সামাজিক বিধান
বিয়ে
বিয়ে চরিত্রের হেফাজত করে
(আরবী*****************************************)
১৩১.হযরত ইবনে মাসউদ(রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যার বিয়ের দায়দায়িত্ব বহন করার সামর্থ্য আছে তার বিয়ে করা উচিত। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে। আর যার সে সামর্থ্য নেই, যৌন আবেগের তীব্রতা দমনের জন্য তার মাঝে মাঝে রোযা রাখা উচিত। (বোখারী, মুসলিম) অর্থাৎ বিয়ে করলে চোখ এদিক ওদিক লাগামহীনভাবে তাকানো থেকে এবং যৌন ক্ষমতা অপচয় ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা পায়।
পাত্র বা পাত্রীর দ্বীনদারী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে
(আরবী*************************************)
১৩২.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ চারটে জিনিসের ভিত্তিতে কোন মেয়েকে বিয়ে করা হয়। মেয়ের ধনসম্পদের প্রাচুর্য, তার বংশীয় সম্ভ্রান্ততা ও মর্যাদা, তার সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী। তবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাও দ্বীনদার নারী লাভ করাকে। তোমার কল্যাণ হোক। (বোখারী, মুসলিম)
হাদিসটির তাৎপর্য এই যে, পাত্রী নির্বাচনে সাধারণত এই চারটে জিনিস দেখা হয়। কেউ পাত্রীর বিত্ত বৈভব ও ধনসম্পদ দেখে, কেউ দেখে তার সামাজিক ও বংশীয় মর্যাদা, কেউ তার বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্যের কারণে বিয়ে করে, আবার কেউ তার দ্বীনদারীকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু রাসূল (সা) মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পাত্রীর খোদাভীতি ও ধার্মিকতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও অগ্রগণ্যতা দিতে হবে। দ্বীনদারী ও খোদাভীতির সাথে যদি অন্য সব গুণাবলীও সমাবেশ ঘটে, তাহলে তো খুবই ভাল কথা। দ্বীনদারীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা শুধু ধনসম্পদ ও রূপ সৌন্দর্যের ভিত্তিতে বিয়ে করা মুসলমানের কাজ নয়।
দ্বীনদার মেয়ে কালো হলেও ভাল
(আরবী********************************)
১৩৩.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তোমরা কেবল সৌন্দর্যের জন্য নারীদেরকে বিয়ে করো না। কেননা এই সৌন্দর্য তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কেবল ধন সম্পদের জন্যও তাদেরকে বিয়ে করো না। কেননা তাদের ধনসম্পদ তাদেরকে অহংকারী বানিয়ে দিতে পারে। বরঞ্চ দ্বীনদারীর ভিত্তিতে তাদেরকে বিয়ে কর। মনে রেখ একটা কালো বাদীও যদি দ্বীনদার হয়, হবে সে আল্লাহর চোখে সুন্দরী সম্ভ্রান্ত অধার্মিক নারীর চেয়ে উত্তম। (মুনতাকা)
দ্বীনদারী ও সচ্চরিত্র পাত্র নির্বাচন না করলে অরাজকতা দেখা দেবে
(আরবী***********************************************)
১৩৪.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যখন তোমাদের কাছে এমন কোন পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়, যার চরিত্র ও দ্বীনদারীর ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট, তখন তাকে তোমরা বিয়ে দাও। অন্যথায় দেশে ফেতনা ও মারাত্ন্যক অরাজকতা দেখা দেবে। (তিরমিযি)
এ হাদীস প্রথমোক্ত হাদীসের বক্তব্যের সমার্থক। রাসূলুল্লাহ(সা) এর বক্তব্য এই যে, বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারী ও সচ্চরিত্রই আসল বিবেচ্য বিষয়। এটা বিবেচনায় না এনে কেবল ধনসম্পদ ও পারিবারিক মর্যাদাই যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে এ দ্বারা মুসলিম সমাজে মারাত্নক বিপর্যয় দেখা দেবে। যারা এতটা দুনিয়া পূজারী হয়ে যায় যে, তাদের চোখে দ্বীনদারীর গুরুত্ব থাকে না এবং ধনসম্পদ ও বিত্তবৈভবই তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তারা সমাজে ইসলামের বিস্তার ও প্রসারের চিন্তা কিভাবে করবে?রাসূল(সা) এ হাদীসে ফেতনা ও ফ্যাসাদ শব্দ দ্বারা এ অবস্থাই বুঝিয়েছেন।
বিয়ে শাদীতে তাশাহহুদ (খুতবা) পড়া
(আরবী***********************************)
১৩৫.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল(সা) আমাদেরকে নামাযের তাশাহহুদও শিখিয়েছেন, বিয়ের তাশাহহুদও শিখিয়েছেন। ইবনে মাসউদ নামাযের তাশাহুদ উল্লেখ করার পর বলেন, বিয়ের তাশাহুদ হচ্ছে এই (মুল হাদীসে দ্রষ্টব্য অনুবাদ এরুপঃ)
সকল কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। আমরা শুধু তারই কাছে সাহায্য চাই, তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিজের অন্যায় অনাচার থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। যাকে আল্লাহ হেদায়াত করেন তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারে না। আর যাকে আল্লাহ বিপথগামী করেন তাকে কেউ হেদায়াত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল। এরপর তিনি তিনটে আয়াত পাঠ করতেন। যথা-(১) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথোচিতভাবে ভয় কর এবং পরিপূর্ণ মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না।
(২) হে মানব জাতি, তোমাদের সেই প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তা থেকে তার জোড়াকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই দুজন থেকে বহু নর ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন। আর তোমরা সেই আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের কাছ থেকে পাওনা দাবী করে থাক, আত্নীয় স্বজনের অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখ। মনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক।
(৩) হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করতে থাক এবং সঠিক কথা বলো। তা হলে আল্লাহ তোমাদের কাজকেও সঠিক বানিয়ে দেবেন। আর তোমাদের অনিচ্ছাকৃত গুনাহ মাফ করে দেবেন। আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সফলতা লাভ করবে। (তিরমিযি)
এ হাদীসে বিয়ের সময় পঠিত খুতবা শিখানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এ কথা বুঝানো যে বিয়ে শুধু আমোদ ফুর্তির নাম নয় বরং বিয়ে হচ্ছে একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পাদিত একটা চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা স্বীকার করে যে, আমরা দুজনে দুজনের সারা জীবনের সাথী ও সাহায্যকারী হয়ে গেলাম। এই চুক্তি সম্পাদনের সময় আল্লাহকে ও তার বান্দাদেরকে সাক্ষী করা হয়। এই খুতবার আয়াতগুলো তেকে সুস্পষ্ট ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে যে, এই চুক্তির বাস্তবায়নে যদি স্বামী বা স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় এবং চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না করা হয়। তা হলে তার ওপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এবং সে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। এই তিনটি আয়াতে ঈমান দারদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহর ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষা করার হুকুম দেয়া হয়েছে।
দেনমোহর
মোহর প্রদান করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে
(আরবী**************************************)
১৩৫.রাসূল(সা) বলেছেনঃ সেই শর্তটি পূরণ করা সর্বাধিক অগ্রগণ্য যার বলে তোমরা নারীর সতীত্বের মালিক হয়েছ। (অর্থাৎ মোহরানা) (বোখারী, মুসলিম, উকবা ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত)
মোহর ধার্যকরণে বাড়াবাড়ি বর্জনীয়
(আরবী******************************)
১৩৬. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেনঃ সাবধান তোমরা অত্যধিক পরিমাণে মোহর ধার্য্য করো না। কেননা এটা যদি দুনিয়ায় সম্মান ও আভিজাত্যের উপকরণ হতো এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন মুত্তাকী সুলভ কাজ হতো, তাহলে আল্লাহর নবীই সবচেয়ে বেশী পরিমাণে মোহর ধার্য করতেন। কিন্তু রাসূল (সা) ১২ উকিয়ার বেশী মোহর দিয়ে কোন স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন কিংবা কোন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই (তিরমিযি)
হযরত ওমর যে জিনিসটির প্রতিরোধ করতে চাইছেন তা হলো, পারিবারিক ও বংশীয় আভিজাত্যের দম্ভের কারণে লোকেরা এমন মোটা মোটা দাগে মোহর ধার্য করতো, যা দেয়ার সামর্থ্য তাদের থাকতো না। ফলে এই মোহর তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাড়াতো। তাই হযরত ওমর মুসলিম গোত্র ও ব্যক্তিগুলোকে এই আভিজাত্যের বড়াই জাহির করতে নিষেধ করেছেন। সাদাসিধে জীবন যাপনের শিক্ষা দিচ্ছেন এবং রাসূল (সা) এর বাস্তব জীবন যাপন প্রণালী তাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
এক উকিয়া হচ্ছে সাড়ে দশ তোলা রুপার সমান রাসূল (সা) স্বয়ং যে মহিলাকেই বিয়ে করেছেন বা নিজের কন্যাদের বিয়ে দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশী মোহর তিনি ধার্য করেননি। উম্মাতের জন্য এটা একটা বাস্তব দৃষ্টান্ত। তবে উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার মোহর ব্যতিক্রম। তাঁর মোহর ছিল অনেক বেশী। কেননা ঐ মোহর বাদশাহ নাজ্জাশী ধার্য করেছিলেন এবং তিনিই দিয়ে দিয়েছিলেন। আর বিয়েটি ছিল গায়েবী।
সর্বনিম্ন মোহর সর্বোত্তম
(আরবী*************************************)
১৩৭. উকবা বিন আমের (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন, সর্বোত্তম মোহর হচ্ছে সেটি, যা সবচেয়ে মামুলী তথা সবচেয়ে কম। (নাইলুল আওতার)
অর্থাৎ বেশী মোহর পরিবারে খুবই জটিলতার সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এমনও হয় যে, স্ত্রী থাকতে চায়না । স্বামীও রাখতে চায়না। অথচ তালাক দেয় না শুধু এই ভয়ে যে, তখন মোহর পরিশোধ করতে হবে যা তার সাধ্যতিত। এর ফলে উভয়ের জন্য বাড়ীটা জাহান্নামে পরিণত হয়।
বৌভাতে গরীবদের দাওয়াত দেয়া উচিত
(আরবী************************************************)
১৩৮.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ওলীমা বা বৌভাতে কেবল ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং গরীবদেরকে উপেক্ষা করা হয়, আর যে ব্যক্তি ওলীমার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো, সে আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করলো। (বোখারী, মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত) এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, ওলীমা বা বৌভাতের আয়োজন করা সুন্নত। আর যে বৌভাতে কেবল ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং গরীবদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় না, সেটা খারাপ বৌভাত। অনুরূপভাবে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা সুন্নাতের পরিপন্থী।
ফাসেকের দাওয়াত কবুল করা নিষিদ্ধ
(আরবী****************************************************)
১৩৯.ইমরান বিন হাসীন (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) ফাসেক তথা আল্লাহর অবাধ্য লোকদের দাওয়াত কবুল করতে নিষেধ করেছেন। (মেশকাত) ফাসেক হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যের সাথে অগ্রাহ্য করে এবং হালাল ও হারাম মানে না। এ ধরনের লোকের দাওয়াত খেতে যাওয়া উচিত নয়। যে ব্যক্তি ইসলামের অবমাননা করে তার দাওয়াত কবুল করে সম্মান বাড়ানো একজন একজন দ্বীনদার ব্যক্তির পক্ষে কিভাবে সম্ভব?বন্ধুর শত্রু বন্ধু হতে পারেনা। তবে তার দাওয়াত ভদ্র ও বিনয় ভাষায় ফিরিয়ে দেয়া উচিত।