অপপ্রচার
হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. এর পবিত্র আবেগ উদ্দীপনা ও আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হারাম শরীফের অভ্যন্তরে মক্কাবাসী কর্তৃক একজন নিরপরাধ মানুষের এই হত্যাকাণ্ড থেকে অনাগত ভবিষ্যতের একটা ধারণা পাওয়া গেলেও এর মধ্য দিয়ে আসল হিংস্রতার যুগের সূচনা হয়নি।
বিরোধিতার প্রথম স্তর সব সময়ই ঠাট্টা বিদ্রুপ, উপহাস ও কূটতর্কের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা সন্ত্রাস- গুণ্ডামীর রূপ ধারণ করে।
রসূল সা. এর দাওয়াতের গুরুত্ব কমানোর উদ্দেশ্যে গালিগালাজের ঘৃণ্য ইতরামির পাশাপাশি রকমারি উপাধি প্রণয়নের কাজও শুরু করে দিল অপপ্রচারের দক্ষ কুশলীরা।
যেমন কেউ বললো, এই ব্যক্তির কথাবার্তা তোমরা শোনো না। কারণ ওতো ‘ধর্মত্যাগী’। আমাদের পূর্বপুরুষদের চিরাচরিত ধর্মকে পরিত্যাগ করে সে নিজে এক মনগড়া উদ্ভট ধর্ম তৈরি করেছে। তারা কোন যুক্তির ধার ধারতো না। যার ইচ্ছা হতো, কুফরি ফতোয়া জারি করে দিত। কখনো বা বলা হতো, সে ‘সাবী’ (নক্ষত্র পূজারী বা প্রকৃতিপূজারী) হয়ে গেছে। যেহেতু তৎকালীন মোশরেক সমাজে সাবী হওয়া ছিল একটা অবাঞ্ছিত ও কলংকজনক ব্যাপার, তাই কাউকে সাবী আখ্যা দেয়া আজকের যুগে কোন মুসলমানকে ইহুদী, খারেজী বা নাস্তিক বলার মতই গালি বলে বিবেচিত হতো। সত্যের বিরুদ্ধে যুক্তিপ্রমাণ সহকারে বক্তব্য দিতে অক্ষম লোকদের একমাত্র সম্বল হয়ে থাকে নেতিবাচক প্রচারণা। আর এই নেতিবাচক প্রচারণার একটা হাতিয়ার হলো খারাপ নাম ও খারাপ উপাধি দেয়া। প্রত্যেক অলিতে গলিতে এবং প্রত্যেক সভা সমিতিতে মক্কার প্রচারণাবিদেরা এই বলে ঢেঁড়া পিটাতো যে, ওরা সাবী হয়ে গেছে, ধর্মচ্যুত হয়ে গেছে, বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করেছে, নতুন নতুন আকীদা তৈরি করে শোনাচ্ছে; ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের প্রচারণার ঝড় যখন উঠতো তখন সাধারণ মানুষের জন্য পরিবেশ যে কত ভারী ও শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠতো এবং সঠিক পথের সন্ধান করা যে কত দুরূহ হয়ে উঠতো, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আর এরূপ পরিবেশে সত্যের সেই ক্ষুদ্র কাফেলা যে কী সংকটের সম্মুখীন ছিল, তা কল্পনা করাও বোধ হয় সহজসাধ্য নয়। কিন্তু পরিস্থিতি ও পরিবেশ যতই বিপদসংকুল হোক, তা দৃঢ়চেতা ও কৃতসংকল্প লোকদের পথ আগলে রাখতে পারে না। আল্লাহ বলেনঃ
‘আল্লাহ মানুষের জন্য যে অনুগ্রহ উন্মুক্ত করেন, তা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।’ (সূরা ফাতের)
যুক্তিপ্রমাণের মোকাবিলায় যখন গালি বর্ষণ করা হতে থাকে, তখন চিরদিনই এরূপ হয়ে থাকে যে, যুক্তিপ্রমাণ তো যথাস্থানে বহালই থাকে, কিন্তু যে গালি দেয়া হয়, তা আবেগের ওপর ভর করে, দু’চারদিন টিকে থাকলেও অচিরেই নিস্প্রভ ও ম্লান হয়ে যায় এবং মানুষের মন তার প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে যায়। তাই এ কাজে যারা অভিজ্ঞ, তাদের মূলনীতি হলো নিত্যনতুন গালি আবিষ্কার করে যেতে হবে।
এই মূলনীতি অনুসারে রসূল সা. এর জন্য আর একটা নতুন গালি উদ্ভাবন করা হয়। তা হলো ‘ইবনে আবি কাবশা’। ‘আবি কাবশা’ আরবের একজন কুখ্যাত ব্যক্তির নাম। সে সারা আরবের ধর্মীয় ভাবধারার বিরুদ্ধে ‘শা’রা’ নামক নক্ষত্রের পূজা করতো। সেই আবি কাবশার নাম থেকেই ‘ইবনে আবি কাবশা’ উপাধির উদ্ভব। এর অর্থ আবি কাবশার ছেলে বা অনুসারী। নাউযুবিল্লাহ। মনের আক্রোশ মেটাতে মক্কার আবেগগ্রস্ত লোকেরা কত কিইনা আবিষ্কার করেছে!
কোন দাওয়াত বা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ও প্রধান ব্যক্তিত্বকে যখন এ ধরনের হীন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, তখন শুধু ঐ ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়াই আসল লক্ষ্য হয় না, বরং আসল লক্ষ্য হয়ে থাকে ঐ মতবাদ ও মতাদর্শকে এবং ঐ আন্দোলনকে হেয় করা ও তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা যার ক্রমবর্ধমান প্রসারে বিরোধীরা আতংকিত থাকে। কিন্তু প্রচণ্ড বেগবান একটা স্রোতধারাকে বালির বাঁধ দিয়ে ঠেকানো কেমন করে সম্ভব? মক্কার বিদ্রুপকারীরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল যে, তারা নোংরা আবর্জনা দিয়ে যত বাঁধই বাঁধছিল, তা এই দাওয়াতের তোড়ে খড়কুটোর মত ভেসে যাচ্ছে এবং প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় তা ক্রমশ কিছু না কিছু সামনেই অগ্রসর হচ্ছে। তাই তারা অপপ্রচারের একটা নতুন কৌশল অবলম্বন করলো। তারা রসূল সা. এর নামে একটা নতুন উপাধি উদ্ভাবন করে বলতে লাগলো, এই ব্যক্তি আসলে পাগল হয়ে গেছে। নাউযুবিল্লাহ। দেবতাদের অভিশাপে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে যে সব কথাবার্তা বলে, তা কোন সচেতন মানুষের উপযোগী কথাবার্তাও নয় এবং কোন সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিজনিত ও চিন্তাসুলভ কথাও নয়। সে এক ধরনের মানসিক ব্যাধি বা হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত মানুষ। এই ব্যাধির তীব্রতা বাড়লে কখনো সে ফেরেশতা দেখে। কখনো বেহেশত ও দোজখের স্বপ্ন দেখে, কখনো তার মনে হয় যেন অদৃশ্য জগত থেকে কোন ওহী বা কোন অদ্ভুত কথা ভেসে আসছে। সে আসলে একজন মস্তিষ্কবিকৃত মানুষ। তার কথাবার্তায় মনোযোগ দেয়া উচিত নয়। সবার নিজ নিজ প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আস্থা অবিচল রাখা উচিত। এভাবে সত্যের আহবায়কদের যুক্তির ধার ভোঁতা করার জন্য তাদের পাগল ও উন্মাদ বলা কিংবা নির্বোধ ও বোকা বলা বাতিলপন্থীদের একটা চিরাচরিত রীতি। দুনিয়ার সুখ সমৃদ্ধি বাড়ানো এবং নিজেদের লোভ-লালসা ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া যাদের স্বভাব, তাদেরকেই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক মনে করা হয়। পক্ষান্তরে সমাজের সংস্কার ও সংশোধনের কর্মসূচি গ্রহণ করে যারা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করে, তাদেরকে নির্বোধ ও উন্মাদ বলা ছাড়া দুনিয়াপূজারীদের অভিধানে আর কোন উপযুক্ত শব্দ থাকে না।
এই সব গালি শুধু যে অসাক্ষাতেই বলা হতো তা নয়, বরং সামনাসামনিও বলা হতোঃ
ياايهاالذىنزلعليهالذكرانكلمجنون
“ওহে ওহীপ্রাপ্ত হওয়ার দাবীদার, তুমি তো একটা পাগল ছাড়া আর কিছু নও।’ (সূরা আল-হিজর, ৬)
আসলে মুখের ওপর গালি না দিতে পারলে গালির প্রকৃত মজাই পাওয়া যায় না।
কিন্তু ভেবে দেখার মত বিষয় হলো, কোন পাগলের নেতৃত্বে কখনো সমাজের লোকেরা আন্দোলন করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছে, এমন কোন দৃষ্টান্ত আছে কি? সুস্থ মস্তিষ্ক, সৎ স্বভাব ও সচেতন তরুণ সমাজ কি কখনো নির্বোধ লোকদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে? মাথা বিগড়ে যাওয়া কোন উন্মাদ লোকের আহবানে সুস্থ ও বুদ্ধিমান লোকেরা কি কখনো সাড়া দিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য মক্কার মোশরেকরা আরো একটা বাহানা প্রস্তুত করে। [ধর্মভীরু লোকদের জন্য পাশ্চাত্যবাসী Fanatics বা ধর্মান্ধ পরিভাষা এই অর্থেই উদ্ভাবন করেছে যে, তারা মস্তিষ্কের ভারসাম্যহারা আবেগপ্রবণ মানুষ। আমাদের সমাজের অধার্মিক ধরনের লোকেরা যখন ইসলামপ্রিয় লোকদের ‘মোল্লা’ বলে আখ্যায়িত করে তখন এই অর্থেই করে যে, তারা অবুঝ, যুগের চাহিদা সম্বন্ধে অজ্ঞ, এবং অতীতের ধ্যানধারণার অন্ধ ভক্ত। এর চেয়েও একধাপ নিচে নেমে ধার্মিক লোকদেরকে বিরোধীরা রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ও নির্বোধ বলে অভিহিত করে থাকে।] তারা বলে, নবুয়তের দাবীদার এই ব্যক্তি জাদুবিদ্যায়ও পারদর্শী। তার সাথে কেউ সাক্ষাত করতে এলেই সে দু’চারটে কথা বলে তাকে সম্মোহিত করে ফেলে এবং মায়াবী দক্ষতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখায়। এ কারণে ভালো ভালো বুদ্ধিমান লোকেরা পর্যন্ত ক্রমশ তাঁর ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশ্ন না জেগে পারে না যে, আজ পর্যন্ত কোন জাদুকর কি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করেছে? কোন জাদুকর বা জ্যোতিষী কি কখনো আল্লাহর ইবাদত, তাওহীদ, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার শিক্ষা দেয়ার জন্য জাদুবিদ্যাকে ব্যবহার করেছে? ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত কি আছে যে, জাদুকরের ন্যায় মানসিকতার অধিকারী কোন ব্যক্তি কখনো চলমান সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পাল্টানোর জন্য নিজের জাদুশক্তি বলে একটা বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলেছে? জাদুর শক্তি দিয়ে মন মগজ, চরিত্র ও অন্তরাত্মাকে বদলে দেয়ার কোন দৃষ্টান্ত কোথাও আছে কি? আর ইনি ছিলেনই বা কেমন জাদুকর যে, জাদুর ভেলকি দেখিয়ে, দু’পয়সা উপার্জন করার পরিবর্তে সারা দেশের মানুষের যুলুম নিপীড়ন ভোগ করে সমাজের সর্বোত্তম লোকগুলোকে বাছাই করছিলেন এবং একটা বিরাট সামষ্টিক অভিযান পরিচালনা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? এটা কি কোন ভেলকিবাজি ছিল? আসলে এটা ছিল একটা গৎবাঁধা অভিযোগ। প্রত্যেক যুগে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত লোকদের ওপর এ অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে। এ দ্বারা জনগনকে এরূপ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এ দাওয়াতের সাথে সত্যের কোন যোগাযোগ নেই এবং এ কারণে তার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত আকর্ষণ জন্মে এমন কোন উপাদানও নেই। দাওয়াতদাতার যুক্তিতে এমন কোন ধার নেই যে, তা দ্বারা সে মানুষের মন জয় করতে পারবে, বরং গোটা ব্যাপারটাই জালিয়াতি ও জাদুর. কারসাজির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এ জন্যই ভালো ভালো বুদ্ধিমান লোকেরা পর্যন্ত দাওয়াত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং ভারসাম্য হারাচ্ছে।
কিছু কিছু লোক হয়তো বা কোরায়েশ নেতাদের সামনে রসূল সা. এর ওহী যোগে প্রাপ্ত বাণী বিশেষত কোরআনের আয়াতগুলো পেশ করে থাকবে যে, এতে উচ্চাংগের অলংকারমণ্ডিত ভাষা রয়েছে। সেই ভাষা নিয়ে সেকালের সাহিত্যবিশারদদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও চিন্তাগবেষণাও হয়ে থাকতে পারে এবং তারা অনুভব করতে পারে যে, ওহীর এই বাণীই এক অলৌকিক ও অসাধারণ প্রভাবশালী বাণী। তাই এই বাণীর অলৌকিকত্বের ধারণাটা খণ্ডন করার জন্য তারা বলতে লাগলো, “এমন অলৌকিকত্বের কী আছে এতে? এতো কেবল এক ধরনের কবিতা, ভাষার শৈল্পিক চর্চা এবং সাহিত্যিক ওজস্বিতা। মুহাম্মাদ স. একজন উচ্চাংগের বাগ্মী। তাঁর বাগ্মিতার জোরে অপরিপক্ব মনের অধিকারী কিছু তরুণ বিপথগামী হচ্ছে।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কবি তো পৃথিবীতে কতই এসেছে। মুহাম্মাদ স. ও তাঁর সংগীরা যে চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, এমন নজিরবিহীন ও নিষ্কলংক চরিত্রের অধিকারী কোন কবি কি কখনো পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে? কোরায়েশদের চোখের সামনে যে ধরনের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, নিছক কবিতার আসর গরমকারীরা কি কখনো তা করতে পেরেছে!
এ প্রশ্ন কোরায়েশদেরকেও বিব্রত করেছিল। এর জবাবে তারা রসূল সা. এর বিরুদ্ধে রটনা করেছিল জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার আর এক অপবাদ। জ্যোতিষীরা কিছু ধর্মীয় ভাবভংগী অনুসরণ করতো। তারা একট রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করতো। চল্লিশ দিন ব্যাপী ধ্যান, নির্জনবাস, জপতপ ও মন্ত্রতন্ত্রের মধ্য দিয়েই তাদের জীবন কাটতো। তারা নানা ধরনের অস্বাভাবিক পন্থায় বিচিত্র তথ্যাবলী সংগ্রহ করে তা রহস্যময় কৌশলগত ভাষার মাধ্যমে ব্যক্ত করতো। সাধারণ মানুষের মধ্যে তারা বিচরণ করতো অসাধারণ মানুষ হিসেবে। কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ধরনের এসব লোককে ‘কাহেন’ নামে আখ্যায়িত করা হতো। সেই নামে রসূল সা. কে আখ্যায়িত করে তারা বুঝাতে চেয়েছিল যে, উনিও একই ধাপ্পাবাজির ব্যবসা খুলেছেন, যাতে লোকেরা এসে মুরীদ হয়, এবং তাঁর জীবিকার সমস্যারও সমাধান হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ)
কিন্তু কোরআন এই সব অপপ্রচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে এই বলে যেঃ
(আরবী*********)
“সে কবি নয়। কিন্তু তোমাদের বিশ্বাস ও ঈমানের দ্বার তোমরাই রুদ্ধ করে রেখেছ। সে কোন জ্যোতিষী নয়। কিন্তু তোমরা তো চিন্তভাবনাই কর না।” (সূরা আল-হাক্কা)
তাদের এই উচ্ছৃংখলতার তাণ্ডব সম্পর্কে কোরআন খুবই সংক্ষেপে যে পর্যালোচনা করেছে তা হলোঃ
(আরবী********)
“দেখ, এ লোকগুলো তোমার সম্পর্কে কি কি ধরনের প্রবাদ, উদাহরণ, পরিভাষা ও উপাধি প্রয়োগ করে।” এত সব কিছু করার পর তারা সহসা কিভাবে বিপথে ধাবিত হয়, সে সম্পর্কে কোরআন বলেঃ (আরবী*****) “নিজেরাই নিজেদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে।”
এবার লক্ষ্য করুন, আরো একটা বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা। হযরত ইবরাহীমের ধর্মের অনুসারী হবার দাবীদাররা বলে যে, মুহাম্মাদের স. কাছে একটা জ্বিন এসে অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তা শিখিয়ে দিয়ে যায়। কখনো কখনো মক্কার জনৈক রোমক খৃস্টান ক্রীতদাস (জাবের, জাবরা বা জারব) এর নামোল্লেখ করে বলা হয় যে, ঐ ক্রীতদাসটা গোপনে গিয়ে মুহাম্মাদকে এ সব ভাষণ লিখে দিয়ে আসে। অথচ সে কেবল মাঝে মাঝে রসূলের স. কথাবার্তা শোনার জন্য যেত। একবার কোরায়েশ নেতাদের একটা দল রসূল স. কে বললোঃ ‘আমরা শুনেছি, ইয়ামামার রহমান নামক এক ব্যক্তি তোমাকে এই সব জিনিস শেখায়। আল্লাহর কসম, আমরা কখনো ঐ রহমানের ওপর ঈমান আনবো না।’[সীরাতে ইবনে হিশাম, (আরবী) প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৩১৭] এই সব ভিত্তিহীন অপপ্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে এরূপ ধারণা দেয়া যে, এসব কোন বিদেশী অপশক্তি কিংবা ব্যক্তির কারসাজি। মুহাম্মাদ স. ঐসব অপশক্তির ক্রীড়নক হয়ে তাদের সাথে যোগসাজশ করে আমাদের ধর্ম ও সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত এঁটেছে। অপরদিকে এ ধারণা দেয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে যে, এই মনোমুগ্ধকর অলংকারসমৃদ্ধ বাণীগুলো মুহাম্মাদেরও স. প্রতিভার সাক্ষর নয়, আল্লাহর দানও নয়। বরঞ্চ এগুলোর মধ্য দিয়ে তৃতীয় কোন বহির্শক্তি তাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। উপরন্তু এ দ্বারা রসূল সা. কে আল্লাহর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপের দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এসব দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দিয়ে কোরআন অনেক বিস্তারিত জবাব দিয়েছে। তবে তার যে চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে অকাট্য ও অব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে তা হলো, ‘তোমরা জ্বিন ও মানুষের সম্মিলিত চেষ্টা দ্বারাও যদি পার তবে কোরআনের মত কোন সূরা বা কয়েকটি আয়াত রচনা করে নিয়ে এস।’
আনুষংগিকভাবে এর মধ্য দিয়ে এ কথাও বলা হলো যে, মুহাম্মাদ স. কোন নতুন কথা বলছে না বা কোন বিরল কৃতিত্বও দেখায়নি। আসলে সে কিছু পুরানো কিসসা কাহিনীর বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে তা জোরদার ভাষায় নতুন করে পেশ করছে। এ হচ্ছে এক ধরনের গল্প বলার শিল্প। গল্পকাররা যেমন গল্প বলে বলে আসর জমায় তেমনি মুহাম্মদ মজার মজার গল্প শুনিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করছে। ইসলামের দাওয়াতকে প্রাচীন কিসসা কাহিনী বলে গালি দেয়ার এরূপ একটা তীর্যক ইংগিত রয়েছে যে, ঐসব সেকেলে কিসসা কাহিনী দিয়ে এ যুগের সমস্যাবলীর সমাধান কেমন করে হবে? সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রাচীন রূপকথায় তখনকার মানুষের কোন উপকারিতা নেই।
মজার ব্যাপার হলো, একদিকে বাপদাদার ধর্মের সম্পূর্ণ বিরোধী নতুন ধর্ম প্রচারের দায়ে রসূল স.কে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। অপরদিকে সেই রসূলের স. পেশ করা বাণীকেই প্রাচীন কিসসা কাহিনী বলে নিন্দা করা হচ্ছিল। মতলববাজ কুচক্রীদের এটা চিরাচরিত স্বভাব যে, আগপাছ চিন্তাভাবনা না করে কখনো একদিক থেকে একটা খুঁত ধরে, আবার কখনো অন্যদিক থেকে আক্রমণ করে ঠিক তার বিপরীত আপত্তি তোলে। অথচ তারা ভেবেও দেখে না যে, এভাবে তারা স্ববিরোধী আচরণই করছে।
এই পর্যায়ে একটা ফ্রন্ট খোলা হয় কবিদের দিয়ে। রসূল স. এর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দাসূচক কবিতা রচনা ও প্রচার করার দায়িত্বে নিযুক্ত হয় আবু সুফিয়ান বিন হারেস, আমর বিন আস, এবং আব্দুল্লাহ বিন যাবারী। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, আরবের জাহেলী সমাজে কবিদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। তারা বলতে গেলে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষক ও দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করতো। তাদের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ মানুষের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করতো এবং তা মুখস্থ করে করে প্রচার করা হতো। ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সেকালে কবিরা অনেকাংশে এ যুগের সাংবাদিকদের ন্যায় অবস্থানে ছিল। আজ যেমন একজন দক্ষ সাংবাদিক নিজের লেখনী ও পত্রিকার শক্তি নিয়ে কারো পেছনে লাগলে তার অনেক ক্ষতিসাধন করতে পারে, নিজের কুটিল ও তীর্যক মন্তব্য, অশালীন ব্যংগবিদ্রুপ, অশোভন চিঠিপত্র, সংবাদ না ছাপানো কিংবা বিকৃতভাবে ছাপানো, এবং বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে যেমন কোন দাওয়াত, আন্দোলন বা সংগঠনের জন্য সমস্যার পাহাড় সৃষ্টি করতে পারে, ঠিক তেমনি ভূমিকা পালন করতো আরবের কবিরা। সেখানে প্রতিটি অলিগলিতে মুহাম্মদ স. ও তার আন্দোলনের দুর্নাম ও কুৎসা রটিয়ে বেড়ানো এবং ছন্দবদ্ধ গালি ও নিন্দাসূচক শ্লোগান দিয়ে পরিবেশকে বিষাক্ত করার কাজে একাধিক কবি নিয়োজিত ছিল। একজন ভদ্র পথচারীর পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিলে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়, মুহাম্মাদ স. কে ঘিরে ঠিক সেই ধরনের দৃশ্যের সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু মানবতার বন্ধু নবী মুহাম্মাদ স. এর বাণী ও চরিত্র কবিদের অপপ্রচারের মায়াবী প্রভাবকে একবারেই নিস্প্রভ ও পণ্ড করে দিচ্ছিল।
উল্লেখ্য যে, অপপ্রচারের এই গোটা অভিযান কোন ভুল বুঝাবুঝির কারণে নয়, বরং একটা সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত চক্রান্তের আওতায়ই পরিচালিত হচ্ছিল। তারা সর্বসম্মতভাবে ও ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেঃ (আরবী*******)
‘এই কোরআন তোমরা শুনো না, বরং কোরআন পাঠের সময় হৈ চৈ কর, হয়তো এভাবেই তোমরা জয়ী হতে পারবে।’ (হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত ২৬)
অর্থাৎ দাওয়াতদাতার কথায় কর্ণপাতই করো না, ওটা বুঝবার চেষ্টাই করো না। তাহলে চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসে যেতে পারে এবং বিদ্যমান আকীদাবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যেতে পারে। হৈ চৈ করে এর প্রচারে বাধার সৃষ্টি কর এবং একে হাসি ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত কর। এতে করে কোরআনের শক্তি চূর্ণ হয়ে যাবে, এবং শেষ বিজয় তোমাদেরই হবে। এ আয়াত থেকেই অনুমান করা যায়, ইসলাম বিরোধী শক্তির মনস্তত্ত্বটা কেমন। তারা কথা শুনতে ও বুঝতে চায় না এবং অন্যদেরকেও শুনতে ও বুঝতে দিতে চায় না। এ জন্য হাংগামা সৃষ্টি করে তারা বাধা আরোপ করতে চায়। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতার পালা পড়েছিল ঠিক এমনি লোকদের সাথে!
আ’স বিন ওয়ায়েল আস-সাহামী রসূল স. এর দাওয়াত ও আন্দোলনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টায় যেভাবে বিষোদগার করছিল তা হলো, ‘মুহাম্মাদ যা করছে, করতে দাও। সে তো নির্বংশ। তার কোন পুত্রসন্তান নেই। সে মারা গেলে তার কথা কেউ স্মরণও করবে না এবং তোমরা তার কবল থেকে চিরতরে অব্যাহতি পাবে।’ রসূল স. এর পুত্রসন্তান জীবিত না থাকায় এই কুটিল মন্তব্য করা হয়। আরবে এ মন্তব্য নিরর্থকও ছিল না। কিন্তু আগের মত লোকেরা এ কথা বুঝতে সমর্থ হয় না যে, নবীদের ন্যায় ইতিহাসস্রষ্টা ব্যক্তিগণের আসল সন্তান হয়ে থাকে তাদের অসাধারণ ও ঐতিহাসিক কীর্তি। তাদের মস্তিষ্ক থেকে নতুন নতুন সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটে। তাদের দাওয়াত ও শিক্ষার উত্তরাধিকার ধারণ করা ও তাদের স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তাদের সাথী ও অনুসারীরা দলে দলে অগ্রসর হয়। এভাবে যে বিপুল কল্যাণের সমাগম ঘটে, তার শক্তি ও মূল্যমান ঝাঁক ঝাঁক পুত্রসন্তানের চেয়েও অনেক বেশি। এই তীর্যক মন্তব্যের জবাবেই সূরা কাওসার নাজিল হয়। ঐ সূরায় আ’স ও তার সতীর্থদের বলা হয় যে, আমি আমার নবীকে কাওসার দান করেছি, এই কাওসারকে তার জন্য বিপুল কল্যাণের উৎস বানিয়েছি, কোরআনের ন্যায় শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত তাকে দিয়েছি, আল্লাহ ও রসূলের অনুগত এবং ইসলামের বাস্তবায়ন ও প্রচারকারী মুমিনদের একটা বিরাট দল তাকে দিয়েছি, আর আখিরাতে তার জন্য কাওসার নামক পুষ্করিণী উপহার দেয়ার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি। সেই পুষ্করিণী থেকে কেউ একবার পানি পান করার অনুমতি পেলে অনন্তকাল পর্যন্ত তার আর পিপাসা লাগবে না। তারপর আল্লাহ বলেছেন, হে নবী, আসলে নির্বংশ তো তোমার শত্রুরাই। তাদের প্রকৃতপক্ষে কোনই স্মরণকারী থাকবে না। তাদের কথা কেউ ভুলেও মনে করবে না যে অমুক কে ছিল। ইতিহাসে তাদের কোন স্থানই থাকবে না।
ব্যংগবিদ্রুপে মক্কার যে নরাধমরা সবচেয়ে অপ্রগামী ছিল, এখানে তাদের একটা তালিকা দেয়া বোধ হয় অপ্রাসংগিক হবে না। তারা ছিল বনু আসাদ গোত্রের আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব, বনু যুহরা গোত্রের আসওয়াদ বিন আব্দু ইয়াগুস, বনু মাখযূমের ওলীদ ইবনুল মুগীরা, বনু সাহমের আস বিন ওয়ায়েল এবং বনু খুযায়া গোত্রের হারিস বিন তালাতিলা।
কূটতর্ক
ব্যংগবিদ্রুপ, ঠাট্টা উপহাস, গালিগালাজ ও অশালীন উপাধি প্রদানের সাথে সাথে কূটতর্কের পালাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। যারা একটা চাক্ষুষ সত্যকে মানতে চায়নি, তারা নিজেদের ও দাওয়াতদাতার মাঝে নানা রকমের কূটতর্ক বাধিয়ে অন্তরায় সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাতো। এই অপচেষ্টার একটা ব্যর্থ হলে নব উদ্যমে আরেকটা শুরু করা হতো। এ ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত লোকদের গোটাজীবনই এতে নষ্ট হয়ে যায়, অথচ তারা না পারে নিজেদের কোন উপকার করতে, আর না পারে অন্যদের কোন গঠনমূলক সেবা করতে। আন্তরিকতার সাথে যে প্রশ্ন ও আপত্তি তোলা হয়, তার ধরন হয় এক, আর চক্রান্তমূলকভাবে দাওয়াতদাতার পথ আটকানোর জন্য যে প্রশ্ন ও আপত্তি তোলা হয় তার ধরন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই শেষোক্ত শ্রেণীর প্রশ্ন ও আপত্তি তোলাকে বলা হয় কূটতর্ক। কূটতর্ক সব সময় বেঈমানী, দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের প্রতীক হয়ে থাকে। কূটতার্কিকদের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা দাওয়াত থেকে কিছুই শিখতে চায় না, বরং তাতে কৃত্রিমভাবে কোন না কোন বক্রতা অন্বেষণ করে। কোরআনে এ অবস্থাটা বলা হয়েছেঃ “তারা বক্রতা অন্বেষণ করে।” (সূরা হুদঃ ১৯)
বাপদাদার ধর্মের এই সব উগ্র ও কট্টর সমর্থক একদিকে তো রসূল স. কে বারবার জিজ্ঞাসা করতো যে, তুমি যদি নবী হয়ে থাক তবে তোমার নবী হওয়ার এমন কোন অকাট্য আলামত ও প্রমাণ তোমার সাথে কেন থাকলো না যা দেখে কারো পক্ষে নবুয়ত স্বীকার না করে উপায়ই থাকবে না?
আবার কখনো কখনো তারা নিতান্ত সরলতার ভান করে বলতোঃ ‘আমাদের ওপর সরাসরি কোন নির্দশন নাযিল হলো না কেন, কিংবা এমন হলো না কেন যে, আমরা আমাদের মনিবকে সরাসরি দেখে নিতাম?’ (সূরা ফুরকান, আয়াত ৩১)
অর্থাৎ দীর্ঘ আলোচনা বা তর্কের কী দরকার? সোজাসুজিভাবে আকাশ থেকে দলে দলে ফেরেশতা নেমে এসে আমাদের সামনে বিচরণ করলেই পারতো। আর আল্লাহ তোমার মাধ্যমে আমাদের কাছে খবরাখবর পাঠিয়ে নিজের খোদায়ী চালু করার বদলে তিনি স্বয়ং আমাদের সামনে হাজির হলেই পারেন। আমরা দেখে নিতে পারি যে, এই তো আমাদের আল্লাহ। তাহলে তো আর ঝগড়া থাকে না।
তারা সময় সময় এও বলতো যে, তুমি যা যা বল, তা যদি সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে থাক, তাহলে তো একখানা লিখিত কিতাব আমাদের চোখের সামনেই আমাদের কাছে চলে আসলে ভালো হতো। বরঞ্চ তুমি নিজেই একটা সিঁড়ি দিয়ে আকাশ থেকে কিতাবখানা হাতে নিয়ে নেমে আসলে আরো ভালো হতো। আমরা তা হলে অবনত মস্তকে মেনে নিতাম যে, তুমি সত্যিই নবী। এ প্রশ্নও তোলা হয় যে, কোরআন এভাবে এক এক অংশ করে নাযিল হয় কেন? পুরো কিতাবখানা একবারেই নাযিল হয় না কেন? কিন্তু তাদের এ জাতীয় প্রতিটি প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব কোরআনে বারবার দেয়া হয়েছে। এই জবাব দেয়ার কারণেই তারা ক্ষুব্ধ ছিল। কেননা এতে করে তাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে যেত এবং তা ব্যর্থ হয়ে যেত।
তাদের আরো একটা কূটতর্ক ছিল এই যে, তুমি তো আমাদেরই মত রক্ত মাংসের তৈরী মানুষ। তোমারও ক্ষুধা লাগে, আয়রোজগার করতে বাধ্য হও, বাজারে যাও, কষ্টে জীবন যাপন কর, তোমার ওপর কত যুলুম হয়, অথচ তোমার কোন সাহায্য করা হয় না। এমতাবস্থায় একথা কিভাবে বিশ্বাস করি যে, তুমি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা এবং তোমাকে বিশ্ববাসীর সংস্কার ও সংশোধনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে? তুমি যদি এমন একজন বিশিষ্ট ও অসাধারণ লোক হতে, তাহলে তোমার আগে আগে একদল ফেরেশতা প্রহরী হিসাবে চলতো এবং পথ থেকে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য হাঁকাহাকি করতো। কেউ তোমার ওপর যুলুম তো দূরের কথা, সামান্য বেআদবী করলেই ঐ ফেরেশতারা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিত। এ রকম হলে সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিত যে, তুমি আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী। তোমার জন্য আকাশ থেকে ধনরত্ন নাযিল হওয়া উচিত ছিল। রাজকীয় শান শওকতে তোমার জীবন যাপন করা উচিত ছিল, তোমার বসবাসের জন্য একটা স্বর্ণনির্মিত প্রাসাদ হওয়া উচিত ছিল, তোমার জন্য বিশেষভাবে একটা খাল তৈরী হওয়া উচিত ছিল, তোমার একটা বড় রকমের ফলের বাগান থাকা উচিত ছিল, এবং সেই বাগান থেকে তোমার সচ্ছন্দে জীবন যাপনের উপযুক্ত অর্থ উপার্জিত হওয়া দরকার ছিল। এ ধরনের শান শওকত ও জাঁকজমক নিয়ে যদি তুমি নবুয়তের দাবী করতে, তাহলে আমরা তা অবশ্যই মেনে নিতাম। অথচ আমরা ধনে, জনে, তোমার চেয়ে কত বড়। আর তুমি ও তোমার সাথীরা সমাজের সবচেয়ে গরীব ও নিম্ন শ্রেণীর লোক। আমাদের তুলনায় তোমাদের কোনই শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তাহলে হে মুহাম্মাদ, তুমিই বল, কোন্ যুক্তিতে আমরা তোমাকে নবী মেনে নেব?
এ জন্য যখনই রসূল সা. কোন রাস্তা দিয়ে যেতেন, অমনি লোকজন বলে উঠতো, ‘ইনি নাকি সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ রসূল সা. করে পাঠিয়েছেন? আংগুল নাচিয়ে নাচিয়ে, ইংগিত করে করে মক্কার গুন্ডাপান্ডা ও সন্ত্রাসী লোকেরা বলতো, ‘দেখ, আল্লাহ নবী ও রসূল বানানোর জন্য এই চালচুলোহীন লোক ছাড়া আর কাউকে পেলেন না। কী চমৎকার নির্বাচন! অনুরূপভাবে ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের দেখিয়ে বলা হতো, এই নাকি সেই সব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যাদেরকে আল্লাহ আমাদের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে বাছাই করেছেন।
এ কথাও বলা হতো, যে আযাবের ভয় দেখিয়ে তুমি নেতা হতে চাইছ, তা নিযে আস না কেন? আমাদের মত কাফেরদের ওপর তুমি আকাশের একাংশ ভেংগে ফেলতো দেখি! খোদ আল্লাহর কাছেও দোয়া করতো যে, এই দাওয়াত সত্য হলে হে আল্লাহ আমাদেরকে আযাব দিয়ে খতম করে দাও।’
বাপদাদার ধর্মের এই একচেটিয়া অধিকারের দাবীদাররা কখনো কখনো এ কথাও বলতো যে, ‘হে মুহাম্মদ! তুমি যখন বল, আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তখন তিনি নিজের শক্তি প্রয়োগ করে আমাদেরকে ইসলামের পথে চালান না কেন? তিনি যদি আমাদেরকে তাওহীদপন্থী ও সৎ লোক দেখতে চান, তাহলে তিনি আমাদের তাওহীদপন্থী ও সৎ লোক বানিয়ে দেন না কেন? তিনি তো আমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে বাধা দিতে পারেন। তিনি আমাদেরকে ভুল আকীদা পোষণ করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেন। তা যখন তিনি করেন না, তখন নিশ্চয়ই আমাদের বর্তমান চালচলন তাঁর পসন্দ। এমতাবস্থায় তুমি কেন আমাদের চালচলন ও রীতিনীতির নিন্দা সমালোচনা কর? তুমি কোথাকার কে?
তারা কেয়ামত নিয়েও উপহাস করতো। খুব নাটকীয় ভংগিতে জিজ্ঞেস করতো, এই ঘটনাটা কবে ঘটবে বলুন তো। কেয়ামতের কোন দিন তারিখ কি নির্ধারিত নেই?
কোরআন, হাদীস ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলী থেকে এই উদাহরণগুলো সংগৃহীত। এগুলো দ্বারা অনুমান করা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনুগ্রাহক এবং মানবতার সবচেয়ে বড় হিতাকাংখী মানুষটিকে কেমন হীন পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অত্যন্ত নিকৃষ্ট রুচির অধিকারী লোকেরা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে নিন্দা ও কুৎসা গেয়ে চলেছে। বিতর্কের সুরে নানা ধরণের প্রশ্ন বানিয়ে বানিয়ে তুলে ধরছে। আর রসূল সা. অত্যন্ত ঠান্ডা ও শান্তমনে এবং অত্যন্ত ভদ্র ও শালীন মেজাজে নিজের দাওয়াতের পক্ষে যুক্তি পেশ করছেন। জবাবে কোন নিন্দা ও তিরস্কার করছেন না। বিতর্কের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। রেগে যাচ্ছেন না। কিন্তু দাওয়াত ও তার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটছেন না।
ব্যংগবিদ্রুপ ও কুটতর্কের এই তান্ডবের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হবার সময় রসূল সা.যে মানসিক নির্যাতন ও কষ্ট ভোগ করেছেন, তার পুরো প্রতিচ্ছবি কোরআনে পাওয়া যায়।
আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং রসূল সা. কে প্রবোধ ও সান্তনা দিয়েছেন এবং এই স্তরটা ধৈর্যের সাথে পেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেনঃ ‘ক্ষমার নীতি অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অজ্ঞ লোকদের এড়িয়ে চল।’ (সূরা আরাফ-১৯৯)
অর্থাৎ সেই যুলুম নির্যাতনের যুগে রসূল সা. কে তিনটে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়ঃ অপপ্রচার ও গালমন্দের তোয়াক্কা না করা, সর্বাবস্থায় হক কথা বলতে থাকা এবং দুশ্চরিত্র ও মুর্খ লোকদের পেছনে না পড়া।
কোরআন ও ইতিহাস উভয়ই সাক্ষ্য দেয় যে, রসূল সা. যুলুম নির্যাতনের সমগ্র যুগটা ঐ তিনটে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পার করে দিয়েছেন। চরম মর্মযাতনা ভোগ করা সত্ত্বেও নিজের ভাষায়ও কোন পরিবর্তন ঘটতে দেননি, দাওয়াতদাতা হিসেবে নিজের উন্নত চরিত্রের পার্থক্য সৃষ্টি হতে দেননি, এবং যুক্তির প্রখরতাকেও কিছুমাত্র ম্লান হতে দেননি।
আল্লাহ তাঁর পবিত্র আত্মা ও তাঁর সঙ্গীদের ওপর রহমত ও বরকত নাযিল করুন। এমনকি ঐ কুটতার্কিকরা যখনই কিছু ধারালো যুক্তি উপস্থাপন করেছে, অমনি ওহীর নির্দেশে তাকেও সর্বতোভাবে খন্ড করেছেন, তা সে যতই নিম্নস্তরের হোক না কেন।
যুক্তি
ব্যংগ বিদ্রুপ, কুৎসা রটনা ও কুটতর্কে কখনো কখনো কোরায়েশ নেতারা দু’একটা ধারালো যুক্তিও উপস্থাপন করেছে, তবে তার সংখ্যা খুবই কম। এর কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাচ্ছেঃ
এ ধরণের একটা যুক্তি তারা মাঝে মাঝে এভাবে পেশ করতো যে, আমরা তো দেবমূর্তিগুলোকে আল্লাহর চেয়ে বড় কখনো মনে করিনা। আমরা শুধু বলি, এই মূর্তিগুলো যেসব মহান ব্যক্তির আত্মার প্রতীক, তারা আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করতে পারে। এসব মূর্তির সামনে সিজদা করে ও বলি দিয়ে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি।
তারা আরো বলতো, আমাদের মতে দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন এ ছাড়া আর কোন জীবন আমাদের হবেনা এবং আমাদের মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিতও হতে হবেনা। সুতরাং আমরা এমন একটা ধর্মকে কিভাবে মেনে নেব, যা অন্য একটা জগতের ধারণা দিয়ে আমাদেরকে এ দুনিয়ার জীবনের স্বার্থ ও সুখশান্তি থেকে বঞ্ছিত করতে চায়?
তারা এ যুক্তিও দিত যে, আমরা যদি মুহাম্মদের সা. দাওয়াত মেনে নেই, বর্তমান ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হতে দেই এবং এর ওপর আমাদের প্রধান্যকে খর্ব হতে দেই, তাহলে দেশ থেকে আমাদের উৎখাত হয়ে যেতে হবে।
এই দু’তিনটে উদাহরণ থেকে বুঝা গেল যে, কূটতর্ক ও ধড়িবাজির মাঝে তারা কিছু কিছু যুক্তিও দিত। তবে কোরআন সে সব যুক্তির দাঁতাভাঙ্গা জবাবও দিত।
সন্ত্রাস ও গুন্ডামী
ব্যংগ বিদ্রুপ, গালিগালাজ ও অপপ্রচারাভিযানের সাথে সাথে কোরায়েশদের উন্মত্ত বিরোধিতা ক্রমশ গুন্ডামী, সন্ত্রাস ও সহিংসতার রূপ নিত। নেতিবাচক ষড়যন্ত্রের হোতারা যখন তাদের ব্যংগ বিদ্রুপ ও কুৎসা রটনাকে ব্যর্থ হতে দেখে, তখন গুন্ডামী ও সন্ত্রাসই হয়ে থাকে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। মক্কাবাসী রসূল সা. কে উত্যক্ত করার জন্য এমন হীন আচরণ করেছে যে, তিনি ছাড়া আর কোন প্রচারক হলে সে যতই সাহসী ও উদ্যমী হোক না কেন, তার উৎসাহ উদ্দীপনা নষ্ট হয়ে যেত এবং হতাশ হয়ে বসে পড়তো। কিন্তু রসূল সা. এর ভদ্রতা ও গাম্ভীর্য সকল সহিংসতা ও গুন্ডামীকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল।
যে আচরণটা একেবারেই নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল, সেটা হলো, তাঁর মহল্লার অধিবাসী বড় বড় মোড়ল ও গোত্রপতি তাঁর পথে নিয়মিতভাবে কাঁটা বিছাতো, তাঁর নামায পড়ার সময় ঠাট্টা ও হৈ চৈ করতো, সিজদার সময় তাঁর পিঠের ওপর জবাই করা পশুর নাড়িভূড়ি নিক্ষেপ করতো, চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিত, মহল্লার বালক বালিকাদেরকে হাতে তালি দেয়া ও হৈ হল্লা করে বেড়ানোর জন্য লেলিয়ে দিত এবং কোরআন পড়ার সময় তাঁকে, কোরআনকে এবং আল্লাহকে গালি দিত।
এ অপকর্মে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিল আবু লাহাব ও তার স্ত্রী। এ মহিলা এক নাগাড়ে কয়েক বছর পর্যন্ত তাঁর পথে ময়লা আবর্জনা ও কাঁটা ফেলতো। রসূল সা. প্রতিদিন অতি কষ্টে পথ পরিষ্কার করতেন। এই হতভাগী তাঁকে এত উত্যক্ত করেছিল যে, তাঁর সান্ত্বনার জন্য আল্লাহ তায়ালা আলাদাভাবে সূরা লাহাব নাযিল করেন এবং তাকে ঐ দুর্বত্ত দম্পতির ঠিকানা যে দোজখে, তা জানিয়ে দেন।
একবার পবিত্র ক’বার চত্বরে রসূল সা. নামায পড়ছিলেন। এ সময়ে উকবা ইবনে আবু মুয়ীত রসূলের গলায় চাদর পেঁচিয়ে এমনভাবে ফাঁস দেয় যে, তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যান। এই দুর্বৃত্তই একবার নামাযের সময় তাঁর পিঠের ওপর নাড়িভূড়ি নিক্ষেপ করেছিল।
একবার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক দুরাচার তাঁর মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে। তিনি ঐ অবস্থাতেই নীরবে বাড়ী চলে যান। শিশু ফাতেমা রা. তাঁর মাথা ধুয়ে দেয়ার সময় দুঃখে ও ক্ষোভে কাঁদতে থাকেন। তিনি শিশু মেয়েকে এই বলে সান্ত্বনা দেন, মাগো, তুমি কেঁদনা। আল্লাহ তোমার আব্বুকে রক্ষা করবেন।
আর একবার যখন তিনি হারাম শরীফে নামায পড়ছিলেন, তখন আবু জাহল ও অপর কয়েকজন কোরায়েশ সরদার তা লক্ষ্য করলো। তখন আবু জাহলের নির্দেশে উকবা ইবনে আবু মুয়ীত গিয়ে নাড়িভূড়ি নিয়ে এল এবং রসূল সা. এর গায়ে নিক্ষেপ করে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সেদিনও শিশু মেয়ে ফাতেদমা তাঁর গা ধুয়ে পরিস্কার করে দেন এবং উকবাকে অভিশাপ দেন।
‘এক আল্লাহর আনুগত্য কর, সততা ও ইনসাফের অনুসারী হও এবং এতীম ও পথিককে সাহায্য কর’, এই সদুপদেশের প্রতিরোধ এভাবে নেয়া হয়েছিল যে, কাঁটা বিছিয়ে ইসলামী আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হলো। ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করে তাওহীদ ও সদাচারের পবিত্র দাওয়াতকে সমুলে উৎখাতে অপচেষ্টা চালানো হলো। রসূল সা. এর পিঠে নাড়িভূড়ির বোঝা চাপিয়ে ধারণা করা হলো যে, এখন আর সত্য মাথা তুলতে পারবেনা। রসূলের সা. গলায় ফাঁস লাগিয়ে জ্ঞানপাপীরা ভেবেছিল এবার ওহীর আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। যাঁকে কাঁটা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো, তিনি সব সময় ফুল বর্ষণ করতে লাগলেন। যাঁর গায়ে ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করা হলো, তিনি জাতিকে ক্রমাগত আতর গোলাপ বিতরণ করতে লাগলেন। যার ঘাড়ে নাড়িভূড়ির বোঝা চাপানো হলো, তিনি মানবজাতির ঘাড়ের ওপর থেকে বাতিলের ভূত নামিয়ে গেলেন। যার গলায় ফাঁস দেয়া হলো, তিনি সভ্যতার গলা থেকে বাতিল রসম রেওয়াজের শেকল খুলে ফেললেন। গুন্ডামী এক মুহূর্তের জন্যও ভদ্রতার পথ আটকাতে পারেনি। ভদ্রতা ও শালীনতার পতাকাবাহীরা যদি যথার্থই কৃত সংকল্প হয়, তবে মানবেতিহাসের শাশ্বত নিয়মের পরিপন্থী সন্ত্রাস ও গুন্ডামীকে এভাবেই চরম শাস্তি দিয়ে চিরতরে নির্মূল করতে হবে।