ইসলাম ও জাহেলিয়াতের আদর্শিক ও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব
পৃথিবীতে মানুষের জন্যে যে জীবন ব্যবস্থাই রচিত হবে তার অনিবার্য যাত্রারম্ভ হবে অতি-প্রাকৃতিক বা ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়াবলী থেকে। মানুষ সম্পর্কে এবং এ পৃথিবী -যার মধ্যে সে বাস করে -তার সম্পর্কে সুস্পষ্প ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা সৃষ্টি না করা পর্যন্ত জঅবনের কোনো পরিকল্পনা প্রণীত হতে পারে না। দুনিয়ায় মানুষের আচরণ কেমন হবে এবং এখানে তাকে কিভাবে কাজ করতে হবে, এ প্রশ্ন আসলে এই পরবর্তী প্রশ্নগুলোর সংগে গভীর সম্পর্ক রাখে যে, মানুষ কি? এ দুনিয়ায় তার মর্যাদা কি? এ দুনিয়ার ব্যবস্থা কোন ধরনের, যার সংগে মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে? এ প্রশ্নগুলোর যে সমাধান নির্ণীত হবে, সে পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিকতা সম্পর্কে একটি বিশেষ মত স্থিরীকৃত হবে। অতঃপর ঐ মতবাদের প্রকৃতি অনুযায়ী মানব জীবনে বিভিন্ন বিভাগ গড়ে উঠবে। আবার এই কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তি চরিত্র ও কর্মকাণ্ড এবং সামষ্টিক সম্পর্ক ও ব্যবহার বিধানাবলী বিস্তারিত রূপ পরিগ্রহ করবে। এভাবে অবশেষে এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে তমুদ্দুনের বিরাট প্রাসাদ নির্মীত হবে। দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত মানব জীবনের জন্যে যতগুলো ধর্ম এবং মত ও পথ তৈরী হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে অবশ্যি নিজের একটি স্বতন্ত্র মৌলিক দর্শন ও মৌলিক নৈতিক মতবাদ প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই মৌলিক দর্শন ও নৈতিক দৃষ্টিভংগীই মূলনীতি থেকে নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়েও একটি পদ্ধতিকে অন্যটি থেকে পৃথক করে। কেননা তাদেরই প্রকৃতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি জীবন বিধানের প্রকৃতি গড়ে উঠেছে। তারা জীবন বিধানের দেহে প্রাণের ন্যায়।
জীবন সম্পর্কে চারটি মতবাদ
খুঁটিনাটি বিষয় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মূলনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে মানুষ ও বিশ্বজাহান সম্পর্কে চারটি অতিপ্রাকৃত (metaphysical) মতবাদ স্থিরীকৃত হতে পারে। দুনিয়ার যতগুলো জীবন বিধানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তার প্রত্যেকই এই চারটির মধ্য থেকে যে কোনো একটির অবশ্যি গ্রহণ করেছে।
নির্ভেজাল জাহেলিয়াত
প্রথম মতবাদটিকে আমরা নির্ভেজাল জাহেলিয়াত আখ্যা দিতে পারি। এর মূল কথা হলঃ
বিশ্বজাহানের ব্যবস্থাবলী একটি আকস্মিক ঘটনার বাস্তব প্রকাশ মাত্র। এর পেছনে কোনো প্রজ্ঞা, সদিচ্ছা উদ্দেশ্য কার্যকরী নেই। এমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটি তৈরী হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে একদিন হঠাৎ কোনো কার্যকারিতা ছাড়াই শেষ হয়ে যাবে। এর কোনো খোদা নেই আর যদি থেকেও থাকে, তাহলে মানুষের জীবনের সংগে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
মানুষ এক ধরনের পশু। অন্যান্য বস্তুর ন্যায় সম্ভবতঃঘটনাক্রমে এখানে তার উদ্ভব হয়েছে। তাকে কে সৃষ্টি করলো এবং কেন সৃষ্টি করলো, এ প্রশ্ন আমাদের নিকট অপ্রাসংগিক। আমরা শুধু এতটুকু জানি যে, এ পৃথিবীতে তার বাস, তার কিছু আশা-আকাংখা আছে-এগুলো পূর্ণ করার জন্যে তার প্রকৃতি ভেতর থেকে চাপ দেয়। তার কিছু শক্তি ও কয়েকটি যন্ত্র আছে-এগুলো তার আশা-আকাংখাসমূহ পূর্ণ করার মাধ্যম হিসেবে পরিণত হতে পারে। তার চারপাশে দুনিয়ার বিশাল বক্ষ জুড়ে অনেক বস্তু, অনেক সাজসরঞ্জাম দেখা যাচ্ছে-এগুলোর ওপর ঐ শক্তি ও যন্ত্রসমূহ ব্যবহার করে সে তার আশা-আকাংখা পূর্ণ করতে পারে। কাজেই নিজের জৈব প্রকৃতির দাবি পূরণ করা ছাড়া মানুষের জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। আর এই দাবি পূরণ করার জন্যে উৎকৃষ্টতর উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা ছাড়া তার মানবিক শক্তি-সামর্থের দ্বিতীয় কোনো কার্যকারিতাও নেই।
মানুষের চাইতে বড় আর এমন কোনো জ্ঞানের উৎস এবং সৎ ও সত্যের উৎপত্তিস্থান নেই, যেখান থেকে তার জীবনের জন্যে বিধান লাভ করতে পারে। কাজেই নিজের চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি, নিদর্শনাবলী এবং নিজের ইতিহাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে তার নিজেকেই একটি জীবন বিধান রচনা করা উচিত।
বাহ্যতঃ এমন কোনো সরকার দৃষ্টিগোচর হয় না, যার সম্মুখে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই মানুষ স্বভাবতঃই একটি অদায়িত্বশীল প্রাণী। আর যদি কোনোক্রমে তাকে জবাবদিহি করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে তার নিজের সম্মুখে অথবা সেই কর্তৃত্বের সম্মুখে যা মানুষের মধ্য থেকে সৃষ্ট হয়ে মানুষের উপর বিরাজিত।
কার্যাবলীর ফলাফল এই পার্থিব জীবনের গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জীবন নেই। কাজেই দুনিয়ায় প্রকাশিত ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতেই ভুল ও নির্ভুল, ক্ষতিকর ও লাভজনক এবং গ্রহণযোগ্য এ অগ্রহণযোগ্য মীমাংসা করা হবে।
মানুষ যখন নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের পর্যায়ে অবস্থান করে অর্থাৎ যখন নিজের অনুভূতি-গ্রাহ্যের বাইরে কোনো সত্য পর্যন্ত সে পৌঁছে না অথবা ইন্দ্রিয়ের দাসত্বের কারণে পৌঁছতে চায় না, তখন তার মনোজগত পূর্ণরূপে এ মতবাদের আওতাধীনে আসে। পার্থিব স্বার্থের মোহে অন্ধ মানুষেরা প্রতিযুগে এ মতবাদ গ্রহণ করেছে। মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া সকল রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরাহ, সভাষদ, শাসক সমাজ, বিত্তশীল ও বিত্তের পিছনে জীবন উৎসর্গকারীরা সাধারণভাবে এই মতবাদকে অগ্রাধিকার দান করেছে। আর ইতিহাসে যেসব জাতির উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির বন্দনা গীত গাওয়া হয়, তাদের প্রায় সবারই সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলে এই মতবাদ কার্যকরী ছিল। বর্তমান পাশ্চত্য সভ্যতার মূলেও এই মতবাদ কার্যকরী আছে। যদিও পাশ্চত্য দেশের সবাই খোদা ও আখেরাতকে অস্বীকার করে না এবং চিন্তার দিক দিয়ে সবাই বস্তুবাদী নৈতিকতার সমর্থক নয়, তবুও তাদের সভ্যতা সংস্কৃতির সামগ্রিক ব্যবস্থায় যে শক্তি ক্রিয়াশীল তা ঐ খোদা ও আখেরাত অস্বীকার এবং বস্তুবাদী নৈতিকতার শক্তি। এ শক্তি তাদের জীবনে এমনভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে যে, যেসব লোক চিন্তাক্ষেত্রে খোদা ও আখেরাতকে স্বীকার করে এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে অবস্তুবাদী দৃষ্টিভংগী অনুসরণ করে, তারাও অবচেতনভাবে নিজেদের বাস্তব জীবনে নাস্তিক ও বস্তুবাদী ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা চিন্তার ক্ষেত্রে তারা যে মতবাদের অনুসারী তাদের বাস্তব জীবনের সংগে তার কোনো কার্যকরী সম্পর্ক নেই।
তাদের পূর্বের সমৃদ্ধশালী ও খোদা বিস্মৃত লোকদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। বাগদাদ, দামেস্ক, দিল্লি ও গ্র্রানাডার সমৃদ্ধশালী লোকেরা মুসলমান হবার কারণে খোদাও আখেরাতে অস্বীকার করতো না। কিন্তু তাদের জীবনের সমস্ত কর্মসূচী এমনভাবে তৈরী হতো যেন খোদা ও আখেরাতের কোনো অস্তিত্ব নেই, কারুর নিকট জবাব দেবার এবং কারুর কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করারও কোন প্রশ্নই নেই। দুনিয়ায় একমাত্র তাদের কামনা-বাসনা, আশা-আকাংখারই অস্তিত্ব আছে। আর এই কামনা-বাসনা পূর্ণ করার জন্যে যে কোনো উপায়-উপকরণ এবং যে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করার ব্যাপারে তারা স্বাধীন। দুনিয়ায় জীবন যাপনের যে সময়টুকু পাওয়া গেছে, একমাত্র ‘ভোগ ও বিলাসিতার’ মাধ্যমেই তার সদ্ব্যবহার হতে পারে।
আগেই বলেছি, এই মতবাদের প্রকৃতিই হলো এই যে, এর ভিত্তিতে একটি নির্ভেজাল বস্তবাদী নৈতিক ব্যবস্থা জন্মলাভ করে। তা বইয়ের পাতায় লিখিত থাক বা কেবল মানস রাজ্যে চিত্রিত হয়ে থাক, তাতে কিছু আসে যায় না। তারপর ঐ মানসিকতা থেকে জ্ঞান, শিল্প, চিন্তা, ও পরিকল্পনার ধারা উৎসারিত হয় এবং সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় নাস্তিক্যবাদ ও বস্তুবাদের সূক্ষ্মতর শক্তি অনুপ্রবেশ করে। অতঃপর এরই ভিত্তিতে ব্যক্তি চরিত্র গড়ে ওঠে। এই নকশা অনুযায়ী মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, আচার-ব্যবহার ও লেনদেনের যাবতীয় নিয়ম-পদ্ধতির রূপ পরিগ্রহ করে। আইন ও সংবিধানের বিকাশ ও অগ্রগতি এরই ভিত্তিতে হয়। সবচাইতে বড় প্রতারক, বেঈমান, আত্মসাৎকারী, মিথ্যুক, ধোকাবাজ, নিষ্ঠুর ও কলুষিত-হৃদয় সম্পন্ন লোকেরাই এহেন সমাজের উপরিভাগে স্থানলাভ করে। সমগ্র সমাজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত থাকে। আর তারা শিকল-ছাড়া বাঘের মত সব রকমের ভীতি ও হিসাব-নিকাশের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে মানুষের ওপর বেদম হামলা চালাতে থাকে। তাদের সমস্ত কূটনীতি মেকিয়াভেলির (Machiavelli) রাজনীতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। তাদের আইনপুস্তকে শক্তির নাম ‘হক’ এবং দুর্বলতার নাম ‘বাতিল’। যেখানে কোনো বস্তুগত প্রতিবন্ধকতা থাকে না, সেখানে কোনো জিনিসই তাদেরকে জুলুম থেকে বিরত রাখতে পারে না। এ জুলুম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এমন ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে যে, শক্তিশালী শ্রেণী নিজের জাতির দুর্বল শ্রেণীর লোকদেরকে পিষে ফেলতে থাকে এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, দেশ জয় ও জাতি ধ্বংসের রূপে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
শের্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াত
দ্বিতীয় অতিপ্রাকৃত মতবাদ শের্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর সারকথা হলোঃ বিশ্বজাহানের এ ব্যবস্থা কোনো ঘটনাক্রমিক প্রকাশ নয় এবং খোদাহীন অস্তিত্বের অধিকারীও নয়, কিন্তু এর একটি খোদা নয়, বহু খোদা আছে।
এ ধারণা কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণভিত্তিক নয় বরং নিছক কল্পনা-নির্ভর। তাই কাল্পনিক, অনুভূতিগ্রাহ্য ও দৃশ্যমান বস্তুর সংগে খোদার শক্তিকে সম্পর্কিত করার ব্যাপারে মুশরিকদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও কোনোদিন হতে পারে না। অন্ধকারে দিশেহারা মানুষেরা যার ওপর হাত রেখেছে, তাকেই খোদা বানিয়ে নিয়েছে। খোদার ফিরিস্তিতে হামেশা সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে। ফেরেশতা, জ্বিন, আত্মা, নক্ষত্র, জীবিত ও মৃত মানুষ, বৃক্ষ, পাহাড়, পশু, নদী, পৃথিবী, আগুন ইত্যাদি সব কিছুকেই দেবতায় পরিণত করা হয়েছে। প্রেম, কামনা, সৃষ্টিশক্তি, রোগ, যুদ্ধ, লক্ষ্মী, শক্তি ইত্যাদির ন্যায় অনেক বিমূর্ত ধারণাকেও খোদার আসনে বসানো হয়েছে। সিংহ-মানুষ, মৎস-মানুষ, পক্ষী-মানুষ, চার মস্তকধারী, সহস্রভূজ, হস্তিশূণ্ডধারী মানুষ প্রভূতিও মুশরিকদের উপাস্যে পরিণত হয়ে এসেছে।
আবার এই দেব গ্রন্থীর চতুর্দিকে কল্পনা ও পৌরাণিকতার (Mytholgy) একটা তেলেসমাতি জগত তৈরী করা হয়েছে। প্রত্যেকটি অশিক্ষিত ও অজ্ঞজাতি এখানে তাদের উর্বর মস্তিক ও শিল্পকারিতার এমন সব অদ্ভুত ও মজার মজার নমুনা পেশ করেছে যে, তা দেখে অবাক হতে হয়। যেসব জাতির মধ্যে প্রধান খোদা অর্থাৎ আল্লাহর ধারণা সুষ্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে সেখানে আল্লাহ তাঁর কর্তৃত্বকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যেন আল্লাহ একজন বাদশাহ এবং অন্যান্য খোদারা তাঁর উজির-নাজির, দরবারী, মোসাহেব ও কর্মচারী পর্যায়ের, কিন্তু মানুষ সেই বাদশাহ নামদার পর্যন্ত পৌঁছতে অক্ষম, তাই অধীনস্থ খোদাদের মারফত যাবতীয় কার্য সম্পন্ন করা হয়, তাঁদের সংগেই সকল ব্যাপারের সরাসরি সম্পর্ক। অন্যদিকে যেসব জাতির মধ্যে প্রধান খোদার ধারণা নিতান্ত অস্পষ্ট বা একেবারে নেই বললে হয়, সেখানে খোদার যাবতীয় কর্তৃত্ব বিভিন্ন শক্তিশালী লোকদের মধ্যে বন্টিত হয়েছে।
নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের পর এই দ্বিতীয় প্রকার জাহেলিয়াতটির স্থান। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ এর স্রোতে ভেসে চলেছে। সবসময় নিম্নতম পর্যায়ের মানসিক অবস্থায় তারা এই পর্যায়ে নেমে আসে। খোদার নবীগণের শিক্ষার প্রভাবে যেখানে মানুষ একমাত্র পরাক্রমশীল খোদার কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে অন্যান্য খোদার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে সত্য; কিন্তু নবী, ওলী, শহীদ, দরবেশ, গওস, কুতুব, ওলামা, পীর ও ঈশ্বরের বরপুত্র দের ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব তবুও কোনো না কোনো পর্যায়ে ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে স্থানলাভ করতে সক্ষম হয়েছে। অজ্ঞ লোকেরা মুশরিকদের খোদাগণকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর সেইসব নেক বান্দাদেরকে খোদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, যাদের সমগ্র জীবন মানুষের কর্তৃত্ব খতম করে একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে ব্যয়িত হয়েছিল। একদিকে মুশরিকদের ন্যায় পুজা-অর্চনার পরিবর্তে ফাতেহাখানি, জিয়ারত, নজরনিয়াজ, উরূস, চাদর চড়ানো, তাজিয়া করা এবং এই ধরনের আরো অনেক ধর্মীয় কাজ সম্বলিত একটি নতুন শরিয়ত তৈরী করা হয়েছে। আর অন্যদিকে কোনো তত্ত্বগত দলিল -প্রমাণ ছাড়া ঐসব নেক লোকদের জন্ম-মৃত্যু, আবির্ভাব-তিরোভাব, কাশফ-কেরামত, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব এবং আল্লাহর দরবারে তাঁদের নৈকট্যের ধরন সম্পর্কে পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের সংগে সর্বক্ষেত্রে সামঞ্জস্যশীল একটি পৌরাণিকবাদ তৈরী করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ ‘ওসিলা’, ‘রূহানী’, ‘মদদ’, ‘ফয়েজ’ প্রভুতি শব্দগুলোর সুদৃশ্য আবরণের আড়ালে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার যাবতীয় সম্পর্ককে ঐ সব নেক লোকদের সংগে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যেসব মুশরিকের মতে বিশ্ব প্রভুর নিকট পৌঁছবার সাধ্য মানুষের নেই এবং মানুষের জীবনের সংগে সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় নীচের স্তরের কর্ম-কর্তাদের সংগে জড়িত, কার্যতঃ সেইসব আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকারকারি মুশরিকের মতো অবস্থা সেখানেও সৃষ্টি হয়। তবে পার্থক্য এতটুকু যে, তারা এই নীচের কর্মকর্তাদেরকে প্রকাশ্য উপাস্য, দেবতা, অবতার অথবা ঈশ্বরের পুত্র বলে থাকে আর এরা গওস, কুতুব, আবদাল, আওলিয়া, আহলুল্লাহ প্রভুতি শব্দের আবরণে ওদেরকে ঢেকে রাখে।
এই দ্বিতীয় ধরনের জাহেলিয়াতকে যুগে যুগে প্রথম ধরনের জাহেলিয়াত অর্থাৎ নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের সংগে প্রায়ই সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। প্রাচীন যুগে ব্যাবিলন, মিশর, হিন্দুস্তান, ইরান, গ্রীক, রোম প্রভৃতি দেশের তাহজিব-তমুদ্দুনে এ দুটি জাহেলিয়াতের সহ-অবস্থান ছিল। বর্তমান যুগে জাপানী সভ্যতা-সংস্কৃতিরও একই অবস্থা। এই সহযোগিতার বিভিন্ন কারণ আছে, তার মধ্যে কয়েকটি আমি এখানে উল্লেখ করছি।
প্রথমতঃ
শের্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াতে মানুষের সংগে তার উপাস্যগণের সম্পর্ক হলো এই যে, সে তাদেরকে নিছক কর্তৃত্বশালী এবং লাভ ক্ষতির মালিক মনে করে এবং বিভিন্ন উপাসনা-আরাধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার পার্থিব উদ্দেশ্য সিদ্ধির ব্যাপারে এই উপাস্যগণের করুণা ও সাহায্য লাভ করার চেষ্টা করে। তাদের কাছ থেকে কোনো প্রকার নৈতিক নির্দেশনামা বা জীবন যাপন সম্পর্কিত আইন কানুন লাভের সম্ভাবনাই নেই। কেননা বাস্তবে সেখানে কোনো খোদা থাকলে তবেই তো তিনি আইন ও নির্দেশ দিবেন। কাজেই এমন কোনো বস্তু যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে মুশরিকরা নিজেরাই অনিবার্যরূপে একটি নৈতিক মতবাদ তৈরি করে এবং এ মতবাদের ভিত্তিতে তারা নিজেরাই একটি শরিয়ত প্রণয়ন করে। এভাবে আসলে সেই নির্ভেজাল জাহেলিয়াতেরই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জন্যেই নির্ভেজাল জাহেলিয়াত ও শের্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াতের তাহজীব-তমুদ্দুনের মধ্যে এ ছাড়া অন্য কোনো পার্থক্য থাকে না যে, এক স্থানে জাহেলিয়াতের সংগে মন্দির পূজারী এবং নানান ধরনের পূজা ও বন্দনার রীতি প্রচলিত থাকে আর অন্য স্থানে তা থাকে না। নৈতিক চরিত্র ও কর্মের ক্ষেত্রে উভয় স্থানে কোনো পার্থক্য নেই। প্রাচীন গ্রীক ও পৌত্তলিক রোমের নৈতিক প্রকৃতি ও চরিত্রের সংগে আজকের ইউরোপের নৈতিক প্রকৃতি ও চরিত্রের যে মিল দেখা যায়, তার কারণও এই একটি।
দ্বিতীয়তঃ
শিক্ষা, শিল্প, দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতির জন্যে শের্ক মিশ্রিত মতবাদ কোনো পৃথক মূলনীতি সরবরাহ করে না। এ অধ্যায়েও একজন মুশরিক নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের পথেই পা বাড়ায়। এবং নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের সামাজিক আদর্শের পথেই মুশরিক সমাজের সমগ্র মানসিক ও চিন্তাগত বিকাশ ঘটে। পার্থক্য শুধূ এইটুকু যে, মুশরিকদের কল্পনাশক্তি সীমাতিরিক্ত, তাদের চিন্তায় কল্পনা প্রবণতার অস্বাভাবিক আধিক্য দেখা যায়। আর নাস্তিকরা হয় অনেকটা বাস্তবধর্মী, তাই কল্পনাভিত্তিক দর্শনের ব্যাপারে তাদের কোন প্রকার আগ্রহ নেই। তবে এই নাস্তিকরা খোদা ছাড়াই যখন এই বিশ্ব জাহানের গ্রন্থী খুলবার চেষ্টা করে, তখন তাদের যুক্তি প্রমাণের বহন ঠিক মুশরিকদের পৌরাণিকতার (Mytholgy) মতোই হাস্যকর এ অযৌক্তিক হয়ে পড়ে। মোদ্দা কথা হলো, শের্ক ও নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের মধ্যে কার্যতঃ কোনো পার্থক্য নেই। আজকের ইউরোপ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সে তার আধুনিক মতবাদের সূত্র প্রাচীন গ্রীক ও রোমের সংগে এমন ভাবে জুড়ে দিয়েছে, যেন মনে হয় সে তাদের সন্তান।
তৃতীয়তঃ
নির্ভেজাল জাহেলী সমাজ যে সমস্ত তমুদ্দুনিক অবলম্বন করে, মুশরিক সমাজও সেগুলো গ্রহণ করার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকে-যদিও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শের্ক ও নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা বিভিন্নতা আছে। শের্কের রাজত্বে বাদশাহদেরকে খোদের আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতাদের একটি শ্রেণী বিশেষ সম্মানের অধিকারী হয়। রাজবংশ ও ধর্মীয় নেতাদের দল সম্মিলিভাবে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে। এ বংশের ওপর অন্য বংশের এবং এক শ্রেণীর ওপর অন্য শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যের একটি স্থায়ী মতবাদ উদ্ভাবন করা হয়। বিপরীত পক্ষে নির্ভেজাল জাহেলী সমাজে এই দোষগুলো বংশ পূজা, জাতি পূজা, জাতীয় সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কত্ব, পুঁজিবাদ ও শ্রণী সংগ্রামের রূপ ধারণ করে। কিন্তু প্রাণশক্তি ও মৌলিক প্রেরণার দিক দিয়ে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব চাপিয়ে দেয়া, মানুষের দ্বারা মানুষকে খণ্ড-বিখণ্ড করা এবং মানবতাকে বিভক্ত করে এক শ্রেণীর জনসমাজকে অন্য শ্রেণীর জনসমাজের রক্ত পিপাসুতে পরিণত করার ব্যাপারে উভয়ই একই পর্যায়ের।
বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত
তৃতীয় অতিপ্রাকৃত মতবাদ বৈরাগ্যবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর সংক্ষিপ্তসার হলোঃ
এ পৃথিবী এবং এই পার্থিব অস্তিত্ব মানুষের জন্যে কারাগারের শাস্তি স্বরূপ। দেহ পিঞ্জরে আবদ্ধ মানুষের প্রাণ আসলে একটি শাস্তিভোগী কয়েদী। সমস্ত আমোদ-আহলাদ, কামনা-বাসনা, স্বাদ ও দৈহিক প্রয়োজন আসলে এই কারাগারের শিকল ও লোহার বেড়ী মাত্র। মানুষ এ জগত এবং এর বস্তুনিচয়ের সংগে যত বেশী সম্পর্ক রাখবে, ততই আবর্জনায় তার সারা অংগ ভরে যাবে এবং তত বেশী শস্তিলাভের অধিকারী হবে। নাজাত ও মোক্ষ লাভের একটি মাত্র পথ আছে। এ জন্যে জীবনের যাবতীয় আনন্দ- উচ্ছাস থেকে সম্পর্কচ্যুত হতে হবে। সমস্ত কামনা-বাসনাকে নিমূর্ল করতে হবে। সকল প্রকার ভোগ পরিহার করতে হবে। দৈহিক প্রয়োজন এ ইন্দ্রিয়ের দাবিসমূহ অস্বীকার করতে হবে। পার্থিব বস্তু সমষ্টি এবং রক্তমাংসের সম্পর্কের সাথে যুক্ত যাবতীয় স্নেহ-প্রেম-ভালবাসাকে হৃদয় থেকে নিশ্চিত করে দিতে হবে। সর্বোপরি নিজের দেহ ও ইন্দ্রিয়রূপ শত্রুকে ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে পীড়ন করতে হবে এবং এত অধীক পরিমাণ পীড়ন করতে হবে যে, আত্মার উপরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকতে না পারে। এভাবে আত্মা সূক্ষ্ম, পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে যাবে এবং নাজাতের উন্নত স্থানসমূহে উড্ডীন হবার শক্তি অর্জন করবে।
এটি আসলে একটি অসামাজিক মতবাদ। কিন্তু সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর বিভিন্নভাবে এ মতবাদ প্রভাব বিস্তার করে। এর ভিত্তিতে একটা বিশেষ ধরনের জীবন দর্শন গড়ে ওঠে। -তার বিভিন্ন রূপ বেদান্তবাদ, মনুবাদ, প্লেটোবাদ, যোগবাদ, তাসাউফ, খ্রীস্টীয় বৈরাগ্যবাদ ও বুদ্ধমত প্রভৃতি নামে পরিচিত। এই দর্শনের সংগে এমন একটি নৈতিক ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে যা খুব কম ইতিবাচক এবং খুব বেশী বরং পুরোপুরি নেতিবাচক হয়। এ দুটি বস্তু সম্মিলিতভাবে সাহিত্য, আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও কর্মজীবনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। যেখানে তাদের প্রভাব পৌঁছায় সেখানে আফিম এ কোকেনের কাজ করে।
প্রথম দুই ধরনের জাহেলিয়াতের সংগে এই তৃতীয় ধরনের জাহেলিয়াতটি সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে সহেযোগিতা করেঃ
(১) এই বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত সৎ ও ধর্মভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার ঝামেলা মুক্ত করে নির্জনবাসী করে তোলে এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের জন্যে পথ পরিষ্কার করে দেয়। অসৎ লোকেরা খোদার দুনিয়ায় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করে অবাধে ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায় আর সৎ লোকেরা নিজেদের নাজাত ও মোক্ষ লাভের চিন্তায় তপস্যা ও সাধনায় আত্মনিয়োগ করে।
(২) এই জাহেলিয়াতে প্রভাবে জনগণের মধ্যো অবাঞ্ছিত ধৈর্য, সহিষ্ণতাও নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভংগীর সৃষ্টি হয় এবং তারা তার সহজ শিকারে পরিণত হয়। এজন্যে রাজা-বাদশাহ আমীর-ওমরাহ ও ধর্মীয় কর্তৃত্বশালী শ্রেণী হামেশা এই বৈরাগ্যবাদী দর্শনে নৈতিক আদর্শের প্রচার ও বিস্তারে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন। আর তাদের ছত্রছায়ায় এই মতবাদ নিশ্চিন্তে বিস্তারলাভ করেছে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও পোপবাদের সংগে এই বৈরাগ্যবাদী দর্শনের কোনোকালে কোনো সংঘাত হয়েছে বলে ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যাবে না।
(৩) এই বৈরাগ্যবাদী দর্শন মানব প্রকৃতির নিকট পরাজিত হলে নানান রকমের বাহানা তালাশ করতে শুরু করে। কোথাও কাফ্ফারা দানের নীতি উদ্ভাবন করা হয়। এতে করে একদিকে মনের আশা মিটিয়ে গোনাহ করা যায় আবার অন্যদিকে জান্নাত ও ছাড়া হয় না। কোথাও ইন্দ্রিয় সুখ চরিতার্থ করার জন্যে দেহকেন্দ্রিক প্রেমের বাহানা করা হয়। এর ফলে অন্তরের আগুনে ঘৃতাহুতিও দেয়া হয় আবার সংগে সংগে ‘হুজুরে আলার’ পাক-পবিত্রতার মধ্যেও কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না। আবার কোথাও সংসার বৈরাগ্যের অন্তরালে রাজা-বাদশাহ ও ধনিকদের সাথে যোগসাজশ করে আধ্যাত্মিকার জাল বিছানো হয়। এর জঘন্যতম রূপ প্রদর্শন করেছেন রোমের পোপ সম্প্রদায় ও প্রাচ্য জগতের রাজা-বাদশাহগণ।
এ জাহেলিয়াত নিজের স্বগোত্রীয়দের সংগে এহেন ব্যবহান করে থাকে। কিন্তু নবীগণের উম্মতের মধ্যে এর অনুপ্রবেশ আরেক দৃশ্যের অবতারণা করে। খোদার দ্বীনের ওপর এর প্রথম আঘাত হলো এই যে, সে এ দুনিয়াকে কর্মস্থল, পরীক্ষাস্থল ও পরকালের কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তে ‘দারুল আজাব’ ও ‘মায়াজাল’ হিসেবে মানুষের সম্মুখে পেশ করে। দৃষ্টিভংগির এই মৌলিক পরিবর্তনের কারণে মানুষ ভুলে যায় যে, তাকে এ পৃথিবীতে খোদার প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছে। সে মনে করতে থাকে, ‘আমি এখানে কাজ করার ও পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়াবলী পরিচালনা করার জন্যে আসিনি বরং আমাকে আবর্জনা ও অপবিত্রতার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ থেকে গা বাঁচিয়ে আমাকে দূরে সরে যেতে হবে। আমাকে এখানে নন-কোঅপারেটর হিসেবে থাকতে হবে এবং দায়িত্ব গ্রহণ করার পরিবর্তে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে’। এধারণার ফলে পৃথিবী ও তার সমুদয় কার্যাবলী সম্পর্কে মানুষ কেমন যেন সংশয়ী ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এবং খোদার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব তো দূরের কথা, সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতেও ভয় করে। তার জন্যে শরিয়তের সমগ্র ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইবাদত-বন্দোগী ও খোদার আদেশ-নিষেধ যে পার্থিব জীবনের সংস্কার ও খোদার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্যে মানুষকে তৈরী করে, এগুলোর এ-অর্থ তাদের নিকট অগ্রাহ্য হয়। বিপরীত পক্ষে সে মনে করতে থাকে যে, ইবাদত-বন্দেগী এবং কতিপয় বিশেষ ধর্মীয় কাজ জীবনের গোনাহসমূহের কাফ্ফারা স্বরূপ। কাজেই কেবল এগুলিকেই পূর্ণ মনোযোগের সংগে যথাযথ পরিমাপ করে সম্পাদন করা উচিত, তাহলেই আখেরাতে নাজাত ও মোক্ষলাভ করা যাবে।
এই মানসিকতা নবীগণের উম্মতের একটি অংশকে মোরাকাবা, মোশাহাদা, কাশফ, রিয়াজাত, চিল্লাদান, অজীফা পাঠ, আমালিয়াত১, মাকামাত২, সফর ও হাকীকত প্রভৃতির দার্শনিক ব্যাখ্যার ৩, গোলক ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছে। তারা মুস্তাহাব ও নফল আদায়ের ব্যাপারে ফরজের চাইতেও বেশী মনোযোগী হয়েছে। এভাবে খোদার যে প্রতিনিধিত্বের কাজ জারি করার জন্যে নবীগণ তাশরিফ এনেছিলেন, তা থেকে তারা গাফেল হয়ে গেছে। অন্যদিকে আর একটি অংশের মধ্যে কাশ্ফ ও কেরামত, দ্বীনের নির্দেশের ব্যাপারে অযথা বাড়াবাড়ি, অনর্থক প্রশ্ন উত্থাপন ছোট ছোট জিনিসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিমাপ করা এবং খুঁটিনিটি ব্যাপারে অস্বাভাবিক মনোযোগ ও যত্ন নেয়ার রোগ জন্ম নিয়েছে। এমনকি খোদার দ্বীন তাদের নিকট এমন একটি হালকা কাঁচপাত্রে পরিণত হয়েছে, যা সামান্য কাথায় বা সামান্য ব্যাপারে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যায়, ফলে তাদের মনে সবসময় সন্ত্রস্তভাব বিরাজিত, যেন একটু এদিক-ওদিক না হয়ে যায়, তাদের শিরোপরি রক্ষিত কাঁচপাত্র যেন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো না হয়ে যায়-এ সন্ত্রস্ততার মধ্যেই তাদের সবটা সময় অতিবাহিত হয়। দ্বীনের মধ্যে এই গভীর সূক্ষ্মতার পথ প্রশস্ত হবার পর অনিবার্যরূপে স্থবিরতা, সংকীর্ণ চিন্তা ও স্বল্প হিম্মত সৃষ্টি হয়। তখন মানুষের মধ্যে উচ্চতর যোগ্যতার চিহ্নই বা কেমন করে অবশিষ্ট থাকতে পারে। (১) আমালিয়াত-তার চাইতে বড় বে-আমলের পদ্ধতিআজ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। (২) দুনিয়ায় মাকামাত নয় রূহানী মাকামাত -আধ্যাত্মিক জগত। (৩) যেমন ধরুন সর্বেশ্বরবাদ। পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী দৃষ্টি দিয়ে মানব জীবনের বৃহত্তম সমস্যাবলীকে সে কিভাবে নিরীক্ষণ করতে পারে!কিভাবে ইসলামের বিশ্বজনীন মূলনীতিও খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করে যুগের প্রতিটি আবর্তনে প্রতিটি নব পর্যায়ে সে মানবতাকে নেতৃত্বদান করতে পারে!
ইসলাম
চতুর্থ অতিপ্রাকৃত মতবাদটি পেশ করেছেন খোদার নবীগণ। এর সংক্ষিপ্তসার হলোঃ
আমাদের চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত এই সৃষ্টিজগত, আমরা নিজেরাও এর একটি অংশ বিশেষ- আসলে এক সম্রাটের সাম্রাজ্য। তিনি একে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই এর মালিক। তিনিই এর একমাত্র শাসক ও পরিচলক। এ সাম্রাজ্যে আর কারো হুকুম চলে না, সবাই তাঁর নির্দেশের অনুগত আর সমস্ত ক্ষমতা পূর্ণতঃ ঐ একজন মালিক ও শাসকের হাতে কেন্দ্রীভূত।
এ সাম্রাজ্যে মানুষ জন্মগত প্রজা। অর্থাৎ প্রজা হওয়া বা না-হওয়া তার ইচ্ছা-নির্ভর নয়। বরং সে প্রজা হিসেবেই জন্মলাভ করেছে এবং প্রজা ছাড়া অন্য কিছু হওয়া তার পক্ষে সম্ভবও নয়।
এ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের স্বাধীনতা ও দায়িত্বহীনতার কোনো অবকাশই নেই। প্রকৃতগতভাবেও তা হতে পারে না। জন্মগত প্রজা এবং সাম্রাজ্যের একটি অংশ হওয়ার কারণে অন্যান্য অংশগুলি যেভাবে সম্রাটের নির্দেশের আনুগত্য করছে তেমনি তাকেও আনুগত্য করতে হবে, এ ছাড়া তার জন্যে দ্বিতীয় কোন পথ নেই। সে নিজেই নিজের জন্যে জীবন বিধান তৈরী করার এবং নিজের কর্তব্য নিজেই স্থির করার অধিকার রাখে না। তার একমাত্র কাজ হলো মালিকুল মুলক-সম্রাটের পক্ষ থেকে আগত প্রত্যেকটি নির্দেশ পালন করা। এ নির্দেশ আগমনের মাধ্যম হলো, ওহি আর যেসব মানুষের নিকট এ নির্দেশ আসে তাঁরা হলেন নবী।
কিন্তু সে মহান প্রভু মানুষের পরীক্ষার জন্যে সূক্ষ্মতর পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তিনি নিজে প্রচ্ছন্ন হয়ে গেছেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যের নির্দেশদান ও পরিচালনার যাবতীয় ব্যাবস্থাকেও প্রচ্ছন্ন করে রেখেছেন। এ রাষ্ট্র্ এমন ভাবে চলছে যে, বাহ্যতঃ এর কোনো শাসক দৃষ্টিগোচর হয় না, কোন কর্মকর্তাও দেখা যায় না। মানুষ শুধু দেখছে, একটি কারখানা চালু আছে। তার মধ্যে সে নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধি করছে। সে কারুর অধীরস্ত এবং কারুর নিকট তাকে হিসেব দিতে হবে, তার বাহ্যেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কোথাও এটা অনুভুত হয় না। চতুষ্পার্শ্বের বস্তুসমূহের মধ্যে এমন কোনো সুস্পষ্ট নিশানীও নেই, যার ভিত্তিতে বিশ্বজাহানের শাসনকর্তার কর্তৃত্ব এবং নিজের অধীনতা ও দায়িত্বশীলতার অবস্থা সকল প্রকার সন্দেহমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হতে পারে এবং তা প্রকাশিত হবার পর তাকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তরও থাকে না। নবীদের আগমন হয়, কিন্তু তাঁদের ওপর যে ওহি নাযিল হয় তা কেউ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে না অথবা কোনো সুস্পষ্ট আলামতও তাঁদের সংগে প্রেরিত হয় না, যা প্রত্যক্ষ করার পর তাঁদের নবুয়াত মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আবার একটি সীমারেখার মধ্যে মানুষ নিজেকে পূর্ণ স্বাধীন দেখতে পায়। বিদ্রোহ করার ক্ষমতাও তাকে দেয়া হয়, এর যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয় এবং দীর্ঘকালীন সুযোগ দেয়া হয়। এমনকি দুষ্কৃতি ও গোনাহের শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছতে গিয়ে সে কোন বাধা পায় না। মালিক ছাড়া অন্য কারুর বন্দেগী করতে চাইলে তাতেও বাধা দেয়া হয় না। এজন্যে পূর্ণ স্বাধীণতা দান করা হয় যাকে ইচ্ছা তার বন্দেগী, দাসত্ব ও আনুগত্য করতে পারে। বিদ্রোহ করলে এবং অন্যের দাসত্ব করতে উভয় অবস্থাতেই রেজেকের মধ্যে কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না, বরং বরাবর রেজেক লাভ করতে থাকে। জীবন যাপনের যাবতীয় সরঞ্জাম, কর্মের উপায় -উপকরণ এবং আয়েশ-আরামের দ্রব্য -সামগ্রী নিজের মর্যাদানুযায়ী বেশ ভালভাবেই লাভ করতে থাকে এবং আমৃত্যু এ পাওনা পেয়ে যেতে থাকে। কখনো কখনো খোদাদ্রোহী বা অন্যের দাসত্বকারীকে তার এই অপরাধের দরুন পার্থিব সাজসরঞ্জাম এবং জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সরবরাহ করা বন্ধ হয়নি। বিশ্বজাহানের মানুষের ব্যাপারে এই বিশিষ্ট কর্মপদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো এই যে, স্রষ্টা মানুষকে বিবেক বুদ্ধি, যুক্তিধর্মীতা, আকাংখা ও স্বাধীন ইচ্ছার যে ক্ষমতা দিয়েছেন। এবং নিজের অসংখ্য সৃষ্টির ওপর মানুষকে যে এক ধরনের কর্তৃত্ব-ক্ষমতা দান করেছেন, তার মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা করতে চান। এই পরীক্ষাকে পূর্ণাংগ রূপ দান করার জন্যে সত্যকে অদৃশ্য করে রেখেছেন। এভাবে মানুষের বিবেকবুদ্ধির পরীক্ষা হয়ে যাবে। মানুষকে নির্বাচনের অবাধ স্বাধীনতা দান করেছেন এভাবে মানুষ সত্যকে জানার পর কোন চাপ বা বাধ্যবাধকতা ছাড়াই স্বেচ্ছায় এবং সাগ্রহে তার অনুগত হবে অথবা কামনার দাসত্ব গ্রহন করে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, এ বিষয়টির পরীক্ষা হয়ে যাবে। জীবন যাপনের সরঞ্জাম উপায়-উপকরণ এবং কর্মের সুযোগ দান না করা হলে তার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার পরীক্ষা হতে পারে না।
এ পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষাকাল। তাই এখানে কোনো হিসাব নেই, কোনো শাস্তি ও পুরস্কার নেই!এখানে যা কিছু দান করা হয়, তা কোনো সৎকর্মের পুরস্কার নয় বরং পরীক্ষার সামগ্রী এবং যে সমস্ত দুঃখ- কষ্ট, বিপদ-আপদ আসে তাও কোনো অসৎ কর্মের শাস্তি নয় বরং যে প্রাকৃতিক বিধানের ওপর দুনিয়ার এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত প্রধানতঃতারই আওতায় এগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১ কর্মের আসল হিসাব, যাচাই-বাছাই এবং সে সম্পর্কে রায় দানের সময় আসবে এ পার্থিব জীবন শেষ হবার পর, তারই নাম আখেরাত। কাজেই দুনিয়ায় যা কিছু কর্মফল প্রকাশিত হয়, তা কোন পদ্ধতির অথবা কোনো কর্মের ভুল বা নির্ভুল, ভালো বা মন্দ এবং গ্রহণযোগ্য বা পরিত্যাজ্যের মানদণ্ডে পরিণত হতে পারে না। আসল মানদন্ড হলো আখেরাতের ফলাফল। আখেরাতের কোন পদ্ধতি এবং কোন কর্মের ফল ভাল বা মন্দ হবে, তার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীগণের ওপর অবতীর্ণ ওহির মাধ্যমে লাভ করা যেতে পারে। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে আখেরাতের লাভ-ক্ষতি যার ওপর নির্ভর করে তা হলো এই যে, প্রথমতঃ মানুষ নিজের সূক্ষ্মবুদ্ধি ও যুক্তিবাদীর নির্ভুল ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাই যে তার আসল শাসক তা জানতে পারে কিনা এবং তাঁর পক্ষ থেকে যে সব নির্দশ প্রেরণ করা হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে পারে কিনা। দ্বিতীয়তঃ এই সত্য অবগত হবার পর সে (নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকা সত্বেও) স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে আল্লাহর কর্তৃত্ব এবং তাঁর নির্দেশাবলীর সম্মুখে আনুগত্যের শির নত করে কিনা।
(১) এর অর্থ এ নয় যে, এ দুনিয়ায় আদতে কোনো প্রতিবিধান ব্যবস্থা কার্যকরী নেই। বরং যা আমি বলতে চাই, তা হলো এই যে, এখানকার প্রতিবিধান ও প্রতিফল দ্ব্যর্থহীন, চুড়ান্ত ও সুস্পষ্ট নয় এবং পরীক্ষার দিকটি সব রকমের পার্থিব শাস্তি ও পুরষ্কারের ওপর কর্তৃত্বশালি। তাই এখানে যে কর্মফল প্রকাশিত হয় তাকে নৈতিক ভালো-মন্দের মানদণ্ড হিসাবে গণ্য করা যায় না। সৃষ্টির প্রারম্ভকাল থেকে নবীগণ এ মতবাদ পেশ করে এসেছেন। এই মতবাদের ভিত্তিতে বিশ্বজাহানের যাবতীয় ঘটনাবলীর পূর্ণাংগ ব্যাখ্যা হয়। বিশ্বের দৃশ্যমান বিষয়সমূহের সুষ্পষ্ট অর্থ জ্ঞাত হওয়া যায়। কোনো পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার মাধ্যমে এ মতবাদ ভুল প্রমাণিত হয় না। এর ভিত্তিতে জাহেলিয়াতের জীবনদর্শন থেকে মূলগতভাবে পৃথক একটি স্বতন্ত্র জীবন দর্শন গড়ে ওঠে। এ জীবন দর্শন বিশ্বজাহান ও মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কিত বিপুল তথ্যাবলী জাহেলিয়াত সম্পূর্ন বিপরীত পদ্ধতিতে সংকলন ও পরিবেশন করে। সাহিত্য ও শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতির জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ তৈরী করে জাহেলিয়াত সৃষ্ট সাহিত্য শিল্পের পথগুলি হয় তার সম্পূর্ন বিপরীতমুখী। জীবনের সমস্ত ব্যাপারে সে একটি বিশেষ দৃষ্টিভংগী এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সৃষ্টি করে প্রাণশক্তি ও মৌলিকতার দিক দিয়ে জাহেলী উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভংগীর সংগে তার কোনো সামঞ্জস্য নেই। সে একটি পৃথক নৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করে জাহেলী নৈতিকতার সংগে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আবার ঐ তাত্ত্বিক ও নৈতিক বুনিয়াদের ওপর যে সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ নির্মীত হয়, তা হয় সমস্ত জাহেলী সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে একটি পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থার মূলনীতি সমূহ জাহেলীয়াতের শিক্ষা ব্যবস্থার মূলনীতি সমূহের সস্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সারকথা হলো এই যে, এই সভ্যতার শিরা-উপশিরায় যে প্রাণশক্তি সক্রিয়, তা এক সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন খোদোর কর্তৃত্ব, আখেরাত বিশ্বাস এবং মানুষের অধীনতা ও দায়িত্বশীলতার কথা ঘোষণা করে। বিপরীত পক্ষে প্রত্যেকটি জাহেলী সভ্যতার সমগ্র ব্যবস্থার মধ্যে মানুষের অবাধ স্বাধীনতা, বল্গাহারা উচ্ছৃংখল প্রবৃত্তি ও দায়াত্বহীনতার প্রেরণা অনুপ্রবেশ করে থাকে। তাই নবীগণের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা-সংস্কৃতির মাধ্যমে মানবতার যে নমুনা তৈরী হয় তার আকৃতি, প্রকৃতি, রূপ ও রং জাহেলী সভ্যতা-সংস্কৃতি সৃষ্ট নমুনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং এই পার্থক্য তার প্রতিটি অংশে ও প্রতিটি দিকেই স্বতঃস্ফূর্ত।
অতঃপর এর ভিত্তিতে তমুদ্দুন যে বিস্তারিত রূপলাভ করে তা সমগ্র দুনিয়ার অন্যান্য নকশা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে পড়ে। পবিত্রতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, জীবন-যাপর পদ্ধতি, সামাজিক রীতি-নীতি, ব্যক্তি-চরিত্র, জীবিকা উপার্জন, অর্থ ব্যয়, দাম্পত্য জীবন, সাংসারিক জীবন, বৈঠকি নিয়ম-কানুন, মানুষ ও মানুষের সম্পর্কের বিভিন্ন আকৃতি, লেন-দেন, অর্থ বন্টন, রাষ্ট্র পরিচলনা, সরকার গঠন, রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা ও দায়িত্ব, পরামর্শ পদ্ধতি, সিভিল সার্ভিস সংগঠন, আইনের মূলনীতি, মূলনীতির ভিত্তিতে রচিত বিস্তারিত বিধানাবলী, আদালত, পুলিশ, হিসাব-নিকাশ, কর, ফিনান্স, জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী, শিল্প, ব্যবসায় -বাণিজ্য, সংবাদ সরবরাহ, শিক্ষা ও সংগঠন এবং যুদ্ধ ও সন্ধির নীতিও এ তমুদ্দুনে এক বিশেষ ও স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী। প্রতিটি অংশে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা তাকে অন্যান্য তমুদ্দুন থেকে আলাদা করে রাখে। প্রতিটি বিষয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে একটি বিশেষ দৃষ্টিভংগী, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য এবং একটি বিশেষ নৈতিক আচরণ সক্রিয় থাকে, যার সম্পর্ক থাকে এক খোদার সার্বভৌম কর্তৃত্ব, মানুষের অধীনতা ও দাসত্ব এবং দুনিয়ার পরিবর্তে আখেরাতের গন্তব্যের সংগে।