অলংকারের যাকাত ফরয না হওয়ার পক্ষে মত
ইবনে হাজম তাঁর গ্রন্থ ‘আল-মুহাল্লা’য় লিখেছেন, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ও ইবনে উমর বলেছৈন, অলংকারের যাকাত দিতে হবে না। আসমা বিনতে আবূ বকরও এ মত দিয়েছেন। হযরত আয়েশা থেকেও এ মতই বর্ণিত হয়েছে এবং তা সহীহ্। শা’বী উমরাতা বিনতে আবদুর রহমান, আবূ জাফর মুহাম্মাদ ইবনে আলী, তায়ূস, হাসান ও সাঈদ ইবনুল মুসাইয্যিব থেকেও এ মত প্রকাশিত হয়েছে। সুফিয়ানা সওরী কখনও বলেছেন, তাতে যাকাত দিতে হবে, কখনও বলেছেন, দিতে হবে না।
কাসেম ইবনে মুহাম্মাদও এ মতে প্রকাশ করেছেন। মালিক ইবনে আনাস, আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াই এ মতই দিয়েছেন। আবূ উবাইদ এ মত সমর্থন করেছেন।
এই মতের দলীল
এই মতের সমর্থনে উদ্ধৃত দলীলসমূহের সারনির্যাস এই-
প্রথম, মূল ও আসল কথা হচ্ছে সমস্ত মানুষই সম্পূর্ণ দায়িত্বমুক্ত, যতক্ষণ না কোন বিসয়ে কোন স্পষ্ট দলীল উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু অলংকারের যাকাত পর্যায়ে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। না কোন অকাট্য দলীল, না কোন দলীল- ভিত্তিক কিয়াস।
দ্বিতীয, যাকাত তো ক্রমবৃদ্ধিশীল বা বর্ধন-উপযোগী সম্পদের উপর ফরয হয়ে থাকে। আর কোন অলংকারই এ পর্যায়ের নয়। কেননা তাকে অলংকাররূপে নির্মাণ ও ব্যবহার করা এবং এ হিসাবে তার দ্বারা ফায়দা লাভ করতে প্রবৃদ্ধির যোগ্যতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। অতএব তাতে যাকাত হবে না। উষ্ট্র ও গরুর যাকাত পর্যায়েও আমরা একথা বলে এসেছি।
তৃতীয়, কয়েকজন সাহাবী থেকে যে সব উক্তি সহীহ্ভাবে উদ্ধৃত হয়েছে তাও উপরিউক্তি মতের সমর্থন করে। আর তা হচ্ছে অলংকারে যাকাত ফরয হয় না।
ইমাম মালিক ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থে কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ (হযরত আয়েশার ভ্রাতষউত্র এবং মদীনার সাতহজন প্রখ্যাত ফিকাহ্বিদদের অন্যতম) থেকে বর্নিত হয়েছে, হযরত আয়েশা- নবী করীম (স)-এর বেগম- তাঁর ভাইয়ের কয়েকটি ইয়াতীম বালিকা লালন করতেন, তারা অলংকার ব্যবহার করত। তারা তাদের অলংকারের যাকাত দিত না।
নাফে থেকে বর্নিত, আবদুল্লাহ ইবনে উমর তাঁর কন্যাদের ও ক্রীতদাসের স্বর্ণালঙ্কার পরাতেন; কিন্তু তিনি সে সবের কোন যাকাত দিতেন না।
ইবনে আবূ শায়বা কাসেম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমাদের ধন-মাল হযরত আয়েশার কাছে গচ্ছিত ছিল। তিনি অলংকারাদি ছাড়া আর সব কিছুর যাকাত দিয়ে দিতেন।
উমরাতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমরা হযরত আয়েশার ক্রোড়ে পালিত ইয়াতীম ছিলাম। আমাদের অলংকার ছিল; কিন্তু তিনি (আয়েশা) তার যাকাত দিতেন না।
আবূ শায়বা ও আবূ উবাইদ হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ ও আসমা বিনতে আবূ বকর থেকে এরূপ কথাই বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশা ও ইবনে উমরের কথাও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।
হযরত জাবির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, অলংকারের যাকাত নেই। আমি বললাম, তা তো প্রায় হাজার দীনারের সম্পদ হবে, বললেন, নিজে ব্যবহার করবে, অন্যকে প্রয়োজন হলে ধার দেবে। তাতেই যাকাতের কাজ হয়ে যাবে। অপর একটি বর্ণনার অতিরিক্ত কথা- ‘এটা বেশী’।
হযরত আসমা যাকাত দিতেন না বলে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস ও আনাস ইবনে মালিক থেকেও বর্ণিত হয়েছে যে, অলংকারের যাকাত নেই।
কাযী আবদুল অলীদ আল-বাজী মুয়াত্তার শরাহ্ গ্রন্থে বলেছেন, ‘অলংকারে যাকাত না হওয়ার মতটি সাহাবীদের কাছেও সুপরিচিত। এঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা এ বিষয়ে অধিক জানাশোনা লোক। তিনি স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর বেগম ছিলেন। তাঁর কাছে এ বিষয়ে কোন কিছুই অজানা থাকতে পারে না।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর এ পর্যায়ের লোক। তাঁর বোন হযরত হাফ্সা(রা) রাসূলে করীশ (স)-এর বেগম ছিলেন। তাঁর অলংকারের ব্যাপারটি নবী করীম(স)-এর কাছে গোপন থাকতে পারে না, তিনি নিজেও অজ্ঞাত থাকতে পারেন না এ সংক্রান্ত শরীয়াতী হুকুম সম্পর্কে।
ইয়াহ্ইয়া ইবনে সাঈদ বলেছেন, এ ব্যাপারটি সাহাবী ও তাবেয়ীনের কাছে খুবই পরিচিত ও সর্বজনজ্ঞাত ছিল। তা এ কথা থেকে প্রমাণিত যে, আমি উমরাতাকে অলংকারের যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন: ‘আমি কাউকেই তার যাকাত দিতে দেখিনি।’
হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, অলংকারের যাকাত দিতে কোন সাহাবী বলেন বলে আমার জানা নেই।
চতুর্থ, ইবনে জাওযী নবী করীম (স) থেকে হযরত জাবির সূত্রে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, রাসূলে করীম (স) বলেছেন, অলংকারের যাকাত নেই।’
বায়হাকী বলেছেন, উক্ত বর্ণনার একজন বর্ণনাকারী ‘আফিয়া’। সে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। কিন্তু ইবনুল জাওযী বলেছেন, তার কোন দোষ আছে বলে আমার জানা নেই। শায়খ তকীউদ্দীন ইবনে দকীক বলেছেন, শায়খ মুনয়েরী এক চিঠিতে লিখেছেন, আফিয়া ইবনে আইউব যয়ীফ বর্ণনাকারী বলে কোন কথাই আমা পর্যন্ত পৌঁছেনি।
পঞ্চম, নবী করীম(স)-এর একটি ভাষণ ছিল এই:
‘হে নারী সমাজ। তোমরা যাকাত দাও- তোমাদের অলংকারের হলেও।’ বুখারী ও তিরমিযী প্রমুখ লিখেছেন, ইবনুল আরাবী বলেছেন, এ হাদীস বাহ্যত এই প্রমাণ করে যে, অলংকারের কোন যাকাত নেই। রাসূলে করীম (স) যে নারী সমাজকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘তোমাদের অলংকারের হলেও যাকাত দাও’ বস্তুত অলংকারের যাকাত ফরয হলে এ ধরনের কথা বলতেন না, যেমন বলা হয় সাধারণ রফল কাজ সম্পর্কে।
পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান
এই ফিক্হী বিতর্কমূলক আলোচনার পর আমার বক্তব্য হল, যাঁরা অলংকারের যাকাত দিতে হয় না বলে মত দিয়েছেন, তাঁদের কথাই অধিকতর শক্তিশালী ও উত্তম। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে পেশ করা যাচ্ছে:
অলংকারের যাকাত ফরয না হওয়ার কথাটি যাকাতের ক্ষেত্র সংক্রান্ত প্রাথমিক সাধারণ নীতির সাথে সংগতিপূর্ণ। তার একটা প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রতিহত মতাদর্শ গড়ে উঠেছে। তার তা হল, যে ধন-মাল কার্যত বর্ধনশীল অথবা বর্ধনশীল হতে পারে- হওয়ার যোগ্যতা আছে, তাতেই যাকাত হয়। বরং ক্রমবর্ধনশীল কাজে লাগানো কর্তব্য, পুঁজি করে রাখা অনুচিত- পুঁজি করে রাখলে মালিক সে জন্যে আযাব ভোগ করতে বাধ্য হবে, তাতেই যাকাত ফরয হয়। কিন্তু মেয়েরদ জন্যে স্বভাবতই যে অলংকার বৈধ, যা ব্যক্তিগত সামগ্রী ও সৌন্দর্য বর্ধক, যা নারীর স্বভাবে নিহিত ও সংরক্ষিত প্রয়োজন পূরণে বিনিয়োজিত, তার অবস্থা ভিন্নতর। ইসলাম এই প্রয়োজনীয় পূরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ কারণে পুরুষদের জন্যে স্বর্ণ ও রেশম হারাম করা হয়েছে এবং নারীদর জন্যে তা মুবাহ্ করা হয়েছে।
এক্ষণে অলংকারাদি মেয়েদের ক্ষেত্রে পোশাক-পরিচ্ছদ তুল্য। ঘরের গৌরব প্রকাশ সরঞ্জামাদি, সৌন্দর্য ও চাকচিক্যের বর্ণালী ও জাঁকজমকপূর্ণ সামগ্রীর মধ্যে এই অলংকারাদিও পণ্য। তাই স্ত্রীলোকদের জন্যে তা হারাম নয়।
বরং তাদের ক্ষেত্রে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকারাদি মণি-মুক্তা-হীরা প্রভৃতি মূল্যবান পাথরের পর্যায়ে গণ্য হবে। যা তারা ব্যবহার করে থাকে এবং আল্লাহ্ কুরআনী দলীল দ্বারা তাদের জন্যে তা হালাল ও মুবাহ্ করে দিয়েছেন।
আর এসব মহামূল্য পাথর, কাপড় ও দ্রব্য-সামগ্রীর উপর যাকাত ফরয না হওয়া সম্পর্কে ইমামগণের ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও তা মহামূল্য ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যসামগ্রী।
কিন্তু নবী করীম (স) উপস্থাপিত হিদায়েত থেকে আমরা জানতে পেরেছি, সর্বপ্রকারের ধন-মালেই যাকাত ফরয হয় না। হয় শুধু ক্রমবৃদ্ধিশীল বা ক্রমবর্ধনযোগ্য ধন-মালে। তাও এ জন্যে যে, আসল ও মূল যেন অক্ষত থাকে। বৃদ্ধি ও বাড়তি থেকেই যাকাত গ্রহণ করা হবে। সেজন্যে গবাদিপশুর ক্ষেত্রে তাতে যাকতা ফরয হওয়ার জন্যে মুক্ত হয়ে ঘাস খাওয়ার শর্ত আরোপিত হয়েছে। মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও বর্ধণশীলতার শর্তও রয়েছে। ঘর-বাড়ি, যানবাহনরূপে ব্যবহৃত ও সাধারণ ব্যবহার্য দ্রব্যাদির যাকাত মাফ করে দেয়া হয়েছে।
হানাফী ফিকাহ্বিদগণ অলংকারের যাকাত দেয়া কর্তব্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে যাকাত ফরয হওয়ার কারণ হচ্ছে, তা এমন মালিকানা, যা ক্রমবর্ধনশীলতার জন্যে প্রস্তুত, তা মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং বাড়তি সম্পদও বটে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ কথাটি স্ত্রীলোকদের অলংকারের উপর কি খাটে? অথচ প্রকৃতপক্ষে তা বর্ধনশীলতার ক্ষেত্রে নয়, বাড়তি বা প্রয়োজনাতিরিক্তও নয়- যতক্ষণ তা স্বাভাবিক পরিমাণের মধ্য থেকে ব্যবহৃত হতে থাকবে।
হানাফী মতে কৃষি, পানি টানা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত গবাদিপশুর যাকাত দিতে হয় না। কেননা তা প্রবৃদ্ধির কাজের পরিবর্তে অন্য কাজে নিয়োজিত গবাদিপশুর যাকাত দিতে হয় না। কেননা তা প্রবৃদ্ধির কাজের পরিবর্তে অন্য কাজে নিয়োজিত। অথচ তারই মত সেসব গবাদিপশু বংশ বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত তাতে যাকাত ফরয হবে। তাহলে তাঁরা কাজে নিয়োজিত গবাদিপশুর যাকাত হয় না বলে মত দিলেন কেন? অথচ অনুরূপ অবস্থায় পড়া ব্যবহার্য অলংকারাদির যাকাত ফরয বলে রায় দিচ্ছেন? এ দুটির মধ্য মৌলিক পার্থক্য তো কিছুই নেই?
প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শরীয়াত দুটি সমান অবস্থার জিনিসের মধ্যে যাকাত ফরয হওয়া-না-হওয়ার পার্থক্য করতে প্রস্তুত নয়। তবু এ পার্থক্য দেখানো হচ্ছে বলে আমাদের মনে করতে হবে যে, এ ভুলটি আসলে আমাদের ধারণা ও সিদত্ধান্ত গ্রহণে রয়েছে। এ কারণে আবূ উবাইদ অভিযোগ তুলেছেন, যাঁরা অলংকারের যাকাত দিতে বলেন ও কর্মে নিয়োজিত গবাদিপশুর যাকাত না দিতে বলেন, তাঁরা দুটি সমান অবস্থার জিনিসের মধ্যে পারথক্য সৃষ্টি করেন।
সর্বোপরি মণি, মুক্তা ও মহামূল্য পাথর (Stone)-যার একটির মূল্যই হয় কয়েক হাজার দীনার এবং কেবল বিরাট সম্পদ-সম্পত্তির মালিক মহিলারাই যা অলংকার হিসেবে ব্যবহার করে- তার যাকাত মাফ কর দেয়া হবে, আর স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকার- যা বেশীর ভাগ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র স্ত্রীলোকেরাই ব্যবহার করে থাকে- তার উপর যাকাত ফরয হবে, সুবিচারকারী ইসলামী শরীয়াতের প্রতি এমন ধারণা করা যায় না।
এই শ্রেণীর মেয়েলোকেরা শরীয়াতের অণুমতিক্রমে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকার ব্যবহারের সুখ ভোগ করবে, আর তারপর তাকে প্রতি বছর তার এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ দিয়ে দিতে বাধ্য করা হবে, মহান ইসলামী শরীয়াত সম্পর্কে এ কথা কল্পনাও করা যায় না- বিশেষ করে এমতাবস্থায় যখন মনি, মুক্তা, হীরা ইত্যাদি মহামূল্য পাথরের অলংকারে যাকাত হবে না।
আমরা মনেকরি, এ সব অলংকারে যাকাত মাফ হয়ে গেছে। কেননা এসব অলংকারই ব্যক্তিগত সামগ্রী। তা ক্রমবর্ধন-উপযোগীও নয়।
যায়দীয়া মতের ফিকাহ্বিদ ইমামুল হাদী বলেছেন, স্বর্ণ-রৌপ্য ও মণি-মুক্তা, হীরা প্রভৃতি সর্বপ্রকারের অলংকারেই যাকাত দিতে হবে। নেনা এ দুইয়ের মাঝে গণনার যোগ্র কোন পারথক্য পরিলক্ষিত নয়। কেননা এ দুইয়ের এক প্রকারের যাকাত মাফ করা হলে সর্বপ্রকারের অলংকারের যাকাতই মাফ করা উচিত। তা না করে এক প্রকারের উপর যাকাত ফরয ধরা ও অন্যান্য প্রকারকে তা থেকে অব্যাহিত দেয়া ইসলামী শরীয়াতের কারণভিত্তিক বিধান সম্পর্কে অকল্পনীয়।
কেননা মূলত দুই প্রকারের মধ্যে কোন পার্থক্য কল্পনা করা যায় না। এ মতের লোকেরাই উম্মতের মধ্যে অধিক।
এই কথা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে এ বিচারে যে, সর্বপ্রকারের মালের যাকতা সেই আসলের অংশ থেকেই গ্রহণের নিয়ম। আসল থেকে এবং বাড়তি প্রবৃদ্ধি থেকেই একই সঙ্গে। নিতান্ত প্রয়োজন চাড়া ও নিয়ম লংঘন করা উচিত নয়। যেমন উষ্ট্রের যাকাত বাবদ ছাগী গ্রহণ করা হয়- যদি উষ্ট্রের সংখ্যা পঁচিশটির কম হয়। উষ্ট্রের যাকাত সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা তার ব্যাখ্যা দিয়েছি।
কোন নারীর যদি অলংকার ছাড়া আর কোন সম্পদ না থাকে, তাহলে সে তার যাকাত কিভাবে আয় করবে? অধিকাংশ মেয়েলোকেরই এ অবস্থা। তখন তার অলংকার বা অন্য কোন জরুরী জিনিস বিক্রয় করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, যাকাত পর্যায়ে ইসলামী শরীয়াত কি এমন কোন বিধান উপস্থাপিত করেছে- উষ্ট্র ও ছাগীর উপরিউক্তি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া? যাকাতদাতাকে তার যাকাতের মাল ছাড়া অন্য মাল থেকে যাকাত আদায় করার কোন বিধান শরীয়াতে দেয়া হয়েছে কি? অন্য মাল বিক্রয় করে অপর কোন মালের যাকাত আদায় করার বিধানও কি ইসলামী শরীয়াতে আছে?
না, আমাদের জানামতে শরীযাত তেমন কোন বিধান আসেনি। তা হলে অলংকারের ক্ষেত্রেই বা তা করা হবে কেন?
এসব কথা ও মতামতই প্রমাণ করে যে, ক্রমবৃদ্ধিশীল মাল থেকেই যাকাত গ্রহণ করতে হবে তার বাড়তি অংশ থেকে। যেন আসলটা সুরক্ষিত থাকে এবং নিত্য নতুন অর্জিত সম্পদ থেকে যাকাত বের হয়ে যায়।
অবর্ধনশীল অলংকারের যাকাত ফরয হলে যাকাত দেয়ার বছরগুলোতে তার গোটা মূল্যটাই খেয়ে ফেলা হবে। মায়মুন ইবনে মাহ্রান বলেছেন, আমার একটা ‘হার’ ছিল, আমি তার যাকাত দিতাম। শেষ পর্যন্ত তার গোটা মূল্যই যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া হল। তাই আমি মনে করি, যাকাতের মৌল ভাবধারা এটাকে অস্বীকার করে।
যাকাত যখন সর্বসম্মতভাবে কেবল প্রবৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশ থেকেই গ্রহণ করতে হবে, তখন ইবনুল আরাবীর কথাটাই আমাদের কাছে অত্যন্ত সত্য বলে প্রতীতি জন্মে। তিনি ‘আহ্কামুল কুরআন’ গ্রন্থে লিখেছেন, জিনিসপত্র যাকাত ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে নয়, তার শুধু-বাড়তি ও প্রবৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশথেকেই যাকাত নেয়া বিধেয়। ঠিক অনুরূপভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য অলংকার হিসেবে ব্যবহৃতহতে থাকলে তার যাকাত ফরয হওয়ার ব্যপারটি নাকচ হয়ে যাবে। এটা হল ফরয হওয়া জিনিসকে ফরয না হওয়ার কাণ দেখা দেয়ার প্রত্যাহার করার ব্যাপার। যা সাধারণভাবে প্রযোজ্য তা থেকে বিশেষ করে একটাকে গ্রহণ।
তবে যে সব দলীলে স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপর যাকাত ফরয হয়েছে, তাতে সে দুটির মূল্যত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এ কারণে রৌপ্যকে নগদ সম্পদ রৌপ্য নগদ এবং স্বর্ণকে স্বরণমুদ্রা দীনার বা স্বর্ণ নগদ বলে তার ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এমনকি কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতকে- যারা স্বর্ণ ও রৌপ্যকে পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে না- এতে পুঁজি ও ‘ব্যয়’ করার কথা বলা হয়েছে, তাতেও স্বর্ণ ও রৌপ্যকে নগদ সম্পদ ধরা হয়েছে। কেননা নগদ সম্পদ হলেই তার পুঁজি করার ও ব্যয় করর কথা উঠে। কিন্তু অভ্যাস-বশত যে অলংকার ব্যবহার করা হয় তাকে পুঁজি গণ্য করা যায় না, আর তা স্বভাবতই ব্যয় হওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকে না।
এখানে আমরা যা বললাম, ফিকাহ্বিদ আবূ উবাইদও তাঁর ‘কিতাবুল আমওয়াল’ গ্রন্থে সে কথাই সমর্থন দিয়েছেন। তাঁর কথাই এখানে উদ্ধৃত করা যাচ্ছে:
নবী করীম(স) বলেছেন: নগদ সম্পদ পাঁচ আউকিয়া হলে তাতে এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ দিতে হবে অর্থাৎ নবী করীম(স) রৌপ্যের নগদকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আর তা ছাড়া যা আছে তার উল্লেখ করেন নি। একথা বলেন নি যে, রৌপ্য এ পরিমাণ হলে এই করতে হবে। তার ‘নগদ’ হওয়ার শর্ত করেছন। আর আরবদের কাছে এ কথাটি লোকদের মধ্যে প্রচলিত মুদ্রিত রৌপ্য মুদ্রা ছাড়া আর কিছু বুঝায় বলে আমরা জানি না।
অনুরূপভাবে ‘আউকিয়া’র অর্থ দিরহাম ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিটি আউকিয়ায় চল্লিশ দিরহাম হয়। পরে মুসলমানগণ একমত হয়ে বলেছেন যে, মুদ্রা হিসেবে গ্রহীত দীনারে দিরহামের মতই যাকাত দিতে হবে। কোন কোন মরফু’[***] হাদীসের দীনারের কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
তাহলে এ ব্যাপারে মুসলিম জনগণেল মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই মনে করতে হবে। কিন্তু অলংকারের ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেননা তা সৌন্দর্য বৃদ্ধির সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত। আ নগদ স্বর্ণ ও নগদ রৌপ্য জিনিসের মূল্য ছাড়া আর কিছু হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তা ব্যয় করা হলেই তাতে অধিকতর ফায়দা লাভ সম্ভব। এ কারণে সৌন্দর্য সামগ্রীরূপে ব্যবহৃত অলংকার থেকে তার ভিন্তর মূল্য হওয়াই স্বাভাবিক। অলংকারগুলো ঘরের অন্যান্য দ্রব্য-সরঞ্জামের মত হয়ে গেল। আর এ কারণে তার উপর থেকে যাকাত বাতিল ও প্রত্যাহার হয়ে গেল।
এ কারণে ইরাকবাসীরা বলেছেন, কার্যরত উষ্ট্র ও গরুর যাকাত হয় না। কেননা তা ক্রীতদাস ও দ্রব্য-সামগ্রীর মত হয়ে গেছে। অথচ তাঁরাই অলংকারের উপর যাকাত ধার্য করে বসেছেন।
আর হিজাজবাসীরা কার্যরত উষ্ট্র ও গরুর উপর যাকাত ধার্য করেছেন, কিন্তু অলংকার থেকে তা প্রত্যাহার করেচেন অথচ এ উভয় মতের লোকদের এ দুটিকে একই রকম গণ্য করা উচিত ছিল। হয় উভয় থেকেই যাকাত প্রত্যাহার করা হত, না হয় উভয়ের উপর যাকাত ধার্য করা আবশ্যক ছিল।
তাই আমাদের মতে এ দুটি একই, উভয় সম্পর্কে একই মত ও সিদ্ধান্ত। উভয়ের উপর যাকাত ফরয হবে না। কারণ আমরা পূর্বেই বিবৃত করেছি। তবে এ আলোচনার শুরুতে আমরা যে মরফূ হাদীস উদ্ধৃতকরেছি, যাতে স্বর্ণের অলংকার প্ররিহিতা একজন ইয়েমনী মহিলাকে রাসূলে করীম (স) বলেছেন: ‘তুমি কি এর যাকাত দাও?, -তা একমাত্র একটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে বলে আমর জানি এবং সে সূত্রটি সম্পর্কে পূর্বে ও পরবর্তীকালের হাদীসবিদ্দের আপত্তি উঠেছে। যেভাবে বর্ণিত হয়েছে- ব্যাপার যদি তাই হয় এবং তা ঠিক রাসূলের বাণী হিসেবেই সুরক্ষিত হয় থাকে, তাহলে তার ব্যাখ্যা আমরা এইা করতে পারি যে, রাসূলে করীম (স) প্রয়োজনশীল লোকদের অলংকার ধার দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। কেননা সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, শা’বী, হাসান ও কাতাদাহ প্রমুখ মনীষী তাই বলেছেন: ‘অলংকারের যাকাত হচ্ছে তা অন্যকে ব্যবহারের জন্যে ধার দেয়া।
‘আর অলংকারে যদি বাস্তবিকই যাকাত ফরয হত, যেমন নগদ মুদ্রার ফরয, তাহলে নবীকরীম (স) একজন মাত্র মহিলার হাতে অলংকার দেখেই এ কথাটি বলে ক্ষান্ত থাকতে পারতেন না, তিনি তা সাধারণভাবেই লোকদের মধ্যে প্রচার করে দিতেন। তাহলে এ কথাটি সর্বত্র প্রচারিতও হত এবং তাঁর সুন্নাতরূপে গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধও হত। তাঁর পরবর্তীমুসলিম নেতৃবৃন্দ অদ্যাবধি তদনুযায়ী আমলও করতেন।অথচ এ দীর্ঘ কাল ধরে অলংকার সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু তার যাকাত দেয়া সম্পর্কে আমরা কোথাও কিছু শুনিনি।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীস- অলংকার ব্যবহারে দোষ নেই যদি তার যাকাত দেয়া হয়- এর অর্থও ধার বাবদ অন্যকে ব্যবহার করতে দেয়া ছাড়া আমরা আর কিছু বুঝি না। কেননা কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ- যিনি হযরত আয়েশার ভ্রাতুষ্টুত্র- হযরত আয়েশা তাঁর ভাইয়ের কন্যাদের বা অন্য কোন মেয়েলোককে অলংকারের যাকাত দিতে আদেশ করেছেন- এমন কথাকে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করেছেন। আর আমাদের জানামতে কেবল মাত্র হযরত মাসউদ ভিন্ন অন্য কোন সাহাবীই অলংকারের যাকাত দিতেন বলে সে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, এর সম্বন্ধেও তেমনি আপত্তি উঠেছে যেমন আপত্তি উঠেছে উপরিউক্ত মরফু হাদীসে। [কোন সাহাবী কর্তৃক রাসূলের কথা বর্ণিত হলে সেটি মরফূ হাদীস।]
দ্বিতীয় মতটি হযরত আয়েশা, ইবনে উমর, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ও আনাসইবনে মালিক এবং যেসব তাবেয়ী তাঁদের সমর্থন করেছেন তাঁদের। তা সত্ত্বেওনবীর সুন্নাতের যে ব্যাখ্যা আমরা দিয়েছি তা চিন্তাবিবেচনায় তাঁদের মতই সমর্থন করে।
আবূ উবাইদের এ দীর্ঘ উদ্ধৃতির পর অলংকারের যাকাত দেওয়ার পক্ষের যে সব দলীল উল্লেখ করা হয়েছে সেই বিষয়ে আমার কতিপয় বিবেচনাযোগ্য কথা এখানে বলতে ইচ্ছা করি।
অলংকারের যাকাত ফরয দলীল ভুল
১. অলংকারের যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষে প্রথম দলীলরূপেপেশকরা হয়েছে কুরআনের আয়অত- যাতে বলা হয়েছে; যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঁজি করে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না- এর ভিত্তিতে বলতে চেষ্টা করা হয়েছে যে, অলংকার তো পুঁজির শামিল।
আমি বলব সাধারণত ব্যবহারের জন্যে যে অলংকার বানানো হয় তাকে এ আয়াত অনুযায়ী পুঁজি গণ্য করা অযৌক্তিক। কেননা আয়াতে সেই স্বর্ণ ও রৌপ্যের কথা বলা হয়েছে যা ব্যয়যোগ্য। কারণ এর পরই বলা হয়েছে, ‘তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে না….’ এ ব্যয় করার কাজটা নগদ মুদ্রা দ্বারাই তো সম্ভব। সৌন্দর্য সামগ্রীরূপে গ্রহীত অলংকার তো ব্যয় করা যায় না। কেননা নিতান্ত প্রয়োজন ভিন্ন মুবাহ অলংকার গরীবকেদিয়েদিতে হবে এমন কথা কেউ বলেনি।
২. অলংকারের যাকাত ফরয হওয়ার সমর্থনে যে সব হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে এ যাকাতের অমান্যকারীদের দুই ধরনের বক্তব্য রয়েছে; হাদীসসমূহের সপ্রমাণিত হওয়ার দিক দিয়ে আপত্তি, আর হাদীসমসূহ থেকে যা বোঝানো হচ্ছে, সে সম্পর্কে আপত্তি।
(ক) এই পর্যায়ে প্রথম হাদীসটি যথার্থতা ও শুদ্ধতা সর্ববাদী সমর্থিত। তা হল নগদ সম্পদে এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ- এ নগদ সম্পদ বলতে তোদিরহাম বোঝায়, যা মুদ্রারূপে প্রচলিত। নির্মিত অলংকার বোঝায় না।
(খ) অন্যান্য হাদীসের কয়েকটি সনদের দিক দিয়ে অগ্রহণযোগ্য। যেমন ইমাম তিরমিযী মন্তব্য করেছন; এ বিষয়ে কোন কিছুই সহীহ্রূপে পাওয়া যায়নি।
এমনি ইবনে হাজমও।তিনি অলংকারে যাকাত ফরয-এ মত দেয়া সত্ত্বেও এসব হাদীসের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। বরং যে কেউ তাকে দলীল হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন, তাকে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁর মন্তব্য হল, অলংকারে যাকাত ফরয প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব সাহাবীর উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে, নেহায়েত বাজে। তা গ্রহণ করার ও মেনে নেয়ার কোন যুক্তি নেই। তবে ইবনে হাজমতাঁর মতের জন্যে স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাত সংক্রান্ত সাধারণ দলীলাদির উপর নির্ভর করেছেন।
এখানে এসব হাদীসের সনদ সম্পর্কে খনিকটা দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে।
আমর ইবনে শুয়াইব বর্ণিত হাদীসটি ইমাম নাসায়ী মুরসালরূপে উদ্ধৃত করেছন। তিনি তাকে অগ্রাধিকারও দিয়েছেন। ইমাম মুনযেরী বলেছৈন, ‘তার মধ্যে দুরবলতার লক্ষণ রয়েছে।’ ইমাম আবূ উবাইদ এই হাদীস সম্পর্কে যা বলেছেন, তা পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটি সনদে ইয়াহিয়া ‘ইবনে আইউয়ুব আল-গাফেকী রয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম প্রমুখ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেছন, তিনি সত্য বর্ণনাকারী। আর ইমাম সাহবী বলেছেন, ‘ইবনে মুয়ীন তাঁকেসঠিক বর্ণনাকারী বলে সমর্থন করেছেন।’ ইমাম আহমদ বলেছৈন, ‘তাঁর স্মরণশক্তি খারাপ।’ ইবনুল কাতান ও আবূ হাতিম বলেন, ‘তাঁর বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য। নাসায়ী বলেছেন, ‘শক্তিশালী নয়।’ দারে কুতনী বলেছে, তাঁর কোন কোন বর্ণনায় ‘আউল-ঝউলৎ (****) রয়েছে; তাঁর আরো কয়েকটি গ্রহণঅযোগ্য হাদীসও এমনিই।
হাদীস সমালোচক ইমামগণের দৃষ্টিতে যে বর্ণনাকারীর অবস্থা এই, তাঁর বর্ণনা কোন বিতর্কিত বিষয়ে দলীলরূপে উপস্থাপিত করা যায় না। বিশেষ করে হযরত আয়েশার আমলে তাঁর সম্পর্কিত বর্ণনার বিপরীত।
হযরত উম্মে সালমার বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে ইমাম মুনযেরীর উক্তি আমরা ইতিপূর্বে শুনেছি। এর সনদে রয়েছেন ইজাব ইবনে বশীর। বুখারী তাঁর বর্নিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তবে তাঁর সনদের উপর যথেষ্ট আপত্তি উঠেছ।
ইমাম যাহবী ‘আল-মিযান’ গ্রন্থে তাঁর জীবন কাহিনীতে লিখেছেন: ইমাম আহমদ বলেছেন, ‘আশা করি তার কোন দোষ হবে না। যদিও খচীফ থেকে অনেক গ্রহণ-অযোগ্য বর্ণনা পেশকরেছেন। মনে করি সেগুলো খচীফের থেকে এসেছে।’ নাসায়ী বলেছেন, ‘হাদীসে এমন কথা নেই।’ ইবনুল মাদীনী বলেছেন, ‘আমার সঙ্গীরা তাঁকে যয়ীফ-ই মনে করেন।’ ইবনে মুয়ীন বলেছেন, ‘তিনি সিকাহ্-বিশ্বাস্য।’ মুর্রা বলেছেন, ‘যয়ীফ।’ আলী বলেছেন, ‘তাঁর বর্ণিত হাদীসের উপর আমরা আঘাত দিয়েছি (দোষবের করেছি)।’ ইবনে আদী বলেছেন, ‘আমি আশা করি তার দোষ নেই’ তার অর্থ উপরিউক্তি ইমামগণের এজকনও তাঁর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়শীল নন। বরং কেউ কেউ দৃঢ়তার সাথেই তাঁকে যয়ীফ বলেছেন।
ইমাম বুখারী তাঁর বর্নিত হাদীস গ্রহণ করেছেন দেখে কারোরই ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। হাফেয় ইবনে হাজার বলেছেন, ‘বুখারীতে তাঁর বর্ণিত মাত্র দুটো হাদীস রয়েছে। একটির পর তার সমর্থনে আর একটি হাদীস আনা হয়েছে এবং অপর একটি অন্য একটি হাদীসের সঙ্গে মিলিয়ে উদ্ধৃত করেছেন।’
হাফেয জায়লায়ী বলেছেন: ‘বুখারী-মুসলিমের গ্রন্থকারদ্বয় যদি আপত্তিকর কোন ব্যক্তির হাদীস উদ্ধৃত করেনও, তবুও তার পরে উদ্ধৃত হাদীস দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেন। তার সাক্ষ্য-সাবুদও তাঁরা পেশ করেন। তাতে জানা যায় যে, তার একটা ভিত্তি আছে। তিনি এককভাবে কিছু বর্ণনা করে থাকলে তা তাঁরা গ্রহণ করেন না। বিশেষ করে যদি তা সিকাহ্ বর্ণিত হাদীসের বিপরীত হয়।
বায়হাকী যেমন বলেছেন, ইজাব ইবনে বশীর সাবিত ইবনে আজলান থেকে এ হাদীসটি এককভাবে বর্ণিত হয়েছে।
সাবিত থেকে বর্ণিত হাদীসটি বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হলেও তার বিষয়ে আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। অবশ্য ইবনে মুয়ীন তাকেসিকাহ্ বলেছেন। আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, ‘আমি তার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করছি।’ আবূ হাতিম বলেছেন, ‘লোক ভাল’ ইবনে আদীও একথা বলেছেন। তিনি তাঁর থেকে বর্ণিত তিনটি অপরিচিত হাদীস নিয়েছেন। হাফেয আবদুল হক বলেছেন, সাবিত বর্নিত হাদীস দলীলরূপে গ্রহণযোগ্য নয়। আবুল হাসান ইবনে কাতান তাঁর এ কথার বিরোধিতা করেছেন। বলেছেন, উকাইলীল কথায়ও তাঁর প্রতি সহনশীলতা রয়েছে। বলেছেন, যে লোক ‘সিকাহ্’ কি আদৌ জানে না, সে-ই এ কথা নিয়ে চলতে পারে। যে তা জানে তার কাছে তার এককত্ব ক্ষতিকর নয়। তবে তার বেশী হলে স্বতন্ত্র কথা। যাহাবী ইবনে কাতানের কথার প্রতিবাদ করে বলেছেন, যে সিকাহ্ কি তা জানে তার কথা বুঝলাম। কিন্তু যার সম্পর্কে ইমাম আহমদের ন্যায় লোকও নীরবতা পোষণ করেন, আর আবূ হাতিমের মত লোক বলেন; ‘সালিহুল হাদীস’ তাকে যে ‘সিকাহ’ গণ্য করে তখন আমরা সিকাহ্র তেমন মর্যাদা মেনে নিতে পারি না। এরূপ অবস্থায় এককত্ব অগ্রাহ্য হওয়ার শামিল। তাই উকাইলী ও আবদুল হকের কথা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
ইমাম বুখারী সাবিত বর্ণিত িএকটি মাত্র হাদীস কিতাবুযযাবায়েহ-তে উদ্ধৃত করেছেন। ‘তাহারাত’ অধ্যায়ে তার আসল হাদীসরয়েছে। যেমন ইবনে হাজার বলেছেন, আমরা যেমন জানি, এটা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের নিয়মবটে; কিন্তু তার দ্বারা কাউকে নিরংকশভাবে সিকাহ্ বানানো হয় না।কাজেই বলা যায়, উক্ত ইমামদ্বয়ের কেউই এ হাদীসটি বা কোন হাদীসই অলংকারে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে নিয়ে আসেননি।
হযরত উম্মে সালমা’র হাদীসযেহেতু সাবিত ইবনে আজুলান ও ইজাব ইবনে বশীরের উপর আবর্তিত- সমালোচকদের দৃষ্টিতে এ দুজনে অবস্থা কি, তা দেখিয়েছি, – তাই এ ধরনের হাদীস বিতর্কিত বিষয়ে দলীল হিসেবে পেশ করা যায় না। কেননা এতে দলীলসমূহ পরস্পর বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে অলংকারের যাকাত ফরয হওয়া পর্যায়ে এ অবস্থা, তখন তাতে তো এ হাদীস দলীলরূপে গৃহীতই হতে পারে না।
আমার মতে এসব হাদীসের সহীহ্ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার বড় কারণ হল, এগুলো সাহাবীদের মধ্যে পরিচিত হয়নি। বরং তার বিপরীত। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে এত মতবৈষম্য হয়েছে, যা প্রায় সব কয়টি পরিবারকেই প্রভাবিত করেছে এবং এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের প্রয়েঅজন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। এ সব হাদীস যদি সাহাবীদের মধ্যে ব্যাপক পরিচিত লাভ করত, তাহলে বিরোধ দূর হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি।
এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব হাদীসকি মন্সুখ হয়ে গেছে? কিংবা তা সবই গায়রে সহীহ্ বলাহবে? অন্যথায় সাহাবীদের মধ্যেএ নিয়ে মতবৈষম্য ঘটবে, আর তাঁরা রাসূলের কাছ থেকে শোনা কথা পরস্পরের কাছে পেশকরবেন না, তা কল্পনা করা যায় না। কেননা অন্যান্য যেসব ব্যাপারে এ ধরনের মতবৈষম্য ঘটেছে, সর্বত্র তাঁরা এ নীতিতেই কাজ করেছেন।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে অতীব সহীহ্ সূত্রে হাদীসটিবর্ণিত হয়েছে বটে; কিন্তু তিনি নিজেতাঁর থেকে বর্ণিত হাদীসেরই বিপরীত আমল করেছেন; তা কিভাবে সম্ভব হল?
এ কারণে বায়হাকী বলেছেন- নববী ও মুনযেরীওতা সমর্থন করেছেন যে, কাসেম ও ইবনে আবূ মুলাইকা হযরত আয়েশাথেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীদের অলংকারের যাকাত না দেযঅর যেবর্ণনা এনেছেন- অথচ ইয়াতীমেরমালের যাকাত দেয়াই তার মাযহাব- এবং এসব মারফূ’ হাদীসের ব্যাপারে বড়ই সন্দেহ জাগিয়ে দেয়।কেননা তিনিতো নবী করীম(স)-এর বা তাঁর সুন্নাতের বিরোধিতা করেন নি, যা তিনি বর্ণনা করেছেন তাতে। তবে কোন কিছুর মনসূখ হয়ে গেছে একথা জানতে পারার পরই তা তিনি করতে পারেন, তা পূর্বে নয়।
(গ) এমন বহুসংখ্যক হাদীসবিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁরা এসব হাদীসকে সহীহ্ মেনে নিয়েও তার ব্যাখ্যা দিযেছেন এই বলে যে, স্বর্ণালংকার ব্যবহার যখন হারাম ছিল, তখনই অলংকারের যাকাত ফরয করা হয়েছিল। পরে তা যখন স্ত্রীলোকদের জন্যে ‘মুবাহ; হয়েগেল, তখন তা ব্যবহারের দরুন তার উপর যাকাত প্রত্যাহা রকরা হল, যেমনকাজে নিয়োজিত গবাদিপশুর যাকাত প্রত্যাহৃত হয়েছে। ইমাম বায়হাকী বলেছেন, আমাদের অনৈক সঙ্গীই এ কথা মনে করেন। এরপর তিনি এমনকিছু হাদীসউদ্ধৃত করেছেন, যা স্বর্ণালংকার ব্যবহার হারাম করে। আর স্ত্রীলোকদের জন্যে তা ‘মুবাহ্ হওয়ার মতে ইজমা’ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগেউ উল্লেখ করেছি। বিশেষভাবেতাদের জন্যে তা হারাম হওয়ার দলীলসমূহ বাতিল হয়ে গেছে।
কিন্তু এ ব্যাখ্রার বিপরীত কথা হচ্ছে, হযরত আয়েশার হাদীস ছিল পৌপ্যলংকার সম্পর্কে। কিন্তু রৌপ্যালংকার কখনও হারাম ছিল, পরে তা মুবাহ হয়েছে, এমন কথা কেউ বলেন নি। হযরত উম্মে সালমার হাদীসে তা ব্যবহার করার স্বীকৃতি রয়েছে।
(খ) হযরত আয়েশা ও উম্মে সালমা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের- যদি তা সহীহ্ই হয়ে থাকে- অপর একটি ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে। তা হচ্ছে, নবী করীম(স) তাঁর বেগমদের এবং আহ্লে বায়তের মহিলাদের ব্যাপারে একটা স্বতন্ত্র ও ভিন্নমত নীতি প্রয়োগ করেছেন।তা হল অপেক্ষাকৃত অধিক মাত্রার কুচ্ছ্রতা গ্রহণ। বাহ্যিক সাজসজ্জা, জাঁকজমক ও বিলাসিতা পরিহার করার জন্যে তাঁর বিশেষ তাগিদ ছিল তাঁদের প্রতি।
কেননা গোটা উম্মতের মহিলাদের জন্যে তাঁরাই নেতৃত্বের ও আদর্শের আসনে আসীন ছিলেন। স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদেরই সম্বোধন করে বলেছেন:
(আরবী**********) হে নবীর ঘরের মহিলারা। তোমরা সাধারণ মহিলাদের একজন নও।
(আরবী**********)
হে নবীর মহিলাগণ! তোমাদের মধ্যেকেউ সুস্পষ্ট প্রকাশ্য লজ্জাকর কাজ করলে তাকে সেজন্য দ্বিগুণ আযাব দেয়া হবে।
তাই বলা যায়, সম্ভবত অলংকারের যাকাত দেয়অর নির্দেশ কেবলমাত্রতাঁদের জন্যেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এই কারণেতাঁদের কেউ কেউ সাধারণ মহিলাদেরও যাকাত দিবারআদেশ করেছেন- এমন কথা কারোকাছ থেকেই বর্ণিত হয়নি। আর এই কারণে হযরত আয়েশা (রা) তাঁর ক্রোড়ে লালিতা তাঁর ভাইয়ের কন্যাদের অলংকারেরওযাকাত দেন নি। অথচ তিনি তাঁদের অন্যান্যসব মালেরই যাকাত দিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে সহীহ্ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে।
(ঙ) অপরাপর বিশেষজ্ঞগণ এ সব হাদীস ‘সহীহ’ মেনেনিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, আসলে নবী করীম(স) অলংকারাদির ব্যবহারকে অপচয় মনে করেছেন এবং এর অভ্যস্ততাকে সীমালংঘন বলে ধরে নিয়েছিলেন। এ কারণে তারা কাফ্ফারা স্বরূপ ও তাদের পবিত্রকরণের উদ্দেশ্যেতার উপর যাকাত ধার্য করেছিলেন।
একজন মহিলার কন্যার হাতে খুব মোটা কাঁকন দেখে নবী করীম(স) তার যাকাত দেয়ার কথা বলেছিলেন এজন্যেই যে, তাঁর দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই ব্যাখ্যা উপরিউক্ত ব্যাখ্যাকে অধিক শক্তিশালী বানিয়ে দেয়। তাতে হারামবা মাকরূহ অলংকারের যাকাত দেয়ার প্রমাণ পাওয়া মাত্র।
(চ) কয়েকজন সাহাবী অলংকারের যাকাত দেয়অর পক্ষেমত দিয়েছেন কিন্তু তাঁরা বলেছেন, মাত্র একবার যাকাত দেয়াই ফরয। ফলে প্রতি বছর যাকাত দেয়ার প্রশ্ন থাকে না। হযরত আনাস (রা) থেকে এই মত বর্নিত হয়েছে।
(ছ) কয়েকজন সাহাবী ও তাবেয়ীন অলংকারের যাকাতের ভিন্নতর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে তা নগদ সম্পদের ন্যায় এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ যাকাত নয়। বরংতা হচ্ছে বিবাহাদির ন্যায় উৎসবকালে তা অন্যদের ধারস্বরূপ দেয়াইতার যাকাত। এটাকে তাঁরা ফরয মনে করেন। বায়হাকী এই কথা ইবনে উমর ও ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে বর্ণনা করেছেন।
উপরে উল্লিীখত হাদীসসমূহের ব্যাখ্যায় এসব সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। ফলে এসব হাদীসকে কোন কিছু অকাট্যভাবে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে দলীল হিসেবে পেশ করা যায় না। কেননা নিয়মের কথা হচ্ছে: ‘কোন দলীল যদি বিভিন্ন সম্ভাব্যতার মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে তার কোন কিছুর দলীল হওয়ার যোগ্যতা বাতিল হয়ে যায়।’
আর এ সব কথাই বলা হচ্ছে উপরিউক্তি হাদীসসমূহকে ‘সহীহ’ মেনে নেয়ার পর। কিন্তু সেসব হাদীস যদি ‘যয়ীফ’ হয়ে থাকে, তা’হলে তদ্দারা কি প্রমাণ করা যেতে পারে?
এই ব্যাপারে সবচাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যাঁদের বলা হয় যে, তাঁরা হাদীসকে অনুসরণ করেন না- নিজেদের বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে শরীয়াতের বরায় নির্ধারণ করেন, তাঁরা তাদের রায় দিয়েছেন হাদীসের ভিত্তিতে। পক্ষান্তরে হাদীস-অনুসরণকারী হওয়ার দাবিদার যাঁরা, তাঁরা িএ ক্ষেত্রে মত দিয়েছেন নিজেদের চিন্তা-বিবেচনার ভিত্তিতে।
হযরত ইবনে মাস্উদ ও ইবনেআমর, ইবনুল আ’স প্রমুখ কয়েকজন সাহাবী থেকে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা সেই বিষয়ে জনগণকে কোন ফতোয়া দেন নি। তাঁরাতা করার জন্যে সকলকে বাধ্য করার উদ্দেশ্যেও কোন কথা বলেন নি।
আর তাঁরা নিজেদের ক্ষেত্রেযে কাজগুলো করেছেন- যেমন হযরত ইবনে মাস্উদের স্ত্রী তাঁকে স্বর্ণ-হার সম্পর্কে জিজ্ঞেসকরেছিলেন: ‘তুমি কি এর যাকাত দাও?’ জবাবেতিনি ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন।– এরূপ জিজ্ঞাসা করায় বোঝা যায় যে, অলংকারের যাকাত দেয়ার ব্যাপারটি তাঁদের মধ্যে সুপরিচিত ছিলনা। আর ইবনে উমর (রা) তাঁর কন্যাদের অলংকারের যাকাত প্রত্যেক বছরই দিয়ে দিতেন, তা তো তাঁর ব্যক্তিগত দানশীলতার ব্যাপারও ছিল না বা নিজের জন্যে কোন সতর্কতামূলক কাজও ছিল না। এমনবিষয়ে, যা রাসূলেরকাছ থেকে তিনি জানতে পারেন নি।
একটি বর্ননা এ সবের বাইরে থেকে যায়। তা হচ্ছে, হযরত উমর হযরত আবূমূসাআশ্য়ারীকে লিখেছিলেন, মহিলাদের তাদের অলংকারের যাকাত আদায় করার আদেশ করার জন্যে। কিন্তু এ বর্ণাটির সত্যতা সপ্রমাণিত হয়নি। কোন একজন সাহাবীও অলংকারের যাকাত দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছন, হাসান এ কথা মানতেই রাযী নন।
যে অলংকারপুঁজি বানানো হবে, তারই যাকাত দিতে হবে
অলংকারের যাকাত দিতে হবে না বলে আমরা যে মত প্রকাশ করছি, তা শুধু সেই অলংকারাদি সম্পর্কে, যা সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। কেননাতা ব্যক্তিগত সৌন্দর্য সামগ্রীরূপে গণ্য। কিন্তু যে অলংকার পুঁজি করা হবে, সঞ্চয়করে রাখা হবে তা সঞ্চিত নগদ টাকাস্বরূপে গণ্য করা হবে, তার যাকাত দেয়া অবশ্যই ফরয হবে।
এই কারণে সাঈদ ইবনুর মুসাইয়্যিব থেকে বর্নিত হয়েছে: অলংকারাদি যখন ব্যবহৃত হবে- তার ব্যবহারিক ফায়দা নেয়া হবে, তখন তার যাকাত দিতেহবে না। আর যখন তা ব্যবহার করা হবে না, তার ফায়দাটাও কাজে লাগানো হবে না; তার যাকাত দিতে হবে।
ইমাম মালিক বলেছৈন, যার কাছে স্বর্ণ বা রৌপ্যের পিণ্ড ও অলংকার মজুদ থাকবে এবং তা ব্যবহারের ফায়দা নেয়া হবে না, প্রতি বছর তার যাকাত দিতে হবে।তা ওজন করতে হবে এবং মোট সম্পদের কে-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ যাকাত বাবদ দিতে হবে, অবশ্য আসল বিশ দীনার কিংবা দুইশ’ দিরহামের কম মূল্যের হলে তার যাকাত দিতে হবে না। এ সম্পদের যাকাত এ জন্যে দিতে হবে যে, জিনিসগুলো ব্যবহার না করে আটকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তবে বাঙ্গা অলংকারও খনিজ স্বর্ণ-রৌপ্য- যা মালিক মেরামতের জন্যে ও মেরামতের পর ব্যবহার করার ইচ্ছায় রেখে দিয়েছে, তা প্রত্যেক ঘরে রক্ষিত দ্রব্য সামগ্রীর ন্যায়।তাই তার যাকাত দেয়া ফরয হবে না।
ইমাম নববী বলেছেন, অলংকার বানানো হলেও তার ব্যবহার করার ইচ্ছা না থাকলে- সে ব্যবহার হারাম-মাকরূহ-মুবাহ যা-ই হোক –তা পুঁজি হিসেবে রেখে দেয়াই ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত হবে, সর্বসম্মত এই যে, তার যাকাত অবশ্যই দিতে হবে।
লাইস ইবনেসাদ এ মতের সমর্থনে বলেছেন, ব্যবহার্য ও প্রয়োজনে লোকদের দেয়া অলংকারের কোন যাকাত নেই। কিন্তু যা পুঁজি করে রাখার জন্যে বানানো হবে, তার যাকাত অবশ্যই দিতে হবে। কেননা যাকাত না দিয়ে পারার (যা যাকাত ফাঁকি দেয়ার) উদ্দেশ্যেই তা বানানো হতে পারে।
ইবনে হাজম লাইসের মতের প্রতিবাদ করে বলেছেন, যদি প্রকৃতপক্ষে তা-ই হত তাহলে লোকনগদ টাকা দিয়ে কোন ঘর-বাড়ি বা জায়গা-জমি ক্রয় করলে টাকার যাকাত দেয়অর দায়িত্বথেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে, তাকেও যাকাত দিতে হবে। আমরা বলব, এসব কলা-কৌশল শরীয়াতের মৌল ভাবধারার পরিপন্থী এবং কৌশলকারীর কাজ-কর্ম তার কৌশল-পরিপন্থী ব্যবস্থাপনার দ্বারাই খতম করা যেতে পারে।
হাম্বলী মাযহাবের লোকেরা তাই বলেছৈন, যাকাত দেয়ার দায়িত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কৌশল স্বরূপ অলংকারাদি বানিয়ে রাখা হলে যাকাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। কোন পুরুষের মালিকানার অলংকারযদি তার পরিবারবর্গ ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনেলোকদের ধার দেয় তাদের ব্যবহারের জন্যে তাহলে তা ঠিক সেই অলংকারের মতই, যার মালিক সেই স্ত্রীলোক। কেননা তা প্রবর্ধনমূলক কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, তা ব্যবহারভুক্ত আছে।
সাধারণ অভ্যাস-বহির্ভূত অলংকারের যাকাত দিতে হবে
যে সব অলংকার সাধারণ অভ্যঅস-বহির্ভূত অপচয় পর্যায়ের, তার যাকাত দিতে হবে। অলংকারের উপর থেকে যাকাত প্রত্যাহারের কারণ হল, শরীয়াত নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেতা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। ফলে তা ঘরের কাপড় ও দ্রব্য-সামগ্রীর পর্যায়ে গণ্য রয়েছে।
কিন্তু যা স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, তা হারাম বা মাকরূহ। শরীয়াত তার ব্যবহার বৈধ করেনি। এজন্যে শাফেয়ী মাযহাবের লোকেরা বলেছেন, স্ত্রীলোকদের জন্যে সেই অলংকার ব্যবহার জায়েয করা হয়েছে, যাতে বাহ্যত অপচয়ের চিহ্ন নেই।কিন্তু যদি দুইশ’ দীনার দিয়ে মল তৈরী করা হয়, তা’হলে তার হারাম হওয়াই বিধেয়।
হাম্বলী মাযহাবের ইবনে হামেদ বলেছেন, একহাজার মিশকালের কমওজনের অলংকারাদি মুবাহ্।যদি এ পরিমাণ ওজনের হয়, তাহলেতা হারামহবে এবংতার যাকাত দিতেহ বে।আমর ইবনেদীনার বলেছেন, হযরত জাবির (রা)-কে অলংকারের যাকাত দিতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘না’। বলা হল, যদি তারমূল্য হাজার দীনার হয়, তাহলে? বললেন, এ তো অনেক বেশী।আর তাতে যেমন অপচয় হয়, তেমনি অহংকার ও গৌরব প্রকাশের মাধ্যমও হয়। এ পরিমাণ ওজনের অলংকার সাধারণত ব্যবহারে আসে না।
এরূপ যুক্তি অবশ্য মজবুত বটে, কিন্তু ইবনে কুদামাহ লিখেছেন, কোনরূপ শর্ত-সীমা ছাড়াই অলংকার ব্যবহার হালাল ঘোষিত হয়েছে। অতএব তার উপর কোন শর্ত-সীমার কয়েদ চাপানো জায়েয নয়। কেননাতা করাহবে শুধু বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে’ শরীয়াতের দলীলের ভিত্তিতে তা করা যাবে না।
কিন্তু শায়খ ইবনে ‘কুদামাহ ভুলে গেছেন যে, শরীয়াতে ঘোষিত মুবাহ জিনিসের ব্যবহারেও দুটি শর্তের অধীন; একটি হচ্ছে তাতে অপচয় হতে পারবে না, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তাতে অহংকার ও গেওরব-বাহাদুরী প্রকাশ হওয়া চলবে না।
এ পর্যায়ে দলীল নবী করীম(স) থেকে বর্ণিত হাদীস:
(আরবী**********) তোমরা খাও, পান কর ও পরিধান কর- কোনরূপ অপচয়, বেহুদা খরচ এবং অহংকার গৌরব প্রশ্ন ছাড়াই।
হাদীসে যে ইয়েমেনী মহিলার হাতে স্বর্ণের দুটি ভারী ওজনের কাঁকন দেখে তাকে যাকাত দেয়ার নির্দেশদেয়ার কথা উদ্ধৃত হয়েছে, তা এজন্যেই যে, তাতে সীমা লংঘনকারী পরিমাণ ছিল, আর তা ছিল অপচয় পর্যায়ের। বেশকয়েকজন বিশেষজ্ঞই এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আর যাকাত তো পয়েঅজনাতিরিক্ত পরিমাণের উপরই ফলয করা হয়েছে। একারণেই সম্ভবত হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) তাঁর কন্যাদের অলংকারের যাকাত দিতেন। বর্ণিত হয়েছে, তিনজন কন্যার ছয় হাজার দীনার মূল্যের অলংকার ছিল। আর এটা খুবই বড় ও সীমালংঘনকারী পরিমাণ। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু অতিরিক্ত পরিমাণের যাকাত দিতে হবে, না সমস্ত অলংকারেরই? উপরে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের তাৎপর্য হচ্ছে, সমস্ত সম্পদেরই যাকাত দিতে হবে। আর তা হবে বাড়াবাড়িমূলক পরিমাণ ব্যবহার করা অপরাধের কাফ্ফারা স্বরূপ।
সর্ব প্রকার অলংকার নিঃশর্তে মুবাহ এবং তার উপর যাকাত ফরয নয়, এই মতে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা হলে জাতির বিরাট সম্পদ মূল্যবান অলংকাররূপে অনুৎপাদক হয়ে পড়ে থাকবে। বছরের পর বছর অতিবাহিত হবে; কিন্তু কেউ তা ব্যবহার করবে না- বিশেষ করে এজন্যে যে, চুরি ডাকাতির ভয়ে এই মূল্যবান সম্পদ লোহার সিন্দুকে কিংবা ব্যাংকের কাস্টডিতে জমা করে রাখবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অপচয়ের সীমাটা কি? কত পরিমাণের হলে অপচয় হয় বলে ধরতে হবে?
আমি মনে করি ব্যক্তি ও পরিস্থিতি পরিবেশের অবস্থার পার্থক্যের দৃষ্টিতে অপচয়ের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। কেননা আমেরিকার মত বিরাট ধনী দেশের কোন ধনী পরিবারের ধনী মহিলার জন্যে এক হাজার দীনার মূল্যের অলংকারও খুব বেশী বলে মনে করা যায় না।
অবস্থান্তরে যে দেশে মানুষ পেট ভরে খেতে পায় না, সেখানে তার অর্ধেক বাএক-চতুর্থাংশ মূল্যের অলংকারও বাহুল্য হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই অপচয়ের মাত্রার বৈধ-মুবাহ পরিমাণ নির্ধারণের জন্যে যেমন ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা দেখতে তেমনি দেখতে হবে জাতির আর্থিক অবস্থাও।
যদি হারাম বা মাকরূহ মাত্রায় নাও হয়, অলংকারাদি বৈধ পরিমাণের মধ্য থেকেও তা পুঁজি হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে- অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে থাকে, তাহলে মনে করতে হবে, স্বাভাবিক সীমা লংঘন করা হয়েছে।
এ কালের লোকনগদ টাকা খরচ হয়ে যাবে- এ ভয়ে অলংকারাদি বানিয়ে রাখে, এ কথা কারোরই অজানা নেই।
তাই এসবকে মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত ও মহামূল্য পাথর মনে করতে হবে। এসবের মধ্যে যা যা অলংকার ও সৌন্দর্যরূপে ব্যবহারের জন্যে বানানো হবে এবং অপচয়ের মাত্রা পর্যন্ত তার পরিমাণ পৌঁছবে না, তাতে যাকাত দিতে হবে না। আর যা এ সীমা সুস্পষ্টভঅবে লংঘন করবে, তা হারাম ও অপচয়ের মধ্যে গণ্য হবে। তার যাকাত মাফ করা কোন ক্রমেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। অনুরূপভাবে যা শুধু পুঁজি করে রাখার উদ্দেশ্যে বানানো হবে, তারও যাকাত দিতে হবে। অন্যথায় এ জাতীয সম্পদ পুঁজি করে রাখার ব্যক্তির সম্পদে বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরযে হক রয়েছে তা থেকে তাদের মাত্রা অতিক্রম করা হলেই বোঝা যাবে যে, নিশ্চয়ই তা অলংকার হিসেবে ব্যবহারের জন্যে বানানো হয়নি।
স্বাভাবিক ও সাধারণ অভ্যাসের সীমা লংঘন যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে একটা স্থানীয় মানদণ্ড হয়ে থাকবে। কেননা অতটুকু পরিমাণের অলংকার যাকাত মাফ পেতে পারে।
সারনির্যাত
উপরের বিস্তারিত ও দীর্ঘ আলোচনার সারনির্যাস এভাবে তুলে ধরা যেতে পারে:
ক. যে লোক কোন স্বর্ণ বা রৌপ্যালংকারের মালিকহবে তার ব্যাপারটি বিবেচনা করা হবে। সে যদি তা পুঁজিকরণ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বানিয়ে থাকে তবে তার যাকাত দিতে হবে। কেননা তা আসলে প্রবৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্য সম্পদ। তখন তা নগদ ও অন্যান্য মুদ্রার সমতুল্য।
খ. যদি তা ব্যক্তিগত কল্যাণ লাভ ও ব্যবহারের জন্যে হয়ে থাকে, তাহলেতার ব্যবহার স্বরূপটা বিবেচনা করতে হবে। যদি তা হারাম হয়- যেমসন স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রাদি, প্রতিকৃতি ও উপঢৌকনের জিনিস-পত্র অথবা কোন পুরুষের নিজের জন্যে বানানো স্বর্ণ চেইন, আঙ্গুরীয় ইত্যাদি হয় তাহলে তাতে যাকাত ফরয হবে। কেননা তা মুবাহ নয়, তা বানিয়ে তার আসল নীতি-বহির্ভূত কাজ করা হয়েছে। কাজেই তার মূল্যের বিচারেই তার উপর যাকাত দিতে হবে।
গ. স্ত্রীলোকদের জন্যে নির্মিত অলংকারে যদি দৃশ্যমান ব্যয় বাহুল্য করা হয়, তবে তার ব্যবহার হারাম হবে। তার মত একজন স্ত্রীলোকের তার পরিবেশ ও সামাজিক, আর্থিক অবস্থার দৃষ্টিতে সেই পরিমাণে অলংকার শোভন কিনা, সেই দৃষ্টিতেই তার মাত্রা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
ঘ. যদি কোনরূপ অপচয়ের ইচ্ছা ব্যতিরেকেই ব্যবহারের উদ্দেশ্যে মেয়েলোকের জন্যে অলংকার বানানো হয়- পুরুষের জন্যে রূপার আঙ্গুরীয় লওয়া হয়, তাহলে তাতে যাকাত ফরয হবে না। কেননা এ তো মুবাহ।
ঙ. কোন জায়েয অলংকার- তা কোন স্ত্রীলোকের ব্যবহার বাধার দেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে কিংবাতা কোন পুরুষের মালিকানা হয়, যার ঘরেরমেয়েরা তা ব্যবহার করে বা ধার দেয়, তার মধ্যে কোন পার্থক্য হবে না।
চ. অলংকার, পাত্র বামূল্যবান উপঢৌকন- যারই যাকাত দেয়া হবে, তা দিতে হবে নগদ সম্পদের ন্যায়। অর্থাৎ এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ- শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে।
ছ. এ সবের পরও শর্ত হচ্ছে, সম্পদ নিসাব পরিমাণের হতে হবে; শুধু সেই জিনিসদিয়ে হোক কিংবা তার অন্যান্য মাল-সম্পদ মিলিয়ে হোক। আর স্বর্ণের নিসাব হচ্ছে ৮৫ গ্রাম।
মূল্যের হিসাব ধরা হবে, ওজনের নয়। কেননা ওজন কম হলেও তার কারুকার্য ও শিল্পকর্মের জন্যে তার মূল্য অধিক বৃদ্ধি পেতে থাকে।
চতুর্থ অধ্যায়
ব্যবসায়ী সম্পদের যাকাত
আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদের জন্যে ব্যবসায়েরকাজে অংশগ্রহণ এবংতার মাধ্যমে সম্পদ উপার্জন জায়েয করে দিয়েছেন।তবে সেজন্যে শর্ত আরোপ করাহয়েছে যে, কোন হারাম পণ্যের ব্যবসা করা চলবে না এব্ং ব্যবসায়ী কার্যকলাপে ইসলামী নৈতিকতার বিধি-বিধান লংখন করা চলবে না। আমানতদারী, সততা ও কল্যাণ দৃষ্টি সর্বতোভাবে রক্ষা করতে হবে। উপরন্তু ব্যবসায়ী ব্যস্ততা ও উপার্জন তৎপরতা যেন মানুষকে আল্লাহ্র স্মরণ ও তাঁর হক আদায় থেকে কখনই গাফিল করে না দেয়।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ের আলোচনা থেকে নগদ সম্পদের মালিকদের উপর শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত ফরয হওয়ার বিষয় আমরা সবিস্তারে জানতে পেরেছি। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করা, সেই সাথে তাদের ধন-মালকেও পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করা। এ যাকাত ফরয হওয়ার যৌক্তিকতাও জানতে পেরেছি বিগত আলোচনা থেকে। শরীয়াত প্রদাতা ও যাকাতকে একটা শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করে দিয়েছেন। ফলে নগদ সম্পদের মালিকগণ সর্বপ্রকার হালাল পন্থায় নিজেদের ধন-মালের প্রবৃদ্ধি সাধন করতে সক্ষম হতে পারে। শরীয়াত-সম্মতভাবে উপার্জন করে তারা পারে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে। যাকাত আদায় করে তারা সেই অপরাধ থেকেও রক্ষা পেয়ে যেতে পারে, যা নগদ সম্পদকে আবর্তন থেকে আটকে রাখা ও উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকেতাকে দূরে সরিয়ে রাখার দরুণ হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে বার্ষিক হিসেবেযাকাত দেয়ার দরুন তাদের মূলধন নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার গ্রাস থেকে তাদের ধন-মালকে রক্ষা করে তার প্রবৃদ্ধি সাধন করবে।
বৈধ ও শরীয়াতসম্মত অর্থোপার্জনের বহুবিধ পন্থার মধ্যে ব্যবসা অন্যতম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কারণে আমরা রাসূলেকরীমস(স) ও সাহাবায়ে কিরামের উক্তি দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, ইয়াতীমের মাল-সম্পদ দ্বারা ব্যবসা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন বার্ষিক যাকাত তাদের মূলধনকে নিঃশেষ করে না দেয়্
এই জাতীয় সম্পদের বিরাট অংশ ব্যবসায়ে নিয়োজিত হওয়া কিছু মাত্র বিচিত্র নয়। বহু প্রকারের ব্যবসায়ের সুযোগ রয়েছে এবংতাতে অংশ গ্রহণ করে বিপুল পরমাণ উপার্জন করা ও নিজেদের ধন-মালের প্রবৃদ্ধি সাধন খুবই সম্ভভপর। আর এ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন বহু লোক থাকাও সম্ভব, যাদের কাছে হাজারও মিলিয়ন পরিমাণ পণ্যদ্রব্য মজুদ রয়েছে।
ফলে ইসলাম যদি এই সম্পদের উপর এবং ব্যবসায়লব্ধ মুনাফার উপর যাকাত ফরয করে থাকেতবেতাও বিস্ময়ের কিছু নয়। এই যাকাত হবে নগদ সম্পদের উপর যাকাতের মত। এভাবে আল্লাহ্র নিয়ামতের শোকর আদায় করা যেমন সম্ভবপর, তেমনি তাঁর অভাবগ্রস্ত বান্দাদের অধিকার আদায় এবং দ্বীন, রাষ্ট্র ও জনগণের সার্বিক কল্যাণে অংশগ্রহণও সম্ভবপর। কেননা যাকাতের বিশেষত্বই হচ্ছে তাই।
এ কারণে ইসলামী ফিকাহ্ যাকাতের বিস্তারিত আইন-বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার উপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে। যেন ব্যবসায়ীরা স্পষ্টভাবে জানতে পারে যে, তাদের কোন্ সব ধন-মালে কি হিসেবে যাকাত ফরয করাহয়েছে এবং কোন ধরন বা পরিমাণের মাল-সম্পদের যাকাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে।
ফিকাহ্ শাস্ত্রে ব্যবসায়ীদের এ পর্যায়ের সম্পদকে ব্যবসায়ী সরঞ্জাম বলে অভিহিত করা হয়েছে। তার অর্থ ব্যবসায়ে নিযুক্ত নগদ সম্পদ ছাড়া আর যে সব পণ্যদ্রব্য, যন্ত্রপাতি, সাজ-সরঞ্জাম, কাপড়, খাদ্য, অলংকারাদি, মূল্যবান পাথর, গাছপালা, জমি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিৃ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ-সম্পত্তি রয়েছে তা।
ব্যবসায়ী সামগ্রী বা সাজ-সরঞ্জাম বলতে কেউমনে করেন, মুনাফার জন্যেযা-ই ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য, তা-ই পন্যদ্রব্যের মধ্যে শামিল।
অতএব যে লোকই এই ব্যবসায়ী জিনিসের মালিকহবে, তার এই মালিকানার উপর একটি বছর অতিবাহিত হবে এবং বছরের শেষ পর্যন্ত তার মূল্য নগদ হিসেবে নিসাব পর্যন্ত পৌঁছালে তার যাকাতদেয়া কর্তব্য হবে। আর তা হচ্ছে, মোট মূল্যের এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ। তা মূলধনের উপর ধার্য কর বিশেষ। কেবলমাত্র লভ্যাংশ বা মুনাফা বাবদ অর্জিত ধনের উপরই নয়; মূল সম্পদের উপরও যাকাত ধার্য হবে।
পরবর্তী আলোচনাসমূহে এ পর্যায়ে যাবতীয় বিধি-বিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করা হবে।
প্রথম আলোচনা, ব্যবসায়ে যাকাত ফরয হওয়ার দলীল;
দ্বিতীয় আলোচনা জাহেরী ও ইমামীয়া ফিকাহ্বিদদের সৃষ্ট সংশয় ও তার জবাব;
তৃতীয় আলোচনা ব্যবসায়ের যাকাতের শরতাবলী;
চতুর্থ আলোচনা ব্যবসায়ী তার ব্যবসা সম্পদের যাকাত কিভাবে দেবে?
প্রথম আলোচনা
ব্যবসায়ে যাকাত ফরয হওয়ার দলীল
ব্যবসায়ের দ্রব্যাদিতে যাকাত ফরয হওয়ার দলীলসমূহ এখানে পর্যায়ক্রমে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
প্রথম. কুরআনের আয়াত
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী ***********)
হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা তোমাদের পবিত্র উপার্জনসমূহ থেকে এবং যা তোমাদের জন্যে জমি থেকে উৎপাদন করেছি তা থেকে ব্যয় কর।
ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ বুখারীর ‘কিতাবুয যাকাত’-এ উপার্জন ব্যবসায়ের যাকাতের অধ্যায়’ দাঁড় করেছেন উপরিউক্ত আয়াতের ভিত্তিতে।অর্থাৎ আয়াতটিতে যে ব্যয় করার নির্দেশ, তা উপার্জন ও ব্যবসায়ের আয় থেকে করতে হবে।
ইমাম তাবারী উপরিউক্ত আয়াতের ভিত্তিতে লিখেছেন, ‘আয়াতটিতে বলা হয়েছে: তোমরা তোমাদের চেষ্টা-সাধনায় যা উপার্জন কর- তা ব্যবসা হোক, শিল্প হোক, স্বর্ণ-রৌপ্য ভিত্তিক কারবার হোক- তা থেকে যাকাত দাও।’
‘তোমাদের পবিত্র উপার্জন বলতে মুজাহিদ থেকে কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী বোঝানো হয়েছে ব্যবসা।’
ইামম জাসসাস তাঁর ‘আল-আহ্কামুল কুরআন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পূর্ববর্তী লোকদর থেকে জানা গেছে, আল্লাহ্র বাণী: ‘তোমরা তোমাদের পবিত্র উপার্জন থেকে ব্যয় কর’ বলে বোঝানো হয়েছে, ব্যবসায়ের কথা- তাই পবিত্র উপার্জনের মাধ্যম। আর এ আয়াতের এই সাধারণ হুকুম সমস্ত ধন-মালেই যাকাত ফরয কর দিয়েছে। ‘তোমাদের উপার্জন’ বা ‘তোমরা যা উপার্জন কর’ কথাটি এ সব কিছুকেই শামিল করে।
ইবনুল আরাবী বলেছেন, ‘তোমরা উপার্জন কর’ বলে আল্লাহ তা’আলা ব্যবসা বুঝিয়েছেন এবং ‘যা জমি থেকে উৎপাদন করি’ বলে গাছ-পালা, শস্য ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে।
এ কথার তত্ত্বহচ্ছে ‘উপার্জন’ দুই প্রকারের। এক প্রকার, যা জমির গর্ভ থেকে পাওয়া যায়। জমির উপর উদ্ভূত সব জিনিসই তার মধ্যে গণ্য। আর দ্বিতীয় প্রকার, জমির উপরিভাগে সাধনা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যা কিছু পাওয়া যায়। যেমন ব্যবসা, উৎপাদন, শত্রুদেশে অস্ত্র চালানোর মাধ্যমে এবং শিকারের মাধ্যমে যা হাতে আসে। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর ধনশালী বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছে, আল্লাহ্ তাদের যা দিয়েছেন তা থেকে যেন তারা গরীবদের দান করে- যেমন রাসূলে করীম (স) বলেছেন:
ইামাম রাযী বলেছেন, বাহ্যত আয়াতটি মানুষের উপার্জিত সর্বপ্রকার মাল-সম্পদের যাকাত ফরয করে দিয়েছে। অতএব ব্যবসায়ের স্বর্ণ-রৌপ্য ও গবাদিপশুর যাকাতও তার অন্তর্ভুক্ত। কেননা এ সবই উপার্জন।
এর সমর্থনে আল্লাহ্র সেই কথাটি এসেছে, যা তিনি আবূ লাহাব সম্পর্কে বলেছেন: (আরবী ***********) তার ‘ধন-মাল’ ও যা কিছু সে উপার্জন করেছে তাকে রক্ষা করতে পারেনি।’ এখানে ধন-মাল বলে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মাল বুঝিয়েছেন এবং যা কিছু সে উপার্জন করেছেন, বলে সে ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে যা সঞ্চয় করেছে, তা-ই বোঝানো হয়েছে।
শুধু এ দুটি আয়াতই নয়, আও বহু আয়াতই সর্বপ্রকার মালে যাকাত ফরয প্রমাণ করেছে।
যেমন: (আরবী ***********) তাদের ধন-মালে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের জন্য হক রয়েছে।
(আরবী ***********) আর সেই লোক, যাদের ধন-মালে অভাবগ্রস্ত প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্যে নির্দিষ্ট হক রয়েছে।
(আরবী ***********) তাদেন ধন-মালথেকে যাকাত গ্রহণ করে পবিত্র কর তাদের ও পরিচ্ছন্ন কর তাদের এর দ্বারা।
কুরআন ও সুন্নাতের এমন কোন দলীলের উল্লেখ করা যেতে পারে না, যদ্দারা প্রমাণ করাযাবে যে, মুসলিম ব্যবসায়ীদের ধন-মালে এ সুনির্দিষ্ট হক্ আদায় করার- যা তাদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে দেবে- দয়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে।
িইবনুল আরাবী বলেছেন, ‘তাদের ধন-মাল যাকাত লও’-আল্লাহ্র এ নির্দেশ সর্বপ্রকারের ধন-মাল- তা যতপ্রকারেরই হোক- সেসবের নামযত বিভিন্ন ও বিচিত্রই হোক তা থেকে যাকাত গ্রহণ করা ফরয করে দিয়েছে। এ থেকে কোন কিছু বাদ দেয়া হলে তার জন্যে অকাট্য দলীল প্রয়োজন।
হযরত আবূ হুরায়রার গোত্র ছিল ‘দওস’। তাঁদের বক্তব্য হল, কাপড়-চোপড়, দ্রব্যসামগ্রী, সরঞ্জামাদি ও পণ্য দ্রব্য সবই মাল-এর মধ্যে শামিল। কেবল অস্থাবর জিনিসই মাল নয়।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসও তাই প্রমাণ করে। তিনি বলেছেন:
(আরবী ***********)
আমরা রাসূলে করীম(স)-এর সাথে খয়বর যুদ্ধের বছর বের হলাম; কিন্তু গণীমত হিসেবে স্বর্ণ-রৌপ্য পেলাম না, পেলাম শুধু মাল- কাপড় ও দ্রব্যসামগ্রী।
দ্বিতীয় সুন্নাত
আবূ দাউদে হযরত সামুরাতা ইবনে জুনদুব (রা) থেকে বর্নিত, তিনি বলেছেন:
(আরবী ***********) আমরাযা কিছু বিক্রয়ার্থে প্রস্তুত করি তার যাকাত দেয়ার জন্যে রাসূলে করীম (স) আমাদের আদেশ দিয়েছিলেন।
‘দারেকুতনী’ হাদীস গ্রন্থে হযরত আবূ যর গিফারী (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি বলেছেন:
(আরবী ***********)
রাসূলে করীম(স)-কে আমি বলতে শুনেছি; উষ্ট্রে যাকাত আছে, ছাগলে যাকাত আছে, আর ঘরের দ্রব্যাদি- কাপড়-চোপড়, সামগ্রী ইত্যাদিতেও যাকাত আছে।
এ হাদীসে ঘরের আসবাবপত্র, ফার্নিচার, দ্রব্যসামগ্রী, পাত্র, ছোট-খাটো পণ্য-দ্রব্যাদি (Haberdasher) প্রভৃতির উপর যাকাত ফরয কর। কিন্তু এ জিনিসগুলো যদি ঘরে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহৃত হতে থাকে, তা দিয়ে ব্যবহার-ফায়দা লাভ হতে থাকে, তাহলে তাতে যে যাকাত হবে না, তা সর্ববাদীসম্মত কথা। তাই এ সব জিনিস যদি ব্যবসার ও অর্থাগমের কাজে নিয়োজিত হয়, তাহলে অবশ্যই তার মূল্য ধরে যাকাত দিতে হবে।
সমস্ত মালের উপর যাকাত ফরয করার আর একটি হাদীস হচ্ছে:
(আরবী ***********) তোমরা তোমাদের ধন-মালের যাকাত আদায় কর।
এ হাদীসে বিভিন্ন ধরনেদর মালের মধ্যে কোন তারতম্য করা হয়নি।
আর ব্যবসায়ের মালপত্র সাধারণ ধন-মালের মধ্যেই গণ্য। কেননা গবাদিপশু শস্যজাতীয় দানা-বীজ, ফল-ফাঁকড়া, অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও দ্রব্যসামগ্রী- যারই ব্যবসা করা হবে, তা সবই এ ‘ব্যবসায়ের মালপত্র’ –এর মধ্যে গণ্য। অতএব এ সব সাধারণ যাকাত ফরযকারী নির্দেশ অনুযায়ী এ সবের উপরও যাকাত ফরয হবে।
তৃতীয়. সাহাবী তাবেয়ীন ও প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের ইজমা
সাহাবিগণের কাছ থেকে পথ-নির্দেশ পর্যায়ে আবূ উবাইদ বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ্য। বর্ণনাকারী বলেছেন:
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের খিলাফত আমলে আমি বায়তুলমাল-এর দায়িত্বশীল ছিলাম। আতা, যখন বের হতেন, ব্যবসায়ের মাল জমাকরে হিসাব করতেন- উপস্থিত ও অনুপস্থিত সব। পরে উপস্থিত মালথেকেই উপস্থিত-অনুপস্থিত উভয় প্রকার মালের যাকাত গ্রহণ করতেন। ইবনে হাজম বলেছেন, এ বর্ণনার সনদ সহীহ্।
হামাম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন, হযরত উমর আমাদের কাছে উপস্থিতহয়ে বললেন, হে হামাম তুমি তোমার মালের যাকাত দিয়ে দাও। আমি বললাম, তুণীর (Quiver) ও চামড়া ছাড়া আর তো কোন মাল আমার নেই। তখন তিনি বললেন, এ সবের মূল্য ধর ও তার যাকাত দাও।
‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে এ খবর সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ ঘটনাটি সর্বজনবিদিতি। কোন একজন সাহাবীও এর বিপরীত মত দেন নি বা এ মতের প্রতিবাদ করেন নি। অতএব এর উপর ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইবনে উমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ক্রীতদাস ও কাপড়-চোপড় যার দ্বারা ব্যবসা করা উদ্দেশ্য হবে, তাতে যাকাত ধার্য হবে।
বায়হাকী ও বিনে হাজম একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, যাতে বলা হয়েছে দ্রব্যসামগ্রী ব্যবসায়েরজন্যে হলেতাতেযাকাত দিতে হবে। ইবনে হাজমের মতে এ কথাটি সহীহ্ সনদে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকেও ব্যবসা দ্রব্যাদিতে যাকাত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
উপরে উদ্ধৃত এসব কথার বিপরীত কোন কথা কোন সাহাবী থেকেও বর্নিত হয়নি। বরং তাবেয়ীনের যুগ পর্যন্ত সমস্ত কাজ ও ফতওয়া এর অনুকূলেই হয়েছে, কোনরূপ মতপার্থখ্য ব্যতীতই। ইতিপূর্বে স্বর্ণের নিসাব পর্য়ায়ে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছি, যাতে বলা হয়েছে, তিনি তাঁর একজন কর্মচারীকে লিখে পাঠিয়েছিলেন:
তোমার সামনে যে মুসলমানই আসবে তার ব্যবসায়ে ব্যবহৃত ও আবর্তিত সব প্রকাশমান সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ কর। প্রতি চল্লিশ দীনারে এক দীনার! কম হলে ঐ হিসাবমত-বিশ দীনার হওয়া পর্যন্ত।
পরবর্তী সব ফিকাহ্বিদিই এ মতে সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ ব্যবসায়ের মালসামগ্রীর উপর যাকাত ফরয হওয়অর কোনই মতভেদ নেই।
এ মতে ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে ইবনুল মুন্যির ও আবূ উবাইদ দাবি করেছেন।
ইবনুল মুন্যির বলেছেন: যে সব জিনিস দিয়ে ব্যবসা উদ্দেশ্য, তার সব কিছুর উপর-বছর পূর্ণ হওয়ার পর –যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে সমস্ত শরীয়াত অভিজ্ঞ লোক সম্পূর্ণ একমত। হযরত উমর, তাঁর পুত্র, ইবনে আব্বাস, সাতজন প্রখ্যাত ফিকা্বিদ- হাসান, জাবির ইবনে যায়দ, মায়মুন ইবনে মাহরান, তায়ূস, নখয়ী, আওযায়ী, আবূ উবাইদ, ইসহাক, ইমাম আবূ হানীফা ও তার সঙ্গিগণ, ইমাম মালিক ও আহমদ- সকলেই এ মত প্রকাশ করেছেন।
ব্যবসায়ের পণ্য সম্পর্কে আবূ উবাইদ বলেছৈন, মুসলমানগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে তাতে যাকাত ফরয।
কাজী ইবনুল আরাবী বলেছেন, চারটি দলীলের ভিত্তিতে ব্যবসায়ের পণ্যে যাকাত ফরয।
প্রথম, আল্লাহর নির্দেশ- তাদের ‘ধন-মাল থেকে যাকাত লও’। এ এক অসাধারণ নির্দেশ সব মাল সম্পর্কেই।
দ্বিতীয, উমর ইবনে আবদুল আযীয ব্যবসার পণ্যে যাকাত গ্রহণের জন্যে লিীখত নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছিল গোটা উম্মতের উপর নির্দেশ। অতএব এ পর্যায়ে আর কোন ভিন্নমত থাকেনি।
তৃতীয, হযরত উমর পূর্বেই এ যাকাত গ্রহণ করেছিলেন। এটা সহীহ্রূপে বর্ণিত:
চতুর্থ, আবূ দাঊদ হযরত সামুরাতা ইবনে জুনদুব থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন :
(আরবী ***********)
নবী করীম (স) ব্যবসায়ের জন্যে প্রস্তুত সব জিনিস থেকে যাকাত দেয়ার জন্যে আদেশ করতেন।
এই ব্যাপারে পূর্ববর্তীদের থেকে ভিন্ন সহীহ্রূপেবর্ণিত হয়নি।
খাত্তাবী বলেছেন: শেষেরদিকে কিছু আলিম মনে করেছেন যে, ব্যবসা পণ্যে যাকাত হবেনা। কিন্তু এ মত ইজমার পরের কথা এবং তার বিপরীত। অতএব গ্রহণ অযোগ্য।
চতুর্থ. কিয়াস-বিবেচনা
ইবনে রুশ্দ উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়ের জন্যে গৃহীত জিনিসপত্র প্রবৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই গ্রহীত হয়। ফলে তা যাকাত ফরয হয় এমন অপরাপর তিনটি জিনিসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়। সে তিনটি জিনিস হচ্ছে ক্ষেতের ফসল, গবাদিপশু ও স্বর্ণ-রৌপ্য।
বিচার-বিবেচনার ব্যাপারটি ইসলামের নিয়মাদি ও তার সাধারণ ভাবধারার উপর নির্ভরশীল। কেননা অর্থোৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গ্রহীত দ্রব্যাদির তাৎপর্যগতভাবে নগদ সম্পদ সমতুল্য।দিরহাম, দীনার বা সেগুলোর মূল্য- এ দুয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। তবে নিসাবের পরিবর্তনশীলতা ও মূল্যে বিবর্তনতার প্রতি অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে। মূল্যের বিনিময়েযে দ্রব্যাদি পাওয়া যায়, তা-ও। কাজেই ব্যবসায়ে যদি যাকাত ফরয না-ই হত তাহলে সমস্ত ধনী বা অধিকাংশ লোকদের পক্ষে তাদের সম্পদ দ্বারা ব্যবসা করা সম্ভব হত। এবং দুই নগদ সম্পদের নিসাব এক বছরকাল অতিবাহিত না হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে পারত। এ কারণে তাদের মতে যাকাত অকেজো হয়ে যেত।
এযুগের ব্যবসায়ীরা যাকাত না-দিয়ে পারার কৌশল ব্যতীতই এমনভাবে নগদ সম্পদ সংরক্ষণ করে না যার উপর একটি বছর অতিবাহিত হতে পারে। বর্তমানে বেশীর ভাগ ব্যবসায়ী কার্যক্রম পণ্যদ্রব্য মূল্য হাতে নেয়া ছাড়াই চেক ইত্যাদির মাধ্যম ছাড়াও সুসম্পন্ন হচ্ছে।
আলোচ্য বিষয়ে আসল বিবেচ্য হচ্ছে-যেমন আল্লামা রশদী রেজা লিখেছেন- আল্লাহ তা’আলা ধনীদের মালে যাকাত ফরয করেছেন গরীবদের সাহায্য-সহানুভূতির জন্য, দ্বীন-ইসলাম ও গোটা জাতির সামষ্টিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। শেষপর্যন্ত তার ফায়দাটাও ধনী লোকেরাই পেয়ে যায়। কার্পণ্যের হীনতা-নীচতা থেকেতারা পবিত্রতা লাভকরতে পারে, গরীবদের প্রতি দয়া-অনুকম্পার উত্তম নৈতিকতায় দীক্ষিত হতে পারে। অভাববগ্রস্ত লোকেরাও পারে সে কল্যাণের অংশ লাভ করতে। সামষ্টিক কল্যাণ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সমগ্র জাতিরও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কালের উত্থান-পতন বিপর্যয়ে দরিদ্র সমাজের ফায়দার ব্যবস্থা সকল বিপর্যয়ের পথও বন্ধ হওয়ার ব্যবস্থা নিহিত। এই ব্যবস্থা সামষ্টিক সম্পদ বৃদ্ধি ও স্ফীত করে। তখনতা অল্প সংখ্যক লোকদের মধ্যেই সীমিত হয়ে থাকে না; গোটা জাতির মধ্যে বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে। ‘ফাই’ সম্পদ বন্টনের কল্যাণ পর্যায়ে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন:
(আরবী ***********)
যেন ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্য থেকে কেবলমাত্র ধনী শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ও কুক্ষিগত হয়ে না যায়।
ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যায় জাতির বেশীর ভাগ সম্পদ। শরীয়াতের উক্ত মহান লক্ষ্য থেকে এই ব্যবসায়দের দূরে সরিয়ে রাখার- তাদের উপর যাকাত ধার্য নাহওয়ার কোন-যৌক্তিকতা স্বীকার করা যায় কি?
আমিবলতে চাই, সমাজের ব্যবসায়ীদের দিল পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হওয়া অন্যদের তুলনায় অধিক প্রয়োজন। কেননা তাদের উপার্জনের বিচিত্র ধরনের উপায় ও পন্থা সংশয়-সন্দেহ থেকে কোনক্রমেই মুক্ত হতে পারে না। আর তাতে সে ক্লেদ পুঞ্জীভূত হতে পারে, তা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তাক্ওয়া ও সততা, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। খুব কম লোকই-বিশেষ করে আধুনিক কালে- এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পারে।
হাদীসে বলা হয়েছে: (আরবী ***********)
ব্যবসায়ীরা কিয়ামতের দিন অপরাধী গুনাহ্গার হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। তা থেকে রক্ষা পাবে শুধু তারা, যারা আল্লাহকে ভয় করেছে, নেক পন্থা অবলম্বন করেছে ও সততার আশ্রয় নিয়েছে।
রাসূলে করীম (স) বললেন: ‘ব্যবসায়ীরা গুনাহ্গার।’ সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে রাসূল! আল্লাহ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় হালাল করে দেন নি?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, তা দিয়েছেন, কিন্তু তারা তো মিছামি্যিছ কিরা-কসম খায়, মিথ্যা কথাবার্তা বলে।’
আমি আরও বলব, ব্যবসায়ীর মন-মানস ও তার মাল-সম্পদ অন্য যে কোন মালদানেরতুলনায় পবিত্র ও পরিচ্ছন্তা অর্জনের মুখাপেক্ষী।
এ পর্যায়ে আবূ দাউদ উদ্ধৃত ও হযরত কাইবইসনে আবূ গাজারাতা থেকে বর্নিত একটি হাদীসউল্লেখ্য। তিনি বলেছেন, রাসূলে করীম(স) আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ক্রয়-বিক্রয়ে অনেক বেহুদা কথাও কিরা কসম করা হয়ে থাকে। অতএব তোমরা তা যাকাত দিয়ে ‘পরিচ্ছন্ন করে নাও।’
এখানে যে যাকাত বা দানের কথা বলা হয়েছে, তা এক বছর অতিবাহিত হওয়ার, নিসাব সমান ও পরিমাণ মত হওয়ার কোন শর্ত নেই। কিন্তু উক্ত হাদীসটি ব্যবসায়ীর স্থায়ী পবিত্রতা অর্জনের প্রয়োজনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে ব্যবসায়ী পংকিলতা ও শোবাহ-সন্দেহ থেকে। তাহলে ইবনে হাজমযেমন বলেছেন, ব্যবসায়ীর উপর ফরযরূপে ধার্য যাকাত কাফ্ফারা হয়ে থাকে ক্রয়-বিক্রয় ক্লেদ থেকে, তাহলে মুসলিম জনগণের উপর ধার্য যাকাত থেকে তারা নিষ্কৃতি পেতে পারে কিভাবে?
দ্বিতীয় আলোচনা
বিরুদ্ধবাদীদের শোবাহ্-সন্দেহ
ক. ব্যবসা পণ্য সম্পর্কে জহিরী ফিকাহ্র মত
আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামায়াতের সব কয়টি মাযহাবই ব্যবসা পণ্যে যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষে রয়েছে। জাহিরী মাযহাবের শেষের দিকের কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন নি। যেমন খাত্তাবী বলেছেন, তাদের মতটা গড়ে উঠেছে, ইবনে হাজম এই মতের প্রবল সমর্থন দিয়েছেন। শেষ জামানার আরও কতিপয় প্রখ্যাত মনীষী যাকাত ফরয মনে করার খুবই সংকীর্ণতার নীতি অবলম্বনকরেছেন। ইমাম শাওকানী ও নওয়াব সিদ্দিক হাসান এই পর্যায়ে উল্লেখ্য। তাঁরাও এই মতের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এবং তার সমর্থন দিয়েছেন। আমরা পরে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করব।
১. এরা দলীলরূপে পেশ করেছেন রাসূলে করীম(স)-এর এই হাদীস:
(আরবী ***********) মুসলিম ব্যক্তির ক্রীতদাস ও ঘোড়ার কোন যাকাত নেই্
বাহ্যত মনেহয়, কোন অবস্থাতেই এই যাকাত হবে না, তাব্যবসার জন্যে হোক, কি অন্য কোন কাজের জন্যে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ এর জবাবে বলেছেন, হাদীসটির মূল বক্তব্য চিন্তা করলে বুঝতে পারা যায়, ব্যক্তির খেদমতে নিযুক্ত ও ব্যক্তির যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত দাস ও ঘোড়ার যাকাত দিতে হবে না। কেননা এই দুটি ক্ষেত্রই মানুষের মৌল প্রয়োজনের মধ্যে গণ্য। আর তার যাকাত যে মাফ করে দেয়া হয়েছে, তা সর্বসম্মত।
২. তাদের বক্তব্য, মূলত মুসলমানের মাল লওয়া হারাম। যেমন প্রতিটি ব্যক্তিই দায়িত্ব মুক্ত- কোন আদেশ, বিধান পালন করতে বাধ্য নয়। কাজেই তাদের ধন-মালের উপর আমরা যাকাত ধার্য করব- অথচ আল্লাহ তা করেন নি, না কুরআনে, না সুন্নাহ্তে- এটা কখনই উচিত হতে পারে না।
খোদ নবী করীমের যুগেও বহুশত প্রকারের জিনিসের ব্যবসা চলত। কিন্তু তাঁর থেকে ব্যবসা পণ্যে যাকাত ফরয হওয়ার মত কোন দলীল পাওয়া যায়নি। হযরত সামুরাতা ও আবূ যর থেকে বর্ণিত হাদীসদ্বয় যেহেতু যয়ীফ, তাই তা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে যে-মত সর্ব সাধারণের একটা চাপের তলেতা তো প্রমাণিতই হতে পারে না।
আমাদের জবাব হচ্ছে, ‘তাঁরা একটা কথার ভিত্তিতে যা বলেছেন, তার দ্বারা অপর একটি মৌলনীতি লংঘন করেছেন। সে মৌলনীতি হচ্ছে, সাধারণভাবে সকল প্রকার মালে যাকাত ফরয করা হয়েছে, তাতে গরীবের হক ধার্য করা হয়েছে। তা স্বীকার করা না হলেকুরআন ও সুন্নাতের অপরাপর দলীলেরও বিরোধিতা হয়, আমরা নিশ্চিত বলে জানি। সাহাবীদের মত সর্বজনমান্য মনীষীদের ইজমারও বিরোধিতা হয়ে যায়।
হযরত সামুরা’র হাদসি সম্পর্কে আবূ দাউদ ও মুনযেরী কোন মন্তব্য করেন নি। তার অর্থ, তাঁরা দুনই হাদীসটি পছন্দ ও গ্রহণ করেছেন। ইবনে আবদুল বারও তাই করেছেন। শায়খ আহমদ শাকের ইবনে হাজমের কথার জবাব স্বরূপ বলেছেন, হাদীসটির বর্ণনাকারিগণ সুপরিচিত। ইবনে হাব্বান তাদের ‘সিকাহ’ গণ্য করেছেন।
মুহাদ্দিসহাকেম আবূ যর বর্ণিত হাদীসটিকে‘সহীহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। হাফেয ইবনুল হাজার তার কতিপয় যয়ীফ সূত্রের কথা বলেছেন, আর একটা সূত্র সম্পর্কে বলেছেন, এ সূত্রে কোন আপত্তি নেই।
হাদীস দুটির সমর্থন রয়েছে সে দুটির সাধারণত্ব ও ব্যাপকতার মধ্যে, সাহাবীদের আমলে, পূর্বের লোকদের ইজমায়, সহীহ করা ও সুস্থ কিয়াসের মাধ্যমেও এর পশ্চাতে সমর্থন ও শক্তি সংগ্রহীত হয়েছে।
৩. ইমাম আবূ উবাইদ একটা তৃতীয় সংশয়ের উল্লেখ করেছেন, ফিকাহ্ ক্ষেত্রে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন এমন ব্যক্তির উত্থাপিত এ সংশয়। বলেছেন, ব্যবসায়ের পণ্যে মাল-সামানে কোন যাকাত নেই। কেননা তাতে যাকাত ধার্য করা হয়েছেতার মূল্য হিসেব করে অথচ যাকাত তো প্রতিটি জিনিসের মূল্য থেকেইদেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু মূল্য দিতে গেলে তা তো সেমাল-সামানের বাইরে জিনিস হয়ে গেল। কাজেই এ অর্থে ব্যবসায়ের দ্রব্যাদিতে যাকাত নেই।
আবূ উবাদ বলেছেন, এরূপ ব্যাখ্যা ভুল, তা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা রাসূলে করীম (স) থেকেই আমরা সুন্নাত লাভ করেছি যে, কোন মালে যাকাত ফরয হয়, পরে দাতার পক্ষে মূল্যের তুলনায় অন্য জিনিস থেকে আদায় করে দেয়া সহজ হয় বলে তা সেই দিকেই ফিরে যায়। নবী করীম(স) ইয়েমেনে জিযিয়া সম্পকেং হযরত মুআযের নামেযে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তাতেই লিখিত আছে:
(আরবী ***********)
প্রত্যক পূর্ণবয়স্ক ব্যকিতর উপর ইয়েমেনী কাপড় বাবদ এক দীনার অথবা তার মূল্য ধার্য হবে।
এ কথায় নবীকরীম(স) একটা জিনিসের আসলের পরিবর্তন তার নগদ অর্থ মূল্য গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন বলে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। নাজরানবাসীদের প্রতি লিখিত পত্রেও বলা হয়েছিল: তাদের প্রতি বছর দুই হাজার পোশাক (Garmants) অথবাতার বিনিময়ে দিরহাম (নগদ অর্থ) দিতে হবে। এতেও দেখা যায়, মূল্য- যার উপর যাকাত ফরয- এর পরিবর্তে তার মূল্য গ্রহণ করার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
‘জিযিয়া’ বাবদ স্বর্ণ-রৌপ্য নগদ অর্থ মূলত গ্রহণীয়। কিন্তু হযরত উমর (রা) তার পরিবর্তে উট গ্রহণ করতেন। হযরত আলী (রা) জিযিয়া বাবদ বিভিন্ন জিনিস গ্রহণ করছেন স্বর্ণ ও নগদ অর্থের পরির্তে।বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুআয মূল যাকাতেরই নগদ অর্থের বদলে জিনিস গ্রহণ করেছেন। তাঁর কথা ছিল: ‘হ্যাঁ তোমরা আমাকে কাপড় দিয়ে দাও, তা যাকাতের অর্থ বাবদ আমি নিয়ে নেব। কেননা তোমাদের পক্ষেও তা-ই সহজ। আর মদীনায় উপস্থিত মুহাজিরদের জন্যেও তা অধিক উপকারী।’ হযরত ইবনে মাস্উদের স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন: ‘আমার বিশ মিশকাল ওজনের একটা হার আছে।’ (তার যাকাত কিভাবেদেয়া হবে?) তিনি বলেছেন, ‘তার যাকাত বাবদ পাঁচ দিরহাম দিয়ে দাও।’ অথচ প্রতি দশ দিরহামের মূল্য এক মিশকাল সমান ছিল। আবূ উবাইদ বলেছেন, এ সব জিনিসই হক্ আদায়স্বরূপ গৃহীত হয়েছে যে মালেতা দার্য ও ফরয হয়েছে, তার পরিবর্তে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এ কথা বলা যায় না যে, তার যাকাত প্রত্যাহার করা হয়েছে। কেননা তা তো বাধ্যতামূলকভাবে দেয় হক্। কোন জিনিসই তা প্রত্যাহার করতে পারে না। তবে সে মালের মূল্য বাবদ অন্য জিনিস দেয়া হয়েছে িএই যা। কেননা তা দাতার পক্ষে সহজ ছিল। ব্যবসায়ের মাল-সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও তাই হবে। মূলত সেই জিনিসই যাকাত বাবদ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়; কিন্তু তা দাতাদের পক্ষে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াত তা কোটা কাটা বা অংশ বের করার জন্যে। এ কারণে তার মূল্য দিয়ে দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে মাত্র। তা হলে কথা দাঁড়াল, ব্যবসা দ্রব্যাদিতে যাকাত ফরয, এ ব্যাপারে মুসলমান সম্পূর্ণ একমত। এর বিপরীত বা অন্য কোন কথা বিশেষজ্ঞদের কথা নয়। স্মরণীয়, দ্রব্যসামগ্রী ও ক্রীতদাসে যাকাত হবে যদি তা ব্যবসায়ের জন্যে সংগ্রহীত হয়ে থাকে। অন্য কারণে হলে যাকাত ফরয হবে না। ব্যক্তিগত ব্যবহার ও কাজেকর্মে খেদমত লওয়ার জন্যে দাস রাখা হলে তার যাকাত দিতে হবে না। কার্যরত গরু বা উটেরও যাকাত দিতে হয় না। আর ব্যবসায়ের দ্রব্যাদি তো প্রবৃদ্ধি উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়ে থাকে, তার মুনাফা লাভই লক্ষ্য। এ দিক দিয়ে তা মুক্ত করে পালিত গবাদিপশুর মত- যা বংশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পালন হয়। আর এ কারণে তাতে অবশ্যই যাকাত ফরয হবে। তবে কথা হচ্ছে, এর প্রতিটি জিনিসের যাকাত সুন্নাত অনুযায়ী দেয়া হবে। ব্যবসায়ের দ্রব্যাদির যাকাত মূল্যের ভিত্তিতে দেয়া হবে। আর গবাদিপশুর যাকাত দিতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ বা পরিসংখ্যান হিসেবে। তাহলে যাকাত ফরয হওয়ার মূল কথায় আমরা একমত হলাম। পরে প্রত্যেকটি জিনিসের যাকাত তার জন্যে নির্দিষ্ট নিয়মে আদায় হওয়ার সাব্যস্ত হল।
এ কারণে আমরা মনে করি, জমহুর মুসলমানের কথাই যথার্থ ও সঠিক। ব্যবসায়ের দ্রব্যাদিতে যাকাত বাধ্যতামূলকভাবে ফরয। বিরুদ্ধ মতের লোকদের কোন কথাই জমহুর ফিকাহ্বিদদের যুক্তি-প্রমাণ এবং সাহাবী ও তাবেয়ীদের ইজমার সম্মুখে টিকতে পারে না।
খ. ইমামীয়া মতের ফিকাহ্বিদগণ মত গিয়েছেন যে, ব্যবসায়ের পণ্যাদিতে যাকাত ফরয নয়, মুস্তাহাব মাত্র।
তবে ব্যবসায়ের মুনাফার ব্যাপারে তাদের অপর একটি মত রয়েছে, তা হল, মুনাফার এক-পঞ্চমাংশ দিয়ে দেয়া ফরয (মূলধন থেকে নয়, মুনাফা থেকে দিতে হবে)। তাদের দলীল হল, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী ***********)
জেনে রাখো, তোমরা গনীমত বাবদ যে মালই পাবে, তার এক-পঞ্চমাংশ দেবে আল্লাহ্, রাসূল, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে।
এ আয়াতের ভিত্তিতে তাঁরা বলেছৈন, মানুষ তার উপার্জন, ব্যবসায়ের মুনাফা ও গনীমত ইত্যাদি থেকে যা-ই পায়, পরিভাষার দিক দিয়েই তাকে ‘গনীমতের মাল’ বলা যায়। আর মুনাফর এক-পঞ্চমাংশ দিতে হবে সারা বছরের সাংসারিক খরচপত্র করার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা থেকে। ‘জাওয়াহিরুল কালাম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে:
যেসব জিনিসের এক-পঞ্চমাংশ দেয়া ধার্য হয়েছে, তা দিতে হবে সারা বছরের যাবতীয় ব্যয়-ভার বহনের পর ব্যবসায়ের মুনাফা, শিল্প কার্য কৃষিকার্যের যা অবশিষ্ট থাকবে তা থেকে। এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই।
আহ্লে সুন্নাহ্ বলেছেন, ‘তোমরা যে জিনিস গনীমত স্বরূপ পাও-এই কথার অর্থ তা-ই হবে, যা রাসূলে করীম (স) বলেছেন। আর তা হচ্ছে, যুদ্ধের পরে পাওয়া গনীমতের মাল।’ ‘গনীমত’ বলে অভিহিত হতে পারে- এমন সব জিনিসথেকে তা দিতে হবে না। আয়াতটির পূর্ববর্তী আলোচনা থেকেও এ কথাই প্রমাণিত হয়। যদি এ আয়াতটিকে একটা সাধারণ নির্দেশ গণ্য করা হয় এবং তা সব কিছুতেইপ্রযোজ্র ধরা হয় তাহলে মীরাস বাবদ প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকেও এক-পঞ্চমাংশ দিতে হবে বলে মনে করতে হবে, কিন্তু তা ঐকমত্যের (ইজমা’র) সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। আর যে কথা অপর একটি বাতিল কথাকে বাধ্যতামূলক ককরে, নীতি হিসেবে তা-ও বাতিল মনে করতে হবে।
তৃতীয় আলোচনা
ব্যবসা-পণ্যে যাকাতের শর্ত
ফিকাহ্বিদদের দেয়অ সংজ্ঞা অনুযায়ী মালের বিনিময়ে মাল উপার্জন করাই ব্যবসা বলে অভিহিত। আর ক্রয়-বিক্রয়ের সূত্রে যা কিছু উপার্জনের জন্যে তৈরী করা হয়, তাই ব্যবসায়ের মাল- পণ্যদ্রব্য।
কেউ কেউ বলেছেন, মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্যে যা-ই প্রস্তুত করা হয়, তা-ই ব্যবসায়ের মাল- পণ্যদ্রব্য। অতএব মানুষ যে দ্রবসামগ্রী ক্রয় করে, তা সবই ব্যবসায়ের মাল নয়। কেননা মানুষ নিজের পরিধানের জন্যে কাপড় খরিদ করে, ঘরের আসবাবপত্র ক্রয় করে, যানবাহনের জন্যে ঘোড়া বা গাড়ি ক্রয় করে। এর কোনটিই পণ্যদ্রব্যরূপে গণ্য হবে না। তবে যা বিক্রয় করে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয় তা-ই পণ্যরূপে গণ্য।
এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্রবসায়ের জন্যে প্রস্তুতকরণের দুটি অংশ। িএকটি কার্যত আর অপরটি নিয়ত পর্যায়ের। কার্যত হচ্ছে ক্রয় ও বিক্রয়ের কাজটি। আর নিয়ত হচ্ছে, মুনাফা অর্জনের ইচ্ছা ও বাসনা। কাজেই কোন ক্ষেত্রে এ দুটির মাত্র একটি অংশের অবস্থিতিতে তা ব্যববা বলে হবে না, কেবল মুনাফা লারে ইচ্ছা ও নিয়ত হলেও তা ব্যবসা বলা যাবে না- কার্যত ব্যবসায়ের কাজটি অনুষ্ঠিত না হলে। আর ইচ্ছা ও নিয়ত ছাড়া কেবল ক্রয় বাবিক্রয় কাজটি হলেও তা ব্যবসা নামে অভিহিত হবে না।
কেউ যদি সম্পত্তি হিসেবে কোন জিনিস ক্রয় করে- যেমন কেউ গাড়ি কিনলো তাতে আরোহণ ও চলাচল করার উদ্দেশ্যে, সেই সাথে মনে মনে এ সংকল্পও নিল যে, মুনাফা পেলে সে তা বিক্রয় করে দেবে, এতেই সেটি ব্যবসায়ের মালবা পণ্য গণ্য হতে পারে না। কিন্তু যদি ব্যবসা করে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে কেউ অনেক কয়টি গাড়ী ক্রয় করে, আর তার কোন একটিতে যদি সে চলাচলও করে ও নিজের জন্যে ব্যবহারও করে এবং কাঙ্ক্ষত পরিমাণ মুনাফা পেয়ে সে তা কোন এক সময়ে বিক্রয় করে দেয়, তাহলে তা অবশ্যই ব্যবসা হবে। এই ব্যীক্তগত ব্যবহারে তার ব্যবসা হওয়াটা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হবে না। কেননা এ ক্ষেত্রে আসল নিয়ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কয় করা হবে, তাতে মুনাফা পাওয়া গেলে তা বিক্রয় করে দেয়ার শুধু নিয়ত থাকলেই তার ‘ব্যবসা’ হওয়া বিনষ্ট বা ক্ষুণ্ণ হয় না। আর সেখানে মূলত বিক্রয় করা ও ব্যবসা করা লক্ষ্য, শুধু ব্যক্তিগত ব্যবহারেই তা বিনষ্ট হয়ে যায় না-। তবে কোন ব্যবসা পণ্যকে যদি ব্যক্তিগত ব্যবহারে নিয়ে আসা হয়, তাহলে জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতে এই ইচ্ছাটুকুই সেই জিনিসকে ব্যবসায়ী জিনিসথেকে বের করে এনে ব্যক্তিগত অপ্রবৃদ্ধিশীল জিনিসে পরিণত করে দেবে।
কেউ কেউ এখানে আরও একটি শর্তের উল্লেখ করেছন। তা হল, বছরে দুইবার একই জিনিসের যাকাত গ্রহণের পথে কোন প্রতিবন্ধকের অনুপস্থিতি। ইবনে কুদামাহ বলেছৈন, একই কারণে একই বছরে ও একই জিনিসের দুইবার যাকাত ফরয করার পথে বাধা না থাকাও একটা শর্ত হবে। হাদীসের উদ্ধৃত হয়েছে’ (আরবী ******) ‘যাকাতের দ্বৈততা- দুইবার গ্রহণের অবকাশ নেই।’
প্রেক্ষিতে বলা যায়, কেউ যদি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্রে কোন কৃষিজমি ক্রয় করে, পরে তাতে সে চাষাবাদ করে ও এমনফসল ফলায়, যাতে ‘ওশর’ ফরয হয়, তাহলে এই ফসলের ‘ওশর’ দিয়েদিলেই সেই ব্রবসায়ের জন্যে খরিদ করা জমি-পণ্যের যাকাত আদায় হয়ে যাবে। সে জমি পণ্যে যাকাত আলাদাভাবেদেয়ার কোন প্রয়োজন হবে না। কেননা একই মাল থেকে একাধিকবার যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়। কোন কোন ফিকাহ্বিদ এর বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে ব্যবসায়ের যাকাতটাই প্রশান দেয় হবে। কেউ কেউ দুইবার যাকাত দেয়ার কথাও বলেছেন। কেননা একবার যাকাতরে যে কারণ, দ্বিতীযবার যাকাত দেযার কারণ তা থেকে ভিন্নতর ও স্বতন্ত্র। অতএব তাকে ‘দ্বৈত’ বলা চলে না। পরে এ বিষয়ে আরও কথা বলা হবে। পণ্যদ্রব্য কি, কি নয় সে বিষয়ে আলোচনার পর তা যাকাত এর শর্ত পর্যায়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীর মূলধন, হয় নগদ টাকা হবে, না হয় হবে পণ্যদ্রব্য- যার মুল্য নগদ টাকার হিসেব করা হবে। যদি নগদ সম্পদ হিসেবেথাকে, তাহলে সে বিষয়ে কোন কথার প্রয়োজন নেই। দ্রব্যসামগ্রী হয়, তাহলে নগদ সম্পদে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যা শর্ত, এ ক্ষেত্রেও সেই শর্ত ধার্য হবে অর্থাৎ মালিকানায় একটি বছর পূর্ণ হওয়া, নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা, সর্বপ্রকার ঋণমুক্ত হওয়া এবং মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। আমরা পূর্বেই বলেছি, এ কালে নগদ সম্পদের যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে যা ৮৫ গ্রাম স্বর্ণের সমান মূল্যের হবে।
-কিন্তু নিসাবের পূর্ণত্ব কখন ধরা যাবে?
-কেবল বছর শেষেই কি গণনা করাহবে?
-অথবা শুধু বছরের শুরুকালে ও শেষকালে তাথাকলেচলবে- মাঝখানের কোন হিসাব না করেই?
এর জবাবে ফিকাহ্বিদদের তিনটি কথা আছে:
প্রথম, ইমাম মালিকের কথা এবং ইমাম ইমাম শাফেয়ীর উদ্ধৃতি। তা এই যে, শুধু বছরের শেষের হিসাবটাকেই ধরা হবে। তখনকার মূল্যটাই বিবেচ্য বিষয় হবে। কেননা সব সময় মূল্যের হিসাব করা কঠিন। তাই যে সময় যাকাত ফরয হচ্ছে, সেই সময়ের মূল্যটা গণ্য করা হবে। আর তা হচ্ছে বছরের শেষ সময়। অন্যান্য যাকাতের জিনিরে অবস্থা এ থেকে ভিন্ন। কেননা তার নিসাব তো সেই মূল জিনিস থেকেই নেয়া হয়। কাজেই তার নিসাব ও গণণা কঠিন নয়।
দ্বিতীয় কথা, সারাটি বছরের নিসাব গণ্য করতে হবে। কখনও নিসাবের কম হয়ে গেলে বছর গণণা সেখানে ছিন্ন হয়ে যাবে। কেননা এই মালের হিসাবে পূর্ণ বছরটাকেই ধরা হয়। কাজেই যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে সারা বছর নিসাব পরিমাণ অক্ষুণ্ণভাবে বর্তমান থাকা আবশ্যক। ইমাম সওরী, আহমদ, ইসহাক, আবূ উবাইদ, আবূ সওর ও আবুল মুনযিল প্রমুখ ফিকাহ্বিদও এ কথাই বলেছেন।
তৃতীয় কথা, নিসাবের অবস্থা বছরের শুরুতে ও শেষে বর্তমান থাকাটাই গণ্য ও যথেষ্ট। মাঝখানে তা না থাকলেও যাকাত ফরয হওয়া কোন বাঁধা নেই। বছরের এ দুই তরফে নিসাব পরিমাণ থাকলেই যাকাত ধার্য হবে। মাঝখানে তা কম হয়ে গেলে কোন অসুবিধা হবে না। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর সঙ্গিগণ এ মত পোষণ করেন। এঁদের দলীল প্রথমোক্ত কথার যে দলীল, তা-ই। অর্থাৎ সারাটি বছর মূল্য হিসাব করা কঠিন বিধায় শুধু বছরের শুরু ও শেষের হিসাবই যথেষ্ট। কেননা পণ্যের মূল্য জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে তা নিসাব পরিমাণ হয় কি না, তা জানা। আর তা প্রতি মুহুর্তে জানতে পারা যেমন কঠিন, তেমনি খুবই অসুবিধাজনকও। ফলে তা মাফ করে দেয়া হয়েছ এবং শুধু বছরের শুরু ও শেষেকেই নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
কেউ যদি এমন পণ্যের মালিক হয়, যা নিসাব পরিমাণের কম এবং তার উপর অর্ধেক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। পরে তার প্রবৃদ্ধির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে গেল অথবা মূল্য পরিবর্তিত হয়ে তা নিসাব পরিমাণ হয়ে গেল কিংবা তা বিক্রয় করল নিসাব পরিমাণ মূল্যে অথবা বছরের মধ্যেই অপর একটা পণ্য বা নগদ সম্পদের মালিক হওয়ার দরুন তার নিসাব পূর্ণ হয়ে গেল। এ সময় বছর শুরু হল তখন অতীতে যা ছিল তা গণ্য করা হবে না। এটাই জমহুর ফিকাহ্বিদদের মত।
কিন্তু ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী’র মত হচ্ছে, নিসাবের কম পরিমাণে বছর শুরু হলেও কেবল বছর শেষেই নিসাব পরিমাণ শর্ত। তা যদি হয়, তাহলে যাকাত ফরয হয়ে যাবে।
এ পর্যায়ে ইমাম মালিক থেকেবর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি পাঁচ দীনারের মালিকহয়- এ পরিমাণটা নিসাব পরিমাণের এক-চতুর্থাংশ মাত্র-পরে তা নিয়ে সে ব্যবসা করে ও তার উপর একটি বছর পূর্ণ হয়ে যায় এবং তাতে তার নিসাব পরিমাণ সম্পদ হয়ে যায়, তাহলে তার যাকাত দিতে হবে।
এ গ্রন্থকারের মতে ইমামমালিকের মতটাই গ্রহণীয়। শাফেয়ীদের কাছে তা-ই সহীহতম। কেননা সে জিনিসের নিসাবের একটি বছর পূর্ণ হওয়াটা প্রমাণিত হয়নি। কোন সহীহ মরফু’ হাদীসও তার পক্ষে নেই। বছর পূর্ণ হওয়া কালে নিসাব পূর্ণত্ব লাভ করলেইতা গণ্য করা যেতে পারে। মুসলমানের যাকাত-বছরের সূচনাটাই গণ্য করতে হবে। প্রতি বছরের সে নির্দিষ্ট সময়টি উপস্থিত হলে যে যে মালের মূল্য নিসাব পরিমাণ হয়ে গেছে, তখন তার যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝখানে নিসাবের কম হলে তা ধর্তব্য হবে না।
সরকার যদি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে, তবে সরকারী পক্ষ থেকেই একটা সময় নির্দিষ্ট করে দিতে পারে প্রতিবছরের যাকাত দেয়ার জন্যে। সে নির্দিষ্ট সময়ে যার যার মালিকানা নিসাব পরিমাণ পাওয়া যাবে, তার কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে। যদিও কারোর নিসাব একটি বছর পূর্ণ বয়সের হয়নি, হয়েছে মাত্র কয়েক মাসের- তবুও।
গবাদিপশুর যাকাতের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিলনবীকরীমও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে। তখন যাকাত আদায়কারীরা নির্দিষ্ট সময় হলে নিসাব পূর্ণ হওয়ার শর্তে যাকাত আদায় করে নিত। সে নিসাব কবে বা কখন পূর্ণত্ব পেয়েছে এ প্রশ্ন করতো না। যাকাত গ্রহণের সময় নিসাব পূর্ণ হওয়াটাই যথেষ্ট ছিল। তারপর চন্দ্র বছরের একটি বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তার কাছ থেকে আর যাকাত গ্রহণ করা হত না।
চতুর্থ আলোচনা
ব্যবসায়ী তার ব্যবসা সম্পদের যাকাত কিভাবে দেবে
ব্যবসায়ী তার যে সম্পদ ব্যবসায়ের কাজে বিনিয়োগ করে, তার নিম্নোদ্ধৃত তিনটি বা ততোধিক অবস্থার কোন একটি অবশ্যই দেখা দেবে:
১. হয় ব্যবসা সম্পদ পণ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের আকারে থাকবে, যা ব্যবসায়ী একটা মূল্য দিয়ে ক্রয় করে, পরে তা বিক্রয় করে না।
২. অথবা তা উপস্থিত নগদরূপে থাকবে, যা কার্যত তার হাতে সঞ্চিত হবে অথবা তার কর্তৃত্বাধীন ব্যাংকের হিসাবে জমাকৃত থাকবে।
৩. অথবা তা তার কর্মচারীদের অথবা অন্যান্যদের কাছে ঋণবাবদ দেয়া হয়েছে- এ হিসেবে থাকবে। ব্যবসায়ের প্রকৃতি ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে তাই স্বাভাবিক। আর এ-ও স্বাভাবিক যে, এভাবে প্রদত্ত ঋণের অনেকগুলো ফেরত পাওয়ারই আশাথাকে না, অবশ্য অনেকগুলো ফেরত পাওয়ার আশাও থাকে।
ব্যবসায়ী নিজের দেয়া ঋণ যেমন অন্যদের উপরথেকে- তার পাওয়ারূপে, তেমনি তাঁর উপরও অনেক ঋণ থাকে- তার উপর পাওনা হিসেবে যা তাকে দিতে হবে। এ কথা আমরা নিশ্চিয়ই ভুলে যাইনি।
এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যবসায়ী তার এ বিভিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকা সম্পদ ও ধনের যাকাত কি করে দেবে?
এ প্রশ্নের জবাবে আমরা তাবেয়ী ইমামগণ থেকে বর্ণিত মতসমূহ উদ্ধৃত করব, যার উল্লেখ করেছেন ইমাম আবূ উবাইদ।
মায়মুন ইবনে মাহ্রান বলেছেন, তোমার যাকাত দেয়ার সময় উপস্থিত হলে তুমি লক্ষ্য কর, তোমারকাছে নগদ কি আছে, কি আছে পণ্যদ্রব্য।তার নগদ মূল্য ধার্য কর। আর ফেরত দিতে সক্ষম- এমন সচ্ছল লোকেরকাছে যা ঋণ হিসেবে তোমার পাওনা আছে তা থেকে তোমার উপর যে ঋণ অন্য লোকের পাওনা আছে তা দিয়ে অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদের যাকাত দেবে।
ইমাম হাসান বসরী বলেছেন, একজনের যাকাত দেয়ার নির্দিষ্টমাস উপস্থিত হলে তার কাছে রক্ষিত সব সম্পদ, ব্যবসায়ের জন্যে ক্রয় করা সব জিনিস ও সব ঋণ বাবদ নেয়া মালেরও যাকাত দেবে। যে ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা নেই, তা অবশ্য বাদ দেবে।
ইবরাহীমনখয়ী বলেছে, ব্যক্তি তাঁর ব্যবসায়ে নিযোজিত সমস্ত সম্পদের মূল্যায়ন করবে, তাতে যাকাত হলে যাকাত দিয়েদেবে তার অন্যান্য সব মালের যাকাত সহকারে। ফিকাহ্র এ ইমামগণের কথা থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, মুসলিম ব্যবসায়ীর যাকাত দেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলে তার মালসমূহ পরস্পরের সাথে মিলিয়ে হিসাব করবে, মূলধন, লব্ধ মুনাফা ও সঞ্চিত সম্পদ এবং ফেরত পাওয়ার আশার ঋণসমূহ। তার ব্যবসায়কে আলাদা করে মূল্যায়ন করবে এবং তার পণ্যদ্রব্যসমূহের মূল্য নগদ সম্পদের সাথে মিলিয়ে হিসাব করবে। তা ব্যবসায়ে নিয়োজিত হয়েছে কি হয়নি, তাতে কোন পার্থক্য হবে না। তার সাথে মিলাবে সে সব দেয়া ঋণ, যা ফেরত পাওয়ার আশা থাকবে। আর এ সব কিছু থেকে এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ- শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে- যাকাত বাবদ দেবে। যে ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা নেই, তার যাকাত দিতে হবে না বলেই আমরা মত দিয়েছি। তবে কখনও তা হাতে ফেরত পাওয়া গেছে তখন মাত্র এক বছরের যাকাত দিতে হবে। আর তার উপর যে ঋণ আছে তা তার সমস্ত মালের হিসাব থেকে বাদ দেবে। তারপরে যা অবশিষ্ট থাকবে তার যাকাত দিয়ে দেবে।
মজুদদার ব্যবসায়ী ও চলতি বাজার দরে বিক্রয়কারী ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য
উপরে জমহুর ফিকাহ্বিদদের মত উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু ইমাম মালিক এ ক্ষেত্রে একটা ভিন্নমত পোষণ করে। তিনি ব্যবসায়দের দু’ভাগে ভাগ করেন। এক ভাগে যে সব ব্যবসায়ী গণ্য, যারা চলতি বাজারদরে পণ্য বিক্রয় করে।তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ের কোন সময় সুনির্দিষ্ট নেই। ইমাম মালিক মনেকরেন, এ ব্যবসায়ীরা প্রতিটি বছর শেষহলেই তাদের দ্রব্যাদি ও পণ্যদির যাকাত দিয়েদেবে, যদিও তিনি বছরের শুরুতে নিসাব পরিমাণ থাকার শর্ত করেছেন- যেমন পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি।
অপর শ্রেণীর ব্যবসায়ী- যারা পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে এবংতার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে- ইমাম মালিক তাদের মজুদদারী বলে অভিহিত করেছেন। যেমন বহু লোক জমি সম্পত্তি ক্রয় করে এবং একটা সময়কাল অপেক্ষা করে বাজারের প্রতি কড়া নজর রাখে। যখন তার বাজার দাম বৃদ্ধি পেয়ে যায়, তখন তা বিক্রয় করে। ইমাম মালিক মনে করেন, বছরের পুনরাবৃত্তির দরুন যাকাত ফরয হওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। তাই যখন সেই সম্পত্তি বিক্রয় করে দেবে, তখন সে এক বছরের যাকাত দিয়ে দেবে, যদিও তা তার কাছে কয়েক বছর অবধি আটক রয়েছে।
ইবনে রুশ্দ তাঁর এ মত বিশ্লেষণে যা কিছু বলেছেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা আছে:
ইমাম মালিক বলেছেন, পণ্য যখন বিক্রয় হবে, তখন তার এক বছরকালের যাকাত দিয়ে দেবে। যেমন ঋণের অবস্থা। যে ব্যবসায়ীর পণ্য ক্রয়ের কোন সময় সুনির্দিষ্ট নয়, তারা ‘আবর্তনকারী’ বলে অভিহিত- তাদের ব্যবসা শুরু করার দিনথেকে একটি বছর পূর্ণ হলেতার কাছে ব্যবসায়ের দ্রব্য যা আছে তার মূল্য নির্ধারণ করবে এবঙ তার সাথে তার কাছে রক্ষিত সম্পদ হিসেবে মিলাবে। এবং সেই ঋণ বাবদ দেয়া টাকা যা ফেরত পাওয়ার আশা আছে। এতে নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলে তার যাকাত দিয়ে দেবে।
ইমাম শাফেয়ী, আবূ হানীফা, আহমদ, সওরী ও আওযায়ী প্রমুখ জম্হুর ফিকাহ্ বিদগণ বলেছেন: এ উভয় ধরনের ব্যবসায়ীরা আসলে এক ও অভিন্ন। যে-ই কোন পণ্য ক্রয় করবে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তার উপর একটি বছর অতিবাহিত হবে, সে-িই তার মূল্য ধরে তার যাকাত দেবে।
ইবনে রুশ্দ ইমাম মালিকের মতের সমালোচনা করে বলেছেন, এ মতটি যেন একটি অতিরিক্ত বিধি, সপ্রমাণিত শরীয়াত থেকে বের করে নেয়া বিধি মনে হয়। ‘মুরসাল কিয়াসের’ সাহায্যে এ ধরনের মতই পাওয়া যায়। তাতে কোন অকাট্য দলীলের ভিত্তি গ্রহণ করা হয় না। শুধু শরীয়াতী মুসলিহাত-কল্যাণ বিবেচনাই হয় একমাত্র ভিত্তি। আর ইমাম মালিক এ ধরনের কল্যাণ চিন্তার উপর কুবই গুরুত্ব আরোপ করেন, যদিও তার পশ্চাতে নির্ভরযোগ্য কোন মূল দলীল বর্তমান নেই।
সত্যি কথা এই যে, দলীলের দিক দিয়ে জম্হুর ফিকাহ্বিদদের মত ইমাম মালিকের মত অপেক্ষা শক্তিশালী। ব্যবসায়ী দ্রব্যাদিতে যাকাত ফরয মনে করার গণনাযোগ্য ভিত্তি হচ্ছে এই যে, তা প্রবৃদ্ধির অপেক্ষায় ক্রয় করা মাল-নগদ সম্পদের মতই। তা কার্যত বৃদ্ধি পেয়েছে কি পায়নি তাতে কোন পার্থক্য নেই। মুনাফা করেছে কি করেনি বা লোকসান হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও কোন গুরুত্ব নেই। ব্যবসায়ী যে-ই হোক, আবর্তনশীল হোক কি মজুদদারী- নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই তাকে যাকাত দিতে হবে।
তা সত্ত্বেও ইমাম মালিক ও সহ্নূনের মত একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। বিশেষ করে মন্দভাব বা ধ্বংসকবালে যখন কোন বিপর্যয়কর অবস্থা দেখা দেবে কোন ব্যবসায়ীর উপর, ব্যবসায়ীর পণ্য বিক্রয় হয় না, বিক্রয় হলেও মুনাফা হয় না, লোকসান হয়, তখন কার্যত যা বিক্রয় হবে কেবল তারই যাকাত গ্রহণ করা যেতে পারে। আর যে যে পণ্যে এবিপদ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, তার যাকাত মাফ করাই বাঞ্ছনীয়। কেননা পণ্যের বিপদগ্রস্ত হওয়ার তার কোন হাত নেই, সে নিজে এ জন্যে দায়ী নয়।
স্থিতিশীল পণ্যের যাকাত নেই
যে ব্যবসায়ের মূলধনের যাকাত দিতে হবে, তা প্রবাহমান ও আবর্তনশীল হবে। নির্মিত প্রতিষ্ঠান-দালান কোঠা, ঘরবাড়ি ও ব্যবসায় কেন্দ্র স্থাপনের সম্পদ-সম্পত্তি- যা বিক্রয় করাহয় না, নড়ানোও হয় না- সম্পদের মূল্য ধরার সময় তা গণ্য করা হবে না। তার যাকাতও দেয়া লাগবে না। ফিকাহ্বিদগণ উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়ের পণ্য তা, যা মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ক্রয় বিক্রয় করা হবে। এ পর্যায়ের দলীল হযরত সামুরা বর্ণিত হাদীস যা আলোচনার শুরুতেই উদ্ধৃত করেছি- নবী করীম(স) আদেশ করতেন- আমরা যা বিক্রয়ার্থে তৈয়ার করি তার যাকাত দিতে।
এ প্রেক্ষিতে ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, পণ্যদ্রব্য যেসব পাত্রে রাখা হয়, পিঞ্জর ও দাঁড়ি-পাল্লা, এবং খন্তা, কুড়াল, করাত, লাঙ্গল-ট্রাক্টর, হাল-ব্যবসা সংক্রান্ত বা কৃষিকাজের এ সব যন্ত্রপাতির কোন যাকাত দিতে হবে না। কেননা এ জিনিসগুলো থেকে যায়, বিক্রয় হয়ে যায় না। ফলে তা সরঞ্জামের মধ্যে গণ্য, পণ্যে নয়। এগুলো ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পদ, প্রবৃদ্ধির জন্যে তৈয়ার করা বা রাখা হয়নি।
কেউ কেউ এসব জিনিসের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য করে বলেছেন, ব্যবসায়ের জন্যে জরুরী দ্রব্যসামগ্রী, আতর বিক্রেতার শিশি, বস্তা-ব্যবসায়ীরা যা ব্যবহার করে, ঘোড়ার জিন ইত্যাদি অশ্ব ব্যবসায়ী যা রাখে- এগুলো সহ পণ্য বিক্রয় করার নিয়ত থাকলেতা-ও পণ্যদ্রব্য হবে। আর তা বিক্রয়ের ইচ্ছা না থাকলে ও এগুলো থেকে গেলে, হিসাবে এগুলো ধরা হবে না।
যাকাত দেয়ার সময় পণ্যদ্র্রব্যের মূল্য কোন্ দরে হিসাব করা হবে
স্থাপর সম্পত্তি প্রভৃতি বিক্রয়ের জন্যে প্রস্তুত করা হয়নি এমনসব জিনিস বাদ দিয়ে যেসব পণ্যদ্রব্যের একটি বছরকাল কারোর মালিকানায় অতিবাহিত হয়েছে, তার হিসাব করে মূল্য ধরে যাকাত দিতে হবে।
কিন্তু ব্যবসায়ী কোন্ দামে বা দরে এ সব জিনিসের মূল্য ধরবে? … অথবা সরকার নিয়েঅজিত যাকাত আদায়কারীই তা কোন্ দরে নিসাব করবে?
ক. সাধারণভাবে সকলেরমধ্যে প্রচলিত নিয়ম হল, যাকাত ফরয হওয়ার সময় চল্তি বাজার দর- যে দামে পণ্য সাধারণত বিক্রয় হচ্ছে- সেই দামে হিসাব করবে। তাবেয়ী ফিকাহ্বিদ ইবনে জাবির ব্যবসা পণ্য সম্পর্কে এ মত দিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন যে, যাকাত ফরয হওয়ার দিন সেই জিনিসগুলোর যে মূল্য থাকবে, সেই মূল্য ধরে হিসাব করতে হবে এবং তারই যাকাত দিতে হবে। ফিকাহ্বিদদেরও এটাই মত।
খ. হযরত ইবনে আব্বাস বলছিলেন, যাকাত ফরয হওয়ার পরও পণ্যবিক্রয় হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা কোন দোষেরকাজ হবে না।
অর্থাৎ পণ্য কার্যত বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে যাওয়ারসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কেননা পণ্য যে মূল্যে বিক্রয় হওয়ার, প্রকৃত সেই মূল্যটার ভিত্তিতেই গোটা সম্পদের মূল্যায়ন প্রয়োজন, এ কারণে এ মতটি দেয়া হয়েছে।
গ. ইবনে রুশ্দ উল্লেখ করেছেন, কোন কোন ফিকাহ্বিদ বলেছৈন, পণ্য যে মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে সেই মূল্য ধরে যাকাত দিতে হবে, তার বর্তমান মূল্যে নয়। কিন্তু ইবনে রুশ্দ কারোর নাম বলেন নি, কোন দলীলেরও উল্লেখ করেন নি।
ব্যাপারটির দুটি অবস্থা হতে পারে। হয় দাম কমে যাবে, তাহলে ক্রয়মূল্য ধরে নিসাব করলে ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথবা মূল্য বেড়ে যাবে।তাহলে নিয়োজিত মূলধনের যাকাত লওয়া হবে- যদি ক্রয়মূল্য হিসাব ধরা হয়- আর তাতে মুনাফা বাদ পড়ে যাবে।
অথচ মূলধন ও তার মুনাফা উভয়ের একত্রে যাকাত আদায় করাই সর্বজনপরিচিত তখনকার সময়ের বাজার দরের ভিত্তিতে পণ্যের মূল্যের হিাসবকরণ, কেননা প্রয়োজনে খুব কম দরেও পণ্য বিক্রয় হয়ে যেতে পারে।
ব্যবসায়ী মূল ব্যবসা দ্রব্য থেকে যাকাত দেবে, না তার মূল্য থেকে
ব্যবসায়ী দ্রব্যাদির মূল্যায়ন করবে। তার প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবসায়ী যাকাত দেবে কোথা থেকে? ব্যবসার দ্রব্যাদির অংশ যাকাত বাবদ দিয়ে দেবে, না নগদ মূল্য দিয়ে তা আদায় করবে?
এই পর্যায়ে কয়েকটি মত প্রকাশিত হয়েছে:
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফেয়ীর একটি মত এই যে, ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য থেকে বা মূল পণ্য দিয়ে যাকাত দিতে পারে- এক্ষেত্রে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। যেমন কাপড়ের ব্যবসায়ী কাপড় দিয়েই যাকাত দিতে পারে, তার নগদ মূল্য দিয়েও যাকাত আদায় করতে পারে। যে পণ্যে যতটা যাকাত ধার্য হবে সেই মূল জিনিস দিয়েই যাকাত দেবে-অন্যান্য সমস্ত ধন-মালের মতেই।তাতে কোন অসুবিধা নেই।
ইমাম শাফেয়ীর আর একটা মত হচ্ছে, মূল জিনিস দিয়ে নয়, জিনিসের মূল্য দিয়ে যাকাত দেয়াই ওয়াজিব। কেননা নিসাব তো মূল্যের হিসাবে ধরা হবে। তাই তা দিয়ে যাকাত দিলে সেই মূল পণ্য থেকেই দেয়া হল মনে করতে হবে।
‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, আমরামনেকরি না যে, যাকাত মালের উপর ফরয হয়, আসলে ফরয হয় তার মূল্যের উপর।
এ মতটিকে আমি অগ্রাধিকার দিচ্ছি শুধু দরিদ্রদের জল্যাণের দিকে নজর রেখে। কেননা জিনিস না দিয়ে নগদ পয়সা দেয়া হলে দরিদ্র ব্যক্তি প্রয়োজনমত জিনিস ক্রয় করে নিতে পারে। আর কোন জিনিস দিলে তাতে তার কোন কাজ হয় না। অনেক সময় সেই জিনিসটির যাকাত বাবদ যা দেয়া হবে- তার কোন প্রয়োজনেই আসবে না বলে সে তা বিক্রয় করে ফেলতে বাধ্যহবে এবং তা নিশ্চয়ই কম দামে বেঁচবে। এ মতটা মেনে নেয়া যেতে পারে, বিশেষ করে সরকারই যখন যাকাত আদায় ও বন্টন করবে তখন। কেননা তার পক্ষে এটাই শোভন ও সহজ।
তবে প্রথম মত অনুযায়ী কাজ করা যেতে পারে একটি মাত্র ব্যতিক্রমধর্মী সময়ে। তা হচ্ছে, যে-ব্যবসায়ী যাকাত দিচ্ছে, সে যদি বিশেষ কোন দরিদ্র ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পারে যে, এ জিনিসটি তার প্রয়োজন এবং সে জিনিসটি যদি তাকেযাকাত বাবদ দিয়েদেয়, তাহলে তাতে তার উপকারও হয়। আসলে ব্যাপারটি সাধারণ কল্যাণ ও সুবিধার দৃষ্টিতে বিবেচ্য, এ ব্যাপারে অকাট্য দলীল বলতে কিছুই নেই।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা তাঁর ফতোয়ায় এ মতের পক্ষেই কথা বলেছেন। তাঁকে ব্যবসায়ী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যেসব জিনিসের উপর যাকাত ফরয হয়েছে, সে জিনিসের কোন অংশ দিয়ে যাকাত দিয়ে দেয়া কি তার পক্ষে জায়েয? তিনি এর জবাবে কয়েকটি কথা বলেছেন:
১. হ্যাঁ, জাযেয, কোনরূপ শর্ত ছাড়াই,
২. না, জায়েয নেই, বিনা শর্তে,
৩. প্রয়োজনবশত অথবা অধিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ সময়ে তা জায়েয।
তিনি বলেছেন, সব কয়টি মতের মধ্য এ শেষোক্ত মতটিই অধিক ভারসাম্যপূর্ণ। যাকাত গ্রহণকারী যদি প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পোশাক করতে চায়, তাহলে যাকাতদাতা তার জন্যে তা ক্রয় করে দিতে পারে। তা করা হলে বলা যাবে, তার প্রতি সে ইহসানই করেছে। আর ব্যবসায়ীর কাছে রক্ষিত কাপড়েরর মূল্য ধরে যদি দিয়ে দেয় তাহলে হয়ত সে বাজার দরের তুলনায় বেশী দাম ধরবে, আর তা নেবে এমন ব্যক্তি, যার সেই কাপড়ের কোন প্রয়োজন নেই। তখন সে তা বিক্রয় করে দেবে, ফলে তাকে অনেক খোসরতও দিতে হতে পারে। পরিণামে যাকাত গ্রহণকারী গরীব ব্যক্তিটির বড় ক্ষতি হওয়ার আশংকা।
পঞ্চম অধ্যায়
কৃষি সম্পদে যাকাত
মানুষের প্রতি আল্লাহর অপার-অসীম নিয়ামত হিসেবেই তিনি এই পৃথিবীকে মানুষের জন্যে সুসজ্জিত ও বাসোপযোগী বানিয়েছেন। এই যমীনকে উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে তৈরী করেছেন। তার উপর আল্লাহ্র প্রাকৃতিক বিধান কার্যকর করেছেন। মানুষেররিযিক ও জীবন-জীবিকার প্রথম উৎস বানিয়েছেন এই জমীনকে। এই জমীনই স্থিতি-স্থাপনের ক্ষেত্র। তা এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের জীবনে যে, পাশ্চাত্যের কোন কোন অর্থনীতিবিদ কেবলমাত্র কৃষি জমির উপর কর ধার্যকরণ ও অন্য কোন কিছুর উপর কোনরূপ কর ধার্য না করার প্রস্তাব করেছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে এই জমিই হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস।
বস্তুত যে লোকই তার সহজ দৃষ্টিতে আল্লাহ্র অনুগ্রহ বিচার করবে সে-ই এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হবে। কেননা তিনিই তো জমিকে মানুষের অদীন, নিয়ন্ত্রিত, নম্র, মসৃণ ও চাষাবোদযোগ্য বানিয়েছেন। তাতে প্রবৃদ্ধি সাধনের উর্বরা ক্ষমতা রেখেছেন এবং পরিমিত পরিমাণ রিযিক উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছেন। এভাবেই এই মহাসম্মানিত সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করেছেন।
আল্লাহ্ নিজেই ইরশাদ করেছেন: (আরবী **********)
আমরাই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছি জমীনের বুকে এবং তাতেই সংরক্ষিত করেছি তোমাদের জীবন জীবিকা। তা সত্ত্বেও তোমরা খুব সামান্যই শোকর কর।
বস্তুত জমীনে বপনকৃত বীজ ও দানা জীবন্ত হতে, বড় হতে ও ফল ধারণকরতে যেসব মৌল উপাদানের মুখাপেক্ষী হয়, তা-ই প্রাকৃতিক নিয়ম ও জীবনের কার্যকারণ- তা যদি আমরা অনুধাবন করতে পারতাম তাহলে আল্লাহ্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও বিচিত্র বিস্ময়কর ধরনের অনুগ্রহের কথা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হত।
সত্যি কথা, সব মাটি উর্বরা শক্তিসম্পন্ন ও উৎপাদনশীল নয়। এই কারণে বীজের প্রয়োজনীয় খাদ্যোপকরণসম্পন্ন বিশেষ মাটির প্রয়োজন শস্যোৎপাদনের জন্যে। তাহলে কে জমিকে উৎপাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় উকরণসম্পন্না বানিয়েছে?
বীজের বেঁচে থাকা ও গাছে পরিণত হওয়ার জন্যে পানির প্রয়োজন। পানি না পেলে তার মৃত্যু অবধারিত। আকাশ থেকে নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি বর্ষানোর অথবা খাল-নদী-ঝর্ণা থেকে পানির পরিমিত প্রবাহ সৃষ্টির ব্যবস্থা কে করেছেন?…. তা এতটা পরিমিত যে, পানির জোয়ারে লোক ডুবেও যায় না, ক্ষেত ও পশুকুল মরে ভেসেও যায় না।
উদ্ভিদের শোষণের জন্যে গ্যাস প্রয়োজন। বাতাসে এই প্রয়োজনীয় গ্যাসের ব্যবস্থা কে করে রেখেছেন? উদ্ভিদকে সেই কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নেয়ার শিক্ষা কে দিল, যা মানুষ ও জীবজন্তু বাইরে নিক্ষেপ করে? এই একক বিনিময় ব্যবস্থার দরুনই তো প্রাণী জগত ও উদ্ভিদ জগতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
উদ্ভিদের জন্যে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ আলো ও তাপের প্রয়োজন। তা মাত্রাতিরিক্ত হলে সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর প্রয়োজনীয় মাত্রার কম হলে তা মরে যাবে। তাহলে সূর্যকে সৃষ্টি করে এই কাজে কে নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত করছে? এবং তার মধ্যেএ সব বিশেষত্ব কেই বা গচ্ছিত রেখেছে পৃথিবীর উপর সূর্যের এ আলো-তাপ বিকীরণের কার্য কে করাচ্ছে তা এমনভাবে সুসম্পন্ন হচ্ছে যে, জীবন্ত জগত অতিরিক্ত শৈত্যে বরফাচ্ছাদিত হয়ে মরে যাচ্ছে না এবং সীমাতিরিক্ত তাপেসব জ্বলে পুড়েও যাচ্ছে না।
শুষ্ক স্থির বীজের মধ্যে জীবন প্রবর্তন ও নিপুলতা সৃষ্টির যোগ্যতা কে দিয়েছে? একটা খেজুর দানা কি করে একটা বড় গাছে পরিণত হয়ে বিপুল সংখ্যক খেজুর কাঁদি ঝোলাতে পারছে কে একটা শ্য দানা সাতটি ছড়া এবং প্রতিটি ছড়া একশ’টি দানা উৎপাদন করতে পারছে কি করে?
তিনিই আল্লাহ্। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়। আর কারোরই এরূপ করার ক্ষমতা নেই। তিনিই এ সব করেন, করেন খুবই উত্তমভাবে, পরিমিত পরিমাণে। তাঁর এই ব্যবস্থাপনা যেমন নিখুঁত, তেমনি সুষ্ঠু। তাই কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে তিনি যদি মানবতার উপর তাঁর তুলনাহীন অনুগ্রহের অবদান হিসেবে এগুলোর উল্লেখ করে থাকেন, তাহলে তা বিস্ময়ের কিছু নয়। যেমনতিনি বলেছেন:
(আরবী **********)
তোমরা কি কখনও ভেবে দেখেছো, তোমরা যে বীজ বপন কর তা দিয়ে তোমরাই কি ফসল ফলাও কিংবা এ সবের ফসল ফলানোকারী আমরা? আমরা চাইলে এ ফসলগুলোকে কৃষি বানিয়ে দিতে পারতাম। আর তোমরা নানা কথা বলার মধ্যে ব্যস্ত থাকতে, যে আমাদের উপর তো উল্টা চাবুক পড়েছে। বরং আমাদের ভাগ্যই মন্দ হয়ে গেছে।
আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেছেন:
(আরবী **********)
আমরা জীমনীকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পাহাড় গেঁড়ে দিয়েছি, তাতে সব জাতির উদ্ভিদ যথাযথভাবে মাপা-জোঁকা পরিমাণ সহকারে সৃষ্টি করেছি। এবং তাতে জীবিকার উপকরণ সংগ্রহকরেদিয়েছি তোমাদের জন্যইআর সেই অসংখ্য সৃষ্টির জন্যেও, যাদের রিযিক্দাতা তোমরা নও। কোন জিনিসই এমন নেই, যার সম্পদের স্তূপ আমার কাছে মজুদ নয়। আর যা-ই আমরা নাযিল করি, তা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে নাযিল করি। ফলদায়কবায়ু আমরাই পাঠাই, পরে পানি বর্ষণ করি। আর সেই পানি দ্বারা তোমাদের সিক্ত করি। এই সম্পদের খাজাঞ্চি তো তোমরা নও।
তিনি আর বলেছেন: (আরবী **********)
মানুষ যেন তার খাদ্যের প্রতি খনিকটা দৃষ্টি দেয়। আমি প্রচুর পানি ঢেলেছি, এদিকে মাটিকে বিস্ময়করভাবে দীর্ণ করেছি। অতঃপর তাতে উৎপাদিত করেছি শস্য, আঙুর, তরি-তরকারী, জয়তুন, খেজুর ঘন-সন্নিবেশিত বাগিচা, আর রকম-বেকমের ফল ও উদ্ভিদ খাদ্য- তোমাদের জন্যে এবং তোমাদের গবাদিপশুর জন্যে জীবিকার সামগ্রীরূপে। বলেছেন:
(আরবী **********)
আর মৃত জমীন তাদের জন্যে নিদর্শন। আমরাই তা জবিন্ত করেছি এবং তাতে উদ্ভূত করেছি দানা, শস্য। তা থেকেই তারা খায়। তাতে আমরা বানিয়েছি খেজুরের বাগিচা। এবং তার বুকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছি যেন তারা তার ফল খেতে পারে- আর যা তাদের হস্ত প্রস্তুত করে।…. তোমরা কি শোকর করবে না?
হ্যাঁ এটাই প্রশ্ন, তোমরা কি শোকর করবে না এ সব নিয়ামত ও অনুগ্রহের, যা আল্লাহ্ দয়া করে সৃষ্টি করেছেন? এ শোকরের প্রথম প্রকাশ ঘটবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে। সে যাকাতদিতে হবেজমির ফসল থেকে। তা হবে মহান আল্লাহ্র কিছুটা হক আদায়ের একটা কাজ। সেই সাথে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া-সহানুভূতিও প্রদর্শিত হবে, তাঁর দ্বীনের সাহায্য কাজে অংশ গ্রহণও হবে। ইসলামী ফিকাহ্-এ এই যাকাতকে ‘ওশর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে অথবা ‘ফল ও ফসলের যাকাত’ও বলা যায়।
এ যাকাত অন্যান্য-গবাদিপশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসা-পণ্য ইত্যাদি মালের যাকাত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ হিসেবেও আলাদা যে, এতে এক বছর পূর্ণভাবে অতিবাহিত হওয়ার কোন শর্ত নেই। বরং শুধু, তা অর্জিত হলেই এ যাকাত দিতে হয়। কেননাতা জমির প্রবৃদ্ধি, জমির ফসল উৎপাদন। অতএব যেখানেই প্রবৃদ্ধি পাওয়া যাবে- তাই হবে যাকাত ফরয হওয়ার কারণ, আধুনিক পরিভাষায় উৎপাদন-জমির ফসল ‘উৎপাদন কর’।
অন্যান্য ধন-মালেরযাকাত দিতে হয় আসলমূলধন থেকে।তা প্রবৃদ্ধি লাভকরুক, কি না-ই করুক।
এ পর্যায়ের যাবতীয নিয়ম-বিধান আমরা নিম্নোক্ত আলোচনাসমূহে, সবিস্তারে উপস্থাপিত করব:
প্রথম আলোচনা: ফল ও ফসলের উপর যাকাত ফরয হওয়ার দলীল
দ্বিতীয় আলোচনা: কৃষি উৎপাদন- যার উপর যাকাত ফরয হয়,
তৃতীয় আলোচনা: নিসাবের হিসাব ও তৎসংক্রান্ত কথা,
চতুর্থ আলোচনা: যাকাত পরিমাণ এবং তার তারতম্য,
পঞ্চম আলোচনা: মিথ্যা কথনের মাধ্যমে ফরয পরিমাণ নির্ধারণ ও তৎসংশ্লিষ্ট কথা,
ষষ্ঠ আলোচনা: ফল ও ফসল মালিকের জন্যে কি ছেড়ে দেয়া হবে,
সম্পতম আলোচনা: ঋণ পরিশোধে ব্যয়ভার বহন এবং অবশিষ্টের যাকাত দান,
অষ্টম আলোচনা: ভাড়ায় লওয়া জমির যাকাত,
নবম আলোচনা: ওশর ও খারাজ একত্রীকরণ।
প্রথম আলোচনা
ফল ও ফসলের যাকাত ফরয হওয়ার দলীল
প্রথম. কুরআন মজীদ:
(আরবী **********)
হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদর পবিত্র উপার্জন থেকে এবং যা তোমাদের জন্যে জমি থেকে উৎপাদন করািই তা থেকে ব্যয় কর। আর ব্যয় করতে গিয়ে তোমরা খারাপ জিনিস দেবার ইচ্ছা করো না। কেননা তোমরা নিজেরাও তা উপেক্ষা করা ছাড়া গ্রহণ করতে প্রস্তুত হও না।
ব্যয় করার এ নির্দেশ ফরয প্রমাণ করে। এ কাজকে ঈমানের অনিবার্য দাবিরূপে আল্লাহ্ তা’আলা উপস্থাপিত করেছেন। কুরআনের বহু আয়াতেই ‘ব্যয় কর’ বলে যাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল-জাসসাস বলেছেন: ‘ব্যয় কর’ অর্থ যাকাত দাও। পরবর্তী কথা ‘তোমরা খারাপ দিতে চেয়ো না ব্যয় করতে গিয়ে’ এ কথার বড় প্রমাণ। পূর্বের ও শেষের দিকের সব বিশেষজ্ঞইএ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
(আরবী **********)
তিনি আল্লাহ্ই, যিনি নানা প্রকারের গুল্ম-লতা ও গাছগাছালি সমন্বিত খেজুর বাগান সৃষ্টি করেছেন, ক্ষেত-খামার বানিয়েছেন, যা থেকে নানা প্রকারের খাদ্য উৎপাদন করা হয়, জয়তুন ও আনারের গাছ তৈরী করেছে, যার ফল দেখতে সাদৃশ্য সম্পন্ন এবংস্বাদে বিভিন্ন হয়ে থাকে। ….. তোমরা সকলে খাও এসবের উৎপাদন- যখন তা ধরবে এবং আল্লাহর হক আদায় কর যখন তার ফসল কেটে তুলবে…
মনীষীদের অনেকেই বলেছেন, এ আয়াতে ‘হক’ আদায় করার যে নির্দেশ তা আসলে যাকাত দেয়ার নির্দেশ এবং তা ফরয। এ যাকাত হচ্ছে ওশর- এক দশমাংশ অথবা অর্থ-ওশর- এক বিংশতিতম অংশ।
আবূ জাফর তাবরী আনাস ইবনেমালিক-এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছে: এ ‘হক’ অর্থ ‘যাকাত’। হযরত ইবনে আব্বাসথেকে বহু কয়কটি সূত্রে বর্নিত হয়েছে, ফল ও ফসলের যে যাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা আসলে ‘ওশর’ বা অর্ধ-ওশর।তাঁরই অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে: ‘আল্লাহ্র হক’ অর্থ ফরয যাকাত, যেদিন তা মাপা হবেও কতটা পাওয়া গেল তা নির্দিষ্টভাবে জানা যাবে- সেদিনই তা আদায় করে দিতে হবে।
জাবির ইবনে যায়দ, হাসান, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়া, তায়ুস, কাতাদাহ্ ও তাহ্হাক প্রমুখ থেকে হক-এর অর্থ বর্ণিত হয়েছে যাকাত-ফরয যাকাত বা ওশর, অর্ধ-ওশর। কথা বিভিন্ন হলেও মুল্য, উদ্দেশ্য ও বক্তব্য এক ও অভিন্ন।
কুরতুবী বলেছেন; ইবনে ওহাব, ইবনুল কাসিম ও মালিক থেকে তাফসীরই বর্ণিত হয়েছে।ইমামশাফেয়ীর কতিপয় সাথিও তাই বলেছেন। ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদের কথাও তা-ই। অন্যান্যরা বলেছেন, ‘এ একটি সাধারণ আদেশ ছিল, আল্লাহ তা’আলা সুনির্দিষ্ট যাকাত ফরয করার পূর্বে মু’মিনদের এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে ওশর ও অর্ধ-ওশর ফরয ধার্য হওয়ার পর তা বাতিল হয়ে যায়।
ইবনে জরীর হযরত ইবনে আব্বাস থেকে এ আয়াতের তাফসীর লিখেছেন; এ নির্দেশকে বাতিল করে দিয়েছে ওশর-অর্ধ-ওশর।
মুহাম্মাদ িইবনে হানাফীয়া ওইবরাহীম নখ্য়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে, উপরিউক্তি আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ। ওশর ও অর্ধ-ওশর দেয়ার নির্দেশ তাকে বাতিল করে দিয়েছে।
সায়ীদ ইবনে জুবাইর বলেছেন, এ নির্দেশ ছিল যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বে। যাকাতের হুকুম নাযিল হলেতা নাকচ হয়ে যায়। হাসানও তাই বলেছেন।সুদ্দী বলেছেন, ফসল কাটার দিন কেউ উপস্থিত হলে লোকেরা তাকে খাইয়ে দিত। পরে যাকাত ফরয হয়ে তা বাতিল করে দেয়। পরে জমির ফসলের এক-দশমাংশ বা তার অর্ধেক ফরয ধার্য হয়।
ইবনে জারীরও এ মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, এ আয়াতটি মন্সুখ হয়ে গেছে। কেননা শস্যের উপর যে যাকাত ফরয, তা ফসল কাটার দিন দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। বরং তা দিতে হয় মাড়াই, ঝাড়-পুছ ও পরিমাপ করার পর।
ফলের যাকাতও তা শুকানোর পরেই দেয়া সম্ভব। যেমন আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলেছেন: (*****) ‘সীমালংঘন করো না’। আর এক-দশমাংশও তার অর্ধেক নির্দিষ্ট করে তার হক্টা যখন স্পষ্ট করে দেয়া হল তখন তাড়াহুড়ার কোন কারণও থাকল না। কেননা এটা একটা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলরাই তা গ্রহণের অধিকারী। তাহলে মালের মালিককে ‘সীমালংঘন’ থেকে কি করে বিরত রাখবে? এমতাবস্থায় এটা যাকাতের বাইরে দ্বিতীয একটা ‘হক’ হয়ে যায়। অথচ ধন-মালে যাকাত ভিন্ন আর কোন হক্ নেই। অতএব এ ‘হক’টা মনসুখ মনে করতে হবে।কেননা তা ধন-মালে পূর্বের হক বাতিল করে দিয়েছে।
মুফাস্সিরকুল শিরোমণি ইবনে জারীর তাবারী আয়াতটিকে মন্সুখ বলে স্বীকার করেছেন, এটা খুবই বিস্ময়কর। কেননা তিনি কোন আয়াতের মন্সুখ হওয়ার কথা সাধারণভাবে স্বীকার করেন না। অন্যান্যবহু আয়াতের মন্সুখ হওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন।যদিও দুটি আয়াতের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বৈপরীত্য দেখা দিলেই মন্সুখ হওয়ার কথা সাধারণত বলা হয়ে থাকে। কেননা তখন একসাথে দুটি আয়াত অনুযায়ী আমলকরা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ্র নির্দেশ- ‘তার হক্ দাও তা কাটার দিন’ এবং ওশর বা অর্ধ-ওশর দেয়া ফরয করার পর্যায়ে কথিত হাদীসসমূহের মধ্যে কোন বৈপরীত্য আছে কি? না, বৈপরীত্যের পরিবর্তে বলা যাবেযে, আয়াতটি ইজমালী নির্দেশেরই বাস্তব রূপ হাদীস বলে দেয়া হয়েছে? অস্পষ্ট কথার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে কি হাদীসে?
এ শোষোক্ত সম্ভাব্যটাই অধিকতর স্পষ্ট। শরীয়াতের দলীলসমূহের মধ্যে এ সম্পর্কটাই মেনে নেয়া বাঞ্ছনীয়। তাবারী হযরত ইবনে আব্বাস প্রমুখ থেকে যেসব কথা উদ্ধৃত করেছেন, তা যেন আমাদের কাউকে ধোঁকায় না ফেলে এবং আমরা যেন মনে করে না বসি যে, আয়াতে যে হক্ দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়াহয়েছে, ওশর ও সুপরিচিত যাকাত তাকে মন্সুখ করে দিয়েছে। কেননা আমরা জানি যে, শেষের দিকের ফিকাহ্বিদদের পরিভাষায় মন্সুখ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, শরীযাতের একটি হুকুম অপর একটি শরীযাতী দলীলের দ্বারা বাতিল বা অকেজো হয়ে যাওয়া। সাহাবী ও তাবেয়ীনেরসময়ে তা ছিল না। ছিল, সাধারণকথাকে বিশেষ অর্থে গ্রহণ, নিঃশর্ত কথাকে শর্তাধীনকরণ, অস্পষ্ট কথাকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা এবং মোটামুটি কথাকে বিস্তারিত করে বলা।
ইমাম আবূ ইসহাক শাতেবী বলেছেন, পূর্ববর্তী মনীষীদের কালাম থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, তাঁরা নিঃশর্ত কথাকে শর্তাধীন করাকে ‘মনসূখ হওয়া’ বলতেন। সাধারণ কথাকে কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দলীলের ভিত্তিতে বিশেষঅর্তে গ্রহণ করাকেও তাঁরা তাই মনে করতেন। অস্পষ্ট করা এবং পরবর্তী কোন দলীলের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী কোন হুকুমকে বাতিল করা বুঝাতেন। কেননা এ সবের মৌল অর্থ একটিই।
ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেন, পূর্বকালের লোকেরা সাধারণত ‘নাসেখ’ ও ‘মনসুখ বলে কখনো বুঝতেন একটা কারণে অন্যটির হুকুম নাকচ করা।এটা শেষের দিকের লোকদের ব্যবহৃত পরিভাষা। আবার ককনো বুঝতেন, সাধারণ তাৎপর্যের পরিবর্তে বিশেষ অর্থ গ্রহণ করা। কোন শব্দের অর্থ ভিন্ন বা বাইরের কোন শব্দ দ্বারা করাকেও তাই মনে করতেন।
ইবনেকাসীর উক্ত আয়াতটিকে মন্সুখ বলাসহজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা এ আদেশটি তো মূলতই অবশ্য পালনীয় ছিল। পরে কথাটিকে স্পষ্ট করে বলতেগিয়েযা দিতে হবে তার পরিমাণটা বলে দেয়া হয়েছে। আর এটা ছিল হিজরতের দ্বিতয় বছরের ব্যাপার।
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আয়াতে কথিত হকটি ‘ওশর’ ধার্য করার দরুন মনসূখ হয়ে গেছে- যে সব উক্তিতে এ কথাটি বলা হয়েছে, তা এ কথার বিপরীত হয় না, যাতে বলা হয়েছে যে, আয়াতে যে হক-এর কথা বলা হযেছে তা ওশর।
ইবনে আব্বাস, ইবনুল হানাফীয়া ও হাসান থেকে দুটি কথা বর্ণিত হয়েছে কেমন করে, তা আমরা পূর্বের আলোচনার দৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছি। কেননা আয়াতটি তো মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিল, ওশর ও অর্ধ-ওশর দ্বারা তার ব্যাখ্যা করার অর্থ এ হতে পারে যে, মক্কা শরীফে যে ইজমালী নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, হিজরতের পর যাকাতের পরিমাণ বলে দিয়ে তারই ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ বহু কয়টিআাতে যাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তখন তাতে তার হার বা নিয়ম বলা হয়নি। বরং তা পরে বলা হয়েছে।
এই যে বলা হয়েছে যে, ফসল কাটার দিনই তার যাকাত দেয়া সম্ভব নয়, এ কথাটি কয়েকটি কৃষি ফসলের ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সত্য। যেমন ধান, গম ইত্যাদি। তবে শাক-সব্জি, ফল-আঙুর, জয়তুন, ডালিমইত্যাদি- যার কথা আয়াতেই কৃষি ফসলের সঙ্গে বলা হয়েছে- এর যাকাত ফল পাড়ার দিনই দিয়ে যেতে পারে।
কোন কোন মনীষীর মতে ‘হক’ দিয়ে দেয়ার অর্থ, তার সংকল্প গ্রহণ করা। আর সীমালংঘন করতে নিষেধ করার ব্যাপারটি যুক্ত হবে খাওয়ার আদেশের সাথে অর্থাৎ খাওয়ার ব্যাপারে যেন সীমালংঘন করা না হয়।
দ্বিতীয়. সুন্নত
(ক) ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম(স) বলেছেন:
(আরবী********)
বৃষ্টি ও খাল-নদীর পানিতে যে জমি সিক্ত হয় অথবা যা মাটির রসে সাধারণ সিক্ত থাকে, তাতে দেয় হচ্ছে ফসলের এক-দশমাংশ। আর যাতে সেচ কাজ করতে হয়, তাতে অর্ধ-ওশর- বিশভাগের এক ভাগ।
(খ) হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত নবী করীম(স)-এর কথা, যা খাল-নদী ও মেঘের পানিতে সিক্ত হয়, তাতে ওশর ধার্য হয়েছে। আর যা সেচের মাধ্যমে সিক্ত হয়, তাতে অর্ধ-ওশর।” (আহমদ, মুসলিম)
(গ) কৃষি ফসলও ফলাদির নিসাব নির্ধারণও যাকাত আদায়ের জন্যে আদায়কারী প্রেরণ পর্যায়ে বহু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে।
তৃতীয়. ইজমা
মোটামুটি জমির যা ফসল হবে তাতে ওশর বা অর্ধ-ওশর ফরয হওয়া সম্পর্কে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি ব্যাপারে কিছুটা মতভেদ আছে বটে।
দ্বিতীয় আলোচনা
কৃষি ফসলে ফরয যাকাত
জমির উৎপাদনের- ফসল ও ফলের যাকাত কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার- এবং যুক্তির ভিত্তিতে ফরয প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এ যাকাত কোন্ ধরনের জমি-উৎপাদনে ওশর বা অর্ধ-ওশর ফরয মনেকরতে হবে? জমিতে যা-ই উৎপন্ন হয়, তার সবটাতেই কি এ ফরয হবে, না তার কোন-কোনটিতে ফরয হবে, আর কোন-কোনটিতে নয়? কোনটিতে ফরয না হলে তা কেন?
এ ক্ষেত্রে আলিমদের বিভিন্ন মত দেখা যায়-
১. হযরত ইবনে উমরের মত
আগের কালের আরও কয়েকজন মনীষীর মত- বিশেষভাবে চারটি খাদ্যশস্যে যাকাত ফরয।
ইবনে উমর, কোন কোন তাবেয়ী এবং তাঁদের পরের কিছু ফিকাহ্বিদ এ মত রাখেন যে, গম ও যব ভিন্ন অন্য কোন শস্যে এবং খেজুর, কিশমিশ, মনাক্কা ছাড়া অন্যকোন ফলের যাকাত দিতে হবে না।
ইমাম আহমদ থেকে এ বর্ণনাটি এসেছে মূসা ইবনে তালহা, হাসান ইবনে শিরীন, শা’বী, হাসান ইবনে সালেহ, ইবনে আবূ লায়লা, ইবনুল মুবারক ও আবূ উবাইদের মত হিসেবে। ইবরাহীম এ মত সমর্থন করেছেন।
এ কথার পক্ষের দলীল হচ্ছে:
(ক) ইবনে মাজা ও দারে কুতনী আমর ইবনে শুয়া্বি সূত্রে বর্ণনা করেচেন:
(আরবী********)
নবী করীম(স) ভুট্টা বা ময়দা, গম, খেজুর ও কিশমিশ-মনাক্কার উপর যাকাত ধার্য করেছেন। ইবনে মাজা (***) শব্দটি বাড়িয়ে বর্ণনা করেছেন।
(খ) আবূ বুরদা থেকে আবূমূসা ও মুআয (রা) সূত্রে বর্নিত হয়েছে, নবী করীম (স) তাঁদের দুজনকে ইয়েমেনে পাঠিয়েচিলেন লোকদের দ্বীনের শিক্ষাদানের দায়িত্ব দিয়ে। তখন তিতিন তাদের আদেশ করেছিলেন ‘এ চারটি ছাড়া অন্য কিছু থেকে যেন ওশর গ্রহণ না করেন- ভুট্টা, গম, খেজুর ও কিশমিশ-মনাক্কা। কেননা এ চারটি বাদে অন্যান্য ফসল সম্পর্কে কোনশরীয়াতী দলীল নেই, কোন ইজমাও অনুষ্ঠিত হয়নি। আর অন্য কিছু প্রধান খাদ্য হওয়ার স্তরে পরিচিতও নয়। অন্য কিচুর বেশী থাকা বা বেশী ফায়দা হওয়াও প্রমাণিত নয়। অন্য কিছুকেও এ চারটির সাথে যুক্ত করার পক্ষেকোন যুক্তি নেই। অতএব অন্য কিছু থেকে ওশর বা অর্ধ-ওশর নেয়াও যাবে না।
২. ইমাম মালিক ও শাফেয়ীর মত
যা-ই খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত এবং সঞ্চয় করে রাখা যায়, তাতেই যাকাত ধার্য হবে। যা-ই সাধারণ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত, জমা করে রাখা যায় এবং শুকানো যায়, তা শস্য দানা বা ফল যা-ই হোক, যেমন ভুট্টা, গম, চাল, ডাল ও অনুরূপ জিনিসগুলো- এ সবের উপর যাকাত ফরয। আখরোট, বাদাম, হেজেল ফল, পেস্তা ও এ ধরনের ফল- তা জমা করে রাখা গেলেও এ সবের উপর যাকাত ধার্য হবে না। কেননা এগুলো মানুষের সাধারণ খাদ্য হিসেবে প্রচলিত নয়। অনুরূপভাবে আপেল, ডালিম, কুম্মাসরা, পীচ ফল, কুল প্রভৃতিতেও যাকাত ফরয নয়। কেননা এসবের কোনটি শুকিয়ে জমা করে রাখা হয় না বা যায় না। ডুমুর ফলে যাকাত হবে কিনা এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। মালিকী মতের এক দল বলেছেন, যাকাত হবে না। কেননা ্মাম মালিক ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থে বলেছেন: ‘যে সুন্নাতে কোন মতভেদ নেই- যা আমি আলিমগণের কাছ থেকে জানতে পেরেছি- তা হল, সব ফলের উপরই যাকাত ফরয নয়। যেমন ডালিম, পীচ ফল ও এ ধরনের বা অন্য ধরনের কোন ফলের উপরই যাকাত ধার্য হবে না।
আবূ আমর ইবনে আবদুল বার্ বলেছেন, তীন বা আঞ্জির জাতীয় ফলকে আমি এর মধ্যে গণ্য করছি, যদিও তা শুকিয়ে জমা করে খাদ্য হিসেবে রাখা ও ব্রবহার করা হয়নি, সে কথা জানা যায়নি। যদি তা জানা যেত নিশ্চিতভাবে, তা হলেআমি তা এর মধ্যে গণ্য করতাম না। কেননা তা খেজুর সদৃশ। আমি জানতে পেরেছি যে, আব্হরি ও তাঁর সঙ্গীরা এর উপর যাকাত ধার্য মনে করতেন। তাঁরা ইমাম মালিকের ফতওয়া অনুযায়ীই এ মত গ্রহণ করেছিলেন।
খারশী উল্লেখ করেছেন যে, মাত্র বিশ প্রকারে ফলের উপর যাকাত ফরয। তা হচ্ছে, মাটর-কলাই, সিম ও বরবটি, ছোট সিম, পিয়াজ, রসুন, লুপিন, মটর ডাল, গম, যব, সল্ত- গমের মত এক প্রকারের শস্র, আলাস- এক ধরনের ভুট্টা- সানবাবাসীদের খাদ্য, চাউল, বিন্দুদানা, জোয়ার, কিশমিশ এবং জয়তুন, সরিসা, ধনিয়া, সয়াবীন বীজ ও খেজুর প্রভৃতি। অতএব আঞ্জির, বাঁশ-বেত, ফল, মূলি-তরকারী, হলুদ, পনির উপর ভাসমান তরকারী, গোল মরিচ, জিরা ইত্যাদির যাকাত হবে না।
ইামম কুরতুবী লিখেছেন: ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, খেজুর ও আঙুর ব্যতীত অপর কোন ফলের উপরইযাকাত হয় না। কেননা নবী করীম (স) কেবলমাত্র এদুটো জিনিসের উপর যাকাত ধার্য করেছেন। আর এ দুটো হিজাজের অধিবাসীদের সাধারণ খাদ্য ছিল, তা তারা জমাও করে রাখত। বলেছেন: আখরোট, বাদামও জমা করে রাখা যায়। কিন্তু তার উপর যাকাত ধার্য হয় না। তদানীন্তন আরবে তা সাধারণ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত না; শুধু ফল হিসেবেই ব্যবহৃত হত।
ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, জয়তুনের উপিরও যাকাত হবে না। কেননা কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা’আলা ‘রুম্মান (ডালিম)-এর সঙ্গেই জয়তুনের উল্লেখ করেছেন। আর ডালিমের উপর যে যাকাত হয় না, তা সর্বজনবিদিত। ইমাম শাফেয়ীর এ কথাটি মিসরীয়। তাঁর ইরাকীয় একটি কথাও আছে, তা হল, তাতে যাকাত হবে।
ইমাম মালিক জয়তুনের যাকাত হবে বলে মত দিয়েছেন। ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে ইবনে শিহাবকে জয়তুন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, তাতে ওশর ধার্য হবে।
ইমাম মালিক জয়তুনে যাকাত হবে বলে মত দিয়েছেন। ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে ইবনে শিহাবকে জয়তুন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, তাতে ওশর ধার্য হবে।ৎ
এ কথা প্রমাণ করে যে, এ দুজন ইমামের মতে উপরিউক্ত আয়াতটি মনসূখ হয়নি। অথচ এঁরা দুজনই ডালিমের যাকাত না হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। যদিও তার উপর যাকাত ধার্য করা তাঁদের দুজনেরই কর্তব্য ছিল।
ইমাম শাফেয়ীর মতের দুটো দলীলপেশ করা হয়েছে। প্রথম, হযরত মুআয ইবনে জাবাল বর্ণিত হাদীস। তাতে বলা হয়েছে, ক্ষীরা, কাঁকর, তরমুজ-খরবুজ, ডালিম, ঘাস, বাঁশ, শনও শাক-সব্জির যাকাত রাসূলে করীম (স) মাফ করে দিয়েছেন। হাদীসটি বায়হাকী ‘সুনানে কুব্রা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। সমস্ত হাদীস উদ্ধৃত করার পর বলেছেন এসব হাদীস ‘মুরসাল’ তবেতার সূত্র বিভিন্ন। ফলে পরস্পরের সমর্থনে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সাহাবীদের উক্তিও তার সাথে রয়েছে। সে সব উক্তি হযরত আলী, উমর ও আয়েশা (রা) থেকে উদ্ধৃত।
দ্বিতীয়, নিত্য-নৈমক্তিক খাদ্য অধিকতর কল্যাণময়, গবাদিপশুর মতই ব্যাপার। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহতে জমির উৎপাদন ও মেঘের পানির বর্ষণসিক্ত যে কোন ফসল থেকেই যাকাত দেয়ার সাধারণ নির্দেশের মুকাবিলা করার জন্যে দলীল দুটো কিছুমাত্র যথেষ্ট নয়।
৩. ইমাম আহমদের মত
ইমাম আহমদ থেকে কয়েকটি কথা বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশিত ও খ্যাত মতটি ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, যে সব জিনিসের নিম্নের গুণগুলো রয়েছে, তাতেই যাকাত দিতে হবে: মাপা যায়, সংরক্ষণ করা যায়, শুকিয়ে রাখা যায়। সব দানা ও ফল জাতীয় জিনিসই এর মধ্যে গণ্য- মানুষ যা সাধারণভাবে উৎপাদনকরে। তা খাদ্যহতে পারে, যেমন-ভুট্টা, গম, খোসাহীন যব, ধন-চাউল, শস্য বজড়া ইত্যাদি অথবা দানা জাতীয় হতে পারে, যেমনসীম-বীজ, মসুর, কলাই, চানা অথচা জিরা, ধনিয়া প্রভিৃতি মসলা জাতীয় বীজ ও বিভিন্ন প্রকারের দানার উপর যাকাত ফরয হবে। তবে সর্বপ্রকার ফলের উপর যাকাত ফরয নয়। সর্বপ্রকারের শাক-সব্জির উপরও নয়।
এ থেকে বোঝা গেল, ইমাম আহমদের দৃষ্টিতে জমির সর্বপ্রকারের উৎপাদনেই যাকাত ফরয নয়।
এ পর্যায়ের দলীল হচ্ছে, নবী করীম (স) সাধারণভাবেই বলেছেন, যা কিছুই বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়, তাতেই ওশর ধার্য হবে এবং হযরত মুআয (রা)কে বলেছিলেণ, সবদানা থেকেই দানা গ্রহণ কর। এই দুটি কথা সর্বপ্রকারের জিনিসের উপর যাকাত ফরয করে দেয। তবে যা খাদ্য নয় ও যা ‘দানা’ নয়, তা এ থেকে বাদ যাবে। কেননা নবী করীম (স) বলেছেন, ‘দানা’ ও খেজুরে যাকাত হবে তার পরিমাণ পাঁচ অসাক্ হলে, তার কম হলে নয়। মুসলিম ও নাসায়ী গ্রন্থে এই হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। এই হাদীস প্রমাণ করেছে যে, যা ওজন করা বা মাপা যায় না, তাতে যাকাত হবে না। কিন্তু যা ওজন করা ও মাপা যাবে, তা সাধারণ নির্দেশের আওতাভুক্ত থাকবে।
৪. ইমাম আবূ হানীফার মত: জমির সর্বপ্রকার উৎপাদনেই যাকাত
ইমাম আবূ হানীফা মত দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা’আলা জমি থেকে যা-ই উৎপাদন করবেন, যে জমির চাষাবাদের লক্ষ্য হবে উৎপাদন এবং জমি থেকে সাধারণভাবে যা উৎপাদন করা হয়, তাতেই ওশর বা অর্ধ-ওশর ধার্য হবে। এ কারণে কাষ্ঠ, ঘাস ও ফার্সী, বাঁশ, বেত ইত্যাদি বাদ যাবে। কেননা মানুষ সাধারণত এসব উদ্দেশ্যমূলকভাবে উৎপাদন করে না।তবে কেউ দি কোন জমিকে ব্যবসায়ী উদ্দেশ্যে এসব উৎপাদনের জন্যে নির্দিষ্ট করে, তাহলে তাতে ওশর ধার্য হবে।
তাহলেতাঁর মতে উৎপাদন খাদ্যহতে হবে এমন শর্ত নেই। শুকিয়ে রাখা ও সঞ্চয় করারও কোন শর্ত নেই যাকাত (ওশর) ফরয হওয়ার জন্যে পরিমাণযোগ্য হতে হবে এমন কথাও নেই। খাদ্য হওয়াও শর্ত নেই।
এ কারণে দাঊদ জাহেরী ও তাঁর সঙ্গীরা বলেছেন, জমি যা-ই উৎপাদন করবে, তাতেই যাকাত ফরয হবে। তাঁরা এ থেকে কোন কিচুই বাদ দিতে প্রস্তুত নন। নখ্য়ীও এ মত প্রকাশ করেছেন। উমর ইবনে আবদুল আযীয, মুজাহিদ ও হাম্মাদ ইবনে আবূ সালমানও এ মতই পোষণ করতেন।
ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ভিন্নমত পোষণকরতেন।তাঁদের মতে স্থায়ী ফল নেই- যেমন ঘাস, শাক-সব্জি, ওষধি ইত্যাদি পর্যায়ে দ্রব্যাদি- তার যাকাত দিতে হবে না।
ইমাম আবূ হানীফার মতে আখ, জাফরান, তুলা, উলশীর চারা- যা দিয়ে কাপড় বোনা হয় ও তৎসদৃশ জিনিসের উপর ধার্য হবে। যদিও তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ ও পরিমাপ করা হয় না।
তাঁর মতে সর্বপ্রকারের ফলেও ওশর দিতে হবে। তা শুকিয়ে রাখা হোক আর না-ই হোক। সর্বপ্রকার ঘাস ও শাক-সব্জির উপরও তিনি যাকাত ধার্য করেছেন।
এ মতের পক্ষে দলীল
প্রথম যা-ই আমরা জমি থেকে তোমাদের জন্যে উৎপাদন করেছি- কুরআনের এই সাধারণ কথা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, জমির সর্বপ্রকার উৎপাদনের উপরই ওশর ধার্য হবে। আয়অতে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, ‘এবং দাও তার হক তা কাটার দিন’ –কুরআনের এই নির্দেশটি কয়েক প্রকারের খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখের পর উল্লিখিত হয়েছে।তাতেও ঘাস ও শাক-সব্জি সবই শামিল রয়েছে।তা কাটা বা তোলার দিনই তার উপর ধার্য হক আদায় করা সম্ভব। অতএব সেদিনইএ যাকাত দিয়ে দিতে হবে। তবে দানা ও শস্য জাতীয় ফসলথেকে যাকাতদেয়া সম্ভব তা পরিচ্ছন্ন করার দিন।
তৃতীয, নবী করীম (স) বলেছৈন, ‘আকাশের পানি যা-ই সিক্ত করে তাতে ওশর এবং যা সেচ কার্যের দ্বারা সিক্ত হয়তাতে অর্ধ-ওশর ধার্য হবে।’- এই কথাও ফসলের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি।
পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয, মুজাহিদ, দাঊদ, নখয়ী প্রমুখ ফিকাহ্বিদের মত অনুযায়ী ইমাম আবূ হানীফার উপরিউক্তি মতটিই অন্যান্য সব মতের তুলনায় অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। আর তা হচ্ছে, জমি যা-ই উৎপাদন করবে, তাতেই ওশর বা অর্ধ-ওশর ধার্য হবে। কুরআন ও সুন্নাহ্র সাধারণ দলীলের সমর্থনে তা অধিক শক্তিশালী মত। যাকাত বিধিবদ্ধ করার মূলে নিহিত উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতার দৃষ্টিতে তা-ই অধিক সংগতিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য মত। কেননা জমিতে এক ধরনের উৎপাদনকারীদের উপর ওশর ধার্য করা এবং অন ধরনের ফসল উৎপাদনকারীদের তা থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার কোন যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। কেবলমাত্র খাদ্য হিসেবে গ্রহণীয় জিনিসের উপর যাকাত ধার্যকরণ সংক্রান্ত হাদীসসমূহের কোনটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। তার সনদ বিচ্ছিন্ন, ধারাবাহিকতা ও অবিচ্ছিন্নতা নেই, না হয় কোন কোন বর্ণনাকারী যয়ীফ। কিংবা যে হাদীস রাসূলে করীম (স)-এর উক্তি হিসেবে বর্ণিত, কিন্তু আসলে তা কোন সাহাবীর উক্তি। আর তার কোনটিকে সহীহ ধরে নিলেও বিশেষজ্ঞগণ তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে, তখন এ চারটি ছাড়া আর কোন জিনিস ছিল না বলেই সে সবের উল্লেখ করা হয়নি। অথবা এ নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধকরণটা প্রকৃত নয়; আপেক্ষিক। িএ কারণে অনুসৃত কোন মাযহাবেই সে হাদীসের ভিত্তিতে মত গ্রহণ করেনি।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আল্লামা রশীদ রেজা মিসরী এ সীমাবদ্ধ যাকাত ক্ষেত্রকেই সমর্থন করেছেন। তবে তিনি এ চারটি দ্রব্যের উপর কিয়াস করেধান বা চালকেও এর মধ্যে শামিল করেছেন। অথচ যে দলীলের ভিত্তিতে ব্যবসায়ী সম্পদের উপর যাকাত ফরয ধরা হয়, সে দলীলের ভিত্তিতেই কৃষি সম্পদেও যাকাত হবে। বিশেষ করে এজন্যে যে, জমিথেকে ফল ও ফসল উৎপাদনের আল্লাহ্র যে নিয়ামত রয়েছে তা অন্য যে কোন মালের তুলনায় অধিক প্রকাশমান। এ কারণে মক্কী পর্যায় থেকে ফসল কাটার দিনই তার হক দিয়ে দেয়ার নির্দেশ কার্যকর হয়েছে, যদিও তার নিসাব ও পরিমাণ মদীনায় যাওয়ার পর প্রকাশ করা হয়েছে।
মালিকী মাযহাবের ফকীহ্ ইবনুল আরাবী ইমাম আবূ হানীফার মতকেই সমর্থন দিয়েছেন ‘আল-আহ্কামুল কুরআন’ গ্রন্থে। আর তিরমিযীর ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন: এ পর্যায়ে দলীলের দিক দিয়ে অধিক শক্তিশালী এবং মিসকীনদের কল্যাণে অধিক কার্যকর হচ্ছে ইমাম আবূ হানীফার মত। আর নিয়ামতের শোকর আদায় অধিক সম্ভব এ মত অনুযায়ী কাজ করলে। কুরআনের আয়াত ও হাদীস থেকেও তা-ই অধিক অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
তিনি ‘তার হক দিয়ে দাও তা কাটা দিন’-এ আয়াতের ব্যাখ্রায় ইমাম আবূ হানীফার সমর্থনে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং তাতে অন্যান্য মতের প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন: ইমাম আবূ হানীফা উক্ত আয়াতটিকে দর্পনস্বরূপে গ্রহণ করেছেন এবং তাতে তিনি প্রকৃত সত্য দেখতে পেয়েছেন। ফলে তিনি সর্বপ্রকারের ফল ও ফসলের উপর যাকাত ফরযমনে করেছেন। নবী করীম (স)-এর এ কথাই বলেছেন।
ইমাম আহমদ হাদীসের ভিত্তিতে যে মত গ্রহণ করেছেন, তা যয়ীফ। কেননা বাহ্যত সে হাদীসের দাবি হচ্ছে, ফল ও দানা উভয়ের ক্ষেত্রেই নিসাব জরুরী। তাছাড়া অন্যান্য সব জিনিসের উপর যাকাত ধার্য না করা কোন শক্তিশালী কথা নয়। এ পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ীর মত একটি দাবি মাত্র। তার কোন ভিত্তি নেই, তাৎপর্যও নেই। কেননা তাৎপর্য হতে পারে যদি শরীয়াতের হুকুম তার মৌলনীতির উপর ভিত্তিশীল হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্য ও ফল-ফাঁকড়ায় আল্লাহ্র নিয়ামতের উল্লেখ করা হবে ও সে জন্যে তার সবটাতেই ‘হক’ ধার্য করা হবে, তার অবস্থা বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও- যেমন আঙুরের ছড়া-মালা ও খেজুর কাঁদি, যাতে তার বিভিন্ন ‘প্রজাতি’ রয়েছে- যেমন কৃষি ফসল ও খাদ্যের সহকারী উপকরণাদি- যার দ্বারা নিয়ামত পূর্ণত্ব লাভ করে- এসব সর্বদিক দিয়ে এক ও অভিন্ন নয়। যদি বলা হয়, যাকাত ফরয সে সব খাদ্যশস্যের উপর, যা স্থায়ী থাকে, কিন্তু শাক-সব্জি ও তরি-তরকারীর কোন স্থায়িত্ব নেই। এ কারণে খাদ্যের শাক-সব্জি অংশের যাকাত গ্রহণ না করে যা শুকিয়ে রাখা হয় তা থেকেই গ্রহণ করা উচিত। আমরা জবাবে বলব, প্রত্যেক প্রকারের চূড়ান্ত মাত্রা থেকেই যাকাত গ্রহণ করা হবে। আর শুষ্কতাই তার চূড়ান্ত মাত্রা। সুগন্থি, হরিৎবর্ণ তার চূড়ান্ত।এ কারণে কাঁচা ফল যদি প্রবৃদ্ধি না পায়, আর আঙুর যদি কিশমিশ-মনাক্কা না হয়, তাহলে এ দুটির এই অবস্থায়ই যাকাত গ্রহণ করতে হবে, যদিও কাঁচা ফলের স্বাদ তেমন হয় না। তা পূর্ণ মাত্রার নিয়ামতও হয় না, যা দিয়ে জান্নাতে আল্লাহ্ তা’আলা অনুগ্রহ প্রদর্শন করবেন। যেমন বলা হয়েছে:
(আরবী **********) তাতে ফল রয়েছে, খেজুর ও ডালিমও।
এখানে খেজুর মৌল খাদ্যহিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ডালিমের উল্লেখ হয়েছে শ্যামল তাজা জিনিসরূপে। কিন্তু লক্ষণীয়, সাধারণভাবে এ সব কিচুকে মানুষের ও গাবদিপশুর জন্যে দেয়া নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করাহ হয়েছে:
(আরবী **********)
আমরা পানি বর্ষণ করেছি, মাটি দীর্ণ করেছি, প তাতে উৎপাদন করেছি দানা, আঙুর, বড় বড় গাছ, জয়তুন ও খেজুর, ঘন-সন্নিবেশিত বাগান, ফল ও তৃণলতা।
ইবনুল আরাবী অতঃপর লিখেছেন, নবী করীম (স) মদীনা ও খায়বরের লোকদের কাছ থেকে শাক-সব্জি ইত্যাদির যাকাত নিয়েছেন, এমন কথা বর্ণিত হয়নি কেন?
আমরা বলব, তা বর্ণিত হয়নি বলেই যে তা গ্রহণ করা হত না, এমন কথা তো বলা যায় না।
যদি বলা হয়, নেয়া হলে তো বর্ণিত হতই।
আমরা বলব, বর্ণনা করার প্রয়েঅজন এজন্যে নেই যে, খোদ কুরআন মজীদই সেজন্যে যথেষ্ট। তাতেই তার উল্লেখ রয়েছে।
নবী করীম(স)-এর কথা হিসেবে বর্ণিত ‘শাক-সব্জিতে যাকাত নেই সনদের দিক দিয়ে খুবই দুর্বল হাদীস। তাই তা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন-হাদীসের সাধারণ ও ব্যাপক ঘোষণাবলীকে সীমিত ও সংকীর্ণ করা তো দূরের কথা। ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি উদ্ধৃত করে লিখেছেন, এ হাদীসের সনদ সহীহ্ নয়। আসলে এ পর্যায়ে রাসূলে করীম(স) থেকে কোন কথাই সহীহ্ভাবে বর্ণিত হয়নি।
হাদীসটিকে সহীহ্ মেনে নিলে হানাফীদের মতে তার ব্যাখ্যা হচ্ছে তাতে এমন যাকাত ধার্য নয় যা আদায়কারী কর্মচারীদের মাধ্যমে আদায় করতে হবে।বরং মালিকরা নিজেরাই তা দিয়ে দেবে। কেননা শাক-সব্জির স্থিতি নেই বলে তার যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের পর্যন্ত পৌঁছার আগেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ কারণে কোন কোন ফিকাহ্বিদ মনে করেন, শাকসব্জির মূল্য থেকে যাকাত গ্রহণ করা উচিত। ইয়াহ্ইয়া ইবনে আদম যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন: গম, যব, খোসাহীন যব, জয়তুন ইত্যাদির মূল্য থেকে যাকাত গ্রহণ কর্তব্য মনে হয়।
আতা খুরাসানী থেকে বর্ণিত, শাক-সব্জি, আখরোট ও সর্বপ্রকারের ফলের উপর ওশর ধার্য হবে। তার কোন অংশ বিক্রয় করা হলেও তার মূল্য বাবদ একশ’ দিরহাম বা তদূর্ধ্ব হয়ে গেলে তাতে যাকাত দিতে হবে। শা’বী থেকেও তা-ই বর্ণিত।আবূ উবাইদ এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে বলেছেন: মায়মুন ইবনে মাহ্রান জুহ্রী ও আওযায়ীও এ মত পোষণ করেন। তবে জুহ্রী মনে করেন, এই যাকাতটা নগদ সম্পদ-স্বর্ণ-রৌপ্যের- যাকাতের ন্যায় হবে। মায়মুন বলেছেন, এসব যখন বিক্রয় করা হবে, তখনই যাকাত ধার্য হবে যদি তার মূল্য দুইশ’ দিরহাম পর্যন্ত পৌঁছায়। তখন তা থেকে পাঁচ দিরহাম যাকাত বাবদ দিতে হবে।
খেজুর যদি কাঁচা হয়, তা থেকে শুষ্ক খেবুর না হয় কিংবা আঙুর থেকে যদি কিশমিশ না হয়, তা বিক্রয় করা হলে এবং পাঁ অসাকের মূল্য পাওয়া গেলে প্রতি দুইশ’তে পাঁচ দিরহাম যাকাত বাবদ দিতে হবে। যে জ য়হুন থেকে তৈলহয় না তার যাকাতও অনুরূপভাবে দিতে হবে।
বস্তুত উপরিউক্ত ফিকাহ্বিদ ইমামগণ শাক-সব্জি ও ফল-ফাঁকড়ায়- যা বায়তুলমালে সংরক্ষণ করা যায় না, খুব দ্রুত পাকে ও নষ্ট হয়ে যায়, তার মূল্যেল উপর যাকাত ধার্য করে ভালোই করেছেন। তবে ফরয পরিমাণের ক্ষেত্রে আমার ভিন্ন মত আছে। আমার মতে তাতে নগদ সম্পদের যাকাতের ন্যায় এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ ধার্য হওয়া উচিত নয়, বরং এক-দশমাংশ বা তার অর্ধেক ধার্য হওয়া উচিত। কেননা জমির আসল উৎপাদন থেকেতো এই যাকাত দেয়া হচ্ছে না, তার মূল্য থেকে দেয়া হচ্ছে। তাই তার হুকুমটা গ্রহণ করা হলে তার পরিমাণটারও গ্রহণ করতে হবে। কেননা দুই বিকল্প জিনিসের হুকুম একই হওয়া উচিত।
যে সব বর্ণনায় এ সবের উপর যাকাত ধার্য হওয়ার কথা আছে, কিন্তু তার পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি তা থেকে এ কথাই বোঝা যাচ্ছে, যে লোক তার আঙুর কাদি আঙুরের মূল্যে বিক্রয় করে, সে তার মূল্য থেকে ওশর বা অর্ধ-ওশর দেবে। ইমাম শা’বী এ মতই দিয়েছেন।
ইবনে আবয় যায়দ বলেছেন, জয়তুনের যাকাত দিতে হবে; যদি তার দানাগুলোর পরিমাণ পাঁচ অসাক হয়ে যায়। তার তৈল থেকেই তা দিতে হবে। আর বিক্রয় করা হলে তার মূল্য থেকে দিতে হবে।
ইমাম মালিক থেকেও এ মত বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন: মূল্যের এক-দশমাংশ দিতে হবে। বলা হয়েছে, যে জয়তুন থেকে তৈল লওয়া হয়, সেই তৈল থেকেই যাকাত দিতে হবে। আর যাতে তৈল হয় না, তার মূল্য থেকে দিতে হবে।
তৃতীয় আলোচনা
কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ার যাকাত
নিসাবের হিসাব
সাহাবী, তাবেয়ীন ও সব আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, পাঁচ অসাক পরিমাণ না হওয়া পর্যন্ত কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ার যাকাত ধার্য হয় না। তাঁদের দলীল রাসূলে করীমের কথা:
‘পাঁচ অসাকের কম পরিমাণের উপর কোন যাকাত হয় না-’ এ হাদীসটি সহীহ্ বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত।
ইমাম আবূ হানীফার মত হল, পরিমাণ কম হোক বেশী হোক, সবটাতেই যাকাত ধার্য হবে। কেননা রাসূলের কথাই সাধারণ অর্থবোধক: বৃষ্টিতে সিক্ত সব জমির ফসলের ওশর হবে। এ-ও একটি সহীহ হাদীস এবং বুখারী শরীফে উদ্ধৃত। ইমাম আবূ হানীফা এজন্যে বছর অতীত হওয়ার কোন শর্ত করেন নি, তাই তার কোন নিসাবও নেই।
ইবরাহীম নখয়ী ও ইয়াহ্ইয়া ইবনে আদম থেকে বর্ণিত, জমির ফসল কমবা বেশীহোক, ওশর বা অর্ধ-ওশর দিতে হবে।হযরত ইবনে আব্বাস বসরায় পিঁয়াজ-রসূনের মত জিনিস থেকেও যাকাত আদায় করতেন।
ইবনে হাজম, মুজাহিদ, হাম্মাদ, উমর ইবনে আবদুল আযীয এ ইবরাহীমনখয়ী থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, যে জমি যা কিছু উৎপাদন করে তাতেই যাকাত ফরয হবে, তার পরিমাণ কম হোক বা বেশী।
দাঊদ জাহেরী বলেছেন, যা পাত্র দিয়ে মাপা হয়, তার পরিমাণ পাঁচ অসাক না হওয়া পর্যন্ত তাতে যাকাত হবে না। তুলা, জাফরান ও সব শাক-সব্জিতে –পরিমাণ যা-ই হোক ধার্য হবে।
আসলে এ মতে দুটি হাদীসে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। তার একটি হাদীসের সাধারণভাবে সব উৎপন্ন দ্রব্যের যাকাত ফরয, আর অপরটিতে পাঁচ অসাকের কমে যাকাত না হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাকের ও নাসের থেকে একটা ভিন্নমত হয়েছে।তা হল শুষ্ক খেবুর ও কিশমিশ, গম ও যবে নিসাব ধার্য হবে। কেননা এটাই সাধারণ অভ্যাস। অতএব সেদিকেই ফিরতে হবে।
পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান
ইমাম আবূ হানীফার মাযহাব মুতাবিক জমির সর্বপ্রকারের উৎপাদনের উপর যাকাত ফরযহওয়ার মতকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। কিন্তু তার নিসাব নির্ধারণনা করা ও ফল ফসলের কমবা বেশী- সর্ব পরিমাণের উপর যাকাত ধার্যকরণেআমরা তাঁর বিপরীত মত পোষণকরি। কেননা এই কথাটি সহীহ হাদীসের পরিপন্থী। কেননা সহীহ হাদীস পাঁচ অসাকের কম পরিমাণে যাকাত ধার্য না করার কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যাকাত তো কেবলমাত্র ধনী লোকদের উপরই ধার্য করা হয়েছে। সাধারণভাবে এটাই শরীয়াতের বিধান। আর নিসাব হচ্ছে ধনীর সম্পদের নিম্নতম মাত্রা। এ কারণে যাকাত ফরয হয়েছে- এমন মালেরই একটা নিসাব নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
যদি দাবি করা হয় যে, উপরিউক্ত দুটি হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে, পাঁচ অসাকের কমে যাকাত নেই এবঙ আকাশের পানিতে যা-ই সিক্ত হয় তাতেই ওশর ধার্য হবে- এ দুটি কথার প্রথমটি বিশেষ এবং দ্বিতীয়টি সাধারণ পর্যায়ে- প্রথমটি দ্বিতীয়টির বিপরীত বিধায়ক অর্থাৎ সর্বপ্রকারের জমির উৎপাদনের উপর যাকাত ধার্যকরণকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে- এরূপ বলা বাঞ্ছনীয় নয়; বরয় বলতে হবে সেই কথা, যা ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম এ পর্যায়ে বলেছেন। তা হচ্ছে:
দুটি হাদীস অনুযায়ী আমল করতে হবে। একটিকে অপরটির বিপরীত মনে করা অনুচিত। কোন একটি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে চলাও সম্ভবপর নয়। কেননা দুটিই রাসূলের কথা এবং দুটি বিধান পালন করেই রাসূলের আনুগত্য করতে হবে। তা-ই ফরয। আসলে দুটির মধ্যে কোনই বৈপরীত্য নেই।তার কয়েকটি কারণ স্পষ্ট। কেননা আকাশের পানি যা-ই সিক্ত করে তাতে ওশর-তার মধ্যকার পার্থক্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। যাকাত পরিমাণের পার্থক্য নির্দেশ পর্যায়ে দুই প্রকারের জমি উল্লেখ করাহযেছে।কিন্তু নিসাবের পরিমাণটা কি হবে সে বিষয়ে এই হাদীসে কিছু বলা হয়নি। তা বলা হয়েছে অপর হাদীসে।তাহলে অকাট্য, সুষ্পষ্ট, সহীহ্ দলীল এড়িয়ে যাওয়া কি জায়েয হতে পারে? তার পরিবর্তে কি করে সেই অস্পষ্ট ও অপার্থক্য নির্দেশক কথা গ্রহণ করা যেতে পারে?
ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন, পাঁচ অসাকের কম পরিমাণে যাকাত নেই- নবী করীম(স)-এর এ হাদীসটি বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃত, সর্বসমর্থিত। এ একটা বিশেষ নির্দেশক কথা। এটিকে সাধারণ অর্থবোধক নির্দেশের উপর অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন ‘প্রতিটি উন্মুক্তভাবে পালিত উটের যাকাত দিতে হবে- এই সাধারণ কথার উপর ‘তিন থেকে দশ বছর বয়সের উটের পাঁচটির কমে কোন যাকাত নেই- এই হাদীসটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আর প্রতি নগদ সম্পদেই এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ যাকাত- এই কথাটির উপর অগ্রাধিকার দেয়াহয়েছে ‘পাঁচ আউকিয়ার কম পরিমাণে যাকাত নেই’ এই কথাটিকে।কেননাএপরিমাণ সম্পদের উপরই যাকাত ফরয হতে পারে, তার কমের উপর নয়। সর্বপ্রথম যাকাতযোগ্য মালেরই এ নিয়ম।
আর এক বছরকাল অতীত হওয়ার শর্ত নেই এ জন্যে এই ফসল কাটা হলেই তার প্রবৃদ্ধিটা পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর হয়, তাকে রেখে দিলে নয়। আর অন্যান্য সম্পদে এক বছরকাল অতীত হওয়ার শর্ত এ জন্যে যে, এ সব মাল-সম্পদে প্রবৃদ্ধি পূর্ণত্ব পায় এ সময়ের মধ্যে আর নিসাব নির্ধারণ করা হয় এ জন্যে যে, সম্পদের একটা এমন পরিমাণ সঞ্চিত হওয়া আবশ্যক, যা দান করার জন্যে তার মালিক সামর্থ হবে। উপরন্তু যাকাত তো কেবল ধনী লোকদের উপর ধার্য হতে পারে। আর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানা না হলে কাউকেই ধনী বলা যায় না।
শস্য ও ফসলের নিসাব
শস্য ও ফলের নিসাব ধার্য করা হয়েছে পাঁচ অসাক। এপর্যায়ে সহীহ্ হাদীসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ একমত হয়ে বলেচেন: ষাট ছা’তে এক অসাক হয় অর্থাৎ পাঁচ অসাকে হয় তিনশ’ ছা’। হাদসেওবলা হয়েছে, ‘এক অসাকে ষাট ছা’ হয়। কিন্তু এই হাদীসটি যয়ীফ, এ কারণে ইজমা’র উপরই নির্ভর করতে হবে।
ছা’র পরিমাণ
ফসল ও ফলাদিরনিসাব নিশ্চিতরূপে জানবার জন্যে ছা’র পরিচিত প্রয়োজন। কেননা তার পরিমাণ করা হয়েছে ‘অসাক’ দ্বারা আর অসাকের পরিমাণ করা হয়েছে ছা’র দ্বারা। রোযার ফিত্রার পরিমাণও এই ছা’র দ্বারা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাহলে ছা’র পরিমাণটা কি?
‘লিসানুল আরব’ অভিধান গ্রন্থের বক্তব্য অনুযায়ী ছা’ তদানীন্তন মদীনাবাসীদের একটি পরিমাপ, যা চার ‘মদ’ পরিমাণ হয়। হাদীসেবলা হয়েছে, নবী করীম(স) এক ছা’ পরিমাণ পানি দিয়ে গোসলকরতেন এবং চার ‘মদ’ দ্বারা পরিমাপ করা হত।
‘মদ’- ও একটা বিশেষ মাপ।মধ্যম মানের ব্যক্তির পূর্ণ দুই অঞ্জরী ভরা পরিমাণ। ‘কামুস’ গ্রন্থকার বলেছেন, পরীক্ষায় এই কথাটি সহীহ্ পাওয়া গেছে।
নবীকরীম(স) উম্মতকে তদানীন্তন মদীনায় প্রচলিত ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন দিরহাম ও মিশকালমক্কায় প্রচলিত পরিমাপে ব্যবস্থা। হযরত ইবনে উমর বর্ণিত হাদীস হল ‘পাত্র ছাড়া মাপ বা ‘কায়ল’ চলবে মদীনাবাসীদের এবং দাড়িপাল্লার ওজন চলবে মক্কাবাসীদের।
এরূপ পার্থক্যকরণের একটা যৌক্তিকতা রয়েছে। তদানীন্তন মদীনাবাসীরা ছিল কৃষিজীবী, ফল ও ফসল উৎপাদক। এ জন্যে তারা পাত্রের মাপ চালু করেছিল। এ মাপটাই ছিল তাদের অধিক যথার্থ ও সংরক্ষিত। আর মক্কাবাসীরা ছিল ব্যবসায়ী। এ কারণে তারা দাঁড়িপাল্লায় ওজনের মুখাপেক্ষী ছিল। যেমন দিরহাম ও দীনার। এটা দ্বারাই তারা সঠিক হিসাব করতে পারত।
ছা’র ব্যাপারে হিজাজ ও ইরাকের মধ্যকার পার্থক্য
নবী করীম (স) মদীনায় প্রচলিত পরিমাপ ব্যবস্থাকে মানদণ্ড (Measure) রূপে ঘোষণা করেছেন এবং সেটিকেই অনুসরণ করতে বলেছেন। অতএব স্বভাবতই আশা ছিল দুনিয়ার মুসলমান মদীনার প্রচলিত ছা’র পরিমাপে সম্পূর্ণ একমত হবেন কিন্তু এ ব্যাপারে মতপার্থক্যের সৃষ্টিহয়েছে।
ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সমর্থকগণ ইরাকের অধিবাসী- এর পরিমাপে ‘আট রতল’ করচেন। এ ‘এ রতল’ হচ্ছে বাগদাদী। আর হিজাজবাসীদের ইমাম শাফেয়ী ও আহমদ প্রমুখ- এর পরিমাপ করেন পাঁচ ও এক-তৃতীয়াংশ ‘রতল’ দিয়ে।
ইরাকী ফিকাহ্বিদদের দলীল
ইরাকী ফিকাহ্বিদগণ বলেন, আমাদের পরিমাপটা হযরত উমর (রা) ব্যবহৃত ছা’র অনুরূপ। কেননা তাতে আট রতল হত, এ কথা প্রমাণিত। আর এ কথাও প্রমাণিত যে, নবী করীম(স) ‘মদ’ পরিমাণ পানি দিয়ে ওযু করতনে ও ইক ছা’ পানি দিয়ে গোসল করতেন। আর অপর হাদীসেবলা হয়েছে তিনি আট ‘রতল’ পানি দিয়ে গোসল করতেন। আর একটি হাদীসের কথা, তিনি দুই রতল পানি দিয়ে ওযু করতেন।
হিজাজীদের দলীল
হিজাজীদের দলীল হচ্ছে, পাঁ ও এক-তৃতীয়াংশ ‘রতলই হল মদীনায় প্রচলিত এক ছা’। আর তা রাসূলে করীম(স) থেকেই পরম্পরানুযায়ী চালু হয়ে এসেছে। আর হাদীস অনুযায়ী পাত্র দিয়ে মাপার মাদানী নিয়মই অনুসরণ করতে হবে।
ইবনে হাজম বলেছেন, এ ব্যাপারটা মদীনায় সর্বজনবিদিত। সার্বিকভাবে বর্ণিত এবং চোট বড় সকলেরই জানা, যেমন মক্কাবাসীরা সাফা ও মারওয়া সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। মদীনাবাসীদের ছা’ ও ‘মদ’ সম্পর্কে আপত্তি করার অর্থ মক্কাবাসীদের উপর সাফ-মারওয়ার অবস্থিত সম্পর্কে আপত্তি করা। এ দুটির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
তিনি আরও বলেছেন, এ ব্যাপারে ইমাম আবূ ইউসুফ সঠিক কথা জানবার জন্যে মদীনায় উপস্থিত হয়েছিলেন ও সেখানকার প্রচলিত ‘মদ’ –এর পরিমাণ জেনে নিয়ে এই পর্যায়ে সত্য উদ্ঘাটন করেছিলেন। তিনি নিজেই এ কাহিনী বর্ণনা করেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়:
আমি মদীনায় উপস্থিত হয়ে ছা’ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। মদীনাবাসীরা বললো, আমাদের এই ছা’ই রাসূলে করীম (স)-এ ব্যবহৃত ছা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার প্রমাণ কি? বলল, প্রমাণ আগামীকাল পেশ করা হবে। পরের দিন প্রায় পঞ্চাশজন বৃদ্ধ বয়সের লোক উপস্থিত হলেন। তাঁরা ছিলেন আনসার ও মুহাজিরদের অধঃস্তন। তাঁদের প্রত্যেকেরই হাতে একটি করে চা’ পাত্র, চাদরের তলে রক্ষিত। প্রত্যেকেই তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যের উল্লেখ করে বললেন, রাসূলে করীম (স)-ই এই ছা’ ব্যবহার করেছেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম পাত্রগুলো সমমানের। অনুমান করলাম তা পাঁচ ও এক-তৃতীয়াংশ ‘রতল’ পরিমাণে হবে, খুব সামান্য কমতিসহ। আমার কাছে ব্যাপারটি খুব শক্ত ও অনস্বীকার্য হলে উঠল। অতঃপর আমি ছা’র ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফার কথা ত্যাগ করলাম ও মদীনাবাসীদের কথা গ্রহণ করলাম।’[(আরবী **********)]
এই কাহিনীর বর্ণনাকারী হুসাইন বলেছৈন, আমি এ নিয়ে আরও অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। ইমাম মালিক ইবনে আনাসের কাছেও জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বললেন, এ ছা’ই রাসূলে করীম (স) কর্তৃক ব্যবহৃত। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কয় রতলের হবে? বললেন, এটা তো ওজন করা হয় না।
ইমাম মালিকের পর তৃতীয় শতকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, আমি ছা’ ওজন করেছি, তা পাঁচ ও দুই-তৃতীযাংশ রতল পরিমাণ হয়।তিনি বলেছেন, আবু নযর থেকে আমি ছা’ গ্রহণ করেছি। আবূ নযর বলেছেন, আমি আবূ যি’ব থেকে তা গ্রহণ করেছি। তিনি বলেছেন, এটাই রাসূলে করীম (স)-এর ছা’ তখনকার মদীনায় প্রচলিত ছিল। আমরা ওজন করে দেখেছি, তা পাঁচ ও এক তৃতীয়াংশ রতল পরিমাণে হয়। আমার কাছে এটাই রাসূলের ছা’ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দুটো কথার সমন্বয়ের কোন পথ আছে কি?
ক. কোন কোন হানাফী বলেছৈন, ইমাম আবূ ইউসুফ ছা’ নির্ধারণ করতে গিয়ে তাকে পাঁচ ও দুই-তৃতীয়াংশ (মদীনার রেওয়াজ মত) পরিমাণের পেয়েছেন। আর এ পরিমাণটা বাগদাদী রতল অনুযায়ী আট রতল সমান হয়। ইমাম মুহাম্মাদ ইমাম আবূ ইউসুফের সাথে দ্বিমত করেন নি। এর অরথ দাঁড়ায় যে, হিজাজী ও ইরাকী উভয়েল কাছে ছা’ তো এক ও অভিন্ন; কিন্তু ‘রতল’ বিভিন্ন। কিন্তু এ কথাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ইমাম আবূ ইউসুফ নিজেই তাঁর ‘কিতাবুল খারাজ’-এ লিখেছেন: নবী করীম (স)-এর ছা’ অনুযায়ী ‘এক অসাক হয় ষাট ছা’তে. আর ছা’ হচ্ছে পাঁচট ও এক তৃতীয়াংশ রতল’ এ যে বাগদাদী রতল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা উক্ত গ্রন্থখানি খলীফা হরুন-অর-রশীদের নির্দেশক্রমে লিখিত হয়েছিল। িইমাম আবূ ইউসুফ রাজধানী বাগদাদেই অবস্থান করতেন। এমতাবস্থায় তিনি বাগদাদে ছাৎর পরিমাণ মাদানী ‘রতল’ হিসেবে কি করে নির্ধারণ করতে পারেন?
খ. হিজাজীদের ও ইরাকীদের এ দুটো পরিমাণের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে ইমাম তাইমিয়া বলেছেন, আসলে এখানেই দুই ধরনের ছা’ প্রচলিত ছিল। একটি ছিল খাদ্য ও শস্য ইত্যাদি পরিমাপ করার জন্যে আর অপরটি ছিল পানি পরিমাপের জন্যে। খাদ্য পরিমাপের ছা’ পাঁচ ও এক-তৃতীয়াংশ রতল পরিমা হত। আর পানি পরিমাপের জন্যে ছা’ ছিল আট রতলের।এ দুটো বিষয়েই সাহাবীদের উক্তি উদ্ধৃতহয়েছে। অতএব যাকাত, কাফ্ফারা ও সদ্কায়ে ফিতর-এরজন্যে সেই ছা’ গণ্য হবে, যা গোসলের পানি পরিমাপের ছা’র দুই-তৃতীযাংশ। ইমাম আহমদের সাথীদের একাংশেরও এই মত।
এ মত অনুযায়ী রতল এক পরিমাণেরই হয়, কিন্তু দুই ছা’ ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে দাঁড়ায়।
গ. এই শতকে আলী পাশা মুবারক ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে ছা’ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন যে, শরীয়াতসম্মত ছা’ হচ্ছে পাঁচ ও এক-তৃতীযাংশ ‘রতল’। নবী করীম (স)-এর হাদীস ও হিজাজী ফিকাহ্বিদগণ এই মতেরই প্রবক্তা। পূর্ববর্তী মত-পার্থক্যের কারণ দর্শানো প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, এই পার্থক্য শুধু বাহ্যিক, প্রকৃত নয়। তিনি বলেছেন:
ইরাকী আলিম ও আরব আলিমদের মধ্যকার মতপার্থক্য এভাবে সৃষ্ট হয়েছে যে, ইরাকী আলিমগণ ‘মদ’ বা ছা’র পাত্রে রক্ষিত পানির পরিমাণটাকে ধরেন। আর অন্যরা ধরেন এই পাত্রদ্বয়ে ধরতে পারে এমন পরিমাণ শস্যদানা।’
পরে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে জানা যায় যে, পাঁচ ও এক-তৃতীয়াংশ ‘রতল’ সমান হয় ততটা পরিমাণ শস্যের।আর আট ‘রতল’ সমান হয় ততটা পরিমাণ গোসেলর পানির। ‘আট’ একটি নৈকট্যমূলক সংখ্যা। কেননা অনেকে বলেছেন, ছা’ আট ‘রতলে’র কম সাত রতেলর বেশী-এটাই ঠিককথা। এভাবে যদি হিসাব করা হয যে, শস্রের ওজন ও পানির ওজনের মধ্যে ৩:৪-এর হার রয়েছে, তাহলে দেখা যাবে পাঁচ ও এক-তৃতীযাংশ ‘রতল’ গম সমান হবে সাত রতলের বেশীকিংবা আট রতলের কম পানির। তার অর্থ, রতল আসলে অভিন্ন। উভয়ের কাছে ছা’ও এক। পার্থক্র আসলে উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গীতে মাত্র।
ইরাকবাসীরা- হানাফী মাযহাব পন্থীরা- ছা’তে যতটা পানি ধরে, সেটা গণ্য করেছেন। আর অন্যরা গণ্র করেছেন যতটা শস্য ধরানো যায়- তা।
কিন্তু মতপার্থক্য শুধু এতটুকু হয়ে থাকলে ইমাম মালিককেন ভয়ানকভাবে ক্রুদ্ধ হবেন এবং ইমাম ইউসূফই বাকেন তাঁর নিজস্ব মত পরিহার করে তাঁর উস্তাদ ইমাম আবূ হানীফা ও তার সাথী ইমাম মুহাম্মাদের বিরোধিতা করতেন?
ফলশ্রুতি
এক্ষণে একথা সুস্পষ্ট যে, হিজাজী ফিকাহ্বিদদের মতটাই সহীহ্ এবং অধিক শক্তিশালী দলীল-প্রমাণে সমৃদ্ধ। আর তাহল, পাঁচ ও এক-তৃতীয়াংশ রতলে এক ছা’ হয়।
মনীষী রীস যেমন বলেছৈন, সত্যি কথা এই যে, এই পরিমাণটার পক্ষে অকাট্য দলীল-প্রমাণ দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর এ ব্যাপারে আর কোন সংশয় থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। বহু মনীষী মুহতাহিদই এ মতটির সমর্থক রয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্যহচ্ছে ইমাম মালিক থেকে বর্ণিত সংবাদ।তিনি নবী যুগের অবশিষ্ট মদীনার অধিবাসীদের ব্যবহৃত দুটো ছা’র পরিমাণ তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন। খলীফা হারুন-উর-রশীদের সম্মুখে তাঁর বিচাপরপতি আবূ ইউসুফের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এই ঘটনা ঘটেছিল। এই বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষণের পর ইমাম আবূ ইউসুফ তা মেনে নিয়েছিলেন এবং নিজের মত পরিহার করে ইমাম মালিক ও মদীনাবাসীদের মত স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
আমরা বলব, মদীনায় প্রচলিত নিয়মাদি সম্পর্কে ইমাম মালিকের তুলনায় অধিক আর কে জানতে পারে? এর ফকীহ মুজতাহিদ ইমাম আবূ ইউসুফের সাক্ষ্যের অপেক্ষা বড় সাক্ষ্য আর কার হতে পারে?
বস্তুত ছা’র এই পরিমাণ নির্ধারণ অন্যান্য সব এককের সাথে সম্পূর্ণ একাকার।এটা যুক্তিসঙ্গত বটে দ্রব্যসমূহের প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু অপর নির্ধারণ মেনে নিলে বিরাট পার্থক্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যৌক্তিকতার সীমাও তাতে লংঘিত হয়।
সে যা-ই হোক, ‘মুদ’ –এর পরিমাণও জানা গেছে- মাঝামাঝি ধরনের এক ব্যক্তির পূর্ণ দুই অঞ্চলি পরিমাণ (Double handfull)। এর প্রেক্ষিতে ধারণা হয় যে, এক ও দুই তৃতীয়াংশ ‘রতল’ এর প্রথম পরিমাণ ছড়িয়ে যাবে না। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, এই রকমের চারবার।
আধুনিক মানে শস্য ও ফলের নিসাব
এটা যখন প্রমাণিত যে, ছা ও ‘মুদ’ বাগদাদী রতল হিসেবে পরিমাপ করতে হবে তখন অন্য যে কোন মান দ্বারা তার পরিমাণ নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। যেমন মিসরীয় ‘রতল’ বা দিরহাম কিংবা কিলোগ্রাম অথবা লিটার। কেননা এই সবের মধ্রকার ওজনের হার সুনির্দিষ্ট।
ছা’র পরিমাণ যখন জানলাম, তখন অসাক-এর পরিমাণটাও জানা গেল। এই অসাকেরই পাঁচটি হল শস্য ও ফলের নিসাব।
ইবনে কুদামাহ যেমন লিখেছেন, পাত্র পরিমাপের (****) দ্বারাই নিসাব নির্ধারিত হবে। কেননা অসাক তো পাত্র দ্বারা পরিমাপ পর্যায়ের জিনিস। তাকে ওজনে রূপান্তরিত করাহয়েছে সুসংবদ্ধকরণ, সংস্করণ ও অনুসরণের জন্যে। এ কারণে যাকাত ধার্য করাহয় পাত্র পরিমাপ অনুযায়ী, পাল্লাহর ওজন হিসেবে নয়। আর পাত্রমাপ-ওজন হিসেবে বিভিন্ন হয়ে থাকে। অনেক জিনিসখুবভারী যেমন যব, ডাল ও মসুর।আর কতক জিনিস হালকা-যেমন বার্লি ও ক্ষুদ্র দানা। কতক আছে মধ্যম। ইমাম আহমদ দৃঢ়তা সহকারে নির্ধারণ করেছেন যে, এক ছা’ পীচও এক-তৃতীয়াংশ রতল পরিমাণের গম।
কোন কোন মনীষী বলেছৈন, হাদীসবিদগণ একমত হয়ে বলেছৈন, নবী করীম (স)-এর গৃহীত ‘মুদ’ পরিমাণ ছিল মধ্যম মানের এক ও এক-তৃতীয়াংশ রতল গম। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাঁরা ভারী জিনিস দিয়েই ছা’র পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। আর হালকা জিনিসহলে যাকাত ফরয হবেযদি এ পরিমাণের কাছাকাছি হয়, পূর্ণটা না হলেও। আর এ দৃষ্টিতেই তা মধ্যম মানের গমের ওজনের পরিমাণ নির্ধারণের ভিত্তিতে হতে পারে।
আর যেহেতু বাগদাদী রতল ও মিসরীয় রতলের মধ্রকার পার্থক্য হার হচ্ছে ৯:১০, –যেমন আলী মোবারক সিদ্ধান্ত করেছেন; কেননা মিসরীয় হিসেবে এক ছা-
ক,৮=৯/১০×৫ ১/৩=গম
এ সংখ্যাটি গমের ওজনহিসেবে ২১৭৬ কিলোগ্রামের সমান। আর এ পরিমাণটা সমান হচ্ছে ২.৭৫ লিটার পানির। সাম্প্রতিক কালের হিসেবে মিসরীয় ‘আরদব’ =১২৮ লিটার (পানি)। আর তা ৯৬টি পানি পানের পাত্র পরিমাণ।
তাই হিসেবে কার্যের ফলে আমরা দেখতে পাই, একটি ছা’ =১ ১/৩ পান পাত্র অর্থাৎ ত(১, ৬) মিসরীয় পরিমাপ।
আর এক্ষণে প্রচলিত মিসরীয় মাপ=৬ আছা’ (****) এবং আদব=৭২ ছা’। অসাক্ =৬ ছা ১০=৬০/৬ মিসরীয় মাপের সমান। আর পাঁচ অসাক- শরীয়াতী নিসাব=৫০=১০*৫ মিসরীয় মাপ সমান অর্থাৎ তার চার ‘আরদব ও এক ‘আয়বা’ এক আরদবের ১/৬ (২২ কিংবা ২৪ মুদ-এর একটা মাপ)।
একাদশ হিজরীর মধ্যকালের মালিকীপন্থী আলিম শায়খ আলী আঝুরীও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মিসরীয় পরিমাপ অনুযায়ী নিসাব নির্ধারণ পর্যায়ে তিনি এই কথাই জানতে পেরেছেন। তিনি ১০৪২ হিজরী সনে মিসরীয় পরিমাপে নিসাব নির্ধারণ করতে গিয়ে চার আরদব ও এক ‘অয়বা’ ঠিক করেছেন। তা এ জন্যে যে, ‘মুদ’ হচ্ছে মধ্যম ধরনের দুইখানি না-খোলা না-বন্ধু অঞ্জলি পরিমাণ। বলেছৈন, মিসরীয় পান পানপাত্র এই দুই পূর্ণ অঞ্চলিতে তিনবার ধরলে যা হয়, তা। আর একথাও জানা গেছে যে, তিনশ ছা’ই নিসাব। আর এক ছা’ চার ‘মুদ’।তাহলে মিসরীয় ‘পানি পানপাত্র’ (****) কাদহ্ অনুযায়ী ৪০০ পাত্র সমান। আর তা হচ্ছে চার আরদব ও এক অয়বা।
আর ওজনে মিসরীয় রতল=১৪৪০=৪.৮*৩০০ রতল গমের সমান।
কিলোগ্রামের হিসাবে ৬৫২, ৮=২১৭৬*৩০০ গম ও প্রায়-৬৫৩ কিলোগ্রাম সমান।
পাত্র দিয়ে মাপা হয় এমন জিনিসের নিসাব
পাত্র দিয়ে মাপা হয় এমন জিনিসের নিসাব পূর্ণ হলে বলে যা কিছু হয়েছে, তা সে সব কৃষি ফসলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যা পাত্র দিয়ে মাপা হয় এবং যা যা পাত্র দিয়ে মাপা হয়না- যেমন তুলা, জাফরান ইত্যাদি- তার নিসাব নির্ধারণে মনীষীদের মতবিরোধ রয়েছে।
ক. ইমাম আবূ ইউসুফ বলেন, তাতে মূল্যের হিসাব করা হবে। তুলা ইত্যাদির মূল্য যদি পাঁচ অসাকের সমপরিমাণ শস্যের মূল্যের নিকটবর্তী হয়, তাহলেতাতে যাকাত দিতে হবে। কেননা অসাক’-ই হল যাকাত হিসাবের ভিত্তি, হাদীসেও তা-ই বলা হয়েছে।
এ কারণে তুলার যাকাতের মূল্যযদি পঞ্চাশ মাপের গমেরমূল্য দাঁড়ায়তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। কেননা খাদ্যশস্যের মধ্যে গমের মুল্য তুলনামূলকভাবে সস্তা- বিশেষ করে মিসরে।
খ. ইমাম মুহাম্মদ বলেছেন, সেই জিনিসটি যা দিয়ে মাপা হয় তার উচ্চতার পাঁচ গুণ নিসাব ধরতে হবে। কেননা পাত্র দিয়ে মাপার জিনিসের অসাক দ্বারা পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে এজন্যে যে, এ পর্যায়ে তা-ই হচ্ছে উচ্চতর মাপ।
এক্ষণে তুলা যদি এ যুগে ‘কিন্তার’ মিসরীয় প্রায় ১১২ রতল বা ৪৪.৯৩ কিলোগ্রাম মাপা হয়, তাহলে পাঁচ ‘কিস্তান’ হবে তার নিসাব। কেননা দেশ, অঞ্চল ও বাজারের পার্থক্যের কারণে উচ্চতর পরিমাণ ধরা খুবই কঠিন। এর ফলে বড়ই বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
গ. যা পাত্র দিয়ে মাপা হয় না, এমন জিনিসের নিসাব কারো-কারো দুই’শ দিরহাম নির্ধারণ করতে হবে। আর তাই নগদ অর্তের নিসাব। সে জিনিসের নিজের জন্যে কোন নিসাব নির্ধারিত না হওয়ার কারণে অন্য জিনিসের নিসাবই সে জন্যে নির্দিষ্ট করতে হবে।
ঘ. দাউদ বলেছেন, যা পাত্র দিয়ে পরিমাপ করা হয় না, তার পরিমাণ কম বেশী যা-ইকহোক, তার উপরই যাকাত ধার্য হবে।
ঙ. ইমাম আহমদের মতে যা পাত্র দিয়ে মাপা হয় না, তা ওজনে মাপতে হবে। এ কারণে জাফরান, তুলা ও তার মত অন্যান্য জিনিসকে এক হাজার সাতশত রতল দিয়ে তার ওজন ঠিক করতে হবে। কেননা তা পাত্র দিয়ে মাপা হয় না বলে তার ওজনটাই পাত্র মানের স্থলাভিষিক্ত হবে। যেহেতু শরীয়াত তার যে নিসাব পেশ করেছে তার পরিমাণ ওজন দিয়ে যাকাত দিতে হবে। আর তা হচ্ছে ৬৫৩ কিলোগ্রাম।
ইবনে কুদামাহ বলেছেন, এ সব কথারমূলে এমন কোন দলীল আছে বলে জানা নেই, যার উপর নির্ভর করা যেতে পারে। এসব কথাকে রদ করে দেয় রাসূলে করীম (স)-এর বাণী: ‘পাঁচ অসাকের কমের উপর কোন যাকাত নেই; আর কম বা বেশী যা-ই পরিমাণ হোক, তার উপর যাকাত ধার্যকরণ যাকাতে সর্ব প্রকার মালেরই বিরোধী।
যে সব জিনিসের ওশর ধার্য হয়, তার বিরোধী কাজ হচ্ছে অন্য জিনিসের নিসাব কোন জিনিসের ব্যাপারে নির্ধারণ করা। আর যার উপর যাকাত হয়, তার কম পরিমাণে উপর যাকাত ধার্যকরণের কোন নজীর ইসলামী শরীয়াতে নেই। আর অস্থায়ী জিনিসের ভিত্তিতে কিয়াস করও ঠিক নয়। কেননা অস্থায়ী জিনিসের মূল্যের উপর কোন যাকাত ধার্য হয় না, ধরা হয় তার মূল্যের উপর, আর সেই ধরা মূল্যের হিসাবে যাকাত দিতে হবে।
এ তো সেই মালের কথা যার যাকাত সেই মাল থেকেই নেয়া হবে। তাই সেই জিনিস দ্বারাই নিসাব ঠিক করতে হবে- যেমন শস্যের ক্ষেত্রে করা হয়। আর যেহেতু তা জমির উৎপাদন, তাই তাতে ওশর বা অর্ধ-ওশর ধার্য হবে। উপরে যাদের মত উদ্ধৃত হয়েছে, সে মতের উপর কোন ইজমা হয়নি। তাদের মত সেই অর্থেও নয়; তাই তা বলা উচিত নয়। কেননা তার কোন দলীল নেই।
আমাদের গৃতীত মত
আমাদের গৃহীত মত হচ্ছে, যা পাত্র দিয়ে মাপা বা ওজন করা হয় না তাতে মূল্যের হিসাবে নিসাব ঠিক করতে হবে। কিন্তু তা যাকাত দেয়ার মাল হতে হবে, যদিও তার নিসাব শরীয়াতে বলে দেয়া হয়নি। তাই তা অন্য জিনিস দ্বারা নির্ধারণ করতে হবে। আর অন্য জিনিস দ্বারা তার নিসাব নির্ধারণ যখন একান্তই অপরিহার্য, তখন যা অসাক হিসেবে ওজন করা যায় তার মূল্যকে গণ্য করতে হবে। কেননা তার দলীল রয়েছে। ইমাম আবূ ইউসুফও এ মত দিয়েছেন। কিন্তু গম বা চাল ইত্যাদি, যা ওজন করা হয়, তার নিকটবর্তী মূল্য হিসাব করতে বলেছেন। আমি এক্ষেত্রে ইমাম আবূ ইউসুফের মতের বিরোধিতা করছি। তাই এতে যদিও গরীব-মিসকীনের ভাগ্যে বেশী পড়বে, কিন্তু সেই সাথে মালেল মালিকদের প্রতি অবিচার হবে।
এ কারণে আমি মনে করি, প্রচলিত ধরনের পাত্র দিয়ে মাপার জিনিসগুলো যা ওজন করা হয় তার গড় পরিমাণ ধরতে হবে কমও নয় বেশীও নয়। তাতে ধনী ও গরীব উভয়ের স্বার্থই রক্ষিত হবে।
যা অসাক হিসেবে ওজন করা হয় তার গড় বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে বিভিন্ন হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থার দরুনও তা হয়।কাজেই তার নিসাব নির্ধারণের দায়িত্ব প্রত্যেক দেশের শরীয়াতবিদদের উপর অর্পণ করা বাঞ্ছনীয়। কোন দেশে হবে গম, কোন দেশে হবে চাল। এভাবে জাফরান, নার্গিস প্রভৃতি অধিক মূল্যবান জিনিসের নিসাব নির্ধারণ সম্ভব হবে। এগুলো জমিতে সাধারণ উৎপাদন করা হয় না, যেমন হয় চাল ও গম। তাই আমাদের দেশের গম বা চাল ইত্যাদি শস্যের গড় হিসেবে কিলোগ্রাম মূল্য ধরতে হবে।তুলা, আখ ইত্যাদিতেও এ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
নিসাব কখন হিসাব করা হবে
ফল শুকিয়ে যাওয়ার পর তার নিসাবের হিসাব করতে হবে অর্থাৎ কাঁচা খেজুর শুকিয়ে গেলে, আঙুর কিশমিশ হলে, আর কৃষি ফসলের খোসা পরিষ্কার করার পর।
ইমাম গাযালী বলেছৈন, যখন কিশমিশ বা শুকনো খেজুর হবে, তখনই তার অসাক ওজন করা হবে। আর শস্যের ক্ষেত্রে ছাল বা খোসা পরিষ্কার করার পর। তবে যা খোসাসহ পেষা ও গুড়ি বানানো হয়; আর যা কাঁচা রাখা হয়, শুকনো হয় না, তার কথা আলাদা। যা খোসা না ছাড়িয়েই জমা রাখা হয়, তার খোসা দূর করতে মালিকদের বাধ্য করা ঠিক হবে না। তাতে তাদের ক্ষতি হওয়ার আশংকা।
কোন কোন ফিকাহ্বিদ খোসা দূর করা জিনিসের দ্বিগুণকে নিসাব ধরেছেন। যেন খোসা দূর করার পর মূল্যের নিসাব যথার্থ হয়। তবে প্রত্যেক ধরনের শস্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের কাছ থেকে সে বিষয়ে জেনে নেয়া ভাল। কেননা প্রত্যেক ধরনের কৃষি ফসলের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বিভিন্ন।
চতুর্থ আলোচনা
যাকাতের পরিমাণ ও তার পার্থক্য
ওশর ও অর্ধ-ওশর
বুখারী হযরত ইবনে উমর থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন:
(আরবী*********)
আকাশের পানিতে ও খা-ঝর্ণার পানিতে যে জমি সিক্ত হয়, কিংবা জমিযদি গর্তসমন্বিত নিচু হয়, তাহলেতার ফসলের এক-দশমাংশ দিতে হবে।আর যে জমিতে সেচকার্য করতে হয়, তার ফসলের অর্ধেক ওশর- বিশ ভাগের একভাগ দিতে হবে।
মুসলিম শরীফে হযরত জাবির থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলেছেন: ‘যে জমি খাল-ঝর্ণা বা মেঘের পানিতে সিক্ত হয়, তাতে ওশর ধার্য হবে। আর যাতে কৃত্রিমভাবে সেচ করতে হয়, তাতে অর্ধ-ওশর দিতে হবে।’
ইয়াহ্ইয়া ইবনে আদম হযরত আনাস থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: যে জমিকে আকাশসিক্ত করে তাতে নবী করীম (স) ওশর ধার্য করেছেন। আর যে জমি কৃত্রিমভাবে সিক্ত করতে হয়, তাতে অর্ধ-ওশর।
ইবনে মাজা হযরত মুআয থেকে বর্ননা উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলে করীম (স) আমাকে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। আমাকে মেঘের পানিতে সিক্ত কিংবা যে জমি স্বতঃই সিক্ত, তা থেকে ওশর গ্রহণ করতে এবং যা কৃত্রিমভাবে সিক্ত করা হয় তা থেকে অর্ধ-ওশর গ্রহণ করতে এবং যা কৃত্রিমভাবে সিক্ত করা হয় তা থেকে অর্ধ ওশর গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন।’
‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মোটকথা, যে জমিই কোনরূপ কৃত্রিম উপায়ে ও পন্থায় সিক্ত হয়, তার ফসলে অর্ধ-ওশর ধার্য হবে। আর যে জমি কোনরূপ স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছাড়াই সিক্ত হয়, তাতে ওশর ধার্য হবে। হাদীসে এ কথাই বলা হয়েছে। কেননা স্বতন্ত্রভাবে দেয়া শ্রমের যাকাত ধার্যকরণে একটা মোটামুটি প্রভাব রয়েছে, যেমন গবাদিপশুকে ঘাস কেটে খাওয়ানো হলে তার যাকাত হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে যাকাতের পরিমাণ হ্রাসকরণের সে প্রভাব অবশ্যই কার্যকর হবে। তা ছাড়া যাকাত তো শুধু ক্রমবর্ধমান সম্পদে ফরয হয়ে থাকে। আর কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমানতা হ্রাসকরণেএকটা বিশেষ প্রভাব রাখে। এ কারণে ফরয পরিমাণে এই ক্রিয়াটা অবশ্যই কার্যকর হবে।
পানি ক্রয় করে সেচ করা হলে তাও এই কৃত্রিম সেচ বলে গণ্য হবে। বছরের একাংশে যে জমির সেচ করতে হয় ও বাকি সময় করতে হয় না।
ক. সে জমির অর্ধেক বছর কৃত্রিম সেচ করতে হয়, আর বাকি অর্ধ বছরসেচ কার্য করার প্রয়োজন হয় না, তার ফসল থেকে ওশরের এক-চতুর্থাংশ দিতে হবে। ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন, ‘এই ব্যাপারে কোন মতবিরোধ আছে বলে আমি জানি না। কেননা যদি জমির উভয় খণ্ডের সারা বছরের অবস্থা একই প্রকারের হত, তাহলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। যখন অর্ধ বছর এই অবস্থা থাকে, তখন সেই অর্ধ বছরের জন্যে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
খ. যদি দুটি খণ্ডের এক খণ্ডে অন্য খণ্ডের তুলনায় অধিক সেচ করা হয়, তাহলে এই অধিক সেচের অংশের ব্যবস্থাই গণ্য করা হবে। অপর অংশের অবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। আতা, সওরী, আবূ হানীফা এবং ইমাম শাফেয়ীর একটি কথা এই মতের সমর্থনে রয়েছে।
গ. পরিমাণ জানা না গেলে ওশর ধার্য করায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতেহবে। কেননা ওশর ফরয করাটা মৌলিক ব্যাপার। কেবলমাত্র কষ্ট থাকলেই তা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। তাই যেখানে প্রত্যাহারকারী কিছু নেই, সেখানে মূল বিধান কার্যকর হবে।যেহেতু জমি চাষে প্রায়শই কষ্ট না থাকার কথা- সেটাই আসল অবস্থা। কেবল সন্দেহের কারণে তার অস্তিত্ব আছে বলে মনে করাযাবে।
সেচ প্রয়োজন না হলেও কষ্টের সম্ভাব্যতা
যন্ত্রপাতির সাহায্যে কৃত্রিমভাবে সেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন কারণে অনেক সময় কষ্টের মাত্রা অধিক হয়ে পড়তে পারে।যেমন পানি প্রবাহের জন্যে খাল ও নানা-ড্রেন কাটা বা গর্ত খোদার প্রয়োজন হতে পারে। এই বাবদ যে কষ্ট ও ব্যয়হবে তা কি যাকাত ধার্যকরণে গণ্য হবে?
এই পর্যায়ে ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থকার মত দিয়েছে, খালও গর্ত খোদায় যে কষ্ট বা অর্থ ব্যয় হয়, তা যাকাতের হার কম করণে কোন প্রভাব রাখবে না। তার কারণ হচ্ছে, জমি আবাদকরণ সংক্রান্ত কাজের সাথে এগুলো জড়িত এবং তা প্রতি বছরে বারবার করার প্রয়োজন হয় না।
রাফেয়ী-ও এই মত সমর্থন করেছেন। তিনি কারণ দর্শাতে গিয়ে বলেছেন, খাল-ড্রেন কাটা বা গর্ত খোদার কষ্টটা জমি আবাদকরণ পর্যায়ে অবশ্যই বহন করতে হবে। যখন তা হয়ে যাবে এবং অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই পানি পৌঁছতে থাকবে, তখন তাতে ওশর ধার্য হওয়া শুরু হবে।
ইমাম খাত্তাবী বলেছেন, ‘কৃষি ফসলের জন্যে যদি খাল-ড্রেন কাটতে হয়, তাহলেতা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনাকরতে হবে।যদি প্রথম খোদাইর কষ্টের অধিক কষ্ট তাতে না লাগে- কোন কোন সময় যদি তা পুনঃ খনন বা পরিষ্কার-করণের প্রয়োজন হয়, তাহলে তার উপর ওশর ধার্যকরণে খালও জমির উপর পানি প্রবাহিত করণের পথই হবে তার পথ। যদিও তাতে কষ্ট বেশীহবে- তাতে বেশী পানি প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে বারবার হয়ত বা করতে হতে পারে এবং তখন নতুন করে খোদাইর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তখন তার পথ হবেসেই সব কূপের পানির পথ যেখান থেকে জন্তুর সাহায্যে পানি টেনে নেয়া হয়।
© Bangladesh Jamaat-e-Islami