যাকাত
এই স্বেচ্ছা প্রণোদিত ব্যয় নির্বাহের পর ইসলাম আর একটি ব্যয়কে অপরিহার্য গণ্য করেছে। সেটি হচ্ছে যাকাত। সঞ্চিত ও সংরক্ষিত অর্থ, ব্যবসায় পণ্য, বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়, কৃষিজাত দ্রব্য ও গবাদি পশুর উপর যাকাত ধার্য করা হয়। এই যাকাতলব্ধ অর্থের সাহায্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর লোকদের সহায়তা দান করা হয়। এই দু’ধরনের ব্যয়কে নফল নামায ও ফরয নামাযের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। নফল নামায যত ইচ্ছা পড়তে পারেন। ইচ্ছামত আত্নিক উন্নতি লাভ করতে পারেন। যত বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান তত বেশি নফল নামায পড়ুন। তবে ফরয নামায অবশ্যি পড়তে হবে। আল্লাহর পথে ব্যয় করার ব্যাপারটিও এই একই পর্যায়ভুক্ত। এক প্রকার ব্যয় নফল শ্রেণীভুক্ত; নিজের ইচ্ছমত তা করতে পারেন। কিন্তু অন্য প্রকার ব্যয় ফরযের অন্তর্ভক্ত। একটি বিশেষ পরিমানের অধিক অর্থের মালিক হলে এ ব্যয়টি করা আপনার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
যাকাত ও ট্যাক্সের পার্থক্য
যাকাত কোন ট্যাক্স নয়। এব্যাপারে কোন প্রকার ভুল ধারনা করা উচিত নয়। আসলে এটা একটা ইবাদত এবং নামাযের ন্যায় ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যাকাত আর ট্যাক্সের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ট্যাক্স মানুষের উপর জোর পূর্বক বসানো হয়। তাই মানুষ তাকে সানন্দে গ্রহণ করে নেবে এমন কোন কথা নেই। ট্যাক্স ধার্যকারীদের কোন ভক্ত অনুরক্ত হয়না। তাদের কাজের সত্যতার উপর কেউ ঈমান আনেনা। তাদের চাপানো এই বোঝাকে সবাই জোরপূর্বক আদায়কৃত জরিমানা মনে করে। এই ট্যাক্সের উপর তারা নাসিকা কুঞ্চন করে। এর হাত থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য তারা হাজারো বাহানা তালাশ করে। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এর ফলে তাদের ঈমানের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য সূচিত হয়না। এছাড়াও এই দু’য়ের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, ট্যাক্সের সাহায্যে এমন সব ব্যয় নির্বাহ করা হয় যা থেকে ট্যাক্সদাতা নিজেও লাভবান হয়। ট্যাক্সের পেছনে যে মৌলিক চিন্তা কার্যকর রয়েছে তা হচ্ছে এই যে, আপনি যেসব সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন বোধ করেন এবং সরকারের মাধ্যমে সেগুলো লাভ করার জন্য আপনার আর্থিক সামর্থানুযায়ী সরকারকে চাঁদা দিন। এ ট্যাক্স আসলে প্রার্থীত সমাষ্টিক সুযোগ সুবিধা দানের বিনিময়ে আপনার নিকট থেকে আইনের বলে গৃহিত এক ধরনের চাঁদার শামিল। এ সুযোগ সুবিধা দ্বারা সমাজের অন্যদের ন্যায় একটি ইবাদত মাত্র। কোন পার্লামেন্ট বা আইন পরিষদ যাকাত ধার্য করেনা। বরং আল্লাহ নিজেই ধার্য করেছেন। প্রত্যেক মুসলমান তাকে একমাত্র মাবুদ মনে করে। যে ব্যক্তি নিজের ঈমান সংরক্ষণ করতে চায় সে কখনো যাকাত ফাঁকি দেবার বা তা থেকে নিস্কৃতি লাভের চেষ্টা করতে পারেনা। বরং তার নিকট থেকে হিসাব নেয়ার এবং যাকাত আদায করার জন্য বাইরের কোন শক্তি না থাকলেও সে নিজের মন ও ঈমানের তাগিদে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজের সম্পদের যথাযথ হিসেব করে তার যাকাত বের করবে। উপরন্তু যে সমস্ত সামজিক প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার সাথে আপনার স্বার্থ বিজড়িত এবং যেগুলি দ্বারা আপনি নিজেও লাভবান হন সেগুলো পূর্ণ করার জন্য যাকাত গ্রহণ করা হয় না। বরং এমন সব লোকের জন্য যাকাত গ্রহণ করা হয় যারা কোন না কোন ভাবে অর্থ বন্টন ব্যবস্থায় নিজেদের অংশ পায়নি বা পূর্ণাঙ্গ রুপে পায়নি এবং কোন কারণে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়। এভাবে দেখা যায় প্রকৃতি, মূলনীতি, মৌলপ্রাণসত্তা ও আকার আকৃতির দিক দিয়ে যাকাত ট্যাক্স থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু। দেশের পথ ঘাট ও রেল লাইন নির্মাণ, খাল খনন এবং আইন ও শাসন বিভাগ পরিচালনার জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা হয় না। বরং কতিপয় বিশেষ হকদারের হক আদায় করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবাদত হিসেবে ফরয করা হয়েছে। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে প্রতিদান লাভ ছাড়া এর থেকে আপনি দুনিয়ায় আর কোন প্রকার লাভবান হতে পারবেন না।
ট্যাক্স ধার্য্য করার ক্ষমতা
অনেকে এ ভুল ধারণা পোষন করেন যে, ইসলামে যাকাত আর খারাজ ছাড়া কোন প্রকার ট্যাক্স নেই। অথচ রাসূল সা. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেনঃ ‘ধন সম্পদের যাকাত ছাড়াও আর একটি হক রয়েছে’। আসলে ইসলামী শরীয়ত যে ট্যাক্সগুলি অবৈধ গণ্য করেছে সেগুলি হচ্ছে কাইসার ও কসরা এবং রাজা বাদশাহ ও আমীর ওমরাগণ কর্তক ধার্যকৃত ট্যাক্স। যেগুলোকে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ মনেকরে নিয়েছিল এবং জনগণের সম্মূখে তার আয় ব্যয়ের হিসাব পেশ করা নিজেদের দায়িত্ব মনে করতো না। তবে পরামর্শ ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত সরকার জনগণের ইচ্ছা ও পর্যায়ক্রমে যেসব ট্যাক্স ধার্য করে এবং এ খাতে সংগৃহীত সমুদয় অর্থ সর্বসাধারনের উদ্দেশ্যে গঠিত সরকারী তহবিলে জমা রাখে, জনগণের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যয় করে এবং সরকার জনগণের সম্মূখে তার হিসাব দেয়ার ব্যপারে নিজেকে দায়িত্বশীল মনেকরে সেসব ট্যাক্স ধার্য করার উপর শরীয়ত অবশ্যি কোন বিধি নিষেধ করেনি। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে সমাজে যদি কোন অস্বাভাবিক রকমের অর্থনৈতিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং এক দল লোক হারাম পদ্ধতিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, তাহলে ইসলামী সরকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরিবর্তে ট্যাক্স বসিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে এবং অন্যান্য ইসলামী আইন প্রয়োগ করে সম্পদ স্তুপীকৃত হবার পথ রুদ্ধ করতে পারে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য শাসকগণকে এমন সব একনায়কত্বমূলক ক্ষমতা দান করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে যেসব ক্ষমতা লাভ করার পর কোন এক পর্যায়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব হয়না। ফলে এক যুলুমের পরিবর্তে তদপেক্ষা ভয়াবহ যুলুমের প্রতিষ্ঠা হয়।
উত্তারাধিকার আইন
এছাড়াও ইসলামের একটি উত্তারাধিকার আইন রয়েছে। কোন ব্যক্তি কম বেশি যে পরিমাণ সম্পদ সম্পত্তি রেখে মারা যাক না কেন একটি নির্দিষ্ট বিধান অনুযায়ী তাকে বিস্তৃততর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। সর্বপ্রথম পিতা, মাতা, স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা এই সম্পত্তির অধিকারী হয়। অতপর ভাই বোনেরা হয় এর উত্তরাধীকারী এবং তাদের পর হয় নিকটবর্তী আত্নীয় স্বজনরা। যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় এবং তার কোন পর্যায়ের উত্তারাধিকারী না পাওয়া যায় তাহলে সমগ্র জাতি তার উত্তারাধিকারী হবে এবং সম্পদ সম্পত্তি বায়তুলমালের অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের জন্য ইসলাম এসব মূলনীতি ও চতুর্সীমা নির্ধারণ করেছে। এ চতুর্সীমার মধ্যে পূর্বোল্লেখিত মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে আপনারা নিজেদের জন্য ইচ্ছামত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারেন। যুগ-সমস্যা ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতি যুগে একে বিস্তারিত রূপদান আমাদের নিজেদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত। আমাদের যে দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে এবং যে বিষয়গুলো অবশ্যি মেনে চলতে হবে, তা হচ্ছে এই যে আমরা অবশ্যি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ন্যায় একটি লাগামহীন অর্থব্যবস্থার সমগ্র উপায়-উপকরণকে সমষ্টি তথা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে পারিনা। আমাদেরকে একটি চতুর্সীমার মধ্যে অবস্থান করে এমন একটি স্বাধীন এবং মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে- যেখানে মানুষের নৈতিক উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত থাকবে। সমষ্টির কল্যাণ সাধনের জন্য মানুষকে আইনের নিগড়ে বাঁধবার প্রয়োজন অতি অল্পই অনুভূত হবে। ভ্রান্ত পদ্ধতিতে যেখানে অস্বাভাবিক শ্রেণী বিভাগের অবকাশ থাকবে না এবং স্বাভাবিক শ্রেণীগুলোর মধ্যে কলহের পরিবর্তে সহযোগীতার পথ উন্মুক্ত হবে। অর্থ উপার্জনের যেসব উপায়-উপকরণকে ইসলাম হারাম গণ্য করেছে এ অর্থ ব্যবস্থায় সেসবই হারাম বিবেচিত হবে এবং সেগুলোকে ইসলাম বৈধ গণ্য করেছে একমাত্র সেগুলোই বৈধ থাকবে। বৈধ পদ্ধতিতে অর্জিত সমুদয় সম্পদের উপর ব্যক্তির ইসলাম প্রদত্ত মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার স্বীকৃত হবে। সম্পদের উপর অবশ্যি যাকাত ধার্য করা হবে এবং যারা নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী তাদের নিকট থেকে অপরিহার্যরূপে এটি আদায় করা হবে। এ উত্তারাধিকার আইন অনুযায়ী মীরাস বন্টন করা হবে। সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা ও প্রতিযোগীতা চালাবার পূর্ণ সুযোগ দান করা হবে। এমন কোন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হবেনা যেখানে ব্যক্তিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখা হবে এবং তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হবে। এ স্বাধীন ও অবাধ প্রতিযোগীতা-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে মানুষ নিজেই যদি ইনসাফ এবং ন্যয়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে আইন সেখানে অনর্থক মাথা গলাবার কোন প্রয়োজন বোধ করবেনা। কিন্তু যদি তারা ইনসাফ এবং ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকে অথবা বৈধ সীমারেখা অতিক্রম করে এবং অস্বাভাবিক ধরনের মজুদদারী প্রভৃতির পথ প্রশস্ত করতে থাকে তাহলে তাদের মৌলিক অধিকারসমূহ হরণ করার ও স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য নয় বরং নিছক ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং সীমা অতিক্রম করার প্রবণতা রোধ করার জন্য আইন অবশ্যি কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
অর্থনৈতিক কর্মী
এ পর্যন্তকার আলোচনায় প্রথম প্রশ্নের প্রথমাংশের জবাব শেষ হয়েছে। এবার ঐ প্রশ্নের দ্বিতীয়াংশের আলোচনায় আসুন। এখানে বলা হয়েছে, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জমি, শ্রম, পুজিঁ ও সংগঠন কোন ধরনের মর্যাদা লাভ করেছে? এ বষয়ে যথার্থ জ্ঞানদান করার জন্য আমি আপনাদেরকে ইসলামী ফিকাহশাস্ত্রে বর্ণিত মুযারিয়াত (ভাগ চাষ) ও মূদারিবাত (অংশীদার ভিত্তিক ব্যবসা) সংক্রান্ত আইনগুলো পাঠ করার পরামর্শ দিতে চাই। আধূনিক অর্থনীতি শাস্ত্রে এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহে জমি, শ্রম, পুজিঁ ও সংগঠনকে যে ধরনের অর্থনৈতিক উপকরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, ইসলামী ফিকাহর পুরাতন গ্রন্থসমূহে ঠিক ঐ ধরনে সেগুলো বিবৃত হয়নি। এবং ঐ বিষয়বস্তুগুলোর উপর পৃথক পৃথক গ্রন্থও রচিত হয়নি। ইসলামী ফিকাহের বিভিন্ন অধ্যায়ে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে এবং এগুলোর পরিভাষা এবং বর্ণনাভংগীও আধূনিক অর্থনীতি শাস্ত্রের পরিভাষা ও বর্ণনাভংগী থেকে আলাদা। কিন্তু যে ব্যক্তি পরিভাষা এবং বর্ণনাভংগীর দাস নয় বরং অর্থনীতির আসল বিষয়বস্তু ও সমস্যাবলী সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী সে অতি সহজেই ইসলামী ফিকাহর অর্থনৈতিক আলোচনার ধারা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে মুযারিয়াত ও মুদারিবাত সম্পর্কে যেসব বিধান লিপিবদ্ধ হয়েছে তা পর্যলোচনা করলে জমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন সম্পর্কিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী পুরোপুরি সুষ্পষ্ট হয়ে উঠে। মুযারিয়াত বলতে এমন এক ধরনের কৃষি ব্যবস্থা বুঝায় যেখানে এক ব্যক্তি জমির মালিক এবং অন্য এক ব্যক্তি তাতে চাষাবাদ করে। এ জমির ফসল থেকে উভয়ই অংশ লাভ করে। আর মুদারিবাত বলতে এমন এক ধরনের ব্যবসা বুঝায় যেখানে এক ব্যক্তির পুঁজি নিয়ে অন্য ব্যক্তি ব্যবসা চালায় এবং মুনাফায় উভয়ই অংশীদার হয়। লেনদেনের এসকল বিভাগে ইসলাম যেভাবে জমি ও ধনের মালিক এবং চাষী এবং ব্যবসায়ীর অধিকার স্বীকার করেছে তা থেকে সুস্পষ্ট জানা যায় যে, জমি এবং শ্রম উভয়ই অর্থনৈতিক কর্মী এবং এর সঙ্গে পুঁজি ও মানুষ নিজের যে শ্রম ও সাংগাঠনিক যোগ্যতা যুক্ত করে এসবই অর্থনৈতিক কর্ম রূপে স্বীকৃত। এসব কর্মী তাদের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে মুনাফায় নিজের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করে। প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম এসব বিভিন্ন ধরনের কর্মীর মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্কের ব্যাপারটি প্রচলিত রীতির উপর ছেড়ে দেয়। কারণ প্রচলিত পদ্ধতিতে মানুষ যদি নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ইনসাফ করে তাহলে সেখানে আইনের হস্তক্ষেপের কোন প্রয়োজন থাকে না কিন্তু যদি কোন ব্যাপরে ইনসাফ না হয় তাহলে অবশ্যি ইনসাফের সীমা নির্ধারণ করা আইনের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হবে। যেমন মনে করুন আমি জমির মালিক। আমার জমি এক কৃষককে বর্গা দিলাম বা আমার জমিতে এক কৃষককে পারিশ্রামিকের বিনিময়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত করলাম অথবা কাউকে জমি ঠিকে দিলাম তার সাথে প্রচলত রীতি অনুসারে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে আমার শর্ত স্থিরীকৃত হলো। এ ক্ষেত্রে আইনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তবে যদি আমি ঐ কৃষকের সাথে বেইনসাফী করি তাহলে অবশ্যি সে ক্ষেত্রে আইনের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হবে। দেশের সংবিধানে এ উদ্দেশ্যে কৃষি সংক্রান্ত ধারা সন্নিবেশ করা যেতে পারে। ভাগচাষী, ভূমি শ্রমিক বা ভূমি মালিক কারো স্বার্থ যাতে বিঘ্ন না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। অনুরূপভাবে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যতক্ষণ ধনের মালিক এবং ব্যবসায়ে পরিশ্রমকারী ও সংগঠনকারীর মধ্যে ন্যায়নীতি সহকারে ব্যবসায়ীক চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকবে এবং কেউ কারোর হক মারার চেষ্টা করবেনা বা কারোর ওপর অত্যাচার করবেনা ততক্ষণ আইন সেখানে হস্তক্ষেপ করবেনা। তবে এসব ব্যাপারে কোন পক্ষ যদি কোন প্রকার ব্নেসাফী করে তাহলে সে ক্ষেত্রে আইন কেবল হস্তক্ষেপ করার অধিকারীই হবেনা পুজিঁ, শ্রম ও সংগঠন সবাই যাতে ব্যবসায়ের মুনাফার ন্যায়ানুগ অংশ লাভ করতে পারে সে জন্য ইনসাফপূর্ণ বিধি-বিধান প্রণয়ন তার দায়িত্ব বিবেচিত হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব
দ্বিতীয় প্রশ্নে বলা হয়েছে, যাকাত ও সাদকাকে অর্থনৈতিক কল্যাণ ও উন্নয়নে ব্যবহার করা যায় কিনা? এর জবাবে বলা যায়, যাকাত ও সাদকার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা কথা খুব গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। তা হচ্ছে এই যে, অর্থনৈতিক কল্যাণ ও উন্নয়ন বলতে যদি সারা দেশের ও সমগ্র জাতির কল্যাণ ও উন্নয়ন বুঝানো হয় তাহলে এ উদ্দেশ্যে যাকাত ও সাদকার ব্যবহার বৈধ নয়। যাকাতের ব্যবহার সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। অর্থাৎ সমাজের কোন ব্যক্তি যাতে তার মৌলিক মানবিক প্রয়োজন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না থাকে যাকাত মূলত সেদিকে দৃষ্টি রাখবে। এছাড়াও যাকাতের সাহায্যে আমরা সমাজের এমন এক শ্রেণীর অর্থনৈতিক প্রয়োজন মিটাতে পারি যারা অর্থোপার্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাবার যোগ্যতা রাখেনা। যেমন এতিম, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু, অক্ষম বা সাময়িকভাবে বেকার অথবা সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণের স্বল্পতা হেতু যারা অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে পারছে না এবং সামান্য সাহায্য সহায়তা লাভ করলে আত্ননির্ভশীল হতে পারে বা যারা ঘটনাক্রমে কোন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ধরনের লোকদের সাহায্যে-সহায়তা দান করার জন্য যাকাত ধার্য করা হয়েছে। আর সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যাকাত ছাড়া অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্নের জবাব
তৃতীয় প্রশ্নে বলা হয়েছে, আমরা কি সুদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারি?
এর জবাবে বলা যায়, অবশ্যি করতে পারি। ইতিপূর্বে কয়েক’শ বছর পর্যন্ত এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল, আর আজ যদি আপনি অন্যের অন্ধ অনুস্মৃতি ত্যাগ করে যথার্থই এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংকল্প নেন তাহলে এর প্রতিষ্ঠা মোটেও কঠিন হবেনা। ইসলামের আগমনের পূর্বে বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা আধূনিক বিশ্বের ন্যায় সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছিল। ইসলাম এ অর্থব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে এবং সুদকে হারাম গণ্য করে। প্রথম আরবে সূদ হারাম হয়। অতপর যেখানেই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে সেখানেই সুদ হারাম হতে থাকে। সমগ্র অর্থ ব্যবস্থা সুদ ছাড়াই চলতে থাকে। শতশত বছর ধরে এ অর্থ ব্যবস্থা দুনিয়ার বুকে পরিচালিত হয়েছে এবং বর্তমানেও এর জীবনী শক্তির অভাবের কোন কারন দেখা যায়না। যদি আমাদের মধ্যে ইজতিহাদের শক্তি থাকে এবং আমরা ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান হই ও এই সঙ্গে যে বস্তুকে আল্লাহ হারাম গণ্য করেছেন তাকে হারাম করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে পারি তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা সুদের বিলোপসাধন করে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার প্রচলন করতে পারি। আমার লেখা সুদ নামক গ্রন্থে আমি এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ ব্যপারে বিশেষ কোন জটিলতা নেই বলে আমি সেখানে দেখিয়েছি। বিষয়টি অত্যান্ত সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। পুঁজি নিয়ে যারা কারবার খাটাচ্ছে ও পরিশ্রম করছে এবং সাংগাঠনিক তৎপরতা ও কার্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে তারা মুনাফা অর্জনে সফল হোক বা না হোক সেদিকে দৃষ্টি না রেখে পুঁজির ঋণের আকারে কারবার লগ্নি হবার ও একটি নির্ধারিত হারে মুনাফা অর্জন করার কোন অধিকার নেই। সুদের আসল অনিষ্টকারিতা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজের পুঁজি শিল্প কারখানায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বা কৃষিফার্মে ঋণ আকারে লগ্নি করে এবং পূর্বাহ্নেই তাদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা স্থীরিকৃত করে নেয়। নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে ঐ পুঁজি লগ্নীকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কারবারে লাভ লোকসানের বা লাভ হলে কি পরিমানে হচ্ছে তার কোন পরোয়াই করেনা। সে কেবল বছরে বছরে বা মাসে মাসে নিজের নির্দিষ্ট হারে মুনাফা লাভ করেই যাবে এবং আসল ফিরিয়ে পাওয়ার অধিকারী হবে। এটিই আমাদেরকে খতম করতে হবে। কোন ব্যক্তিই এটিকে যুক্তি সংগত প্রমাণ করতে পারেনা। এর বৈধতার কোন কারন পেশ করা যেতে পারেনা। পক্ষান্তরে ইসলাম যে নীতি পেশ করে তা হচ্ছে এই যে, আপনি যদি ঋণ দেন তাহলে ঋণের আকারেই তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিজের ঋণ বাবদ প্রদত্ত অর্থ ফেরত নেয়ার অধিকার আপনার থাকবে। আর যদি আপনি মুনাফা অর্জন করতে চান তাহলে সোজাসুজি আপনাকে কারবারে অংশীদার হতে হবে এবং সেভাবেই চুক্তি করতে হবে। নিজের পুঁজি কৃষি, শিল্প, ব্যবসায় যেখানেই লাগাতে চান এ শর্তে লাগান যে, তা থেকে মুনাফা অর্জিত হবে একটি বিশেষ হারে তা আপনার ও কৃষি, শিল্প, ব্যবসায় পরিচালনাকারীদের মধ্যে বন্টিত হবে। এটিই ইনসাফ এবং ন্যায়নীতির দাবী এভাবেই অর্থনৈতিক জীবনের সমৃদ্ধি সম্ভব। সুদ পদ্ধতি খতম করে এ দ্বিতীয় পদ্ধতিটির প্রচলনের পথে বাধা কোথায়? বর্তমানে যে পুঁজি ঋণ আকারে খাটানো হয় তা অংশীদারী নীতির ভিত্তিতে খাটালেই হবে। সুদের হিসেবের ন্যায় মুনাফার হিসেব কষতে হবে। এ ব্যপারে কঠিন সমস্যা দেখা যায়না। সমস্যা হচ্ছে আমাদের মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই। আমরা অন্ধ অনুসৃতিতেই অভ্যস্ত। পূর্ব থেকে যা চলে আসবে চোখ কান বন্ধ করে তা চালিয়ে যেতেই আমরা চাই। ইজতিহাদ করে ইসলাম বিধৃত মূলনীতির উপর ভিত্তিতে কোন সুসামঞ্জস্য, বৈধ ও ইনসাফপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে আমরা প্রস্তুত নই। বেচারা আলেম ওলামাদের নিন্দা করা হয় যে, তারা তাকলীদ তথা অন্ধ অনুসরণ করে; ইজতিহাদে প্রবৃত্ত নয়। অথচ তারা নিজেরাই (পাশ্চাত্য চিন্তার) অন্ধ অনুসরণ করে চলছে, ইজতিহাদে তারাও উদ্যোগী নয়। আমাদের রোগ এ মারাত্নক পর্যায়ে উপনীত না হলে বহু পূর্বেই এ সমস্যার সমাধান হতো।
চতুর্থ প্রশ্নের জবাব
শেষ প্রশ্নে বলা হয়েছে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলোর পরস্পরের মধ্যে কোন পর্যায়ে সম্পর্ক রয়েছে?
এর জবাবে বলা যায়, এ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক একটি গাছের শিকড়, কান্ড, শাখা-প্রশাখা ও পত্রের মধ্যকার সম্পর্কের ন্যায়। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নৈতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি এখান থেকেই। ইবাদাত বা প্রচলিত অর্থে ধর্মীয় ব্যবস্থাও এখান থেকেই সৃষ্টি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত ব্যবস্থার উৎসও এখানেই। এরা সবাই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যদি আপনি আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান এনে থাকেন তাহলে অনিবার্যভাবে ইসলাম প্রদত্ত নৈতিক আদর্শ ও নীতি অবলম্বন করতে হবে। ইসলাম প্রদত্ত নীতির ভিত্তিতে আপনাকে সমাজ জীবন গড়ে তুলতে হবে, ইসলামী নীতির ভিত্তিতে অর্থনীতির সমস্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালিত করতে হবে। যে আকিদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনি নামায পড়েন ঐ একই আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনাকে ব্যবসায় পরিচালনা করতে হবে। যে দ্বীনের বিধি-বিধান আপনার রোযা ও হজ্জ নিয়ন্ত্রণ করে ঐ একই দ্বীনের বিধি-বিধান আদালত ও বাজারের জীবনও নিয়ন্ত্রণ করবে। ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থণৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাগুলো পৃথক এককের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং এগুলো একই ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ ও শাখা মাত্র। এগুলো একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত এবং প্রত্যেকটি অন্যটির সাহায্যে শক্তিশালী। যেখানে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের অস্তিত্ব না থাকে এবং উৎসগুলো থেকে উৎসারিত নৈতিক বৃত্তি অনুপস্থিত থাকে সেখানে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোনদিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। কোনক্রমে প্রতিষ্ঠিত করলেও তা টিকে থাকতে পারেনা। অনুরূপভাবে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে একই কথা। আল্লাহ, রসূল, আখেরাত ও কুরআনের প্রতি ঈমান না থাকলে এ ব্যবস্থা চলতে পারেনা। কারন ইসলাম যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দান করেছে তার ভিত্তি হচ্ছেঃ আল্লাহ আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক, রসূল সা. তাঁর প্রতিনিধি, কুরআন তার অবশ্য পালনীয় ফরমান এবং আমাদেরকে একদিন সর্বশক্তিমান আল্লাহর সম্মূখে আমাদের কাজের জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামে ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কহীন কোন পৃথক এককের অধিকারী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে বা ইসলামের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধর্মীয় এবং নৈতিক ব্যবস্থা থেকে সম্পর্কহীন থাকতে পারে এ ধারনা সম্পূর্ন ভ্রান্ত। যে ব্যক্তি ইসলামকে জেনে বুঝে গ্রহন করেছে সে কখনো এ ধারনাই পোষণ করতে পারেনা যে, মুসলমান থাকা অবস্থায় তার রাজনীতি অর্থনীতি ও আইন আদালতের ক্ষেত্রে ইসলাম থেকে আলাদা থেকে ইসলাম ছাড়া অন্যকোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে কেবলমাত্র ‘ধর্মীয়’ ব্যাপারে ইসলামের আনুগত্য করার নাম ইসলামী জীবন হতে পারনা।
— সমাপ্ত —