দাওয়াতে হকের সঠিক কর্মপন্থা
আরবী হবে——-
‘হে নবী, কোমল ও ক্ষমা সুন্দর নীতি অবলম্বন কর। ‘মারূফ’ কাজের নিদের্শ দিয়ে যাও এবং মুর্খদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না। শয়তান কখনো যদি তোমাকে উস্কানী দেয়-তবে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। তিনি সব জানেন, সব শুনেন। প্রকৃত পক্ষে যারা মুত্তাকী, তাদের অবস্থা তো এরূপ যে, শয়তানের প্ররোচনায় কোনো খারাপ খেয়াল যদি তাদের স্পর্শ করেও তারা সাথে সাথে সাবধান ও সতর্ক হয়ে যায়। অতঃপর (তাদের সঠিক করণীয় কি) তা তারা সুস্পষ্টভঅবে দেখতে পায়। বাকী থাকলো তাদের (শয়তানের) ভাই বন্ধুদের কথা। এদের তো শয়তান বক্র পথে টেনে নিয়ে যায়। এবং এদের বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে তার কোনো ত্রুটিই করে না’। (আরাফ ১৯৯-২০২)
এ আয়াত সমূহে নবী করীম (সঃ) দাওয়াত ও তাবলীগ এবং হেদায়ত ও সংস্কার সংশোধনের হিকমাত সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট শিক্ষা দেয়া হয়েছে; এর উদ্দেশ্য শুধু হুজুর (সঃ)-কে শিক্ষা দেয়ই নয়; বরং যেসব লোক হুজুর (সঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত ও প্রতিনিধি হয়ে দুনিয়াবাসীদের সরল সঠিক পথ দেখঅতে প্রস্তুত হবে হুজুর (সঃ)-এর মাধ্যমে এমন সকল মানষকেই এ হিকমাত শিক্ষা দেওয়অ উদ্দেশ্য। ক্রমানুসারে এ শিক্ষা ও মূলনীতিগুলো নিম্নে পদত্ত হলোঃ
১। দা’য়ীয়ে হকের জন্যে সবচাইতে জরুরী গুণাবলীর একটি হচ্ছে তাকে কোমল, বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও উদারচিত্ত সম্পন্ন হতে হবে। নিজ সহকর্মীদের বেলায় তাকে কোমল ও প্রেমময় সাধঅরণ মানুষের বেলায় দরদী ও সহানুভূতিশীল এবং বিরোধীদের বেলায় অতিশয় সহিষ্ণু হতে হবে। কঠিন উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশেও তার মন মেজাজকে ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কঠিন বিরুদ্ধবাদীদের কঠিন বিরোধিতা এবং নিজ সহকর্মীদের দুর্বলতা সমূহ বরদাশত করার মতো সহিষ্ণু হতে হবে। সম্পূর্ণ অসহনীয় কথাকেও উদারচিত্তে এড়িয়ে যেতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে যতোই শক্ত কথা, মিথ্যা, অপবাদ, জ্বালা যন্ত্রণা এবং নিতান্ত দুষ্কৃতিমূলক বাধা বিপত্তি আসুক না কেনো এ সবকিছুই তাকে উদার ও ক্ষমার দৃষ্টিতে হজম করতে হবে। কঠোরতা, কড়া ব্যবহার, তিক্ত কথা-বার্তা এবং প্রতিশোধ মূলক উত্তেজনা এ মহান কাজের পক্ষে বিষের মতো কাজ করে। এতে কাজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে য়অয়, গড়ে উঠে না। এ জিনিসটাকে নবী করীম (সঃ) এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমার রব আমাকে আদেশ দিয়েছেন যে, ‘আমি ক্রোধ সন্তোষ উভয় অবস্থাতেই ইনসাফের কথা বলবো। যে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবো। যে আমাকে আমার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, আমি তাকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করবো। যে আমার প্রতি যুলুম করবে, আমি তাকে মাফ করে দেবো’। নিজের পক্ষ থেকে তিনি যাদেরকে দ্বীন প্রচার করতে পাঠাতেন, তাদেরকেও তিনি এরূপ হেদায়াতই দিতেনঃ
আরবী হবে—–
মানে-‘তোমরা যেখানেই যাবে, তোমাদের আগমন যেনো লোকদের কাছে সুসংবাদের বিষয় হয়-ঘৃণা ও অসন্তোষের ষিয় নয়। তোমরা লোকদের জন্যে সহজতা বিধানকারী হবে-কাঠিন্য ও কঠোরতা বিধানকারী নয়’। আর আল্লাহ তায়ালাও নবী করীমের (সঃ) এ গুণটারই প্রশংসা করে এরশাদ করেছেনঃ
আরবী হবে—–
‘অর্থাৎ-এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তুমি লোকদের প্রতি খুবই বিনম্র। নতুবা তুমি যদি পাষাণাত্মা ও রূঢ় ব্যবহারকারী হতে তবে এসব লোক তোমার চতুস্পার্শ্ব থেকে সরে যেতো’। (আল ইমরান-১৫৯)
২। দাওয়াতে হকের কামিয়াবী এ পন্থায় নিহিত রয়েছে যে, দাওয়াত দানকারী বড় বড়[ দর্শন ও সূক্ষ্মতত্ত্বের পরিবর্তে লোকদের সরাসরি মারূফ’ মানে-সোজা ও সুস্পষ্ট কল্যাণের শিক্ষা দেবে,যেসব কথাকে সাধারণ মানুষ ভাল কথা বলে জানে কিংবা যা ভাল কথা বলে মনে করার জন্যে-তাদের সাধারণ বুদ্ধিই(Common sence) যথেষ্ট হতে পারে। এ পন্থা গ্রহণের ফলে সত্য পথের দাওয়াত দানকারীর আবেদন সাধারণ ও সুধী সবাইকে প্রভাবিত করে। শ্রোতার কর্ণকুহ ভেদ করে দাওয়াত আপনিতেই তার মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। এমন ‘মারূফ’ দাওয়াতের বিরুদ্ধে যারা চিৎকার ও হাঙ্গামা করে-তার নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতা এবং এ দাওয়াতের কামীয়াবীর ক্ষেত্র তৈরি করে। কারণ সাধারণত মানুষ যতোই হিংসা বিদ্বেষে নিমজ্জিত থাকুক না কেনো-তারা যখন দেখে যে একদিকে একজন ভদ্র ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী মানুষ সরল সঠিক কল্যাণের প্রতি দাওয়াত দিচ্ছেন-অপরদিকে অনেকগুলো লোক তার বিরোধিতায় সর্বপ্রকার নৈতিকতা ও মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে হীণ কার্যক্রম গ্রহণ করছে-তখন আপনিতেই তারা ধীরে ধীরে সত্যবিরোধীদের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে এবং সত্যের দাওয়াত দানকারীদের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। শেষ পযন্ত কেবল বাতিল সমাজ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই মুকাবিলার ময়দানে থেকে যায়, অথবা সেসব লোকেরাই বিরোধীতা করতে থাকে, যাদের অন্তরে অতীত লোকদের অন্ধ অসুসরণ কিংবা জাহেলী হিংসা বিদ্বেষ কোনো প্রকার সত্যপথ গ্রহণের যোগ্যতা ও সামর্থ্যই বাকী রাখেনি। এটাই হচ্ছে সে হিকমাত যা অনুসরণের ফলে আরবে নবী করীম (সঃ)-এর কামিয়াবী হাসিল হয়েছিল। এবং তার পরবর্তীতে অল্পকালের মধ্যে পার্শ্ববতী দেশসমূহে ইসলামের শ্রোতাধারা এমনভাবে প্রবাহিত হতে থাকলে যে, কোথাও শতকরা ১০০জন, কোথাও ৮০জন আবার কোথাও ৯০ জন অধিবাসী মুসলমান হয়ে যায়।
৩। দাওয়াতী কাজে সত্যানুসন্ধিৎসু লোকদের মারূফের প্রশিক্ষণ দেয়া যতোটা জরুরী এ ক্ষেত্রে তারা যতোই তর্ক বিবাদে জড়িয়ে ফেলতে চেষ্টা করুক না কেনো-দাওয়াত দানকারীকে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেবল এমন লোকদের সম্বোধন করে কথা বলাই তার উচিত-যারা যুক্তি ও বুদ্ধির সাথে এ দাওয়াতকে বুঝার জন্যে প্রস্তুত হবে। কোনো জাহেল ব্যক্তি যদি কখনো জাহেলী আচররণ করতে শুরু করে এবং অর্থহীন তর্ক, ঝগড়া ও তিক্ত কথা-বার্ত বলতে আরম্ভ করে, তখন দা’য়ীয়ে হককে তার প্রতিপক্ষ সাজতে অস্বীকার করতে হবে। কারণ এ ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার লাভ কিছুই নেই। আর তাতে লোকসান হচ্ছে এই যে দাওয়াত দানকারীর যে শক্তি দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও সংশোধনের জন্যে ব্যয় হওয়া উচিত ছিল-তা অর্থহীন কাজে বিনষ্ট হয়ে যায়।
৪। তিন নম্বরে যে হেদায়ত দেয়া হলো,সে প্রসঙ্গে আরো অধিক হেদায়াত হচ্ছে যে, দা’য়ীয়ে হক যখন বিরুদ্ধবাদীদের যুলুম, অত্যাচার, দুস্কৃতি ও মূর্খতা ব্যাঞ্জক প্রশ্ন ও অভিযোগের কারণে নিজের মন মেজাজ উত্তেজিত হচ্ছে বলে অনুভব করবে তখনই তাকে বুঝতে হবে-এটা শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তখনই তাকে খোদার পানাহ চাইতে হবে যেন তিনি নিজের বান্দাকে এ উত্তেজনায় সীমা লংঘন থেকে রক্ষা করেন এবং এমন বেসামাল হতে না দেন-যাতে দওয়াতে হকের ক্ষতি সাধিত হবার মতো কোনো তৎপরতা তার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। দাওয়াতের হকের কাজ সর্বাবস্থায় ঠাণ্ডা দিলেই হওয়া সম্ভব। সে পদক্ষেপই সঠিক হওয়া সম্ভব-যা উত্তেজনায় পরাজিত হতে নয়, বরং স্থান পরিবেশ ও সময় সুযোগ অনুযায়ী খুব বুঝে শুনে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু শয়তান যে, কখনো এ কাজের প্রসার চায় না ও সহ্য করে না সব সময়ই আপন ভাই-বন্ধুদের দ্বারা দাওয়াত দানকারীর উপর হামলা চালাবার চেষ্টা করে এবং এ হামলার জবাব দেবার জন্যে তাকে প্ররোচিত করতে থাকে যে, এ হামলার অবশ্যই জবাব দেয়অ চাই। শয়তানের এ প্ররোচনা যা সে দাওয়াত দানকারীর অন্তরে সৃষ্টি করে দেয়-অনেক সময় বড় বড় ধোকা ও ধর্মীয় পরিভাষার আবরণে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এর অভ্যন্তরে নিছক আত্মম্ভরিতা ছাড়া আর কিছু্ই থাকে না। এ জন্যে শেষ দুটি আয়াতে বলা হয়েছে মুত্তাকী লোকেরা তো নিজেদের অন্তরে কোনো শয়তানী তৎপরতা ও প্রভাব এবং খারাপ চিন্তা অনভব করতেই সাবধান ও সতর্ক হয়ে যায়। অতঃপর তারা পরিস্কারভাবে দেখতে ও বুঝতে পারে এমতাবস্থায় কোন নীতি ও কর্মপন্থা অবলম্বনে দাওয়াতে দ্বীনের পক্ষে কল্যাণকর হবে আর এমতাবস্থায় দাওয়াত দ্বীনের দাবীই বা কি। যারা আত্মপূজার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে এবং এ কারণে শয়তানদের সাথে যাদের ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক তারা কখনো শয়তানী প্ররোচনায় সম্মুখে টিকে থাকতে পারে না। তারা শয়তানী প্ররোচনায় পরাজিত হয়ে ভ্রান্ত পথে চলতে শুরু করে। অতঃপর শয়তান তার ইচ্ছা মাফিক তাদেরকে সর্বত্র তাড়িয়ে বেড়ায় এবং কোথাও তাদের এ চলার গতি বন্ধ হয় না। বিরোধিদের প্রতিটি গালির মুকাবিলায় তাদের কাছেও একটা গালি এবং বিরোধিদের প্রতিটি য়ড়যন্ত্র ও দুস্কৃতির মুকাবেলায় তাদের কাছেও একটা য়ড়যন্ত্র ও দুস্কৃতি মওজুদ থাকে।
এ আলোচনায় একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও আছে। তা হচ্ছে এই যে, তাকওয় সম্পন্ন লোকেরা সাধারণত নিজেদের জীবন পদ্ধতিতে অমুত্তাকী লোকদের চাইতে ভিন্নতর হয়ে থাকে। যারা প্রকৃতই আল্লাহকে ভঅ করেন এবং আন্তরিকভঅবে অন্যায় ও পাপ থেকে বাঁচতে চান তাদের অবস্থা তো এরূপ হয়ে থাকে যে, তাদের চিন্তার কোণে সামান্য বদখেয়ালও যদি ছায়া ফেলে-তখনই তাদের খটকা অনুভূত হয় ও কষ।ট লাগে। যেমন কষ।ট অনুভূত হয়েথাকে আঙ্গুলে কাঁটা বিধলে অথবা চোখে ধুলকণা পড়লে। যেহেতু তারা এসব বদখেয়াল, অন্যায় বাসনা ও খায়েশ এবং বদনিয়তে অব্যস্ত নয়-তাই এসব জিনিস তাদের স্বভাববিরোধী হয়ে থাকে। যেমন পায়ে কাটা ফুটলে, চোখে আবর্জনা প্রবেশ করলে কিংবা পরিচ্ছন্ন কাপড়ে ময়লার ছিটা লাগলে লাগলে পরিচ্ছন্ন মানসিকতার লোকদের অসুবিধা হয়ে থাকে। এ খটকা ও অসুবিধা অনুভূত হবার সাথে সাথে তাদের চোখ খুলে য়ায়, মন সতর্ক হয়ে উঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা এ ক্ষতিকর আবর্জনা ঝেড়ে ফেলতে লেগে যায়। এরা সেসব লোকদের মতো নয়, যারা না খোদাকে ভয় করে আর না অন্যায় ও পাপ থেকে বাঁচতে চয় এবং শয়তানের সাথে মনের মিল রয়েছে। এদের মনে বদখেয়াল খারাপ বাসনা ও অসৎ উদ্দেশ্য ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু এসব নোংরামিতে নিমজ্জিত থেকেও তারা কোনো প্রকার অসুবিধা ও অস্বাভাবিকতা নিজেদের মধ্যে অনুভব করে না। যেমন কোনো ডেগচীতে শুয়োরের মাংস রান্না হচ্ছে-কিন্তু তাদের চিন্তাতেই আসে না যে এতে কি রান্না হচ্ছে। অথবা কোনো মেথর, যার সারাটা দেহে ময়লা লেগে লতপত হয়ে আছেঠ, কিন্তু তার অনুভূতিই নেই যে তার দেহে কি জিনিস লেগে আছে।
তীব্র বিরুদ্ধতার পরিবেশে আল্লাহর পথে দাওয়াত
আরবী হবে——–
“এবং সে ব্যক্তির কথার চাইতে ভাল কথা কার হবে, যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং বললোঃ আমি মুসলমান?”
পূবের আয়াতে ঈমানদার লোকদের সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল এবং তাদের সাহস বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, অতঃপর এ আয়াতে সে প্রকৃত দায়িত্বের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষন ও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে,যে উদ্দেশ্যে তারা মুসলমান হয়েছিল। পূর্বের আয়াতে তাদেরকে বলা হয় যে,আল্লাহর বন্দেগীল পথ গ্রহণ করা ও পথে দৃঢ় পতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর, তা থেকে বিভ্রান্ত না হওয়া এমন একটা নেক কাজ-যা মানুষকে ফেরেশতাদের বন্ধু ও জান্নাতের অধিকারী বানিয়ে দেয়। এখন তাদের পরবর্তী স্তরের কথা বলা হচ্ছে যার চাইতে উন্নত স্তর আর হতে পারে না। তা হচ্ছে-তোমরা নিজেরা নেক আমল করো এবং অন্যান্য লোকদের আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব গ্রহণের আহ্বান জানাও। তীব্র বিরুদ্ধতার পরিবেশ এবং যেখানে ইসলামের কথা বলা ও প্রকাশ করা নিজের উপর বিপদ ডেকে আনার শামিল সেখানেও বুক ফুলিয়ে বলোঃ ‘আমি মুসলমান’। আল্লাহ তায়ালার এ কথাটির পূর্ণ গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্যে সে পরিবেশ পরিস্থিতিকে চোখের সামনে রাখা জরুরী, যে পরিবেশে এ কথাগুলো বলা হয়েছিল। তখনকার পরিবেশ এইরূপ ছিল যে, ব্যক্তিই নিজের মুসলমান হবার কথা প্রকাশ করত সহসাই তার মনে হতো সে যোনো হিংস্র জন্তুদের জঙ্গলে প্রবেশ করছে, সেখানে প্রতিটি পশু তাকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলবার জন্যে ছুটাছুটি করছে। তার চাইতে অগ্রসর হয়ে যে লোক ইসলাম প্রচারের জন্যে মুখ খুলতো সেতো যেনো হিংস্র পশুগুলোকে ডেকে বলতোঃ ‘এসো আমাকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলো’। এ কঠিন অবস্থাতেই বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির আল্লাহকে নিজের রব হিসেবে মেনে নিয়ে সোজা পথ অবলম্বন করা নিঃসন্দেহে অতি বড় মৌলিক নেক কাজ। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরের নেক কাজ হচ্ছে, এ পরিবেশে ঘোষণা করে দেয়া যে, ‘আমি মুসলমান’ এবং ফলাফলের পোয়অ না করে খোদার বান্দাদের তাঁরই দাসত্ব গ্রহণের প্রতি দাওয়াত দান করা এবং কাজ করতে গিয়ে নিজের আমলকে এতটুকু পবিত্র রাখা, যেনো ইসলাম ও ইসলামের পতাকাবহীদের কোনো খূঁৎ বের করা সম্ভব না হয়।
উত্তম নেকী দ্বারা মন্দের মুকাবিলা করা
সামনে অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছেঃ
আরবী হবে———–
‘হ নবী ভাল আর মন্দ সমান নয়। মন্দের মুকাবিলা করো সে নকী দিয়ে-যা অতীব উত্তম। তাহলে দেখতে পাবে-তোমার সাথে যাদের ছিল চরম শত্রুতা তারা হয়ে গেছে তোমার পরম বন্ধু’।
এ আয়াতের পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে হলে সে পরিবেশ পরিস্থিতিকে চোখের সামনে রাখতে হবে-যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে নবী করীম (সঃ)-কে এবং তাঁর মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের এ হেদায়াত দেয়া হয়েছিল। তখন অবস্থা এরূপ ছিল যে, দাওয়াত হকের বিরুদ্ধতা চরম হটকারিতা ও কঠিন আক্রমণাত্মক ভূমিকা দ্বারা করা হচ্ছিল। তার বিরুদ্ধে নান হাতিয়অর ব্যবহার করা হচ্ছিল। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিটি ফৌজই তাঁর বিরুদ্ধে জনমনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করার কাজে নিরত ছিল। তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের নানা প্রকার কষ্ট, নির্যাতন ও পীড়া দেয়অ হচ্ছিল। যাতে অতিষ্ট হয়ে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সময় হুজুর (সঃ)-এর প্রচার কাজ বন্ধ করে দেবার জন্যে এরূপ কর্মসূচী তৈরী করা হয় যে, গণ্ডগোল ও হট্টগোলকারীদের একটা দল সব সময় তাঁর পিছে লাগিয়ে রাখা হতো। যখনই তিনি দাওয়াতে হকের জন্যে মুখ খুলতেন তখন তারা এমন হৈ-হট্টগোল ও চীৎকার শুরু করতো যে তাঁর কথাই কেউ শুনতে পেত না বস্তুত এটা ছিল খুবই নাজুক পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে বাহ্যত দ্বীন প্রচারের সমস্ত পথই বন্ধ দেখা যাচ্ছিল। ঠিক এরূপ অবস্থায়ই বিরদ্ধবাদীদের দাঁত চূর্ণ করার জন্যে হুজুর (সঃ)-কে এ হেদায়ত দেয়া হয়।
প্রথম কথাতেই বলা হয়েছে নেকী ও বদী তথঅ ভঅল ও মন্দ এক নয়। মানে বাহ্যথ তোমাদের বিরুদ্ধবাদীরা পাপ ও অন্যায়ের যতবড় তুফানই সৃষ্টি করুক না কেনো,তার মুকাবিলায় নেকী যতই দুর্বল, অসহায় অক্ষমই মনে হোক না কেনো;কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বদী ও অন্যায় তার নিজ সত্তার দিক থেকেই দুর্বল ও অসহায় আর এ জন্যেই শেষ পর্যন্ত মানুষ থাকে তার স্বভাব প্রকৃত অন্যায় ও পাপকে ঘৃণা না করে পারে না। পাপ ও অন্যায়ের সঙ্গী সাথীরাই শুধু নয়, তার পতাকাবাহীরা পর্যন্ত মনে মনে একথঅ অনুভব করে যে, তারা মিথ্যাবাদী, যালেম ও নিজেদের স্বার্থের জন্যে অন্যায়ভাবে হঠকারিতা করছে। এ জিনিসটাই অন্যদের মনে তাদের প্রতি আস্থা জন্মানোর পরিবর্তে তাদের নিজেদের দৃষ্টিতে নিজেদের মর্যাদা বিনষ্ট করে। আর তাদের দিলের উপর একটা চোর বসে যায়-যা প্রতিটি বিরুদ্ধবাদী পদক্ষেপের সময়ই তাদের সাহস ও সংকলপকে ভিতরগত ভঅবে দলন করতে থাকে। এ অন্যায় ও পাপের মুকাবিলায় যদি সে নেকী দ্বারা যা বাহ্যিকভঅবে সম্পূর্ণ অসহায় অক্ষম বলে পরিলক্ষিত হয়-নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকে তবে শেষ পর্যন্ত তা জয়ী হবে। কারণ একে তো নেকীর মধ্যে এক বিরাট শক্তি নিহিত রয়েছে যা মানুষের দিলকে প্রভাবিত ও মোহময় করে তোলে। মানুষের নৈতিক চরিত্র যতোই খারপি ও বিকৃত হয়ে যাক না নেনো সে নিজের অন্তরে নেকীর মর্যাদা অনুভব না করে পারে না। আর নেকী ও বদী যখন সম্মুখে সমরে লিপ্ত হয়ে এবং উভয়েরই আচ্ছাদিত মনিমুক্ত সর্ব সাধঅরণেল সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে তখন দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব সংগ্রামের পর খুব কম লোকই এমন থাকতে পারে যারা অন্যঅয় ও পাপের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও নেকীর প্রতি আসক্ত ও উৎসর্গীকৃত না হবে।
দ্বিতীয় কথা বলা হয়েছে, পাপের মুকাবিলা মুধুমাত্র নেকী দ্বারা নয়; বরং এমন নেকী দ্বারা করতে হবে যা অতি উত্তম ও উচ্চ মানের। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি তোমাদের সাথে অন্যায় আচরণ করলে তোমরা তাকে ক্ষমা করে দাও। এটা হবে নেক কাজ। আর উচ্চতম মানের নেকজাক হবে, যে ব্যক্তি তোমার অসদাচরণ করবে সুযোগ পেলেই তোমরা তার ইহসান ও উপকার করবে।
এর সুফল সম্পর্কে বলঅ হয়েছে, নিকৃষ্টতম শত্রুও শেষ পর্যন্ত প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে। কারণ এটাই মানব স্বভাব। কেউ গালি দিলে আপনি চুপ থাকুন। নিঃসন্দেহে এটা একটা নেকীর কাজ হবে। কিন্তু গালী দানকারী র মুখ এতে বন্ধ হবে না আর তার গালাগালের জবাবে যদি আপনি তার কল্যাণ কামনা করেন তবে যতবড় নির্লজ্জ বিরুদ্ধবাদীই হোক না কেনো তাকে লজ্জিত হতেই হবে। অতঃপর আপনার বিরুদ্ধে খারাপ কথা তার জন্যে আর সহজ ব্যাপার হবে না। এক ব্যক্তি আপনার ক্ষতি করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না, অথচ আপনি তার সমস্ত বাড়াবাড়ি সহ্য করে যাচ্ছেন। এত হয়তো সে নিজের দুস্কৃতির কাজে আরো সাহসী হবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে কখনো তার কোনো ক্ষতি হতে যাচ্ছে আর আপনি সে ক্ষতি হতে তাকে রক্ষ করলেন, তবে সে আপনার পায়ের উপর পড়ে থাকতে বাধ্য। কারণ এরূপ নেকীর মুকাবিলায় কোনো প্রকার দুস্কৃতি টিকে থাকাই সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও এ নিয়মটাকেই কোনো স্থায়ী বা সাধারণ নিয়মে পরিণত করে নেয়া ঠিক নয় যে এ উচ্চস্তরের নেকী প্রত্যেক জানের দুশমনকেই প্রাণের বন্ধু বানিয়ে দেবে। দুনিয়তে এমন নিকৃষ্ট আত্মার লোকও হয়ে থাকে যে, আপনি তাদের বাড়াবাড়ির জবাবে ক্ষমা এবং তাদের দুর্ব্যবহারের বিনিময়ে সদাচরণ করে যতোই পূর্ণতার মানবিকতা দেখান না কেনো তাতে তাদের দংশনের বিষ বিন্দুমাত্র কম হয় না। কিন্তু এরূপ চরম নিকৃষ্ট মানুষ এতই কম পাওয়া পায়-যতটা কম পাওয়া যায় পরম কল্যাণ-কামী মানুষ।
হকের দাওয়াতের সবরের গুরুত্ব
অতঃপর বলা হয়ঃ
আরবী হবে——–
‘এ গুণ কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটে, যারা ধৈর্যধারণ করে। আর এ মর্যাদা লাভ করতে পারে কেবল তারাই যারা বড়ই ভাগ্যবান’।
মানে এ প্রেসক্রিপশান যদিও খুবই কার্যকর; কিন্তু এর ব্যবহার ও প্রয়োগের কোনো হাসি-তামাশা ও খেলার ব্যাপার নয়। এ জন্যে বিরাট মনোবল ও বলিষ্ঠ আত্মার-প্রয়োজন। দৃঢ় সংকল্প বিরাট সাহসিকতা,ধৈর্য্যশক্তি ও আত্মসংযমের। সাময়িক ভাবে কেউ হয়তো অন্যায়ের মুকাবিলায় বিরাট কোনো নেকী করেও ফেলতে পারে। এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়; কিন্তু যেখানে কোনো ব্যক্তিকে বছরের পর বছর ধরে এসব বাতিলপন্থী দুষ্কৃতিকারীদের মুকাবিলায় দ্বীনে হকের খাতিরে ক্রমাগত ভাবে লড়ে যেতে হয়-যারা যে কোনো নৈতিকসীমা লংঘন করতে কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করে না। এবং শক্তি ও ক্ষমতার নেশায় থাকে মত্ত হয়ে, সেখানে নিরন্তর পাপের মুকাবিলায় নেকী তথা উচ্চ মানের নেকী এবং একবারের জন্যেও সংযমের বাধ ভেঙ্গে না যাওয়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভবপর ব্যাপার নয়। এ কাজ সে ব্যক্তিই করতে পারে, যে প্রশান্ত মনে সত্য দ্বীনের উন্নতি ও প্রতিষ্ঠার জন্যে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করছে; যে নিজের আত্মাকে জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেকের অনুগত করে নিয়েছে যে বিরুদ্ধবাদীদের কোনো দুস্কৃতি ও নোংরা আচরণই তাঁকে তাঁর এ মহান মর্যাদা থেকে নীচে নামাতে ও ধৈর্যহীন করতে কামিয়াব হতে পারে না।
আর এ যে বলা হলোঃ ‘এ মর্যাদা কেবল তারাই লাভ করতে পারে, যারা বড় ভাগ্যবান’। এটা হচ্ছে প্রকৃতিরই নিয়ম। অতি বড় উচ্চ মর্যাদার মানুষই এসব গুণাবলিতে গুণান্বিত হয়। আর যিনি এসব গুণের অধিকারী হয়ে থঅকেন, দুনিয়অর কোনো শক্তিই তাক সফলতার মনযিলে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নিকৃষ্টস্তরের লোকদের হীন আচরণ, জঘন্য ষড়যন্ত্র ও অমানুষিক কার্যকলাপ তাকে পরাস্ত করবে-এটা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।
শয়তানের প্ররোচনা থেকে খোদার আশ্রয়
অবশেষে বলা হয়েছেঃ
আরবী হবে——
‘তোমরা যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার প্ররোচনা অনুভব করো, তবে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো’। (ঐ আয়াত-৩৬)
শয়তান যখন দেখে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বে হীনতার মুকাবিলায় ভদ্র ও শালীন আচরণ এবং অন্যায় ও বদীর মুকাবিলায় ন্যায় ও নেকীর আচরণ গ্রহণ করা হচ্ছে তখন সে কঠিন দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সে চায় একবার হলেও কোনো ক্রমে সত্য পথের মুজাহিদরা, বিশেষ করে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা সর্বোপরি তাদের নেতা এমন কিছু ভুল করে বসুক, যার ভিত্তিতে জনগনেকে বলা যেতে পারে, দেখুন-অন্যায় এক তরফা হচ্ছে না। একপক্ষ থেকে অন্যায় কিছু খারাপ আচরণ হয়ে থাকলেও অপর পক্ষের লোকেরাও তো তেমন উচ্চমানের লোক নয়। অমুক অন্যঅয় কাজটি তো শেষ পর্যন্ত তারাও করে বসেছে।
সাধারণত মানুষের তো আর এতটুকু ক্ষমতা নেই যে, তারা এক পক্ষের বাড়াবাড়ি ও অপর পক্ষের জবাবী কাজের মাঝে তুলনা করে দেখবে। তারা যতক্ষণ দেখতে পাবে যে বিরুদ্ধবাদীদের সর্বপ্রকার হীন, নিকৃষ।ট ও অন্যায় আচরণের মুকাবিলায় এসব লোকেরা শালীনতা, ভদ্রতা, নেকী ও ন্যায়পরায়ণাতর পথ থেকে বিন্দু পরিমাণ সরছে না, ততক্ষণ তারা এদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হতে থাকবে। কিন্তু এদের দ্বারা যদি কোনে রূপ অন্যায় আচরণ হয়ে বসে কিংবা তাদের মর্যাদার তুলনায় কোন নীচু কাজ হয়ে যায়-তা অতিবড় কোনো বাড়াবাড়ির মুকাবিলায়ই হোক না কেনো, তখন তাদের দৃষ্টিতে উভয় পক্ষই সামান হয়ে য়ায়। এবং বিরুদ্ধবাদীরাও একটা শক্ত কথার জবাবে হাজারো গালি দেবার বাহানা পেয়ে যায়। এ নাজুক ব্যাপারটির ভিত্তিতেই এরশাদ হয়েছে যে, ‘শয়তানের ধোকা ও প্ররোচনা থেকে সতর্ক থাকো’। সে তোমার খুবই খঅয়েরখা ও দরদী বন্ধু সেজে তোমাকে প্ররোচিত ও উত্তেজিত করবে যে, অমুক বাড়াবাড়ি তো কিছুতেই সহ্য করা যেতে পারে না, ‘অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে’। ‘এ হামলার মুকাবিলায় তো লড়ে যাওয়া উচিত নতুবা তো তোমাদের কাপুরুষ বলা যাবে’। এমন প্রতিটি অবস্থঅয় তোমারা যখন নিজেদের মধ্যে অবাঞ্চিত-উত্তেজনা ও প্ররোচনা অনুভব করবে তখনই সতর্ক হয়ে যাবে যে, নিশ্চই এটা শয়তারেনর কাজ। সে তোমাদের ক্রোধান্ধ করে তোমাদের দ্বারা কোনো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে চায়। সতর্ক হয়ে যাবার পর এমন ধঅরণ করে বসোনা যে, ‘আমি আমার উত্তেজন কন্ট্রোল করতে সক্ষম, শয়তান আমাকে দিয়ে কোনো ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে পারে না’। নিজের এরূপ বিচার ক্ষমতা এবাং সংকল্প শক্তির ধঅরণ শয়তানের আর একটা অতি ভয়ানক ধোকা এ সবের পরিবর্তে তোমাদেরকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। কারণ তিনি যদি তৌফিক দেন এবং হেফাযত করেন তবেই মানুষ ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষ পেতে পারে।
এ আয়াতের সর্বোত্তম তাফসীর হচ্ছে সে ঘটনা, যা ইমাম আহমদ (রঃ) তাঁর মুসনাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেনঃ একবার নবী (সঃ)-এর উপস্থিতিতেই এক ব্যক্তি হযরত আবু বকরকে (রাঃ) অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকলো। হযরত আববকর (রাঃ) চুপচাপ তার গালাগাল শুনতে থাকলেন এবং নবী (সঃ) তা দেখে মুচকি হাসছিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত সিদ্দীক (রাঃ)-এর ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। জবাব তিনিও একটা শক্ত কথ তাকে বলে দিলেন। তাঁর মুখ থেকে সে কথাটা বের হতেই নবী করীম (সঃ) দারুন অসন্তোষ পয়ে পড়লেন যা তাঁর চেহারা মুবারকে পরিস্ফুট হয়ে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। হযরত আবুবকরও উঠে তাঁর পিছু নিলেন এবাং পথিমধ্যে এ ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করে আরয করলেনঃ ‘লোকটা আমাকে গালি দিতে থাকলে আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন, আর আমি তার জবাব দিলে আপনি অসন্তউষ।ট হলেন’। হুজুর (সঃ) বললেন, যতক্ষণ তুমি চুপচাপ ছিলে, ততক্ষণ তোমার সাথে একজন ফেরেশতা ছিলো এবং তোমার পক্ষ থেকে লোকটাকে জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু তুমি নিজেই যখন কথা বলে উঠেলে, তখন ফেরেশতার স্থলে শয়তান এসে বসলো। আমি তো শয়তানের সঙ্গে বসতে পারি না।
সত্যের দাওয়াত দানকারীকে নিঃস্বার্থ হওয়া
দাওয়াতে হকের ব্যাপারে দাওয়াত দানকারীর সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হওয়া তার আন্তরিকতা ও সত্য পরায়ণতার এক সুস্পষ্ট দলীল। কুরআন মজীদে বার বার বলা হয়েছে নবী আল্লাহর দিকে ডাকার যে কাজ করছেন তাতে তাঁর নিজের কোন স্বার্থ নেই; বরং তিনি তো নিজে আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণের জন্যেই নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিচ্ছেন।
সূরা আনআমে এরশঅদ হয়েছেঃ
আরবী হবে——
‘হে নবী, আপনি বলে দিনঃ এ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের জন্যে আমি তো তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছিনা। এ তো গোটা জগদ্বাসীল জণ্যে সাধারণ উপদেশ ও নসীহত মাত্র’। (আয়াত-৯০)
সূরা ইউসুফে বলা হয়েছেঃ
আরবী হবে—-
আর হে নবী এ কাজের জন্যে তো আপনি তাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক দাবী করছেন না। এতো গোটা জগদ্বাসীর জন্যে এক সাধারণ নসীহত মাত্র’। (আয়াত-১০৪)
বাহ্যত এ ভাষণে নবী করীশ (সঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্বোধন কাফেরদের সমষ্টির প্রতিই করা হয়েছে। তাদের একথা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, হে আল্লাহর বান্দারা এ হঠকারিতা কতইনা অন্যায়। নবী যদি নিজের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের জন্যে দাওয়াত ও তাবলীগের একাজ চালু করতেন কিংবা তিনি যদি নিজের জন্যে কিছু চাইতেন তাহলে তোমাদের অবশ্যই একথা বলার সুযোগ ছিলেঅ যে, আমরা কেনো এ মতলবী ব্যক্তি কথা মেনে নেবো? কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ যে, তিন একান্তই নিঃস্বার্থপর। তোমাদের এবং গোটা দুনিয়ার কল্যাণের জন্যে তিনি নিঃস্বার্থভাবে একটা কথা পেশ করছেন, তার সাথে কোনো খামাখা কেউ জিদ করবে? খোলা মনমানসিকতা নিয়ে তাঁর কথা শুনো, মনে লাগলে তা মেনে নাও আর মনে না চাইলে মনে নিওনা।
সূরা মুমিনুনে বলা হয়েছেঃ
আরবী হবে———
‘হে নবী, আপনি কি তাদের কাছে কিছু চাচ্ছেন? আপনার জন্যে আপনার রবের দানই উত্তম। আর তিনিই উত্তম রিযিক দানকারী’। (আয়াত-৭২)
অর্থাৎ ঈমানদারীর সাথে কোনো ব্যক্তি আপনার প্রতি এ অপবাদ দিতে পারবে না যে, আপনি কোন আত্ম-স্মর্থ হাসিল করার জন্যে এ তৎপরতা চালাচ্ছেন। আপনার চমৎকার ব্যবসায় ছিলো; অথচ এখন আপনি দারিদ্রে নিমজ্জিত। গোটা কওম আপনাকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতো, সকলেই ইযযত ও সম্মান করতো। এখন গালাগাল শুনছেন, পাথর নিক্ষেপ হচ্ছে এমনকি আপনার জীবন পযন্ত মারত্মক সংকটাবর্তে নিমজ্জিত। শান্তিতে বিবি-বাচ্চাদের সাথে আনন্দময় দিনাতিপাত করছিলেন। আর এখন এমন কঠিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আপতিত হয়েছ্নে যে, এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেবার সময় নেই। সর্বোপরি এমন কথ নিয়ে ময়দানে নেমেছেন যার কারণে গোটা দেশ আপনার শত্রু হয়ে গেছে। কে বলবে এটা একজন স্বার্থপর মানুষের কাজ? স্বার্থপর ব্যক্তি তো কওম ও কবিলার পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করে তোড়ে-জোড়ে নেতৃত্ব লাভের কোশেশ করে। আপনার মতো তারা এমন কথা নিয়ে ময়দানে নামে না, যা আপনার কওমের স্বার্থর বিরুদ্ধে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ; আর আপনি তো শুরু থেকেই সে জিনিসের শিকড় কেটে আসছেন যার ভিত্তিতে আরব মুশরিকদের উপর কুরাইশ কবিলার জমিদারী প্রতিষ্ঠিত।
সূরা সাবায় বলা হয়েছেঃ
আরবী হবে——
‘হে নবী, আপনি বলে দিন; আমি যদি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চেয়েই থাকি; তবে তা তোমাদেরই জন্যে। আমার পারিশ্রমিকের যিম্মাদার তো আল্লাহ। আর তিনি প্রতিটি ব্যাপারের সাক্ষ্য’।
প্রথম বাক্যাংশের দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, আমি যদি সত্যিই কোনো প্রতিফল চেয়ে থাকি তবে তা তো তোমাদেরই জন্যে। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি যদি সত্যিই কোনো প্রতিফল চেয়েই থাকি, তবে তা তোমাদেরই কল্যাণ ছঅড়া আর কিছু নয়। বাক্যের শেষাংশের তাৎপর্য হচ্ছে অভিযোগ ও অপবাদ দানকারীর যে অপবাদ ইচ্ছা দিতে থাকুক। আল্লাহই সব কিছু জানেন। আমি যে একজন নিঃস্বার্থ মানুষ, ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থে একাজ করছিনে-এ ব্যাপারে আল্লাহই সাক্ষ্য।
সূরা সোয়াদে বলা হয়েছেঃ
আরবী হবে—
‘হে নবী আপনি বলে দিন, এ দ্বীন প্রচারের জন্যে আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না আর না আমি বানোয়াটকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। (আয়ায়-৮৬)
মানে আমি সে সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত নই, যারা নিজেরদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে মিথ্যা দাবী নিয়ে উথিত হয় এবং তারা যা নয় তা হয়ে বসার চেষ্টা করে। নবী কমীম (সঃ) এর মুখ দিয়ে একথাটা কেবল মক্কার কাফেরদের জানানোর জন্যেই বলা হয়নি; বরং এ কাফেরদের মধ্যে অতিবাহিত তাঁর নবুওয়াত পূর্ববর্তী চল্লিশটি বছরের যিন্দেগীই এর সাক্ষ্য হিসেবে মওজুদ রয়েছে। মক্কার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জানতো নবী করীম (সঃ) কোনো বানোয়অট লোক নন। গোটা কওমের একজন ব্যক্তিও তাঁর মুখ দিয়ে এমন কথা কখনো শুনেনি যাতে তিনি কিছু একটা হতে চান এবং নিজেকে প্রভাবশালী করবার চেষ্টা করছেন বলে সন্দেহ করবার কোনো অবকাশ থাকতে পারে।
সূরা আততুর এবং সূরা ক্কলম-এ বলঅ হয়েছেঃ
আরবী হবে—
‘হে নবী, আপনি কি এদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছেন যে এরা জোর পূর্বক আদায় করা জরিমানার বোঝার তলায় পড়ে নিস্পেসিত হচ্ছে?’ (তুর-৪০,ক্কলম-৪৬)
হুজুর (সঃ)-এর প্রতি নয়; মূলত কাফেরদের প্রতিই প্রশ্নটি করা হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে যে, রসূল (সঃ) তোমাদের কাছ থেকে যদি পারিশ্রমিক চাইতেন কিংবা ব্যক্তিগত কোনো ফায়দা হাসিল করবার জন্যে এসব তৎপরতা চালাতেন, তবে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাবার ব্যাপারে তোমাদের নিকট অন্তত একটা যুকিআতসঙ্গত কারণ থাকতো। কিন্তু তোমরা নিজেরাই জানো যে, তিনি তাঁর এ দাওয়াতের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ এবং কেবলমাত্র তোমাদের কল্যাণেল জন্যেই তিনি প্রাণপাত করছেন। তাহলে তোমরা যে শান্ত মনে তাঁর কথাও শুনতে প্রস্তুত নও, এর কি কারণ থাকতে পারে? এ প্রশ্নটাতে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রুপও নিহিত রয়েছে। সারা দুনিয়ার কৃত্রিম ধর্মনেতা এবং ধর্মীয় আস্তানাসমূহের সেবায়েতদের মতো আরবেও মুশরিকদের ধর্মীয় নেতা ও পণ্ডিত পুরোহিতরা প্রকাশ্যভাবে ধর্মীয় ব্যবসা চালাতো। এ প্রসঙ্গেই তাদের সামনে এ প্রশ্ন রাখা হয় যে, একদিকে এসব ধর্মীয় ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যভাবে তোমাদের নিকট নযর-নিয়ায এবং প্রতিটি ধর্মীয় কাজ পালন করার জন্যে পারিশ্রমিক আদায় করে থাকে। অপরদিকে এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে উপরন্তু নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য বরবাদ করে তোমাদেরকে অত্যন্ত যুক্তি প্রমাণ সহকারে দ্বীনের সোজা সঠিক পথ প্রদশর্ন করবার চেষ্টা করছেন। এখন বল, এটা তোমাদের সুস্পষ্ট বেআকলী ছাড়া আর কি যে, তোমরা এ মহান ব্যক্তি প্রষ্ঠ প্রদর্শন করছো এবং ঐসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতি দৌড়ে যাচ্ছো?
এ প্রসঙ্গে একটি মাত্র আয়াত আছে যেটি নিয়ে কিছুটা তর্কের অবকাশ আছে আয়াতটি হচ্ছেঃ
আরবী হবে—-
‘হে নবী এ লোকদের বলে দিনঃ এখানে আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রকার পারিশ্রমিকের দাবীদার নই। তবে নৈকট্যের ভালবাস অবশ্যই পেতে চাই’। (আশশূরা-২৩)
এখানে (নৈকট্য) শব্দটির সত্যিকার তাৎপর্য নিয়ে মুফাসরিদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে।
একদল এর অর্থ আত্মীয়তার সম্পর্ক বুঝেছেন। এবং আয়াতটির তাৎপর্য এরূপ বলে বর্ণনা করেছেন যে, এ কাজে আমি তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাইনা। কিন্তু এটা অবশ্যই চাই যে, ‘তোমরা (কুরাইশরা) তোমাদের ও আমার মধ্য্যকার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে। তোমাদের তো কর্তব্য ছিলো আমার কথা মেনে নেয়া। কিন্তু তা যদি না-ই মানো তবে অন্তুত সারা আরবের মধ্যে তোমরাই আমার দুশমনির জন্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করো না’। -এ হচ্ছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীল যা বহু সংখ্যক রাবীর সূত্রে ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, ইবনে জরীর, তাবরানী, বায়হাকী এবং এবনে সায়দ প্রমুখ উদ্ধৃত করেছেন। মুজাহিদ,ইকরামা, কাতাদা, সুদ্দি, আবু মালেক, আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম, দাহাক, আতা ইবনে দীনার এবং অন্যান্য বড় মুফাসসীরগণও এ তাফসীরই করেছেন।
দ্বিতীয় দল কে (নৈকট্য) ও(নিকটত্ব) অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে একাজে আমি তোমাদের কাছে এতটুকু ছাড়া আর কিছুই চাই না যে, ‘তোমাদের মাঝে আল্লাহর নৈকট্যের ভঅব জাগ্রত হোক’ অর্থাৎ-তোমরা ঠিক হয়ে যাও। ব্যস এটাই আমার পুরস্কার। এ তাফসীল হযরত হাসান বসরী (রঃ) থেকে বর্ণিত। এর সমর্থনে কাতাদা থেকেও একটি কথার উদ্ধৃতি রয়েছে। এমনকি তাবরানীল বর্ণনায় এর সমর্থনে হযরত ইবনে আব্বাসেরও একটা মত উদ্ধৃত হয়েছে। কুরআনে মজীদেরই অন্য জায়গায় এ বিষয়টা নিম্নোক্ত ভাষায় এরশাদ হয়েছেঃ
আরবী হবে—-
‘এ লোকদের বলে দাও এ কাজে আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাইনা। আমার পারিশ্যমিক হচ্ছে এ যে, যার ইচ্ছ সে নিজের খোদার পথ গ্রহণ করবে’। (ফোরকান-৫৭)
তৃতীয় দল শব্দের অর্থ করেছেন (আত্মীয়-স্বজন)। তাদের দৃষ্টিতে আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে-‘তোমরা আমার নিকটাত্মীয়দের ভালবাসবে-এছাড়া এ কাজের আর কোনো পুরস্কারই আমি তোমাদের কাছে চাই না’। অতঃপর এ দলের কেউ কেউ মনে করেন। নিকটাত্মীয় বলতে আবদুল মুত্তালিবের গোটা বংশধরদেরই বুঝায়। আর কেউ কেউ কেবলমাত্র হযরত আলী, ফাতেমা (রাঃ) এবং তাঁদের সন্তানদের পর্যন্ত এটাকে সীমাবদ্ধ মনে করেন, হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) ও আমর ইবনে শুয়াইব (রাঃ) থেকে এ তাফসীরই বর্ণিত হয়েছে। আবার কোনো কোন বর্ণনায় এ তাফসীল ইবনে আব্বাস ও হযরত আলী ইবনে হুসাইন (যয়নুল আবেদীন) এর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ তাফসীল কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমতঃ মক্কায় যখন সূরা আশ-শূরা নাযিল হয়, তখন হযরত আলী ও ফাতেমার বিয়েই হয়নি, সন্তান হওয়ার তো দূরের কথা। আর আবদুল মুত্তালিবের বংশধররাও সকলেই তখনো নবী (সঃ) এর সঙ্গী-সাথী হয়নি, বরং তাদের অনেকেই প্রকাশ্যভাবে দুশমনদের সঙ্গী-সাথী ছিলো। আবু লাহাবের দুশমনী তো গোটা দুনিয়া জানে। দ্বিতীয়তঃ নবী (সঃ)-এর আত্মীয় কেবল আবদুল মুত্তালিবের বংশধররাই ছিল না। তাঁর মাতা, তাঁর পিতা ও সম্মানিতা স্ত্রীর (হযরত খাদীজা) সূত্রে কুরাইশদের সব ঘরেই তাঁর আত্মীয় এগানা ছিলো। এমনি করে কুরাইশদের সকল ঘরেই তাঁর মহোত্তম সাহাবিরা যেমন বর্তমান ছিলেন, তেমনি নিকৃষ্টতম দুশমনরাও বর্তমান ছিলো। এসব নিকৃষ্টতম লোকদের মধ্যে কেবল আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদেরকেই নিজেরআত্মীয় বলে আখ্যা দেয়া এবং তাদের জন্যে বিশেষ ভালবাসা পাবার আবেদন জানানো নবী করীম (সঃ) এর পক্ষে কি করে সম্ভব ছিলো? এ ব্যাপারে তৃতীয় কথাটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে একজন নবী যিনি অতি উন্নত মর্যঅদায় অবস্থান করে মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দান করেন, সে উচ্চতম মর্যাদায় অভিষিক্ত থেকে এ মহান কাজের জন্যে পারিশ্রমিক চাওয়া যে, তোরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে মহব্বত করো-নিতান্তই নীচু স্তরের কাজ। কোনো সুরুচিসম্পন্ন ব্যাক্তি এমনকি কল্পনাও করতে পারে না যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে এমন কথা শিক্ষা দেবেন আর নবী কুরাইশদের সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলবেন। কুরআন মজীদে আম্বিয়ায়ে কেরামের যে সব কাহিনী আলোচিত হয়েছে, তাতে আমরা দেখতে প্ই প্রথ্যেক নবীই তাঁর জাতির লোকদের পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাইনা, আমার পারিশ্রমিক তো মহান্আল্লাহর দায়িত্ব রয়েছে। (ইউনুস-৭,২,হুদ-২৯,৫১,আশশূয়ারা ১০৯,১২৭,১৪৫,১৬৪,১৮০)। সূরা ইয়াসীনে নবীর সত্যতা যাচাইর মানদণ্ড হিসেবে বলা হয়েছে নবী তাঁর দাওয়াতী কাজে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হয়ে থঅকেন (আয়াত-২১)। স্বয়ং নবী (সঃ)-এর মুখ দিয়ে কুরআন মজিদে বার বার বলানো হয়েছেঃ আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাইনা, এ সম্পর্কে উপরে উদ্ধৃত হয়েছে। অতঃপর এ কথা বলার কি অবকাশ আছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াত দানের যে কাজ আমি করছি তার বিনিময়ে তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে ভালবাসো। এরপর যাখন আমরা দেখি এ ভাষণ্ঈমানদারদের নয় বরং কাফেরদের সম্বোধান করা হয়েছে, তখন এমন বক্তব্য আরো অধিক অযাচিত বলে দৃষ্টিগোচর হয়। উপর থেকে গোটা ভাষণেই কাফেরদের সম্বোধন করা হয়েছে আর সম্মুখের সম্বোধনও তাদেরই প্রতি। কথার এ প্রাসঙ্গিকতায় বিরুদ্ধবাদীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার পারিশ্রমিক চাওয়ার প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত কেমন করে সৃষ্টি হতে পারে? পারিশ্রমিক ঐসব লোকদের কছেই চাওয়া যায় যাদের দৃষ্টিতে কাজটা খুবই মূল্যবান এবং যাদের জন্যে তিনি তাদের এ মূল্যবান কাজটির সুব্যবস্থা করেছেন। কাফেররা হুজুর (সঃ) এর এ মহান কাজের কি মূল্যটা দিচ্ছিল যে, তিন তাদের বলতে পারেনঃআমি যে তোমাদের এ বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছি এর বিনেময়ে তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসো? বরং তারা তো উল্টা এ কাজটাকে বিরাট দোষ ও অপরাধ মনে করছিল, যার কারণে তার তাঁর প্রাণ পযন্ত নাশ করতে চেয়েছিল।
দাওয়াতী কাজের সূচনায় পরকালীন ধারণা বিশ্বাসের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান
মক্কা মুয়অযযমায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ইসলাম প্রচারের কাজ আরম্ভ করেন, তখন তাঁর এ কাজের ভিত্তি ছিলো ৩টি। প্রথমতঃ খোদয়ীর ব্যাপারে আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক মানা যাবে না। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স্বীয় রাসূল মনোনীত করেছেন। তৃতীয়তঃ একদিন এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, অতঃপর আর একটি পৃথিবী বানানো হবে। তখন আদি থেকে অন্ত পর্যন্তকার সমস্ত মানুষকে পুনরুন্খিত করা হবে এবং ঠিক সে দেহ ও শরীর সহ হাশরের ময়দানে উপস্থিত করানো হবে, যে দেহ ও শরীল নিয়ে কাজ করছিল। অতঃপর তাদের আকীদা বিশ্বাস ও যাবতীয় কাজ-কর্মের হিসেব নেয়া হবে। এ হিসেব-নিকেষে যারা ঈমানদার ও সৎ প্রমাণিত হবে-তারা চিরদিনের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করবে। পক্ষান্তরে যারা কাফের ও ফাসেক প্রমাণিত হবে, তারা চিরকালে জন্যে জাহান্নামবাসী হবে।
এ তিনটি কথার প্রথম কখাটি মেনে নেয়া যদিও মক্কাবাসীদের জন্যে কঠিন ব্যাপার ছিলো, কিন্তু অথাপি তারা আলআলাহর অস্তিত্বের অস্বীকারকারী ছিল না। আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ রব, সৃষ্টিকর্তা এবং রেযেকদাতা হিসেবেও তারর মানত এবং আল্লাহকে ছাড়া অন্য যাদের তারা উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল, সেগুলোকেও আল্লাহর সৃষ্টি বলেই তারা স্বীকার করতো। সুতরাং তাদের সাথে কেবলমাত্র বিরোধ ছিলো খোদার গুণাবলী ক্ষমতা ইখতিয়ার ও ইলাহর মূল সত্তায় ঐসব উপাস্যদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে কি নেই-এ বিষয় নিয়ে।
দ্বিতীয় কথাটা মক্কার লোকেরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলো না। কিন্তু তাদের পক্ষে একথঅ স্বীকার করা অসম্ভব ছিলো যে, নবী করীম (সঃ) নবুওয়াতের দাবী করার পূর্বে সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছর তাদের মাঝেই জীবন যাপন করেছিলেন এবং দীর্ঘ সময়ে তারা তাঁকে খখনো মিথ্যাবাদী, ধোকাবজ, কিংবা আত্মস্বার্থরক্ষার জন্যে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী হিসেবে দেখতে পায়নি। তারা তো সব সময় র্তাঁর বুদ্ধিমত্তা; বিচক্ষণতা, সুস্থমস্তিস্ক এবং উন্নত নৈতিক চরিত্রের সমর্থক ও প্রশংসাকারী ছিলো। এ কারণে হাজারো টালবাহানা ও অভিযোগ রচনা সত্ত্বেও তা অন্য লোকদের বিশ্বাস করানো তো দূরের কথা স্বয়ং তাদের পক্ষেও তাদের এসব কথা সত্য বলে মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না। কারণ, নবী করীম (সঃ) যখন সব ব্যাপারেই সত্যবাদী ও সত্যপন্থী তখন কেবলমাত্র রেসালাতের দাবীর ব্যাপারে মায়াযাল্লাহ! মিথ্যাবাদী কেমন করে হতে পারেন?
এমনি করে প্রথম দুটি কথা মক্কাবাসীদের এতো বেমী আপত্তিকর ছিল না। যতটা আপত্তিকর ছিল তৃতীয় কথাটি। একথাটি তাদের সম্মুখে পেশ করা হলে এটা নিয়েই তারা সর্বাধিক বিদ্রূপ করে। এ ব্যাপারটা শুনে তারা সবচাইতে বেশী বিস্ময় ও হয়রানী প্রকাশ করলো এবং তার এটাকে অযৌক্তিক ও অসম্ভব মনে করে বিভিন্ন স্থানে তা ধারণার অতীত, গ্রহণ অযোগ্য বলে প্রচার করতে লাগলো। অথচ ইসলামে আনার জন্যে তাদেরকে পরকালের প্রতি বিশ্বাসী বানানো ছিলো অপরিহার্য কারণ পরকালের সম্ভাব্যতা স্বীকার করে না নিলে হক ও বাতিলের নির্ভু চিন্তা পদ্ধতি গ্রহণ, ভাল-মন্দ নির্বাচনের মেরুদণ্ড পরিবর্তন ও দুনিয়া পূজার পথ পরিহার করে ইসলাম প্রদর্শিত পথে চলঅ তাদের পক্ষে একান্তিই অসম্ভব ছিলো। এ জন্যে মক্কা মুয়াযযমায় অবতীর্ণ প্রাথমিক যুগের সূরাগুলোতে সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে পরকাল বিশ্বাসকে মানষের অন্তরে পতিষ্ঠিত করে দেবার জন্যে। অবশ্য সেজন্যে দলিল প্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রেও এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়-যাতে লোকদেরকেমনে তৌহিদের ধারণা আপনাতেই বসে যায়। মাঝে মধ্যে রাসূলে করীম (সঃ) ও কুরআন মজীদের সত্যতা প্রমাণের যুক্তি প্রমাণও সংক্ষেপে আলাচনা করা হয়েছে।