অধ্যায় ০৬ : ইসলামপন্থীদের সংকট
বাংলাদেশ আন্দোলনে ইসলামপন্থীদের সংকট
যারা মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিল এবং যারা চেয়েছিল যে, দেশে আল্লাহর আইন ও রাসূলের প্রদর্শিত সমাজ ব্যবস্থা চালু হোক, তারা আরও বড় সংকটের সম্মুখীন হলো। তারা তো স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্ত্রের বিরোধী ছিল। তদুপরি স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রী চেহারা তাদেরকে চরমভাবে আতংকিত কর তুলল। তারা মনে করল যে, ইসলামের নামে পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্ত্বেও যখন ইসলাম বিজয়ী হতে পারল না, তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা যদি ভারতের সাহয্যে কোন রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে, তাহলে সেখানে ইসলামের বিজয় কি করে সম্ভব হবে?
ভারতে মুসলমানদের যে দুর্দশা যাচ্ছে, তাতে ভারতের সাহায্য বাংলাদেশ কায়েম হলে এখানেও কোন দুরবস্থা নেমে আসে, সে আশাংকাও তাদের মনে কম ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যদি শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের শ্লোগান তুললেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা যদি তারা না হতেন এবং ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া যদি আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হতেন, তাহলে ইসলাম পন্থীদের পক্ষে ঐ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা খুবই স্বাভাবিক ও সহজ হতো।
ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থীদের ভূমিকা
ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থীরা উভয় সংকটে পড়ে গেল। যদিও তারা ইয়াহইয়া সরকারের সন্ত্রাসবাদী দমনীতিকে দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করতেন, তবুও এর প্রকাশ্য বিরোধিতা করার কোন সাধ্য তাদের ছিল না। বিরোধীতা করতে হলে তাদের নেতৃস্থানীয়দেরকেও অন্যায়ের মতো ভারতে চলে যেতে হতো-যা তাদের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব ছিল।
তারা একদিকে দেখতে পেল যে, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ করে ইয়াহইয়া সরকারকে বিব্রত করার জন্য কোন গ্রামে রাতে আশ্রয় নিয়ে কোন পুল না থাকায় বোমা ফেলেছে, আর সকালে পাক বাহিনী যেয়ে ঐ গ্রামটাই জ্বালিয়ে দিয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা রাতে বাড়ীতে উঠলে পরদিন ঐ বাড়ীতেই সেনাবাহিনীর হামলা হয়ে যায়। এভাবে জনগণ এক চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলো। ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থীরা শান্তি কমিটি কায়েম করে সামরিক সরকার ও অসহায় জনগণের মধ্যে যোগসূত্র কায়েম করার চেষ্টা করলেন, যাতে জনগণকে রক্ষা করা যায় এবং সমারিক সরকারকে যুলুম করা থেকে যথাসাধ্য ফিরিয়ে রাখা যায়। শান্তি কমিটির পক্ষে থেকে সামরিক শাসকদেরকে তাদের ভ্রান্তনীতি ও অন্যায় বাড়াবাড়ী থেকে ফিরাবার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে।
একথা ঠিক যে, শান্তি কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের সবার চারিত্রিক মান এক ছিল না। তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যারা সুযোগ মতো অন্যায়ভাবে বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করেছে।
অধ্যায় ০৭ : ৭১-এ জামায়াতের ভূমিকা
জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা
ইসলামের নামে পাকিস্তান কায়েম হলেও পাকিস্তানের কোন সরকারই ইলামের ভিত্তিতে দেশকে গড়ে তুলবার কোন চেষ্টা করেনি। জামায়াতে ইসলামী যেহেতু ইসলামকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে একটি বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচি অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল, সেহেতু কোন সরকারই জামায়াতকে সুনজরে দেখেনি।
তদুপরি ইসলামেরই নীতি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য জামায়াতে ইসলামী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৬২ সারে আইয়ুব খানের সামরিক আইন তুলে নেবার পর আইয়ুবের তথাকথিথ মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলেছিল, তাতে জামায়াত কোন দলের পেছনে ছিল না।
এভাবেই জামায়াতে ইসলামী আইন ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসনের জন্য নিষ্ঠার সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৬২ সাল থেকে ৬৯ পর্যন্ত আইয়ুব আমলের আট বছরের মধ্যে জামায়াত ইসলামী ছাড়া আর কোন দলকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়নি। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে জামায়াতকে বে-আইনী ঘোষণা করে ৯ মাস পর্যন্ত ৬০ জন নেতাকে বিনা বিচারে জেলে আটক রাখা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে সরকারের বে-আইনী ঘোষণাটি বাতিল হয়ে যায়।
জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস ইসলামী আদর্শ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পক্ষে একনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ সংগ্রামের গোরবময় ইতিহাস। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির ময়দানে যে ভূমিকা পালন করছে, তা সবার সামনেই আছে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা পাকিস্তান আমলে যেমন স্বীকৃত ছিল, তেমনি বর্তমানে সর্ব মহলে প্রশংসিত।
৭১-এ জামায়াতের ভূমিকা
জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমানের ভূমিকা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে জামায়াত আপোসহীন। দুনিয়ার কোন স্বার্থে জামায়াত কখনও আদর্শ বা নীতির সামন্যও বিসর্জন দেয়নি। এটুকু মূলকথা যারা উপলব্ধি করে, তাদের পক্ষে ৭১-এ জামায়াতের ভূমিকা বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।
প্রথমত, আদর্শগত কারণেই জামায়াতের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে ধারক ও বাহকগণের সহযোগী হওয়া সম্ভব ছিল না। যারা ইসলামকে একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান বলে সচেতনভাবে বিশ্বাস করে, তারা এ দুটো মতবাদকে তাদের ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী মনে করতে বাধ্য। অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেস দলের আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। জামায়াতে ইসলামী তখন থেকেই এ মতবাদের অসারতা বলিষ্ঠ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে। আর সমাজতন্ত্রের ভিত্তিই হলো ধর্মহীনতা।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের প্রতি ভারত সরকারের অতীত আচরণ থেকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে এদেশের এবং মুসলিম জনগণের বন্ধু মনে করাও কঠিন ছিল। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সংগত কারণেই তাদের যে আধিপত্য সৃষ্টি হবে এর পরিণাম মংগলজনক হতে পারে না বলেই জামায়াতের প্রবল আশাংকা ছিল।
তৃতীয়ত, জামায়াত একথা বিশ্বাস করত যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলে গোটা পাকিস্তানে এ অঞ্চলের প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হবে। তাই জনগণের হাতে ক্ষমতা বহাল করার আন্দোলনের মাধ্যমেই জামায়াত এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জন করতে চেয়েছিল।
চতুর্থত, জামায়াত বিশ্বাস করত যে, প্রতিবেশি সম্প্রসারণবাদী দেশটির বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এক রাষ্ট্রভুক্ত থাকাই সুবিধাজনক। আলাদা হয়ে গেলে ভারত সরকারের আধিপত্য রোধ করা পূর্বাঞ্চলের একার পক্ষে বেশি কঠিন হবে। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগলিক দিক দিয়ে বিচ্ছন্ন এবং ভারত দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় এ অঞ্চলের নিরপত্তা প্রশ্নটি জামায়াতের নিকট উদ্বেগের বিষয় ছিল।
পঞ্চমত, পাকিস্তান সরকারের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক পলিসির কারণে এ অঞ্চলে স্থানীয় পুঁজির বিকাশ আশানুরূপ হতে পারেনি। এ অবস্থায় এদেশটি ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খপ্পরে পড়লে আমরা অধিকতর শোষণ ও বঞ্চনার শিকার পরিণত হব বরে জামায়াত আশাংকা পোষণ করত।
জামায়াত একথা মনে করত যে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে ভারতের সাথে সমমর্যাদায় লেনদেন সম্ভব হবে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব জিনিস এখানে আমদানি করা হতো, আলাদা হবার পর সে সব ভারত থেকে নিতে হবে। কিন্তু এর বদলে ভারত আমাদের জিনিস সমপরিমাণে নিতে পারবে না। কারণ রফতানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের প্রয়োজন নেই। ফলে আমরা অসম বাণিজ্যের সমস্যায় পড়ব এবং এদেশ কার্যত ভারতের বাজারে পরিণত হবে।
ষষ্ঠত, জামায়াত পূর্ণাংগ ইসলামী সমাজ কায়েমের মাধ্যমেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা এবং সকল বৈষম্যের অবসান করতে চেয়েছিল। জামায়াতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে,আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম হলে বে-ইনসাফী, যুলুম ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের সত্যিকার মুক্তি আসবে।
এসব কারণে জামায়াতে ইসলামী তখন আলাদা হবার পক্ষে ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এদেশে যারাই জামায়াতের সাথে জড়িত ছিল, তারা বাস্তত সত্য হিসাবে বাংলাদেশকে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে মেনে নিয়েছে। আজ পর্যন্ত জামায়াতের লোকেরা এমন কোন আন্দোলন বা প্রচেষ্টার সাথে শরীক হয়নি যা বাংলাদেশর আনুগত্যের সামান্য বিরোধী বলেও বিবেচিত হতে পারে। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তারা বাস্তব কারণেই যোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তারা কোন প্রতিবেশী দেশের আশ্রয় পাবে না। তাই এ দেশকে বাঁচাবার জন্য জীবন দেয়া ছাড়া তাদের কোন বিকল্প পথ নেই।
জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিতে পূর্বপাকিস্তানের সমস্যা কী ছিল?
যে কোন সমস্যারই একাধিক বিশ্লেষণ হতে পারে এবং সমাধানের ব্যাপারেও আন্তরিকতার সাথেই মতপার্থক্য থাকতে পারে। জামায়াতে ইসলামী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সমসাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছে, তা যদি কেউ নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করে, তাহলে একথা উপলব্ধিকরা সহজ হবে যে, জামায়াত কেন বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করা প্রয়োজন মনে করেনি। এ বিষয়ে জামায়াতের সাথে কেউ একমত হোক বা না হোক, জামায়াতের দৃষ্টিভংগিকে ভালভাবে বুঝতে পারবে।
জামায়াত কখনও সুবিধাবাদের রাজনীতি করে না এবং কোন প্রকারে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিও জামায়াত করে না। ইসলামী জীবন বিধানকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যেই জামায়ত কাজ করে যাচ্ছে।
জামায়াত কখনও সুবিধাবাদের রাজনীতি করে না এবং কোন প্রকারে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিও জামায়াত করে না। ইসলামী জীবন বিধানকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যেই জামায়াত কাজ করে যাচ্ছে।
জামায়াত স্বল্পমেয়াদী কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে না বলে দেশকে ইসলামী আদর্শে গড়ে তুলবার যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী সৃষ্টি না করে ক্ষমতা গ্রহণে মোটেই আগ্রহী নয়। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জামায়াতের বিরুদ্ধে ৭১-এর ভূমিকা সম্পর্কে যত অপপ্রচারই চালন হোক, তাতে কারো কোন উপকার হবে না। যারা ধীরচিত্তে জামায়াতের দৃষ্টিভংগিকে বুঝতে চান, তাদের জন্যই এদেশের সমস্যা সম্পর্কে নিন্মরূপ বিশ্লেষণ পেশ করা হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান কায়েম হয়, তখন বর্তমান বাংলাদেশের এলাকা সবচাইতে অনুন্নত ছিল।
যেমন:
১। সশস্ত্র বাহিনীতে এ অঞ্চলে লোক ছিল না বললেই চলে।
২। পুলিশ বাহিনীতেও খুব কম লোকই ছিল। তাই ভারত থেকে যে সব মুসলমান পুলিশ অপশন দিয়ে এসেছিল, তারাই প্রথম দিকে থানাগুলো সামলিয়েছিল।
৩। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী মাত্র গুটিকয়েক ছিলেন।
৪। ২/৩ টা কাপড়ের কারখানা ছাড়া শিল্প কিছু ছিল না। এ এলাকার পটেই কোলকাতার পাটকল চলতো। এখানে পাটের কারখানা ছিল না।
৫। বিদেশের সাথে বাণিজ্য করার যোগ্য একটা সামুদ্রিক বন্দরও এখানে ছিল না।
৬। কোন মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল না।
৭। ঢাকা শহর একটা জেলা শহর ছিল মাত্র। প্রাদেশিক রাজধানীর অফিস ও কর্মচারীদের জন্য বাঁশের কলোনী তৈরী করতে হয়েছে। আর ইডেন মহিলা কলেজ বিল্ডিংকেই সেক্রেটারীয়েট (সচিবালয়) বানাতে হয়েছে। আর ইডেন মহিলা কলেজ বিল্ডিংকেই সেক্রেটারীয়েট (সচিবালয়) বানাতে হয়েছে।
অধ্যায় ০৮ : বংগভংগ ও পূর্ব বাংলার উন্নয়ন
বংগভংগ আন্দোলন
এ দুরবস্তার প্রধান কারণ এটাই ছিল যে, পূর্ব বাংলাকে বৃটিশ আমলে কোলকাতার পশ্চাদভূমি (হিন্টারল্যান্ড) বানিয়ে রাখা হয়েছিল। এখানকার চাউল, মাছ, মুরগী, ডিম, দুধ, পাট ও যাবতীয় কাঁচামাল কোলকাতার প্রয়োজন পূরণ হতো। তদুপরি শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি অমুসলিমদেরই কুক্ষিগত ছিল।
ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ও আসামের মুসলমানরা নিজেদের এলাকার ও এর অধিবাসীদের উন্নয়নের প্রয়োজনে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি আলাদা প্রদেশ করার আন্দোলন চালায়, যাতে কোলকাতার শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে এ এলাকাটি উন্নতি করতে পারে। এ দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করে ইংরেজ সরকার ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববংগ ও আসাম এলাকা নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে। ১৯০৬ সালে এ নতুন প্রাদেশিক রাজধানীতে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এ সম্মেলনে গোটা ভারতবর্ষের বড় বড় মুসলিম নেতা যোগদান করায় ঢাকার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
বংগভংগ বাতিল আন্দোলন
এ নতুন প্রদেশে মুসলমানদের প্রাধান্য, প্রভাব ও উন্নতির যে বিরাট সম্ভবনা দেখা দিল, তাতে কোলকাতার কায়েমী স্বার্থে তীব্র আগাত লাগল। অমুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্য পেশাজীবীগণ বাংলা-মায়ের দ্বিখন্ডিত হওয়ার বিরুদ্ধে চরম মায়াকান্না জুড়ে দিলেন। অখন্ড মায়ের দরদে তারা গোটা ভারতে তোলপার সৃষ্টি করলেন।
এ আন্দোলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাসূলে মতো কিছুসংখ্যক মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবী ও শরীক হয়ে অখন্ড বাংলার দোহাই দিয়ে বংগভংগের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়েন। এ আন্দোলনের পরিণামে ১৯১১ সালে বংগভংগ রহিত না হতো, তাহলে ১৯৪৭ সালে ঢাকাকে একটি উন্নত প্রাদেশিক রাজধানী হিসাবে এবং চট্টগ্রামকে পোর্ট হিসাবে রেডী পাওয়া যেত। তাছাড়া শিক্ষা ও চাকরিতে মুসলমানরা এগিয়ে যাবার সুযোগ এবং এ এলাকায় শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে উঠত।
মজার ব্যাপার এই যে, ১৯৪৭ সালে গোটা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসের প্রবল দাবিতে বৃটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করে পশ্চিশবংগকে ভারতের হাতে তুলে দিল। যে অমুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৯১১ সালে বংগভংগ রহিত করিয়েছিলেন, তারাই ১৯৪৭ সালে বংগভংগ করিয়ে ছাড়লেন। স্বার্থ বড় বালাই!
পূর্ব বাংলার উন্নয়ন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার পরই পূর্ববাংলার সার্বিক উন্নয়ন শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সিভিল, পুলিশ সার্ভিস ইত্যাদিতে মুসলমান অফিসার নিয়োগ শুরো হলো। অগনিত পদে মুসলিম যুবকরা ব্যাপকভাবে চাকরি পেতে লাগল। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীতেও বেশ সংখ্যায় লোক ভর্তি হবার সুযোগ এলো।
অপরদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ময়দানে অমুসলিমদের স্থানে মুসলিমদের অগ্রযাত্রা শুরু হলো। ভারত থেকে হিজরাত করে আসা লোকেরাই অমুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে বিনিময়ের ভিত্তিতে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করল। শিল্প-কারখানার পুঁজি এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে মুহাজিররাই এ এলাকার উন্নয়নে লেগে গেল।
যদি পাকিস্তান না হতো এবং আমরা যদি অখন্ড ভারতের অন্তর্ভুক্তই থাকতাম, তাহলে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোন রাস্ট্রের জন্ম হতো না। এ অবস্থায় এ এলাকার মুসলমানদের কী দশা হতো তা কি আমরা ভেবে দেখি? আজ যারা জেনারেল, তাদের কয়জন নন-কমিশন অফিসাররের উপর কোন স্থান দখল করার সুযোগ পেতেন? সেক্রেটারীর মর্যাদা নিয়ে আজ যারা সচিবালয়ে কর্তৃত্ব করছেন, তাদের কতজন সেকশন অফিসারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন? আজ যারা পুলিশের বড় কর্তা, তারা দারোগার বেশি হতে পারতেন কী?
মুসলিম নামের অধিকারী হয়েও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বড় বড় মর্যাদার আসন অলংকৃত করছেন, তাদের কি এ সুযোগ ঘটতো? ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের যে বাহিনী এখন বিদেশ পর্যন্ত বিরাট সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের মধ্যে শতকরা কতজন মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়াররিং-এ পড়ার সৌভাগ্য লাভ করতেন?
বাংলাদেশ এখন যেসব শিল্প-কারখানা রয়েছে পাকিস্তান না হলে তা কি সম্ভব হতো? আজ যারা বড় বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন, তারা মাড়োয়ারীদের দাপটে কি মাথা তুলতে পারতেন?
আজ বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে পরিচিত। পাকিস্তান হয়েছিল বলেই এটুকু পজিশন সম্ভব হয়েছে। তা না হলে আমরা ভারতের একটা প্রদেশের অংশ হয়েই থাকতে বাধ্য হতাম। একটা পৃথক প্রদেশের মর্যাদাও পেতাম না।
কেন সার্বিক উন্নয়ন হলো না?
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পূর্ব বংগের সার্বিক উন্নয়ন না হওয়ার জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারই প্রধানত দায়ী। ইংরেজ চলে যাবার পর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে যারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করলেন, তাদের মধ্যে পূর্ববপংগের কোন বড় কর্মকর্তা ছিল না। আর পাকিস্তান আন্দোলনের যেসব নেতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের মধ্যে পূর্ববংগের যারা প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তারা এত অনভিজ্ঞ ও দুর্বল ছিলেন যে, পূর্ববংগের উন্নয়নের ব্যাপারে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের যতটা করণীয় ছিল তার সামান্য কিছুই আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
বৃটিশ আমলে পূর্ববংগ চরমভাবে অবহেলিত থাকার দরুন এ অঞ্চল শিল্প-বাণিজ্য, সেচ প্রকল্প, বন্দর-সুবিধা, কৃষি-উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, পেশাগত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক অনুন্নত ছিল। এ অবস্থায় পূর্ববংগের উন্নয়নের প্রতি শুরু থেকেই বিশেষ মনোযোগ দেয়া কর্তব্য ছিল। এ কর্তব্য পালন করা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি এখানকার জনগণের এমন আস্থা সৃষ্টি হতো, যা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিক দৃঢ় করতে সক্ষম হতো।
পূর্ববংগের সার্বিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার জন্য শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমাদের নিজেদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতা ঢেকে রাখার যারা চেষ্টা করে আমরা তাদের সাথে একমত নই।
যারা নিজেদের পশ্চাদগামিতার জন্য শুধু অপরকে দোষী সাব্যস্ত করেই আপন দায়-দায়িত্ব শেষ করে, তারা নিজেদের দোষ ও ভুল দেখতে পায় না। তাদের পক্ষে সত্যিকার উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হয় না। পাকিস্তান হবার পর এ এলাকার জনগণের অবস্থার সার্বিক উন্নয়ন না হওয়া এবং যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা দ্রুত না হওয়ার জন্য পাকিস্তানীদের উপর দোষ চাপাবার প্রবণতা এত প্রবল ছিল যে, সব ব্যাপারেই শুধু পশ্চিমের শোষণের দোহাই দেয়া হতো।
নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ন্যায্য অধিকার আদায়ের যোগ্যতা না থাকলে এক মায়ের পেটের ভাই-এর কাছেও ঠকতে হয়। যে ভাই ঠকায়, সে নিশ্চয়ই দোষী।
কিন্তু সে তার স্বার্থ যেমন বুঝে নিচ্ছে, অপর ভাইও যদি নিজের অধিকার আদায় করার যোগ্যতা হয়, তাহলে আর ঠকতে হয় না।
আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল নি:স্বার্থ, জনদরদী, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। পূর্ব পাকিস্তানের উপর যত অবিচার হয়েছে এর জন্য প্রধানত দায়ী এখানকার ঐসব নেতা, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের শরীক থেকেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেননি। বিশেষ করে আইয়ুব আমলে যারা মন্ত্রিত্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ পেয়ে গণতন্ত্রের বদলে একনায়কত্বকে সমর্থন করেছিলেন, তারা এদেশের জনগণকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাথে সাথে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পংগু করে রাখার জন্যও বিশেষভাবে দায়ী।
নওয়াব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের জন্য যারা শুধু লর্ড ক্লাইভকে গালি দেয়, তাদের সাথে একমত হওয়া যায় না। ক্লাইভ তার জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। মীর জাফরের স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দরুনই যে আমরা পরাধীন হয়েছিলাম, তা থেকে শিক্ষা আজও আমরা নিচ্ছি না। পশ্চিম পাকিস্তানের “ক্লাইভদের” চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের “মীরজাফররাই” যে আমাদের অবনতির জন্য অধিকতর দায়ী, সে কথা উপলব্ধি না করার ফলে আজও আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
নি:স্বার্থ নেতৃত্বের অভাব
সত্যিকার আদর্শবান, নি:স্বার্থ, জনদরদী, চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব দূর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অবস্থার উন্নতি হতে পারে না। আমাদের দেশে কোন পলিটিকেল সিস্টেম গড়ে ওঠার লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এখানে রাজনীতি করা মানে যে-কোন উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা। দলীয় নেতৃত্বের আসন দখল রাজনৈতিক দল গঠনের একমাত্র লক্ষ্য। ঐ আসন বেদখল হয়ে গেলে দল ভেংগে হলেও নেতা হবার নীতি এদেশে প্রচলিত হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের শ্লোগান আমাদের দেশে একনায়করাই বেশি জোর দিয়ে থাকে। কারণ, রাজনৈতিক পরিবেশ আছে বলেই সেনাপতিরাও ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করার ডাক দিলে গণতন্ত্রের বহু তথাকথিত ধ্বজাধারী একনায়ককেই গণতন্ত্রের নায়ক হিসাবে মেনে নেয়।
নি:স্বার্থ নেতৃত্বে থাকলে জনগণের সব অধিকারই অর্জন করা সম্ভব হতো। আর ঐ জিনিসের অভাব থাকায় বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।
নি:স্বার্থ নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন:
১। নিষ্ঠার সাথে গণতন্ত্রের আদর্শ মেনে চলার অভ্যাস।
২। সরকারী ও বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন।
৩। দেশ শাসনের উদ্দেশ্যে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলবার ব্যবস্থা।
৪। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান।
৫। যারা বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করে, তাদেরকে গণতন্ত্রের দুশমন মনে করা এবং তাদের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করা।
অধ্যায় ০৯ : এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্ষক কারা?
বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন দেশ হিসাবে কায়েম হবার দেড় যুগ পরেও যারা ’৭১-এর ভূমিকার কারণে যারা এদেশে ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থী হিসাবে চিহ্নিত, তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হবার পর এমন কোন কাজ হয়েছে কি, যা এদেশের স্বাধীনতার সামান্য বিরোধী বলে প্রমাণ করা যায়? একথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, এদেশের স্বাধীনতার উপর যদি কোথাও থেকে আঘাত আসে, তা একমাত্র ভারত থেকেই আসতে পারে। দেশের চারপাশে যদি ভারত ছাড়া আরও কয়েকটি দেশ থাক, তাহলে এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণের সুযোগ হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকার কারণে যারা এ বাস্তবতা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখতে চান, তারা জনগণ থেকে ভিন্ন চিন্তা করেন। জনগণকে বাদ দিয়ে দেশরক্ষা সম্ভব নয়। নি:সন্দেহে এদেশের জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না। তাদের কোন আচরণই বন্ধুসুলভ বলে প্রমাণিত নয়। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকাকেও এদেশের মংগলের নিয়তে পালন করা হয়েছে বলে জনগণ বিশ্বাস করে না।
সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্যই হলো প্রতিরক্ষা বা ডিফেন্স। “ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম” বা “কার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা” প্রশ্নটি আপনিই মনে জাগে। যেহেতু একমাত্র ভারত থেকেই আক্রমণের সম্ভবনা, সেহেতু এ প্রশ্নের জওয়াবও একটাই।
তাছাড়া শুধু সশস্ত্র বাহিনী দিয়েই দেশ রক্ষা হয় না। জনগণ যদি সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে না দাঁড়ায়, তাহলে সে বাহিনী কিছুতেই প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারে না। জনগণও একথা বিশ্বাস করে যে, এদেশের স্বাধীনতা তাদের হাতেই নিরাপদ, যারা ভারতকে আপন মনে করে না এবং ভারতও এদেশে যাদেরকে তার আপন মনে করে না। তাই ’৭১-এর ভূমিকা দ্বারা যারা এদেশে ভারতের বন্ধু নয় বলে প্রমাণিত, তারা জনগণের আস্থাভাজনই আছে। যারা বিশেষ রাজনৈতিক গরজে তাদের বিরুদ্ধে বিষাদগার করেছেন, তারা এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে কোন সমর্থন যোগার করতে পারবেন না।
এদেশের জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না বলেই রাশিয়াকেও আপন মনে করে না। কারণ, রাশিয়ার নীতি সব সময়ই ভারতের পক্ষে দেখা গেছে। তাছাড়া, রুশ-দূতাবাসের কার্যকলাপ সম্পর্কে মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তাতে তাদের সম্পর্কে সুধারণা সৃষ্টি হওয়ার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে আফগানিস্তানে রাশিয়ার নির্লজ্জ ভূমিকা গণমনে তীব্র ঘৃণাই সৃষ্টি করেছে।
এদেশে জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না বলেই রাশিয়াকেও আপন মনে করে না। কারণ, রাশিয়ার নীতি সব সময়ই ভারতের পক্ষে দেখা গেছে। তাছাড়া, রুশ-দূতাবাসের কার্যকলাপ সম্পর্কে মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তাতে তাদের সম্পর্কে সুধারণা সৃষ্টি হওয়ার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে আফগানিস্তানে রাশিয়ার নির্লজ্জ ভূমিকা গণমনে তীব্র ঘৃণাই সৃষ্টি করেছে।
এদেশে কারা রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকাকে সমর্থন করে এবং কারা ভারতের নিন্দনীয় ভূমিকাকে নীরব সমর্থন করে এবং কারা ভারতের নিন্দনীয় ভূমিকাকে নীরবে সমর্থন করে, তা কোন গোপনীয় ব্যাপার নয়। সুতরাং তারা যখন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ’৭১-এর ভূমিকার দোহাই দিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়, তখন তাদের নিজেদের হীন মতলবই ফাঁস হয়ে পড়ে। তাদের এ চিৎকাররের অর্থ দেশপ্রেমিক জনগণের বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
এদেশের জনগণ একথা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করে যে, ’৭১-এর যারা ভারতবিরোধী বলে প্রমাণিত হয়েছে, তারা কোন অবস্থায়ই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উপর কোন হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না। আর যারা এদেশে ইসলামকে বিজয়ী দেখতে চায়, তারাই দেশরক্ষার জন্য প্রাণ দেবার বেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং ’৭১-এর ভূমিকার ভিত্তিতে তাদের দেশপ্রেমকে যারা কটাক্ষ করে, তারা প্রতিবেশী দেশের সম্প্রসারণবাদী সরকারের বন্ধু বলেই জনগণের নিকট বিবেচিত হবে।
আর একটা বাস্তবতা হলো এই যে, এদেশে কোন গৃহযুদ্ধ লাগলেও যারা ভারতের কোন আশ্রয় আশা করে না, তারাই এদেশকে রক্ষা করবে। যাদের আর কোথাও যাবার পথই নেই, তারাই মরিয়া হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসবে। কারণ, এছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই। তাদের জীবন ও মরণ এদেশেই নির্ধারিত যারা সব সময় ভারতের আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরোধী তাদেরকেই জনগণ এদেশে স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক বলে মনে করে। দেশে কোন বড় রকমের রাজনৈতিক আশ্রয় পান, তারা কী করে আশ্রয়দাতা দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন? এদেশ ছাড়াও যাদের আশ্রয় আছে, তার কি এদেশের হিফাযত করতে পারবেন?
’৭১-এর রাজনৈতিক মতপার্থক্য এখন অবান্তর। তখন এমন এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, দেশপ্রেমিকদের মধ্যে দেশের কল্যাণ কোন পথে সে বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে গেল। এক পক্ষ মনে করল যে, পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া ছাড়া মুক্তি নেই। অপর পক্ষ মনে করল যে, পৃথক হলে ভারতের খপ্পরে পড়তে হবে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে “পাঞ্জাবের দালাল” আর “ভাতের দালাল” মনে করত। কিন্তু এসব গালি দ্বারা কোন পক্ষের দেশপ্রেমই মিথ্যা হয়ে যায় না। ঐ সময়কার দু:খজনক মতবিরোধকে ভিত্তি করে যদি এখনও বিভেদ জারী রাখা হয়, তাহলে জাতি হিসাবে আমরা ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে।
শেষ কথা
দুনিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হবার পর সব ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিজেদের জন্মভূমিতে সাধ্যমত ইসলামের খেদমত করার চেষ্টা করছে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার ধ্বনি স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৭ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ খতম করে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও দৃঢ় আস্থা এবং সমাজতন্ত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা সংবিধানে সন্নিবেশিত করার পর জনগণ রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানাবার ফলে ইসলামপন্থী দলগুলো বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য শাসনতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এদেশের মুসলমানদের জন্য তাদের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্ব সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটা এলাকা। আর কোন মুসলিম দেশ এমন বিচ্ছন্ন অবস্থায় নেই। তদুপরি আমাদের এ প্রিয় জন্মভূমিটি এমন একটি দেশ দ্বারা বেষ্টিত, যাকে আপন মনে করা মুশকিল। তাই এদেশের আযাদীর হিফাযত করা সহজ ব্যাপার নয়। জনগণ এ ক্ষেত্রে একেবারেই বন্ধুহীন। আশপাশ থেকে সামান্য সাহায্য পাওয়ারও কোন আশা করা যায় না। এ দেশবাসীকে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজেদের শক্তি নিয়েই প্রতিরক্ষার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে।
যে কোন জাতির আদর্শ ও বিশ্বাসই তার শক্তির উৎস হবে। সুতরাং এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনাদর্শ ইসলামই স্বাধীনতার আসল গ্যারান্টি। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী সকলেই এ মহান উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। তাই জনগনের নিকট তাদের চেয়ে বেশী আপন আর কেউ হতে পারে না।
অধ্যায় ১০ : যারা বাংলাদেশ আন্দোলনে শরীক হয়নি তার কি স্বাধীনতা বিরোধী ছিল?
যারা বাংলাদেশ আন্দোলনে শরীক হয়নি তার কি স্বাধীনতা বিরোধী ছিল?
১৯৭০এর নির্বাচনের দীর্ঘ অভিযানে যে, “আমরা ইসলাম বিরোধী নই” এবং “আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাই না”। জনগণ তাকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। পাকিস্তান থেকে বিচ্চিন্ন হবার কোন মেন্ডট তিনি নেননি। নির্বাচনের পরও এ জাতীয় সুষ্পষ্ট কোন ঘোষণা তিনি দেননি।
তাই ১৯৭১-এর যারা বাংলাদেশ আন্দোলনে শরীক হয়নি, তারা দেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল না। ভারতের স্বাধীন হবার ভয় এবং ধর্মনিরপেক্ষাতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের খপ্পরে পড়ার আশংকই তাদেরকে ঐ আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য ছিল। তারা রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজে লিপ্ত ছিল না বা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করেনি। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কাজ করেছে। তাই আইনগত ভাবে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
নৈতিক বিচারে ব্যক্তিগতভাবে যারা নরহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অন্যান্য অন্যায় করেছে, তারা অবশ্যই নরপশু। যাদের চরিত্র এ জাতের, তারা আজও ঐসব করে বেড়াচ্ছে। পাক সেনাবাহিনীর যারা এ জাতীয় কুকর্মে লিপ্ত হয়েছিল, তারাও নরপশুদেরই অন্তর্ভুক্ত। যাদের কোন ধর্মবোধ, নৈতিক চেতনা ও চরিত্রবল নেই, তারা এক পৃথক শ্রেণী। পাঞ্জাবী হোক আর বাংগালী হোক, এ জাতীয় লোকের আচরণ একই হয়।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও স্বাধীনতাবিরোধী হওয়া এক কথা নয়
অবিভক্ত ভারত থেকে ইংরেজ বিতাড়নের আন্দোলনে কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগের মতবিরোধকে কতক কংগ্রেস নেতা স্বাধীনতার বিরোধী বলে প্রচার করত। কংগ্রেস হিন্দু-মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাবী করতো এবং গোটা ভারতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ জানত যে, কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে ইংরেজের গোলামী থেকে মুক্তি পেয়েও মুসলমানদেরকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের অধীন থাকতে হবে। তাই ঐ স্বাধীনতা দ্বারা মুসলমানদের মুক্তি আসবে না। তাই মুসলিম লীগ পৃথকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন চালালো এবং ভারত বিভাগ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাকিস্তান দাবী করল। ফলে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন একই সংগে ইংরেজ ও কংগ্রেসের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেল।
কংগ্রেস নেতারা তারস্বরে মুসলিম লীগ নেতাদেরকে ইংরেজের দালাল ও দেশের স্বাধীনতার দুশমন বলে গালি দিতে লাগল। কংগ্রেসের পরিকল্পিত স্বাধীনতাকে স্বীকার না করায় লীগকে স্বাধীনতার বিরোধী বলাটা রাজনৈতিক গালি হতে পারে, কিন্তু বাস্তব সত্য হতে পারে না।
ঠিক তেমনি যে পরিস্থিতিতে ভারতের আশ্রয়ে বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল,সে পরিবেশে যারা ঐ আন্দোলনকে সত্যিকার স্বাধীনতা আন্দোলন বলে বিশ্বাস করতে পারেনি, তাদেরকে স্বাধীনতার দুশমন বলে গালি দেয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যতই প্রয়োজনীয় মনে করা হোক, বাস্তব সত্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
বিশেষ করে স্বাধীনতার নামে প্রদত্ত শ্লোগানগুলোর ধরন দেখে ইসলামপন্থীরা ধারণ করতে বাধ্য হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশ বানাতে চায়, তারা এদেশে ইসলামকে টিকতে দেবে না, এমনকি মুসলিম জাতীয়তাবোধ নিয়েও বাঁচতে দেবে না। সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাংগাল জাতীয়তাবাদের (মুসলিম জাতীয়তার বিকল্প) এমন তুফান প্রবাহিত হলো যে, মুসলিম চেতনাবোধসম্পন্ন সবাই আতংকিত হতে বাধ্য হলো। এমতাবস্থায় যারা ঐ স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারল না, তাদেরকে দেশের দুশমন মনে করা একমাত্র রাজনৈতিক হিংসারই পরিচায়ক। ঐ স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীন হবার আশাংকা যারা করেছিল, তাদেরকে দেশপ্রেমিক মনে না করা অত্যন্ত অযৌক্তিক।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও সাংবাদিক মরহুম আবুল মনসুর আহমদ দৈনিক ইত্তেফাক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় বলিষ্ঠ যুক্তিপূর্ন এত ছিল লিখে গেছেন, যা অন্য কেউ লিখলে হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহী বলে শাস্তি পেতে হতো। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে পরাজিত পক্ষকে বিজয়ী পক্ষ দেশদ্রোহী হিসাবে চিত্রিত করার চিরাচরিত প্রথা সাময়িকভাবে গুরুত্ব পেলেও স্থায়ীভাবে এ ধরনের অপবাদ টিকে থাকতে পারে না।
আজ এ কথা কে অস্বীকার করতে পারে যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবিদার কিছু নেতা ও দলকে দেশের জনগণ বর্তমান ভারতের দালাল বলে সন্দেহ করলেও বাংলাদেশ আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেনি, সে সব দল ও নেতাদের সম্পর্কে বর্তমানে এমন সন্দেহ কেউ প্রকাশ করে না যে, এরা অন্য কোন দেশের সহায়তায় এ দেশের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দিতে চায়।
তারা গোটা পাকিস্তানকে বিশ্বের বৃহত্তম মুসিলম রাষ্ট্র হিসাবে রক্ষা করা উচিত বলে বিবেচনা করেছিল। তাদের সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ পৃথক একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবার পর তারা নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যায়নি। যদি বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে ভৌগোলিক দিক দিয়ে ঘনিষ্ঠ হতো, তাহলেও না হয় এ সন্দেহ করার সম্ভবনা ছিল যে, তারা হয়তো আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ষড়যন্ত্রে করতে পারে। তাহলে তাদের ব্যাপারে আর কোন প্রকার সন্দেহের কারণ থাকতে পারে? বাংলাদেশকে স্বাধীন রাখা এবং এ দেশকে রক্ষা করার লড়াই করার গরজ তাদেরই বেশী থাকার কথা।
বাংলাদেশের নিরাপত্তার আশংকা একমাত্র ভারতের পক্ষ থেকেই হতে পারে। তাই যারা ভারতকে অকৃত্রিম বন্ধু মনে করে, তারাই হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। কিন্তু যারা ভারতের প্রতি অবিশ্বাসের দরুন ’৭১ সালে বাংলাদেশকে ভারতের সহায়তায় পৃথক রাষ্ট্র বানাবার পক্ষে ছিল না, তারাই ভারতের বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন দেবে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হওয়ার মানসিক, আদর্শিক ও ঈমানী প্রেরণা তাদেরই, যারা এদেশকে একটি মুসলিম প্রধান দেশ ও ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায়।
পশ্চিবংগের বাংগালীদের সাথে ভাষার ভিত্তিতে যারা বাংগালী জাতিত্বের ঐক্যে বিশ্বাসী, তাদের দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা টিকে থাকার আশা কতটা করা যায় জানি না। কিন্তু একমাত্র মুসলিম জাতীয়তাবোধই যে বাংলাদেশের পৃথক সত্তাকে রক্ষা করতে পারে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং মুসলিম জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিতদের হাতেই বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা সবচেয়ে বেশী নিরাপদ।
শেরে বাংলার উদাহরণ
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবই পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল। শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক ঐতিহাসিক দলিলের প্রস্তাবক ছিলেন। অথচ মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে এক ব্যাপারে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ বিরোধী শিবিরের সাথে হাত মিলান এবং পাকিস্তান ইস্যুতে ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন হয়, তাতে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করেন। পাকিস্তান হয়ে যাবার পর তিনি কোলকাতায় নিজের বাড়ীতে সসম্মানে থাকতে পারতেন। তিনি ইচ্ছা করলে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হতে পারতেন। কিন্তু যখন পাকিস্তান হয়েই গেল, তখন তাঁর মত নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক কিছুতেই নিজের জন্মভূমিতে না এসে পারেন নি। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত থাকা সত্ত্বেও এদেশের জনগণ শেরে বাংলাকে পাকিস্তানের বিরোধী মনে করেনি। তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাঁরই নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের উপর এত বিরাট বিজয় লাভ করে। অবশ্য রাজনৈতিক প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” বলে গালি দিয়ে তাঁর প্রাদেশিক সরকার ভেংগে দেয়। আবার ক্দ্রেীয় সরকারই তাঁকে প্রথমে গোটা পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বানায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরও নিযুক্ত করে। এভাবেই তাঁর মতো দেশপ্রেমিককেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাষ্টদ্রোহী বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদাহরণ
জনাব সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে যখন বংগদেশে ও আসামকে মিলিয়ে “গ্রেটার বেংগল” গঠন করার উদ্দেশ্যে তিনি শরৎ বসুর সাথে মিলে চেষ্টা করেন। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হলে পূর্ববংগ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো না। তিনি পশ্চিমবংগের লোক। পশ্চিমবংগের বিপুল সংখ্যক মুসলমানের স্বার্থরক্ষা এবং কোলকাতা মহানগরীকে এককভাবে হিন্দুদের হাতে তুলে না দিয়ে বাংলা ও আসামের মুসলমানদের প্রাধান্য রক্ষাই হয়তো তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল। কিন্তু পরে যখন তিনি পূর্ববংগে আসেন, তখন তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে পাকিস্তানের দুশমন বলে ঘোষণা করা হয় এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য তিনিই পরে পাকিস্তানের উযিরে আযম হবারও সুযোগ লাভ করেন। বলিষ্ঠ ও যোগ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার প্রয়োজনে দুর্বল নেতারা এ ধরনের রাজনৈতিক গালির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের গালি দ্বারা কোন দেশপ্রেমিক জননেতার জনপ্রিয়তা খতম করা সম্ভব হয়নি।
তাই ’৭১-এর ভূমিকাকে ভিত্তি করে যে সব নেতা ও দলকে “স্বাধীনতার দুশমন” ও “বাংলাদেশের শত্রু” বলে গালি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যতই বিষেদাগার করা হোক, তাঁদের দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও জনপ্রিয়তা ম্লান করা সম্ভব হবে না।
— সমাপ্ত —