ধার-কর্জ
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে সদয় ব্যবহার
ঋণ মাফ করে দেয়ার বিরাট সওয়াব
(আরবী*********************************)
১০৫. রাসুল (সা) বলেছেনঃ এক ব্যক্তি মানুষকে ঋণ দিত। তারপর সে প্রদত্ত ঋণ আদায় করতে একজন আদায়কারী পাঠাতো। আদায়কারীকে সে বলে দিত যে, অত্যধিক অভাবী কোন ব্যক্তি পেলে তাকে মাফ করে দিও। হয়তো এর কল্যাণে আল্লাহ আমাদেরকেও মাফ করে দেবেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ এই লোকটি যখন আল্লাহর সাথে মিলিত হলো, তখন আল্লাহ তাকে গুনাহ মাফ করে দিলেন। (বোখারী, মুসলিম)
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুযোগ দানের সুফল
(আরবী**************************************)
১০৬.রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করলে যার আনন্দ লাগে, সে যেন দরিদ্র ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় অথবা তার ওপর থেকে ঋণের বোঝা একেবারেই নামিয়ে দেয়। (অর্থাৎ মাফ করে দেয়। –অনুবাদক, মুসলিম, আবু কাতাদাহ(রা) থেকে বর্ণিত)
অন্যের ঋণ পরিশোধ করে দেয়ার সওয়াব
(আরবী******************************************)
১০৭. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত: রাসূল (সা) এর নিকট একটি লাশ এলো, যেন তিনি তার ওপর জানাযার নামায পড়ান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই সাথীর (মৃত ব্যক্তির) ওপর কি কোন ঋণ আছে? লোকেরা বললো, জি, ঋণ আছে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ সে কি কোন সম্পত্তি রেখে গেছে, যা দ্বারা এই ঋণ পরিশোধ করা যায়? লোকেরা বললোঃ না। তখন রাসূল (সা) বললেন, তোমরা ওর জানাযার নামায পড়। (আমি পড়বো না) এই পরিস্থিতি দেখে হযরত আলী (রা) বললেন হে রাসুলুল্লাহ (সা) সামনে এগিয়ে গেলেন ও জানাযার নামায পড়ালেন। অন্য বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন হে আলী, তুমি যেভাবে নিজের এই মুসলিম ভাই এর ঋণের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাকে রক্ষা করলে, সেভাবে আল্লাহ তায়ালা তোমাকেও দোযখ থেকে রক্ষা করুন। যে কোন মুসলমান নিজের মুসলমান ভাই এর ঋণ পরিশোধ করে দেবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহর তায়ালা তাকে দোযখ থেকে মুক্তি দেবেন।
ঋণ থেকে শহীদেরও রেহাই নেই
(আরবী*************************)
১০৮.রাসূল(সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে তার সকল গুনাহ মাফ হবে। কিন্তু ঋণ মাফ হবে না। (মুসলিম, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত)
ঋণ পরিশোধ করা যে কত জরুরী, তা উল্লিখিত দুটো হাদীস থেকে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায়। যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ পর্যন্ত আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছে, সেও যদি কারো কাছে ঋণগ্রস্ত থেকে থাকে এবং তা পরিশোধ না করে থাকে, তবে তা মাফ হবে না। কেননা এটা বান্দাহর হকের সাথে সম্পৃক্ত। পাওনাদার মাফ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাও মাফ করবেননা। অবশ্য ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ঋণ পরিশোধ করার নিয়ত বা ইচ্ছা পোষণ করে থাকে কিন্তু পরিশোধ করতে না পারে ও মারা যায় তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা পাওনাদারকে ডাকবেন, তাকে মাফ করতে বলবেন এবং তার বদলায় তাকে বেহেশতের অঢেল নিয়ামত দেয়ার আশ্বাস দেবেন। ফলে পাওনাদার তার পাওনা মাফ করে দেবে। কিন্তু যদি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করে বা দুনিয়ায় থাকতে মাফ করিয়ে না নেয়, কেয়ামতের দিন তার ক্ষমার কোন উপায় নেই।
ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব ও গড়িমসির ওপর নিষেধাজ্ঞা
সর্বোত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করা
(আরবী*************************************************)
১০৯.হযরত আবু রাফে (রা) বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) একটি অল্পবয়স্ক উট এক ব্যক্তির কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। এরপর তাঁর কাছে যাকাতের কিছু উট এল। তাই তিনি আমাকে আদেশ দিলেন ঐ ব্যক্তির অল্পবয়স্ক উটের ঋণ যেন পরিশোধ করে দেই। আমি বললাম এই উটগুলোর ভেতরে তো কেবল একটা উটই এমন আছে যা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট এবং সাত বছর বয়স্ক। রাসূল (সা) বললেন ওটাই তাকে দিয়ে দাও। কেননা সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম মানুষ, যে সর্বোত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করে। (মুসলিম)
ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে তালবাহানা করা যুলুম
(আরবী****************************************************)
১১০.রাসূল(সা) বলেছেন ধনী ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের তালবাহানা করা যুলুম। আর যদি কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বলে যে, তুমি তোমার ঋণ অমুক সচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে নাও। তাহলে অযথা সেই ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়ে থাকা উচিত নয়। তার এই অনুরোধ গ্রহণ করা ও সে যে ব্যক্তির বরাত দিয়েছে তার কাছে গিয়ে নিয়ে নেয়া উচিত। (বোখারী, মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত)
এ হাদীসে বলা হয়েছে যে, যার কাছে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই এবং সে ঋণদাতাকে বলে যে, অমুক ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে নিন। আমার সাথে তার আলোচনা হয়েছে এবং সে ঋণ পরিশোধ করে দিতে সম্মত আছে। সেই তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণদাতার ঋণের অর্থ না নিয়ে আমি তোমার কাছ থেকেই নেব। আমি আর কাউকে চিনিনা ইত্যাদি বলা উচিত নয়। বরঞ্চ তার সাথে নমনীয় ও উদার আচরণ করা উচিত এবং যার বরাত দিয়েছে তার কাছ থেকেই নেয়া উচিত।
ঋণ পরিশোধের নিয়ত থাকলে আল্লাহ তা পরিশোধ করে দেবেন
(আরবী******************************************)
১১১.রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জনগণের কোন সম্পদ ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে এবং তা পরিশোধ করার নিয়ত তাঁর থাকে, তার ঐ ঋণ আল্লাহ তায়ালা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি তা আত্নসাত করার নিয়ত রাকে আল্লাহ তাকে সেই কারণে ধ্বংস করে দেবেন। (বোখারী, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত)
ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না করার ভয়ংকর পরিণাম
(আরবী******************************************)
১১২.রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে সক্ষম সত্ত্বেও তালবাহানা ও গড়িমসি করে, তার অপমানিত হওয়া ও শাস্তি পাওয়া বৈধ হয়ে যায়। (আবু দাউদ)
অপমানিত হওয়া ও শাস্তি পাওয়া বৈধ হওয়ার অর্থ হলো, যে ব্যক্তি ঋণ নেয় এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করতে তালবাহানা করে তার এ অপরাধটা এতই খারাপ যে, সমাজের চোখে তার সম্মান ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা বৈধ হয়ে যায় এবং তাকে শাস্তি দেয়া যায়। যে দেশে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা চালু থাকবে, সে দেশে এ ধরনের লোক থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মচারীরা তাকে শাস্তি দিতে পারবে এবং তাকে সম্ভাব্য বিভিন্ন উপায়ে অপমানিত করতে পারবে।
জবর দখল ও খেয়ানত
যুলুম ও জবরদস্তির মাধ্যমে অন্যের সম্পত্তি দখল করা
(আরবী********************************************)
১১৩.রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত পরিমাণ ভূমিও অত্যাচার ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে দখল ও আত্নসাত করবে। আল্লাহ কেয়ামতের দিন সাতটা পৃথিবী তার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেবেন। (বোখারী)
যে সম্পদ তার মালিক খুশী মনে দেয় না তা হালাল নয়
(আরবী***********************************************)
১১৪.রাসূল(সা) বলেছেনঃ সাবধান, কেউ যুলুম করো না। কোন ব্যক্তির সম্পদ ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল নয়, যতক্ষণ তার মালিক সন্তুষ্ট চিত্তে তা না দেয়। (বায়হাকী)।
ধার কর্জ ফেরত দেয়া অপরিহার্য
(আরবী****************************************************)
১১৫. রাসূল (সা) বলেছেনঃ ধারে নেয়া জিনিস, দুধ খাওয়ার জন্য প্রদত্ত জন্তু ও ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি কারো জামিন হবে তাকে তার জামানত অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। (তিরমিযি)
অর্থাৎ যে জিনিস কারো কাছ থেকে সাময়িক ব্যবহারের জন্য চেয়ে আনা হয় তা ব্যবহারের পর ফেরত দিতে হবে। আরবের রীতি ছিল যে, ধনী লোকেরা নিজেদের আত্নীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে দুধ খাওয়ানোর জন্য উটনী দিত। একে মিনহা বলা হতো। হাদীসের মর্ম এই যে দুধ খাওয়ার জন্য যে জন্তু দেয়া হবে তার দুধ শেষ হওয়া মাত্রই জন্তুকে মালিকের নিকট ফেরত দিতে হবে। আর ঋণ অবশ্যই যথা সময়ে পরিশোধ করতে হবে। আত্নসাত করা যাবে না। আর যে ব্যক্তি কারো জামিন হবে, তার কাছ থেকে জামানত অবশ্যই আদায় করতে হবে।
খেয়ানতকারীর সাথে খেয়ানত করা যাবে না
(আরবী**********************************************)
১১৬.রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমাকে বিশ্বস্ত মনে করে যে ব্যক্তি তোমার কাছে কোন আমানত রাখবে, তার আমানত ফিরিয়ে দিও। আর যে ব্যক্তি তোমার সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাস ঘাতকতা করবে, তুমি তার সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না। (নিজের ন্যায় পাওনা আদায়ে অন্য কোন বৈধ পন্থা অবলম্বন কর। ) (তিরমিযি)
যেখানে খেয়ানত, সেখানে শয়তান
(আরবী***********************************************)
১১৭.রাসূল(সা) বলেছেন আল্লাহ তায়ালা বলেন যতক্ষণ কোন কারবারের দুই সহযোগী পরস্পরের সাথে খেয়ানত বিশ্বাসঘাতকতা না করবে ততক্ষণ আমি তাদের সাথে থাকি। কিন্তু যখন এক শরীক অপর শরীকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন আমি সেই দুজনের মধ্য থেকে বের হয়ে আসি। আর আমার বের হওয়ার সাথে সাথে সেখানে চলে আসে শয়তান। (আবু দাউদ)
এ হাদীসের মর্ম হলো, কারবারে শরীক লোকেরা যতক্ষণ পরস্পরের সাথে খেয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা ও ধোকাবাজি ঠগবাজী না করে, ততক্ষণ আমি তাদেরকে সাহায্য করি, তাদের উপর রহমত ও করুণা বর্ষণ করি এবং তাদের ব্যবসায়ে ও পারস্পরিক সম্পর্কে বরকত দেই। কিন্তু যখন তাদের কারো নিয়ত তথা মানসিকতা খারাপ হয়ে যায় এবং বিশ্বাস ঘাতকতায় লিপ্ত হয়, তখন আমি সাহায্য ও রহমত বর্ষণ বন্ধ করে দেই। এরপর সেখানে শয়তান চলে আসে এবং তাদের উভয়কে ও তাদের কারবারকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।
ক্ষেত খামার ও বাগান করা সদকায় পরিণত হয়
(আরবী******************************************)
১১৮.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে মুসলমান কৃষি কাজ করে, গাছের চারা লাগায় এবং তা তেকে (ফলমুল ও চারা) পাখী, মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী খেয়ে ফেলে, তা তার জন্য সদকায় পরিণত হবে। (মুসলিম)
প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আটকে রাখার ভয়াবহ পরিণাম
(আরবী****************************************)
১১৯.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তিন শ্রেণীর ব্যক্তির সাথে আল্লাহ কেয়ামতের দিন কথাও বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না, প্রথমত, যারা নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যে কসম খেয়ে বলে যে, এর যত দাম আমি চাইছি, তার চেয়ে বেশী দাম খরিদ্দাররা বলে গেছে। দ্বিতীয়তঃ যারা আছরের নামাযের পর মিথ্যে কসম খায় এবং তার মাধ্যমে কোন মুসলমানকে ঠকিয়ে তার পণ্য নিয়ে নেয়। তৃতীয়তঃ যারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানির অধিকারী হয়ে তা আটকে রাখে এবং কাউকে দেয়না। শেষোক্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেনঃ তুমি যেমন তোমার অতিরিক্ত পানি আটকে রেখেছ অথচ তুমি পানির স্রষ্টা নও, আমি তেমনি আজ (তোমার প্রতি) আমার অনুগ্রহ আটকে রাখবো। (বোখারী, মুসলিম)
শ্রমিকের মজুরী ঘাম শুকানোর আগে দিতে হয়
(আরবী********************************************)
১২০.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও। (ইবনে মাজা)
বস্তুত শ্রমিক বলাই হয় সেই ব্যক্তিকে, যে নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ভরণ পোষণ চালানোর জন্য প্রতিদিন শ্রম খাটাতে বাধ্য হয়। তখন তার মজুরী যদি পরবর্তী কোন দিনে দেয়া হবে বলে বিলম্বিত করা হয়, অথবা আত্নসাত করা হয়, তাহলে ঐ দিন সন্ধ্যায় সে নিজেই বা কী খাবে। আর তার ছেলেমেয়েকেই বা কি খাওয়াবে?
শ্রমিকের মজুরী আত্নসাতের পরিণাম
(আরবী**********************************************)
১২১.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ যে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ আমি কেয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবোঃ এক, যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং তারপর তা ভঙ্গ করে। দুই, যে ব্যক্তি কোন সম্ভ্রান্ত ও স্বাধীন ব্যক্তিকে (অপহরণ করে) বিক্রি করে দেয় এবং তার পণ্যের অর্থ আত্নসাত করে। তিন, যে ব্যক্তি কোন শ্রমিককে নিয়োগ করলো, তার কাছ থেকে পুরো কাজ আদায় করলো, অতঃপর কাজ আদায় করার পর তাকে মজুরী দিল না। (বোখারী)