মতবৈষম্যের কারণ
এ মতবৈষম্যের প্রথম কারণ যাকাতের মৌলিক তাৎপর্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের অবস্থিতি। তা একটা ইবাদত ও আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মাধ্য; কিংবা ধনীদের ধন-মালে ফকীরদের জন্যে আরোপিত ও নির্ধারিত অধিকার- এই প্রশ্নে দৃষ্টিকোণের পার্থক্য রয়েছে। আমাদের মতে তা একটা অর্থ সংক্রন্ত কর- নিসাব পরিমাণ ধন-মালের মালিকের ওপর ফরয করা হয়েছে।
সত্যি কথা হচ্ছে- একাধিকবার আমরা যেমন বলেছি- দুটি তাৎপর্য ধারণ। কিন্তু শাফেয়ী ও আহমাদ এবং মালিকী মাযহাবের ও জাহিরী ফিকাহবিদদের কারো কারো করো মতে যাকাতের ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের তাৎপর্যটি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই তাঁর যাকাতের মূল জিনিসটিই- যার ওপর দালিল আরোপিত হয়েছে- দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মূল্য প্রদান করাকে আদৌ জায়েয মনে করেননি।
আর আবু হানীফা, তাঁর মতের অন্যান্য এবং অপর দিকের ইমামগণের মতে যাকাত হচ্ছে একটি সম্পদগত অধিকার, যদ্দারা গরীব লোকদের দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাওয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের মতে জিনিসের মূল্য দেয়া যেতে পারে।
মূল্যদানে নিষেধকারীদের দালিল
যাকাত জিনিসের মূল্য দেয়া জায়েয নয় বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাদের বিভিন্ন দলিল রয়েছে। তা যেমন চিন্তা বিবেচনামূলক তেমনি পূর্বর্তীদের উক্তি। নিন্মে আমরা তার বিভিন্নতা ও বিন্যাসকে তুলে ধরছিঃ
১. শাফেয়ী মতের হারামাইনের ইমাম আল- জুরাইনী বলেছেনঃ আমাদের মতের লোকদের নির্ভরযোগ্য দলিল হচ্ছে, যাকাত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের মাধ্যম। আর যে কাজ এ পর্যায়ের হবে, তাতে সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ পালন করাই বিধয়। কেউ যদি তার প্রতিনিধিকে বলেঃ একটি কাপড় ক্রয় কর, এবং সে প্রতিনিধি যদি জানে যে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসা এবং সে তার মালিকরে পক্ষে অধিক মুনাফাদায়ক কোন পণ্য পায় এবং সে মনে করে যে, মালিক সেটাকে অধিক মানাকাদায়ক দেখলে তার বিরোধিতা করবে না, এটা যদি হতে পারে তাহলে আল্লাহ যা দেবার আদেশ করলেন সেটা দিয়ে তা পালন করাই তো অধিক উত্তম হওয়া বাঞ্ছনীয়।
অনুরূপভাবে নামাযে যেমন গাল ও চিবুকের ওপর সিজদা করা জায়েয হয় না, কেননা সিজদার স্থান হচ্ছে কপাল ও নাক। আর তার কারণ বিনয় আনুগত্য আত্মসমর্পণের ভাবধারা এভাবেই প্রাকশিত হওয়া সম্ভব। তাই গাল ও চিবুকের ওপর সিজদা করা হলে তা মূল দলিলের বিপরীত হবে এবং আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারমূলক ভাবধারও বিনষ্ট হবে। অনুরূপভাবে যাকাতে ছাগীর বা উটের মূল্য প্রদান জায়েয হবে না। দানা বা ফলের মূল্য দিলে যাকাত আদায় হবে না, তাতে যে পরিমাণ দেয়, সেই পরিমাণ ফসল ও ফলই দিতে হবে। তা না করা হলে মূল দলিলের পরিপন্থী কাজ হবে। আল্লাহ্ দাসত্বমূলক ভাবধারারও বিপরীত হবে। যাকাত তো নামাযেরই বোন। [আরবী************]
এ কথার ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে যাকাত দেয়ার আদেশ করেছেন সংক্ষিপ্তভাবে, শুধু এই কথা বলেঃ (আরবী***********) ‘এবং তোমরা যাকাত দাও’ অতঃপর রাসূলের সুন্নত কুরআনের এ সংক্ষিপ্ত কথাটুকুর বিস্তারিত ব্যাখ্যঅ দিয়েছে। ধন-মালের কত পরিমাণ থাকলে কি পরিমাণ যাকাত বাবদ দিতে হবে, তাও বলে দিয়েছে। যেমন রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ ‘প্রত্যেক চল্লিশটি ছাগীতে একটি করে ছাগী’ দিতে হবে, ‘প্রতি পাঁচটি উটে একটি করে ছাগী দিতে হবে’ প্রভৃতি। তার অর্থ যেন আল্লাহই বলেছেনঃ ‘তোমার যাকাত দাও প্রতি চল্লিশটি ছাগীতে একটি ছাগী।’ ফলে এ দলিলের বলে যাকাত গরীবের অধিকারের জিনিস হয়ে দাঁড়াল। অতএব এ মূল ছাগী থেকে দারিদ্রদের বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে এর কারণ বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করা উচিত বা জায়েয হতে পারে না।
২. অপর একটি ব্যাপারে এ জিনিসেকে অধিকতম তাগিদপূর্ণ করে দিয়েছে। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী মালিকী সেই ব্যাপারটির উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে, যাকাত বাধ্যকরণ- এ বাধ্যবাধকতায় লোকদের বন্দীকরণ শুধু মাল হ্রাসকরণের লক্ষ্যেই নয়- যেমন ইমাম আবূ হানীফা মনে করেছেন। কেননা মক মানের জিনিস নির্ধারণে শরীয়াত পালনের অধিকার পূরণের পথে একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা। তা কম পরিমাণের ওপর শরীয়াতের বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যাওয়ার উপায়। কেননা সম্পদের মালিক চায়, তার মালিকানা যথাযথ বর্তমান ও অক্ষুণল্ণ থাক আর অপর জিনিস থেকে বোঝা চলে যাক। তার মন যখন ধন-মালের দিকে ঝুঁকে পড়বে ও তার সাথে জড়িয়ে পড়বে, তখন মন ও মালের সেই অংশের মধ্যবর্তী যে সম্পর্ক তা ছিন্ন করে দেয়াই শরীয়াত পালনের লক্ষ্য। এ কারণে মালের সেই নির্দিষ্ট অংশটিই যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া অবশ্য কর্তব্য। [আরবী************]
৩. তৃতীয় তাৎপর্য- আর তা হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে যাকাত ফরয করা হয়েছে। সে সাথে মালের নিয়ামত দেয়ার জন্যে আল্লাহ্র শোকর আদায়স্বরূপ। আর প্রয়োজন তো বিচিত্র ধরনের হয়ে থাকে। অতএব ধার্য ফরযও বিচিত্র ধরনের হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়। তবেই না ফকীর মিসকীনরা সর্বপ্রকারের মাল পেয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এবং আল্লাহর দেয়া নিয়ামতে জাতীয় জিনিস দিয়ে ফকীর- মিসকীনের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারলেই নিয়ামতের শোকর আদায় হতে পারে। [দেখুন (আরবী***************)]
৪. অতঃপর কথা হচ্ছে, আবূ দাউদ ও ইবনে মাজা [এই হাদীস (আরবী***********) গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। শাওকানী লিখেছেনঃ হাকেম বুখারী ও মুসলিম আরোপিত শর্তানুযায়ী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। তার সনদে ‘আতা মুয়ায থেকে’ উদ্ধৃত হয়েছে, অথচ আতা মুয়াযের কাছ থেকে শুনতে পাননি। কেননা আতার জন্ম হয়েছে তাঁর মুত্যুর এক বছর পর। (আরবী**************)] বর্ণনা করেছেন, নবী কারীম (স) যখন হযরত মুয়ায (রা) কে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন তখন তাঁকে বলেছিলেনঃ দানা থেকে দানা গ্রহণ কর, ছাগল (আরবী ***********) থেকে ছাগী (আরবী************) গ্রহণ কর, উট থেকে উট গ্রহণ কর এবং গরু থেকে গরু গ্রহণ কর। এটা অকাট্য স্পষ্ট দলিল। অতএব যা বলা হয়েছে তাই করার ওপর স্থিতি গ্রহণ করা কর্তব্য। কাজেই তার মূল্য গ্রহণ করে এ নির্দেশ পালণ থেকে সরে যাওয়া জায়েয হবে না। কেননা মূল্য গ্রহণ করা হলে দানার স্থান এমন জিনিস গ্রহণ করা হবে যা দানা নয়। অনুরূপভাবে ছাগলের পরিবর্তে ছাগী না দিয়ে অন্য কোন জিনিস নেয়া হবে- যাকাত বাবদ। আর তাহলে হাদীসের নির্দেশের বিপরীত কাজ কার হবে।
মূল্য প্রদান জায়েয মতের দলিল
যাঁরা মূল জিনিসের পরিবর্তে তার মূল্যটা যাকাত বাবদ দেয়া জায়েয বলেছেন, তারা হলেন, হানাফী মতের ও তার সমর্থক ফিকাহবিদ। তাঁরা তাঁদের মতের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন এবং এ পর্যায়ে যুক্তি ও বর্ণিত দলিলের ওপর তাঁর নির্ভরতা গ্রহণ করেছেন, সেসব উপস্থপিত করেছেন। আমরা এখানে তার উল্লেখ করছিঃ
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ ‘তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর।’ এ দলিল অকাট্যভাবে বলছে যে, গ্রহণীয় জিনিসটি অবশ্যই ‘মাল’ হবে। আর মূল্যটাও ‘মাল’। অতএব মূল্য দিলে দলিল অনুরূপ কাজ হবে।
তা ছাড়া নবী করীম (স) কুরআনের ‘মুজমাল’ অবিস্তারিত কথার বিশ্লেষণ দিয়েছেন এই বলে- যেমন, ‘প্রতি চল্লিশটি ছাগল একটি করে ছাগী নিতে হবে।’ এটা বলে গবাদি পশুর মালিকদের প্রতি সহজতা বিধান করা হয়েছে। কেবল সেই ‘ছাগী’ দেয়ার বাধ্যতা আরোপ করার উদ্দেশ্য একথা বলা হয়নি। কেননা গবাদি পশুর মালিকদের হাতেও নগদ টাকা থাকে। কাজেই তাদের কাছে রক্ষিত সেই নগদ টাকা দ্বারা যাকাত আদায় করা তাদের পক্ষে সহজতর পন্থ। [আরবী***********]
২. বায়হকী তাঁর সনদসূত্রে এবং বুখারী তায়ূস থেকে টীকাস্বরূপ বর্ণনা করেছেনঃ মুয়ায ইয়েমেন গিয়ে লোকদের বলেছিলেনঃ ‘তোমরা আমাকে পাঁচগজি কাপড় বা অন্য কোন পোশাক দাও। আমি তা তোমাদের কাছ থেকে যাকাতের স্থানে বা যাকাত বাবদ গ্রহণ করব। কেননা তাই তোমাদের পক্ষে সহজ এবং মদীনায় বাসবাসকারী মুহাজিরদের জন্যেও তা খুবই কল্যাণবহ।’
অপর বর্ণনায় ভাষাটি এইঃ ‘আমাকে তোমরা কাপড়ের একটি বান্ডিল দাও। আমি তা তোমাদের কাছ থেকে চাল ও যবের স্থালে নিয়ে নেব।’ [আরবী**********]
এটা এজন্যে যে, ইয়েমেনবাসীর কাপড় বুনন ও বস্ত্র শিল্পে খুবই খ্যাতিমান ছিল। কাজেই এ কাপড় দেয়া ছিল তাদের পক্ষে অতি সহজ। অপরদিকে মদীনাবাসীদেরও খুব বেশি প্রয়োজন ছিল এ কাপড়ের। আর ইয়েমেনবাসীদের দেয়া যাকাত সেখানকার লোকদের প্রয়োজনের চাইতে বেশি হত। ফলে মুয়ায তা মদীনায় পঠিয়ে দিতেন- যা ছিল ফিলাফতের কেন্দ্র, রাজধানী। মুয়াযের উক্ত কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ইয়েমেনের ফিকাহবিদ ও তাবেয়ী যুগের ইয়েমেনী ইমাম তায়ূস তা বর্ণনাও করেছেন। তা প্রমাণ করে যে, অপর যে হাদীসে রাসূলে করীম (স) ‘দানা থেকে ও উটের যাকাত বাবদ ছাগী নাও’ বলে যে আদেশ করেছেন, তা থেকে ঠিক সেই জিনিসটিই বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে, এমন কথা বুঝতে পারেন নি। কিন্তু যেহেতু ধন-মালের নির্ভরশীল। যে জিনিসের যাকাত বাবদ সেই জিনিসটা গ্রহণ করায় ধন-মালের মালিকদের প্রতি সহজতা বিধান করা হয়। কেননা প্রত্যেক মালের মালিকের পক্ষে সেই জাতীয় মাল দেয়া, যা তার নিকট রয়েছে, সহজ হয়। যেমন কোন বর্ণনায় সাহাবিগণের উক্তি হিসেবে এসেছে যে, নবী করীম (স) দিয়েতের ক্ষেত্রে কাপড়ওয়ালাদের জন্যে কাপড় দেয়ার পথ করে দিয়েছিলেন। [আরবী**********]
৩. আহমাদ ও বায়হাকী বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, ‘নবী করীম (স) যাকাত বাবদ পাওয়া উটের পালের মধ্যে একটা খুব বয়ষ্ক উষ্টী দেখতে পেয়ে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেনঃ এই উষ্ট্রটি যে নিয়ে এসেছে আল্লাহ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। লোকটি বললেঃ হে রাসূল! আমি যাকাতের মধ্যে থেকে দুটি উটের পরিবর্তে এই একটি উট নিয়েছি।’ তখন নবী করীম (স) বললেনঃ তাহলে ঠিক আঁছে।
এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়েও দলিলরূপে গৃহীত হওয়ার যোগ্য। [আরবী ***********] আর এ হাদীসটি উপরিউক্ত কথাই প্রমাণ করে। কেননা দুটি উটের পরিবর্তে একটি উট গ্রহণ করা মূল্যই গ্রহণেরই শামিল।
৪. যাকাতের লক্ষ্য হচ্ছে, ফকীরকে স্বচ্ছল বানানো, অভাবগ্রস্তের অভাব মোচন এবং আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দারী উম্মত ও মিল্লাতের সামিষ্টিক কল্যাণ সাধন। আর তা মূল্য গ্রহণ দ্বারাও সাধিত হতে পারে, যেমন তা হতে পারে ছাগী নিলে। তাবে অনেক সময় মূল জিনিসটির পরিবর্তে মূল্য দিলে এ লক্ষ্য অধিক ভালো ও সহজভাবে পূর্ণ হতে পারে। কেননা প্রয়োজন তো বিচিত্র ধরনের। আর মূল্য গেলে তদ্দারা যে কোন প্রয়োজন পূরণ সম্ভব।
৫. তাছাড়া মূল্য জিনিসের পরিবর্তে সেই জাতীয় অন্য জিনিস অবলম্বন ইজমার ভিত্তিতে জায়েয। যেমন কেউ তার ছাগলের যাকাত যদি তার নিজের ছাগল ছাড়া অন্য ছাগল থেকে দেয়, কেউ তার জমির ওশর তার নিজের কৃষির ফসল ছাড়া অন্য ফসল ও দানা দিয়ে দেয়, তাহলে তা আদায় হবে। তাহলে দেখা গেল এক জাতীয় জিনিস থেকে অন্য জাতীয় জিনিস চলে যাওয়া- একটির পরিবর্তে অন্যটি দেয়া জায়েয, এই কথায় কযী ইবনুল আরাচীর অভিমতের প্রতিবাদ রয়েছে। কেননা তিনি মনে করেন যে, যে মাল থেকে যাকাত ফরয করা হয়েছে। সেই জিনিসের অংশ নির্ধারণে শরীয়াতের বিধানদাতার লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের মালিকের অন্তর ও সেই জিনিসের নির্দিষ্ট অংশের সাথে যে একাত্মাতার সম্পর্ক রয়েছে তা ছিন্ন করা। তার কারণ এই যে, শরীয়াতদাতার যদি তাই লক্ষ্য হত, তাহলে মালের এ নির্দিষ্ট অংশের পরিবর্তে অন্য মাল থেকে সেই পরিমাণ দিলে যাকাত আদায় হয়ে যেত না।
৬. সায়ীদ ইবনে মনসুর তাঁর ‘সুনানে আতা’ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, উমর ইবনুল খাত্তাব যাকাত বাবদ দিরহামের পরিবর্তে জিনিস গ্রহণ করতেন। [আরবী**********]
তুলনা ও অগ্রাধিকার দান
আমি মনে করি, উভয় পক্ষের দলিল- প্রমাণসমূহ পর্যালোচনা ও তুলন করার পর আমাদের সম্মুখে এ বিষয়ে হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিকোণটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ মাযহাব পূর্বোদ্ধৃত খবর ও সাহাবী- তাবেয়ীনের উক্তির ওপর ভিত্তি করেছে। বাস্তব চিন্তা ও বিবেচনাও এই মাযহাবের যৌক্তিকতা অকাট্য করে তোলে।
প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যাকাতের ব্যাপারে ইবাদতের দিকটির প্রাধান্য স্বীকার করা ও মূল দলিলের আক্ষরিক অনুসরণের শর্তে নামাযের ওপর ‘কিয়াস’ কার যাকাতের সেই প্রকৃতির সাথে সংগতিসম্পন্ন নয় যাতে হানাফীদের বিরোধীরা নিজেরা অপর দিকটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
আসলে তা একটা অর্থনৈতিক অধিকার বা দায়িত্ব এবং বিশিষ্ট ধরনের ইবাদত- এ দুটোই তাতে সন্নিবেশিত। বালক ও পাগলের মারে তাঁর এ কারণেই যাকাত ফরয ধরেছেন। অথচ তাদের ওপর নামায ফরয ধার্য হয়নি। এ পর্যায়ে তাঁর যা বলেছেন, এখানে তাঁদের উচিত ছিল সে কথার উল্লেখ করা। তদ্দারা তাঁরা হানাফীদের প্রতিবাদ করেছেন অথচ হানাফীরা শরীয়াত পালনে অযোগ্য লোকদের ওপর নামাযের ওপর কিয়াস করে- যাকাতকে ফরয করেননি।
বস্তুত হানাফী মাযহাবের মতটি আমাদের যুগে অধিক উপযোগী। জনগণের পক্ষেও অধিক সহজাসাধ্য। হিসেব রক্ষা করাও কষ্টমুক্ত। বিশেষ করে যদি সেখানে এমন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থাকে যা যাকাত সংগ্রহ, একত্রিতকরণ ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে। মূল জিনিস গ্রহণ করা হলে তা তার স্থান থেকে নিয়ে বহু দুরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছানো, তার পাহাপরাদারী করা ও তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি কাজে অনেক বেশি ব্যয় হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর যাকাত বাবদ গবাদি পশু এলে তার খাবার পনি, বাসগৃহ ও ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সর্বক্ষণ তার কাছে লোকের উপস্থিতির ব্যবস্থা করায় খুব বেশি অর্থ ব্যয় ও কষ্ট স্বীকার অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তা ‘কর’ ব্যয় হ্রাসকরণ নীতিরও পরিপন্থী।
উমর ইবনে আবদুল আজীজ ও হাসান বসরী থেকেও এ মতিটিই বর্ণিত হয়েছে, সুফিয়ার ও সওরীও এ মতই প্রকাশ করেছেন। ফিতরায় যাকাত ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে ইমাম আহামাদেরও একথা বলে বর্ণিত হয়েছে। [আরবী**********]
ইমাম নববী বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী হানাফী মতের সাথে আনুকূল্য করেছেন। হানাফীদের মতই এর নিজের মত অথচ তিনি বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু উপরিউক্ত দলিল প্রমাণই তাঁকে হানাফীদের অনুরূপ মত গ্রহণে বাধ্য করেছে। [আরবী************]
তা এভাবে হয়েছে যে, ইমাম বুখারী তাঁর হাদীস গ্রন্থে ‘যাকাতের দ্রব্যাদি গ্রহণ’ (আর তা মূল্য হিসেবে) শীর্ষক একটি অধ্যায় দাঁড় করেছেন। তাতে তিনি দলিল হিসেবে উপস্থিত করেছেন হযরত মুয়াযের সেই কথা বা তায়ূস তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, তিনি যাকাত বাবদ দানা শস্য ও যবের বদলে লোকদের কাছ থেকে কাপড় নেয়ার কথা বলেছিলেন। কেননা তা দেয়া তাদের পক্ষে সহজতর ছিল এবং মদীনায় বসবাসকারী লোকদের জন্যেও অধিক কল্যাণবহ ছিল। [বুখারী তায়ুস বর্ণিত উক্ত সংবাদটি ‘মুয়াল্লাকে’ স্বরূপ দৃঢ়তা সহাকরে উদ্ধৃত করেছেন। তা যে তাঁর কাছে সহীহ, এটাই তার প্রামণ। তায়ূস ইয়েমেনের ইমাম ও তাবেয়ী যুগের ফিকাহবিদ ছিলেন। মুয়াযের ইয়েমেন অবস্থানকালীন যাবতীয় খবর সম্পর্কে অধিক অবহিত ছিলেন। ইমাম বুখারী এ সংবাদটি দলিল হিসেবে তাঁর গ্রন্থে উদ্ধৃত করায় বোঝা যায় যে, তিনি ওটাকে শক্তিশালী মত মনে করেন। আরবী************)]
ইমাম বুখারী অবশ্য অন্যান্য হাদীসকেও দলিল হিসেবে তুলে ধরেছেন। গবাদি পশুর যাকাত পর্যায়ে হযরত আবূ বকর (রা) লিখিত চিঠিখানিও তন্মধ্যে একটি। তাতে লিখিত ছিলঃ
‘যারা যাকাত হবে এক বছর বয়সের উষ্ট্রী ছানা, তা তার কাছে না থাকলে তার কাছ থেকে দুই বছর বয়সের উষ্ট্রী ছানা গ্রহণ করা হবে। তবে যাকার আদায়কারী তাকে বিশ দিরহাম কিংবা দুটি ছাগী ফেরত দেবে।’ তাহলে এক বয়সের পশুর স্থলে অন্য বয়সের পশু গ্রহণ করা যায়- পার্থক্যের মূল্যটা দিরহাম বা ছাগী বাবদ ফেরত দিলেই হল। তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঠিক যে জিনিসটি যাকাত বাবদ চিহ্নিত হবে ঠিক সেই আসল জিনিসটিই ফকীরকে দিয়ে দিতে হবে- এমন কথা নয়। তবে সম্পদের মালিকের পক্ষে যা সহজে দেয়, তা-ই গ্রহণ করা যেতে পারে।
কিন্ত ইবনে হাজম তায়ূস বর্ণিত উক্ত হাদীসকে দলিল হিসেবে উপস্থাপিত করার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর ধারণা, ওটাকে দলিল হিসেবে দাঁড় করানো যায় না। তার কয়েকটি কারণও তিনি উল্লেখ করেছেন।
প্রথমত, উক্ত হাদীসটি ‘মুরসাল, (সাহাবীর নাম না বলে তাবেয়ীর বর্ণনা করা।) কেননা তায়ূস মুয়াযকে দেখতে পাননি; তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর জন্ম হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তা যদি সহীহ হত, তাহলে নিশ্চয়ই তার একটা দলিল থাকত। আর। ওটা দলিল নয় এজন্যে যে, তা রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত নয়। আর যা রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত নয়, তা দিললই হতে পারে না।
তৃতীয়ত, উক্ত বর্ণনায় একথা নেই যে, কথাটি তিনি যাকাত প্রসঙ্গে বলেছেন। যদি তা সহীহ হয় তবুও তিনি তা জিযিয়াদাতাদের বলে থাকতেন, তারও সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা সেক্ষেত্রে ‘জিযিয়া’ বাবদ দানা, চাল ও যব গ্রহণ করতেন। আর জিজিয়ার টাকা পরিবর্তে জিনিস বা দ্রব্যদি গ্রহণ করা যায়।
চতুর্থত, এ সৎবাদটি যে বাতিল, তার দলিল তাতেই নিহিত রয়েছে। কেননা তাতে মুয়াযের উক্তির একটি অংশ হচ্ছে ‘মদীনাবসীদের জন্য কল্যাণবহ।’ আমি মনে করি না, মুয়ায এরূপ কথা বলতে পারেন। কেননা এ কথাটি সত্য হলে আল্লাহ তাদের কল্যাণের জন্যে যা ফরয করেছেন, তার পরিবর্তে অন্য জিনিসে তাদের কল্যাণ আছে বলে দাবি করা হয়, (আল্লাহ না করুন, এরূপ দাবি একজন সাহাবী করবেন!) [আরবী***********]
এ গ্রন্থকারের মনে ইবনে হাজম কর্তৃক উপস্থাপিত এসব কারণ খুবই দুর্বল। কেননা তায়ূস যদিও হযরত মুয়াযকে দেখতে পাননি, তা সত্ত্বেও তাঁর ইয়ামন অবস্থানকালীন যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে তায়ূস বিশেষ অবহিত ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী তো তাই বয়েছেন। আর তায়ূস তো ইয়েমেনের তাবেয়ী যুগের ইমাম ছিলেন। তিনি মুয়াযের যাবতীয় অবস্থা ও সংবাদ সম্পর্কে বিশেষ সমীক্ষাশালী ছিলেন। আর তাঁর সময়টাও খুব নিকটবর্তী।
হযরত মুয়াযের ইয়েমেনে কার্যক্রম এবং যাকাত বাবদ জিনিসের মূল্য গ্রহণ প্রমাণ করছে যে, তাতে নবী করীম (স)- এর সুন্নাতের বিরোধিতা কিছুই নেই। তিনিই তো কুরআন ও সুন্নাতের পর ইজতিহাদেকে শরীয়াতেরন তৃতীয় দলিল হওয়ার মর্যাদা প্রদান করেছেন। সেই সাথে একথাও যে, তখনকার কোন সাহাবীই তাঁর এই কাজকে শরীয়াত বিরোধী বলেননি। তাও প্রমাণ করে যে, সমস্ত সাহাবীই এ পর্যায়ে তাঁর সাথে পূর্ণ আনুকূল্য রক্ষা করেছেন।
এই কথাটি জিযিয়া সম্পর্কিত হওয়ার সম্ভবনাটিও খুবই দুর্বল। বরং বাতিল মনে করতে হবে। আল্লামা আহমদ শারে (আরবী**********) গ্রন্থের টীকায় এ কথা বলেছেন। কেননা ইয়াহইয়া ইবনে আদামের বর্ণনায় (আরবী**********) ‘যাকাতের স্থলে’ কথাটি উদ্ধৃত রয়েছে।
আর চতুর্থ কারণ পর্যায়ে ইবনে হাজম যা বলেছেন, তা তাঁর জুলুম ছাড়া কিছু নয়। তিনি এটা জোর করে বলেছেন বলতে হবে। কেননা উক্তির মধ্যে ‘তোমাদের জন্যে কল্যাণবহ’ যে কথাটি আছে তার অর্থ ‘তোমাদের জন্য উপকারী।’ কেননা মদীনাবাসীদের কাপড়ের খুব বেশি অভাব ছিল খাদ্য-শস্য- দানা ও যবের তুলনায়। এটা একটা বাস্তব ঘটনা এতে কোন মতদ্বৈততা নেই। কথার এই অংশ- ‘আল্লাহ তা ফরয করেন নি- এ কথাটি মতদ্বৈততার বিষয়। কাজেই শুধু মৌখিক দাবিকে দলিল মনে করা জায়েয হবে না। আর মূল্য গ্রহণ তো সেই পর্যায়ে গণ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শরীয়াতে ফরয করেছেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া এক্ষেত্রে দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যবর্তী একটা মত বা মাযহাব গ্রহণ করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেনঃ
‘এ ব্যাপারে অধিক স্পষ্ট কথা হচ্ছে, কোন প্রয়োজন বা অগ্রধিকার প্রাপ্ত কোন কল্যাণ বিবেচনা ব্যতীত যাকাত বাবদ দেয় দ্রব্যের মূল্য প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ কারণে নবী করীম (স) দুটি ক্ষতিপূরণের বিধান দিয়েছেন একটি ছাগী অথবা বিশটি দিরহাম দেয়ার কথা বলে। কিন্তু মূল্যকে মূল জিনিসের বিকল্প ধরা হয়নি। আরও এজন্যে যে মূল জিনিসের মূল্য প্রদান যখনই জায়েয ঘোষিত হবে, তখনই সম্পদ-মালীক নিন্মতম মালের বিচিত্র ধরনের মাল বিকল্পস্বরূপ নিয়ে আসবে। তাছাড়া মূল্য নির্ধারণেও অনেক সময় ক্ষতির কারণ থাকতে পারে। যেহেতু যাকাতের ভিত্তি হচ্ছে সহানুভুতি জ্ঞাপন। তা কার্যকর হতে পারে মালের একটি পরিমাণ থেকে সেই জাতীয় মাল দিলে। আর প্রয়োজন বা বিশেষ কল্যাণ বিচারে অথবা ন্যায়পরতা রক্ষার্থে মূল্য প্রদান করা হলে তাতে কোন দোষ থাকতে পারে না। যেমন বাগানের সব ফল বা ক্ষেতের সব ফসল নগদ টাকা বিক্রি করে দেয়া হলে মোট প্রাপ্ত মূল্যের এক-দশমাংশ দেয়া হলে তাতে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। তা দিয়ে ফল বা ফসল ক্রয় করে দেবার জন্যে বাধ্য করা যাবে না। কেননা সে জিনিস দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছে। ইমাম আহমাদও তা জায়েয বলে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন।
আর যেমন পাঁচটি উটের যাকাত বাবদ একটি ছাগী দেয়া ফরয ধার্য হল; কিন্তু তার কাছে ছাগী ক্রয় করার কোন লোক নেই। তখন তার মূল্য প্রদানই যথেষ্ট হবে। সেজন্যে অপর শহরে গমন করে ছাগী ক্রয় করতে বাধ্য করার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
অথবা এও হতে পারে যে, যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকেরাই তার কাছে মূল্য প্রদানের দাবি করল তা তাদের জন্যে অধিক উপকারী মনে করে। তাহলে তাদেরকে তা-ৈই দেয়া যাবে অথবা যাকাত সংগ্রহকারী কর্মকর্তাই যদি মূল্য প্রদান ফকীর মিসকীনদের জন্যে অধিক উপকারী মনে করে তবুও। মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) তো তাই করেছেন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি নিজেই ইয়েমেনবাসীদের বলেছিলেনঃ তোমরা আমাকে পাঁচগজি কাপড় বা তৈরী পোশাক দিয়ে দাও। তা তোমাদের জন্যেও যেমন সহজতর, তেমনি মদীনায় বসবাসকারী আনসার ও মুহাজিরদের পক্ষেও অনেক কল্যাণকর। ( এ কথাটি কাদের জন্যে বলা হয়েছে?….. কেউ বলেছেন, যাকাতদাতাদের লক্ষ্য করে, কারোর মতে ‘জিযিয়ার’ ক্ষেত্রে বলেছেন।) [আরবী ***********]
এ কথাটি আমাদের গৃহীত মতের নিকটবর্তী। আমাদের এ যুগে প্রয়োজন ও কল্যাণ উভয় দিক দিয়েই মূল্য গ্রহণ জায়েয হওয়া বিধেয় হওয়া উচিত- অবশ্য যদি তাতে ফকীর-মিসকীন ও সম্পদের মালিকদের পক্ষে কোনরূপ ক্ষীতর কারণ না হয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
যাকাত স্থানান্তরকরণ
যাকাতলব্ধ সম্পদ ব্যয় ও বিনিয়োগ বা বণ্টনের ক্ষেত্রে ইসলামের একটা বিশেষ বিজ্ঞানসম্মত ও ন্যায়বাদী নীতি রয়েছে। আমাদের এ যুগে প্রতিষ্ঠানগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যতই পরিবর্তিত হোক না- কেন, তার সাথে সে নীতির পূর্ণ সংগতি বিদ্যমান। অধিকন্তু লোকদের ধারণা-কল্পনায় ভবিষ্যতে যত রকমের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাই গড়ে উঠুক এবং যতই নতুন নতুন আইন-বিধান তৈরী হোক; ইসলামের এই নীতির সাথেও উপযুক্ততা ও সংগতি রক্ষা করে অতি আধুনিক ও নতুন হয়ে কাজ করতে সক্ষম হবে।
আরব জাহিলিয়াত ও ইউরোপ ইত্যাদির অন্ধকার জাহিলিয়াতের যুগেও লোকেরা ভালভাবে জানতো, কৃষক-চাষী, শিল্প মালিক, পোশকধারী, ব্যবসায়ী প্রতৃতির নিকট থেকে কিভাবে কর- এর নামে অর্থ লুট করে নেয়া হত। অথচ তখন এ লোকেরা কত না কঠোর শ্রম করে মাথার ঘাম ফেলে ও রাত জেগে জীবিকা উপার্জন করত! লোকদের ঘাম রক্ত ও অশ্রুনিষিক্ত এই অর্থ চলে যেত সম্রাট, রাজা-বাদশাহ, স্থানীয় শাসক-প্রশাসক ইত্যাদির হাতে এবং তা তাদের বিলাস-ব্যসনে, রাজধানী ও রাজপ্রাসাদের চাকচিক্য বিধানে অকাতরে ব্যয় করা হত। তাদের সিংহাসন খচিত করা হত তাদের বাহাদুরী ও শান-শওকত বৃদ্ধির জন্যে। তাতে চারপাশের পাহারাদার, সাহায্যকারী ও অনুগমনকারীদের অপেক্ষা নিজেদের অধিকতর প্রাচুর্য উন্নত করে তুলবার ব্যবস্থা ছিল। তারপরও কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা রাজধানী সম্প্রসারণ, সৌন্দর্য বিধান ও তার অধিবাসীদের সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধিকল্পে ব্যয়িত হত। তারপরও কিছু বেঁচে গেলে সর্বোচ্চ কর্তার নিকটবর্তী ব্যক্তি ও শহরের বিশিষ্টদের মধ্যে বণ্টন করা হত। আর তারা সকলেই সেই দূরবর্তী অনগ্রসর ও দুর্দশাগ্রস্ত কষ্টে নিমজ্জিত গন্ডগ্রামের লোকদের প্রতি চরম উপেক্ষা ও অনীহা পোষণ করত অথচ সে সব ‘কর’ এই স্থানসমূহ থেকেই নেয়া হয়েছে, সংগ্রহ করা হয়েছে এ সব বিলাস দ্রব্য।[গ্রন্থকারে (আরবী************)থেকে উদ্ধৃতি।]
কিন্তু দুনিয়ায় যখন ইসলামের আগমন হল এবং মুসলিম ধনী ব্যক্তিদের জন্যে নিয়মিতভাবে যাকাত দেবার বিধান জারি করল, সেই সাথে তা আদায় করার জন্যে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হল, তখন এ নীতিও চালু ও কার্যকর করা হল যে, এ যাকাত যেখান থেকে পাওয়া যাবে- আদায় ও সংগ্রহ করা হবে, সেখানেই তা বণ্টনও করা হবে। এ নীতিটি গবাদি পশু, কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ার যাকাতের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ও পালিত। কেননা যাকাত বণ্টন করতে হবে যেখানেই তা পাওয়া যাবে। সেই সাথে এ ব্যাপারেও কোন দ্বিমত নেই যে, রোযার ফিতরা-ফিতরার যাকাত সেখানেই বণ্টন করা হবে, যেখানে বসবাস করে সেই ব্যক্তি যার উপর তা ওয়াজিব হয়েছে।
তবে নগদ সম্পদের যাকাত পর্যায়ে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থাক্য রয়েছে। এ যাকাত কি সেখানেই বণ্টন করা হবে যেখানে তা পাওয়া গেছে অথবা যেখানে সম্পদের মালিক বসবাস করে? [দেখুনঃ (আরবী************)]
প্রখ্যাত কথা-যা অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মত- হচ্ছে, এ পর্যায়ে মালের অবস্থান ধরতে হবে, মালিতের নয়।
এই নীতির দলিল হচ্ছে রাসূলে করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের সুন্নত। নবী করীম (স) যখনই এবং যেখানেই যাকাত আদায়কারী লোক প্রেরণ করেছেন-প্রশাসক নিয়োগ করেছেন কোন অঞ্চলে, শহরে বা রাজ্যে তাদের স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন সেখানকার ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করে এবং সেখানকারই ফকীর-মিসকীনের মধ্যে তা বণ্টন করে দেয়।
হযরত মুয়ায সংক্রান্ত হাদীস অনেকবার উদ্ধৃত করা হয়েছে। সে হাদীসটি যে সহীহ, সে ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই- সর্বসম্মত। তাতে বলা হয়েছে, নবী করীম (স ) তাঁকে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানকার ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করে সেখানকারই গরীব লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিতে।
হযরত মুয়ায রাসূলে করীম (স)-এর এ আদেশকে পুরোপরি ও যথাযথভাবে কার্যকর করেছেন। ইয়েমেনবাসীদের যাকাত সেখানকারই তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যেই বণ্টন করে দিয়েছিলেন। বরং প্রতিট রাজ্যের বা অঞ্চলের যাকাত বিশেষভাবে সেখানকার অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যেই বণ্টন করেছিলেন। আর তাদের জন্যে একটি সনদও লিখে দিয়েছিলেন। তাতে ছিলঃ যে‘ জেলায়’ [মূল্য (আরবী**********) শব্দ রয়েছে। ইবনুল আসীর (আরবী**********) গ্রন্থে বলেছেনঃ ইয়ামনে ‘মেখ’ ‘লাফ’ তেমন যেমন ইরাকে রুস্তাক (আরবী********) অর্থাৎ তা একটি শাসন এলাকা যেমন প্রদেশ বা জিলা।] যারা লোকজন জমি ও সম্পদ সেখান থেকে সে অন্যত্র চলে গেলেও তার যাকাত ও ওশর তার লোকজনের সেই জেলাতেই (বণ্টিত) হবে’। [আবূ হুযায়ফা থেকে তায়ূস এই বর্ণনাটি করেছেন সহীহ সনদে। সায়ীদ ইবনে মনসূর এবং তাঁর ন্যায় আমরাও তা উদ্ধৃত করেছি, যেমন (আরবী*************) তে উদ্ধৃত হয়েছে।]
আবূ হুযায়ফা বলেছেনঃ আমাদের কাছে রাসূল (স)- এর প্রেরিত যাকাত আদায়কারী উপস্থিত হল। সে আমাদের মধ্যকার ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত আদয় করে আমাদেরই গরীব লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিল। তখন আমি ছিলাম এক ইয়াতীম ক্রীতদাস। আমাকে সে যাকাত সম্পদ থেকে একটা উট দিয়েছিল। [ঘটনাটি তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি ‘হাসান’ উক্ত সূত্র]
সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, একজন আরব বেদুঈন রাসূলে করীম (স)- কে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। তন্মধ্যে একটি এইঃ আল্লাহ্ আপনাকে রাসূল বানিয়েছেন, তাঁর কসম, আল্লাহ্ কি আপনাকে আদেশ করেছেন যে, আপনি আমাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করবেন এবং তা বণ্টন করবেন আমাদেরই দরিদ্র লোকদের মধ্যে? বললেনঃ হ্যাঁ।
আবূ উবাইদ উমর (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তিনি তাঁর উপদেশনামায় বলেছেনঃ আমি আমার পরবর্তী খলীফাকে অসিয়ত করছি এ বিষয়ে। আরও অসিয়ত করছি এই……বিষয়ে এবং অসিয়ত করছি আরব বেদুঈনদের কল্যাণ করার জন্যে। কেননা তারাই আসল আরব ও ইসলামের সারবস্তু এবং এভাবে করতে হবে যে, তাদের মালদার লোকদের কাছ থেকে তাদের ধন-মালের যাকাত গ্রহণ করতে হবে এবং তা তাদেরই দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। [আরবী*************]
হযরত উমর (রা)-এর জীবনকালীন কাজের ধারাও তা-ই ছিল। তিনি যেখান থেকে যাকাত সংগ্রহ করতেন, সেখানেই বণ্টন করাতেন। আর সরকার নিয়েজিত যাকাত কর্মচারীরা মদীনায় ফিরে আসতো রিক্ত হস্তে, সঙ্গে নিয়ে আসত শুধু সে সব কাপড়-চোপড়, যা পরিধান করে তারা গিয়েছিল নিজ নিজ ঘর থেকে অথবা সেই লাঠি, যার ওপর তারা ভর করে চলাফেরা করত আগে থেকেই।
এ পর্যয়ে সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমর মুয়াযকে বনু কিলাব গোত্রের বা বনু সায়াদ ইবনে যুবিয়ান গোত্রের যাকাত সংগ্রহকারীরূপে পঠিয়েছিলেন। সেখানকার যাকাত বণ্টন করে দেয়ার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। পরে তিনি সেই পোশাকেই রাজধানীতে ফিরে আসেন, যা তার পরিধানে ছিল যাওয়ার সময়।[আরবী*************]
ইয়ালা ইবনে উমাইয়্যাতার সঙ্গী ও হযরত উমর যাদেরকে যাকাত আদয়ে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে সায়াদ বলেছেনঃ
আমরা যাকাত আদায়ের জন্য বের হয়ে যেতাম। পরে আমরা ফিরে আসতাম শুধু আমাদের চাবুকগুলো হাতে নিয়ে।[আরবী*************]
হযরত উমর (রা)- কে সওয়াল করা হয়েছিলঃ আরব বেদুঈনদের যাকাত কি জিনিস থেকে নেয়া হবে? তা নিয়ে আমরা কি বা কেমন করব? জবাবে হযরত উমর (রা) বলেছিলেনঃ আল্লাহ্র শপথ, আমি তাদের ওপর সহজভাবে যাকাত ফিরিয়ে দেব, পতক্ষণ তাদের এক- এক জনের ভাগে একশ ‘উষ্ট্রী বা একশ’ উট পড়ে।[আরবী************]
পরিপন্থী- ক্ষতিকর, যে জন্যে যাকাত ফরয করা হয়েছে। এ কারণে আল-মুগনী গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ যেহেতু যাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে তদ্দারা গরীব-মিসকীন লোকদের ধনী বা সচ্ছল বানানো। অতএব তাকে স্থানন্তরিত করাকে যদি আমরা মুবাহ করে দিই, তাহলে সেই স্থানের ফকী- মিসকীনদের অভাবগ্রস্ত অবস্থায় রেখে দেওয়ার পরিস্থিতি দেখা দেবে। [আরবী************]
রাসূলে করীম (স) ও তাঁর খুলাফায়ে রাশেদুন উপস্থপিত নীতি ও পদ্ধতির ওপরই স্থিতিশীল রয়েছেন সুবিচারক ও ন্যায়বাদী প্রশাসকবৃন্দ। সাহাবী ও তাবেয়ীনের মধ্যে ষাঁরা ফতোয়ার ইমাম ছিলেন, তাঁরাও তা থেকে এক বিন্দু বিচ্যুত হন নি।
ইমরান ইবনে হুচাইন (র) জিয়াদ ইবনে আবীহ্ কিংবা বনু উমাইয়্যা বংশোর কোন প্রশাসকের পক্ষ থেকে যাকাতের কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি যখন ফিরে এলেন তাঁকে সে জিজ্ঞাসা করলঃ মাল-মত্র কোথায়?
তিনি বললেনঃ আমাকে কি মাল আনতে পাঠিয়েছিলেন? মাল তো সেখান থেকেই আমরা পেয়িছি, যেখান থেকে আমরা রাসূলে করীম (স)-এর যুগে পেতাম এবং তেমনিভাবেই তা রেখে এসেছি যেমন করে পূর্বে রেখে আসতাম।[আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। দেখুনঃ (আরবী*************]
মুহাম্মাদ ইবনে ইউসূফ সাকাফী তায়ূসকে- যিনি ইয়েমেনের ফিকাহবিদ বলে খ্যাত ছিলেন- মিখ্লাফ এলাকার যাকাতের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি তথায় ধনীদের কাছে থেকে যাকাত গ্রহণ করতেন এবং তা ফকীরদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। যখন বণ্টনের কাজ শেষ করতেন, তখন তাকে বলা হলঃ তোমার হিসেব পেশ কর। বললেনঃ আমার কোন হিসেব নেই। আমি তো ধনীর কাছ থেকে নিতাম ও মিসকীনকে দিয়ে দিতাম।[আরবী**************]
ফাসকাদ সাবখী থেকে বর্ণিত আছেঃ আমি আমার মালের যাকাত বহন করে নিয়ে মক্কায় বিতরণ করতে চেয়েছিলাম। পথে সায়ীদ ইবনে জুবাইরের সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি বললেনঃ ওসব ফিরিয়ে নিয়ে যাও এবং তোমার নিজের শহরেই তা বিতরণ করে দাও।[আরবী*************]
আবূ উবাইদ বলেছেনঃ এ কালের আলিমগণ এসব উক্তি ও দলিলের ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। প্রত্যেকটি শহর বা এলাকার জনগণ- মরুবাসীদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পানি কেন্দ্রের লোকেরা সেখানকার যাকাত পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের তুলনায় বেশী।
অধিকারসম্পন্ন- যতক্ষণ পর্যন্ত তথায় অভাবগ্রস্ত লোক থাকবে- একজন বা বহু তাতে যদি সমস্ত যাকাতই নিঃশেষিত হয়ে যায়- এমন কি যাকাতের কর্মচারীকে রিক্ত হস্তে ফিরে আসতে হয়, তবুও।
একটু পূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে- হযরত মুয়ায সংক্রান্ত কথা যে, তিনি যে পোশাক পরে গিয়েছিলেন, তা পরা অবস্থায়ই ফিরে এসেছিলেন; সায়ীদ সংক্রন্ত কথা- তিনি বলেছেলেনঃ আমরা যাকাত সংগ্রহে বের হয়ে যেতাম, পরে আমাদের মুয়ায ইয়েমেনবাসীদের উদ্ধৃত যাকাত হযরত উমরের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তা ফেরত পাঠিয়েছিলেন- আবূ উবাইদ এ সবকেই দলিলরূপে উপস্থাপন করেছেন। পরে আবূ উবাইদ বলেছেনঃ এ সব হাদীস প্রমাণ করছে যে, প্রত্যেক স্থানের জনগণ সে স্থানের যাকাত পাওয়ার সর্তবিধ অধিকারী- যতক্ষণ না তার সম্পূর্ণরূপে যাকাতের ওপর নির্ভরতা- মুখাপেক্ষিতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হচ্ছে। আমরা যে অন্যদের তুলনায় কেবল সে স্থানের লোকদের অধিকারের কথা বলছি, তার কারণ হচ্ছে, হাদীসে সুন্নাতের প্রতিবেশীর মর্যাদা ও অধিকারের ওপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ধনীর পাশে দারিদ্রদের ঘর হওয়াটা তাদেরকে এই অধিকার এনে দিয়েছে। [আরবী***************]
হ্যাঁ, যাকাতদাতা যদি ভুলে যায় বা না জানে এবং সে যাকাত এক স্থান থেকে অন্য এক স্থনে বহন করে নিয়ে যায়, অথচ সেখানকার সেই প্রথম স্থানের লোক তার মুখাপেক্ষী, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান তা তাদের কাছে ফেরত পাঠাবে- যেমন হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ করেছিলেন এবং যেমন সায়ীদ ইবনে জুবাইর এ মতের ওপর ফতোয়া দিয়েছেন। [আরবী*************]
অবশ্য ইবরাহীম নখ্য়ী ও হাসানুল বখরী যাকাতদাতার এ অধিকার আছে বলে মনে করেন যে, সে তার যাকাত পাওয়ার নিকটবর্তী অধিকার কার তা অগ্রাধিকার দিয়ে ঠিক করবে।
আবূ উবাইদ বলেছেন, ব্যক্তির বিশেষত্ব ও তার মালের বিবেচনায় তা জায়েয হবে। কিন্তু জনসাধারণের যাকাত সম্পদ- যা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সংগ্রহ করে ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে, সে ক্ষেত্রে এ কাজ জায়েয নয়।
উপরিউক্ত ফকীহ্ দুজনের মত বহন করে আবদুল আলীয়া বর্ণিত হাদীস। তাতে বলা হয়েছে, তিনি তাঁর যাকাত মদীনায় বহন করে নিয়ে যেতেন।
আবূ উবাইদ বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, তিনি তা তাঁর নিকটাত্মীয় ও মুক্ত করা গোলামদের মধ্যেই বিশেষভাবে বণ্টন করেছেন, আর কাউকে দেন নি। [আরবী***********]
কোন স্থানের জনগণ দারিদ্র্যমুক্ত হলে সেখানকার যাকাত অন্যত্র নিয়ে যাওয়া জায়েয
মূলত ও সর্ববাদীসম্মত মত যেমন এই যে, যাকাত যে স্থানের ধন-মালের ওপর ফরয হয়েছে তদুযায়ী আদায় হয়েছে, সেই স্থানের দারিদ্রদের মধেই তা বণ্টন করতে হবে; অনরূপভাবে এ কথাও সর্বসম্মত যে, সে স্থানের জনগণ যখন সে যাকাতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মুক্ত হবে, তখন তা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সর্বতোভাবে জায়েয। সে নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি হয় এ কারণে হতে পারে যে, তা পাওয়ার যোগ্য বিভিন্ন প্রকারের লোক তথায় নেই অথবা এজন্যে যে, তাদের সংখ্যা কম আর যাকাতের মালের পরিমাণ বিপুল। তখন হয় রাষ্ট্রপ্রাধানের কাছে অবশিষ্ট পরিমাণ যকাত ফিরিয়ে দিতে হবে, যেন সে প্রয়োজন মত ব্যয় করতে পারে অথবা সে স্থানের আবূ উবাইদ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) রাসূল (স) কর্তৃক ইয়েমেনে প্রেরিত হওয়ার পর তাঁর ও তাঁর পরে হযরত আবূ বকর (রা)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী সময় পর্যন্ত ‘জামাদ’ নামাক স্থানে অবস্থান করছিলেন। পরে হযরত উমর (রা)- এর সময় তিনি ফিরে আসেন। তখন তিনিও তাঁকে পূর্বের সেই দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন। তখন হযরত মুয়ায তাঁর কাছে লোকদের কাছ থেকে পাওয়া এক-তৃতীয়ংশ যাকাত পাঠিয়েছিলেন। হযরত উমত (রা) তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন এবং বলে পাঠালেন, ‘আমি তো তোমাকে কর আদয়কারী করে পাঠাইনি। জিযিয়া গ্রহণকারীরূপেও নয়। পাঠিয়েছি এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি ধনী লোকদের কাছ থেকে (যাকাত) নেবে ও তা তাদের মধ্যকার দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করবে। হযরত মুয়ায (রা) জানালেনঃ আমি আপনার কাছে এমন অবস্থায় কিছুই পাঠাইনি যে, তা গ্রহণ করার এখানে কজন লোকও পাওয়া গিয়েছিল (অর্থাৎ যা পাঠিয়েছি তা গ্রহণ করার এখানে কেউ নেই।) পরবর্তী বছর তিনি খলীফার কাছে অর্ধ-পরিমাণ যাকাত পাঠিয়ে দিলেন। সেবারও তিনি তা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তৃতীয় বছরে তিনি যাকাত বাবদ প্রাপ্ত সমস্ত সম্পদ খলীফার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখনও হযরত উমর পূর্বের ন্যায় ফেরত পাঠালেন। তখন হযরত মুয়ায বললেনঃ আমার কাছ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করার একজন লোকও এখানে পাই নি। [(আরবী ***********) এবং আমার গ্রন্থ (আরবী***********) গন্থের শেষের টীকা দেখুন।]
প্রথমবার হযরত উমর (রা) হযরত মুয়ায কর্তৃক প্রেরিত যাকাত সম্পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন- তারপরও বারবার তাই করেছিলেন- এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, যাকাতের ব্যাপারে মৌল নীতি হচ্ছে তা প্রাপ্তির স্থানেই বণ্টন করতে হবে। পরে শেষবার হযরত উমর (রা) হযরত মুয়াযের কাজকে বহাল রেখেছিলেন তা পাওয়ার যোগ্য লোক পাওয়া যাবে না।
পূর্ণ অভাবমুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও স্থানান্তরিতকরণে বিভিন্ন মত
যাকাত সংগৃহীত হওয়ার স্থানের লোকদের অভাবমুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও তা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ফিকাহ্বিদগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে কোন কোন মাযহাব খুব বেশী কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। এ মতের লোকেরা কোনক্রমেই অন্যত্র নিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করতে প্রস্তুত নন। এমনকি ততটা দূরত্বের নিয়ে যাওয়া জায়েয মনেস করেন না যতটা দূরত্বে গেলে নাময ‘কছর’ করা যায়, যত বড় প্রয়োজনই হোক না কেন ।
শাফেয়ী মতের লোকদের বক্তব্য হল, যাকাত এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া জায়েয নয়, নেখান থেকে তা পাওয়া গেছে সেখানেই তা ব্যয় ও বণ্টন করা ওয়াজবি। তবে সে স্থানে তা পাওয়ার যোগ্য লোক যদি আদৌ না থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। হাম্বলী মতের লোকদেরও এ মত। পাওয়ার যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও যাকাত স্থানান্তরিত করা হলে গুনাহ্ হবে, যদিও যাকাত আদায় হবে। কেননা যাকাতের তো তা পাওয়ার যোগ্য লোককে দিয়েছে তাই সে দায়িত্বমুক্ত হবে, যেমন ঋণের ক্ষেত্রে হয়। অন্যবা বলেছেন, যাকাত আদায়ই হবে না। কেননা অকাট্য দলিলের বিরোধিতা করা হয়েছে। [ (আরবী ***********) মুল্লা আলী আল-কারী মিশকাত-এর শরাহ্ গ্রন্থে তাবেযী থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ফিকাহ্বিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, যাকাত সম্পদ স্থানান্তরিত করা হলেও আদায় করা হলে ফরয পালন হবে। তবে উমর ইবনে আবদুল আবদুল আজীজ ভিন্ন মত পোষণ করেন। কেননা তাঁর সময়ে খোরাসান থেকে যাকাত সম্পদ ‘শাম’ চলে যাওয়ার পর তিনি তা তার স্থানে ফেরত দিয়েছিলেন। আ-কারী লিখেছেন,এতে এই প্রমাণ হয় যে, তাঁর এ কাজটা ইজমা’র বিরোধিতা করা বোঝায় না। বরং তিনি তা করেছেন পূর্ণ মাত্রায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এবং লোভ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে। দেখুনঃ আরবী**********]
আর হানাফী মাযহাবের লোকদের মত হচ্ছে যাকাত স্থানান্তর করা মাক্রুহ বটে; তবে তা যদি নিকটাত্মীয় অভাবগ্রস্ত লোকদেগর মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্যে নেয়া হয়, তাহলে মাকরুহ্ হবে না। কেননা তাতে ‘ছেলায়ে রেহমী’ রক্ষার দিকটি প্রবল অথবা যদি এমন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর কাছে তা নিয়ে যাওয়া হয় যারা স্থনীয় লোকদের তুলনায় অধিক অভাবগ্রস্ত; কিন্তু তা স্থানান্তরিতকরণ মুসলিম জনগণের পক্ষে অধিক কল্যাণকর বিবেচিত হয় অথবা তা ‘দারুল হরব’ থেকে দারুল- ইসলামের মুসলিম ফকীর মিসকীন দারুল হরবের ফকীর- মিসকীনের তুলনায় সাহায্য পাওয়ার উত্তম ও বেশী অধিকারসম্পন্ন। কোন আলিম বা তালেবে ইলমকে দেয়ার জন্যে নেয়া হয়, তাতেও আপত্তি নেই। কেননা তাতে তাকে সাহায্য করা হবে ও তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা হবে অথবা যদি অধিক আল্লাহ্ভীরু বা মুসলিম জনগণের পক্ষে অধিক উপকারী ও কল্যাণকামী ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়,- এও হতে পারে যে, যাকাত বছর শেষ হওয়ার পূর্বেই তা আদয় করা হয়েছে- এসব অবস্থায় যাকাত স্থানান্তরিত করা মাকরুহ্ নয়। [আরবী*************]
মালিকী মতের লোকদের অভিমত হচ্ছে, যাকাত ফরয হওয়া স্থানে বা তার নিকটবর্তী স্থানে তা বণ্টন করা ওয়াজিব। এই নিকটবর্তী স্থান বলতে নামায ‘কসর’ করা যায় এমন দূরুত্বের কম বোঝায়, কেননা তাও যাকাত ফরয হওয়ার স্থানের মধ্যে গণ্য।
আর যাকাত ফরয হওয়া বা তার নিকটস্থ স্থানে তা পাওয়ার যোগ্য লোক যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তা এমন স্থানে নিয়ে যাওয়া ওয়াজিব, যেখানে তা পাওয়ার যোগ্য লোক রয়েছে। তা ‘নামায কসর’- এর দূরত্বে হলেও কোন দোষ নেই। যাকাত ফরয হওয়ার স্থানে বা তার নিকটবর্তী স্থানে কোন যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক থাকে, তাহলে তা সেই স্থানে বণ্টন করা অবশ্যম্ভাবী হবে। তখন তা ‘নামায-কসর,- এর দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার জায়েয হবে না। তবে তা যাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে তারা যদি তুলনামূলকভাবে অধিক অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রও হয়, তাহলে বেশী পরিমাণ তাদের জন্যে নিয়ে যাওয়া মুস্তাহাব হবে। আর যদি সবটাই সেখানে নিয়ে যায়, কিংবা তার সবটা ওয়াজিব হওয়া স্থানেই বণ্টন করে, তাহলেও চলবে।
কিন্তু তা যদি অধিক দুঃস্থ ও অধিক অভাবগ্রস্ত নয় এমন লোকদের জন্যে স্তানান্তরিত করা হয়, তাহলে তার দুটি অবস্থাঃ
প্রথম, তুলনামূলকভাবে ওয়াজিব হওয়া স্থানের লোকদের সমান অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহেল তা জায়েয হবে না। যাকাত অবশ্য আদায় হয়ে যাবে, তা পুনরায় দিতে হবে না।
আর দ্বিতীয়, অপেক্ষাকৃত কম অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাতে দুটি কথাঃ প্রথম কথা, খলীল তাঁর (আরবী***********) –এ বলেছেন, তাতে যাকাত আদায় হবে না। আর দ্বিতীয় কথা, ইবনে রুশদ ও আলকাফী বলেছেন, যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কেননা তা তার জন্যে নির্দিষ্ট ব্যয় ক্ষেত্রেই ব্যয় করা হয়েছে। [আরবী*************]
জায়দীয়া ফিকাহ্র মতে যাকাত আদয়ের স্থানে তার গরীব লোক থাকা সত্ত্বেও তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে তা বণ্টন করা মাক্রুহ্। বরং সেখানে দারিদ্র লোক থাকলে তাদের মধ্যে বণ্টন করাই উত্তম। মালের মালিক ও রাষ্ট্রপ্রধান সেখানেই থাকুক, কি অন্যত্র তাতে কোন পার্থাক্য হবে না তাঁরা বলেছেনঃ আমাদের মতে মাক্রুহ্ বলতে বোঝায় মুস্তাহাবের বিপরীতটা। সে স্থানের গরীবদের ছাড়া অন্যত্র যাকাত ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে বটে; তবে মাকরুহ্ হবে। যদি না তা উত্তম ও অধিক ভালো কোন উদ্দেশ্যের জন্য স্থানান্তরিত কার হয়ে থাকে। সে ভালো উদ্দেশ্যে হতে পারে নিকটাত্মীয় কোন ব্যক্তি বা দ্বীনী শিক্ষার্থী যদি যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয় তবে তাকে দেয়া। খুব বেশী ঠেকায় পড়া কোন লোককে দেয়। এরূপ অবস্থায় যাকাত স্থানান্তরিত করা হলে ত মাক্রুহ্ তো হবেই না বরং তাই উত্তম কাজ হবে। [আরবী*********** ]
আবাজীয় মতের লোকদের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রপ্রধান প্রতিটি স্থানের দরিদ্রদের মধ্যে যেখান থেকে যাকাত পাওয়া গেছে, সেখানে এক-তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক পরিমাণ বিতরণ করবেন এবং অবশিষ্ট পরিমাণ ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেৃশ্যে নিয়োগ করবেন?…… এ প্রশ্নের জাবাবে দুটি কথাঃ
তাঁরা বলেছেন, যদি সম্পূর্ণ পরিমাণই ব্যয় করার প্রয়োজন হয়, তবে তাই নিয়ে নেবে এবং তাদের দেবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী। যদি প্রয়োজন না হয়, তাহলে সবটাই বণ্টন করে দেবে। আর একটি স্থনের লোকের যখন যথেষ্ট পরিমণ পেয়ে যাবে, তখন তার নিকটবর্তী আর একটি স্থানকে গ্রহণ করতে হবে। [আরবী**************]
রাষ্ট্রপ্রধানের ইজতিহাদে স্থানান্তর জায়েয
আমার যা মনে হয়- উপরে যেসব হাদীস, সাহাবীদের উক্তি এবং তাবেয়ীদের মন্তব্য- বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে এ বিশ্বাস জন্মে যে, যাকাতের মূল কথা হচ্ছে, যেখান থেকে তা সংগৃহীত হবে সেখানেই তা বণ্টন করে দিতে হবে প্রতিবেশীর অধিকারের মর্যদা প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য বিরোধী যুদ্ধ ও প্রতিঘাত সংঘঠিত করার লক্ষ্যে। সেই সাথে প্রত্যেক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর করে তোলার উদ্দেশ্যে ও সেখানকার স্থানীয় অভ্যন্তরীণ সমস্যাসমূহের মুকাবিলা করার জন্যে। আরও বিশেষ করে এজন্যে যে, স্থানীয় ফকীর-মিসকীনরা তো তাদের দৃষ্টি ও মন এসব ধন-মালের ওপর নিবদ্ধ করে রেখেছে এবং তার যাকাত পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। ফলে অন্যদের তুলনায় তাদের অধিকার অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিকারী হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও এ মৌলনীতির বিপরীত কোন কাজ করার পথে প্রতিবন্ধক কিছু আছে বলে মনে করার কারণ দেখছি না। যদি ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রপ্রধান উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শক্রমে তা করা মুসলিম জনগণের পক্ষে কল্যাণকর এবং ইসলামের পক্ষে মংগলজনক মনে করে, তাহলে তা সে অনায়াসেই করতে পারে।
এ পর্যয়ে ইমাম মালিক যা বলেছেন, তা আমার খুব মনঃপূত হয়েছে। তা হচ্ছেঃ যাকাত স্থানান্তরকরণ জায়েয নয়। তবে কোন স্থানের লোকদের জন্যে তা অপরহার্যভাবে প্রয়োজনীয় বোধ হলে রাষ্ট্রপ্রধান স্বীয় ইজাতিহাদ ও সবিবেচনার ভিত্তিতে তা করতে পারেন।[আরবী***********]
তাঁর সহকর্মীদের মধ্য থেকে ইবনুল কাসেম বলেছেনঃ যাকাতের কিছু অংশ প্রয়োজনের কারণে স্থানান্তরিত করা আমি সঠিক বলে মনে করি।[]
মসনূন থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্রপ্রধান যদি জানতে পারেন যে, কোন কোন স্থানে অভাব ও প্রয়োজন খুব তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান যাকাতের একটা অংশ অন্যদের জন্যে স্থানান্তরিত করতে পারেন- তা তাঁর জন্যে জায়েয। কেননা অভাব যখন দেখা দেয়, তখন তাকে অভাবমুক্ত এলাকার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া- একান্তই কর্তব্য। হাদীস বলছেঃ (আরবী************) ‘একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তাকে বিপদের মুখে ছেড়ে দিতে পারে না, তার ওপর সে জুলুমও করতে পারে না। [আরবী**********]
(আরবী**********) গ্রন্থে ইমাম মালিক থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) মিশরে অবস্থানরত হযরত আমর ইবনুল আ’স (রা)- কে মহাদুর্ভিক্ষের বছর লিখে পাঠিয়েছিলেনঃ [(আরবী************) হাকেম তাঁর (আরবী**********) গ্রন্থে এ উক্তিটি (আরবী**********) এর তুলনায় আরও দীর্ঘ আকারে উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, এটি ইমাম মুসলিম আরোপিত শর্তানুযায়ী সহীহ্। যাহবীও তাই বলেছেনঃ (১ম খন্ড, ৪০৫-৪০৬ পৃ.)] হায় হায়, আরবদের জন্যে মহাসংকট! উষ্ট্রের একটি কাফেলা বোঝাই খাদ্য আমার কাছে পাঠাও। তা যেন এত দীর্ঘ হয় যে, তার প্রথমটি আমার কাছে পৌঁছবে যখন, তখন কাতারের শেষ উটটি থাকবে তোমার কাছে। কাপড়ের বস্তায় ছাতু বহন করবে। তা পৌঁছার পর পযরত উমত আরবদের মধ্যে স্বীয় বিবেচনা অনুযায়ী বণ্টন করতে শুরু করলেন। এ কাজের জন্যে কয়েক ব্যক্তিকে তিনি দায়িত্বশীল বানিয়েছিলেন। তাদেরকে তিনি উটের গলার কাছে উপস্থিত থাকতে আদেশ করতেন এবং বলতেন ‘আরবরা উট ভালোবাসবে। আমি ভয় করছি তারা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অতএব তা যবেহ করা বাঞ্ছনীয় এবং তার গোশত্ ও চর্বি মাখা দরকার এবং যে বস্তায় ছাতু এসেছে তা দিয়ে জোব্বা বানিয়ে পরা আবশ্যক।’
বস্তুত কঠিন দুর্ভিক্ষ ও ব্যাপক অভাব অনটনকালে মুসলিম সমাজ পরস্পরের পরিপোষণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যে কাজ করে। একজনের এক অঞ্চলের অভাব অপরজন ও অপর অঞ্চল পূরণ করে দিতে এগিয়ে আসে।
পরবর্তী কথাও এরই সমর্থক ও পরিপূরক।
প্রথম যে শহর বা অঞ্চল বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নয় এবং সমগ্র প্রশাসন হতে যে প্রশাসনিক অঞ্চল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং কেন্দ্রীয় সরকারে সূত্রেও সমগ্র মুসলিমের সাথে সম্পর্কযুক্ত- যেমন অংশ ‘সমগ্র’- এর সাথে সংযুক্ত থাকে, ব্যক্তি পরিবার সংস্থার সাথে জড়িত থাকে, অংগগুলো গোটা দেহের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এই একত্ব পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ততা ও একে অপরের দায়িত্বশীলতার শিক্ষাই দেয় ইসলাম এবং তা ফরয করে। কোন অঞ্চল বা শহরকে অন্যান্য ইসলামী দেশসমূহ থেকে- ইসলামের কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন মনে করা যায় না। অতএব দুর্ভিক্ষ, আগুনে জ্বলা বা মাহামারী প্রভৃতি ধরনের কোন বিপদ যদি কোথাও এসে পড়ে, তাহলে সেখানকার জনগণ সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়ার বেশী অধিকারী। যাকাত সংগ্রহের স্থানের লোকদের অপেক্ষা ওদের সাহায্য দান অধিক প্রয়োজনীয়।
দ্বিতীয়, যাকাতের অনেক ব্যয়-ক্ষেত্রে রয়েছে। যেমন ইসলামের দিকে লোকদের মন আকৃষ্ট করার ও ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক বানানোর জন্যে অর্থ ব্যয় করা, সাবীলিল্লাহ্- আল্লাহ্র পথে ব্যয় পর্যায়ে জিহাদ এবং যেসব কাজ ইসলামের পক্ষে আসে, ইসলামের কালেমা বুলন্দ হয়, তার সাহায্য করাও বিশেষভাবে গণ্য হয় আর এ ধরনের সব কাজই রাষ্ট্রপ্রধানের করণীয়, আধুনিক পরিভাষায় বলতে হয়, কেন্দ্রীয় ‘জিহাদ’ পর্যায়ে পরিচালিত করা হয়, তাও তো ব্যক্তির করণীয় হতে পারে না, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানেরও করণীয় ব্যাপারি নয়।বরং তাও সর্বতোভাবে সর্বোচ্চ সরকারের দায়িত্ব।
এ আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হল যে, কেন্দ্রয়ী সরকারের একটা নিজস্ব আায়ের উৎস থাকা আবশ্যক, যেখান থেকে সেসব কাজে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে, যা সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইসলামের কল্যাণ ও মুসলিম জনগণের পক্ষে পরম উপকারী বিবেচিত হবে। অবশ্য তার কাছে যদি এমন সব আয়ের উপায় থাকে, যার দরুন যাকাতের মুখাপিক্ষিতা থাকবে না, তাহলে সে তো ভালই; খুবই উত্তম কথা। অন্যথায় রাষ্ট্রপ্রধানের এ অধিকার থাকতে হবে যে, সে বিভিন্ন অঞ্চল বা প্রদেশ থেকে যাকাতের টাকা নিয়ে নেবে যদ্দারা এ গুরুতর কাজগুলো করা হবে। এ কারণে ইমাম কুরতুবী এ সম্পর্কে কোন আলিমের মত উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে- ফকীর ও মিসকীনদের জন্যে যাকাতের যে অংশ তা স্থানীয়ভাবে বণ্টন করতে হবে এবং অবশিষ্ট অংশ রাষ্ট্রপ্রধানের ইজতিহাদ অনুযায়ী ব্যয় করার জন্যে কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হবে। [আরবী*************]
এসব হচ্ছে ইজতিহাদী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত আর তাতে উপদেষ্টা পরিষদের লোকদের পরামর্শ শামিল হওয়া আবশ্যক। খুলাফায়ে রাশেদুর ঠিক এভাবেই কাজ করতেন। এই কারণে কোন স্থির ও অনড় নীতি নির্ধারণের কাছে নীতি স্বীকার করা যাবে না এবং প্রতি বছরের জন্যে বাধ্যতামূলকভাবে কোন অভিন্ন নীতি ধরে রাখা যেতে পারে না।
উমর ইবনে আবদুল আজীজ থেকে যা আমাদের পর্যন্ত বর্ণিত হয়ে এসেছে, তা-ও এ কথারই ব্যাখ্যা দেয়। তিনি তাঁর কর্মচারীদের লিখে পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা অর্ধেক পরিমাণ যাকাত- আবূ উবাইদ বলেছেন- যথাস্থানে স্থাপন কর এবং অপর অর্ধেক আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।” পরবর্তী বছর আবার লিখে পাঠলেনঃ ‘সব’ যাকাতই যথাস্থানে ব্যয় কর।[আরবী*************]
‘রায়’ থেকে কুফা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যাওয়া যাকাত তিনি পনর্বার ‘রায়’ তে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, তা আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি।
আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কোন মতদ্বৈততা বা বৈপরীত্য নেই। সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রয়োজনের দৃষ্টিতেই তিনি এ কাজ করেছিলেন।
এজন্যে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, নামায কসর পরিমাণ দূরত্বের যাকাত স্থানান্তরিতকরণ সম্পূর্ণ ও নিশ্চিতরূপে নিষিদ্ধ হওয়ার কোন শরীয়াতী দলিল নেই। তাই শরীয়াতী কল্যাণ দৃষ্টিতে যাকাতও তদনুরূপ অন্যান্য জিনিস স্থানান্তারিত করা সম্পূর্ণ জায়েয। [আরবী*************]
তৃতীয় প্রসিদ্ধ ও প্রত্যয়ে পরিণত কথা হচ্ছে, নবী (স) আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে মদীনায় যাকাত আনিয়ে নিতেন এবং মদীনায় মহাজির ও আনসারদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিতেন।
নাসায়ী আবদুল্লাহ্ ইবনে হিলাল সাকাফী বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, “এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)- এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেঃ আমি যাকাতের ছাগী বা ছাগলের বিনিময়ে নিহত হওয়ার অবস্থায় পড়েছিলাম। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ যদি তাড মুহাজির দরিদ্রদের দেয়া না হত তাহলে আমি তা গ্রহণ করতাম না।”
অনুরূপ পারিবারিক বোঝা বহন প্রসঙ্গে কুবাইচা ইবনুল মুযারিক (রা)- কে বলে নবী করীমের কথাঃ অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আমাদের কাছে যাকাতের মাল এসে যায়, তখন হয় আমরা এ ব্যপারে তোমায় সাহয্য করব নতুবা এ বোঝা তোমার ওপর থেকে আমরা তুলে নেব। লোকটি ছিল নজদের অধিবাসী। তাকে হিজাজ থেকে সংগৃহীত যাকাত থেকে দেয়ার কথা রাসূলে করীম (স) চিন্তা করছিলেন এবং তা নজ্দ্বাসীদের কাছ থেকে হিজাজবাসীদের কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন।[ও]
আদী ইবনে হাতেম (রা) তাঁর গোত্রের যাকাত নবী করীম (স)- এর পর হযরত আবূ বকর (রা)- এর কাছে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। চারদিকে মুর্তাদ হওয়ার হিড়িকের বছর সম্পর্কেও সেই কথাই সত্য।
হযরত উমর (রা) ইবনে আবূ যুবাবকে শুষ্কুতার পর দুর্ভিক্ষের বছর পাঠিয়েছিলেন তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ লোকদের ওপর দুটি বার্ষিক যাকাত বাধ্যতামূলক করে দেবে এবং একবারেরটা সেখানকার লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে এবং দ্বিতীয়বারেরটা আমার কাছে নিয়ে আসবে। [আরবী*************]
মুয়াযের সেই কথাটিও এরূপ, যা তিনি ইয়েমেনবাসীদের বলেছিলেনঃ তোমরা আমার কাছে নিয়ে আস পাঁচ গজি কাপড় বা পোশাক। আমি তা যাকাতের স্থালে গ্রহণ করব। কেননা তা মদীনায় বসবাসকারী মুহাজিরদের জন্যে খুবই উপকারী ও সুবিধানজনক হবে। [ও]
আবূ উবাইদ বলেছেন, এসব জিনিস তখনই স্থানন্তরিত হতে পারে যদি তা স্থানীয় লোকদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় তাদের সচ্ছলতা লাভের পর উদ্ধৃ্ত্ত থাকে। উমর ও মুয়ায সংক্রান্ত বর্ণনা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। [ঐ]
আমি বলব, স্থনীয় লোকদের নিরংকুশ ও চরম মাত্রায় সচ্ছল হতে হবে, তা আদৌ জরুরী ও বাধ্যতামূলক নয়। সচ্ছলতারও স্তরভেদ রয়েছে। তার কোনটি অপরটি থেকে নিম্মে এবং কোনটি অপরটির তুলনায় উচ্চে।
প্রয়োজনও অভিন্ন নয়। তাই কার প্রয়োজন অধিক তীব্র, তা দেখা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব এবং অবিলম্বে তাকে সাহায্য পৌঁছিয়ে দেয়া কর্তাব্য। যার অবস্থা একটা সময় পর্যন্ত বিলম্ব সইতে পারবে ও ধৈর্য ধারণ সম্ভব হবে, তাকে সাহায্য দেয়ায় বিলম্ব হলে কোন দোষ হবে না। কেননা দ্রুত কল্যাণ সাধনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে কোথাও। কোথাও এমন মারাত্মক বিপদ দেখা দিতে পারে যে, তা বিলম্ব সহ্য করতে পারে না, সেখানে খুব দ্রুত সাহায্য পৌঁছাতে হবে।
তবে যাকাতের সবটাই স্থানান্তরিত না করে তার একটা অংশ পাঠিয়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। সমস্তটা স্থানান্তরিত করা যাবে কেবলমাত্র তখন, যখন সে স্থানের লোকেরা পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় সচ্ছলতা পেয়ে যাবে। উমর ও মুয়ায (রা) সংক্রান্ত খবরে একথা বলা হয়েছে।
অবশ্য একটি সতর্কতামূলক কথা বলা দরকার।শাফেয়ী মাযহাব যাকাত স্থানান্তরিত করার ব্যাপারে সব কয়টি মাযহাবের মধ্যে সর্বাধিক কড়াকড়ি ও কঠোরতা করার পক্ষপাতী হলেও তাঁর এ কাড়াকড়ি হ্রাস করেন যদি যাকাতের মালেক নিজেই তা বণ্টন করে। আসলে রাষ্ট্রপ্রধান ও যাকাত সংগ্রহের কর্মচারী- উভয়েল পক্ষেই যাকাত স্থানান্তরিত করা জায়েয, এটাই সহীহ্ কথা।
শাফেয়ী মতের ‘আলী মুহায্যাব’ গ্রন্থের লেখক বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান যাকাত কর্মচারীকে যাকাত বণ্টনের অনুমতি দিলে সে তা বণ্টন করবে। আর বণ্টন করার অনুমতি না দিয়ে থাকলে সে তা বহন করে তার কাছে নিয়ে যাবে। [আরবী*************]
ইমাম নববী তাঁর ‘শরাহ্’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ
জেনে রাখ, উপরিউক্ত বক্তব্য দাবি করে যে, যাকাত স্থানান্তরিত করার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধান ও যাকাত কর্মচারীর নিশ্চিতভাবে রায়েছে। আর যাকাত স্থানান্তরিতকরণে যে প্রসিদ্ধ মতভেদ রয়েছে, তা হচ্ছে বিশেষভাবে মালের মালিকের নিজের স্থানান্তরিত করা পর্যায়ে। রাফেয়ী এ কথাটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলেছেনঃ
এই যে কথটিকে তিনি অগ্রধিকার দিয়েছেন, হাদীসসমূহের দৃষ্টিতেও তাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। [ঐ- ১৭৫ পৃ.]
বিশেষ প্রয়োজন ও কল্যাণদৃষ্টিতে ব্যক্তিদের যাকাত স্থানান্তরিতকরণ
রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে গণনরাযোগ্য ইসলামী কল্যাণ দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করে এক স্থান থেকে অন্যত্র যাকাত নিয়ে যাওয়া যখন জায়েয, যে মুসলিম ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরয ধার্য হয়েছে, কোন প্রয়োজন ও গ্রহণযোগ্য কল্যাণ বিচারে যাকাত স্থানান্তরিত করা তার পক্ষেও জায়েয হবে। অবশ্য যদি সে নিজেই স্বীয় ধনমালের যাকাত বণ্টনের দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয়ে আসে। উপরিউক্ত দীর্ঘ আলোচনার তাই ফলশ্রুতি।
হানাফীরা স্থানান্তরকরণ পর্যায়ে যেসব দিক বিবেচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, সেগুলোও লক্ষণীয়। যেমন নিকটাত্মীয় অভাবগ্রস্তদের কাছে নিয়ে যাওয়া, অধিক অনশন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যে বহন করে নেয়া, মুসলমানদের জন্যে অধিক কল্যাণকামী ও সাহায্য পাওয়ার বেশী অধিকারী ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাওয়া অথবা অপর স্থানে কোন ইসলামী পিরকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া- যার ফলে মুসলিম জনগণের পক্ষে বিপুল ও বিরাট কল্যাণ সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- যাকাত যেঙ স্থানে থেকে সংগৃহীত সেখানে অনুরূপ কোন পরিকল্পনা না পাওয়া গেলে-ইত্যাদি ধরনের কার্যক্রম ও কল্যাণকর পদক্ষেপ- তাৎপরতা, যা দ্বীনপন্থী মুসলমানদের হৃদয়কে আশ্বস্ত করতে পারবে, সেই সাথে আল্লাহ্রও সন্তুষ্টি অর্জিত হবে- তা সম্পূর্ণ জায়েয, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যাকাত প্রদানে দ্রুততা ও বিলম্বিতকরণ
দ্রুত ও অনতিবিলম্বে যাকাত দিয়ে দেয়া ফরয
হানাফী ফিকাহ্বিদদের প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, যাকাত খুব ব্যপকতা সহকারে ফরয হয়। ধন-মালের যে মালিকের ওপর তা ফরয হয়, তা তার কাছে যতক্ষণ দাবি করা না হবে, ততক্ষণ তা দেয়া বিলম্বিত করার পূর্ণ ইখতিয়ার তার রয়েছে। কেননা যাকাত আদায়ের হুকুমটা শর্তহীন তাই দেয়ার জন্যে সময়ের প্রথম ভাগকে অপর অংশ থেকে আলাদা করে নির্দিষ্ট করা যায় না। যেমন এক স্থানের পরিবর্তে অপর স্থনে আদায় করার দির্দেশও দেয়া যায় না। ইমাম আবূবকর আর-রাযীও এ মত গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু হানাফী ইমামগণের মধ্য থেকে ইমাম আল-কারখী বলেছেন, যাকাত তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া ফরয। কেননা ‘আদেশ’ তো তাৎক্ষণিকতার দাবি করে। এমন কি যদি তাৎক্ষণিকতার দাবি না করে, বিলম্বিত করারও দাবি নেই। তাহলে ফিকাহ্ বিশারদ ইবনুল হুম্মাম যেমন বলেছেন- ফকীরকে তা দিয়ে দেয়ার নির্দেশটা তাৎক্ষণিকতার নিদর্শনসম্পন্ন। তা হচ্ছে, নির্দেশ তো তার প্রয়োজন দূর করার উদ্দেশ্যে। আর খুব শীঘ্রতা সম্পন্ন। তা তাৎক্ষণিকাভাবে ফরয না হলে দেয়া ফরয করার উদ্দেশ্যটা পূর্ণমাত্রায় হাসিল হতে পারে না। [আরবী************]
এই কথাটি যথার্থ। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহ্মদ এবং জম্হুর ফিকাহ্বিদগ আলিমগণ এই মত দিয়েছেন।
ইবনে কুদামাহ্ যেমন বলেছেন, এটা এজন্যে যে, ‘আদেশ’ তো আসলে তাৎক্ষণিকতার দাবি করে। যেমন ফিকাহ্র মৌল নীতি বলে। এ কারণে বিলম্বকারী আযাব পাওয়ার উপযোগী হয়। এ কারণে তো আল্লাহ্ তা’আলা ইবলিসকে তাঁর দরবার থেকে বহিষ্কার করেছেন, তার ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়েছেন। সিজদা করার আদেশ হওয়া মাত্র তা পালন করা থেকে বিরত থাকার দরুনই তাকে তিরস্কার করেছিলেন। কেউ যদি তার গোলামকে তাকে পানি খাওয়াবার নির্দেশ দেয় আর তা পালন করতে বিলম্ব করে, সে নিশ্চয়ই শাস্তি পাওয়া যোগ্য হবে। আরও এজন্যে যে, বিলম্ব করা জায়েয হলে তা ফরযের পরিপন্থী হয়ে পড়ে। কেননা ফরয তো তা, যা পালন না করলে আযাব দেয়া হবে। তাই আদেশ পালনে বিলম্ব করা জায়েয হলে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কাজ করা জায়েয হতে হয়। আর তাহলে তা অমান্য করলে সেজন্যে আযাব দেয়া ন্যায় হয়ে পড়ে।
আমরা যদি মেনেও নিই যে, নিঃশর্ত আদেশ তাৎক্ষণিকতার দাবি করে না, তাহলে আমাদের বিষয়টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা এখানে যদি বিলম্বিতকরণ বৈধ করা হয়, তা হলে তার প্রকৃতির দাবি অনুযায়ীই তা বিলম্বিত করা হবে সে ব্যাপারে এই নির্ভরতা সহকারে যে, বিলম্ব করা হলে গুনাহ্ হবে না। তাহলে এর মধ্যে তার মৃত্যু সংঘটিত হলে ফরযটাই অবহেলিত হয়ে থাকবে এ সময় তার ধন-মাল বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে বো সে তা পালনে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে। আর তাহলে যাকাত পাওয়ার অধিকারী ফকীর-মিসকীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
আসলে এখানে তাৎক্ষণিতদার দাবি প্রবল, সেই লক্ষণটা প্রকট। তা হচ্ছে, যাকাত ফরয হয়েছে ফকীর-মিসকীনের অভাব ও প্রয়োজন দূর কারার লক্ষ্যে। আর এ অভাব ও প্রয়োজন তো চলামান, গতিশীল। অতএব ফরয পালনটাও চলমান ও গতিশীল হতে হবে। তা ছাড়া তা একটা বারবার পালনীয় হওয়া ইবাদতও। কাজেই তা পালন করা ততটা বিলম্বিত হওয়া উচিত নয়, যতে করে আবার ফরয হওয়ার সময় উপস্থিত হয়ে পড়তে পারে- যেমন নামায ও রোযা।
এসব কথাই প্রযোজ্য তখন, যখন কোনরূপ ক্ষতির আশংকা থাকবে না। মূলত যাকাত দেয়ার ব্যাপারে কোন ক্ষতি বা অসুবিধা হওয়ার আশংকা থাকলে অথবা তার এছাড়া অন্য মাল থেকে থাকলে তা দিতে বিলম্ব করা জায়েয হবে। কেননা নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী************) ‘ক্ষতি করাও যাবে না, ক্ষতি স্বীকার করাও যাবে না। [ হাদীসটি আহমাদ ও ইবনে মাজা উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আব্বাস (রা) থেকে। ইবনে মাজাহ্ উবাদাতা ইবনুস সামেত থেকেও উদ্ধৃত করেছেন। আর হাকেম ও দারে কুত্নী উদ্ধৃত করেছেন আবূ সায়ীদ থেকে। নবী তাঁর (আরবী*************) গ্রন্থে হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। বলেছেনঃ মালিক তার ‘মুরসাল’ রূপে এমন সব সূত্র উদ্ধৃত করেছেন, যা পরস্পরকে শক্তিশালী করে। ‘হায়সামী’ হাদীসটির বর্ণনাকরীরা সকলেই সিকাহ্। আর আল-আলায়ী বলেছেন, হাদীসটির সমর্থক ও সাক্ষীস্বরূপ বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে, যার সমষ্টি ‘সহীহ্’ হওয়ার মর্যাদা পায়, অথবা ‘হাসান’ হওয়ায় যাকে দালিলরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। শয়খ আহমাদ শাকের মুসনাদের ২৮৬৭ নম্বরের হাদীসটির সনদ বের করতে গিয়ে বলেছেনঃ হাদীসটির সনদ ‘যয়ীফ’। তার অর্থ, উবাদাতা ইবনে সাবেত বর্ণিত হাদীসটি যা ইবনে মাজাহ্ উদ্ধৃত করেছেন, সে সনদটি সহীহ্ ও প্রমাণিত।
‘ক্ষতি করা’ ও ক্ষতি স্বীকার করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ক্ষতি করা হচ্ছে একটি কাজের সূচনা। আর ক্ষতি স্বৎীকার করা হচ্ছে সেই কাজের পরিণতি। প্রথমটি নিঃশর্তভাবে অন্যের সাথে বিপর্যায়কারী মিশিয়ে দেয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিপর্যয়তারীকে তার সাথে মেশানো তার মুকাবিলা বা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। এ হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব প্রণীত (আরবী************) গ্রন্থে বহু কালাম করা হয়েছে। তা দেখুন। মুল্লা কারী প্রণীত (আরবী************) গ্রন্থের ১৮০-১৮৫ পৃষ্ঠায় এবং আল-মুসাভী রচিত (আরবী***********) গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খন্ডে ৪৩১-৪৩২ পৃষ্ঠায়ও বিশদ আলোচনা হয়েছে।]
আরও যেহেতু কারোর ঋণ শোধ করায় বিলম্ব করা যখন জায়েয উপরিউক্ত কারণে, তখন যাকাত বিলম্বিত করা তো আরও উত্তমভাবে জায়েয হবে। [আরবী***********]
ইবাদত পালনে দ্রুততা এবং তা আদায়ের জন্যে সাধারণ অর্থেই খুব তীব্রত কারার জন্যে ইসলাম আহ্বান জানিয়েছে, উৎসাহ যুগিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা নিজেই ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী************) তোমরা খুব দ্রুততা সহকারে অগ্রসর হয়ে যাবতীয় কল্যাণময় কাজে যোগদান কর। [] তিনি আরও বলেছেনঃ (আরবী***********)
এবং দ্রুত দৌড়ে চল তোমাদের কাছ থেকে ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্যে। [আরবী**************]
সর্বপ্রকারের নেক কাজেই এ দ্রুততা ও তরান্বিককরণ যখন খুবই পসন্দনীয় প্রশংসণীয়, তখন যাকাত প্রভৃতি জনগণের অর্থনৈতিক অধিকারসন্পন্ন কাজগুলোতে তা গ্রহণ অধিকতর প্রশংসনীয় হবে, তা খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া লোভ ও মায়া বিজয়ী হয়ে ওঠোর আশংকাও রয়েছে, নফ্সের খায়েশ তার পথে বাধার সৃষ্টি করতেও পারে অথবা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা মাঝখানে দাঁড়িয়েও যেতে পারে- এ ভয়টা পুরোপুরি রয়েছে। তাহলে তো ফকীর-মিসকীনের অধিকার বিনষ্ট হতে পারে! এ কারণে আলিমগণ বলেছেন, সকল প্রকার কল্যাণমূলক কাজই খুব তাড়াহুড়া ও দ্রুততা সহকারে করে ফেলা বাঞ্ছনীয়। কেননা বিপদ-আপদ আসতে পারে, কাজের সুযোগ না-ও থাকতে পারে। আর মৃত্যুর ব্যাপারে তো কোন নিরাপত্তাই নেই। কাজেই বিলম্ব করা অপসন্দনীয়, অপ্রশংসনীয়। দ্রুততা ও দায়িত্ব মুক্তর অধিক সহায়কও। প্রয়োজন ও অভাব দূরকারী, ঘৃণ্য অলসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় এবং আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা ও গুনাহ্ নির্মূলকরণে অধিক কার্যকর। [আরবী**********]
হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে- নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘যে ধন-মালে যাকাত মিলে মিশে যায় (তা থেকে আলাদা করা হয় না), তা ধ্বংস করে দেয়।’ শাফেয়ী ও বুখারী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে এবং হুমাইদীও উক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে অতিরিক্ত কথা এটুকু রয়েছেঃ হতে পারে তোমরা মলে যাকাত ফরয হয়েছে। এখন তুমি যদি তা হিসাব করে বের করে না দাও, তাহলে এই হারাম মাল হালাল মালকে ধ্বংস করে ফেলবে। [আরবী**************]
আর যাকাত খুব দ্রুততা সহকারে ও অবিলম্বে বের করা যখন খুব প্রশংসনীয় ব্যাপার, তাহলে তার জন্যে সুনির্দিষ্ট ওয়াদার সময় থেকে তাকে আগে নিয়ে আসা ও পিছনে ঠেলে দেয়া এই উভয় কাজই জায়েয হতে পারে?…….. যেমন বছন পূর্ণ হওয়া কিংবা ফসল কর্তিত হওয়ার পূর্বেই কি তা আদায় করা জায়েয হবে?
এই বিষয়ে ফিকাহ্বিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। একটু পরেই আমরা সে আলোচনায় আসছি।
নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাকাত আদায় করা।
যাকাত ফরয যেসব মালে, তা দু’প্রকারের- এক প্রকারের মালে একটি বছর পূর্ণ হওয়ার শর্ত করা হয়েছে। যেমন গৃহপালিত গবাদি পশু নগদ টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়ের পণ্য। আর অন্য প্রকারের মলে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে একটি বছন পূর্ণ হওয়ার শর্ত নেই- যেমন কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদি।
প্রথম প্রকারের মাল সম্পর্কে অধিক সংখ্যক ফিকাহ্বিদ এ মত পোষণ করেন, যে, যাকাত ফরয হওয়ার কারণ যখনই ঘটবে- আর তাহলে পূর্ণ মাত্রায় নিসাব বা নিসাবের পরিমাণ পূর্ণ হওয়া- একটি বছর অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েয। শুধু তা-ই নয়, দুই কিংবা ততোধিক বছরের যাকাত অগ্রিম দেয়া হলেও তা জায়েয হবে। তবে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পূর্বে যাকাত দিলে তা জায়েয হবে না।
হাসান বসরী, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, জুহ্রী, আওযায়ী, আবূ হানীফা, শাফেয়ী আহমদ, ইসহাক, আবূ ইউসুফ প্রমুখ ফিকাহ্ বিশারদ উপরিউক্ত মত পোষণ করেন। [আরবী************]
রাবীয়, মালিম ও দাউদ বলেছেন, মালিকানায় একটি বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েয নয়- তা নিসাব পরিমাণের মালিকানা লাভের পূর্বে দেয়া হোক, কি তার পর। [(আরবী***********) ইবনে রুশদ তাঁর (আরবী*************) গ্রন্থে লিখেছেন (১ম খন্ড, ২৬৬পৃ.) এ মতভেদের কারণে তা ইবাদত না মিসকীনদের জন্যে ধার্য হক্- এ নিয়ে মতভেদ। যারা তাকে শুধু ইবদত মনে করেন এবং তাকে নামাযের সাথে তুলনা করেন, তাঁরা যাকাত নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব দেয়া জায়েয মনে করেন না। আর যাঁরা তাকে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক ধার্য হক্ মনে করেন, তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ইচ্ছঅ করে দিলে জায়েয হবে বলে মনে করেছেন। ইমাম শাফেয়ী হযরত আলী বর্ণিত হাদীসকে দলিলণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তা হচ্ছে, ‘নবী করীম (স) বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই হযরত আব্বাসের যাকাত নিয়ে নিয়েছিলেন।’] কোন কোন মালিকী মাযহাবপন্থী আলিম বলেছেন, নির্দিষ্ট সময়ের অল্প পূর্ব যাকাত দিয়ে দিলে তা জায়েয হবে। তবে তা নগদ সম্পদের, আবর্তনশীল ব্যবসায়ী পণ্যের বিক্রয় থেকে লব্ধ ফেরত পাওয়ার আশা পূর্ণ ঋণ (লোকদের কাছে পাওনা)- নিজের করা ঋণ নয়, ইত্যাদির হতে হবে। যে সব গবাদি পশুর জন্যে চেষ্টা যত্ন নিতে হয় না, তাও এর মধ্যে গণ্য। এসবের যাকাত অগ্রিমভাবে দেয়া যাবে, যদিও অগ্রিম দেয়া মাকরূহ। কৃষি ফসল ও ফলের মওজুদ করা ব্যবসায় পণ্য আবর্তনশীল ঋণ ইত্যাদির যাকাত অগ্রিমভাবে আদায় করা যায় না। অনুরূপভাবে যে সবের জন্যে আদায়কারী নিযুক্ত হয়েছে- যদি যাকাতের কর্মকর্তা ছাড়াই এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যাকাত দিয়ে দেয়, তাও আদায় হবে না। কিন্তু যদি যাকাতের জন্যে নিযুক্ত কর্মীকে এক বছর পূর্ণ হওয়ার কিছু সময় পূর্ব দেয়া হয়, তাহলে সে যাকাত আদায় হবে।
এ‘কিছু সময়’ বলতে কি বোঝায়- যে সময়ের পূর্ব দিলে যাকাত হবে তা নির্ধারণে ফিকাহ্বিদগণ একদিন দুদিন হতে শুরু করে এক মাস দুমাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের কথা বলেছেন। আরন নির্ভরযোগ্য হচ্ছে এক মাস কাল। তাই তার অধিক সময় পূর্ব দিলে আদায় হবে না।
আগে ভাগে যাকাত দেয়া কোনরূপ ‘কেরাহিয়াত’ ছাড়াই জায়েয হবে যদি যাকাত সংগ্রহের স্থান থেকে অধিকতর তীব্র প্রযোজনক্লিষ্ট কোন ফকীরকে দেয়ার জন্যে স্থানান্তরিত করা হয়, যেন বছর শেষ হওয়া কালেই তা পাওয়ার যোগ্য লোককে দেয়া সম্ভব হয়। বরঞ্চ এরূপ আগে দেয়া তো ফরযও হয়ে পড়ে, যেমন মলিকী মযহাবের কেউ কেউ বলেছেন। এমন কি যাকাত যদি বিনষ্ট হয়ে যায় কিংবা আগে দেয়ার ফলে তা নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলেও তা আদায় হবে এবং তার ক্ষতিপূর্ণ দিতে হবে না। কেননা এ যাকাত তো যথাস্থানে নিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময়টাও ঠিক তা ফরয হওয়ার সময়রূপেও নির্ধারিত হল। তখন অবশিষ্ট সময়ের যাকাত বের করা তার পক্ষে জরুরী নয়। কিন্তু পূর্বোক্ত ধরনে যদি সময়ের আগে যাকাত দেয়া হয়, তাহলে অবশিষ্ট সময়ের জন্যে যাকাত দিতে হবে যদি মালিকানা নিসাব পরিমাণ হয়। [দেখুনঃ (আরবী****************)]
যাঁরা জায়েয বলেন না তাঁদের দলিল
যাঁরা অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয বলেন না, তাঁদের দলিল হচ্ছে, যাকাত ফরয হওয়ার দুটি শর্তঃ একটি নিসাব পূর্ণ হওয়া আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মালিকানার একটি বছর পূর্ণ হওয়া। কাজেই একটি পূর্তির পূর্বে তা দেয়া জায়েয হবে না, যেমন সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে না নিসাব পরিমাণের মালিকানা হওয়ার পূর্বে দিলে। কেননা শরীয়াত যাকাতের জন্যে একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে আর তা হচ্ছে একটি বৎসর পূর্তি হওয়া। তাই তার পূর্বে অগ্রিম দেয়া জায়েয হবে না, যেমন নামায সময় হওয়ার আগে পড়লে নামায হবে না। [আরবী***************]
যাঁরা জায়েয বলেন তাঁদের দলিল
যাঁরা অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন, তাঁদের দলিল হচ্ছে- আবূ দাউদ প্রমুখ উদ্ধৃত ও হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস। তা হচ্ছে হযরত আব্বাস (রা) রাসূলে করীম (স)- এর কাছে এক বছর পূর্তির পূর্বে অগ্রিম যাকাত দেয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাঁকে সেজন্যে ‘রুখসত’ (অনুমতি) দিয়েছিলেন। [হাদীসটি নাসায়ী ছাড়া অবশিষ্ট পাঁচখানি সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। হাকেম, দারে কুত্নী ও বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন। দারে কুত্নী ও আবূ দাউদ বলেছেন, হাদীসটি ‘মুরসাল’। অপরাপর বহু হাদীস এটিকে শক্তিশালী বানিয়েছে। দেখুনঃ (আরবী**************)]
এ হাদীসটির সনদ সম্পর্কে কথা উঠেছে বটে; তবে বায়হাকী হযরত আলী (রা) থেকে যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তা এর পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। তা হচ্ছে, নবী করীম (স) হযরত উমর (রা)- কে যাকাতের জন্যে পাঠালেন। পরে বলা হল, উবনে জামীল, খালেদ উবনুল অলীদ ও নবী করীম (স)- এর চাচা আব্বাস (রা) তা দিতে অস্বীকার করেছেন।
তখন নবী করীম (স) খালেদ ও আব্বাসের মর্যাদা রক্ষা করলেন। তখন তিনি যা বলেছিলেন, তার মধ্যে এই কথাটিও ছিলঃ ‘আমরা খুব ঠেকায় পড়েছিলাম। পরে আব্বাস থেকে আমরা দুই বছরের যাকাত অগ্রিম নিয়ে নিরেছি। [আরবী************) আবূ দাউদ তায়ালিসী আবূ রাফে’র এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন, নবী করীম (স) উমর (রা)- কে বললেনঃ ‘আরমা আব্বাসের মালের যাকাত প্রথম বছর অগ্রিম নিয়েছিলাম। (আরবী*************)] সহীহ্ বুখারী গ্রন্থেও এই কিস্সাটি আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে এসেছে। তাতে এ কথা আছে, ‘আব্বাসের ব্যাপার হচ্ছে তাঁর যাকাত আমার কাছে এবং অনুরূপ আরও যাকাত সেই সাথে।’ পরে বললেনঃ হে উমর! তুমি কি জানো না এক ব্যক্তির চাচা তার পিতার মূল- শাখা বিশেষ হয়ে থাকে।’ [ঐ- এ কিস্সা সহীহ্ মুসলিমের রয়েছে।]
আবূ উবাইদ বলেছেন, (আরবী**************) এ বর্ণনার সারকথা হচ্ছে, তাঁর কাছ থেকে দুই বছরের যাকাত অগ্রিম নেয়া হয়েছিল- সে বছরের এবং তার পূর্বের বছরের। [শাওকানী বলেছেন, তার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত তাৎপর্য হচ্ছে, নবী করীম (স) যদি হযরত আব্বাসের ওপর ধার্য যাকাত নিজের ওপর নিয়ে নেন এজন্যে যে, তিনি দিতে অস্বীকার করেছেন, তাহলে অনুরূপ আরও এক বছরে দায়িত্ব নিতে পারেন কোনরূপ বাড়তি ছাড়া। দ্বিতীয়ত দিতে অস্বীকার করার কথা মনে করলে হযরত আব্বাসের প্রতি খারাপ ধারণা করা হবে। (আরবী**************)]
চিন্তাবিবেচনা ও কিয়াসের ভিত্তিতে তাঁর এ দলিল পেশ করেছেন যে, এই অগ্রিম গ্রহণ এমন মালের যাকাত যা ফরয হওয়ার কারণ পাওয়া গেছে তা ফরয হওয়ার পূর্বেই। আর তা জায়েয। যেমন ঋণ আদায় করার নির্দিষ্ট পূর্বেই তা আগেভাগে দিয়ে দেয়, যেমন কসম খাওয়ার পর কসমের কাফ্ফারা আদায় করা তা ভংগ করার পূর্বেই। কাউকে জখম করার পর তার প্রাণ বের হওয়ার পূর্বেই হত্যার কাফ্ফারা দিয়ে দেয়া ইমাম মারিকের মতে জায়েয। [আরবী**************]
তাঁদের এই কথা, বছর পূর্তি হওয়া যাকাতের দুটি শর্তের অন্যতম। অতএব তা জায়েয নয়- যেমন নিসাব এই কথা সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা নিসাব পরিমাণের মালিক হওয়ার পূর্বে অগ্রিম যাকাত দেয়া কারণ ঘটার পূর্বেই কার্যকে আগাম করার সমতুল্য। ফলে তা সমমের পূর্বে কাফ্ফারা দেয়া ও আহত করার পর হত্যার কাফ্ফারা দেয়ার মতই হয়ে যায়। তখন অবস্থা হয়, যেনস দুটি শর্ত পূরণ হওয়ার পূর্বে তা অগ্রিম দেয়া হয়েছে। আর প্রথমোক্ত অবস্থায় একটি শর্তের হওয়ার অর্থাৎ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই দিয়ে দেয়া- এ দুটি কখনও এক ও অভিন্ন নয়। [আরবী***************]
‘যাকাতের জন্যে একটি সময় নির্দিষ্ট আছি’- এ কথার জবাবে আমরা তা- ই বলব, যা ইমাম খাত্তাবী বলেছেন। আর তা হচ্ছে, কোন জিনিসে যদি সময় প্রবেশ করে মানুষের প্রতি সদয়তাস্বরূপ হয়ে, তাহলে সে তার অধিকারে অনুমতি নিতেও পারে এবং তার প্রতি হৃদ্যতা পরিহারও করতে পারে। যেমন, কারোর বিলম্বিত অধিকার তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল, যেমন কোন অনুপস্থিত ব্যক্তির যাকাত কেউ আদায় করে দিল, যদিও তার প্রতি তা ফরয হওয়ার দৃঢ় প্রত্যায় অর্জিত হয়নি। কেননা হতে পারে, সেই মাল সেই সময়ে সংগৃহীত হয়েছে। [আরবী*************]
তবে নামায ও রোযা নিছক ইবাদত ছাড়া আর কিছু নয়্ তার জন্যে যে সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার তাৎপর্য বোঝার অপেক্ষা রাখে না। তা শরীয়াত আরোপিত দায়িত্ব, একটা কাজের পরীক্ষা। অতএব তা ঠিক সেভাবেই আদায় করা যেতে পারে মাত্র।
যদি কেউ তার মালিকানাভুক্ত নিসাবের যাকাত অগ্রিম দিয়ে দেয়- যা তার কাছে উৎপন্ন হবে তা থেকে কিংবা তাতে তার যে মুনাফা হবে তা থেকে, তাহলে কোনরূপ বৃদ্ধি ছাড়াই নিসাব থেকে তা আদায় হয়ে যাবে ইমাম শাফেয়ী ও আহমাদের মতে। কেননা সে অগ্রিম যাকাত দিয়েছে এমন মালের যা তার মালিকানায় নেই। এ কারণে তা জায়েয হবে না।
ইমাম আবূ হানীফার মতে তা আদায় হবে। কেননা সে যে জিনিসের মালিক, তা তার অধীন। অতএব তা তারই মর্যাদা পাবে। [আরবী***************]
মালের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে সে সব যাতে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে এক বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত থাকে না। যেমন কৃষি ফসল, ফল, খনিজ সম্পদ, রিকাজ ইত্যাদি। এসবে যাকাত অগ্রিম দেয়া জায়েয নয়। তবে শাফেয়ী মাযহাবের কেউ কেউ ওশর অগ্রিম দেয়া জায়েয বলেছেন। কিন্তু অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত হচ্ছে, তা- ও জায়েয নয়। কেননা ‘ওশর’ ফরয হয় একটি মাত্র কারণে। তা হচ্ছে ফসল পাওয়া- হস্তগত হওয়া, দানা হাতে আসা। তা যদি অগ্রিম দেয়া হয়, তাহলে ফরয হওয়ার করণ দেখা দেয়ার পূর্বেই তা দেয়া হবে। এজন্যে তা জায়েয বা আদায় হবে না। যেমন নিসাব পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যদি কেউ যাকাত দেয়, তাহলে তা হয় না। [দেখুন (আরবী***************)]
হাম্বলী মাযহাবের কেউ কেউ অগ্রিম ‘ওশর’ দেয়ার ব্যাপারে শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা হতে হবে পাছ বড় হওয়ার ও খেজুরের ছাড়া বের হয়ে আসা- প্রভৃতির পর।
অগ্রিম দেয়ার কোন নির্দিষ্ট সীমা আছে কি
যাকাত অগ্রিম দেয়া যখন জায়েয, তখন তার জন্যে কয় বছরের সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে কিংবা কোন সীমা ছাড়াই তা জায়েয?
হানাফী ও অন্যান্য ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, মালিক যে- কয় বছরের ইচ্ছা অগ্রিম যাকাত দিতে পারে, সেজন্যে কোন সীমা নেই। এমন কি তাঁর এতদূর বলেছেন, কারোর যদি তিনশ’ দিরহাম সম্পদের মালিকানা থাকে আর তা থেকে সে ভবিষ্যতের বিশ বছেরের যাকাত বাবদ একশত দিরহাম দিয়ে দেয়, তাহলেও তা জায়েয হবে। কেননা ‘কারণ’ এখানে পাওয়া গেছে। তা হল নিসাব পরিমাণ ক্রমবর্ধনশীল সম্পদের মালিকানা। ওশর এরকম নয়। তা গাছ বেড়ে ওঠা ও ফল বের হওয়ার পূর্বে অগ্রিম দেয়া জায়েয হবে না। এমন কি- চারা করা ও গাছ বপনেরও পূর্বে! কেননা ওশর ফরয হওয়ার কারণটাই এখানে অনুপস্থিতি। যেমন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানার পূর্বেই অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয নয়। [আরবী**************]
এ কারণে অগ্রিম না দেয়া ও যথাসময়ে যাকাত বের করাই উত্তম ও অধিক ভাল। তাহলে সর্বপ্রকারের মতদ্বৈততা থেকে বাঁচা যাবে এবং সেই সাথে রাষ্ট্রর বার্ষিক আর্থিক আয়ও সুসংহত ও সুসংবদ্ধ থাকবে। অবশ্য অগ্রিম দেয়ার বা নেয়ার কোন প্রয়োজনই যদি দেখা দেয় তা হলে তা স্বতন্ত্র কথা। যেমন বায়তুলমালের আয় ফরয জিহাদ পালনের জন্যে বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দিলে অথবা দরিদ্রদের অভাব পূরণের তাৎক্ষিণিক ব্যবস্থা নিতে হলে সমস্ত ধন-মালের বা কতিপয়ের যাকাত অগ্রিম নেয়া যবে, যেমন স্বয়ং নবী করীম (স) তাঁর চাচা হযরত আব্বাসের কাছ থেকে নিয়েছিলেন।
তবে অগ্রিম বা পূর্বের যাকাত দুই বছরের অধিক সময়ের নেয়া উচিত নয়। তাহলে অন্ততঃ মূল দলিলের ওপর শক্তভাবে আমল করা হবে।
যাকাত বিলম্বিত করা কি জায়েয
প্রয়োজন বা কোন কল্যাণ- দৃষ্টিতে অগ্রিম যাকাত নেয়ার বিষয়ে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি এবং জয়েয বলেছি। তাই তা ফরয হওয়ার সময় থেকে বিলম্বিত করা বা দেরী করে যাকাত দেয়াটা কোন বিশেষ কারণ ছাড়া জায়েয হতে পারে না। কোন গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ- দৃষ্টির দাবি অনুযায়ী যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা হলে তা স্বতন্ত্র কথা। যেমন কোন অনুপস্থিত ফকীরকে দেয়ার উদ্দেশ্য- যার প্রয়োজন উপস্থিত অন্যান্য ফকীরের তুলনায় অনেক বেশী মনে হবে- বিলম্বিত করা হলে জায়েয হবে। অনুরূপভাবে তা কোন অভাবগ্রস্ত নিকটাত্মীয়কে দেয়ার জন্যে বিলম্বিত করাও জায়েয। কেননা তার অধিকারটা অত্যন্ত তাগিদপূর্ণ এবং তাতে কয়েক গুণ বেশী সওয়াবও রয়েছে।
উপস্থিত আর্থিক ওযরের কারণে যাকাত দিতে দেরী করা যেতে পারে। যেমন যদি মালিকের নিজেরই যাকাত সম্পদের প্রতি অধিক প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তা যদি ব্যয় করে এবং তা তার ওপর ঋণ হয়ে চাপে, তবে তাতে খুব বেশী দোষ হবে না। অবশ্য তার সুযোগ- সুবিধা হওয়ার প্রথম ভাগেই তা আদায় করে দেয়া তার কর্তব্য হবে।
শমসুদ্দীন রমলী বলেছেন, অধিকতর অভাবগ্রস্ত, অধিক কল্যাণকর বা নিকটবর্তী কিংবা প্রতিবেশীর অপেক্ষায় যাকাত প্রদানে বিলম্ব করায় যাকাতদাতার অধিকার রয়েছে। কেননা এই বিলম্বকরণটা স্পষ্ট উদ্দেশের জন্যে, আর তা মর্যদা। অনুরূপভাবে উপস্থিত লোকদের অধিকার লাভের বিবেচনায় বিলম্ব করা যাবে। তবে এই বিলম্বকরণে যদি যাকাতের মাল ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার ক্ষত্পিূর্ণ দিতে হবে। এজন্যে যে তার খুব বেশী সম্ভাবনা রয়েছে। সে তো নিজের গরজে বিলম্বিত করেছে। এ কারণে তার বৈধতা জিনিসটির নিরাপত্তার শর্তাধীন করে দেয়ার প্রয়োজন আছে। অপর পক্ষে বিলম্বিত করায় উপস্থিত ফকীর যদি না খেয়ে থাকার দারুনস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এ বিলম্বকরণ সম্পূর্ণ হারাম হবে। কেননা তার ক্ষতি কোনক্রমেই জায়েয হতে পারে না। [আরবী**************]
কোন প্রয়োজনে যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা জায়েয হওয়ার ইবনে কুদামহ্ শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা খুব সামান্য জিনিস হতে হবে। যদি পরিমাণ বিপুল হয়, তাহলে তা জায়েয হবে না। তিনি ইমাম আহমাদের এ কথা উদ্ধৃত করেছেন, ‘কারোর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে যাকাত প্রতি মাসে দেয়া হয় না অর্থাৎ তা দিতে এতটা বিলম্ব করা যাবে না যে, তা মাসিক হিসেবে প্রতি মাসে কিছু কিছু করে বিচ্ছিন্নভাবে দেয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। যদি অগ্রিম দেয়া হয়, তাহলে তাদের বা অন্যদের দেবে- বিচ্ছিন্নভাবেও দেয়া যাবে, এক সঙ্গে সবও দিয়ে দেয়া যাবে। কেননা সে তা তার জন্যে নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বিত করেনি। অনুরূপভাবে যদি কারো নিকট দুই প্রকারের মাল থাকে অথবা বহু মাল থাকে, কিন্তু তার যাকাত একই হয়। আর তার বছর হয় বিভিন্ন তারিখে- যেমন কারো কাছে নিসাব রয়েছে অথচ বছরের মধ্যেই সে অনুরূপ মাল অর্জন করল যা নিসাব পরিমাণের কম, তাহলে এসবের যাকাত একত্রিত করা ও একসাথে দেয়ার উদ্দেশ্যে বিলম্ব করা জায়েয হবে না। কেননা এ একত্রিতকরণ এভাবেও হতে পারে যে, বছরের মাঝখানে পাওয়া সম্পদের যাকাত অপর মালের ওপর যাকাত ধার্য হওয়ার শুরুতে দিয়ে দেবে। [আরবী*************]
মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ এ কথাটির ব্যাখ্যা এই দিয়েছেন যে, যাকাত তাৎক্ষণিকভাবে বণ্টন করাই ওয়াজিব। মালের মালিকরে কাছে তা অবশিষ্ট থাকা এবং পাওয়ার যোগ্য- লোক তার কাছে যখনই আসবে তখন তা প্রদান করা বছরের দীর্ঘ মেয়াদের মধ্যে- এ নীতি জায়েয নয়।[আরবী*************]
রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর দায়ীত্বশীল বেতনভূক্ত প্রতিনিধির পক্ষে যাকাত সম্পদ একত্রিত ও সংগৃহীতকরণে বিশেষ কোন কল্যাণ বিবেচনায় বিলম্বিত করা জায়েয। সে কল্যাণ বিবেচনা এ হতে পারে যে, মালের মালিক কোন দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছে, মাল ও ফল- ফসল বিনষ্ট হয়েছে এই সব। ইমাম আহমাদ এটাকে জায়েয বলেছেন হযরত উমর (রা)- এর হাদীসকে দলিলরূপে গ্রহণ করে। তারা এক বছর খুব বেশী ঠেকায় পড়ে গিয়েছিল। হযরত উমর (রা) সেই বছর তাদের কাছ থেকে যাকাত নেন নি। নিয়েছেন পরবর্তী বছর। [দেখুন (আরবী*************)]
আবূ উবাইদ ইবনে আবূ যুবাবের সূত্রে উল্লেখ করেছেনঃ হযরত উমর (রা) শুষ্কতা ও দুর্ভিক্ষের বছর যাকাত সংগ্রহের কাজ বিলম্বিত করেছিরেন। পরে যখন লোকেরা বৃষ্টিপাতের দরুন নতুন জীবন ফিরে পেল, তখন আমাকে পাঠালেন। বলে দিলেন, লোকদের কাছ থেকে দুইবারের যাকাত আদায় করবে। তার একবারেরটা সেখানকার লোকদের মধ্যেই বণ্টন করে দেবে আর অপরটা আমার কাছে নিয়ে আসবে। [আরবী****************]
এটা ছিল হযরত উমর (রা)- এর ফিলাফত পরিচালনার নীতি এবং এ যে অতীব উত্তম ও মানব কল্যাণকর, তা নিঃসন্দেহে। জনসাধারণের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ স্নেহ ও মমত্ববোধ। এ কারণে দুর্ভিক্ষের বছর বিপন্ন লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণকে বিলম্বিত করেছিলেন। ঠিক যেমন তিনি চোরের হাত কাটার দন্ডও এ বছর মওকুফ রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, (আরবী************) ‘দুর্ভিক্ষের বছর চোরের হাত কাটা চলবে না।’
যাকাত অগ্রিম দেয়া পর্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত আব্বাস (রা)- এর যাকাত বিলম্বিতকরণের ওযর বলতে গিয়ে নবী করীম (স) বলেছিলেনঃ এ যাকাত তো তাঁর ওপর আছে এবং তার সাথ অনুরূপ আরও একটি। আবূ উবাইদ বলেছেনঃ আল্লাহ্ই প্রকৃত ব্যাপার জানেন, তবে আমি মনে করি, নবী করীম (স) হযরত আব্বাসের বিশষ কোন প্রয়োজন দেখা দেয়ায় তাঁর যাকাত বিলম্বিত করে দিয়েছিলেন। আর রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ বিবেচনায় এরূপ করার ইখতিয়ার রয়েছে। অবশ্য পরে তা নিয়ে নেবে। [আরবী**************]
বিনা প্রয়োজনে যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা
কোনরূপ ‘ওযর’ বা কোন প্রয়োজন ছাড়াই যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা জায়েয নেই। তা করলে সে গুনাহ্গার হবে। তার পরিণতি তাকেই ভোগ করতে হবে। কেননা একথা স্পষ্টভাবে প্রামণিত যে, যাকাত তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা ফরয।
শাফেয়ী মতের (আরবী************) গ্রন্থে প্রণেতা এ পর্যায়ে লিখেছেন, ‘যার’ ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তার পক্ষে তা প্রদানে বিলম্ব করা জায়েয নয়। কেননা তা এমন একটা হক- অধিকার, যা কোন ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছানো ফরয। তাকে দিয়ে দেয়ার দাবি তো প্রবল হয়ে আছে। আতএব বিলম্ব করা জায়েয হতে পারে না। যেমন কারো কোন আমানতের জিনিস তার মালিক যখনই চাইবে, অবিলম্বে দিয়ে দিতে হবে। যদি দিতে বিলম্ব করে- দিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও, তাহলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কেননা সে একটা ফরয কাজকে বিলম্বিত করেছে যথাসময়ে দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও। আতএব ক্ষতিপূরণ দান অনিবার্য- আমানতের মতই। [আরবী***************]
হানাফীদের গ্রন্থাবলীতে লিখিত আছে, কোনরূপ প্রয়োজন ব্যতীতই যাকাত প্রদান বিলম্বিত করার অপরাধ এত বড় যে, তা যে করবে তার সাক্ষ্য কবুল করা যাবে না, তার গুনাহ্ হবে- মেন আল-করখী প্রমুখ এ কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। আর তা ঠিক সেই কথাই যার উল্লেখ ইমাম আবূ জাফর তাহাভী করেছেন আবূ হানীফা (র) থেকে। কথাটি হচ্ছে, তিনি তা মাকরূপ মনে করেন। মাকরূপ তাহরীমীই মনে করতে হবে যখন শুধু ‘কিরাহিয়াত’ বলা হবে। আমাদের তিনজন ইমাম থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান।
তাঁরা বলেছেন, বাহ্যত তো এ কথাই সত্য যে, যাকাত প্রদানে বিলম্ব করলে- সে বিলম্ব একদিন বা দুইদিন বা যত কম সময়ের জন্যেই হোক- গুনাহগার হবে। কেননা তারা ‘তাৎক্ষণিক বলতে বুঝেছেন সম্ভাব্য সময়ের প্রথম মুহূর্ত। বলা যায়, লক্ষ্য হচ্ছে, পরবর্তী বছর পর্যন্ত যেন ঠেলে নিয়ে যাওয়া না হয়। কেননা (আরবী**************) গ্রন্থ থেকে (আরবী*************) গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, যাকাত সময়মত না দেয়া অবস্থায় যদি দুটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে খুবই খারাপ হবে ও গুনাহ হবে। [আরবী****************]
আমার মতে মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণের যে মত জানা গেছে, তার বাহ্যিক অর্থ যা, তা থেকে অন্যথা করা উচিত নয়। তা একদিন বা দুই বা কয়েক দিনের উপেক্ষা বা অবহেলা হলেও একটা সম্ভব ব্যাপার, সহজতা বিধঅন ও অসুবিধা দূর করণের নিয়মে তা হতে পারে। কিন্তু এক মাস বা দুই মাস- কি ততোধিক সময়ের উপেক্ষা- এক বছরের কম সময় পর্যন্ত- যেমন (আরবী**************) গ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, তা গণ্য করা ঠিক হবে না, মানুষ যেন তাৎক্ষণিকভাবে দেয় ফরযের কথা ভুলে না যায়, তা দেখতে হবে।
যাকাত দেয়ার পর তা বিনষ্ট হয়ে গেলে
অনেক সময় এমনও ঘটে যে, মালের মালিক যাকাত বের করে দিয়েছে, তারপর কোন কারণে তা বিনষ্ট হয়ে গেল। হয় চুরি হল, জ্বলে গেল, কিংবা এ ধরনের অন্য কিছু ঘটল। তখন কি হবে, এ ব্যাপারে ফিকাহ্বিদদের মত বিভিন্ন। ইবনে রুশ্দ তা খুব সুন্দরভাবে ও সংক্ষিপ্তরূপে পেশ করেছেন। বলেছেনঃ
‘যাকাত দিয়ে দেয়ার পর যদি তা নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কি হবে?- কিছু লোক বলেছেন, তাতেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। অপর কিছু লোক বলেছেন, প্রদান স্থানে ধ্বংস বা বিনষ্ট হরে তার ক্ষতিপূরণ তাকেই করতে হবে, যতক্ষণ না তার যথাস্থানে তা স্থপিত হয়। অপর লোকরা দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। হয় তা দিয়েছে তা দেয়া সম্ভব হওয়ার পর নতুবা তা দিয়েছে ফরয ও সম্ভব হওয়ার প্রথম সুযোগেই। কেউ কেউ বলেছেন, ফরয ও সম্ভব ও সম্ভব হওয়ার কিছু দিন পর যদি তা বের করে থাকে। তাহলে উক্ত অবস্থায় তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যদি তা দিয়ে থাকে প্রথম ফরয হওয়ার কালেই এবং তাতে দাতার কোন ক্রটি না হয়, তাহলে উক্ত অবস্থায় তাকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। ইমাম মালিকের প্রসিদ্ধ মত এটাই।
অন্য লোকেরা বলেছেন, দাতার ক্রটি ধরা পড়লে ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে। আর তার কোন ক্রটি না হলে সে অবশিষ্টের যাকাত দেবে। আবূ সওর ও শাফেয়ী এ মত দিয়েছেন।
অন্যারা বলেছেন, বরং সব কিছু থেকে যা যাবার তা যাওয়ার পর মিসকীনরা মালের মালিক অবশিষ্ট সম্পদে দুটনই শরীক গণ্য হবে মালের মালিকর অংশ থেকে তাদরে দুজনের অংশ অনুপাতে। যেমন দুই শরীক- সম্মিলিত মালের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে অনুপাতে তারা দু’জনই ক্ষতিপূরণে শরীক হয়- এ- ও তেমনি।
আলোচ্য বিষয়ে মোটামুটি পাঁচটি মত পাওয়া গেলঃ
১. একটি মতঃ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না নিঃশর্তভাবে,
২. একটি মতঃ ক্ষতিপূরন দিতে হবে নিঃশর্তভাবে,
৩. একটি মতঃ দাতার কোন ক্রটি হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ক্রটি না হলে নয়।
৪. একটি মতঃ ক্রটি হলে ক্ষতিপূরণ দেবে, নতুবা অবশিষ্টের যাকাত দেবে,
৫. একটি মতঃ (পঞ্চম০ অবশিষ্টের মধ্যে ইভয়ই অংশীদার হবে। [আরবী************]
যাকাত ফরয হওয়ার পর ও প্রদানের পূর্বে মাল ধ্বংস হলে
ইবনে রুশ্দে অপর একটি বিষয়েরও উত্থাপন করেছেন। তা হচ্ছে, যাকাত ফরয হওয়ার পর এবঙ তা প্রদানের পূর্বে তা ধ্বংস হয়ে গেলে কি হবে? বলেছেন, ফরয হওয়ার পর ও প্রদানে সক্ষম হওয়ার পূর্বে কিছু অংশ মাল যদি চলে যায়, তাহলে কিছু সংখ্যক ফিকাহ্বিদ বলেছেন, যা অবশিষ্ট আছে তা থেকে যাকাত দেবে। অপর লোকেরা বলেছেন, তখন মিসকীনরা ও মালের মালিক দুই শরীকের অবস্থায় এসে যাবে, উভয়ের অংশ থেকে কিছু কিছু বাদ যাবে।
বিষয় দুটিতে মতপার্থক্যের কারণ
ইবনে রুশ্দ বলেছেন, এ পর্যায়ে ফিকাহ্হিদদের মতপার্থক্য হওয়ার কারণ হচ্ছে, যাকাতকে ঋণের মত মনে করা অর্থাৎ অধিকারটা সম্পর্কিত হবে দায়িত্বের সাথে, মূল মালের সাথে সম্পর্কিত হয়, মাল যার হাতে তার দায়িত্বের সাথে নয়। যেমন আমানতরক্ষাক লোক প্রভৃতি।
যাকাতদাতাদেরকে যারা আমানতদাতাদের ন্যায় মনে করেছে, তাঁরা বলেছেন, যখন যাকাত বের করে দিল, তারপর তা ধ্বংস হয়ে গেলে সেজন্যে তার ওপর কিছুই বর্তাবে না।
আর যাঁরা তাদেরকে ঋণগ্রস্তদের মত মনে করেছেন তাঁরা বলেছেন তারা ক্ষতিপূরণ করতে বাধ্য হবে।
আর যাঁরা ক্রটি হওয়া ও ক্রটি না হওয়ার মধ্যে পার্থক্য করেছেন, তাঁরা তাদেরকে সবদিক দিয়েই আমানতদারদের মত মনে করেছেন। কননা আমানতদারের ক্রটি হলে সে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকে। আর যিনি বলেছেন, ক্রটি না হয়ে থাকলে অবশিষ্টের যাকাত দেবে, তিনি তাকে মনে করেছেন সেই লোক যার যাকাত বের করার পর কিছু মাল নষ্ট হয়ে গেছে, সে সেই লোকের মত যার কিছু মাল নষ্ট হয়ে গেছে যাকাত ফরয হওয়ার পর। যেমন কারো ওপর যাকাত ফরয হল, সে তো শুধু যে মাল মজুদ আছে তার যাকাত দেবে। এখানেও তাই। তার যে মাল এখানে বর্তমানে আছে, কেবল সে মালেরই যাকাত দেবে।
এরূপ মতপার্থক্যের কারণ হচ্ছে সম্পদের মালিককে ঋণগ্রস্ত ও আমানতদার এবং শরীক ও ফরয হওয়ার পূর্বেই যার মাল ধ্বংস হয়ে গেছে- এ দুয়ের সাথে তুলনা আবর্তিত হওয়া।
আর যখন যাকাত ফরয হবে এবং তা প্রদানে সক্ষম হবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তা প্রদান করল না- এর মধ্যে কিছু মাল চলে গেল- এ অবস্থায় আমার বিশ্বাস, সব ফিকাহ্বিদই এ ব্যাপারে একমত যে, মালের মালিক ক্ষতিপূরণ দেবে। তবে পবাদি পশুর ক্ষেত্রে মনে করেছে যে, তাতে যাকাতে ফরয হওয়াটা সম্পূর্ণতা পায় এক বছর অতীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি যাকাত আদায়কারী যাকাত নেয়ার জন্যে উপস্থিত হয়্ এ হচ্ছে ইমাম মালিকের মায্হাব। [(আরবী*************) দেখুনঃ (আরবী**************)]
আগে-পরে হলে কি যাকাত রহিত হবে
কোন বিশেষ ওযরের দরুন কিংবা ওযর ছাড়াই যদি যাকাত প্রদান বিলম্বিত করে, অতঃপর এ অবস্থায় একটি কিংবা কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু তা আদায় করা হয় না, তা পাওয়ার যোগ্য লোকদেরকে তা প্রদান করা হয় না, এভাবে কয়েকটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে কি যাকাত রহিত হয়ে যাবে?
জবাব” আসলে যাকাত একটা অধিকার, আল্লাহ্ তা’আলা তা ফকীর মিসকীন ও অন্যান্য পাওয়ার যোগ্য লোকর জন্যে এ অধিকার নির্দিষ্ট ও ফরয করেন দিয়েছেন। এ হিসেবে যাকাত কোন অবস্থায়ই রহিত না হওয়া স্বাভাবিক। কেননা তা ফরয ধার্য হয়েছে, তা প্রদান করা বাধ্যতামূলক হয়েছে, তা প্রদানে এক বছন বিলম্ব হোক, কি তার অধিক কাল। কিছু কালের অতিক্রমণে প্রমাণিত হক্ বা অধিকার কখনই রহিত হতে পারে না।
ইমাম নববী এ পর্যায়ে বলেছেন, যাকাতদাতার যদি অনেক কয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং এর মধ্যে যাকাত প্রদান না করে, তাহলেও এ সব কয়টি বছরের যাকাত প্রদান করা তার জন্যে বাধ্যতামূলক- সে যাকাত ফরয হওয়ার কথা জানুক আর নাই জানুক। অনুরূপভাবে সে দারুল ইসলামে বসবাসকারী হোক, কি দারুল হরবে। এটা আমাদের মাযহাব।
ইবনুল মুন্যির বলেছেন, বিদ্রোহীরা যদি কোন দেশ-শহর-স্থঅন দখল করে নেয় এবয় সেখানকার ধনী লোকেরা যদি ক্রমাগত কয়েক বছরের যাকাত প্রদানে অক্ষম হয়ে থাকে আর তারপর মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান তথায় বিজয়ী হয়ে পুনর্দখলে সক্ষম হয়, তা হলে এ অতীত বছরগুলোর যাকাত তখন নিয়ে নিতে হবে। ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আবূ সত্তর এ মত প্রকাশ করেছেন। কিয়াসের পক্ষপাতী ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, অতীত বছরগুলোর যাকাত তাদের দিতে হবে না। তাঁরা এ-ও বলেছেন, দারুল হরবে কিছু লোক যদি ইসলাম কবুল করে এবয় তথায় কয়েক বছর অবস্থান করে, পরে দারুল ইসলামে চলে আসে, তাহলে এই অতীত বছরগুলোর কোন যাকাত তাদের দিতে হবে না। [আরবী************]
আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাজম বলেন, [আরবী**********], যে লোকের ধন-মালে দুই বা ততোধিক বছরের যাকাত অদেয় অবস্থায় জমা হয়ে থাকল অথচ সে জীবিত আছে, তা সবই প্রত্যেকটি বছরের জন্যে সেই সংখ্যানুপাতে প্রদান করতে হবে যা প্রত্যেক বছর তার ওপর ফরয হয়েছে। তা তার ধান-মালসহ পালিয়ে যাওয়ার দরুন হয়ে থাক অথবা সরকার নিয়োজিত যাকাত আদায়কারীর বিলম্বে পৌঁছার কারণ হোক কিংবা তার অজ্ঞতা বা অন্য যে কোন কারণেই হোক এবং তা সে মূল নগদ সম্পদে, কৃষি ফসলে গবাদি পশুর ক্ষেত্রে হোক অথবা যাকাত তার সমস্ত মালের ওপর ধার্য হোক কিংবা না-ই হোক তার মাল থেকে যাকাত নিয়ে নেয়ার পর সে মালের দিকে ফিরে আসুক যার পওর যাকাত ধার্য হয়নি, কি ফিরে না আসুক- এই অবস্থাসমূহের মধ্যে কোন পার্থাক্য হবে না। ঋণদাতারা কিছুই নিতে পারবে না যতক্ষণ না যাকাত পুরোমাত্রায় আদায় হয়ে যায়। [এ মতটি সহীহ্ কথার ওপর ভিত্তিশীল। যাকাত তো সম্পদের মালিকের দায়িত্বভুক্ত হয়ে যায়, মূল মালের মধ্যে শামিল থাকে না। যখন কারো দায়ীত্ব তা ফরয হয়ে গেল, তারপর তার মালের ওপর দিয়ে যদি দুটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়- তার যাকাত দেয়া না হয়, তাহলে এ অতীত বছরগুলোর যাকাত প্রদান করা তার কর্তব্য হবে। দ্বিতীয়ং বছর গিয়ে তার যাকাতের পরিমাণ একবিন্দু কমে যাবে না। অনুরূপ যদি নিসাবের পরিমাণের অপেক্ষা বেশী হয়ে যায়, তাতেও যাকাত হ্রাস পাবে না, যদিও তার ওপর কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অতএব তার কাছে চল্লিশটি ছাগল থাকলে- তার ওপর কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়; কিন্তু যাকাত আদায় না করে, তা হলে তার ওপর তিনটি ছাগী ফরয হবে। যদ একশ’টি দীনার থাকে, তাকে সাড়ে সাত দীনার দিতে হবে। কেননা যাকাত তার দায়ীত্বে ফরয হয়ে গেছে, তাই নিসাব হ্রাস পেলে তার কোন প্রভাব হবে না। কিন্তু তার যদি অন্য মাল না থাকে, তা হলে তা থেকেই যাকাত দেবে, সে পরিমাণ যাকাত হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেননা ঋণ তো যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক। দেখুনঃ (আরবী*************)]
সরকার ধার্যকৃত কর যদিও আগে- পিছে হওয়ার ও বহু বছর অতিবাহিত হওয়ার দরুন আইনের নির্ধারণ অনুযায়ী কমবেশী রহিত হয়ে যায়, কিন্তু যাকাত একটা ঋণরূপেই মুসলিম ব্যক্তির গলায় ঝুলে থাকবে, তার দায়িত্বমুক্তি হবে না, তার ইসলাম যথার্থ হবে না, তার ঈমানকে সত্য ও সঠিক মনে করা যাবে না- তা আদায় না করা পর্যন্ত, মাঝখানেস যতটি বছরই অনাদায় অবস্থায় অতিবাহিত হোক না কেন।
মৃত্যুতে কি যাকাত রহিত হয়
জমহুর ফিকাহ্বিদগণ এ মত দিয়েছেন যে, ধনের মালিকের মৃত্যুতে যাকাত রহিত হয়ে যায় না, বরং তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে সে যাকাত আদায় করে দিতে হবে- যদি তার অসীয়ত সে নাও করে যায়। এটা আতা, হাসান, জুহরী, কাতাদাহ ও ইমাম মালিকের মত। [ মালিকী মাযহাবের গ্রন্থাবলীতে লিখিত হয়েছে” যাকাত কখনও বের করা হয় মূলধন থেকে, কখনও এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে অর্থাৎ কৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে। সে যদি অসীয়ত করে যায়, তাহলে এক- তৃতীয়াংশ থেকে দেয়া হবে। আর যদি যাকাতের বছর পূর্তির অঙ্গিকার করে এবং তা দেয়ার অসীয়ত করে যায়, মূলধন থেকে দিতে হবে। (আরবী**********) গ্রন্থে মালিকের মৃত্যুর বছর- সে যদি তা দিয়ে যেতে না পারে, তাহলে তার মূলধন থেকে দেযা হবে, কেননা তা সুনির্দিষ্ট। দেখুন (আরবী*************)] শাফেয়ী, [ নববী বলেছেন, যাকাত ফরয হয়ে যাওয়ার পর তা আদায় করতে সক্ষম হয়েও যদি তা না দিয়েই মরে যায়, তাহলে তার মৃত্যুর দারুন- আমাদের মতে- যাকাত রহিত হয়ে যাবে না। বরং তার মাল থেকে তা আদায় করে দেয়া কর্তব্য হবে। এটা আমাদের মত। দেখুনঃ (আরবীঁ***********)] ইসহাক, আবূ আহ্মাদ, সত্তর ও ইবনুল মুনযিরও [আরবী**************] এ মত দিয়েছেন। জায়দীয়া মাযহাবও তাই বলে। [আরবী*************] আওযায়ী ও লাইস বলেছেন, অন্যান্য অসীয়ত পূরণের আগেই এক- তৃতীয়াংশ সম্পদ- সম্পত্তি থেকে তা নেয়া হবে। কিন্তু সে যাকাত আদায় করতে গিয়ে এক- তৃতীয়াংশ পরিমাণ ছাড়িয়ে যাওয়া চলবে না।
ইবনে সীরীন, শবী, নখয়ী, হাম্মাদ ইবনে সুলায়মান, সওরী প্রমুখ বলেছেন, মৃত্যুর পূর্বে অসীয়ত করে না গেলে তা আদায় করা যাবে না, অসীয়ত করে গিয়ে থাকলে দেয়া যাবে। আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গিগণ এ মত দিয়েছেন, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে তার মৃত্যুতে যাকাত রহিত হয়ে যাবে, তবে অসীয়ত করে গিয়ে থাকলে তা দিতে হবে এবং তা দেয়া হবে তার পরিত্যক্ত সম্পওির এক-তৃতীয়াংশ থেকে। যাদের জন্যে অসীয়ত করে গেছে, তারা তো তার ওপর ভিড় জমাবে। আর যদি অসীয়ত করে না যায়, তাহলে তা রহিত হয়ে যাবে। উওরাধিকারীরা তা দিতে বাধ্য হবে না। যদি দেয় তবে তা হবে নফল দান। কেননা যাকাত ইবাদত হলেও তা আদায় করায় নিয়তের শর্ত রয়েছে। তাই যে মরে গেছে তার ওপর ধার্য যাকাত রহিত হয়ে যাবে- নামায ও রোযার মত। [ইমাম আবী হানীফার এ কথা স্বর্ণ ও রৌপ্য সম্পর্কে। কিন্তু কৃষি ফসল ও গবাদি পশুর পর্যায়ে তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া গেছে- মৃত্যুর পর তা রহিত হয়ে যায় কিংবা তা নিয়ে নেয়া হবে এ বিষয়ে। দেখুনঃ (আরবী**************)]
তার অর্থঃ হানাফীরা বলেন, যাকাত না দিয়ে মরলে সে গুনাহগার হয়ে মরল। তার মৃত্যুর পর তার ওপর থেকে তা রহিকরণের আর কোন উপায়ই নেই- যেমন নামায- রোযা তরককারী। এজন্যে কোন কোন হানাফী আলিম বলেছেন, ‘যাকাত বিলম্বিত করলে এ সময় সে যদি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে উওরাধিকারীদের থেকে লুকিয়ে তা আদায় করে দিতে হবে। [ এ কথা (আরবী************) গ্রন্থে (আরবী**************) থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।]
প্রথমোক্ত কথা বা মতই সবদিক দিয়ে সহীহ্। কেননা- ইবনে কুদামাহ, যেমন বলেছেন- যাকাত হচ্ছে হক,- অধিকার, অবশ্য পালনীয়। সে বিষয়ে অসীয়ত সহীহ্ হয়। কাজেই মৃত্যুর দারুন তা রহিত হতে পারে না- যার ওপর তা ফরয, তার ওপর থেকে। যেমন অন্য কারো ঋণ পাওনা। তা একটা আর্থিক অবশ্য দেয় অধিকার বিশেষ। অতএব যার ওপর তা ফরয, তার মৃত্যুতে তা রহিত হবে না। এটা ঋণের মতই নামায রোযা থেকে তা ভিন্ন রকমের। কেননা এ দুটি দৈহিক ইবাদত। এ দুটির ব্যাপারে কোন অসীয়ত চলে না। প্রতিনিধিত্বও করা যায় না। [আরবী************]
তবে একটি সহীহ্ হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যে মরে গেল তার ওপর রোযা পালনের দায়িত্ব রয়েছে এরূপ অবস্থায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবক রোযা পালন করবে।’ অথচ রোযা একটা ব্যক্তিগত দৈহিক ইবাদত বিশেষ। এক্ষেত্রে হাদীস অনুযায়ী মৃত্যুর পর প্রতিনিধিত্ব চলে বলে দেখা যায়। বুঝতে হবে, এটা মহান আল্লাহ্র একটা অনুগ্রহ ও দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। রোযার যদি এটা সম্ভব তাহলে যাকাতের ক্ষেত্রে তো অধিক উত্তমভাবে সম্ভব হওয়া উচিত। কেননা তা একটা আর্থিক অধিকারের ব্যাপার যেমন পূর্বে বলেছি।
যাকাতের ঋণ অপরাপর ঋণের তুলনায়
শাফেয়ী মাযহাবের গ্রন্থ (আরবী*************)- এর লেখক [আরবী**************] বলেছেনঃ ‘যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে এবং সে তা আদায় করতে সক্ষম হয়েও তা প্রদান না করেই মরে গেল, তার এ যাকাত তার পরিত্যক্ত সম্পওি থেকে প্রদান করা ওয়াজিব। কেননা তা একটা আর্থিক অধিকার যা তার জীবদ্দশায়ই তার ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চেপে বসেছে। তার মৃত্যুর দরুন তা রহিত হয়ে যেতে পারে না- অন্য লোকের প্রাপ্য ঋণের মতই। যদি অদেয় যাকাত ও অন্য লোকের প্রাপ্য ঋণ একত্রিত হয়; কিন্তু পরিত্যক্ত সম্পদ- সম্পত্তি যা আছে তা থেকে উভয়টি দিয়ে দেয়া সংকুলান না হয়, তাহলে তা কি করা যাবে এ পর্যায়ে তিনটি মত পাওয়া গেছেঃ
একটি প্রথমে লোকের ঋণ শোধ করতে হবে। কেননা তার ভিওি অত্যান্ত কঠোর ও তাগিদের ওপর সংস্থাপিত। আল্লাহ্র হক্ তার তুলনায় অনেক হালকা ও অগুরুত্ব সম্পন্ন।
দ্বিতীয়, যাকাত সবার আগে দিয়ে দিতে হবে। কেননা নবী করীম (স) হজ্জ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ ‘আল্লাহ্র ঋণ সর্বাধিক অধিকারী যে, তা আদায় করা হবে। [বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে হাদীসটি উদ্ধৃত ইবনে আব্বাসের এবং রোযা সম্পর্কে।]
এবং তৃতীয়, উভয়ের মধ্যে ত্যক্ত সম্পত্তি-সম্পদ ভাগ করা হবে। কেননা দিয়ে দেযার বাধ্যবাধকতার দিক দিয়ে উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ, অতএব উভয়ই আদায় হতে হবে সমান গুরুত্ব সহকারে।
যাকাতকে অপরাপর মানুষের প্রাপ্য ঋণের ওপর অগ্রধিকার দেয়ার মতটি জাহিরী মতের লোকদের। আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাজম এ মতটিকে অধিক সহায়তা করেছেন। কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে সহীহ্ দলিলসমূহ পেশ করে মতটিকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছেন। বলেছেন, ‘যদি সে লোক মরে যায় যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে এক বা দুই বছর ধরে তাহলে তা তার মূলধনে গণ্য হয়ে গেছে। তার সাথে মিলে-মিশে স্থিতি পেয়ে গেছে। সে তা নিজে স্বীকার করবে অথাব তার ওপর অকাট্য প্রশাণ আনা হবে। তার সন্তানরা তা উওরাধিকারসূত্রে পেয়ে যাবে অথবা ‘কালালা’ হবে। [‘কালালা’ বলা হয় সে ব্যক্তিকে যার ওয়ারিশ হয় তার পিতামাতা ও সন্তানাদি ছাড়া অন্য কেউ।] পাওনাদার, অসীয়ত যাদের জন্যে করা হয়েছে এবং উওরাধিকারী লোকেরা কেউ কোন অধিকারই পাবে না যতক্ষণ সম্পূর্ণ যাকাত পুরামাত্রায় আদায় করে নেয়া না হবে- তা সেই আসল জিনিস, গবাদি পশু ও কৃষি ফসল যে থেকেই নেয়া হোক না কেন, তাতে কোন পার্থক্য হবে না।
ইবনে হাজম হানাফী প্রমুখদের সমালোচনা করেছেন। যাঁরাই বলেছেন যে, মালের মালিকের মৃত্যুতে তার ওপর ফরয হওয়া যাকাত রহিত হয়ে যাবে। ইবনে হাজমের মতে তাঁরা খুব মারাত্মক ধরনের ভুল করেছেন। কেননা তাঁরা এক ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার ওপর ফরযরূপে ধার্য হওয়া আল্লাহ্র ঋণ সে ব্যক্তির মৃত্যুর দরুন তার ওপর থেকে রহিত বলে ঘোষণঅ করেছেন কোনরূপ দলিল-প্রমাণ ছাড়াই। বড় জোর তাঁরা শুধু এতুটুকুই বলেছেন যে, যদি তাই হত, তাহলে তার পরিত্যক্ত সম্পওির একবিন্দু পরিমাণেরও কেউ উওরাধিকারী না হোক, তাই হত প্রত্যেকটি মানুষের কাম্য।
বলেছেন, প্রশ্ন করেছেন, যে লোক অন্য লোকদের ধন-মাল খুব বেশী ধ্বংস করে এ উদ্দেশ্যে যে, তা তার ওপর ঋণ হয়ে চাপবে এবং তার মৃত্যুর পর উওরাধিকারীরা কেউ কিছু পাবে না, সে সম্পর্কে তোমরা কি বলবে? সে ঋণগুলো যদি ইয়াহুদী বা খৃষ্টানদের প্রাপ্য হয় তাদের জন্যে খরচ করা মদের কারণে, তাহলেও তাই হবে? তাহলে কে বলবে যে, এ সবই তার মূলধন থেকে দিতে হবে, তার উওরাধিকারীরা কিছু পেল আর না-ই পেল? তাহলে তহারা তাদের সঙ্গে করে দিল যা তিনি ফকীর- মিসকীন মুসলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন-ঋণগ্রস্ত, দাসত্বশৃংখলে বন্দী, আল্লাহ্র পথে ও নিঃস্ব পথিকের জন্যেও। তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে আল্লাহ্র কাছ থেকে ধার্য করা ফরযস্বরূপ অথচ তারা লোকদের পাওনাটা ফেরত দেয়া ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং উওলাধিকারীদেরকে হারাম খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছেন?
এ সবই খুব আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা ইচ্ছাপূর্বক নামায তরককারীর জন্যে নামায ফরয মনে করেছেন তার জন্যে নির্দিষ্ট সময় চলে যাওয়ার পর! কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক যাকাত প্রদান থেকে বিরত থাকা লোকদের ওপর থেকে তা প্রত্যাহার করলেন তার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে সে তা আদায় করেনি বলে!
আবূ মাহাম্মাদ বলেছেন, ‘আমাদের কথা যে সহীহ্ এবং বিরুদ্ধবাদীদের বক্তব্য যে বাতিল, তা মহান আল্লাহ্র উওরাধিকারী আইন সংক্রান্ত আয়াত স্পষ্ট করে দিচ্ছে। আয়াতে বলা হয়েছেঃ [আরবী**************]
অসীয়ত যা করা হয় তা কিংবা ঋণ আদায় করার পরই। [আরবী*************]
এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলঅ সর্বপ্রকারের ঋণকে এ পর্যায়ে সাধারণভাবে গণ্য করেছেন। যাকাতও আল্লাহ্র জন্যে নির্দিষ্ট একটা ঋণ। সেই সাথে তা মিসকীন, ফকীর, ঋণগ্রস্ত ও অন্যান্য সবার জন্যে- যাদের কথা যাকাতের আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে।
পরে ইবনে হাজম তাঁর সনদে সেই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন যা মুসলিম তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। সায়ীদ ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ ও আতা অযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)- এর কাছে এসে বললঃ ‘আমার মা মরে গেছে, তার ওপর এক মাসের রোযা অপালিত হয়ে আছে। আমি কি তা তার পক্ষ থেকে ‘কাজা’ স্বরূপ আদায় করব? নবী করীম (স) বললেন, তোমার ‘মা’র ওপর যদি ঋণ থাকত, তাহলে তুমি কি তা আদায় করতে? বলল, ‘হ্যা’। বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ্র ঋণ তো বেশী অধিকারী এ দিক দিয়ে যে, তা আদায় করা হবে।’
ইবনে আব্বাস থেকে অপর বর্ণনায়- ইবনে জুবাইর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘তাহলে তোমরা সকলে আল্লাহ্র পাওনা পূরণ কর, কেননা তা পূরণ হওয়ার বেশী অধিকারী।’
বলেছেন, আতা, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ- এঁরা উক্ত হাদীসটি হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। এ সকলকে পিছনে ফেলে রেখে ওঁরা নিজেদের মতের ভিত্তিতে বলেছেন যে, আল্লাহ্র পাওনাটা রহিত হয়ে যাবে। আর মানুষের পাওনাটা প্রত্যর্পিত হওয়ার বেশ অধিকারী হবে- মানুষের পাওনা পূরণ বেশী গুরুত্বপূর্ণ। [আরবী****************]
ঝগড়া- বিতর্কে ইবনে হাজম ব্যবহৃত রূঢ় তীব্র কটাক্ষ ভাষা ও ভঙ্গী থেকে [কোন কোন লোক মনে করেন, ইবনে হাজম অপরাপর মাযহাব ও তার অনুসারীদের বিরোধিতায় এত চরম মাত্রার কঠোরতা ও তীব্রতার পন্থা গ্রহণ করেন যে, তাঁর মহামূল্য ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে আমরা কোন উপকার পাই না। এ পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে ইবনে হাজম সম্পর্কিত এ কথটি আমরা স্বীকার করি না। বরং তিনি যে সব উচ্চমানের চিন্তা-বিবেচনাপূর্ণ কথা উপস্থাপন করেন, তা আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে চেষ্টা করতে হবে। তীব্রতা-রূঢ়তা যা আছে তা তাঁর ওপর থাক। প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর নিয়ত অনুযায়ীই ফল পাবেন। তার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ তো আল্লাহ্র কাজ। আরে এ তো জানা কথা যে, সব মানুষই তার কথাবার্তার দরুনও পাকড়াও হবে। নিষ্কৃতি পাবেন কেবল নবী করীম (স)।] দৃষ্টি ফিরিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে যেসব দলিল তিনি পেশ করেছেন, কেবল তাই যদি বিবেচনা করি, তাহলে তাকীদ সহকারে এ কথা আমাদের সম্মুখে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, যাকাত একটা মৌলিক ও সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য, আগে পরে হলেই বা কারোর মৃত্যুতে তা রহিত হয়ে যায় না, পরিত্যক্ত সম্পদ-সম্পওি থেকেও তা অবশ্যই নেয়া হবে এবং অন্য সর্বপ্রকারের পাওনার ওপর তা অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব পাবে। অন্যান্য ঋণের স্থান তার পরে হবে। এভাবেই ইসলাম আধুনিক অর্থনৈতিক বিধান রচনার ক্ষেত্রেও অগ্রবার্তী অবদান রাখতে পেরেছে। আধুনিক অর্থনীতি ও সরকারের আর্থিক অধিকার অপরাপর ঋণও অধিকারের ওপর স্থান দিয়েছে। সেগুলো সব পরে বিবেচিত হতে পারে। [আরবী***************]
যাকাত প্রদান পর্যায়ে বিভিন্ন-বিক্ষিপ্ত আলোচনা
যপাকাত রহিত করার উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন
যাকাত এড়িয়ে যাওয়ার বা তা প্রদান থেকে পালিয়ে বেড়ানো কি জায়েয? অন্য কথায়, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তার ওপর থেকে তা রহিতকরণের উদ্দেশ্যে কোন কৌশল অবলম্বন করা কি জায়েয?
ফিকাহ্বিদদের বিভিন্ন মত
ইবনে তাইমিয়া (আরবী*****************) গ্রন্থে লিখেছেনঃ আবূ হানীফা যাকাত রহিত করানোর উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন করা জায়েয মনে করেন। বলেছেনঃ তবে তাঁর সঙ্গীরা ভিন্ন মত পোষণ করেন- এরূপ করা মাক্রূপ, কি মাক্রূহ্ নয়? ইমাম মাহাম্মাদ মনে করেন, ইমাম আবূ ইউসুফ মাক্রূহ্ মনে করেন না।
বলেছেন, যাকাত প্রত্যাহার করানোর লক্ষ্যে কৌশল অবলম্বন করাকে ইমাম মালিক হারাম বলেছেন। এরূপ কৌশল সত্ত্বেও তা ফরযই থাকবে। ইমাম শাফেয়ী যাকাত রহিত করানোর উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন করা মাক্রূহ কলেছেন।
কিন্তু ইমাম আহ্মদ এ কৌশল অবলম্বন পর্যায়ে ইমাম মালিকের মতই কথা বলেছেন। অর্থাৎ যাকাত রহিত করানোর জন্যে কৌশল করাকে তিনিও ‘হারাম’ বলেছেন। কৌশল সত্ত্বেও তা ফরযই থাকবে। সূরা নূন [জান্নাতবাসীদের কিস্সার কথা মনে করা হয়েছে। ইবনে কুদামাহ্র বর্ণনায় তা এরটু পরই আসেছে।] ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ [আরবী***************] থেকেও তা-ই প্রমাণিত হয়।
ইমাম আবূ ইউসূফ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া যা লিখেছেন, তা আবূ ইউসুফের নিজ রচিত ‘কিতাবুল খারাজ’- এ স্পষ্ট ভাষায় বলা কথার বিপরীত। তিনি তাতে অকাট্য ভাষায় বলেছেনঃ ‘যে লোক আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, তার পক্ষে যাকাত দিতে অস্বীকার করা বা অপ্রস্তুত হওয়া এবং তা নিজের মালিক না থেকে সমষ্টির মালিকানয় বণ্টন করা জন্যে না দেয়া- যেন তার থেকে যাকাত রহিত হয়ে যায় এমন কারোর ওপরই যাকাত ফরয হবে না- হালাল হতে পারে না। কোন কারণ বা অবস্থার দারুন যাকাত রহিত করার কৌশলও কেউ করতে পারে না। [আরবী***************]
উপরিউক্ত কালাম স্পষ্ট এবং অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে যে, ইমাম আবূ ইউসূফ যাকাত রহিতকরণ এবং কোন কারণ বা অবস্থার দরুন তা প্রত্যাহার করানোকে সম্পূর্ণ হারাম মনে করেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া যা বলেছেন এবং আবূ ইউসুফ সম্পর্কে যে কথা খুব ছড়িয়ে পড়েছে, তা হচ্ছেঃ কৌশল বিচারে কার্যকর হবে, যদিও ঈমানকারীর দিক দিয়ে তা জায়েয নয়।
হানাফী ফিকাহ্র কিতাবসমূহে স্পষ্টভবে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছেঃ কোন কোন কৌশল মাকরূহ্ এবং কোন কোনটা মাক্রূহ্ নয়।
তাঁরা আরও বলেছেন, যাকাতকে সম্পদ মলিকের অভাবগ্রস্ত পিতামাতার দিকে ফেরাবার জন্যে কৌশল করা- এভাবে যে, তা এক ফকীরকে দিয়ে দেয়া হবে, সে ফকীর তা মূল মালিকের পিতামাতাকে দেবে- মাকরূহ্। তাঁদের বেশীর ভাগ কিতাবেই এ কথাটি আলোচিত হয়েছে।
আর তাঁরাই যখন বলেছেন, যাকাত মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা যাবে না, মৃতের কাফন খরিদ করায় ব্যয় করা যাবে না, তা দিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে না- ইত্যাদি বলেছেন, ওসব জিনিসের জন্যে তা দেয়ার কৌশল করা এভাবে যে, সহীহ্ভাবেই এক ফকীরকে যাকাত দেয়া হবে, পরে তাকেই এসব কাজ করতে আদেশ করা হবে, তাতে যাকাতের সওয়াব তো সে পাবেই, ফকীরও ওসব কাজের সওয়াব পাবে। যেমন এ ক্ষেত্রে তাঁরা বলেছেন, ফকীরের অধিকার আছে; সে চাইলে উক্ত আদেশ সে অমান্য করবে। কেননা তাকে মালিক বানানো সহীহ্ হওয়ার অনিবার্য দাবিই হচ্ছে এই। বাহ্যত এত কেন সংশয় নেই। কেননা সে তো তার মালের যাকাতের মালিক তাকে বানিয়ে দিয়েছে, তার পরে তার ওপর যে শর্ত চাপিয়েছে, তা অবশ্য ‘ফাসেদ’-অগ্রণযোগ্য। কিন্তু হেবা- দানও যাকাত ‘ফাসেদ’ শর্তের দারুন ‘ফাসেদ’ হয়ে যাবে না। [আরবী**************]
কিন্তু লক্ষণীয় যে, যাকাতকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার এসব কৌশলের মধ্যে কিছু মাকরূহ আর কিছু মাকরূহ নয়। তবে সম্পদের মালিকের ওপর থেকে যাকাত রহিতকরণ পর্যায়ে হানাফীদের গ্রন্থাবলীতে- যা আমি দেখতে পেয়েছি- স্পষ্টভাবে জয়েয বলার কোন কথা লিখিতভাবে পাইনি।
মলিকী মতের লোকেরা কৌশল হারাম বলেন ও তার প্রভাব বিলুপ্ত করেন
মালিকী মতের লোকদের দৃষ্টিতে ঈমানদারীর দিকে দিয়ে কৌশল করা জায়েয নয় এবং বিচারে তা কার্যকর হবার নয়।
এজন্যে তাঁরা বলেছেন, যার কাছে নিসাব পরিমাণ মাল-সম্পদ রয়েছে, তার ওপর যাকাত ফরয হয়,- যেমন গবাদি পশু- সে যদি তার সবটা বা কিছু অংশ বছরান্তে কিংবা তার অল্প পূর্বে- যেমন একমাস পূর্বে- সেই প্রজাতীয় অন্য গবাদি পশু দ্বারা বদল করে ফেলে, যেমন পাঁচটি উটকে চারটি দ্বারা বদল করল অথবা অন্য পজাতীয় পশু দ্বারা- যেমন উট বদল করে ছাগল বা এর উল্ট বদল করে নেল। এ ধরনের পশু নিসাব পরিমাণ হোক কি তার কম, কিংবা তা বদলানো নগদ টাকায় বা দ্রব্যাদিতে বা তার পশু যবেহ্ করে ফেলল বা এ ধরনের অন্য কোন পন্থঅ অবলম্বন করল এবং জানা গেল যে, সে তা করেছে যাকাত এড়াবার উদ্দেশ্যে বা যাকাত ফরযরূপে ধার্য হতে না দেয়ার উদ্দেশ্যে তা তার নিজের স্বীকারোক্তী থেকে জানা যাক বা অবস্থার লক্ষণ দেথে, এরূপ পরিবর্তন বা এ ধরনের অন্য কোনরূপ হস্তক্ষেপে বদলে দেয়া মালের ওপর যাকাত ফরয হওয়া রহিত হতে পারে না। বরং তার যাকাত অবশ্যই নেয়অ হবে- তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে আচরণ করতে হবে। বদলের পর যে জিনিস এসছে তার যাকাত বেশী হলেও তা নেয়া হবে না। কেননা বদলানো জিনিসের মালিকানার মেয়াদ এক বছর না হওয়ার কারণে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না।
এটা এজন্যে যে, মায্হাবে এটা সিদ্ধান্ত যে, ইবাদতে কৌশল যেমন কোন ফায়দা দেয়া না, তেমনি লেনদেন-মুয়ামিলাতেও নয়।
তাঁরা বলেছেন, বাতিল কৌশল হচ্ছেঃ মালিক তার মাল সম্পদ সম্পূর্ণ বা তার অংশ যেন পূর্তির কাছাকাছি সময়ে তার সন্তান বা তার ক্রীতদাসের নামে হেবা করে দিল, যেন পরবর্তী সময়ে বছর পূর্তি হওয়া সত্ত্বেও তার ওপর যাকাত ফরয দাঁড়াতে না পারে। পরে তা তার কাছ থেকে নিঙ্ড়িয়ে বা কেড়ে নিয়ে নেবে। তখন তার ধারণা মতে মালিকানার কেবল সূচনা কাল হবে। এরূপ কৌশল স্বামী করে থাকে স্ত্রীকে দিয়ে। পরে তাকে বলে, ‘আমি তোমাকে যা দিয়েছিলাম, তা আমাকে ফিরিয়ে দাও, এবং তা করা তারও কর্তব্য হবে তা প্রদান করা। [দেখুনঃ (আরবী****************)]
হাম্বলী মতের লোকেরা মালিকী মতের লোকদের মতই
ইবনে কুদামাহ্ তাঁর (আরবী**************) গ্রন্থে লিখেছেনঃ
‘আমরা বলে এসেছি, নিসাব পরিমাণ সম্পদ অন্য জাতীয় জিনিসের সাথে অদল-বদল করা বছর শেষ হওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ করে, তবে তাতে যাকাত রহিত হবে না। তা গবাদি পশু বদলানো হোক, কি নিসাবের অন্য কোন জিনিস। অনুরূপভাবে কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে কিছু অংশ নষ্ট করে নিসাব হয় না প্রমাণের উদ্দেশ্যে- যেন তার ওপর যাকাত ফরয না হয়, তাতেও যাকাত রহিত হবে না। বছর শেষ হলেই তার কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নেয়া হবে, যদি তা বদলানো ও বিনষ্ট করা ফরয হওয়ার কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত হয়। আর তা যদি বছরের শুরুতে করে, তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কেননা যাকাত এড়িয়ে যাওয়ার জিনিসই নয়।
এই যা বলা হল, মালিক, আওজায়ী, ইবনুল মাজেলূন, ইসহাক ও আবূ উবাইদ প্রমুখও তাই বলেছেন।
আবূ হানীফা ও শাফেয়ী বলেছেনঃ তার যাকাত রহিত হবে। কেননা তার সম্পদ বছর পূর্তির পূর্বেই নিসাব পরিমাণের চাইতেও কম হয়ে গেছে। তাই তার ওপর যাকাত ফরয থাকবে না। যদি তার নিজের প্রয়োজনে নষ্ট করা হয়, তা হলেও তা-ই।
ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন- আমাদের দালিল হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার কথাঃ (আরবী****************)
আমরা এ (মক্কার অধিবাসী) লোকদেরকে সেরূপ পরীক্ষায় ফেলেছি, যেমন একটি বাগানের মালিকগণকে পরীক্ষার সম্মুখীন করে দিয়েছিলাম, তারা যখন যখন কিরা-কসম করে বলল আমার খুব সকাল বেলা অবশ্য- অবশ্যই আমাদের বাগানের ফল পাড়ব। তারা এ কথার কোনরূপ ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা রাখছিল না। রাতের বেলা তারা নিদ্রামগ্ন হয়। এ সময় তোমার আল্লাহ্র কাছ থেকে একটি বিপদ সেই বাগানের ওপর আপতিত হল এবং তার অবস্থা যেন কর্তিত ফসলের মত হয়ে পেল। [আরবী************]
আল্লাহ্ এ লোকদের শাস্তি দিলেন এজন্যে যে, তারা যাকাত এড়াতে চেয়েছিল এবং এজন্যে যে, যে ফকীর-মিসকীনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, তা যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে ও তাদের অংশ রহিত হয়, তার জন্যে চিন্তা ও চেষ্টা করেছিল কিন্তু এতে যাকাতের দায়িত্ব রহিত হয় না। যেমন কেউ যদি মুমুর্ষাবস্থায় তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে তার মীরাসের অংশ রহিত হবে না। আর এজন্যে যে, সে একটা খারাপ উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছে, তার উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে দিয়ে তার শাস্তি প্রদান সুবিচারের ঐকান্তিক দাবি। যেমন কেউ যদি সে যার উওরাধিকার পাবে তা পাওয়াকে তরান্বিত করার উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করে, তাহলে শরীয়াত তাকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করে এই অপরাধের শাস্তি দেয়। [আরবী*************]
কিন্তু মালিক যদি তা নিজের প্রয়োজনে কিছু পরিমাণ মাল বিনষ্ট করে, তাহলে তার অবস্থা ভিন্নতর হবে। কেননা সে কোন খারাপ উদ্দেশ্যে তা করেনি। অতএব সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্যও হয়নি।
জায়দীয়া মতের লোকেরা কৌশল অবলম্বন হারাম মনে করেন
এ ব্যাপারে জায়দীয়া ফিকাহ্ অনেকটা বিস্তারিত কথা বলেছে। এ ফিকাহ্র অনুসারীরা বলেছেন, যাকাত রহিত করার উদ্দেশ্যে কৌশল করা জায়েয নেই। এ ব্যাপারে দুটি অবস্থা- একটি হচ্ছে, ফরয হওয়ার পূর্বে (আর সূক্ষ্মভাবে বললে, এক বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত পূরণ হওয়ার পূর্বে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার পর।
ফরয হওয়ার আগের কৌশল- যেমন কেউ নগদ সম্পদের নিসাব পরিমাণের মালিক হল। তার ওপর একটি পূর্ণ বছর অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই সে তদ্দারা এমন কোন জিনিস ক্রয় করল যার ওপর যাকাত ফরয হয় না- যেমন খাদ্য, উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত রহিত করার জন্যে কৌশল করা। এটা জায়েয নেই। তা করলে গুনাহ্গার হবে- যদিও যাকাত ফরয হবে না।
এদের ফিকাহ্বিদদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, এরূপ করা মুবাহ্। যাকাত ফরয ধার্য হওয়ার পর কৌশল করা- যেমন তা ফকীরকে দিয়ে দিল ও শর্ত করল তা থেকে ফিরিয়ে দেয়ার, এ শর্তের সাথে একটা চুক্তিও করল। যেমন-বলল- আমি আমার যাকাত থেকে জিনিসটি তোমাকে দিচ্ছি এই শর্তে যে, তুমি ওটি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। এরূপ করা জায়েয নয়। এরূপ করলে যাকাত রহিত হবে না। মাযহাবে এ নিয়ে কেন মতভেদ নেই।
যদি শর্ত আগে আসে- যেমন এক সাথে সংঘটিত হল- দেয়ার পূর্বে ফিরিয়ে দেয়ার, পর তা ফকীরকে দিল কেনরূপ শর্ত ছাড়াই- যা এক সাথে ঘটে গেছে, মাযহাবের বক্তব্য হচ্ছে, এরূপ করা জায়েয নয়। এতে যাকাত আদায় হবে না। অপর কিছু লোক বলেছেন, যাকাত হবে, তবে মাক্রূহ তাহ্রীমী সহকারে।
মাযহাবের এ মতের কারণ হচ্ছে, এর ফলে ফকীরদের অধিকার রহিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আল্লাহ তা’আলা তা তাদের জন্যেই নির্দিষ্ট করেছেন। এরূপ কর হলে আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেছেন, যা বিধান দিয়েছেন তা বাতিল করা হয়। আর যে কৌশলের পরিণতি হবে শরীয়াতের বিধানদাতার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী তা-ই হারাম। এ আচরণ তার সুফলও নিঃশেষ করে দেয়। [আরবী****************]
তাঁরা যেমন যাকাত রহিত করার লক্ষ্যে কৌশল করতে নিষেধ করেছেন, তেমনি তা গ্রহণ বা পাওয়ার লক্ষ্যে কৌশল করাকেও নিষেধ করেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ
যার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়, তার পক্ষে তা পাওয়ার জন্যে কৌশল করাও জয়েয নেই। তা পাওয়ার জন্যে কৌশলের দুটি রূপ হতে পারেঃ
একটি এই যে, ফকীর কৌশলস্বরূপ যাকাত নিল, যেন সে নিতে পারে তার জন্যে যার জন্যে তা জায়েয নেই- যেমন হাশেমী বংশের লোক বা ধনী, নিজের সন্তান, পিতা বা অন্য যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক নয়। এরূপ করা জায়েয় নয়, এতে যাকাত আদায়ও হবে না। তা ফিরিয়ে দেয়া ওয়াজিব হবে।
এ কথার একটা ব্যতিক্রম তাঁরা স্বীকার করেছেন। তা হচ্ছে কোন হাশেমী ফকীর ব্যক্তিকে দেবার জন্যে যদি গ্রহণ করে বা এ ধরনের কিছু। এরূপ জায়েয-যদি পারস্পরিক আনুকূল্যের কথা পূর্বহ্নে হয়েও থাকে।
দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে, বিশেষভাবে ধনাঢ্যতার কারণে যার জন্যে যাকাত মোটিই হালাল নয়, সে যদি তার মালিকানা সম্পদ পরের মালিকানায় দিয়ে দেয় নিজে দরিদ্র সাজার উদ্দেশ্যে, যেন তার জন্যে যাকাত গ্রহণ হালাল হয়। মায্হাবের বক্তব্য হল, এরূপ করাও জায়েয নয়। কেউ কেউ এ শর্ত দিয়েছেন যে, এরূপ যদি সে করে বেশী সম্পদ করার উদ্দেশ্যে, এ উদ্দেশ্যে নয় যে, সে আয় বৃদ্ধির সময় পর্যন্ত তার জন্যে যা যথেষ্ট হয় তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা জায়েয হবে। [আরবী**************]
সারকথা, কৌশলের লক্ষ্য যদি হয় আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধান, শরীয়াতের উদ্দেশ্যাবলীর সাথে আনুকূল্য করা, হারাম থেকে ফিরে থাকা, তা হলে তা জায়েয। আর তার লক্ষ্য যদি হয় শরীয়াতের উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করা, তা হলে তা জায়েয হবে না। আমরা যদি তা মোটামুটি জায়েয বলিও তাহলে সব হারামই হালাল হয়ে যাবে। [(আরবী**************)এবং দেখুনঃ (আরবী*************)]
(আরবী*************) গ্রন্থের টীকায় শাওকানী থেকে উদ্ধুত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ ‘যে পরিণাম থেকে রক্ষা নেই, তা হচ্ছে প্রতিটি কৌশলই আল্লাহ্র ঘোষিত হারামকে হালাল করে দেবে কিংবা হালালকে করে দেবে হারাম। কৌশলকে সহীহ্করণ শরীয়াতের কাজ নয়-না আমাদানীতে, না দিয়ে দেয়ায়। [ঐ, ২৪০ পৃঃ।]
যাকাতদাতা ও গ্রহীতা কি বলবে
রাষ্ট্র সরকারসমূহের ধার্যকৃত সাধারণ কর প্রথা থেকে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা যে বহু দিক দিয়েই ভিন্নতর, যাকাতের যে একটি আধ্যত্মিক দিক রয়েছে, যা সাধারণ কর প্রথায় নেই এবং এ হিসেবে যাকাত যে অধিক উন্নত এক মানবিক ব্যবস্থা, এক্ষণে আমরা সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চাচ্ছি। আমাদের এ দৃষ্টি এ কারণেও যে, ইসলামী জীবন-ব্যবন্থায় যাকাত ইবাদতের গুণেও মহীয়ান হয়ে রয়েছে।
একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, যাকাত সংগ্রহ কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি তার হস্তে যখন যাকাত দ্রব্য অর্পণ করা হবে তখন সে দাতার জন্যে দো‘আ করতে আদিষ্ট হয়েছে। এ জন্যে তাকে উৎসাহ দান করবে। সেই সাথে তাকে এ কথাও জানিয়ে দেবে যে, যাকাতদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে পরিপূর্ণ সব ধর্ম ও মিল্লাতের লোক এবং জবরদস্তিমূলক করদাতা লোকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত করে তুলবে। এই দো‘আ করার কাজটি মহান আল্লাহ্র আদেশ পালন স্বরূপ হয়ে থাকে। কেননা তিনি বলেছেনঃ
(ধনী) লোকদের নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তাদের পবিত্র কর ও পরিশুদ্ধ কর তার দ্বারা এবং তাদের প্রতি উচ্চমানের রহমতের দো‘আ কর। নিশ্চয়ই তোমার দো‘আ তাদের জন্যে বড় সান্ত্বনা বিশেষ।
আয়াতের কথা (আরবী*************) অর্থ তুমি তাদের জন্যে উচ্চমানের রহমাতের দো’আ কর। যাকাতদাতাদের মনের ওপর এ দো‘আর ক্রিয়া ও প্রভাব কি হতে পারে তাও আল্লাহ্ তা‘আলা এই সঙ্গেই বলে দিয়েছেন। তা হচ্ছে পরম সান্ত্বনা, সুগভীর নিশ্চিন্ততা ও অস্বস্তি, নিরাপওা ও স্থিতি-দৃঢ়তা বোধ। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আবূ আওফা বর্ণনা করে বলেছেনম, লোকেরা যখন তাদের যাকাতের মাল নিয়ে আসত, নবী করীম (স) তাদের জন্যে দো‘আ করতেন। বলতেন ‘হে আল্লাহ্, তুমি এদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ রহমত নাযিল কর’। আবূ আওফাও তাঁর যাকাত নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন, তখন নবী করীম (স) বললেনঃ হে আমাদের মহান আল্লাহ্! তুমি আবূ আওফার লোকদের প্রতি পূর্ণ মাত্রার রহমত বর্ষণ কর। [(আরবী**************) গ্রন্থে বলা হয়েছে, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত , ‘নাইলুল আওতার’ ৪র্থ খন্ড, ১৫৩ পৃ।]
এই দো‘আর জন্যে কোন স্থায়ী বা সুনির্দিষ্ট ভাষা নেই। ইমাম শাফেয়ী বলেছেনঃ (যাকাতদাতা যখন যাকাত দেয় তখন গ্রহীতা এই কথা বলুক,) এটাই আমি পসন্দ করিঃ
আল্লাহ্ তোমাকে পূর্ণ শুভ ফল দান করুন যা তুমি দিলে সেজন্যে এবং তাকে তোমার জন্যে পবিত্রকারী বানিয়ে দিন, এবং তোমার কাছে যা অবশিষ্ট রয়েছে তাতে আল্লাহ্ তোমাকে বরকত ও প্রবৃদ্ধি দান করুন। [আরবী***************]
নাসায়ী বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ নবী করীম (স) একটি লোকের জন্যে দো‘আ করেছিলেন, যে লোক একটি সুন্দর উষ্ট্রী পাঠিয়েছিল। তিনি বলেছিলেনঃ হে আল্লাহ্ তুমি তার মধ্যেও এবং তার এই উষ্ট্রীতে বরকত দাও। [আরবী**************]
একটি প্রশ্ন, এরূপ দো‘আ করা কি ওয়াজিব, না মুস্তাহাব? উপরিউক্ত আয়াতে যা আদেশ রয়েছে, তাতে বাহ্যত মনে হয়, দো‘আ করা ওয়াজিব। জাহিরী ফিকাহ্ ও শাফেয়ী মায্হাবের কিছু লোকের এটাই মত। জমহুর ফিকাহ্বিদ্গণ বলেছেন দো‘আ করা ওয়াজিব হলে নবী করীম (স) তাঁর নিয়োজিত যাকাত কর্মচারীবৃন্দকে তা শিক্ষা দিতেন ও আদেশ করতেন- হযরত মুযায (রা)-কেও বলতেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, এরূপ কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। [(দেখুনঃ ) আরবী**************]
উপরিউক্ত কথাটি অ-গ্রহণযোগ্য। কেননা এজন্যে নবী করীম (স) উপরিউক্ত আয়াতটিকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। আর হযরত মুযায (রা)- এর মত লোকদের কাছে তা আদৌ গোপন থাকতে পারেনি।
তাঁরা আরও বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান ঋণ ও কাফ্ফারা ইত্যাদি বাবদ আর যত কিছুই গ্রহণ করে থাকেন, সেজন্যে তার দো‘আ করার দায়িত্ব নেই। যাকাতও সে-ই গ্রহণ করে। [আরবী*************] এর জন্যে আলাদা কোন দলিলের প্রয়োজন পড়ে না। কেননা কুরআনের উক্ত আয়াতে দো‘আ করার আদেশটি কেবল মাত্র যাকাত প্রসঙ্গেই, অন্য কেন কিছু প্রসঙ্গে নয়। তাও এজন্যে যে, দ্বীন-ইসলামে যাকাতরে স্থান ও মর্যাদা অনেক বড় ও উচ্চ। আর তা বাধ্যতামূলক ও আবর্তনশীল অধিকারের ব্যাপারও। অতএব তাতে উৎসাহ দান খুবই উওম, এই কাজে দাতাকে প্রতিষ্ঠিত রাখা খুবই প্রয়োজনীয়।
এই দো‘আ করাটা বিশেষভাবে নবী করীম (স) এর জন্যে বাধ্যতামূলক। কেননা তাঁর দো‘আয় লোকদের জন্যে নিশ্চিত সান্ত্বনার বিষয় নিহিত। অন্যদের ব্যাপার সেরূপ নয়। এটা স্থিতিদান সেই সংশয়ের জন্যেও; যার অধীন হযরত আবূ বকর (র)- এর খিলাফতকালে যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। কোন একজন সাহাবীও তার সমর্থন দেননি। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আয়াতটির প্রথম অংশ সাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ ও শেষাংশ কেবল রাসূল (স)-এর জন্যে নির্দিষ্ট মনে করা যেতে পারে কিভাবে? অতএব অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য কথা হচ্ছে, আদেশটি তার আসলরূপে অবশিষ্ট থাকবে, তা কার্যটিকে ওয়াজিব প্রমাণ করছে। আর বিশেষভাবে যাকাতের প্রকৃতির সাথে এর সাযুজ্য সুর্স্পষ্ট। সাধারণত যে সব ‘কর’ ধার্য করে থাকে, তা থেকে যাকাতের স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর দ্বারা।
দ্বিতীয় বিশিষ্টতা হচ্ছে, যাকাতদাতার হৃদয় যাকতের প্রতি খুবই সন্তুষ্টিসিক্ত থাক- এটাই কাম্য। আল্লহ্র তার দেয়া যাকাত কবুল করুন এই ভাবধারা ও মিনতিতে তার হৃদয় ভরপুর হয়ে থাকে। আল্লাহ্ যেন তা তার জন্যে ‘গনীমত’ বানান, জরিমানা নয়, এই দো‘আও সে সব সময় কাতর কণ্ঠে করতে থাকে। রাসূলে করীম (স) সে শিক্ষাই তো দিয়েছেন আমারেকে। তিনি বলেছেনঃ ‘তোমরা যখন যাকাত দেবে, তখন তার সওয়াবের কথাটা ভুলে থেকো না। তখন তোমরা বলবেঃ হে আল্লাহ্ এই যাকাতকে গনীমতের মাল বানাও, তাকে জরিমানার মাল বানিও না। [ হাদীসটি ইবনে মাজা কর্তৃক উদ্ধৃত, ১ম খন্ড, ১৭৯৭ সংখ্যা। আবদুর রাজ্জাক তাঁর জামে গ্রন্থেও এই হাদীসটি এনেছেন। সয়ূতূ তাঁর (আরবী*************) গ্রন্থে সেদিকে ইঙ্গিক করেছেন।– হাদীসটি আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত। তিনি হাদীসটির ‘যয়ীফ’ হওয়ার দিকেও ইশারা করেছেন। মুনাভী (আরবী*************) গ্রন্থে (১ম খন্ড, ২৯০ পৃঃ) বলেছেনঃ হাদীসটি খুব বেশী ‘যয়ীফ’ নয়। যেমন ধারণা করা হয়েছে। (আরবী************) এ বলা হয়েছে, সে পরিত্যক্ত। দেখুনঃ (আরবী*************)]
হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, যার ওপর যাকাত ফরয সে যখন ইমামের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেই পাওয়ার-যোগ্য-ফকীর কিংবা সরকার নিয়োজিত কর্মচারীকে দেবে তখন যেন এই দো‘আর কথা সে ভুলে না যায়- উপেক্ষা না করে। তাহলে তার জন্যে এর সওয়াব পূর্ণত্ব পাবে। এ দো‘আর তাৎপর্য হচ্ছে, হে আল্লাহ্! এই যাকাতের দরুন আমার মন ও মানসকে পবিত্র, একনিষ্ঠ ও নিষ্কলুষ বানাও, যেন আমি তা প্রদান করাকে গনীমত এবং আমার দ্বীনী ও বৈষয়িক জীবনে এবং পরকালে আমার জন্যে খুবই লাভজনক মনে করতে পারি। এটাকে যেন আমি জরিমানা মনে না করি, যা জোরপূর্বক নেয়া হয় ও অসন্তুষ্ট চিত্তে দেয়া হয়।
কিরমিযী হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে রাসূলের কথা রয়েছেঃ ‘আমার উম্মত যদি পনেরটি নৈতিক কাজ করে, তাহলে তার ওপর মুসিবত নেমে আসবে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছেঃ ‘আমানতকে যখন গনীমতরূপে গ্রহণ করা হবে’ আর যাকাতকে যখন জরিমানা মনে করা হবে। [ হাদীসটির সনদ যয়ীফ ‘নাইনুল আওতার’ গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে।] আর কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি তার আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করে এই বলে যে, তার যাকাতকে যেন জরিমানা বানানো না হয়, তাহলে তিনি তাঁর মন ও তাঁর উম্মতকে বিপদের কারণসমূহ থেকে দূরে রাখবেন ও রক্ষা করবেন।
এ কথা এ ভিওিতে বলা হচ্ছে যে, হাদীসের শদ্ব (আরবী**********) কর্তাবাচক হবে। শদ্বটি কর্তৃবাচকও হতে পারে। মুনাভী তাই বলেছেন। তখন সম্বোধনটা যাকাত যাওয়ার যোগ্য লোকদের প্রতি নিবদ্ধ ধরা হবে। অর্থ হবে যাকাত পাওয়ার যোগ্য হে লোকরা, তোমাদেরকে যখন যাকাত প্রদান করা হবে, তখন তোমরা যাকাতদাতার এই দয়া ও অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একথা বলতে ক্রটি করো নাঃ ‘হে আল্লাহ্ তুমি এই লোকের জন্যে এই যাকাতকে গনীমত বানিয়ে দাও, তার উপর তাকে জরিমানাস্বরূফ চাপিয়ে দিও না। [(আরবী*****************) গ্রন্থের ১ম খন্ড ২৯০ বলা হয়েছে, বোঝা যায়, এরূপ বলা মস্তাহাব। যদিও তারা তার উল্লেখ না করে। কেননা এ হল ফযীলতের কাজ। একটা মৌল নীতির অধীন। তা হচ্ছে, যাকাতদাতার জন্যে দো‘আ চাওয়া]
পাওয়ার যোগ্য লোকদের পক্ষ থেকে যে ‘উকীল’ বা প্রতিনিধি হবে- সে রাষ্ট্রপ্রধান হোন বা তাঁর প্রতিনিধি, এরূপ দো‘আ করা তাঁ জন্যেও কর্তব্য হবে। আল্লাহ্র কথাঃ (আরবী************) এর এটাই তাৎপর্য।
যাকাত প্রদানে উকীল নিয়োগ কোন মুসলিম নিজের যাকাত নিজেকেই প্রদান করতে হবে, এমন কথা নেই। বরং সে অপর একজন মুসলিম বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে এ কাজের জন্যে দায়িত্বশীল বানাতে পারে। সে তার পক্ষ থেকে তার যাকাত প্রদান করবে। (আরবী***************) বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তিকে যার আমানতদারীর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে যে, সে যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যেই তা যথাযথভাবে বিতরণ ও বণ্টন করে দেবে। অবিশ্বাস্য ও অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তির ওপর এ দয়িত্ব দয়ৈ বণ্টন পর্যায়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কোন কোন ফিকাহ্বিদ সেজন্যে শর্ত আরোপ করেছেন যে, সে ‘উকীল’ কে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। কেননা যাকাত একটা বিশেষ ইবাদত। অমুসলিম ব্যক্তির পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, শোভন নয়। অন্যরা বলেছেন, যাকাত প্রদানের জন্যে কোন ‘যিম্মী’ (ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম নাগরিক।– কে ‘উকীল’ বানানো জায়েয হতে পারে যদি যাকাতদাতা নিজে নিয়তের কাজটা করে। তার নিয়তই যথেষ্ট হবে। [দেখুনঃ (আরবী*****************)]
আমি মনে করি, কোন বিশেষ কারণ বা প্রয়োজন ছাড়া কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত প্রদানের জন্যে ‘উকীল’ বানানো কেবলমাত্র তখনই জায়েয হতে পারে, যদি এ নিশ্চিন্ততা ও নির্ভরতা থাকে যে, সে দাতার আগ্রহ-অনুরূপ বিশ্বস্ততা রক্ষা করে যাকাত প্রদান করতে সক্ষম হবে।
মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন, দাতার যাকাত প্রদানের জন্যে কাউকে প্রতিনিধি বানানো একটা মুস্তাহাব ব্যাপার। রিয়াকারী ও দেখানোপনা থেকে বাঁচার জন্যে এটা করা যেতে পারে। তার এ ভয়ের উদ্রেক হতে পারে যে, সে নিজেই যদি যাকাত বণ্টন করার দায়িত্ব পালন করতে যায়, তাহলে লেকাদের প্রশংসা ও স্তুতি পাওয়ার ইচ্ছা তার মনে জাগতে পারে। তাহলে রিয়াকারী হবে।
যদি নিজ সম্পর্কে কেউ এতটা সচেতন হয়, তাহলে তার যাকাত কোন প্রতিনিধির মধ্যমে বণ্টন করানো ওয়াজিব। কেবল ভয়েরই ব্যাপার নয়, কে যাকাত পাওয়ার যোগ্য তা যদি দাতার জানা না থাকে, তাহলে তার উচিত হবে এমন ব্যক্তিকে বণ্টনকারী বানানো, যে তা যথাস্থানে স্থাপন করতে ও তা পাওয়ার যোগ্য লোকদেরকে দিতে পারবে। [দেখুনঃ (আরবী**********)]
যাকাত প্রকাশ্যভাবে প্রদান
ইমাম নববী বলেছেন, যাকাত প্রদানে প্রকাশনীতি অবলম্বন উওম যেন অন্য লোকেরা তা দেখেতে ও জানতে পারে। তাহলে তারাও অনুরূপ কাজ করবে, তার প্রেরণা ও উৎসাহ পাবে। অন্যথায় লোকেরা খারাপ ধারণা করে বসবে। এটা ঠিক ফরয নামায আদায়ের মত। তা প্রকাশ্যভাবে পড়াই পসন্দনীয়। গোপন কার মুস্তাহাব শুধু নফল নামায-রোযা-দান ইত্যাদি। [(আরবী***********) এবং দেখুনঃ (আরবী*************) তাতে একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে (আরবী************) ‘যাকাত গোপনে দেয়ার পরিবর্তে জানিয়ে শুনিয়ে দেয়া অনেক ভাল।’]
তা এজন্যে যে, যাকাত হচ্ছে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। তা প্রকাশ করা, তার বিরাটত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং সে বিষয়ে চারদিকে জানাজানি করা খুবিই সঙ্গত ও কাম্য তাতে দ্বীনকে যেমন শক্তিশালী করা হয়, তেমনি মুসলিমদের ব্যক্তিত্বও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হয়। যাকাত দাতার মনে এ মহান লক্ষ্য প্রবল থাকা ও উক্ত উদ্দেশ্যে লাভ করা আগ্রহ জাগা আবশ্যক। লোকদের দেখানোর কোন মনোবৃওি থাকা উচিত নয়, তাতে নিয়তটাই খারাপ হয়ে যায়। কাজটা কলুষযুক্ত হয় এবং আল্লাহ্র কাছে শুভ ফল লাভের সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যায়।
ইসলামের মৌল গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীর প্রচার-প্রকাশ তার মহও প্রতিষ্ঠিত করা এবং লোকদের কাছে তাকে অতিশয় প্রিয় করে তোলার লোভ ও ইচ্ছা ঈমানের লক্ষণ তাকওয়ার চিহ্ন। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবী**************)
তা এজন্যে যে, যে লোক আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীকৈ বিরাট করে তুলবে-সম্মনিত করবে, তার এ কাজটা হৃদয়ের আল্লাহ্-ভীরুতার লক্ষণরূপে গণ্য। [আরবী***************]
সম্ববত আল্লাহ্ তা‘আলা যাকাত প্রদানে যে মনোভাবে ও আত্মচেতনাবোধ সৃষ্টি করা পসন্দ করেন, যে বিষয়ে নবী করীমের হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তা উক্ত আয়াতে বিবৃত হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছেঃ যে আত্মচেতনাবোধ মহান আল্লাহ্ তা‘আলা পসন্দ করেন, তা হচ্ছে ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে চেতনাবোধ যুদ্ধকালে ও যাকাত প্রদানের সময়ে।
আর এ পর্যায়ে আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার এ কথাটিঃ (আরবী*************)
তোমরা যদি যাকাত প্রকাশ্যভাবে দাও, তাহলে তা খুবই উওম। [আরবী**************]
ফকূরকে জানাতে হবে না যে, এ যাকাত
ইসলামী বা মুসলিম রাষ্ট্র সরকারই যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের সঠিক দায়িত্বশীল। কিন্তু তা যদি না থাকে আর ব্যক্তিরাই যদি যাকাত বণ্টনের দায়িত্ব পালন করতে থাকে তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে,- একালের প্রায় সব মুসলিম দেশেই এ অবস্থা বিরাজমান- তখন উওম নীতি হচ্ছে, যাকাতদাতা ফকীরকে বলবে না যে, এটা যাকাতের মাল। কেননা এরূপ কথা গ্রহীতার পক্ষে খুবই মনসিক কষ্টদায়ক হতে পারে। বিশেষ করে গ্রহণকারী লোক যদি আত্মগোপনকারী হয়, যারা যাকাত গ্রহণ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে সদা সচেতনভাবে সচেষ্ট। আর তা বলার প্রয়োজনও নেই। (আরবী***********) গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
একজনকে ফকীর মনে করে তাকে যাকাতের মাল দেয়া কালে তা যাকাতের মাল, তা বলে দেয়ার কোন প্রয়োজন করে না। হাসান বলেছেনঃ তুমি কি তাকে আঘাত দিতে চাও? ……. না, তাকে জানিও না।
আহমাদ ইবনুল হাসান বলেছেনঃ আমি আহমাদকে বললাম, এক ব্যক্তি যখন অপর ব্যক্তিকে যাকাত দেয়, তখন কি সে বলবে যে, এটা যাকাতের মাল?…………. না চুপ থাকবে?
বললেনঃ এ কথা বলে তাকে নিন্দিত করা কেন? তাকে দেবে ও চুপ থাকবে। তাকে আঘাত দিতেই হবে, এমন কি প্রয়োজন পড়েছে। [আরবী***************]
বরং মলিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেনঃ বলাটা মাকরূহ। কেননা তা বললে ফকীরের অন্তর চূর্ণ করা হয়। [আরবী************]
জা‘ফরী মতের লোকদের ‘মাসলাকে’ তা-ই যা এ ব্যাপারে আহলুস্ সুন্নাতের নীতি। তাঁরাও ফকীরকে যাকাত দেয়ার সময় বা তারপরে জানিয়ে দেয়া ওয়াজিব মনে করেন না। আবূ বসীর বলেছেনঃ আমি ইমাম বাকের (রা)-কে জিজ্ঞেস করলামঃ আমাদের লোকদের মধ্যে কেউ কেউ যাকাত গ্রহণে লজ্জাবোধ করে। আমি তাকে যাকাত দিই। কিন্তু বলি না যে, এটা যাকাত। এতে আপনার মত কি? বললেনঃ হ্যাঁ, তাকে দাও। কিন্তু বলো না। মুমিনকে লাঞ্ছিত করো না। [দেখুনঃ (আরবী**************)]
গরীব ব্যক্তির ঋণ রাহিত করাকে যাকাত গণ্য করা যাবে
ইমাম নববী বলেছেন, কোন অসচ্ছল ব্যক্তির যদি দেয় ঋণ থাকে, তখন যদি এ ইচ্ছা করা হয় যে, যাকাত বাবদ সে ঋণটা রহিত করা হবে এবং তাকে বলেঃ ঋণটাকে আমার দেয় যাকাত বাবদ কেটে দিলাম। এ ব্যাপারে শাফেয়ী মাযহাবে দুটি দিক রয়েছে। তার মধ্যে অধিক সহীহ্ দিক হচ্ছে, এতে যাকাত আদায় হবে না। আবূ হানীফা ও আহমাদের মাযহাবও তাই। কেননা যাকাত হচ্ছে ধনী ব্যক্তির দায়িত্বভুক্ত। তা অন্যকে ধরিয়ে দিয়ে দেয়া ছাড়া এ দায়িত্ব পালিত হতে পারে না। দ্বিতীয়, যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এটা হাসান বসরী ও আতা’র মাযহাব। কেননা সে যদি যাকাতের টাকা তাকে দেয় এবং ঋণ শোধ বাবদ তার কাছ থেকে তা নিয়ে নেয়, তাহলে তা জায়েয হবে। তাহলে তার হাতে না দিয়ে তাকেই যদি যাকাত ও পরে ঋণ বাবদ ফেরত ধরে নেয়া হয় তাহলে জায়েয হবে না কেন? যেমন কারো কাছে যদি কিছু টাকা আমানতরূপে গচ্ছিত থাকে এবং তা যাকাতরূপে কেটে দেয়, তাহলে তাতে যাকাত দেয়া হয়ে যাবে, তা সে নিজের হাতে নিল, কি না-ই নিল। কিন্তু যাকাত তাকে যদি এরূপ শর্ত করে দেয় যে, সে তা তার ঋণ আদায়স্বরূপ ফেরত দেবে তাহলে তাকে দেয়া সহীহ্ হবে না। আর তাতে যাকাতও আদায় হয়ে যাবে না। এটা এ মাযহাবে সর্বসম্মত। আর এভাবে ঋণ শোধ করাও সহীহ্ নয় সর্বসম্মত মতে। অবশ্য উভয়েই যদি অনুরূপ নিয়ত করে- কিন্তু শর্ত না করে, তাহলে সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে এবং যাকাতও আদায় হবে। আর যদি সে তার ঋণ শোধরূপে তা তাকে ফেরত দেয়, তা হলে সে ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। আর ঋণী ব্যক্তি যদি বলেঃ তোমার যাকাত আমাকে দাও, আমি তোমার ঋণ শোধ করে দেব এবং তাই যদি করেও, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। যার মুঠে তা আছে সেই তার মালিক হবে না। তা আর তাকে ঋণ শোধস্বরূপ দেয়ার প্রয়োজন হবে না। যদি দেয়, তাহলে তা কবুল হবে। [(আরবী*************)]
নববী হাসান থেকে এ পর্যায়ে যা উল্লেখ করেছেন, আবূ উবাইদ তা উদ্ধৃত করেছেন। তা হচ্ছেঃ তিনি তাতে কোন দোষ মনে করেন না। যদি তা ফরয হয়। বলেছেনঃ কিন্তু ‘তোমাদের এ বিক্রয় বা ক্রয়, তা জায়েয হবে না অর্থাৎ ঋণ যদি কোন প্রণ্যের মূল্য হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে জায়েয হবে না। যেমন ব্যবসায়ীর ঋণসমূহের অবস্থা হয়ে থাকে। হাসান তাতে যাকাত আদায় হয় বলে মনে করেন না। এটা উওম শর্ত।
তবে আবূ উবাইদ এ ব্যাপারে খুবই কড়াকড়ি করেছেন। তিনি কোন অবস্থায়ই তা জায়েয মনে করেন না। সুফিয়ান সওরী থেকেই এটা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি তাতে সুন্নাতের বিরোধিতা দেখতে পেয়েছেন। যেমন এ ভয় হয় যে, ঋনদাতা এভাবে ঋণ দিয়ে নিজের ধন-মাল বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারে যা পাওয়া থেকে সে নিরাশ হয়েছে। এভাবে সে যাকাতকে তার ধন-মালের সংরক্ষণের সাহায্য হিসেবে মনে করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্ তো কেবল তাই গ্রহণ করেন, যা কেবলমাত্র তাঁরই উদ্দেশ্যে খালেসভাবে দেয়া হবে। [আরবী***************]
ইবনে হাজম বলেছেন, যাকাতদাতা লোকদের কারো কারো কাছ থেকে যারা ঋণ নেয়, পরে সে তাকে সেই ঋণটাকেই যাকাতস্বরূপ রহিত করে দিলে, সে তা কবুল করে নেবে এবং নিয়ত করবে যে, এটা যাকাত বাবদ নিল। তা হলে তা আদায় হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে সেই ঋণটাকে যদি দান করে দিল এমন ব্যক্তিকে, যে যাকাত নেয়ার যোগ্য এবং তা হাওয়ালা করে দিল সেই ব্যক্তির যার যার কাছে তার ঋণ দেয়া আছে এবং তা করে যাকাত দিল বলে নিয়ত করল, তাতেও তার যাকাত আদায় হবে।
তার দলিল হচ্ছে, সে তো ফরয যাকাত দিতে আদিষ্ট। তা সে দিল এভাবে যে, যাকাত পাওয়ার লোকদের মধ্য থেকে যার ওপর তার ঋণ আছে সে সেটিকেই যাকাত ধরে দিল। সে ব্যক্তি যখন ঋণমুক্ত হয়ে গেল, তখন সেটিকেই যাকাত মনে করে নেবে। এতে তার যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
ইবেন হাজম এ কথার দলিলস্বরূপ সহীহ্ মুসলিমে উদ্ধৃত আবূ সায়ীদ বর্ণিত হাদীসের উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রাসূলে করীম (স)- এর যুগে এক ব্যক্তি ফল ক্রয় করে খুব বিপদে পড়ে গেল। তার ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেল। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ তোমরা সকলে এ লোকটিকে যাকাত দান কর। বলেছেন, আতা ইবনে আবূ রিবাহ্ প্রমূখও এ মত গ্রহণ করেছেন। [আরবী****************]
জাফরীয়া মাযহাবেরও এটাই মত। এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদেককে প্রশ্ন করল এই বলেঃ আমার ঋণ পাওনা রয়েছে লোকদের কাছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তা তাদের কাছে আটক রয়েছে। তারা সে ঋণ শোধ করতে সমর্থ হচ্ছে না। অবশ্য তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকও। তাহলে আমি কি তাদের কাছে পাওনাটা ছেড়ে দেব এবং মনে করে নেব যে, আমি তাদেরকে যাকাত দিলাম? বললেনঃ হ্যাঁ। [আরবী******************]
আমার মতে এ মতটিই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। যতক্ষণ ফকীর-মিসকীনরা যাকাত দ্বারা নিজেদের আসল মৌল প্রয়োজন পূরণ দ্বারা চূড়ান্তভাবে উপকৃত হতে থাকবে- তাদের মৌল প্রয়োজন এখানে তাদের ঋণ শোধ করা- তাহলে তা জায়েয হবে, কুরআন মজীদে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে পাওনা ঋণ ছেড়ে দেয়াকে ‘সাদকা’ বা যাকাত বলা হয়েছে। আল্লাহ্র কথাঃ (আরবী*************)
‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অভাবে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার সুবিধাজনক সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাক। আর যদি ‘সাদকা’ দিয়ে দাও, তাহলে তা তোমাদের জন্যে খুবই উওম-যদি তোমরা জান। [আরবী*************]
অসচ্ছল ঋণী ব্যক্তিকে এভাবেই যাকাত বা সাদ্কা দেয়া হয়। যদিও তাতে হাতেও ধরা হয় না, মালিকও বানিয়ে দেয়া হয় না। কিন্তু কাজ তো সম্পন্ন হয় নিয়তের গুণে, তর বাহ্যিক অনুষ্ঠানে নয়। এটা তখন জায়েয হবে, যদি ঋণগ্রস্ত ঋণ শোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তখন তাকে ঋণের শৃংখল থেকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তাকে তা জানিয়েও দেয়া চলবে। এরূপ অক্ষম ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ঠিক ফকীর-মিসকীনের মধ্যে গণ্য নাও হয়, তাহলেও তারা নিঃসন্দেহে ঋণগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য। আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিও যাকাত পাওয়ার যোগ্য। ঋণভার থেকে মুক্তি দানটা যাকাতের মাল দরিয়ে দেয়ার শামিল। এতে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মানসিক প্রয়োজন পূরণ হওয়ার ব্যবস্থা রয়ছে। আর তা হলো তাঁর কাঁধের ওপর থেকে ঋণের বোঝা অপসারিত করা। তাহলে সে রাতের দুশ্চিন্তা ও দিনের লাঞ্ছনা থেকেও বেঁচে যায়। তাগাদার ও কয়েদ হওয়ার ভয়ও দূল হয়। আর সর্বোপরি পরকালীন আযাব থেকে বাঁচার পথটিও খুলে যায়।
তবে হাসান যে ব্যবসায়ের ঋণ না হওয়া ও কর্য লওয়ার ঋণ হওয়ার শর্ত করেছেন, এ ব্যাপারটি অবশ্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। ঋণে বা বাকীতে বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়কে ছড়েয়ে দেয়া হয়। খুব বেশী মুনাফা লাভের লোভে পড়ে, তাতে এ ভয়টা তীব্র হয়ে রয়েছে। যখন সে ঋণের দাবিতে তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে, তখন যাকাত থেকে কেটে নেবে। এতে যথেষ্ট আপওির কারণ আছে।
কোন কোন ফিকাহ্বিদ এ পর্যায়ে একটি মাস্লা উপস্থাপন করেছেন। তা হচ্ছে কেউ যদি কোন ইয়াতীম বা মেহমান ফকীরকে খাবার খাওয়ায় যাকাত দেয়ার নিয়তে, তাকে যে খাবার দিল তা কি যাকাত গণ্যৗ হবে যদি তার নিয়ত করে? ….. এ হিসেবে যে, সে তা তাদের জন্যে মুবাহ মনে করে নিয়েছে?
হানাফী ও অন্যান্য আলিমগণ অকাট্যভাবে বলেছেন, এ খাবার দেয়া যাকাত আদায় বলে গণ্য হবে না। কেননা যাকাত প্রদানে ‘মালিক বানানো’ জরুরী; কিন্তু খাবার খাওয়ালে ‘মালিক বানানো’ হয় না। এ তো তাদের জন্যে অনুমরিত দানমাত্র।
কিন্তু তাঁরা বলেছেন, খাদ্যদ্রব্য কাউকে যাকাতের বিকল্প হিসেবে দিলে তাতে যাকাত আদায় হবে। যেমন কাউকে কাপড় পরিয়ে দেয়া হল, কেননা তা ফকীরকে যাকাত আদায়ের নিয়তে দিয়ে তাকে তার মালিক বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে যে খাবার খেলো সে তার মালিক হয়ে গেল আর যদি নিজের সাথে বাসিয়ে খাওয়ানো হয়, তাহলে তাতে যাকাত আদায় হবে না। [আরবী**********]
জায়দীয়া ফিকাহ্র কেউ কেউ ফকীর মেহমানদের সম্মুখে যা পেশ করা হবে তা যাকাতের মধ্যে গণ্য হতে পারে বলে মত দিয়েছেন পরপৃষ্ঠায় বর্ণিত শর্তের ভিওিতেঃ
(১) যাকাতের নিয়ত করতে হবে। (২) মূল খাদ্য অবশিষ্ট থাকতে হবে- যেমন খেজুর ও কিশমিশ। (৩) প্রত্যেককে এমন জিনিস দিতে হবে যার মূল্য আছে এবং এ কাজের ভুল করা যাবে না। (৪) ফকীর তা নিজের মুঠোর মধ্যে নেবে কিংবা তারও সেই জিনিসের মধ্যে পথ উন্মুক্ত করে দেবে- তার জানা শোনা সহকারে এবং (৫) ফকীর জানবে যে, এটা যাকাতের মাল। অন্যথায় যাকাত হল বলে বিশ্বাস করা যাবে না। জামীল এ কথার প্রতিবাদ করেন। [আরবী***************]
তৃতীয় অধ্যায়
যাকাতের লক্ষ্য এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে তার প্রভাব
• যাকাতের লক্ষ্য এবং ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব
• যাকাতের লক্ষ্য এবং সামষ্টিক জীবনে তার প্রভাব
ভুমিকা
‘কর’- এর যে কোন মানবিক বা সামষ্টিক কিংবা অর্থনৈতিক লক্ষ্য থাকতে পারে, অর্থনীতি ও কর পারদর্শী ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই চিন্তাকে সযন্তে এড়িয়ে চলেছেন। তাঁদের ভয় ছিল, এই ব্যাপারটি তাঁদের নিজেদের প্রথশ লক্ষ্য- অর্জিত সম্পদের প্রাচুর্যের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করে না বসে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ভান্ডারে উচ্ছুসিত হয়ে ওঠে কেবলমাত্র আদায়ের মাধ্যমে। এই চিন্তা-ভাবনার নাম দেয়া হয়েছে ‘কর’ সংক্রান্ত নিরপেক্ষতার মত’।
শেষ পর্যন্ত চিন্তার বিবর্তন, অবস্থার পরিবর্তন এবং বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠার পর তাঁরা উক্ত পুরাতন অন্ধ অনুসরণের চিন্তা-ভাবনা পরিহার করে সুনির্দিষ্ট সামষ্টিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ‘কর’-এর কল্যাণ গ্রহণের আহ্বান ও ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। সে উদ্দেশ্যস্বরূপ বলা হয় শ্রেণীসমূহের মধ্যকার পার্থক্য হ্রাসকরণ এবং সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনঃস্থাপনে……………. ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার একটা ভিন্নতর বিশেষত্ব রয়েছে। ইসলাম যাকাতকে তার অন্যতম রুকন স্তম্ভ বানিয়েছে। তার বহু বিশেষত্বমূলক নিদর্শনের অন্যতম হচ্ছে যাকাত। উপরন্তু ইসলামের উপস্থাপিত ইবাদতসমূহের মধ্যে একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে দাঁড় করেছে এ যাকাতকে। মুসলিম ব্যক্তি তা একটি পবিত্র দ্বীনী গুণসম্পন্ন ফরয হিসেবে দিয়ে থাকে- দিয়ে সে আল্লাহ্র স্পষ্ট অকাট্য আদেশ পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে। দেয় সে স্বীয় মনের পবিত্র প্রেরণার দরুন, সে ব্যাপারে তার নিয়ত থাকে খালেস, নিষ্কলুষ, যেন তা মহান আল্লাহ্র কাছে গৃহীত হয়। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী*************)
নিয়ত অনুযায়ীই আমলের মূল্যায়ন হয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পায় যার সে নিয়ত করে। [এ হাদীসের উৎসের কথা পূর্বে বলা হয়েছে।]
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছনঃ (আরবী****************)
লোকদের আদেশ করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করা, তাঁর জন্যে আনুগত্য একনিষ্ঠ করার মাধ্যমে সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এবং তারা নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। আর এ হচ্ছে সুদৃঢ় দ্বীন। [আরবী***************]
প্রথম পর্যায়ে যাকাত, মুসলিম ব্যক্তি তা পালন কর আল্লাহ্র কাছ থেকে মানুষের জন্যে জীবন বিধান অবর্তীর্ণ হয়েছে তার একটি হিসেবে। এ মানুষকেই তো আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে তাঁর খলীফা বানিয়েছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ কেবল তাঁরই ইবাদত করবে। পৃথিবীকে সত্য ও ইনসাফ দ্বারা পুনর্গঠিত ও সুবিন্যস্ত করে তুলবে, যেন তার সুফল সে পরকালে সংগ্রহ করতে পারে। মানুষ প্রস্তুতি নেয়, পরিচ্ছন্ন হতে সবের মধ্যে পড়ে সে পরীক্ষা দিয়ে তৈরী হয় যেন সে নিজেকে পরকালীন জান্নাতের চিরন্তন অধিবাসী হওয়ার যোগ্য করে তুলতে পারে। এভাবে তার মন ও মানসিকতা যখন পবিত্র হবে, তার অন্তর হবে পরিশুদ্ধ আল্লাহ্র কড়া আইনসমূহ পালনের মাধ্যমে ও তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার ফলে, তবেই সে পরকালীন জীবনের নিয়ামতসমূহ পেতে পারবে আল্লাহ্র জান্নাতে তাঁর নিজটবর্তী হওয়ার সুযোগ পাবে। সেই লোকদের মধ্যে গণ্য হতে পারবে, যাদের কথা বলা হয়েছে এ আয়াতেঃ (আরবী************)
ফেরেশতাগণ যাদেরকে মৃত করেন পবিত্র থাকা অবস্থায়, তারা বলবেঃ তোমাদের ওপর সালাম, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর তোমরা যা করেছ তার ফলস্বরূপ। [আরবী******************]
ঠিক এ কারণেই কুরআন মজীদে নামায ও যাকাতকে ২৮টি স্থানে পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদীসে এ দুটির উল্লেখ পাশাপাশি হয়েছে দশ-দশটি স্থানে। ইসলামে একথা সর্বজন পরিচিত যে, যাকাত হচ্ছে নামাযের বোন। এ দুটির মধ্যে কোন বিচ্ছেদ বা পার্থক্যকরণ স্বীকার করা যেতে পারে না। তা জায়েযও নয়। কেননা আল্লাহ্ই এ দুটিকে একত্র করেছেন। এ কারণে যে সব লোক নামায কায়েম করত, কিন্তু যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তাওেদর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে যে সব সাহাবী ইতস্ততঃ করছিলেন, হযরত আবূ বকর (রা) তাঁদের বলেছিলেনঃ
আল্লাহ্র কসম, যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যেই যুদ্ধ করব।
এ কারণেই ইসলামী ফিকাহর কিতাবসমূহে মাযহাবী মতপার্থক্য থাকা সও্বেও যাকাত সংক্রান্ত হুকুম-আহকাম ‘ইবাদত’ অধ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে নামায সংক্রন্ত হুকুম-আহকামের পরে পরে। [এটা অধিকাংশ ফিকাহর কিতাব সম্পর্কে সত্য। সংখ্যক কিতাবে অবশ্য নামাযের পর রোযা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। তার ভিওি হচ্ছে, এই দুটিই দৈহিক ইবাদত অর্থাৎ এ দুটি পালনে দৈহিক কষ্ট ও শারীরিক কৃচ্ছ্রতা সহ্য করতে হয়। কিন্তু যাকাত হচ্ছে শুধু আর্থিক ইবাদত আর হজ্জ আর্থিক ও দৈহিক উভয় দিকের ইবাদত এক সাথে।] তাতে কুরআন ও সুন্নাহকেই অনুসরণ করা হয়েছে।
যাকাতে ইবাদতের ভাবধারা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা সও্বেও তাতে একটা মহান মানিবিক কল্যাণের লক্ষ্য প্রকট হয়ে আছে। তা নৈতিকতার দিক দিয়ে অতি উন্নতমানের আদর্শও বটে। উচ্চতর আধ্যাত্মিক মূল্যমানও তাতে নিহিত রয়েছে। ইসলাম তা বাস্তবায়িত ও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যাকাতের ফরয আদায়ের মাধ্যমে। উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ সে বিষয়ে আমাদেরকে অবহিত করেছে। এ ছাড়া ইসলামের বহু মনীষীও এ দিকের বিস্তরিত ব্যাখ্যা দান করেছেন।
প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা যখন ইসলামী শরীয়াতকে বাস্তবে কার্যকর করেছিলেন-যেমন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল নির্দেশ দিয়েছেন, তখন এ সব মহান লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়ে ফুটে উঠেছিল, ব্যক্তি মুসলিমের জীবনে তার প্রভাব স্পষ্ট ও প্রকট হয়ে উঠেছিল। আর ইসলামী সমাজ সমষ্টি সে অপূর্ব ভাবধারায় পরিপূর্ণ হয়ে ভরে উঠেছিল। দুনিয়ার চক্ষুসমূহের সম্মুখে তা জ্বচলজ্বল করছিল।
এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেহায়েত বস্তুগত নয় আদৌ। নয় একান্তভাবে আধ্যত্মিক। এ বস্তুগত ওও আধ্যাত্মিক উভয় দিকই সমম্বিত ছিল তাতে। আধ্যত্মিক ও নৈতিক লক্ষ্যের অবদান সেখানে সর্বোতভাবে একাকার হয়ে দেখা দিয়েছিল অর্থনৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে।
এ লক্ষ্যসমূহ নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় যেমন, তেমনি নয় নিছক সামষ্টিক। তার অনেকগুলি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে প্রতিভাত হয়, সে যাকাতদাতা হোক কি গ্রহীতা। আবার তার অনেকগুলো ভাবধারা মুসলিম সমাজে প্রতিফলিত হয় তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে, তার কল্যাণময় দায়িত্বের সম্প্রসারণে এবং তার সমস্যাসমূহের সুষ্ঠু সমাধানে। পরবর্তী অধ্যায়টি দুটি মৌলিক পরিচ্ছেদে বিভক্ত। প্রথমঃ যাকাতের লক্ষ্য ও মসলিম ব্যক্তির জীবনে তার প্রভাব পর্যায়ের আলোচনা। আর দ্বিতীয়ঃ যাকাতের লক্ষ্য ও মুসলিম সমাজের ওপর তার প্রভাব সংক্রন্ত আলোচনা।
প্রথম পরিচ্ছেদ
ব্যক্তি জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও প্রভাব
এ পরিচ্ছেদে দুটি আলোচনা সংযোজিত হচ্ছেঃ
প্রথম, যাকাতের লক্ষ্য- দাতার প্রসঙ্গে। দাতা হচ্ছে সেই ধনী ব্যক্তি, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে।
আ দ্বিতীয়, যাকাতের লক্ষ্য- গ্রহণকারীরও তা থেকে উপকার প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রসঙ্গে। এ সেই অভাবগ্রস্ত লোক যাকে যাকাত দেয়া হয় এবং যাকাত ব্যয় করা হয় এমন লোকের জন্যে যার প্রতি মুসলমানরা ঠেকা- যেমন মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম, ঋণগ্রস্ত, পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার্থে, আল্লাহ্র পথের যোদ্ধা, যাকারেত জন্যে নিযুক্ত কর্মচারী। এসব লোক যাকাতের সামষ্টিক লক্ষ্য সংক্রান্ত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হবে।
প্রথম আলোচনা
যাকাতের লক্ষ্য ও দাতার জীবনে তার প্রভাব
যাকাত বিধান জারি করার মূলে ইসলামের লক্ষ্য শুধু মাল সম্পদ সংগ্রাহ করা নয়। রাষ্টীয় ভান্ডার বিপুল সম্পদ সম্ভারে ভরপুর হবে, তাই একমাত্র কাম্য নয়। দুর্বল, অক্ষম ও অভাবগ্রস্ত লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা ও তাদের দুঃখ-দারিদ্র্য দুরীভূত করাই কেবল উদ্দেশ্য নয়। বরং তার প্রথম লক্ষ্য, মানুষ বস্তুর ঊর্ধ্বে উঠবে; বস্তুর দাসানুদাস নয়, তার পরিচালক, নিয়ন্ত্রক ও কর্তা হয়ে বসবে। এখানে থেকেই দাতার ব্যাপারে যাকাতের লক্ষ্য, তার কাছ থেকে যাকাত গ্রহণের পূর্ণ মাত্রার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মানুষের সাধারণভাবে ধার্যকৃত কর থেকে যাকাত একটি ফরয কার্যরূপে বিশেষ বিশেষত্বের অধিকারী হয়েছে। কেননা ‘কর’ ধার্যকরণে দাতাকে রাষ্ট্রীয় ভান্ডারের একটি আয়ের মাধ্যম কিংবা ভান্ডারে ভর্তিকারী ছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয় না।
কুরআন মজীদ যাকাতের লক্ষ্যের ব্যাখ্যায় সেই ধনীদের প্রতি গুরুত্বের লক্ষ্য আরোপ করেছে, যাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করা হয়ং কয়েকটি অক্ষরের সমন্বয়ে গড়া দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দে তা বিবৃত হয়েছে। কিন্তু এ সংক্ষিপ্ত শব্দদ্বয় যাকাতের বিপুল গভীর তও্ব ও তার বিরাট মহান লক্ষ্যে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। সে শব্দদ্বয় হচ্ছেঃ (আরব*************) ‘পবিত্রকরণ’, এবং (আরবী************) ‘পরিশুদ্ধকরণ’ কুরআনের আয়াতে এ শব্দদ্বয় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়াতটি হচ্ছেঃ (আরবী**************)
তাদের ধন-মাল থেকে তুনি যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।
এই ‘পবিত্রকরণ’ ও ‘পরিশুদ্ধকরণ’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে পূর্ণমাত্রার পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা নিহিত। তা বস্তুগত হোক, কি তাৎপর্যগত, তা ধনীর আত্মা, মন-মানসিকতা ও তার যাকতীয় মাল ও সম্পদ পূর্ণঙ্গভাবে পরিব্যাপ্ত। পরবর্তী বাক্যসমূহের দ্বারা আমরা তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করব।
যাকাত লোভ নিবারক ও তা থেকে পবিত্রকারী
মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ্র আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যে যাকাত প্রদান করে, তা তার নিজের জন্যে পবিত্রকারী সাধারণভাবে সমস্ত গুনাহের মালিনতা-কলুষতা থেকে এবং বিশেষভাবে লোভ ও কার্পণ্যের হীনতা, নীচতা, সংকীর্ণতা থেকে।
বস্তুত লোভ ও কার্পণ্য খুবই ঘৃণ্য ও নিন্দিত, মানব মন তাতে খুব বেশী আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তার আনীত কঠিন বিগদে নিমজ্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের অন্তঃকরণ বাগানে মনস্তাও্বিক বা প্রকৃতিগত প্রতিরোধের বৃক্ষ রোপণ করার ইচ্ছা করলেন, যা মানুষকে পৃথিবীতে চেষ্টা-সাধনা ও সংগঠনের প্রচিষ্টায় নিয়োজিত করে। মানুষের মধ্যে রয়েছে আত্মপ্রেম এবং ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার লিন্সা ও স্পৃহা, দুনিয়ায় স্থিতি লাভের প্রেরণা। এ সব প্রকৃতিগত ভাবধারার লক্ষণ ও প্রকাশক হচ্ছে ব্যক্তির লোভ ও কার্পণ্য নিয়ে যা তা হাতে রয়েছে। অন্য মানুষের তুলনায় নিজেকে বেশী বেশী কল্যাণ ও মুনাফা-সুবিধার দৌলতে সমৃদ্ধ করে তোলার কামনা ও বাসনা। কুরআনে বলা হয়েছেঃ (আরবী*************)
মানুষ বড় সংকীর্ণমনা হয়ে পড়েছে। [আরবী*************] আরবী*************)
মনকে কার্পণ্য ও লোভ পরিব্যাপ্ত করে নিয়েছে। [আরবী****************]
অতএব ক্রমোন্নতিশীল বা মুমিন মানুষের জন্যে তার মনের জগতে, প্রভাব বিস্তারকারী স্বর্থপরতা ও আত্মম্ভরিতার প্রতিরোধঘকারী ভাবধারা প্রবল হয়ে ওঠা একান্তই অপরিহার্য ছিল। আবশ্যক ছিল ঈমানী শক্তির বলে লোভ-লালসার লেলিহান জিহ্বাকে দমন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার। আর প্রকৃতপক্ষেই এ মারাত্মক লোভ ও কার্পণ্যের ওপর বিজয়ী হয়ে ওঠা ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতে তার কল্যাণ লাভের আর কোনই উপায় ছিল না।
বস্তুত লোভ ও কার্পণ্য একটি কঠিনতর বিপদ-ব্যক্তির জন্যেও যেমন, সমষ্টির জন্যেও তেমন। যার ওপর তা সওয়ার হয়, তাকে রক্তপাতের দিকে তাড়িত করে, মান মর্যাদা নষ্ট হওয়ার কারণ ঘটায়। দ্বীন লংঘন করতে ও দেশ মাতৃকাকে শত্রুর হাতে বিক্রয় করে দিতেও প্ররোচিত করে। এ জন্যেই রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি এ লোভ ও কার্পণ্যেকে কয়েকটি মারাত্মক বিধ্বংসী ভাবধারার মধ্যে গণ্য করেছেন এবং বলেছেনঃ তিনটি ভাবধারা খুবই বিধ্বংসী-লোভ, যা অনুসৃত হয় লালসা-যা পূরণে নিয়োজিত হতে হয় এবং ব্যক্তির নিজেকে নিয়ে বড়ত্ব বোধ ও আত্ম-অংহকার। [হাদীসটি তাবারানী তাঁর (আরবী**************) গ্রন্থে ইবনে উমর থেকে যয়ীফ সনদসূত্রে উদ্ধৃত করেছেন, যেমন (আরবী****************) গ্রন্থে বলঅ হয়েছে।] আল্লাহ তা‘আলাও ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
যারাই তাদের মন মানসের লোভ ও কার্পণ্যকে রোধ করতে সক্ষম হবে, তারাই কল্যাণধন্য ও সাফল্যমন্ডিত হবে। [আরবী******************]
কুরআনে এই একই আয়াতে দুবার উদ্ধৃত হয়েছে। যারাই এ মারাত্মক রোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে, তারাই সফলকাম হবে, এটাই তিনি বোঝাতে ও সেদিকে উদ্ধুদ্ধ করতে চেয়েছেন। নবী করীম (স) ভাষণ দান প্রসঙ্গ বলেছেনঃ
তোমরা লোভ ও কার্পণ্য থেকে দূরে থাকবে। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা এ লোভ ও কার্পণ্যর দরুনই তো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
এ লোভই তাদেরকে কার্পণ্যে উদ্ধুদ্ধ করেছে। ফলে তারা কার্পণ্য করতে শুরু করেছে। তা তাদেরকে নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে আদিষ্ট করেছে। তারা তাই করেছে, যা তাদেরকে শরীয়াতের বিধান লংঘন করে পাপানুষ্ঠানে প্ররোচিত করেছে, ফলে তারা তা-ই করেছে। [হাদীসটি আবূ দাউদ ও নাসায়ী উদ্ধৃত করেছেন। দেখুনঃ (আরবী***************)]
এই বিচারে যাকাত বাস্তবিকই পবিত্রতাকারী অর্থঃ তা ব্যক্তিকে বিধ্বংসী- লোভ কার্পণ্য-কলূষতা থেকে পবিত্র করে দেয়। এ পবিত্রকরণ কার্যটি হবে যতটা তাকে প্রয়োগ ও কার্যকর করা হবে। এ কার্পণ্য যতটা দূল করা যাবে ততটাই তার হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। নিজেকে যত বেশী আল্লাহমুখী করতে পারবে, তার চিওও ততটা স্ফূরিত হবে।
যাকাত যেমন মন পবিত্রকরণের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করে, মনকে ঠিক সেই অনুপাতে মুক্ত ও স্বাধীনচেতা বানিয়ে দেয়, তার মুক্তি মালের বন্ধনের যিল্লাতী থেকে, মনের কাতরতা ও অধোগতি থেকে, টাকা-পয়সার দাসত্বের হীনতা-নীচতা থেকে। কেননা ইসলাম চায়, মুসলিম ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহ্র বান্দা হোক, অন্য সব কিছুর অধীনতা আনুগত্য থেকে মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে উঠুক। এ বিশ্বলোকে যা কিছু আছে-বস্তুগত উপাদান উপকরণ ও দ্রব্য সামগ্রী মানুষ সেই সবকিছুর কর্তা ও নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াক। আল্লাহ তো মানুষকে পৃথিবীর বুকে তাঁর খলীফা ও সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন। কিন্তু সে শুরু করে দিয়েছে নিজের নফসের দাসত্ব করতে, বস্তু ও সম্পদের উপাসনা করতে-এর চাইতে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে!
এর চাইতে বড় দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে, ধনসম্পদ সংগ্রহ করাকেই মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য ও সবচাইতে বেশী চিন্তার বিষয়রূপে নির্দিষ্ট করেছেন। তার জ্ঞানের চূড়ান্ত পরিধি বানিয়েছে, জীবনের লীলাকেন্দ্র বানিয়েছে, এ ধনসম্পদকে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে একটা বিরাট দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তার লক্ষ্য তো খুবই উঁচু অতীব মহান।
সন্দেহ নেই, নবুয়তের দ্বীপস্তম্ভ থেকে জ্যোতি এসেছে-ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। মুসলিমকে এই দুঃখজনক অবস্থা সম্পর্কে নানাভাবে হুশিয়ার ও সাবধান করে দিয়েছে। কেননা তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির দাসত্ব ও আনুগত্য। রাসূলের বাণীঃ
টাকা-পয়সার দাস হতভাগ্য, অর্থ সম্পদের দাস ভাগ্যহত। মখমল বস্ত্রের দাস ভাগ্যহীন………. এদের জন্য দুঃখ। তারা দুঃখ কুড়িয়েছে এবং বারবার সেই অবস্থায় ফিরে এসেছে। আর যখনই বাধাদান করা হয়েছে, তখনই স্ফীত হয়ে উঠেছে। [বুখারী, কিতাবুল জিহাদ ও রিকাক এ এবং ইবনে মাজা (আরবী***********)- এ উদ্ধৃত।]
যাকাত অর্থদান ও ব্যয়ে অভ্যস্ত করে
যাকাত যেমন মুসলিম ব্যক্তির মন-মানসকে লোভ থেকে পবিত্র করে, তেমনি অর্থদান, সাধারণ ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতেও সাহায্য করে।
নৈতিকতা ও প্রশিক্ষণ পারদর্শী বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতপার্থক্য নেই যে, মানুষের আদত অভ্যাসের একটা গভীর প্রভাব রয়েছে মানুষের চরিত্রে, আচারণ-আহরণে ও তার লক্ষ্য নির্ধারণে। এ কারণেই তো বলা হয়ঃ ‘অভ্যাস দ্বিতীয় প্রকৃতি’ তার অর্থ, অভ্যাসের একটা শক্তি ও আধিপত্য রয়েছে, যা মানুষের জন্মগত প্রথম প্রকৃতির অনুরূপ দৃঢ়তামূলক হয়ে থাকে।
যে মুসলমান অর্থ ব্যয় এবং ফসল কাটার সাথে সাথেই তার যাকাত ‘ওশর’ ও তার অন্যান্য আয়ের যখনই তা পাওয়া যায় যাকাত বের করে দিতে অভ্যস্ত হয়, তার গবাদি পশুর ও ব্যবসায় পণ্যের যাকাত বছর পূর্ণ হতেই দিয়ে দেয়, ঈদুল ফিতর নামযের পূর্বেই যে ফিতরা-যাকাত দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে, এ মুসলমান দান ও অর্থব্যয়ের একটা মৌলিক গুণের অধিকারী হতে পারে। তার এই চরিত্রের প্রকৃতির গভীরে শিকড় গেড়ে ও ছড়িয়ে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ কারণে এ চরিত্রটি কুরআনের দৃষ্টিতে মুওাকী মমিনের একটা অন্যতম গুণ হয়ে রয়েছে। মানুষ যখন মহান গ্রন্থ খুলে বসে ও সূরা আল-ফাতিহা পাঠের পর পরবর্তী পৃষ্ঠার দিকে তাকায় সূরা আল-বাকারা পাঠের উদ্দেশ্যে সেখানেই মুওাকীদের গুণাবলী পড়তে পারে। যারা মহান কিতাক পাঠে উপকৃত হতে পারে, তারা হচ্ছেঃ (আরবী**************)
এই কিতাব………। কোন সন্দেহ নেই এতে। তা মুওাকীদের জন্যে হেদায়েত,(মুওাকী) তারা, যারা গায়েবের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে এবং আমরা তাদের যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। [আরবী************]
এর পূর্বেও-আয়াতটি মদীনায় অবর্তীর্ণ-মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনে মুমিনদের এ অন্যমত মহান চরিত্র সম্পর্কে কথা বলতে ভুলে যাওয়া হয়নি। মক্কায় অবতীর্ণ সূরা (আরবী************) তে বলা হয়েছেঃ (আরবী**************)
তোমাদেরকে যে জিনিসই দেয়া হয়েছে তা নিছক দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী। আর যা আল্লাহ্র কাছে রয়েছে তা অতীব উওম ও স্থায়ী তাদের জন্যে, যারা ঈমান এনেছে। তারা যখন রাগাম্বিত হয়, ক্ষমা করে দেয়। আর যারা তাদের আল্লাহ্র আহ্বানে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে তাদের যাবতীয় ব্যাপার পারস্পরিক পরামর্শের ভিওিতে আঞ্জাম পায় এবং আমরা যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। [আরবী***************]
এ কথার তাৎপর্য নির্ধারণে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেছেন, তার অর্থ ফরয যাকাত দেয়। হযরত ইবনে আব্বাসের মতরূপে বর্ণিত। কেননা এখানে নামায কায়েম করার কথার সাথেই ‘ইনফাক’ অর্থ ব্যয় করার কথা বলা হয়ছে। অতএব তার অর্থ হবে যাকাত প্রদান। কারো মতে নফল দান-সাদকা। দহহাক এ মত দিয়েছেন বলে বর্ণিত। তাঁরা দৃষ্টি এদিকে নিবদ্ধ যে, যাকাতের কথা কুরআনের বিশেষভাবে সেই শদ্বেই বলা হয়েছে। অন্য কারো কারো মতে পরিবার-পরিজনের জন্যে অর্থ ব্যয় করার কথা হলা হয়েছে।
অন্যদের মত হচ্ছে, শদ্বটি সাধারণ অর্থবোধক, সর্ব প্রকারের অর্থ ব্যয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। [দেখুনঃ (আরবী*************] এ কথাটাই যথার্থ। এরই আলোকে গোটা আয়াত অধ্যয়ন ও অনুধাবন আবশ্যক। এখানকার কথা ফরয যাকাত কিংবা নফল সাদ্কা অথবা পরিবার-পরিজনের জন্যে ব্যয় থেকেও অধিক ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। আসলে মুমিনদের চরিত্রসমূহের এ একটা বিশেষ চরিত্র গুণঃ (আরবী**************)
যারা তাদের ধন-মাল ব্যয় করে রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে [আরবী***********]
(আরবী***********)
যারা ব্যয় করে স্বচ্ছন্দ অবস্থায় এবং অভাব-অনটনের সময়। [আরবী***********]
(আরবী*************)
আর ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, বিনয়ী, অনুগত, ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে মাগফিরাতে কামনাকারী……। []
মক্কী আয়াতসমূহে মুওাকীদের যে গুণাবলীর উল্লেখ হয়েছে, তাও এ কথাই বোঝায়ঃ (আরবী***************)
নিংসন্দেহে মুওাকীগণ জান্নাতে ও ঝর্ণাধারাসমূহে অবস্থান করবে, গ্রহণকারী হবে তাদের আল্লাহ তাদেরকে যা দিয়েছেন তার। পূর্বে তারা ইহসানের নীতির অনুসারী ছিল্ রাতে তারা খুব কমই নিদ্রা যেত। শেষ রাতে তারা মাগফিরাত চাইত এবং তাদের ধন-মালে হক রয়েছে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতের জন্যে। [আরবী***************] (আরব***************)
মানুষ খুবই সংকীর্ণমনা-ছোট আত্মার-সৃষ্ট হয়েছে। তার ওপর যখন বিপদ আসে, তখন ঘাবড়িয়ে ওঠে এবং যখন স্বচ্ছন্দ্য-সচ্ছলতা আসে তখন সে কার্পণ্য করতে শুরু করে। কিন্তু সেসব লোক (এই জন্মগত দুর্বলতা থেকে মুক্ত) যারা নামাযী, যারা নিজেদের নামায রীতিমত আদায় করে, যাদের ধন-মালে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতের একটা নির্দিষ্ট হক রয়েছে। [আরবী**************]
যারা অর্থ ব্যয় করতে অভ্যস্ত নিজেদের তহবিল থেকে অন্যদের জন্যে, ভাইদের প্রতি সহানুভূতিস্বরূপ নিজেদের মালিকানা থেকে ত্যাগ স্বীকার করে এবং নিজেদের জাতির সামষ্টিক কল্যাণের লক্ষ্যে তারা অন্য লোকের ধন-মাল ও মালিকানার ওপর হস্তক্ষেপ করা- চুরি বা অপহরণ থেকে অবশ্য অবশ্যই বিরত থাকবে। যারা নিজেদের ধন-মাল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে অন্যদের দান করে, তাদের পক্ষে যা তাদের নয় তা হস্তগত করা খুবেই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কেননা তাতে আল্লাহ্র গজবই তো টেনেস আনা হবে নিজেদের ওপর।
মক্কায় প্রাথমিক দিক দিয়ে অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সূরা ‘আল-লাইন’। তাতে আল্লাহ তা‘আলা কসম খেয়ে বলেছেনঃ (আরবী*************)
রাত্রির শপথ, যখন তা আচ্ছন্ন করে নেয় শপথ দিনের যখন তা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শপথ সেই সওার যিনি পুরুষ ও স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। আসলে তোমাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরন ও প্রকারের। পরন্তু যে লোক (আল্লাহ্র পথে) ধন-মাল দিল (আল্লাহ্র নাফরমানী থেকে) আত্মরক্ষা করল এবং কল্যাণ ও মঙ্গলকে সত্য মেনে নিল, তাকে আমি সহজ পথে চলার সহজতা দান করব। আর যে কার্পণ্য করল , তার জন্যে আমি শক্ত ও দুষ্কর পথের সহজতা বিধান করব। তার ধন-মাল কোন্ কাজে আসবে-যখন সে-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। পথ-প্রদর্শন নিঃসন্দেহে আমরাই দায়িত্ব। আর পরকাল ও ইহকালের সত্যিকার মালিক তো আমিই। অতএব আমি তোমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দিলাম জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সম্পর্কে। তাতে ভম্মীভূত কেউই হবে না, হবে কেবল সেই চরম হতভাগ্য ব্যক্তি যে অমান্য করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল। আর তা থেকে দূরে রাখা হবে সেই অতিশয় পরহেজগার ব্যক্তিকে, যে পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজের ধন-মাল দান করে। তার ওপর কারো অনুগ্রহ এমন নেই, যার বদলা তাকে দিতে হতে পারে, সে তো শুধু নিজের মহান শ্রেষ্ঠ আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে এ কাজ করে। তিনি অবশ্যই (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন।
এক ভাগের লোকদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন এবং তাদের জন্যে সহজতা বিধানেরও ওয়াদা করেছেন। কেননা সে দিয়েছে, আল্লাহকে ভয় করেছে, পরম সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। তাহলে ‘দান’ তাকওয়া ও মহান পরম সত্যকে সত্য বলে জানার ও মানার দিক দিয়ে একটা অতীব মৌলিক গুণ বিশেষ। কুরআন তার এ ‘দান’ করার গুণের উল্লেখ করেছে; কি দিয়েছে, কত দিয়েছে, কোন্ প্রকারের ও কোন্ প্রজাতীয় জিনিস দান করেছে তা বলেনি। সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করেনি। কেননা তার লক্ষ্য হচ্ছে এমন মহান আত্ম গড়ে তোলা যা হবে দানশীল, ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারকারী। নিষিদ্ধকারী ও পরশ্রীকাতর নয়। তাই বলতে হবে দানশীল আত্ম ও মনই হচ্ছে কল্যাণকর ও ইহসানের নীতির অনুসরণকারী, যার প্রকৃতিই হচ্ছে লোকদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা, ধন-মাল লোকদের দান করা। সে তার ভাল জিনিস দেয়-নিজেকে ও অন্য মানুষকেও। তা যেন একটা প্রস্রবণ, তা পান করে ও করিয়ে বিপুল সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হচ্ছে। পান করিয়েছে তাদের যানবাহন, চতুষ্পদ জন্তু ও তাদের কৃষি ক্ষেতকে। তারা তা থেকে উপকৃত হয় যেমন তারা ইচ্ছা করে। তা এই কাজের জন্যে খুবই সহজলভ্য। এ ধরনের মানুষ সব সময়ই বরকত লাভে ধন্য-যেখানেই প্রয়োজন কল্যাণ করতে ব্রতী হয়ে যায়। এর শুভ প্রতিফল হচ্ছে আল্লাহ তাকে ‘মহাসহজতার জন্যে (জান্নাতের জন্যে) সহজতা দান করবে, যেমন তার মন দান-এর জন্যে সহজপন্থী ছিল।
অপর ধরনের লোক এর প্রতিকূলে, আল্লাহ তাদের নিন্দা করেছেন, এবং কঠিনতর দিক সহজ করে দেন। কেননা তারা কার্পণ্য করেছে তারা বিমুখ হয়েছে এবং মহাসুন্দরকে অস্বঅকার করেছে। এ লোকেরা লোভী, পরশ্রীকাতর, নিজেদের ধন-মালের কার্পণ্যৗ করেছে। নিজেদেরকে আল্লাহ থেকেও বিমুখ লোকদের থেকেও মুখাপেক্ষীহীন বানিয়েছে। আল্লাহ সত্যিকার মুমিনদের জন্যে যে উওম পরিণতির ওয়াদা করেছেন তাকে অসত্য মনে করেছে। এ কারণে আল্লাহ তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনের ভয় দেখিয়েছেন। তাতে যাবে শুধু সেই হতভাগ্য ব্যক্তি যে সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয়নি এবং বিমুখ হয়ে গেছে। যেমন মহাসুন্দরকে যে লোক অসত্য মনে করে এবং দান ও তাকওয়া থেকে বিরত থাকে। আর তা থেকে দূরে রাখা হবে সেই অতিশয় পরহিজগার ব্যক্তিকে, যে পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজের ধন-মাল দান করে। তার ওপর কারো অনুগ্রহ নিয়ামত এমন নেই, যার বদলা তাকে দিতে হতে পারে। সে তো শুধু নিজের মহান শ্রেষ্ঠ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই এ কাজ করে। তিনি অবশ্যই (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন।
আল্লাহ্ন চরিত্রে ভূষিত হওয়া
মানুষ যদি কার্পণ্য ও লোভ থেকে পবিত্র হতে পারে, দান-ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতে পারে, তাহলেই সে মানবীয় লোভের পংকিলতা-‘মানুষ বড়ই সংকীর্ণমনা হয়েছে’ [আরবী***************] বলে যেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে- থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, আল্লাহ প্রদও উচ্চতর পূর্ণঙ্গ গুণাবলীতে পারে ভূষিত হতে। কেননা মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম গুণাবলীর অন্যতম হচ্ছে কল্যাণ, রহমত, অনুগ্রহ ও দয়া বর্ষণ-আল্লাহ্র নিজের লভ্য কোন স্বার্থ ছাড়াই। এ গুণাবলী অর্জনের উদ্দেশ্যে মানবীয় শক্তি সামর্থ্যের যতটা কুলায়-চেষ্টা চালিয়ে আল্লাহ্র চরিত্রে ভূষিত হওয়া একান্তই আবশ্যক। আর তা-ই হচ্ছে মানুষের উৎকর্ষের চরমতম মান।
ইমাম আর-রাযী বলেছেন, [আরবী***************] ‘মানুষ যে ‘নফসে-নাতেকা’র দারুন মানুষ হয়েছে তার দুটি শক্তিঃ মতবাদগত এবং বাস্তব কর্মগত। মতবাদগত শক্তির পূর্ণত্ব নিহিত রয়েছে আল্লাহ্র আদেশ-আইন বিধানের বড়ত্ব স্বীকার ও তার প্রতি মর্যাদা দানে। আর বাস্তব কর্মগত শক্তির পূর্ণত্ব নিহিত রয়েছে আল্লাহ্র সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য করাতে। এ কারণে আল্লাহ যাকাত ফরয করেছেন, যেন আত্মর মৌল শক্তি এই পূর্ণত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর তা হচ্ছে সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া অনুগ্রহশীল হওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া। তাদের কল্যাণ সাধনে সদা সচেষ্ট হওয়া, তাদের ওপর আপতিত বিপদ-আপদসমূহ বিদূরণকারী হওয়া। এই তও্বকে [হাদীস হিসেবে রাসূলের এ কথাটি বর্ণনা করা হয় কিন্তু আমি কোন ভিওি পেলাম না। কে এ বর্ণনা করেছেন তাও জানা যায়নি।] সম্মুখে রেখেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী************)
তোমরা সকলে আল্লাহ্র চরিত্রে ভূষিত হও। [এই অর্থের নিকটবর্তী একটা কথাও রয়েছে। কোন জিনিস না পেয়ে তার মুখাপেক্ষী না থাকা কোন জিনিস পেয়ে মুখাপেক্ষীহীন হওয়ার চেয়ে অনেক বড় গুণ। কেননা কোন জিনিস পেয়ে যে মুখাপেক্ষী হয় তাতে সেই জিনিসের মুখাপেক্ষিতা প্রমাণিত হয়, তবে তা পেয়ে অন্য জিনিস থেকে মুখাপেক্ষীহীনতা অর্জন করা ভিন্ন কথা। কিন্তু কোন জিনিস না পেয়ে তা থেকে যে মুখাপেক্ষীহীনতা তা হচ্ছে মহান স্রষ্টার গুণ। তাই মহান আল্লাহ যখন তাঁর কোন কোন বান্দাকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ দিলেন, তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণ রিযিক দিলেন-এটা হল কোন জিনিস পেয়ে তা থেকে মুখাপেক্ষীহীনতা হওয়া। তিনিই যখন তাকে যাকাত দেবার নির্দেশ দিলেন তখন তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কোন জিনিস পেয়ে যে মুখাপেক্ষীহীনতা সে স্তর থেকে সেই উন্নত স্তরে তাকে নিয়ে যাওয়া যা তার চেয়েও অনেক বেশী মূল্যবান ও মর্যাদাসম্পন্ন। আর তা হচ্ছে জিনিস পেয়ে তা থেকে মুখাপেক্ষীহীন হওয়া।]
এহেন চরিত্র এবং সেই আত্ম-যাকে ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে যাকাত প্রথার মাধ্যমে সৃষ্টি ও লালন করেছে-ত্যাগের চরিত্র ও কল্যাণের ভাবধারা-তা সেই সদা প্রবহমান ও সর্বক্ষণ কার্যকর দান-সদকাসমূহ যা মুসলিম মহান ব্যক্তিগণ তাঁদের পরবর্তীকালের লোকদের উপকারার্থে রেখে গেছেন। কল্যাণমূলক ওয়াকফ ব্যবস্থা তাপর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। কল্যাণমূলক কাজের ঐকান্তিক আগ্রহে মুসলমানগণ ওয়াকফ ব্যবস্থা কায়েম করে তুলনাহীন দৃষ্টান্ত। রেখে গেছেন। তাদের দিলে যে মানুষের প্রতি কল্যাণবোধ ও আন্তরিক দরদ ছিল তারও প্রমাণ রেখে গেছেন। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদরে এই ভাবধারার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। লোকেরা বহু প্রকারের প্রয়োজনে বস্তুগত বা তাৎপর্যগহত সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিল-বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন শ্রেণীর লোক তারা। বরং মানব-বংশ ছাড়া কোন কোন জীবের ক্ষেত্রেও তাই। [এই পর্যায়ের কিছু নমুনা দেখা যাবে এ গ্রন্থকার প্রণীত (আরবী******************) গ্রন্থের (আরবী*************) পরিচ্ছেদ।]
যাকাত আল্লাহ্র নিয়ামতের শোকর
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সুন্দরকে সুন্দর বলে স্বীকার করা এবং নিয়ামরেত শোকর-দাতার কৃতজ্ঞতা একান্তই অপরিহার্য। মানুষের বিবেক তার জন্যে তাড়া করে, প্রকৃতি এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, নৈতিকতা তার দাবি করে এবং সকল প্রকার ধর্ম ও আইন ব্যবস্থা সেজন্যে বিশেষভাবে উৎসাহ দান করে।
যাকাতদাতার মন-মানসিকতায় আল্লাহ্র শোকরের ভাবধারা জাগিয়ে দেয়। ইমাম গাযালী যেমন বলেছেন, আল্লাহ্র বান্দাগণের ওপর অফুরন্ত নিয়ামত-তার মনে, তার ধন-মালে। দৈহিক ইবাদাতসমূহগ দৈহিক নিয়ামতের শোকর, আর্থিক নিয়ামতের শোকর হয় আর্থিক ইবাদত পালন করে। যে দরিদ্র ব্যক্তির রিযিক সংকীর্ণ, নানাভাবে অভাবগ্রস্ত তার প্রতি যার দৃষ্টি পড়ে, তারপরও যার মনে আল্লাহ্র শোকরের ভাবধারা জাগে না এই ভেবে যে, আল্লাহ তাকে অন্য মানুষের কাছে ভিক্ষার হাত দরাজ করার হীনতা থেকে মুক্ত রেখেছেন এবং সে তার সম্পদের দশ ভাগের এক ভাগের এক-চতুর্থাংশ কিংবা দশ ভাগের এক ভাগ ফসল দিয়ে তার শোকর আদায় করে না, তার মত সংকীর্ণমনা ও হীন চরিত্রের লোক আর কে হতে পারে? [আরবী******************]
মুসলমানদের চিন্তা ও চেতনায় যে গভীর ভাবধারা জাগ্রত হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই ভাবধারা যে,যাকাত হচ্ছে আল্লাহ্র নিয়ামতের বিনিময়। প্রতিটি নিয়ামতের বিনিময়ে মানুষের যাকাত দেয়া একান্ত আবশ্যক-সে নিয়ামত বস্তুগত হোক, কি তাৎপর্যগত। এ কারণে মুসলিম সমাজে এ কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও প্রচলিতঃ ‘তুমি তোমরা সুস্থতার যাকাত দাও, তোমার দৃষ্টিশক্তির যাকাত দাও, চোখের জ্যোতির মহাসৌভাগ্যের যাকাত দাও’………….. এমনিভাবে একটি নির্মল ভাবধারা মুসলিমের মনে জেগে ওঠে। হাদীসেও বলা হয়েছেঃ ‘প্রতিটি জিনিসেরই যাকাত দিতে হয়।’ [হাদীসটি ইবনে মাজাহ আবূ হুরায়রা (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাবারানী উদ্ধৃত করেছেন সহল ইবনে সায়দ থেকে, সুয়ূতী হাদীসটির যয়ীফ হওয়ার ইশারা করেছেন। মুনযেরী (আরবী****************) গ্রন্থেও এ দিক ইঙ্গিত করেছেন।]
দুনিয়া প্রেমের চিকিৎসা
অপর দিক দিয়ে যাকাত মুসলিমের মনেকে আল্লাহ্র প্রতি-পরতালের ব্যাপারে তার কর্তব্য সম্পর্কে সতর্ক করে তোলে। দুনিয়ার প্রেমে মনের ভরপুর হওয়ার-ধন-মালের জন্যে পাগলপ্রায় হওয়ার চিকিৎসা হচ্ছে এ যাকাত। এ কারণে শরীয়াতের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হিসেবে ধন-মালের মালিককে তার মালের কিছু অংশ তার হাত থেকে বের করার জন্যে দায়িত্বশীল বানিয়ে দেয়া একান্তই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেছে। এই কিছু পরিমাণ মাল আলাদা করে কাউকে দিয়ে দেয়া ধন-মালের প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ এবং মায়া মালিকের মনে রয়েছে তা চূর্ণ করে দিতে পারে। মনকে সেদিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকিয়ে দেয়ার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে। তার জন্যে হুঁশিয়ারী হতে পারে এদিক দিয়ে যে, ধন-মারের সন্ধানে নিমজ্জিত হলে মানুষ পরম সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে না। বরং পরম সৌভগ্য লাভের অন্যমত পন্থা হচ্ছে মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ধন-মাল ব্যয় করা। অতএব বলা যায়, যাকাত ফরয করা হয়েছে অন্তর থেক দুনিয়া ও ধন-মালের প্রেম রোগের সুনির্দিষ্ট ও সঠিক চিকিৎসা বিধানের লক্ষ্যে। [ও]
মানব মনের ওপর মালের প্রেম আধিপত্যশীল হয়ে পড়ার পরিণতি কি হতে পরে, এ পর্যায়ে ইমাম রাযী স্পষ্ট করে বলেছেনঃ [তাঁর তাফসীর, ঐ, ১০১ পৃষ্ঠা।]
ধন-মালের আধিক্য ও প্রাচুর্য শক্তির তীব্রতা ও সামর্থ্যের পূর্ণত্ব সৃষ্টি করে। আর ধন-মাল বেশী বেশী চাওয়ার মানে বেশী বেশী মক্তি লাভের চেষ্টা। আর বেশী বেশী শক্তি লাভের চেষ্টা সেই শক্তিতে বেশী বেশী স্বাদ পাওয়ার বেশী বেশী চেষ্টা চালানো। আর স্বাদ আস্বাদনের বেশী বেশী আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বাধ্য করে সেই মাল লাভের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে, যা এই বেশী বেশী মাত্রার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দেয়। এভাবে ব্যাপারটি আবর্তমশীল হয়ে দাঁড়ায়। কেননা মালের প্রাচুর্য বিধানে যদি চরম মাত্রার চেষ্টা বেশী হবে, তা-ই আবার মানুষকে বেশী বেশী মাল পাওয়ার জন্যে চেষ্টানুবর্তী বানাবে-এভাবে। আর ব্যাপারটি যখন চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকবে, তখন আর কোন শেষ মাত্রা বা সীমা কখনই দেখা যাবে না। এ কারণে শরীয়াত একটা শেষ পর্যায় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আর তা এভাবে যে, ধন-মালের মালিমের ওপর তার ধন-মালের একটা অংশ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যেন মনকে সেই অন্ধকারময় শেষহীন আবর্তনশীলতার চক্র থেকে নিষ্কৃতি দেয়া যায় এবং তাকে আল্লাহ্র বান্দা হওয়ার পরিমন্ডলে ফিরিয়ে এনে তাঁর সন্তুষ্টি সন্ধানে নিয়োজিত করা সম্ভব হয়।
তার অর্থ আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাকে একটা শেষহীন চক্রের মধ্যে পড়ে অনন্ত কাল ধরে আবর্তিত হতে দেয়া পসন্দ করেন না। সে চক্রটি হচ্ছে ধন-মাল সংগ্রহ সঞ্চয়ের চক্র। তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে, ধন-মাল একটা উপায় মাধ্যম মাত্র, চরম লক্ষ্য নয়। একটা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পর তিনি তাকে বলে দিতে চানঃ থাম, যা অর্জন করেছ তা থেকে ব্যয় কর, দান কর-এর মধ্যে আল্লাহ্র হক রয়েছে, তা আলাদা করে বের করে দিয়ে দাও-ফকীরের হক দিয়ে দাও-সমাজ সমষ্টির অধিকার আদায় কর।
আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের জন্য ধন-মাল উপার্জন ও সঞ্চয় করাকে ‘মবাহ’ করে দিয়েছেন। দুনিয়ার যাবতীয় পাক-পরিচ্ছন্ন জিনিসই তার জন্যে জায়েয। কিন্তু তাকেই জীবনের একমাত্র চিন্তা-ধান্ধার ব্যাপার ও চরম লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করাতে আল্লাহ আদৌ রাজী নন। কেননা মানুষ তো তার চাইতেও অনেক উঁচু ও মহান উদ্দেশ্যের জন্যে সৃষ্ট হয়েছে। তার জন্যে নির্মিত হয়েছে সেই ঘর যা চিরন্তন। এ বিশ্বলোক-এ দুনিয়া মানুষের জন্যে সৃষ্ট। আর সে নিজে সৃষ্ট পরকালের জন্যে-আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে। এ দুনিয়াটা তো পরকালেরই পথ। মানুষ এই ‘পথ’কে সৃন্দর সুসজ্জিত করে পড়ে তুলুক, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু তার একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সে একটা লক্ষ্যের পানে চলমান, একটা মহান লক্ষ্যের জন্যেই সে চেষ্টাকারী।
আল্লাহ তো ধন-মাল দেন, যাকে তিনি ভালোবাসের তাকেও, যাকে ভালোবাসেন না তাকেও। মুমিন ও কাফির উভয়কেই দেন। পাপী ও আল্লাহ্ভীরু কাউকেই বঞ্চিত রাখেন না। বলেছেনঃ (আরবী**************)
এদেরকেও এবং ওদেরকেও উভয় শ্রেণীর লোকদেরকে আমরা (দুনিয়ায়) জীবনের সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছি, এটা তোমার আল্লাহ্র দান। আর তোমারা আল্লাহ্র দানকে প্রতিরোধ করতে পারে এমন কেউ নেই। [আরবী****************]
অতএব কোন লোকের হাতে ধন-মালের অবস্থিতি প্রমাণ করে না যে, সে খুবই উওম ব্যক্তি, খুবই মর্যাদাবান ব্যক্তি। বৈশিষ্ট্য মর্যাদা ও সার্বিক ভাল আল্লাহ্র জন্যে মর্যাদা পাওয়া সম্ভব। তার হাতের জিনিস ব্যয় করতে হবে সে জিনিস পাওয়ার জন্যে যা আল্লাহ্র হাতে নিবদ্ধ।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধন-মাল একটা বড় নিয়ামত, কল্যাণেল উৎস। কিন্তু তা এমন কল্যাণ যা দিয়ে মানুষের পরীক্ষা করা হয় যেমন পরীক্ষা করা হয় খারাপ জিনিস দিয়ে বলেছেনঃ (আরবী*****************)
পরীক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে কল্যাণে নিমজ্জিত করি, অকল্যাণেও। [আরবী************] (আরবী**************)
জেনে রাখ তোমাদের ধন-মাল ও তোমাদের সন্তান পরীক্ষাস্বরূপ। [আরবী**********] (আরবী***********)
মানুষকে তার রব্ব যখন পরীক্ষা করেন, তখন তাকে সম্মানিত করেন এবং নিয়ামতদানে ভূষিত করেন। [আরবী********]
এরূপ অবস্থায় মহাভাগ্যবান সে, যে নিজেকে ধন-মালের আমানতদার এবং তাতে সে আল্লাহ্র খলীফা মনে করে কাজ করে। আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী তা ব্যয় করেঃ (আরবী***************)
এবং তোমরা ব্যয় কর সে জিনিস থেকে, যাতে তোমাদেরকে খলীফা বানানো হয়েছে। [আরবী************]
যাকাত ব্যবস্থা দুনিয়ার ফেতনা ও ধন-মালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় মুসলিম ব্যক্তিকে এভাবে যে, তা তাকে অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত করে। আল্লাহ্র আদেশ পালন এবং তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্যে চেষ্টা সাধনা করতে প্রস্তুত করে।
দুনিয়ায় জাতিসমূহ অনেক সময় নানা বিপদের সম্মুখীন হয়। তার সমস্ত ভয়াবহ প্রস্তুতিও বন্যার তৃণখন্ডের মত ভেসে যায়, তার শত্রুরা তাতে হয়ত উওেজ্বিত হয়, তা হচ্ছে, তার লোকের চরম দুর্বলতার মধ্যে পড়ে যায়, সাহস-হিম্মত হারিয়ে ফেলে। মন-মানসিকতা চেতনাহীন হয়ে পড়ে, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা কর্পূরের মত উড়ে যায়। অন্তর্নিহিত আত্ম নিহত হয়। রাসূলে করীম (স)-এর এ বিশ্লেষণ অনুযায়ী এ দুর্বলতা দুটি কারণে ঘটে থাকেঃ দুনিয়া-প্রেম ও মৃত্যুভয়।
কাজেই মুসলমান যখন জানতে পরবে দুনিয়াকে পরকালের জন্যে কিভাবে ছাড়তে হয় এবং আল্লাহ্র জন্যে ধন-মল ব্যয় করতে অভ্যস্ত হবে, অন্য লোকেরা কল্যাণ কামানায়-অন্য লোকেরা প্রয়োজন পূরণে সে স্বীয় মনের লালসা-বাসনাকে দমন করতে সক্ষম হবে, তখনই এ দুর্বলতারন জমাট বাঁধা বরফ গলবে, মনে এক পরম শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটবে আর শেষ পর্যন্ত গোটা জাতি জেগে উঠবে, শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
ধনী ব্যক্তিত্ব বিকাশে যাকাত
যাকাত যে ‘তাজকিয়া’ করে, তার তাৎপর্য হচ্ছে, ধনী ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সমৃদ্ধি, তার অন্তর্নিহিত সওার বিকাশ সাধন। তাই যে লোক কল্যাণের হাত প্রসারিত করে, ন্যায়সঙ্গত কাজ সম্পন্ন করে এবং তা নিজের ও তার হাতের সম্পদ ও শক্তি নিয়োজিত করে তার দ্বীনী ভাই ও মানবতাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে, যেন তার ওপর আল্লাহ্র যে অধিকার আরোপিত তা সে যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়, সে তার নিজের মধ্যে একটা প্রশান্তি, সম্প্রসারতা এবং তার বক্ষে উদারতা, বিশালতা-বিপুলতা অনুভব করতে শুরু করবে, যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার সুখ অনুভব করবে। সে কার্যতই তার দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠে, তপার কূপ্রভাব থেকে মুক্ত হতে এবং তার লালসা ও লোভের শয়তানকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করবে।
এটাই হচ্ছে মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ-আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ। কুরআনের আয়াতঃ (আরবী*************) থেকে আমরা এ তাৎপর্যই অনুধাবন করতে পারছি। আয়াতে (আরবী************) শব্দটি (আরবী************) শব্দের পরে ‘এবং’ বলে আনা হয়েছে। এ থেকেই উপরিউক্ত তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেননা কুরআনের প্রতিটি শব্দ-প্রতি অক্ষরেরই একটা অর্থ আছে-একটা তাৎপর্য আছে।
যাকাত ভালোবাসা উদ্ভাবক
যাকাত ধনী ব্যক্তি এবং তার সমাজ সমষ্টির মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা- একটা গভীর সূক্ষ্ম সম্পর্ক সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কটি হয় খুবই দৃঢ়, দৃশ্ছেদ্য। ভালোবাসা ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতাই এর মূল সূত্র। কেননা মানুষ যখন অন্য কারো সম্পর্কে জানতে পারে যে, তার কল্যাণে সে আগ্রহ রাখে-তার যাতে ভালো হয় সেই চেষ্টাই সে করে, তার জন্যে যা ক্ষতিকর তা সে দূর করতে চায়, তা হলে সে তাকে ভালোবাসবে স্বাভাবিকভাবেই। তার মন-মানস তার প্রতি আকৃষ্ট হতে অনিবার্যভাবে। এজন্যে হাদীসে বলা হয়েছেঃ যে লোক যার কল্যাণ করল তার হৃদলে তার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসা জাগবে। আর যে তার অকল্যাণ করেছে, তার প্রতি স্বভাবতই জাগাবে অসন্তোষ ও ক্রোধ। [ইবনে আদী (আরবী***********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, আবূ নয়ীম উদ্ধৃত করেছেন (আরবী***********) গ্রন্থে, আর বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন (আরবী*************) গ্রন্থে- ইবনে মাসুউদ থেকে, রাসূলের কথা হিসেবে। তবে সনদ যয়ীফ। বরং এটিকে ‘সউজ’ রচিত’ বলা হয়েছে। বায়হাকী অবশ্য সহীহ বলেছেন ইবনে মাসউদের কথা হিসেবে। মাথাভী বলেছেন, এটি রাসূলের কথাও নয়, সাহাবীর কথাও নয়-বাতিল। (আরবী*****************)] ফকীর-মিসকীনরাও যখন জনবে যে, এ ধনী ব্যক্তি তার ধন-মালের একটা অংশ তাদেরকে দেবে। তার ধন-মাল বেশী বেশী তাদের জন্যে, তার ব্যয়ের পরিমাণও অবশ্য বেশী হবে। তখন তারা তার জন্যে আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করে, তার সাহস বৃদ্ধি করে। আর জনগণের এ মনোভাবের একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। হৃদয়গুলোর উওাপ তাকে অধিক উৎসাহিত করবে। সে সব দো‘আ- আন্তারিক শুভেচ্ছো সেই ব্যক্তি সর্বক্ষণ কল্যাণকর ও মহানুভবতার কাজে নিমগ্ন থাকার কারণ হয়ে দাঁড়াবে-যেমন ইমাম রাযী বলেছেন। আল্লাহ্র এ কথায় সেদিকেই ইঙ্গিত রয়েছেঃ (আরবী*****************)
যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর তাই দুনিয়ায় টিকে থাকে। [আরবী*******************]
নবী করীম (স)-এর কথাঃ (আরবী****************)
তোমরা তোমাদের ধন-মাল যাকাত দ্বারা সংরক্ষিত করা। [আবূ দাঊদ ‘মুরসাল’ হিসেবে তাবারানী ও বায়হাকী প্রমুখও উদ্ধৃত করেছেন অনেক কয়জন সাহাবী থেকে রাসূলের কথা হিসেবে। সনদ ধারাবাহিক। মুনযেরী বলেছেনঃ মুরসাল হওয়াই অধিক গ্রহণীয়।]
একই তাৎপর্য বহন করে।
যাকাতা ধন-মালের পবিত্রতা বিধান করে
যাকাত যেমন মন-অন্তর হৃদয়ের পবিত্রতা ও পিরশুদ্ধতার বিধান করে, তেমনি তা ধনীর ধন-মালের পবিত্রতা সাধন করে, তার প্রবৃদ্ধি ঘটায়।
যাকাত ধন-মাল পবিত্র করে এভাবে যে, মালের সাথে অপর লোকের মাল মিলেমিশে থাকলে তা কলুষিত হয়। সেই অপরের মাল তা থেকে বের করে না দেয়া পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারে না। এদিকে লক্ষ্য রেখেই পূর্বকালের কেউ কেই বলেছেনঃ অপহৃত ইট কোন দালানে থাকলে তার ধ্বংস তাতেই গচ্ছিত হয়ে আছে। অনুরূপভাবে যে পয়সা ফকীর মিসকীনের-ধনীর মালের মধ্যে শামিল রয়ে গেছে, তার সবটাই তাতে কলুষিত হয়ে গেছে। এ কারণেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘তুমি যখন তোমার মালের যাকাত দিয়ে দিলে তখন তুমি তা থেকে খারাবীটা দূর করে দিলে।’ [ইবনে খুজাইমা তাঁর সহীহ প্রন্থে এবং হাকেম এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন হযরত জাবি থেকে। এ হাদীস সম্পর্কে কথা আছে, তা বলা হবে অষ্টম অধ্যায়ে।]
রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত ও পূর্বে উদ্ধৃতঃ ‘তোমরা তোমাদের ধন-মালকে সংরক্ষিত কর’ হাদীসটি সবচাইতে বড় কথা। ধনী ব্যক্তিরা এ সংরক্ষণ ব্যবস্থার খুব বেশী মুখাপেক্ষী। বিশেষ করে আমাদের এ যুগে-যখন চারদিকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চলছে ও লাল বিপ্লবের আগুন দাউ দাই করে জ্বলে উঠেছে।
বস্তুত ধনীর মালের সাথে অক্ষম ফকীরের সম্পর্ক খুবই দৃঢ় ও অবিচ্ছিন্ন। এমন কি কোন কোন ফিকাহবিদ এতদূর বলেছেনঃ ‘যাকাত মূল মালের মধ্যে শামিল, তা ধনীর কোন দায়িত্বের ব্যাপারে নয়। তাই মূল মালটাই ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকবে যকক্ষণ না তা থেকে যাকাত বের করে দেয়া হবে। এ বিষয়েই বলা হয়েছে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসেঃ
যাকাত যদি কোন মালের মধ্যে শামিল হয়ে মিলেমিশে থাকে তাহলে তা এ মালকে ধ্বংস করবে।
কোন কোন বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ ‘তোমার মালের ওপর যাকাত ফরয ধার্য হয়ে থাকতে পারে। তা যদি তুমি বের করে না দাও তাহলে হারামটা হালালটাকে ধ্বংস করবে। [এ হাদীসের সূত্র পূর্বে বলা হয়েছে।]
শুধু তাই নয়, গোটা জাতির ধন-মাল হ্রাস পাওয়ার আশংকা দেখা দেয়, আসমানী মুসিবতে এসে যে সাধারণ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জাতীয আয়ের হার নিম্নগামী হয়ে পড়ে, তাতে বুঝতে হবে তা মহান আল্লাহ্র গজব ছাড়া আর কিছু নয়। তা নেমে এসেছে এমন সমাজ ও জাতির লোকদের ওপর যারা পরস্পরে নিরাপওার ব্যবস্থঅ করে না, পারস্পরিক সাহায্যের কোন ব্যবস্থা যাদের মধ্যে নেই, যাদের শক্তিমান ব্যক্তি তাদের দুর্বল ব্যক্তিকে ধারণা করে না। হাদীসে বলা হয়েছেঃ
যে জতি যাকাত দিতে অস্বীকৃত হয়েছে সে জাতি আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত হওয়াকে বাধা দিয়েছে। জন্তু-জানোয়াররা যদি না থাকতে তাহলে সেই অবস্থায় বৃষ্টিপাত আদৌ হত না। [এর উৎস ও সূত্র পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।]
ব্যক্তি ও সমষ্টির ধন-মাল থেকে ধ্বংস ও হ্রাসপ্রাপ্তির কারণসমূহ থেকে পবিত্রকরণ ও সংরক্ষণের একটি মাত্র পন্থা হচ্ছে, তা থেকে আল্লাহ্র হক ও গরীবের হক বের করা। আর তাই হচ্ছে যাকাত ব্যবস্থ।
যাকাত হারাম মাল পবিত্র করে না
আমরা যখন বলি, যাকাত ধন-মালের পবিত্রতা বিধানকারী, তার প্রবৃদ্ধির কারণ, তাতে বরকত হওয়ার উসিলা তখন আমরা হালাল মালের কথাই বলি। হালাল মাল সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য। যে মাল তার মালিক বা দখলদারের হাতে শরীয়াতসম্মত পন্থায় পৌঁছেছে, তা-ই হালাল মাল, কিন্তু খবীস খারাপ মাল তা যা অপহরণ, ছিলতাই, ঘুষ, অকারণ মূল্য বৃদ্ধিকরণ কিংবা সুদ ও জুয়া খেলা থেকে প্রাপ্ত কিংবা লোকদের ধন-মাল হরণ করার যে কোন হারাম পন্থায় লব্ধ ধন-মালকে যাকাত পবিত্র করে না, তাতে বরকত সৃষ্টি করে না। কোন কোন বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞানী খুব সত্যই বলেছেনঃ ‘হারাম মাল যাকাত দ্বারা পবিক্রকরণটা ঠিক প্রস্রাব দিয়ে পায়খানা ধোয়ার মত।’
বড় বা ছোট বহু চোর-ডাকাত-যারা চৌর্যবৃওি বা নানা মথ্যা ও বিভ্রান্তকারী নামের অধীন লকিয়ে নেয়ার দক্ষতায় খুব খ্যাতি অর্জন করেছে-তারা মনে করে যে, তারা সুদ-ঘুষের মাধ্যমে যা উপার্জন করেছে এবং যে সব হারাম মাল সঞ্চয় করেছে তা থেকে কিছু অংশ সাদকা করে দিলেই যথেষ্ট হবে। আর এভাবে তারা যখন আল্লাহ্র কাছে ‘মকবুল’ হয়ে যাবে তখন জনগণের কাছেও নির্দোষ নিষ্পাপ ও পবিত্র সাব্যস্ত হবে।
আসলে এটা একটা মিথ্যা ধারণা। ইসলাম এ ধারণাকে অসত্য বলছে, তা মেনে নিতে অস্বীকার করছে। ইসলামের নবী এ প্রসঙ্গ বলেছেনঃ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাইয়্যের পবিত্র মাহন, তিনি তাইয়্যেব-পবিত্র ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেন না। [হাদীসটি মুসলিম, তিরমিযী (আরবী***************) উদ্ধৃত করেছেন। সহীহ বুখারীতে অনুরূপ বর্ণনা হয়েছে (আরবী****************)] বলেছেনঃ ‘যে লোক হারাম উপয়ে মাল সংগ্রহ করল, পরে তা দান করে দিল, এতে তার কোন শুভ ফল প্রাপ্য হবে না। বরং তা বোঝাটা তার ওপরই চাপবে। [হাদীসটি ইবনে খুজাইমা ও ইবনে হাব্বান তাঁদের সহীহ প্রন্থদ্বয়ে এবং হাকেম উদ্ধৃত করেছেন। হাকেম বলেছেন হাদীসটি সনদের দিকে দিয়ে সহীহ। (আরবী**************** ] আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাস ভঙ্গ করা বা চুরি করা মালের সাদকা (যাকাত) কবুল করেন না, অযুবিহীন নামাযও গ্রহণ করেন না। [হাদীসটি আবূ দাউদ সহীহ সনদে উদ্ধৃত করেছেন। উপরে তারই ভাষা। মুমলিমও তাঁর সহীহ গ্রন্থে তুলেছেন। (আরবী*****************)]
বস্তুত এই ধরনের কলুষযুক্ত ধন-মালের যাকাত আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না, যেমন অযুর পবিত্রতা ছাড়া নামায কবুল করেন না।
তিনি আরও বলেছেনঃ যার মুঠোর মধ্যে আমার প্রাণ তাঁর কসম, কোন বান্দাহ যদি হারাম মাল উপার্জন করে তা দান করে তার পরিমাণ হ্রাস পাবে-তা থেকে ব্যয় করা হলে তাতে তার জন্যে কোন বরকত হবে না। আর তা তার পিঠের পিছনে রেখে দিলে তা জাহান্নামের দিকেই তার পথ প্রশস্ত করবে। আল্লাহ খারাপকে খারাপ দ্বারা দূর করেননা; বরং খারাপকে দূর করেন ভালোর দ্বারা। কেননা খারাপ খারাপকে নির্মূল করতে পারে না। [হাদীসটি আহমাদ প্রমুখ এমন সুত্রে উদ্ধৃত করেছেন, যাকে ইলমে হাদীসের কোন কোন আলেম ‘হাসান’ বলেছেন। (আরবী******************)]
কুরতুবী বলেছেন, আল্লাহ হারাম মালের ‘দান’ কবুল করেন না; কেননা তা তো দানকারীর মালীকানাভুক্ত নয়, সে মালের ওপর তার হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ তা দান করে সে তার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। তা যদি তার কাছ থেকে কবুল করা হয় তাহলে যা একদিক দিয়ে নিষিদ্ধ, তাই আদিষ্ট হয়ে পড়া আবশ্যক হয়।’ কিন্তু তা অসম্ভব। [আরবী***********]
বরং হানাফী আলিমদের কেউ কেউ বলেছেনঃ কেউ যদি ফকীরকে হারাম মাল থেকে কিছু দেয় ও তার ফলে সে সওয়াব পাওয়ার আশা করে, তাহলে এ কারণে সে কাফির হয়ে যাবে। আর সে ফকীর যদি সে কথা জানতে পারা সও্বেও তার জন্যে দো’আ করে, তাহলে সেও কাফির হয়ে যাবে। অপর কোন লোক তা শুনতে পেয়ে তার দো‘আর ওপর সে যদি ‘আমিন’ বলে-অবস্থা জানা থাকা সও্বেও তাহলে সেও অনুরূপ কাফির হবে। এমনিভাবে হারাম মাল দ্বারা যদি কোন মসজিদ নির্মিত হয়-তার ফলে আল্লাহ্র নৈকট্যের আশা করা হয়-তাহলেও অনুরূপ পরিণতি হবে। কেননা সে এমন কাজের সওয়াব পেতে চাচ্ছে যার পরিণাম আযাব ছাড়া কিছু নয়। আর তা হতে পারে কেবল তখনই যদি হারামকে হালাল মনে করা হয়। কিন্তু সেটাও কুফরী। তবে এ সব কথা কেবল সেই হারাম সম্পর্কে যা নিশ্চিত, নিঃসন্দেহ। কোন সন্দেহপূর্ণ জিনিস সম্পর্কে উপরিউক্ত কথা প্রযোজ্য হবে না। [দেখুনঃ (আরবী*******************)]
তাই কেউ যেন এমন ভিওিহীন ধারণা পোষণ না করে যে, যাকাত কাফফারা হবে অপহরণকারীর অপহরণ অপরাধের, ঘুষখোরের ঘুষখোরীর অপরাধের, সুদখোরীর সুদী কারবারের অপরিবত্রতা থেকে। না তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও দুঃখজনক। কেননা হারাম মালের কোন যাকাত গ্রহণযোগ্য হতে পরে না। আসলে তাতে যাকাতই ফরয হয় না। যাকাত ফরয হয় কেবলমাত্র সেই মালে, যা একজনের হালালভাবে মালিকানাভুক্ত। আর ইসলাম হারাম মালের কোন মালিকানাই স্বীকার করে না, তার ওপর যত আশার জালই বুনানো হোক-না কেন। ইসলাম পরের ধন হরণকারী ঘুষখোর ও ছোট বা বড় চোরদের কখনও বলে নাঃ ‘তোমরা যাকাত দাও; বরং তাদেরকে সর্বাগ্রে বলে, তোমাদের দাখলে যে সব মাল-সম্পদ রয়েছে তা সবেই তার আসল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দাও।’
যাকাত ধন-মালের প্রবৃদ্ধির কারণ
এ সবের পর যাকাত পর্যায়ে বক্তব্য হচ্ছে তা ধন-মালের প্রবৃদ্ধির কারণ। তা তাতে বরকত সৃষ্টি করে। অবশ্য কেউ কেউ এ কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে। কেননা যাকাত তো বাহ্যত মালের পরিমাণ হ্রাস করে-তার একটি অংশ অপরকে দেয়া হয় বলে। তাহলে তা মালের প্রবৃদ্ধি ও পরিমাণে বেশী হওয়ার কারণ হয় কি করে?
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত লোকেরা জানেন যে, বাহ্যত এ হ্রাস প্রাপ্তি প্রকৃতপক্ষে প্রবৃদ্ধিতে পরিণতি লাভ করবে। সামষ্টিক ধন-সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি ধনীর মূল সম্পদেই প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কেননা যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া এ সামান্য অংশ তার কাছে কয়েকগুণ বেশী হয়ে ফিরে আসে এমনভাবে যা সে হয় জানতে পরে, না হয় জানতেই পারে না।
এরই কাছাকাছি একটি ব্যাপার আমরা সচরাচর লক্ষ্য করি। তা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধন-মালের মালিক কোন কোন দেশ কোন কোন দরিদ্র দেশকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে-আল্লাহ্র ওয়াস্তে নয়-দেয় এই উদ্দেশ্যে, যেন সে দেশের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে সে দেশ সেই ধনী দেশেরই উৎপাদন ক্রয় করবে।
আমরা আরও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে দেখতে পাব, এক ব্যক্তির হাতে একটি টাকার জন্যে তার প্রাণ ধুক ধুক করে ওঠে তার মায়ায় এবং তার জন্যে দো‘আর মুখগুলো নড়ে ওঠে, ধ্বনি করে। সাহায্য ও সংরক্ষণের হস্ত তাকে রিবেষ্টিত করে রাখে। টাকাসহ এই ব্যক্তি বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে পড়ে, অন্যের হাতের বিপুল টাকার তুলনায় সে অধিক গতিশীল ও কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাখ্যার দিকেই সম্ভবত কুরআনের এই আয়াতসমূহ ইঙ্গিত করেঃ (আরবী*************)
তোমরা যা ব্যয় কর তা তার স্থলভিষিক্ত বানিয়ে দেয়। আসলে সেই আল্লাহই বর্বোওম রিযিকদাত। [আরবী***************]
(আরবী****************)
শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং নির্লজ্জ কার্যাবলীর আদেশ করে তোমাদেরকে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা দানের ওয়াদা করেন এবং অনুগ্রহ দানের। আর আল্লাহ বিপুর বিশাল সর্বজ্ঞ। [আরবী****************] (আরবী***************)
তোমরা যে যাকাত দাও, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি পাওয়ার ইচ্ছা কর তোমরা, তাহলে তারাই প্রবৃদ্ধির অধিকারী। [আরবী***************]
(আরবী***************)
আল্লাহ সুদ নির্মূল করে দেন এবং দান-সাদকা-যাকাত বৃদ্ধি করে দেন। [আরবী*****************]
এই স্থলাভিষিক্তকরণ ও প্রবৃদ্ধি সাধনে মহান আল্লাহ তা‘আলার যে অনু্গ্রহের বিরাট অবদান রয়েছে তার কার্যকারিতার কথা তোমরা ভুলে যাবে না, যদিও আমরা তার কার্যকরণের কোন খবর রাখি না। আল্লাহ তো তাই দান করেন- যা তিনি চান, যার জন্যে তিনি চান। আর আল্লাহ অসীম বিরাট অনুগ্রহশীল।
উপরন্তু মুসলমানের ধন-মাল থেকে প্রতি বছর যে সম্পদ যাকাত বাবদ গৃহীত হয়, পিছন দিক থেকে তা-ই তার ধন-মালকে অধিক মুনাফা ও তার সম্পদকে অধিক প্রবৃদ্ধি দানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হয় তা স্বতঃই কিংবা অন্যের সাথে শরীকানার ভিওিতে। শেষ পর্যন্ত যাকাত সে মূলধনকে খেয়ে ফেলে না। আর এই বেশী মুনাফা ধন-মালের মালিকরাই পেয়ে থাকে, এটাই আল্লাহ্র স্থায়ী নিয়ম। তিনি যা গ্রহণ করেন তা কয়েক গুণ বেশী তাকে প্রদান করাই আল্লাহ্র রীতি। তাতে অন্যথা হতে পারে না।
দ্বিতীয় আলোচনা
গ্রহণকারীর জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও প্রভাব
যাকাত গ্রহণকারীর ক্ষেত্রে তা মানুষের জন্যে মর্যাদাহানির অবস্থা থেকে মুক্তি বিধায়ক। জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনা ও কালের আবর্তন-বিবর্তনসমূহের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রমের তা এক কার্যকর ও মনস্তও্বিক প্রতিরোধ। কোন্ লোক যাকাত গ্রহণ করে এবং কোন্ সব ব্যক্তি তা পেয়ে উপকৃত হয়?
সে হল ফকীর-দরিদ্র ব্যক্তি, দারিদ্র্য যাকে পর্যুদস্ত করেছে;
অথবা সেই মিসকীন, অভাবগ্রস্ততা যাকে ধূলি লুণ্ঠিত ও লাঞ্ছিত অবমানিত করেছে;
অথবা সেই ক্রীতদাস, দাসত্ব শৃংখলা যাকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত করেছে;
অথাব সেই ঋণগ্রস্ত, ঋণ যাকে হেস্ত-নেস্ত করেছে;
অথবা সেই নিঃস্ব পথিক, যে তার পরিবারবর্গ ও ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে।
যাকাত তার গ্রহণকারীকে অভাবগ্রস্ততা থেকে মুক্তি দেয়
ইসলাম চায় মানুষ অতীব উওম ও পবিত্র জীবন যাপন করুক। এ জীবনে তারা প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনকে ধন্য করে তুলুক। আসমান ও জমিনের সব ‘বরাকাত’ তারা লাভ করুক। ওপর থেকে ভ্রান্ত নিয়ামতসমূহ এবং নীচ থেকে প্রাপ্ত সম্পদসমূহ আয়ও করে তারা ধন্য হোক, সেই সৌভাগ্য তারা অনুভব করুক, যা তাদের অবয়বসমূহকে স্বাচ্ছেন্দ্যপূর্ণ করে দেবে, পরম শান্তি ও সমৃদ্ধিতে তাদের হৃদয় কানায় কানায় ভরে দেবে, আল্লাহ্র নিয়ামতের চেতনায় তাদের মন ও জীবন ভরপুর হয়ে উঠুক।
বস্তুত মানুষের সৌভাগ্য বিধানে বস্তুগত সুযোগ-সুবিধার বাস্তবায়নকে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বানিয়ে দিয়েছে ইসলাম। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী******************)
তিনটি হচ্ছে মহাসৌভাগ্যের অবলম্বনঃ সেই স্ত্রী, যাকে তুমি দেখলে সে তোমাকে উৎফুল্ল সন্তুষ্ট করে দেবে, তুমি তার কাছে অনুপস্থিত থাকলে সে নিজেকে ও তোমার ধন-মালকে সংরক্ষিত রাখে। সেই যানবাহন যা স্থিতিশীল সুদৃঢ় হবে এবং তা তোমাকে তোমার বন্ধু-স্বজনদের সাথে মিলিত করবে। আর ঘরবাড়ি, যা প্রশস্ত হবে এবং খুবই আরামদায়ক হবে। [আরবী****************]
অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ চারটি হচ্ছে সৌভাগ্যের উপাদান-সত্যাচারিণী স্ত্রী, প্রশস্ত বসত ঘর, চরিত্রবান প্রতিবেশী, সহজগামী যানবাহন। আর চারটি হচ্ছে দুর্ভাগ্যের কারণ-দুশ্চরিত্র প্রতিবেশী, খারপ স্ত্রী, খারাপ যানবাহন ও সংকীর্ণ বসত ঘর। [আরবী*******************]
এ হচ্ছে দাম্পত্য জীবন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বসতবাটি ও প্রতিবেশের দিক দিয়ে মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভগ্যের ব্যাপরে নবুয়তের সূত্রে প্রাপ্ত দিগন্ত উজ্জ্বলকারী আলোকসম্পাত। বাস্তব জীবন এ কথার সত্যতা সর্বাধিক মাত্রার বাস্তবতার আলোকে সত্যায়িত করে তুলেছে।
হ্যাঁ, ইসলাম চায় মানুষ ধনাঢ্যতায় সৌভাগ্যবান হোক। দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় জর্জরিত হোক কোন মানুষ তা ইসলামের কাম্য নয়। কিন্তু সে দারিদ্র্য যদি বণ্টন ব্যবস্থার ক্রটি ও সামষ্টিক জুলুম পীড়ন-বঞ্চনার দরুন হয়, কেউ অন্য কারোর অধিকার হরণ করেছে-এ কারণে দেখা দেয়, তা হলে দারিদ্র্যের সাথে ইসলামের শত্রুতা-দারিদ্র্যের প্রতি ইসলামের ঘৃণা ও বিদ্বেষ তীব্রতর হয়ে ওঠে।
ইসলামী সামাজ বিধান ও বস্তবাদী সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বস্তুবাদী সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে উদরপূর্তি ও যৌন তৃপ্তিতে চারিতার্থ করতে চায়। বস্তুগত দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিধি অতিক্রম করা তার সাধ্যাতীত। সুখ-স্বচ্ছন্দ্য ও প্রশস্ততা তার দূরতম লক্ষ্য। তার স্বপ্ন স্বর্গ সবই এ পৃথিবীতে। এ ছাড়া কোন ‘স্বর্গের চিন্তা করাই তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু ইসলামী জীবন বিধান ধনাঢ্যতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে মানুষের ‘রূহ’ কে মহান আল্লাহ্র দিকে রুজু করতে চায়। চায়, তারা যেন খাদ্যের সন্ধানে একান্তভাবে মশগুল এবং খাদ্যের সংগ্রামে সংগ্রামলিপ্ত হয়ে না পড়ে, যেন ভুলে না যায় আল্লাহ্র পরিচিতি, আল্লাহ্র সাথে গভীর সম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সেই সাথে পরকালীন জীবনের বিষয়টিও যেন তাদের চোখের আড়াল পড়ে না যায়। কেননা সেই জীবনটাই তো অধিকতর কল্যাণময় এবং চিরন্তন।
মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যখন বৃদ্ধি পায়, তার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ যখন নিশ্চিন্ততার মাত্রায় পৌঁছায়, তখনই তার জীবনে স্বস্তি আসে, আল্লাহ্র ইবাদতে গভীর তন্ময়তা সহকারে আত্মনিয়োগ করা সম্ভবপর হয়। সেই আল্লাহই তো মানুষকে ক্ষুধার অন্ন যোগান এবং ভয় থেকে নিরাপওা দান করেন।
ইসলাম যে দারিদ্র্যেকে ঘৃণা করে, ধনাঢ্যতা পসন্দ করে এবং মানুষের পবিত্র স্বচ্ছন্দ জীবন কামনা করে, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা তার দরিদ্র রাসূলকে সচ্ছল বানিয়ে দিয়েছিলেনঃ (আরবী*****************)
এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাকে দারিদ্র পেয়েছেন, অতঃপর তিনিই তোমাকে সচ্ছল বানিয়ে দিয়েছেন। [আরবী********]
হিজরতের পর মুসলমানদের প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুগ্রহের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেনঃ (আরবী**********)
অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁর বিশেষ সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে রিযিক দিয়েছেন পবিত্র দ্রব্যাদি-যেন তোমরা শোকর কর। [আরবী******************]
রাসূলে করীম (স)- এর একটা প্রসিদ্ধ দো‘আ হচ্ছেঃ (আরবী******************)
হে আমাদের আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হোদায়াত, তাকওয়া নৈতিক পবিত্রতা, রোগ নিরাময়তা এবং ধনাঢ্যতার প্রার্থনা করছি। [আরবী******************]
রাসূলে করীম (স) আল্লাহ্র শোকর আদালয়কারী ধনী ব্যক্তিকে ধৈর্যশীল দরিদ্র ব্যক্তির ওপর অধিক মর্যাদাবান বলে ঘোষণা করেছেন। [যেমন হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়ঃ বিলুপ্তি বলে লোকের মজুরী নিয়ে গেছে (বুখারী, মুসলিম।)]
কুরআন মজীদ ধনাঢ্যতা ও পবিত্র জীবনকে নেককার মুমিনদের জন্যে আল্লাহ্র দেয়া তাৎক্ষণিক সওয়াব বা শুভু প্রতিফলস্বরূপ দান বলে ঘোষণা করেছে। আর কাফির-ফাসিক ব্যক্তিদের জন্যে দারিদ্র্য ও জীবন সংকীর্ণতাকে তাৎক্ষণিক আযাব হিসেবে ব্যবস্থা করে থাকেন বলে জানিয়েছেন। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে পুরুষ বা নারীই নেক আমল করবে, ঈমানদার হয়ে তাকেই আমরা পবিত্র জীবন যাপনের সুযোগ করে দেবে। [আরবী************]
(আরবী***************)
নগরবাসীরা যদি ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে আমরা তাদের জন্যে আসমান ও জমিনের বরকতসমূহ উন্মূক্ত করে দেব। [আরবী***************]
(আরবী**************)
যে লোক আল্লাহকে ভয় করবে তিনি তার জন্যে মুক্তির পথ বানিয়ে দেবেন এবং তাকে রিযিক দেবেন এমন পথে। যা সে চিন্তাও করতে পারে না। [আরবী**************]
(আরবী****************)
এবং আল্লাহ দৃষ্টান্তস্বরূপ উপস্থাপিত করেছেন একটি নগরের কথা যা খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল। তথায় প্রাচুর্য সহকারে রিযিক আসত সব দিক দিয়ে। সেই নগরবাসীরা কুফরী করে আল্লাহ্র নিয়ামতের প্রতি। ফলে আল্লাহ তাদেকে ক্ষুধার পোশাক পরিযে ভয়ের স্বাদ আস্বদন করান তাদের কার্যকলাপের বিনিময়ে। [আরবী***************]
হযরত আদম ও হাওয়া যেদিন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন তখনই সৃষ্টিকুলে আল্লাহ্র চলিত বিধানের কথা তাঁদের জনিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেনঃ (আরবী***************)
তোমরা দুইজন নেমে যাও একত্রে। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার কাছ থেকে হেদায়েত আসতে থাকবে। পরে যে আমার হোদায়েত অনুসারে চলবে সে পথভ্রষ্ট হবে না-হতভাগ্য হবে না। আর যে লোক আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে যাবে তার জন্যে সংকীর্ণতাপূর্ণ জীবন যাত্রা হবে এবং কিয়ামতের দিন আমরা তাকে অন্ধ অবস্থায় হাশরের ময়দানে আসব। -(সূরা ত্ব-হাঃ ১২৪)
এসব আয়াতের আলোকে আমাদের সম্মুখে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাসাউফপন্থীদের পরিবেশে দারিদ্র্যকে যেভোবে মহান মনে করা হচ্ছে, তাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে এবং সাধারণভাবে ধনাঢ্যতার নিন্দা করা হচ্ছে সেদিক দিয়ে লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে-এ সব নতুন সৃষ্টি চিন্তাধারা আসলে পারসিক মানুষের উৎক্ষিপ্ত চিন্তাধারা, ভারতীয় বৈষ্ণববাদী চিন্তাধারা, খৃষ্টীয় পাদ্রীসুলভ চিন্তাধারা। এই সব চিন্তা ইসলামের নয়, বাইরে থেকে ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী চিন্তাধঅরা এবং বিদ‘আত। [দেখুন মৎপ্রণীত (আরবী************) অধ্যায় (আরবী*************)]
এ সব কারণেই আল্লাহ তা‘আলা যাকাত ফরয করেছেন এবং তাকে দ্বীন ইসলামের একটা বড় অবদানরূপে গণ্য করেছেন। তা ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দারিদ্রের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে। তা পেয়ে দরিদ্ররা তাদের বস্তুগত প্রয়োজন ও অভাব-অনটন দূর করবে-খাবার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করবে। সেই সাথে জৈ-মনস্তাও্বিক প্রয়োজন পূরণেরও ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে-যেমন বিয়ে। মানীষিগণ তাকে পূর্ণঙ্গ জীবনের জরুরূ অংশ বলে গণ্য করেছেন, মানুষের আত্মিক প্রয়োজনের দিক দিয়েও তার গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন লেখাপড়ায় নিয়োজিত লোকদের জন্যে বইপত্র প্রয়োজন।
এ ফকীর-দরিদ্র ব্যক্তি যদি এসব জিনিস পায়, তাবেই সে জীবন যাত্রা শুরু করতে ও তা চালিয়ে নিতে পারে। পারে আল্লাহ্র আনুগত্য অনুসরণ স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে। বিশেষ। তাকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেয়া হবে না। সে নয় কোন অর্থহীন সূল্যহীন ব্যক্তি। সে মানুষের মহান সমাজের একজন, তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, তার গুরুদ্ব যথাযথভাবে স্বীকার করা হচ্ছে। সে বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধার করা হবে, তার প্রতি সহায়তা-সহাযোগিতার হস্ত প্রসারিত করা হবে-খুবই সম্মানজনকভাবে। তার ওপর কারো ব্যক্তিগত দয়া-অনুগ্রহের বোঝা চাপানো হবে না। তার দোহাই দিয়ে কেউ তাকে জ্বালাযন্ত্রণাও দেবে না। তার সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা সমাজে কার্যকর রয়েছে। রাষ্ট্রের হস্তই তার ওপর ছায়া বিস্তার করে আছে। সে মর্যাদাবান, উন্নত শির, উচ্চতর সম্মানের অধিকারী। কেননা সে তো তার জন্যে নির্দিষ্ট ও সর্বজনজ্ঞাত অধিকার পাচ্ছে। তার ন্যায্য অংশ পাওয়ায় কোন অনিশ্চয়তাই নেই।
এমন কি ইসলামী সমাজ সংস্থার কাঠামো চুরমার হয়ে গেলেও এবং মুসলিম ব্যক্তিগণ নিজেরাই যাকাত বণ্টনকারী হয়ে পড়লেও কুরআন মজীদ তাদের সাবধান করে দিয়েছে দারিদ্র মিসকীনদের কোনরূপ অপমান-লাঞ্ছনা দেয়া-তাদের অনুভূতির ওপর আঘাদ হানা-গ্রহীতার ওপর দাতার উচ্চ কর্তৃত্ব দেখানোর মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে। তাদের ওপর কোনরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন করতেও নিষেধ করেছে। কোন দিক দিয়েই তার মানবিক ক্ষন্ন হতে পারে এমন কোন কাজ করাই সম্ভবপর রাখা হয়নি। সে যেন একজন মুসলিম হিসাবে প্রাপ্য মর্যাদা পেতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ
(আরবী***************)
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা তোমাদের দান-সাদকাকে অর্থহীন বানিয়ে দিও না অনুগ্রহ দেখিয়ে ও কষ্ট দিয়ে সেই ব্যক্তির মত, যে তার মাল খরচ করে লোক দেখানোর জন্যে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না। এ ব্যক্তির এই কাজের দৃষ্টান্ত হচ্ছে শক্ত প্রস্তর, তার ওপর মাটি, মুষলধারার বৃষ্টি পৌঁছে শূন্য শক্ত প্রস্তরই ফেলে রাখাল। [আরবী***********]
ফকীর-মিসকীনের এ চেতনা থাকতে হবে যে, সে সমাজে অসহায় ধ্বংসশীল ব্যক্তি নয়। সমাজ তার জন্যে চিন্তা-ভাবনা করে। কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করে। তার ব্যক্তিত্বের জন্যে একটা বিরাট উপার্জন রয়েছে। তার মানসিকতার পবিত্রতা বিধানের ব্যবস্থাও আছে। তার এই চেতনাই তার জন্যে একটা বিরাট সম্পদ, গোটা উম্মতের জন্যে তা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়।
পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ব এবং মহান আল্লাহর নিকট তার সম্মান ও মর্যাদা-উভয়ই যুগপতভাবে দাবি করে যে, সমাজে এমন বারিদ্র্য থাকতে দেয়া হবে না, যা ব্যক্তিকে নিজেকে ও তার আল্লাহ্কে বিম্মৃত হতে বাধ্য করে, তার দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কে তাকে উদাসীন বানায়, তাকে গোটা জাতি থেকেও তার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে কেবল তার ক্ষুণা নিবৃওি, লজ্জা নিবারণ ও আশ্রয় অর্জনের চিন্তায়ই দিনরাত মশগুল থাকতে বাধ্য হবে। শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীতে এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
ইসলাম দারিদ্র্য ও লোকদের অভাব-অনটনকে ঘৃণা করে। কেননা ইসলাম চায় তাদের বৈষয়িক জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণ হোক-যেন সে তার চাইতেও বিরাট ও জাতীয় ব্যাপারসমূহে অংশ গ্রহণের অবসর পায়-যা মানবতার সাথে সায়ুঞ্জ্যপূর্ণ, আল্লাহ বনি আদমকে মর্যাদা দিয়েছেন তার সাথে সামঞ্জস্যশীল। নিশ্চয়ই আদম বংশকে আমরা সম্মানিত করেছি স্থল ও জলভাগে এবং তাদের রিযিক দিয়েছি পবিত্র জিনিসমূহ এবং তাদের মর্যদাবান বানিয়েছি যথার্থভাবে আমরা বহু সৃষ্টির ওপর। [আরবী*************]
আল্লাহ মানুষকে কার্যত সম্মানিত করেছেন বিবেক-বুদ্ধি পারস্পরিক আকর্ষণ এবং দৈহিক প্রয়োজনেরও ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মিক ভঅবধারা ও চেতনা দিয়ে। এক্ষণে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রাচুর্য থাকলেই এসব চিন্তামূলক ক্ষেত্রেও আধ্যাত্মিক চেতনা পরিতৃপ্ত রাখার সুযোগ পেতে পারে। আর যদি তা থাকে তাহলে তার এ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। তখন মানুষ নিতান্ত জীবজন্তুর পর্যায়ে নেমে যায়। তা-ও নয়, প্রায়ই তা থেকে বঞ্চিত থাকে না, উপরন্ত জন্তুরা খেলা করে, লম্ফ-ঝম্ফ দেয়, আনন্দ-উল্লাস করে। অনেক পাখী গলা খুলে গান গায়-ধ্বনি করে, জীবন নিয়ে নৃত্য করে এবং তা করে পেটভরা খাদ্য ও পানীয় পাওয়ার পর।
কিন্তু মানুষরে কি হয়েছে, আল্লাহ্র নিকট তার মান-মর্যাদারই বা কি মূল্য? তাকে তো খাদ্য পানীয়ের এতটা মশগুল করে রাখে যে পাখী ও জন্তু-জানোয়ারেরা কি পাচ্ছে; তা অনুধাবন করার মত শক্তিও তার থাকে না। তারা আল্লাহ্র নিকট সম্মানর্হ হওয়ার পর তাদের ওপর যে কর্তব্য-দায়িত্ব চেপেছে তা যথাযথভাবে পালন করার মত অবকাশও তারা পায় না। তার সময় ও শ্রম নিঃশেষ করেও যখন সে প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্যপানীয় পায় না, তখন তার ওপর এমন একটা আঘাত হয়ে পড়ে, যা আল্লাহ্র ইচ্ছা ও মর্জিকে আয়ও করার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। মানুষ যে সমাজে বাস করে, তা-ও ব্যাপারে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। তখন স্পষ্ট মনে হয়,এ এমন একটা পতিত সমাজ, যা আল্লাহ্র ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলেছে।
মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহ্র খলীফা। তাকে খলীফা বানানো হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, সে এ দুনিয়ার জীবনেকে প্রবৃদ্ধি দান করবে, তাকে উন্নত করে তুলবে। পৃথিবীকে সুন্দর চাকচিক্যময় করে সজ্জিত করবে। পরে তার সৌন্দর্য ও চাকচিক্য সে উপভোগ করবে। তারপরে আল্লাহ্র দেয়া এই অমূল্য নিয়ামতসমূহের শোকর আদায় করবে। কিন্তু মানুষ এ সবের কোন একটাও করতে পারে না, যদি তার জীবনটাই নিঃশেষ হয়ে যায় একমঠি অন্নের সন্ধানে, তা যতই যথেষ্ট ও পেটভরা হোক না কেন । তাহলে সেই তার জীবনের প্রয়োজনই যদি কেউ পূর্ণ করতে না পারল, তাহলে সে তার জীবনটা কীভাবে কাটাবে?
যাকাত হিংসা ও বিদ্বেষ দূর করে
যাকাত হিংসা ও ঘৃণা প্রভৃতি রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করে-দাতাকে যেমন, গ্রহীতাকেও তেমনি। তাই কোন মানুষকে যদি তার দারিদ্র্যের দন্ত দংশন করতে থাকে, প্রয়োজনের আঘাত যদি তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়-অথচ সে তার চতুর্দিকের মানুষকে মাহ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সহাকারে দিনাতিপাত করতে দেখতে পায়-মাহপ্রাচুর্যের পাহাড় জমে উঠাতে দেখা তাদরে ঘরে-সংসারে; কিন্তু তারা কেউ তার সাহায্যে হস্ত প্রসারিত না করে-দারিদ্র্যের উপর্যুপরি আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার জন্য তাকে অসহায় করে ছেড়ে দেয়, তাহলে এ ব্যক্তির হৃদয় হিংসা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প থেকে কি করে মুক্ত থাকতে পারে? তার হৃদয়ে পরশ্রীকাতরতা কেন জাগবে না? তার ক্ষতি সাধনের প্রবৃওি কেন তব্র হয়ে উঠবে না সেই সমাজের প্রতি যা তাকে অসহায় করে ছেড়ে দিয়েছে ধ্বংস হওয়ার জন্যে? সে সেই সমাজের কল্যাণের কোন চিন্তাই করতে পারে না। আসলে লোভ ও আত্মম্ভরিতা প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তির প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষই সৃষ্টি করে।
ইসলাম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের সমন্বকারী ভ্রাতৃত্বের ভিওিতে পড়ে তোলে। আর সেই ভ্রাতৃত্বের আসল কথা হচ্ছে অভিন্ন মনুষ্যত্ব ও আকিদা বিশ্বাসের পরম ঐক্য ও একাত্মতা। ইসলামের আহ্বানঃ
(আরবী***********)
তোমরা সকলে আল্লাহ্র বান্দাহ ভাই হয়ে যাও। [মুসলিম, আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত।]
(আরবী**********)
মুসলমান মুসলমানের ভাই। [বুখারী, মুসলিম ইবনে উমর থেকে, মুসলিম উকবা ইবনে আমের আবূ দাউদ, আমর ইবনুল আহওয়াস ও কিবলা বিনতে মাখরামা থেকে। দেখুনঃ (আরবী***********)]
কিন্তু এক ভাই যদি পেট ভরে খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে থাকে আর অন্য ভাইদের ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করার জন্যে ছেড়ে দেয়া হয় আর সে তাদের দেখতে থাকে কিন্তু তাদের প্রতি সাহায্যের হস্ত প্রসারিত না করে, তাহলে তাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃত্ব কখনই কায়েমে হতে ও স্থয়ী হতে পারবে না।
তার পরিণতি হচ্ছে ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করা এবং ফকীর ও বঞ্চিতের মনে ঘৃণা ও হিংসার আগুন প্রজ্বলিত করা ধনী ও পরিতৃপ্ত লোকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইসলাম তা চায় না। মুসলমান সমজকে সে অবস্থা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।
কেননা হিংসা ও বিদ্বেষ বিচ্ছিন্নকারী রোগ, হত্যাকারী বিপদ, ব্যক্তি ও সমাজকে পর্যুদস্তকারী মহাক্ষতির কারণ।
হিংসা দ্বীনের একটা সহাবিপর্যয়। কেননা তা হিংসাকারীর দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের রিযিকদানের ক্ষেত্রে যে বণ্টননীতি কার্যকর করেছেন, সে সম্পর্কে তার মনে অনেক প্রকারের খারাপ ধারণা জেগে ওঠে। লোকদের পরস্পরের মধ্যে যে সামজিক জুলুম নির্যাতন চলতে থাকে, তাই চরম বিদ্রোহের সৃষ্টি করে। এ কারণে কুরআন মজীদ ইয়াহুদীদের পরিচিতিস্বরূপ বলেছেঃ
(আরবী************)
ওরা কি লোকদের প্রতি হিংসা পোষণ করে আল্লাহ্ তাঁর যে অনুগ্রহ তাদের দিয়েছেন সে জন্যে? [আরবী**********]
হিংসা ও শত্রুতা, ক্রোধ ও আক্রোশ এমন সব বিপদ, যা জরাজীর্ণ করে দেয় ব্যক্তির দৈহিক ও আত্মিক সওাকে। সমাজের বৈষয়িক ও আত্মিক সংস্থাকেও ভেঙ্গে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এরূপ অবস্থায় যে ব্যক্তি হৃদয় হিংসার লড়াইয়ে তৎপর হয়, ঘৃণা ও ক্ষতির ইচ্ছা তাকে করায়ও করে, সে কখনই পূর্ণ ঈমানদার মানুষ হতে পারে না। কেননা আল্লাহ্র বান্দাহদের প্রতি হিংসা যে হৃদয়কে বিষাক্ত করে তোলে সেখানে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান কখনই স্থান পেতে পারে না।
হিংসা ও ঘৃণা আক্রোশ-একটা প্রকৃতিগত রোগ, যেমন পাকস্থলীতে জখম ও রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া। হিংসা ও ঘৃণা সামাজিক উৎপাদন ও অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। হিংসুক ঘৃণা জর্জরিত মানুষ উৎপাদরকে দুর্বল করে-যদিও সম্পূর্ণ বন্ধ্যা বানিয়ে দেয় না। সে কাজ ও উৎপাদনে সনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে হিংসার ও ঘৃণা ও আক্রোশেই সমস্ত ক্ষমতা নিঙড়িয়ে ব্যয় করে। এ কারণে ইসলামের নবী যদি এ সব বিপদকে ‘জাতীয় রোগ’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন এবং সে বিষয়ে লোকদের সাবধান করে দিয়ে থাকেন, তাহলে তা কিছু মাত্র বিম্ময়ের কথা নয়। এগুলো বিচ্ছু ও বিষাক্ত কীটের মত নিঃশব্দে লোকদের মধ্যে প্রবেশ করে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহ থেকে জাতীয় রোগসমূহ নিঃশব্দে তোমাদের মধ্যে এসে গেছে, তা হচ্ছে-হিংসা-ক্রোধ, আক্রোশ ও প্রতিহিংসা-এগুলো তো নির্মূলকারী। তাবে আমি একথা বলছি না যে, তা চুল কামিয়ে দেয় বরং বলছি, তা দ্বীনকে নির্মূল করে। [হাদীসটি বাজ্জার উদ্ধৃত করেছেন উওম সনদে এবং বায়হাকী প্রমুখও (আরবী*************)]
ইসলাম এসব মনস্তাও্বিক সামষ্টিক কঠিন রোগসমূহের কেবল ওয়ায-নসীহত ও মৌলিক উপদেশ দ্বারাই মুকাবিলা করেনি এবং তা করাকেই যথেষ্ট মনে করেনি। বরং ইসলাম কার্যত ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সবের কারণসমূহকে জীবন ও সমাজ থেকে উৎপাটিত করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, কেননা ক্ষুধা-কাতর বঞ্চিত বিবস্ত্র মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষের বিপদ বিপর্যয় সম্পর্কে একটা মর্মস্পর্শী ওয়ায শুনিয়ে দেয়াই কখনও যথেষ্ট হতে পারে না। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই তো দুঃখময়, শুষ্ক, নির্মম। আর তার চুতর্দিকে রয়েছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিতৃপ্ত মহাবিলাসী মানুষের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনধারা। তা তাদের সম্মুখে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের বাস্তব নিদর্শনাদি উপস্থাপিত করছে। এরূপ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে হিংসা জাগবে না কেন? পরশ্রীকাতরতায় তারা জর্জরিত হবে না কেন? বিদ্বেষের আগুন তাদের হৃদয় মনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে না কেন? এই কারণেই তো ইসলাম যাকাত ফরয-বাধ্যতামূলক করেছে। করেছে এজন্যে যেন বেকার কাজ পায়, অক্ষম উপার্জনহীন মানুষও বাঁচার স্থানে আপন জনের মধ্যে ফিরে যেতে পারে। তাবেই না মানুষ অনুভব করতে পারবে-তারা পরস্পরের ভাই, পরস্পরের অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক। প্রয়োজন ও অভাবের সময় অন্য লোকদের ধন-মাল তাদেরই ধন-মাল হবে। ব্যক্তি অনুভব করবে তার ভাইয়ের শক্তি সে তো তারই শক্তি-যদি সে দুর্বল হয়ে পড়ে, তার ভাইয়ের ধনাঢ্যতা তার জন্যে সাহায্য, যদি সে দরিদ্র হয়ে পড়ে। বস্তুত এরূপ পরিচ্ছন্ন পরিবেশেই ঈমানের ছায়া বিস্তার হওয়া সম্ভব, লোকদের মধ্যে জাগতে পারে ভালোবাসা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। রাসূলের কথাঃ
(আরবী*************)
তোমাদের কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তাই পসন্দ করবে, যা পসন্দ করে সে নিজের জন্যে। [হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজা আনাস থেকে। (আরবী*************)]
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যাকাতের লক্ষ্য এবং সমাজ-জীবনে তার প্রভাব
যাকাতের সামাজিক সামষ্টিক লক্ষ্য স্পষ্ট অতীব প্রকট। এতে কোন সন্দেহ নাই। যাকাতের ব্যয় খাতসমূহের ওপর চোখ বুলালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার ওপর এক তড়িৎ দৃষ্টিও আমাদের সম্মুখে এই মহাসত্য প্রতিভাত করে তোলে যেমন রাতের অবসানে পৃথিবী চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে প্রত্যক্ষ হয়ে।
সুরা তওবার এ আয়াতটি যখন আমরা পাঠ কিরঃ
নিঃসন্দেহে যাকাত-সাদকাত কেবলমাত্র ফকীর-মিসকীন, তার জন্যে নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করতে হবে- এদের জন্য এবং ক্রীতদাস ঋণগ্রস্ত, আল্লাহ্র পথ ওনিঃস্ব পথিকের ব্যাপারে নিয়োজিত হওয়ার-আল্লাহ্র নিকট থেকে ফরয করে দেয়া।
তখন আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ লক্ষ্যসমূহের একটা দ্বীনী রাজনৈতিক রূপ রয়েছে। কেননা তা দ্বীন ও রাষ্ট্র হিসেবেই ইসলামের সাথে মিলিত হয়। যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করতে হবে এবং আল্লাহ্র পথে-প্রধানত এ দুটি অংশই সেদিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে।
এ দু্ই ব্যয়খাত দাবি করছে, দ্বীন-ইসলাম একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধান, এ রাষ্ট্র যাকাতসমূহ ধন-মালের মালিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে তার জন্যে নিযুক্ত কর্মচারীদের মাধ্যমে। পরে তা ব্যয় করা হবে ইসলামের দাওয়াত প্রচার ও তার কালেমার বিস্তার সাধনের কাজে, তার ভূমিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে আর তা হবে লোকদের হৃদয় আকৃষ্টকরণ এবং জাতিসমূহের সেদিকে দাওয়াত দেয়ার দ্বারা। কেননা ‘আল্লাহ্র পথের দিকে রায়েছে ইসলামের উদাও আহ্বান।
‘যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের বিস্তরিত ব্যাখ্যার আলোচনা আমরা এ দুটি খাত সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কথা বলে এসেছি। এক্ষণে তার ওপর নতুন করে দৃষ্টি নিক্ষেগ করা আবশ্যক। এ পরিচ্ছেদে আমরা আলোচনা করব ‘মুসলিম সমাজ ও ইসলামী উম্মতের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সাথে যাকাতের সম্পর্ক।’
যাকাত ও সামজিক নিরাপওা
উপরিউক্ত লক্ষ্য ও খাতসমূহ সামাজিক-সামষ্টিক রঙে রঙিন। অভাবগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করা, ফকীর-মিসকীন ঋণগ্রস্ত ও নিঃস্ব পথিক প্রভৃতি দুর্বল লোকদের হাত ধরে উপরে উঠানো ইত্যাদি, এদের সাহায্য ও সহযোগিতা দান তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে তাদের ব্যক্তি হওয়া হিসেবে যেমন, তেমনি সমাজসমষ্টির ওপরও পড়বে এ হিসেবে যে, তারা সকলে পরস্পর সংযুক্ত এক অভিন্ন দেহ সংস্থা বৈ কিছু নয়।
সত্রি কথা। ব্যক্তি ও সমষ্টির সীমা পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট, ব্যক্তিদের সমষ্টিই সমাজ। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যতটা শক্তিশালি হবেম তার প্রতিভাসমূহ উৎকার্ষিত হবে এবং তার বস্তুগত ও অন্তর্নিহিত শক্তিসামর্থ্য যতটা বিকাশিত হবে, সমাজ ঠিক তাতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ততটাই উৎকর্ষ লাভ করবে-এত আর কোনই সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে সমাজের ওপর যা কিছু সাধারণভাবে প্রভাব বিস্তার করবে, তা তার ব্যক্তিদের ওপরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে-তারা তা অনুভব করতে পারুক আর নাই পারুক।
অতএব বেকারকে কাজ দেয়া, অক্ষমকে সহযোগিতা দেয়া এবং ফকীর-মিসকীন দাস-ঋণগ্রস্ত প্রভৃতি ঠেকে যাওয়া লোকদের সাহায্য করা ‘সামাজিক সামষ্টিক লক্ষ্য’ গণ্য করা-কিছুমাত্র বিম্বয়ের ব্যাপার নয়। কেননা এ সব কাজের মাধ্যমেই সমাজ-সমষ্টিক ধারণ করা সামজিক নিরাপওা বিধান করা সম্ভব হয়ে থাকে। এ সব কাজ একই সময় যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের লক্ষ্য এ সব যাকাত গ্রহণকারী লোকদের বিচারে, তেমনি সামষ্টিক সামাজিকও।
বস্তুত যাকাত ইসলামে সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থার একটা অংশ। পাশ্চাত্য এ সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থা খুবই সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করে। তা কেবল অর্থনৈতিক রিাপওা। দারিদ্র অক্ষম লোকগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই তারা এ কার্য সম্পাদন করে। কিন্তু ইসলাম সামাজিক নিরাপওার এ ব্যবস্থাকে একটি বিশাল ও গভীর পরিমন্ডলে তুলে ধরেছে। বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় জীবনের সমগ্য দিকেই তার অন্তর্ভুক্ত। এখানে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক নিরাপওা আছে, জ্ঞান ও শিক্ষাগত নিরাপওা আছে, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষামূলক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, ফৌজদারী ইবাদতমূলক সভ্যতা সংক্রান্ত এবং সর্বশেষে জৈবিক জীবনের পূর্ণ নিরাপওার ব্যবস্থা কার্যকর অথচ আজকের দিনে ভুলবশত তার নাম দেয়া হয়েছে শুধু ‘সামাজিক নিরাপওা।’ [ডঃ মুস্তফা সাবায়ী রচিত (আরবী*************) গ্রন্থে এ ধরনের নিরাপওা ব্যবস্থাসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে।]
‘সামাজিক নিরাপওা’ এখন যাকাত অপেক্ষাও অধিক ব্যাপক ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা। কেননা সমগ্র জীবনের শাখা প্রশাখাসমূহের তা বাস্তবভাবে কার্যকর হয়ে চলছে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্ত দিক-ই তার অন্তর্ভুক্ত। এ সমস্ত শাখা বা প্রশাখার একটা অংশ হচ্ছে যাকাত। তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এখানকার সামাজিক বীমা ও সামাজিক নিরাপওা দুটিই। ‘সামাজিক বীমা’ ও ‘সামাজিক নিরাপওা’ এ দুটির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে বীমায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের আয় থেকে কিস্তি দিতে হবে। আর সামাজিক বা স্থায়ী অক্ষমতা দেখা দিলে তখন সে তা থেকে উপকৃত হবে। কিন্তু ‘নিরাপওা’ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রিই তার রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে এর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সমাজের ব্যক্তিদের সেজন্যে নির্দিষ্ট হারে কোন কিস্তি দিয়ে তাতে শরীক হতে হবে না।
এমন দেখা গেছে, বহু লোক যারা এ বছর যাকাত দিয়েছে, পরবর্তী বছর হয়ত তারাই যাকাত পাওয়ার যোগ্র বিবেচিত হয়েছে। কেননা তখন তাদের হাতে তাদের প্রয়োজন পূরণ পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকেনি অথবা উপর্যুপরি এমন সব বিপদ-আপদ এসছে, যার ফলে তারা নিজেদের ও নিজেদের পরিজনের প্রয়োজন পূরণের জন্যে হয়ত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অথবা তারা নিজেদের দেশ ঘর-বাড়ী থেকে বহু দূরে হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাকাতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনি তারা আরও অনেক কিছু হতে পারে। এ দিকে দিয়ে তা সামাজিক বীমা পর্যায়ের। এদের মধ্যে এমন অনেজ লোকই হয়ত আছে পূর্বে যাদের ওপর যাকাত ফরয হয়েছেল। এজন্যে তখন তারা যাকাতের কোন অংশ পায়নি। কিন্তু এক্ষণে তাদের দারিদ্র্য ও অভাবের জন্যে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয়েছে। এ হিসেবে যাকাত হচ্ছে ‘সামাজিক’ ব্যবস্থা। [(আরবী*************)]
তা ছাড়া যাকাত বাস্তবিকপক্ষে বীমার পরিবর্তে ‘সামাজিক নিরাপওার নিকটবর্তী ব্যবস্থা।’ কেননা তাতে বীমার মত ব্যক্তিদের কোন পরিমাণের কিছু (প্রিমিয়াম) দেতে হয় না, ব্যক্তিকেও তা থেকে দেয়া হয় ততটুকু পরিমাণ, যা তার জন্যে প্রয়োজন। তা কমও হতে পারে, বেশীও হতে পারে।
যাকাত এ কারণে ‘সামাজিক নিরাপওা‘র পথে সর্বপ্রথম বাস্তব ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত নফল দান সাদকার ওপর তা নির্ভরশীল নয়। বরং তা সরকারী সুসংগঠিত ও আবর্তনশীল সাহায্যদানের ওপর চলে। এ সব সাহায্যের লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ। এ প্রয়োজন পূরণ খাদ্য, বস্ত্র-বাসস্থান অন্যান্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে। তা হবে ব্যক্তির জন্যে, ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল পরিজনদের জন্যে-কোনরূপ অপচয় বা ব্যয় বাহুল্য কিংবা কার্পন্য ছাড়াই।
বস্তুত মানুষের যত প্রকারের প্রয়োজনের কথাই চিন্তা করা যায়, যা ব্যক্তিগত অক্ষমতা কিংবা সামাজিক বিপর্যয়ের দরুন সৃষ্ট হয়-তা সবই পূরণ করে যাকাত। এমন সব অবস্থাও দেখা দিতে পারে যা থেকে কোন মানুষই সাধারণত রক্ষা পায় না। ইমাম জুহরী উমর ইবনে আবদুল আজীজ-খলীফাকে ‘যাকাতের ক্ষেত্রে সুন্নতের ভূমিকা’ সম্পর্কে যা লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা আমরা পড়ি, নিশ্চয়িই তাতে অংশ রয়েছে সাময়িকভাবে অভাবগ্রস্ত বেকার বসে থাকা লোকদের জন্যে, প্রত্যেক মিসকীনের জন্যেও তাতে অংশ রয়েছে-যার কোন বিপদ বা রোগ হয়েছে, পরিবারবর্গের ভরন-পোষণ করতে এবং দুনিয়য় ঘোরাফেরা করতে সমর্থ হচ্ছে না। যেসব মিসকীন ভিক্ষা করে, তাদের জন্যেও অংশ রয়েছে- তাদেরও খাবার প্রয়োজন (শেষ পর্যন্ত তারা না।) যেসব মুসলমান কারাবন্দী হয়ে আছে তাদের জন্যেও একটা অংশ রয়েছে-যাদের কোন অভিভাবক নেই। মসজিদসমূহে যেসব মিসকীন আছে ভিক্ষার জন্যে-যাদের সাধারণত দেয়া হয় না, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট অংশও নেই। (যাদের জন্যে মাসিক বৃওি নির্ধারিত হয়নি-বিধিবদ্ধ সুসংগঠিত কোন অর্থ ব্যবস্থাও নেই) তা সও্বেও তারা লোকদের কাছে চেয়ে বেড়ায় না- ভিক্ষা করে না। যে লোক দারিদ্র হয়ে পড়েছে, তার ওপর ঋণও চেপেছে, সে ঋণ থেকে আল্লাহ্র নাফরমানির কাজে কিছুই ব্যয় করা হয়নি, তার দ্বীনী চরিত্রে কোন দোষরোপ নেই অথবা ঋণের মধ্যের কোন ফাঁকি নেই। আশ্রায়হীন প্রত্যেক পথিকও তা থেকে অংশ পাবে, যার এমন দেয়া হবে, খাবার দেয়া হবে এবং তার জন্তু বাহনকে ঘাস (এ কালে বাহন যন্ত্রকে তেল বা ভাড়া) দেয়া হবে যতক্ষণ না সে বসবাস ও অবস্থানের কোন স্থান লাভ করেছে অথবা তার প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা হয়েছে। [দেখুনঃ (আরবী*************)]
এ ব্যবস্থা সকল প্রকার অভাবগ্রস্ত ও ঠেকায় পড়া লোকদেরই নিরাপওার জন্যে। তাদের সর্বপ্রকারের প্রয়োজনের জন্যেও, তা দৈহিক, মানস্তাও্বিক ও বুদ্ধি-বিবেকগত যা-ই হোক না কেন। বিবাহ করিয়ে দেয়াকেও মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তা কেমন করে হল, তা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। বিদ্যার্থীর জন্যে জ্ঞান আহরণের বই-পুস্তক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত, তা কি করে হল, তা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।
এ ব্যবস্থা কেবল মুসলমানদের জন্যেই নয়। মুসলমানদের রাষ্ট্রে ইয়াহুদী, খৃষ্টান (হিন্দু, বৌদ্ধ) যারাই বসবাস করবে তাদের সকলের জন্যেই এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। হযরত উমর (রা) একজন ইয়াহুদীকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখে তার জন্যেও এ ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমানদের বায়তুলমাল থেকে তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা ছিল তার জন্যে এবং তার মত অন্যান্য লোকদের জন্যে একটা সূচনামূলক ব্যবস্থা। [(আরবী*************)] তেমনি তিনি দামেশক যাওয়ার পথে খৃষ্টান লোকদেরকে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত দেখতে পেয়ে ইসলামী বায়তুলমাল থেকে তাদের জন্যে জীবিকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [(আরবী*************)]
বস্তত এই হচ্ছে ‘সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থা’। পাশ্চাত্য জগত এরূপ ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়েছে খুব বেশী দিনের কথা নয়। তার যা-ও বা চিন্তা করেছে খালেসভাবে আল্লাহ্র জন্যে তা করেনি, দুর্বল লোকদের প্রতি দয়াপরবশ হয়েও তা করেনি, ক্রমাগত বিদ্রোহ-বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিষ্ট মতবাদের আঘাত তাদেরকে এরূপ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত পরিস্থিতিও তা করার প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে। জনগণকে খুশী করার উদ্দেশ্যেই তা করা হয়েছে। রক্ত ও ঘাম পানি করে শ্রম করে যেতে অব্যাহতভাবে তাদেরকে প্রস্তুত রাখার মতলবেই তা করেছে যেন তারা কখনই বিদ্রোহী হয়ে উঠতে না পারে।
এরূপ সরকারী নিরাপওা ব্যবস্থা সর্বপ্রথম গৃহীত হয় ১৯৪১ সনে। এ সময় বৃটিশ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক চুক্তিতে ব্যক্তিবর্গের সামাজিক নিরাপওা দানের বাধ্যাবাধকতার ওপর একমত হয়। [(আরবী*************)]
কিন্তু তা সও্বেও তা ইসলাম নিরাপওা ব্যবস্থার পর্যায়ে দেশের সকল অধিবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করার এবং তাদের পরিবারের সার্বিক মৌল প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব নেয়ার দিক দিয়ে উন্নীত হতে পারেনি। ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সমর্থকবৃন্দ ফকীর-মিসকীনের সারা জীবনের প্রয়োজন পূরণ এবং যাকাত দ্বারা তাদেরকে স্থয়ীভাবে সচ্ছল বানিয়ে দেয়ার-যেন অতঃপর কোনদিনই আর কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা মাখাপেক্ষী না হয়-যে কথা বলেছেন তার সমান ব্যবস্থা নেয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার।
ইসলাম সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থা গ্রহণ এ সব রাষ্ট্রের বহু বছর পূর্বেই যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। দ্বীন তা ফরয করেছে, রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন করার সংস্থা কায়েম করেছে। এ উদ্দেশ্যে তলোয়ারও চালিয়েছে ধনী লোকদের মুঠ থেকে গরীব জনগণের অধিকার আদায় ও মক্ত করার লক্ষ্যে। তা সও্বেও আমরা লক্ষ্য করছি, বহু লেখকই সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থায় ইউরোপের অবদানকে অগ্রবর্তিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের জন্য কলম চালিয়েছেন। কিন্ত আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও উওরাধিকার তার ওপর মাটি নিক্ষেপ করছে।
এ পর্যায়ে উল্লেখ ঘটনা হচ্ছে, আরবী রাষ্ট্রসমূহের বিশ্ববিদ্যালয় জোট দামেশকে শহরে ১৯৫২ সনে সমাজবিদ্যা অধ্যয়নের একটা চক্র আহ্বান করে। এ চক্রকে ‘সামাজিক নিরাপওা’ বিষয়ে অধ্যয়নের বিশেষ দায়িত্ব দেয়। চক্রের পরিচালক-মিঃ দানীল এস জীরজ ‘সামাজিক নিরাপওা’ শিরোনাসে একটা রচনা পেশ করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেনঃ
প্রাচীনকালের অভাবগ্রস্ত লোকদের সম্মুখে না খেয়ে মরার হাত থেকে বাঁচার জন্যে লোকদের কাছে সাহায্য চাওয়া বা সাদকা পেতে চেষ্টা করা ছাড়া আ কোন উপায় ছিল না। সরকারীভাবে গরীব লোকদের সাহায্য করার জন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ইতিহাস সপ্তদশ শতাব্দীতে সূচিত হয়। জাতীয় সংস্থার পক্ষ থেকে গরীব লোকদের সাহায্য করার সংগঠন পড়ার প্রথম পদক্ষেপ তখন গৃহীত হয়……….[(আরবী************)]
এরূপ ইতহাস রচনার কারণ ইসলামের ইতিহাস ও যাকাত ফরয হওয়ার মৌল তও্ব সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। পূর্বে যেমন বলেছি, এতে সন্দেহ নেই যে, মুসলিম সরকারই যাকাত সংগ্রহ করে এবঙ তা বণ্টনেরও দায়িত্ব পালন করে। তা ব্যক্তিগত কোন দয়া বা অনুগ্রহের ব্যাপার নয় আদৌ। আর তা কোন নফল দানও নয়। যাকাত বস্তুতই অভঅবগ্রস্ত লোকদের জন্যে নির্ধারিত ও সর্বজনজ্ঞাত অধিকার বিশেষ। আর ধনী লোকদের প্রতি তা বাধ্যতামূলকভাবে দেয় সনির্দিষ্ট কর। মুসলিম রাষ্ট্রই এ কর আদায় করে এবং বণ্টন করে। তবে যাকাত তার স্থায়িত্ব ও চিরন্তনতার দিক দিয়ে সাধারণ রাষ্ট্রসমূহের ধার্য করা কর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর জিনিস। রাষ্ট্রসরকার যদি কখনও তার প্রতি অবহেলা করে এবং তা আদায় না করে তাহলে তখনও তা আদায় না করা পর্যন্ত কোন মুসলিম ব্যক্তির ইসলাম সহীহ হবে না, তার ঈমান পূর্ণ হবে না, এবং তা আদায় করতে হবে আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তষ্ট করার উদ্দেশ্যে মাত্র। আর নিজের তাজকীয়া এবং তার ধন-মালের পবিত্রতা এ উপায়েই হতে পারে। ব্যক্তির জন্যে যা ফরয করে দেয়া হয়েছে, সে তা নিজের মনের আগ্রহে ও উৎসাহে আদায় করবে। তাতে কোনরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শনের ও পীড়াদানের একবিন্দু ইচ্ছাও থাকবে না। এরূপ অবস্থায় যে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তা গ্রহণ করবে, সে তা গ্রহণ করবে-ইমলাম তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর কোন কোন বান্দাকে তার মালের ওপর খলীফা বানিয়েছেন, সেই মালে তার জন্যে হক নির্দিষ্ট করে ধার্য করা হয়েছে, এটা তার প্রাপ্য অধিকার। সমাজকে দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে এজন্যে। এ জানা অধিকার আদায়ের জন্যে যুদ্ধ করতে হলেও সমাজ তা করতে বাধ্য।
যাকাত ও অর্থনৈকিত রূপায়ণ
গোটা অর্থনীতির ওপর যাকাত ব্যবস্থার প্রত্যেক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। পূর্বের পরিচ্ছেদে আমরা বলে এসেছি, ধনীদের কাছে থেকে যাকাত যা কিছু নেয়া হয়, তাই তাদেরকে অধিক কর্মে উদ্বুদ্ধ করে-যা নেয়া হয়েছে তার বিনিময়ে।
নগদ সম্পদের যাকাতের বেলায় এ কথাটি খুবই স্পষ্ট। কেননা ইসলাম নগদ সম্পদেকে সঞ্চয় করাকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। তার আবির্তিত ও উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগকৃত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করাও নিষিদ্ধ। এ পর্যাযে আল্লাহ তা‘আলার বজ্রকঠিন ঘোষণা এসেছেঃ
(আরবী************)
আর যারাই স্বর্ণ ও রৌপ্য পূঁজি করে রাখবে এবং তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করবে না, তাদের পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।
শুধু এ কঠোর ঘোষনা দিয়েই কুরআন ক্ষান্ত হয়নি; বরং পুজিকরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছে এবং নগদ সম্পদকে ভান্ডার ও ব্যাংক হিসাবে থেকে বের করার সরকারী পদক্ষেপ গ্রহণেরও নির্দেশ দিয়েছে। তা এভেবে যে, ইসলাম যখন নগদ সম্পদের ওপর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত বাবদ দেয়া ফরয করেছে-মালিক তা উৎপাদনে বিনিয়োগ করে থাকুক, কি না-ই করুক তখন এ যাকাত বাবদ বের করা নগদ সম্পদই একটা চাবুক হয়ে তাকে পরিচালিত করবে অধিক শ্রম করে, উৎপাদন করে উপার্জন করতে ও প্রবৃদ্ধি লাভ করার দিকে। এ কাজ সে বছরের পর বছর করে যেতে থাকবে। এ পর্যায়ে বহু হাদীস এবং সাহাবীদের উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। যেমনঃ
(আরবী************)
তোমরা অভিভাবকরা ইয়াতীমদের মাল নিয়ে ব্যবসা কর, যেন তাদের মাল যাকাত খেয়ে না ফেলে।
নগদ সম্পদের যাকাত পর্যায়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। যাকাত যে মূলধানের ওপর ধার্য হয়, তাও ব্যাখ্যা করেছি।
যাকাত ও জাতির আধ্যত্মিক উপাদান
সর্বোপরি যাকাতের অনেক লক্ষ্য রয়েছে-প্রভাব রয়েছে মুসলিম উম্মতের উন্নতমানের জীবন যাত্রা নির্বাহের ব্যবস্থা বাস্তবায়নে। এ উম্মত সেভাবেই জীবন যাপন করেবে তার আধ্যত্মিক উপাদানসমূহ যার ওপর তার ভিওি স্থাপিত, তার কাঠোমো সংস্থাপিত-সংরক্ষিত হবে এবং তার ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হবে।
উস্তাদ বহী আল খাওলী যেমন বলেছেন, উম্মত তার আধ্যাত্মি শক্তি-সামর্থ্যের বলেই গড়ে উঠতে পারে, কেবল বস্তুগত শক্তির বলে নয়। বরং জাতি গঠনের বস্তগত শক্তি সামর্থ্যের কোন মূল্যই নেই, আধ্যাত্মিক শক্তি-সামর্থ্য ছাড়া তার সংগঠন সওা গড়ে উঠতে পারে না। এজন্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলাম আধ্যাত্মিক শক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সমষ্টিক ধন-মাল ব্যক্তিবর্গের জন্যে ব্যয় করা এবং ব্যক্তিগণের সাহায্য কাজে তৎপর হওয়াকে ইমলাম ফরয ঘোষণা করেছে- অপরিহার্য কর্তব্য বলেছে। তা সমষ্টিক আধ্যাত্মি অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, যেমন খাদ্যপানীয় তিনটি মৌল নীতিতে সন্নিবদ্ধ ও সবিন্যস্ত করে দিয়েছে-যাকাত ব্যয় সংক্রান্ত আয়াত সে দিকে ইঙ্গিত করেছে।
প্রথম মৌল নীতিঃ সমাজের ব্যক্তিগণের স্বধীনতা সংরক্ষিত করা। কিন্তু এ স্থানে দাসমুক্তির ওপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে অর্থাৎ ক্রীতদাসদেরকে দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করার-এ লাঞ্ছনা তিরোহিত করা। দাসমুক্তির পর্যায়ে উচ্চতর আইন ক্ষেত্রে বিশ্বমানবতা সর্বপ্রথম ইমলামের এ অবদানই লাভ করেছে। তাদের ধন-মালের নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে তাদের মুক্তকরণকে মুসলমানদের জণ্যে ফরয করে দিয়েছে। যাকাত সংক্রান্ত আয়াতে এ সত্যটি ধ্বনিত ও স্থপিত হয়েছে আল্লাহ্র কথা (আরবী************) ‘এবং দাস মক্তিতে’।
দ্বিতীয় মৌল নীতিঃ ব্যক্তিগণের সংকল্প ও পুরুষোচিত ভাবধারোকে কল্যাণময় কাজে নিয়োজিতকরণ, যা সমষ্টিক জন্যে সাংস্কৃতিক ও অনুভবনীয় লাভ সৃষ্টি করে অথবা কোন অপসন্দনীয় অবস্থায় মধ্যে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
তা এজন্যে যে, ব্যক্তিগণের মধ্যে কল্যাণ প্রেমের সীমাহীন শক্তি নিহিত রয়েছে। বিভিন্ন সামষ্টিক অবদান রাখার যোগ্যতাও তাদের মধ্যে রায়েছে। তা বিবেক, বুদ্ধির অবদানের মতেই অমূল্য। আল্লাহ তা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিজ সওার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে যেন সে জীবনে তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। কেননা মানসিক শক্তিকে উৎকর্ষদান এবং তার ভূমিকা বাস্তবায়ন একান্তই কর্তব্য-যেন সে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে জীবনে। তাই ব্যক্তিগণের মধ্যে প্রকৃতিগত প্রতিভার উৎকর্ষ সাধন অধিক উওম এবং বেশী অধিকারসম্পন্ন। কেবল তার ফলশ্রুতি এবং জীবনে যে ঔদার্যের ভাবধারা ফুটে ওঠে কেবল সেজন্যে নয়। বরং এজন্যে যে, আমাদের জন্যে মূল্যবান ব্যক্তি তৈরী করার একমাত্র পন্থাও তাই। উম্মতের জন্যে তার উচ্চ মহান মানসিকতার মৌলিক সম্পদ কেবল এভাবেই পাওয়া সম্ভব। কোন কল্যাণময় কাজই ভল নয়-যে মন তা করে কেবল তা-ই ভাল। আর যে নিয়ত মনোভাব তা করায়, তা-ই ভাল। যে জাতি এ পন্থাকে অবলম্বন করে সে শক্তির কার্যকারণ ও মর্যাদার সম্স্ত উপকরণে সমৃদ্ধ হতে পারে। তাই মর্যাদাও জীবনের যোগ্যতার জন্যে যথেষ্ট। তা-ই কল্যাণে দৃঢ় সংকল্প জাগিয়ে তোলে ভালোবাসার সাহাত্ম্য সৃষ্টি করে। সত্যেল প্রতি পুণ্যময় আহরণের জন্যে তা যথেষ্ট, মূল জীবনের জন্যেও তা কল্যাণকর। মন ও প্রকৃতির উৎস থেকে তা যা কিছু বের করে তা খুবই মূল্যবান সম্পদ। মন খনির সর্বোওম উৎপাদন তা। জীবনকে তা উওম তাৎপর্য দান করে। মনূষ্যত্বকে তা সর্বোচ্চ মানে উন্নীত করে। আর তা-ই হচ্ছে সেই উচ্চতর আদর্শ যার ওপর মনুষ্যত্ব ও মানুষের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে আল্লাহ তা‘আলা চেয়েছেন।
অতএব সমাজের কর্তব্য হচ্ছে তার ব্যক্তিগণের মনের মধ্যে সেই শক্তিসমূহ জাগ্রত করবে, তদ্দারা তাকে হুঁশিয়ার করবে। জাগিয়ে তুলবে এবং প্রবৃদ্ধি ঘটাবে। তাকে নিষ্ক্রিয় ও স্থবির করে রাখবে না-যার ফলে তার কর্মশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েতে পারে, তার ভিততে নিহিত শক্তি উৎসসমূহ মুছে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন তাদের একেকজন প্রস্তুত থাকতে তার ধন-মাল সম্পূর্ণভাবে ব্যয় করতে এবং শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব হয়ে যেতে-যেন তার উম্মতের এমন এক-একটি অন্যায়ের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়, যার দরুন গোটা জতির শাস্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারত। তাদের কিছু লোকের হৃদয়ে যে প্রতিহিংসা ও ক্রোধ জেগে ওঠেছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এ ব্যক্তিকে-যার মনুষ্যত্বেবোধ এতটা করেছে-যদি দারিদ্যের ক্রোড়ে ঠেলে দেয়া হয় এবং তার এ কর্মের সুফল থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে সে আবার কখনই অনরূপ মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন কল্যাণকর কাজে ফিরে আসবে না, যদি একবার এ আছাড়া খাওয়া থেকে সে উঠবার সুযোগ পায়। অতঃপর সে অপর কোন মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষের অনুসরণও করবে না। অতএব সত্য ও ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে, এই যে ব্যক্তি অথবা এ সামষ্টিক সম্পদে সাধারণভাবে মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে একটা অংশ ধার্য হওয়া একান্তই আবশ্যক। তাদের মধ্যে যে জনকল্যাণমূলক কাজ করার প্রবৃওি রয়েছে, তাকে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে তাদের কেউ দারিদ্র্যের আঘাত আহত হবে না।– পূর্বে জাতির জন্যে সে যে কল্যাণমূলক কাজ করেছে, তার জন্যে। ঠিক এ কারণেই ইমলাম তাদের জন্যে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং মহান আল্লাহ তা‘আলাও যাকাতের আয়াত স্পষ্ট করে বলেছেনঃ (আরবী************) ‘এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিগণ’।
তৃতীয় মৌল নীতীঃ মানুষের অন্তরে নিহিত প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ‘তাজকিয়া’র উদ্দেশ্যে’ যে সব আকীদা-বিশ্বাস এবং শিক্ষা ও আদর্শ অবতীর্ণ হয়েছে, বিশেষ করে আল্লাহ্র কাছে সম্পর্ক রক্ষা পর্যায়ের হুকুম-আহকাম, ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনকরণ এবং তার পরকালীন পর্যায়সমূহ-যা পত্যেককে অতিক্রম করতে হবে অনন্তকালের অধ্যায়সমূহে বিবর্তিত তাগিদে-তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ একান্তই আবশ্যক। উক্ত মূল আয়াতের এ দিকের গুরুত্ব লক্ষ্য করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ (আরবী***********) ‘এবং আল্লাহ্র পথে।’
এ ‘আল্লাহর পথে’ কথাটির তাৎপর্য যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষামূলক অর্থাৎ সামরিক প্রস্তুতিমূলক কার্যবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইসলামে প্রতিরক্ষা ও জিহাদ আসলে দায়িত্বমূলক কাজ নয়। নয় শুধু দেশমাতৃকার জন্যে যুদ্ধ, যেখানে আল্লাহ্র পথে জিহাদ। আর আল্লাহ্র পথে জিহাদের সবচাইতে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে, তা হয় ইসলামের আকীদা রক্ষা, বহিরাক্রমণ থেকে তার প্রতিরক্ষা এবং তার ওপর স্থিতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জনের লক্ষ্যে এ আকীদার প্রভাববলয় সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে। [উস্তাদ আল বাহী আল খাওলী লিখিত- (আরবী***********) থেকে উদ্ধৃত।]
এ তিনটি মৌল নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে যাকাত উচ্চতর মূল্যমান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তার ভূমিকা পালন করে। এ আসল তাৎপর্যগত বিশেষত্বের জন্যেই মুসলিম সমাজ অধিক আগ্রহী। বরং এর ওপরই তার গোটা সংস্থা গড়ে ওঠে-যেমন পূর্বে বলেছে।
বস্তুত ইসলামী জীবনে পরিপূরবতা ও পূর্ণত্ব এসবের মাধ্যমেই আসে। সমস্ত ইসলামী সংস্থাও তাই। অতএব যাকাত বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটা অর্থনৈতিক বিধান হলেও ইসলামের মৌল আকীদা থেকে- ইসলামের ইবাদত থেকে তা কখনই বিচ্ছিন্ন হয় না। মূল্যমান ও নৈতিকতা কখনই উপেক্ষিত হয় না। রাষ্ট্রনীতি ও জিহাদের সাথে তার সম্পর্ক চিরন্তন। ব্যক্তি ও সমষ্টির সমস্যা ও জটিলতা দূর করাই তার বড় অবদান। জীবনে বাঁচিয়ে তার মৌল ভাবধারা।
পরবর্তী আলোচনাসমূহে আমরা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক জটিলতার উল্লেখ করব, আমাদের সমাজ-সমষ্টি যা নিয়ে খুব বেশী চিন্তা-ভাবনা করে। সমাজ সংস্করকগণ সে সবেরেই সংশোধন চান। এসব জটিলতার চিকিৎসা কিংবা এসবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া লাঘব করার ব্যাপারে যাকাত ব্যবস্থার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
আমার লিখিতঃ (আরবী***********)
(ক) ‘দারিদ্র্য সমস্যা ও তার সমাধান ইসলাম কিভাবে করেছে’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ সংশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাকাতের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে এ স্বতন্ত্র গ্রন্থখানি প্রকাশ করেছি। [প্রকাশক (আরবী***********)] তা যার ইচ্ছা পড়ে নিতে পারেন।
© Bangladesh Jamaat-e-Islami