কমীর্য় বৈশাদৃশ্যের তত্ত্বকথা
মুনাফিকীর পর দ্বিতীয়ত আমরা যে জিনিসকে নতুন-পুরাতন সকল মুসলমানের জীবন হইতে দুর করিতে বলি তাহা হইতেছে কর্মীয় বৈসাদৃশ্য- কথা ও কাজের অসামঞ্জস্য। মানুষ মুখে মুখে যে আদশের্র প্রতি ঈমান গ্রহণের দাবী করে, উহার বিপরীত কাজ করাকেই বলা হয় অসামঞ্জস্য। বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করাকেও অসামঞ্জস্য বলা হয়। কাজেই কেহ যদি সমগ্র জীবনকে খোদার বন্দেগীর অনুসারী করার দাবী করে, তবে চেতনা থাকিতে জীবনে কোন একটি কাজও এই বন্দেগীর বিপরীত করা কোনক্রমেই উচিত হইতে পারে না। মানবীয় দুর্বলতার কারনে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটিলে সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ত্রুটি স্বীকার করিয়া খোদার বন্দেগীর দিকে প্রত্যাবর্তন করিবে। সমগ্র জীবনকে খোদার দাসত্ব স্বীকার ভিত্তিতে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যের সহিত গঠন করা ঈমানের ঐকান্তিক দাবী। বহুরূপী হওয়াতো দূরের কথা, প্রকৃত ঈমান দ্বিরূপী হওয়াও বরদাশত করে না। আমরা যদি একদিকে খোদা, পরকাল, ওয়াহী, নবুয়াত এবং শরীয়তকে মানিয়া চলার দাবী করি, আর অপরদিকে বৈষয়িক স্বার্থ, সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য বস্তুবাদি, খোদা ও পরকালের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টিকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষালাভের জন্য যাই; এইরূপ শিক্ষাব্যবস্হা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করি ও অপরকেও সেই জন্য উৎসাহিত করি, তবে আমাদের দৃষ্টিতে ইহা বহুরূপী নীতি ভিন্ন আর কিছুই নহে। একদিকে খোদার শরীয়াতের প্রতি ঈমান গ্রহণের দাবী করি, আর সেই সঙ্গে খোদার দুশমনদের রচিত আইনের ভিত্তিতে স্হাপিত আদালতের জজ ও উকিল হইতে এবং সেই আদালতের বিচারকের উপর সত্য-মিথ্যা, হক, না-হক নির্ধারণে একান্তভাবে নির্ভর করি; একদিকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ি,অপরদিকে মসজিদ হইতে বাহির আসিয়াই নিজেদের জীবনে লেন-দেনের ব্যাপারে, জীবিকা নির্বাহের উপায় অবলম্বনে, বিবাহ-শাদীতে, মীরাস বণ্টনে, রাজনৈতিক আন্দোলন সমূহে এবং নিজেদের সকল প্রকার পার্থিব খোদাকে এবং খোদার শরীয়তকে ভুলিয়া গিয়া কোথাও নিজেদের নফসের দাসত্ব করি, কোথাও বংশীয়নিয়ম প্রথা, কোথাও সমাজের রীতি-নীতি এবং কোথাও খোদাদ্রোহী শাসকদের দাসত্ব করি; একদিকে আমরা খোদার নিকট এই বলিয়া বারবার প্রতিশ্রুতি দেই যে, আমরা তোমারই বান্দাহ-আমরা তোমারই ইবাদাত ও দাসত্ব করি, আর অপরদিকে আমরা এমন সকল ‘মূর্তির’ পূজা করি- যাহার সহিত আমাদের কিছু না কিছু স্বার্থ, ভালবাসা, দরদ, মনের সংস্কার, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট রহিয়াছে, তবে ইহা সবই কর্মীয় বৈষম্য, অসামঞ্জস্য এবং মুনাফিকী ভিন্ন আর কিছুই নহে। বর্তমান মুসলমানদের জীবনে যে এই ধরনের অসংখ্য বৈশাদৃশ্য বর্তমান রহিয়াছে, তাহা চক্ষুষ্মান ব্যক্তিই অস্বীকার করিতে পারে ন। আমার মতে মুসলিম জাতির ইহা এক মারাত্নক রোগ, যাহা ইহার চরিত্র ও প্রকৃতি এবং দ্বীন ও ঈমানকে ভিতর হইতেই ঘূণের ন্যায় অন্তঃসারশূন্য করিয়া দিতেছে। বাস্তব জীবনের প্রতোকটি ক্ষেত্রেই আজ যে তাহাদের দূর্বলতা প্রকট হইয়া উঠিয়াছে, তাহারও মূল কারণ হইতেছে এই কর্মীয় বৈষম্য ও বৈসাদৃশ্য। দীর্ঘকাল হইতে মুসলিম জাতিকে এই বলিয়া প্রবোধ দেওয়া হইতেছে যে, মুখ দ্বারা তাওহীদ ও নবুয়াতের সাক্ষ্য দিলে এবং নামায, রোযা ইত্যাদি কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করিলেই সকল কতর্ব্য আদায় হইয়া গেল, অতঃপর জীবনের অন্যান্য সকল কাজে দ্বীন বিরোধী ও ঈমান বিরোধী কর্মনীতি অবলম্বন করিলেও তোমাদের ঈমানের একবিন্দু ক্ষতি হইবে না, আর তোমাদের মুক্তিলাভের ব্যাপারেও কোন আশঙ্কা দেখা দিবে না। এই সুবিধা দানের (Allowance) সীমা ক্রমশ এতদুর সম্প্রসারিত হইয়া পড়িল যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমান হওয়ার জন্য নামায পড়াও আর কোন অনিবার্য শর্ত রহিল না। মুসলমানদের মধ্যে এই ধারনাও বদ্ধমূল করিয়া দেওয়া হইল যে, ঈমান ও ইসলামের স্বীকারোক্তি হইলেই যথেষ্ট, কার্যত সমস্ত জীবন ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শে চলিলেও কোন ক্ষতি নাই। ইহারই ফলে আজ দেখিতেছি সকল প্রকার ফাসিকী, কাফিরী, পাপ, নাফরমানী, যুলুম ও স্পষ্ট খোদাদ্রোহিতাকে অবলীলাক্রমে ইসলামের নামে চালাইয়া দেওয়া হইতেছে। মুসলমানগণ বর্তমানে যে পথে তাহাদের সময় শ্রম, ধন-মাল, শক্তি-সামর্থ্য, যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা এবং জীবন ও প্রাণ একান্তভাবে নিযুক্ত করিতেছে, যেসব উদ্দেশ্য ও লক্ষের পশ্চাতে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা-সাধনা করিতেছে, তাহার অধিকাংশই যে তাহাদের ঈমানের সম্পূর্ণ বিপরীত, এইটুকু কথাও আজ মুসলমানরা অনুধাবন করিতে সমর্থ হন না। বস্তুত এই অবস্তা বর্তমান থাকিতে অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণেরও কোন সাথর্কতা নাই। কারণ এই লবনের খনিতে বিচ্ছিন্নভাবে যত লোকই প্রবেশ করিবে, তাহারা লবনের সহিত মিশিয়া একাকার হইয়া যাইবে। কাজেই এই সব বৈষম্য ও কর্মীয় বৈসাদৃশ্য হইতে জীবনকে পবিত্র করার জন্য মুসলমানকে আহবান জানান আমাদের মূল দাওয়াতের একটি অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তিকেই আমরা সম্পূর্ণ একমুখী একনীতির অনুসারী ও একই আদর্শবাদী হইতে এবং ঈমান ও ইসলামী জীবন ধারার বিপরীত সকল প্রকার কাজ-কর্মের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিতে না পারিলে, তাহা করিবার জন্য অবিশ্রান্ত চেষ্টা ও সাধনা করিতে আহবান জানাই। অনুরূপভাবে আমরা ঈমানের সকল দাবীকেই গভীর ও সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করিতে এবং তাহা পূরণ করিতে প্রস্তুত থাকার জন্য প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তিকেই বলিয়া থাকি।
নেতৃত্বে মৌলিক পরিবতর্নের আবশ্যকতা
আমাদের ইসলামী দাওয়াতের তৃতীয় দিক হইতেছে নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন সৃষ্টির সাধনা। ইতঃপূর্বে যে দুইটি বিষয়ের ব্যাখ্যা করিয়াছি, এই তৃতীয় বিষয়টিকে উহার অনিবার্য ফল হিসাবেই গ্রহন করিতে হয়। আমাদের নিজেদেরকে এক খোদার দাসত্বের নিকট সোপর্দ করিয়া দেওয়া এবং এই ব্যাপারে কোন প্রকার মুনাফিকী ও বৈসাদৃশ্যের ফাঁক না রাখিয়া সম্পূর্নরূপে একনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করিতে হইলে অনিবার্যরূপে আমাদেরকে বর্তমান জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্হায় বিপ্লব সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করিতে হইবে। বর্তমানে আমাদের জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্হা কুফর, নাস্তিকতা, শিরক, ফাসিকী ও অসচ্চরিত্রতার ভিত্তিতে স্হাপিত রহিয়াছে। ইহার পরিকল্পনা রচনাকারী, চিন্তাশীল এবং কর্মপরিচালক রাষ্ট্রনীতিবিদগণ নির্বিশেষে খোদা এবং তাহার বিধানকে অমান্য করিতেছে। বস্তুত কতৃত্ব ও নেতৃত্ব যতদিন পর্যন্ত এইসব লোকের করায়ত্ত থাকিবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রচার-বেতার, আইন রচনা ও জারি করা অর্থ-বিভাগ, ব্যবসায়-শিল্প, কৃষি বিভাগ, রাষ্ট্র পরিচালনা, ব্যবস্হাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি সকল ব্যাপারে ও প্রত্যেকটি জিনিসেরই মূল চাবিকাঠি যতদিন ইহাদের হাতে থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত দুনিয়াতে খাঁটি মুসলমানের ন্যায় জীবন যাপন করা এবং খোদার দাসত্বকে জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা কেবল কার্যতই কঠিন নহে, ভবিষ্যত বংশধরদেরকে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসী রাখিয়া যাওয়াই সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব ব্যাপার। এতদ্ব্যতীত খোদার সন্তোষ এবং বিধান অনুযায়ী দুনিয়া হইতে ধ্বংস ও বিপর্যয়মূলক অবস্হা দূর করিয়া শান্তি ও নিরাপত্তা এবং স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দের প্রতিষ্টা করিতে চেষ্টা করা খোদার প্রত্যেক নিষ্ঠাবান বান্দাহরই প্রদান কর্তব্য। কিন্তু দেশ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব যতদিন পর্যন্ত খোদার সৎ বান্দাহদের হাতে অর্পিত না হইবে, ততদিন পর্যন্ত এই বিরাট ও মহান উদ্দেশ্য কিছুতেই লাভ হইতে পারে না। বস্তুত ফাসিক-ফাজির, খোদাদ্রোহী এবং শয়তানের দাসানুদাসগণ বিশ্বের নেতা, ব্যবস্হাপক ও পরিচালক থাকিলে যুলুম, অত্যাচার, অশান্তি, বিপর্যয়, নৈতিক ভাঙ্গন এবং ব্যাপক অধঃপতনের সম্পূর্ণ বিপরীত। অতএব আমরা ‘মুসলিম’ হইলে দুনিয়ার বুক হইতে পথভ্রষ্ট নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব চিরতরে খতম করিয়া দেওয়া এবং কুফর ও শিরকের প্রাধান্য চূর্ণ করিয়া সত্য ও সঠিক জীবন-ব্যবস্হা দ্বীন-ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা ও সাধনা করা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হইয়া পড়ে।
নেতৃত্বের পরিবতর্ন কিরূপে হইবে
কিন্তু শুধু চাহিলে বা ইচ্ছা করিলেই নেতৃত্বের এই পরিবর্তন বাস্তবায়িত হইতে পারে না। আল্লাহ পৃথিবীর সুব্যবস্হার উপর নিশ্চয়ই অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বিশ্ব পরিচালনা ও ব্যবস্হার জন্য কিছু না কিছু যোগ্যতা, শক্তি এবং বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন রহিয়াছে। তাহা যথাযথভাবে অর্জিত না হইলে মানুষের কোন দলই বিশ্ব-পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে লইতে এবং তাহা সঠিকভাবে চালাইয়া যাইতে পারে না। খোদার নেক বান্দাহদের কোন সুসংগঠিত দল যদি বিশ্ব-পরিচালনার যোগ্য না থাকে, তবে খোদার বিধান অনুযায়ী ‘অঈমানদার’ ও অসৎ লোকদের হাতেই দুনিয়ার ব্যবস্হাপনা ও পরিচালনার কর্তত্ব ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু এমন একটা দল যদি বাস্তবিকই বর্তমান থাকে, যাহাদের খাঁটি ঈমান আছে, যাহারা প্রকৃত সৎ এবং যাহাদের বিশ্ব-পরিচালনার জন্য অপরিহার্য গুণাবলী, শক্তি ও কর্মদক্ষতা কাফিরদের অপেক্ষা বেশী আছে, তবে মনে রাখিতে হইবে যে, খোদার বিধান কখনও যালিম নহে- বিপর্যয়কামীও নহে। অতএব এমতাবস্হায় বিশ্বের নেতৃত্ব ফাসিক ও কাফিরদের হাতেই থাকিয়া যাইবে, এই ধারণা কিছুতেই করা যায় না। কাজেই দুনিয়ার কর্তত্ব ফাসিক ও কাফিরদের হাত তইতে সৎ ও ঈমানদার লোকদের হাতে শুধু সোপর্দ করাই আমার উদ্দেশ্য নহে, বরং সক্রিয়ভাবে ঈমানদার ও সৎলোকদের একটি আদর্শ দল গঠন করাও আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের দাওয়াত এই যে, ঈমানদার ও সালেহ লোকদের এমন একটি দল ও সংগঠন করা হউক, যাহারা শুধু ঈমানের দিক দিয়াই মজবুত হইবে না, ইসলামের নিষ্ঠাবান অনুসারীই হইবে না, তাহাদোর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চরিত্রই কেবল পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হইবে না, বরং সেই সঙ্গে নিষ্ঠার সহিত বিশ্বের বাস্তব জীবনধারা, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার তুলনায় তাহারা অনেকগুণে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিবে।
বিরুদ্ধতা ও উহার কারণ
আমাদের উদ্দেশ্য সংক্ষেপে ইহাই। এই দিকেই আমরা বিশ্বের অধিবাসীদের আহবান জানাইয়া থাকি। কিন্তু বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এই আন্দোলণের সর্বপ্রথম বিরুদ্ধতা হইয়াছে মুসলমানদের তরফ হইতে। অমুসলিমগণ- যাহারা এই আন্দোলনের বিরোধী হইতে পারে, আজ পর্যন্ত ইহার বিরুদ্ধে কোন কথাই বলে নাই, কোথাও কার্যত কোন বিরুদ্ধতা কেহ করেও নাই। ভবিষ্যতেও এইরূপ অবস্হা বর্তমান থাকিবে, কিনা, তাহা বলিতে পারি না; আর কতদিন পযর্ন্ত এই অবস্হা বর্তমান থাকিবে, তাহা অনুমান করাও সম্ভব নহে। কিন্তু তবুও আমাদের উপরিউক্ত দাওয়াত শ্রবণ করিয়া নাক সিটকানো, ইহাকে বিপদের পূর্বাভাষ মনে করা এবং উহার বিরুদ্ধতার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হওয়া প্রভৃতি কোন একটি কাজও আজ পর্যন্ত অমুসলিমগণ করে নাই- করিয়াছে আমাদের মুসলমান ভাইগণ। সম্ভবত এই ধরনের অবস্হায়ই আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের বলা হইয়াছিলঃ( ) ‘তোমরাই সবর্প্রথম ইহার অমান্যকারী হইও না।’
হিন্দু, শিখ এবং ইংরেজদের সহিত এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করিয়াছি। আমাদের কথাবার্তা বিস্তারিতভাবে শুনিয়া কিংবা আমাদের বই-পুস্তুক পাঠ করিয়া তাহাদের একজন লোকও আজ পর্যন্ত ইহাকে ‘সত্য নহে’ বলে নাই। কিংবা ইহার বিরুদ্ধতা করার প্রয়োজনীয়তাও তাহারা প্রকাশ করে নাই। অনেক অমুসলিম এতদূর বলিয়াছি যে, ইসলামের দাওয়াত যদি এই দেশে অনেক আগেই পেশ করা হইত এবং বহিরাগত ও স্হানীয় সবল মুসলমানই যদি ইহাকে কায়েম করিতে চেষ্টা করিতেন, তবে দেশের অবস্হা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হইতে পারিত। অনেক অমুসলিম এতদূর বলিয়াছি যে, কোন সমাজ বা দল যদি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিত এই আদর্শ অনুযায়ী কাজ করিত, তাহার জীবন ও মৃত্যু যদি এই উদ্দেশ্যের জন্যই উৎসর্গীকৃত হইত, তবে অমুসলিমগণ ইহার অন্তর্ভুক্ত হইতে কোনরূপ দ্বিধা সংকোচ করিত না। এতদসত্ত্বেও সর্বপ্রথম আমাদের বিরুদ্ধতা করিবার জন্য মুসলিমগণই অত্যধিক তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের বিরুদ্বে কুৎসা রটনায়, নানাবিধ ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপনে ইহারাই অগ্রসর হইয়াছে। আবার মুসলমানদের মধ্যেও অধিক তৎপরতা দেখাইতেছে ধর্মপন্হী দল। সর্বাপেক্ষা মজার ব্যাপার এই যে, আমাদের উদ্দেশ্য ও দাওয়াতকে আজ পর্যন্ত কেহই বাতিল বা ‘সত্য নহে’ বলিবার সাহস করে নাই। স্বম্ভবত ইহার একমাত্র কারণ এই যে, আমাদের দাওয়াত ও আন্দোলনের উপর সম্মুখ দিক হইতে আক্রমণ (FRONTAL ATTACK) করা কাহারও পক্ষেই সম্ভব নহে। এই জন্যই কখনো পশ্চাৎ দিক হইতে, কখনো ডান দিক আর কখনো বাম দিক হইতে ইহার উপর আক্রমণ করা হয়। কখনো বলা হয়ঃ কথা তো ঠিক, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু আন্দোলনকারীগণের মধ্যে এই দোষ বা ত্রুটি রহিয়াছে। কেহ বলে, ইহারই সত্যতা অনস্বীকার্য, তবে এইরূপ আন্দোলন পরিচালনার জন্য সাহাবাদের ন্যায় লোকদেরই দরকার আর বতর্মানে তাহাদেরকে কোথায় পাওয়া যাইবে? কখনো বলা হয়, ইহা নিঃসন্দেহে ইসলামেরই দাওয়াত, তবে এই যুগে ইহা আদৌ চলিতে পারে না। কেহ বলে এই দাওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে কেহ টু- শব্দটি করিতে পারে না, কিন্তু মুসলমানদের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্হার পরিপ্রেক্ষিতে ইহা গ্রহণ করা তাহাদের পক্ষে বিপজ্জনক হইবে। এখানেই শেষ নহে, মুসলমানদের মধ্য হইতে খোদার কোন বান্দাহ যদি আমাদের এই দাওয়াত কবুল করেন এবং নিজের জীবনক্ষেত্র হইতে প্রকৃত মুনাফিকী ও কর্মীয় বৈসাদৃশ্য দূর করিতে যত্নবান হন, সমগ্র জীবনকেই খোদার বন্দেগীর অধীন করিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত করেন, তবে তাহার ভাই পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবই সর্বপ্রথম তাহার বিরুদ্ধতা করার দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়। অনেক ধার্মিক ও মুত্তাকী ও এমন দেখা গিয়াছে, যাহাদের কপালে সিজদার চিহ্ন পড়িয়াছে, ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনাই যাহাদের রসনা চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকে, তাহারাও তাহার বিরুদ্ধতা করিতে বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করে না। তাহাদের পুত্র, ভ্রাতা কিংবা কোন আত্মীয় এই আন্দোলনে যোগদান করুক ইহা আদৌ সহ্য করিতে প্রস্তুত নহে। বস্তুত আমাদের এই আন্দোলনের বিরোধিতা সর্বপ্রথম মুসলমানদের করা, তাও আবার দুরিয়ার লোকদের অপেক্ষা দ্বীনদার লোকরাই বেশী- ইহা এক মারাত্মক রোগের পরিচয় সন্দেহ নাই। এই রোগ যদিও চাকচিক্যপূর্ণ বহিরাবরণে আচ্ছাদিত ছিল, কিন্তু ইহার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। আমরা যদি দাওয়াতকে নিছক একটি জ্ঞান ও গবেষণামূলক আন্দোলন হিসাবে পেশ করিতাম এবং এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিতে লোকদের আহবান জানাইতাম, তবে আমরা বলিতে পারি যে আমাদের এই কাজের বিরুদ্ধতা না হইয়া চতুর্দিক হইতে ইহার প্রশংসা ও ধন্যবাদের পুষ্প বর্ষিত হইত। খোদা ছাড়া অপর কাহারও দাসত্ব করা উচিত কিংবা মুসলমানদের মুনাফিকী ও ঈমান বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা উচিত অথবা মানব জীবনের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সৎ মুসলমানদের হাতে নহে- কাফিরদেরই করায়ত্ত থাকা উচিত- খোদার শরীয়াতের বদলে কাফিরী আইন দুনিয়ায় চলা উচিত- এই সব কথা কি কোন মুসলমান স্বীকার করিতে পারে? কিন্তু আমি পূর্ণ দৃঢ়তার সহিত বলিতে পারি, আজ পর্যন্ত আমরা যত কথাই বলিয়াছি, তাহার একটিও নিছক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে পেশ করি নাই, বরং সেই সঙ্গে তদানুযায়ী বাস্তব কাজেরও আহবান জানাইয়াছি। যদি তাহা না করিতাম, শুধু একটি তত্ত্ব হিসিবেই তাহা পেশ করিতাম, তবে একজন মুসলমানও উহার বিরুদ্ধে টু- শব্দটি করিতে সাহস পাইত না। কিন্তু ব্যাপার এই যে, আমরা তাহা করিতে পারি না। আমাদের দাওয়াত তো ঈমানের দৃষ্টিতে প্রত্যেক সত্যকে প্রথমত আমাদের নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করা এবং পরে আমাদের বেষ্টনীতে ও সমগ্র পৃথিবীতে কার্যত কায়েম করা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখিলে বলা যায়, ইতঃপূর্বে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনেও ঠিক এই ধরনেরই পরিস্হিতির উদ্ভব হইয়াছিল। জাহিলী আরবের কাব্য- সাহিত্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বীকার করিবেন যে, হযরতের উপস্হাপিত তাওহীদ ও নৈতিক বিধান আরব দেশে কিছুমাত্র নতুন জিনিস ছিল না। অনুরূপ তাওহীদবাদী মতবাদ ও চিন্তাধারা জাহিলী যুগের অসংখ্য কবি এবং বক্তাও পেশ করিয়াছিল, ইসলামী নৈতিকতার অধিকাংশ কথা তাহারাও বলিয়াছিল। কিন্তু পার্থক্য ছিল এই যে, নবী করীম (সা.) নির্ভেজাল ও অবিমিশ্র সত্যকে একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্হা হিসাবে পেশ করিয়াছিলেন এবং প্রকৃত তাওহীদের বিপরীত ভাবধারাকে বাস্তব জীবন ক্ষেত্র হইতে দূর করিয়া দিয়া সমগ্র জীবনকে এই তাওহীদের ভিত্তিতে গঠন করার আহবান জানাইয়াছিলেন। সেই সঙ্গে নৈতিক চরিত্রের মূলনীতিসমূহকে পরিপূর্ণ বাস্তব জীবনের ভিত্তি হিসাবে কার্যত স্হাপিত করারও দাওয়াত দিয়াছিলেন। ঠিক এই জন্যই যে কথা বলা ও প্রচার করার কারণে বরং বাতিল ব্যবস্হার সহিত সংশ্লিষ্ট সকল সুযোগ-সুবিধাও পরিত্যাগ করিতে এবং পূর্ণ নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও সামঞ্জস্যের সহিত দ্বীন-ইসলাম অনুসরণ করিয়া চলিবার আহবান জানাই; উপরন্তু সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জান-মাল, সময়-শ্রম সব কিছুই উৎসর্গ করিয়া চেষ্টা-সাধনা করিবার জন্যও যখন আহবান জানাই, তখন এই ‘মারাত্মক অপরাধ’ (?) যে বাস্তবিকই ক্ষমার যোগ্য নহে, তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন। আমাদের কথা যদি সত্য বলিয়া মানিয়া লওয়া হয়। যদি বলা হয় যে, দ্বীন-ইসলামের ইহাই দাবী, ইহা পূরণের জন্য একনিষ্ঠ ও একমুখ হওয়া কর্তব্য, প্রকৃতপক্ষে বাতিল ব্যবস্হার সহিত ঈমানদার ব্যক্তিকে সমঝোতা নহে, সংঘর্ষের সৃষ্টি করিতে হইবে এবং সেই জন্য দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাহা হইলে নিম্নলিখিত দুইটি উপায়ের যে কোন একটিকে গ্রহণ করা ভিন্ন আর কিছুই করিবার থাকে না। হয় নিজেদের স্বার্থের কোরবানী বরদাশত করিয়া কার্যত এই আন্দোলনে ঝাপাইয়া পড়িতে হয়, (কিন্তু এই কাজের তীব্রতা ও গুরুত্ব ভয়ানক) অথবা ইহাকে স্বীকার করার পর শুধু মনের দুর্বলতার দোহাই দিয়া এই আন্দোলন হইতে দূরে সরিয়া থাকিতে হয়।
কিন্তু এই কথা স্বীকার করাও সহজ কাজ নহে। কারণ এই কথা স্বীকার করিলে পরকালে মুক্তি নিশ্চয়তা ও গ্যারান্টি যে নষ্ট হইয়া যায় শুধু ইহাই নহে, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও ইহাদের আবহমানকালের প্রতিষ্ঠিত শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। এইরূপ ক্ষতি স্বীকার করা ব্স্তবিকই কঠিন ব্যাপার। এই জন্য একটি বড় দল এই ব্যাপারে এক তৃতীয় পথ অবলম্বন করিয়াছে। তাহারা আমাদের দাওয়াত ও আন্দোলনকে ভুল তো বলিতে পারে না, কারণ তাহা বলার বিন্দুমাত্র অবকাশ কোথাও নাই। কিন্তু সুস্পষ্ট ভাষায় ইহার সত্যতা স্বীকার করিলেও মূলনীতিকে বাদ দিয়া বিশেষ কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার করিয়াই তাহারা ব্যাপারটিকে যথাসম্ভব ঘোলাটে করিয়া তোলে যেন এই সত্যের আন্দোলন হইতে দূরে থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। এ সম্পর্কে আমি শুধু ইহাই বলিতে চাই যে, আজ তাহারা যেসব কথা ও যুক্তি পেশ করিয়া মানুষের মুখ বন্ধ করার প্রয়াস পাইতেছে, কিয়ামতের দিন খোদার মুখও যে তাহারা এই যুক্তি দ্বারা বন্ধ করিতে পারিবে না, তাহা আজই তাহাদের ভাবিয়া দেখা উচিত।
আমাদের কর্মনীতি
অতঃপর আমাদের এই আন্দোলনের জন্য গৃহীত কর্মনীতি সংক্ষেপে পেশ করিতে চেষ্টা করিব। আমাদের মূল দাওয়াতের ন্যায় আমাদের কর্মনীতিও কুরআন এবং নবীদের কর্মনীতি তইতে গৃহীত হইয়াছে। আমাদের দাওয়াত যাহারা গ্রহণ করে, আমরা তাহাদেরকে সর্বপ্রথম কার্যত খোদার দাসত্ব অনুযায়ী জীবন গড়িয়া তুলিতে এবং এই কাজে নিজেদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও একাগ্রতার প্রমাণ উপস্হিতি করিতে বলিয়া থাকি। ঈমানের বিপরীত সকল কাজ হইতেই তাহাদের নিজেদের জীবনকে পবিত্র করিতেও বলি। বস্তুত এখান হইতেই তাহাদের চরিত্র শুদ্ধি, স্বভাব-প্রকৃতি গঠন এবং উহার যাচাই শুরু হইয়া যায়। যাহারা বড় ও উচ্চ লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়া উচ্চশিক্ষা লাভ করিয়াছেন, তাহাদেরকে নিজেদের রচিত গগনচুম্বী স্বপ্ন-প্রাসাদ নিজেদের হাতেই ধূলিসাৎ করিয়া দিতে হয় এবং এমন এক জীবন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করিতে হয়, যাহাতে মান-সম্মান, পদমর্যাদা, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের সম্ভাবনা তাহাদের নিজেদের জীবনেই শুধু নহে, পরবর্তী কয়েক পুরুষ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয় না। আর যাহাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা, লুণ্ঠিত সম্পদ, অংশীদারীদের অপহৃত অংশ এবং উত্তরাধিকারীদের হক নষ্ট করা সম্পত্তি জমি-জায়গার উপর স্হাপিত, এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ফলে তাহাদেরকে ইহার সবকিছু ত্যাগ করিয়া সর্বহারা সাজিতে হয়। তাহাদের একমাত্র কারণ এই যে, তাহারা যে খোদাকে নিজেদের মালিক ও মনিব হিসিবে স্বীকার করিয়াছে, সেই খোদাই কাহারো সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা মোটেই পছন্দ করেন না। যাহাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় শরীয়ত বিরোধী কিংবা বাতিল রাষ্ট্র ব্যবস্হার সহিত সংশ্লিষ্ট ছিল, উন্নতির স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা, বর্তমান উপায়ে অর্জিত খাদ্যের একমুঠি গলাধকরণ করাও তাহাদের পক্ষে দুঃসহ হইয়া পড়ে। ফলে তাহা বর্তমান জীবিকার উপায় পরিত্যাগ করিয়া অন্য একটি পবিত্র পন্হা- তাহা যতই নিকৃষ্ট হোক না কেন- গ্রহণ করিতে প্রাণপ্রণে চেষ্টা করে। এতদ্ভিন্ন উপরে যেমন বলিয়াছি কার্যত এই আদর্শ গ্রহণ করিলেই প্রত্যেকটি লোকের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী লোকজন তাহার দুশমন হইয়া পড়ে। তাহার পিতা-মাতা, ভাই-বন্ধু, স্ত্রী-সন্তান এবং নিকটাত্মীয় লোকই সর্বপ্রথম তাহার ঈমানের সহিত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এই আদেশ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষেরই শান্তিপূর্ণ ও স্নেহময় নীড় বোলতার বাসায় পরিণত হয়। বস্তুত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ইহাই হইতেছে সর্বপ্রথম ট্রেনিংকেন্দ্র। এই কেন্দ্রের মারফতের আমরা সৎ, নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র এবং দৃঢ় স্বভাব-প্রকৃতির কর্মী লাভ করিয়া থাকি। ইহা ইসলামী আন্দোলনের অনূকুলে খোদার তরফ হইতে এক স্বাভাবিক অবস্থা। এই প্রাথমিক অগ্নিপরীক্ষায় যাহারা ব্যর্থ হয়, তাহারা এই আন্দোলন ও সংগঠন হইতে স্বতঃই ঝরিয়া পড়ে, আমাদের সেই জন্য বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকার করিতে হয় না। আর যাহারা ইহাতে সাফল্য লাভ করে, তাহারা নিজেদের প্রাথমিক নিষ্ঠা, একাগ্রতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, দৃড়সংকল্প, সত্যের প্রতি প্রেম এবং সুদৃঢ় স্বভাব-প্রকৃতির অস্তিত্ব প্রমান করে যাহা খোদার পথে অন্তত প্রাথমিক পদক্ষেপ এবং পরীক্ষার প্রথম অধ্যায় অতিক্রম করার জন্য একান্তই অপরিহার্য। এই অধ্যায়ের সফলতা প্রাপ্ত লোকদের আমরা আমরা অপেক্ষাকৃত অধিক বিশ্বাসযোগ্য মনে করিয়া দ্বিতীয় অধ্যায়ের দিকে অগ্রসর করিতে পারি। কারণ এই অধ্যায়ে পূর্বাপেক্ষাও অধিক কঠিন পরীক্ষা দেখা যায়। সেই পরীক্ষা আর একটি অগ্নিকুন্ডের সৃষ্টি করে, তাহাও পূর্বানুরূপ ‘জাল মুদ্রাগুলিকে’ বাছাই করিয়া দূরে নিক্ষেপ করে এবং খাঁটি ও অকৃত্রিম মুদ্রাগুলি আমাদের কাছে রাখিয়া দেয়। আমাদের জ্ঞানমতে আমরা দৃঢ়তার সহিত বলিতে পারি যে, মানবীয় খনি হইতে অকৃত্রিম ও কার্যকরী অংশগুলি ছাটাই করিবার এবং উহাদের অধিকতর কর্মপযোগী করিয়া তুলিবার জন্য ইহাই চিরন্তন ও শাশ্বত পন্থা। এই অগ্নিকুন্ডে যে ‘তাকওয়া’ গড়িয়া ওঠে, তাহা ফিকাহ শাস্ত্রের পরিমাপে উত্তীর্ণ না হইলেও এবং পীরের ‘ খানকার’ মানদন্ডে অসম্পূর্ণ হইলেও মূলত এই ধরনের তাকওয়া’ই বিশ্ব পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করিবার এবং এই বিরাট আমানতের দুর্বহ ভার বহন করিবার যোগ্য হইয়া থাকে। ‘খানকায়’ যে তাকওয়ার সৃষ্টি হয়, তাহা ইহার একশত ভাগের একভাগও বহন করিবার যোগ্য হইতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতের সদস্যদের উপর আদর্শ প্রচারেরও দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যে সত্যের আলো তাহারা লাভ করিয়াছে, উহাকে নিজেদের নিকটবর্তী পরিবেশের সকল লোকের মধ্যে বিকীর্ণ করিও তাহাদের অন্যতম ও প্রধান কর্তব্য। এইসব ক্ষেত্রে হইতেও যাহাতে কিছু না কিছু লোক এই সত্যকে গ্রহণ করে, সেই জন্য চেষ্টা করা তাহাদের দায়িত্ব হিসাবে গণ্য হয়। এখানে আবার নতুন পরীক্ষা শুরু হইয়া যায়। সর্বপ্রথম এই প্রচারমূলক কাজের চাপে প্রচারকের নিজের জিবনই নির্ভুল হইতে শুরু করে। কারণ এই কাজ আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য দূরবীক্ষণ ও সন্ধানী আলো (SEARCH-LIGHT) তাহার জীবন ও চরিত্রের দিকে উত্তোলিত হয়। ফলে প্রচারকের নিজের জীবনে ঈমান বিরোধী সামান্য কিছু থাকিলেও এই বিনা পয়সার সংশোধনী প্রচেষ্টার সাহায্যে তাহার নিজের নিকট উহা স্পষ্ট হইয়া ধরা পড়ে এবং নিরন্তর চাবুক লাগাইয়া তাহার জিবনকে নিখুঁত ও নিমর্ল করিয়া তোলে। প্রচারকই প্রকৃতই যদি এই দাওয়াতের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিত ঈমান আনিয়া থাকে, তবে এই সমালোচনায় সে মোটেই ক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্ধ হইবে না এবং গোঁজামিল দিয়া নিজের কাজের ভুল গোপন করিতে কখনও চেষ্টা করিবে না। বরং লোকদের এই সমালোচনার আলোকে তাহা নিছক পরিশুদ্ধতার উদ্দেশ্যে হইলেও বিনা পরিশ্রম ও বিনা ব্যয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করিয়া লইবার অবকাশ পাইবে। যে পাত্রকে শত শত হাত মাজিয়া-ঘষিয়া সাফ করিতে চেষ্টা করিবে, উহার ময়লা যতই পুঞ্জীভূত হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তাহা যে নির্মল ও স্বচ্ছ হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।
শুধু তাহাই নহে, এই ধরনের প্রচার-প্রক্রিয়ার ফলে আমাদের কর্মীদের মধ্যে এমন অনেক গুণ বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ হয়, যাহা পরবর্তী কর্মক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে বৃহত্তর কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রচারক যখন নানাবিধ প্রতিকূল ও হতাশাব্যঞ্জক অবস্হার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতে থাকে, কোথাও তাহার উপর বিদ্রুপবান বর্ষিত হয়, কোথাও অপমানকর উক্তি শুনিতে হয়, অসংখ্য প্রকার ভৎসনা এবং নানাবিধ মূর্খতামূলক কার্য দ্বারা তাহাকে অভ্যর্থনা করা হয়, কোথাও তাহার উপর নানা প্রকার দোষারোপ ও অভিযোগ উত্থাপন করিয়া তাহার জীবনকে ভারাক্রান্ত করিয়া তোলা হয়, কোথাও তাহাকে নানা প্রকার ফেতনা ও ঝগরা-বিতর্কে জড়াইবার জন্য অভিনব উপায় অবলম্বন করা হয়, কোথাও তাহাকে ঘর হইতে বিতাড়িত করা হয়, উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত করা হয়, বন্ধুতা এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করা হয় এবং তাহার নিজ পরিবেশে তাহার জীবন দুর্বিষহ করিয়া দেওয়া হয়। এইরূপ অবস্হায়ও আমাদের যে কর্মী সাহস হারায় না, সত্যের এই আন্দোলন হইতে বিরত থাকে না, বাতিলপন্হীদের সম্মুখে আত্মসমর্পন করিতে প্রস্তুত হয় না, বিক্ষুব্ধ হইয়া নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার ভারসাম্য হারায় না, বরং ইহার বিপরীত বৈজ্ঞানিক কর্মপন্হা, গভীর বুদ্ধিমত্তা, নমনীয় দৃঢ়তা, স্হিরতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরহেযগারী ও ঐকান্তিক একনিষ্ঠ মন লইয়া নিজ আদর্শের অনুকূল করিয়া তুলিবার জন্য অবিশ্রান্তভাবে চেষ্টা করে, তাহার মধ্যে যে উচ্চতর মহান গুণাবলীর পূর্ণবিকাশ ও উৎকর্ষ সাধিত হইবে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না। আর ব্স্তুত এই ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট্যই ইসলামী আন্দোলনের পরবর্তী অধ্যায়সমূহে একান্ত অপরিহার্য।
আদর্শ প্রচারের জন্য আমরা আমাদের কর্মীদের কুরআনে উপস্হাপিত কর্মনীতিই শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছি। অর্থাৎ যুক্তি, জ্ঞান, বুদ্ধি এবং মহৎ উপদেশের সাহায্যে লোকদেরকে খোদার পথে আহবান জানানো, ক্রমশ এবং অত্যন্ত স্বভাবিক ক্রমিক নীতি অনুসারে লোকদের সম্মুখে দ্বীন ইসলামের প্রথমিক ও বুনিয়াদী মূলনিতিসমূহের ভিত্তিতে বাস্তব জীবন গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করা। কাহাকেও সাধ্যাতীত খোরাক দান, মূলনীতির পূর্বে খুঁটিনাটি বিষয় পেশ করা, মৌলিক দোষ-ত্রুটি দূর করিতে চেষ্টা করার পরিবর্তে বাহ্যিক দোষক্রটি দূর করিতে চেষ্টা করিয়া সময় নষ্ট করার মত অবৈজ্ঞানিক কাজ করিতে কর্মীদেরকে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়। অবসাদ এবং বিশ্বাস ও কর্মগত ভ্রান্তিতে জড়িত লোকদের সহিত ঘৃণা ও অবজ্ঞা মিশ্রিত ব্যবহার না করিয়া একজন সুদক্ষ চিকিৎসকের ন্যায় সহানুভূতি ও কল্যাণ কামনার সহিত মানুষের প্রকৃত রোগের চিকিৎসা করিতে চেষ্টা করাই আমাদের কাজ। ভৎসনা এবং পাথর নিক্ষেপের উত্তরে কল্যাণকর কাজ করিতে শেখা, অত্যাচার ও নিপীড়ন হইলে ধৈর্য ধারণ করা, অজ্ঞ-মূর্খ লোকদের সহিত কু-তর্কে এবং স্বার্থসংকুল বিসম্বাদে লিপ্ত না হওয়া, অর্থহীন কথাবার্তার উন্নত ও মহান আত্মার ন্যায় উপেক্ষা করাই আমাদের কর্মীদের বৈশিষ্ট্য। সত্যের আদর্শ হইতে যাহারা দূরে থাকিতে চেষ্টা করে, তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করার পরিবর্তে সত্যানুসন্ধিৎসু লোকদের দিকেই অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য-বৈষয়িক পদমর্যাদার দিক দিয়া তাহারা যতই হীন হোকনা কেন। এই চেষ্টা সাধনার ব্যাপারে রিয়াকারী ও প্রদর্শনীমূলক কাজকর্ম হইতে দূরে থাকা, নিজেদের কীর্তিকলাপ গণিয়া গৌরবের সহিত লোকদের সম্মুখে পেশ করিয়া তাহাদের দৃষ্টি আকর্ষন করিতে চেষ্টা না করা, সকল কাজ একমাত্র খোদার উদ্দেশ্যে করা এবং উহার ফল খোদার নিকট হইতেই পাইবার আশা করা আমাদের কর্মীদের কর্তব্য। তাহাদের মনে এ ভাব থাকা দরকার যে, আল্লাহ তাহাদের সকল কাজ দেখিতেছেন এবং তিনি তাহাদের সকল কাজের মূল নিশ্চয়ই দিবেন। দুনিয়ার মানুষ উহার মূল্য বুঝুক আর না বুঝুক, মানুষ কোন সুফল দিক আর শাস্তিই দিক তাহাতে কিছু আসে যায় না। বস্তুত এইরূপ কর্মনীতিতে অনন্যসাধারণ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা এবং অবিশ্রান্ত চেষ্টা সাধনার প্রয়োজন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত ক্রমাগত কাজ করার পরও হয়ত কোনরূপ সুফল লাভ হইবে না-কৃত্রিম প্রদর্শনমূলক কর্মনীতিতে যদিও অল্প সময়ের কাজের দ্বারাই বিরাট লোভনীয় ফল লাভ করা যায়, কিন্তু আমাদের কর্মীগণ তাহা আদৌ গ্রহণ করিবে না। ইহার ফলে আমাদের কর্মীদের মধ্যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি, গাম্ভীর্য, বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলনের অত্যধিক সংকটপূর্ণ এ শ্রমসাধ্য অধ্যায়সমূহে এই গুণাবলীর সর্বাধিক গুরুত্ব রহিয়াছে। ইহার ফলে আন্দোলন কিছুটা মন্হর গতিতে অগ্রসর হইতে থাকিলেও উহার প্রতিটি পদক্ষেপ সুদৃঢ় ও গভীর ভিত্তিতে স্হাপিত হয় একমাত্র এই ধরনের কর্মনীতির সাহায্যেই সমাজের সর্বোত্তম অংশকে আন্দোলনে টানিয়া আনা সম্ভব। স্হূল দৃষ্টিসম্পন্ন অপদার্থ লোকদের বিরাট ভীড় সৃষ্টি করার পরিবর্তে উল্লিখিত রূপ কর্মনীতির দ্বারাই সমাজের সর্বাধিক সৎলোকদেরকে আন্দোলনের কর্মী হিসাবে পাওয়া যাইতে পারে। এই ধরনের একজন কর্মী সহস্র অকর্মণ্য অপদার্থ লোকের অপেক্ষা যে সমধিক মূল্যবান ও শক্তিপ্রদ তাহাতেও কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। আমাদের কর্মনীতির একটি বিরাট অংশ এই যে, আমরা নিজেদেরকে বাতিল শাসন ব্যবস্হার আইন-আদালতের সাহায্যে সুযোগ হইতে বঞ্চিত করিয়াছি। আমরা নিজেদের মানবীয় অধিকার, নিজেদের জান-মাল, সম্মান-সম্ভ্রম কোন জিনিসেরই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাতিল রাষ্ট্র ব্যবস্হার কোন সাহায্যই গ্রহণ করিব না- যদিও ইহা আমাদের সকল সদস্যের উপর কর্তব্য হিসাবে চাপাইয়া দেওয়া হয় নাই, বরং ইহাকে একটি উচ্চমান হিসাবে সকলের সম্মুখে পেশ করা হইয়াছে এবং সকলকে ইহা গ্রহণ সম্পর্কে স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে। তাহারা ইচ্ছা করিলে এই উচ্চতর মান পর্যন্ত পৌছিতে পারে, অন্যথায় প্রতিকূল অবস্হায় ঘাত-প্রতিঘাতে পরাজিত হইয়া অধোগতি লাভ করিবে। অবশ্য নিম্ন গতিরও এখানে একটা সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। সেই শেষ সীমাও যাহারা লঙ্ঘন করিবে, যাহারা তাহাও নীচে পড়িয়া যাইবে, তাহাদেরকে আর জামায়াতের মধ্যে থাকিবার সুযোগ দেওয়া হইবে না। যে মিথ্যা মোকদ্দমা করে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, কিংবা কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত মোকদ্দমায় জড়াইয়া পড়ে- নিছক স্বার্থপরতা, লালসাবৃত্তি চরিতার্থতা কিংবা কোন বন্ধুতা বা আত্মীয়তার অমূলক সম্ভ্রম রক্ষার জন্য কোন মোকদ্দমায় লিপ্ত হয় জামায়াতে ইসলামীতে তাহার কোন স্হান হইতে পারে না।
আইন ও আদালত সম্পর্কে অনুসৃত আমাদের এই নীতির যৌক্তিকতা আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই অনুধাবন করিতে সমর্থ হয় না, এই জন্য নানা প্রকার অমূলক প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিন্তু একটু চিন্তা করিলেই ইহার অন্তর্নিহিত বিপুল সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। প্রথমত, ইহা দ্বারা আমরা আমাদেরকে একটি আদর্শবাদী জামায়াত হওয়ার কথা বাস্তব কাজের সাহায্যে প্রমাণিত করিতে পারি। মনে রাখা দরকের যে ইহা একটি তামাশা ও স্ফূর্তির ব্যাপার নহে; এই জন্য অত্যন্ত তিক্ত ও কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করিতে হয়। আমরা যখন বলি, মানব জীবনের জন্য আইন রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কাহারো নাই। যখন দাবী করি, প্র্রভুত্ব (SOVEREIGNTY) একমাত্র আল্লাহর এবং খোদার আনুগত্য না করিয়া ও তাহার আইন না মানিয়া পৃথিবীতে হুকুম বা শাসন চালাইবার অধিকার কেহ পাইতে পারে না। আমাদের বিশ্বাসই যখন এই যে, খোদায়ী আইন ব্যতীত মানুষের ব্যাপারসমূহের বিচার-ফায়সালা যে করিবে, সে কাফির, ফাসিক এবং জালিম, তখন আমাদের বিশ্বাস ও দাবী অনুযায়ী ও খোদার আইনের ভিত্তিতে আমাদের অধিকার স্হাপিত হওয়া কোন মতেই উচিত নহে। বাতিল রাষ্ট্র ক্ষমতার উপর আমরা হক ও বাতিলের বিচার ভার স্বভাবতই ন্যস্ত করিতে ক্ষতি এবং বিপদকালেও যথাযথভাবে পূরণ করিয়া দেখাইতে পারি, তবে ইহা আমাদের সততা, আমাদের স্বভাব, দৃঢ়তা, আদর্শবাদতা এবং আমাদের বিশ্বাস ও বাস্তব কাজে গভীর সামঞ্জস্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ হইবে। পক্ষান্তরে কোন স্বার্থ, আশা, লোভ, কোন বিপদাশঙ্কা, কোন যুলুম- নিপীড়নের আঘাত যদি আমাদের ঈমানের বিরুদ্ধে কাজ করিতে আমাদের বাধ্য করে, তবে ইহাতে আমাদের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও আমাদের স্বভাব- প্রকৃতির অন্তসারশূন্যতা প্রকট হইয়া উঠিবে এবং অতঃপর সেই জন্য প্রমাণেরই আবশ্যক হয় না। দ্বিতীয়ত, আমাদের সদস্যদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করিবার জন্য ইহা আমাদের নিকট এক সন্দেহাতীত মানদন্ড বিশেষ। আমাদের মধ্যে কোন সব লোক আস্হাভাজন, সুদৃঢ় এবং কোন ধরনের পরীক্ষায় তাহারা উত্তীর্ণ হইতে পারিবে বলিয়া আশা করা যায়, তাহা ইহারই মারফতে সঠিকভাবে জানিতে পারা যায়।
ইহার তৃতীয় এবং বিরাট সার্থকতা এই হইবে যে, আমাদের সদস্যগণ এই নীতি গ্রহণ করিবার পর সমাজের সহিত নিজেদের সম্পর্কে ও সম্বন্ধ আইনের পরিবর্তে ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার ভত্তিতে স্হাপন করিতে স্বতঃই বাধ্য হইবে। তাহাদিগকে নিজেদের নৈতিক চরিত্র এত উচ্চমান পর্যন্ত পৌঁছাইতে হইবে- পরিবেশের মধ্যে নিজেকে এতদূর সত্যাদর্শ, দ্বীনপন্হী, খোদাভীরু এবং মঙ্গলময় কাজের বাস্তব প্রতীক হইতে হইবে যে, সমাজের লোকগণ স্বতঃই তাহাদের অধিকার, মান-সম্মান এবং জানমাল রক্ষা করিতে বাধ্য হইবে। কারণ এই নৈতিক সংরক্ষণ ব্যতীত আত্মরক্ষার আর কোন উপায় এই দুনিয়ায় তাহাদের নাই। এমতাবস্তায় নৈতিক নিরাপত্তা লাভ করিতে না পারিলে নিবিড় অরণ্যের শৃগাল পালের মধ্যে একটি ছাগল ছানার মতই তাহার অবস্হা হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
চতুর্থত, আমরা এইভাবে নিজেদেরকে ও নিজেদের সকল স্বার্থ ও অধিকারকে বিপদের মুখে নিক্ষেপ করিয়া বর্তমান সমাজের নৈতিক অবস্হাকে একবারে উলঙ্গ করিয়া তুলিতে চাই। আমরা পুলিশ, আদালতের সাহচর্য গ্রহণ করি না জানিতে পারিয়া চারিদিক হইতে আমাদের অধিকারের উপর যখন দস্যুবৃত্তির আঘাত হানা হইবে, তখন আমাদের দেশের ও সমাজের নৈতিক অবস্তা বিশ্বের সম্মুখে প্রকাশিত হইয়া উঠিবে। তখন বুঝিতে পারা যাইবে যে, আমাদের মধ্যে কত লোক শুধু আইন, শাসন ও পুলিশের ভয়েই ‘ভদ্র’ সাজিয়াছে, আর কতলোক ধর্ম, নৈতিকতার ও মানবতার মিথ্যা আবরণে আত্মগোপন করিয়া আছে এবং ধরপাকড়ের ভয় না পাইলে প্রকাশ্যভাবে দস্যুবৃত্তির যথার্থতা দেখাইতে পারে। ইহা দ্বারা আরও প্রমাণিত হইবে যে, সময় ও সুযোগ পাইলে এইসব ‘ভদ্র’ ধর্মচারী লোক নিকৃষ্টতম চরিত্রহীনতা, ধর্মহীনতা এবং পাশবিকতার বাস্তব প্রমাণ পেশ করিতে পারে। বস্তুত ইহা আমাদের জাতীয় নৈতিক চরিত্রের মধ্যে একটি গৃণ্যের ন্যায় ইহাকে ধ্বংসের দিকে লইয়া যাইতেছে। আমাদের এই কর্মনীতির ফলে এই ভিতরকার রোগ লোকসমক্ষে প্রকট হইয়া উঠিবে। তাহা দেখিয়া আমাদের সমাজের চক্ষু যেন উম্মীলিত হয় এবং যে মারাত্মক রোগকে আজ পর্যন্ত উপেক্ষা করা হইয়াছে উহার ভয়াভহতা সম্পর্কে যেন সঠিক ধারণা জন্মে। (আইন-আদালতের আশ্রয় গ্রহণ না করা নীতি ব্রিটিশ আমলে বর্তমান ছিল। পাকিস্তান আমলে এ নীতি পরিত্যক্ত হইয়াছে। বাংলাদেশ আমলে এ নীতিই চালু রহিয়াছে। ব্রিটিশ আমলের এই কঠিন নীতি কেউ মানিয়া চলিতে পারিলে খুবই ভাল। অবশ্য এ নীতি চাপাইয়া দেওয়ার বিষয় নয়-পালন করিবার ব্যাপার।)-অনুবাদক
আমাদের এই দাওয়াত ও কর্মনীতি আপনারা গভীর দৃষ্টিতে যাচাই কেরিয়া দেখুন, তীব্র সমালোচনার দৃষ্টিতে ইহা পরীক্ষা করুন, আমরা মানুষকে কোনক দিকে ডাকিতেছি এবং সেই জন্য যে কর্মনীতি আমরা গ্রহণ করিয়াছি তাহা অনুধাবন করুন- তাহা কতখানি সত্য। আল্লাহ এবং তাহার রাসূলের বিধানের সহিত ইহার সামঞ্জস্য আছে কি না, বর্তমান সমাজে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত রোগের ইহা কতখানি প্রতিষেধক হইতে পারে, তাহা গভীরভাবে যাচাই করিয়া দেখুন। আল্লাহর দ্বীনকে সর্বজয়ী এবং বাতিল মতবাদকে নির্মূল করার যে মহান উদ্দেশ্যে আমরা এই আন্দোলন চালাইতেছি, তাহা কতখানি কার্যকরি হইতে পারে তাহাও ভাবিয়া দেখুন।
অতঃপর কতগুলি সন্দেহ ও সংশয় সম্পর্কে আমি আলোচনা করিব এবং সেই সম্পর্কে আমার জবাব পেশ করিব।
আলিম ও পীর সাহেবদের দোহাই
একটি পুরাতন প্রশ্ন নতুন করিয়া উত্থাপন করা হইতেছে। তাহা এই যে, দেশের বড় বড় আলিম ও পীর সাহেবান কি দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নহেন? উহার যে রূপ আজ জামায়াতে ইসলামী মারফতে ফুটিয়াছে, তাহারা কি আগেই তাহা বুঝিতে পারেন নাই? উপরন্তু যেমন বলা হইয়াছে, তাহাদেরকে বারবার বলা সত্ত্বেও তাহারা উহা গ্রহণ করেন না। শুধু তাহাই নহে, ইহার সহযোগিতা পর্যন্ত করিতে প্রস্তুত নহেন, ইহারই বা কারণ কি? ইহা দ্বারা কি এই কথা প্রমাণিত হয় যে, তাহারা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জামায়াতের পক্ষ হইতে যাহা কিছু প্রচার করা হয়, তাহাই মূলত দ্বীন ইসলামের বহির্ভূত জিনিস?
এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর এই যে, দ্বীন ইসলামকে বর্তমান কি অতীতের ব্যক্তিদের নিকট হইতে বুঝিতে চেষ্টা না করিয়া সব সময়ই কুরআন ও নবী করীম (সা.) -এর সুন্নাহ হইতে বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছি। এই জন্য খোদার দ্বীন আমার নিকট এবং অন্যান্য ঈমানদার ব্যক্তিদের নিকট কি দাবী করে, তাহা জানিবার জন্য কোন বুযুর্গ ব্যক্তি কি করেন আর কি বলেন, সেই দিকে আদৌ ভ্রুক্ষেপ করি নাই। ইহার পরিবর্তে আমি সবসময়ই কুরআন এবং রাসূলের কর্মনীতি বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছি। অতএব জ্ঞান লাভের এই পন্হার দিকে আমি আপনাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করিব। আমি যেদিকে আপনাদেরকে আহবান জানাইতেছি এবং এজন্য গৃহীত কর্মনীতি কুরআন পাকের নির্দেশসমূহ ও নবীদের কার্যকলাপ হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় কি না, আপনারা অনাবিল ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে শুধু তাহার বিচার করুন। কুরআন ও সুন্নাহ হইতে ইহা প্রমাণিত হইলে- আপনারা কুরআন ও সুন্নাহ হইতে জ্ঞান লাভ করিতে যদি প্রস্তুত থাকেন, তবে আপনারা আমার দাওয়াত গ্রহণ করুন, আমার সঙ্গে আপনারাও মিলিত হউন। আমাদের দাওয়াত ও কর্মনীতিতে কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত কিছু থাকিলে অসংকোচে তাহা প্রমাণ করুন। আমরা কোথাও কুরআন সুন্নাহ হইতে একবিন্দু দূরে সরিয়া গিয়াছি এই কথা যদি বাস্তিকই প্রমাণিত হয়, তবে প্রকৃত সত্য গ্রহণে আমরা এক মুহূর্তও বিলম্ব করিব না। কিন্তু হক ও বাতিল প্রমাণ করার জন্য আপনারা যদি কুরআন ও সুন্নাহ ব্যতীত ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করেন তবে তাহা আপনাদের ইচ্ছাধীন। আপনারা আজ নিজেদের ভবিষ্যত ব্যক্তিদেরই হাতে সমর্পন করুন, খোদার নিকটও তাহাই বলিবেন যে, আপনার দ্বীনকে কুরআন ও সুন্নাহর পরিবর্তে ব্যক্তিদের উপর ছাড়িয়া দিয়াছিলেন- এইরূপ উত্তর যদি আপনাদের খোদার নিকট রক্ষা করিতে পারে বলিয়া মনে করেন, তবে নিশ্চিন্তেই তাহাই করুতে পারেন, সেই জন্য আমার কিছু বলিবার নাই।