বৈরাগ্যবাদ
বাস্তব পর্যবেক্ষণের সাথে অমূলক আন্দায-অনুমান সংমিশ্রণের ফলে মানব-জীবনের মৌলিক প্রশ্নের দ্বিতীয় যে উত্তরটি ঠিক করা হয়েছে, এক কথায় বলা যায় বৈরাগ্যবাদ। এ মতাদর্শের গোড়ার কথা এই যে, পৃথিবী এবং মানুষের শারীরিক সত্তা স্বয়ং মানুষের জন্য একটি ‘শান্তি কেন্দ্রবিশেষ’ আর মানুষের আত্মাকে একটি দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীর ন্যায় পিঞ্জিরাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বস্তু জগতের সাথে একটি জড় সম্পর্ক বর্তমান থাকায় মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, ইচ্ছা-বাসনা এবং প্রয়োজনীয় যা কিছুই রয়েছে মূলত তা সবই বন্দীখানার শৃংখল বিশেষ। এই পৃথিবী এবং এর দ্রব্য সামগ্রীর সাথে মানুষ যতোই সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে, ততোই তার এই শৃংখলের বন্ধন দৃঢ়তর হবে এবং সে ততোধিক কঠোর শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবে। এই শাস্তি হতে মুক্তিলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে জীবনের সকল প্রকার সম্পর্ক সম্বন্ধ ও ধান্ধা- ঝামেলা পরিপূর্ণ সাফল্যের সাথে এড়িয়ে স্বাভাবিক লোভ-লালসা ও ইচ্ছা-বাসনাকে কঠোরভাবে অবদমিত করা, স্বাদ-আস্বাদন পরিহার করা, শারীরিক প্রয়োজন এবং প্রবৃত্তির দাবি ও প্রেরণাকে দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করা ; রক্ত-মাংসের বাস্তব সম্পর্কের কারণে হৃদয় মনে যে প্রেম-ভালবাসার উদ্রেক হয়, পূর্ণরূপে তার মূলচ্ছেদ করা এবং এই শত্রুকে মন ও দেহকে কঠোর ও অন্তহীন কৃচ্ছসাধনার সাহায্যে এমনভাবে নিস্পেষিত করা যেনো আত্মার উপর এর কোনরূপ প্রভাব-প্রভুত্ব আদৌ স্থাপিত হতে না পারে। এর ফলে আত্মা লঘু ও পবিত্র হবে এবং মুক্তির উচ্চতম মার্গে উড্ডীন হওয়ার শক্তি লাভ করতে পারবে। এরূপ মতাদর্শের ফলে মানবজীবনের নিম্নলিখিত রূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। প্রথমত, এর প্রভাবে মানুষের সমগ্র ঝোঁক-প্রবণতা সমষ্টিবাদ হতে ব্যষ্টিবাদের দিকে এবং সমাজ ও সভ্যতা হতে বর্বরতার দিকে নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষ পৃথিবী এবং জীবনধারা হতে সম্পূর্ণরূপে বিমুখ হয়ে পড়ে। কোনো জৈবিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয় না, তার সমগ্র জীবন অসহযোগ ও সম্পর্কহীনতার বাস্তব প্রতিমূর্তিতেই পরিণত হয়। তার চরিত্র সম্পূর্ণ নেতিবাচক (negative) ভাবধারায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, এই মতাদর্শের প্রবল প্রভাবে সমাজের উত্তম ও সৎলোকেরা পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্জন একাকীত্বের নিভৃততম কোণে আশ্রয় নেয় এবং নিজের ব্যক্তিগত মুক্তি সাধনায় একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করে। ফলত পৃথিবীর সকল প্রকার দায়িত্ব ও কর্তৃত্বপূর্ণ কাজ কর্মের চাবিকাঠি সমাজের সর্বাপেক্ষা দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, সমাজ ও সভ্যতার ক্ষেত্রে এ মতের যে প্রভাব আবর্তিত হয়, তার ফলে লোকদের মধ্যে নেতিবাচক (negative) নৈতিকতা, সমাজবিরোধী (individualistic) ভাবধারা এবং নৈরাশ্যব্যঞ্জক মতবাদ সৃষ্টি হয়। তাদের কর্মশক্তি ও কার্যদক্ষতা ক্ষীণ হতেও ক্ষীণতর হয়ে যায়। অত্যাচারীদের জন্য তারা ‘সহজভোগ্য’ হয়ে পড়ে এবং সকল দুর্ধর্ষ নিপীড়ক সরকার তাদেরকে অতি সহজেই হস্তগত করে নিতে পারে। বস্তুত এই মতাদর্শ জনগণকে যালেম লোকদের পক্ষে বিনয়াবনত ও পোষমানা (tame) বানিয়ে দিতে যাদুর মতো অব্যর্থ।
চতুর্থত, মানব প্রকৃতির সাথে এই বৈরাগ্যবাদী জীবন দর্শনের চিরস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রায়ই এটা সংগ্রামে পরাজিত হয়। এটা পরাজিত হলে নিজের দুর্বলতা গোপন করার জন্য তারা নানা ফন্দি ও কূটকৌশলের সাহায্যে আত্মপ্রতারণা করতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন প্রাচীণ ধর্মে ‘কাফ্ফারা’ এশকে মাজাযী দুনিয়া ত্যাগের আবরণে দুনিয়া পূজার এই যে পংকিল ও লজ্জাকর অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট হয়েছে, তার মূল কারণ এখানেই নিহিত রয়েছে।
সর্বেশ্বরবাদ
অবাস্তব আন্দায-অনুমানভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ও অনুশীলনের ফলে তৃতীয় যে মতটির সৃষ্টি হচ্ছে, তা হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদ (pantheism)। অর্থাৎ মানুষ ও বিশ্বজগতের সমগ্র জিনিসই মূলত অপ্রকৃত। এদের আদৌ কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই। বস্তুত একটি সত্তাই এ সমগ্র বস্তুজগতকে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমরূপে গ্রহণ করেছে মাত্র এবং তাই এ সকলের মধ্যে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশমান। বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করলে এ মতাদর্শের অসংখ্য রূপ প্রকাশিত হয়। সমগ্র সৃষ্টিজগত, বস্তুজগত একটি মাত্র সত্তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মূলত সেই সত্তাই বর্তমান, অন্যান্য যা কিছু পরিদৃষ্ট হয় আসলে তা কিছুই নয় এই একটি মাত্র সত্তাই হচ্ছে এর সারকথা।
এ মতাদর্শের ফলে মানুষের মনে সৃষ্টি হয় সংশয়বাদ। তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেই তার মনে জেগে উঠে সন্দেহের নিরন্ধ্র তমিস্রা। ফলে তার দ্বারা বাস্তব দুনিয়ার কোনো কাজই যে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে সম্পন্ন হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। সে নিজেকে একটি কাষ্ঠ নির্মিত পুত্তলিকা মনে করতে শুরু করে, যাকে অন্য কেউ অন্তরালে থেকে নাচাচ্ছে, অথবা অন্য কেউ তার মধ্যে থেকে নৃত্য করছে। সে তার এই অমূলক কল্পনার গভীর পংকে আত্মনিয়োগ হয়ে পড়ে। তার নিজের জীবনের কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যই থাকতে পারে না, কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপথও নয়। সে মনে করে আমি নিজে তো কিছুই নই আমার করারও কিছু নেই। আর আমার করার কিছু থাকতেও পারে না। মূলত সেই সার্বিক সত্তা যা আমার মধ্যে ও সমস্ত সৃষ্টিজগতের পরতে পরতে বিকাশমান যা অজ্ঞাত আদি হতে অনন্তকাল পর্যন্ত চলে আসছে, সকল কাজ তারই, সকল কর্ম সে-ই সম্পন্ন করে। সত্তা যদি পরিপূর্ণ হয়ে থাকে, তবে আমিও পরিপূর্ণ, অতএব আমার চেষ্টা-সাধনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর সেই সত্তাই যদি নিজের পূর্ণতা বিধানের জন্য চেষ্টিত হয়ে থাকে, তাহলে যে বিশ্বব্যাপক গতি সহকারে সে নিজের পূর্ণতা লাভের দিকে অব্যাহতভাবে ছুটে চলেছে। একটি অংশ হিসেবে এর দিকে আবর্তনে পড়ে আমিও সে দিকে পৌঁছতে পারবো। আসলে আমি একটি অংশবিশেষ, সার্বিক সত্তা কোথায় যাচ্ছে এবং কোথায় যেতে চাচ্ছে, তা আমি কিছুই জানি না। এরূপ চিন্তা পদ্ধতির বাস্তব ফল বৈরাগ্যবাদী জীবন দর্শনের অনুরূপই হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এমত গ্রহণকারীদের কর্মনীতির সাথে খালেছ জাহেলিয়াতের অনুসারীদের কর্মনীতির সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ এদের সকলেই নিজেদের সমগ্র জীবনকে নিজেদের প্রবৃত্তি ও অন্ধ লালসার দাসানুদাসে পরিণত করে। ফলে তাদের প্রবৃত্তি তাদেরকে যে দিকে নিয়ে যায়, তারা নির্বিচারে ও নির্বিকার চিত্তে সে পথেই ছুটতে থাকে। তারা মনে করে যে, তারা নিজেরা মোটেই চলছে না, যা ঘটছে তা সার্বিক সত্তাই করছে।
বস্তুত শেষোক্ত তিনটি মতাদর্শও প্রথমোল্লিখিত মতের ন্যায় জাহেলিয়াতের বিষাক্ত ভাবধারায় ভরপুর। ফলে এ মতের অনুসারীদের সমগ্র জীবন জাহেলিয়াতের বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। কারণ প্রথম কথা এই যে, এসব মতাদর্শের কোনো একটিরও কোনো বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, নিছক কল্পনা ও আন্দায-অনুমানের উপর একান্তভাবে নির্ভর করেই বিভিন্ন প্রকার মত রচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এসব মতাদর্শ প্রকৃত ও বাস্তব অবস্থার যে সম্পূর্ণ বিপরীত, তা বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে প্রমাণিত হয়। এসবের মধ্যে একটি মতও যদি প্রকৃত অবস্থার অনুরূপ হতো তবে তদনুযায়ী কাজ করলে খারাপ ফল হওয়ার কোনোই কারণ থাকতে পারে না। একটি জিনিস ভক্ষণ করলেই যখন নিশ্চিতরূপে মানুষের পেটে ব্যথার সৃষ্টি হতে দেখা যায় তখন আমরা সকলেই একথা নির্ভুল বলে বুঝতে পারি যে, পাকস্থলীর গঠন প্রকৃতি এবং এর হজম-শক্তির সাথে এই জিনিসটির বস্তুতই কোনো সামঞ্জস্য নেই। অনুরূপভাবে শির্ক, বৈরাগ্যবাদ এবং সর্বেশ্বরবাদের মতাদর্শ গ্রহণ করলে সমগ্র মানবতা যখন নিশ্চিতরূপে বিপর্যস্ত ও সর্বতোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর এই ব্যাপারে যখন আর কোনো সন্দেহ নেই, তখন সংশ্লিষ্ট মতাদর্শের কোনো একটিও যে বাস্তব অবস্থা ও প্রকৃত সত্যের অনুরূপ নয়, তাতেও বিন্দুমাত্র সংশয় থাকতে পারে না।
ইসলাম
এরপর তৃতীয় পন্থাটি সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। মানব জীবনের মৌলিক প্রশ্নাবলীর জবাব লাভ বুনিয়াদি সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত ও সর্বশেষ উপায়। আল্লাহর প্রেরিত নবীগণ এসব প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছেন, মানব জীবনের মৌলিক সমস্যার যে সমাধান দেখিয়েছেন, আন্তরিকতার সাথে তাই পূর্ণরূপে গ্রহণ করার নামই হচ্ছে ইসলাম।
একটি উদাহরণের সাহায্যে এ পন্থাটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে। কোনো নতুন ও অপরিচিত স্থানে সর্বপ্রথম উপস্থিত হলে আর সেই স্থান সম্পর্কে নিজের বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকলে তখন অন্য কারো নিকট জিজ্ঞেস এবং তার পথনির্দেশ অনুসারে সে স্থান পরিভ্রমণ করাই হয় একমাত্র উপায়। এরূপ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট স্থান সম্পর্কে পূর্ণ অভিজ্ঞতার দাবিদার ব্যক্তিকেই সর্বপ্রথম খুঁজে বের করতে হয়। এরূপ লোকের সাক্ষাত পেলে সে ব্যক্তি বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য কিনা, নানাভাবে পরীক্ষা ও যাচাই করে সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। তারপরই এই ব্যক্তির নেতৃত্বে পথ চলে দেখতে হয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা যখন প্রমাণিত হয় যে, তার নিকট লব্ধ জ্ঞান তথ্য অনুসারে কাজ করে বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি হয়নি বা খারাপ ফল নির্গত হয়নি, তখনই এই ব্যক্তির নির্ভুল অভিজ্ঞতা এবং সংশ্লিষ্ট স্থান সম্পর্কে তার উপস্থাপিত স্থান তথ্যের সততা সম্বন্ধে মনে আর কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ থাকে না। বস্তুত এই কর্মপন্থা মূলতই বৈজ্ঞানিক। এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক পন্থা যখন আর হতেই পারে না, তখন মত নির্ধারণের ব্যাপারে এটাকেই বিশুদ্ধ, নির্ভুল পন্থারূপে গ্রহণ করতে হয়।
এ উদাহরণ সম্মুখে রেখে মানব জীবনের মৌলিক প্রশ্নাবলীর জবাব লাভ করার সঠিক পন্থা নির্ণয় করা খুবই সহজ। মানুষের পক্ষে এ দুনিয়া অভিনব, অপরিচিত ও অজ্ঞাতপূর্ব স্থান। এটার নিগূঢ় তত্ত্ব এবং মৌলিক অবস্থা সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না। এ পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা কোন্ ধরনের এবং কোন্ ধাঁচের, কোন্ আইন অনুযায়ী এ বিশ্ব-কারখানা পরিচালিত হচ্ছে, এ পৃথিবীর বুকে মানুষের পক্ষে অনুকূল আচরণ নীতি কি হতে পারে, সে সম্পর্কে মানুষ একেবারেই অনভিজ্ঞ। ফলে বাহ্যদৃষ্টিতে দুনিয়া সম্পর্কে যা কিছু ধারণা করা যায় তাই মানুষ ধারণা করে, তাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে মনে করে এবং সে অনুসারে যেরূপ কর্মনীতি অবলম্বন করা কর্তব্য মনে হয় মানুষ তাই করে। কিন্তু এর বাস্তব ফল অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়ে।
এরপর মানুষ নিছক আন্দায-অনুমানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মত ঠিক করতে থাকে এবং প্রত্যেকটি মত অনুযায়ী কাজ করার পর তার তিক্ত ফল ভুগতে থাকে। এরপর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত পন্থা এই থেকে যায় যে, মানুষ আল্লাহর প্রেরিত নবীদের নিকট পথের সন্ধান জানতে চাইবে। নবীগণ নিজেদেরকে ‘প্রকৃত সত্য নিগূঢ় তথ্য সম্পর্কে পূর্ণ অভিজ্ঞরূপে’ পেশ করেন তার দাবিও তাঁরা করে থাকেন। তাঁদের যাবতীয় অবস্থার যতোই পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা যায়, ততোই তাঁরা অত্যন্ত সত্যবাদী, বিশ্বাসযোগ্য আমানতদার, সততাসম্পন্ন সচ্চরিত্রবান, নিঃস্বার্থ এবং নির্ভুল চিন্তার ধারক বলে প্রমাণিত হয়। কাজেই শুরুতেই বিশ্বাস করার এবং তাদের প্রতি আস্থা স্থাপনের যু্ক্তিসংগত কারণ বর্তমান রয়েছে।
অতপর দুনিয়া সম্পর্কে এবং দুনিয়ার মানুষের অবস্থান সম্পর্কে যেসব জ্ঞান-তথ্য তাঁরা পরিবেশন করেন, তাঁরা সত্যাসত্য যৌক্তিকতার এবং বাস্তবক্ষেত্রে তার সামঞ্জস্য পরীক্ষা করতে হবে। উপরন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো বাস্তব (কর্মগত) প্রমাণ আছে কিনা এবং তদনুযায়ী যে আচরণ নীতি দুনিয়ায় অবলম্বন করা হচ্ছে, বাস্তব পরীক্ষায় তা কিরূপে প্রমাণিত হলো, তাও বাছাই করে দেখতে হবে। তদন্ত ও যাচাই গবেষণার পর এ তিনটি কথারই উত্তর যদি নিঃসন্দেহ রূপে লাভ করা যায়, তাহলে নবীদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা কর্তব্য এবং তাঁদের পথনির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা আর এ মতাদর্শের সাথে বাস্তব সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য জীবনের কর্মক্ষেত্রের যেরূপ আচরণ ও কর্মনীতি গ্রহণ করা উচিত তা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
পূর্বেই বলেছি, জাহেলিয়াতের পূর্বোক্ত পন্থাসমূহের মুকাবিলায় শেষোক্ত পন্থাটি নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিক। এই বিজ্ঞানের সম্মুখে মানুষ যদি নতি স্বীকার করে, স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মম্ভরিতা পরিহার করে যদি এটাকেই অনুসরণ করে এবং এই ‘বিজ্ঞান’ মানুষের জন্য যে সীমা নির্ধারণ করেছে তা রক্ষা করেই যদি তারা জীবন যাপন করে, তবে এটাই হবে ইসলামী কর্মপন্থা।
মানুষ ও বিশ্ব সম্পর্কে নবীদের মত
নবীগণ বলেন, মানুষের চতুর্দিকে বিদ্যমান এই বিরাট বিশাল বিশ্বভূবন মানুষ যার একটি অংশ কোনো আকস্মিক দূর্ঘটনার ফল নয়। এটা এক শৃঙ্খলাপূর্ণ সুসংঘবদ্ধ ও নিয়মতন্ত্র সম্মত সাম্রাজ্য বিশেষ। আল্লাহ তায়ালাই এটা সৃষ্টি করেছেন, তিনিই এর মালিক, তিনিই এর একমাত্র শাসনকর্তা ও নিয়ন্ত্রণকারী। সমগ্র সৃষ্টিজগত একটি সার্বিক ব্যবস্থার (totalitarian system) অধীন। এখানকার সমগ্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একমাত্র কেন্দ্রীয় শক্তির হস্তে নিবদ্ধ। সেই উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা ভিন্ন এই প্রাকৃতিক জগতে অন্য কারো বিধান চলে না। বিশ্ব ব্যবস্থার যতো শক্তিই কর্মনিরত হয়ে আছে, তা সবই এক কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অধীন এবং অনুগত। তার বিধান ও নির্দেশের বিরোধিতা করা কিংবা তার অনুমতি ব্যতীত নিজের ইচ্ছামত কোনো কাজ করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা কারো নেই। এই সঠিক ব্যবস্থায় কোনরূপ স্বাধীনতার (independence) ও দায়িত্ব্হীনতার (irresponsibility) আদৌ অবকাশ নেই। আর স্বভাবতই তা থাকতে পারে না।
মানুষ এ জগতে জন্মগত প্রজা (born subject) হওয়া তার ইচ্ছা সাপেক্ষ নয় বরং প্রজা হিসেবেই তার জন্ম হয়েছে ; আর প্রজা ভিন্ন অন্য কিছু হওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব। অতএব নিজের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করা এবং নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করার কোনো অধিকারই তার নেই। মানুষ নিজে বিশ্ব ভূবনের কোনো কিছুরই মালিক নয়। কাজেই মালিকানা ব্যবহারের পদ্ধতি তার রচনা করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তার নিজের শরীর, তার অন্তর্নিহিত সকল প্রকার ক্ষমতা-প্রতিভা একমাত্র আল্লাহর মালিকানা আল্লাহরই অবদান মাত্র। কাজেই এসবের কোনো অধিকার তার থাকতে পারে না। যিনি মানুষকে এসব জিনিস দান করেছেন, তাঁরই মর্জি ও বিধান অনুযায়ী এর ব্যবহার করাই মানুষের কর্তব্য।
অনুরূপভাবে মানুষের চতুষ্পার্শ্বে দুনিয়ার বিভিন্ন দিকে যেসব দ্রব্য-সামগ্রী ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে বর্তমান রয়েছে জমি, জন্তু, পানি, উদ্ভিদ, গাছপালা ও গুল্ম-লতা, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি সবকিছুই আল্লাহ তায়ালার মালিকানা, মানুষ এর মালিক নয়। কাজেই সে সবের উপরও নিজের ইচ্ছামত হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকারই মানুষের নেই। বরং প্রকৃত মালিক এসব ব্যবহার করার জন্য যে নিয়ম-বিধান রচনা করে দিয়েছেন তদনুযায়ী এটা ব্যয়-ব্যবহার করা মানুষের কর্তব্য। দুনিয়ার বুকে যতো মানুষ বসবাস করেছে, তাদের জীবন পরস্পর ওতপ্রোত জড়িত। এরা সকলেই আল্লাহ তায়ালার ‘প্রজা’। অতএব এদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ও কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য নিয়ম-নীতি নির্ধারণের কোনো অধিকার এই মানুষের নেই। একমাত্র আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী এসব কাজ আঞ্জাম দেয়া কর্তব্য। আল্লাহর দেয়া বিধানের ভিত্তিতেই তাদের সম্পর্ক-সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কিন্তু আল্লাহর সেই বিধান কি? পয়গাম্বরগণ বলেন যে, যে জ্ঞান উৎস হতে আমরা দুনিয়ার এবং স্বয়ং মানুষের নিগূঢ় তত্ত্ব জানতে পেরেছি সেই সূত্র হতে আমরা আল্লাহর বিধানও পেয়েছি, আল্লাহ নিজেই আমাদের এই জ্ঞান দান করেছেন এবং দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে এ দিক দিয়ে পূর্ণরূপে অভিজ্ঞ ও অবহিত করার জন্য আমাদেরকে আদেশ করেছেন। অতএব আমাদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদেরকে মহামহিমান্বিত ‘বাদশাহের’ প্রতিনিধি মনে করা এবং আমাদের নিকট হতে আল্লাহর প্রামাণ্য বিধান গ্রহণ করাই মানুষের কর্তব্য।
পয়গাম্বরগণ আরও বলেন, আপত দৃষ্টিতে নিখিল বিশ্বপ্রকৃতির সমগ্র কাজ সুষ্ঠু সুসংবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে দেখা যায় বটে কিন্তু কোথাও কোনো পরিচালক পরিদৃষ্ট হয় না, তার কর্মচারী কোনখানে দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে মানুষ এখানে এক প্রকারের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের অবকাশ অনুভব করে, মানুষ এখানে ‘মালিকের’ ন্যায় আচরণ করতে পারে। প্রকৃত মালিক ভিন্ন অপরের সম্মুখে দাসত্ব ও আনুগত্যের অনুভূতিতে মাথাও নত করতে পারে, আর সকল অবস্থায়ই তার ‘রিযক’ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী অব্যাহতভাবে লাভ করতে সক্ষম হয়। সকল প্রকার কাজের সুবিধা লাভ করতে পারে। কিন্তু আল্লাহদ্রোহিতার প্রতিফল সংগে সংগে পায় না। মূলত এসব মানুষের পরীক্ষার জন্য করা হয়েছে। মানুষকে যেহেতু জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, উদ্ভাবন ও নির্বাচন শক্তি দান করা হয়েছে, এ কারণেই প্রকৃত ‘মালিক’ ‘রাজাধিরাজ’ নিজেকে এবং নিজের অদৃশ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছেন। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত এ শক্তিসমূহের বাস্তব প্রয়োগ ও ব্যবহার কিভাবে করে তার পরীক্ষা ও যাচাই করাই তাঁর উদ্দেশ্য। আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি, নির্বাচন স্বাধীনতা (freedom of choice) এবং এক প্রকারের ‘স্বরাজ’ (autonomy) দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন মানুষ যদি তার জন্মগত প্রজা হওয়ার কথা হৃদয়ংগম করে এবং সাগ্রহে ও স্বেচ্ছায় এ ‘মর্যাদা’কেই গ্রহণ করে এ মর্যাদা গ্রহণের জন্য কোনো দিক দিয়েই কোনরূপ যবরদস্তি না হওয়া সত্ত্বেও; তবেই মানুষ তাদের সৃষ্টিকর্তার এ পরীক্ষায় সফলকাম হতে পারবে। পক্ষান্তরে প্রজা হওয়ার মর্যাদা যদি মানুষ বুঝতে না পারে কিংবা বুঝতে পেরেও বিদ্রোহীর ভূমিকা গ্রহণ করে, তবে পরীক্ষায় তার ব্যর্থতা অনিবার্য। অথচ এ পরীক্ষার জন্যই মানুষকে দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা দান করা হয়েছে। দুনিয়ায় অসংখ্য জিনিসই মানুষের কর্তৃত্বাধীনে রাখা হয়েছে। আর সেই সংগে একটি জীবন ব্যাপী সময় তাকে অবকাশ দেয়া হয়েছে।
অতপর পয়গাম্বরগণ এও বলেছেন যে, পার্থিব জীবন যেহেতু একটানা ও নিরবচ্ছিন্ন একটি পরীক্ষার মুহূর্ত, কাজেই কাজ কর্মের প্রকৃত হিসেব এই দুনিয়ায় হবে না, কোনো প্রতিফল শান্তি বা সম্মানও এখানে লাভ হবে না। (টিকা: এ সম্পর্কে একটি কথা ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়াতে আমরা এখন বসবাস করছি, মূলত এটা প্রাকৃতিক জগত (Physical world) নৈতিক বিধানভিত্তিক জগত এটা নয়। বিশ্বজগতের বর্তমান ব্যবস্থা যেসব আইনের ভিত্তিতে স্থাপিত তাও নৈতিক নিয়ম নয়, তা প্রাকৃতিক নিয়ম। এ জন্য বর্তমান পার্থিব ব্যবস্থায় মানুষের কাজ-কর্মের নৈতিক ফল পুরাপুরিভাবে লব্ধ হতে পারে না। অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়ম যতোখানি এই ফল নির্গমের অনুকূল পরিস্থিতির উদ্ভব করবে, ঠিক ততোখানিই নৈতিক ফল প্রকাশিত হবে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ম যদি সেই সুযোগ না দেয়, তবে তা প্রকাশ হওয়া অসম্ভব। যেমন, নরহত্যার নৈতিক ফল প্রকাশ তখনি হতে পারে, যদি প্রাকৃতিক নিয়ম হত্যাকারীর সন্ধান করতে, তার অপরাধ প্রমাণে এবং তার উপর হত্যার নৈতিক দণ্ড কার্যকরী করার ব্যাপারে সাহায্য করে। নতুবা কোনো নৈতিক ‘ফল’ আদৌ প্রকাশিত হতে পারবে না। তার আনুকূল্য লাভ হলেও এ কাজের পুরাপুরি নৈতিক ফল কখনও প্রকাশিত হবে না। কারণ নিহত ব্যক্তির পরিবর্তে শুধু প্রাণদণ্ড দেয়াই তার এ কাজের পূর্ণ নৈতিক ফল নয়। এ জন্যই বর্তমান পৃথিবী প্রতিফল লাভের ক্ষেত্র নয় তা হতেও পারে না। প্রতিফল দানের ক্ষেত্র হবার জন্য এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থার একান্ত আবশ্যক যেখানে বর্তমান প্রচলিত প্রাকৃতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে নৈতিক নিয়মই হবে প্রধান ও প্রভাবশীল। আর প্রাকৃতিক আইন হবে তার আজ্ঞাবাহক ও অনুকূল অবস্থার উদ্ভাবক মাত্র।)
মানুষ এ দুনিয়াতে যা কিছু ‘ভালো’ লাভ করে তা যে কোনো পুণ্যের প্রতিফলই হবে এমন কোনো কথা নেই। তা মানুষের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্ট হওয়ার প্রমাণও নয়। কিংবা মানুষ যা কিছু করেছে তার নির্ভুল হওয়ারও কোনো লক্ষণ নয়। মূলত তা পরীক্ষার সরঞ্জাম বিশেষ ধন সম্পদ, সন্তান-প্রজনন শক্তি, রাষ্ট্র ও সরকার, জীবন যাপনের উপযোগী দ্রব্য-সামগ্রী সব কিছুই শুধু পরীক্ষার জন্য মানুষকে দান করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ এসব প্রয়োগ ও ব্যবহার করে নিজেদের ভালো কিংবা মন্দ কর্মক্ষমতার বাস্তব প্রমাণ পেশ করবে। অনুরূপভাবে দুঃখ-কষ্টে, ক্ষতি-আঘাতে, মানুষের বর্তমান জীবনে যা কিছু সংঘটিত হয়, তাও কোনো পাপ কাজের শাস্তি নয়। তন্মধ্যে অনেকগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন স্বতস্ফূর্তভাবেই প্রকাশিত হয়। (টিকা: যেমন ব্যভিচারীর রোগাক্রান্ত হওয়া এটা তার এ পাপের নৈতিক শাস্তি নয়। এটা হচ্ছে প্রাকৃতিক ফলমাত্র। চিকিৎসায় সাফল্য লাভ হলে রোগ হতে সে মুক্তি পাবে বটে ; কিন্তু নৈতিক শাস্তি হতে কখনই রক্ষা পাবে না। আর ‘তওবা’ করলে নৈতিক শাস্তি হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হলেও কেবল এটার দরুনই রোগ হতে মুক্তি লাভ সম্ভব হবে না।) উহাদের কতকগুলি নিছক পরীক্ষা স্বরূপ। (টিকা: যেমন কারো দরিদ্র হওয়া। এ সময় সে তার প্রয়োজন মিটাবার জন্য অসংগত পন্থা অবলম্বন করেনা, ন্যায়সংগত পথেই দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে, বিপদের কঠিন আঘাতে সত্য ও সততার পথে মজবুত থাকে, না অস্থির হয়ে অন্যায় ও পাপ পথে পদক্ষেপ করে এসব দিক দিয়ে তার পরীক্ষা হয়।) আর কতকগুলো হয় প্রকৃত অবস্থার বিপরীত মত নির্ধারণের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অনিবার্যভাবে। (টিকা: মানুষ যখন এ দুনিয়াকে ‘রব’হীন এবং নিজেকে সম্পূর্ণ ‘স্বাধীন’ মনে করতে শুরু করে কিন্তু যেহেতু এটা প্রকৃত অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত সেহেতু এই দুনিয়া ‘রব’হীন নয় মানুষও এখানে স্বাধীন নয় ; তাই প্রকৃত ব্যাপারের বিপরীত কাজ করার ফলে আঘাত খাওয়া অনিবার্য। আগুনকে খেলনা মনে করে স্পর্শ করলে হাত পুড়ে যাবে। কারণ এ আচরণ স্বাভাবিক অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত।)
মোটকথা এ দুনিয়া মোটেই ‘প্রতিফল লাভের ক্ষেত্র’ নয়। মূলত এটা পরীক্ষার ক্ষেত্র। এখানে প্রকাশিত কর্মফল দ্বারা কোনো পন্থার বা কোনো কাজের বিশুদ্ধ, নির্ভুল বা ভ্রান্ত কিংবা পাপ অথবা পূণ্য গ্রহণযোগ্য বা বর্জনযোগ্য হওয়া প্রমাণিত হয় না। এজন্য তা কোনো মানদণ্ড হিসেবেও পরিগণিত হতে পারে না। সে জন্য প্রকৃত, নির্ভুল ও একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে পারলৌকিক ফলাফল। পৃথিবীর এই অবকাশের মুহূর্ত এ পার্থিব জীবন শেষ হওয়ার পর আর একটি জীবন রয়েছে। তখন পার্থিব জীবনের প্রত্যেকটি কাজ নিখুঁতভাবে যাচাই করা হবে, আর এ পরীক্ষায় কে সাফল্য লাভ করল, কে ব্যর্থকাম হলো, তার চূড়ান্ত ফায়সালা তখনি করা হবে। পারলৌকিক জীবনের সাফল্য-অসাফল্য কয়েকটি জিনিসের উপর নির্ভর করে। প্রথম এই যে, মানুষ নিজের দৃষ্টি ও যুক্তিবিন্যাস প্রতিভার নির্ভুল প্রয়োগের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালাকে প্রকৃত ও একমাত্র ব্যবস্থাপক, আইন রচয়িতা এবং তাঁর নিকট হতে প্রাপ্ত শিক্ষা ও জীবন বিধানকে যথার্থ আল্লাহর বিধান বলে জানতে পারল কিনা। দ্বিতীয় এই নিগূঢ় সত্য জেনে নেয়ার পর পথ নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ নিজের আন্তরিক ইচ্ছা ও আগ্রহ সহকারে আল্লাহ তায়ালার বাস্তব প্রভুত্ব এবং তাঁর শরীয়াতী বিধানের সম্মুখে মাথা নত করলো কিনা।
ইসলামী মতবাদ
মানুষ ও পৃথিবী সম্পর্কে নবীদের উপস্থাপিত এ মতাদর্শ একটি পরিপূর্ণ মতবাদ। এর সমগ্র দিক ও বিভাগ পরস্পর জড়িত পরস্পরের মধ্যে যুক্তিসম্মত নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এর একটি অংশ অপরটির বিপরীত বা বিরোধী নয়। এর ভিত্তিতে বিশ্বের সকল প্রকার ঘটনাবলীর পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং বিশ্ব প্রকৃতির নিদর্শনসমূহের পূর্ণ ব্যাখ্যা দান অত্যন্ত সহজ। এ মতের বিশ্লেষণ করা যায় না। এমন কোনো জিনিসই কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। অতএব এটা একটি বৈজ্ঞানিক মত (scientific theory) এবং এর যে সংজ্ঞাই দেয়া হোক না কেন, এ মত সম্পর্কে তা নিঃসন্দেহে প্রযোজ্য হবে।
পরন্তু কোনো গবেষণা, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ বা বাস্তব অভিজ্ঞতাই এ মতকে আজ পর্যন্ত ‘ভ্রান্ত’ প্রমাণ করতে পারেনি। বস্তুত এটা বাস্তবে পরিণত সত্য, এর সত্যতা চিরস্থায়ী। প্রমাণিত ভ্রান্ত মতবাদসমূহের মধ্যে এটাকে কোনো মতেই গণ্য করা যায় না। (টিকা: কোনো বিশেষ যুগের বৈজ্ঞানিক মত এর বিপরীত হলেই এর ভ্রান্তি প্রমাণিত হয় না। বৈজ্ঞানিক মতে বাস্তব সত্যই (Facts) এটাকে চুর্ণ করতে পারে নিছক মতবাদ নয়। অতএব মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে নবীদের উপস্থাপিত ধারণাকে যতোক্ষণ পর্যন্ত না কোনো বাস্তব ও সপ্রমাণিত ঘটনাই ভুল প্রমাণিত করবে ততোক্ষণ এটাকে ‘অতীত কালের মতবাদসমূহের’ মধ্যে গণ্য করা শুধু মারাত্মক ভুল ও অবৈজ্ঞানিকতাই নয়, তা হিংসা-বিদ্বেষমূলক কাজের পরিণামও বটে।) বিশ্বপ্রকৃতির যে নিয়ম আমরা দেখতে পাচ্ছি, সে দিক দিয়েও এ মত খুবই সত্য বলে মনে হয়। বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত বিরাট ও ব্যাপক নিয়ম-শৃংখলা এবং এর সুসংবদ্ধতা দেখে স্বতই মনে হয় প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই মনে হবে যে, নিশ্চয়ই এর কোনো ‘ব্যবস্থাপক’ রয়েছেন ; এরূপ মনে না করার মূলে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে এ সুসংবদ্ধ নিয়ম-শৃংখলা এটাকে একটি ‘কেন্দ্রভিত্তিক ব্যবস্থা’ এবং এই ব্যবস্থায় একজন স্বাধীন ও স্বেচ্ছাধিকারী পরিচালক থাকার জন্য বিশ্বাস করাই বুদ্ধিসম্মত মনে হয়, এটাকে বিকেন্দ্রীক মনে করা এবং এর অসংখ্য পরিচালকের অধীন চলার কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশ্বপ্রকৃতির এই বিস্ময়কর ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, যৌক্তিকতা এবং নির্ভুল বুদ্ধির যে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তদ্ধৃষ্টে এটাকে একটি সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যবস্থা মনে করাই অধিকতর যুক্তিসংগত, এটাকে উদ্দেশ্যহীন এবং শিশুর খেলনা মনে করার মুলে কোনোই যুক্তি থাকতে পারে না।
এতদ্ব্যতীত এ বিশ্বপ্রকৃতির ব্যবস্থাকে আমরা যদি একটি বাস্তব রাজ্য এবং মানুষকে এই বিরাট ও সুসংবদ্ধ ব্যবস্থার একটি অংশ বলে মনে করি, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, এই নিয়ম-শৃংখলা ব্যবস্থার অধীন মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার ও স্বাধীনতার কোনোই অবকাশ থাকতে পারেনা। এই পৃথিবীতে প্রজা হওয়াই মানুষের সঠিক মর্যাদা। এ দিক দিয়েও উল্লিখিত মতটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত (most reasonable) বলে মনে হয়।
বাস্তব কার্যকারিতা সম্পর্কে বিচার করলেও এটা একটি বাস্তব কর্মোপযোগী (practicable) মত বলেই প্রতিপন্ন হয়। এ মতের ভিত্তিতে মানব জীবনের একটি পূর্ণাংগ ও ব্যাপক কর্মসূচী এর খুঁটিনাটিসহ খুব সহজেই রচিত হতে পারে। দর্শন, নৈতিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্প, রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, যুদ্ধ-সন্ধি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধ এক কথায় জীবনের সকল দিক ও বিভাগ এবং সকল প্রয়োজন ও সমস্যার জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্থায়ী ব্যবস্থা এরই ভিত্তিতে লাভ করা সম্ভব। ফলে মানব জীবনের কোনো বিভাগেই কর্মনীতি নির্ধারণের জন্য এ মতাদর্শের বাইরে যাওয়ার কোনো দিনই প্রয়োজন দেখা দেবে না।
পক্ষান্তরে, এ মতাদর্শের ভিত্তিতে মানুষের এ পার্থিব জীবন কিরূপে গঠিত হয় এবং এর ফলাফলই বা কিরূপ এখন তাই আমাদের বিচার্য। এ মতবাদ ব্যক্তিগত জীবনকে অন্যান্য জাহেলি মতবাদসমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত। অতীত দায়িত্ব জ্ঞান-সম্পন্ন এবং খুবই সুসংবদ্ধ ও শৃংখলাপূর্ণ (well diciplined) করে তোলে। এ মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ এই যে, মানুষ তার দেহ তার যাবতীয় শক্তি-সামর্থ এ পৃথিবী এবং পৃথিবীর কোনো একটি বস্তুকেও নিজের মালিকানা সম্পদ মনে করে তার সাথে স্বাধীনভাবে আচরণ করবে না, বরং আল্লাহর মালিকানা মনে করে তাঁরই আইন ও বিধানের ভিত্তিতে এর ব্যবহার করবে। তার লব্ধ প্রত্যেকটি জিনিসকেই আল্লাহর আমানত মনে করবে এবং এ আমানতের হিসেব তাঁর নিকট দিতে হবে যার নিকট কোনো কাজ, মনের কোনো গোপন ইচ্ছাও অজ্ঞাত নয় এবং একথা মনে করেই এটাকে ব্যবহারে আনবে। এরূপ সচেতন মানুষ যে সকল সময় এবং সকল অবস্থায়ই একটি আদর্শের নিষ্ঠাবান অনুসারী হবে তাতে সন্দেহ নেই। এরূপ ব্যক্তি কখনই বল্গাহারা ও প্রবৃত্তির দাস হতে পারে না। অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতক হতে পারে না। এমন ব্যক্তির উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা সম্ভব। শৃংখলা রক্ষা ও নিয়মতন্ত্র অনুসরণের ব্যাপারে কোনো বাহ্যিক চাপের (pressure) প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করবে না। সেজন্য একটি বিরাট শক্তিসম্পন্ন নৈতিক বাঁধন ও সংযম অনুভূতি জেগে উঠে। ফলে, যেসব অবস্থায় কোনো পার্থিব শক্তির নিকট জবাবদিহি করার কোনোই আতংক থাকে না, তখনও এ শক্তি তাকে সততা, ন্যায় ও সত্যের পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। বস্তুত সমাজের লোকদের সর্বাধিক বিশ্বাসভাজন করে তোলার জন্য আল্লাহর ভয় ও আমানতদারীর অনুভূতি অপেক্ষা উত্তম ও কার্যকরী উপায় অন্য কিছু হতে পারে না। অধিকন্তু এ মত মানুষকে কেবল সংগ্রামী ও অবিশ্রান্ত চেষ্টানুবর্তী করে তোলে না; এর যাবতীয় চেষ্টা-সাধনাকে স্বার্থপরতা, আত্মপূজা অথবা জাতিপূজার পংকিলতা হতে পবিত্র করে সততা ও সত্যবাদিতা এবং উচ্চতর নৈতিক আদর্শের লক্ষ্য পথে নিয়ন্ত্রিত করে। যে ব্যক্তি মনে করে যে এ দুনিয়ায় তার আগমণ উদ্দেশ্যহীন নয়, কোনো বিরাট কাজ সম্পাদনের জন্যই এখানে তাকে প্রেরণ করা হয়েছে, তার জীবন কেবল নিজের জন্যই কিংবা তার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের জন্যই নয় বরং তার জীবন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর সন্তোষমূলক কাজে একান্তভাবে নিয়োজিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, তাকে বিনা হিসেবে রেহাই দেয়া হবে না, তার সময় ও ক্ষমতার কতখানি কোন্ কাজে ব্যয় হয়েছে তার হিসেব নেয়া হবে। একথা যার মনে সর্বদা জাগ্রত থাকবে, তার তুলনায় অধিক পরিশ্রমী ফলপ্রসু, সুষ্ঠ ও নির্ভুল চেষ্টানুবর্তী ব্যক্তি আর কেউ হতে পারে না। কাজেই এ মতাদর্শ যতোদুর উত্তম ও আদর্শ ব্যক্তি গঠন করে, তদপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি চরিত্রের ধারণা করা যায় না।
সামগ্রিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এর পরীক্ষা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সর্বপ্রথম কথা এই যে, মতাদর্শ মানব সমাজের ভিত্তিমূলকেই সম্পূর্ণরূপে বদলিয়া দেয়। এ মত অনুযায়ী সমগ্র মানুষ আল্লাহর প্রজা এবং এ দুনিয়ার ক্ষেত্রে সকলের মর্যাদা, সকলের অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা লাভের সম্ভাবনা সকলের পক্ষেই সমান। কোনো ব্যক্তি কোনো পরিবার কোনো শ্রেণী, কোনো জাতি, কোনো বংশের জন্য অন্যান্য মানুষের উপর কোনোরূপ শ্রেষ্ঠত্ব, আভিজাত্য নেই, নেই কোনো বৈষম্যমূলক অধিকার। এভাবে মানুষের প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মুলোচ্ছেদ করা হয়। এবং রাজতন্ত্র, জায়গীরদারী, সামন্তবাদ, অভিজাততন্ত্র (aristocracy) ব্রাক্ষণ্যবাদ ও পোপতন্ত্র প্রভৃতি জাহেলি মতাদর্শ হতে যেসব মারাত্মক দোষত্রুটি ও ব্যাধি সৃষ্টি হয় ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করলে তারা চিরতরে বিলুপ্ত হয়।
এটা বংশীয়, গোত্রীয়, ভৌগলিক, আঞ্চলিক এবং বর্ণ ভিত্তিক বৈষম্য বিদ্বেষেরও মূলোৎপাটন করে। কারণ এসব মারাত্মক ব্যাধিই মানব সমাজে আবহমানকাল যাবত রক্তপাত ও যুদ্ধ সংগ্রামের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ইসলামী মতাদর্শের দৃষ্টিতে সমগ্র পৃথিবীর মালিক আল্লাহ, সমগ্র মানুষ এক আদমের সন্তান এবং আল্লাহর বান্দাহ। এ সমাজে গোত্র, ধন-সম্পত্তি কিংবা বর্ণের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বৈষম্য করা হয় না ; নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা এবং আল্লাহর ভয় থাকা না থাকার ভিত্তিতে এ পার্থক্য হতে পারে। আল্লাহভীতি যার মধ্যে সর্বাধিক, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, সত্যের জন্য সংগ্রামশীলতার দিক দিয়ে তিনিই শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবেন। ইসলামী সমাজে কেবল তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য স্বীকৃত হবে।
এরূপে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধ কিংবা পার্থক্য বৈষম্যের ভিত্তি ও দৃষ্টিতে আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে। সমাজক্ষেত্রে মিলন বিচ্ছেদের যে মান বা কারণ মানুষ নিজেরা আবিষ্কার করেছে তা বিশ্ব মানবতাকে অসংখ্য খণ্ডে বিভক্ত করে ; এ খণ্ডসমূহের মধ্যে দূর্লংঘ্য প্রাচীরও খাড়া করে দেয়। যেহেতু বংশ, স্বদেশ, জাতীয়তা কিংবা বর্ণ প্রভৃতির পরিবর্তন করা মানুষের সাধ্যাতীত এদের মধ্যে একটির অন্তর্ভূক্ত মানুষ কোনোক্রমেই অন্যটির মধ্যে গণ্য হতে পারে না। পক্ষান্তরে ইসলামী মতাদর্শে মানুষের মধ্যে মিলন বিচ্ছেদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার এবং তাঁর বিধান পালনের উপরে। কাজেই সৃষ্টির দাসত্ব পরিত্যাগ করে যারা স্রষ্টার বন্দেগী শুরু করবে এবং মানুষের রচিত আইনে পদাঘাত করে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে জীবনের একমাত্র আইন হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা সকলেই একটি জামায়াতের মধ্যে গণ্য হবে। আর যারা এরূপ করবে না তারা ভিন্ন দলভুক্ত হবে এভাবে মানব সমাজের সকল প্রকার পার্থক্য-বৈষম্য বিলুপ্ত হয়ে একটি মাত্র পার্থক্যই থেকে যায় আর এই পার্থক্য সকলেই লংঘন করতে পারে। কারণ আকীদা বিশ্বাস ও জীবন যাপনের রীতিনীতি পরিবর্তন করে একটি দল হতে অপর দলের মধ্যে শামিল হওয়া প্রত্যেকের পক্ষেই সহজ।
এসব সংশোধন-সংস্কারের পর মতাদর্শের ভিত্তিতে যে সমাজ গড়ে উঠে, তার মনোবৃত্তি মানসিকতা ভাবধারা ও সমাজের গঠন অবয়ব (social structure) আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর রাষ্ট্র মানব প্রভুত্বের ভিত্তিতে নয় আল্লাহর সার্বভৌম প্রভুত্বের বুনিয়াদেই স্থাপিত হয়। (টিকা: গ্রন্থকার রচিত ‘ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ’ দ্রষ্টব্য।) এখানে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই শাসন কায়েম হয়, আল্লাহরই আইন জারী এবং কার্যকরী হয়। মানুষ কেবল আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবেই কাজ করতে থাকে। এর ফলে প্রথমত মানুষের হুকুমাত এবং মানুষের আইন রচনার অধিকারজনিত সমস্ত দোষ-ত্রুটি নিমিষেই দূর হয়।
দ্বিতীয়ত এই মতাদর্শের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়ার ফলে আর একটি বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। তা এই যে, রাষ্ট্রের সমগ্র ব্যবস্থাই ইবাদত ও তাকওয়ার পূত ভাবধারায় পরিপ্লুত হয়। রাষ্ট্রনেতা ও জনগণ সকলেই সমানভাবে অনুভব করতে থাকে যে, তারা আল্লাহর হুকুমাতের অধীন জীবন যাপন করছে এবং গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কে অবহিত আল্লাহর সংগেই তাদের প্রত্যেকটি ব্যাপার প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। করদাতা আল্লাহকেই কর দিচ্ছে মনে করে তা আদায় করে এবং তার গ্রহণকারী ও খরচকারী উভয়েই নিজেদেরকে এর আমানতদার মাত্র মনে করে। একজন সিপাহী হতে বিচারপতি ও গভর্ণর পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মচারীই ঠিক সেই মানসিকতার সাথে কর্তব্য পালন করে, যেরূপ মনোভাব নিয়ে তারা সালাত আদায় করে ; তাদের পক্ষে এই উভয় প্রকার কাজ সমানভাবে ইবাদত এবং উভয় ক্ষেত্রে একই প্রকার আল্লাহভীরুতা এবং সে জন্য শংকাপূর্ণ মনোভাবের প্রয়োজন। গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময়ে তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে সন্ধান করা হয় আল্লাহর ভয়, আমানতদারী, বিশ্বাস পরায়ণতা, সততা ও সত্যবাদিতা প্রভৃতি মহৎ গুণাবলী। এর পরিণামে সমাজের সর্বাধিক উন্নতি ও উত্তম নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন ব্যক্তিগণই নেতৃত্ব ও দায়িত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হন রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদেরই হাতে অর্পণ করা হয়।
সমাজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ মতাদর্শ অনুরূপ আল্লাহভীরুতা ও নৈতিক পবিত্রতার স্বতস্ফূর্ত ভাবধারা প্রবাহিত হয়। আত্মপূজার পরিবর্তে আল্লানুগত্যের প্রভাব বিস্তার করে। মানুষের পরস্পরের মধ্যে এক আল্লাহর সম্পর্কই ভিত্তিগত মর্যাদা লাভ করে, আল্লাহর আইনই পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত, সুসংবদ্ধ ও সুশৃংখলাপূর্ণ করে। এই আইন যেহেতু সেই মহান সত্তাই রচনা করেছের, যিনি সকল প্রকার স্বার্থপরতা ও নফসের খাহেশের পংকিলতা হতে পবিত্র, সর্বজ্ঞ, পরম বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিমান, তাই তাঁর রচিত আইনে অশান্তি ও উচ্ছৃংখলতা যুলুম-পীড়ন ও ভাঙন-বিপর্যয়মূলক কোনো ব্যবস্থাই বিন্দুমাত্র স্থান পায়নি। উপরন্তু মানব প্রকৃতির সকল দিক এবং মানুষের সকল জৈবিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখেই এটা রচিত হয়েছে।
এ মতাদর্শের ভিত্তিতে যে বিরাট সমাজ ও সামগ্রিক জীবন গড়ে উঠে, এখানে তার পূর্ণ চিত্র পেশ সম্ভব নয়। কিন্তু উপরে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা দ্বারা মানুষ ও পৃথিবী সম্পর্কে পয়গাম্বরদের উপস্থাপিত ধারণার ভিত্তিতেই যে ধরনের জীবনধারা গঠিত হয় এবং বাস্তব ফলাফল প্রকাশিত হয় বা হতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা পাঠকের পক্ষে সহজ হবে বলে মনে করি। উপরন্তু এটা কেবলমাত্র অসম্ভব কল্পনার সুখরাজ্য (utopia) নয়। বিশ্ব ইতিহাসের এক অধ্যায়ে এ মতাদর্শের ভিত্তিতে একটি সমাজ, একটি সমষ্টিগত জীবন একটি উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে বিশ্বমানবের সম্মুখে তার বাস্তবতার স্পষ্ট নিদর্শন স্থাপন করা হয়েছে। আর ইতিহাসও এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, এ আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তিদের তুলনায় উত্তম লোক মানব সমাজে আর কখনও পরিদৃষ্ট হয়নি এবং এর ভিত্তিতে স্থাপিত রাষ্ট্র অপেক্ষা কোনো রাষ্ট্রই আজ পর্যন্ত নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের পক্ষে কল্যাণকর প্রমাণিত হয়নি। এ রাষ্ট্রের প্রজা সাধারণের মধ্যে নৈতিক দায়িত্ববোধ অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছিল। প্রমাণ স্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। এক বেদুঈন নারী ব্যভিচারের দরুন অন্তসত্তা হয়েছিল, ইসলামী শরীয়াতে এ পাপের দণ্ড যে সংগেসার প্রস্তর খণ্ডের আঘাত দ্বারা মৃতুদণ্ড দান এর ন্যায় ভয়াবহ তা সে ভালো করেই জানতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজেই রসূল (সঃ) এর দরবারে হাজির হয় এবং অপরাধের দণ্ড দানের জন্য অনুরোধ করে। তাকে সন্তান প্রসবের পরে আসার জন্য বলে দেয়া হয় এবং কোনো মুচলেকা বা জামানত ছাড়াই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে সন্তান প্রসবের পর সে পুণরায় উপস্থিত হয় এবং উপযুক্ত দণ্ডদানের জন্য দাবি জানায়। কিন্তু এবারেও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং সন্তানকে স্তনদান ও লালন পালন করার পর পুনরায় আসার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে আবার সে মরুভুমির দিকে প্রত্যাবর্তন করে, কিন্তু কোনো পুলিশ পাহারার প্রয়োজন বোধ হয়নি। স্তন দানের নির্দিষ্ট সময় অতীত হওয়ার পর মরুবাসিনী আবার ফিরে আসে এবং কৃত অপরাধের দণ্ডদানে তাকে পবিত্র করে দেবার প্রার্থনা জানায়। অতপর তাকে ‘সংগেসার’ পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এভাবে যখন তার মৃত্যু ঘটে তখন তার জন্য আল্লাহর নিকট ‘রহমতের দোয়া করা হয়’। এ সময় এক ব্যক্তি সহসা বলে উঠে মেয়েলোকটি বড় নির্লজ্জ ছিলো। তখন উত্তরে নবী করীম (সা) বললেন, “আল্লাহর শপথ এই নারী যেভাবে তওবা করেছে, অনুরূপ তওবা যদি সকল দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিই করত, তবে তাদেরকেও ক্ষমা করা হত।”
বস্তুত ইসলামী সমাজে নাগরিকদের এটাই ছিলো বৈশিষ্ট্য। আর রাষ্ট্র ও সরকারের বৈশিষ্ট্য ছিলো আরও বিরাট। কোটি কোটি টাকার আয় সম্পন্ন এবং ইরান, সিরিয়া ও মিসরের ন্যায় বিপুল ধন-ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ রাজ্যের বায়তুলমালের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার রাষ্ট্রপ্রধান মাসিক বেতনস্বরূপ মাত্র দেড়শত টাকা গ্রহণ করতেন ; আর নাগরিকদের মধ্যে ভিক্ষা গ্রহণের যোগ্য একজন লোক খুঁজেও পাওয়া যেতো না।
এই বিরাট বাস্তব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা লাভের পরেও যদি নবীদের স্থাপিত বিশ্ব-ব্যবস্থার নিগূঢ়তত্ত্ব এবং তাতে মানুষের অবস্থা ও মর্যাদা সম্পর্কীয় মতাদর্শের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না হয়, তবে এ বিষয়ে তাকে পরিতৃপ্ত করার অন্য কোনো উপায় নেই। কারণ আল্লাহ ফিরিশতা এবং পারলৌকিক জীবনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এ দুনিয়ায় কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আর যেখানে তা সম্ভব নয় তথায় বিভিন্ন কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিন্ন সত্যাসত্য নির্ধারণে অন্য মানদণ্ড আদৌ হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রোগীর দেহাভ্যন্তরের কোথায় কোন জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে শত চেষ্টা করেও যদি তার প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব না হয় তাহলে চিকিৎসক বিভিন্ন প্রকার ঔষধ প্রয়োগ করে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং যে ঔষধটি এ অজ্ঞাত রোগ নির্ধারণে সাহায্য করে তাই রোগের প্রকৃত ঔষধ বলে বিবেচিত হয়। ঐ ঔষধে রোগ দূর হওয়ার ফলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় ঐ ঔষধে দেহাভ্যন্তরস্থ রোগ চিকিৎসার সম্পূর্ণ অনুকূল ইহা অনস্বীকার্য। অনুরূপভাবে মানব জীবনের জটিল যন্ত্র অন্য কোনো মতাদর্শ অনুযায়ী যখন সঠিকভাবে চলতে পারে না। পক্ষান্তরে কেবল নবীদের উপস্থাপিত মতের ভিত্তিতেই যখন তা সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে, তখন এটাই এ মতাদর্শই প্রকৃত অবস্থার অনুকূল হওয়ার জন্য অনস্বীকার্য প্রমাণ। বস্তুত এই নিখিল বিশ্বপ্রকৃতি আল্লাহ তায়ালার একটি রাজ্য। এ জীবনের পর আরো একটি জীবন বাস্তবিকই রয়েছে এবং সেই পারলৌকিক জীবনে সমস্ত মানুষকেই ইহ-জীবনের সকল কাজ-কর্মেরই পুংখানুপুংখরূপে হিসেব দিতে হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
— সমাপ্ত —-