বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
অধ্যায়-৫৯
ফরজ, আরকান, আদাব তথা শিষ্টাচার এবং এ জাতীয় বিধানগুলো নির্ধারণের কারণ
স্মরণ রাখা চাই যে, উম্মতকে শাসন করার সময় এরূপ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথা জরুরী যে, তার আনুগত্যের বিধানগুলোর প্রত্যেকটির জন্য দুটি সীমারেখা নির্ধারণ করা হবে। সর্ব ঊর্ধ্ব সীমা ও সর্বনিম্ন সীমা। সর্ব ঊর্ধ্ব সীমা হলো যে ইবাদতের মাধ্যমে উম্মত তার অভিষ্ট লক্ষ্যের সর্বশেস সীমায় উপনীত হতে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে সর্বনিম্ন সীমা থাকবে এমন পর্যায়ের যে পর্যায়ে পৌঁছার পর তারপর আর কোন কিছু থাকবে না, যাকে গ্রহণ করা যেতে পারে।
তার ব্যাখ্যা হলো, এরূপ করার এমন কোন পন্থা নেই যে, মানুষের নিকট একটা বিষয়ের দাবি করা হবে অথব সে বিষয়ের অংশ, ছুরত এবং তার সে পরিমাণ বর্ণিত হবে না যা তার নিকট কাম্য। এমনটি হওয়া শরীয়তের (শরীয়তের উদ্দেশ্যের) খেলাপ। আর সেজন্যে এমন পন্থাও হতে পারে না যে, সকলকেই তার আদাব ও পরিপূর্ণভাবে তা করার জন্যে বাধ্য করা যাবে। তা এজন্য সম্ভব নয় যে, এরূপ করা হলে তা হবে অসম্ভব কাজ সমাধানের জন্য বাধ্য করা, ব্যস্ত লোকদের অথবা তা হবে সীমাতিরিক্ত কষ্টকর কাজ। উম্মতের সকল কাজের পরিধি হলো মধ্যম পন্থা অবলম্বন। সর্বশেষ পর্যায়ে উপনীত হওয়া নয়। আবার এমন করাও ঠিক নয় যে, সর্ব ঊর্ধ্ব সীমা ত্যাগ করে সর্বনিম্ন সীমাকে যথেষ্ট মনে করা হবে –গ্রহণ করা হবে –যথেষ্ট মানা হবে। সুতরাং নিঃসন্দেহে সর্ব ঊর্ধ্বের সীমা সাবেকীনদের এবং মোখলেছীনদের। আর এ জাতীয় কর্মকে অর্থহীন ও অস্পষ্ট রাখা আল্লাহর শানে শোভনীয় নয়। তখন সর্বনিম্ন সীমা বর্ণনা করে তা ফরয না করে পালন করার ফয়সালা করে দেয়া এবং এ সীমার ঊর্ধ্বে যা রয়েছে তার প্রতি তারগীব তথা উৎসাহ সৃষ্টি ও প্রেরণা দান ব্যতীত অপর কোন পথ থাকে না।
যে বিধান পালন করার অকাট্য প্রমাণ ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তা আনুগত্যের একটি নির্ধারিত সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা। রমজান মাসের রোজা পালন করা এবং এসব আনুগত্যের বিভিন্ন অংশ তথা পার্টগুলো বলে দেয়া যেগুলো ব্যতীত এসব আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন নামাযের তাকবীরে তাহরীমা এবং সূরা ফাতেহা পাঠ করা। এগুলোকে আরকান বলা হয়। আবার ঐসব অংশগুলোও বলে দিতে হবে যেগুলো এগুলোর বাইরের অথব যেগুলো ব্যতীত এ আনুগত্য গ্রহণীয় হবে না, ঐগুলোকে শর্ত বলা হয়। যেমন নামাযের জন্য অযু করা।
(স্মরণ রাখা চাই যে,) কখনো কখনো সে ইবাদতের ফিতরাতের তথা প্রকৃতির দাবি অনুযায়ী কোনো জিনিসকে তার রোকন ঘোষণা করা হয়। আবার কখনো কখনো আকস্মিক বা আরেজী কারণেও কোনো জিনিসকে তার রোকন করা হয় (ভিত্তি করা হয়)।
তন্মধ্যে প্রথমটি হলোঃ যা না হলে ইবাদত হয় না এবং তার ফায়দা তথা উপকারিতা লাভ হয় না। যেমন নামাযে রুকু ও সিজদা করা এবং রোজার মধ্যে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ এবং স্ত্রী সহবাস-যৌনসংগম ত্যাগ করা। অথবা ঐ বস্তু এমন হবে যা ঐ ইবাদত ও আনুগত্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যেমন তাকবীরে তাহরীমা। এ তাকবীরে তাহরীমা নিঃসন্দেহে নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত আর নিয়ত নির্ধারিত। আবার যেমন ফাতেহা, আর নিঃসন্দেহে তা দোয়ার সাথে সম্পৃক্ত। আবার যেমন সালাত আর তা নামায হতে বের হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। এটি এমন কাজ যা নামাযের সম্মান ও মর্যাদার পরিপন্থী নয়।
দ্বিতীয় হলোঃ তা ওয়াজিব হবে, অপরাপর কারণগুলোর কোন একটি আরেজী বা আকস্মিক কারণে আর তাকে নামাযের রোকন ঘোষণা করা হবে। এ কারণে যে, তা নামাযের মধ্যে পরিপূর্ণতা আনয়ন করে। আর তা নামাযের উদ্দেশ্যকে পূর্ণভাবে আদায় করে, যে কারণে সে নিজেই নামাযের রোকন হওয়ার যোগ্য। যেমন সূরা ফাতেহার পর পবিত্র কুরআনের অন্য যেকোন সূরা পাঠ করা –তাদের জন্য যারা সূরা পাঠ করাকে নামাযের রোকন মনে করে। (অর্থাৎ হানাফী মতাবলম্বীদের নিকট; যারা সূরা ফাতেহার পর অন্য সূরা পাঠ করা ওয়াজেব মনে করে। অন্য তিনজন ইমামের নিকট সূরা মিলানো সুন্নত)। নিশ্চয়ই পবিত্র কুরআন (আরবী********) আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম তাকে তাজিম করতেই হবে, তাজিম করা ওয়াজিব। পবিত্র কুরআনকে পেছনে ফেলা যাবে না। পবিত্র কুরআনের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা যাবে না। পবিত্র কুরআন পাঠের জন্য এর চেয়ে উত্তম আর কোনো পন্থা নেই যে সবচেয়ে অধিক তাকিদকৃত ইবাদতের মধ্যে এবং সে ইবাদতের মধ্যে যা অধিক পরিমাণে হয়ে থাকে এবং যা পালন করা অধিক পরিমাণে প্রচলিত তাতে পাঠক রা হবে। অথবা দুটি জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক বস্তুর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যে বস্তুর উপর নির্ভরশীল তাকেই রোকন (ভিত্তি বা স্তম্ভ) করা হয় এবং তা করার হুকুম দেয়া হয়। যেমন রুকু ও সিজদার মধ্যবর্তী স্থলে দাঁড়ানো। এর দ্বারা পার্থক্য নির্ণয় হয় সে শির নত করা যা সিজদা করার ভূমিকা এবং সে রুকুর মধ্যে যা স্বতন্ত্রভাবে তাজিম তথা সম্মান প্রদর্শন, এবং যেমন বিবাহের ক্ষেত্রে ইজাব ও কবুল (প্রস্তাবনা ও তা গ্রহণ) ও সাক্ষী, অলীর উপস্থিতি এবং নারীর বিবাহে রাজি থাকা। নিশ্চয়ই এর দ্বারা জেনা ব্যভিচার ও বিবাহের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্য নির্ণয় হয়। হতে পারে কোনো কোনো রোকনের তাওজীহ বর্ণনা উভয় দিক থেকেই করা যায় (অর্থাৎ জাতী ও আরেজী –মূল ও আকস্মিক উভয় কারণের অধীনে তাদের নেয়া যায়।) রোকন সম্পর্কে আমরা যা আলোচনা করেছি শর্তের ক্ষেত্রেও তা গ্রহণ করা কর্তব্য। সুতরাং কখনো কোনো কারণে এক বস্তু জরুরি তথা অত্যাবশ্যকীয় হয়। (অর্থাণ কোনো আরেজী বা আকস্মিক কারণে) তখন তাকে দ্বীনের কোনো (আরবী*********) শায়ায়ের বা রীতিনীতির ক্ষেত্রে শর্ত ধরে নেয়া হয় (যেমন নামাযের জন্য)। ঐ কারণের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য। তার শান ততক্ষণ (সে আকস্মিক কারণের শান) বৃদ্ধি পায় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ইবাদত তথা নামায ঐ বস্তুর মিলিত হওয়ার কারণে পূর্ণতা লাভ করে যেমন (আরবী**************) তথা কেবলামুখী হওয়া। যখন কাবা শরীফ আল্লাহর (আরবী**********) নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত তখন তাকে সম্মান প্রদর্শন ছিল লোকেরা তাদের ভালো অবস্থায় তার দিকে মুখ করবে। যেখানে আল্লাহর কোনো নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে (যেমন কাবা শরীফ রয়েছে) সেদিকে মুখ করা মুসল্লীর জন্য নামাযের মধ্যে আনুগত্য প্রদর্শনের নিমিত্তে এবং তা ত্রীতদাসের তথা গোলামের তার মালিক ও মনিবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ কারণে নামাযে কেবলামুখী হওয়াকে শর্ত করা হয়েছে।
কখনো কোনো বস্তু তার কোনো আকৃতি ব্যতীত কোন ফায়দা দেয় না, উপকারে আসে না, তখন ঐ বস্তুকে ঐ ইবাদতের শুদ্ধতার জন্য শর্ত করা হয়। যেমন নিয়ত। নিঃসন্দেহে আমল তখনি কার্যকর ও মর্মস্পর্শী হয় যখন সে কোনো ছবি বা চিত্রের ন্যায় অন্তরে অনুভূত হয়। নামাযের দ্বারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের চিত্র অন্তরে ভেসে উঠে আর সে আনুগত্য নিয়ত ব্যতীত হয় না এবং যেমন হয় না কেবলামুখী হওয়া অন্য দৃষ্টিতে। যখন অন্তরকে কেবলার প্রতি একাগ্রচিত্তে করা একটা লুকায়িত বিষয় –তখন সে কাবার দিকে মুখমণ্ডল করা আল্লাহর নিদর্শন (আরবী*****************) তাকে –অন্তরকে একাগ্রচিত্তে করার স্থানে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে এবং যেমন অযু করা ছতর ঢাকা এবং অপবিত্রতা ত্যাগ করা। যখন তাজিম করা তথা সম্মান প্রদর্শন করা, একটা লুকায়িত বস্তু ছিল, তখন লোকেরা যে বিষয়টিকে রাজা-বাদশাহ এবং ঐ জাতীয় লোকদের সামনে প্রদর্শন করাকে নিজেদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও করণীয় মনে করে, লোকেরা তাকে তাজিম তথা সম্মান প্রকাশ মনে করে এবং তা লোকদের অন্তরে স্থান লাভ করে, আর আরব অনারব সকলে সে বিষয়ে ঐকমত্য পোষন করে তখন তাকে তাজিমের স্থানে স্থলাভিষিক্ত করা হলো।
যখন কোনো আনুগত্য ফরজ করা হয় তখন সে ক্ষেত্রে কিছু মূলনীতির প্রতি দৃষ্টি দেয়া অত্যাবশ্যকীয়।
তন্মধ্যে রয়েছেঃ
লোকদের উপর ঐ জিনিস ফরজ করা হবে যা তাদের পক্ষে সহজ হবে। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ হচ্ছে-
(আরবী******************************************************************)
“যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর না হতো তাহলে আমি তাদেরকে প্রত্যেক নামাযের সময় মেছওয়াক করার হুকুম করতাম”। (মিশকাত হাদীস নং ৩৯০) এ হাদীসের তাফসীরে তথা ব্যাখ্যার দ্বিতীয় বর্ণনায় এসেছে-
(আরবী****************************************************************************)
“যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর না হতো তাহলে তাদের উপর প্রত্যেক নামাযের সময় মেছওয়াক করা ফরজ করে দিতাম যেমনিভাবে আমি তাদের উপর অযু ফরজ করে দিয়েছি”। (মসনদে আহমদঃ ২১৪)
তন্মধ্যে রয়েছেঃ উম্মত যখন কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো নির্ধাতির পরিমাণ সম্পর্কে এ বিশ্বাস তথা এতেকাদ পোষন করেছে তা বাদ দেয়া বা তার প্রতি অনিহা প্রদর্শন করা আল্লাহর নিকট দুর্বলতা তথা গুনাহ এবং সে পরিমাণের প্রতি তার অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়েছে অতবা ঐ পরিমাণ নবীদের পক্ষ হতে নির্ধারিত করা হয়েছে বলে বর্ণিত রয়েছে বা ঐ পরিমাণের উপর সালফের নিকট ঐকমত্য রয়েছে অথবা অনুরূপ কিছু। তাহলে আল্লাহর হিকমত হলো তা তাদের জন্য ফরজ করে দিতেন। যেমন তারা তাদের জন্য ওয়াজিব মনে করত। যেমন বনী ইসরাঈলের জন্য উটের গোশত ও উটের দুধ হারাম ঘোষনা করা। এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রজমান মাসের রাতের নামায-তারাবীহ সম্পর্কে (আরবী**********************) “এ নামায তোমাদের প্রতি ফরজ করে দেয়া হবে এ সন্দেহ আমার হয়েছিল”। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত শরীফ হাদীস নং ১২৯৫)। তন্মধ্যে রয়েছে কোন বস্তু সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ না করে তা পালন করার জন্য অকাট্যভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করা। এ কারণে হায়া অর্থাৎ লজ্জা-শরম ও অন্যান্য উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীকে ইসলামের রোকন (স্তম্ভ) বলে ঘোসনা করা হয়নি। যদিও এগুলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত।
আনুগত্যের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমার বর্ণনার ক্ষেত্রঃ প্রথমে সর্বোচ্চ স্তর, অতঃপর সর্বনিম্ন স্তর। মানুসের সুসময় ও দুঃসময়ের বিভিন্নতার কারণে আনুগত্যের সর্বনিম্ন সীমার অবস্থার মধ্যে বিভিন্নতা দেখা দেয়। কেয়াম তথা দাঁড়ানোকে নামাযের রোকন ঘোষণা করা হয়েছে যে দাঁড়াতে সক্ষম তার জন্যে। আর অক্ষমের জন্য বসে পড়াকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। অতএব সর্বোচ্চ স্তরেরসীমা পরিমাণ ও অবস্থার গুণের প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত হয়।
পরিমাণঃ নফলগুলো ফরজগুলোর মধ্য হতেই। যেমন সুন্নাতে মোয়াক্কাদা, তাহাজ্জুদের নামায এবং প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখা। যেমন নফল সদকা করা এবং তাহাজ্জুদের নামায এবং প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখা। যেমন নফল সদকা করা এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজগুলো।
অবস্থা বা গুণঃ ইবাদতের আকার আকৃতি, যিকিরসমূহ এবং ঐসব বস্তু হতে দূরে থাকা যেগুলো ইবাদতের শানের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। আনুগত্যের ক্ষেত্রে সেগুলো করার হুকুম এজন্য দেয়া হয় যাতে করে ঐগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণতা আসে এবং যেন ঐ আমলগুলোকে সঠিকভাবে পরিপূর্ণরূপে অভিষ্ট লক্ষে উপনীত করতে পারে; যেমন অযুর সময় শরীরের কোকড়ানো স্থানগুলোর প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করার কথা এজন্য বলা হয়েছে যাতে পরিপূর্ণ পবিত্রতা অর্জিত হয়। আবার যেমন অযু ডানদিক থেকে আরম্ভ করা (প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেই এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।) যাতে ইবাদতের গুরুত্বের প্রতি দেহ সচেতন থাকে। নফস যেন ইবাদতের দিকে একাগ্রচিত্ত ও মনোযোগী থাকে যখন সে স্বয়ং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর ক্ষেত্রে তা মেনে চলে।
স্মরণ রাখবেন, মানুষ যখন কোন চরিত্র অর্জন করতে চায় এবং চায় যে এর দ্বারা তার জীবন রঙিন হয়ে যাক এবং সে চরিত্রের সকল দিক অর্জন করবে। তার কার্যপ্রণালী বা পদ্ধতি হলোঃ সে নিজেকে একান্ত অনুগত করবে, সে চরিত্রের উপযুক্ত সকল ক্রিয়া ও সকল বিদ্যার –যদিও তার সে গ্রহণকৃত কাজগুরো সাধারণের নিকট কোন গ্রহণযোগ্যতা নাও থাকে। যেমন বীরত্ব ও বাহাদুরী প্রদর্শনকারী তথা নৈপুণ্য প্রদর্শনকারীর কাদায় প্রবেশক রা, রোদের মধ্যে চলা এবং অন্ধকার রাতে ভ্রমণ করা ইত্যাদি ও এ জাতীয় কাজ করা হতে বিরত না থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। তেমনিভাবে আনুগত্যের অভ্যাসকারী সর্বাবস্থায় সম্মান প্রদর্শনেচ্ছার প্রতি তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখে। সে তার প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য বসতে লজ্জাবনত অবস্থায় মাথা নীচু করে বসে। সে যখন আল্লাহর যিকির করে তখন নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে জড়ো করে বসে, এ জাতীয় সকল কাজে সে এরূপ অভ্যাস করে। ন্যায়পরায়ণতায় নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী প্রত্যেক বস্তুর সঠিক অধিকার আদায় করে। সে ডান হাতকে খাওয়া ও পবিত্র কাজগুলো করার জন্য এবং বাম হাতকে নাজাসাত তথা অপবিত্রতা দূর করার কাজে ব্যবহার করে। এ রহস্যই লুকায়িত রয়েছে সে ঘটনায় যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেছওয়াক সম্পর্কে বলা হয়েছে –“বয়োজ্যেষ্ঠকে দিন, বয়োজ্যেষ্ঠকে দিন”।
(আরবী**************************************************************************************)
ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম যে, আমি একটি মেছওয়াক দ্বারা মেছওয়াক করছি। তখন আমার নিকট দুব্যক্তির আগমন ঘটল। তাদের মধ্যে একজন অপরজন হতে বয়সে বড়। আমি মেছওয়াকটি ছোটজনকে দিলাম। তখন আমাকে বলা হলো বড়জনকে অর্থাৎ বয়োজ্যেষ্ঠকে দিন, বয়োজ্যেষ্ঠকে দিন। (আরবী***********)
এবং ঐ ঘটনার যেখানে হুয়াইছা ও মুহাইছার ঘটনা বিবৃত হয়েছে সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –“বয়োজ্যেষ্ঠকে কথা বলতে দাও”।
ঘটনা এরূপঃ আবদুল্লাহ ইবনে সহল খয়বারে নিহত হলে তার হত্যাকারী কে তা জানা যায়নি। তখন নিহতের ভাই আবদুর রহমান ও ইবনে মাসউদের দু’পুত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এল। তখন আবদুর রহমান কথা বলতে আরম্ভ করল অথচ তিনি ছিলেন বয়সে ছোট। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, (আরবী***********) “বয়োজ্যেষ্ঠকে দাও”। অর্থাৎ কথা বলার জন্য বড়কে প্রাধান্য দাও। আর এরূপ করাই হলো আদব তথা শিষ্টাচারের ভিত্তি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী (আরবী************) নিশ্চয়ই শয়তান তার বাম হাতে ভক্ষণ করে এবং এ জাতীয় আরো অন্যান্য বাণীতে তিনি অনেক কাজের সম্পর্ক শয়তানের সাথে দেখিয়েছেন। এ বাণীগুলোর রহস্য জেনে রাখুন। স্মরণে রাখুন। আমাকে আমার প্রতিপালক পরওয়ারদেগার মহান আল্লাহ যতটুকু বুঝার ক্ষমতা দিয়েছেন তাতে আমি যা বুঝেছি তা হলোঃ শয়তানকে আল্লাহ তায়ালা এ ক্ষমতা দিয়েছেন যে, সে লোকদেরকে স্বপ্নে অথবা জাগ্রত অবস্থায় এমন সব অবস্থার পরিবর্তন করে দিতে পারে যা তার মেজাজ ও মনপূত হয়। তার স্বভাবের সাথে খাপ খেয়ে যায়।
সঠিক চিন্তার অধিকারী ও নেককার ব্যক্তিরা জানে যে, শয়তান লোকদেরকে (১) ক্ষতিকর কাজের সাথে সম্পর্ক রাখা; (২) এমন সব আচরণ যা কাঙ্ক্ষিত নয়, অনাকাঙ্ক্ষিত তা করার প্রতি আগ্রহী করা; (৩) অপবিত্রতার নিকটবর্তী হওয়া; (৪) আল্লাহর যিকিরের প্রতি অমনোযোগীতা; (৫) এবং সকল পছন্দনীয় কাজের ক্ষতি সাধন করার প্রতি আগ্রহী করে দেয়।
ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক কাজ বলতে আমি বুঝাচ্ছি ঐ সব কাজ যা করলে মানুষের অন্তর কেঁপে উঠে, মানুষের চর্ম শির শির করে উঠে এবং মানুষের জবানে লানত বর্ষিত হতে থাকে। এসব কাজ ও কথা সকল মানুষের জন্যেই সমানভাবে দৃষ্টিকটু, সকলের নিকটই সমান, এগুলো কোনো জাতির গঠনমূলক উদ্দেশ্যে করা হয় না। যেমন কেউ তার লিঙ্গ ধরে নাচানাচি কুদাকুদি করে বা তার পেছনের রাস্তায় বা পায়খানার রাস্তায় অঙ্গুলি প্রবিষ্ট করে বা তার দাড়িকে পেটের সাথে বেঁধে নেয় বা সে নাক কাটা হয়, কান কাটা হয় বা স্বীয় মুখমণ্ডলে কালি মেখে নেয় বা সে নিজের পরিধেয় পোশাক উল্টাভাবে পরিধান করে, অথবা সে কোনো চতুষ্পদ জন্তুর উপর আরোহনপূর্বক তার মুখ ঐ জন্তুর পেছনের দিকে করে নেয় বা এক পায়ে মোজা পরিধান করে অপর পা খালি রাখে। এ জাতীয় কোনো দৃষ্টিকটু ও ন্যাক্কারজনক কাজ দেখলেই মানুষ লানত বর্ষণ করে ও গালাগাল দিতে থাকে। আমি কোনো কোনো স্থানে এরূপ ন্যাক্কারজনক কাজ ও নিন্দনীয় কাজ হতে প্রত্যক্ষ করেছি।
এমন সব আচরণ যা অনাকাঙ্ক্ষিত বলতে আমি বুঝাচ্ছি যেমন (নামাযের মধ্যে) স্বীয় কাপড় নিয়ে খেলা করা ও কংকর নিয়ে খেলা করা বা নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন হাত, পা ইত্যাদিকে নিন্দনীয় পদ্ধতিতে নাড়াচাড়া করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোটকথা, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসব বিষয় পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এসব কাজ মানুষকে শয়তানী কাজে ও শয়তানের স্বভাবের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। শয়তান স্বপ্নেই হোক কি জাগ্রত অবস্থায় হোক যার সাথে সম্পৃক্ত হয় তাকেই এগুলোর কোনো না কোনোটির সাথে সম্পৃক্ত করে নেয়।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর নভীর নিকট এটাও পরিস্কারভাবে প্রতিভাত করে দিয়েছেন যে, যতটা সম্ভব নিজের সামর্থ ও শক্তি অনুযায়ী মুমিন ব্যক্তিগণ এসব শয়তানী কাজ ও শয়তানী স্বভাব হতে দূরে থাকবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সব কাজ, সে সব স্বভাব বর্ণনা করেছেন; সেগুলো অপছন্দ করেছেন, নিন্দা করেছেন এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকার হুকুম দিয়েছেন।
এ পর্যায়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী হচ্ছে (আরবী**************) নিশ্চয়ই এসব (আরবী*******************) পায়খানা ও প্রস্রাবের স্থানসমূহ –শয়তানদের উপস্থিতির স্থান। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী-
(আরবী*******************************************************************************)
“নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের পায়খানার রাস্তা নিয়ে খেলা করে এবং মানুষ যখন হা, হা করে উঠে তখন শয়তান হাসতে থাকে। এর উপর কেয়াস করুন ফিরিশতাদের স্বভাব অর্জনের প্রতি তারগীব তথা উৎসাহিত করাকে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এরশাদ হচ্ছে- (আরবী*****************************) “ফিরিশতারা যেভাবে সারিবদ্ধ হয় তোমরা কি সেবাবে সারিবদ্ধ হও না। এটি হলো শিষ্টাচারের বা আদবের অপর অধ্যায়।
স্মরণ রাখুন যে, কোনো বস্তুকে ফরজে কেফায়া হিসেবে নির্ণয় করার কারণগুলোর মধ্যে একটি কারণ হলো এর জন্য সকল লোকের একত্রিত হওয়া তাদের জীবিকা নির্বাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহকে নিস্ফল করার দিকে নিয়ে যাবে। আর কিছু সংখ্যক লোককে এ কাজের জন্য নিয়োগ করা এবং অপরদেরকে অন্য কাজের জন্য নিয়োগ দেয়া সম্ভব না হওয়া। যেমন জিহাদ। সমাজের সকল লোক একাজে একত্রিতভাবে নিয়োজিত হয়ে গেলে তাদের ক্ষেতি, বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানা ত্যাগ করলে, তাহলে তাদের জীবিকা অকেজো হয়ে যাবে। তখন কোনো ব্যক্তিকে ব্যবসার জন্য নির্বাচন করা এবং কোনো লোককে জিহাদের জন্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কারণ কোনো কাজ একজনের জন্য সহজ হলে অপরের জন্য তা সহজ নাও হতে পারে। লোকদের নাম ও বিভাজন দ্বারা কে কোন কাজের উপযুক্ত তা জানা যায় না যে, তার উপর সে কাজ সোপর্দ করা যায়।
এর দ্বিতীয় কারণ হলো ফরজে কেফায়ার দ্বারা যে মাছলেহাত উদ্দেশ্য তা একটি নিয়মের অস্তিত্বের অধীন। যাকে বাদ দিলে ব্যক্তি সত্তার অবলম্বন অবনতি হয় না, আর না পশুত্ব তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। যেমন বিচারকের কাজ ও ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা এবং রাষ্ট্রীয় গুরু দায়িত্ব পালন করা। এসব বিষয় একটি নীতি ও শাসন কার্যপরিচালনার খাতিরে প্রচলন করা হয়েছে। এক ব্যক্তির ঐ দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে তা লাভ হয়। যেমন রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং জানাযার নামায; এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যেন রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং জানাযার নামায; এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যেন রুগ্ন ব্যক্তি ও মৃতব্যক্তি পরিত্যক্ত হয়ে না যায়। আর কিছু লোকতা সমাধানের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে যায়। আল্লাহই ভালো জানেন।
অধ্যায়-৬০
ইবাদতের জন্য সময় নির্ধারণের মধ্যে নিহিত হিকমত
ইবাদতের জন্য সময় নির্ধারিত না করে উম্মতের নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। আর এ সময় নির্ধারণ মোকাল্লেফীনদের –যাদের থেকে ইবাদত কামনা করা হয়েছে –অবস্থা জানার উপর নির্ভরশীল এবং এমন বিষয়বস্তুসমূহ গ্রহণ করার উপর যা লোকদের জন্য কষ্টসাধ্য না হবে তার উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় যেন তা দ্বারা উদ্দেশ্য লাভ হয়ে যায়। এর সাথে সাথে এ সময় নির্ধারণের মধ্যে অন্যান্য হেকমত ও মাছলেহাত তথা কল্যাণও নিহিত রয়েছে। যা জ্ঞানবান ব্যক্তিরা অবগত রয়েছে। আর সে হিকমতসমূহ মূলনীতির দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
তন্মধ্যে একটি হলোঃ আল্লাহ তায়ালা যদিও তিনি সময়ের সীমা পরিসীমার ঊর্ধ্বে। কিন্তু পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদীস একে অপরের এ বিষয়ে সাহায্য করে যে, কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের নিকটবর্তী হয়ে যান। আবার কখনো তার সামনে তাদের আমল তথা কৃতকর্ম পেশ করা হয়। আবার কোনো কোনো সময় ঘটনা প্রবাহের মিমাংসা করা হয়। এছাড়া নতুন নতুন অবস্থারও মীমাংসা এবং নির্ধারণ করা হয়। যদিও ঐ সব নতুন অবস্থার আসল হাকীকত আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
(আরবী*******************************************************************)
“শেষ রাতের তৃতীয় প্রহর বাকি থাকতে আমাদের প্রতিপালক পরওয়ারদেগর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন”। তিনি আরো এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
-“নিঃসন্দেহে বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর সমীপে সোমবার দিন ও বৃহস্পতিবার উপস্থাপন করা হয়”।
এছাড়াও শাবান মাসের পনেরো দিনের দিবাগত রাতের সম্পর্কে বলেছেন-
(আরবী*****************************************************************)
“নিশ্চয়ই ঐ রাতে আল্লাহ তায়ালা উঁকি দিয়ে দেখেন। অপর বর্ণনায় রয়েছে ঐ রাতে আল্লাহ তায়ালা জমিনের আকাশে, দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন”।
এতদসংক্রান্ত অনেক হাদীস রয়েছে যা সকলের জানা।
মোটকথা দ্বীনের প্রয়োজগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, আল্লাহর নিকট এমন কতগুলো সময় রয়েছে যে সময়গুলোতে জমিনে –পৃথিবীতে রুহায়িত প্রসার লাভ করে, সেখানে উপমাকর শক্তির প্রসার ঘটে। ইবাদ কবুল হওয়ার ও দোয়া কবুল হওয়ার তার চেয়ে উত্তম আর কোনো সময় হতেই পারে না। অতি অল্প প্রচেষ্টায় তথা ন্যূনতম প্রচেষ্টায় তখন বিশাল দরজা খুলে যায়। পশুর স্তর হতে ফিরিশতার স্তরে উপনীত হওয়ার জন্য।
আল মালাউল আলা তথা ফিরিশতাজগত ঊর্ধ্বাকাশবাসীরাসে রূহানিয়াতের প্রসারের ও সে শক্তির সম্প্রসারের বিষয়টি আকাশের কোনো হিসেবের দ্বারা জানতে পারে না, বরং তারা তাদের আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে বুঝতে পারে যে, তাদের অন্তরে কোনো বস্তু লুকিয়ে রয়েছে –তখন তারা বুঝতে সক্ষম হয় যে আল্লাহর নিকট হতে কোনো সিদ্ধান্ত ফয়সালা অবতীর্ণ হওয়ার রয়েছে বা রুহানিয়াত সম্প্রসারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে ও তার ন্যায় আরো কিছু সম্প্রসারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এটাই সে বস্তু হাদীসে যে সম্পর্কে বলা হয়েছে –(আরবী**********************************) যেন পাথরের উপর লোহার জিঞ্জির শিকল পতিত হওয়ার ন্যায়।
আম্বিয়া (আঃ)-দের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ হতে (আরবী*********************) এ জ্ঞান লুকিয়ে থাকে। আকাশের পরিবর্তনের বিবর্তনের মাধ্যমে নয় বরং অন্তর দ্বরা তারা তা জেনে যান। তখন তারা ঐ সময়গুলোতে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার পূর্ণ চেষ্টা করেন। সুতরাং তারা লেকাদরেকে নির্দেশ দেন ঐ সময়গুলোর হেফাযতের জন্য। তথা ঐ সময়গুলোতে আল্লাহর ইবাদতে রত থাকার জন্য।
ঐ রূহানিয়াতের প্রকাশের সময়গুলোর মধ্যেঃ
একটি হলোঃ যা বছর ঘুরে আসার সাথে ঘুরে আসে। আর তা হলো মহান আল্লাহর বাণী-
(আরবী**********************************************************************)
“নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কুরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি ভয় প্রদর্শনকারী-সতর্ককারী। ঐ বরকতময় রাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে। আমার পক্ষ হতে হুকুম হয়ে। নিশ্চয়ই আমিই রাসূলদের প্রেরণ করি”। আর ঐ বরকতময় রাতেই পবিত্র কুরআনের রূহানিয়ত পৃথিবীর আকাশে স্থাপিত হয়েছে। আর সকলের ঐকমত্য রয়েছে এ ব্যাপারে যে, তা হয়েছে পবিত্র রমজান মাসে।
তন্মধ্যে অপরটি হলোঃ যা প্রতি সপ্তাহের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসে। তা একটি সামান্য স্বল্প সময়। যে সময়ের মধ্যে দোয়া ও ইবাদত কবুল হওয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। মানুষ যখন পরপারে আখেরাতে চলে যাবে তখন সে সময়টিই আল্লাহর তাঁর বান্দাদের উপর তাজাল্লী বর্ষণের এবং আল্লাহর বান্দাদের নিকটবর্তী হওয়ার সময় হবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, সে সময়টি হবে জুমায়ার দিন। আর সেজন্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছে নযে, বিশাল বিশাল ঘটনাবলি এ জুমা বারেই –জুমার দিনেই সংঘটিত হয়েছে। যেমন হযরত আদম (আঃ)-এর জন্ম। চতুষ্পদ জন্তু কখনো কখনো নিম্ন জগত হতে এ সময়ের জ্ঞান লাভ করে থাকে, তখন তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ও ঘাবড়িয়ে যায়। যেমন বিকট শব্দে কোনো ব্যক্তির ঘাবড়ানোর অবস্থা দেখা যায়। আর তিনি তা জুমার দিনে প্রত্যক্ষ করেছেন।
তন্মধ্যে অন্যটি হলোঃ ঐ সময় যে সময়টি দিনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসে। আর এ রূহানিয়াত অপর রূহানিয়ত হতে কমজোর তথা দুর্বল। যারা ঊর্ধ্ব জগত হতে জ্ঞান প্রাপ্ত তারা সকলে ঐকমত্য পোষন করেন যে, সেটি দিনের চারটি সময়। (১) সূর্যোদয়ের সামান্য পূর্বে (২) সূর্য ঠিক মাথার উপর দণ্ডায়মান হওয়ার সামান্য পর (৩) সূর্যাস্তের পর (৪) অর্ধরাত হতে সেহেরীর সময় পর্যন্ত। ঐ সময়গুলোর সামান্য পূর্বে ও পরে রূহানিয়াত সম্প্রসারিত হয় ও বরকত প্রকাশ পায়।
পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি নেই যারা জানেনা যে, এ সময়গুলো ইবাদত কবুলের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। অগ্নি উপাসকরা দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন করেছে। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের উপাসনা পূজা করতে লাগল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ তাহরীফের পথ বন্ধ করলেন এবং ইবাদতের সময় পরিবর্তন করে দিরেন। এমন সময় দ্বারা যে সময় তাদের সে সময়ের চেয়ে অধিক দূরবর্তী নয়। এমনকি মূল উদ্দেশ্যকেও ব্যাহত করে না। তিনি অর্ধরাতে মানুষের উপর কোনো নামায ফরজ করেননি। কারণ এতে অনুদারতা-অপ্রশস্ততা রয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন-
(আরবী************************************************************************************)
“অবশ্যই রাতের মধ্যে একটা সময় রয়েছে। সে সময়ে কোনো মুসলমান বান্দা আল্লাহর নিকট তার দুনিয়া ও আখেরাতের কোনো কল্যাণ কামনা করলে আল্লাহ তাকে তা দান করেন। এ সময় প্রতি রাতেই আসে”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, (আরবী************************************) “উত্তম নামায হলো অর্ধরাতের নামায। অর্ধরাতে নামায আদায়কারী খুবই কম”। তার নিকট জিজ্ঞেস করা হলো (আরবী*******************) “কোন দোয়া অধিক পরিমাণে কবুল হয়?” (আরবী******************) “রাতের দোয়া”। দ্বিপ্রহরের পরের সময় সম্পর্কে বলেছেন,
(আরবী*****************************************************)
“নিশ্চয়ই এটি এমন একটি সময়, যখন আকাশের দরজাসমূহ খোলা থাকে, আমি কামনা করি যেন ঐ সময় আমার কোনো নেক আমল আকাশে উত্থিত হোক।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম এরশাদ করেছেন-
(আরবী******************************************************************************)
“দিনের ফিরিশতা রাতের ফিরিশতাদের পূর্বে আল্লাহর নিকট চলে যায়। (অর্থাঃ একত্রিত হওয়ার পর রাতের ফিরিশাতরা ডিউটিতে থেকে যায় এবং দিনের ফিরিশতারা ফিরে যায়।) আর রাতের ফিরিশতারা দিনের ফিরিশতাদের পূর্বে আল্লাহর নিকট ফিরে যায়। আল্লাহ তায়ালা এ অর্থের দিকেই তাঁর পবিত্র বাণীতে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন-
(আরবী*******************************************************************)
“তোমাদের সকাল ও সন্ধ্যায় সর্ব সময়ে আল্লাহর পবিত্রতা, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা এবং রাতে দ্বিপ্রহরের সকল সময় তাঁর সকল প্রশংসা”। এতদসংক্রান্ত অনেক আয়াত রয়েছে তা সকলেই অবগত রয়েছে। আমি এর মাঝে বিশাল বিষয় প্রত্যক্ষ করেছি।
দ্বিতীয় মূলনীতি হলোঃ আল্লাহ তায়ালার দিকে তাওয়াজ্জুহ হওয়ার উত্তম সময় হলো মানুষেল প্রাকৃতিক দুশ্চিন্তা, হতবুদ্ধিতা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা হতে মুক্ত হওয়া। যেমন ভিষণ ক্ষুধা। অতি ভক্ষণ। অধিক ঘুমের চাপ। অবসাদ ও দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া। ছোট বা বড় ধরনের ইস্তিঞ্জা (পায়খানা প্রস্রাব) আটকিয়ে রাখা। এবং কাল্পনিক দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত হওয়া। যেমন কান বধির হওয়া ধ্বংসাত্মক শব্দ দ্বারা অথবা অনর্থক মূল্যহীন শব্দ দ্বারা। চোখের অন্ধ হওয়া বিভিন্ন ধরনের চিত্র দ্বারা, চিন্তা শক্তির আচ্ছন্ন করার ন্যায় বিভিন্ন রং দ্বরা বা এ জাতীয় অন্যায় হতবুদ্ধিতা হতে মুক্ত হওয়া।
অভ্যাসের বিভিন্নতার কারণে এ অভ্যাসগুলো বিভিন্ন হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী গঠনগতভাবে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলো আরব অনারব প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সকলের নিকটই সমান; যেমন সকল বিষয় সবারই ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য। শরীয়তের বিধানে তাকেই সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এবং ঐ সব বিষয় যা তার বিপরীত, বিরল ও দুর্লব হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তা হলো (আরবী***********) অর্থাঃ, উষা ও সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময় ও (আরবী****************) রাতের প্রথমাংশের সময়।
মানুষের নফছের মধ্যে ঝং পড়ার পর রং ধরার পর মানুষের তা দূর করার জন্য শান বা ঘর্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। এ প্রয়োজন তখন দেখা দেয় যখন সে বিছানায় ঘুমানোর জন্য গমন করে ও ঘুমানোর দিকে ধাবিত হয়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার পর কথাবার্তা বলা এবং কবিতা রচনা করতে নিষেধ করেছেন।
মানুষকে সর্বদা তার নিজের নফছের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার বিধান করে না দেয়া হলে তাকে সঠিকবাবে নিয়ন্ত্রণ ও শাসনে রাখা সম্ভব হবে না। যাতে তার মধ্যে নামাযের জন্য অপেক্ষা করা, নামায আদায় করার পূর্বে সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং নামায আদায়ের পর তার নূর তার মধ্যে বিস্তৃত হওয়া বিষয়টি তার মধ্যে পাওয়া যায়, এতে হয়ত নামাযের পুরো সময় এতে পাওয়া যাবে তা না হলে অধিকাংশ সময় তো অবশ্যই পাওয়া যাবে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যে, তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য নিয়ত করে শয়নকারী পশুত্বের ঘুমে ডুবে থাকে না। যদি কারো অন্তর দুনিয়াবী কোনো কাজের চিন্তায় ব্যস্ত থাকে বা কোনো নামাযের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে বা কোনো কাজের জন্য একাগ্রচিত্ত তথা মোতাওয়াজ্জুহ থাকে যাতে করে তা তার হাতছাড়া হয়ে না যায় সে পশুত্বের জন্য পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারে না। আর এ রহস্যই লুকিয়ে রয়েছে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মধ্যেঃ (আরবী**************************) “যে ব্যক্তি রাতে আল্লাহর যিকির বলতে বলতে জেগে উঠে”। আল হাদীস এবং আল্লাহ তায়ালার বাণীর (আরবী*******************************) “এমন অনেক লোক রয়েছে যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় কিছুই আল্লাহর যিকির হতে গাফেল বা বেখবর করে না”।
প্রতি দুই ওয়াক্তের মাঝে দিনের চার ভাগের এক ভাগের দূরত্ব নির্ণয় করা যায় –তা দিন ঘন্টা পরিমাণ সময় হবে। আরব এবং অনারব সকলের নিকটই দিবা ও রাত্রির ভাগ এরূপই। এটাই সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ভাগ। ঐতিহাসিক বর্ণনা রয়েছে যে, প্রথম ব্যক্তি যিনি দিবারাত্রকে ঘন্টায় ভাগ করেছেন তিনি হলেন নূহ (আঃ)। তাঁর বংশধরদের মধ্যে এ নিয়ম উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছে।
তৃতীয় মূলনীতি হলোঃ ইবাদত আদায়ের সময় হবে সে সময় যা আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতসমূহের মধ্যে কোনো নেয়ামতকে স্মরণ করিয়ে দেবে। যেমন আশুরার দিন। ঐ দিন আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের বিরুদ্ধে মূসা (আঃ)-কে সাহায্য ও বিজয় দিয়েছেন। তিনি সেদিন রোজা পালন করেছেন এবং বনী ইসলাইলকে ঐ দিন রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন যেমন রজমান মাস। এ মাসে পবিত্র কুরআনে কারীম নাজিল হয়েছে যাতে মিল্লাতে ইসলামীর আবির্ভাবের সূচনা ছিল। অথবা সে সময় এমন হবে যখন আল্লাহ তাঁর নবীদেরকে –পয়গাম্বরদেরকে তাদেঁর প্রতিপালকের আনুগত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন এনং তাদের সে ইবাদত তাঁর নিকট কবুল হওয়ার কথা স্মরণ করাবেন। যেমন কুরবানীর ঈদের দিন। ঐ দিন হযতর ইসমাঈল (আঃ)-এর জবাইয়ের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তার পরিবর্তে বিশাল জবাইর কতা –কুরবানীর কথা মনে করিয়ে দেয়। অথবা তা হবে দ্বীনের কোনো বিশেষ (আরবী*************) নিদর্শনকে স্মরণ করানোর দিন। যেমন ঈদুল ফিতরের বা রোজার ঈদের দিন। ঐ দিন নামায আদায় ও সদকা করা রমজানের রোজার শানকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে দেয় এবং আল্লাহ তায়ালার রোজা পালনের তাওফিক দেয়ার শোকার আদায় হয়। যেমন কুরবানীর দিন। তাতে হাজী সাহবেদের সাথে ঐকমত্য পোষন ও হাজীদের ন্যায় হওয়া এবং হাজীদের জন্য যেসব স্থান প্রস্তুত রাখা হয়েছে সেসব স্থানের মধ্যে আল্লাহর রহমত কামনা করা। অথবা উম্মতের মুখে মুখে যাদের কল্যাণের আলোচনা বিদ্যমান তাদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা আল্লাহর আনুগত্য করেছেন ঐ সময়ে তাদের সুন্নাতের অনুসরণ হবে। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়। জিবরাঈল (আঃ)-এর কথা অনুযায়ী-
(আরবী**********************************************************)
“এটা আপনার সময় ও আপনার পূর্ববর্তী নবীদের সময়”। অথবা যেমন রমজান মাস সম্পর্কে মহান আল্লাহর এরশাদ –এ আয়াতের এক তাফসীর অনুযায়ী-
(আরবী******************************************************************************)
“তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল”।
আবার যেমন আশুরার দিনের রোজা সম্পর্কে আমাদের মতানুযায়ী। আর এ তৃতীয় মূলনীতি অধিকাংশ সময় নির্ণয়ের ব্যাপারে প্রযোজ্য, এ ছাড়া দুটি মূলনীতি হলো প্রধানত মূলনীতির মূলনীতি। আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
অধ্যায়-৬১
সংখ্যা ও পরিমাণ নির্ধারণের হিকমত তথা রহস্য
স্মরণ রাখতে হবে যে, শরীয়ত কোনো হিকমত ও মাছলেহাত ব্যতীত কোনো প্রমাণাদি ছাড়া কোনো সংখ্যা ও পরিমাণ নির্ধারণ করেনি, যদিও পরিপূর্ণ ভরসা ঐ (আরবী********) এর উপর নির্ভরশীল, যা মোকাল্লেফীনদের অবস্থা জানার উপর ভিত্তি করে এবং তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার সময় যা তাদের জন্য উপযোগী তার প্রতি দৃষ্টি রেখে করা হয়েছে।
এ মাছলেহাত ও হিকমত কতগুলো মূলনীতির উপর নির্ভরশীল। এসব মূলনীতির প্রথমটি হলোঃ বিজোড় সংখ্যা, একটি মোবারক তথা সম্মানিত সংখ্যা, বরকতময় সংখ্যা যতক্ষণ পর্যন্ত এ সংখ্যা যথেষ্ট ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ত্যাগ করে অপর সংক্যা গ্রহণ করা হয় না। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী হলোঃ
(আরবী*******************************************************************************)
“আল্লাহ তায়ালা বিজোড়; তিনি বিজোড়কে পছন্দ করেন, অতএব হে পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহেকরা, আহলে কুরআনেরা! তোমরা বিতরের নামায আদায় কর। (মেশকাত হাদীস নং-১২৬৬)।
এর রহস্যঃ সংখ্যা যতই অধিকই হোক তার ভিত্তি হলো (আরবী**********) বা এক। এ (আরবী********) এর নিকটবর্তী বিজোড় সংখ্যা হলো (আরবী********) বা বিজোড় সংখ্যা। কারণ সংখ্যার সকল পর্যায়েই এক (আরবী*******************) থাকে। যে কারণে তার সে মর্যাদা নির্ণীত হয়। যেমন ধরুন (১০) দশ সংখ্যাটি। এটি অনেকগুলো (আরবী******) তথা এক মিলে হয়েছে। পাঁচ ও পাঁচ মিলে হয়নি। এমনিভাবে অপর সংখ্যাগুলো। এ একটি হচ্ছে মূল এককের হাকীকত তথা মূল এককের ভিত্তি। আর এ এককটি মূল এককের উত্তরাধিকারী। আর বিজোড় সংখ্যার মধ্যে এ (আরবী************) তথা একক বিদ্যমান রয়েছে। আর সে একক হচ্ছে এ সংখ্যাটিকে সঠিকভাবে সমান দুটি এককে ভাগ তথা বিভাজন করতে না পারা বা না হওয়া। আর জোড়ের তুলনায় এককটি বিজোড়ের কাছাকাছি। প্রত্যেক বস্তুর স্বীয় মূলের দিকে প্রত্যাবর্তনই আল্লাহ তায়ালার দিকে প্রত্যাবর্তনের নামান্তর। কারণ আল্লাহ তায়ালা সকল ভিত্তির উৎপত্তি, সূচনা ও উৎস। আল্লাহর সত্তাই একমাত্র পরিপূর্ণ একক। (আরবী****************)
অতঃপর জেনে রাখুন যে, বিজোড় ও একক সংখ্যাগুলো বিভিন্ন স্তরেরহয়। এক বিজোড় সংখ্যাহলো তা জোড় সংখ্যার সাথে সাদৃশ্য রাখে। আর তা সে বিজোড় সংখ্যার পার্শ্ব তথা বাহু হয়। যেমন ১৯ সংখ্যাটি ও ৫ সংখ্যাটি। এ দুটি সংখ্যা হতে এক বাদ দিলে তারা সমান সমান দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯ সংখ্যাটি যদিও দুই দ্বারা ভাগ হয় না কিন্তু সে তিন দ্বারা ভাগ হয়। এমনিভাবে জোড় সংখ্যাগুলোরও স্তর রয়েছে। জোড় সংখ্যা যা বিজোড় সংখ্যার সাদৃম্য হয় যেমন ১২ সংখ্যাটি; এটি তিনবার চার এর সমমানের আবার যেমন ৬ সংখ্যাটি তা তিনবার দুয়ের সমমানের সংখ্যা।
বিজোড় ও একক সংখ্যার ইমাম এবং তন্মধ্যে জোড় সংখ্যার সাদৃশ্য হতে অনেক দুয়ের সংক্যা এক এর সংখ্যা। তার অছিয়তকারী ও তার খলিফা প্রতিনিধি –স্থলাভিষিক্ত ও তার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী হলো ১৩ এবং ৭। এ ছাড়া যত সংখ্যক বিজোড় সংখ্যা রয়েছে তারা সবাই “একের” সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক পরিমাণের ক্ষেত্রে তিন ও সাতকেই গ্রহণ করেছেন।
যেখানে আল্লাহ তায়ালার হিকমতের দাবি যে, তার চেয়ে অধিক পরিমাণ বুঝায়, এ জাতীয় সংখ্যা হুকুম দেয়া হবে, তখন এদের মধ্যকার কোনো সংখ্যার উচ্চতর, উর্ধ্বতন ও উৎকৃষ্ট সংখ্যা গ্রহণ করেন। যেমন একের উন্নতি হয় ১০/১০০ ও ১০০০ এর দিকে এবং স্বয়ং ১১ এর দিকে। এবং যেমন তিনের উন্নতি হয় ৩০/১৩৩৩০০ এর দিকে। এবং সাতের উন্নতি হয় ৭০ এবং ৭০০ এর দিকে। সংখ্যার উন্নতির কারণে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায় তা মূলত ঐ মূল সংখ্যাই। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক নামাযের পর একশত কালেমা পাঠ করা সুন্নত করেছেন। ঐ সংখ্যাকে তিনি ভাগ করেছেন ৩৩/৩৩/৩৩ এর দিকে। অবশিষ্ট রাখলেন ১ সংখ্যাটিকে। যাতে পুরো সংখ্যাটি বিজোড় হয়ে যায়, যা প্রত্যাবর্তন হয় ইমামের দিকে বা তার উপদেষ্টার দিকে।
প্রত্যেক জাওহার এবং আরবদের মাকুলার জন্য একজন ইমাম ও একজন উপদেশদাতা রয়েছেন যেমন বিন্দু হলো ইমাম এবং বৃত্ত ও বল তাদের উপদেষ্টা এবং ছবির দিক থেকে তাদের নিকটতম।
আমার পিতা কুদদিছ ছিররুহু আমাকে বলেছেন যে, তিনি একটি বিরাট ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। যেখানে অভিনয় করেন জীবন, জ্ঞান, ইচ্ছা ও আল্লাহর অপরাপর গুণাবলী, অথবা তিনি বলেছেন যে, সেখানে অভিনয় করেছেন, আল হাই, আল আলীম, মুরীদ ও আল্লাহর অপরাপর সুন্দর নামগুলো। আমার স্মরণে নেই যে, এতদুভয়ের মধ্যে কোনোটির কথা তিনি বলেছেন। উত্তর বৃত্তের ন্যায়। এরপর তিনি আমাকে অবহিত করেছেন যে, অতিমিশ্র তথা সূক্ষ্ম বস্তুর আকৃতি গঠনের ক্ষেত্রে অভিনয় তা বিন্দুর সবচেয়ে নিকটতম হয়ে থাকে। আর সেটি বৃত্তের ছাদের উপর এবং বলের দেহের মধ্যে হয়ে থাকে (তাঁর বাণী শেষ)।
জেনে রাখুন! আল্লাহ তায়ালার সুন্নাত তথা অনুসৃত রীতি পদ্ধতি হলো এককের নাজিল হয় অধিকের প্রতি মেছালী এরতেবাতের মাধ্যম তথা মিলনের মাধ্যমে। আর সে সম্বন্ধের মাধ্যমে ঘটনাবলী প্রকাশ পায়। আর সেটিকেই যথাসম্ভব মেনে চলে অনন্তকালের রীতি পদ্ধতি তথা আল্লাহ তায়ালার চিরাচরিত নিয়ম।
দ্বিতীয় মূলনীতিঃ উৎসাহ উদ্দীপনা তারগীব ও তারহীবের উদ্দেশ্যে যেসব সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তার রহস্য উদঘাটন। জেনে রাখুন! কখনো কখনো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পাপ ও পুণ্যের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে এবং নেকীর তথা পুণ্যময় কাজের ফজিলত এবং পাপের তথা গুনাহের কাজের আয়েব মন্দ ও দোষ বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি সেগুলো বর্ণনা করেছেন যা আল্লাহ তাঁকে বলেছেন। তখন যে জিনিসের অবস্থা তিনি জেনেছেন তার সংখ্যা তিনি বলেছেন। কিন্তু এতে সে বস্তুর গুণাবলী ও সংখ্যা সীমাবদ্ধ করা তার উদ্দেশ্য নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
(আরবী************************************************************************************)
“আমার নিকট আমার উম্মতের আমলসমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের ভালো ও মন্দ আমল। তাদের ভালো আমলের মধ্যে পেয়েছি রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর তাদের মন্দ আমলের মধ্যে সে কফ, শ্লেষ্মা যা মসজিদে ফেলা হয়েছে, যাকে মাটিতে পুতে ফেলা হয়নি।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
“আমার নিকট আমার উম্মতের পুরস্কার প্রতিদান ও সওয়াবসমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিশেষে কোনো ব্যক্তি মসজিদ হতে খড়কুটা ধূলিকণা ইত্যাদি বের করলে কি সওয়াব পাবে তাও। আমার নিকট আমার উম্মতের পাপসমূহও উপস্থাপন করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের কোনো সূরা বা আয়াত মুখস্ত করার পর তা ভুলে যাওয়ার গুনাহ হতে বড় গুনাহ আর আমি দেখিনি”।
এ পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীকেও বুঝে নেয়া একান্ত প্রয়োজন (আরবী***************************) তিন ব্যক্তির জন্য দুটি পুরস্কার –আল হাদীস এবং তাঁর বাণী (আরবী*****************) তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তায়ালা কোনো কতা বলবেন না।
আল হাদীস এবং তাঁর অপর বাণী-
(আরবী*************************************************************)
চল্লিশটি কথা, তন্মধ্যে সবচেয়ে সর্বোচ্চ কথা হলো, বকরী উপঢৌকন দেয়া। কোনো ব্যক্তি সেগুলোর একটির উপরও যদি সওয়াব পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং ওয়াদাকৃত সত্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ আমল করে তাহলে এর কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
কখনো কখনো তাঁর নিকট কোনো আমলের ফজিলত অথবা কোনো বস্তুর অংশসমূহ এজমালীভাবে প্রকাশিত হয়। তিনি তখন ঐ আমলের ফজিলত ও ঐ বস্তুর জন্য এমন একটি সংখ্যা নির্ধারণ করেন যাতে ঐ বস্তুর অধিক পরিমাণে হওয়া, বা যে বস্তুর সম্মান বা তার ন্যায় সেগুলো তাতে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি এ সম্পর্কে সংবাদ দেন, লোকদের বলেন।
এ পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
(আরবী***************************************************************************)
একলা নামায হতে জামাতের সাথে নামায আদায়ের সওয়াব সাতাইশ গুণ বেশি। এসংখ্যা নিঃসন্দেহে ৩*৩*৩-এর সমপরিমাণের। তিনি দেখেছেন যে, জামাতের সাথে নামায আদায়ের সওয়াব এ উপকারিতা তিন প্রকারের হয়ে থাকে।
(১) যেসব কল্যাণ নামাযীর নিজের মধ্যে সংঘটিত হয়ঃ তার চরিত্র সুন্দর হওয়া, সম্পদের অধিকারী হওয়া, পশুত্ব স্বভাব দূর হওয়া।
(২) যেসব উপকারিতা ও কল্যাণ অন্যদের প্রতি হয়ঃ মানুষের মধ্যে সুন্নাতের সঠিক প্রচার হওয়া, তাতে আমলের জন্য তাদের প্রতিযোগিতা করা। এর দ্বারা তাদেরকে সুষমামণ্ডিত করা, এবং সুন্নাতের উপর তাদের ঐকমত্য হওয়া।
(৩) যেসব কল্যাণ উম্মতের প্রতি হয়ঃ মিল্লাতে মুহাম্মদীর চির সবুজ ও চিরঞ্জীব হয়ে টিকে থাকা, তাদের মধ্যে কোনো ধরনের তাহরীফের প্রবেশ না হওয়া। তাদের মাঝে দ্বীনের কদর যেন কমে না যায়।
প্রথম প্রকারের মধ্যে তিনটি উপকারিতা রয়েছেঃ (১) আল্লাহ তায়ালার নিকট নৈকট্য লাভ, (২) তাদের জন্য নেক লিখে দেয়া, (৩) তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া।
দ্বিতীয় প্রকারের মধ্যে উপকারঃ (১) তাদের জাতি ও শহরের পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জা (২) দুনিয়ার জীবনে তাদের প্রতি বরকত বর্ষিত হওয়া (৩) আখেরাতে নামাজিদের পরস্পরেরজণ্য সুপারিশ করা।
তৃতীয় প্রকারের মধ্যে তিনটি উপকারিতাঃ (১) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সকলের চলা (২) আল্লাহর দ্বীনকে ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করা (৩) লোকদের একজনের নূর অপরজনের উপর প্রতিফলিত হওয়া।
উক্ত নয়টির মধ্যেকার সবগুলোতে তিনটি উপকারিতাঃ (১) তাদের প্রতি আল্লাহর খুশী হওয়া, রাজি হওয়া (২) তাদের প্রতি ফিরিশতাদের দোয়া বর্ষিত হওয়া (৩) তাদের থেকে শয়তান দূরীভূত হওয়া।
অপর এক বর্ণনায় আছেঃ (আরবী*************************) ‘পঁচিশ দরজা’ আর তার ব্যাখ্যা হলোঃ জামাতের উপকারিতা (৫*৫) পাঁচকে পাঁচ দ্বারা গুণ করার সমান।
(১) তাদের ব্যক্তি চরিত্রের সংশোধন। (২) তাদের জামাতের সঠিকভাবে চলা (৩) তাদের মিল্লাতের (জাতির) টিকে থাকা। (৪) ফিরিশতাদের খুশি হওয়া। (৫) তাদের থেকে শয়তানের পেছনে হটে যাওয়া।
আবার এ পাঁচ উপকারিতার প্রত্যেকটির মধ্যে পাঁচটি করে উপকারিতা নিহিত রয়েছে। (১) তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্ট হওয়া (২) দুনিয়ার জীবনে তাদের প্রতি বরকত নাযিল হওয়া (৩) তাদের জন্য নেক লিখে দেয়া (৪) তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া। (৫) এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ফিরিশতাদের তাদের জন্য সুপারিশ করা। এ ক্ষেত্রে বর্ণনার বিভিন্নতা ও বুঝের বিভিন্নতার কারণে। আল্লাহই ভালো জানেন।
কখনো কখনো সংখ্যার উল্লেখ করা হয় সে বস্তুর মহত্ত্ব এবং বিশালতার প্রকাশ করার জন্য। তখন উপমা হিসেবে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। তার উপমা হলো, যেমন বলা হয়, অমুকের ভালোবাসা আমার অন্তরে পাহাড়ের ন্যায় বা অমুকের মর্যাদা আকাশসম। এর উপর ভিত্তি করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। (আরবী****************************) তার কবর সত্তর হাত পরিমাণ প্রশস্ত করা হবে”। তাঁর অপর বাণী (আরবী********************) দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত। এবং তাঁর অমর বাণী (আরবী*********************) আমার হাউজের (হাউজে কাওছারের) প্রশস্ততা পবিত্র কাবা শরীফ ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানের পরিমাণ এবং তাঁর বাণী (আরবী*************************) আমার হাউজের দূরত্ব আইলা ও আদনের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। এ জাতীয় বিষয়াবলীতে কখনো এক পরিমাণ এবং দ্বিতীয়বার অপর পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে, এরূপ করার মধ্যে কোনো ধরনের বৈপরীত্ব নেই।
তৃতীয় মূলনীতিঃ প্রকাশ্য ও নির্ধারিত সীমা ব্যতীত কোনো জিনিসের পরিমাণ নির্ধারণ করা অনুচিত তথা উচিত নয় বা কাম্য নয়। যে সব বিষয় ব্যবহার করা হয় কোনো বিধানের ক্ষেত্রে তার সহজাত হুকুমের ভিত্তি রূপে এবং হিকমতের সাথে। আওকিয়ার সাথে ব্যতীত অন্য কিছুর সাথে দিরহামের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত নয়। এমন কোনো অংশ (হিসসা) গ্রহণ করা যাবে না যা অংক শাস্ত্রের বিশেস পাণ্ডিত্যসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত অপর কারো পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যেমন সতেরোতম অংশ বা ঊনিশতম অংশ। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা ফরায়েজের ক্ষেত্রে (সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে) এমন টুকরা অংশ গ্রহণ করেছেন যাকে অর্ধেক করা যায়, দ্বিগুণ করা যায়, যাকে ভাগ করে তার শেষ সীমায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়।
এগুলো দু’ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ হলোঃ সুদুছ ছয় ভাগের এক ভাগ (আরবী******) সুলুছ তিন ভাগের এক ভাগ ও (আরবী**********) সুলছানে তিন ভাগের দু’ অংশ। দ্বিতীয় ভাগ হলো (আরবী*************) সুমুন আট ভাগের এক অংশ, (আরবী*******) রুবুউ চার ভাগের এক ভাগ ও (আরবী************) নিছফ দুই ভাগের এক অংশ।
এর রহস্যঃ এর মধ্যে লুকায়িত রহস্য হলো অধিক পাওনাদারের পাওনা এবং অল্প পাওনাদারের পাওনা পরিস্কার হয়ে যাবে সহজভাবে। অপর রহস্য হলো, দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সকলের প্রাপ্য সংক্রান্ত মাসয়ালা বের করা সহজ হবে। প্রথমত, যদি কখনো এমন পরিমাণের প্রয়োজন হয় যে কোনো পরিমাপ নির্ণয় বা নির্ধারণ করতে হবে যাদের মধ্যকার সম্পর্ক হবে দ্বিগুণের। তাহলে সে ক্ষেত্রে তিন ভাগের এক অংশ হতে অর্ধেক বাড়ানো সম্ভব হবে না বা এককের মধ্যে তিন ভাগের এক অংশের, চারের এক ভাগ অথবা অর্ধেক কারণ সমগ্র অংশগুলোই আরো অস্পষ্ট।
যখন কোনো বস্তুর পরিমাণ ঠিক করার ইচ্ছা করা হবে, যা কোনো পর্যায়ে অনেক সংখ্যক। তখন সে বস্তুকে তিন দ্বারা পরিমাপ করা চাই, আর যদি তা হতে অধিক সংখ্যা দ্বারা পরিমাণ নির্ধারণ করতে চায় তাহলে তাকে দশ দ্বারা পরিমাপ করা উচিত। যখন কোনো বস্তু স্বল্প পরিমাণের হবে বা অধিক পরিমাণের হবে তখন উচিত হবে সর্বনিম্ন সীমা গ্রহণ করা অথবা সর্বাধিক সীমা গ্রহণ করে তাকে দুভাগে ভাগ করে নেয়া।
যাকাতের অধ্যায়ে গ্রহণযোগ্য হলোঃ (আরবী************) এক-পঞ্চমাংশ (আরবী*******) এক দশমাংশ, (আরবী**********) ওশরের অর্ধেক, (আরবী**********************) ওশরের চার ভাগের এক ভাগ। কারণ যাকাতের বাড়তি হওয়া সম্পদের আধিক্য ও তার ব্যয়ের ক্ষেত্র কম হওয়ার উপর নির্ভর করে। দেশের সমগ্র জনগণের অধিকাংশের আয়ের পরিমাণ চার পর্যায়ের হয়ে থাকে। প্রত্যেক দু’পর্যায়ের মাঝে প্রকাশ্যভাবে পার্থক্য হওয়া উচিত। যাতে ঐ চার স্তরের এক স্তর দ্বিতীয় স্তরের দ্বিগুণ হয়। অচিরেই তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হবে।
যখন সম্পদের মালিকের মেছাল হিসেবে সম্পদের পরিমাণ ঠিক করার প্রয়োজন দেখা দেবে; তখন দেখতে হবে ঐ সব মাল যাকে প্রচলিত নিয়মে সম্পদ ধরা হয় এবং যতটুকু মাল হলে তাকে মালদার হিসেবে ধরা হয়। আর তা গ্রহণ করা হবে সমগ্র দুনিয়ার লোকদের নিকট গ্রহণযোগ্য হিসেবে, প্রাচ্য-প্রতিচ্য আরব-অনারব নির্বিশেষে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হিসেবে। কোনো বাধা প্রতিবন্ধকতা না থাকলে তা হবে প্রাকৃতিকগতভাবে সবাইর নিকট গ্রহণযোগ্য বস্তু। যদি তা জমহুর তথা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে তা সকলের দৃষ্টিতে ঠিক হবে না। প্রথম আরবদের অবস্থা গ্রহণযোগ্য। তারা হলেন ঐসব লোক যাদের মাঝে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। এবং যাদের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী শরীয়তের বিধান নির্ধারিত হয়েছে। এ কারণে শরীয়ত ধন ভাণ্ডারের সীমা ও পরিমাণ ঠিক করেছে পাঁচ আওকিয়া দ্বারা। তা এজন্য করা হয়েছে যে ছোট্ট পরিবারের জন্য পাঁচ আওকিয়া যথেষ্ট পুরো বছরের জন্য অধিকাংশ জনবসতিতে। ইল্লা মাশাআল্লা, দুর্ভিক্ষের সময়ে অথবা বড় ধরনের শহরে বা তার আশপাশের অবস্থা অন্য রকম হতে পারে এবং ছোট পশুপালের জন্য পরিমাণ ধরা হয়েছে চল্লিশটিকে। আর বড় পশুপালের জন্য একশত বিশটিকে। অধিক ফসলের পরিমাণ দরা হয়েছে পাঁচ ওসকে। এটা এজন্য ধরা হয়েছে যে, ছোট্ট পরিবারে স্বামী-স্ত্রী এবং তৃতীয় ব্যক্তি হয়তবা চাকর ও একটি সন্তান থাকে। দিবা রাত্রে তারা অধিক খেলে এক মুদ অথবা এক রেতেল পরিমাণ খাদ্য ভক্ষন করে থাকে। এজন্য তাদের শুধু তরকারির প্রয়োজন বাকি থাকে। তাদের পুরো বছরের জন্য এ পরিমাণ যথেষ্ট হয়। পানির পরিমাণ ধরা হয়েছে দুমটকা। এটা এজন্য যে, আরবদের রীতি অনুযায়ী কোনো ভাবেই এর চেয়ে নিচে যাওয়া যায় না। শরীয়তের অন্যান্য বিধানগুলোকে এর উপর কেয়াছ করে নিন। বাকিটুকু আল্লাহই ভালো অবগত রয়েছেন।
অধ্যায়-৬২
কাজা ও রোখছতের হিকমত
স্মরণ রাখবেন যে, নিয়ম হলো যখন কোনো বিষয়ের হুকুম দেয়া হয় বা কোনো কিছু করা হতে কাকেও বিরত রাখা হয়, আর যাকে হুকুম দেয়া হলো বা বিরত রাখা হলো সে সম্পূর্ণভাবে জানেনা যে, এ আদেশ বা নিষেধের মাঝে কি হিকমত নিহিত রয়েছে, তখন অবশ্যই বিষয়টি এমন হতে হবে যাতে সে বিষয়ের চরিত্র দ্বারা সে বুঝতে সক্ষম হয় যে, তাকে এটা মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু তখনো সে সে বিষয়ের তাছির সম্পর্কে ও তাছিরের কারণ সম্পর্কে জানতে পারে না। যেমন মন্ত্রের বিষয়টি। ঐ ব্যক্তি জানেনা তার কার্যকারিতার কারণ। এ কারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালার আদেশ ও নিষেধের মধ্যে কি হিকমত নিহিত রয়েছে তা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তার উম্মতের বিজ্ঞ ও জ্ঞানী পণ্ডিতদের জন্য ঐ হিকমতের কিছুটা ইঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে দ্বীনের পতাকাবাহীদের, খোলাফায়ে রাশেদীনদের এবং দ্বীনের ইমামদের নিজেদের জীবন সম্পর্কে ফিকির তথা চিন্তা-ভাবনা হতে উম্মতের চিন্তা অধিক ছিল।
হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন-
(আরবী********************************************************************)
“আমি নামাযরত অবস্থায় বাহরাইনের জিজিয়া করের হিসাব করে নেই। এবং আমি নামাযরত অবস্থায় সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করি”। এজন্য অতীতের এবং বর্তমানের সকল মুফতিদের অনুসৃত নীতি হলো তারা ফতোয়া দেয়ার সময় মাসয়ালার দলিলের ব্যাপারে দ্বিমত পোষন করেন না। এবং অবশ্যই নির্দেশিত বিষয়টিকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নেবে, যেভাবে করা প্রয়োজন। এবং নির্দেশিত বিষয়টিকে ত্যাগ করলে সেজন্য তাকে কঠিন ও কঠোরভাবে তিরস্কার করা হবে এবং তাদের অন্তরকে সেদিকে আগ্রহী করে তুলবে এবং তাকে ভালোবাসবে যেমন ভালোবাসা প্রয়োজন। যাতে ভেতরে বাহিরে সকল ক্ষেত্রে হক তথা সত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
বিষয়টি যখন এমন তখন যদি কোনো জরুরী বিষয় সে নির্দেশিত কর্ম করার পথে প্রতিবন্ধক হয়, তখন তার স্থলাভিষিক্ত হয় এমন বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। তা এজন্য যে, তখন বিধান পালনকারী দুটি বিষয়ের মধ্যে অবস্থান করেনঃ
(১) যত কষ্টই হোক সে কাজটি বা নির্দেশিত বিষয়টি তাকে পালন করা। এরূপ করা শরীয়তের খেলাফ যেমন আল্লাহ বলেছেন-
(আরবী***************************************************************************)
“আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ কাজটি চান, তিনি তোমাদের উপর কঠোরতা আরোপ করতে চান না”।
(২) অথবা নির্দেশিত কাজটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করবে। তাহলে তার প্রবৃত্তি তথা নফস তা ত্যাগ করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এবং সে নির্দেশিত কাজ ত্যাগ করে নির্ভীকভাবে বেপরোয়াভাবে চলতে থাকবে।
নফসকে প্রশিক্ষণ দেয়া বেয়াড়া প্রাণীকে সোজা করার ন্যায়। তার ক্ষেত্রে মহব্বত ও আগ্রহকে গণিমত হিসেবে ধরে নেয়া হয়। যে ব্যক্তি বিয়াজাতে নফসনীকে তথা নিজের নফসকে সোজা পথে চালানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছে বা শিশুদের শিক্ষায় অথবা কোনো চতুষ্পদ জন্তুকে পোষ মানানোতে অথবা এ জাতীয় কাজে ব্যস্ত হয়েছে সে বলতে পারবে বা জানে যে, কিবাবে বিরতিহীনভাবে প্রচেষ্টার মাধ্যমে মহব্বত তথা ভালোবাসা লাভ হয়। আর সে কাজ ত্যাগ বা তাতে ঢিল দেয়ার মাধ্যমে কিভাবে ভালোবাসা দূর হয়ে যায়। নফস তখন সে কাজকে সে আমলকে বোঝা মনে করে এবং তা নফসের জন্য কঠিন মনে হয়। তারপর সে যখন সে আমলের দিকে ফেরার ইচ্ছা পোষন করে তখন দ্বিতীয় বার ভালোবাসা সৃষ্টির মুখাপেক্ষী হয়।
আমলের সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে তা কাজা করার বিধান দেয়া অত্যাবশ্যকীয় হয় এবং আমলের জন্য রোখছতের বিধান দেয়া এবং যাতে সহজে তা পালন করতে পারে সে ব্যবস্থা করা এবং কাজটি তথা আমলটি যেন তার জন্য সহজ হয় সে ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে উত্তম হলো যাদের উপর আমলটি ফরজ করা হয়েছে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান হওয়া এবং সে আমলের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সে আমল ও তার সকল অংশ আশলকারীর নিকট উপস্থাপন করা। এতদসত্ত্বেও এ আল্লাহর দেয়া অধিকার এবং রোখছতের জন্য কিছু মূলনীতি অছুল রয়েছে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা যা অবগত রয়েছেন। তন্মধ্যে একটি হলো রোকন। রোকন ও শর্তের মধ্যে দুটি জিনিস রয়েছে-
প্রথমটিঃ আছলী তথা মূলঃ যা সে বস্তুর হাকীকতের মধ্যে রয়েছে তথা হাকীকতের মধ্যে বিদ্যমান। অথবা এমন অত্যাবশ্যকীয় বিষয় মূল উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ করলে যা ব্যতীত সে উদ্দেশ্য চিন্তা করা যায় না। যেমন দোয়া (অর্থাৎ ফাতেহার মূল উদ্দেশ্য) এবং কুকার আমল বা তাজিম তথা সম্মান করা বুঝায়। যেমন পবিত্রতা এবং খুশুর দুটি গুণের সংবাদ যা অযু এবং সিজদার উদ্দেশ্য) আর এগুলো এমন বিষয় যা খুশি অখুশি কোনো অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা যাবে না, ছাড়া যাবে না। কারণ এগুলো ত্যাগ করা অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই কোনো আমল পাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয়টি তাকমিলী তথা পূর্ণতা দানকারীঃ যা শরীয়তের বিধান রূপে স্বীকৃত হয়েছে অন্য কারণে, ওয়াজেব হওয়ায়। তা নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ার কারণে। এ আনুগত্য ব্যতীত সে জন্য অপর কোনো সময় উপযুক্ত নয়। অথবা এটা শরীয়তের বিধান রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে যে তা এমন একটা অতি উত্তম মাধ্যম যার মাধ্যমে এর আসল উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে পালিত হবে। এ প্রকারের মর্যাদা তথা মাহাত্ম্য হলো যে, (আরবী**********) কষ্টকর সময়ে এর মধ্যে সহজ করা হবে।
এ মূলনীতির ভিত্তিতে অন্ধকারে এবং এ জাতীয় কোনো সময়ে কেবলামুখী হওয়ার ক্ষেত্রে তা ত্যাগ করা যেতে পারে। তখন কেবলামুখী হওয়া হতে রোখছত পাওয়া যেতে পারে। যে ব্যক্তির কাপড় নেই তার জন্য সতর ঢাকা ত্যাগ করা, আবার যে ব্যক্তি পানি পায় না তার জন্য তাইয়াম্মুম করা এবং যে ব্যক্তি ফাতেহা পাঠ করতে অক্ষম তার জন্য অপর কোনো যিকির পাঠ করা, কেয়াম করার ক্ষমতা না থাকলে বসে বা শুয়ে যাওয়া এবং রুকু ও সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তি ইশারায় নামায আদায় করা ইত্যাদির সুযোগ তথা রোখছত লাভ করা যায়।
দ্বিতীয় মূলনীতিঃ পরিবর্তিত বিষয়ের মধ্যে এমন কিছু বিষয় যোগ করে দিতে হবে যাতে তা দ্বারা মূল বিষয় স্মরণে থাকে। এবং বুঝা যায় যে এটা তার নায়েব তথা তার স্থলাভিষিক্ত ও তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে।
এরূপ করার রহস্যঃ রোখছত তথা সুবিধা ও সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্য হাসিল করা। আর তাহলো যেন প্রথম আমলের তথা মূল আমলের সাথে ভালোবাসা ও তার প্রতি আকর্ষণ অবশিষ্ট থাকে। আর সে জন্য আমলকারীর সত্তা অপেক্ষমান থাকে। এ কারণেই (আরবী*******************************) মোজার উপর মাছেহ করার জন্য পূর্বশর্ত করা হয়েছে পবিত্র অবস্থায় তা পরিদান করা এবং সে জন্য একটি সময়ও নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, যে সময়ে পৌঁছে তা শেষ হয়ে যাবে। কেবলা ঠিক করার শর্তারোপ করা হয়েছে।
তৃতীয় মূলনীতিঃ প্রত্যেক বিপদজনক অবস্থায়ই রোখছত দেয়া হয় না, তা এ কারণে যে, বিপদের ধরন অনেক-অসংখ্য। আর সকল বিপদে তথা সকল সমস্যায় রোখছত দিতে গেলে মূল বিষয়টিকেই নিস্ফল ও অর্থহীন করে দেবে। আর এভাবে রোখছত তথা অনুমতি দিতে গেলে কষ্ট করা ও কঠিন কিছু মোকাবেলা করার ক্ষমতাই বিনষ্ট হয়ে যাবে। অথচ তাই শরীয়তের আনুগত্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তায়ালার হিকমত হলো যে এ বাণী অধিক পরিমাণে ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় এবং সে সবক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যেখানে পরীক্ষা অনেক। বিশেষ করে সে জাতির জন্য যাদের ভাষায় পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং যাদের নিয়মানুযায়ী শরীয়তের বিধান নির্ধারিত হয়েছে।
আনুগত্য যেন স্বভাবের উপর প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সে দিকে সাধ্যমত দৃষ্টি রাখতে হবে। এ কারণে সফর অবস্থায়, ভ্রমণ অবস্থায় নামাযে কছরের বিধান রাখা হয়েছে। কষ্টকর কাজের মধ্যে এবং কৃষক ও কর্মচারীদের জন্য তা করা হয়নি। জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সফরকারীর জন্য যা বৈধ করা হয়েছে অজাঁকজমকপূর্ণভাবে সফরকারীদের জন্যও তাই বৈধ করা হয়েছে।
কাজাঃ কাজার মধ্যে এক ধরনের কাজা হলো যুক্তিসম্মত, যথার্থ ও যথাযথ কাজা। আবার কাজার মধ্যে রয়েছে যা যথার্থ বা হুবহু ঐ আমলের কাজা নয়। আল্লাহর আনুগত্যের আসল তথা মূল হলো আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক নফসকে মোয়াখাজা করা। তাহলে যে ইচ্ছা ও এরাদা ব্যতীত আমল করে, যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি, অথবা নামাযকে ভুলে যাওয়া ব্যক্তি, অথবা সে এমন অবস্থায় যে সে তার ইচ্ছা পূর্ণ করতে অক্ষম এবং আল্লাহর প্রতি কাঙ্ক্ষিত সম্মান প্রদর্শন করতে পারে না। তখন তাকে মাজুর ধরা হবে। তার প্রতি তখন চরম কঠোরতা প্রদর্শন করা যাবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীকে এর আলোকে বিবেচনা করতে হবে-
(আরবী*******************************************************************************)
“তিন ব্যক্তির উপর হতে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে”। (আল হাদীস)
আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
অধ্যায়-৬৩
উপকারী বস্তুর প্রসার ও প্রচার করা এবং প্রচলিত রীতি-নীতিকে সুন্দর ও সংশোধন করা প্রসঙ্গে
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে সরাসরি ও ইঙ্গিতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উপকারি বিষয়গুলোর জন্যেই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ঐগুলোর কারণেই অপরাপর সৃষ্টি জগত হতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তথা অন্যান্য প্রাণীর উপর মানুষের প্রাধান্য ঐ দুটোকে ত্যাগ করা ও ঐ দুটোর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন তাদের পক্ষে অসম্ভব। এসব বিষয়াবলীর অধিকাংশকে বুঝার জন্য বিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তির প্রয়োজন। যারা এসব উপকারি বস্তুগলোর প্রয়োজনীয়তা এবং এগুলোর প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হবেন। যা সর্বষ্তরের মানুষের উপকারে আসবে। হয়ত তারা তা চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে লাভ করবেন অথবা কোনো অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে সে তা অর্জন করবে। সে হয়ত মালায়ে আলার উচ্চতর পরিষদের পক্ষ হতে তার নিকট জ্ঞান অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত হবে। আর এটি হলো উক্ত দুটির মধ্যে পরিপূর্ণ ও উভয়ের মধ্যে অধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। আর প্রচলিত রীতিনীতি ও পদ্ধতি হলো উপকারি বস্তুগলোর মধ্যে যেমন দেহের মধ্যে কলবের ন্যায় তথা হৃদপিণ্ডের ন্যায়। প্রচলিত রীতিনীতি ও পদ্ধতিগুলো সমাজে অন্যায়ের ও অশুভের প্রসার ঘটায়, এ জাতীয় লোকদের সমাজের প্রধান সরদার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে, যাদের মাঝে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকে না। সুতরাং এর ফলে মানুষ, পশুত্বমূলক প্রবৃত্তির দাসত্বমূলক এবং শয়তানী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তখন তারা সমাজে সে অন্যায় ও অশুভ কাজের প্রচলন করে। অধিকাংশ মানুষ তাদের অনুসারী হয়ে যায়। এমনিভাবে অন্যদিক থেকেও ধ্বংসমূলক কাজ প্রসার লাভ করে। (যার আলোচনা তৃতীয় অধ্যায়ে অতীত হয়েছে) তখন প্রয়োজন দেখা দেয় এমন একজন শক্তিশালী ব্যক্তির যিনি কারো কোনো সমালোচনার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেন এবং অদৃশ্য জগত হতে সাহায্যপ্রাপ্ত হন যিনি সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে ব্রতী হবেন যাতে তিনি তাদের প্রচলিত রীতিনীতি ও পদ্ধতিকে সত্যের দিকে –হকের দিকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন। তিনি সেজন্যে এমন এক পদ্ধতি গ্রহণ করবেন যে পদ্ধতি শুধুমাত্র রুহুল কুদুস অর্থাৎ মহান আল্লাহর পক্ষ হতে সাহায্য প্রাপ্তরা লাভ করে থাকেন।
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলো যেসব বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে যদি আপনি তা উত্তমরূপে বুঝে থাকেন ও হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন তাহলে জেনে নিন যে, নবীদের প্রেরণ তথা আবির্ভাব-যদিও বাস্তবিকপক্ষে প্রথমত বান্দাদের আল্লাহর ইবাদতের পদ্ধতি শিক্ষার জন্য হয়ে থাকে তথাপি তার সাথে সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত রীতি-নীতি পদ্ধতিগুলোকে মূল উৎপাটনের বিষয়টি তার মধ্যে ধর্তব্য থাকে এবং সেখানে উপকারি ও কল্যাণময় জিনিসগুলোর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এরশাদ হচ্ছে –(আরবী********************)
“আমি বাদ্যযন্ত্র ধ্বংস করার জন্য প্রেরিত হয়েছি”। এবং তাঁর এরশাদঃ (আরবী***********************) “আমি উত্তম চরিত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি”।
জেনে নিন যে, আনন্দের সাথে জীবন যাপন করার পথ অবলম্বন করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার রীতি নিয়মকে অবজ্ঞা ও নিস্ফল করা আল্লাহ তায়ালার মর্জি নয়। আর কোনো নবীও তাঁর কোনো উম্মতকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেননি এ সংক্রান্ত বিষয়ে। যারা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে সংসার ত্যাগ করে অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। যারা ভালোমন্দ কাজে লোকদের সাথে মেলামেশা করা পরিত্যাগ করেছে যারা বন্য জন্তুদের ন্যায় বসবাস করে। এ কারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ইচ্ছা করেছিল তার সে ইচ্ছাকে গ্রহণ করেননি। অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন, রদ করেছেন এবং তিনি বলেছেন-
(আরবী*******************************************************************************)
“আমি সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য গ্রহণ করার জন্য প্রেরিত হইনি। আমি সহজতর মিল্লাতে হানিফীর সাথে প্রেরিত হয়েছি”। অথচ আম্বিয়া (আঃ) দেরকে উত্তম কাজগুলোকে আরো সুষমামণ্ডিত ও সুন্দর করার হুকুম দেয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে যেন উত্তম জীবনোপকরণ গ্রহণ করতে গিয়ে পানোন্মত্ত, ও মাতাল লোকদের পর্যায়ে উপনীত না হয়। যেমন অবস্থা প্রাচ্যের রাজা বাদশাহদের। আর না তা নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থানরত লোকদের মতো অবস্থানে পৌঁছায়, যারা বন্য জানোয়ার সাথে মিলিত হয়।
এক্ষেত্রে দুটি বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। দেখা যায় এক দৃষ্টিভঙ্গি হরো খোশহাল –ভালো অবস্থা –ভালো। তাতে মন ও মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়, তাতে চরিত্র সুন্দর ও কোমল হয়, তার দ্বারা মানুষের সে মর্যাদা তার জাতির অপরাপরদের থেকে পৃথক শানে প্রকাশিত হয়। বন্যতা ও দুর্বলতা এবং এ জাতীয় কথাবার্তা বদ তদবীরের দ্বারা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হলোঃ খোশহাল ভালো ও উত্তম অবস্থা খারাপ ও নিন্দনীয়। তার কারণে লোকদের সাথে বিরাট ধরনের ঝগড়া সৃষ্টি হয়, লোকদের সাথে মিলে ধান্দা করতে হয়, এজন্য দিবারাত্র কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, আল্লাহর দিক হতে বিমুখতা এবং আখেরাতের কল্যাণ লাভের প্রচেষ্টাকে ত্যাগ করা হয়।
এ কারণে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা উত্তম। জীবন যাপনের ভালো উপকরণ অবশিষ্ট থাকার সাথে সাথে আল্লাহর যিকির ও শিষ্টাচারকে মিলিয়ে নিতে হবে এবং আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করার সুযোগকে গনিমত মনে করতে হবে।
উত্তম জীবনোপকরণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আম্বিয়াগণ আল্লাহর পক্ষ হতে যা গ্রহণ করেছেন, তাহলো জাতির নিকট যা বর্তমান রয়েছে তার প্রতি লক্ষ করতে হবে। অর্থাৎ খাওয়া দাওয়া, দালানকোঠা তৈরির ক্ষেত্রে গৃহীত পন্থা এবং আনন্দ উল্লাসের অবস্থাসমূহ, বিবাহ-শাদীর পদ্ধতি, স্বামী স্ত্রীর চরিত্র, ক্রয়-বিক্রয়ের পন্থা ও পদ্ধতি, পাপাচার হতে বেঁচে থাকার পন্থা এবং বিচার ব্যবস্থা ও এ জাতীয় অপরাপর বিষয়াবলির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এরমধ্যে যা কিছু সাধারণ জনগণের জন্য কল্যাণকর এবং জমহুরের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল হবে তাকে ঠিক রাখা হবে। তার মদ্যে কোনো পরিবর্তন করা অর্থহীন ও তা হতে বিমুখ হওয়া ঠিক নয় এবং তখন এমতাবস্থায় কর্তব্য হয় যে, লেকাদেরকে ঐ বিষয়গুলোর প্রতি উৎসাহিত করা হবে এবং এক্ষেত্রে লোকদের মতের প্রাধান্য দেয়া হবে এবং এসবের মধ্যে যেসব কল্যাণ ও উপকারিতা বিদ্যমান রয়েছে তা বুঝাতে হবে।
পক্ষান্তরে যদি প্রচলিত রীতিনীতিগুলো সাধারণের জন্য উপকারি ও কল্যাণকর না হয় তাহলে তখন তাতে পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধন করা বা তাকে নির্মূল ও উৎখাত করা অসম্ভব হয়। একারণে একটি অপরটির জন্য ক্ষতির কারণ হয় বা দুনিয়াদারীর দিকে ধাবিত হওয়ার কারণ হয় বা, নেক কাজের থেকে বিমুখ হওয়ার কারণ হয় বা এমন পর্যায়ে হয় যে কারণে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বিফল ও নিস্ফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনো এমন সব বিষয় সেখানে কার্যকর করা উচিত হবে না যা সেখানকার জনতার পূর্বাভ্যাসের বিপরীতমুখী হবে। বরং তখন সেখানে এমন সব বিষয় প্রচলন করতে হবে যেগুলো প্রচলিত বস্তুসমূহের ন্যায় হবে বা ঐসব বস্তুর সমপর্যায়ের হবে, যেগুলো সেখানকার ভালো ও উত্তম ব্যক্তিদের নিকট প্রচলিত রয়েছে। যার প্রতি লোকদের দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। উদ্দেশ্য হলো ঐ প্রচলিত কাজগুলোর স্থানে এমন বিষয়ের প্রচলন করতে হবে যা সেখানকার লোকদের জন্য উপযোগী হবে। এবং তাদের জ্ঞান তা এভাবে গ্রহণ করবে যে, এগুলো তাদের জন্য কল্যাণকর ও তাদের জন্য উপযোগী। আর যেহেতু প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিকট গ্রহণযোগ্য বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকে, সেহেতু নবীদের শরীয়তের বিধানের মধ্যেও বিভিন্নতা হয়েছে। ইলমে শরীয়তের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সকলেই এ বিষয় সম্যক অবগত যে, শরীয়ত বিবাহ, তালাক, পরস্পর লেনদেন-কায়কারবার সুন্দর্য ও পোশাকাদি, বিচার ও শরীয়দের হদ কার্যকরী করা এবং গণিমতের সম্পদ ভাগাভাগির ক্ষেত্রে এমন কোনো বিষয় উপস্থাপন করেনি যা লোকের পূর্ব হতে অবগত ছিল না এবং এসব বিষয় গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের মতোবিরোধ ছিল যখন তাদেরকে এসব বিষয়ে হুকুম করা হয়।
হাঁ, তবে নবীগণ এটা করেছেন যে, যা বক্র ছির তাকে সোজা করেছেন আর যা রুগ্ন ও দুর্বল ছিল তা ঠিক যথার্থ ও উপযুক্ত করে দিয়েছেন। যেমন তাদের মধ্যে সুদের ব্যাপক প্রচলন ছিল শরীয়ত তা নিষেধ করে দিয়েছে। লোকেরা ফল উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে বিক্রয় করত পরে তা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতো, ফল বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে ও ফলের রোগ সংক্রান্ত বিষয়ে অঙ্গীকার পত্র গ্রহণ করত। এতে তাদেরমধ্যে বিপদ দেখা দিত। এজন্য এজাতীয় বিক্রয় হতে তাদের বারণ করা হয়েছে। আবদুল মোত্তালেবের সময় হত্যার দিয়ত ছিল দশটি উট। আব্দুল মুত্তালেব যখন দেখলেন যে, লোকেরা এ ধরনের হালকা বা সামান্য দিয়তের কারণে হত্যা করাহতে বিরত থাকছে না, তখন তিনি তা বাড়িয়ে একশত উট করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হত্যার দিয়ত তাই ঠিক রাখলেন –বহাল রাখলেন।
কাসামা (ঐ কসম যা যেখানে হত্যা সংঘটিত হয়েছে সে স্থানের পঞ্চাশ ব্যক্তিকে দেয়া হতো।) এর বিধান সর্ব প্রথম চালু করা হয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালেবের নির্দেশানুযায়ী। ইসলাম সে বিধান অনুসন্ধানের মধ্যে অবশিষ্ট রেখেছে। ইসলামের পূর্ব লুটের মালের চার ভাগের এক ভাগ কাওমের সর্দারের জন্য নির্ধারিত ছিল। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমতের মালের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালের জন্য অর্থাৎ কাওমের জন্য নির্ধারিত করেছেন। কুব্বাজ ও তার পুত্র নুশিয়াঁওয়া উভয়ে লোকদের উপর উশর ও খেরাজ নির্ধারণ করেছিল। ইসলামী শরীয়ত তা বহাল রেখেছে। বনী ইসরাইল জিনাকারীদেরকে ছঙ্গেচার (পাথর মেরে হত্যা) করত, চোরের হাত কেটে দিত, হত্যার পরিবর্তে হত্যাকারীকে হত্যা করা হতো। পবিত্র কুরআনেও সে একই বিধান দেয়া হয়েছে। এরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে যা জ্ঞানীদের নিকট ও গবেষকদের নিকট অস্পষ্ট নয়।
আপনি যদি বুদ্ধিমান হন এবং শরীয়তের বিধানগুলো বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে থাকেন তাহলে আপনি জানতে পারবেন যে, নবীগণ ইবাদতের মধ্যে এমন কোনো ইবাদত নিয়ে আবির্ভূত হননি যে ইবাদত তাদের মধ্যে ছিল না অথবা যার কোনো নজির তদের নিকট ছিল না। নবীগণ জাহেলিয়াতের বিকৃতিগুলো দূর করেছেন। যেসব ইবাদতের সময় নির্ধারিত ছিল না এবং যার কোনো নীতি নিয়ম ছিল না এবং যেসব ইবাদত তারা ভুলে গিয়েছিল তারা সেসব ইবাদতের সময় নির্ধারণ, তাকে নিয়মিতকরণ ও যা তাকে স্মরণ করিয়ে তার প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা তারা করেছেন।
আরো স্মরণ রাখুন যে, অনারব ও রোমবাসীরা যখন যুগ যুগ ধরে একে অপরের বাদশাহীর উত্তরাধিকারী হতে থাকল এবং দুনিয়ার শান শওকতের ডুবে গিয়ে আখেরাতকে ভুলে বসল এবং শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়ে পড়ল, তখন তারা জীবিকা নির্বাহের সর্বশেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল, জীবন যাপনের সামগ্রী ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে আভিজাত্য ও গর্ব করতে শুরু করল। দূর দূরান্ত হতে ভিনদেশ হতে তাদের নিকট পণ্ডিতদের আবির্ভাব হতো এবং তারা তাদের জীবনযাপনের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো প্রকাশ করতে থাকত। আর তারা ওদেরকে খুব আপনজন মনে করত। প্রত্যেক নতুন আগমনকারী কোনো কোনো নতুন বিষয় যোগ করত। বাদশাহগণ তাদের জীবিকার সাথে তা যোগ করে পরস্পরের মধ্যে গর্ব ও গৌরব এবং আভিজাত্য প্রকাশ করতে থাকত। বর্ণিত আছে যে, তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের মধ্যে যিনি লক্ষ দেরহামের কম দামি কোমরবন্দ ও তাজ পরিধান করত, যার নিটক আলীশান তথা গগনচুম্বি দালানকোঠাঁ না থাকত, ফোয়ারা ও বিশাল হাউজ হাম্মাম, বাগান বাড়ি, মূল্যবান খাট, সুন্দর দাস এবং খাওয়া উন্নত মানের না হতো এবং পোশাক ও বাহন জাঁকজমকপূর্ণ চটকদার না হতো তাকে দোষের ও লজ্জাজনক মনে করা হতো। এসবের ফিরিস্তি অতি দীর্ঘ। আমাদের বর্তমান বাদশাহদের অবস্থা দেখলে তা বর্ণণা করার প্রয়োজন পড়ে না।
ক্রমে এসব বিষয় তাদের জীবন জীবিকার মধ্যে এমন ভাবে মূলনীতি হিসেবে প্রবেশ করল এবং এমন অংশ হয়ে গেল যাকে তা হতে বাদ দিতে হলে তাদের অন্তরকে ভেঙে টুকরা টুকরা করা ব্যতীত আর কোনো পথই নেই। তাদের এ বিলাস বহুল জীবন যাপনের কারণে এমন সব চিকিৎসার অযোগ্য রোগ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করল এবং এক মহা আপদ চেপে বসল। যা হতে না কোনো শহরবাসী রক্ষা পেল আরনা গ্রামবাসী আর না রক্ষা পেল কোনো ধনী আর না কোনো দরিদ্র। এ বিপদ সকলকেই গ্রাস করে নিল। সবাইর ঘাড়ে চেপে বসল। লোকেরা এসব দুশ্চিন্তায় এমনভাবে ডুবে গেল যা হতে বাঁচার কোনো পথ ও পন্তা উন্মুক্ত থাকল না।
জীবন জীবিকা নির্বাহের এ সকল বস্তু অনেক সম্পদ খরচ করা ব্যতীত লাভ করা যেত না এগুলোমোফত পাওয়া যেত না। তা লাভ করা হতো কৃষকদের, ব্যবসায়ীদের ও অন্যান্য লোকদের উপর বিভিন্ন ধরনের করারোপের মাধ্যমে ও তাদের সাথে কঠোর আচরণের তথা নির্মম আচরণের মাধ্যমে। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, লোকেরা যখন এসব কর দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞানপ করত তখন তাদের সাথে যুদ্ধ বেঁধে যেত এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো। আর যদি তারা তা মেনে নিত তাহলে তাদেরকে গাধা এবং বলদের স্থান-মর্যাদা দেয়া হতো। যেগুলোকে পানি উত্তোলন, ঘানি টানা এবং ফসল কাটার কাজে ব্যবহার করা হয়। যাদের এজন্য পালন করা হয় যে, প্রয়োজনের সময় তাদের সাহায্য নেয়া হবে, তাদেরকে এক মুহুর্তও বিশ্রাম দেয়া হয় না। লোকদের অবস্থা শেষ পর্যন্ত এমন হলো যে, তারা আখেরাত তথা পরকালীন জীবনের উন্নতি ও কল্যাণ লাভের জন্য মাথা উঠাতেই পারত না। তাদের মাঝে সে শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না। কখনো এমন অবস্থা হতো যে, কোনো বিশাল এলাকায় দ্বীন সম্পর্কে চিন্তা করার একজন ব্যক্তিও পাওয়া যেত না।
এসব বিলাস বহুল জীবন সামগ্রী তখনই পর্যাপ্ত পরিমাণে লাভ করা সম্ভব যখন কিছু সংখ্যক লোক তাকে জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে বেছে নেয়। তারা বাদশাহদের জন্য এবং সর্দারদের জন্য মজাদার খাদ্য তৈরী করে। তাদের জন্য পোশাক পরিচ্ছদ তৈরী করে। বিশাল বিশাল ভবন তৈরি করে এবং আয়েশী জীবনের জন্য এছাড়া অন্যসব কিছু সহজলভ্য করে। লোকদের দিবা রাত্র এ কাজেই ব্যস্ত সমস্ত থাকতে হয় এবং তারা জীবিকার ঐ সব মূল বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে যেগুলোর উপর রাষ্ট্রের উন্নতি নির্ভরশীল। সাধারণ মানুষ যারা ঐসব বাদশাহ ও সর্দারদের চারদিকে ও আশপাশে ঘুরত তারা নিশ্চিন্তে সর্দারদের পদাঙ্ক অনুসরণ করত। কারণ তা না করলে তারা বাদশাহর দরবারে কোনো স্থান পেত না আর না সেখানে তাদের কোনো মূল্যায়ন করা হতো।
এমনিভাবে সাধারণ জনগণ খলিফাদের উপর বোঝা হয়ে পড়ল। কখনো তারা এ বলে বাদশাহর নিকট ভিক্ষা চাইত যে, আমরা রাষ্ট্রের পক্ষের সৈনিক এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তারা শুধুমাত্র নিজেদের চেয়ার দখল করে রয়েছে। রাষ্ট্রের কোনো প্রয়োজন তারা পূর্ণ করে না। কোনো প্রয়োজন পূর্ণ করার তাদের কোনো ইচ্ছাও নেই, শুধুমাত্র আঙ্যুল হেলানোর মাধ্যমে চলাই তাদের কাজ ছিল। কাজ হতো। তারা শুধু দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকত, দায়িত্বের চেয়ার আঁকড়িয়ে থাকত রাষ্ট্রের কোনো খেদমত ও দায়িত্ব তারা পালন করত না। শুধুমাত্র পূর্বসূরীদের আদর্শ অনুসরণ করাই হতো তাদের কাজ। আবার কখনো এ বলে বাদশাহর নিকট ভিক্ষ চাইত যে, তারা রাজদরবারের কবি, রাজ কবি তাদেরকে মুক্ত হস্তে সহযোগিতা করা রাজাদের চিরাচরিত নিয়ম বলে আসছে। আবার কেউ এ পদ্ধতি অবলম্বন করে ভিক্ষা দান দক্ষিণা কামনা করত যে, তিনি জাহেদ-সংসার ত্যাগী ও দরবেশ ও ফকির। খলিফার পক্ষ হতে তাদের সংবাদ না নেয়া খারাপ মনে করা হতো। এভাবে একদল অপর দলকে কোণঠাসা করত অর্থাৎ একদল ভিক্ষা নিয়ে বের না হতে অপর দল উপস্থিত হতো।
লোকদের রুজি রোজগার বাদশাহ এবং আমির ওমারাহদের সাহচর্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। তাদের সাথে নরম ভাষায় কথা বলা, কথোপকথন করা তাদের জন্য মিষ্টি মিষ্টি কথামালা তৈরী করা এবং তাদের তোষামুদি, চাটুকারী, চাপলুসী করাই মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়। আর এটা একটা পরিপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়ে থাকল। লোকেরা তা রীতিমত শিখত এবং সারাক্ষণ এ চিন্তায় ডুবে থাকত, বাদশাহ ও আমীর ওমারাদের সাথে আড্ডা দিয়ে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করত। যখন এ অবস্থা লোকদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল তখন খারাপ অভ্যাস লোকদের মধ্যে প্রসার লাভ করল, আর তারা ভালো অভ্যাস হতে বিমুখ হয়ে গেল।
আপনি যদি এ রোগের হাকীকত সম্পর্কে অবগত হতে চান তাহলে ঐ সব লোকদের প্রতি লক্ষ্য করুন যাদের মধ্যে বাদশাহী নেই। আর না তারা খাওয়া, পান করা এবং লেবাস ও পোশাকের আনন্দে ডুবে রয়েছে। তাদের সকলে স্বাধীন। তার নিজের ব্যবস্থা নিজের হাতে করে। সে ভারি ধরনের বোঝায় ডুবে নেই যা তার কোমর ভেঙে দেবে। সে দ্বীন ও মিল্লাতের জন্য কাজ করার সময় বের করতে সক্ষম। আপনি দ্বিতীয়বার ঐ লোকদের চিত্র সামনে উন্মোচিত করুন যাদের নিকট শাসন ক্ষমতা তথা বাদশাহী ছিল। বাদশাহ ব্যতীত অন্যান্য নেতার সৃষ্টি হয়েছে যারা সময়ের অপচয় করছে আর তা তাদের উপর মন্দ ভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। দেখতে পাবেন এ দ্বিতীয় অবস্থাটি প্রথম অবস্থা তথা প্রথম চিত্র হতে কতই না ভিন্ন ধরনের।
যখন বাদশাহ ও আমীর ওমারাদের বিলাস বহুল জীবন যাপনের এ বিপদ ভারী হয়ে গেল এবং এ রোগ কঠিন রূপ ধারণ করল তখন আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর নিকটতম মোকাররবা ফিরিশতারা তাদের প্রতি নারাজ তথা অসন্তুষ্ট হলেন। আল্লাহর মর্জি এমন হলো যে, এ রোগের চিকিৎসা এমনভাবে করবেন যাতে এ রোগের মূল উৎপাটিত হয়ে যায়। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা নবী উম্মি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করলেন যিনি উম্মি হওয়ার ফলে অনারবদের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হননি। ইরান এবং রোমের সাথে যার কোনো খোলামেলা সম্পর্ক ছিল না, যিনি তাদের কোনো রীতি-নিয়ম ও পদ্ধতি কখনো আপন করে নেননি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে মিজান –দাঁড়িপাল্লা তুলাদণ্ড করেছেন, যার দ্বারা চেনা যায়, পার্থক্য করা যায় নেক ছিরত –উত্তম চরিত্র যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং বদ ছিরত যা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় এবং তার পবিত্র জবানে অনারবদের খারাপ অভ্যাসগুলোর ক্ষতিকর দিকের আলোচনা করলেন এবং পার্থিব তথা দুনিয়ার জীবনে ডুবে যাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো, আরতার অন্তরে জাগিয়ে দিলেন যে তিনি ঐসব বিশাল বিশাল বস্তুগুলো হারাম ঘোষণা করবেন যেগুলোতে অনারবরা অভ্যস্ত ছিল আর যা নিয়ে তারা পরস্পর গর্ব ও গৌরব প্রকাশ করত। যেমন রেশমি, কাছি ও আরগুয়ানী কাপড় পরিধান করা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের বাসন ব্যবহার করা, টুকরা না করা স্বর্ণের গয়না পরিধান করা, ছবি খচিত কাপড় পরিধান করা এবং ঘরবাড়ি সাজানো গুছানো এবং কিচু হারাম ঘোষণা করেন যাতে জীবনোপকরণের উঁচুস্তরের বস্তুগুলো এবং আনন্দের চরম উৎকর্ষতার বিমোহিত এবং দুনিয়ার চাকচিক্যে ও জাঁকজমকে মদমত্ত হওয়ার সীমায় পৌঁছে না যায়। আল্লাহর ফয়সালা হলো তার শাসন দ্বারা অনারবদের শাসন খতম করবেন তার সর্দারী দ্বারা ওদের সর্দারী খতম করবেন এবং এ ফয়সালাও করলেন যে, যখনি কিসরা খতম হয়ে যাবে তারপর আর যেন কোনো কিসরা না থাকে। আর যখন কায়সার খতম হয়ে যাবে তারপর যেন কোনো কায়সার না থাকে।
জেনে রাখুন যে, জাহেলী যুগে এমন সব ঝগড়া ও তর্ক হতো যার দ্বারা লোকদের জীবন সংকীর্ণ অবস্থায় আপতিত হতো-নিপতিত হতো। শুধুমাত্র এ ভুল পন্থার মূল উৎপাটন ও তা বাতিল করা ব্যতীত তা বদ্ধ করা খুবই কঠিন হতো। যেমন নিহতের রক্তের প্রতিশোধ নেয়া। আরবে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করত তাহলে নিহত ব্যক্তির অলী (অভিভাবক) হত্যকারীর ভাই অথবা ছেলেকে হত্যা করত। পরে দ্বিতীয় বংশের লোকেরা প্রথম বংশের লোকদের প্রধানদের মধ্য হতে কোনো একজনকে হত্যা করে ফেলত। এমনিভাবে হত্যার পরম্পরা চলতেই থাকত। সুতরাং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পথ চিরতরে বন্ধ করে দিলেন এবং তিনির এরশাদ করলেনঃ
(আরবী************************************************************)
“জাহেলিয়াতের সকল রক্তপণ আমার পায়ের নিচে (অর্থাৎ আমি সেগুলোকে পদদলিত করলাম)। আমি প্রথমে যে রক্তের ঋণ রহিত করছি তা রবিয়ার রক্তের ঋণ”।
মিরাছ তথা উত্তরাধিকারের বিষয়ঃ জাহেলী যুগে জাহেলী সর্দারগণ মিরাছ সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রায় প্রদাণ করত। এক্ষেত্রে লুটতরাজ ও ঘুষের থেকে বিরত থাকত না। এভাবে এক যুগ চলে যেত পরে আরেক যুগ আসত। পরে এ দলিলের ভিত্তিতে ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হতো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এতদসংক্রান্ত ঝগড়া বিবাদ খতম করে দিলেন- নিঃশেষ করে দিলেন। তিনি এরশাদ করলেন-
(আরবী****************************************************************)
ইসলাম যে বস্তুকে যেভাবে পেয়েছে তা পবিত্র কুরআনের বিধান অনুযায়ী ভাগ করা হবে। যে বস্তু জাহেলী যুগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে, অথবা কোনো না কোনো পন্থায় কেউ কোনো বস্তুর মালিক হয়েছে সেটি সেভাবেই থাকবে। সে পন্থা ভেঙ্গে ফেলা হবে না।
সুদঃ জাহেলী যুগে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ঋণ প্রদান করত, তাতে কিছু বাড়তি শর্ত জুড়ে দিত। পরে ঋণ আদায়ের জন্য পীড়াপীড়ি করত। সে ব্যক্তি তা শোধ করতে অপরাগ হলে সুদ আসল যোগ করে তাকে মূলধন ধরে সুদ বাড়িয়ে দেয়া হতো। এমনিভাবে সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকত। এমনিভাবে সুদের অংক বিশাল আকার ধারণ করত। তিনি এ চক্রবৃদ্ধি সুদ বন্ধ করে দিলেন –এবং হুকুম দিলেন যাতে এভাবে মূলধন বৃদ্ধি করা না হয় এবং মূলধন ফেরত দেয়ার বিধান করে দিলেন। বললেন- (আরবী****************) কারো প্রতি যেন কোনো ধরনের যুলুম না হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব নাহলে এ জাতীয় আরো অনেক সমস্যারই সমাধান হতো না।
জেনে রাখুন যে, কখনো কখনো ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণা ও শত্রুতা খতম তথা নির্মূল করার জন্য কোনো পদ্ধতির প্রচলন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেমন পানি পান করা বা এ জাতীয় অন্যান্য কাজে ডানদিক হতে শুরু করা। কখনো দেখা যায় মানুষ একগুয়েমী করে ভদ্রভাবে আচরণ করতে চায় না। যাতে তার সাথের লোকটির দিক থেকে আরম্ভ করা যায়। এরূপ না করা হলে তাদের মধ্যকার তর্ক ও ঝগড়া শেষ করা যাবে না এবং যেমন ঘরের মালিকের ইমামতি করা। বাহনে আরোহণের সময় বাহনের মালিককে প্রাধান্য দেয়া তার বন্ধুর উপর। এ জাতীয় অপরাপর বিষয়েও এদিকে দৃষ্টি রাখা। বাকি আল্লাহই ভালো জানেন।
অধ্যায়-৬৪
যেসব বিধান একটি অপরটিকে টেনে আনে তার বিধান
মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
“আপনার পূর্বে আমি শুধুমাত্র পুরুষদের নবী করে প্রেরণ করেছি। যাদের নিকট আমি অহী প্রেরণ করতাম। তোমরা যদি তা না জান তাহলে আহলে জিকিরদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখ। পরিস্কার প্রমাণ ও কিতাবসহ আমি আপনার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি লোকদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তাদের নিকট পরিস্কারভাবে বর্ণনা করতে পারেন। যাতে তারা তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে পারে।
জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী প্রেরণ করেছেন এ জন্য যেন তিনি লোকদের নিকট ঐসব বিষয় পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেন যেগুলো আল্লাহ তায়ালা তার নিকট অহী করেছেন। ইবাদতের মধ্য হতে, যাতে লোকেরা তার প্রতি আমল করতে পারে। গুনাহ তথা পাপের কাজ যাতে লোকেরা তা হতে বিরত থাকতে পারে। জীবন যাপনের ঐসব উত্তম বস্তুসমূহ যা আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য পছন্দ করেছেন। যাতে এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারে মানুষ।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনার মধ্যে রয়েছে যে, তিনি আয়াতের মাঝে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা বর্ণনা করবেন। তাছাড়া এর মধ্যে ঐ কথাও রয়েছে যে, অহী যে বিষয়ে ইঙ্গিত করেছে তাও তিনি বর্ণনা করবেন এবং তার ন্যায় বিষয়ও বর্ণনা করবেন। এ বিষয়ে অনেকগুলো মূলনীতি রয়েছে যা দ্বারা আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক বিশাল সংখ্যক হাদীসের মূল্যায়ন করতে সক্ষম হব। এখানে আমরা সেসব মূলনীতিসমূহের মধ্যে বড় বড় মূলনীতিগুলোর প্রতি আলোকপাত করব।
সে সব মূলনীতির মধ্যে রয়েছে- (১) আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ সৃষ্টি জগতে যখন একটি নিয়ম প্রচলিত রেখেছেন আর তা হলো কারণের মাধ্যমে কার্য সম্পাদিত হওয়া। অর্থাৎ কারণ কার্য পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, যাদে আল্লাহর সর্বোচ্চ হিকমত ও সর্বোচ্চ রহমতে যা মাছলেহাত ও কল্যান নিহিত রয়েছে তা পরিপূর্ণ ভাবে সংঘটিত ও কার্যকরী হয়। আর এ কারণে কার্য সংঘটিত হওয়ার নীতির দাবি হলো তার সৃষ্টির মধ্যে যেন কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধন করা না হয়। তার সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা করা খারাপ ও নিন্দনীয় এবং ক্ষতিকর কাজ। আর এরূপ প্রচেষ্টা যারা করে তাদের প্রতি মালায়ে আলা তথা উচ্চতর পরিষদের মহান আল্লাহর ঘৃণা অভিশাপ, ভৎসনা বর্ষিত হয়। আল্লাহ তায়ালা যখন একটি রীতি ও পদ্ধতিতে মানুষ সৃষ্টির ধারা প্রচলিত রেখেছেন অর্থাৎ মানুষ হযরত আদম (আঃ)-এর অনুসৃত পন্থার বিপরীতে (Direct) জমিন হতে কীটের মতো সৃষ্টি হয় না। আল্লাহ তায়ালার হেকমতের দাবিও এ ছিল যে, পৃথিবীর বুকে মানুষ জাতির ধারা অবশিষ্ট থাকুক, দুনিয়ায় তাদের বংশধারা বৃদ্ধি পাক ও তা প্রসার লাভ করুক। তখন আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয়ার, বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতা প্রদান করে তাদের ধন্য করেছেন। এবং তাদেরকে সন্তান চাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং তিনি তাদের মধ্যে কামভাব সৃষ্টি করেছেন। যাতে আল্লাহ এর মাধ্যমে তার সে কাজ পূর্ণ করতে পারেন যা তার হিকমতে বালেগা তথা সর্বোচ্চ হিকমতের একান্ত দাবি ছিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যখন এ রহস্য প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং এর হাকীত তাঁর নিকট আল্লাহ তায়ালা প্রকাশিত করে দিলেন তখন তিনি ঐ পথ রুদ্ধ করা নিষেধ করলেন এবং ঐ যোগ্যতাকে নিস্ফল করা হতে বারণ করলেন যে পদ্ধতি অধিক সন্তান উৎপাদনের কারণ হয়। অথবা তাকে বাজে পথে ব্যয় করা নিষিদ্ধ করে দিলেন এবং খুশি হওয়া ও লাওয়াতাত (পুরুষে পুরুষে যৌন সংগম) করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। আজল (যৌন মিলনের পর নারীর যোনিপথে বীর্য না দিয়ে বাহিরে ফেলাকে অপছন্দ করলেন)।
জেনে রাখুন যে ব্যক্তির সৃষ্টি যখন সুস্থ সাবলীল ও সুন্দর হয় তখন তার দেহ সোজা হয়। তার দেহের চামড়া পশম মুক্ত হয় এবং এ জাতীয় অন্যান্য গুণ তার মধ্যে প্রকাশ পায়। এবং এজাতীয় হওয়া তার সৃষ্টির দাবী। মানব জাতি সৃষ্টির দাবি এবং ব্যক্তির মাঝে তা প্রকাশ পায়। মাকামে আলা তথা আল্লাহর নিকট এভাবে সকল জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকার দাবি উত্থিত হয়। এবং প্রত্যেক জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে টিকে থাকার ও তা প্রকাশ এবং বিস্তার লাভ করা তার দাবি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুকুর হত্যা করার আদেশ প্রদান করার পর এ বলে তা প্রত্যাহার করেন যে, এটি একটি প্রজাতি একে পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় নয়। (আরবী*************************) (“এটি জাতি আল্লাহর সৃষ্ট জাতিগুলোর মধ্যে”) এমনিভাবে কোনো সৃষ্ট প্রজাতিকে পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন ও বিলুপ্ত করে দেয়া পছন্দনীয় কাজ নয়। এমনিভাবে এর দাবি হলো এ নিয়মকে ভাঙার চেষ্টা না করা এবং একে খণ্ডন ও এতে রদবদল সাধনের প্রচেষ্টা না করা। এমন কিছু না করা যা সাধারণের স্বার্থের বিপরীত ও সেজন্য ক্ষতিকর। এর উপর ভিত্তি করে দেহের মধ্যে এমন কোনো কাজ করা যা জাতির জন্য ক্ষতিকর তা কাম্য নয়। যেমন খাসি হওয়া, নারীদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দাঁতের ফাঁক বৃদ্ধি করা এবং চেহারার পশম উঠিয়ে ফেলা বা এ জাতীয় কিছু করা ইত্যাদি। বাকি রইল সুরমা লাগানো, চিরুনী ব্যবহার করা। এগুলো তো সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এবং এগুলো কাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ নয়। এগুলো শরীয়তের উদ্দেশ্যের সাথে ও নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণে পুরুষদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার দিক থেকে কাঙ্ক্ষিত হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ নয়। মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিককে সুন্দর ও সুসজ্জিত করার উদ্দেশ্যে যখন আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য কোনো শরীয়ত নির্ধারিত করেন এবং ফিরিশতাদের মধ্যেও এরকম শরীয়তের দাবি উত্থাপিত ও কাম্য হয় তখন তা জমিনে ও জাতির জন্য কাঙ্ক্ষিত নিয়মে পরিণত হয়। এ কারণে মালায়ে আলা –উচ্চতর পরিষদ তথা আল্লাহর নিকট শরীয়তের এসব বিধানকে অকার্যকর করার প্রচেষ্টা চালানো অপছন্দনীয়, কঠোরভাবে নিন্দনীয়, আর তা আল্লাহর মর্জিরও বিপরীত এবং তার রোষানলে পতিত হওয়ার কারণ। এমনিভাবে আরব অনারব দূর ও নিকট নির্বিশেষে সকলের নিকট জীবন জীবিকার যেসব উচ্চতর উপকরণ ঐকমত্যভাবে গ্রহণীয় ও পছন্দনীয় এগুলোও প্রকৃতিগতভাবেই সবাইর নিকট গ্রহণীয়। এতে কোনো ধরনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সঠিক নয়।
যখন এ বিষয়টি সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হলো যে, বাদীকে আদালতে তথা বিচারালয়ে সাক্ষী দিতে হবে তখন তার দাবি হলো মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মিথ্যা শপথ করা কবিরা গুনাহ। এটা পরিহার করতে হবে। এটা আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাদের নিকট সম্পূর্ণভাবে নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয়।
ঐ মূলনীতিগুলোর মধ্যে ২নং মূলনীতি হলোঃ যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর নিকট শরীয়তের কোনো বিধান সম্পর্কে অহী প্রেরণ করেন এবং তার কারণ ও এর পেছনে অন্তর্নিহিত হিকমত তাকে অবহিত করেন তখন তাঁর জন্য এটি বৈধ যে, তিনি তার জন্য কারণ ও সীমা নির্ধারণ করবেন। এটা হলো নবীর কেয়াছের সীমা, আরতাঁর উম্মতের কেয়াছের সীমা হলো তারা তাঁর বর্ণিত সীমা অবগত হবেন এবং যেখানে যেখানেসে কারণ পাওয়া যাবে সেখানে তা প্রয়োগ করবেন। তার উপমা হলো যেসব জিকির-আজকারগুলো, দোয়াগুলো, যেগুলো হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল সন্ধ্যা ও শোয়ার সময় আমল করতে আদেশ করেছেন। তিনি যখন নামাযের সময় নির্ধারণের হেকমত জানতে পারলেন তখন তিনি সকাল সন্ধ্যা ও শোয়ার সময় জিকিরের বিষয়টি ইজতিহাদ করলেন ও তা করার বিধান দিলেন।
ঐ মূলনীতিগুরোর মধ্যে ৩নং মূলনীতি হলোঃ যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো আয়াতের (আরবী*************) তথা পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে পারেন। তা বুঝা নবী ব্যতীত অপর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তার বিষয় বুঝা ও বিভিন্ন দিক নির্ধারণ কঠিন হওয়ার কারণে। তখন নবীর অধিকার ও কর্তব্য হলো তার বুঝ অনুযায়ী সে আয়াতের হুকুম ও বিধান জারী করা। যেমন-
আল্লাহ তায়ালার বাণীঃ
(আরবী*********************************************************************)
“সাফা ও মারওয়া নামের পাহাড় দুটি আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত”।
এ আয়াত হতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝেছিলেন সাফা পাহাড়ের উল্লেখ প্রথমে শুধুমাত্র কথার ছলে বলা হয়নি। তাতে শরীয়তের বিধানের প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সায়ীর বিধান যেভাবে আরম্ভ করতে বলেছে সেভাবে করতে হবে। অর্থাৎ সাফা হতে সায়ী শুরু করতে হবে। এদিকে দৃষ্টি রেখে সাফাকে প্রথমে নেয়া হয়েছে। যেমন কখনো কখনো প্রশ্নের ধারণানুযায়ী আগ পিছ করা হয় অর্থাৎ প্রশ্নানুযায়ী উত্তর দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রশ্ন যে ধারাবাহিকতার হয়, উত্তরও সে ধারাবাহিকতায় দেয়া হয়। কোনো শব্দকে প্রথমে নেয়ার অন্যান্য কারণও থাকতে পারে। তিনি বলেছেন –(আরবী*************************) “আল্লাহ তায়ালা যেখান থেকে শুরু করেছেন তোমরাও সেখান থেকে শুরু কর”। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
(আরবী**********************************************************************************)
“তোমরা সূর্যকেও সিজদা করো না, চাঁদকেও সিজদা করো না, বরং তোমরা আল্লাহকে সিজদা কর, যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন”।
আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী***************************************************************************)
“যখন তারকারাশি ডুবে গেল তখন তিনি বললেন, আমি ডুবে যাওয়া সত্তাদের ভালোবাসি না”।
উপরোক্ত দুটি আয়াত হতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝেছেন যে, চন্দ্র গ্রহণ ও সূর্য গ্রহণের সময় লেকাদেরকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালার বাণীঃ
(আরবী**************************************************************************)
“পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকই আল্লাহর জন্য”।
এ আয়াত হতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝেছেন যে, নামাযের মধ্যে কেবলামুখী হওয়া এমন একটি ফরজ যা শুধুমাত্র ওজরের সময় বাদ দেয়া যেতে পারে। এ থেকে অন্ধকার রাত্রে কেউ ভুলে কেবলা বাদ দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে নামায আদায় করলে তা ঠিক হবে এ মাসয়ালা বের করা হয়েছে। আবার শহর হতে বেরিয়ে সফলে যাওয়ার সময় বাহন যেদিকেই চলুক না কেন সেদিকে মুখ করে নফল নামায আদায় করা জায়েয হওয়ার বিধান দেয়া হয়েছে।
চতুর্থ মূলনীতিঃ আল্লাহ তায়ালা যখন এমন হুকুম দেন যা সাধারণ লোকদের সাথে তথা সাধারণ জনগণের সাথে সম্পর্কিত হয়। তখন তাঁর এ হুকুমের দাবি হলো যাদেরকে তা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা যেন হুকুম দাতার আনুগত্য করে এ হুকুম পালন করা। যেমন-
(১) যখন কাজি-বিচারকদের হুকুম করা হলো, ইসলামী দণ্ডবিধি কার্যকর করার। তখন এ হুকুমের দাবি হলো, অন্যায়কারীদের উচিত হলো কাজি-বিচারকের আনুগত্য করা।
(২) যখন যাকাত আদায়কারীদের যাকাত আদায়ের হুকুম দেয়া হলো তখন এ হুকুমের দাবি হলো যাকাত দাতাগণ আনন্দচিত্তে ও খুশি মনে যাকাত দিয়ে দেবে।
(৩) যখন নারীদেরকে পর্দা করার বিধান দেয়া হলো তখন পুরুষদের বলা হলো তারা যেন নারীদের থেকে তাদের চোখকে নিচু করে নেয় অর্থাৎ তারাও যেন নারীদের প্রতি চোখ তুলে না তাকায়।
পঞ্চম মূলনীতি হলোঃ আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো কাজ করতে নিষেধ করেন তখন তার দাবি হলো তার বিপরীত কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে করা। অবস্থঅর প্রেক্ষিতানুযায়ী। আবার তিনি যখন কোনো কাজের হুকুম করেন তখন কর্তব্য হলো তার বিপরীত কাজটি না করা। সুতরাং আল্লা জুমার দিনে আযান হওয়ার পর ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করে নামাযে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন তখন এ হুকুমের দাবি হলো –আযান শোনার পর শ্রোতা ক্রয় বিক্রয় হতে তো বিরত থাকবেই বরং অন্যান্য কামাই রোজগার হতেও বিরত থাকবে।
৬ষ্ঠ মূলনীতিঃ আল্লাহ তায়ালা যখন পাকাপাকিভাবে কোনো বিষয়ের হুকুম প্রদান করেন তখন তার দাবি হয় সে জন্য উৎসাহিত করার ও সেজন্য সকল মাধ্যম সহজতর করার ও সে জন্য ভূমিকা পালন করা। আবার যখন তিনি পাকাপাকিভাবে কোনো বিষয় হতে বাধা প্রদান করেন তখন তার দাবি হয় তার সকল মাধ্যম বদ্ধ করা এবং তাকে এবং তার দিকে ধাবিতকারী সকল কিছুকি নিশ্চিহ্ন করা।
মূর্তি পূজা করা যখন পাপ ছিল, ছবি তৈরী করা ও মূর্তি বানানো সেদিকে উৎসাহিত করত, যেমনটি অতীতের উম্মতদের মাঝে ছিল –তখন প্রয়োজন দেখা দিল মূর্তি কারকদের এ কাজ করা হতে বিরত রাখা। আবার যখন মদপান করা পাপ ছিল তখন কর্তব্য ছিল মদ প্রস্তুতকারীদের তা করা হতে বিরত রাখা এবং যেসব অনুষ্ঠানে মদপান করা হয় সেসব অনুষ্ঠানে যাওয়া হতে বারণ রাখা। যখন গৃহযুদ্ধ, হত্যা, নিষিদ্ধ গুনাহ ছিল তখন উচিত চিল গণ্ডগোলের সময়, ফিতনার সময় অস্ত্র বন্ধ রাখা।
এরূপ করা রাষ্ট্র প্রশাসনের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ যখন রাষ্ট্র প্রধান জানতে পারলেন যে, খাদ্যদ্রব্য বিষ মিশানো হচ্ছে, পানীয়ের সাথে বিষ মিশানো হচ্ছে, তখন তারা ঔষধ বিক্রেতাদের নিকট হতে শপথ গ্রহণ করল যে, তারা সে পরিমাণ বিষই বিক্রয় করবে যে পরিমাণ কারো মৃত্যুর কারণ হবে না। আবার যখন রাষ্ট্র শাসকগণ জানতে পারল যে, কিছু লোকের পক্ষ হতে বিদ্রোহ হতে পারে, তখন তারা লোকদেরকে ঘোড়ায় আরোহণ করতে বারণ করল এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ চলতে নিষেধ করল এবং এ বিষয় জনগণ হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করল।
এমনিভাবে ইবাদতের বিষয়টিও, নামায যখন সর্বোত্তম ইবাদত তখন কর্তব্য হলো তা জামাতের সাথে আদায়ের জন উৎসাহ দেয়া। কারণ জামাতের সাথে নামায আদায় নামাযকে শক্তভাবে ধারণ করার বিষয়ে সহযোগিতাকারী, তখন আযান প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল যাতে সকলে একই সময়ে একই স্থানে একত্রিত হতে পারে। তখন প্রয়োজন দেখা দিল মসজিদ তৈরির এবং তাকে পরিচ্ছন্ন ও সুঘ্রাণ যুক্ত রাখার। আবার যখন মেঘলা দিনে রমজানের চাঁদ দেখে রোজা রাখা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল হলো তখন শাবান মাসের তারিখগুলোর হিসাব রাখা মোস্তাহাব হলো। এর প্রমাণ রাষ্ট্র প্রশাসনের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়, তখন রাষ্ট্র শাসকগণ দেখতে পায় যে, তীর নিক্ষেপ করার মধ্যে অনেক কল্যাণ নিহিত, তখন তারা হুকুম দিল কামান ও তীর অধিক পরিমাণে উৎপাদন করার এবং তার ব্যবসা করার।
সপ্তম মূলনীতি হলোঃ আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করেন এবং কোনো বিষয় হতে বাধা দেন তখন আল্লাহ চান যে, যারা তার আনুগত্য করে তাদের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন এবং যারা তার নাফরমানী করে তাদেরকে খাটো করে দেবেন।
(১) যখন পবিত্র কুরআনের প্রচার-প্রসার ও তার তেলাওয়াত করার ক্ষেত্রে নিয়মিত হওয়া কাঙ্ক্ষিত ছিল তখন প্রয়োজন দেখা দিল তার ব্যাপক প্রচারের। তখন বলা হলো সে ব্যক্তি ব্যতীত অপর কেউ ইমামতি করবে না যে অধিক পরিমাণে ভালোভাবে পবিত্র কুরআন পাঠ করতে পারে এবং মজলিসে, মাহফিলে, পবিত্র কুরআনের পাঠকদের, ক্বারীদের প্রশংসা করা হলো।
(২) পথভ্রষ্ট লোকদের এবং বদকারদের সাথে কথাবার্তা বলা, তাদের সাথে মেলামেশা করার বিষয়টি ও তাদেরকে প্রথমে সালাম দেয়ার ব্যাপারটিও এর উপর কেয়াস করা যায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে তীর নিক্ষেপকারীদের পুরস্কৃত করা এবং দেয়ালে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা এবং দানের ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রথমে দেয়ার বিষয়টি।
অষ্টম মূলনীতি হলোঃ যখন আল্লাহ তায়ালা কোনো শ্রেণীর লোকদের কোনো কাজ করার হুকুম প্রদান করেন বা কোনো কাজ করতে নিষেধ করেন তখন এর দাবি হলো সে কাজ উত্তমরূপে সমাধা করা ও আন্তরিকতার সাথে সে কাজে অগ্রগামী হওয়া। অন্তরে তার প্রতি জযবা ও প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করা, এ কারণে কেউ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার ইচ্ছা পোষন করা ও বিবাহে বিশাল ধরনের মোহর ধার্য করে তা আদায়ের নিয়ত না করার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ এতে শরীয়তের বিধানের সাথে মজাক-ঠাট্টা বিদ্রুপ করা হয়।
নবম মূলনীতি হলোঃ যখন কোনো কিছুর মধ্যে খারাপ তথা মন্দের সন্দেহ থাকে তখন তার দাবি হলো ঐ বস্তুকে অপছন্দ করা। যেমন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী-
(আরবী************************************************************************************)
“কোনা ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর যেন তার হাত পানির পাত্রে প্রবিষ্ট না করে কারণ সে জানেনা ঘুমের ঘোরে তার হাত কোথায় ছিল”।
মোদ্দা কথা হলো, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে ইবাদত ও জীবন জীবিকার উত্তম পন্থা ভালেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি বিভিন্নভাবে তা উম্মতের সামনে উপস্থাপন ও বর্ণনা করেছেন এবং শরীয়তের বিভিন্ন সেক্টরে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল হুকুম পরিস্কাররূপে বর্ণনা করেছেন।
এ অধ্যায় এবং এর পরবর্তী অধ্যায়গুলোর গুরুত্ব
এ অধ্যায়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীসমূহের যে স্ববিস্তারে বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে এবং এর পরবর্তী অধ্যায়ে যে বিষয়গুলো বর্ণিত হবে এগুলো উম্মতের ফিকাহ শাস্ত্র বিশারদদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলদায়ক। আশা করি উম্মতের ফকীহগণ তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করবেন। পূর্ববর্তী ফকীহগণও এ অধ্যায়গুলোকে এবং এর মূলনীতি সমূহকে ভালোভাবে গ্রহণ করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসগুলোকে গবেষণার দৃষ্টিতে গ্রহণ করে তাদের প্রণীত গ্রন্থাবলীতে তার স্বাক্ষর রেখেছেন। এবং এ মূলনীতিগুলোর আলোকে হাদীসসমূহকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। আল্লাহই ভালো জানেন।