সদকায়ে ফিতরের বয়ান
সদকায়ে ফিতরের অর্থ
ফিতরের আভিধানিক অর্থ রোযা খোলা। সদকায়ে ফিতরের অর্থ রোযা খোলার সদকা। পারিভাষিক অর্থে সদকায়ে ফিতর বলতে বুঝায় সেই ওয়াজিব সদকা যা রমযান খতম হওয়ার এবং রোযা খোলার পর দেয়া হয় যে বছর মুসলমানদের ওপর রমযানের রোযা ফরয করা হয় সে বছরই নবী (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার হুকুম দেন।
সদকায়ে ফিতরের তাৎপর্য ও উপকারিতা
রমযান মাসে রোজাদারগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী এ চেষ্টা করেন যাতে করে তারা রমযানের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন এবং ঐসব সীমারেখা, নিয়ম পদ্ধতি ও শর্তাবলীর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখেন যা মেনে চলার জন্যে শরীয়াতে তাকীদ করা হয়েছে। তথাপি জ্ঞাতে অজ্ঞাতে মানুষের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে যায়। সদকায়ে ফিতরের একটি তাৎপর্য এইযে, মানুষ আল্লাহর পথে আগ্রহ সহকারে তার অর্জিত মাল খরচ করবে যাতে করে তার ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হয় এবং আল্লাহর দরবারে রোযা কবুল হয়। উপরন্তু ঈদ উপলক্ষে সদকায়ে ফিতর দেয়ার একটা তাৎপর্য এটাও যে, সমাজের গরীব দুস্থ লোক যেন নিশ্চিন্তে এবং ভালোভাবে অন্ত বস্ত্রের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এবং অন্যান্য মুসলমানদের সাথে ঈদগাহে উপস্থিত হতে পারে যাতে করে ঈদগাহের সম্মেলন বিরাট হয় এবং পথে মুসলমানদের বিপুল জনসমাগমের কারণে ইসলামের প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) সদকায়ে ফিতর এজন্য নির্ধারিত করেছেন যে, এ ফিতরা রোজাদারদেরকে বেহুদা কাজ কর্ম এবং অশ্লীলতার ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে পাক করবে এবং সে সাথে অভাবগ্রস্তদের খানা পিনার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করবে তার সে সদকা কবুল হবে এবং যে নামাযের পরে পরিশোধ করবে তা সাধারণ দান খয়রাতের মতো একটি সদকা হবে। (আবু দাউদ)
শাহ অলী উল্লাহ (র) বলেন, ঈদের দিন খুশীর দিন। এদিনে মুসলমানদের বিরাট জনসমাবেশের মাধ্যমে ইসলামের শান শওকত প্রকাশ পায় এবং সদকায় ফিতরের দ্বারা এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। তাছাড়া সদকায়ে ফিতর রোযার পূর্ণতারও কারণ হয়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ)
সদকায়ে ফিতরের হুকুম
সদকায়ে ফিতর এমন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমান নারী পুরুষ, নাবালক সাবালকের ওপর ওয়াজিব (আহলে হাদীসের মতে সদকায়ে ফিতর যাকাতের মতো ফরয। অতএব প্রত্যেক ধনী গরীব, নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট-বড়, সকলের ওপর ফরয। তাদের যুক্তি এই যে, নবী (স) মক্কার অলিতে গলিতে লোক পাঠিয়ে এ ঘোষণা করিয়ে দেন সাধান থাক। সদকায় ফিতর প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, আযাদ গোলাম, ছোট-বড় সকলের ওপর ওয়াজিব। (তিরমিযি) উপরন্তু ইবনে ওমর (রা) বলেন, নবী (স) সদকায়ে ফিতর ফরয বলেছেন এবং তাহলো প্রত্যেক নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট ও বড়োর জন্যে এক সা খেজুর, এক সা যব এবং হুকুম দিয়েছেন যে, ঈদগাহে যাবার পূর্বে তা দিতে হবে।)যার কাছে তার প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতো মূল্যের মাল হবে যার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়। সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক বা না হোক। যেমন ধরুন, কারো কাছে তার বসবাসের গৃহ ছাড়া আরও বাড়ী-ঘর আছে যা খালি পড়ে আছে অথবা ভাড়ার জন্যে তৈরী করা হয়েছে। যদি সে ঘর-বাড়ীর মূল্য নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার মালিকের ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে যদিও সে বাড়ীর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। তবে যদি বাড়ীর ভাড়ার দ্বারা সে জীবিকা অর্জন করে তাহলে তা তার প্রকৃত প্রয়োজনের মধ্যে শামিল হবে এবং তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে না। অথবা কারো ঘরে ব্যবহারের সামগ্রী ছাড়াও কিছু আসবাবপত্র আছে যেমনঃ তামার বাসনপত্র, মূল্যবান ফার্নিচার প্রভৃতি যার মূল্য নেসাবের পরিমাণ অথবা তার অধিক, তাহলে তার ওপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। যদিও সে সব মালের যাকাত দিতে হবে না।
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্যে ওপরে বর্ণিত নেসাব ছাড়া অন্য কোনো শর্ত নেই। না আযাদী কোনো শর্ত, আর না বালেগ হওয়া অথবা হুশ জ্ঞান থাকা। গোলামের ওপরও ওয়াজিব। কিন্তু তার মনিব তা দিয়ে দিবে। নাবালেগ ও পাগল ছেলেমেয়েদের ফিতরা তার বাপ-মা অথবা ওলী দিয়ে দেবে।
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য এটাও শর্ত নয় যে, মাল এক বছর স্থায়ী হতে হবে। বরঞ্চ সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পূর্বেও যদি কেউ ধন দৌলতের মালিক হয়, তাহলে তার ওপরও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে।
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় ঈদের দিনের প্রভাতকাল (আহলে হাদীসের নিকটে সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় রমযানের শেষ দিন সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদের নামাযের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। এক বলা হয় রোযা খোলার সদকা। অতএব রমযানের শেষ রোযা খোলার পর থেকেই এ ওয়াজিব হয় যদিও তা আগেও দিয়ে দেয়া দুরস্ত আছে) অতএব যে ব্যক্তি ফজর হওয়ার পূর্বে মারা যায় অথবা ধন দৌলত থেকে বঞ্চিত হয় তার ওপর ওয়াজিব হবে না। যে শিশু ফজরের পর জন্মগ্রহণ করবে তার ওপরও ওয়াজিব হবে না। তবে যে ঈদের রাতে জন্মগ্রহণ করবে তার ওপর ওয়াজিব হবে। এমনিভাবে যে ফজরের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে অথবা ধনের মালিক হয় তাহলে তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে।
সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করার সময়
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় যদিও ফজরের সময় কিন্তু ওয়াজিব হওয়ার তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য এটাই দাব করে যে, ঈদের কিছু দিন পূর্বে তা অভাবগ্রস্তদের কাছে পৌছিয়ে দেয়া হোক। যাতে করে গরীব দুস্থ অন্ন-বস্ত্রের সামগ্রী নিশ্চিন্তে লাভ করে সকলের সাথে ঈদগাহে যেতে পারে। বুখারী শরীফে আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা) দু একদিন পূর্বেই সদকায়ে ফিতর বিতরণ করতেন। দু চার দিন পূর্বে দেয়া না গেলে ঈদের নামাযের পূর্বে অবশ্যই দিয়ে দেয়া উচিত। নবী (স) বলেনঃ
********** আরবী ************
যে ব্যক্তি সদকায়ে ফিতর নামাযের পূর্বে দিয়ে দেবে তাহলে সেটা হবে আল্লাহর নিকটে গৃহীত সদকা। আর যে নামাযের পরে দেবে, তার সদকা হবে দান খয়রাতের মতো একটি সদকা।
কাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব
১. সচ্ছল ব্যক্তি তার নিজের ছাড়াও নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর দিয়ে দিবে, নাবালেগ সন্তান যদি ধনবান হয় তাহলে তাদের ধন থেকে নতুবা নিজের পক্ষ থেকে দেবে।
২. যেসব সন্তান হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তাদের মাল থাক আর না থাক, তাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর দিয়ে দেয়া ওয়াজিব, তারা সাবালক হোক বা না হোক।
৩. যারা তাদের খাদেম বা চাকর বাকরের পৃষ্ঠপোষকতা ও ভরণ পোষণ করে তারা তাদের পক্ষ থেকে সদকা দিয়ে দেবে।
৪. সাবালক সন্তানদের পক্ষ থেকে পিতার দেয়া ওয়াজিব যদি তারা দুস্থ ও দরিদ্র হয়। মালদার হলে ওয়াজিব হবে না।
৫. বিবির পক্ষ থেকে ওয়াজিব তো নয়। তবে স্বামী দিয়ে দিলে বিবির পক্ষ থেকে হয়ে যাবে।
৬. বাপ মারা গেলে দাদার উপরে সকল দায়িত্ব এসে পড়ে যা পিতার ছিল।
৭. স্ত্রীলোক যদি সচ্ছল হয় তাহলে শুধু তার সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তার নিজের ছাড়া স্বামী, সন্তান বা মা-বাপের পক্ষ থেকে দেয়া তার ওয়াজিব নয়।