ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ
অধ্যাপক গোলাম আযম
বইটির অডিও শুনুন
ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের জন্মকথা
‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ইংরেজী ‘সেকিউলারিজম’ শব্দেরই বাংলা অনুবাদ। গত আড়াই শত বছর থেকে এটা দুনিয়ার সর্বত্র একটি আদর্শের মর্যাদা লাভ করেছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম কামাল পাশাই তুরস্কে এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন। ইতিপূর্বে মুসলমানগণ এরূপ নির্লজ্জভাবে দুনিয়াময় প্রচার করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেছে বলে কোন নযীর পাওয়া যায় না। এমনকি যে পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে কায়েম হয়েছিল সেখানেও এক শ্রেণীর মুসলিম নামধারী প্রভাবশালী লোক ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকাশ্য সমর্থক। পাকিস্তানের ইতিহাস ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কলংকময় ইতিহাস। তাই এ মতবাদের জন্ম বৃত্তান্ত, প্রকৃত রূপ ও পরিণাম সম্পর্কে তথ্য ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনার প্রয়োজন।
ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়
ধর্মীয় প্রবণতাকে মানুষের ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে আল্লাহ ও রাসূলের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার নামই ধর্মনিরপেক্ষতা। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এর লক্ষ্য। সে হিসাবে এ মতবাদকে ধর্মহীনতা বলাই সমীচীন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের বিধান মেনে চলার বিরুদ্ধে এর কোন বিশেষ আপত্তি নেই বলে এ মহান “উদারতার” স্বীকৃতি স্বরূপ এর নাম ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা হয়েছে।
এ মতবাদ সরাসরি আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না বটে, কিন্তু আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে এর নিজস্ব ধারণা আছে। আল্লাহ নিজের প্রতি যতগুণই আরোপ করুন না কেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মাত্র কযেকটা গুণই স্বীকার করতে রাযী। তাদের মতে, আল্লাহ এ বিশ্বটা শুধু সৃষ্টি করেছেন, বড়জোর তিনি এ জড়জগতের নিয়ম কানুন (প্রাকৃতিক নিয়ম ) রচয়িতা। মানুষকেও না হয় তিনিই পয়দা করেছেন। তাঁকে পূজা অর্চনা করলে মৃত্যুর পর তা কোন কাজে লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে উন্নতি, শান্তি ও প্রগতির জন্য আল্লাহ বা রাসূলের কোন প্রয়োজন নেই। এটাই আল্লাহ সম্পর্কে বিশুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা।
সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা গোটা সমাজ জীবনকেই আল্লাহ এবং ধর্মের অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখাকে আদর্শ বলে মনে করে। তাদের মতে, ধর্ম নিতান্তই একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। দু’ বা ততোধিক মানুষের সকল প্রকার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে ধর্মকে অনধিকার প্রবেশ করতে দেয়া চলে না। কেননা সমাজ জীবনে ধর্মের প্রভাব সম্পূর্ণ প্রগতি বিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিচায়ক।
আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস
যদিও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোন আধুনিক সৃষ্টি নয়, তবুও একটি আদর্শ হিসাবে বর্তমানকালে এর প্রচার চলছে। একটি মতাদর্শ হিসাবে আধুনিক ও প্রগতিশীল বলেই এক শ্রেণীর নিকট এর সুনাম। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এ আধুনিক সংস্করণ প্রায় আড়াই শত বছর পূর্বে ইউরোপে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পনের শতাব্দীতে এর জন্ম হয় এবং আড়াইশত বছর সংগ্রামের পর আঠার শতাব্দীর প্রথমার্ধে তা বিজয়ী মতাদর্শ হিসাবে কায়েম হয়।
তৎকালীন ইউরোপের অবস্থা
যে ইউরোপ এর জন্মস্থান, সেখানকার তৎকালীন অবস্থার সঠিক ধারণা ব্যতীত ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস বুঝা অসম্ভব। পনের শতাব্দীতে ইউরোপে সবেমাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা শরু হয়েছে। সেকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই মুসলমানদের হাতে নেতৃত্ব ছিল। আজকাল যেমন উচ্চ জ্ঞান লাভ করার জন্য আমরা ইউরোপ ও আমেরিকার নিকট ধর্ণা দেই, চৌদ্দ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপবাসীদেরকেও তেমনি আলহামরা, কর্ডোভা ও গ্রানাডায় জ্ঞানের তালাশে ভীড় জমাতে হতো।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গ্রীক সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব যুগে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সপ্তম শতাব্দী থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায় মুসলিমদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হল। আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক বিভাগই মুসলিম সভ্যতার সৃষ্টি। পনের শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপ অজ্ঞতার অন্ধকারেই ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানের নিকট তাদের প্রথম হাতে খড়ি হয়। কিন্তু বারো শতাব্দীর পর থেকে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছেড়ে বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ব পুরুষের সাধনালব্ধ জ্ঞান সম্পদের উপর নির্ভর করে তাদের জীবন গতানুতিক ধারায় চলতে থাকে। অপরদিকে ইউরোপ যেটুকু জ্ঞানের আলো মুসলমানদের নিকট থেকে লাভ করেছিল তার ভিত্তিতে নতুন জ্ঞান সাধনায় তারা ক্রমেই অগ্রসর হতে লাগল।
সে সময় ইউরোপে খ্রিস্টান পাদ্রীদের শাসন ছিল। পাদ্রীরা ধর্মের নামে মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে রাজত্ব করছিল। অথচ তাদের নিকট আল্লাহর বিশুদ্ধ বাণীর অস্তিত্ব নেই বলে ষষ্ঠ শতাব্দীতেই কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। পাদ্রীরা খোদার নামে নিজেদের মত চালু করত। তারা মানুষের নিকট ধর্মের নামে নিরঙ্কুশ আনুগত্য দাবী করত এবং শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে থাকায় তারা গায়ের জোরেই আনুগত্য করত। জীবনের প্রত্যেক দিকে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে তারা সকল বিষয়েই নিজেদের মতামত জোর করে চাপিয়ে দিত।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের লড়াই
ইউরোপে যখন নতুন জ্ঞান সাধনার উন্মেষ হলো তখন পাদ্রীদের মনগড়া গবেষণাহীন মতামত গবেষকদের নিকট ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হল। সৃষ্টিজগতের রহস্য যতই উদঘাটিত হতে লাগল, পাদ্রীদের সাথে জ্ঞান সাধকদের মতবৈষম্য ততই প্রকট হয়ে উঠল। বিজ্ঞানীদের প্রত্যেকটি নতুন মত ক্ষমতাসীন পাদ্রীদের ভ্রান্তি প্রমাণ করে চলল। পাদ্রীগণ তখন অনন্যোপায় হয়ে ধর্মের দোহাই পাড়তে শুরু করল এবং শাসন শক্তি প্রয়োগ করে বেত্রাঘাত থেকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত অমানুষিক শাস্তি দ্বারা গবেষকদের শায়েস্তা করতে লাগল। গ্যালিলিওর ন্যায় শত শত জ্ঞান পিপাসী পাদ্রীদের এ খোদায়ী অস্বীকার করার পাপে চরম দন্ড ভোগ করল।
এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা হবার তাই হল। চিন্তা ও গবেষণাভিত্তিক জ্ঞানের অনুসন্ধানীদের উপর এ যুলুমের বিরুদ্ধে সুধীমন্ডলী ও চিন্তাশীলদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠল। পাদ্রীদের নিজস্ব মনগড়া মতামতের ভ্রান্তি যতই প্রমাণিত হল, ততই এ বিদ্রোহী শক্তি অধিকতর মযবুত হয়ে চলল। ধর্মের নামে পাদ্রীদের এ অধার্মিক আচরণ বিদ্রোহীদের মনে তীব্র ধর্মবিদ্বেষ সৃষ্টি করল। তারা ধর্মকে মানুষের পক্ষে সকল প্রকার মঙ্গলের বিরোধী বলে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বসল।
গীর্জা বনাম রাষ্ট্র
বিদ্রোহীরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে পাদ্রীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংগ্রাম ঘোষণা করল। পাদ্রীরা (গীর্জা) ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মান্ধ জনতার সহায়তায় রাজশক্তি নিয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। অন্যদিকে জীবনের সকল বিভাগ থেকে পাদ্রীদের উৎখাত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিদ্রোহীরা অগ্রসর হল। দীর্ঘ দু’শ বছর (ষোল ও সতর শতাব্দী ) ধরে এই ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলতে থাকে। এ সংগ্রাম ইতিহাসের ছাত্রদের নিকট ‘গীর্জা বনাম রাষ্ট্রের’ লড়াই নামে পরিচিত।
দীর্ঘ দু’শত বছরের অবিরাম সংগ্রামের দ্বারা একথা প্রমাণিত হল যে, ধর্মবিশ্বাসকে গায়ের জোরে ধ্বংস করা যায় না। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না তাদের মনে যেমন জোর করে বিশ্বাস সৃষ্টি করা যায় না, তেমনি বিশ্বাসীদেরকেও শক্তি প্রয়োগ দ্বারা অবিশ্বাসীতে পরিণত করা যায় না। দু’পক্ষই বিব্রত হয়ে পড়ল। অতঃপর সংস্কারবাদীদের নেতৃত্বে দু’পক্ষের মধ্যে আপোষ প্রচেষ্টা জোরদার হয়ে উঠে।
আপোষ প্রস্তাব
মার্টিন লূথারের নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলন ‘আপোষ আন্দোলন’ নামে খ্যাত। এ আন্দোলনের প্রস্তাব হল যে, ‘‘ধর্ম মানুষের ব্যক্তিতগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকুক এবং মানুষের ধর্মীয় দিকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চার্চের হাতে থাকুক। কিন্তু সমাজের পার্থিব জীবনের সকল দিকের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত থাকবে এবং পার্থিব কোন বিষয়েই চার্চের কোন প্রাধান্য থাকবে না। অবশ্য রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দকে চার্চের নিকটই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবার শপথ গ্রহণ করতে হবে।”
সকল দিক বিবেচনা করে এ প্রস্তাব উভয় পক্ষই গ্রহণ করতে রাজী হল। পাদ্রীরা নিজেদের অবস্থা সমন্ধে সচেতন ছিল। সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সমর্থন ছাড়া শুধু ধর্মান্ধ জনতার সাহায্যে যে নেতৃত্ব চলে না, তাও তারা বুঝতে পারল। বিশেষতঃ দু’শ বছর সংগ্রাম পরিচালনার পর তারা জয়ের আশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করল। বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালকদের চার্চে শপথ গ্রহণ করার প্রস্তাবে পাদ্রীদের কিছুটা ইজ্জত রক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে বলে তারা সসম্মানে ক্ষমতাচ্যুত হতে রাযী হল। অপরদিকে বিদ্রোহীরা যদিও ধর্মকে উৎখাত করার ব্রত নিয়েই জয়ের পথে এগিয়ে চলছিল তবুও তারা এ চিন্তা করেই এ আপোষ সম্মত হল যে, পার্থিব জীবনের কোন ক্ষেত্রেই যদি ধর্ম ও গীর্জা কোন প্রাধান্য না পায় তাহলে বিষদাঁতহীন এ সাপকে ভয় করার কোন কারণ নেই। তাই তারা চার্চকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত হল। রাষ্ট্র পরিচালকদের চার্চের নিকট শপথ গ্রহণ করায়ও ধর্মাদ্রোহীদের আপত্তি হল না। ক্ষমতাচ্যুত পাদ্রীদের এ অসহায় অবস্থায় এটুকু অপার্থিব এবং মূল্যহীন ঘুষ দিতে তারা কার্পণ্য করল না।
চিন্তার বিষয়
এভাবে সমাজ জীবন থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করার ‘মহতী পরিকল্পনা’ দীর্ঘ সংগ্রামের পর পরম সাফল্য অর্জন করল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এই সাফল্যজনক আন্দোলন সম্পর্কে নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে :
(১) যে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনের সূচনা হয়, সেখানে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের প্রাধান্য ছিল। ইসলামের শিক্ষা সেখানে প্রবেশ লাভ করেনি। পার্থিব প্রয়োজনে বস্তুগত ও জড় জীবন সম্পর্কে ইউরোপ মুসলমানদের নিকট থেকে যথেষ্ট জ্ঞান আহরণ করেছিল – একথা ঐতিহাসিক সত্য, কিন্তু তারা ইসলামের শিক্ষা বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে মোটেই গ্রহণ করেনি। সে যুগ ছিল মুসলমাদের পতনের যুগ। সে পতনের কারণ, তারা ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে দুনিয়ায় কায়েম রাখার দায়িত্ব পালন করেনি। যদিও সেকালের মুসলমানদের ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিকে উত্তরাধিকার সূত্রে ইসলামের প্রভাব যথেষ্ট ছিল তবুও তা এমন একটা সজীব ও আকর্ষণীয় শক্তি হিসাবে অবশিষ্ট ছিল না যে, ইউরোপবাসীকে তা আকৃষ্ট করতে পারে। মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানীরা যদি তাদের ইউরোপীয় শাগরিদদের নিকট ইসলামকে একটি সুষ্ঠু জীবন বিধান হিসাবে পেশ করতেন তাহলে ইউরোপের নব জাগরণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারত। এতে খ্রিস্টান পাদ্রীদের মনগড়া ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ইসলামী জীবন ব্যবস্থারই রূপায়ন হয়ত অসম্ভব ছিল না।
(২) খ্রিস্টান পাদ্রীদের নিকট আল্লাহর বিধান ছিল না। তারা ধর্মের নামে যা প্রচার করত তা আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ছিল না। তারা গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের উপর নিজেদের ধর্মীয় মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ফলে তাদের মতবাদের সূত্রসমূহ যখন ভ্রান্ত ও সন্দেহজনক বলে প্রমাণিত হতে শুরু করল তখন মূল ধর্মই অস্বীকৃত হল বলে তারা মনে করে বসল।
সুতরাং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তারা নতুন শিক্ষা ও আন্দোলনের বিরোধিতা করতে লাগল এবং এ ব্যাপারে তারা যুক্তি ত্যাগ করে শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করল। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের এ সংগ্রাম ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না, পাদ্রীদের বিরুদ্ধেই বিজ্ঞানের বিদ্রোহ ছিল। কিন্তু নতুন জ্ঞান সাধকেরা সঠিক ধর্ম সমন্ধে অজ্ঞ ছিল বলে তারা ধর্মের বিরুদ্ধেই জিহাদ ঘোষণা করে বসল। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হল যে এতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে ইসলামের কোন সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়নি।
(৩) এ পর্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞান যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে যত কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তার কোনটাই আল্লাহ ও রাসূলের কোন সিদ্ধান্তকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারেনি। যে কয়টি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইসলামের নীতি বিরোধী বলে মনে হচ্ছে তা এখনও থিওরীর পর্যায়েই রয়েছে। বাস্তব তথ্য দ্বারা অকাট্যরূপে কোনটাই প্রমাণিত হয়নি।
মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
উপরোক্ত তিনটি মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার সাধ্য কারোর নেই। তবুও মুসলিম দুনিয়ায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার কেমন করে হল? আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর মুসলিম সর্বত্র ইসলামকেও পাদ্রীদের ধর্মের ন্যায় উন্নতি ও প্রগতি বিরোধী মনে করছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায় :
১. মুসলিম বিশ্বে যারা জ্ঞান চর্চা করেছেন তাদের অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে অনেক অমুসলিম চিন্তানায়কের চেয়েও কম জানেন। তারা অনেক মোটা মোটা বই মুখস্থ করেছেন কিন্তু কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করার সুযোগ পাননি হয়তো-বা প্রয়োজনও বোধ করেননি। অপরদিকে মুসলমানদের মধ্যে যারা কুরআন ও হাদীসের গবেষণা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধ্যয়ন না করার ফলে এবং পার্থিব জীবনকে সর্বদিক দিয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করা সুযোগের অভাবে গোটা মুসলিম সমাজকে যোগ্য নেতৃত্ব দান করতে অক্ষম। দীর্ঘকাল অনৈসলামী শাসনের ফলে ইসলামী মন-মগজ ও চরিত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্ব জীবনের সকল দিক থেকেই উৎখাত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। ফলে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ অথচ ইসলামী মন-মস্তিষ্ক শূন্য মুসলমানদের নেতৃত্বই প্রতিষ্ঠা লাভ করল। এ নেতৃত্বের পক্ষে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা এবং যে কোন পন্থায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠার পথ মুক্ত করার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হওয়া মোটেই বিস্ময়কর নয়।
২. মানব সভ্যতার ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, জ্ঞান সাধনা, তথ্যনুসন্ধান ও চিন্তা গবেষণার ইঞ্জিনই বিশ্বের এই বিরাট গাড়ীখানাকে টেনে নিয়ে চলছে। চিন্তানায়ক সাধকরাই উক্ত ইঞ্জিনের পরিচালক। তাদের মর্জি অনুযায়ী গোটা গাড়ীর সকল যাত্রীকেই চলতে হয়। যদ্দিন মুসলমান জাতি চিন্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তদ্দিন ইসলামী চিন্তাধারাই মানব জাতিকে প্রভাবান্বিত করেছিল। সত্য ও মিথ্যা, সুন্দর ও অসুন্দর, ভাল ও মন্দের ইসলামী মাপকাঠিই তখন একমাত্র গ্রহণযোগ্য ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনের ফলে বর্তমান খোদাহীন চিন্তাধারার বন্যার মুখে ইসলামী জ্ঞান বঞ্চিত মুসলিমদের ভেসে যাওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই পাশ্চাত্যের নেতৃত্বে আধুনিক জ্ঞান সাধনার যে ইঞ্জিন দুর্বার গতিতে মানবজাতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাতে মুসলিম নামধারীদের এমনকি ধার্মিক বলে পরিচিত বহু মুসলমানেরর প্রভান্বিত হওয়া বিস্ময়কর নয়।
চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণ দাসত্ব মুসলিম নেতৃত্বকে পঙ্গু করে রেখেছে। তারা ইউরোপের উস্তাদদের নিকট নৈতিক ও মানসিক আত্মা বিক্রয়ের মাধ্যমে বিশ্বস্ত শাগরিদের ন্যায় পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ করে চলেছেন। তাদের স্বাধীন মন মগজ বা চক্ষু আছে বলে মনে হয় না। তারা পাশ্চাত্যের চক্ষু দ্বারা সুন্দর অসুন্দরের সিদ্ধান্ত নেন; ইউরোপের মগজ দিয়ে উন্নতি অবনতির হিসাব করেন এবং উস্তাদদের মন দিয়েই ভালমন্দের বিচার করেন।
ইউরোপের এসব মানস সন্তানগণ যদি মানসিক দাসত্ব ত্যাগ না করেন তাহলে একদিন রাজনৈতিক দাসত্বই এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোর উপর নেমে আসবে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলো আজ এ কারণেই বিভিন্ন জাতির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোলামে পরিণত হতে চলেছে।
যুক্তির মানদন্ডে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ইতিহাস পাঠ করে কারো এ ধারণা করা উচিত নয় যে, পনের শতাব্দীর পূর্বে কোন কালেই এ মতবাদ দুনিয়ার প্রচলিত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে পূর্ণাঙ্গ ধর্মের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের লড়াই চিরন্তন। যখনই আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান মানব সমাজে কায়েম করার উদ্দেশ্যে নবী ও রাসূলগণ আওয়াজ তুলেছেন তখনই শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে নানা অজুহাতে প্রবল বিরোধিতা হয়েছে। ইব্রাহীম (আ) এর সময় নমরুদ ও মূসা (আ) এর সময় ফিরআউন কঠোরভাবে পূর্ণাঙ্গ ধর্মের বিরোধিতা করেছে। অথচ তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে স্বীকার করত। ধর্মকে কোন সময়ই তারা অস্বীকার করেনি। নমরুদের দরাবরে রাজ পুরোহিত ছিল ইব্রাহীম (আ) এর পিতা আযর। আল্লাহকে ও ধর্মকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিচালক শক্তি হিসাবে গ্রহণ করতে তারা কিছুতেই রাজী ছিলনা। সুতরাং আধুনিক পরিভাষায় তাদেরকেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীই বলতে হবে। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর যুগে আবু লাহাব এবং আবু জেহেল ধর্মনিরপেক্ষতাদীই ছিল।