অধ্যায়ঃ ৫
মানবতার বন্ধুর সামরিক তৎপরতাঃ নীতি-কৌশল ঘটনাবলী-শিক্ষা
ইসলামী আন্দোলন সিনাই উপত্যকা থেকেই আবির্ভূত হোক, কিংবা ফারানের ঘাঁটি থেকে, তার পথ সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়েই অতিক্রান্ত হয়ে থাকে।
ইসলামের বিপ্লবী আন্দোলন যুক্তির বলে মানুষের হৃদয় জয় করছিল, গোত্রীয় উচ্ছৃংখলতার বিপরীত একটা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলছিল, অসংগঠিত মানবগোষ্ঠীগুলোকে সংঘবদ্ধ করছিল, এবং নৈরাজ্যবাদী ও আইন মেনে চলতে নারাজ একটি সমাজের স্থলে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাষ্ট্র তৈরি করছিল। ইসলামী আন্দোলন মানুষের সুপ্ত জ্ঞানগত শক্তির ভেতরে নতুন করে প্রেরণার সঞ্চার করছিল।
জাহেলিয়াতের অন্ধকারে জ্ঞানের মশাল জ্বালাচ্ছিল, আল্লাহভক্তির হারানো প্রাণশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করছিল এবং নৈতিক মূল্যবোধের নিভে যাওয়া প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করছিল। প্রাচীন জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত বিশ্বকে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষিত নিষ্পেষিত শ্রেণীসমূহকে সামাজিক ন্যায়বিচারের বেহেশতী পথ দেখাচ্ছিল, আর তার কোলে বেড়ে উঠছিল মানবতার উৎকৃষ্টতম নমুনা।
এর বিপরীত দিকে অবস্থান করছিল সেই জাহেলিয়াত, যার কাছে কোন প্রেরণাদায়ক আদর্শ ছিলনা, যা নৈরাজ্য ও বিশৃংখলাকে সংরক্ষণ করে যাচ্ছিল, যা স্বার্থপরতার ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনা করছিল, যা ধর্মকে হাস্যকর করে তুলেছিল এবং তার ভিত্তিতে পবিত্র ব্যবসা চলছিল। সমাজে যেটুকু প্রাচীন নৈতিক মূল্যবোধ অবশিষ্ট ছিল, তাও এই জাহেলিয়াতের হাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। মোটকথা, সে স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ইনসাফ ও উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। নিজের এই দুর্বলতার কারণেই সে পিছপা হতে হতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। তার যুক্তিপ্রমাণ তখন নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার হিংস্রতার হাতিয়ার ভোতা হয়ে গেছে। তার ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে এবং তার লোকেরা নিকৃষ্টতম মানুষে পরিণত হচ্ছে।
জাহেলিয়াতের প্রধান হোতারা নিজেদের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ সা.ও তাঁর সাথীদেরকে মক্কা থেকে বের করে দিয়ে একটা মারাত্মক আঘাত হেনেছিল বটে। তবে অনতিবিলম্বেই তারা বুঝতে পেরেছিল, আকাবার বায়য়াত দ্বারা রসূল সা.আনসারদের যে সহযোগিতা পেয়ে গিয়েছিলেন তার অর্থ এই যে, এখন মদিনা ইসলামী আন্দোলনের একটা মজবুত ঘাঁটিতে পরিণত হবে, সেখানে একটা সরকার গঠিত হবে এবং ইসলামী সমাজ এমন এক শক্তিতে পরিণত হবে, যার পথ রোধ করা আর কখনো সম্ভব হবেনা।
তাছাড়া মদিনা পৌঁছে যখন রসূল সা.মদিনার ইহুদী ও অন্যান্য গোত্রের সাথে রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করলেন, তখন কোরায়েশদের জন্য বিপদাশংকা আরো বেড়ে গেল। এর অব্যবহিত পরই রসূল সা.প্রতিরক্ষা শক্তি সংগঠিত করা শুরু করেন। সেই সাথে মদিনা রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা এবং সন্নিহিত এলাকাগুলোতে শত্রুর গতিবিধি তদারক করার জন্য টহলদারী হিসেবে সেনাদল প্রেরণ করতেও আরম্ভ করেন। এতে কোরায়েশদের চোখে ভেসে উঠলো আরো বহু ভীতিপ্রদ আশংকা। তাদের সিরিয়ামুখী বানিজ্যপথ মদিনার নিকট দিয়েই প্রবাহিত। ফলে সমগ্র বাণিজ্য ব্যবস্থাটাই অচল হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিল। বরঞ্চ সা’দ ইবনে মুয়াযকে যখন আবু জাহল ওমরা করতে বাধা দিল, তখন তিনি পরিষ্কার হুমকি দিলেন যে, এমন করলে তোমাদের বানিজ্যের পথ বন্ধ করে দেয়া হবে। রসূল ও তাঁর সাথীরা ইতিপূর্বে কোরায়েশদের জালে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি তাদের কবল থেকে মুক্ত। আগে শুধু দাওয়াত দিতেন। এখন তিনি ক্ষমতার গদিতেও আসীন। আগে মজলুম ছিলেন এবং প্রত্যেক জুলুম নীরবে সহ্য করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখন তিনি জুলুমের প্রতিকার ও প্রতিরোধ করার যোগ্য হয়ে গেছেন। বস্তুত ইসলামের দাওয়াতের বিরোধিতার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে কোরায়েশরা যে পর্যায়ে পৌছেছিল, তার পরবর্তী ধাপ যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া আর কিছু হতে পারতোনা। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ওপর নিষ্ঠুরতম নির্যাতন চালানো ও রসূল সা.এর হত্যার পরিকল্পনা করার পর তাদের ভেতরে অনিবার্যভাবে একটা খুনী ও রক্তপিপাসু মানসিকতা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। এদিকে রসূল সা.নতুন যুগ সৃষ্টির মানসে মদিনায় যে সামান্য পুঁজি সঞ্চিত করেছিলেন, তা যদি লুন্ঠিত হয়ে যায়, তবে তার অর্থ হবে এ যাবত যেটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা সব পন্ড হয়ে যাওয়া এবং ইসলামী রাষ্ট্রের ফলে ফুলে সুশোভিত হওয়ার আশা পুরোপুরি নস্যাৎ হয়ে যাওয়া। এই রাষ্ট্রের বিকাশ ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সময়ের গতির প্রতি লক্ষ্য রাখা খুবই জরুরী ছিল। প্রত্যেক বিপদাশংকাকে যদি সঠিক সময় অনুভব করা না হয় এবং সময়মত তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না করা হয়, তবে কোন নেতৃত্বের এর চেয়ে বড় অযোগ্যতা ও অক্ষমতা কল্পনা করা যায়না। অনুরূপভাবে এটাও জরুরী যে, যে পদক্ষেপের জন্য যেটা সর্বোত্তম সময়, এবং সর্বোত্তম সময়ের মধ্যেও যেটা সর্বপ্রথম সময়, পদক্ষেপটা সেই সময়েই নেয়া উচিত। নচেত বিদ্যুত গতিতে প্রবহমান সময় কখনো কারো পথ চেয়ে থাকেনা। প্রত্যেক দাওয়াত ও আন্দোলনের শুধু নিজের দিকে তাকালেই চলেনা, বরং নিজেকে প্রতিপক্ষের শক্তির সাথে তুলনা করে দেখতে হয় যে, কে কখন কতখানি আগে বা পিছে চলছে। বিশ্বমানবের পরম সুহৃদ মহানবী সা.ও তাঁর বিচক্ষন সাথীরা ভালোভাবেই জানতেন, হিজরতের পরে এখন সামনে জেহাদই অবধারিত পরবর্তী ধাপ। তারা বুঝেছিল যে, বাঁচতে হলে এখন কোরায়েশদের সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। তাই মোহাজেরদের পুনর্বাসন ও মদিনার নতুন শক্তির ভারসাম্য বহাল হওয়ার অব্যবহিত পরই রসূল সা.একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে সর্বোতভাবে মনোযোগ দিলেন।
যুদ্ধ ও জেহাদের ইসলামী দৃষ্টিভংগি
এখানে আমি একটা মৌল তত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা করা জরুরী মনে করছি। মৌল তত্ত্বটা এইযে, যে কোন রাষ্ট্রের অপরাধ দমনের জন্য পুলিশ ও আদালতের ব্যবস্থা যেমন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তেমনি জেহাদও তার একটা স্বাভাবিক কাজ। কিন্তু একটা নবীন রাষ্ট্র, একটা সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজ এবং স্বতন্ত্র যুগ সৃষ্টিকারী একটা সরকারের জন্য একটা কঠোর জেহাদী যুগ অতিবাহিত করা শুধু স্বাভাবিক নয় বরং অনিবার্যও বটে। বিশেষত যখন কোন নতুন সমাজ ব্যবস্থা কোন বিপ্লবী মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তখন প্রাচীন বিপ্লব বিরোধী শক্তিগুলো যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে রূখে আসবে, তা অবধারিত। এ ধরণের বিপ্লব বৈরী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে শুধু প্রতিরক্ষাই যথেষ্ট হয়না, বরং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া ছাড়া কোন বিপ্লবের পক্ষে নিজের বর্তমান সীমানা ও মান বজায় রাখা সম্ভব নয়। কাজেই ইসলামের জেহাদ তত্ত্ব নিছক আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নয় যে কেবল কেউ আক্রমণ চালালেই বাধ্য হয়ে তার মুখোমুখী হতে হয়। বরঞ্চ ইসলাম এই নির্দেশও দেয় যে, ইসলামী বিপ্লবের আহবায়কগণ একদিকে তাদের রাষ্ট্রের প্রতিটি ইঞ্চি জমি, তার যাবতীয় সহায় সম্পদ এবং নাগরিকদের প্রাণ ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের জান ও মালের সর্বাত্মক কুরবানী দিতে প্রস্তুত থাকবে। অপরদিকে আল্লাহর কোটি কোটি বান্দাকে জুলুম শোষণ, অজ্ঞতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও নৈতিক অধোপতন থেকে উদ্ধার করার মাধ্যমে বিপ্লবের পূর্ণতা সাধনের জন্য বিপ্লব বিরোধী শক্তিগুলোকে উৎখাত করবে। কোন বিপ্লবী আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পক্ষে এ কাজ না করে গত্যন্তর থাকেনা। [প্রসংগত এখানে এ কথা বলা খুবই জরুরী মনে হচ্ছে যে, সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক কাজ যে কোন পর্যায়েই করা হোক না কেন, তার জন্য কোন না কোন ভাবে শক্তি প্রয়োগ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মা বাপ যেমন ছেলেমেয়েদের কল্যাণের জন্য এবং সরকার যেমন দেশবাসীর ভালাইর জন্য যুক্তি, সদুপদেশ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শক্তিও প্রয়োগ করে থাকে, তেমনি গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক বিপ্লবের পতাকাবাহীরাও কিছু না কিছু শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়ে থাকে। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, আরবের জাহেলী যুগে গোত্রীয় শাসন ব্যবস্থার যে কাঠামো ও পদ্ধতিই চালু থাকনা কেন, এবং জনগণ তার আওতায় যে অবস্থায়ই কাটাক না কেন, তা পাল্টাবার অন্যদের কী অধিকার ছিল? সংস্কার ও গঠনমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে কোন বিপ্লব সংগঠিত করা, অতপর তার পূর্ণতা সাধন এবং এ ব্যপারে শক্তি প্রয়োগ করাকে আদৌ বৈধ কাজ বলে মেনে নেয়া যায় কি? এই প্রশ্নকে যদি কিছুমাত্র আমল দেয়া হয়, তাহলে কোন পিতা বা মাতাকে কিসের ভিত্তিতে এ অধিকার দেয়া যাবে যে, তারা তাদের সন্তানদের মগজে কোন বিশেষ ধারণা ঢুকাতে পারবে, কোন বিশেষ ধরনের আদব আখলাক, চালচলন ও রীতিনীতি তাকে জোর করে শেখাবে, কোন বিশেষ নৈতিক চেতনা তার ওপর জোরপূর্বক প্রয়োগ করবে? কিভাবেই বা কোন সরকারকে নাগরিকদের কোন কোন কাজে বাধা দান ও কোন কোন কাজ করতে বাধ্য করার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকার দেয়া হবে? কোন্ অধিকারে সে অজ্ঞতা, দুস্কম, অপরিচ্ছন্নতা ও চারিত্রিক অসততার বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক কৌশল প্রয়োগ করবে এবং যে শক্তি এই কৌশল প্রয়োগে বাধা দেবে, তাদের বাধা অপসারণ করবে? সংস্কার ও গঠনমূলক কাজ করতে কোন বাধা আসবেনা এবং সেই বাধা দুর করতে শক্তি প্রয়োগ করার দরকার হবেনা- এটা কোন ক্ষেত্রেই কল্পনা করা যায়না। আপনি যদি বাধা দানকারী শক্তিগুলোকে অবাধ সুযোগ দিয়ে দেন, তাহলে কোন সংস্কারমূলক বা গঠনমূলক কাজ করাই সম্ভব হবে না। সংস্কার ও গঠনমূলক প্রতিটি কাজের পক্ষে খোদ মানুষের স্বভাবপ্রকৃতি সর্বশক্তি নিয়ে বর্তমান থাকে। একটি দেশ বা জাতিকে পতিত দশা থেকে উদ্ধার পূর্বক কল্যাণের পথে চালিত করার জন্য যখন কোন গঠনমূলক বিপ্লব সংঘঠিত হয়, তখন মানুষের স্বভাব প্রকৃতি তথা সহজাত মনোবৃত্তি, সদিচ্ছা ও বিবেক তার পক্ষে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করে। এই সাক্ষ্যপ্রমাণই ঐ বিপ্লবের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। তখন যে প্রশ্নটার জবাব আবশ্যক তা এই যে, মানুষের স্বভাব প্রকৃতির দাবী যেহেতু অস্পষ্ট, সেহেতু কোন বিপ্লব গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক, না বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসাত্মক, সেটা যাচাই বাছাই করার অকাট্য পন্থা কী? এর জবাব এইযে, এই অকাট্য পন্থাটা হলো, মহানবীর (সা) দেয়া আদর্শ আল্লাহর বিধান। মানুষের অসংখ্য গালভরা বুলির মধ্যে কোনটি কল্যাণকর ও কোনটি অকল্যাণকর, তা পরখ করার হলো, নির্ভুল পথ হলো ওহির প্রদর্শিত পথ। আরব জাতিকে নৈরাজ্য থেকে সুসংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পর্যায়ে নিয়ে আসা, গোত্রে গোত্রে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা একক জাতি সত্তায় রূপান্তরিত করা, লক্ষ লক্ষ মানুষকে জ্ঞান ও সচ্চরিত্রের অলংকারে সজ্জিত করা এবং তাদেরকে শক্তি, নিরাপত্তা ও ইনসাফের একটা নবযুগ উপহার দেয়া এমন একটা মহান ও পবিত্র কাজ যে, এর জন্য যদি শক্তি প্রয়োগ বৈধ না হয়, তাহলে মানবেতিহাসে শক্তি প্রয়োগের আর কোন ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ স্থান আর অবশিষ্ট থাকেনা।] আল্লাহর যদি তাওফীক দেন তবে এ বিষয়টি আমরা বিশদভাবে আলোচনা করবো পুস্তকের সেই খন্ডে, যাতে রসূল সা.এর যুগের সামরিক অভিযানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার ইচ্ছা রয়েছে।
এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে অত্যন্ত কুটিল মানসিকতা নিয়ে একটা বিভ্রান্তির বিতর্ক তোলা হয়েছে। আর এর কারণে আত্ম বিস্মৃত মুসলমানদের পাশ্চাত্যমনা অংশটিও নিদারুণ ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়েছে। আপত্তিকারীরা সামরিক অভিযানগুলোর এরূপ অর্থ করেছে যে একটা ধর্ম বলপ্রয়োগে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য সামরিক আক্রমণগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এটা নিছক একটা ধর্মের ব্যাপার ছিলনা। এটা ছিল সর্বাত্মক বিপ্লবী আন্দোলন। এ বিপ্লব জান ও মালের বহু মূল্যবান কোরবানীর বিনিময়ে মানবতার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছিল এবং স্বার্থপর বিপ্লব বিরোধীরা এ বিপ্লবকে পূর্ণ সফলতার মুখ দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। এখানে লক্ষ্য ছিল একটা রাষ্ট্র গড়া। এই রাষ্ট্রের পত্তন করার জন্য এর নির্মাতারা তেরো বছর যাবত চরম নির্যাতন সহ্য করেছে, অতঃপর ঘরবাড়ী জায়গা জমি সব ত্যাগ করে এসেছে এবং একেবারেই সর্বহারা হয়ে নিজেদের এমন একটি ক্ষুদ্র ভূখন্ডে সীমিত করে নিয়েছে, যেখানে তারা নিজেদের পছন্দসই জীবনপদ্ধতি অনুসারে জীবন যাপন করতে পারবে এবং সারা দুনিয়ার মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ দেখাতে পারবে।
মহা সমারোহে ইতিহাসের এই নয়া সোনালী অধ্যায়টা উদ্বোধন করার আয়োজন চলছিল।কিন্তু মদিনার ইহুদী, মোনাফেক, মক্কার কোরায়েশ, তাদের তাবেদার গোত্রগুলো, এবং বাইরের কতিপয় বড় বড় শাসক-সবাই মিলে এই আয়োজনকে অংকুরে বিনষ্ট করতে চাইছিল। তারা মুসলমান বিপ্লবীদেরকে এই সুযোগই দিতে চাইছিল না যে, এই বিপ্লবকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিক। এ কথা সত্য যে ইসলাম ধর্ম ইসলামী আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল (অবশ্য ধর্মের যে বিকৃত অর্থ আজকাল প্রচলিত, তা থেকে ভিন্ন অর্থে) কিন্তু এর সাথে আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ মিলিত হয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এ জন্যই দেখা যায়, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মের সীমিত পরিসরে অমুসলমানদেরকে পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সে ধর্মকে চাপিয়ে দেয়ার জন্য তরবারী ধারণ করেনি, বরং আন্দোলন, সামগ্রিক জীবন বিধান ও ইসলামী রাষ্ট্রের স্বার্থে তরবারী ধারণ করেছিল। তার আসল সমস্যা ছিল নিজের পবিত্র রাজনৈতিক কাঠামোর স্থায়িত্ব ও সুস্থ বিকাশ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, কেননা তাতেই সমগ্র আরব জাতি ও সমগ্র মানব জাতির কল্যাণ নিহিত ছিল। মুসলমানদের সর্বব্যাপী সংগ্রাম সংঘাতের পরিমন্ডল ছিল রাজনৈতিক। সততা ও খোদাভীরুতার নৈতিক ভিত্তির ওপর রাজনীতি করার এক নতুন চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করতে শুরু করেছিল। আর এই মহৎ কাজটাকেই পন্ড করে দিতে চেয়েছিল কোরায়েশ, ইহুদী ও বেদুইন গোত্রগুলো। এ পরিস্থিতিতে এই নিরর্থক বিষয়টা আলোচনায় আসেই বা কিভাবে যে, রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা ধর্ম প্রচারের জন্য তরবারী ব্যবহার করেছিলেন কিনা? এ প্রশ্নই বা ওঠে কিভাবে যে, রসূল সা. এর সামরিক অভিযানগুলো আত্মরক্ষামূলক ছিল, না আক্রমণাত্মক? তথাপি আমাদের স্পর্শকাতর মুসলমানরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে রাজী হয়ে গেছে। পশ্চিমাদের অন্যায় ও অর্থহীন যুক্তিকে মেনে নিয়ে তারা ভেবেছে, এতে নিজেদের ইতিহাসের পাতা থেকে তথাকথিত কিছু কলংকের দাগ মুছে ফেলা যাবে। সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তারা প্রাচ্যবিদদের দরবারে করজোড় ওযর ব্যক্ত করতে আরম্ভ করেছে। তারা ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও সীমিত ধারণা অন্তরের অভ্যন্তরে বদ্ধমূল করে নিয়েছে এবং জেহাদ তত্ত্বকেও বিকৃত করে ফেলেছে। তাদের পশ্চিমা গুরুদের অবস্থা এইযে, তাদের ধর্মীয় নেতারা নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এবং তাদের রাজারা নিছক রাজ্য বিস্তারের জন্য যে জঘন্য যুদ্ধগুলো করেছে, তা তাদের কবিতায় ও সাহিত্যে আজও গৌরবের বিষয় বিবেচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন স্বাধীন দেশকে গোলাম বানানোর জন্য যে অন্যায় পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে, তাকে তারা সব সময় গর্বের বিষয় বলে মনে করে। তাদের নৌ দস্যুতার অপরাধ যদি উপনিবেশ গড়ার কাজে সহায়ক হয়, তাহলে তাকে তারা হিরো বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র যদি চতুর্মুখী হুমকিতে পরিবেষ্টিত হয়ে নিজের নতুন শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সংরক্ষণ করা, কয়েকটা ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরোধ করা এবং ঐক্য, শৃংখলা, শান্তি, নিরাপত্তা, সুবিচার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ন্যায় দুর্লভ সম্পদে সজ্জিত হবার জন্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তাহলেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগনামা তৈরী করা ও অপরাধ প্রমাণ করার জন্য পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ মানের প্রতিভাধারীরা নিরলস পরিশ্রম করে যেতে থাকে। এই সব দাবীদার ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের আদালতে মামলা চালানোর সময় এখন ঘনিয়ে এসেছে। তাদের ধাপ্পাবাজী ও জালিয়াতির মুখোস উন্মোচনের জন্য চার্জশীট তৈরী করার সময় এখন সমাগত। আমাদের এই জাতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য ইতিহাস ও সীরাত শাস্ত্রের যুবক ছাত্রদেরকে এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
ইসলামে জেহাদ তত্ত্ব আদৌ প্রচলিত প্রতিরক্ষার ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরী হয়নি। তবে তা এই অর্থে প্রতিরক্ষামূলক যে, তার উদ্দেশ্য ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সমাজের সংরক্ষণ, যে আদর্শের ভিত্তির ওপর ইসলামী বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, সেই আদর্শকে সংরক্ষণ করাই তার উদ্দেশ্য। এমন যে কোন কার্যকর নাশকতাবাদী শক্তির প্রতিরোধ তার লক্ষ্য, যা ইসলামী বিপ্লবের অর্জিত সাফল্যকে ধ্বংস করতে চায় এবং তার পূর্ণতা অর্জনের পথে অন্তরায়, এবং এমন যে কোন অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থাকে সমূলে উৎখাত করা তার উদ্দেশ্য, যা সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতি এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
কোরআনের সমর দর্শন
এখানে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই। তবে কোরআনের কয়েকটি অতীব জরুরী অংশের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজনঃ
“যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়, তাদেরকে অস্ত্র ধারণের অনুমতি দেয়া হলো। কেননা তারা যুলুমের শিকার। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শুধু এই কারণে বাড়ীঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, “আল্লাহই আমাদের একমাত্র প্রভু।” আল্লাহ যদি (এভাবে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে) কিছু লোককে (যারা বিকৃত ও বিপথগামিতার হোতা) অন্য কিছু লোকের দ্বারা (যারা গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কাজের পতাকাবাহী) ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করতেন, তাহলে (অপশক্তির দাপট বেড়ে যাওয়ার কারণে) সংসার বিরাগীদের আশ্রম, খৃস্টানদের গীর্জা, ইহুদীদের এবাদতখানা ও মুসলমানদের মসজিদ, যাতে আল্লাহর নাম খুব বেশী উচ্চারিত হয়ে থাকে, ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহ শুধু তাদেরকেই সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর কাজে সহযোগিতা করে। নিশ্চয়ই (তাদেরকে সাহয্য করতে) আল্লাহ সর্বতোভাবে ক্ষমতাবান ও বিজয়ী। তারা এমন লোক, আমি তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন করলে তারা (আত্মপূজা ও ধ্বংসাত্মক কাজের পরিবর্তে) নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, সৎকাজের আদেশ দেবে, খারাপ কাজ প্রতিহত করবে এবং সকল বিষয়ের চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।”(হজ্জঃ ৩৯, ৪০, ৪১)
“আল্লাহর পথে (তাঁর ন্যায়সংগত বিধানের বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের জন্য) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তবে বাড়াবাড়ি করোনা। [এখানে বিস্তারিত তাফসীর আলোচনা করার অবকাশ নেই। তবে ততটুকু আভাস দেয়া জরুরী যে, বাড়াবাড়ী করতে নিষেধ করার অর্থ হলো, অশান্তিকামী ও নৈরাজ্যবাদীদেরকে দমন করতে গিয়ে শান্তিকামীদের ওপরও যেন শক্তি প্রয়োগ না করা হয়। দ্বিতীয়ত, সামরিক তৎপরতা একান্ত প্রয়োজনের সীমার বাইরে না চালানো উচিত। তৃতীয়ত, যুদ্ধের সময় ইসলামের নৈতিক বিধিবিধান ও যুদ্ধ আইন মেনে চলা উচিত]।
যারা বাড়াবাড়ি করে, তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন না। শত্রুদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর এবং যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করেছিল, সেখান থেকে তোমরাও তাদেরকে বের কর। কেননা ফেতনা (সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় প্রতিরোধ ও বাধা দান) হত্যার চেয়েও খারাপ। মসজিদুল হারামের চত্তরে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করোনা। তবে তারা যখন (মসজিদুল হারামের মর্যাদা রক্ষা না করে) তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তখন তোমরাও যুদ্ধ কর। তারপর যদি তারা সত্যিই (হারাম শরীফের সীমানার ভেতরে) তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরাও (কোন দ্বিধা সংকোচ না করে) তাদের সাথে যুদ্ধ কর। এ সব কাফেরকে (ইসলামী বিপ্লবের শত্রুদেরকে) এভাবেই উপযুক্ত শাস্তি দেয়া যায়। এরপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে আল্লাহ তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু আছেনই। (অন্যথায়) তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ইসলামী বিধান কায়েম করার পথ থেকে সকল বাধা অপসারিত না হয়ে যায় এবং সমগ্র জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর বিধানের অনুসারী না হয়ে যায়। এরপর যদি তারা বাধা দেয়া থেকে বিরত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না। তবে অত্যাচারীদের কথা স্বতন্ত্র।’’ (সূরা বাকারাঃ ১৯০-১৯৩)
‘‘তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে, এবং বিশেষ করে ঐসব অসহায় নরনারী ও শিশুকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করনা, যারা দোয়া করে যে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এই জনপদ থেকে উদ্ধার কর, যার অধিবাসীরা অত্যাচারী। আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে কাউকে রক্ষক বানিয়ে পাঠাও এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে সাহায্যকারী বানিয়ে পাঠাও।’’ (সূরা নিসাঃ ৭৫)
‘‘এরপর যদি তারা চুক্তি করে তা ভংগ করে এবং তোমাদের ধর্মের ওপর টিটকারী দেয়, (এবং এভাবে প্রমাণ করে দেয় যে তারা ষড়যন্ত্র করতে বদ্ধপরিকর) তাহলে তোমরা ঐ সব ইসলাম বিরোধী শক্তির নেতাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও। তাদের দৃষ্টিতে তাদের চুক্তি ও অংগীকারের কোন মূল্য নেই। হয়তো তারা বিরত হবে। যারা তাদের চুক্তি লংঘন করে, রসূলকে (মদীনা থেকে) বের করে দেয়ার চক্রান্ত আঁটে, এবং তোমাদের ওপর সর্বপ্রথম আক্রমণ চালায়, তাদের সাথে কি তোমরা লড়বেনা? (সূরা তওবাঃ ১২)
‘‘তোমরা যদি (জেহাদের জন্য) বের না হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন। এবং তোমাদের স্থলে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসাবেন, তার কোন ক্ষতিই তোমরা করতে পারবেনা। আল্লাহ সব কিছুই করতে সক্ষম।’’ (সূরা তওবাঃ ৩৯)
ইসলামের জেহাদ তত্ত্ব ও রসূল সা. এর অনুসৃত সমর নীতি সম্পর্কে কোরআনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার যোগ্য আয়াত রয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলোর মধ্য থেকে কেবলমাত্র সেই আয়াতগুলোরই উদ্ধৃতি দিয়েছি, যা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং যা থেকে শুধু মৌলিক তত্ত্বই পাওয়া যায়। এ আয়াতগুলোতে যে ক’টি বিষয় বুঝানো হয়েছে, তা নিম্নরূপঃ
১. সামগ্রিকভঅবে মুসলমানরা বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন ভোগ করে আসছিল এবং রসূল সা. ও তাঁর সাহাবীদেরকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করে সামষ্টিক যুলুমের সর্বশেষ আঘাত হানা হয়েছিল। প্রতিপক্ষ শুরু থেকেই নিপীড়নমূলক আচরণ করে আসছিল। কেননা মুসলিম সমাজকে তারা তিষ্টাতেই দিচ্ছিলনা। সত্যনিষ্ট লোকেরা আল্লাহকে প্রভূ ও প্রতিপালক মেনে নিয়ে তার নির্দেশের অধীন জীবন গড়ে তুলুক- সে সুযোগই তারা দিতে চাইছিলনা। তারা আকীদা বিশ্বাস ও মতামত পোষণ, স্বাধীন চিন্তাধারা প্রকাশ, সত্যের দিকে মানুষকে ডাকা এবং সংগঠন গড়ার স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করে নিয়েছিল। এক নাগাড়ে কয়েকটি বছর ধরে তারা নিরীহ, ভদ্র শান্তিপ্রিয় ও ধৈর্যশীল বিপ্লবী মুসলমানদের ওপর বর্বরোচিত হিংস্র আঘাত হেনে হেনে আপন জন্মভূমিতে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
২. ইসলাম তার বিরোধীদেরকে বক্তব্য অনুধাবন ও আপন আচরণে পরিবর্তন আনার সর্বাধিক সুযোগ দিয়ে থাকে এবং এই সুযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই সে তার অনুসারীদেরকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এক সুদীর্ঘ যুগ অতিবাহিত করায়। কিন্তু তার এই ধৈর্যশীল অনুসারীরা চিরদিন কেবল মযলুম ও নির্যাতিতই হতে থাকবে এবং অত্যাচারীদের দর্প ও অহংকার বৃদ্ধি করতে থাকবে, এটা সে কখনো বরদাশত করতে পারেনা। মানব সমাজে কিছু সংখ্যক হিংস্র নরপশুকে লালন পালন করার জন্য সস্তা শিকার যোগাড় করে দেয়া ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। সে ধৈর্যশীলদেরকে গড়ে তোলেই এ জন্য যে, তারা যুলুমবাজদেরকে উচ্ছেদ করে মানব জাতির জন্য মু্ক্তির পথ উন্মোচিত করুক।
৩. নির্যাতন নিপীড়ন ও যুলুম শোষণকারী ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলোর মূলোৎপাটন সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় কাজ। কেননা এই নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলোকে যদি বলপ্রয়োগে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ না করা হয় এবং তারা স্থায়ীভাবে কাজ করার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায়- তাহলে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, শান্তিপ্রিয়তা ও আল্লাহ প্রীতিমূলক সমস্ত মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য।
৪. ইসলামের বৈপ্লবিক মতাদর্শ প্রয়োজনের সময় অস্ত্রের শক্তির প্রয়োগ করে সেই সব লোকের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চায়, যারা বিশৃংখলা, অজ্ঞতা, দুষ্কর্ম-দুর্নীতি ও অন্যায় অত্যাচারের পৃষ্ঠপোষক। অতঃপর এমন লোকদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে চায়, যারা আল্লাহর আনুগত্য, নামায ও যাকাত ব্যবস্থা কায়েম করবে, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার বিস্তার ও বিকাশ ঘটাবে এবং অন্যায় ও অসত্যের প্রতিরোধ করবে।
৫. ‘‘যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তাদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর’’- এ কথার অর্থ এটা নয় যে, শত্রুরা তোমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দেয়ার পরই আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ কর। এখানে যে বিষয়টির দিকে ইংগিত দেয়া হয়েছে তা হলো, ইসলামের শত্রুদের মধ্যে যারা বিরোধিতায় ও প্রতিরোধে সক্রিয় নয়, তাদের পেছনে তৎপর হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যারা তোমাদের কাজে প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি করে এবং আক্রমণ চালিয়ে তোমাদেরকে ও তোমাদের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর তারা কখন কার্যত হামলা চালাবে, সেই মুহূর্তটির অপেক্ষায় বসে থাকা জরুরী নয়। বরঞ্চ তাদেরকে যেখানেই বাগে পাওয়া যায়।, সেখানেই খতম করা যেতে পারে। এর সপক্ষে সুস্পষ্ট ও অকাট্য যুক্তিও দেয়া হয়েছে যে, খুনখারাবি মূলতঃ কোন ভাল কাজ নয়। তবে ইসলামী আন্দোলন, সংগঠন, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানো, গোলযোগ ও হাঙ্গামা এবং অবরোধ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা বহু গুণ বড় অন্যায় কাজ। ইসলামের শত্রুদেরকে এ কাজ চালিয়ে যেতে দেয়া হলে তারা ইসলামেরই মূলোৎপাটন করে ছাড়বে। এজন্য বৃহত্তর অন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সশস্ত্র জেহাদের উদ্যোগ ও সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য। সত্য ও ন্যায়ের পথে প্রতিরোধ ও অবরোধ সৃষ্টিকারীদেরকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল না করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ দ্বীন চালু না হওয়া পর্যন্ত এই সশস্ত্র সংগ্রাম সর্বশক্তি নিয়োগ করে চালিয়ে যেতে হবে।
৬. একদিকে যদিও ধর্মীয় পবিত্র স্থান, সময় ও রীতিনীতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে ধর্মভীরুতার এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেও মুসলমানদেরকে রক্ষা করা হয়েছে যে, শত্রুরা যদি এই সব পবিত্র জিনিসের সম্মান ও মর্যাদা পদদলিত করে মুসলমানদেরকে যবাই করতে থাকে, তবুও তারা টু শব্দটিও করবেনা এবং নিষিদ্ধ ও পবিত্র স্থান ও মাসের সম্মান রক্ষা করা বাধ্যবাধকতাকে গুরুত্ব দিয়ে অকাতরে বিনা প্রতিরোধে যবাই হতে থাকবে। বলা হয়েছে, তারা যদি কোন স্থান ও সময়ের মর্যাদাহানি করে আক্রমণ চালায় তবে সেই আক্রমণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে।
৭.মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব শুধু নিজেদের জানমাল সম্ভ্রম রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং অন্য কোন এলাকায়ও যদি দূর্বল ও অসহায় লোকেরা নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে থাকে এবং তারা অত্যাচারীদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকে, তবে তাদের ফরিয়াদে সাড়া দেয়া ইসলামী সরকারের কর্তব্য। অর্থাৎ ইসলামী শক্তিকে গোটা মানব জাতির মুক্তিদাতা ও ত্রাণকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ধর্ম ও সভ্যতার উত্তম মূল্যবোধগুলোকে সংরক্ষণ করা তার ব্যাপকতর ও আসল কর্তব্য।
৮. যুলুম অন্যায় দূর করার জন্য চুক্তি করাও একটা শান্তিপূর্ণ উপায়। রসূল সা. এই উপায়টাও সর্বতোভাবে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভংগকারীদের সম্পর্কে কোরআন কঠোর নির্দেশ দিয়েছে যে, শক্তি প্রয়োগ করে তাদেরকে শায়েস্তা করতে হবে। বিশেষতঃ যারা প্রতিশ্রুতি ভংগ করে ইসলামী কেন্দ্রকে ধ্বংস করা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা বা প্রশাসনকে উৎখাত করা ও বিরাজমান শৃংখলাকে ধ্বংস করে অরাজকতা সৃষ্টির চক্রান্ত করে এবং প্রথম উস্কানী দেয়, তারা যদি খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা নাও করে থাকে, তথাপি তাদের এ জাতীয় প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে এক একটা যুদ্ধ ঘোষণা মনে করতে হবে এবং তাকে বিনা প্রতিরোধে চলতে দেয়া যাবেনা।
৯. এ প্রসংগে মুসলিম সরকারকে যে বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে সেটি হলো, সামরিক তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য নিরীহ ও নিরস্ত্র জনসাধারণকে হতাহত করা নয়, বরং ইসলামী বিপ্লবের বিরোধী ও কুফরী শক্তির মূল হোতাদেরকে খতম করা।
১০. জেহাদের ফরয আদায়ে শৈথিল্য ও উদাসীনতার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, জেহাদে উদাসীন হলে তোমাদের এই রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতা- সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমরা যদি সাহস করে এগিয়ে না যাও, তবে বিরোধীরা তোমাদের ওপর চড়াও হবে, এবং তোমাদেরকে হটিয়ে ও পদদলিত করে নিজেদের শাসন চালু করে ফেলবে। তখন তোমরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে এবং টু শব্দটিও করতে পারবে না। এ ধরণের পরিস্থিতিতে তোমাদের কেমন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে ভেবে দেখ।
ইসলামী যুদ্ধ-বিগ্রহের ধরণ
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইসলামী জেহাদ তত্ত্বকে ভালো করে বুঝে নেয়া ছাড়া ইসলামী বিপ্লবের সংগঠকদের ও ইসলামী বিপ্লবের শত্রুদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের ধরণ ও প্রকৃতি বুঝা সম্ভব নয়। যে মূল কথাটা বুঝা দরকার তা হলো, আরবের দুটো ঐতিহাসিক শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। একটা শক্তি বাতিল ও অত্যাচারমূলক জাহেলী শাসন ত্রাসন থেকে জনগণভকে মুক্তি দিয়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নব যুগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। আর অপর শক্তিটি গতানুগতিক জাহেলী সমাজ ব্যবস্থাকে যেমন আছে তেমনভাবেই বহাল রাখার নিমিত্তে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল। উভয়ের আদর্শে ও উদ্দেশ্যে কোন ধরণের স্থায়ী সমঝোতা বা আপোষ যেমন সম্ভব ছিলনা, তেমনি লেনদেন করেও দুইপক্ষের মধ্যে কোন সহাবস্থানের অবকাশ ছিল না। অবস্থাটা ছিল এ রকম যে, ‘‘হয় তোমরা থাকবে, না হয় আমরা থাকবো।’’ অথবা, সুপরিচিত ইংরেজী প্রবাদ অনুসারে এভাবেও বলা যেতে পারে যে, ‘‘তুমি আগে ওকে মেরে ফেল, নচেত ও তোমাকে মেরে ফেলবে।’’ ব্যাপারটা অনেকাংশে এ রকম ছিল যে, একজন কর্মঠ কৃষক অনেক পরিশ্রম করে একটা পতিত জমিতে আবাদ করে তাতে ফলের বাগান বানালো। ঐ এলাকার পাশেই ছিল অরণ্য। সেখান থেকে বুনো পশুরা এসে বাগান নষ্ট করে ফেলতে প্রবল ছিল। এমতাবস্থায় সে যদি বুনো পশুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে তার বাগান উজাড় হবে। আর যদি বাগানকে রক্ষা করতে চায়, তবে বুনো পশুদের প্রতি তাকে নিষ্ঠুর হতেই হবে। ইতিহাসে যখনই কোন সর্বাত্মক বিপ্লব ঘটেছে, তখনই এ ধরণের আপোষহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিয়ে ইসলামী যুদ্ধগুলো আত্মরক্ষামূলক ছিল কি ছিল না, সেই বিতর্কে যাওয়ার আর প্রায়োজন হয় না। মুসলমানরা তলোয়ার প্রয়োগ করে মানুষকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে- এই কাণ্ডজ্ঞানহীন অপপ্রচারের পথও বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এরও প্রয়োজন থাকে না যে, এক একটা লড়াই নিয়ে আলাদা আলাদা পর্যালোচনা চালিয়ে তার তাৎক্ষণিক কারণগুলো চিহ্নিত হবে এবং জেনেশুনে অপপ্রচারে লিপ্ত লোকদেরকে আশ্বাস দেয়া হবে যে, ইসলামী সরকারকে এ যুদ্ধটা অনন্যোপায় হয়ে লড়তে হয়েছিল। এ মূল দায়িত্ব প্রতিপক্ষের ওপরই বর্তে।
আজ যখন আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের পূর্ববর্তী কিছু কিছু বিজ্ঞজন বিভিন্ন যুদ্ধের, বিশেষত বদর যুদ্ধের কারণ পর্যালোচনা ও পরিস্থিতির একটা বিশেষ চিত্র অংকন করার জন্য ব্যাপকভাবে মাথা খাটিয়েছেন, তখন ভেবে কুলকিনারা পাইনা যে, এত চুলচেরা বিশ্লেষণকারকেরা এমন সহজ সরল কথাটা কেন বুঝলেন না, যা একবার মাত্র বলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায় এবং আর কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার পড়েনা? নবী জীবনী নিয়ে লেখা তাদের মূল্যবান গ্রন্থাবলী পড়ে এরূপ ধারণা পাওয়া যায় যে, আসল কারণটা কী ছিল বা ছিলনা, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেয়ার অধিকার যেন পাশ্চাত্যবাসীর। আমরা যেন শুধু তাদের দরবারে আমাদের সাফাই পেশ করারই অধিকার রাখি, এর চেয়ে বেশী নয়।’ আমরা বিচার বিবেচনার এই রীতিটা পাল্টে ফেলতে চাই। আমাদের দ্বীন, আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের নবী জীবনী বুঝা ও বুঝানোর সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত ক্ষমতা আমাদের, অন্য কারো নয়। আমাদের দ্বীন ও আমাদের রসূল আমাদেরকে চিন্তাগবেষণা ও বিচার বিবেচনার যে মানদণ্ড ও মাপকাঠি দিয়েছেন, সেটাই আমাদের সব কিছু বুঝার সর্বোত্তম মাপকাঠি। আমরাই আমাদের অবস্থা যাচাই করার সবচেয়ে বেশী হকদার। পশ্চিম বা উত্তর দক্ষিণ- যে দিকেরই লোক হোক না কেন, আমাদেরকে আমাদের ধর্ম ও আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার তারা কেউ নয়। বরঞ্চ আমাদের কাছ থেকেই তাদের জেনে নেয়া উচিত আমাদের ধর্ম ও ইতিহাসের কোন্ জিনিসটার মর্ম কী? আমাদের অতীতের কীতিকলাপের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা এবং আমাদের পরিভাষার অর্থ বুঝানো আমাদেরই দায়িত্ব, অন্য কারো নয়। আমাদের ধর্ম, আমাদের ইতহিাস ও আমাদের নবীর জীবনেতিহাস যাচাই করার জন্য প্রাচীন খ্রীষ্টীয় গীর্জা অথবা আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতার তৈরী করা মানদণ্ড আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ঐ সব বাতিল মানদণ্ডে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে যাঁচাই করে দেখাতে আমরা প্রস্তুত নই।