. কাউকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়ার পর জানা গেল যে, সে অমুসলিম, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় দিতে হবে।
৭. নোট, মুদ্রা, তেজারতি মাল যা কিছুই সোনা চাঁদির নেসাবের পরিমাণ হবে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। যেমন, কারো কাছে কিছু নোট আছে এবং বিভিন্ন মুদ্রা আছে সব মিলে ৪০০/- টাকা হচ্ছে অথবা এতো টাকার তেজারতি মাল আছে, তাহলে যদিও সোনার নেসাব পুরো হচ্ছে না, চাঁদির নেসাব পুরো হচ্ছে, তাহলেও সে ব্যক্তি সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে এবং তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এজন্যে যে ৪০০/- টাকা সাড়ে ৩৬ তোলা চাঁদির মূল্যের অধিক। (মনে রাখা দরকার যে, সোনা এবং চাঁদির মূল্য বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে (১৯৮৩) সাড়ে ৩৬ তোলা চাঁদির মূল্য প্রায় তিন হাজার টাকা। তাছাড়া নেসাব সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে সাড়ে ৫২ তোলা চাঁদি এবং সাড়ে ৭ ভরি সোনা যাকাতের নেসাব। যাই হোক, সোনা ও চাঁদির বাজার দরের ওপরই যাকাতের নেসাব ঠিক হবে। অনুবাদক
৯. ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর যাকাত ওয়াজিব।
১০. এক ব্যক্তি সারা বছর বিভিন্নভাবে সদকা খয়রাত করতে থাকলো কিন্তু যাকাতের নিয়ত করলো না। তাহলে বছর শেষ হওয়ার পর ঐসব খয়রাত করা মাল যাকাতের হিসেবে ধরা যাবে না। এজন্যে যাকাত বের করার সময় যাকাতের নিয়ত করা শর্ত।
১১. যাকাতের টাকা মানি অর্ডার করে পাঠানো যায় এবং মানি অর্ডার ফিস যাকাত থেকে বাদ দেয়া জায়েয।
ওশরের বিবরণ
ওশরের অর্থ
ওশরের আভিধানিক অর্থ এক দশমাংশ। কিন্তু পরিভাষায় ওশর হচ্ছে উৎপন্ন ফসলের যাকাত যা কোনো জমির উৎপন্নের দশ ভাগের এক ভাগ এবং কোনো জমির বিশ ভাগের এক ভাগ।
ওশরের শরয়ী হুকুম
********** আরবী ************
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের রোজগারের উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে খরচ কর। এবং তার মধ্য থেকেও যা তোমাদের জন্যে আমি জমিন থেকে বের করেছি। (উৎপন্ন করেছি)। (সূরা আল বাকারাঃ ২৬৭)
অন্য স্থানে বলা হয়েছেঃ
********** আরবী ************
এবং আল্লাহর হক আদায় কর যেদিন তোমরা ফসল কাটবে। (সূরা আল আনআমঃ১৪১)
তাফসীরকারগণের এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে যে, এর অর্থ হলো উৎপন্ন ফসলের যাকাত অর্থাৎ ওশর।
কোরআন পাকের উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ ফরয এবং হাদীস সম্পর্কে তাকীদ রয়েছে। নবী বলেনঃ
যে জমি বৃষ্টির পানি অথবা ঝর্নার বা নদী নালার পানিতে প্লাবিত হয় অথবা নদীর কিনারে হওয়ার কারণে স্বভাবত উর্বর ও পানিসিক্ত থাকে, তার থেকে উৎপন্ন ফসলের দশভাগের একভাগ ওশর বের করা ওয়াজিব। আর যে জমিতে কুপের পানি তুলে চাষ করা হয় তার বিশ ভাগের একভাগ ওয়াজিব।
ওশরের হার
বর্ষা নদী নালার পানিতে যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় অথবা নদীর কিনারায় হওয়ার কারণে যে জমিতে স্বভাবতই উর্বরতা ও পানি থাকে সে জমির উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ যাকাত হিসাবে বের কর ওয়াজিব। আর বিভিন্ন উপায়ে সেচ কাজের দ্বারা যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় তার বিশভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে বের করা ওয়াজিব।
ওশর (ফসলের যাকাত) আল্লাহর হক এবং তা মোট উৎপন্ন ফসলের প্রকৃত এক-দশমাংশ অথবা এক-বিশমাংশ। অতএব শস্য অথবা ফল ব্যবহারযোগ্য হলে প্রথমে তার ওশর বের করতে হবে তারপর সে শস্য বা ফল ব্যবহার করা হবে।
ওশর বের করার আগে তা ব্যবহার করা জায়েজ নয় নতুবা এক-দশমাংশ হোক অথবা তার অর্ধেক তা আল্লাহর পথে যাবে।
কোন কোন জিনিষের ওশর ওয়াজিব
জমি থেকে উৎপন্ন প্রত্যেক বস্তুর ওপর ওশর ওয়াজিব। যা গুদামজাত করা হয় এমন ফসলের উপরও, যেমন খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, আখ, খেজুর, শুকনো ফল প্রভৃতি এবং ঐসব ফসলের উপরও যা গুদামজাত করা যায় না, যেমন শাকসবজি, শসা, খিরা, গাজর, মূলা, শালগম, তরমুজ, আম, মালটা প্রভৃতি।(কোনো ফকীহর মতে শাক সবজি, তরি-তরকারী, ফলমূল যা গুদামজাত করা যায় না তার ওপর ওশর ওয়াজিব নয়। তবে যদি কৃষক বাজারে বিক্রি করে তাহলে তার উপর তেজারতি যাকাত ওয়াজিব হবে তার মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে। অর্থাৎ যদি বছরের প্রথমে এবং শেষে তেজারতি মাল দুশ দিরহাম অথবা অধিক হয়।)
মধুর উপরেও ওশর ওয়াজিব।নবী (স) বলেনঃ ********** আরবী ***********মধুর ওশর দাও।–(বায়হাকী)
হযরত আবু সাইয়াদাহ (রা) বলেন, আমি নবী (স)-কে বলেছিলাম আমার কাছে মৌমাছি পালিত আছে। তখন নবী (স) বলেন, তাহলে তার ওশর দাও।(ইমাম মালেক (রা) এবং হযরত সুফিয়ান সওরী (র) এর নিকট মধুর ওশর নেই। ইমাম শাফেয়ী (র) এর মশহুর বক্তব্যও তাই। ইমাম বুখারী (র) বলেন, মধুর যাকাতের ব্যাপারে কোনো হাদীস সহীহ নয়। বায়হাকীতে আছে এক ব্যক্তি নবীর দরবারে মধুর ওশর এনে আরজ করে, সাবলা বনের হেফাজতের ব্যবস্থা করুন। নবী (স) সে বনের হেফাযতের ব্যবস্থা করে দেন। তারপর হযরত ওমর (রা) এর খেলাফত আমলে সুফিয়ান বিন ওয়াহাব এ ব্যাপারে তার কাছে প্রকৃত সত্য জানতে চাইলেন, তিনি তাকে লিখে জানালেন যে, সে নবীকে যা দিতো তা তোমাকে দিতে এলে নিয়ে নিবে এবং সাবলা বনের হেফাজতের ব্যবস্থা করে দেবে। নতুবা তা তো মৌমাছি দ্বারা তৈরী জিনিস আসমানের পানির মতো। যে ইচ্ছা করে সে তা ব্যবহার করতে পারে।
আল্লামা মওদূদীর অভিমত এই যে, মধুর ওপরে যাকাত নেই। তবে তার ব্যবসার ওপরে সেই ধরনের যাকাত হবে যা অন্যান্য তেজারতি মালের ওপর হয়ে থাকে।)
ওশরের মাসয়ালা
১. ওশরের মোট উৎপন্ন ফসলের আদায় করতে হবে। ওশর আদায়ের পর অবশিষ্ট ফসল থেকে কৃষির যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে। যেমন কারো জমিতে ত্রিশ মণ ফসল হল। এক দশমাংশ তিন মণ ওশর দেওয়ার পর বাকি সাত মণ থেকে কৃষির খরচপত্র বহন করতে হবে।
২. ফসল যখনই ব্যবহার যোগ্য হবে তখনই তার উপর ওশর ওয়াজিব হবে। যেমন-ছোলা, মটর, আম প্রভৃতির পাকার পূর্বেই ব্যবহার করতে হবে। অতএব তখন যে পরিমাণ হবে তার ওশর বের করতে হবে। ওশর বের করার পূর্বেই তা ব্যবহার করা দুরস্ত নয়।
৩. কারো বাগানে ফল হয়েছে। তা পাকার পূর্বে বিক্রি করলে ওশর খরিদদারের উপর ওয়াজিব হবে। পাকার পর বিক্রি করলে ওশর বিক্রেতার ঘাড়ে পড়বে।
৪. জমিতে যে চাষ করবে ওশর তারই উপর ওয়াজিব হবে তা সে জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করুক অথবা বর্গা নিয়ে চাষ করুক।
৫. দুজন মিলে চাষাবাদ করলে ওশর উভয়ের উপর ওয়াজিব হবে তা যদি বীজ একজনের হয় তবুও।
৬. ওশর ফরজ হওয়ার জন্য নেসাব কোন শর্ত নয়।(ইমাম আযম ও ইমাম শাফেয়ীর মতে পাঁচ ওয়াসাক (ত্রিশ মণ) এর কম হলে তার ওশর নেই। আহলে হাদীসের অভিমতও তাই। ওশর ফরয হওয়ার এ একটি শর্ত যে, উৎপন্ন ফসল অন্তত পাঁচ ওয়াসাক বা ত্রিশ মণ হবে। তার প্রমাণ নিম্ন হাদীসঃ …………….. আরবী …………
পাঁচ ওয়াসাকের কম ফসলের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়।-বুখারী) ফসল কম হোক বেশী হোক ওশর দিতে হবে। অবশ্যি দু আড়াই কিলো ফসল ধর্তব্য নয়।
৭. ওশরে বছর পূর্ণ হওয়ার প্রশ্নও নেই। বরঞ্চ যে জমিতে বছরে দু ফসল হয় তার প্রত্যেক ফসলের ওশর দিতে হবে।
৮. নাবালেগ শিশু ও মাথা খারাপ লোকের ফসলেরও ওশর ওয়াজিব।
৯. ওয়াকফ করা জমি চাষ করলে চাষির উপর ওশর ওয়াজিব।
১০. বৃষ্টির পানিতে উর্বর জমিতে কৃত্রিম উপায়ে সেচ কার্য করলে তার ওশর নির্ধারণে এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, স্বাভাবিক বর্ষণের কারণে সে জমি অধিক উর্বরতা লাভ করেছে, না সেচের কারণে।
১১. ওশর ফসলের আকারেও দেয়া যায় অথবা তার মূল্য।
১২. বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে যেসব জমি মুসলমানদের মালিকানায় আছে, তা ওশরী এবং তার ওশর দিতে হবে।
১৩. জমির খাজনা দিলে ওশর মাফ হয় না।
১৪. যাকাত যেসব খাতে ব্যয় করা হয়, ওশরও সেসব খাতে ব্যয় করতে হবে।
গুপ্তধন ও খনিজ দ্রব্যাদির মাসয়ালা
মাটির নীচে রক্ষিত সম্পদ ও খনিজ দ্রব্যাদির মাসয়ালা নিম্নরূপ:
১. মাটির নীচে রক্ষিত প্রাপ্ত সম্পদের পাঁচ ভাগের এক বায়তুল মালের জন্য নির্দিষ্ট। হাদীসে আছে …………….. আরবী ………… অর্থাৎ গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশও বায়তুল মালে দেয়া ওয়াজিব।
২. খনিজ দ্রব্য তা ধাতব পদার্থ হোক যেমন লোহা, রূপা, সোনা, রাং ইত্যাদি অথবা অধাতব পদার্থ যেমন গন্ধক, এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালের অংশ। আর বাকী চার ভাগ খনির মালিক পাবে।
৩. যেসব খনিজ দ্রব্য আগুনে পোড়ালে নরম হয় না যেমন জাওহার ইত্যাদি অথবা তরল পদার্থ যেমন কেরোসিন ও পেট্রোল ইত্যাদি। এসব দ্রব্যে বায়তুলমালের কোনো অংশ নেই। (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর মতে খনিজ পদার্থ ধাতব, অধাতব বা তরল যা-ই হোক না কেন শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত ওয়াজিব যদি তা নেসাব পরিমাণ হয় এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়ে এ মতে আমল করা হতো।)