পরিচ্ছেদঃ তেপ্পান্ন
সামাজিক পাপ
জেনে রাখুন, প্রাণীকুলের কয়েক শ্রেণী রয়েছে। এক শ্রেণীতে পোকা, যা মাটিতেই জন্ম নেয়। মহা পরিকল্পনাবিদ আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সেগুলোর ইলহাম হয়, কিভাবে তারা মাটি তেকে খাদ্য জোগাড় করবে। তবে কোন পারিবারিক ব্যবস্থাপনার ইলহাম তাদের হয় না। অপর এক শ্রেণীর বাচ্চা বা বংশধর হয়। সেখানে স্ত্রী ও পুরুষ জাতি মিলে-মিশে সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব পালন করে। তাই আল্লাহ পাক তাদের খাদ্যের ইলহামের সাথে সাথে পারিবারিক ব্যবস্থাপনারও ইলহাম প্রদান করেন। পাখীদের ইলহাম হয়, কিভাবে তারা খাদ্য সংগ্রহ করবে, কিভাবে উড়ে বেড়াবে, কিভাবে যৌথ সম্পর্ক স্থাপন করবে ও কিভাবে বাসা বেঁধে শাবকদের লালস-পালন করবে।
জীব জগতে প্রকৃতিগতই সামাজিক মানুষ। তারা পারস্পরিক সহায়তা ছাড়া বাঁচতে পারে না। কারণ, তারা যেমন ঘাস খেতে পারে না, তেমনি কাঁচা শস্য সবজীও পারেনা। তাদের গায়ে এমন পালকও নেই যদ্বারা তার শীত নিবারণ হয়। এভাবে আরও বহু ব্যাপার রয়েছে। তাই আল্লাহ পাক তাকে ঘর-সংসার, সমাজ-জমাত ও সরকার, দরবার ইত্যাকার ব্যাপারে ইলহাম করে থাকেন। অন্যান্য জীব থেকে মানুষের পার্থক্য এই যে, অন্যান্য জীবের ইলহাম হয় প্রয়োজনীয় মুহুর্তে তা পূরণের জন্যে। আর মানুষের ইলহাম হয় জীবনের এক এক অধ্যায়ের প্রয়োজনীয় জ্ঞান দানের মাধ্যমে। যেমন মানব শিশু কিভাবে স্তন চুষে দুধ পান করবে, কণ্ঠ পরিস্কার করার জন্যে কিভাবে কেশে নেবে আর দেখার সময় কিভাবে চোখ খুলে নিবে তা তাকে ঠিকমত একই সাথে জানিয়ে দেয়া হয়। কারণ, তার খেয়াল অনুসারেই সব বস্তুই গড়ে উঠে ও গুরুত্ব পায়। সে পারিবারিক ও সামাজিক জ্ঞান লাভ করে প্রচলিত ব্যবস্থা ও রীতি-নীতি থেকে এবং আধ্যাত্মিক আলো থেকে যাদের আল্লাহ সাহায্য করেন তাদের অনুসরণের মাধ্যমে। মূলতঃ শেষোক্ত জ্ঞান তারা অর্জন করে ওহীর মাধ্যমে। তা ছাড়া অভিজ্ঞতা ও গায়েবী ইলহাম থেকে তারা জ্ঞানার্জন করে। কখনও সে দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষ ঊর্ধ্বালোক থেকে জ্ঞানার্জন করতে পারে। সে জ্ঞান তার উপযোগী একটা রূপধরে ধরা দেয়। মানুষের অবস্থা ভেদে তা ভিন্ন রূপ প্রকাশ পায়।
সব মানুষকে যে জ্ঞান দেয়া হয় তা সে আরব-আজম, শহর-পল্লী যেখানেরই হোক না কেন, আর যে পথেই সে জ্ঞান হাসিল করুক না কেন, তা হচ্ছে কতিপয় স্বভাবের অবৈধতার জ্ঞান। মূলতঃ সেগুলো নিষিদ্ধ না হলে সব নিয়ম-শৃঙ্খলা চুরমার হয়ে যায়। সে স্বভাব হল তিনটিঃ যৌন অনাচার, হিংস্র আচরণ ও অবিশ্বস্ত কায়-কারবার। এগুলো নিষিদ্ধ হবার দলীল হচ্ছে এই যে, মানব জাতির স্বভাবে কামভাব, আত্মশ্লাঘা ও লালসা বিদ্যমান।
পশুত্ব, পাশবিকতা চরিতার্থের জন্যে স্ত্রী পশুর প্রতি আকৃষ্ট থাকে। সে তার জুটির ব্যাপারে অপরের হস্তক্ষেপ সহ্য করে না। এ স্বভাব মানুষেরও। কিন্তু তফাত এখানে যে, পুরুষ পশু স্ত্রী পশু দখলের জন্যে লড়াই করে এবং শক্তিশালী পশু দুর্বল পশুর উপর জয়ী হয়। ফলে দুর্বলটি পালিয়ে যায়। আর এই অনুপস্থিতির কারণে তার জুটির সাথে সকলের মিলন দেখে না বলে প্রতিশোধ স্পৃহা দেখা দেয় না।
পক্ষান্তরে মানুষকে অত্যন্ত অনুভূতিশীল ও সচেতন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে অনুমান দ্বারা একটা ব্যাপারকে এরূপ অনুভব করে যেন সে তা দেখতে পাচ্ছে কিংবা শুনতে পাচ্ছে।
তবে মানুষকে এ বিবেক দান করা হয়েছে যে, এসব ব্যাপার লড়াইয়ে লিপ্ত থাকা হলে রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নারীর চাইতে পুরুষের দখল বেশী। তাই আল্লাহ পাক তাদের এ বিবেক দিয়েছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্ত্রী নিয়েই তৃপ্ত থাকবে, তার অন্য ভাইয়ের স্ত্রী নিয়ে হাংগামা বাঁধাবে না।
ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার এটাই স্বাভাবিক কারণ। স্ত্রী নির্দিষ্ট করে নেয়ার ব্যাপারে সামাজিক রীতি কিংবা শরীয়ত সহায়ক হয়।
মানুষের ভেতরে পশুর স্বভাবের আরেকটি সাযুজ্য এই যে, পশুর পুরুষ আকর্ষণণ যেরূপ স্ত্রী পশুর দিকে ঠিক তেমনি পুরুষ লোকের যদি বিবেক ঠিক থাকে, তাহলে স্ত্রী লোকের দিকেই আকর্ষণ দেখা দেয়। বিকত বিবেক ছাড়া কখনও পুরুষের দিকে পুরুষের যৌন আকর্ষণ হয় না। অবশ্য যেমন কোন কোন পুরুষের সেরূপ বিকৃতি দেখা দেয়। কোন কোন লোক মাটি কিংবা কয়লা খেতে স্বাদ পায়, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার। সে ব্যক্তির স্বাভাবিক রুচি ও স্বভাবে চরম বিকৃতি থাকে। এ বিকৃতি কাজের অভ্যেস তার মন-মেজাজ বদলে ফেলে ও সে রুগ্ন মানসিকতার অধিকারী হয়। এ বদ অভ্যেস মানুষের বংশধারা সৃষ্টির মূলে কুঠারাঘাত করে। কারণ, যে যৌন শক্তি আল্লাহ পাক মানুষের বংশ ধারা সম্প্রসারণের জন্যে প্রদান করেছেন, তা যদি বিপথে বিনষ্ট করা হয়, তখন মানব সমাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। এ কারণেই মানুষ স্বভাবতঃই সে কাজকে নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় মনে করে। তাই কোন পাপী বদকার যদি তা করে, তবে অতি সংগোপনে করে থাকে। তার এ কাজ বাইরে জানাজানি হোক তা সে কখনও চায় না। যদি কেউ এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে, তখন সে লজ্জায় মরে যায়। হ্যাঁ যদি সে পুরোপুরিই মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে তখনই কেবল তার পক্ষে প্রকাশ্যে এ কাজ করা সম্ভব হয়। মানুষ যখন এ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহর গজব নাযিল হতে আর বিলম্ব হয় না। যেমন, হযরত লূত (আঃ)-এর যুগে হয়েছিল। এ কারণেই সমকামিতা নিষিদ্ধ হয়েছে।
মানুষের জীবিকা পদ্ধতি, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যেহেতু জ্ঞান ও ভাল-মন্দ বাছাই শক্তি ছাড়া পরিপর্ণূ হয় না এবং মদ্যপ ব্যক্তির মদ্য পানের মাতলামী যেহেতু শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর ও প্রতিবন্ধক হয়, এমনকি তা দাংগা-হাংগামা সৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাই তা নিষিদ্ধ হওয়া মানুষের স্বভাবগত দাবী। কিন্তু কিছু লোক এ ক্ষতিকর অভ্যেসের শিকার হয়ে পড়ায় তারা নীচ প্রকৃতির কাজ অনুসরণ করে। ফলে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। যদি এটা নিষিদ্ধ করা না হত, তাহলে সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি হত। মদ হারাম হওয়ার এটাই স্বাভাবিক কারণ। এ নিষিদ্ধতার সবিস্তারে আলোচনা আমি শরীয়তের দৃষ্টি ভংগী বর্ণনার সময় করব।
পশু যদি কোন লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে যেভাবে ক্ষিপ্ত হয়, মানুষও তেমনি হয়ে থাকে। কোন দৈহিক বা মানসিক আঘাতও তাকে ক্ষিপ্ত করে। তবে পশু ও মানুষের ভেতর তফাত এই যে, পশু জৈব ও খেয়ালী লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ধাবিত হয়, আর মানুষ জৈব বা জ্ঞানগত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। তবে পশুর তুলনায় মানুষের লালসার মাত্রা বেশী। তেমনি পশু পরস্পর লড়াই করে বটে, কিন্তু যেটি পরাজিত হয়ে পালায় সেটির ভেতরে আর কোন প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করে না। হ্যাঁ, কোন কোন পশু এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন উট, গরু, ঘোড়া। কিন্তু মানুষ স্বভাবতঃই শত্রুতা ভুলতে পারে না। এখন যদি মুক্তভাবে শত্রুতার লড়াই করতে দেয়া হয়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে অশান্তি-অরাজকতা দেখা দেবে ও জীবন-জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেই তাদের বিবেক দেয়া হল যে, এরূপ খুনখারাবি ও দাংগা-হাংগামার কাজ নিষিদ্ধ ও অন্যায়। হ্যাঁ বিশেষ কল্যাণ সাধনার্থে হত্যা করা যেতে পারে। যেমন- হত্যার পথ বন্ধ করার জন্য হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান।
এ মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে কারো অন্তরে হিংসা-দ্বন্দ্বের আগুন জ্বলতে থাকলেও হত্যাকাণ্ড ঘটাতে বিরত থাকবে।
কেউ কেউ তার প্রতিশোধস্পৃহা বা হিংসা-দ্বেষের প্রতিফলন সরাসরি হত্যা কাণ্ডের মাধ্যমে না ঘটিয়ে বিষ প্রয়োগ বা যাদু-টোনার সাহায্যে হত্যা কার্য সাধন করে। এ কাজটি মানুষের বিবেচনায় সরাসরি হত্যার চাইতেও জঘন্য। কারণ, প্রকাশ্য আক্রমণ থেকে মানুষ আর না হোক পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু গোপনে বিষ প্রয়োগ বা যাদু-টোনা থেকে আত্মরক্ষার কোন সুযোগ থাকে না।
কেউ আবার তার হত্যাস্পৃহা চরিতার্থ করে রাষ্ট্রনায়কের কাছে অপবাদ ও চোগলখুরীর মাধ্যমে কিংবা মিথ্যা অভিযোগ সৃষ্টি করে। এ কাজগুলোও মানুষ অন্যায় ও নিষিদ্ধ ভেবে থাকে।
আল্লাহ পাক বান্দাদের জন্যে রুজী-রোজগারের বিভিন্ন ব্যবস্থা রেখেছেন। যেমন, বৈধ যমীন থেকে শস্য উৎপাদন, পশু পালন, কৃষিকাজ, নানাবিধ শিল্প ও কারিগরী কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন দায়-দায়িত্ব পালন। এ ছাড়াও বিভিন্ন পেশায় কাজ করা হয় বটে, কিন্তু সভ্য সমাজে তার কোন ঠাঁই নেই।
কোন কোন লোক ক্ষতিকর পেশায় নিয়োজিত। যেমন- চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। এগুলো দেশের জন্য ধ্বংসকর পেশা। তাই মানবের বিবেক সাক্ষ্য দিল যে, এগুলো অবৈধ কাজ। সমগ্র মানব জাতি এ ব্যাপারে একমত। কিছু নাফরমান লোক প্রবৃত্তির তাড়নায় এ পেশা অবলম্বন করে। পক্ষান্তরে ইনসাফগার শাসকমণ্ডলী এরূপ অসৎ পেশাদারদের বিলোপ সাধনের জন্যে সার্বিক প্রয়াস চালিয়ে আসছেন। তাই কিছু লোক শাসকমণ্ডলীর এ প্রয়াস থেকে বাঁচার জন্যে মিথ্যা দাবী, মিথ্যা ভাষণ ও মিথ্যা সাক্ষী, মাপে কম দেয়া, জুয়া খেলা, সুদ খাওয়া ইত্যাদি পেশা ধরেছে। অথচ এগুলোও ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ পেশা। এমনকি ভারি ট্যাক্স-খাজানা চাপানোও ডাকাতি, এমনকি ডাকাতির চেয়েও জঘন্য কাজ।
মোটকথা সমাজ ও রাষ্ট্রের এসব ক্ষতিকর কাজ মানব মনে আবহমান কাল থেকে নিষিদ্ধ পেশা বলে বদ্ধমূল হয়ে আছে। ফলে বুঝ-জ্ঞানের অধিকারী মানুষেরা বংশ পরম্পরায় এসব কাজ নিষেধ করে আসছে। পরিণামে এ নিষিদ্ধতা সামাজিক রীতি-নীতিতে পরিণত হয়েছে। তাই তা এখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে। এ অপরাধের সাথে স্বভাবতঃই সর্বোচ্চ পরিষদের ঘৃণা সংযুক্ত হয়েছে। তাই মানুষের অন্তরে ইলহাম হয়েছে যে, এগুলো হারাম কাজ। এ ধরনের পেশাদারদের প্রতি সর্বোচ্চ পরিষদ অত্যন্ত রুষ্ট হন। কেউ জ্বলন্ত অংগারে পা রাখলে যেভাবে তার কষ্ট প্রতিটি অনুভুতি ইন্দ্রিয়কে তোলপাড় করে তোলে, তাদের অবস্থা তা-ই হয়। তাদের এ কষ্টের ফলে আগুনের বেড়ী সৃষ্টি হয় এবং তা অপরাধীদের ঘিরে ফেলে। তখন অন্যান্য কর্মরত ফেরেশতাদের অন্তরে এ ইলহাম হয় যে, তাকে কষ্ট ও শাস্তি দিতে হবে। ফলে তার জন্যে যা কিছু বরাদ্দ ছিল অর্থাৎ ফেরেশতাদের তার ব্যাপারে যে সব কল্যাণ সাধনের ইলহাম হয়েছিল তা তার জন্য আরও প্রশস্ত করে দেয়া হয়। তার রুজী ও আয়ু বেড়ে যায়। তারপর যখন তারা তা পূর্ণ করে মারা যায় তখন আল্লাহ পাক তাদের ইনসাফের জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসেন। যেমন তিনি পাক কালামে বলেনঃ-
(আরবী*************************************************************)
সূরা আর-রাহমানঃ আয়াত ৩১
অর্থাৎ, হে জ্বিন ও ইনসান! শীঘ্রই আমি তোমাদের হিসেব নিতে অবকাশ নিয়ে বসব। বস্তুত তখন তিনি তাদের পাপের যথাযোগ্য শাস্তি দেবেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
পরিচ্ছেদঃ চুয়ান্ন
জাতি-ধর্মের ব্যবস্থাপনা
ধর্মীয় সম্পদ্রায় ও ধর্ম নায়কদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব
আল্লাহ পাক বলেনঃ-
(আরবী***********************************************)
সূরা রা’দঃ আয়াত ৭
“তুমি শুধুই সতর্ককারী; প্রত্যেক জাতির জন্য প্রদর্শক রয়েছে”।
স্মরণ রাখা দরকার, পশু প্রবৃত্তিকে বিবেকের নিয়ন্ত্রণে রাখার পদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত পাপাচার সম্পর্কিত জ্ঞান যে কোন বিবেক সম্পন্ন জ্ঞানীরই রয়েছে। তারা তার কল্যাণ সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু সাধারণ মানুষ সে সব ব্যাপারে বেখবর। কারণ, তাদের উন্নয়নের পথে বহু অন্তরায়। ফলে তাদের আত্মিক শক্তিগুলো নিস্তেজ হয়ে যায়। রুগ্ন ব্যক্তির কাছে যেমন সব ভাল খাবারই বিস্বাদ ও তিক্ত হয়ে যায়, তাদের অবস্থাও তা-ই হয়। ফলে নিজের ভাল-মন্দ যাচাইয়ের ক্ষমতা তার থাকে না। তাই তাদের এমন এক আলেমের মুখাপেক্ষী হতে হয় যিনি সঠিক পথের দিশারী হবার জ্ঞান রাখেন। তিনিই তাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ধর্মীয় পথ নির্দেশ করবেন। তিনি তাদের সঠিক পথে চলার প্রেরণা জোগাবেন এবং বিপথে যাওয়া থেকে সতর্ক করবেন।
কিছু লোক এমন রয়েছে যারা মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়ে থাকে। তাদের উদ্দেশ্যই হয় সঠিক পথের বিরোধিতা করা। তারা নিজেরা ভ্রান্ত বলেই অন্যদেরও ভ্রান্ত পথে ডাকে। এ ধরনের লোকদের পুরোপুরি নির্মূল করা ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র ঠিক হতে পারে না।
কিছু লোক এমন রয়েছে যাদের কিছু না কিছু সঠিক ধারণা রয়েছে। তারা আংশিক ও অসম্পূর্ণ হেদায়েতের অধিকারী হয়। হেদায়েতের কিছু কথা তাদের মনে থাকে ও কিছু কথা ভুলে যায়। তারপর তারা নিজেদের পূর্ণ হেদায়েতপ্রাপ্ত ভেবে চলে এবং এ ব্যাপারে কারো সাহায্য বা পথ নির্দেশনা প্রয়োজন মনে করে না। তারা এমন এক পথ প্রদর্শকের মুখাপেক্ষী যিনি তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারেন! মোট কথা মানুষ এমন একজন যথার্থ আলেমের মুখাপেক্ষী যিনি নিজে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত।
শহরের যদিও অধিকাংশ নাগরিক রুজী-রোজগারে জ্ঞান রাখে এবং সমাজ ও সভ্যতার পরিমার্জন ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্পর্কে নিজেরাই ধারণা রাখে, তথাপি তারা এমন এক ব্যক্তিত্বের মুখাপেক্ষী থাকে যিনি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত এবং জনগণের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে!
একটি শহরের জন্যেই যখন একজন পথ প্রদর্শক মহাজ্ঞানী ব্যক্তি প্রয়োজন হয়, তখন যে বিরাট জাতির ভেতর বিভিন্ন যোগ্যতা সম্পন্ন বহু প্রতিভা বিদ্যমান, তাদের প্রদর্শক থাকার কি কোন প্রয়োজন নেই? এ ধরনের পথ প্রদর্শক পথ সম্পর্কে শুধু পবিত্র স্ববাবের সচেতন ব্যক্তিরাই যথার্থ সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে। তাঁরা সেই শ্রেণীর লোকই হয়ে থাকেন যারা মানবতার জগতে সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন থাকেন। এদের সংখ্যা অবশ্যই নগণ্য হয়ে থাকে।
লোহারী কিংবা সুতারীর কাজেও যদি পূর্ব পুরুষের অনুসরণ ও ওস্তাদের শিক্ষা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয় তো আপনারা পথ প্রদর্শক ও শিক্ষক ছাড়া সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে বলে আশা করেন যার অনুধাবনের ক্ষমতা কেবল আল্লাহ যাদের দেন তারা লাভ করে থাকে! একমাত্র নিষ্ঠাবান নিঃস্বার্থ ব্যক্তি ছাড়া সে পথের দিকে কেউ আকৃষ্ট হয় না।
এ ধরনের পথ প্রদর্শক আলেমের জন্যে প্রয়োজন হল খোলাখুলি ভাবে মানুষের কাছে এটা প্রমাণ করা যে, তিনি সঠিক পথের বিশেষজ্ঞ, তাঁর কথাবার্তা ভুল-ভ্রান্তি আর বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত ও পবিত্র এবং তিনি হেদায়েত ও ইসলাহের একটি অংশ অনুসরণ করে অন্য কোন জরুরী অংশ বর্জন করেন না। এটা দুভাবে হতে পারে। এক, তিনি যে ব্যক্তিত্বের বরাত দিয়ে দলীল পেশ করবেন সেই ব্যক্তিত্বটি সর্বজন শ্রদ্ধেয় নির্ভরযোগ্য হতে হবে। তা হলে কেউ কোন ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে তাঁর বরাত দিয়ে প্রশ্নকারীকে নিরস্ত করা যাবে। দুই, তিনি নিজেই এমন ব্যক্তিত্ব হবেন যার ব্যাপারে কোন বিতর্ক নেই এবং সবাই তাঁর সততার ব্যাপারে এক মত।
সারকথা হল এই, মানুষের জন্যে এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন যিনি নিষ্পাপ, এবং যার নিষ্কলুষতা সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। পরন্তু তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ও বর্ণনা নির্ভুল বলে প্রমাণিত।
এখন এতটুকু জানা দরকার যে, লোকটির আনুগত্য সম্পর্কিত পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে বিধায় তিনি উত্তম তরীকা সৃষ্টি করতে পারেন। পরন্তু তিনি তরীকার ভাল-মন্দ হওয়ার কারণগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। এ গুলো না কোন দলীল-প্রমাণ দ্বারা জানা যায়, না পার্থিব প্রয়োজন মিটাবার জ্ঞান দ্বারা তা পাওয়া যায়। এমন কি কোন ইন্দ্রিয়ানুভূতি দ্বারাও তা লাভ করা যায় না। এটাতো এমন ব্যাপার যা কেবল আল্লাহই উপলব্ধি করে থাকেন। ক্ষুৎপিপাসা কিংবা ওষুধের উষ্ণতা বা শীতলতা যেরূপ আত্মাই জানতে পায়, তেমনি কোন জিনিস আত্মার অনুকূল বা প্রতিকূল তা শুধু সুস্থ অভিরুচিই জানতে পায়।
উক্ত ব্যক্তির ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকার পথ এই যে, আল্লাহ পাক তার ভেতর এমন জ্ঞান দান করেন যা দ্বারা সে জ্ঞান ও অনুভূত ব্যাপারগুলো সঠিক কি বেঠিক তা বুঝতে পায়। দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি যেভাবে কোন বস্তু দেখেই তা যথাযথ ভাবে বুঝতে পায় এবং তার এ সন্দেহ জাগে না যে, তার দৃষ্টিভ্রম ঘটেছে কিংবা সে যা দেখছে তা থেকে বস্তুটি ভিন্ন কিছু, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার। ভাষার ক্ষেত্রে যে শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সে শব্দটি সেই অর্থে ব্যবহার করার অর্থাৎ পানিকে পানি ও মাটিকে মাটি বলার পর যেরূপ কারো সন্দেহ থাকে না যে, সেটি কোন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করবে, এটাও তেমনি ব্যাপার। এ জ্ঞানের জন্যে না কোন বুদ্ধিলব্ধ দলীল থাকে, না এ শব্দের সাথে অর্থের কোন যুক্তিগত অপরিহার্যতা রয়েছে। তথাপি আল্লাহ পাক এগুলোর স্পষ্ট জ্ঞান মানুষের স্বভাবগত করে দিয়েছেন। অধিকাংশ লোকের ভেতর এ ভাবের সৃষ্টি হয় যে, তাদের ভেতর স্বভাবতগত এক প্রতিভা প্রদত্ত হয় আর তার সাহায্যে তার যথাযথ বাবেই প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো জেনে ফেলে। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সর্বদা তারা যেগুলোকে তাদের জ্ঞানের অনুকূলই দেখতে পায়।
ঠিক এ পথেই সাধারণ মানুষের সেই পথপ্রদর্শকের নিষ্পাপ হবার জ্ঞান অর্জিত হয়। তাদের প্রতীতি ও বহুল প্রচারিত দলীল-প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দেয় যে, লোকটি যে পথে ডাকছে এবং যা বলে ডাকছে তা সব সত্য। কারণ, তার সর্বজন প্রশংসিত গুণাবলী এ কথাই বলে দেয় যে, তিনি যা বলেন তা মিথ্যা হতে পারে না।
কখনও তার প্রভাব প্রভাবে সৃষ্টি হয় যে, তার ব্যক্তিত্ব থেকে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তির নিদর্শন ঠিকরে পড়ে। তার থেকে মুজিযা প্রকাশ পায় ও তার যে কোন দোয়া কবুল হয়। ফলে জনমানুষের প্রত্যয় জমে যায় যে, আসমানী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার কোন মর্যাদাকর ভূমিকা রয়েছে। এমন কি তার আত্মা সে সব পবিত্র আত্মার অন্যতম যার সাথে ফেরেশতাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা এও বিশ্বাস করে যে ,এ ধরনের লোক কখনও আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারে না।
বস্তুতঃ এরূপ ব্যক্তিকে মানুষ সমবেতভাবে তার সন্তান, সম্পদ, এমন কি জীবন ধারণের শীতল পানি থেকেও অধিক ভালবাসে। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব ছাড়া কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের ভেতর কখনও উদ্দিষ্ট বিশেষ রং সৃষ্টি হয় না। মানুষ সেই ধরনের ইবাদতেই লিপ্ত যা তারা অনুরূপ ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। তারা তাঁর জীবনের অলৌকিক ব্যাপারগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করে, হোক সে বিশ্বাস ঠিক কিংবা ভুল। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
পরিচ্ছেদঃ পঞ্চান্ন
নবুওয়াতের হাকীকত
স্মরণ রাখতে হবে যে, মানব সমাজে সব চাইতে সমঝদার ব্যক্তিরাই সর্বোচ্চ মর্যাদায় থাকে। তারা পারিভাষিক ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন হয়ে থাকেন। তাদের ফেরেশতা স্বভাব তথা বিবেক অত্যন্ত সবল হয়ে থাকে। তারা সদিচ্ছা নিয়েই অভীষ্ট অর্জনের ব্যবস্থা উদ্ধুদ্ধ হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সর্বোচ্চ পরিষদ থেকে তাদের ওপর সর্বোত্তম জ্ঞান ও ঐশী কার্যাবলী অবতীর্ণ হয়ে থাকে।
এক, সমঝদারের চরিত্র হল এই যে, তার স্বভাব-প্রকৃতি অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ হয়। কোন আবেগ প্রসূত খেয়াল তাকে কখনও অস্থির করে না। তার কোন প্রান্তিক চিন্তা-ভাবনাও থাকেনা। ফলে তিনি শুধু সামষ্টিক জিনিসই দেখেন না; বরং তার প্রতিটি অংশ দেখতে পান। তিনি মানুষের দেহ ও আত্মা সবই দেখে থাকেন, তিনি এমন মেধাহীনও নন যে, শুধু অংশ বিশেষই দেখেন, কিন্তু তার সামগ্রিক রূপ দেখতে পান না। তেমনি তিনি দেহ থেকে আত্মায়ও পৌঁছতে সক্ষম নন। তিনি সঠিক পদ্ধতির সর্বাধিক অনুসারী ও ইবাদতে সর্বোত্তম মর্যাদার অধিকারীদের সাথে কার্যকলাপে সাফগার ও তাদের ব্যাপারে পরিপূর্ণ তদারককারী হয়ে থাকেন।
তাছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজে তিনি অত্যন্ত আগ্রহশীল হন। বিশেষ কারণ ছাড়া তিনি কাউকে কষ্ট দেন না। যেমন জনকল্যাণের স্বার্থেই কেবল তিনি কাউকে শাস্তি দেন। তিনি সর্বদা অদৃশ্য জগতের দিকে আকৃষ্ট থাকেন। তাঁর কথায় ও চেহারায় এ সত্যটি প্রতিভাত হয়। তাঁর প্রতিটি কাজে বুঝা যায় যেন তিনি অদৃশ্য জগতের সাহায্য পাচ্ছেন। তাঁর সাধারণ সাধনায়ই নৈকট্য ও স্বস্তির দরজা উন্মুক্ত হয়। অথচ অন্যান্যদের তা হয় না।
এ সমঝদার শ্রেণী আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। তাদের যোগ্যতায়ও তারতম্য রয়েছে। যেমনঃ-
১। সাধারণতঃ যার আল্লাহর তরফ থেকে এরূপ জ্ঞানরাশি অর্জিত হয়েছে যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখার জন্যে যথেষ্ট, তাকে বলা হয় পরিপূর্ণ সমঝদার।
২। সাধারণতঃ যার চারিত্রিক উৎকর্ষ ও যথাযথ জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তাকে বলা হয় হেকীম বা বিজ্ঞজন।
৩। সাধারণতঃ যার রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জিত হয় ও জনগণের কল্যাণ সাধন ও অকল্যাণ দূর করার তাওফিক হাসিল হয় তাকে বলা হয় খলীফা।
৪। সাধারণতঃ সর্বোচ্চ পরিষদে যার উপস্থিতি সম্ভব হয় এবং সেখানকার ফেরেশতারা যাকে শিক্ষা দেয়, তারা যার সাথে কথা বলে, তাদের যে দেখে ও যার বিভিন্ন ধরনের কারামত প্রকাশ পায়, তাকে বলে পবিত্র আত্মার সাহায্য-প্রাপ্ত ব্যক্তি।
৫। যার অন্তর ও মুখ নূরময় হয়ে যায়, যার সাহচর্য ও উপদেশ দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, যার সহচর ও সহযোগীরাও নূরে উদ্দীপ্ত ও প্রশান্ত হয় যার বরকত ও উছিলায় সেও পূর্ণত্বে পৌঁছে থাকে এবং তাদের হেদায়েদের জন্য যে সর্বদা উদগ্রীব থাকে, তাকে পথপ্রদর্শক ও পরিচালক বলা হয়।
৬। যার বিশেষ সম্প্রদায় বা জাতির রীতি-নীতি ও ভাল-মন্দ জ্ঞান অর্জিত হয় ও সে বিলুপ্ত ও হৃত রীতিনীতি পুনঃ প্রবর্তনে উদ্যোগী হয় তাকে ইমাম বলা হয়।
৭। যার অন্তরে এ কথার উদ্রেক হয় যে, সে মানব মণ্ডলীকে আসন্ন পার্থিব বিপদাপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে কিংবা সে আত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে জানতে পায় যে, মরণোত্তর জীবনে কবর ও হাশরে মানুষের কি দুর্গতি হবে আর সে জন্যে সে তাদের সতর্ক করে থাকে, তাকে বলে সতর্ককারী বা নাজীর।
আল্লাহ পাকের কার্যকৌশলের যখন এটাই দাবী হয় যে, তিনি তার এমন এক সমঝদার বান্দাকে সৃষ্টিকুলে প্রেরণ করবেন যিনি মানব মন্ডলীর আঁধার-পুরী থেকে আলোর জগতে আসার উপলক্ষ হবেন, তখন তিনি তাঁর বান্দাদের জন্যে তার আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য করে দেন। সর্বোচ্চ পরিষদেও তখন তার অনুগত ও অনুসারীদের ওপর সন্তোষ প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। তেমনি তার বিরোধী ও শত্রুতা পোষনকারীর ওপর তাদের অভিসম্পাত বর্ষণের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। আল্লাহ পাক মানুষের অন্তরে অনুসরণ ও সহায়তা প্রেরণা সৃষ্টি করে থাকেন। ইনিই হলেন নবী।
তার ভেতর শ্রেষ্ঠতম নবী তিনিই যার প্রেরণের পেছনে কোন উদ্দেশ্য থাকে। তা হচ্ছে এই, আল্লাহ পাক ইচ্ছা করেন যে, তার মাধ্যমে মানব জাতিকে তিনি আঁধারপুরী থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসবেন। তার জাতিকে তিনি সর্বোত্তম আলোর দিশারী জাতি হিসেবে মনোনীত করবেন। আর তাই তা প্রেরণ অন্যান্যদের প্রেরণের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। এ শ্রেষ্ঠতম নবীর প্রথম প্রেরণ প্রসংগে আল্লাহ পাক বলেনঃ-
(আরবী***********************************************************************)
সূরা জুমআঃ আয়াত ২
অর্থা, তিনি আল্লাহ যিনি নিরক্ষর মানুষদের ভেতর থেকেই তাদের জন্য নবী পাঠিয়েছেন।
আর দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রেরণ প্রসংগে আল্লাহ বলেনঃ-
(আরবী**************************************************************************)
সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত ১১০
অর্থাৎ, তোমরা এমন এক জাতি যাদের মানবজাতির জন্য বাছাই করা হয়েছে।
হুজুর (সঃ) বলেনঃ “তোমাদের আরাম দেয়ার জন্যেই পাঠানো হয়েছে, কষ্ট দেয়ার জন্যে নয়”।
আমাদের মহানবী (সঃ) মূলতঃ সমঝদারীর যাবতীয় বিষয়গুলোর ওপর দখল রাখতেন। পরন্তু তিনি উল্লিখিত দু’স্তরের প্রেরণকার্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাঁর পূর্ববর্তী নবীরা দু’এক বিষয়ে দক্ষ হতেন।
স্মরণ রাখুন, আল্লাহ পাকের কর্মকৌশলে প্রেরণ কার্যকে এ জন্যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, মানুষের কল্যাণ সাধন কেবল সেই পথেই সম্ভব হতে পারে। এর তত্ত্ব কেবল আলেমুল গায়েবই ভাল জানেন। অবশ্য আমরা শুধু এতটুকুই জানি যে, নবী প্রেরণের জন্যে কয়েকটি জরুরী কারণ থাকে। সে কারণগুলোর সাথে প্রেরণ কার্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
রাসূলের আনুগত্য এ জন্যে অপরিহার্য যে, আল্লাহ তাআলার ইলমে এটা রয়েছে যে, কোন জাতির সংস্কার ও পরিশুদ্ধি শুধু আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর ইবাদতের ভেতর নিহিত রয়েছে। অথচ তারা এরূপ যোগ্যতা রাখেনা যে, সরাসরি তারা আল্লাহ পাকের জ্ঞান থেকে কিছু অর্জন করবে। তাই তাদের পথপ্রাপ্তি ও সংশোধনের একমাত্র পথ হল নবুওয়াতে আনুগত্য। অতঃপর আল্লাহ তাআলা পবিত্র মজলিসে এ সিদ্ধান্ত প্রদান করে যে, নবীর অনুসরণ সবার জন্যে ফরজ। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে নতুন অনুশাসনের আগমন ঘটে ও পূর্ব অনুশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তখন আল্লাহ পাক এমন একজন লোক পাঠান যিনি নতুন অনুশাসনের সহায়ক ও অনুগামীদের জীবন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধ করেন। যেমন, আমাদের মহানবীর (সঃ) আবির্ভাব।
কখনও বা আল্লাহ পাকের দরবারে কোন এক জাতির অস্তিত্ব সৃষ্টি ও অন্যান্য জাতির ওপর তাদের প্রভাব বিস্তারের সিদ্ধান্ত হয়। তখন তিনি এমন একজন লোক পাঠান যিনি তাদের বক্রতা ও ভ্রষ্টতা দূর করেন এবং তাদের আল্লাহর কিতাব শিক্ষা দেন। যেমন, হজরত মুসা (আঃ) এ জন্যে প্রেরিত হন।
কখনও কোন জাতির আধিপত্য ও জীবন ব্যবস্থা অবশিষ্ট রাখা আল্লাহ পাকের মর্জি হয়, তখন তিনি সে ব্যবস্থা আঞ্জাম দেয়ার জন্য সহায়ক নবী বা মোজাদ্দেদ পাঠান। যেমন, হযরত দাউদ (আঃ), হযরত সোলায়মান (আঃ) ও বনী ইসরাঈলের অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম। আল্লাহ পাক বলেন, তিনি তাঁর নবীদের তাদের বিরোধীদের ওপর বিজয়ী করবেন। যেমন, তিনি বলেনঃ
(আরবী**************************************************************)
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
সূরা ছাফফাতঃ আয়াত ১৭১-১৭৩
অর্থাৎ, আমার প্রেরিত বান্দাদের আমি আগেই বলে দিয়েছি নিঃসন্দেহে তারাই মদদপ্রাপ্ত আর অবশ্যই আমার সেনাদল বিজয়ী।
উক্ত নবীদের ছাড়া আরও এমন লোক রয়েছেন যাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য পাঠানো হয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
যখন কোন জাতির কাছে কোন নবী পাঠানো হয় তখন সে জাতির জন্যে ফরজ হয়ে যায় তাকে মেনে নেয়া ও অনুসরণ করা, যদিও তারা পূর্ব থেকেই কোন সত্য নবীর অনুসারী হয়ে থাকে। কারণ, নবীর মত কোন উঁচু স্তরের বান্দার বিরোধিতা করলে তা সর্বোচ্চ পরিষদের অভিশাপ বর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং নবীর বিরোধীদের লাঞ্ছিত করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়ে যায়। ফরে তাদের পক্ষে আর আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের পথ খোলা থাকে না। তখন তাদের সব পরিশ্রম ও সাধনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ধরনের নবী বিরোধী কেউ মারা গেলে তাকে অভিশাপ গ্রাস করে নেয়।
অবশ্য স্মরণ রাখা চাই যে, যা বললাম তা নীতিগত কথা বললাম যার বাস্তবতা রয়েছে। ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে এর বাস্তবতা অনুধাবন করা যায়। তারা দ্বীনের ব্যাপারে কতভাবে বাড়াবাড়ি করেছিল। আল্লাহর কিতাবে তারা বিকৃতি আনল। তাদের জন্যে নবীর প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। আল্লাহ পাকের নবী পাঠানোর মৌল কারণ এটাই যে, মানুষ জন্মগতবাবে এ যোগ্যতা নিয়ে আসে না যে, কোন মাধ্যম ছাড়াই তারা তাদের ভাল-মন্দের ব্যাপারগুলো সব জানতে বা বুঝতে পারে। হয় তাদের এ ক্ষেত্রে যোগ্যতার অভাব থাকে যা পয়গাম্বরের মাধ্যমে দূর হয় অথবা তাদের ভেতরে এমন দোষ-ত্রুটি থাকে যা ভয়-ভীতি ও জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে দূর করতে হয়। সেটাও নবীরা পরকালীন ভয়-ভীতি ও ইহকালীন শাস্তির মাধ্যমে সুসম্পন্ন করেন।
বস্তুত বিভিন্ন উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের কারণ দেখা দেয়ায় আল্লাহ পাকের এটাই সিদ্ধান্ত হয় যে, কোন পবিত্র ব্যক্তির কাছে তিনি ওহী পাঠাবেন। আর সেই লোক মানবমণ্ডলীকে সত্য ও ন্যায়ের পথে ডাকবে ও তাদের সহজ-সরল পথে চালাবে। তার উদাহরণ এই যে, কোন এক মালিকের ভৃত্য অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন সেই মালিক তার বিশেষ কোন পার্শ্বচরকে পাঠালেন তাকে যেভাবেই হোক তিক্ত ওষুধ সেবন করানোর জন্য। এখন যদি সে এসে তাকে জোর জবরদস্তি করে ওষুধ খাওয়ায় সেটাও ন্যায় কাজ হত। কিন্তু আল্লাহপাকের পরিপূর্ণ মায়া-মমতার এটাই বহিঃপ্রকাশ যে, পয়লা এসে তাঁর লোক জানিয়ে দিল, তুমি অসুস্থ। তাই এ ওষুধ সেবন করলে তুমি সুস্থ ও উপকৃত হবে। তাদের আস্থা সৃষ্টির জন্যে প্রেরিত লোকটির দ্বারা কিছু অলৌকিক ব্যাপারও তিনি ঘটিয়ে থাকেন। তার ফলে রোগীরা বুঝতে পারে, লোকটি যা বলছে তা সত্য। লোকটি তিক্ত ওষুধে মিষ্টি মিশিয়ে তা সেবন করায়। সে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিচক্ষণতা নিয়ে কাজ করে এবং যেভাবে তাকে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেভাবেই সে তা সম্পন্ন করে।
মু’জিযা ও দোয়া কবুলের ব্যাপারটি যদিও নবুওয়াতের অংশ নয়, তথাপি তা নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে সহায়ক হয়ে থাকে। বড় বড় মু’জিযা দেখা দেয়ার কারণ তিনটি।
১। মু’জিযা প্রকাশকারী নিজে অন্যতম সমঝদার। সে কারণে কিছু কিছু ঘটনা তার কাছে ধরা দেয়। দোয়া কবুলের এটা কারণ হয়ে থাকে। তাই সে যে জিনিস বরকত হওয়ার দোয়া করে, তাতে বরকত দেখা দেয়। অবশ্য বরকত দেখা দেয়ারও বিভিন্ন রূপ রয়েছে। কখনও জিনিসে যথেষ্ট মুনাফা হয়। যেমন, অল্প সংখ্যক সৈন্যদের বহু সংখ্যক বলে মনে হয়, আর তা দেখে শত্রু বাহিনীর মনোবল ভেংগে যায়। এমনকি তারা ভয়ে পালিয়ে যায়। কখনও খাদ্য বস্তুর ভেতরে এরূপ গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয় যে, যে খায় সে অল্প খেয়েই ভাবে অনেক বেশী খেয়েছে। তাই অল্প খাদ্য সামগ্রী বহু লোক মিলেও খেয়ে শেষ করতে পারে না। অথবা সেই বস্তুকেই পরিমাণে এমনভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয় যা খেয়ে শেষ করা যায় না। এমন ধরনের আরও বহু রূপ আছে যার সংখ্যা নির্ণয় করা দুষ্কর।
২। উচ্চতম পরিষদে এ সিদ্ধান্ত হয়ে যায় যে, প্রেরিত নবীর কার্যধারাকে এগিয়ে নিতে হবে। ফলে এমন সব মানসিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবর্তন দেখা দেয়, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। দেখা যায়, নবীর প্রিয় অনুসারীরা সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ও তাঁর বিরোধীরা লাঞ্ছিত হয়ে থাকে। অবশেষে আল্লাহর ফরমান বিজয়ী হয়, যদিও কাফেরদের জন্যে তা হয় অত্যন্ত কষ্টদায়ক।
৩। বাহ্যিকভাবেও কোন কোন ঘটনা ঘটে থাকে। যেমন, নাফরমানদের শাস্তির জন্যে ভূপৃষ্ঠে বড় বড় দুর্যোগ দেখা দেয়। আল্লাহ পাক কোন না কোন ভাবে সেটাকে নবীর মু’জিযা হিসেবে প্রকাশ করেন। যেমন, নবী আগেই সতর্ক করেন ও তার ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক তা দেখা দেয়। কিংবা নবীর হুকুম অমান্য করার ফলে কোন বিপদ দেখা দেয়া। অথবা যে পাপের যে পরিণতি বলে তিনি নির্দেশ করেছেন তা স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয় বা তার অনুরূপ কোন অশুভ পরিণতি দেখা দেয়।
নবী নিষ্পাপ হওয়ার কারণ তিনটিঃ
১। মানুষ হিসেবেই তাঁদের নীচ প্রকৃতির বাসনা-কামনা থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
২। নেক কাজের সুফল ও বদ কাজের কুফল তাঁদের ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়।
৩। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাদের মানবিক দুর্বলতা ও স্খলন-পতন থেকে হেফাজত করেন।
স্মরণ থাকা চাই, আম্বিয়ায়ে কেরামের এটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে, তাঁরা আল্লাহ পাকের অস্তিত্ব ও গুণাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দেন না। কারণ, সেটা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহর সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা-ভানা কর এবং আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না। পাক কালামে রয়েছেঃ-
(আরবী**************************************************)
সূরা নজমঃ আয়াত ৪২
অর্থাৎ তোমার পালনকর্তাকে নিয়েই সব কিছুর পরিসমাপ্তি।
তাই নবী করীম (সঃ) বলেন,
রাব্বুল আলামীদের সত্তা নিয়ে কোন চিন্তা-গবেষণা নেই। অবশ্য নবীগণ আল্লাহ পাকের নেয়ামতরাজি ও তাঁর বিশাল কুদরত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আম্বিয়ায়ে কেরামের এটাও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে, মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী তারা তাদের সাথে কথাবার্তা বলেন এবং তাদের প্রকৃতিগত যে সহজতা জ্ঞান ও বিদ্যা রয়েছে সে অনুসারেই তাদের যা কিছু বলার তা বলেন। তার কারণ এই যে, মানব জাতির প্রকৃতিগত জ্ঞান-বুদ্ধি অন্যান্য জীব-জানোয়ার থেকে স্বভাবতঃই বেশী। অবশ্য যার মৌলিক সত্তাই নষ্ট ও ভ্রষ্ট সে জীব-জানোয়ার থেকে আদৌ উন্নত হয়। কোন কোন মানুষেল সহজাত জ্ঞান-বুদ্ধি এমন পর্যায়ের হয় যেখানে পৌঁছতে গেলে মানুষের স্বাভাবিক দৈনন্দিন অভ্যাসের বিপরীত পথে গিয়ে তা করতে হয়। যেমন, আম্বিয়া ও আওলিয়ায়ে কেরামের মত পবিত্রাত্মাদের জ্ঞান-বুদ্ধি। তাছাড়া কখনও কোন মানুষ আধ্যাত্মিক সাধনা ও এলমী মেহনত দ্বারা এমন স্তরে পৌঁছে যেতে পারে যা কেউ ভাবতেও পারেনা। বিজ্ঞান, দর্শন, শাস্ত্রীয় মূলনীতি ইত্যাদির ওপর দীর্ঘকাল চর্চার মাধ্যমেও এরূপ স্তর অর্জিত হয়।
মোটকথা, আম্বয়ায়ে কেরাম মানুষের সাথে তাদের স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী কথা বলেন। প্রতিটি লোক জন্মগত ভাবে যে জ্ঞান-বুদ্ধি পেয়ে থাকে সে অনুযায়ী তাদের কাছে তাঁরা বক্তব্য রাখেন। কোন দুর্লভ ও অস্বাভাবিক কিছুর দিকে তাঁরা আদৌ দৃকপাত করেন না। এ কারণেই আম্বিয়ায়ে কেরামের কর্ম-ধারা এটাই হয় যে, তাঁরা আল্লাহ পাককে তাঁর তাজাল্লীসহ দেখার কিংবা দলীল-পমাণ বা অনুমানের ভিত্তিতে তাঁকে চেনার জন্যে কাউকে বলেন না। পরন্তু তাঁদের এ সবকই দেন যে, আল্লাহকে দলীল-প্রমাণ থেকে ঊর্ধ্বে ভেবে মেনে চলবে। কারণ, সে পথে তাদের আল্লাহ প্রাপ্তি এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে যতক্ষণ না তারা দীর্ঘকাল ধরে আত্মিক সাধনা চালাবে এবং দর্শন-বিজ্ঞানে পারদর্শীদের সাথে পর্যাপ্ত মেলামেশা না করবে, ততক্ষণ কেউ উক্ত দুঃসাধ্যপথে পা বাড়াতে পারবে না। কারণ, দলীল-প্রমাণ ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি লাভ না করে সে পথে অগ্রসর হওয়াটা বিপজ্জনক। অবশ্য যাদের সেই প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞতা বিদ্যমান স্বভাবতঃই তারা ব্যক্তিগত মতামত পোষণের অধিকারী মুজতাহিদ এবং তাদের মর্যাদা মুহাদ্দিসদের ওপরে।
আম্বিয়ায়ে কেরামের পবিত্র স্বভাব এই যে, তাঁরা ব্যক্তির পরিশুদ্ধি ও জাতির বিন্যস্ততার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান ছাড়া অন্য কোন জ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করেন না। যেমন, জল-স্থলে সংঘটিত দুর্ঘটনার বস্তুগত কার্যকারণ উদঘাটন, বৃষ্টিপাত, সূর্যগ্রহণ কিভাবে সংঘটিত হয় তা নির্ণয় করা, জীব-জানোয়ার ও গাছ-পালার ওপর তাঁর প্রভাবের দিকগুলো নির্ধারণ, বিভিন্ন শহর, রাজা-বাদশহা বা নবী-পয়গাম্বরদের ইতিহাস ও কাহিনী ইত্যাকার ব্যাপার নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। হ্যাঁ, তাঁরা শুধু এতটুকু উল্লেখ করেন যাতে সেগুলো শুনে ও বুঝে কেউ আল্লাহ পাকের কুদরত ও নেয়ামত সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। তাই তা বলা হয় অত্যন্ত সংক্ষেপে ও ইশারা-ইংগিতে।
তাঁদের এ নীতির কারণেই যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে একদল লোক প্রশ্ন করল, চাঁদ কেন কমে ও বাড়ে? তার জবাবে আল্লাহ পাক সে প্রশ্ন এড়িয়ে মাসগুলোর কল্যাণকারীতা সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ-
(আরবী********************************************************************)
সূরা বাক্বারাঃ আয়াত ১৮৯
অর্থাৎ, তোমাকে চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে? তুমি বলে দাও, ওটা মানুষের জন্যে সময় নির্দেশক ও হজ্জের নির্ধারক।
আপনারা কোন কোন লোককে দেখতে পাবেন না যে, সব বৈষয়িক বিষয়ের জ্ঞান চর্চায় অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে তাদের মৌল বিষয়ের রুচি হারিয়ে ফেলেছে। এ সব লোকই আম্বিয়ায়ে কেরামদের বাণীসমূহের অপব্যাখ্যা দেয় ও বেজায়গায় তার প্রয়োগ ঘটায়। এভাবে তারা নবীদের বাণীগুলোর তাৎপর্য ওলট-পালট করে থাখে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
পরিচ্ছেদঃ ছাপ্পান্ন
দ্বীন একঃ শরীয়ত বিভিন্ন
আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী*****************************************************)
অর্থাৎ, তোমাদের জন্যে দ্বীন থেকে সেই বস্তু (বিধান) নির্ধারণ করা হল যা নূহকেও নির্দেশ করা হয়েছিল। আর আমি ওহীর মাধ্যমে তাই তোমাকে নির্দেশ করেছি যা নির্দেশ করেছি ইব্যাহীম, মুসা ও ঈসামে। (তা হচ্ছে) তোমরা দ্বীন কায়েম রাখ এবং এ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।
হযরম মুজাদ্দিদ (রঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেন, অর্থাৎ হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে ও তাদেরকে একই দ্বীন সম্পর্কে ওসিয়ত করেছি।
আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী******************************************************)
সূরা মুমিনুনঃ আয়াত ৫২-৫৩
অর্থাৎ ইসলামী মিল্লাতই তোমাদের সকলের মিল্লাত। অতঃপর ইয়হুদী, নাসারা ও মুশকরিকরা তাতে মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ই যার যার মত ও পথ নিয়ে তৃপ্ত।
আল্লাহ পাক আরও বলেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
সূরা মায়িদাহঃ আয়াত ৪৮
অর্থাৎ, তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্যে শরীয়াত ও তারপদ্ধীত ভিন্ন ভিন্ন করেছি।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেন, শরীয়াত অর্থ পথ ও মিনহাজ অর্থ পদ্ধতি।
আল্লাহ জাল্লা জালালাহু বলেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
সূরা হাজ্বঃ আয়াত ৬৭
অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মতের জন্যে আমি ইবাদতের পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি। তদনুসারে তারা ইবাদত করে থাকে। স্বর্তব্য, মূল দ্বীন একই। সকল নবী ও রাসূল এ ক্ষেত্রে একক। অবশ্য পথ ও পদ্ধতি ভিন্ন। এর ব্যাখ্যা এই যে, সকল নবী ও রাসূলেরই কথা হচ্ছে, আল্লাহ এক, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে। সাহায্য শুধু তাঁরই চাইতে হবে এবং তিনি সর্ব প্রকারের অশোভন কিছু থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তেমনি তাঁর পবিত্র নামসমূহে অবিশ্বাস ও অনাস্থা হারাম। বান্দার ওপর আল্লাহর হক এটাই যে, বান্দা আল্লাহর এরূপ ইবাদত করতে যাতে কিছুমাত্র ক্রুটি-বিচ্যুতি না থাকে। আল্লাহ পাকের সামনে তারা কায়মনে ঝুঁকে যাবে। তারা আল্লাহর নিদর্শনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করবে।
এ ব্যাপারেও তারা একমত যে, আল্লাহ পাক যা কিছু ঘটার তার আগে থেকেই জানেন এবং আল্লাহর ফেরেশতারা তাঁর নাফরমান নন। তারা আল্লাহর যখন যে নির্দেশ আসে তা হুবহু পালন করেন। আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের থেকে যাকে খুশী কিতাব প্রদান করেন এবং মানুষের জন্যে তাঁর আনুগত্যকে ফরজ করে দেন।
তাঁরা এ ব্যাপারেও একমত যে, কিয়ামত সত্য, পুনরুত্থান সত্য এবং দোযখ সত্য, তেমনি পবিত্রতা অর্জন, নামায পড়া, যাকাত দেয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, নফল ইবাদত করা অর্থাৎ, দোয়া, জিকির, তিলাওয়াতে কালামে পাক ইত্যাদির মাধ্যমে যে পুণ্য অর্জিত হয় এ ব্যাপারে তাঁরা একমত।
তেমনি বিবাহ বৈধ ও ব্যভিচার অবৈধ হওয়া, মানুষের ভেতর ইনসাফ কায়েম করা ও জুলুম নিষিদ্ধ করা, নাফরমানদের শাস্তির বিধান করা, আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা, আল্লাহর দ্বীন ও বিধি-বিধান প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস চালাতো ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁদের মতৈক্য রয়েছে। এগুলোই দ্বীনের আসল কতা। একারণেই কোরআনে পাকে এ সবের রূপ সম্পর্কে সবিস্তারে বলা হয়নি। হ্যাঁ, কোথাও কোন ব্যাপারে সামান্য যা কিছু ইংগিত করা হয়েছে তা স্বতন্ত্র কথা। যাদের ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে এমনকি এসব তাদেরও সর্বজন স্বীখৃত ব্যাপার ছিল।
অবশ্য উক্ত মৌলিক ব্যাপারগুলোর রূপ বিভিন্ন নবীর কালে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যেমন, হযরত মূসা (আঃ)-এর শরীয়ত নামাযের সময় বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করা হত। অথচ আমাদের রাসূল (সঃ)-এর শরীয়াতে কা’বা ঘরের দিকে মুখ করে নামায পড়ার বিধান দেয়া হয়েছে। মূসা (আঃ)-এর বিবাহিত কি অবিবাহিত সবারই ব্যভিচারের শাস্তি ছিল প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আমাদের শরীয়তে বিবাহিতের জন্যে প্রস্তরখাতে মৃত্যুদণ্ড ও অবিবাহিতের জন্যে দোররা মারার ব্যবস্থা রয়েছে। হযরত মূসা (আঃ)-এর শরীয়তে হত্যার বদলে হত্যা অথবা ক্ষতিপূরণ, দু’ব্যবস্থাই প্রদত্ত হয়েছে। এভাবে এবাদতের সময়, পদ্ধতি ও রীতি-নীতিতেও পার্থক্য রয়েছে।
মোটকথা, সে সব বিশেষ ধরন-ধারণ যার ওপর পুণ্য অর্জনের সব কর্ম ও কৌশল নির্ভরশীল সেগুলোই হচ্ছে শরীয়ত ও মিনহাজ্ব বা পথ ও পদ্ধতি।
মনে রাখতে হবে, সব ধর্মের ভেতরেই আল্লাহ পাক যে সব ইবাদত আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন তা হচ্ছে সে সব কাজ যার ভিত্তি ও উৎস হচ্ছে মানুষের অন্তর। তার ভিত্তিতেই সেগুলো পরকালে কল্যাণকর কিংবা ক্ষতিকর হয়ে দেখা দেভে। আসল ইবাদত ও আনুগত্য মূলতঃ অন্তরের ব্যাপার। বাহ্যিক কাজগুলো শুধু তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অন্তরের অবস্থা দিয়েই কর্মের বিচার হবে। এটা যে না জানবে তার আমল অর্থহীন হবে। কারণ, মনোযোগ বিহীন আমলের যত আধিক্যই থাকুক না কেন দোয়া ও কিরাআতের ত্রুটি-বিচ্যুতিতে তা কল্যাণকর হবে না।
ধর্মীয় কাজের ভেতর এরূপ বিচক্ষণতা ও ব্যবস্থাপনা থাকা চাই যা থেকে সর্ব স্তরের মানুষ তা সহজেই উপলব্ধি ও অনুসরণ করতে পারে। কোন আমল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন ব্যাপারে কারো যেন কোনরূপ অস্পষ্টতা ও সন্দেহ দেখা না দেয়। প্রতিটি আমল যেন আল্লাহ পাকের তরফ থেকে পাওয়া দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে যথাযথভাবে আদায় হয় ও পরকালে তা সর্বতোভাবে স্বীকৃত হয়।
কখনও কোনটি পাপ আর কোনটি পাপ নয় তা নিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। যেমন, মুশরিকরা বলেছিল, সুদ ও ব্যবসায়ের মুনাফা তো একই ব্যাপার। এ ধরনের মতিভ্রম কখনও অজ্ঞতা থেকে দেখা দেয় কখনও পার্থিব স্বার্থান্ধতা থেকে সৃষ্টি হয়। এ কারণেই পাপ ও অপাপের ভেতর এরূপ সুস্পষ্ট সীমারেখা থাকা চাই যা সকলের জন্যই সহজবোধ্য। ইবাদতের জন্যে সময় যদি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা না হত, তাহলে অনেকের পক্ষেই সঠিক ভাবে নামায, রোযা করা সম্ভব হত না। সে ক্ষেত্রে মানুষের বাহানা ও অজুহাতের জন্যেও তাদের ধমকানো যেত না। যদি মানুষের জন্যে ইবাদতের আরকান-আহকাম সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়অ না হত, তাহলে তারা ইচ্ছামত হাত-পা ছুঁড়তে থাকত। তেমনি পাপের জন্যে কোন শাস্তিও নির্ধারিত না হত তা হলে নাফরমানেরা কখনো নাফরমানী ছাড়ত না। মোটকথা, ইবাদত ও আমলের সুনির্দিষ্ট সময়, নিয়ম-কানুন ও শাস্তি-পুরস্কার রয়েছে বলেই মানুষের জন্যে তার বাস্তবায়ন সহজ হয়েছে এবং এ কারণেই জনসাধারণকে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করা যাবে। যদি শরীয়ত প্রণয়নের কায়দা-কানুন জানতে হয় তাহলে বিজ্ঞ ডাক্তারের বিধি-ব্যবস্থা প্রদানের ব্যাপারটি গভীরভাবে খেয়াল করতে হবে।
লক্ষ্য করুন, কিভাবে তিনি রোগীদের নিরাময় করার জন্যে পথ নির্দেশ করে থাকেন। রোগীরা যা জানে না সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দেন। যে সূক্ষ্ম ব্যাপার তাদের বোধগম্য হয়না সে সব ব্যাপারে তাদের না বুঝিয়ে বাধ্যগতভাবে পালনের ব্যবস্থা দেন। তিনি শিরা ধরে রোগীর অন্তর্নিহিত রোগ নির্ধারণ করে দাওয়াই দেন। কখনও চেহারার রক্তিমতা বা ফ্যাকাশে ভাব দেখে রোগ নির্ধারণ করেন। তিনি রোগীর শক্তি, বয়স, পরিবেশ, ঋতু ইত্যাদি অনুসারে ওষুধ ঠিক করেন।
মোটকথা, রোগীর সব কিছু বিবেচনা করে ওষুধ ও তার পরিমাণ স্থির করে তিনি চিকিৎসা করে থাকেণ। অনেক সময় নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুমানের ভিত্তিতে রোগের কারণ নির্ণয় ক্ষতিকর দিকগুলো আপনোদনের ব্যবস্থাসহ ওষুধ ও তার পরিমাণ নির্ধারণ করেন। যেমন তিনি বলেন, যদি কোন রোগীর চেহারা রক্তিম হয়ে যায় এবং তার শিরা-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালন তীব্র হয়ে যায়, তখন তাকে আংগুরের শরবত কিংবা মধুমিশান পানি পান করাবে। এটা না করলে সে মারা যাবে। অথবা তিনি বলেন, যে ব্যক্তি অমুক অমুক মাজুন এই এই পরিমাণ কাবে সে অমুক রোগ থেকে রেহাই পাবে। ডাক্তার বা হাকিম এসব বিধি-বিধান তৈরী করেন, মানুষ তা পালন করে এবং আল্লাহ পাক তাতে কল্যাণ দান করেন।
এক্ষণে সেই বিজ্ঞ শাসকের ব্যাপারটি ভেবে দেখ যিনি রাষ্ট্রের সংস্কার ও সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার জন্যে প্রখর দৃষ্টিদান করেন। তিনি যারা দেশের জমাজমি আবাদ ও ফসলপূর্ণ করার জন্যে চাষীদের সর্বপ্রকারের উপায়-উপকরণ দিয়ে উৎসাহিত করেন। তারপর তার উপর রাজস্ব ধার্য করেন। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে সহায়তার জন্যে তিনি নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ উজীর ও কর্মচারী নিয়োগ করেন। তাদের মাধ্যমে আইন-কানুন তৈরী করে তা রাষ্ট্রে জারী করেন। তিনি জনগণের প্রয়োজন সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকেন। তিনি অসংখ্য কর্মচারী পুষে থাকেন ও তাদের যাবতীয় প্রয়োজন মিটান। তাদের এমন ভাবে যার যার কাজে নিয়োজিত করেন, যাতে উদ্দেশ্য সফল হয়, অথচ তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপও না পড়ে। এভাবেই সকলের সব দিক খেয়াল রেখে তিনি সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি লক্ষ্য করুন। তারা শিশুদের কিরূপভাবে শিক্ষা দেণ। তেমনি কোন মালিক তার ভৃত্যদের কিভাবে পরিচালন করেন তাও লক্ষ্য করুন। শিক্ষক চায় শিশুর শিক্ষা। মালিক চায় ভৃত্যের দ্বারা তার কাজ উদ্ধার করতে। কিন্তু শিশু ও ভৃত্য তো তাদের যথার্থ কল্যাণ কিসে তা জানে না, তাই তারা সেরূপ কোন ব্যবস্থা পছন্দ করতে পারেনা। তারা তা এড়াবার জন্য নানা বাহানা ও অজুহাত সৃষ্টি করে। তবে শিক্ষ ও মালিকরা তাদের অবস্থা আগে থেকেই জানেন। তাই তারা কিভাবে সে সব বাধা দূর করে কার্য সমাধা করবেন তা স্থির করেন। তারপর তারা শিশু কিংবা ভৃত্যদের প্রয়োজনে দিনকে রাত ও রাতকে দিন বানিয়ে সুনিপুণ কৌশলে কাজে লাগেয় থাকেন। ফলে তাদের বাহানা ও অজুহাত কোন কাজেই আসে না। যার ফলে শিশু ভৃত্যরা শিক্ষক ও মালিকদের কলাকৌশল বুঝুক বা না বুঝুক তাদের কল্যাণ অর্জিত হয়ে যায়।
মোটকথা, যে লোকই এমন এক জনগোষ্ঠীকে সংস্কার করার জন্যে নিয়োজিত হবেন, যাদের যোগ্যতার বিভিন্ন স্তর আর যাদের দূরদর্শিতা তা যেমন নেই, তেমনি নেই কোন আগ্রহ, তিনি তখন বাধ্য হন তাদের জন্যে বিভিন্ন সময় ও পরিমাণ নির্ধারণ করতে। তাকে সব কিছুর রূপরেখা ও প্রয়োগ পদ্ধতি রচনা করতে হয় এবং সে সবের ভিত্তিতে লোকদের পরিমাপ ও জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হয়।
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ পাক যখন মানব জাতিকে আঁধার থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসার জন্যে নবী পাঠাবার ইচ্ছা করলেন, তখন সে নবীর কাছে ওহী পাঠালেন। এমন কি সে নবীকে আলোকময় করলেন ও তাঁর ভেতরে জগতের সংস্কার স্পৃহা সৃষ্টি করলেন। এ সবই হচ্ছে তখনকার মানবগোষ্ঠীর সংস্কার ও হেদায়েতের পটভূমি। আল্লাহ পাক আম্বিয়ায়ে কেরামকে পাঠাবার ব্যাপারে এ সমস্ত দিকগুলো সামনে রেখেছেন। তাই তিনি মানব জাতির জন্যে পয়গাম্বরদের আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য করে দিয়েছেন। কারণ, সংস্কার কাজটিকে মানুষের স্ববাব ও অভ্যেসের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নের জন্যে এ অপরিহার্যতা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
বস্তুতঃ আলোচ্য বিষয়বস্তুর এটাই সামগ্রিক রূপ। এর একটি অংশ অপর অংশের সাথে অংগাংগীভাবে জড়িত। আল্লাহ পাকের কাছে কোন কিছুই গোপন নেই। আল্লাহর দ্বীনে কোন হাওয়াই কথা বা বাজে কথা নেই। মূলতঃ সেখানে যখন কোন ব্যাপার নির্ধারিত হয়ে যায়, তখন তা নজিরবিহীন কোন কিছু হয় না। তবে হ্যাঁ, তিনি বিশেষ অবস্থায় নির্দিষ্ট হেকমত মোতাবেক বিশেষ কোন হুকুম জারী করেন যার রহস্য বিশেষজ্ঞ আলেম ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনা। আমি চাই, সে ধরনের কিছু রহস্য জনগণের সামনে তুলে ধরি।
পরিচ্ছেদঃ সাতান্ন
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতির কাছে ভিন্ন ভিন্ন শরীয়াত প্রেরণের রহস্য
এ বিষয়বস্তুর আসল রহস্য আল্লাহ পাকের নিম্ন আয়াতে নিহিত রয়েছে। তিনি বলেনঃ-
(আরবী*****************************************************************)
সূরা আলে-ইমরানঃ আয়াত ৯৩
অর্থাৎ নবী ইসরাইলের জন্যে সব খাদ্যই হালাল ছিল। তবে ইয়াকুব নিজের জন্যে কিছু হারাম করে নিয়েছিল। তাও তাওরাত নাযিল হবার পূর্ব পর্যন্ত। তুমি বলে দাও, তাহলে তাওরাত নিয়ে এস এবং পড়, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।
এ আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, হযরত ইয়াকুব (আঃ) একবার গুরুতর অসুস্থ হলেন। তখন তিনি মানত করলেন, আল্লাহ পাক যদি তাকে সুস্থ করেন, তাহলে তিনি তার প্রিয়তর খাদ্য ও পানীয় বর্জন করবেন। তারপর যখন তিনি সুস্থ হলেন, তখন তিনি তার প্রিয়খাদ্য উটের গোশত ও প্রিয় পানীয় উটের দুধ নিজের জন্যে হারাম করে নিলেন। তাঁর বংশধররাও তাঁর দেখাদেখি সেগুলো বর্জন করে গেল।। কিছুকাল এ অনুসরণ চলছিল। এর ফলে জনমনে এটা মজবুতভাবে বসে গেল যে, এটা অমান্য করা নবীকেই অমান্য করা এবং নবীর অভিসম্পাতের শিকার হওয়া। ফলে তওরাতেও সেগুলো নিষিদ্ধতা বহাল রাখা হল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম যখন ঘোষণা করলেন যে, তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর মযহাব অনুসরণ করছেন, তখন ইয়াহুদীরা প্রশ্ন তুলল, কি করে তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতে রয়েছেন? তিনি তো উটের গোশত খান ও উটের দুঢ় পান করেন। তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের যুক্তি খণ্ডনের জন্যে বললেনঃ বনী ইসরাঈলের জন্যে তো সব খাদ্যই হালাল ছিল। উটের গোশত ও দুধ তো বিশেষ কারণে নিষিদ্ধ হয়েছে। এখন যখন বনী ইসরাঈল থেকে বনী ইসমাঈলের নবুয়াত স্থানান্তরিত হয়েছে, তখন পূর্ব কারণে এখানে অবর্তমান বিধায় সেগুলো বৈধ হয়ে গেল।
এ প্রেক্ষিতেই হুযুর (স) নিয়মিত তারাবীহ নামায পড়া থেকে বিরত ছিলেন। তিনি বলেনঃ তোমাদের যেভাবে আমি নিয়মিত তারাবীহ নামায পড়তে দেখছি তাতে আমার ভয় হয় যে, আল্লাহ পাক তোমাদের ওপর তারাবীহ ফরজ করে দেবেন এবং তোমাদের জন্যে তা আদায় করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই হে লোক সকল! তোমরা যার যার ঘরে বসে তা পড়।
মোটকথা, তিনি তারাবীহ নামাযকে ধরাবাঁধা রীতিতে এ জন্যে পরিণত হতে দিলেন না যে, সেটা দ্বীনের অপরিহার্য অংগ হয়ে যাবে। ফলে তা ফরজের স্তরে পৌঁছে যাবে। হুযুর (সঃ) এও বলেছেনঃ
মুসলমানদের ভেতর সব চাইতে বড় অপরাধী সে ব্যক্তি যার প্রশ্ন তোলার কারণে কোন হালাল বস্তু হারাম হয়ে গেল। তিনি বলেনঃ হযরত ইবরাহীম (আঃ) মক্কাকে হরম শরীফ বানিয়ে গেছেন এবং তার জন্যে দোয়া করে গেছেন। আমিও তাঁর পথ ধরে মদীনাকে হরম শরীফে পরিণত করলাম। তেমনি আমি মদীনার বস্তুগুলোর ভেতরে বরকত সৃষ্টির জন্যে যে ভাবেই দোয়া করছি সেভাবে ইবরাহীম (আঃ) মক্কার জন্যে দোয়া করে গেছেন।
এক ব্যক্তি হুজুর (সঃ)কে প্রশ্ন করলঃ হে আল্লাহর রাসূল! প্রত্যেক বছরই কি হজ্জ ফরজ? হুযুর (সঃ) জবাব দিলেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে সেটাই হয়ে যেত অথচ তোমরা তা পালন করতে পারতে না। ফলে তোমরা কঠিন শাস্তির শিকার হতে।
মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন কল্যাণের কারণে বিভিন্ন কালের নবীদের শরীয়তে তারতম্য রাখা হয়েছে। তার কারণ এই যে, আল্লাহ পাক স্থান-কাল-পাত্রের উপযোগী করে তাঁর নিদর্শন ও শরীয়ত নাযিল করেছেন। হযতর নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় অত্যন্ত কঠিন হৃদয় ও শক্তিমত্তার অধিকারী ছিল। আল্লাহ পাক নিজেই তা বলেছেন। তাই তাদের ওপর স্থায়ীভাবে সারা বছর রোযা ফরজ করা জরুরী ছিল। তার ফলে যেন তাদের পাশব শক্তি নিয়ন্ত্রণে থাকে। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ (সঃ)-এর উম্মত হল দুর্বল। তাই তাদের সে ব্যবস্থা দেয়া হয়নি। তেমনি পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্যে আল্লাহ পাক গনীমতের মাল হালাল করেন নি, কিন্তু আমাদের এই দরিদ্রদের জন্যে তিনি তা হালাল করেছেন। মূলতঃ আম্বিয়ায়ে কেরামের কাজই হচ্ছে জাতির সামগ্রিক দিকগুলোর সংস্কার ও কল্যাণ সাধন। বস্তুতঃ কোন নবী বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া মানুষের স্ববাব ও অভ্যেসের পরিপন্থী কোন নির্দেশ দেননা। তাই এটা স্বাভাবিক যে, বিভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে সৃষ্ট বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন শরীয়ত এসেছে। এ ধরনের কারণ পরিবর্তন সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট।
তার উদাহরণ এই যে, প্রত্যেক ডাক্তার রোগীর পরিবেশ ও অবস্থার দিকে খেয়াল রেখে বিধান দেণ। সে ক্ষেত্রে কাল ভিন্ন, ব্যক্তিও ভিন্ন তথাপি বিধান এক হবে কেন? একটি তরুণকে যে কাজ দেয়া যায়, কোন এক বৃদ্ধকে কি সে কাজ দেয়া যায়? গ্রীষ্মকালে যেভাবে খোলা ময়দানে শোয়ার ব্যবস্থা করা যায, শীত কালেও কি তা পারা যায়?
মূলতঃ যারা দ্বীনের একত্ব ও শরীয়তের সূক্ষ্ম তারতম্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না, তাদের কাছে দ্বীনের ভেতর কখনও কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। এ কারণেই শরীয়তের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে বিভিন্ন জাতির সঙ্গে। কারণ, প্রত্যেক জাতি তাদের প্রাপ্ত ও অনুসৃত শরীয়তেরই উপযোগী। এ যেন তারা দরখাস্ত করে তাদের উপযোগী শরীয়ত চেয়ে নিয়েছেন। এ কারণেই তারা স্বভাবতঃই জবাবদিহি হবে। আল্লাহ পাক বলেনঃ-
(আরবী***********************************************************************************)
সূরা মুমিনূনঃ ৫৩
অর্থাৎ তারপর তারা নিজেদের কাজকে নিজেদের মধ্যে টুকরা টুকরা করে ভাগাভাগি করে নিল এবং প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেদের কাছে যা পেল তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকল।
এ কারণেই আমাদের নবী-এর উম্মতের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটল এবং তাদের জন্যেই শুক্রবারকে জুমুআর দিন নির্ধারণ করা হল। কারণ, এ জাতি ছিল নিরক্ষর জাতি উপার্জিত বিদ্যা থেকে ছিল তারা মুক্ত। পক্ষান্তরে ইয়াহুদীর জন্যে শনিবার ধার্য করা হল। কারণ, তাদের আকীদা এটাই ছিল যে, আল্লাহ এই দিন সৃষ্টিকার্য শেষ করে অবসর নিয়েছেন। তাই নির্দিষ্টভাবে ইবাদতে নিয়োজিত হবার জন্যে এটাই উপযুক্ত দিন। অথচ আল্লাহ পাক সব কিছুই করেন নির্দেশ ও ওহীর মাধ্যমে, তিনি নিজে সে সব কাজে নিয়োজিত থাকেন না।
শরীয়তে এর উদাহরণ হচ্ছে এই যে, শুরুতে কিছু হুকুম-আহকাম অপরিহার্য করে দেয়া হয়। তারপর তাতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। ফলে তা শিথিল করে দেয়া হয়। কারণ, তাতে ব্যাপক শৈথিল্য দেখা দেয়। এক্ষেত্রে মানুষের অবস্থার কারণেই এ শিথিলতা প্রদত্ত হয়েছে। তাই অনেক সময় এ ধরনের শিথিলতার জন্য সেই সম্প্রদায়ই দায়ী থাকে। আল্লাহ পাক বলেনঃ-
(আরবী****************************************************)
সূরা রা’দঃ আয়াত ১১
অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা কখনও কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না ঘটান।
রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ- কোন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোকের বুদ্ধিভ্রষ্ট করার ব্যাপারে তোমাদের স্বল্পবুদ্ধি ও অসম্পূর্ণ দ্বীনের নারীদের চেয়ে বেশী সক্রিয় আর কাউকে দেখিনি। নারীদের অসম্পূর্ণ দ্বীনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ- তোমরা দেখতে পাচ্ছ ঋতুবতী নারী না নামায পড়ছে না রোযা রাখছে।
মনে রাখা দরকার, অবস্থা বিশেষে যদিও বিভিন্ন শরীয়ত নাযিল হবার অনেক কারণ রয়েছে, তথাপি মূলতঃ তা সবই দু’ধরনের হয়ে থাকে।
এক, মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতা। এর ভিত্তিতেই মানুষ শরীয়তের অনুসারী ও তার জন্যে জবাবদিহি হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতঃই শ্রেণীগত উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতার অধিকারী হয়। যেমন, জন্মান্ধের ধারণার ভাণ্ডারে কোন রূপ বা রঙ্গের ঠাঁই নেই। তাতে থাকে শব্দ আর স্পর্শের সঞ্চয়। ফলে সে যখন স্বপ্নে কিছু দেখতে পায়, তখন সে তার ভাণ্ডারে যা আছে তা দিয়েই সেটা বুঝে থাকে, অন্যভাবে বোঝার তার কোন উপায় নেই।
যে আরব আরবী ছাড়া আর কোন ভাষা জানে না, যদি তাকে অন্য ভাষায় কোন কতা বলা হয়, তখন স্বভাবতঃই সে আরবী ভষায় তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে প্রয়াসী হবে। যে সব দেশে হাতী, ভল্লুক ইত্যাদির মত ভয়াবহ জন্তু অহরহ দেখা যায়, সেসব দেশে জ্বীন-শয়তানের কল্পনায় হাতী-ভল্লুকের বিদুঘটে রূপই পরিদৃষ্ট হবে। যে দেশে বস্তুর মর্যাদা দেয়া হয়। আর যে ধরনের উত্তম খানা-পিনা ও আকর্ষণীয় পোশাক-পরিচ্ছদ গ্রহণ করা হয়, তারা কোন ফেরেশতা কিংবা ঐমী নেয়ামতের ধারণা দিতে গিয়ে সেসবের সাহায্যই নেবে। যদি আরবের কোন লোক কো নকাজ করতে কিংবা পথ চলতে গিয়ে ‘রাশেদ’ কিংবা ‘নাজী’ শব্দ শুনতে পায়, তাহলে সেটা শুভলক্ষণ ভেবে থাকে, কিন্তু কোন অনারব তা ভাবে না। এ ধরনের কোন কোন ব্যাপার হাদীস শরীফেও এসেছে। যেমন, পূর্ববর্তী ঘটনার প্রভাব পরবর্তী ঘটনায় পরিলক্ষিত হয়। শরীয়তের ক্ষেত্রে জাতির অতীত ধ্যান-ধারণার প্রভাব ছড়াবেই। ব্যাধি যে ভাবে সংক্রমিত হয় এও তেমনি।
এ কারণেই উটের গোশত ও দুধ বনী ইসরাঈলের জন্যে হারাম হয়েছে বটে, কিন্তু বনী ইসমাঈলের জন্যেতা হালাল হয়েছে। এই একই কারণে খানা-পিনার পাক-নাপাক ও ভাল-মন্দের ব্যাপারটি আরবদের রুচির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তেমনি ভগ্নী বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ইয়াহুদীদের বেলায় তা করা হয়নি। কারণ, তারা ভগ্নীকে বিবেচান করত তার পিতার সন্তান বলে। পিতা যেহেতু তার আপন কেউ নয়, তেমনি ভগ্নীও আপনজন নয়। তাই তার সাথে বিবাহ তাদের অরুচি ছিল না। কিন্তু আরবদের বিবেচনায় ছিল বিপরীত। তেমনি বাছুরের গোশত-গাভীর দুধের সাথে পাকিয়ে খাওয়া ইয়াহুদীদের জন্য হারাম। আমাদের জন্যে তা হালাল। কারণ, ইয়াহুদীদের জানা আছে যে, এ কাজটি আল্লাহর সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটানো ও তাঁর সৃষ্টি কৌশলের পরিপন্থী কাজ। কারণ, আল্লাহ পাক বাছুর লালন-পালনের জন্যে গাভীর দুধ সৃষ্টি করেছেন। উক্ত কাজ দ্বারা তার মূলোৎপাটন ঘটানো হয়। ইয়াহুদীদের ভেতর এ ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল। পক্ষান্তরে আরবদের এসব বিদ্যা ও ধ্যান-ধারণা ছিল না। তাদের তা বলা হলেও তারা তা বুঝত না। কিসের ভিত্তিতে কোন হুকুম আসে তাও তাদের জানা ছিল না। এ অবস্থায় তাদের মন-মানসের অনুকূল ব্যবস্থাই প্রদত্ত হয়েছে।
এটাও মনে রাখা দরকার, শরীয়ত নাযিলের ক্ষেত্রে শুধু যে জনগোষ্ঠীর জ্ঞান, অবস্থা ও ধ্যান-ধারণাই বিবেচনা করা হয় তা হয়; বরং বেশী খেয়াল করা হয় তাদের স্বভাব প্রকৃতিকে। কারণ, তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি তার দ্বারাই পরিচালিত ও প্রভাবিত হয়। ফলে তারা এক কথা দিয়ে অন্য কথা বুঝে থাকে। যেমন যারা সেহরী খেল না তাদের বলা হয় মুখে সীল মারা হয়েছে। যেহেতু তারা মুখে সীল মারা থেকে সেহরী না খাওয়া বুঝে থাকে, তাই যথার্থ সীল মারার এখন প্রশ্ন আসে না।
মোটকথা, বান্দার ওপর আল্লাহ পাকের হক এটাই যে, তাঁর যথাসাথ্য মর্যাদা রক্ষা করে চলবে এবং কোন অবস্থাতেই তাঁর বিধি-বিধানের পরিপন্থী কিছু করবে না। তাছাড়া মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের জন্যে অপরিহার্য হচ্ছে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা রক্ষা করা। একে অপরকে কষ্ট দেবে না। তবে যদি সবাই মিলে কাউকে শাস্তি দিতে চায়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। এ কারণেই কোন ব্যক্তি যখন নিজ স্ত্রীর সাথেও ভিন্ন নারী ভেবে শয্যাশায়ী হয়, তখন তার ও আল্লাহর মাঝখানে এক দেয়াল সৃষ্টি হয়ে যায়, তখন এ কাজটি খোদাদ্রোহিতার শামিল হয়ে যায়। কারণ, সে জেনে-বুঝে আল্লাহর সাথে নাফরমানীর পদক্ষেপ নিয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজ স্ত্রী ভেবে ভিন্ন নারীর সাথে শয্যাশায়ী হয়, তাকে আল্লাহ পাক ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন।
তেমনি কেউ যদি রোযার মানত করে তো রোযা তার জন্যে অপরিহার্য হয়ে যায়। যদি সে রোযা না রাখে, তাহলে সে জবাবদিহি হবে। কিন্তু মানত না করলে জবাবদিহি করতে হবে না।
মোটকথা, দ্বীনকে যে কঠিন করে নিতে চায়, তার জন্যে কঠিন করে দেয়া হয়। কোন ইয়াতীমকে আদব শিখানোর জন্যে থাপ্পড় মারাও পুণ্যের কাজ। অথচ শুধু কষ্ট দেয়ার জন্যে থাপ্পর দিলে পাপ হবে। ভুল-চুকের ব্যাপারগুরো ক্ষমার্হ। এ রীতি-নীতিগুলো জাতির অন্তর্নিহিত স্বাবাবিক জ্ঞানথেকেই জন্ম নেয়। এর ভিত্তিতেই শরীয়তের বিধান অবতীর্ণ হয়।
মনে রাখতে হবে, কমনসেন্স বা সাধারণ ও স্বাভাবিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরব-আজম তথা সকল সভ্য জাতিগুলোই সমান। যেমন, মৃতের জন্যে শোক করা, তার ব্যাপারে সদয় ও বিনয়ী হওয়া, বংশের গৌরব করা, রাতের এক-চতুর্থাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ পার হতেই শুয়ে পড়া, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা ইত্যাদি মানব সভ্যতার পয়লা স্তর থেকেই সর্বজন স্বীকৃত হয়ে চলে আসছে। তারপর যে জাতির কাছে নবী প্রেরিত হয়েছে ও তারা নবীর শিক্ষা পেয়েছে এবং যাদের সব কিছুই আল্লাহ পাক নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তাদের ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান-বুদ্ধি তো আরও উন্নত।
মনে রাখতে হবে, নবুয়ত কোন না কোন মিল্লাতের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী***********************************************************)
সূরা হাজ্জঃ আয়াত ৭৮
অর্থাৎ তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত। তিনি আরও বলেনঃ
(আরবী************************************)
সূরা ছাফাতঃ আয়াত ৮৩
অর্থাৎ নিঃসন্দেহে ইবরাহীমের অনুসারী ছিল।
এর রহস্য এই যে, যখন কো জনগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোন ধর্মের অনুসারী হয় এবং সেই ধর্মের নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে চলে, আর তার বিধি-বিধানগুলো অনস্বীকার্য সামাজিক রীতি-নীতিতে পর্যবসিত হল, তখন অন্য যুগ এসে যায়। উদ্দেশ্য হচ্ছে, এতদিনে দ্বীনের ভেতর যা কিছু ঘাটতি বা বাড়তি হয়েছে তা সংশোধন করা ও মিল্লাতের ভেতরে যে বিচ্যুতি বিপর্যয় ঘটে গেছে তা সংস্কার করা।
বস্ততঃ নতুন নবী এসে মিল্লাতের সুবিদিত ও সুপ্রচলিত রীতি-নীতিগুলো যাচাই-বাছাই করেন। যেগুলো জাতীয় ব্যবস্থাপনার রীতি-নীতি হয়ে গেছে ও দ্বীনি দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক আছে সেগুলো ঠিক রাখা হয় এবং সেদিকে সবাইকে আহবান জানায় ও তা অনুসরণের জন্যে সবাইকে উদ্ধুদ্ধ করে। পক্ষান্তরে যেসব রুছম ও রীতি-নীতি দ্বীনের পরিপন্থী হয়েছে ও বিকৃতি ঘটিয়েছে সেগুলোতে প্রয়োজন মোতবেক পরিবর্তন ঘটান। সাধারণতঃ নতুন নবী আগেকার শরীয়তের বেঁচে থাকা বিধি-বিধানের দলীল হিসেবে পেশ করেন এবং বলা হয় এ নবী অমুক নবীর দ্বীনেরই অনুসারী কিংবা তাঁরই গোত্রভুক্ত। অবশ্য অনেক সময় এ নবুওয়ত ভিন্ন জাতির ভেতর আসে, তখন সেই জাতির ভিন্ন রীতি-নীতির কারণে শরীয়তের ভেতর পার্থক্য সৃষ্টি হয়।
দুই, বিশেস ধরনের শরীয়ত নাযিল হওয়ার কারণ, নিতান্তই বাহ্যিক। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে এই, যদিও আল্লাহ পাক স্থান কালের ঊর্ধ্বে, তথাপি কালগত ব্যাপারের সাথে তাঁর কোন না কোন ধরনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। নবী করীম (সঃ) বলেন, আল্লাহ পাক প্রতি শতকে বড় ধরনের কিছু ঘটান। হযরত আদম (আঃ) সহ অন্যান্য নবীগণ কেয়ামতের দিন শাফায়াত প্রসঙ্গে বলেনঃ আল্লাহ পাক আজ এতই রুদ্ররূপ ধারণ করেছেন যা তিনি আর কখনও করেন নি এবং আজকের পরেও করবেন না।
পৃথিবী যখন তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়, তখন তার সীমারেখাও নির্ধারিত হয়। আল্লাহ পাক পৃথিবীতে দ্বীন ও শরীয়ত পাঠাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান। সর্বোচ্চ পরিষদ তদনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়। তদ্রূপ সময়ে একটি সাধারণ কারণও যদি দেখা দেয় সেটাও মহান দরবারের দরজায় কড়া নাড়াবার জন্যে যথেষ্ট হয়। তখন যে লোকই দরজায় কড়া নাড়বে তার জন্যে দরজা খুলে যাবে। এ ব্যাপারটি বোঝার জন্যে শস্য উৎপাদনের মৌসুমটি খেয়াল করুন। তখন বীজ বপন-রোপনের ব্যাপারে সামান্য প্রয়াসই যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়। অথচ অন্য মৌসুমে হাজার চেষ্টায়ও তা হয় না। রাসূলে করীম (সঃ)-এর কোন কিছুর দিকে মনোযোগ দেয়া, তার জন্যে দোয়া করা এবং তা আকাঙ্ক্ষা করা এমনকি আল্লাহর ফায়সালা আসার জন্যে অপেক্ষা করা প্রয়োজনীয় কারণের চাইতে অধিক শক্তিশালী কারণ বটে।
হুযুর (সঃ)-এর দোয়া যখন একটি আলোকময় পদ্ধতিকে জীবন দান করে এবং তাঁর দোয়ায় বিরাট এক জামাত তাঁর অনুসারী হয়ে যায়, দেখাদৃষ্টেই খানাপিনায় বরকত দেখা দেয়, তখন সেই হুকুম নাযিলের ব্যাপারে তোমাদের কি খেয়াল যা হচ্ছে একটি সামগ্রিক প্রাণসত্তা আর যার অবস্থান হচ্ছে বস্তুগত এক অবয়বের সাথে?
এ মৌলনীতির আলোকে জানা দরকার যে, হুযুর (সঃ)-এর যুগের যে দুটি বড় দুর্ঘটনা নিয়ে তিনি নিজেও অত্যন্ত পেরেশান হয়েছিলেন, যেমন হযরত আয়েশা সিদ্দিকার (রাঃ) ওপর অপবাদ ও হুযুর (সঃ) কে তা নিয়ে বারংবার প্রশ্ন করা এবং জেহারের ঘটনা। এ ধরনের ব্যাপারও ওহী নাযিলের কারণ হয়ে যায়। এগুলো আসল সত্য উদঘাটনের জন্যে উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবে কোন জাতির আনুগত্যে শৈথিল্য দেখানো, আনুগত্যের পরিপন্থী কাজে নিয়োজিত হওয়া, নাফরমানীর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা ও অনুরূপ কোন ব্যাপারে অভ্যস্ত হওয়া, এমনকি এ বিশ্বাস রাখা যে, এ কাজ না করলে আল্লাহর কাজে নিদারুণ শৈথিল্য দেখানো হবে, এসবকাজ সেই জাতির ওপর কড়া বিধি-বিধান নাযিল ও উক্ত কার্যাবলী হারাম হওয়ার কারণ হয়ে দেখা দেয়।
এ ভাবেই লক্ষ্য করুন, যখন কোন নেক বান্দা তাঁর পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে কায়মনে আল্লাহর দরবারে করুণার বারি বর্ষণের জন্যে দোয়া করেন, তখন তা সঙ্গে সঙ্গে কবুল হওয়ার সংগত কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রসংগেই আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
সূরা মায়িদাঃ আয়াত ১০১
অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ! সেই ব্যাপারগুলো থেকে কোন কিছুর জন্যে তোমরা প্রার্থনা করোনা যা প্রকাশ পেলে তোমরা নাখোশ হবে। কোরআন নাযিলের সময়কালের ভেতরে যদি তোমরা সে ধরনের কিছু চেয়ে বস, তাহলে তা প্রদত্ত হবে”।
আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হন যদি তাঁর বান্দারা শরীয়ত অবতরণ কালে বা তার প্রাক্কালে শরীয়ত কাঠিন্য সৃষ্টি করার মত কোন কাজ বা প্রার্থনা না করে। কারণ, শরীয়ত নাযিলই হয় জনগোষ্ঠীর বিশেষ অবস্থা ও চাহিদার প্রেক্ষাপটে। অনেক সময়ই পূর্ব প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ পরবর্তী জনগোষ্ঠীর জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই হুযুর (সঃ) প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে বলতেন। তিনি বলেনঃ যে ব্যাপারে আমি তোমাদের ওপর ছেড়ে দেই সে ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করো না। কারণ, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণ অতিরিক্ত প্রশ্ন ও নবীদের বিরোধিতা করে ধ্বংস হয়েছে।
তিনি আরও বলেনঃ “মুসলমানদের ভেতরে সবচেয়ে অপরাধী সেই লোক যে অহেতুক প্রশ্ন করে বৈধ বস্তুকে অবৈধ করিয়েছে”। হাদীসে এও আছেঃ “বনী ইসরাঈলরা যে কোন ধরনের গাভী জবাই করলেই যথেষ্ট হত। কিন্তু তারা অহেতুক প্রশ্ন করে ব্যাপারটিকে কঠিন করে নিয়েছে”। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
পরিচ্ছেদঃ আটান্ন
শরীয়তের জন্যে জবাবদিহির কারণ
এখানে আমরা শরীয়ত ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। আল্লাহ পাক মানুষের জন্যে যা কিছু নির্ধারণ করেছেন, তা করা বা না করার কারণে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে কিনা এবং দেয়া হলে তা কিভাবে করা বা না করার জন্যে দেয়া হবে তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে। যেমন, এক ব্যক্তি নামাযের ওয়াক্তে নামায না পড়ে অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভক্তিতে ডুবে থাকল, তখন তাকে কি নামায না পড়ার জন্যে শাস্তি দেয়া হবে? আর যে ব্যক্তি যথারীতি ওয়াক্ত মত নামায আদায় করল, কিন্তু অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভক্তির উপস্থিতি ছিল না, তাকে কি পুরস্কার দেয়া হবে?
শরীয়তের নাফরমানীর ভেতর যে মারাত্মক ক্ষতি ও জটিলতা রয়েছে তা প্রশ্নাতীত ব্যাপার। এটা সুস্পষ্ট যে, যে কাজ সুনির্ধারিত ও সঠিক পথে বিকৃতি ও বিভ্রান্তি আনে এবং পাপের দুয়ার খুলে দেয়, গোটা মুসলিম মিল্লাত তাতে বিভ্রান্তির শিকার হয়, তাদের রাষ্ট্র, নগর ও পল্লীতে তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এ ধরনের নাফরমানীর উদাহরণ এই যে, কোন শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেয়া হল, কিন্তু কেউ এসে তাতে সুড়ং খুঁড়ে দিল, তারপর নিজে এড়িয়ে গিয়ে বাঁচল, কিন্তু শহরবাসী ডুবে মরল। এখন প্রশ্ন হল, পাপ বা পুণ্যের আওতায় সে লোক আসে কি না?
সকল মজহাব এ ব্যাপারে একমত যে, শরীয়তের বিধি-নিষেধের ভিত্তিতেই পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে। তাদের মধ্যকার মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম ও সাহাবায়ে কেরাম শরীয়তের কাঠামোর সাথে তার প্রাণসত্তার সংযোগও অপরিহার্য মনে করেছেন। তবে যারা দ্বীনের বাহক ও শরীয়তের সংরক্ষক, তারা শরীয়তের কাঠামোকেই যথেষ্ট মনে করেন। ইসলামের দার্শনিকরা বলেন, সাওয়াব ও আজাবের ভিত্তি হল ব্যক্তির সে সব দৈহিক ও চারিত্রিক আমল, যার সাথে আত্মার সংযোগ রয়েছে। শরীয়তের অবয়বের সাথে পরিচয় ঘটানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে তার সূক্ষ্ম তাৎপর্যের দিকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ ব্যাখ্যাটি জাতির পথ ও পদ্ধতির যথার্থই অনুকূল।
আমি বলছি, বিশেষজ্ঞ আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে যে, শরীয়তের বিধি-নিষেধের নিয়ামক কতিপয় কারণ থাকে। তার ফলে এক শ্রেণীর সম্ভাবনাকে অপর শ্রেণীর ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। আল্লাহ পাক ভাল করেই জানেন যে, এ শরীয়ত ও তরিকত ছাড়া সাধারণ জনগোষ্ঠী দ্বীন অনুসরণ করতে পারবে না। তিনি এও জানেন যে, দ্বীন বাস্তবায়নের শুধু পদ্ধতি দিয়েই হবে না তা অপরিহার্য করে দিতে হবে। যে জাতিকে আল্লাহ পাক এ কাজ দেবেন আদি থেকে তা তাঁর ইলমে মওজুদ আছে। যখন পৃথিবী এরূপ উপযোগী হয়ে যায় যে, আল্লাহর মূল দ্বীন বিশেষ শরীয়তের রূপ ও কাঠামো নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে এবং তা বিশেষ ধরনের শরীয়ত সমগ্র দ্বীনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবে। তারপর যখন আল্লাহ পাক সর্বোচ্চ পরিষদকে তা জানিয়ে দেন এবং ইলহাম করে দেন যে, এ শরীয়তই এখন মূল দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং জনগোষ্ঠীকে এরূপ বিধি বিধানের ব্যবস্থা ছাড়া জবাবদিহি করা যাবে না, তখন পবিত্র মজলিস এ ব্যাপারে একমত হয়ে যায় যে, বর্তমান শরীয়তই দ্বীনের যথার্থ রূপ। শব্দের সাথে অর্থের যে সম্পর্ক, মৌলসত্তার সাথে বাহ্যিক অবয়বের যে সম্পর্ক, ছবি বা প্রতিবিম্বের মূল বস্তুর যে সম্পর্ক, বর্তমান শরীয়তের সাথে সনাতন দ্বীনের সেই একই সম্পর্ক।
এসব ক্ষেত্রে প্রমাণ ও প্রমাণিতের ভেতর সুদৃঢ় সম্পর্ক হয়ে যায় এবং এ দুটোর একটি অপরটির জন্যে অপরিহার্য হয়ে যায়। ফরে এটা সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, প্রমাণই প্রমাণিতের স্থলাভিষিক্ত এবং দুটোই এক। অতঃপর এ জ্ঞানের রূপ ও স্বরূপ আবর ও আজমের সকল লোকের অনুভূতিতেই সাড়া জাগাল এবং এ ব্যাপারে সকলেই একমত হয়ে গেল। তুমি এমন কোন লোক দেখতে পাবে না, যে ব্যক্তি তার অন্তরে গোপন দপ্তর রাখেনি। কখনও আমরা সেটার নাম দেই প্রমাণিতের প্রতিবিম্ব। অনেক সময় সেই অংশটির এমন সব অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক প্রভাব ও লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা সন্ধানী লোকের চোখ এড়ায় না। কোন কোন শরীয়তে তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ কারণেই সদকাকে সদকাদাতার ময়লা আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই আমলের যা কিছু ত্রুটি আত্মিক সাধনার মাহাত্ম্যে নির্মল হয়ে যায়।
অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রেরিত হন, তিনি তখন পবিত্র আত্মার (জিবরাঈল আঃ) সহায়তা পেলেন। আর তাঁর অন্তরে স্বজাতির সংস্কারের প্রবণতা ঢেলে দেয়া হল। শরীয়তের অবতরণ এবং তার রূপ ও স্বরূপ প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর আত্মিক শক্তির এক প্রশস্ত দরজা খুলে গেল। ফলে তাঁর হিম্মত বেড়ে গেল। তখন তিনি সংস্কার কাজের জন্যে অত্যন্ত দৃঢ় সংকল্প নিলেন। নিজ সহযোগীদের জন্যে তিনি দোয়া করলেন আর বিরোধীদের জন্যে শক্তভাবে লানত করলেন। আম্বিয়ায়ে কেরামের মনোবল সপ্ত আকাশ ভেদ করে চলে যায়। যখন তাঁরা বৃষ্টি বর্ষলেণর জন্যে দোয়া করেন, তখন যদি সামান্য মেঘের কণাও না থাকে, তথাপি পাহাড়ের মত কালো হয়ে বর্ষা নেমে থাকে। তাদের দোয়ায় মৃত ব্যক্তি জীবন ফিরে পায়। তাদের কারণে পবিত্র মজলিসে সন্তোষ কিংবা অসন্তোষ দেখা দেয়।
রাসূল (সঃ) বলেনঃ নিঃসন্দেহে তোমার নবী ও বান্দা ইবরাহীম (আঃ) মক্কার জন্যে দোয়া করেছিলেন এবং আমি মদীনার জন্যে দোয়া করছি।
অতঃপর যখন বান্দার জানতে পেল যে, আল্লাহ তাআলা এই নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং এও জানতে পেল যে, সর্বোচ্চ পরিষদ সব রকমের আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে নবী করীম (সঃ)-এর সাহায্য করে থাকে, তারা এও ভালভাবে জেনে নিল যে, আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ ব্যাপারে বিপরীত পদক্ষেপ নেয়া আল্লাহরসাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শন এবং কাজে ত্রুটি ঘটানো বৈধ নয়, তারপরও যদি কেউ জেনে-বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিপরীত কাজ করে বসে, তবে সে নিঃসন্দেহে কুফরীর আঁধারে হাবুডুবু খেয়ে থাকে। তার ফেরেশতাসুলভ স্বভাব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সে কাজের ফলে তার অন্তর পাপে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
পক্ষান্তরে যখন কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন কঠিন কাজ করে, আর তখণ তা সে কাউকে দেখানোর জন্যে না করে, বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তোষ লাভের জন্যে করে, তখন তার কারণ এটাই হয় যে, তার অন্তর ইহসান ও ফজিলতে পরিপূর্ণ থাকে এবং তার পাশব শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। আত্মার ওপর পুণ্যকে দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপনের এটাই কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অবশ্য যদি কেউ কোন নামায তরক করে, তখন জানা দরকার যে, কেন সে তা করেছে। কোন বস্তু তাকে সে কাজে বাধ্য বা উদ্ধুদ্ধ করেছে? যদি সে ভুলে গিয়ে থাকে বা ঘুমে অচেতন থেকে থাকে কিংবা উক্ত নামাযের ফরজিয়াত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে অথবা এমন কোন সমস্যায় আবদ্ধ থাকে যা থেকে রেহাই পাচ্ছিল না, তাহলে সে ব্যক্তি সর্বসম্মতভাবেই গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। পক্ষান্তরে যদি সে জেনে-বুঝে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নামায বাদ দিয়ে থাকে, তাহলে তার এ কাজটি দ্বীনের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন বলে বিবেচিত হবে। হয় সরাসরি শয়তান কিংবা তার শয়তান প্রভাবিত আত্মা তার পথে অন্তরায় হয়েছে। কারণ, শয়তানী প্রভাব তার আত্মার দিব্যদৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
তেমনি যে ব্যক্তি নামায আদায় করে দায়িত্ব পালন করে থাকে, তখন অনুমান করা দরকার, সে কি লোক দেখানো নামায পড়ল, না উদ্দেশ্যবিহীনভাবে খেয়ালে এল তাই পড়ল। যদি সেসবের কিছু হয়, তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে ব্যক্তি অনুগত বান্দা নয়। তাই তার সে নামাযের কোন গুরুত্ব নেই। হ্যাঁ, যদি সে আল্লাহকে রাজী-খুশী করার জন্যে তা করে থাকে, আর ঈমানের সাথে বুঝে-শুনে যথানিয়মে তা করে এবং সরল নিয়তে কায়মনে আল্লাহর দ্বীনের অনুসরণের জন্যে তা করে থাকে, তাহলে তার আর আল্লাহর মধ্যকার দরজা অপরিহার্যভাবে খুলে গেল। হোক তা সূঁচের মতই ক্ষুদ্র দরজা।
যে ব্যক্তি দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করে নিজেকে বাঁচাল সে ব্যক্তি বেঁচে গেল বলে আমি মনে করি না। তা হয়ই বা কি করে? কারণ, আল্লাহর দরবারের ফেরেশতারা দেশ ও জাতির সামগ্রিক সংস্কার ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করতে থাকেন। সে ক্ষেত্রে যে দেশ-জাতি ধ্বংস করে থাকে সে ফেরেশতাদের বদদোয়া পেয়ে থাকে। তাই তার ফলে কোন না কোন শাস্তি নেমে আসে। এ ক্ষেত্রটি বেশ সূক্ষ্ম ও জটিল বিধায় ফেরেশতার দোয়াকে এর শিরোনাম করলাম।
কলা-কৌশল ও কার্যকারণ রহস্য
স্মরণ রাখা চাই যে, বান্দার কোন কোন কাজ এমন হয় যাতে আল্লাহ তার ওপর খুশী হন। তেমনি বান্দার কোন কোন কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। অবশ্য বান্দার এমন কিছু হয় যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কোনটাই হন না। আল্লাহ পাক নেহাৎ দয়া করে বান্দার কাছে রাসূল পাঠিয়ে থাকেন। তাঁর মাধ্যমে তিনি বান্দাকে তাঁর খুশী ও অখুশীর কাজগুলো বাতলে দেন। তিনি বান্দার কাছে কিছু কাজের দাবী জানান এবং কিছু কাজ করতে নিষেধ করেন। এ ছাড়া অন্যান্য কাজে বান্দাকে স্বাধীনতা দান করেন। যদি কেউ ধ্বংস চায় সে যেন দলীল দাঁড় করে ধ্বংস হয় এবং যে বাঁচতে চায় সেও যেন দলীল সহকারে বাঁচতে পারে।
বান্দার কাছে কোন চাওয়া কিংবা তাকে কোন কাজে নিষেধ করা অথবা তাকে কোন কাজে স্বাধীনতা দেয়া, এ সবই আল্লাহর হুকুমের আওতায় আসে। এর ভেতরে কিছুতো আল্লাহ খুশী-অখুশীর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। কিছু কাজ আবার তাঁর খুশী-অখুশীর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে না। কখনও কাজের জোর দাবী থাকে যা করলে আল্লাহ খুশী হন ও বান্দা পুরস্কৃত হয় এবং তা না হলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন ও বান্দা শাস্তি পেয়ে থাকে। আবার কোন কাজ দাবী করা হয় এবং তা করলে পুরস্কার পেয়ে থাকে, কিন্তু না করলে অসন্তোষ ও শাস্তির যোগ্য হয় না।
তেমনি কোন কাজ জোর দিয়ে নিষেধ করা হয় যা পালন করলে সন্তোষ ও পুরস্কার পাওয়া যায় এবং তা না মানলে অসন্তোষ ও শাস্তি দেখা দেয়। তদ্রূপ কোন কোন নিষিদ্ধ কাজ এরূপ যে, তা থেকে বিরত থাকলে সন্তোষ ও পুরস্কার পাওয়া যায়, কিন্তু বিরত না থাকলে অসন্তোষ ও শাস্তি দেখা দেয় না। মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিভাষায়ও এ ধরনের ব্যাপার দেখা যায়। এর ওপর ভিত্তি করেই শরীয়তের বিধান পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে।
(১) ওয়াজিব (২) মুস্তাহাব (৩) মুবাহ (৪) মকরূহ (৫) হারাম। অনুসারীদের অবস্থানুসারে প্রত্যেক শ্রেণীর সকল কাজ ভিন্ন ভিন্নভাবে সবিস্তারে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কারণ তা অসংখ্য। মানুষেল পক্ষেই তা পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়। তাই এটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল যে, প্রত্যেক শ্রেণীর জন্যে এমন এক মূলনীতি বলে দেয়া যার মধ্যে সেই শ্রেণীর যাবতীয় কাজ শামিল হতে পারে। মানুষ যেন সেই মানদণ্ডে নিজ নিজ কার্যাবলীর অবস্থা পরিপূর্ণ পরিজ্ঞাত হতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ে এ ধরনের মূলনীতি নির্ধাতির হয়ে থাকে। যেমন, আরবী ব্যাকরণবিদগণ বলে থাকেন, কর্তা পেশযুক্ত হবে। পাঠক তা স্মৃতিতে ধরে রাখে। তাই তারা “কানা যায়দুন ও কাআদা আমরুন” পাঠ করে। এভাবেই তারা সব কর্তার অবস্থা জেনে নেয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে একই রীতি অনুসরণ করে। এরূপ মূলনীতিই সকল কার্যের কারণ হয়ে থাখে। সেটা আবার দু’ধরনের হয়ে থাকে।
নয়া বিধায় বিধানও পরিবর্তিত হয়। শুধু ঈমানের প্রশ্নটিই অনুসারীর জন্যে সর্বাবস্থায় সমানে প্রতিপাল্য।
অনুসারীর অবস্থা বিবেচনার ক্ষেত্রে দুটি দিক বিবেচ্য হয়। এক, অনুসারীর স্থায়ী গুণগত অবস্থা, যার ভিত্তিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া যায়। দুই, তার অস্থায়ী গুণগত অবস্থা। এটা পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তিত অবস্থার ক্রমাবর্তন ঘটে চলে। এ ধরনটি বেশীর ভাগ ইবাদতের ক্ষেত্রে দেখা দেয়। যেমন, ইবাদতের ওয়াক্ত, সামর্থ্য, সুযোগ ইত্যাদি। তাই হাদীস শরীফে এসেছেঃ “যে ব্যক্তি জ্ঞানপ্রাপ্ত ও বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায় নামাযের ওয়াক্ত পেল, তার জন্যে নামাজ পড়া ফরজ হয়ে গেল। তেমনি যে ব্যক্তি জ্ঞানপ্রাপ্ত ও বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায় রমযান মাস পেল তার জন্যে শক্তি থাকলে রোজা রাখা ফরজ হয়ে গেল। তেমনি যে ব্যক্তি যাকাত যোগ্য সম্পদের মালিক হয়, আর তা এক বছর স্থায়ী থাকল, তার জন্যে যাকাত দেয়া ফরজ হল। অতঃপর যে ব্যক্তি সফরে থাকে তার কসর নামায ও রোযা ভঙ্গের অনুমতি রয়েছে। এভাবে যদি কেউ নামায পড়তে চায়, তবে তার জন্যে অজু না থাকলে অযু করা ফরজ হয়ে যায়।
এসব ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই গুণের অনুপস্থিতি ঘটে যার ওপর সাধারণ বিধি-বিধান নির্ভর করে। তখন বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিশেষ গুণের ভিত্তিতে বিধান প্রদত্ত হয়। যার ফলে এক ধরনের ইবাদতের ওপর অন্য ধরনের ইবাদত বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে। অবশ্য ভুলক্রমে সেটাকে ইবাদতের কারণ বলা হয়। বলা হয় নামাযের কারণ হচ্ছে ওয়াক্ত উপস্থিত হওয়া। রোযার কারণ হল রমযান মাস উপস্থিত হওয়া। কোন কোন ব্যাপারে স্বয়ং শরীয়ত প্রবর্তক কোন বিশেষ বিশেষণের ভিত্তিতে সময় নির্ধারণ করেন। যেমন, যে ব্যক্তি যাকাত যোগ্য সম্পদের মালিক হয়েছে তাকে দু’এক বছর আগেই যাকাত দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। অবশ্য যাকাতযোগ্য সম্পদের অধিকারী না হলে তার ব্যাপার স্বতন্ত্র। যাহোক, যে কোন ফিকাহবিদ প্রত্যেকটি বিষয়ের সঠিক পরিমাপ ও যথার্থ নির্ধারণ করতে পারেন। তিনি কোনটিকে কার্যকারণের সাথে এবং কোনটিকে শর্তের সাথে নির্দিষ্ট করে নেন।
করা হয় যার ওপর কাজটি সক্রিয় হয়, কিংবা সেই অবস্থার সাথে কাজটির কোন না কোন সম্পর্ক থাকে। এ কারণটি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে, শরাব পান করা হারাম, শূকর খাওয়া, হিংস্র জানোয়ার ও নখ বিশিষ্ট পাঞ্জাওয়ালা পাখী হারাম, মা’কে বিয়ে করা হারাম ইত্যাদি। কখনও এ কারণটি সাময়িক হয়। একের পর এক করে তা এসে থাকে। যেমন, আল্লাহ পাক বলেনঃ “পুরুষ কিংবা নারী চোরের হাত কেটে দাও”।
অনেক সময় এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, যে বিষয়ে কাজটি সংশ্লিষ্ট হয়, সে বিষয়টি দুই বা ততোধিক অবস্থার সাথে শামিল থাকে। যেমন, শরীয়ত প্রবর্তকের নির্দেশ হল, “বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা কর এবং অবিবাহিত ব্যভিচারীকে কোড়া মার”।
অনেক সময় বিষয়টি অনুসারীর অবস্থার সাথে কাজটি সংশ্লিষ্ট এ উভয় অবস্থায়ই বিবেচ্য হয়। যেমন, শরীয়ত প্রবর্তক বলেছেনঃ সোনা ও রেশমের ব্যবহার এ উম্মতের পুরুষদের জন্যে হারাম, অবশ্য নারীর জন্যে হারাম নয়।
এ কথা স্মরণ রাখঅ প্রয়োজন যে, আল্লাহর দ্বীনে কোন আজেবাজে ব্যাপার নেই। যে সব কাজে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টি জড়িত, তা এ রূপে যে, সে সব কাজের এমন বিশেষ রূপ দেয়া হয়, যাতে তার সাথে আল্লাহর খুশী-অখুশীর প্রশ্নটি জড়িয়ে যায়। তাও আবার দু’ধরনেরঃ
এক, ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণে ও অকল্যাণের সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ ও পুণ্য, যেমন- সাধারণ বৈষয়িক কার্যাবলী
দুই, শরীয়াতের নিছক ধর্মীয় ব্যাপার সংশ্লিষ্ট পাপ ও পুণ্য, যেমন –তাহরীফ বা বিকৃতির পথ বন্ধ করা, বাহানা খোঁজা থেকে বিরত রাখা ইত্যাদি।
এসব নির্ধাতির কার্যাবলীর যথাযথ স্থান ও অপরিহার্য উপকরণ রয়েছে এবং উভয়ের ভেতরে পরোক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির ব্যাপারটিও কেবল ব্যাপক অর্থে সে সবের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে। যেমন বলা হল, সুস্থতার কারণ হচ্ছে ওষুধ খাওয়া। অথচ সুস্থতার কারণ হল পিত্তের এলোমেলো অবস্থা গুছিয়ে যাওয়া কিংবা তা সৃষ্টির কারণ দূর হওয়া। তবে স্বভাবতঃই ওষুধ খেলে এসব হয়ে থাকে। কিন্তু ওষুধ ও পিত্তের স্থিরতা এক বস্তু নয়। যেমন, বলা হয়, রোদে ঘুরলে কিংবা হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খাটলে অথবা উত্তেজনাকর খাদ্য খেলে জ্বর হয়। আসলে তো পিত্ত তেতে জ্বর হয়। আর পিত্ত গরম হওয়া একই বিষয়। অবশ্য তার কারণ ও উপকরণ বিভিন্ন। মূলনীতিকেই যথেষ্ট ভাবা ও তার কার্যকারণ এড়িয়ে চলা শুধু দর্শন শাস্ত্রে পারদর্শীদের জন্যে সম্ভব। কারণ, তাদের দৃষ্টি অনেক গভীরে। সাধারণ লোকের সেই স্তর নয়।
অথচ শরীয়ত সাধারণ মানুষের উপযোগী করেই নাযিল করা হয়েছে। তাই প্রতিটি হুকুম-আহকামের কারণ এরূপ গুণ বিশিষ্ট হওয়া চাই যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। কোন বিধানের রহস্য যেন তাদের কাছে গোপন না থাকে। তার অস্তিত্ব কি অনস্তিত্ব কোনটিই যেন তাদের কাছে লুকানো না থাকে। তবে তা অবশ্যই সেই রীতি-নীতির সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত থাকবে যার সাথে সন্তোষ ও অসন্তোষ জড়িত। হয় তা সেদিকে নিয়ে যাবে কিংবা তার কাছাকাছি করে দেবে।
যেমন, শরাব পান করার ফলে অনেক অন্যায় কাজ দেখা দেয়। সেগুলোর সাথে আল্লাহর অসন্তোষ জড়িয়ে আছে। যেমন, শরাবখোর ভাল ও নেক কাজ থেকে বিরত থাখে। সে আজেবাজে বকে থাকে। পারিবারিক ও নাগরিক জীবন বিপন্ন করে। এ সব খারাপ কাজ শরাব পানের অপরিহার্য কুফল। তাই সব ধরনের শরাব হারাম করা হয়েছে। কোন এক বস্তুর যখন কয়েকটি উপায় ও অনুষঙ্গ থাকে, তখন সেই বস্তুর কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেটাকেই প্রাধান্য দিতে হবে যেটা সুস্পষ্ট ও রীতি-নীতির সাথে সুসম্পৃক্ত। মূলের সাথে তার অপরিহার্যতা ও কারণ হিসেবে তার সম্ভাবনা সমধিক হতে হবে। যেমন, কসর নামায ও রোযা ভংগের মূল কারণ সফর কিংবা রুগ্নতা। সে দুটোর অন্যান্য অন্তরায়গুলোর ওপর তা নির্ভরশীল নয়। কারণ, কৃষি ও কামারের কাজ যদিও বেশ কষ্টকর কাজ, তথাপি সেগুলোকে কারণ বানালে আনুগত্য ও ইবাদতে বাধা সৃষ্টি হয়ে থাখে। মূলতঃ পেশাদাররা নিজ নিজ পেশায় জীবিকার তাগিদেই অভ্যস্ত হয়ে থাকে। তাই গরম-ঠাণ্ডার সঠিক আন্দাজ তাদের থাকে না। কারণ, গরম-ঠাণ্ডারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। সেগুলো সব জানাও কঠিন ব্যাপার। নির্দিষ্ট লক্ষণ ও চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না।
তাই অন্তরায়গুলোর শুধু সেটাকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে যা প্রথম যুগেই পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেছে। সফর ও ব্যাধি এমন ব্যাপার, যার ভেতরে কোন সংশয়ের বালাই নেই। যদিও আজকাল তাতেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ, আরবের সেই সহজ সরল পয়লাযুগটি খতম হয়ে গেছে। মানুষ এখন সংশয়ের ভেতর গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করছে। মানুষের সেই সুস্থ বিবেক শেষ হয়ে গেছে যা প্রথম যুগে খাস আরবদের ভেতর দেখা যেত।
প্রথম খণ্ড সমাপ্ত